শুক্রবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

পাঠকের চোখে : স্বরবর্ণ * ছয় * ১৪২৮

 পাঠকের চোখে :  স্বরবর্ণ *  ছয় * ১৪২৮





' স্বরবর্ণ * ছয়  ' সংখ্যাটি কেমন হল ? কী বলছেন সুধী পাঠকমন্ডলী ? এ বিষয়ে ব্লগে অনেকেই মতামত দিয়েছেন । আবার ব্লগে সড়গড় না হওয়ায়, অনেকে সম্পাদকের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে মতামত জানিয়েছেন। ফোনেও অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাছাড়া, এ সংখ্যার কবি লেখকেরা অনেকেই তাঁদের নিজস্ব ওয়ালে সংশ্লিষ্ট লেখাটি শেয়ার করেছেন। সেখানেও অনেকে মতামত দিয়েছেন। সুচিন্তিত মতামত দেওয়ার জন্য সকল পাঠককে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ।

পাঠকের মতামত শিরোধার্য করে আমরা ক্রমান্বয়ে সেগুলি প্রকাশ করব । আজ পাঠ প্রতিক্রিয়ার প্রথম পর্ব  -----


শতদল মিত্র লিখেছেন  কিছু পত্রিকা আছে, যার জন্য অপেক্ষায় থাকি। 'স্বরবর্ণ' তেমনই এক পত্রিকা। প্রথমেই খুঁজে নিই অনুবাদ কবিতা। আর চমকে দিল মীনাকুমারীর শায়েরী সুধাংশুরঞ্জন সাহার সাবলীল অনুবাদে। স্বপন নাগের উজ্জ্বল  অনুবাদে নাগার্জুন, নরেশ মেহেতা, সর্বেশ্বরদয়াল সাক্সেনা, ওমপ্রকাশ বাল্মীকি ও হূবনাথ পাণ্ডের হিন্দি কবিতা সমৃদ্ধ করল। ঝলসে দিল যেন ওমপ্রকাশ বাল্মীকির কবিতা। 

     গদ্য বিভাগে সুশান্ত চট্টোপাধ্যায়ের 'প্রতিবাদের নন্দনজ্যামিতি'তে কবি তরুণ সান্যালের কবিতাদর্শন ও কবির আকবিতাজীবন এক 'গোটা মানুষের ছবি'-র সন্ধান সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে। পারমিতা ভৌমিকের কবি পিনাকী ঠাকুরের আটপৌরে কাব্যভাষা, তার কাঠামো নিয়ে আলোচনা যথাযথ। তবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায় 'পিনাকী সময়কে বিধৃত করে ছোট ছোট পঙক্তিতে'-- এ বিষয়ে বিশদ উল্লেখ থাকলে আরও প্রাপ্তি হতো।

     অণুগল্প বিভাগে রঞ্জনা ভট্টাচার্যর 'খাদ' এবং শর্বরী চৌধুরীর 'সম্পর্ক'-- দুটি গল্পই যেন নারী-পুরুষের সম্পর্কের ভান, তার ভঙ্গুরতার ছবি। 'সম্পর্ক'-এ যদি ভঙ্গুরতাকে ঢেকে রাখার অসহায় ভান, 'খাদ'-এ আপাত ভঙ্গুরতার মধ্যেই কাঠামোর সন্ধান। পাঠক আমি তৃপ্তি পেলাম।

     কবিতাবিভাগ আগের মতোই সুসম্পাদিত। অভিবাদন সম্পাদককে। পরবর্তী সংখ্যার অপেক্ষায় থাকলাম।


গৌরীশঙ্কর দে-এর নিবিড় পাঠে উন্মোচিত হয়েছে পত্রিকার নানা দিক । তাঁর মন্তব্যগুলি একে একে তুলে দিচ্ছি ---

"সম্পাদকীয়" সম্পর্কে তিনি লিখছেন -----সম্পাদকীয় পড়ে পত্রিকার সঞ্চারপথটিকে চেনা যায়। জ্ঞানের গরিমা নেই,উদ্ধার করেছি গোছের কোনো প্রতিবর্তী ক্রিয়ার সোল্লাস নেই, স্নিগ্ধ মাধুর্য নিয়ে অনায়াসে নিজকে, নিজস্ব দলবৃত্তের বাইরে বেরিয়ে ডাক দিল শিল্পের সতীর্থ-সুজনবর্গকে। এই ডাক তিতিরের, এই হাত নগ্ন নির্জন। Hat's off.

বিজয় সিংহ-এর কবিতা সম্পর্কে তাঁর বীক্ষণ ----বিজয় সিংহ! এক অতি প্রিয় পরিচিত নাম। দুটি কবিতাকে একইসঙ্গে জানাই সেলাম ।

পঙ্কজ মান্না-এর কবিতা সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য ---অসামান্য লাগলো দুটি কবিতাই। স্বরবর্ণ-এর কাছে ঋণী রইলাম। কবিকে জানাই অশেষ অভিনন্দন।

সুজয় যশ-এর কবিতা পড়ে তিনি জানাচ্ছেন ---অত্যন্ত সম্ভাবনাময় কবিদের একজন কবি সুজয় যশ। ওঁর কবিতায় আমি গভীর নিমগ্ন এক পরাবাস্তব খুঁজে পাই। এ কবির একান্ত নিজস্ব অভিজ্ঞা। শুভকামনা।

চন্দন রায়-এর কবিতা সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য ---"একমাত্র কবিই পারে/ রাতের মন্থর আকাশে মায়ার ছন্দ এনে দিতে—" চন্দন পারেন।

সৈয়দ কওসর জামাল-এর কবিতা সম্পর্কে তাঁর অভিমত ----জামালদা কবিদের কবি। ওঁর প্রসঙ্গে কিছু বলা এত স্বল্প পরিসরে অসম্ভব। তলপ্রধান ছন্দে লেখা এই কবিতায় আবার উদ্বেলিত হলাম। 

উদয় ভানু চক্রবর্তী-এর কবিতা  সম্পর্কে তিনি লিখছেন---অত্যন্ত মিতবাক এই কবির কবিতা পড়ে মুগ্ধ হলাম। এক অতীন্দ্রিয় স্বরক্ষেপণ।

অনুবাদ কবিতা * তপন পাত্র---খুব ভালো লাগলো অনূদিত কবিতাগুলি। শুধু কবিপরিচিতি সামান্য থাকলে ভাওলো হতো।

কবিতাগুচ্ছ * রাহুল দাশগুপ্ত---কবি রাহুল দাশগুপ্ত-এর কবিতাগুলো এক গভীর প্রত্যয়ে বলে গেল যেন নিজস্ব বিশ্বাসই অন্তর্নিহিত আস্তিকতা। শিরদাঁড়া সোজা রেখে চলাই জীবন। কুর্ণিশ জানাই।

কবিতাগুচ্ছ * শীলা দাশ---"সমুদ্র বাতাসের দিগন্তবন্দীশ"-এ জাড়িত কবিতাগুলি বড়ো মধুময়।

কবিতাগুচ্ছ * অমিত চক্রবর্তী---অমিত চক্রবর্তীর অমিত শক্তিশালী লেখনীর সঙ্গে প্রথম পরিচয়েই বসন্তবাহারে যেন কোথায় হারিয়ে গেলাম। "মধুর বসন্ত"-এ মায়ার খেলায়।

রামকৃষ্ণ মাহাতো-----বাহ্ অপূর্ব প্রান্তিকবৃন্তে ফোটা অত্যাধুনিক দুটি কবিতাই মন জুড়ে ঝড় বুনে দিলো। শুভকামনা।

দেবার্ঘ সেন----দেবার্ঘ সেন অসম্ভব শক্তিমান কবি। এখানে প্রকাশিত 'শিহরন সংক্রান্ত' কবিতাটি অনন্য। 'সমীর'ও সুন্দর। অনেককেই জানেন বোধকরি ওঁর ছবির হাতও অপরূপ।

শহীদুল ইসলাম---চমৎকার কবিতা। কবিতার শত ফুল বিকশিত হোক।

মৃন্ময় মাজী----মৃণ্ময় মাজী আমার আত্মজার বয়সী। অত্যন্ত সুন্দর লিখে চলেছে। ওঁকে প্রথম দেখি মুখপুস্তকে। অত্যন্ত বলিষ্ঠ হাত। পাশাপাশি লোকায়ত প্রান্তিক কবিতায়ও সমান পারদর্শী। এখানে প্রকাশিত দুটো লেখাই অত্যন্ত গভীর, মর্মস্পর্শী।

উপন্যাস * দেবাশিস সাহা ---- ডায়েরির অংশে লেখাটি নতুন মাত্রা নিল। অসাধারণ লাগছে।

( আগামী পর্বে )



' স্বরবর্ণ * ছয়  ' সংখ্যাটি কেমন হল ? কী বলছেন সুধী পাঠকমন্ডলী ? এ বিষয়ে ব্লগে অনেকেই মতামত দিয়েছেন । পাঠকের মতামত শিরোধার্য করে আমরা ক্রমান্বয়ে সেগুলি প্রকাশ করছি । আজ পাঠ প্রতিক্রিয়ার দ্বিতীয় পর্ব  -----


সুজয় যশ তাঁর নিবিড় পাঠ প্রতিক্রিয়ায় জানাচ্ছেন----- 

"সম্পাদকীয়"   আপনার এই সৃজনশীলতাকে আগলে রাখার যে সুন্দর প্রচেষ্টা ,তাতে সাথে থাকব আমৃত্যু । সবাই আসুক সাহিত্যের আলোয় নিশ্বাস নিই প্রাণ ভরে ।

গৌরীশঙ্কর দে  আপনার কাছে শিখে চলি নিত্য ।

"প্রিয় কবি প্রিয় কবিতা * সুভাষ মুখোপাধ্যায়"  যতবার এ লেখা পড়ি একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে । ভেতর থেকে কে যেন বলে ওঠে লাগছে, আমার লাগছে খুব , ফুলগুলো সরিয়ে নাও এবার ।

"উপন্যাস * দেবাশিস সাহা"  পরের অংশের অপেক্ষায় রইলাম দাদা। বেশ ভালো লাগছে ।

"অণুগল্প * শর্বরী চৌধুরী"  দিদি মন খারাপ হয়ে গেল । তবে খুব সুন্দর লেখা ।

"কবিতা বিষয়ক গদ্য * পারমিতা ভৌমিক"  আপনার এই গভীর বিশ্লেষণ আরও ভালো ভাবে চিনতে শেখায় বুঝতে শেখায় । শ্রদ্ধা জানাই ।

"শ্রীময়ী দে" এই প্রথম আপনার লেখা পড়লাম । বিস্মিত হলাম, আপনার ভাবনার অভিব্যক্তি দেখে । শ্রদ্ধা জানাই কলমকে ।

"রামকৃষ্ণ মাহাতো"  ভীষণ ভালো লেখা দুটি কবিতা ।

"পলাশ দাস"  খুব সুন্দর আপনার লেখা ।

"উদয় ভানু চক্রবর্তী" মন্তব্য করার ধৃষ্টতা দেখাতে পারলাম না । অসাধারণ ।

"দেবার্ঘ সেন"  পোড়া পেন্সিলের মৃতদেহ.... মনে থেকে যাবে এ কথা ।

"গৌতম রায়"  খুব ভালো লেখা ।

"গোবিন্দ মোদক"  বুকের ভেতর আস্ত নদী, আহা কি অপূর্ব লিখলেন !

"মৃন্ময় মাজী"  দুটি কবিতা আলাদা সত্তায় অনন্য ।

"নিমাই জানা"  অসাধারণ বললেও কম হয় । আপনার লেখায় একটা অন্য মাধুর্য ।


রামকৃষ্ণ মাহাতো লিখছেন ,"পঙ্কজ মান্না"-র কবিতা সম্পর্কে  ‘কী কথা উহারা বলে ’ মুচড়ে মরা যন্ত্রণা'রা ঠাঁই পেয়েছে কবিতায় । ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করবো, এরকম কবিতা পড়ার জন্য আরো একটা প্রেমিক জন্ম যেন পাই ।

"শতদল মিত্র"-র কবিতা সম্পর্কে   তারপর বলো , --কবি , তুমি নষ্ট ! ... ডুবে যাওয়া যায় এইরকম লাইনে ,লেখাতে ।

ধৃতিরূপা দাস "শতদল মিত্র"-র কবিতা সম্পর্কে লিখছেন  মনুর সন্তানেরা সত্যই নিরক্ষর দাদা। সহজে বুঝবে না। আহা, আরাম হয় আপনাদের কবিতা পড়লে...

তৈমুর খান "পলাশ দাস"-র কবিতা সম্পর্কে লিখছেন "দু একটা লোক আলো হাওয়া" লোককে এভাবে ভাবতে পারাটাই একজন প্রকৃত কবির কাজ।

স্বপন নাগ  দেবাশিস সাহা-র উপন্যাস ধুলোর সিংহাসন (পর্ব * ছয় ) পড়ে জানাচ্ছেন----- 

আগের কিস্তিগুলো পড়িনি। এটি পড়লাম। উপমাকে ঘিরে অশোকের পিতৃস্নেহ বিবৃত আছে ডায়েরির পাতায়। একুশ বছর পর খুঁজে পেয়ে বিহ্বল এক পিতার কাছে যেন পুরনো দিনকে খুঁজে পাওয়ারই উত্তাল এক অস্থিরতার সাবলীল বর্ণনায় ঋদ্ধ এই কিস্তি। এরপর? এমন আগ্রহ তৈরি হয় বৈকি। আর সেই আগ্রহকে চারিয়ে দেওয়াই তো উপন্যাসের গুন। চোখ ভীষণ বিরোধিতা করে ওয়েব ম্যাগাজিনের লেখা পড়তে। তবু অপেক্ষায় থাকব পরেরটুকু জানবার উৎকন্ঠায়।

"অনুবাদ কবিতা * সুধাংশুরঞ্জন সাহা"  সম্পর্কে স্বপন নাগ লিখছেন  প্রাপ্তি। মীনা কুমারী শায়েরী লিখেছেন, এই তথ্যটিই আমার মনে হয়, আমার মত অনেকের কাছেই অজানা। ফলে, এই পাঠ এক অনন্য প্রাপ্তি। আমার বিশ্বাস, এমন প্রকাশনা যে কোন পত্রিকার পক্ষেও যথেষ্ট গর্বের।

সমিত পালিত "অণুগল্প * দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়" সম্পর্কে  লিখছেন    আগে অনেক বেশি ধন্যবাদ ও নমস্কার জানাই। খুব ই ভালো লাগলো অনুগল্পটি পড়ে। সত্যিই বিন্দুর মধ্যে সিন্ধু এঁকেছেন আপনি। আগামী দিনে আরও বেশি পাওয়ার আশায় থাকলাম। "বেশি পাওয়ার এই আশা কিন্তু আমায় দুঃখ দেবেনা।

( আগামী পর্বে )

সোমবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

প্রিয় কবি লেখক এবং পাঠকদের প্রতি

 





স্বরবর্ণ * ছয় * ২০২২   সংখ্যাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত আমাদের অকপটে জানান । প্রাপ্ত মতামতগুলি আমরা ক্রমান্বয়ে প্রকাশ করব ২৫ ফেব্রুয়ারি পর থেকে । 


**********************

স্বরবর্ণ * সাত  * ২০২২  

দ্বিতীয় বর্ষ

*************************

প্রকাশিত হবে আগামী  ১৫ এপ্রিল  ২০২ 


* এই সংখ্যার জন্য আপনার মৌলিক ও অপ্রকাশিত লেখা ( গল্প কবিতা প্রবন্ধ  অণুগল্প  অনুবাদ কবিতা  ভ্রমণ কাহিনি  ইত্যাদি  ) ১৫ মার্চ  ২০২- এর মধ্যে পাঠিয়ে দিন । 

* শব্দসীমা অনির্দিষ্ট। 

কবিতার ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুটি কবিতা পাঠাবেন  

* লেখার সঙ্গে আপনার একটি ছবি এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, প্রকাশিত গ্রন্থ (থাকলে)  ছবিসহ পাঠান । 

* "স্বরবর্ণ " সামগ্রিক চিন্তার ফসল। প্রতি দুমাস অন্তর মাসের ১৫ তারিখ বেরো আগে থেকে লেখা পাঠানপরিকল্পনার সুবিধার জন্যলেখা পাঠাবেন ওয়ার্ড ফাইলে, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ই-মেইল বডিতে টাইপ করে 


* হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর   8777891532

*ই-মেইল --- debasishsaha610@gmail.com 


সম্পাদকমণ্ডলী                                                   

 ড : শুভঙ্কর দে           অলোক কোৱা

সৌম্যজিৎ দত্ত             দেবাশিস সাহা  

স্বরবর্ণের অন্তরঙ্গ কিছু বই

 


স্বপন চক্রবর্তী বহু অবিস্মরণীয়  গ্রন্থের প্রণেতা |

 তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত গ্রন্থ ----


মিথ্যার দ্বিপাক্ষিক চুক্তি * লৌকিক মাঘোৎসব * আত্মপ্রতিকৃতি * গীতবিতানের হাট 

যে কুসুম নিজের নাম না -জেনেই ফুটে আছে * স্মৃতি স্বপ্ন কান্না দরবারি *

হেমন্তের কাক তুমি অপরাহ্নের ডাক ইত্যাদি |




শুভঙ্কর দে  সম্পাদিত 

Health has a History Revisiting Bengal

বিজ্ঞানের ইতিহাস ভবিষ্যতের সন্ধান 

ভারতের সামাজিক ইতিহাস  









দীপংকর রায় 

কবিতার বই  *  

অন্তর অয়ন * আঁধার আলোকলতা *   অপ্রচলিত 

আর এক শরণার্থী দিন * মৎস্য কুমারীর জোছনা 



         



কবিতা উপন্যাস

অসমাপ্ত ছোঁয়া * ছায়ার খিদে *

গল্পগ্রন্থইচ্ছে পতঙ্গের  কান্না    আত্মজৈবনিক  উপন্যাস কোথাকার অতিথি আমি  

 





আমি-ই তোমার একমাত্র সাক্ষী , আমি-ই তোমার একমাত্র প্রতিপক্ষ



মাধুরী দাশগুপ্ত

বাতাসে কার কান্না


 

শুভজিৎ গুপ্ত  

পাখিদের আহিরভৈরব 


দেবাশিস সাহা 

    কবিতার বই 

তোমায় খুঁজে ফিরি * স্বামী নির্বাণানন্দ




মায়ের কথা 

স্বামী নির্বাণানন্দ


(৪)

মাস পাঁচ-ছয় পর ছোট্ট একটা ঝুলি নিয়ে একদিন শেষ রাত্রে গঙ্গা স্নান করে কাশীর উদ্দেশ্যে মঠ থেকে বেরলাম। একগাছা লাঠি একহাতে, আরেক হাতে একটা কমন্ডলু। তখন ব্রহ্মচারী, তাই সাদা কাপড়। একটা কাপড় কেটে অর্ধেক পরেছি, অর্ধেক গায়ে দিয়েছি। একা একা গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে বুঝলাম পায়ে হেঁটে যাওয়া মায়ের ইচ্ছা নয়। খুব অসুস্থ এবং দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। দুইদিন প্রায় কিছুই পেটে পড়েনি। মাঝে মাঝে মায়ের প্রতি অভিমান হচ্ছে। তৃতীয় দিন সকালে পথে একটা বড় আম গাছের তলায় ক্লান্ত হয়ে শুয়ে আছি। মনে মনে বলছি, মা তুমি আশীর্বাদ করলে, তার ফল কি এই? খানিক বাদে ওই গাছের তলায় একটা মোটর গাড়ি এসে দাঁড়াল। সেই গাড়ি থেকে একটা পরিবার নামলেন। তারা ঐ গাছের ছায়ায় বসে খাওয়া দাওয়া করবেন। আমি শুয়েই আছি। কে কি তা দেখার মত মন বা ইচ্ছাও নেই। হঠাৎ এক পরিচিত পুরুষ কন্ঠের আওয়াজ, -'সূর্যি মহারাজ না? কি ব্যাপার, এখানে? তাকিয়ে দেখি মঠের এক পরিচিত ভক্ত। কাশী যাচ্ছি শুনে বললেন, -'চলুন আমাদের গাড়িতে। আমরা মধুপুর যাব। যতখানি সম্ভব এগিয়ে দেব।' আমি বললাম, -'ধন্যবাদ, কিন্তু আমি যে পদব্রজে যাব সঙ্কল্প করেছি।' তখন ভদ্রলোক তাদের সঙ্গে আনা নানা খাবার থেকে আমাকে পরোটা, ফল, মিষ্টি দিয়ে আগে খাওয়ালেন। কমন্ডলুতে জল ভরে দিলেন। খেলাম, কিন্তু তাদের অনেক অনুরোধেও গাড়িতে উঠলাম না বা পয়সা নিলাম না। কিছুক্ষণ পর খাওয়া-দাওয়া করে ওরা চলে গেলেন। আবার আমার যাত্রা শুরু হলো। হাঁটছি তো হাঁটছি। খালি পায়ে হাঁটার জন্য পায়ে ফোসকা পড়ে গিয়েছে, গায়ে ব্যথা। দিনে কষ্ট হয় বলে রাত্রেই বেশি হাঁটি। এভাবে আরো তিনটে দিন গেল। এই তিনদিন কয়েকটা পেয়ারা ছাড়া পেটে আর কিছু পরেনি। মনে হলো ওই ভদ্রলোকরা তাদের সঙ্গে গাড়িতে করে আমাকে এগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি তা শুনিনি। মা আমাকে বলেছিলেন, -'ইচ্ছে করে অনর্থক কঠোরতা করবেনা'। ভক্তটির কথা না শুনে মায়ের কথার অবাধ্য হয়েছি, তাই বোধ হয় এই কষ্ট।  ভিক্ষা চাইতে গেলে লোকের উপহাসের পাত্র হয়েছি। সাদা কাপড়ে ব্রহ্মচারীর পোশাকও হয়তো ভিক্ষা না পাওয়ার একটা কারণ। যাই হোক প্রতিদিন মাইল বিশেক করে হাঁটতাম। এভাবে যাত্রার সপ্তম দিন সন্ধ্যায় বাংলা-বিহার বর্ডারে একটা গ্রামে গিয়ে পৌঁছলাম। জায়গাটা হাজারীবাগ জেলার একটি গ্রাম।


(৫)

     গ্রামটির নাম বীরপুর। খোঁজাখুঁজির পর একটা শিব মন্দিরের সন্ধান পেলাম। সেখানেই রাতের মত আশ্রয় নিলাম। প্রচন্ড মশা, বুঝলাম রাত্রে সেখানে থাকা অসম্ভব হবে। বসে বসে মশা তাড়াচ্ছি। আবার মায়ের আশীর্বাদের খেলা দেখলাম। প্রায় রাত্রি নটার সময় মন্দিরের পূজারী এলেন। আমাকে খুঁটিয়ে দেখলেন। বয়সে যুবক। আমাকে কয়েকটি প্রশ্ন করলেন। তারপর পূজায় বসলেন। পূজা শেষ হলে আমাকে বললেন, -'মেরে সাথ ঘরমে চলিয়ে। ইঁহা রাতমে ভালু ঔর জানওয়ার ভী আতা হ্যায়।'  আমি 'না' বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু মায়ের কথা মনে পরল - 'ইচ্ছে করে কঠোরতা করবে না'। কাজেই বিনা বাক্যব্যয়ে তার সঙ্গ নিলাম। পূজারীর সঙ্গে তাদের বাড়িতে গেলাম। বেশ সম্পন্ন পরিবার। পূজারীর বৃদ্ধা মা আমাকে দেখে খুব খুশী হলেন। জপ-আহ্নিক করার জন্য তাদের ঠাকুরঘরে আমাকে বৃদ্ধা নিয়ে গেলেন। ঠাকুর ঘরে গিয়ে আমি তো চমকে উঠলাম। দেখি, যে দেবদেবীদের মধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণের ছবিও রয়েছে। অভিভূত হয়ে গেলাম। চোখে জল এসে গেছে নিজের অজান্তেই। বাংলা-বিহার সীমান্তে এই অজ পাড়াগাঁয়ে কিভাবে তিনি এলেন? মনে যে কি আনন্দ আর বিশ্বাস এল তা কি বলব! বৃদ্ধার স্নেহে যত্নে তিনরাত্রি ওখানে আটকে থাকলাম। খিচুড়ি, মালপোয়া কত কি নিজের হাতে বানিয়ে তিনি খাওয়ালেন আমাকে। পায়ের ফোস্কায় মলম লাগালেন। পায়ের মচকে যাওয়া ব্যাথায় চুন-হলুদ দিলেন। তিনদিন পরে মনে হলো আমি বেশ সুস্থ হয়েছি, এবার আবার হাঁটা শুরু করতে পারি। কিন্তু সেই বৃদ্ধা বললেন, -'না বাবা, তুমি এখনো দুর্বল। একা এতটা পথ হেঁটে কাশীতে গিয়ে তুমি আর তপস্যা করতে পারবে না। এই তোমার ট্রেনের টিকিট। তুমি ট্রেনে যাবে।' মায়ের কথা মনে পড়ল, কাজেই এবারেও 'না' বলতে পারলাম না। তারা আমাকে কাছাকাছি একটা স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে তুলে দিলেন।

     বৃদ্ধা এবং তার ছেলের কাছে তাদের ঠাকুর ঘরের ছবিটির ইতিহাস শুনেছিলাম। ছেলেটি একবার কাশী বেড়াতে যান। সেখানে একটা হোমিওপ্যাথি ওষুধের দোকানে ক্যালেন্ডারে ঠাকুরের ছবিটা দেখে চেয়ে নিয়ে আসেন। মনে হয় এম ভট্টাচার্যের দোকান থেকে। দোকানেই জিজ্ঞেস করে জেনেছিলেন যে ছবিটি শ্রীরামকৃষ্ণের, -'রামকিষেণ- কই বাঙালি অবতার হোঙ্গে'। মা ও ছেলে দুজনেই বললেন, -'লেকিন ইয়ে ফটো ঘরমে লে আনেকা বাদ সব কুছ আচ্ছা চল রাহা হ্যায় (কিন্তু এই ফটোটি ঘরে আনার পর থেকে সংসারে সবকিছু ভালভাবে চলছে)। ফটোটি তিনি কেন দোকান থেকে চেয়েছিলেন তা জিজ্ঞাসা করায় তার ছেলে বললেন, -'রামকৃষ্ণের চোখ দুটিতে যেন একটা জাদু আছে। এই চোখ দুটি আমাকে বড় টানছিল। তাই ক্যালেন্ডারটি চেয়েছিলাম। পরে ফ্রেমে বাঁধিয়ে নিই।'

    

(৬)

      যাইহোক, ট্রেনে কাশী পৌঁছলাম। বৃদ্ধা এবং তার ছেলে আমাকে আরো কয়েকটা দিন তাদের বাড়িতে রাখতে চেয়েছিলেন। শেষে অনেক করে বলে তাদের রাজি করিয়েছিলাম এবং চারদিনের দিন ওদের একান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিদায় নিলাম। কাশী পৌঁছান পর্যন্ত আর কোনো অসুবিধা হয়নি। দেখলাম মঠ থেকে বেরোনোর পর মা আমার সঙ্গে সঙ্গেই ছিলেন।

      ‎মা বলেছিলেন, -'সেবাশ্রমে থাকবে, আর খুব ইচ্ছে হলে বাইরে মাধুকরী করে খেতে পার।' কিন্তু তপস্যার প্রবল প্রেরণায় আমি ঠিক করলাম -যেকটা দিন তপস্যা করব, বাইরেই থাকব। সেবাশ্রমে থাকলে বাসস্থানের নিশ্চিন্ততায় তপস্যার ক্ষতি হবে। সুতরাং বাইরে থাকবো এবং ভিক্ষা করে খাব। গঙ্গার কাছে একটা পুরনো বাগানবাড়িতে জায়গাও পেলাম এবং সত্যি সত্যিই কেবল ভিক্ষার ওপর নির্ভর করে ধ্যান- জপ-তপস্যায় দিন কাটাতে লাগলাম। যেখানে থাকতাম সে জায়গাটা মোটেই স্বাস্থ্যকর ছিলনা। নানারকম পোকামাকড় ও মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ হতে হতো। বুঝলাম, কেন মা সেবাশ্রমে থাকতে এবং খুব ইচ্ছে হলে মাধুকরী করে খেতে পারি বলেছিলেন। উত্তর ভারতের মাধুকরীর ডাল-রুটি আমার সহ্য হলো না, শীঘ্রই দুর্বল বোধ করতে লাগলাম। মনে হল, মনের উৎসাহ যেন কমে আসছে। মনে উদ্দীপনা আনার জন্য পূজ্যপাদ লাটু মহারাজের কাছে গেলাম। তিনি তখন সেখানে গঙ্গার কাছে একটা ঘাটে থাকতেন। আমাকে দেখে তিনি পরম স্নেহে বললেন, -'সুয্যি, তোমার কি হয়েছে? এত দুর্বল দেখাচ্ছে? আমার মনে হচ্ছে, ভিক্ষা তোমার সহ্য হচ্ছে না। ঠিক আছে, এই দুই টাকা তুমি রাখ -মাস্টার মশাই আমাকে প্রতিমাসে পাঠান দুধ খাওয়ার জন্য। ঠিক আছে এই দু টাকা তুমি নাও। এই দিয়ে আজ থেকে প্রতিদিন একটু দুধ খাবে' কিন্তু তিনি নিজেই তো অত্যন্ত কৃচ্ছতা করে থাকতেন। খুব খারাপ লাগছিল তাঁর কাছ থেকে টাকা নিতে। কিন্তু আমার মায়ের কথা মনে পড়ল -ইচ্ছে করে কঠোরতা করবেনা। কাজেই নিতে বাধ্য হলাম। চোখে জল এসে গেল তাঁর ভালোবাসা দেখে।




প্রিয় কবি প্রিয় কবিতা * সুভাষ মুখোপাধ্যায়





এই বিভাগে আমরা এমন দু-একটি  কবিতা পড়ব , যে কবিতা আমাদের অন্তর্লোকে বিস্ময় সৃষ্টি করে শুধু নয় ,আমাদের কবিতা পড়ার আনন্দে অবগাহন করায় , প্রতি দিন  প্রতি মুহূর্তে | এই পর্যায়ের কবি যে সবসময়  বিখ্যাতই  হবেন , এমনটা নয় , তিনি অখ্যাত তরুণ তরুণতর কবিও হতে পারেন , কিন্তু ,শর্ত একটাই ,কবিতাটি যেন আমাদের মর্মলোক স্পর্শ করে | স্বরবর্ণ / ৬    সংখ্যায় 'প্রিয় কবি  প্রিয়  কবিতা ' বিভাগের কবি হলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায় |






পাথরের ফুল

( মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর লেখা )

সুভাষ মুখোপাধ্যায়


 ফুলগুলো সরিয়ে নাও,

 আমার লাগছে।

মালা জমে জমে পাহাড় হয়

ফুল জমতে জমতে পাথর।

পাথরটা সরিয়ে নাও,

আমার লাগছে।


এখন আর

আমি সেই দশাসই জওয়ান নই।

রোদ না,জল না,হওয়া না ----

এ শরীরে আর

কিছুই সয় না।


মনে রেখো

এখন আমি মা-র আদুরে ছেলে-- 

একটুতেই গলে যাব।


যাব বলে

সেই কোন সকালে বেরিয়েছি--- 

উঠতে উঠতে সন্ধে হল।

রাস্তায় আর কেন আমায় দাঁড় করাও?


অনেকক্ষণ থেমে থাকার পর

গাড়ি এখন ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে চলছে।

মোড়ে ফুলের দোকানে ভিড়। 

লোকটা আজ কার মুখ দেখে উঠেছিল?


ঠিক যা ভেবেছিলাম

হুবহু মিলে গেল।

সেই ধুপ,সেই ধুনো, সেই মালা,সেই মিছিল---

রাত পোহালে

সভা -টভাও হবে।

(একমাত্র ফুলের গলায় জড়ানো কাগজে লেখা /নামগুলো বাদে)

 সমস্তই হুবহু মিলে গেল।

মনগুলো এখন নরম ---

এবং এই হচ্ছে সময়।

 হাত একটু বাড়াতে পারলেই

ঘাট -খরচাটা উঠে আসবে।


এক কোণে ছেড়া জামা পরে

শুকনো চোখে 

দাঁতে দাঁত দিয়ে 


ছেলেটা আমার 

পুঁটুলি পাকিয়ে বসে।

বোকা ছেলে আমার

ছি ছি এই তুই বীরপুরুষ?

শীতের তো সবে শুরু---

এখন কি কাঁপলে আমাদের চলে?


ফুলগুলো সরিয়ে নাও,

আমার লাগছে।

মালা জমে জমে পাহাড় হয়

ফুল জমতে পাথর।

পাথরটা সরিয়ে নাও,

আমার লাগছে।


 ৩

ফুলকে দিয়ে

মানুষ বড় বেশি মিথ্যে বলায় বলেই 

ফুলের ওপর কোনোদিনই আমার টান নেই।

তার চেয়ে আমার পছন্দ 

আগুনের ফুলকি

যা দিয়ে কোনোদিন কারো মুখোশ হয়না।


ঠিক এমনটাই যে হবে,

আমি জানতাম।

ভালবাসার ফেনাগুলো একদিন উঠবে উঠবে 

এ আমি জানতাম।

যে বুকের 

যে আধারে ভরে রাখি না কেন

ভালোবাসাগুলো আমার

আমারই থাকবে।


রাতের পর রাত আমি জেগে থেকে দেখেছি 

কতক্ষণে কিভাবে সকাল হয় 

আমার দিনমান গেছে 

অন্ধকারের রহস্য ভেদ করতে। 

আমি এক দিন এক মুহূর্তের জন্যেও 

থামি নি।

জীবন থেকে রস নিংড়ে নিয়ে 

বুকের ঘটে ঘটে আমি ঢেলে রেখেছিলাম 

আজ তা উথলে উঠল।


না।

আমি আর শুধু কথায় তুষ্ট নই

যেখান থেকে সমস্ত কথা উঠে আসে 

যেখানে যায় 

কথার সেই উৎসে

নামের সেই পরিণামে,

জল- মাটি -হাওয়ায় 

আমি নিজেকে মিশিয়ে দিতে চাই।


কাঁধ বদল করো।

এবার

স্তূপাকার কাঠ আমাকে নিক। 

আগুনের একটি রমণীয় ফুলকি

আমাকে ফুলের সমস্ত ব্যথা 

ভুলিয়ে দিক।।



উপন্যাস * দেবাশিস সাহা





ধুলোর সিংহাসন

পর্ব * ছয়

দেবাশিস সাহা 


[ পূর্বানুষঙ্গ : বাড়ি পৌঁছেই অশোক স্ত্রী অলির চিৎকার শুনতে পায়। না পড়ে মেয়ে উপমা কানে হেডফোন গুঁজে কথা বলছিল,অথচ দুদিন বাদে বিএ ফাইনাল। চিৎকার চেঁচামেচি থামিয়ে অশোক ঘরের শান্ত পরিবেশ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে।রাতে খেয়েদেয়ে তিন জনে শুয়ে পড়ে। শুলেও অর্থ চিন্তায় অশোকের ঘুম আসেনা। অনেক রাতে যখন দুচোখের পাতা একটু জড়িয়ে এসেছে,অলি ডেকে দেখায়, চাদর মুড়ি দিয়ে উপমা তখনও ফোন নিয়ে ব্যস্ত । 

মেজাজ হারিয়ে অশোক ফোন কেড়ে নিয়ে মেঝেয় আছাড় মারে এবংপরপর দেওয়ালে ঘুসি মেরে নিজেকেও রক্তাক্ত করে। এই ঘটনার কয়েকদিন পর, এক ছুটির দিনে --] 



তোর জন্মকথা

২ /১২/৯৫ * শনিবার 

১৯৭ সুভাষ পার্ক  

                                                                                                                       

তখনও তুই তোর মায়ের গর্ভে। রামকৃষ্ণ মিশন শিশুমঙ্গল হাসপাতালের ভিজিটিং আওয়ারস  চারটা থেকে ছ'টা। কালকের মতো আমি ঠিক চারটেয় পৌঁছেছি হাসপাতালে। গিয়ে দেখি তোর দাদু-দিদা এসেছে। একটু পরে এল মেজবৌদি ও মমতা। আমার মনে তখন অজস্র চিন্তার স্রোত। সমুদ্রের মতো বুকটা উঠছে-নামছে। উপরে উঠে জানা গেল, তোর মাকে লেবার রুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সকাল থেকে স্যালাইন চলছে। ডক্টর গিরি ও ডক্টর বি চৌধুরী চেষ্টা করছেন নর্মাল ডেলিভারির। কিন্তু তা হল না।সাড়ে পাঁচটা নাগাদ আমাকে ডেকে এক মহিলা ডাক্তার জানালেন, এবার ওরা সিজার করবেন। আমাদের সম্মতি চাইলেন। আমি বললাম, 'যা ভালো বুঝবেন,করবেন। আমরা মা ও শিশু দু'জনকেই সুস্থ চাই।' বলে আমি ও তোর দাদু নীচে নেমে এলাম।


          রামকৃষ্ণ মিশন হাসপাতালের লম্বা বারান্দায় আমি তখন অস্থিরভাবে পায়চারি করছি। অসীম উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগের মধ্যে। কিন্তু কাউকে বুঝতে দিচ্ছি না। সবার সঙ্গেই স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে চেষ্টা করছি। ইতিমধ্যে দিলীপ এসেছে ডিউটি থেকে। ও আর আমি বাইরে বেরিয়ে ঘনঘন সিগারেট ধরাচ্ছি। মাঝে দু-একবার বাবলুদা, আমাদের বাড়ির উলটোদিকে ওদের বাড়ি,আমার বন্ধু কানুর দাদা, কাজ করে ওই হাসপাতালেই, এসে আমাদের আশ্বস্ত করে গেছে, চিন্তার কিছু নেই, অপারেশন হয়ে গেলেই ও আমাদের খবর দিয়ে যাবে।


         হলও ঠিক তাই। ৭টা ৪০ নাগাদ বাবলুদাই  প্রথমে এসে আমাদের জানাল তোর জন্মবার্তা। তুই হয়েছিস সুস্থ এবং স্বাভাবিক, জেনে বুকের ভেতর তোলপাড় করা ঢেউ অনেকটা শান্ত হয়ে এল। তুই আমার মেয়ে, তুই ১৯৯২ সালের ২৭ এপ্রিল মেঘের কোলে হারিয়ে যাওয়া আমার মা। কোনওদিন তুই আমাকে, তোর মাকে ছেড়ে ,যাবি নাতো???


৩/১২/৯৫ * রবিবার

১৯৭ সুভাষ পার্ক                                                                                                                                        

                                                                                                                      

              সকালে সিক্স এবং এইটের কয়েকজন এসেছিল পড়তে। ১/১২/৯৫ অলিকে হাসপাতলে ভর্তি করানোর পর থেকে ক'দিন ঠিকমত পড়ানো হচ্ছে না। আজও হল না। কোনওমতে ওদের একটু দেখিয়ে ছুটলাম হাসপাতালে উদ্দেশে। কিছু প্রয়োজনীয় ওষুধ কেনার কথা ছিল। আমার বন্ধু স্বপন এসেছিল। অলি যে হাসপাতলে ভর্তি ও জানত না। স্বপনও আমার সঙ্গে গেল। ওষুধ কিনে হাসপাতালের  এনকোয়ারি সেকশনে জমা দিয়ে,আমি ছুটলাম সোনারপুরে। বড়দাকে খবর দিতে। দুপুরে বড়দার ওখানে খাওয়া-দাওয়া সেরে বৌদি, টুকু ও আমি চারটেয় পৌঁছলাম হাসপাতালে। পাকান আসতে চাইছিল খুব। কিন্তু ওর টেস্ট চলছে। কাল ইংরেজি পরীক্ষা। তাই ওকে আনা হল না। আমরা এসে দেখি অলির মা ও বাবা এসেছেন। একটু পরেই এল মেজবৌদি ও মমতা। আমি প্রথম অলিকে দেখতে গেলাম। ও আছে চারতলায় এ-৩ ওয়ার্ডের সি-৩৯ বেডে। অলি  তখন বেডে শোয়া। সারা চোখে মুখে কালকের ধকল স্পষ্ট। উঠতে পারছে না। বলল একটু আগে নাকি স্যালাইন শেষ হয়েছে। ডাক্তার প্রেসক্রিপশন দিয়ে গেছেন। আমি ছুটলাম ওষুধ আনতে।


            আজ তোর বয়স এক দিন। যারা হাসপাতালে এসেছে,সবাই তোকে দেখার জন্য ব্যস্ত। আমি অবশ্য কালকেই তোর জন্ম হওয়ার আধ ঘণ্টার মধ্যেই তোকে দেখেছি। এমনিতে নিয়ম নেই। কিন্তু বাবলুদাই ভিতরে  নিয়ে গেল। তোর হাতের নম্বর ছিল ৪২৫ । বাবলুদা বলতেই একজন নার্স তোকে নিয়ে এল। কাচের ছোট ফুটো দিয়ে তোকে দেখলাম। সাদা কাপড়ে পেঁচানো তোর মুখটুকুই শুধু দেখা যাচ্ছিল। তোর চোখ বোজা। গালটা অসম্ভব লালাভ দেখাচ্ছিল।


           বড়বৌদি,টুকু,মেজবৌদি, মমতা তোর দাদু-দিদা সবাইকে নিয়ে সেই কাঁচের ঘরে গেলাম। সবাই তোকে দেখল উৎসুক হয়ে। ফেরার পথে আমি বড়দির বাড়ি হয়ে এলাম। তোর জন্মবার্তা দিয়ে।



৪ /১২/৯৫ * সোমবার 

১৯৭ সুভাষ পার্ক                                                                                                         


                 আজও সকালে হাসপাতালে গেলাম। একজন আয়া ঠিক করে এলাম। তোর ও তোর মাকে  দেখার জন্য। দুপুরে মেজবৌদির কাছে খেয়ে একটু ঘুমিয়ে তিনটে পনেরো নাগাদ বেরোলাম হাসপাতালে উদ্দেশে।


               গিয়ে দেখি, আজ তোকে তোর মায়ের কাছে দিয়ে গেছে। এইটুকুন পুঁচকি তুই, শুয়ে আছিস তোর মায়ের বাঁ দিকে কাত হয়ে। আমি ভালো করে তোকে দেখছিলাম। বড়সড় খেলার পুতুলের মত লাগছিল তোকে। ছোট্ট ছোট্ট এইটুকুন হাত-পা। আঙুলগুলো কী ছোট! এর আগেও অনেকবার ছোট বাচ্চা দেখেছি, কিন্তু এত ভালো করে,এত কাছ থেকে,এত মনোযোগ দিয়ে দেখিনি তো! তাই অবাক লাগছিল---এই তুই এক দিন কত বড় হবি! হাঁটতে শিখবি, স্কুল যাবি, কলেজ যাবি, চাকরি করবি, না না চাকরি না, আমার ইচ্ছে তুই ডাক্তার হবি, খু..উ..ব বড় ডাক্তার। কী রে ,পারবি না হতে? আমি আর তোর মা ,আমরা দু'জন , আমাদের সবকিছু দিয়ে তোকে মানুষের মত মানুষ করব।দ্যাখ,আজ তোর বয়স সবে দুই দিন। আর এখনই আমি কত কত বছর পরের স্বপ্ন দেখছি,তোকে নিয়ে--। আসলে স্বপ্ন ছাড়া কি বাঁচা যায়? নাকি বাঁচতে পেরেছে কেউ কোনওদিন? যে ভিখারি সে-ও একটি উজ্জ্বল রুটির স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখা মানুষ মাত্রেরই স্বধর্ম।


              যাইহোক, তোকে দেখে আমি তো তন্ময় হয়ে এইসব ভাবছিলাম, হঠাৎ তাকিয়ে দেখি বড়দা এসেছে। একটু দূরে দুলালদা, তোর পিসা। আর তোর মাথার দিকে দাঁড়িয়ে তোর দাদু। এর পর হাসপাতালের ক্যান্টিন থেকে তোর জন্য প্রথম জামা কিনলাম, তেরো  টাকা করে দুটো। সেইসাথে একটা অয়েলক্লথও, যেটার উপর তুই শুবি। আপাতত। ছ'টায় বেল বাজতেই বড়দা ও দুলালদা এবং তোর দাদু চলে গেল। আমি রয়ে গেলাম, মহারাজের সঙ্গে কথা বলে, আয়ার থাকার পারমিশন নেওয়ার জন্য। কাজ সেরে ন'টা নাগাদ বাড়ি ফিরলাম।


   

রবিবার সকালে স্তুপীকৃত বইপত্র গোছাতে গিয়ে  হঠাতই  চোখে পড়ল বহুকালের পুরনো একটা ডায়রি।পৃষ্ঠা উল্টাতেই খুলে গেল ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বর মাসের ২ তারিখের 'তোর জন্মকথা ' শিরোনামের এই লেখাগুলো।এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলল ২, ৩ এবং ৪ তারিখের  রোজনামচা। মনের আকাশে ঝিলিক দিয়ে উঠল স্মৃতির বিদ্যুৎ। একুশ বছর আগের মুহূর্তগুলো যেন কাটা মাছের মত ছটফট করতে লাগল চোখের সামনে...


            ভুলে যাচ্ছে অশোক আজ রবিবার। কাল থেকে শুরু উপমার পরীক্ষা । ও ঘরে পড়ছে এক মনে। সকালের টিফিন করতে ব্যস্ত অলি। ঘুম থেকে উঠে নিজেই বায়না করে এসেছে, ' অলি,আজ আর রুটি তরকারি না, টিফিনে চিড়ের পোলাও করো। রোজ রোজ এক খাবার ভালো লাগে না।' কথা শোনাতে ছাড়েনি অলিও, 'তুমি তো অর্ডার দিয়েই খালাস। চিড়েটা, ডিমটা আর একটু আলু-পিয়াজ এনে দাও নতুন বাজার থেকে।’

 ' তবে থাক। '

' থাকবে কেন, যাও না জিনিসটা একটু এনে দাও।'

' দেখ, আজ আমার অনেক কাজ। বইপত্রগুলো সিস্টেমেটিক্যালি গোছাতে  হবে , যখন যে -বইটা পড়ার ইচ্ছে হয়, কিছুতেই খুঁজে পাইনা, তারপর ---- ' মুখের কথা কেড়ে নিয়ে অলি বলল, 'দোকান থেকে এসে গোছাও না, কে বারণ করেছে, আজ তো পড়ানোও নেই।'

'নেই না, ছিল। ছুটি দিয়েছি। এই কাজটা করব বলে। তা ছাড়া উপমার পড়াগুলোও  একবার রিভিশন করাব, এখন ও পড়ছে,পড়ুক।'

 'তাহলে তুমি যাবে না?'

'না।'  বলল বটে, সাথে সাথে ভাবল, উপমাকে আজ অলি কিছুতেই দোকানে পাঠাবে না আর অলিকে  যেতে হলে এখন আবার ড্রেস চেঞ্জ করতে হবে,অতগুলো সিঁড়ি ঠ্যাঙাতে হবে। তা ছাড়া ওরও তো কত কাজ বাকি। সবে ঘর ঝাঁট দেওয়া হয়েছে, এখনও ঘর মোছা,কাচাকাচি,স্নান, ঠাকুর পুজো,রান্নাবান্না রাজ্যের কাজ পড়ে আছে ।

'ঠিক আছে,যাচ্ছি দাও।'


তারপর জিনিসগুলো এনে দিয়ে বসেছে বই গোছাতে। তারমধ্যে চোখে পড়ল ডায়রিটা...তোর জন্মকথা... আর অমনি ওলট-পালট অতীত-বর্তমান... ভুলতে শুরু করেছে পরিপার্শ্ব। কানে আসছে না আর উপমার পড়ার শব্দ। অলির  হাতা খুন্তির ঠুং ঠাং। চিঁড়ের পোলাও-এর সুবাস।


           

সত্যি, সময় কীভাবে,কত অবলীলায় ছিনিয়ে নেয় জীবনের নানা রঙের মুহূর্তগুলো। তারপর ছুঁড়ে ফেলে বার্ধক্যের আস্তাকুঁড়ে। উপমার জন্মমুহূর্তের সাক্ষী ছিল যারা, তারা অনেকেই আজ বার্ধক্যের ভারে ন্যুবজ। কোথায় ডক্টর গিরি আর ডক্টর বি চৌধুরী ,যাঁরা তোকে প্রথম পৃথিবীর আলো দেখাতে প্রাণপাত করেছিলেন, কী সুন্দর মিষ্টি ব্যবহার , এখনও মনে পড়ে অশোকের ,সেদিন ও খুব টেনশন করছিল দেখে ডক্টর গিরি মৃদু হেসে বলেছিলেন ,চিন্তা করবেন না মিস্টার সাহা ,ইউ আর গোয়িং টু বি এ ফাদার অফ এ হেলথি  চাইল্ড ভেরি সুন । কোথায় আছেন তারা আজ ,কেমন আছেন ,কে জানে ! তখন কিশোর ছিল যারা ,তারা হারিয়েছে ফুটবল খেলার মাঠ, ক্রিকেটের ব্যাট বল। ঘাড়ে পড়েছে সংসারের জোয়াল। আর কিশোরী ছিল যারা ,তারা অনেকেই এখন পাক্কা গিন্নি, দু'এক সন্তানের মা। কারও বা শেষ হয়েছে জীবনের পথ পাড়ি দেওয়া। যেমন তোর দাদুর, ছ'বছর হল তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু আমার চোখে ভাসছে একুশ বছর আগেকার  তোর দাদুর মুখখানা। ঠিক যেমনটি তোর জন্মদিনের দিনটিতে দেখেছিলাম । ধবধবে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি। চোখে হাই পাওয়ারের মোটা ফ্রেমের চশমা । আমরা দু'জন নামছি শিশুমঙ্গল হাসপাতালের  সিঁড়ি দিয়ে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ' মেয়ে হয়েছে, আপনি খুশি তো ?' ঠোঁটে  ঈষৎ হাসি ঝুলিয়ে তিনি বললেন, ' পোলা হইলেই ভালো হইতো। ' বাঙাল ভাষাতেই কথাবার্তা বলতেন তিনি। খাস বাঙাল কিনা । দেশ ভাগের পর এদেশে এসে অর্ধ শতাব্দী পার করে দিলেও কলকাতার পরিশীলিত ভাষার ধার ধারেননি কোনওদিন ,মাতৃভাষার টান তো ! মাটি কেড়েছ ,ভাষাটাকেও কেড়ে নেবে ,অত সহজ ! পঞ্চাশ বছরেও তো পারলে না ,এটাই যেন বোঝাতে চাইতেন বাঙাল ভাষায় উচ্চকিত কথাবার্তা ,অট্টহাসি দিয়ে । ' পোলা হইলেই ভাল হইত' কিন্তু কেন, সেই  কথাটা অবশ্য  আমি মুখ ফুটে শ্বশুরমশাইকে জিজ্ঞেস করতে পারিনি। লিঙ্গ ছাড়া ছেলে এবং মেয়ের মধ্যে কোনও পার্থক্য আছে বলে আমি সেদিনও মনে করিনি,আজও করি না। তোর জন্মের বার্তা বাড়িতে আনার সময় 'গৌরাঙ্গ মিষ্টান্ন ভান্ডার 'থেকে এক হাঁড়ি  রসগোল্লা কিনে এনেছিলাম। বড় বড় রসগোল্লার সেই সাইজটা এখনও যেন চোখে ভাসে ! পাড়া-প্রতিবেশীদের খাইয়েছিলাম আনন্দ করে।


  আর জানিস তো, দিলীপ, তোর পিসতুতো কাকা, সেই একুশ বছর আগের কর্মঠ চনমনে ছটফটে দিলীপকাকাইটি নেই! সে এখন স্নায়ু রোগের শিকার! হাত-পা কাঁপে। কথা বলতে গেলে মাথাটা দোলে এদিক-ওদিক।


   আর সেই বাবলুদা,যে নিয়ম ভেঙে তোর জন্ম মুহূর্তের আধ ঘন্টার মধ্যেই আমাকে দেখার সুযোগ করে দিয়েছিল, সেই বাবলুদা রিটায়ারের পর, আজ স্মৃতিভ্রংশ রোগে ভুগছে। এইতো সেদিন রাতে কী হুলুস্থুলু কাণ্ড ! শরীরে সোডিয়াম পটাশিয়াম লেভেল কমে গিয়ে সে কী  অবস্থা ! খালি চিৎকার করছে। উলঙ্গ হয়ে উঠোনে দৌড়োদৌড়ি  করছে আর অনর্গল বলে চলেছে, ' আমি অফিস যাব,আমি অফিস যাব ' ছেলেমেয়ে বউ কেউ ধরে রাখতে পারছে না।


     আর এই যে আমি,তোর বাবা , আমিও কি আর একুশ  বছর আগের আমিটি আছি ! এখন তো তুই দেখিস একমাথা পাকা চুল,একগাল পাকাদাড়ি,  হাঁটু কোমরের ব্যথায় কাহিল,সুগার প্রেশারের আক্রমণে ধরাশায়ী প্রায় বার্ধক্যে উপনীত তোর বাবাকে। আহা! তুই যদি তোর পঁচিশ বছর আগেকার বাবাকে একবার দেখতে পারতিস! কী দুরন্ত স্ট্রাইকার ছিল সে... বিপক্ষের রক্ষণভাগ ফালাফালা করে দৌড়োচ্ছে ... গোলমুখে... দুই ডিফেন্ডারকে চতুর ডজে কাত করে...  গোলকিপারকে ভেলকি দেখিয়ে... আলতো ছোঁয়ায় গো.. ও...ল। ছিয়াশি আর নব্বইয়ের মারাদোনা তখন রক্তে দৌড়োচ্ছে যে!


   ' কী গো, এই তোমার বই গোছানো?' এক হাতে প্লেটভর্তি চিড়ের পোলাও আর এক হাতে জলের গ্লাস অশোকের সামনে রাখতে রাখতে বলে অলি।


    কোনও সাড়াশব্দ নেই। কাকে ডাকছে অলি? যাকে ডাকছে, সে এখন দু'দিন বয়সি মেয়ের জন্য জামা কিনতে যাচ্ছে, শিশুমঙ্গল হাসপাতালের উল্টো দিকের দোকানে। তেরো  টাকা করে চারটে জামা কিনল। অলি দুটো কিনতে বলেছিল। অলির কোনও  বুদ্ধি আছে! ডিসেম্বর মাস। কী ঠান্ডাটাই না পড়েছে! দু'টো জামায় কী করে হবে? ঘনঘন হিসু পটি করলে গায়ে টানবে না! তাই চারটেই  কিনছে। বন্ধু স্বপনের কাছ থেকে কুড়ি টাকা ধার নিয়ে। দাম দিচ্ছে গুনে গুনে। চার তেরং বাহান্ন। এই নিন বাহান্ন টাকা। কী সুন্দর পুতুলের জামার মতো উজ্জ্বল  রং!



   আর ধৈর্য রাখতে পারে না অলি। পিছন থেকে আচমকা এক ধাক্কা লাগায়, ' কী গো, আবার ধ্যানস্থ হয়েছ? কী দেখছ পোকায় খাওয়া পুরনো একটা ডায়রি খুলে ? অশোকের হাত থেকে ডায়রিটা ছিনিয়ে নেয় অলি। অপ্রকৃতিস্থ দু'টি চোখ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে অলির দিকে।


 'বলি, ক'টা বই গোছালে? কেমন গোছালে দেখি? ' চারপাশে তাকায় অলি, ' কই! যেমন ছিল, তেমনই তো রয়েছে সব।'


  কী কাজ করতে বসেছিল এতক্ষণে মনে পড়ল যেন, ' হ্যাঁ হ্যাঁ গোছাব গোছাব, খাবারটা দাও, আগে খেয়ে নি।' প্লেটটা মুখের কাছে টেনে নিয়ে বলে ' বাহ! বেশ তো ঘ্রাণ বেরিয়েছে!'


   'আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান'  অলির ফোনের কলার টিউন ।

  ' মা, তোমার ফোন।'

  ' কে রে? '

  ' রিনা মাসি,নাও কথা বলো।'

  ' হ্যাঁ, রিনাদি বল। '

  ' কী রে, কেমন আছিস তোরা সব?'

  ' ভালো, তুই গোগল ,প্রদীপদা তোরা সবাই কেমন ?'

   ' সবাই ভালো আছি। শোন যে জন্য ফোনটা করলাম।'

   ' বল।'

   ' উপমার পরীক্ষা কবে শেষ যেন? '

   ' এইতো কাল সোমবার থেকে শুরু, শেষ শনিবার।'

    ' বাহ, শোন, তোর প্রদীপদা বলছিল,গোগলের পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে , উপমারটাও জেনে নাও, তারপর সবাই মিলে দিন সাতেকের জন্য হৈ হৈ করে পুরী ঘুরে আসি, যাবি?'

    অলি উত্তর দেওয়ার আগেই ফোনের কাছে মুখ এনে উপমা লাফাতে থাকে , ' যাব,যাব রিনা মাসি, যাব।'

   ' দাঁড়া ,তোর মা কী বলে আগে শুনি, কী রে,যাবি তো?'

   ' আমার তো খুবই ইচ্ছা,দিন রাত আর হেঁসেল ঠেলতে ভালো লাগে না , দেখি তোদের অশোকবাবু কী বলেন। '

   ' আচ্ছা। তোরা কথাবার্তা বলে দু-এক দিনের মধ্যে জানাস, তাহলে তোর প্রদীপদা সামনের সপ্তাহেই টিকিট বুকিং করে রাখবে।'

 ' আচ্ছা, রাখি তাহলে।'

  ' রাখ।'

  ' ওমা যাবে তো?'


 ' আমি কী জানি,তোমার বাবা জানে।'এবার বাবার গলা জড়িয়ে ধরে আবদার উপমার, ' বাবাই, কী বলবে রিনা মাসিকে? যাবে তো?

 ' দাঁড়াও দেখছি,আগে পরীক্ষাটা তো দাও ভাল করে ।'

' দেখছি টেখছি না, বলো যাবে।'

  ' বলছে তো দেখবে,অত ঝুলোঝুলি করছিস কেন, টিফিন হয়ে গেছে, যা না পড়তে বস গিয়ে। আর তো মাত্র ক'টা ঘন্টা!'

  ' সারাক্ষণ পড়ব নাকি? কোন সকাল থেকে পড়ছি বলতো , একটু বিশ্রাম নেব না! '

  ' হ্যাঁ নিবি, তা এখনও বিশ্রাম হয়নি? আধঘন্টার উপর তো হয়ে গেল গ্যাজাচ্ছিস ?'


          অলি--উপমার কথার মাঝখানে অশোকের ফোনটা বেজে উঠল হঠাৎ। ফোনটা এগিয়ে দেয় অলি। অচেনা নম্বর।

   ' হ্যালো?'

   ' অশোক বসু বলছেন?'

   ' বলছি।'

   ' অশোকদা ,আমি ' অবশ হাতের ক্ষ্যাপা বুলেট' লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক বলছি।'

   ' ও, চিরন্তন বিশ্বাস? বলো ভাই, কেমন আছ? এই অধমের শরণ কেন? '

   ' আমার নাম আপনার মনে আছে দাদা! '

   ' থাকবে না কেন, তরুণ প্রজন্মের অন্যতম শক্তিশালী কবি তুমি। তোমার কবিতা আমাকে খুব স্পর্শ করে। '

  ' ধন্যবাদ দাদা, আপনার একগুচ্ছ কবিতা চাই, আমাদের শারদ সংখ্যার জন্য।'

  ' একটু সময় দিতে হবে কিন্তু ভাই।'

  ' হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি এক মাসের মধ্যে পাঠান না।'

  ' বেশ বেশ, তাই পাঠাব।'

 ' ধন্যবাদ দাদা। এবার বইমেলায় আসছেন তো?'

  ' একদিনের জন্য হলেও যাব। নাহলে বইমেলার  ধুলো কাঁদবে যে!'

  ' দারুণ বললেন তো! '

  ' জানো চিরন্তন, সেই কলেজ লাইফ থেকে এ পর্যন্ত একটা মেলাও বাদ যায়নি। বইমেলাও তো আমাদের আর এক শারোদৎসব, কী বলো?'

 ' ঠিক তাই, দাদা। তাহলে মেলাতে দেখা হচ্ছে। ওখানেই আপনার কপিটা  দিয়ে দেব।'

  ' দিয়ো , কিন্তু আমার একটা অনুরোধ আছে, চিরন্তন।'

  ' কী বলুন।'

  ' তুমি আমাকে আমার কপিটি-সহ আরও পাঁচটি কপি দেবে এবং ছ'টির নির্ধারিত মূল্যই আমি তোমাকে দেব, কোনও কমিশন টমিশন লাগবে না, এবং সেটা তোমাকে নিতে হবে।'

  ' আশ্চর্য লাগছে অশোকদা আপনার কথাটা শুনে। পাঁচ বছর পত্রিকাটা চালাচ্ছি। এরকম কথা কারও  মুখে এ পর্যন্ত শুনিনি। সবাই তো সৌজন্য সংখ্যা পাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকেন। কোনো কারণে না পেলে সম্পাদকের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করেন। '

' সে করেন হয়তো। কিন্তু আমি তো জানি, লিটল ম্যাগাজিনের প্রতিটা পৃষ্ঠায় সম্পাদকের কতটা ঘাম,অশ্রু, ভালোবাসা লেগে থাকে। পয়সা দিয়ে তার মূল্য হয় না,তবুও যতটুকু পারি।'

' মন ভরে গেল আপনার কথা শুনে।'

' আর একটা কথা।'

' বলুন!'

' এমন সব লেখা ছাপো, যাতে ' অবশ হাতের ক্ষ্যাপা বুলেট 'সৌজন্য সংখ্যা পিপাসুদের বুকে গিয়ে লাগে।'

 ' দারুণ! দারুণ!!' এবার হো হো করে হেসে ওঠে  চিরন্তন। হাসতে হাসতেই বলে , 'ভালো থাকবেন দাদা,ভালো থাকবেন।'

' তুমিও।'


পাশে দাঁড়িয়ে  অশোক আর চিরন্তনের কথা শুনে মুখ টিপে টিপে হাসছিল অলি। খুব তৃপ্তি পাচ্ছিল । মনে মনে ক্ষ্যাপা স্বামীর জন্য একটু গর্বও হচ্ছিল যেন। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অশোকের দিকে।

' কী দেখছ?'

' না,ভাবছি। '

' কী?'

' চিরন্তন ' ছেলেটার নামটা যেমন অভিনব, তেমনই পত্রিকার নামটাও  ' অবশ হাতের ক্ষ্যাপা বুলেট...'


( আগামীপর্বে )


উপন্যাস * দীপংকর রায়




'স্বরবর্ণে'র চতুর্থ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে কবি দীপংকর রায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে '। এই উপন্যাস লেখকের ষোল-সতের বছর বয়সের কালপর্ব থেকে শুরু। যদিও লেখকের জন্ম এপার বাংলায়, কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে থেকেছে ওপার বাংলায়। কাজেই যাতায়াত থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ ছেড়ে চলে আসা আর তারই নাছোড় এক টানাটানির মধ্যে যে জীবনের ক্রমাগত আসা আর যাওয়া ,এই উপন্যাস মূলত তারই এক নির্মম নিষ্ঠুর ভাঙা-গড়ার আশ্চর্য কথোপকথন। ধারাবাহিকভাবে যা আমরা পড়ব, কবি দীপংকর রায়ের মায়াময় কলমে।



কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে 

পর্ব * ৩  

দীপংকর রায়


মলি তো ইদানীং দেখতে পাচ্ছি আমার সঙ্গে সঙ্গে গরুর জাবনাও মেখে দিচ্ছে। এই কাজটি ইতিমধ্যে কাজের দিদির কাছ থেকে আমি আয়ত্ত করে নিয়েছি খানিকটা । আমার সঙ্গে সঙ্গে ওরা দু'বোনও বেশ নিষ্ঠার সঙ্গে এই কাজে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসে। 

        ওরা যদিও সকালে আর বিকেলেই আসে ।খানিকটা সঙ্গ দিয়ে এই সময়ের একাকীত্বের জায়গাগুলো ভরিয়ে তোলে। এইসব নানা টুকিটাকি কাজে সঙ্গ দেয় আমায়। সন্ধ্যা-প্রদীপও লাগায় এক একদিন আগ্রহ সহকারেই । এমনকি কখনো কখনো দুপুরবেলাতে বিছানায় আমার পাশে শুয়ে শুয়ে গল্পও করে। 

        অলোকও মাঝে-মধ্যে আসে। অনেকক্ষণ আমার সঙ্গে উঠোনের উপর যে জায়গাটা পরিষ্কার করে বাগান বানাবো বলে রোজ একটু একটু করে কুপিয়ে ঘাস বেছে ফেলছি মাটি থেকে, সে সব কীভাবে করলে আরো ভালো হয় তার খানিকটা পরামর্শও দিয়ে যায়। কারণ ওদের বাড়ির বারান্দার সামনে যে জায়গাটায় যে সব ফুল গাছ লাগানো রয়েছে , সে সমস্তর পরিচর্যা ওই করে বলে জানিয়েছিল আমায়। গাছের গোড়ায় কী কী সার দিতে হয়, তাও তো ওই জানালো, আমি তো একমাত্র গোবর সার ছাড়া আর কিছুই চিনতাম না এর আগে ! না বুঝি আর একটা সার চিনতাম, সে হলো নদীর কচুরিপানা পচিয়ে সার তৈরি করে জমিতে দেওয়া। কিন্তু এখানে আর সেসব কোথায়ই বা পাওয়া যাবে ! তাই এখানে এসেই প্রথম জানলাম ইউরিয়া ফসফেড, হাড়ের গুড়ো, আরো কত কি !

         বর্ষার প্রকোপ এখনো যায়নি । মাটি ভিজে রয়েছে । এর চাইতে ভালো পরিষ্কার আর করা যাবে না। তাই আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে, তারপর ভালো হবে। তা না করলে এই মাটিতে কোনো কাজই করা যাবে না। সামনের ভাদ্র-আশ্বিন মাসে মাটি একটু ঝুরঝুরে হবার মতোন অবস্থাটা দেখতে পেলে তবেই মাটিকে তৈরি করে নিতে হবে। আর তখন যা যা করতে হবে সব বলে দেবে বলেছে ও আমায়। 

         এত পরিপাটি করে ঘরদুয়োর গোছাতে হয় কী করে, তাও ওরাই শিখিয়ে দেয় রোজ একটু একটু করে। খাট বিছানাও গুছোয়, এ যেন আমার ঘরের বোন এরা। 

           এই যে দুই বোনের পালা করে এসে দুই বেলা সমান ভাবে আমাকে সঙ্গ দেওয়া থেকে শুরু করে আজকাল তো ভালোমন্দ রান্না করেও খাইয়ে যায়। আবার এরই মধ্যে ঠাকুরদেবতার সেবা যত্নও সমান ভাবে সময় মতো করে তাও দেখতে পাচ্ছি। তাই এদের আত্মীয় না ভেবে আর কী ভাবতে পারি ? 

          যদিও বাস্তবে তো তার কিছুই না------ সম্পর্কটা হলো আমার দিদির বন্ধু ওদের বড় বোন কৃষ্ণাদি । তা থেকে তো আর কিছু না !ওদের বাড়ির মানুষজনের সমান যাতায়াত। তাই, কলকাতায় ফিরে এসে সেই আমার প্রথম আত্মীয় খুঁজে পাওয়া। এমনই আন্তরিক সম্পর্ক ছিল সেই সব। এমনই অভিজ্ঞতা ছিল কলকাতায় ফিরে এসে প্রথম পর্বের দিনগুলোতে। কী গভীর আন্তরিকতায় আমিও যেন কেবলই সরু লিকলিকে একটি লতা গাছের মতন বড় গাছের অবলম্বন পেয়ে সেই বড় গাছটি বেয়ে লতিয়ে তার শাখাপ্রশাখা জড়িয়ে ধরতে চাইছি। 


           কদিন ধরেই মনে মনে ভাবছি রসিক দাদুকে একখানা চিঠি লেখা হলো না আজ অবধি। দিদিমাও মনে মনে ভাবছে ঠিকই, ও তো কোনোদিন ওর মাকেও কিছু লেখেনি, তার আমার কাছে কী লিখবে ! চিঠি লেখার অভ্যাস থাকা দরকার হয়। লিখেছে নাকি আজ পর্যন্ত কাউকে একখানা কিছু, কই দেখিনি তো তেমন কোনোদিন ; তাই এ নিয়ে আর ভেবে কোনো লাভ নেই। লেখে লিখুক না লেখে না লিখুক, যাক গে-------        


           এসব দিদিমার মনের ভাবনা আমি ভাবছি কীভাবে, নাকি এভাবে ভেবে নিজেকে আড়াল করছি, নিজের অক্ষমতা ঢাকছি ইনিয়ে বিনিয়ে ? কথাটা তাই তো মনে হচ্ছে, তাই নয় কি ? তবু  আমিও দিদিমাকে বললাম যেন, মাকে তো তুমিই লিখতে যা কিছু, দিদিভাই। আমার সব  উপদ্রপের কথাই লিখতে তো একে ওকে ধরে। আবার তাদের তোমার কাছ থেকে শুনে শুনে লেখা হয়ে গেলে, জানতে চেয়ে বলতে, একবার পড়ে শোনা তো দেখি, সব কিছু লিখতে পারলি কি না শুনি একবার। 


           আমার আর আলাদা করে মার কাছে লেখার দরকার পড়তো না। কিন্তু এখানে তোমার মতো লিখে দেবার লোক কোথায় পাই আমি ? এই যে বার বার তোমার মুখের কথা শুনে কাইলে মামা বা কুমারেশ দাদুরা লিখতো, ইদানিং তো সঞ্চয়কে দিয়েও সে কাজ করাতে, তবুও কখনো আমাকে বলতে না কেন যে, তার অর্থ এখন খুঁজে মরছি আমি ------ তখন ভাবিনি ঠিকই, কিন্তু এখন বুঝি কিছুটা। আর এইসব কারণে আমার অভ্যাসটা তৈরি হলো না। অন্তত তখন যদি করাতে, তাহলে আজ খানিকটা পাকাপোক্ত হতো সেই অভ্যাসটা। কেন যে এইসব দিক থেকেও চিরকাল আমার মুখটাকে ঘুরিয়ে রাখলে, তা বুঝতে দিলে না যেন ; এইভাবে আরো কত কিছুর থেকে দূরে সরিয়ে রাখলে, কিছুরই সামনাসামনি হতে দিতে চাওনি।


         যাক গে, এখন যে কথা বলছিলাম, যে চিঠি প্রসঙ্গে ; তোমার এই যে সংশয় তা কি আমার উপরে তোমার ভরসা ছিল না বলেই ? যদি আমি তোমার সব কথা না লিখে দিই, তাই, সেই জন্যেই কি একে ওকে তাকে ধরে বেড়াতে আমাকে বাদ দিয়ে ? একবার ভাবলাম, এত বড় ত্রুটির কথাটা নাই বা বললাম, এখন মনে হলো, নাই বা বলবো কেন ? 

           যদিও এসব ভুলে আজ আমি নিজেই লিখবো। কোনো কিছুই লুকোবো না, সমস্তটাই লিখবার চেষ্টা করবো। লিখবো আমার ওদেশ ছেড়ে চলে আসার নানা কথা। এখানে এখন কেমন আছি না আছি তাও বিস্তারিত সব লিখবো। ভাই তোমাকে এখন কতটা অস্বস্তিতে ফেলেছে তাও জানতে চাইবো। সে কি ঠিক মতো আছে মিলেমিশে ? দাঁড়াও দেখি, একটুখানি ভেবেনি ভালো করে , আজ রাত্রেই তোমাকে এবং রসিক দাদুকে লিখবো, দেখি কী দাঁড়ায় ; এই তো সকাল হলো সবে, বিছানায় গড়াতে গড়াতে এইসব ভাবনা ভাবতে ভাবতেই আজ বিছানায় ছিলাম সকাল বেলাতে ।

           ইলেকট্রিক সংযোগে চলা একখানি রেডিও আছে এখানে। তা অতি যত্নে একখানি কাপড়ের ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখা থাকে। এভাবে এত যত্নের সঙ্গে তাকে রক্ষণাবেক্ষণ করতে দেখে আসছি সেই একাত্তর সাল থেকে। যখন দিদি এ বাড়িতে ছিল , এই রেডিওটি ছিল তার অতি যত্নের, এই সব কিছুকে সুন্দর ভাবে আগলে রাখার স্বভাব ছিল তার একদম অন্যরকম। এত গোছানো টোছানো ভাব হয়তো মার মধ্যেও ছিল না। তাই তার যত্নের বস্তুটি এখনো এ বাড়িতে ঠিক সেভাবেই সমাদর পায়।

               সকালে কাজের দিদি যখন চা-এর  জল বসায় উনুনে, ওদিকে তখন রেডিওতে সকালের সংবাদ হয়। আমি কোনো কোনো দিন বিছানায় শুয়ে শুয়েই সকালের সংবাদটা শুনি। মা রেডিও চালিয়ে দেয়। আকাশবাণীর এই সংবাদ শুনতে শুনতে ঠিকে কাজের লোক সুশীলা মাসি আসে বাসন মাজতে। তার বাসন মাজা হয়ে গেলে কাজের দিদি তাকেও চা দেয়। সে দুই হাঁটু মুড়ে বসে বসে হাতে গড়া রুটি পাকিয়ে চায়ের গ্লাসের মধ্যে চোবায় আর হুস হুস শব্দ করে চা খায়। তার এই ধরণটা সেই একাত্তর সাল থেকে দেখে আসছি , আজও তা  একইরকম আছে দেখতে পাই। এবার চা পান করতে করতে তার পাড়ার সকলের বাড়ির এটা ওটা খবরাখবর বর্ণনা করার থাকে। এ যেন তার নিত্যদিনের একই ধরণ। মাঝে- মধ্যে মা অবশ্য তাকে বারণ করে, বলে, সুশীলা, এসব আলোচনা ক'র না। আমার হাটখোলা বাড়ি, কে কী শুনতে কী শোনে, তারপর তার একটা ভুল মানে করে, নানা অর্থ বের করবে হয়তো; ভাববে, দেখ, আমরা কীরকম অন্যের সমালোচনা করে বেড়াই …!

           সে বলে,  না না দিদি, তুমি কি কিচু বলতিচ নাকি, না আমি তেমন কিচু  কচ্চি, এসব তো সবই কতার পৃষ্টে কতা, তাই একটুখানি কচ্চি ---- এই দ্যাকো না, ওগের যেমন কতা, একেবারে একসঙ্গে সব করাতে পারলেই বাঁচে , আমাগের জানি আরামবিরাম বলে কোনো কিচু  নেই ,যতো সব ! হ্যাঁ….. দাঁড়াও দেকিনি…. তারপর বুজোবানে ক্ষণ, কত ধানে কত চাল…  ;

            এইরকমের নানা কথা তার। মা বারণ করলে বকবক করতে করতে থেমে যায় । এরপর আস্তে আস্তে কাজের দিদিকে কিছু বলে । যেন ওইটুকু শেষ না করতে পারলে তার স্বস্তি নেই ! 

           মা তখন হয়তো কলতলার দিকে চলে গেছে, বা গোরুটার ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া হচ্ছে কি না সেদিকে নজর দিতে গেছে একটুখানি, না হলে হয়তো বাড়ির এদিকটাতে কী হচ্ছে না হচ্ছে তাই নিয়ে তার পর্যবেক্ষণ চলছে। আর সুশীলা মাসি এই ফাঁকে আরো খানিকটা বাকি কথা সেরে নিচ্ছে কাজের দিদির সঙ্গে ফিসফিসিয়ে।

            সেও খুব একটা খেয়াল দিতে চায় না এসবে, তবু না শুনিয়ে সেও ছাড়তে চায় না যেন তাকে। 

            এসব সব আমি চেয়ে চেয়ে দেখি আর ভাবি, এই তো, এত হোইহট্টগোল, একটু পরেই তো এই বাড়িটাতে আমি আর এই কাজের দিদি আর ওই গরুটা ছাড়া আর কেউই থাকবে না।

            মা অফিসে চলে যাবে। আজ যদি শিবানী মলি আসে তো খানিকটা সময় কাটবে, তা না হলে সেই সামনের বাড়ির পেছনের ঝাউবনের মাথার সারী, আর স্তব্ধ দুপুরবেলা, এ ছাড়া আর কে, আমার যেন সময় আর ফুরোতে চায় না।

             আজ একটা কথা মাকে বলবো মনে মনে ভেবে রেখেছি। দেখি মা তার কোনো উপায় বের করতে পারে কি; যদিও জানি মার হাতে এখন তেমন একটা টাকা-পয়সা নেই। কারণ আজ দেখলাম যামিনী দাদুকে মা মাছের দাম সবটা দিতে পারলো না। তাকেও বাজারে যাবার পথে এই নিয়ে দু'তিনবার দেখেছি মাছ দিয়ে যেতে। আজ মা বললো তাকে, আজ কিন্তু সব টাকা দেব না যামিনীদা….. । 

           সে তাতে বেশ খানিকটা তুতলে তুতলে বললো, আ-আ-মি কি চা-আ-ই-ছি নাকি, ও-ও দিদি, তু-উ-উ-মি  না-আ-আ  হয়  আ-আ-জ কি-ই-ছু-উ-ই  দি-ই-ও  না। আ-আ-মি তো আর তো-ও-মা-আ-র  কা-আ-ছে  কিছু  পা-আ-বো  না ! এ-এ-ই-টা  না  হয়  থা-আ-ক  না,  পরে  দি-ই-য়ে  দি-ই-ও…।

           যামিনী দাদুর সব কথা তাকে টেনে টেনে বলতে হয়। পরিস্কার করে একভাবে বলতে পারে না সে। কখনো কখনো বোঝা যায়। কখনো কখনো বোঝা যায় না। আর কথা বলার সময় তার গালের দুপাশে থুতুর গ্যাজলা বের হয়ে আসে। বিষয়টায় আমার কীরকম যেন একটা অনুভব হয়। কেন যে তাকে এত কথা বলতে হয় ! না বললে চলে কীভাবে তারই বা, এ কথা কেউ বা বোঝে ! কেন জানি না তাকে দেখলেই আমার ভেতরটা কেমন যেন উতলা হয়ে ওঠে। তার আন্তরিক কথাবার্তাগুলি মনে রাখবার মতো। বুঝতে পারি, ঠিক মতো হিসেব-পত্র  করতে পারে না। সেই জন্যে এক হিসেব বারবার  আওড়াতে হয় তার। ঠিক করে নিতে হয় নিজে নিজেই বকবক করে। না হলে অন্যের কাছে শুনতে হয়, কার কাছে কতো পাওনা থাকলো তার। এখানে আসার আগে সে কাকে কী দিয়েছে কী দেয়নি সব গড়গড় করে বলে নেয় খানিকটা তুতলে তুতলে; পাওনা দেনাটা ঠিক না করতে পারলে এখান থেকে হিসেবটাকে স্মরণে রাখতে চায়। মা তাকে কোনো কোনো দিন যোগ বিয়োগ করে বলেও দেয় দেখি। যদিও তখন যদি হাতে সময় থাকে তাহলেই। তা না হলে তাকে বকাবকি করে এই বলে, একটা খাতা বানাও যামিনীদা, যে যা দিলো তা তাকে দিয়েই লিখিয়ে নেবে খাতায়। 

            সে তাতে  বলে,  তা-আ-ই…., তা-আ-ই-ই করতে হ বে, কিন্তু আ মি তো তা বুঝতি পা র বো নারে দিদি….!

            মা বলে, তা না পারলে, হিসাবটা তো থাকবে, অন্য কাউকে জিজ্ঞাসা করলে সেও বলে দিতে পারবে। অমুকের কাছে কত তমুকের কাছেই বা কত কী পাবে, সেই কথাটা। তাই শোনো, এখনো বলছি, এই কাজটা কালই করায়ে ফেলবা ,না হলে কিন্তু তোমার পুঁজিপাটা সব বেলেঘাটা হয়ে যাবে। আচ্ছা, হইছে এবার যাও দেখিনি ----  আমার আবার বেলা গ্যালো, ওদিকে তাড়া লেগে যাবে --- ;

             যামিনী দাদু তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়, বলে, সত্যিই তো, তা-আ-ই  তো, যাই  যাই, খাতা বানাতিই হ-অ-বে…. ; 



           ওদেশে থাকতে এই মাছ বিক্রেতা মালোদের দেখেছি, তাদের সঙ্গে সবার নানা ধরনের সম্পর্ক ; এক একজনের সঙ্গে এক একরকম ডাকাডাকির সম্ভাষণ পর্ব সে সব ---- কেউ দাদা তো কেউ কাকা, কেউ কাকা তো কেউ মেসো, কেউ খুড়িমা তো কেউ জেঠিমা, আরো কত কি ; যেন সবটাই এক গভীর বন্ধনে জড়ানো। বড় মায়াময় সে সব সম্পর্কের সুতোনাতা ; যদিও আজ আর সেরকম না হলেও, সেই বাবলা অশ্বত্থের ঝুঁকে পড়া ছায়া সুনিবীড় নবগঙ্গার জল-শ্যওলা গন্ধে ভরানো নৌকোর খোলের ভেতর থেকে উঠে আসা আঁশটে গন্ধে ভরপুর মালোপাড়ার কোনো হাঁকাহাঁকি, ডাকাডাকি না থাকলেও কী হবে, এখানে আজ যা দেখলাম, তার সঙ্গেও কি কম মেলবন্ধন ? যা আজ যামিনী দাদুর মাছ কেনা-বেচার সম্পর্কের মধ্যে এমন এক সাযুজ্য রক্ষা করে দেখালো------ তা তো আমার সেই ফেলে আসা নবগঙ্গার পাড়ের মালো সম্প্রদায়ের থেকে কম না ! যা আজ আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম। কী বিশ্বাস ! কী নির্ভরতা ! কী অধিকার ! আবার আমার মায়েরও শাসন করার ধরণ, সাবধান করার ধরণ, পরামর্শ দেওয়া ; এসব দেখে আজ আমার সেইসব মালো পাড়ার সঙ্গে আমাদের সব সম্পর্কের দিনগুলির কথা মনে পড়লো কয়েকবার যেন ; এক একদিন, সেই যে তাদের বলা কথাগুলো, ও দিদি, তুমি কি আর কম দিবা নাকি, ওই হলো, ঠিক আছে, ঠিক আছে, পাওনা-দেনা তো থাকবেই ---- নাও, নাও তো দেহিনি , দাও , দাও, যা পারতিছ তাই দাও। মাছ, সব কটাই রাখে দাও না। তোমারে দিতি আমার আর কিসির ভয় ? আমার টাকা কোথাও যাবে না, আজ না হয় কাল, এই তো, নাও, নাও দেহিনি,  নাও …. ;


           এই ভাবে সকালবেলাটা এক একদিন শুরু হয়। এই ভাবে এক একটা দিন এখানের জীবনযাপনের সঙ্গে পরিচিত হতে থাকি আর এক ছন্দে। 

 

মা অফিসে চলে গেলে কিম্বা মা থাকতে থাকতেই শিবানী, মলি, ওদের কেউ না কেউ আসে এ বাড়িতে ঠাকুর পুজো দিতে। কারণ প্রায় দিনই তার দেরি, এবং ওদের আসা, আজ শিবানী তো কাল মলি, একজন না একজন আসেই। তারপর অনেক বেলা অবধি মায়ের ঠাকুর দেবতার পুজোপাঠ সেরে, শঙ্খে ফু দিয়ে পুজো শেষ করে আমার পাশে এসে বসে। বসে নানা গল্পগাছায় সময় কাটিয়ে দেয়। আমিও এক অদ্ভুত আনন্দে সেই সঙ্গসুখ অনুভব করি। ওরা নানা প্রশ্ন করে জানতে চায় আমার কাছ থেকে, বাংলাদেশে থাকতে এমন সময়গুলোতে আমি কী করতাম ? 

            তার অর্থ, কীভাবে ওখানকার দিনগুলি কাটতো আমার পড়াশোনার বাইরে ? এখনও ওখানের জন্যে আমার মনখারাপ আছে কি না , এইসব। 

             নানা সত্য-কল্পনা মিশিয়ে তাদের জানাতাম এই কিছুদিন আগের আমার ফেলে আসা সেইসব সময়ের কথা। ওরাও সে সব শুনে যেত বেশ মন দিয়ে। বলতো, বাবা ! কী সুন্দর রে ! জানিস, আমার না ভীষণ যেতে ইচ্ছে করে, ওই দেশটিতে নিয়ে যাবি আমারে একবার ?

              আমি বলতাম, নারে, এহনে তো আর যাওয়া হচ্ছে না, পরে গেলি নিয়ে যাবানে ----

             ওরা আমার শেষের  যাবানে কথাটা শুনে বলতো, যাবানে ,খাবানে এসব আবার কী ? এইসব যাবানে টাবানে, যাতি টাতি, করতি, দেখতি এইসব বাদ দে এবার, ক, যাবো, যাবো বল দেখি একবার, অভ্যাস এবার পাল্টা !

             এরপরেই মুখটা হঠাৎ বেশ ঘোর করে ফ্যাকাশে করে বলতে থাকতো একটানা ---- না বাবা, কাজ নেই যাইয়ে ,আমার বাবার কাছে সব তো শুনেছি, তারা কীভাবে পালিয়ে এসেছিল সব কিছু ছেড়ে-ছুড়ে রাতের অন্ধকারে; নৌকো, স্টিমার,গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, হাঁটা পথ কতো সে সব কাহিনী, সব বাবা মার মুখে শুনেছি তো ; ---- জানিস, আমাদের কতো বড় বাড়ি ছিল ! পুজো হতো ঢাকঢোল বাজিয়ে, আমাদের বাড়ির পুজো উপলক্ষে গ্রামের মধ্যে মেলা হতো ---- আরো কত আড়ম্বর, অনুষ্ঠান, সব ফেলে পালিয়ে চলে আসতে হলো আমাদের ! আমরা তো জন্মাইনি তখন, তাই আমরা দেখতে পাইনি, শুনেছি সবই, বাবা মার কাছ থেকেই। 


             আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তোর বাবা মা এখনো সেসব গল্প বলে ?

             সে বলে, এখনো মাঝে মাঝে পুরোনো লোকজন এলে, দেশের কথা উঠলেই বাবা বলে।

তবে আগে খুব বলতো, আমরা যখন ছোটো ছিলাম, আমাদের বড়দা তো দেখেছে খানিকটা, সে বলে ।  কখনো কখনো বলতে বলতে বড়দার মুখটা কেমন হয়ে যায় জানিস তো ! এই তো, এবারে যদি পুজোয় এখানে থাকিস তো দেখতে পাবি, আমাদের বাড়ির দুর্গা পুজো কেমন হয়। বেশ মজা করবো তোকে নিয়ে এবার…!

             ভেতরে ভেতরে বেশ একটা কম্পন হতো যেন। মনে হতো যেন রক্তের ভেতরে একটা ঢেউ দিল কে এসে !  এমন আনন্দঘন মুহূর্তের কথা এ ক'দিন কেউ তো বলেনি ! তারপরে ওরা কি সহজ ভঙ্গিমায় আমাকে জানাতো, পুজো এলে ওরা আমাকে নিয়ে কী কী করবে তার একটা বড় তালিকা গড়গড় করে বলতে থাকতো। 

           ওদের বাড়ির ভেতরে ওদের দাদা অলোকের সঙ্গে যেদিন প্রথম গেছিলাম, সেদিন যে যে জিনিস দেখেছিলাম, এবং মুগ্ধ হয়েছিলাম, তার কথা তো মনে আছেই। কি সুন্দর করে সাজানো গোছানো ওদের ঘরদুয়োর গুলো। বাড়ির ভেতরে কী সুন্দর একটা অন্দরমহল। যেখানে সান-বাঁধানো চাতাল ! ঠিক আমার ঠাকুমার বাপের বাড়ির মতো। সেই ভবানীপুরের বাড়িটার মতনই তো খানিকটা ! মনে মনে ভাবতাম, সব সম্পদশালী মানুষজনের বাড়ির অন্দরমহলটা মনে হয় এরকমই হয় দেখতে ! সেই একই গন্ধ, এক-ই  ধরণের একটা গমগমে ভাব চারদিকটা ; সেই যে, দেখেছিলাম ঝুড়ি ঝুড়ি তরিতরকারির সমারোহ, বড়ো বড়ো মাছ, আলু-পটলের ডাঁই, এইসব, সব কিছু মিলে সে-ই যে একই ছন্দ যেন চারদিকের পরিবেশটুকুতে। 

             এসব দেখে-শুনে কেন জানি না নিজের ভেতরে নিজেই ছোটো হয়ে যেতাম। ভাবতাম, কতো গরীব এই আমরা ! আমাদের তো টালির চালের ঘর। একখানা ঘরের মধ্যে সয়াল-সংসার। আর এরা, কতো বড়ো বড়ো ঘরদুয়োরের মধ্যে থাকে ! কিন্তু একটা কথা ভেবে পরমুহূর্তেই কূল কিনারা পেতাম না, ভাবতাম, আচ্ছা, এরা যে এতো ধনী, কই , তাও দেখি আমার মা উঠোনের উপর থেকে শিবানী মলি বলে ডাকলেই চলে আসে ; এসে কী আন্তরিকভাবে সব কিছু সামলে দিয়ে যায়। এক একদিন কিছু রান্নাবান্না থাকলে তাও তো করে, আমাকে একেকদিন ভাত বেড়ে খেতেও দেয়। ঘর ঝাঁট দিয়ে দেয় নিজেদের আনন্দেই । এমনকি থালাবাসন গুছিয়ে-গাছিয়েও দিয়ে যায়। ঠাকুর পুজো তো আছেই। বিছানা বালিশও গুছিয়ে রাখে। আলনা গুছোয়। কে বলবে যে এটাও ওদের বাড়ি না !

             এসব সব অবশ্য কাজের দিদির অনুপস্থিতি হলে তবেই। সেই দিনগুলোতে ওরাই দুই বোন এইভাবে সব সামলায় !

             এইসব দেখেশুনে দিন যত যাচ্ছে ততোই ওদের পরিবারের সঙ্গে বেশ একটা একাত্মতা অনুভব করতে লেগে গেলাম।

             আলোক আমাকে বাগান তৈরি করা শিখিয়ে দিচ্ছে। উঠোনের সামনেটায় যে জায়গাটাতে ঘাসজঙ্গল পরিষ্কার করে নিয়ে , কোদাল দিয়ে মাটি কুপিয়ে নিয়েছি বেশ করে, সেখানে সে এসে প্রতিদিন দেখে যেতে লাগলো মাটি তৈরি হয়েছে কি না। তারপরে একদিন রাণীকুঠির একটি বড় বাগানবাড়ির মালির কাছে নিয়ে গেছিল, সূর্যমুখী ফুলের  এবং জিনিয়া ফুলের চারা নিয়ে আসার জন্যে ।এমনকি সেখানে প্রথম দিনের চারার দামও ওই দিয়ে দিয়েছিল। আমি বলেছিলাম, কিরে, তুই দিচ্ছিস যে ? 

             ও তাতে বলে, ঠিক আছে, পরে না হয় তুই একদিন দিয়ে দিস। 

              বলেছিলাম তাকে, পরে আবার কবে হবে তা কি জানি ! ঠিক আছে মার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে দিয়ে দিবানে তোরে কিন্তু ---- !

               তা শুনে ও বেশ একগাল হেসে বলতে থাকলো, ঠিক আছে, ঠিক আছে বললাম নারে বাবা, পরে একদিন  হবে হিসেব টিসেব সব, এখন চল তো --- ;

              পিঠে চাপড় দিয়ে বললো, চল, চল, ঠিক আছে, দিসেনে না হয় ----।

               অত্যন্ত যত্নে গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে গাছগুলিকে লাগিয়ে দিয়েই খালাস হলো না সে, পরে এসে প্রতিদিন দেখে যেতে লাগলো, ঠিক আছে কি না। কিছু অসুবিধা দেখলে নিজেই পরিচর্যা করত। সকালের বেশ খানিকটা সময় কাটত রোজই এইসব নিয়ে ওর সাথেই। 


              তাই ইদানিং সকাল থেকে দুপুরের আগে পর্যন্ত বেশ কেটে যেত। কিন্তু যেই দুপুরবেলার  খাওয়া দাওয়া মিটতো, সেই কেন জানি না আমার মনটাও খারাপ হয়ে যেত। কাজের দিদি তখন হয়তো গরুর কাজ নিয়ে ব্যস্ত বা সংসারের এটা ওটা কাজ নিয়ে কলতলার দিকটায় আছে, হয় তো বাসনকোসন এটা ওটা নিয়ে ব্যস্ততা তার । আর আমি সামনের জানলাটায় মুখ বাড়িয়ে দিয়ে ,খাটের উপর থেকে আধ-শোয়া অবস্থায় বাড়ির সামনের দিকের থেকে যে আকাশটুকু দেখা যায়, সামনের বাড়ির মাসিমাদের ঘরের পেছনের, যেসব বড় বড় ঝাউগাছের ফাঁক দিয়ে তার উপরের আকাশটার দিকে চেয়ে চেয়ে কত কথাই না ভাবতাম ! তার কোনোটার সঙ্গে কোনোটার মিল নেই যদিও, অথচ আমি তাতেই  ভেসে বেড়াতাম নানাভাবে এদিক ওদিক। একবার এদেশ তো একবার ওদেশ। এইসব করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম, তাও যেন মনে থাকতো না কিছুই। বিকেলে যখন ঘুম ভাঙতো তখন চোখ মেলে দেখতাম মাথার কাছে কখন মলি এসে বসে বসে কাজের দিদির সঙ্গে বকবক করছে। আমার ঘুম ভেঙেছে দেখে বলতো, বাবা , কী ঘুম রে বাবা ! এত যে বকবক করছি ঠাকুমার সঙ্গে তাও মহারাজের ঘুম ভাঙার নাম নেই ! 

             মাথায় হাত দিয়ে চুলগুলো নাড়তে নাড়তে বলতো, এবার উঠবি তো ? 

             বলতাম, উঠে কী করবো আর, তাই বল ? 

             ও বলতো, চল, ঘুরে আসবি চল। তোকে নিয়ে আজ কংগ্রেস নগরের দিকটায় যাবো…। 

             আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ওদিকে কী আছে ? 

             ও বলতো, চল না, ঘরে বসে বসে কী করবি, তাই বলতো আমাকে একবার ! 


             শুনলাম, ইস্কুলে যাসনি ? 

            ও বললো, হ্যাঁ…. গেছিলাম তো, এই তো বাড়িতে এসেই খাওয়া-দাওয়া করে চলে আসলাম এখানে। ভাবলাম, দেখি, আজ তোকে একটু বাইরে নিয়ে যাবো। সারাদিন শুধু বাড়ির মধ্যে বসে বসে কী করিস তা তুইই জানিস ; আরে, মানুষের সঙ্গে মিশতে হয় তো এক-আধটু, নাকি মিশতে হয় না, তাই বলতো ! 

            বললাম, হ্যাঁ …তা তো হয়, কিন্তু আমি তো এখানে আর কারো সঙ্গে সেরকম মেলামেশা করতে পারিনি। কত নতুন মানুষজন, কাউকে তো সেরকম চিনিও না ; তাছাড়া জানিস তো , ইচ্ছাও করে না, ওই যে, তোর দাদার সঙ্গে সেদিন একটু গেছিলাম, ওই তো, তারপরে আর বের হইনি। 

            ও বলে, ঠিক আছে, ঠিক আছে, সে যাই হোক, আজ তুই আমার সঙ্গে চল। 

             বললাম, আজ না, কাল, কাল না হয় যাবো। কাল রবিবার তো, মাও বাড়িতে থাকবে, কাল না হয় হবে, আজ তার চাইতে তোর সঙ্গে একটু গল্প করে সময় কাটাই, একটু পরেই তো সন্ধ্যে লেগে যাবেনে, তাই আজ থাক, কাল দেখবানে …

            এইভাবে নানা কথা বলে সেদিনটা ওকে থামাতে পারলাম। পরদিন আবারো ওর টানা-হেঁচড়া। কিন্তু সেদিনও আর একভাবে বুঝিয়ে বাঝিয়ে ওকে থামিয়ে দিলাম একই রকম ভাবে। 

             এইভাবে একদিন দু'দিন হবার পরে সে নিজেই ভীষণ বিমর্ষ হয়ে গিয়ে বললো, আচ্ছা, কেন বলতো, তোর কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না ? আমি তো কিছুতেই বুঝতে পারি না, কেন তোর এক রকমের একটা অদ্ভুত ভাব ?

             আমি কিন্তু ভেবে দেখেছি এই বিষয়টা নিয়ে, কোনো উত্তর পাইনি। কী অদ্ভুত মানুষ রে বাবা তুই --- !


           এদিকে খুব আড়ালে এদিক ওদিক চাওয়া-চাওয়ি শুরু হয়ে গেছে অন্তরে। কিছু পড়া যায় কী, কী ভাবেই বা তা যায় ? যদিও লেখার কথা মনে আসছে না তেমন কিছুই। সমস্ত দিন বাগান, একটু-আধটু ঘাস-মাটি, গাছের চারা, এইসব নাড়াচাড়া---; আর বেলা বাড়তে থাকলে বারান্দায় মোড়া পেতে বাড়ির সামনের রাস্তার মানুষজনের চলা-ফেরা লক্ষ্য করা। কাজের দিদি উনুনে কয়লা দেয়, তালপাতার পাখার হাওয়া টেনে ফের আঁচ ধরায় , মা চলে গেলে অফিসে ----- তার আগে এক চোট খানিকটা রান্নাবান্না হয়েছে যা, তাই খেয়েই মা চলে গেলে হনতদন্ত হয়ে বাসস্ট্যান্ড মুখো, সে তার পরের রান্নাটুকু করবার জন্যে নিভে যাওয়া উনুনে আবারও কাঠকুটো গুঁজে দিয়ে, ঘুটে ভেঙে ভেঙে সাজিয়ে দেয় ও কয়লা চাপায়। 

            এসব সব চেয়ে চেয়ে দেখি আমি। তাকে কোনো সহযোগিতা করতে পারি না যদিও, তবু ভাবি তার রোজকার এই কর্মপদ্ধতির কথা। জ্বালানির এই এক সমস্যা, যা ও দেশে থাকতে সেরকম দেখিনি ! ওখানে যেন সবকিছুই সোজা। দাও পাটকাঠি ঠেলে উনুনে, তারপর কাঠ, এবার আগুন দেও, এবার তুমি যত খুশি রান্নাবান্না করো। এখানে তা না। সবই কয়লা ঘুটে কেরোসিন তেল নির্ভর। না হলে স্টোভ ।কেরোসিন মজুত করতেই হবে, তাহলে কিছুটা স্বস্তি, তা না হলে ঝক্কির শেষ নেই।

             ঠাকুর পুজো করার পদ্ধতি আজকাল কাজের দিদিকে মা দেখিয়ে দিয়েছে। রোজ রোজ তো আর পরের মেয়েকে ডাকা যায় না, তাদেরও তো বাড়ির কাজকর্ম কিছু থাকে ! যদিও ওরা না ডাকলেও আসে, তবুও আজ ক'দিন হলো কাজের দিদিই গোটা প্রকৃয়াটা বেশ আয়ত্তে এনে ফেলেছে যেন। কীভাবে রামঠাকুরের পটে জামাকাপড় পরাতে হয়, কীভাবে কৃষ্ণ ও রাধারাণীকে কাপড় চোপড় ছাড়িয়ে পরাতে হয়। তাই ইদানিং কাজের দিদি সব কিছু গুছিয়ে দিয়ে মাকে বলে, ও মাসিমা, এবার তুমি একটু নিবেদনটা করে দেও। 

             মা তখন হয়তো সবে স্নান সেরে উঠেছে, তার আগে ডানদিকের আলগা চাতালে সূর্য প্রণামের মন্ত্র উচ্চস্বরে উচ্চারণ করা শেষ হয়েছে তার। তারপরে থাকে গুরু প্রণাম। তাও মুখস্থ। আওড়াতে আওড়াতে মা চুল আঁচড়াচ্ছিল তখন চিরুনি দিয়ে। কাজের দিদির বলাতে নিবেদনটা সেরে দিয়েই কাজের দিদিকে বলে, হ্যাঁ গো মাসি, ঠাকুরের খাওয়া হয়ে গেলেই ফুল বেলপাতাগুলি চরণের ওপর থেকে সরিয়ে দিও। 

              তাই শুনে কাজের দিদি বলে, নাও গো মাসি, নাও তো, ওসব আমি ঠিক ঠিক করে দেবক্ষণ, এইটুকু সময়ে তোমার ঠাকুরের তেমন কোনো অসুবিধা হবে না। ততক্ষণ না হয় ওইটুকু ভার সহ্য করুক তোমার ঠাকুর। 

              মা অফিস চলে গেলে সেই আবার দিদি আর আমি। আর একজন যদিও আছে ওদিকে, তিনি এবার সকালের নিত্য আহারাদি সেরে নিয়ে, থেমে থেমে জাবর কাটছেন। 

             এগারোটা বাজলে গুড়ের সরবৎ গ্রহণ করেন  তিনি ছোলার বেসন সহ। ইদানিং এই কাজটুকু সকালে আমিই নিয়েছি। 

             মা অফিসে চলে গেলে কাজের দিদি যখন তাকে স্নান করায়, তাতেও আমি তাকে জল এগিয়ে দি যদিও , তিনি তখন চুপ করে স্নান সারেন। তারপর গুড়ের সরবৎ খেয়ে ওইরকম মনের আনন্দে জাবর কাটেন।



        ‌‌‌‌      বর্ষা শেষ হয়ে এসেছে প্রায়। শরৎ ঢুকে পড়েছে তার মেঘভাঙা রোদ বুকে করে। কোনো কোনো দিন সকাল সন্ধ্যায়  তা টের পাই। ওপাশে সেনগুপ্ত বাড়িতে তো বড় একটি শিউলি ফুলের গাছ দেখা যায়। শিবানী মলিরা এখনো একবেলা না একবেলা আসে । যদিও মলিই বেশি আসছে ইদানিং। পাড়ার পুরোনো পরিচিত কয়েকজন আবার নতুন করে আসা-যাওয়া করছে। ডানপাশের ব্যানার্জি বাড়ির বড় ছেলেটা তো আমি এখানে আসার আগেই জলে ডুবে মারা গেছে। তার পরেরটা কাল্টু , ওই ইদানিং মাঝে মাঝে আসে। আর আসে ওপাশের কর্মকার বাড়ির ছেলে শঙ্কর। আসে মজুমদার বাড়ির ফোচন। ওদের সঙ্গে ইদানিং বেশ কিছুটা সময় কাটছে আমার। 

              দুপুরে ফোচনের ঠাকুমা এসে কাজের দিদির সঙ্গে লুডুর কোট বসায়। মাঝে মধ্যে শিবানী মলিরাও ভিড়ে যায় সেই সঙ্গে। 

     যদিও আমি কয়েকদিন সন্ধেবেলা হলে দিদির বাড়িতে চলে যাই। ফিরে আসি একেবারে রাতে মায়ের সঙ্গে। ততক্ষণ কাজের দিদি একাই বাড়ি পাহারা দেয়। 

             দিদির ছেলেটি তখনও খুব একটা ভালো করে হাঁটা শেখেনি । নানা পোশাকে -আসাকে তাকে সাজিয়ে রাখে দিদি। সে টলমল পায়ে বারান্দার গ্রিলের ভেতরে নানা ধরণের খেলনা নিয়ে নাড়াচাড়া করে। 

              মা অফিস ফেরত এখানে আসে দুটি কারণে। একদিকে নাতির পরিচর্যা আর একদিকে মা এলে দিদির একটু বাইরে বেরোনো হয়। 

             আমার বাড়তি একটা আনন্দ হয়েছে এখানে, সেটা হলো নতুন শাদাকালো টেলিভিশনে নানা অনুষ্ঠান দেখা । তখনও পর্যন্ত টেলিভিশনের জল-চল এতটা শাদামাঠা এলেবেলে হয়নি। ও পাড়াতে ওদের বাড়িতেই প্রথম টেলিভিশন আসে। এবং সে কারণে পাড়ার বেশ কয়েকজন সন্ধেবেলা হলে এ বাড়িতে চলে আসে । 

             দিদির বাড়িতেই প্রথম  রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত দেখি। দেখি অন্নদাদি শ্রীকান্ত। অন্নদাদি শ্রীকান্ত দেখে রাতের বালির চরের পাউড়ি ধরে সেই ইন্দ্রনাথের নৌকো ভাসানো --- অন্নদাদির ওখানে যাবার জন্যে, তাই দেখে কী স্বাভাবিক ভাবেই না বুকের ভেতরটায় মোচোড় দিয়ে উঠেই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো আপনা আপনিই । তারপরে কখন যে ভেসে চলে গেছিলাম নবগঙ্গার কাছে, তা আমি নিজেও জানি না। আজ আবার এই প্রথম তার টান নতুন করে অনুভব করতে থাকলাম বুকের ভেতরে ।কাউকে বলতে পারিনি তা। শ্রীকান্তের সঙ্গে সঙ্গে আমিও কখন আখড়া বাড়ির পথে নৌকো চালিয়ে ডাঙায় নৌকোটি বেঁধে রেখে জোছনা রাতে উঠে চলে  গেছিলাম নদীর  পাউড়ি বেয়ে সুপুরি জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যে পথটি আখড়া বাড়ির ভেতরে উঠেছে, সেখানে! 

           কিন্তু সেখানে তো অন্নদিদির মতো কেউ নেই! তাহলে---?


         মনে মনে এই যে চলাচল, এই যে ছায়াছবির শ্রীকান্ত আর ইন্দ্রনাথ, ইন্দ্রনাথ আর শ্রীকান্তের কথোপকথন, এ যে কী ভাবে যেন আমায় একাত্ম করে ফেলতে লাগলো। তার রেশ পরদিন পর্যন্তও লেগে থাকলো মনের ভেতরে। শ্রীকান্ত কার লেখা, এর মধ্যে জেনেছি। মার কাছে বলেও রেখেছি, মা, দেখ তো , যদি পারো আমার জন্যে শরৎচন্দ্রের রচনাবলীর এক দুই খন্ড এনে দেওয়া যায় কি না। 

            তা শুনে মা বলেছে, আচ্ছা দেখি ব্রোজদাকে বলে দেখি, সে এনে দিতে পারে কি না। 

             বললাম, ব্রোজদা কে গো ? 

             মা বললো, ও আছে, তুই চিনবি না। ব্রোজদা আমাদের অফিসের একজন মানুষ। অফিসে অনেককেই দেখেছি কলেজস্ট্রিট থেকে বইপত্র এনে দেয়। 

             আমি বললাম, এনে দেয় মানে, টাকা নেয় না ? 

     ----- নেবে না কেন , মাসে মাসে নেয়। দেখি, আমি তোর কথা বলবো, দেখি পারে কিনা এনে দিতে। 


       ----- তাহলে তাকেই বলো। বেশ তো, ভালোই হবে, একখণ্ড একখণ্ড করে প্রতিমাসে তোমাকে দিক না উনি না হয় ! 

      ----- ঠিক আছে। শ্রীকান্ত পর্বটা যেখান থেকে শুরু হয়েছে সেটাই আগে দিতে বলবো তো ?

      ----- হ্যাঁ…. দেখ মনেহয় তাইই হবে, শ্রীকান্ত দিয়েই শুরু হয়েছে মনে হয়, তাই তো শুনেছি----- দেখ        ----- প্রথম খণ্ডটাই দিক না আগে ;


          কী যে আনন্দ হচ্ছে, কী যে একটা আহ্লাদিত হয়ে পড়ছে ভেতরটা ----- সমস্ত দিনই বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি তাই। বইগুলি নেড়েচেড়ে দেখতে পাবো ! সেই প্রথম শরৎচন্দ্রের লেখার সঙ্গে কয়েকদিনের মধ্যেই পরিচয় ঘটলো। 

             একদিন বেশ বিকেল বিকেল মা বাড়ি চলে এল। সন্ধ্যার প্রথম আলোয় সেই আমার বই পাওয়ার  আনন্দ ! সেই শরৎচন্দ্রের চেহারাটি আলাদা ভাবে দেখা মলিটটি খুলেই। কিন্তু রচনাবলী বস্তুটি কি তখনও ভালো করে পরিষ্কার তো বুঝতাম না, তাই ভাবছি, কটি খণ্ড তাই বা কে জানে ! যদিও পরে সে চিন্তার অবসান ঘটলো, তবে সে তো অনেক দিনের পরের কথা-----


 ( ক্রমশ )

মুক্ত গদ্য * জিষ্ণু নিয়োগী




উত্তরবঙ্গ চিরকালই বঞ্চিত ও রাজধানীর উপেক্ষায় অবহেলিত


জিষ্ণু নিয়োগী



উত্তরবঙ্গের কপালে দেশভাগের কোপ পড়েছিল যেমন তীব্র, রাজধানী কলকাতার উপরে পড়েছিল ছিন্নমূল সর্বহারার দল—এসব শুনেছি পূর্বপুরুষদের কাছে। শিয়ালদহ স্টেশনে শোনা যেত কাতারে কাতারে মানুষের ‘ভাত দাও, ফ্যান দাও’ চিৎকার। কম্যুনিস্ট পার্টির তৎকালীন মানুষ সর্বহারাদের বাসস্থান হিসাবে উত্তরে দমদম, সিঁথি আর দক্ষিণে যাদবপুর, গড়িয়া, সোনারপুর, আদিগঙ্গার খালপাড় ধরে জমি দখল করে পাইয়ে দিয়েছিল ছিন্নমূল মানুষকে। আজ অবশ্য তারাই প্রচুর সম্পত্তির অধিকারী, যদিও বালিগঞ্জ, গড়িয়াহাট, যোধপুর পার্ক, ঢাকুরিয়া্র উচ্চবিত্তরা তাদের বসতিবাসী ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না। দুধে জলে এক হয়ে তারাও আজ বৃহৎ কলকাতাবাসী। 


এই দীর্ঘ ইতিহাসে বঞ্চিত উত্তরবঙ্গবাসী। কলকাতার সংস্কৃতি, কলকাতার মিথ্যে ঠাঁটবাট ক্রমশ গ্রাস করছে উত্তরবঙ্গকে—কেন? কারণ আমরা উত্তরবঙ্গবাসীরা হ্যাংলা এবং উচ্ছিষ্টই  আমাদের পাথেয়। আমরা ওদের মিথ্যে বচনে আকৃষ্ট হই। একবার ভাবুন রাজধানীর কী আছে। পাট, চা, কাঠ, পর্যটন বা অন্যান্য যা সামগ্রী তা তো উত্তরবঙ্গের, অথচ আমরা উত্তরবঙ্গবাসীরা বঞ্চিত। কোনো প্রতিবাদ নেই। একটু অনুযোগ করলেই, এ মাও সে ছাও ছাপ্পা লাগিয়ে উত্তরবঙ্গের কণ্ঠরোধ করতে বদ্ধ পরিকর। উত্তরবঙ্গ এবং পূর্ববঙ্গের যত মেধাবীদের নিয়েই দম্ভ কলকাতাবাসীর। আর তারাও নীল জলে স্নান সেরে নিজেদের অদ্ভুত প্রাণী সাজাতে ব্যস্ত। উত্তরবঙ্গের মানুষ বেশির ভাগই অলস ও প্রতিবাদহীন, তাই তারা কোনোদিন গুরুত্ব পাবে না, রাজধানী যা ভাববে তাই মেনে নিতে হবে আমাদের মতো মেনিমুখোদের। এই প্রতিবাদহীনতার জন্যই ক্রমশ বঞ্চনার শিকার হচ্ছে উত্তরবঙ্গ। পত্র-পত্রিকায় ‘গৌড়বঙ্গ’, ‘উত্তরবঙ্গ’ করবে কর্পোরেট হাউস তথা প্রচারমাধ্যম, আর সরকারও ‘উত্তরবঙ্গ পর্ষদ’ তৈরি করবে, কিন্তু কিছু শিক্ষিত মানুষ প্রতিবাদ করলেই সেটা হবে অপরাধ। এভাবে সবাই নিশ্চুপ থাকলে উত্তরবঙ্গের উন্নতি কখনোই সম্ভব নয়। রাজধানী সব গ্রাস করে ঠিকই, কিন্তু পাশাপাশি শহর গ্রামও উন্নত হয়। স্বাধীনতার সত্তর পার হলেও উত্তরবঙ্গের  উন্নতি তেমনভাবে হয়ে ওঠেনি। এর দায় উত্তরবঙ্গবাসীর, কারণ তারা আদায় করে নিতে পারেনি অধিকার। আসলে আমরা বেশির ভাগ উত্তরবঙ্গবাসী চিড়িয়াখানার অদ্ভুত প্রাণী—কিছুতেই হেলদোল নেই আমাদের। উত্তরবঙ্গের চিকিৎসা শিক্ষা সবই নির্ভর করে কিছু ডান-বাম ধান্দাবাজ রাজনৈতিক নেতাদের উপর। তারা জণগণকে যেভাবে পরিচালিত করে, অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত গরিবগুর্বোরা সেভাবেই চালিত হয়। নিজেদের স্বাভিমান বলে উত্তরবঙ্গের কিছুই নেই। মনে পড়ে ছেলেবেলায় পড়া লীলা  মজুমদারের দুটি লাইন—‘বন থেকে জানোয়ার তুলে আনা যায়, জানোয়ারের মন থেকে বন তুলে ফেলা যায় না’। ‘কালকুট্টা’ যেমন ব্রিটিশরা ভুল উচ্চারণ করতেন, যেহেতু বাংলা বলতে পারতেন না তারা, তাই এখন আমরাও দাবি করছি কলকাতা বাদ দিয়ে সুতানটি, গোবিন্দপুরকে অবলুপ্ত না করে তিনটি নামই থাক রাজধানীর। কলকাতার নাম হোক ভিন্ন ভিন্ন। কারণ তারা যদি এক পশ্চিমবঙ্গকে উত্তরবঙ্গ, গৌড়বঙ্গ, রাঢ়বঙ্গ করতে পারেন, তাহলে কল্লোলিনী কলকাতা পুরনো নামেই চলে যাক। আমাদের আক্ষেপ একজন কবি যদি তার কবিতার বই ছাপাতে চান, তার প্রকাশনী সংস্থার ঠিকানা ঝামাপুকুর লেন বা কলেজস্ট্রিট, কলকাতা—৭০০০০৯ হতে হবে। উত্তরবঙ্গ থেকে প্রকাশিত হলে ওই বই কেউ ছুঁয়েও দেখবে না—এটাই পরিহাস এবং যন্ত্রণার। 


(এই লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব)


**********************************************************



জিষ্ণু নিয়োগী

 নাট্যচর্চায় নিবেদিত প্রাণ জিষ্ণু নিয়োগী ' তূনীর' নামে একটি নাট্যদল পরিচালনা করেন। এর পাশাপাশি মূলত প্রবন্ধ ও গল্প লেখেন। বালুরঘাটনিবাসী এই লেখকের লেখা বালুরঘাট বার্তা, বরেন্দ্রভূমি, দক্ষিণ দিনাজপুরবার্তা প্রভৃতি কাগজে প্রকাশিত হয়েছে।
 নাটকের জন্য কয়েকটি পুরস্কারও আছে তাঁর মুকুটে।