বামনের চন্দ্রাভিযান
পর্ব * ১২
বিশ্বনাথ পাল
আঠেরো
আজ এসেছি আমার মাধ্যমিক পাশের স্কুলে। সঙ্গে এনেছি ভেরিফিকেশন রোলের কপি। সরকারি চাকরিতে পুলিশ ভেরিফিকেশন ও মেডিকেল সার্টিফিকেট জমা দেওয়ার পরই জয়েনিং হয়। কিন্তু আমার হাইকোর্টে চাকরির বেতন সরকারি তহবিল থেকে হলেও যেহেতু হাইকোর্ট সরাসরি সরকারের অধীনস্থ নয় এবং হাইকোর্টের দ্রুত কাজের লোক দরকার ছিল, তাই পুলিশ ভেরিফিকেশনের আগেই আমার নিয়োগ হয়েছে। ফলে এখন সেই ভেরিফিকেশন রোল পূরণ করে আমাকে জমা দিতে হবে। গত পরশু অ্যাকাউন্টস সেকশন থেকে আমাকে ডেকেছিল। সেখানে একজন ইউ ডি অ্যাসিট্যান্ট কুশলদা আমার হাতে একটা ফর্ম ধরিয়ে বলল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটা পূরণ করে আমাকে জমা দাও। তুমি যত তাড়াতাড়ি জমা দেবে আমরা তত তাড়াতাড়ি এটা পুলিশের কাছে পাঠাতে পারব।
ফর্মটা হাতে নিয়ে দেখি সেটা ভেরিফিকেশন রোল। সরকারি কাজে নিযুক্ত ব্যক্তির শিক্ষাগত যোগ্যতা ঠিকঠাক কিনা বা তার কোনও অপরাধের ইতিহাস আছে কিনা তা পুলিশ মারফৎ যাচাই করাই এর লক্ষ্য। কুশলদাকে বললাম, কতদিনের মধ্যে জমা দিতে হবে?
দাও না, যত তাড়াতাড়ি পারো।
আজ সেই ফর্ম নিয়েই এসেছি স্কুলে। অফিসে সি এল নিয়েছি। ফর্মের দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় আছে প্রাইমারি বাদে যে যে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষালাভ করেছি সেখানে ভর্তি ও পাশ করে বেরনোর তারিখ লেখার ঘর। আমার সাল মনে আছে। নির্দিষ্ট তারিখ মনে নেই। তাই স্কুলে এসেছি যদি স্কুলের রেজিস্টার দেখে ভর্তি ও পাশ করে বেরনোর তারিখ উদ্ধার হয়। হেড স্যার অমলকুমার কুণ্ডুর ঘরে বসে আছি। হেডস্যার বললেন, একটা অ্যাপ্লিকেশন জমা দিয়ে যান। দেখছি কী করা যায়।
শুনে আমার মাথায় হাত। বললাম, দেখুন না যদি আজকেই পাওয়া যায়।
হেডস্যার চুপ। মুখ দেখে মনে হল আমি কোনও অসঙ্গত আবদার করে ফেলেছি। তিনি এবার মুখ খুললেন, সঙ্গে সঙ্গে হয়? আপনার অফিসে গেলে সঙ্গে কাজ করে দেন?
যা বাবাঃ!কী বলব? আজ যদি কাজটা না হয় তবে আমাকে আরেক দিন অফিস ছুটি নিয়ে আসতে হবে। এই হেডস্যার নতুন। আমার পরিচিত নন। আমি স্কুল ছাড়ার পরে জয়েন করেছেন। অমলবাবুর মুখে এমন এক দৃঢ় অসম্মতির ভাব ফুটে উঠেছে যে আমার শত অনুরোধেও কাজ হবে বলে মনে হয় না। উঠব উঠব করছি এমন সময় ঘরে তড়িৎস্যারের প্রবেশ। আপনাদের হয়তো মনে আছে আমার মায়ের কথায় এই স্যার আমাকে বিনা বেতনে পড়িয়েছিলেন। স্যার জানতে চাইলেন, কী ব্যাপার?
স্যারকে সংক্ষেপে বললাম সব। হাইকোর্টে চাকরি পাওয়ার খবর স্যার জানতেন। কারণ জয়েন করার পর একদিন মিস্টি নিয়ে স্যারের সঙ্গে দেখা করে এসেছি। স্যার হেডস্যারকে উদ্দেশ্য করে বললেন, সোমনাথ আমাদের স্কুলের খুব ভাল ছাত্র ছিল। বলে হেডস্যারের কোনও অনুমতির তোয়াক্কা না করে আমাকে বললেন, তুই আমার সঙ্গে আয়।
স্যারকে অনুসরণ করলাম। স্যার আমাকে স্কুলের ক্লারিকাল স্টাফ নির্মল্বাবুর ঘরে নিয়ে গেলেন। বললন, নির্মলদা, সত্যজিতের কাজটা একটু করে দিন তো।
ব্যস! আমার কাজ হয়ে গেল।
এরপর বৈকুন্ঠপুর শিক্ষানিকেতনে গিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি ও পাশ করে বেরনোর তারিখ পেতে সমস্যা হল না। কারণ এই স্কুলে আমি আড়াই বছর শিক্ষকতা করেছি। কলেজ আর বিশ্ব বিদ্যালয়ে আর ছুটিনি। তারিখের বদলে মাস ও সাল লিখে দিলাম ফর্মে।
*
ভেরিফিকেশন রোল পূরণ করার পর একজন গেজেটেড অফিসারের শংসাপত্রের প্রয়োজন ছিল। ফর্মের দ্বিতীয় পাতার নীচে ছাপানো বয়ান পূরণ করে তলায় গেজেটেড অফিসারের স্বাক্ষরের স্থান। এটি না হওয়া পর্যন্ত জমা দিতে পারব না।
আমার মনে পড়ে গেল গোপাল মুখার্জীর কথা। ডেপুটি সেত্রেটারি পদে পি এস সি-তে কর্মরত গোপালবাবুর সঙ্গে আমার আলাপ বাপিদার মাধ্যমে। বাপিদা মাঝেমধ্যে গোপালবাবুর কাছে অ্যাটেস্টেড করাতে যেত। আমিও সঙ্গে যেতাম অ্যাটেস্টেড করাতে। সুচেতনা স্টাডি সেন্টার ছাড়ার পরেও কয়েকবার একাই গিয়েছি। যে সময়ের কথা বলছি তখনও অনলাইনে চাকরির আবেদন করার ব্যবস্থা চালু হয়নি। ফলে আমাদের ফর্ম তুলে তার সঙ্গে শিক্ষাগত যোগ্যতার সমস্ত সার্টিফিকেট বা মার্কশীটের কপি অ্যাটেস্টেড করে জমা দিতে হত।
হাইকোর্টের ইন্টারভিউ দেওয়ার পর সামনে যখন মিসসেলেনিয়াসের ইন্টারভিউ তখনও একদি এসেছিলাম এই গোপাল স্যারের বাড়ি। স্যার আমার ইন্টারভিউয়ের কথা শুনে বললেন, ইন্টারভিউতে কিন্তু জিজ্ঞেস করবে কী করো। তখন প্যারাটিচারি করার কথা বল্বে না। বলবে টিউশনি করি।প্যারাটিচারির থেকে টিউশনি করি বলা অনেক সম্মানের।
স্যারের এই পরামর্শ মেনে নিয়েছিলাম। ইন্টারভিউতে আমাকে বোর্ডের চেয়ারম্যান জিজ্ঞেস করেছিলেন, তা সোমনাথ , কী করো তুমি?
বললাম, আমি টিউশনি করি। মিথ্যে বলা হল না। কারণ প্যারাটিচারি করা ছাড়াও টিউশনি তো করতামই।
কিন্তু চেয়ারম্যান বললেন, না, পড়াশোনা ছাড়া আর কী করো? মানে তোমার সখ কী?
আমি কবিতা লিখি।
কবিতা লেখো। তা তোমার প্রিয় কবি কে?
বললাম, জীবনানন্দ দাশ আমার প্রিয় কবি। এছাড়া জীবিত কবিদের মধ্যে শঙ্খ ঘোষ, উৎপলকুমার বসু, জয় গোস্বামী, বিনয় মজুমদার।
বিনয় মজুমদার তো কিছুদিন আগে মারা গেলেন।
আচ্ছা রবীন্দ্রনাথের কবিতা ভাল লাগে না?
চেয়ারম্যান ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার একপ্রস্থ আলোচনাই হয়ে গেল কবিতা নিয়ে। ইন্টারভিঊয়ের ভীতি তখন কোথায় যে উড়ে গেল! হঠাৎ চেয়ারম্যানের মোবাইল বেজে উঠল। তিনি ফোনটা রিসিভ করে উঠে পায়চারি করতে করতে কথা বলতে থাকলেন আর ইশারায় বোর্ডের অন্য দুই সদস্যকে প্রশ্ন করতে বললেন।
আমি একটা মাসিক পত্রিকায় রাজ্য সিভিল সার্ভিসে সফল এক চাকরিপ্রার্থীর সাক্ষাৎকারে পড়েছিলাম ইন্টারভিউয়ের মাঝে বোর্ড মেম্বারের ফোন আসাটা নাকি পরিকল্পিত। এতে চাকরিপ্রার্থীর একাগ্রতা পরীক্ষা করা হয়।
যাইহোক, বোর্ডের বাকি দু’জনের একজন আমাকে পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে এবং অন্যজন ইকনমিক্স নিয়ে প্রশ্ন করলেন। সব না পারলেও মিনিট কুড়ির ইন্টারভিউ খারাপ হয়নি।
গোপাল স্যারকে সঙক্ষাপে বললাম আমার হাইকোর্টে চাকরি পাওয়ার বৃত্তান্ত। ওয়েটিং লিস্টের এক নম্বর থেকে চাকরির শিকে ছেঁড়ার কথা শুনে বললেন, তুমি লটারি কাটো। লাখে একটা ঘটে এরকম ঘটনা।
আমার ভেরিফিকেশন রোলে স্বাক্ষর করে দিলেন খুব খুশি মনে।
মাস দুই পরে একদিন অফিসে বসে কাজ করছি এমন সময় আমার মোবাইল বেজে উঠল। দেখি বাড়ির ফোন। মা বলল, রিজেন্ট পার্ক থানা থেকে একজন অফিসার এসেছে তোর কী ভেরিফিকেশনের ব্যাপারে। তোর সঙ্গে কথা বলতে চায়।
বললাম, ওনাকে কিছু চা-টা দিয়েছ তো?
বলেছিলাম, কিন্তু উনি খাবেন না।
আচ্ছা, দাও ফোনটা।
হ্যালো। আমি রিজেন্ট পার্ক থানার সাব ইন্সপেক্টর শুভময় ঘোষ বলছি।
বলুন স্যার।
আপনার ভেরিফিকেশন কপি আমাদের কাছে এসেছে। আপনি আপনার স্কুল কলেজের সমস্ত অরিজিনাল মার্কশীট ও সার্টিফিকেট নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করবেন। সঙ্গে আনবেন আপনার স্থায়ী বাসিন্দা, নাগরিকত্বের প্রমাণ। আমার মোবাইল নাম্বারটা লিখে নিন।
পরের শনিবার মাসের দ্বিতীয় শনিবার। অফিস নেই। মনে মনে ভাবছি যে আজ থানায় গিয়ে ডকুমেন্টগুলো ভেরিফাই করিয়ে আসব। ওমা মিনিট দুয়েক পড়েই দেখি স্ক্রিনে শুভময় ঘোষের নাম দেখিয়ে আমাম্র মোবাইল বেজে উঠল।
হ্যালো স্যার বলুন।
কোথায় আপনি এলেন না তো?
শুভময়বাবু এসেছিলেন গত সপ্তাহের শুক্রবার। পরদিন শনিবারও অফিস ছিল। এই কাজে অফিস ছুটি নিতে চাইনি। তাই দ্বিতীয় শনিবারের অপেক্ষায় ছিলাম। বললাম, এই তো স্যার আজই যাচ্ছি।
খানিক ক্ষণের মধ্যে সাইকেল নিয়ে কাগজপত্র একটা প্লাস্টিক প্যাকেটে গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
উনিশ
আমি শুনেছিলাম পুলিশ ঘুষ খায় এবং চাকরির ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে তো খায়ই। হয়তো ঘুষ নামে খায় না। বলে মিষ্টি খাওয়ার জন্য দিন। না দিলে ওরা ভেরিফিকেশন রোল মাসের পর মাস আটকে রাখে। সরকারি চাকরিপ্রার্থীর জয়েনিং-ও ঝুলে থাকে ভেরিফিকেশন রোলের অপেক্ষায়। এই কারণে বেচারা চাকরিপ্রার্থী হিসেব করে দেখে যে জয়েনিং এক মাস পিছনো মানে এক মাসের মায়না হাতছাড়া। তারচেয়ে মায়নার পাঁচ-দশ শতাংশ যদি পুলিশকে মিষ্টি খাওয়া বাবদ দিতে হয় দোষের কী! কিন্তু আমার ঘুষ দেওয়ার কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় এবং ঘুষ দেওয়া ও নেওয়া দুটোকেই অপরাধ(সমান কিনা জানি না) মনে করায় বেশ সমস্যায় পড়ে গেলাম। দুরু দুরু বক্ষে থানায় গিয়ে পৌঁছলাম। নিজের কাছে নিজের ভাবমূর্তি অনেকটা যুধিষ্ঠির গোছের। সততাই শ্রেষ্ঠ পথ। সেই পথ কি আজ আমায় ছাড়তে হবে? যদি আমার কাছে পুলিশ ঘুষ চায় কী বলব তখন? এইসব ভাবতে ভাবতে মাথায় এল ভেরিফিকেশন আটকে আমার অর্থক্ষতির কোনও আশঙ্কা নেই। কারণ আমি তো চাকরিতে নিযুক্ত হয়েই আছি। মায়নাও পাচ্ছি। হাইকোর্টের চাকরি। সরাসরি সরকার বাহাদুরের নয়। তবে ভেরিফিকেশনে যদি দেখা যায় আমি কোনও মিথ্যা তথ্য সরবারাহ করেছি তাহলে হয়তো চাকরি থেকে বরখাস্ত হতে হবে।
একজন কনস্টেবল আমাকে সাব ইন্সপেক্টর শুভময় ঘোষের ঘর দেখিয়ে দিলেন। তিরিশ-বত্রিশের ঝকঝকে শুভময় ঘোষকে দেখে বেশ সম্ভ্রম হয়। ফরসা সৌম্য চেহারা এবং পেটমোটা নয়। কাছে গিয়ে পরিচয় দিতেই বসতে বললেন।
একে একে আমার সমস্ত কাগজপত্র দেখালাম। এমনকী আমার ঠাকুরদার পাশপোর্টটা পর্যন্ত দেখালাম। এটা একটা পুরনো বাক্সে পেয়েছিলাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঠাকুরদা যখন পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসেছিল পাশপোর্ট করেই এসেছিল।
শুভময়বাবু যখন আমার কাগজপত্র খুঁটিয়ে দেখছেন আমার মনে আশঙ্কার মেঘ জমছে, এই বুঝি এক ভয়ানক ত্রুটি আবিষ্কার করে বললেন এত টাকা দিলে ত্রুটি দূর হবে।
শুভময়বাবু আমার কাগজপত্রে সন্তুষ্ট হলেন। আমি তাও বসে আছি, ভাবছি এবার হয়তো ‘মিস্টিমুখ’-এর কথা পাড়বেন। আর সেক্ষেত্রে আমি কী উত্তর দেব জানি না। এমন সময় উনি বললেন, যান, হয়ে গেছে।
আমি কাগজপত্র গুছিয়ে ফেরার পথ ধরলাম। এমন সময় ওসি সাহেব আমাকে ডাকলেন। তাঁর নাম মৃগাঙ্কবাবু। তিনি আমার সঙ্গে খানিক গল্প করলেন। আমি কবিতা লিখি শুনে খাতির করে চা খাওয়ালেন।
কার মুখ দেখে যে উঠেছি আজ। পুলিশকে মিস্টি খাওয়াতে হল না। বরং পুলিশই আমাকে চা খাওয়াল। আমার একটা ভুলও ভাঙল। সব মানুষ যেমন সমান নয়। সব পুলিশও সমান নয়। সবাই ঘুষখোর নয়। পুলিশবিভাগে শুভময়বাবুর মতো ভাল মানুষরাও আছেন।
আজ এত বছর পর সেইসব দিনের স্মৃতিচারণ করতে বসে সব যে ঠিকঠাক গুছিয়ে বলতে পারছি এমন দাবি করি না। মৌমিতা একদিন আমার অফিস দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করল। বললাম, বেশ তো একদিন ফোন করে চলে আয়।
এমনিতে মৌমিতার সঙ্গে আমার বন্ধুত্বকে আমার নিজের অত্যুৎসাহের ফল বলে মনে হত। এই সুযোগে তাও কিছু ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত তৈরি হবে।
সেইমতো একদিন সকালে মৌমিতার ফোন পেলাম, সোমনাথ শোন আজ তোর অফিস দেখতে যাব।
অন্য কেউ হলে হয়তো ভাবতাম আমি সত্যি সত্যি হাইকোর্টে চাকরি পেয়েছি কিনা সেই সন্দেহ মেটাতে আসছে। কিন্তু মৌমিতার ক্ষেত্রে তা মনে হল না। বরং এক হালকা খুশির রেশ আমাকে ছেয়ে থাকল। মেয়েটা একটু অন্য রকম। গড়পড়তা সাধারণ মেয়ের থেকে আলাদা বলেই আমার চোখে লেগেছিল।
কিন্তু একটা ব্যাপারে আমার মনে আশঙ্কা দেখা দিল। কোনও সমবয়সি সুন্দরি মেয়ে (যদিও বিবাহিতা)অফিসে এসে আমার সঙ্গে দেখা করবে এটাকে সহকর্মীরা কীভাবে নেবে। পিছনে লাগবে না তো?
কিন্তু সে সব হল না। মৌমিতা ফোনে আমার দিকনির্দেশ শুনে নিজেই হাইকোর্টের মেইন বিল্ডিঙের তিন তলায় উঠে এল একেবারে অ্যাপয়ন্টমেন্ট সেকশনের সামনে। কিন্তু ভিতরে ঢুকল না বা আমিও বললাম না। দরজার সামনে করিডোরে দাঁড়িয়ে আমি ওকে আমার টেবিল দেখালাম। সহকর্মীদের কেউ বোধহয় আমাদের খেয়ালও করল না।
মৌমিতা বলল, কম্পিউটার নেই?
আমার টেবিলে নেই। আমাদের সেকশনে মাত্র দুজনকে দিয়েছে। আমাকে হাতে লিখে নোটশীট করতে হয়। চিঠির ড্রাফট হাতে লিখে বাবুয়াদাকে দিই টাইপ করার জন্য। দিনে দুটোর বেশি চিঠি করতে দিলে বাবুয়াদা বিরক্ত হয়। আমাকে বলে, তুই তো একাই সবার চাকরি খেয়ে নিবি। বিকেলের দিকে বাবুয়াদার টাইপ মেসিন ফাঁকা পেলে আমি নিজেই টুকটুক করে কচ্ছপের গতিতে টাইপ করি।
শুনে মৃদু হেসে মৌমিতা বলল, ভালই লাগছে কাজটা কী বল?
এখন লাগছে। তবে আরও দিন গেলে হয়তো একঘেয়ে লাগতে পারে।
ওকে নিয়ে নীচে নেমে এলাম। হাইকোর্ট চত্বরে রকমারি খাবারের দোকান। কোথাও গরম গরম এগরোল-চাউমিন পরিবেশিত হচ্ছে, তো কোথাও আবার পাউরূটি ঘুগনি। আবার কোথাও বেশ বড় বড় সাইজের জিলাপি। সস্তায় বেশ মুখরোচক খাবার।মাঝেমধ্যেই টিফিনের সময় এইসব খাবারের স্বাদ গ্রহণ করি। বললাম, কী খাবি?
আমরা দুজন চাউমিন খেলাম।
খেতে খেতে ও বলল, চাকরি পাওয়ার খাওয়াটা এই খাইয়ে মেটালে হবে না কিন্তু।
বললাম, বেশ। তোকে একদিন রেস্টুরেন্টে নিয়ে খাওয়াব, অবশ্য আমার সঙ্গে যেতে যদি তোর আপত্তি না থাকে।
ও মাথা নেড়ে জানাল আপত্তি নেই।
এমনিতে কোনও বিবাহিত মেয়েকে এই প্রস্তাব দিতে হয়তো বাধো বাধো ঠেকত। কিন্তু ওর স্বামীর সঙ্গে অশান্তি চলছিল। বাপের বাড়িতেই থাকছিল সে সময়।
দাঁড়িয়ে খানিক কথাবার্তার পর বললাম, তুইও ডবলুবিসিএস পরীক্ষায় বসতে পারিস। বিডিও হলে অনেক টাকা স্যালারি।
কত টাকা?
এই ধর ষোলো হাজার।
সেই সময় বিডিওর বেসিক আট হাজার। এইচ আর এ এবং ডি এ নিয়ে ষোলো হাজার দাঁড়াত মায়না।
বলল, তেরো হাজার তো আমার এখনই রোজগার। এই অবধি বলে মৌমিতা থামতে পারত। কিন্তু থামল না। যোগ করল, আর দিলে ডবলুবিসিএস কেন, দেখি আইএএস-এ বসতে পারি।
এই হচ্ছে মৌমিতা। নিজের সম্বন্ধে অত্যধিক উচ্চধারণা, উৎকট রকমের আত্মবিশ্বাস। ও জানে না সরকারি চাকরি পাওয়া কত কঠিন। আইএএস-এ যারা বসে তারা ডবলুবিসিএস-কেও হেলাফেলা ভাবে না। তবু মেয়েটা আমাকে কী করে যে বশ করে রেখেছে!
মৌমিতাকে খানিকটা এগিয়ে দিয়ে আমি অফিসে ফিরে এলাম।
হাইকোর্টে যোগ দেওয়ার তিন মাসের মধ্যেই আরেকটা ভাল খবর পেলাম। সেই সময়টা স্মার্ট ফোনের নয়। ইন্টারনেট সংযোগহীন সাধারণ ফোন ব্যবহার করতাম। ফলে মেল চেক করতে বা পিএসসি-র ওয়েবসাইট দেখতে সাইবার কাফেতে যেতাম। দশ-কুড়ি টাকা দিলে পরে সাইবার কাফের কম্পিউটার একটি ঘণ্টার জন্য ব্যবহারের ছাড়পত্র মিলত। তো এভাবেই একদিন সাইবার কাফেতে পিএসসি-র ওয়েবসাইট খুলে দেখি মিসসেলেনিয়াস রিক্রুটমেন্ট সার্ভিসেসের রেজাল্ট বেরিয়েছে। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। হাইকোর্ট এবং মিসসেলেনিয়াসের চাকরির ইন্টারভিউয়ের খবর একই মাসে জেনেছিলাম। গত ডিসেম্বরে। দীপুদার কথামতো মিসসেলেনিয়েসের জন্য একটা ইন্সটিটিউটেও ভর্তি হয়েছিলাম একহাজার টাকার বিনিময়ে। সেখানে দাশগুপ্ত স্যারের অধীনে সপ্তাহে একদিন করে দু’মাস তালিম নিলাম ইন্টারভিউতে কীভাবে নিজেকে উপস্থাপিত করতে হয়, মাথা ঠান্ডা রেখে কীভাবে প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় সেই বিষয়ে। প্রথমদিন দাশগুপ্ত স্যারের ক্লাসে পৌঁছতে দেরি হয়ে গিয়েছিল।রাস্তায় জ্যাম ছিল। ক্লাস শুরু গিয়েছিল। দরজা ভেজানো একটি ঘরে চলছিল ক্লাস। আমি দরজাটা আলতো ফাঁক করে বলেছিলাম, আসব স্যার?
স্যার খেঁকিয়ে উঠেছিলেন, না। ক’টা বাজে? যারা সময় মেনে চলে না তাদের কিস্যু হবে না জীবনে।
অপমানে আমার মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল। আরও চাকরি প্রার্থীরা আমার দিকে হাঁ করে দেখছিল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হল, দরকার নেই এই স্যারের ক্লাস করে। বাড়ি ফিরে যাই। এক হাজার টাকা জলে যায় যাক। নিজে যা পারি তা-ই ইন্টারভিউতে বলব।
তবে বেশিক্ষণ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে হল না। একটু পরেই স্যার বললেন, যাও, এরকম দেরি যেন আর না হয়।
আজ যেন সেই অপমান হজমেরও প্রতিদান পাওয়া গেল। সারা পশ্চিমবঙ্গের পরীক্ষার্থীদের মধ্যে পরীক্ষা হয়েছিল। অন্তত একলাখ তো বসেছিল বলে মনে হয় প্রিলিমিনারিতে। সেই বাধা টপকালে মেইন। তারপর ইন্টারভিউ বা পার্সোনালিটি টেস্ট। এই শেষ ধাপে শুনেছি শুন্যপদের তিনগুণ পরীক্ষার্থীকে ডাকা হয়। তালিকায় আমার নাম শোভা পাচ্ছে একুশ নম্বরে। যতদূর জানি এই সাজানোটা র্যাঙ্ক অনুসারে। তারমানে লক্ষ পরীক্ষার্থীর মধ্যে আমার স্থান একুশ! অথচ এই ছেলেই কিনা ফেল করার ভয়ে এমএসসিতে ড্রপ দিয়েছিল! কে বলে জীবন গল্পের চেয়ে কম রোমাঞ্চকর?
এটা আমার প্রথম স্থায়ী চাকরি নয়, দ্বিতীয়। কারণ হাইকোর্টে আমার স্থায়ী চাকরির প্রথম স্বাদগ্রহণ। তবু কী এক অনির্বচনীয় আনন্দের স্রোত যেন বয়ে গেল সারা শরীর মন জুড়ে। পরক্ষণেই আফশোস হতে লাগল। ইস! এই খবরটা যদি বাবা জেনে যেতে পারত। ভগবান যদি বাবার মৃত্যুটাকে আর একটা বছর পিছিয়ে দিত। বাবার বিশ্বাস ছিল আমি একেবারেই চাকরির পড়াশোনা করতাম না। লোকজনের কাছে বলে বেড়াত, ও পড়ে নাকি? ওই রাত্রে একটু খবরের কাগজ নাড়েচাড়ে।
বাবার হয়তো ধারণা ছিল না যে খবরের কাগজও চাকরির পরীক্ষার অন্যতম স্টাডি ম্যাটিরিয়াল। সাম্প্রতিক ঘটনাবলী একটি সিলেবাসের বিষয়। কিন্তু আমি খবরের কাগজ ছাড়াও টুকটাক বইও পড়তাম। পড়ার পাশাপাশি ভাবতামও। বাড়ির প্রায় সবাই শুয়ে পড়লে রাত ১১ টা থেকে ১ টা পর্যন্ত পড়তাম। সবদিন হয়তো হত না। কিন্তু এই রুটিন মেনে চলার চেষ্টা করতাম। আজ সেই চেষ্টার ফল লাভ করলাম।
শুধুমাত্র একটা ব্যাপারেই আমি বাবার গর্বের কারণ হতে পেরেছিলাম জীবনে। ইউনিভার্সিটিতে যখন পড়তাম, সপ্তাহে একদিন করে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী ক্লাস নিতে আসতেন আমাদের। সাম্মানিক ক্লাস। বাবাকে সে খবর জানাতে বাবা গর্বে সারা পাড়ায় বলে বেড়াত, ও অর্থমন্ত্রীর কাছে পড়ে। আসলে বাবা খুব সরল ছিল। অর্থমন্ত্রী বেশ পরিচিত মুখ। টিভিতে প্রায়ই দেখা যেত খবরে। সেই অর্থমন্ত্রীর ছাত্র হওয়া যে গর্বের বাবার মুখে শুনে শুনে আমারও বিশ্বাস জন্মেছিল।
তো যাইহোক সারা পশ্চিমবঙ্গব্যাপী অনুষ্ঠিত একটি গ্রাজুয়েট লেভেলের চাকরির পরীক্ষায় একুশতম স্থান অধিকার নিশ্চয়ই কম যোগ্যতার নয়। হতে পারে এটা রাজ্য সিভিল সার্ভিস নয়। গ্রুপ এ চাকরি নয়। কিন্তু অফিসার অবশ্যই। রাজ্য সরকারের গ্রুপ বি অফিসার।
বাড়ি ফিরে সবার আগে মাকে খবরটা দিলাম। মা বলল, আমারও মন বলছিল তোর আরও চাকরির খবর আসবে।
এই কথা আমাকেও অনেকে বলেছে। চাকরি পাচ্ছি না যখন, বেকারত্বের জ্বালায় জ্বলছি, তখন কৌশিক একদিন বলেছিল, দেখবি একবার একটা চাকরি লেগে গেলে পর পর আরও লাগতে থাকবে। রেকর্ড তাই বলছে। যারা চাকরি পায়, তাদের বেশির ভাগই অনেক গুলো চাকরি পায়।
এর কারণ হিসেবে ও বলেছিল, আসলে পড়াশোনার মানটাকে একটা নির্দিষ্ট উচ্চতায় নিয়ে গেলে একাধিক চাকরির পরীক্ষায় সাফল্য আসে। সিলেবাস তো প্রায় কাছাকাছিই থাকে।
মাকে বললাম, কই আমাকে বলোনি তো?
তোর দিদিকে বলেছি। তাছাড়া আমাকে একজন হাত দেখে অনেক আগে বলেছিল, এখন আপনার স্বামীর আন্ডার সংসার আছে তো, যখন ছেলের আন্ডারে যাবে তখন দেখবে্ন সংসারের উন্নতি হবে।
মায়ের এই কথায় সায় দেওয়া মানে বাবার অনুপস্থিতিকে মঙ্গলজনক মনে করা। মানে বাবা যেন ছিল অপয়া নাম্বার ওয়ান। আজ বাবা নেই তাই নিয়তি আমাদের উন্নতির রাস্তায় নিয়ে যাচ্ছে।
মনে মনে আবার ভগবানকে বললাম, ঠাকুর, আর একটা বছর বাবাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলে না? লোকটা সংসারের মেঘ বয়ে বেড়াল সারা জীবন। রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিন কেমন জানলই না। কখনও কোথাও বেড়াতে যেতে পারল না। পুরী তো দূরের কথা দিঘার সমুদ্রও দেখা হল না মানুষটার। মনোজগতে শুধু ভাতকাপড়ের চিন্তা ছাড়া আর কোনও সৌন্দর্যের ভাগ পেল না তোমার সৃষ্টির।
*********************************************
আগামী পর্বে
********************************************


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন