কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে
পর্ব * ১৯
দীপংকর রায়
তার একটা বর্ণনা দিলো এরকমই — ঐ যে দেখছো পাহাড়গুলি.…সূর্যকে মনে হচ্ছে না কতো কাছে, কিন্তু তাতো না, উনি কোথা থেকে আমাদের দেখছেন তাতো আমরা জানতে পারছি না, তবে ঐ যে পাহাড়গুলি, সেখানে পৌঁছাতে কিন্তু আমাদের কম সময় লাগবে না, অন্তত ধরে রাখো ঘন্টা দুয়েক মতো তো লাগবেই। তার মানে ধরে রাখো একটু বাদে রওনা দিলে তাও এগারোটা তো হবেই। তাহলে বুঝতে পারছো কতটা দূর ! পাহাড়ে পৌঁছোতে কতটা সময় লাগতে পারে ?
তখন ছ’টা সাড়ে ছ’টা মতো হবে হয়তো, বেরোতে বেরোতে আটটারও বেশিই হবে । তাহলে দু’ ঘন্টাতে হয় কীভাবে ? ঘন্টা-তিনেক মতো লাগবে হয়তো ; অথচ মনে হচ্ছে সে যেন একেবারেই হাতের কাছে।
গতকাল রাতের বেলায় তো কালো কালো ছায়ার মতো মনে হয়েছিলো চাঁদের আলোতে পাহাড়গুলিকে। এবং মুগ্ধ হয়ে চেয়ে ছিলাম হোটেলের ব্যালকনির বারান্দা থেকে। পালদার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম চুপটি করে। তখন কেন জানি একবার বাড়ির কথা মনে হচ্ছিল ভীষণভাবে। ভাবছিলাম এই যে চলে এলাম, এবারে ভাইটা আরো স্বেচ্ছাচারী হয়ে যাবে হয়তো। তাও যেটুকু পারে না, সে তো আমার জন্যেই। তারপর বিষনি ভাই, যার উপরে রেখে এলাম সব কিছু। যতোই কাজের দিদি থাকুক। লালির বাছুরটিও তো কম দুরন্ত নয়। তারপরে চৈতির দস্যিপনাও রয়েছে। কাজের দিদি একা সামলাতে পারবে কি সব ? বিষনি ভাই-এর কাছে যদিও সকলেই একেবারে চুপ। কিন্তু তারও তো আর-এক-সমস্যা রয়েছে, যদি একবার রাণিয়ায় যেয়ে চোলাই মদ ঢেলে দেয় গলায় খানিকটা, তাহলেই হয়েছে। তখন তো তার আর কিছুই ঠিক থাকবে না ।
বাড়ির কথা ভাবতে ভাবতে এবার ওদেশের কথা এসে পড়লো ।
অনেক রাত অবধি হোটেলের ব্যালকনির বারান্দায় সে-যে কতকিছুই না ভাবতে থাকলাম এইরকম একটি অচেনা অজানা দেশের হিমশীতল রাতে, তার ঠিকঠিকানা নেই। পালদা বললো, ভায়া, একটু খাবে ? ঠান্ডার দেশে এসেছো, একটু নাও, সুধারস, দেখবে শরীর মন বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠছে।
বললাম, না না পালদা, আমার তো এসবের অভ্যাস নেই, তাই…
সে একেবারে বড় বড় চোখ করে অদ্ভুত এক ভঙ্গিমায় হাত নেড়ে বলে উঠলো, আমার কি খুব আছে নাকি, বাইরে বেরোলে যা একটু-আধটু, নাও, ধরো তো, বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষের কথা শুনতে হয়।
এই বলে সে ঘরের ভেতরে যেয়ে টেবিলে রাখা বোতল থেকে ঢক ঢক করে একটি গেলাসে খানিকটা মদ ঢেলে দিলো, তারপর তাতে পরিমান মতো জল মেশাতে মেশাতে আমার দিকে গেলাসটিকে উঁচু করে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, ঠিক আছে তো ?
—-আমি তো এসবের কিছুই বুঝি না পালদা ! ঠিক বেঠিকের আমার কাছে কি শুনছেন বলুন তো দেখি ? আর, সে কথা তো আগেই বললাম আপনাকে।
সে তাতে বেশ চোখ দুটি বড় বড় করে বললো, তুমি তো দেখছি একেবারেই ভার্জিন! মদ ছোঁওনি কখনো! মহিলা সঙ্গ করেছো ? না তাও করোনি ? এসব তুমি কী বলছো বলো তো দেখিনি শালা বাবু ?... ও সুবীর, দ্যাখো.. দ্যাখো.. এ কেমন নির্জলা উপোষী বাওন! এ কোন সাধু সঙ্গের গুঁতোয় পড়লাম কও তো দেখিনি ভাই! এরে একটু দেখো তো দেখিনি তুমি ভায়া।
সুবীর যদিও দাঁড়িয়ে এসব শোনার মতোন অবস্থায় ছিল না। কারণ ঘর নিয়ে কোনো একটা অসুবিধার কারণে সে ম্যানেজমেন্টের একজন হওয়ায় তাকে দোতলার দিকে যেতে হলো কারোর ডাকে। সে তাই হাত নেড়ে চালিয়ে যাবার সম্মতি জানিয়ে নিজের জামাইবাবুকে ইশারায় বুঝিয়ে দিয়ে ঐ ব্যক্তির সঙ্গে চলে গেল সিঁড়ির দিকে। পালদার কথা হয়তো সে সবটা মন দিয়ে শোনেওনি। রাতে আমাদের তিনজনের একটি ঘরে শোবার থাকবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এবং তাতে পালদার বেশ আনন্দই হয়েছে। কারণ ঘরে স্ত্রী এবং দিদি ওদের সঙ্গে একজায়গায় থাকতে হলে তার রসাস্বাদনের ব্যাঘাত ঘটবে যে এটা সে ভালো করেই জানে। তাই এমন একটি পূর্ণিমার রাতে এই ব্যালকনিওয়ালা বারান্দাটা তাকে যে কী আনন্দ দিচ্ছে এ কথা সে ছাড়া আর কে জানতে পারে। তাই তার আনন্দ আর ধরছে না। পারলে একটু নেচে নিতেও তার বাধা নেই যেন। এখনো আর কাউকে সে পায়নি বলে আমাকেই তার নতুন সঙ্গী করে নিয়েছে হয়তো। কী আর করা ! আমিও খুব একটা বেগরবাই না করে একটু ভয়ে ভয়েই চুমুক দিলাম গেলাসে। দুই এক চুমুকের পরে দেখতে পেলাম কানটা বেশ গরম হয়ে উঠলো যেন। বেশ একটা ঝাঁঝালো ঝাঁঝালো ভাব লেগেছিলো যদিও প্রথম প্রথম তারপরে আর কিছুই মনে হয়নি।
পালদা বললো, নাও নাও আস্তে আস্তে চুমুক দেও আর এই কাজু বাদাম চিবাও দুই একটি। ঐ ঝাঁঝালো ভাবটা কেটে যাবে। এরপর একটুখানি নেশা হলে বুঝতে পারবে এই রাতটা কীরকম স্মরণীয় হয়ে থাকলো। আরে ভায়া, এই বয়সটাকে উপোভোগ করো। আমার তো আর তোমার বয়স নেই, একসময় খুব বিভোর হয়ে এই বয়েসটাকে উপভোগ করবার জন্যে কত চেষ্টা করেছি ! কিন্তু তোমাকে সে জায়গায় ভেবে খুব নিরাশ হলাম, মনে হচ্ছে তোমার শৈশবকালই এখনো কাটেনি। আরে, এই বয়সে এই পরিবেশে হুইস্কি পান করবে না, নারী সঙ্গ করবে না, এ কেমন বেরসিক তুমি ! নাও নাও, এবারে এটুকু মেরে দেও তো দেখি চোখ বুজে। আরে আমি তো দুইবার মেরে দিলাম, আর তুমি হাতে ধরে দাঁড়ায়ে রইসো এখনো ?
পালদার কথার মধ্যে আমি আর কী বলি, নিতান্ত বালকের ন্যায় চেয়ে থাকলাম তার কথাগুলি শুনে।
বেশ একটা ঝিমঝিম ভাব আসছে । হয়তো প্রথম মদ্যপানের পরে এমনই হয়। এরপরে আর একবার শেষ করতেই বেশ টলমল করছিলো। তবে শীত শীত একটা ভাব আছে তো, তাই নেশাটা মনে হয় চড়তে পারছে না বিশেষ । এরপর দু’জনে বেশ কিছুক্ষণ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকলাম চুপ করে । সামনে স্থির হয়ে মস্ত বড় থালার মতো চাঁদটি যেন চেয়ে চেয়ে দেখছে আমার মুখটি, এরকমটাই মনে হচ্ছে খানিকটা।
পালদাকে অনেক কথাই বলতে মন চাইছে এখন তাও পারছি না। শুধু মনে মনে বলছি যেন, পালদা আপনার দৌলতে কতজনের কথাই না মনে পড়ছে এখন। এই তো সেদিনের কথা, দুপুর বেলা। চারদিকে কেউ কোথাও নেই। আমি জানলায় চোখ রেখে বাড়ির সদর দরজার দিকে চেয়ে একেবারে হতভম্ব। সদর দরজার দিকে তাকিয়ে সে যে কী অবস্থা আমার ! সামনে মাসিমাদের বাড়ির দিকটাতে কীভাবে যেন চোখটা চলে গেছিলো, কিন্তু ওমা, এ-কী অবস্থা দেখছি ! এতোটুকু লজ্জা-টজ্জা বা সংকোচ কিচ্ছু নেই ! যেন, আমি দেখতে পাবো বলেই ওখানে দাঁড়িয়ে ঐভাবে সে আলগা হয়ে জামাকাপড় পাল্টাতে লাগলো বাথরুম থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে ! সেই তো প্রথম একটি সদ্য যুবতী নারীর অর্ধনগ্ন শরীর দেখা। যদিও নজর পড়তেই জানলার পাল্লাটা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু সেদিন নিজেকে নিজে একা একা প্রশ্ন করেছিলাম কয়েকবার, ‘আমি কি মুগ্ধ হইনি এই দেখাতে… ?’
একটা মন যদিও বললো, না না, এতে কী সত্যি সত্যিই মুগ্ধ হওয়া যায় হঠাৎ করে ! তবে এই বয়েসে যেমনটা হয় তেমনই হয়তো আমারও মনে হয়েছিলো । এই নিয়ে এত ভাববারই এমন কী আছে ? তবে বারবার একটি কথাই মনে হলো, কী বলতে চায় ও, এভাবে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করে ? একে কী বলে ? একে কি এই বয়েসের চঞ্চলতা ছাড়া আর কিছু বলতে পারার আছে !
নেশার ঘোরে পড়ে পালদার ঐ নারীসঙ্গ প্রসঙ্গটির কথায় ক’দিন আগে এরকম একটি ঘটনার কথা বেশ মজা করেও তো বলতে পারতাম তাঁকে। কিন্তু কোই তা আর পারলাম না তো !
তাতেই বুঝলাম নেশা একটু হলেও, নেশার ঘোরে নিজেকে হারিয়ে ফেলিনি এখনো ? মনে মনে ভাবতে থাকলাম, নিজে নিজেই বলতে থাকলাম আপন মনে আরো কতকিছুই ; এই ক’দিনের সামান্য জীবনে উপলব্ধিতে তো কত কিছুই রয়েছে ! কাকে বলা যায় আর সেসব কথা ! যদিও সে সবকে কি আর প্রেম ভালোবাসা বলে ! তার সবটাই তো একার অনুভব। বিপরীত দিকটার কোনো খবর কি আর আমি জানবার মতো সময় কখনো দিয়েছি সেইভাবে ?
কিন্তু কেন জানি না মন যেন ইদানীং মাঝে মাঝেই ব্যাকুল হয়ে ওঠে ! মনে হয় কেউ যেন আমাকে একটু চোখে হারাক। আমিও একটু নেচে-গেয়ে উদ্দাম হই হিন্দি সিনেমার নায়ক নায়িকাদের মতো। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই মনে হয়, না না, এই জালে একবার জড়িয়ে পড়লে, আমার যে জন্যে আবার ফিরে আসা এই দেশে… সেই শিক্ষাদীক্ষা সব চুলোর দুয়ারে চলে যাবে যে। সে সবের কী হবে তাহলে ?
সচ্ছলতা বলতে তো কিছুই নেই সংসারে। টানাটানির মধ্যে দিয়েই চলতে হয়। তাতে এমন সব বিলাসিতা কি মানায় ? সে-সব আমি তখন কী দিয়ে সামলাবো ? ওদেশের সেই জীবন তো আর এখানে নেই ! এখানে তো সংশয় অনটন এই সবকিছুর সঙ্গেই বসবাস সব সময়। সেখানে তো এত সংকট ছিল না। সেসব নিয়ে কিছুই কখনো ভাবতে হতো না। পরীক্ষার পরে মনের আনন্দে কল্যানীকে সঙ্গে করে দাদুদের নৌকাখানা খুলে নিয়ে ভেসে পড়তাম জলে। এরপর চুপটি করে বাবুদের ভাঙ্গনের পাড়ে না হলে আখড়া বাড়ির চরে, না হলে সুকুমার মাঝিদের বাঁশ জঙ্গলের পাড়ের ধারে বা একটু কূলের কাছে বসে পড়া নৌকার দুইপাশে দু’খানি চৈড় পুঁতে দিয়ে। দুই মাথায় দু’জনে বসে পড়ে ছিপ বড়শি ফেলা হয়ে গেলে তারপরে তার সঙ্গে বকর বকর করা।
সেই জীবন আজ আর কোথায় খুঁজে পাবো!
একটি দিনের জন্যেও তো তাকে বুঝতে চাইলাম না! ঐ সব সময় এলোমেলো ছড়ানো চুলগুলি মুখের সামনে ঝুলে আছে কখনো কখনো তার, জোড়া ভুরু দুটির নিচেয় দুষ্টুমি ভরা চোখ দুটি, কিছুই কি কখনো চেয়ে দেখতে চেয়েছি ! একদিনের জন্যেও তো বুঝতে চাইলাম না, কেন সেই মেয়েটা ঘন্টার পর ঘন্টা আমার সঙ্গে নদীতে ভেসে থাকতে চায় এমনভাবে ? কই, একটুও তো অস্থির হয় না ! একটিবারও বলে না তো, ‘চলো তো, আর নয় ....’
বরঞ্চ সে যে আমার থেকেও স্থির! দেরি হলে হয়তো নৌকোর খোলের মধ্যেই ঘুমিয়ে নিলো, বেশ খানিক সময়, একটানা।
আজ কেন যে বারবার সেই মেয়েটির কথাই মনে হচ্ছে খালি ! যতবার ভাবতে চাইছি এখানকার কথা, ততবারই মনে পড়ছে সেই তার মুখটিই যেন।
বীরগঞ্জের এই রাতের বেলা, হুইস্কির নেশা বেশ আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ওদিকে, ঐ কালো কালো ছায়ার মতো পাহাড়গুলির গায়ে হেলান দিয়ে জ্বলজ্বল করেছেন তিনিই যেন একা ! কখনো কখনো একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে যেন মুখের উপর তেনার রূপ। কোথায় এক অপরিচিত রূপ-মুগ্ধতায় ডুবে এই চাঁদনি রাত্তিরে তলিয়ে যাবো তা না, ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়ায় সেই কোন দূর গাঁয়ের বকবক করা মেয়েটির কথাই ভাবছি খালি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে…!
সেই সাথে পালদার কত কথাই না শুনছি। পালদা এই এক রাত্তিরে আমার স্বভাবের যে দুর্বলতম দিকটি আছে তাকে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ টানিটানি করে বাইরে বের করে আনতে চাইছে যে সেটা বেশ বুঝতে পারছি। যেরকমটা এর আগে কখনো এমন ভাবে হয়নি।
রাতের খাবারে মুরগির মাংস আর রুটি। মাংসে কামড় দিতে যেয়ে সে আবার কী বিভ্রাট। গা গুলিয়ে উঠলো যেন। আঁশে আঁশে তাজা রক্তের শির। এ আবার কেমন রান্নারে বাবা ?
পালদা আমার ইতস্তত করা দেখে বলছে, এঁরা সব ছাল না ছাড়িয়ে মাংস রান্না করে ভায়া। তাও তো দেখছি এগুলির ছাল ছাড়িয়েছে খানিকটা। এরা সব বুঝলে কিনা আদিম জনগোষ্ঠীর লোকজন তো ! মশলাটশলা বিশেষ ব্যবহার করে না। তবে স্বাস্থ্যের পক্ষে বেশ ভালোই বলা চলে। বাঙালির মতো রান্নাবান্না এরা জানে না। রান্নাবান্নায় বাঙালির ধারেকাছে আছে নাকি কেউ ? রসনাতে বাঙালিই ফাস্ট বুঝলে কিনা ভায়া, নাও নাও, শুরু করো তো গুরুর নাম স্মরণ করে।
একদিকে মদের খিদে আর এক দিকে এই রান্না, দুটির ধাক্কাতেই হিমসিম খেতে হচ্ছে, তাই স্যালাড দিয়েই রুটি চিবাচ্ছি মাংসের আয়োজন সরিয়ে দিয়ে। মনে মনে ভাবছি সামনে আরো জানি কত কীই-না আছে ! মাথায় থাক হিমালয় দর্শন, এখন ভালোয় ভালোয় ঘরে ফিরে যেতে পারলেই বাঁচি। কিন্তু তারও তো উপায় নেই ! তাই ঘরে ফেরার কথা এখনি কী ভাই ! সামনে এখনো কত কিছু বাকি, এ তো শুরু হলো সবেমাত্র । এখনি এত অস্থির হলে হবে বাবা !
সেই ভাবনাই প্রতিমুহূর্তে চলতে চলতে মনে হয়েছিলো পাহাড়ের উপরে যখন বাস চলতে লাগলো ঘুরে ঘুরে। এবং এমন সব জায়গাগুলোতে এমন এমন ভাবে এক একটি বাঁক ঘুরতে যেয়ে মনে হচ্ছে যেন খাদের গা ঘেঁষে চলে গেল একেবারে। মনের ভেতরে তখন অনেকেরই ধুকপুকানি শুরু হয়েছে এরই ভেতরে। কতক্ষণে একটুখানি সমতল বা জনবসতিপূর্ণ জায়গা মিলবে যেখানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে একটু কিছু খেয়ে-দেয়ে খানিকটা মনের জোর আসে শরীরেও খানিকটা। পথের পাশে ছোটো ছোটো হোটেলগুলোই ভরসা। সেখানেই বসে পড়ছে সকলে। যা পাওয়া যায়, তাই নিয়েই খাওয়া-দাওয়া। সে রুটি দুধ তো তাই সই। কিংবা ছোলার ঘুগনি। না হলে মোরগার ঝাল। ঝাল বললাম এই জন্যে — সে ঝালই বটে, ঝোল নয়। রসুন পেঁয়াজে একেবারে ভরপুর মোরগার ঝাল আর রুটি।
সেই পাহাড় দেখার প্রথম অভিজ্ঞতা আমার। একদিকে পাহাড়ি নাম না-জানা গাছগাছালির বৈচিত্র্য, আর আরেক দিকে ঝর্নাধারা। উঁচু উঁচু পাহাড়ের গা বেয়ে ঝরঝর করে ঝরে পড়ছে জলধারা… তারা নিচেয় খাদে পড়ে এঁকেবেঁকে কোথায় চলে যাচ্ছে … আমরা কেউই তার গতিবিধি জানতে পারি না কিছুই।
বাস চলা শুরু হলে সেই একই আতঙ্ক, রাস্তার মোড়গুলো ঘুরতে যেয়ে এই যে খাদের কিনার ঘেঁষে চলে যাচ্ছে, কোনো রকমে যদি টাল খেয়ে পড়ে যায়, কত হাজার ফুট নিচেয় পড়বে যে গড়াতে গড়াতে তারপরে কি আর কোনো কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে অস্তিত্ব কারোর ! মনে মনে ঠাকুর দেবতার নাম জপ করা শুরু হয়ে যায় দেখি সকলেরই।
কিছুই খেতে পারছি না। যা খেতে যাচ্ছি একটা বোঁটকা গন্ধ। পালদা বলছে, কীসের মাংস জানো কি ভায়া ? এসব মহিষের মাংস। শালারা খাসি বলে মোষের মাংস খাওয়াচ্ছে বুঝতে পারছি। আরে শালা ভেঁড়ার মাংসও-তো দিতে পারতিস ! ভেড়া তো সস্তা শুনছি, তাও খাওয়া যেতো। এর আগের হোটেলটায় দেখেছো তো মাথার উপর কী ঝুলোনো ! সাপের মাংস। সাপ শুকিয়ে রেখেছে, দিশি মদের সঙ্গে খায় নাকি এঁরা। শালারা আর কী কী খায় বলো তো ভায়া ! তাই বলি কী, তুমি তো একেবারেই খেতে পারছো না, দুধ খাও, রুটি আর দুধ। দুধের দামও তো কম ।
বরফে আটকে গেলাম এক জায়গায়। বলছে, আর যাবে না নাকি। বরফ গলবে তারপর রাস্তা পরিষ্কার হলে, তবেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেল আমরা নাকি সমতল ভূমি থেকে সতেরো হাজার ফুট উচ্চতায় দাঁড়িয়ে আছি এখন। পালদা বরফ হাতে করে ছবি তুললো। দিদিও ওঁর ইয়াশিকা ক্যামেরাতে আমার ছবি তুলে দিলো পালদার সঙ্গে দু’হাতে বরফ নিয়ে। সেই আমার প্রথম পাহাড়ে বরফ হাতে ছবি তোলা।
বুক ঢিবঢিব আতঙ্কের মধ্যে সমস্ত দিন চক্কর কাটতে কাটতে গাড়ি ঘুরতে ঘুরতে একেকটি করে পাহাড় ডিঙিয়ে এগিয়ে চলেছে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর দিকে। পেটে খাবার নেই। চা আর দুধ খেয়ে ভেতো বাঙ্গালী কতক্ষণ পারে ! কাঠমান্ডু পৌঁছোতে বেশ খানিকটা রাত্তির হলো।
এত দুর্গম রাস্তা পাড়ি দিয়ে হোটেলের ঘরে পৌঁছে ঠান্ডা কাল জলে হাতমুখ ধুয়ে সবে যখন শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিয়েছি, পালদা ঘরে ঢুকে বললো, চলো ভায়া আজকের রাতের রসদ জোগাড় করে নিয়ে আসি।
পালদা রসদ বলতে কি বোঝাতে চাইছে সেটা বুঝতে পেরেই বললাম, কোথায় যাবেন ? চেনেন এখানের পথঘাট ?
সে প্রচন্ড নির্ভরতার সাথে বললো, ওসব তোমার ভাবার নয়, ওসব আমি বুঝে নেবো। তুমি চলো শুধু আমার সঙ্গে। কোথায় যেতে হবে। কোথায় পাওয়া যাবে ওসব বুঝে নিচ্ছি। চলো … চলো … পালদার আর সবুর সইছে না।
এরপর একেকটি দোকানের গুমটিতে ঢুকে জিজ্ঞাসা করা, মাল হ্যায়…. মাল … ?
সে যে কী অভিজ্ঞতা ! সেই চাদর মুড়ি দেওয়া পালদাকে দেখে আমি তো মনেমনে হেসে কুটিকুটি হই। দোকানে ঢুকে দোকানদারের সঙ্গে রসিকতার সেই কায়দা দেখে আমিও হেসে ফেলছি একেকবার। আর যদি আমাদের সামাজিক আদপ কায়দার সঙ্গে না মেলে, তাহলে তার জাতিগোষ্ঠী তুলে একেবারে উদ্ধার করে দিচ্ছে মানুষটা। আবার মিলে গেলে একটুখানি, পারলে তার গলা জড়িয়ে ধরে আদরও করতে ছাড়ছে না এই মানুষটিই। যদিও এইসব গালাগালি ভালোবাসা যা কিছুর দর্শক এবং স্রোতা আমাদের মধ্যের এই কয়েকজনই।
যাই হোক, সবকিছু মিলে এ-পর্বে পাহাড় দর্শনের স্বাদ মোটামুটি মিটেছে আমার অন্তত। পাহাড়ি জনজীবনের আচার আচরণে যেটুকু লক্ষ্য করতে পেরেছি সেটা তো শুধুমাত্র গাড়ি থামিয়ে পথে যেটুকু। কিন্তু তাদের মধ্যে থাকার সৌভাগ্য তো হয়নি !
পাহাড়ি ঝর্ণার জলের স্রোতধারায় পা ভিজিয়ে নিয়ে আবার গাড়িতে উঠে ছুটে চলেছি। কোথাও মেঘ তো কোথাও রোদ্দুর। যদিও খুবই বর্ণময়। যদিও এতটাই বর্ণময় তখনকার সেই পৃথিবীতে আমার দেখা সেইসব চিত্ররূপময়তা ঠিকঠাক বর্ণনা করা এখন আর সম্ভব না যদিও, তবু সেই বিস্ময়-ঘোর এতকালের ব্যবধানেও একটুও ম্লান হয়নি।
মনে আছে এই ভ্রমণে পালদাই আমার একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাঁড়ালো যেন। সে যেখানে যায় আমাকে সেখানেই সঙ্গে করে নিয়ে চলে। এটা খেতে পাচ্ছি না, ওটা না, কোনটা খাওয়ানো যায় তার চিন্তায় একমাত্র তাঁরই ঘুম নেই যেন। কখন হুইস্কির প্রয়োজন এত ঠান্ডায়, সেও ঠিক করছেন পালদাই। সময় সুযোগ মতো বলছেন, নেও নেও, ঢেলে দেও তো ভায়া, ওসব জ্বর, ঠান্ডা লাগা, সব পালিয়ে যাবে কোথায় দেখো। নেও ধরো। এইটুকু মেরে দেও তো ভায়া চটপট, তারপরে চলো যাই আবার।
রাত ভোর হতে না হতেই ঠান্ডা জলে স্নান করে পালদা। প্রথমে একচোট সরষের তেল ডলে নেয় আচ্ছা করে শরীরে। তেল ডলতে ডলতে পারলে ডনবটকিও দিয়ে নেয় দুই একটা, তারপর বাথরুমে ঢোকে। বাথরুম থেকে পালদা যখন বাইরে বেরিয়ে আসে তখন তাকে গুরুর নাম জপতে জপতে দেখা যায় ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় মাখামাখি হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে যেন। মনে হচ্ছে তার শরীরে যেন আগুন জ্বালিয়েছিলো কেউ। আর তাই দেখে তাকে বলি, ও পালদা, আপনার কি ঠান্ডা নেই নাকি ? এই সকালে উঠে ঠান্ডা জলে স্নান করেন কীভাবে আপনি?
সে তাতে বলে, অভ্যাস, ভায়া সবই অভ্যাস। এই সকালে স্নান করা আমার অনেক কালের অভ্যাস। তোমরা তো সকলে গরম জলে স্নান করছো দেখছি বেলাতেও। আর আমি দেখো সাওয়ার খুলে কেমন গায়ে ঠান্ডা জল ঢালছি । হুঁ…খানিকটা হুইস্কির ধুমকিও বলতেই পারো। হাঃ… হাঃ…. হাঃ…
পালদা হো হো, হা হা করতে করতে ভুঁড়ি নাচাতে নাচাতে কী সব বীজমন্ত্র জপ করতে লাগলো আঙুলের কর গুনতে গুনতে সে সবের আর কি বুঝবো।
সমস্ত কাঠমান্ডু শহরটি প্রতিদিনই এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। পশুপতিনাথ দর্শনে যেয়ে আমি আর ভেতরে প্রবেশ করতে চাইনি। জ্বর এসেছে মনে হচ্ছে। শরীর একেবারে দুমড়ে নিচ্ছে যেন। তাও বেরোতে হয়েছে। তা না হলে আমাকে একা থাকতে হবে লজে।
তখনো পর্যন্ত ঈশ্বর ভীতি ভেতরে খুব একটা বাসা বাঁধতে পারেনি। এইটা না করলে পাপ হবে, ঐ টা না করলে অমঙ্গল হবে, এই ভয়ে বা নানা লোক কাহিনীর ভয়ে আজকে যেমন কিছু ভাবতে গেলে কেবলই আগুপিছু করতে থাকে ভেতরটা, সেদিন সেই বালাই ছিলো না। আজ যেমন সমস্ত রকম আচার আচরণের মধ্যে দিয়ে ঈশ্বরের স্বরূপকে প্রত্যক্ষ করতে বাধ্য হই। কিন্তু সে সময় এই ভীতি কোনো জায়গায় পাইনি। এইসব আচার আচরণের মধ্যে দিয়ে এমন কোনো দুর্বলতা তৈরি করতেই পারেনি। তখন যেন এই না মানতে পারাটাই ছিল সব চাইতে গৌরবের। অনেকটা বীরত্ব দেখানোই বলা যায়। অথচ কী অদ্ভুত, গতকালকে হিমালয়ের এই খাড়াই উতরাই ডিঙ্গাতে গিয়ে একটি বারও কি সেই ঈশ্বরকে স্মরণ করা ছাড়া কোনো উপায় ছিলো ! তখন সেই সব বীরত্ব গেছিল কোথায় ?
আসলে ঈশ্বরকে নিয়ে দ্বন্দটা মনে হয় অন্য জায়গায়। তার স্বরূপের দ্বন্দ নয় সেটা। সেটির দ্বন্দ মনে হয় তার আচার বিচারের এই যে স্থানিক একটা প্রভাব নিয়ে এত মাতামাতি মানুষের, সেই জায়গাটা নিয়ে। বাকি আর সব নিয়ে তাঁর উপস্থিতি, তাঁর মাধুর্য এই সব যেন তখনো পর্যন্ত একটুখানি ধ্যানগম্ভীরতাতেই আকৃষ্ট ছিল বেশিটা। অর্থাৎ তাঁর সকল উপস্থিতিই ছিল বেশ কিছুটা মনে মনেই মনে হয়।
খানিকটা জ্বরে কাবু হয়ে দ্বিতীয় পর্বে আর গেলাম না বাইরে ঘুরতে। হোটেলের ঘরে বসে বসে একা একাই কাটিয়ে দিলাম। আশ্চর্য হচ্ছি একটা জিনিস দেখে, সামনে যেসব বাড়ি-ঘর-দুয়ার দেখা যাচ্ছে, সেখানকার মানুষজন যার যার মতো ঘরদুয়োর খালি রেখেই বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোনো তালা চাবির বালাই নেই। এঁরা সকলেই যার যার মতো দরজা জানলা আলগা রেখে বেরিয়ে যাচ্ছে কীভাবে সেটাই ভাবছিলাম। এরা কেউ সকালের পরে ঘরে থাকে না। যে যার নিজের মতো বাইরে কাজে বেরিয়ে যায়। এখানে চৌর্যবৃত্তি বলে কোনো বৃত্তিই নেই নাকি!
কথাগুলি মানতে বাধ্য হয়েছি সকালে হোটেলে যে মহিলা ঝাড়পোছ করতে আসেন তাঁর সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলেও জানতে পেরেছি চুরি করা জিনিসটাকে এঁরা অত্যন্ত খারাপ কাজ বলে মনে করে। এবং সকলেই ঘৃণা করে মনেপ্রাণে।
শেষপর্যন্ত পশুপতিনাথ দর্শন হয়েছিলো এই ভেবে, এত দূরের দুর্গম পথ অতিক্রম করে এলাম যখন তখন আর মানুষের এই বিশ্বাসের মর্যাদা কেনোই বা দেবো না !
এরপর আরো একটি দিন কাটিয়ে পোখরা নামক একটি জায়গায় আরো কয়েকটি পাহাড়ী পথ ঘুরে, বিশাল একটি জলাশয়ের ধারে কী যে অনুভূতি সঞ্চয় করলাম, তাকে ঠিক বর্ণনা করে বলা সম্ভব না । সেই পাহাড়ী ঢালের গায়ে যে বিশাল জলাশয়, তাতে নানা জাতের নানা বর্ণের যে সব জলচর প্রাণীর দেখা পেলাম, সে যেন এতকাল পরে এসেও চোখ বুজলে অনুভব করছি তার দর্শনীয় সকল মাধুর্যটুকুন।
এই ভ্রমণে আরো যে কতরকমের প্রকৃতি মানুষজন তাদের সুখ দুঃখ সংসার জীবনযাপন ভালোবাসা প্রেম ধর্মীয় বিশ্বাস সব কিছুর সঙ্গেই একটা অন্যরকম ভাবের অনুভবের দেখা দিল। এর মূল্য এই দুর্গম পাহাড়ী পথ অতিক্রম করার কষ্টের থেকেও মহামূল্যবান যে একথা স্বীকার না করে উপায় নেই। যা এখানে না আসলে হয়তো কোনোদিনও এইভাবে দেখতে পেতাম না। এই যে যেখানে দেখলাম চুরি নেই। অবিশ্বাসও নেই যেন। আমার আমার বলে নিরন্তর সবকিছুকে বাঁধন-ছাদন দেওয়া নেই, এই ধারণা তো যদি না আসতাম তাহলে তো কোনোকালেই হতো না ! আর ঐ পোখারার জলাশয়টি? ঐ বিকেলের স্তব্ধ পাহাড়ের ছায়াটি যে হুমড়ি খেয়ে মিশে আছে জলের ভেতরে একাকার হয়ে ! ডানপাশে হিমালয়ের সর্বচ্চ শৃঙ্গ নাকি, সেটা ডিঙ্গাতে পারলেই নাকি চীন দেশ।
সে যে দেশই হোক, তাও মনে মনে সেই সমতলের ছোঁয়া পাবো কবে তা জানার জন্যে কেন জানি ছটফট করছি ভেতরে ভেতরে কখনো কখনো। মনে হচ্ছে হাঁপ ছেড়ে বাঁচবো বুঝি তাহলে। যদিও এই ছটফটানি কিছুটা কমেছে যে, আর সেটা পোখারারই অবদান !
কে যেন বলা শুরু করে দিয়েছে ইতিমধ্যে, বলছে, যা কিছু পেছনে ফেলে চলে যাচ্ছ তা পেছনেই পড়ে থাকলো। তাকে আর এমনভাবে কোনোকালেই দেখতে পাবে না জেনো। আবার এই গা ঘিনঘিনে হোটেলগুলির খাওয়া দাওয়ার এরকম দুরবস্থার অদ্ভুত একটা চিত্র, তা তোমাকে যতোই কষ্ট দিয়ে থাকুক, তারপরেও জানবে এইসব অভিজ্ঞতা তুমি সঙ্গে নিয়েই চলেছো যেভাবে, সেটা তোমারই। আবার যদি কোনোদিন ফিরে আসো, আবার একবার দেখতে, সেদিনের সেই অনুভব আর হাজার চেষ্টা করলেও ফিরে পাবে না কোনোদিনও।
এই কথাগুলি সেদিন পালদাই বলেছিলো তার ভাষায়, হয়তো একটু অন্যভাবে। তবে তার ভাবার্থ তো একই ছিলো !
হোটেলের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে হুইস্কির গ্লাস হাতে করে একটুখানি আগে পোখারার লেক থেকে বেড়িয়ে এসে সেই যে আমাকে ডেকে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল পালদা, তারপর হুইস্কি পান করতে করতে এই কথাগুলিই তো পালদা পালদার ভাষায় বলে চলেছিলো। মনে মনে আমি তো মেনে নিয়েছিলাম তাঁর কথা ! যা এভাবে কখনো ভাবিনি !
সেই যে দূর গাঁয়ে, যেখানে যে অবস্থায় যাঁদের ভেতর আমি আমার অতিবাহিত করা সেদিনের সেই যে সময়গুলি ফেলে এসেছি আমবাগানে, ঠাকুর নালার মাঠের বিলের জলে, আম পাকা গ্রীষ্মের রাত্তিরের হাওয়া-বাতাসে, ভোরবেলার বেলে জ্যো স্নায়, নবগঙ্গার জলে পালতোলা গয়না নৌকোর মধ্যে, সেই যে মাঝি মাল্লাদের সাথে থেকেছিলাম কিছু সময়, সেই সবকে কি আর তেমন করে কোনোদিনও ফিরে পাবো! তাঁরা কি আর সেই প্রকৃতির ভেতরে আমার অপেক্ষায় বসে থাকবে তেমন করে ? সময়ের তোড়ে তারাও তো পাল্টাতে পাল্টাতে চলে গেছে কত দূরে, তা কি আমি জানি !
এই তো কিছুদিন আগেও তারা আসা-যাওয়া করতো কত দিন ধরে যেন সন্ধ্যার ছায়া সুনিবিড় শান্ত নবগঙ্গার জলে কোনো একটি ঘাটের পাশটিতে নোঙর করতো তাদের নৌকা খানি, তারপর সেই নৌকার ঘর-সংসারের আলোআঁধারিতে কী এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে নৌকার ছোই-এর মাথাতেই হয়তো সার সার ঘুমিয়ে থাকতো তারা। তখন সন্ধ্যা রাতের তারারা হয়তো মিটমিট করে জ্বলে উঠত আকাশের কোনো এক কোণে, ওপাশে চাঁদ উঁকি দিতো তার থালার মতো মুখটি নিয়ে ; এসব সব ছিলো একদিন, হয়তো থাকেও কিছুকাল এমন কিছু মানুষের হৃদয়ে, তবুও তাঁরাই আজ যেন কত দূরের ছায়াই শুধু, তাতে আর কিছুই স্পষ্ট করে দেখা যায় না আজ আর। যেমন যেত, এই তো কিছুদিন আগেও !
পালদা আজ যা বললো, তা তো রসিক দাদুরই বলা কথার পুনরাবৃত্তি। মনে হচ্ছে এই তো, এই তো আমার শিক্ষাগুরু ! এই তো আমার দীক্ষাগুরু ! যা আজ পালদার মুখ দিয়ে এই সময় আমাকে শোনালো !
সেসব তো পালদা বলেনি ! যেন পালদাকে দিয়ে আমাকে সাবধান করালো সেই অচেনা পথিক যিনি, এই পথে আমার সঙ্গে সঙ্গে চলে এসেছিলেন অন্তরালে ! আমাকে শিক্ষা দিতেই যেন পালদা এখানে তাঁর মুখোপাত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে, সে আর কী ? সে তো আর কিছু না। এই যে গিরিচূড়ার সামনে দাঁড়িয়ে আজ আমি যার কথা বেশি করে মনে করছি, সে তো আমার ফেলে আসা সময়। যাকে আমি আর অমন ভাবে যেন কোনোকালেই খুঁজে পাবো না। হয়তো আজও সে খানিকটা তেমনই। কিন্তু সমস্তটা তবুও তেমন না। যা সময় তার হাওয়া বাতাসে হয়তো একটা ঝারি মেরে পাল্টে ফেলে দেয় তার মতো করে। যা পালদা এখানে একটু আগেই বোঝাতে চাইলো হয়তো তার মতো করে। আর পালদা বলার সঙ্গে সঙ্গে যে মুহুর্তটি চলে গেল আজ তার মতো, তাঁকে কি পালদাও একটু পরে টেনে ধরে রাখতে পারবে তেমন করে ?
কাঠমান্ডু শহরে একদিন ভীষণ মনখারাপ হয়েছিল দুটি কথা ভেবে, এক, শরীরে জ্বরের জন্য তাপ যখন কমছিল না, পালদার নানা দাওয়াই ট্যাবলেট মদ সব করেও তাপ ভীষণ ওঠানামা করছিল। যা কাঠমান্ডুতে থাকা কালীন কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। তার মধ্যে বেশি সময়ই হোটেলের ঘরের মধ্যে খানিকটা বন্দী অবস্থায় একটি জানলাকে সামনে করে কাটাতে হতো একাকী। কারণ আমার জন্যে তো এরা সকলে তাদের এই অমূল্য মুহুর্তগুলি হোটেলে বসে বসে কাটাতে পারে না। তবু যেন মনে হয়েছিল দিদি তো পারতো অন্তত আমার জন্যে থাকতে একটা দিন! কী এমনই বা হতো, একদিন একটু ঘোরাঘুরি না করলে বা কেনাকাটা না করলে ! আর সকলের কথা বাদই দিলাম না হয় এই ক্ষেত্রে । খুব মনখারাপ হয়েছিলো সেদিন। বেশ ভয়ভয়ও করছিলো কেন জানি।
আর একদিন মনে হয়েছিলোও। একা একাই সে কথা বলাবলিও করছিলাম নিজের সঙ্গে নিজেই, আচ্ছা এমনটা দিদির হলে, আমি কি পারতাম এইভাবে ঘুরে বেড়াতে বা কেনাকাটা করতে ? এই অচেনা অজানা বিদেশ বিভুঁইয়ে যেভাবে একা একটা ধুম-জ্বর-গায়ে-ছেলেকে ফেলে রেখে এঁরা সকলেই বেরিয়ে গেল, আমি কি পারতাম ওদের মতো এরকমভাবে ? আচ্ছা এমনও তো হতে পারতো, আমাদের গাড়িটা আসার পথে খাদে পড়ে গেল। সকলেই তাতে অক্ষত থাকতে পারলো হয়তো ধরে নিলাম। সেখানে আমিই শুধু আধমরা হয়ে পড়ে থাকলাম এক্সিডেন্ট এর পরে কোনো একটি চিকিৎসা কেন্দ্রে হয়তো, আমাকে ভর্তি করে চিকিৎসা শুরু করলো। কিম্বা হয়তো আমি যে বেঁচে আছি সেটাই বুঝতে পারলো না কেউ তারা। ভেবে নিলো আমি আর নেই হয়তো ! তখন তারা কি আমার কথা ভেবে এই সমস্ত টুরটা মনখারাপ করে বসে থাকতো ঘরে ? হয়তো ধরলাম সেটাও না। তাদের ফিরে আসার মধ্যে আমার জন্যে খানিকটা মনখারাপ হয়তো থাকতো, কিন্তু তাও, সেখানে নিজেদের এই বেঁচে থাকাটার গুরুত্বই বেশি পেতো। আমার জন্যে বিলাপ হয়তো থাকত কিছুটা কিন্তু বেদনা হয়তো কিছুই থাকত না, যা সকলের চোখেমুখের উপর ছড়িয়ে পড়া দেখা যেত একেবারে বিমর্ষ রুগীর মুখের মতো !
যাইহোক, পরে যখন পোখরাতে পৌঁছে বেশ খানিকটা চাঙ্গা হলাম, বেশ সুস্থতা অনুভব করতে লাগলাম, তখন এসব ভাবনা আর গাঢ় হতে পারলো না। সে সব সরে যেয়ে অন্য নানা অনুভবের মধ্যে ডুবে গেলাম আবার সবকিছু মন থেকে সরিয়ে দিয়ে।
পোখরা থেকে যদিও অন্য সব ভাবনা গাঢ় হতে লাগলো আরো, এই যে এখানকার মানুষজন, তাঁদের পাহাড়ি সারল্য, পথ চলতে চলতে এঁদের দেখে মনে হতে লাগলো কত প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেই না এঁদের জীবনযাপন ! একদিকে বেশিরভাগটাই নানা অনটনের মধ্যেই জীবনযাপন করে যে, সে তাঁদের চেহারার মধ্যেই সুস্পষ্ট। একদিকে পাহাড়ি দুর্গমতা, এখান থেকে ওখানে যেতে হলে যে পথ, তা শুধুই তো আর এই গাড়ি চলবার পথের মতোন না ! ঐ যে পাহাড়ি গা বেয়ে সরু সরু পায়ে হাঁটা পথ, তাকে পেরিয়ে কত দূরে তাদের যেতে হয় এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে, তা কি সবটা জানি আমরা পরিষ্কার করে কিছুই !
সেইসব পথ দিয়ে তাঁরাই হয়তো চলতে পারে, আমরা পারবো না, এঁদের জীবন জীবিকা বলতে যা মনে হলো, তাতে চাষবাসের উপরেই সবটা হয়তো নির্ভর না, হয়তো এইসব পর্যটকদের আসা-যাওয়ার উপরেও খানিকটা। এইসব চায়ের দোকানের মতো দেখতে হোটেল গুলিতে যদি পর্যটক আসা-যাওয়া না ঘটে কিছুদিন তাহলে তাঁদের মনে হয় না খুব সচ্ছলতা থাকে। তখন কীভাবে চলেই বা তাঁদের ? সেও যে এমন বড় কিছু একটা তাও তো মনে হয় না ! দারিদ্রের মিনমিনে একটি ছায়া মনে হয় যেন প্রতিটি মানুষের মুখের উপরে কেমন যেন ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে বলে মনে হয়।
বড় বড় শহর গঞ্জগুলি বাদ দিলে, এই যে এইসব পথ, পাশের জনবসতিগুলি, তাঁদের নানা অসহায়তার চেহারাটি তাঁদের মুখ চোখের মধ্যেই ধরা পড়ে। পাহাড়ের খাদ কেটে কোথাও ধান গমের চাষ লক্ষ্য করা যাচ্ছিল যদিও, ছিল বেশ কিছু ভুট্টার ক্ষেতও। বাকিটা তো যা জানতে পারলাম মহিষ ভেড়া কিম্বা বড় বড় রামছাগলের মতো ছাগল চরিয়েই চলে মালিকের কাছ থেকে চরানোর প্রারিশ্রমিকের উপর, যা মনে হলো। যদিও কিছু চমরী গাইও দেখছিলাম। পালদা বললো, এই যে এত সস্তা দুধ খাচ্ছো, এর বেশির ভাগটাই মোষ আর চমরী গাই-এর। গোরু তো দেখছি না একটিও আমাদের দেশের মতো !
এত প্রতিকুল পরিস্থিতি থাকলেও সততায় এরা প্রসংশা করার মতো। মনে আছে আমাদের গাড়িটি যখন পাহাড় ছাড়িয়ে কিছুটা সমতলে নেমে এসেছে, তখন একটি ছোট্ট গঞ্জ মতো জায়গায় দাঁড়িয়েছিলো একটুখানি বিরতির জন্য। আমরা সকলেই চা জলখাবার বাথরুম পেচ্ছাপ এইসবের বিরতি পর্বের মধ্যে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করতে করতে সদ্য জ্বর ছাড়ানো মুখে একটু রুচি আনবার জন্যে কাঁচা শাল পাতায় মোড়া ছোলা সেদ্ধ মাখা কিনে খাচ্ছিলাম। খেতে খেতে দোকানিকে টাকা দিয়ে ফেরত অর্থ বুঝে না নিয়েই ঐ স্থান ছেড়ে বেশ খানিকটা চলে এসেছিলাম। ছোলা সেদ্ধ খেতে খেতে প্রায় গাড়ির কাছে পৌঁছে গেছি, ওমা সেই দোকানি দেখছি ছুটতে ছুটতে কাছে এসে বলছে, বাবুজি, আপনি ফিরতি রুপাইয়া নেহি লিয়া, ধরিয়ে।
আমি অবাক হয়ে চেয়ে আছি তাঁর মুখের দিকে! সেটা দেখে সে হয়তো বুঝতে পেরে বলছে, এ আপকো নেহি দেনে সে হামলোক কা বহুত গুনা হোগা….
তাঁর ভাষায় ঠিকঠাক বলতে পারলাম না হয়তো, তবে সেই ব্যক্তির এই সততার দৃষ্টান্ত আজও আমাকে স্তম্ভিত করে রেখেছে। জানি না আজও তাঁরা এই মানসিকতা নিয়ে বেঁচে আছে কিনা !
বাঙালি ঘরানার বাইরে না যেয়ে অন্যদের জীবনযাপন রন্ধন প্রণালীর পার্থক্য বুঝবো কীভাবে ? এর আগে সেসব পরিচয় তো ঘটেনি। তাই প্রতিমুহূর্তে ভেতরে একটা নাক টানা ভাব তো ছিলোই। সেটা অস্বীকার করি না আজ আর। তাই সেই পর্বে যেখানেই গেছি খাবারদাবারের বিষয়ে সব সময় একটা খুতখুতানি, এই, এটা না, ওটা দেখি, এইটাই বা কেমন এঁদের !
আর এই পুড়ি চাপাটি আর কষা মাংস ডিমের কারি তড়কার ডাল এসব করতে করতে একেবারে এই তেরো চোদ্দ দিনে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি এরকমের একটা ভাব ভেতরে ভেতরে শুধুই মুখ ভ্যাংচাচ্ছে। ভাত, ডাল, ছোট মাছের চচ্চড়ি, তরকারি, বিশুদ্ধ বাঙালি রান্না যে, সে এখনো অনেকটা পথ পেরোনোর পরে। বাঙালি হোটেলগুলোতেও অবাঙালি রান্নার ঝাঁঝ। যদিও কাঁশীতে পৌঁছে এই অভাব খানিকটা পূরণ হয়েছিলো বলা যায়। তাও বিরোধ ঘটিয়েছিলো কারি পাতার ব্যবহার সব কিছুতেই বলে। তারপর পাতলা ট্যালটেলে ডাল আর আলুর তরকারি। এ ছাড়া অন্য কোনো সবজি বা তরিতরকারি এরাও যেন জানে না ! পর্যাপ্ত দুধের অবশ্য যোগান ছিল চারদিকে। যেদিকে যাও সেখানেই ঢালাউবুড় চলছে দুধের। তাই সেই দুধ দিয়েই চাপাটি সহ রাতের আহার সারা হতো সকলেরই এক রকম।
দিন পনেরো কাটিয়ে দিয়ে আমাদের সেই গাড়ি যখন আবার বেহালার সেই সরকারি কোয়ার্টারের ভেতরে যেখান থেকে ছেড়েছিল আবার সেখানেই নিয়ে এসে দাঁড় করালো, তখন ঘরে ফেরার পথে কেবলই ভাবছিলাম, এই যে ক’দিন সকলের সঙ্গে সকলে একটা সংসার পেতেছিলাম কিছু মানুষজন মিলে যেন, এবারে দেখো তাঁরা কেমন এক একজন এক একদিকে যার যার ঘরে ফেরার পথের জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ! আচ্ছা, কারোর আমার মতন মনটা খারাপ হচ্ছে না ? ভাবছিলাম আজ আবার সব আগের মতো হয়ে যাবে, যেগুলির সঙ্গে এই পনেরো দিনের কোনো মিলই নেই ! চলতে চলতে কতো অসহিষ্ণুতা ছিলো নানা ভাবে নানা জনের মধ্যেই তো দেখেছি । সে আহারে বিহারে, সে নানা কিছুতেই তো ছিল । কত মনকষাকষি … পালদার চিৎকার চেঁচামেচি হোটেল কর্তিপক্ষের লোকজনের সঙ্গে … হয়তো অন্য যাত্রিদের সঙ্গেও লেগে গেল নানা কিছু নিয়ে । এইরকম কত কিছুই তো ঘটে চলেছিলো এই ক’টি দিনের পথ চলায়। বাস থেকে নামার পর আর তো কোনো কিছুই থাকলো না সেসব!
এই যে এই পথ চলতে গিয়ে যে সকল মানুষগুলির সঙ্গে পরিচয় হলো, আর কি জীবনে কখনো দেখা হবে তাঁদের সঙ্গে
গত পঁয়তাল্লিশ বছরে সেটাই তো সত্যি। দেখাশোনা আর তো হয়নি, একমাত্র পালদার পরিবার ছাড়া !
আজ পালদাও ইহলোকে নেই। মোড়ের সেই দোকানটি, পল্লী ভান্ডারে এখনো কিছু কেনাকাটা করতে গেলে দেখি পালদার ছেলের পরিচালিত বর্তমান সেই দোকানটির দেয়ালে ঘট হয়ে পালদা বসে আছে ছবিতে। কত কথা মনে পড়ে, সেই বীরগঞ্জের হোটেলের ব্যালকনিতে বা সামনের পাহাড়ের সেইদিনের সেই পূর্ণিমার চাঁদটিকে বুকে করে দাঁড়িয়েছিল যে পেছনের কালো কালো ছায়াবৃত্ত পাহাড়গুলি রাতের আকাশে, আর পালদার হাতে ধরা ছিল মদের গেলাস, জীবনে প্রথম যেদিন মদ্যপান করবার স্বাদ পেয়েছিলাম পালদার সৌজন্যে, সেই আমার প্রথম নেশার স্বাদ পাওয়ার অনুভূতি, সেই যে সেদিনের সেই পালদার বলে যাওয়া নেশার ঘোরে কথাগুলি, ভায়া, একদিন মনে পড়বে এই যে কাটিয়ে যাবে যে দিনগুলি, এই সময়টাকে জীবনে আর কোনোদিন এমন করে ফিরে পাবে না। তাই বলি কি, আজ যা পাচ্ছ, তাকে ভালো করে উপভোগ করো। এই যে আমি, স্বাভাবিক নিয়মে আমিও একদিন থাকবো না। নিয়ম মতো হলে আমি তো তোমার আগেই চলে যাবো। তুমি থাকবে আরো বেশ কিছু কাল । তখন জীবনের কোনো একসময় তোমার এই দিনগুলির কথা মনে পড়বে দেখো। সেদিন যখন মনে পড়বে তখন ভাববে… যাই, পালদার সঙ্গে একটু সময় কাটিয়ে আসি গে। কিন্তু তখন কোথায় আর পালদা ! তাঁকে তুমি আর কোথায় খুঁজে পাবে সেদিন ! ….বীরগঞ্জের এবং পোখরার সেই মুহুর্তগুলি তখন অনেক পেছনে। কাউকে তুমি খুঁজে পাবে না আর তেমন করে….. ।
*******************************************************
আগামী পর্বে
********************************************************


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন