'স্বরবর্ণে'র চতুর্থ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে কবি দীপংকর রায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে '। এই উপন্যাস লেখকের ষোল-সতের বছর বয়সের কালপর্ব থেকে শুরু। যদিও লেখকের জন্ম এপার বাংলায়, কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে থেকেছে ওপার বাংলায়। কাজেই যাতায়াত থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ ছেড়ে চলে আসা আর তারই নাছোড় এক টানাটানির মধ্যে যে জীবনের ক্রমাগত আসা আর যাওয়া ,এই উপন্যাস মূলত তারই এক নির্মম নিষ্ঠুর ভাঙা-গড়ার আশ্চর্য কথোপকথন। ধারাবাহিকভাবে যা আমরা পড়ব, কবি দীপংকর রায়ের মায়াময় কলমে।
কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে
পর্ব * ৩
দীপংকর রায়
মলি তো ইদানীং দেখতে পাচ্ছি আমার সঙ্গে সঙ্গে গরুর জাবনাও মেখে দিচ্ছে। এই কাজটি ইতিমধ্যে কাজের দিদির কাছ থেকে আমি আয়ত্ত করে নিয়েছি খানিকটা । আমার সঙ্গে সঙ্গে ওরা দু'বোনও বেশ নিষ্ঠার সঙ্গে এই কাজে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসে।
ওরা যদিও সকালে আর বিকেলেই আসে ।খানিকটা সঙ্গ দিয়ে এই সময়ের একাকীত্বের জায়গাগুলো ভরিয়ে তোলে। এইসব নানা টুকিটাকি কাজে সঙ্গ দেয় আমায়। সন্ধ্যা-প্রদীপও লাগায় এক একদিন আগ্রহ সহকারেই । এমনকি কখনো কখনো দুপুরবেলাতে বিছানায় আমার পাশে শুয়ে শুয়ে গল্পও করে।
অলোকও মাঝে-মধ্যে আসে। অনেকক্ষণ আমার সঙ্গে উঠোনের উপর যে জায়গাটা পরিষ্কার করে বাগান বানাবো বলে রোজ একটু একটু করে কুপিয়ে ঘাস বেছে ফেলছি মাটি থেকে, সে সব কীভাবে করলে আরো ভালো হয় তার খানিকটা পরামর্শও দিয়ে যায়। কারণ ওদের বাড়ির বারান্দার সামনে যে জায়গাটায় যে সব ফুল গাছ লাগানো রয়েছে , সে সমস্তর পরিচর্যা ওই করে বলে জানিয়েছিল আমায়। গাছের গোড়ায় কী কী সার দিতে হয়, তাও তো ওই জানালো, আমি তো একমাত্র গোবর সার ছাড়া আর কিছুই চিনতাম না এর আগে ! না বুঝি আর একটা সার চিনতাম, সে হলো নদীর কচুরিপানা পচিয়ে সার তৈরি করে জমিতে দেওয়া। কিন্তু এখানে আর সেসব কোথায়ই বা পাওয়া যাবে ! তাই এখানে এসেই প্রথম জানলাম ইউরিয়া ফসফেড, হাড়ের গুড়ো, আরো কত কি !
বর্ষার প্রকোপ এখনো যায়নি । মাটি ভিজে রয়েছে । এর চাইতে ভালো পরিষ্কার আর করা যাবে না। তাই আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে, তারপর ভালো হবে। তা না করলে এই মাটিতে কোনো কাজই করা যাবে না। সামনের ভাদ্র-আশ্বিন মাসে মাটি একটু ঝুরঝুরে হবার মতোন অবস্থাটা দেখতে পেলে তবেই মাটিকে তৈরি করে নিতে হবে। আর তখন যা যা করতে হবে সব বলে দেবে বলেছে ও আমায়।
এত পরিপাটি করে ঘরদুয়োর গোছাতে হয় কী করে, তাও ওরাই শিখিয়ে দেয় রোজ একটু একটু করে। খাট বিছানাও গুছোয়, এ যেন আমার ঘরের বোন এরা।
এই যে দুই বোনের পালা করে এসে দুই বেলা সমান ভাবে আমাকে সঙ্গ দেওয়া থেকে শুরু করে আজকাল তো ভালোমন্দ রান্না করেও খাইয়ে যায়। আবার এরই মধ্যে ঠাকুরদেবতার সেবা যত্নও সমান ভাবে সময় মতো করে তাও দেখতে পাচ্ছি। তাই এদের আত্মীয় না ভেবে আর কী ভাবতে পারি ?
যদিও বাস্তবে তো তার কিছুই না------ সম্পর্কটা হলো আমার দিদির বন্ধু ওদের বড় বোন কৃষ্ণাদি । তা থেকে তো আর কিছু না !ওদের বাড়ির মানুষজনের সমান যাতায়াত। তাই, কলকাতায় ফিরে এসে সেই আমার প্রথম আত্মীয় খুঁজে পাওয়া। এমনই আন্তরিক সম্পর্ক ছিল সেই সব। এমনই অভিজ্ঞতা ছিল কলকাতায় ফিরে এসে প্রথম পর্বের দিনগুলোতে। কী গভীর আন্তরিকতায় আমিও যেন কেবলই সরু লিকলিকে একটি লতা গাছের মতন বড় গাছের অবলম্বন পেয়ে সেই বড় গাছটি বেয়ে লতিয়ে তার শাখাপ্রশাখা জড়িয়ে ধরতে চাইছি।
কদিন ধরেই মনে মনে ভাবছি রসিক দাদুকে একখানা চিঠি লেখা হলো না আজ অবধি। দিদিমাও মনে মনে ভাবছে ঠিকই, ও তো কোনোদিন ওর মাকেও কিছু লেখেনি, তার আমার কাছে কী লিখবে ! চিঠি লেখার অভ্যাস থাকা দরকার হয়। লিখেছে নাকি আজ পর্যন্ত কাউকে একখানা কিছু, কই দেখিনি তো তেমন কোনোদিন ; তাই এ নিয়ে আর ভেবে কোনো লাভ নেই। লেখে লিখুক না লেখে না লিখুক, যাক গে-------
এসব দিদিমার মনের ভাবনা আমি ভাবছি কীভাবে, নাকি এভাবে ভেবে নিজেকে আড়াল করছি, নিজের অক্ষমতা ঢাকছি ইনিয়ে বিনিয়ে ? কথাটা তাই তো মনে হচ্ছে, তাই নয় কি ? তবু আমিও দিদিমাকে বললাম যেন, মাকে তো তুমিই লিখতে যা কিছু, দিদিভাই। আমার সব উপদ্রপের কথাই লিখতে তো একে ওকে ধরে। আবার তাদের তোমার কাছ থেকে শুনে শুনে লেখা হয়ে গেলে, জানতে চেয়ে বলতে, একবার পড়ে শোনা তো দেখি, সব কিছু লিখতে পারলি কি না শুনি একবার।
আমার আর আলাদা করে মার কাছে লেখার দরকার পড়তো না। কিন্তু এখানে তোমার মতো লিখে দেবার লোক কোথায় পাই আমি ? এই যে বার বার তোমার মুখের কথা শুনে কাইলে মামা বা কুমারেশ দাদুরা লিখতো, ইদানিং তো সঞ্চয়কে দিয়েও সে কাজ করাতে, তবুও কখনো আমাকে বলতে না কেন যে, তার অর্থ এখন খুঁজে মরছি আমি ------ তখন ভাবিনি ঠিকই, কিন্তু এখন বুঝি কিছুটা। আর এইসব কারণে আমার অভ্যাসটা তৈরি হলো না। অন্তত তখন যদি করাতে, তাহলে আজ খানিকটা পাকাপোক্ত হতো সেই অভ্যাসটা। কেন যে এইসব দিক থেকেও চিরকাল আমার মুখটাকে ঘুরিয়ে রাখলে, তা বুঝতে দিলে না যেন ; এইভাবে আরো কত কিছুর থেকে দূরে সরিয়ে রাখলে, কিছুরই সামনাসামনি হতে দিতে চাওনি।
যাক গে, এখন যে কথা বলছিলাম, যে চিঠি প্রসঙ্গে ; তোমার এই যে সংশয় তা কি আমার উপরে তোমার ভরসা ছিল না বলেই ? যদি আমি তোমার সব কথা না লিখে দিই, তাই, সেই জন্যেই কি একে ওকে তাকে ধরে বেড়াতে আমাকে বাদ দিয়ে ? একবার ভাবলাম, এত বড় ত্রুটির কথাটা নাই বা বললাম, এখন মনে হলো, নাই বা বলবো কেন ?
যদিও এসব ভুলে আজ আমি নিজেই লিখবো। কোনো কিছুই লুকোবো না, সমস্তটাই লিখবার চেষ্টা করবো। লিখবো আমার ওদেশ ছেড়ে চলে আসার নানা কথা। এখানে এখন কেমন আছি না আছি তাও বিস্তারিত সব লিখবো। ভাই তোমাকে এখন কতটা অস্বস্তিতে ফেলেছে তাও জানতে চাইবো। সে কি ঠিক মতো আছে মিলেমিশে ? দাঁড়াও দেখি, একটুখানি ভেবেনি ভালো করে , আজ রাত্রেই তোমাকে এবং রসিক দাদুকে লিখবো, দেখি কী দাঁড়ায় ; এই তো সকাল হলো সবে, বিছানায় গড়াতে গড়াতে এইসব ভাবনা ভাবতে ভাবতেই আজ বিছানায় ছিলাম সকাল বেলাতে ।
ইলেকট্রিক সংযোগে চলা একখানি রেডিও আছে এখানে। তা অতি যত্নে একখানি কাপড়ের ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখা থাকে। এভাবে এত যত্নের সঙ্গে তাকে রক্ষণাবেক্ষণ করতে দেখে আসছি সেই একাত্তর সাল থেকে। যখন দিদি এ বাড়িতে ছিল , এই রেডিওটি ছিল তার অতি যত্নের, এই সব কিছুকে সুন্দর ভাবে আগলে রাখার স্বভাব ছিল তার একদম অন্যরকম। এত গোছানো টোছানো ভাব হয়তো মার মধ্যেও ছিল না। তাই তার যত্নের বস্তুটি এখনো এ বাড়িতে ঠিক সেভাবেই সমাদর পায়।
সকালে কাজের দিদি যখন চা-এর জল বসায় উনুনে, ওদিকে তখন রেডিওতে সকালের সংবাদ হয়। আমি কোনো কোনো দিন বিছানায় শুয়ে শুয়েই সকালের সংবাদটা শুনি। মা রেডিও চালিয়ে দেয়। আকাশবাণীর এই সংবাদ শুনতে শুনতে ঠিকে কাজের লোক সুশীলা মাসি আসে বাসন মাজতে। তার বাসন মাজা হয়ে গেলে কাজের দিদি তাকেও চা দেয়। সে দুই হাঁটু মুড়ে বসে বসে হাতে গড়া রুটি পাকিয়ে চায়ের গ্লাসের মধ্যে চোবায় আর হুস হুস শব্দ করে চা খায়। তার এই ধরণটা সেই একাত্তর সাল থেকে দেখে আসছি , আজও তা একইরকম আছে দেখতে পাই। এবার চা পান করতে করতে তার পাড়ার সকলের বাড়ির এটা ওটা খবরাখবর বর্ণনা করার থাকে। এ যেন তার নিত্যদিনের একই ধরণ। মাঝে- মধ্যে মা অবশ্য তাকে বারণ করে, বলে, সুশীলা, এসব আলোচনা ক'র না। আমার হাটখোলা বাড়ি, কে কী শুনতে কী শোনে, তারপর তার একটা ভুল মানে করে, নানা অর্থ বের করবে হয়তো; ভাববে, দেখ, আমরা কীরকম অন্যের সমালোচনা করে বেড়াই …!
সে বলে, না না দিদি, তুমি কি কিচু বলতিচ নাকি, না আমি তেমন কিচু কচ্চি, এসব তো সবই কতার পৃষ্টে কতা, তাই একটুখানি কচ্চি ---- এই দ্যাকো না, ওগের যেমন কতা, একেবারে একসঙ্গে সব করাতে পারলেই বাঁচে , আমাগের জানি আরামবিরাম বলে কোনো কিচু নেই ,যতো সব ! হ্যাঁ….. দাঁড়াও দেকিনি…. তারপর বুজোবানে ক্ষণ, কত ধানে কত চাল… ;
এইরকমের নানা কথা তার। মা বারণ করলে বকবক করতে করতে থেমে যায় । এরপর আস্তে আস্তে কাজের দিদিকে কিছু বলে । যেন ওইটুকু শেষ না করতে পারলে তার স্বস্তি নেই !
মা তখন হয়তো কলতলার দিকে চলে গেছে, বা গোরুটার ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া হচ্ছে কি না সেদিকে নজর দিতে গেছে একটুখানি, না হলে হয়তো বাড়ির এদিকটাতে কী হচ্ছে না হচ্ছে তাই নিয়ে তার পর্যবেক্ষণ চলছে। আর সুশীলা মাসি এই ফাঁকে আরো খানিকটা বাকি কথা সেরে নিচ্ছে কাজের দিদির সঙ্গে ফিসফিসিয়ে।
সেও খুব একটা খেয়াল দিতে চায় না এসবে, তবু না শুনিয়ে সেও ছাড়তে চায় না যেন তাকে।
এসব সব আমি চেয়ে চেয়ে দেখি আর ভাবি, এই তো, এত হোইহট্টগোল, একটু পরেই তো এই বাড়িটাতে আমি আর এই কাজের দিদি আর ওই গরুটা ছাড়া আর কেউই থাকবে না।
মা অফিসে চলে যাবে। আজ যদি শিবানী মলি আসে তো খানিকটা সময় কাটবে, তা না হলে সেই সামনের বাড়ির পেছনের ঝাউবনের মাথার সারী, আর স্তব্ধ দুপুরবেলা, এ ছাড়া আর কে, আমার যেন সময় আর ফুরোতে চায় না।
আজ একটা কথা মাকে বলবো মনে মনে ভেবে রেখেছি। দেখি মা তার কোনো উপায় বের করতে পারে কি; যদিও জানি মার হাতে এখন তেমন একটা টাকা-পয়সা নেই। কারণ আজ দেখলাম যামিনী দাদুকে মা মাছের দাম সবটা দিতে পারলো না। তাকেও বাজারে যাবার পথে এই নিয়ে দু'তিনবার দেখেছি মাছ দিয়ে যেতে। আজ মা বললো তাকে, আজ কিন্তু সব টাকা দেব না যামিনীদা….. ।
সে তাতে বেশ খানিকটা তুতলে তুতলে বললো, আ-আ-মি কি চা-আ-ই-ছি নাকি, ও-ও দিদি, তু-উ-উ-মি না-আ-আ হয় আ-আ-জ কি-ই-ছু-উ-ই দি-ই-ও না। আ-আ-মি তো আর তো-ও-মা-আ-র কা-আ-ছে কিছু পা-আ-বো না ! এ-এ-ই-টা না হয় থা-আ-ক না, পরে দি-ই-য়ে দি-ই-ও…।
যামিনী দাদুর সব কথা তাকে টেনে টেনে বলতে হয়। পরিস্কার করে একভাবে বলতে পারে না সে। কখনো কখনো বোঝা যায়। কখনো কখনো বোঝা যায় না। আর কথা বলার সময় তার গালের দুপাশে থুতুর গ্যাজলা বের হয়ে আসে। বিষয়টায় আমার কীরকম যেন একটা অনুভব হয়। কেন যে তাকে এত কথা বলতে হয় ! না বললে চলে কীভাবে তারই বা, এ কথা কেউ বা বোঝে ! কেন জানি না তাকে দেখলেই আমার ভেতরটা কেমন যেন উতলা হয়ে ওঠে। তার আন্তরিক কথাবার্তাগুলি মনে রাখবার মতো। বুঝতে পারি, ঠিক মতো হিসেব-পত্র করতে পারে না। সেই জন্যে এক হিসেব বারবার আওড়াতে হয় তার। ঠিক করে নিতে হয় নিজে নিজেই বকবক করে। না হলে অন্যের কাছে শুনতে হয়, কার কাছে কতো পাওনা থাকলো তার। এখানে আসার আগে সে কাকে কী দিয়েছে কী দেয়নি সব গড়গড় করে বলে নেয় খানিকটা তুতলে তুতলে; পাওনা দেনাটা ঠিক না করতে পারলে এখান থেকে হিসেবটাকে স্মরণে রাখতে চায়। মা তাকে কোনো কোনো দিন যোগ বিয়োগ করে বলেও দেয় দেখি। যদিও তখন যদি হাতে সময় থাকে তাহলেই। তা না হলে তাকে বকাবকি করে এই বলে, একটা খাতা বানাও যামিনীদা, যে যা দিলো তা তাকে দিয়েই লিখিয়ে নেবে খাতায়।
সে তাতে বলে, তা-আ-ই…., তা-আ-ই-ই করতে হ বে, কিন্তু আ মি তো তা বুঝতি পা র বো নারে দিদি….!
মা বলে, তা না পারলে, হিসাবটা তো থাকবে, অন্য কাউকে জিজ্ঞাসা করলে সেও বলে দিতে পারবে। অমুকের কাছে কত তমুকের কাছেই বা কত কী পাবে, সেই কথাটা। তাই শোনো, এখনো বলছি, এই কাজটা কালই করায়ে ফেলবা ,না হলে কিন্তু তোমার পুঁজিপাটা সব বেলেঘাটা হয়ে যাবে। আচ্ছা, হইছে এবার যাও দেখিনি ---- আমার আবার বেলা গ্যালো, ওদিকে তাড়া লেগে যাবে --- ;
যামিনী দাদু তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়, বলে, সত্যিই তো, তা-আ-ই তো, যাই যাই, খাতা বানাতিই হ-অ-বে…. ;
ওদেশে থাকতে এই মাছ বিক্রেতা মালোদের দেখেছি, তাদের সঙ্গে সবার নানা ধরনের সম্পর্ক ; এক একজনের সঙ্গে এক একরকম ডাকাডাকির সম্ভাষণ পর্ব সে সব ---- কেউ দাদা তো কেউ কাকা, কেউ কাকা তো কেউ মেসো, কেউ খুড়িমা তো কেউ জেঠিমা, আরো কত কি ; যেন সবটাই এক গভীর বন্ধনে জড়ানো। বড় মায়াময় সে সব সম্পর্কের সুতোনাতা ; যদিও আজ আর সেরকম না হলেও, সেই বাবলা অশ্বত্থের ঝুঁকে পড়া ছায়া সুনিবীড় নবগঙ্গার জল-শ্যওলা গন্ধে ভরানো নৌকোর খোলের ভেতর থেকে উঠে আসা আঁশটে গন্ধে ভরপুর মালোপাড়ার কোনো হাঁকাহাঁকি, ডাকাডাকি না থাকলেও কী হবে, এখানে আজ যা দেখলাম, তার সঙ্গেও কি কম মেলবন্ধন ? যা আজ যামিনী দাদুর মাছ কেনা-বেচার সম্পর্কের মধ্যে এমন এক সাযুজ্য রক্ষা করে দেখালো------ তা তো আমার সেই ফেলে আসা নবগঙ্গার পাড়ের মালো সম্প্রদায়ের থেকে কম না ! যা আজ আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম। কী বিশ্বাস ! কী নির্ভরতা ! কী অধিকার ! আবার আমার মায়েরও শাসন করার ধরণ, সাবধান করার ধরণ, পরামর্শ দেওয়া ; এসব দেখে আজ আমার সেইসব মালো পাড়ার সঙ্গে আমাদের সব সম্পর্কের দিনগুলির কথা মনে পড়লো কয়েকবার যেন ; এক একদিন, সেই যে তাদের বলা কথাগুলো, ও দিদি, তুমি কি আর কম দিবা নাকি, ওই হলো, ঠিক আছে, ঠিক আছে, পাওনা-দেনা তো থাকবেই ---- নাও, নাও তো দেহিনি , দাও , দাও, যা পারতিছ তাই দাও। মাছ, সব কটাই রাখে দাও না। তোমারে দিতি আমার আর কিসির ভয় ? আমার টাকা কোথাও যাবে না, আজ না হয় কাল, এই তো, নাও, নাও দেহিনি, নাও …. ;
এই ভাবে সকালবেলাটা এক একদিন শুরু হয়। এই ভাবে এক একটা দিন এখানের জীবনযাপনের সঙ্গে পরিচিত হতে থাকি আর এক ছন্দে।
মা অফিসে চলে গেলে কিম্বা মা থাকতে থাকতেই শিবানী, মলি, ওদের কেউ না কেউ আসে এ বাড়িতে ঠাকুর পুজো দিতে। কারণ প্রায় দিনই তার দেরি, এবং ওদের আসা, আজ শিবানী তো কাল মলি, একজন না একজন আসেই। তারপর অনেক বেলা অবধি মায়ের ঠাকুর দেবতার পুজোপাঠ সেরে, শঙ্খে ফু দিয়ে পুজো শেষ করে আমার পাশে এসে বসে। বসে নানা গল্পগাছায় সময় কাটিয়ে দেয়। আমিও এক অদ্ভুত আনন্দে সেই সঙ্গসুখ অনুভব করি। ওরা নানা প্রশ্ন করে জানতে চায় আমার কাছ থেকে, বাংলাদেশে থাকতে এমন সময়গুলোতে আমি কী করতাম ?
তার অর্থ, কীভাবে ওখানকার দিনগুলি কাটতো আমার পড়াশোনার বাইরে ? এখনও ওখানের জন্যে আমার মনখারাপ আছে কি না , এইসব।
নানা সত্য-কল্পনা মিশিয়ে তাদের জানাতাম এই কিছুদিন আগের আমার ফেলে আসা সেইসব সময়ের কথা। ওরাও সে সব শুনে যেত বেশ মন দিয়ে। বলতো, বাবা ! কী সুন্দর রে ! জানিস, আমার না ভীষণ যেতে ইচ্ছে করে, ওই দেশটিতে নিয়ে যাবি আমারে একবার ?
আমি বলতাম, নারে, এহনে তো আর যাওয়া হচ্ছে না, পরে গেলি নিয়ে যাবানে ----
ওরা আমার শেষের যাবানে কথাটা শুনে বলতো, যাবানে ,খাবানে এসব আবার কী ? এইসব যাবানে টাবানে, যাতি টাতি, করতি, দেখতি এইসব বাদ দে এবার, ক, যাবো, যাবো বল দেখি একবার, অভ্যাস এবার পাল্টা !
এরপরেই মুখটা হঠাৎ বেশ ঘোর করে ফ্যাকাশে করে বলতে থাকতো একটানা ---- না বাবা, কাজ নেই যাইয়ে ,আমার বাবার কাছে সব তো শুনেছি, তারা কীভাবে পালিয়ে এসেছিল সব কিছু ছেড়ে-ছুড়ে রাতের অন্ধকারে; নৌকো, স্টিমার,গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, হাঁটা পথ কতো সে সব কাহিনী, সব বাবা মার মুখে শুনেছি তো ; ---- জানিস, আমাদের কতো বড় বাড়ি ছিল ! পুজো হতো ঢাকঢোল বাজিয়ে, আমাদের বাড়ির পুজো উপলক্ষে গ্রামের মধ্যে মেলা হতো ---- আরো কত আড়ম্বর, অনুষ্ঠান, সব ফেলে পালিয়ে চলে আসতে হলো আমাদের ! আমরা তো জন্মাইনি তখন, তাই আমরা দেখতে পাইনি, শুনেছি সবই, বাবা মার কাছ থেকেই।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তোর বাবা মা এখনো সেসব গল্প বলে ?
সে বলে, এখনো মাঝে মাঝে পুরোনো লোকজন এলে, দেশের কথা উঠলেই বাবা বলে।
তবে আগে খুব বলতো, আমরা যখন ছোটো ছিলাম, আমাদের বড়দা তো দেখেছে খানিকটা, সে বলে । কখনো কখনো বলতে বলতে বড়দার মুখটা কেমন হয়ে যায় জানিস তো ! এই তো, এবারে যদি পুজোয় এখানে থাকিস তো দেখতে পাবি, আমাদের বাড়ির দুর্গা পুজো কেমন হয়। বেশ মজা করবো তোকে নিয়ে এবার…!
ভেতরে ভেতরে বেশ একটা কম্পন হতো যেন। মনে হতো যেন রক্তের ভেতরে একটা ঢেউ দিল কে এসে ! এমন আনন্দঘন মুহূর্তের কথা এ ক'দিন কেউ তো বলেনি ! তারপরে ওরা কি সহজ ভঙ্গিমায় আমাকে জানাতো, পুজো এলে ওরা আমাকে নিয়ে কী কী করবে তার একটা বড় তালিকা গড়গড় করে বলতে থাকতো।
ওদের বাড়ির ভেতরে ওদের দাদা অলোকের সঙ্গে যেদিন প্রথম গেছিলাম, সেদিন যে যে জিনিস দেখেছিলাম, এবং মুগ্ধ হয়েছিলাম, তার কথা তো মনে আছেই। কি সুন্দর করে সাজানো গোছানো ওদের ঘরদুয়োর গুলো। বাড়ির ভেতরে কী সুন্দর একটা অন্দরমহল। যেখানে সান-বাঁধানো চাতাল ! ঠিক আমার ঠাকুমার বাপের বাড়ির মতো। সেই ভবানীপুরের বাড়িটার মতনই তো খানিকটা ! মনে মনে ভাবতাম, সব সম্পদশালী মানুষজনের বাড়ির অন্দরমহলটা মনে হয় এরকমই হয় দেখতে ! সেই একই গন্ধ, এক-ই ধরণের একটা গমগমে ভাব চারদিকটা ; সেই যে, দেখেছিলাম ঝুড়ি ঝুড়ি তরিতরকারির সমারোহ, বড়ো বড়ো মাছ, আলু-পটলের ডাঁই, এইসব, সব কিছু মিলে সে-ই যে একই ছন্দ যেন চারদিকের পরিবেশটুকুতে।
এসব দেখে-শুনে কেন জানি না নিজের ভেতরে নিজেই ছোটো হয়ে যেতাম। ভাবতাম, কতো গরীব এই আমরা ! আমাদের তো টালির চালের ঘর। একখানা ঘরের মধ্যে সয়াল-সংসার। আর এরা, কতো বড়ো বড়ো ঘরদুয়োরের মধ্যে থাকে ! কিন্তু একটা কথা ভেবে পরমুহূর্তেই কূল কিনারা পেতাম না, ভাবতাম, আচ্ছা, এরা যে এতো ধনী, কই , তাও দেখি আমার মা উঠোনের উপর থেকে শিবানী মলি বলে ডাকলেই চলে আসে ; এসে কী আন্তরিকভাবে সব কিছু সামলে দিয়ে যায়। এক একদিন কিছু রান্নাবান্না থাকলে তাও তো করে, আমাকে একেকদিন ভাত বেড়ে খেতেও দেয়। ঘর ঝাঁট দিয়ে দেয় নিজেদের আনন্দেই । এমনকি থালাবাসন গুছিয়ে-গাছিয়েও দিয়ে যায়। ঠাকুর পুজো তো আছেই। বিছানা বালিশও গুছিয়ে রাখে। আলনা গুছোয়। কে বলবে যে এটাও ওদের বাড়ি না !
এসব সব অবশ্য কাজের দিদির অনুপস্থিতি হলে তবেই। সেই দিনগুলোতে ওরাই দুই বোন এইভাবে সব সামলায় !
এইসব দেখেশুনে দিন যত যাচ্ছে ততোই ওদের পরিবারের সঙ্গে বেশ একটা একাত্মতা অনুভব করতে লেগে গেলাম।
আলোক আমাকে বাগান তৈরি করা শিখিয়ে দিচ্ছে। উঠোনের সামনেটায় যে জায়গাটাতে ঘাসজঙ্গল পরিষ্কার করে নিয়ে , কোদাল দিয়ে মাটি কুপিয়ে নিয়েছি বেশ করে, সেখানে সে এসে প্রতিদিন দেখে যেতে লাগলো মাটি তৈরি হয়েছে কি না। তারপরে একদিন রাণীকুঠির একটি বড় বাগানবাড়ির মালির কাছে নিয়ে গেছিল, সূর্যমুখী ফুলের এবং জিনিয়া ফুলের চারা নিয়ে আসার জন্যে ।এমনকি সেখানে প্রথম দিনের চারার দামও ওই দিয়ে দিয়েছিল। আমি বলেছিলাম, কিরে, তুই দিচ্ছিস যে ?
ও তাতে বলে, ঠিক আছে, পরে না হয় তুই একদিন দিয়ে দিস।
বলেছিলাম তাকে, পরে আবার কবে হবে তা কি জানি ! ঠিক আছে মার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে দিয়ে দিবানে তোরে কিন্তু ---- !
তা শুনে ও বেশ একগাল হেসে বলতে থাকলো, ঠিক আছে, ঠিক আছে বললাম নারে বাবা, পরে একদিন হবে হিসেব টিসেব সব, এখন চল তো --- ;
পিঠে চাপড় দিয়ে বললো, চল, চল, ঠিক আছে, দিসেনে না হয় ----।
অত্যন্ত যত্নে গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে গাছগুলিকে লাগিয়ে দিয়েই খালাস হলো না সে, পরে এসে প্রতিদিন দেখে যেতে লাগলো, ঠিক আছে কি না। কিছু অসুবিধা দেখলে নিজেই পরিচর্যা করত। সকালের বেশ খানিকটা সময় কাটত রোজই এইসব নিয়ে ওর সাথেই।
তাই ইদানিং সকাল থেকে দুপুরের আগে পর্যন্ত বেশ কেটে যেত। কিন্তু যেই দুপুরবেলার খাওয়া দাওয়া মিটতো, সেই কেন জানি না আমার মনটাও খারাপ হয়ে যেত। কাজের দিদি তখন হয়তো গরুর কাজ নিয়ে ব্যস্ত বা সংসারের এটা ওটা কাজ নিয়ে কলতলার দিকটায় আছে, হয় তো বাসনকোসন এটা ওটা নিয়ে ব্যস্ততা তার । আর আমি সামনের জানলাটায় মুখ বাড়িয়ে দিয়ে ,খাটের উপর থেকে আধ-শোয়া অবস্থায় বাড়ির সামনের দিকের থেকে যে আকাশটুকু দেখা যায়, সামনের বাড়ির মাসিমাদের ঘরের পেছনের, যেসব বড় বড় ঝাউগাছের ফাঁক দিয়ে তার উপরের আকাশটার দিকে চেয়ে চেয়ে কত কথাই না ভাবতাম ! তার কোনোটার সঙ্গে কোনোটার মিল নেই যদিও, অথচ আমি তাতেই ভেসে বেড়াতাম নানাভাবে এদিক ওদিক। একবার এদেশ তো একবার ওদেশ। এইসব করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম, তাও যেন মনে থাকতো না কিছুই। বিকেলে যখন ঘুম ভাঙতো তখন চোখ মেলে দেখতাম মাথার কাছে কখন মলি এসে বসে বসে কাজের দিদির সঙ্গে বকবক করছে। আমার ঘুম ভেঙেছে দেখে বলতো, বাবা , কী ঘুম রে বাবা ! এত যে বকবক করছি ঠাকুমার সঙ্গে তাও মহারাজের ঘুম ভাঙার নাম নেই !
মাথায় হাত দিয়ে চুলগুলো নাড়তে নাড়তে বলতো, এবার উঠবি তো ?
বলতাম, উঠে কী করবো আর, তাই বল ?
ও বলতো, চল, ঘুরে আসবি চল। তোকে নিয়ে আজ কংগ্রেস নগরের দিকটায় যাবো…।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ওদিকে কী আছে ?
ও বলতো, চল না, ঘরে বসে বসে কী করবি, তাই বলতো আমাকে একবার !
শুনলাম, ইস্কুলে যাসনি ?
ও বললো, হ্যাঁ…. গেছিলাম তো, এই তো বাড়িতে এসেই খাওয়া-দাওয়া করে চলে আসলাম এখানে। ভাবলাম, দেখি, আজ তোকে একটু বাইরে নিয়ে যাবো। সারাদিন শুধু বাড়ির মধ্যে বসে বসে কী করিস তা তুইই জানিস ; আরে, মানুষের সঙ্গে মিশতে হয় তো এক-আধটু, নাকি মিশতে হয় না, তাই বলতো !
বললাম, হ্যাঁ …তা তো হয়, কিন্তু আমি তো এখানে আর কারো সঙ্গে সেরকম মেলামেশা করতে পারিনি। কত নতুন মানুষজন, কাউকে তো সেরকম চিনিও না ; তাছাড়া জানিস তো , ইচ্ছাও করে না, ওই যে, তোর দাদার সঙ্গে সেদিন একটু গেছিলাম, ওই তো, তারপরে আর বের হইনি।
ও বলে, ঠিক আছে, ঠিক আছে, সে যাই হোক, আজ তুই আমার সঙ্গে চল।
বললাম, আজ না, কাল, কাল না হয় যাবো। কাল রবিবার তো, মাও বাড়িতে থাকবে, কাল না হয় হবে, আজ তার চাইতে তোর সঙ্গে একটু গল্প করে সময় কাটাই, একটু পরেই তো সন্ধ্যে লেগে যাবেনে, তাই আজ থাক, কাল দেখবানে …
এইভাবে নানা কথা বলে সেদিনটা ওকে থামাতে পারলাম। পরদিন আবারো ওর টানা-হেঁচড়া। কিন্তু সেদিনও আর একভাবে বুঝিয়ে বাঝিয়ে ওকে থামিয়ে দিলাম একই রকম ভাবে।
এইভাবে একদিন দু'দিন হবার পরে সে নিজেই ভীষণ বিমর্ষ হয়ে গিয়ে বললো, আচ্ছা, কেন বলতো, তোর কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না ? আমি তো কিছুতেই বুঝতে পারি না, কেন তোর এক রকমের একটা অদ্ভুত ভাব ?
আমি কিন্তু ভেবে দেখেছি এই বিষয়টা নিয়ে, কোনো উত্তর পাইনি। কী অদ্ভুত মানুষ রে বাবা তুই --- !
এদিকে খুব আড়ালে এদিক ওদিক চাওয়া-চাওয়ি শুরু হয়ে গেছে অন্তরে। কিছু পড়া যায় কী, কী ভাবেই বা তা যায় ? যদিও লেখার কথা মনে আসছে না তেমন কিছুই। সমস্ত দিন বাগান, একটু-আধটু ঘাস-মাটি, গাছের চারা, এইসব নাড়াচাড়া---; আর বেলা বাড়তে থাকলে বারান্দায় মোড়া পেতে বাড়ির সামনের রাস্তার মানুষজনের চলা-ফেরা লক্ষ্য করা। কাজের দিদি উনুনে কয়লা দেয়, তালপাতার পাখার হাওয়া টেনে ফের আঁচ ধরায় , মা চলে গেলে অফিসে ----- তার আগে এক চোট খানিকটা রান্নাবান্না হয়েছে যা, তাই খেয়েই মা চলে গেলে হনতদন্ত হয়ে বাসস্ট্যান্ড মুখো, সে তার পরের রান্নাটুকু করবার জন্যে নিভে যাওয়া উনুনে আবারও কাঠকুটো গুঁজে দিয়ে, ঘুটে ভেঙে ভেঙে সাজিয়ে দেয় ও কয়লা চাপায়।
এসব সব চেয়ে চেয়ে দেখি আমি। তাকে কোনো সহযোগিতা করতে পারি না যদিও, তবু ভাবি তার রোজকার এই কর্মপদ্ধতির কথা। জ্বালানির এই এক সমস্যা, যা ও দেশে থাকতে সেরকম দেখিনি ! ওখানে যেন সবকিছুই সোজা। দাও পাটকাঠি ঠেলে উনুনে, তারপর কাঠ, এবার আগুন দেও, এবার তুমি যত খুশি রান্নাবান্না করো। এখানে তা না। সবই কয়লা ঘুটে কেরোসিন তেল নির্ভর। না হলে স্টোভ ।কেরোসিন মজুত করতেই হবে, তাহলে কিছুটা স্বস্তি, তা না হলে ঝক্কির শেষ নেই।
ঠাকুর পুজো করার পদ্ধতি আজকাল কাজের দিদিকে মা দেখিয়ে দিয়েছে। রোজ রোজ তো আর পরের মেয়েকে ডাকা যায় না, তাদেরও তো বাড়ির কাজকর্ম কিছু থাকে ! যদিও ওরা না ডাকলেও আসে, তবুও আজ ক'দিন হলো কাজের দিদিই গোটা প্রকৃয়াটা বেশ আয়ত্তে এনে ফেলেছে যেন। কীভাবে রামঠাকুরের পটে জামাকাপড় পরাতে হয়, কীভাবে কৃষ্ণ ও রাধারাণীকে কাপড় চোপড় ছাড়িয়ে পরাতে হয়। তাই ইদানিং কাজের দিদি সব কিছু গুছিয়ে দিয়ে মাকে বলে, ও মাসিমা, এবার তুমি একটু নিবেদনটা করে দেও।
মা তখন হয়তো সবে স্নান সেরে উঠেছে, তার আগে ডানদিকের আলগা চাতালে সূর্য প্রণামের মন্ত্র উচ্চস্বরে উচ্চারণ করা শেষ হয়েছে তার। তারপরে থাকে গুরু প্রণাম। তাও মুখস্থ। আওড়াতে আওড়াতে মা চুল আঁচড়াচ্ছিল তখন চিরুনি দিয়ে। কাজের দিদির বলাতে নিবেদনটা সেরে দিয়েই কাজের দিদিকে বলে, হ্যাঁ গো মাসি, ঠাকুরের খাওয়া হয়ে গেলেই ফুল বেলপাতাগুলি চরণের ওপর থেকে সরিয়ে দিও।
তাই শুনে কাজের দিদি বলে, নাও গো মাসি, নাও তো, ওসব আমি ঠিক ঠিক করে দেবক্ষণ, এইটুকু সময়ে তোমার ঠাকুরের তেমন কোনো অসুবিধা হবে না। ততক্ষণ না হয় ওইটুকু ভার সহ্য করুক তোমার ঠাকুর।
মা অফিস চলে গেলে সেই আবার দিদি আর আমি। আর একজন যদিও আছে ওদিকে, তিনি এবার সকালের নিত্য আহারাদি সেরে নিয়ে, থেমে থেমে জাবর কাটছেন।
এগারোটা বাজলে গুড়ের সরবৎ গ্রহণ করেন তিনি ছোলার বেসন সহ। ইদানিং এই কাজটুকু সকালে আমিই নিয়েছি।
মা অফিসে চলে গেলে কাজের দিদি যখন তাকে স্নান করায়, তাতেও আমি তাকে জল এগিয়ে দি যদিও , তিনি তখন চুপ করে স্নান সারেন। তারপর গুড়ের সরবৎ খেয়ে ওইরকম মনের আনন্দে জাবর কাটেন।
বর্ষা শেষ হয়ে এসেছে প্রায়। শরৎ ঢুকে পড়েছে তার মেঘভাঙা রোদ বুকে করে। কোনো কোনো দিন সকাল সন্ধ্যায় তা টের পাই। ওপাশে সেনগুপ্ত বাড়িতে তো বড় একটি শিউলি ফুলের গাছ দেখা যায়। শিবানী মলিরা এখনো একবেলা না একবেলা আসে । যদিও মলিই বেশি আসছে ইদানিং। পাড়ার পুরোনো পরিচিত কয়েকজন আবার নতুন করে আসা-যাওয়া করছে। ডানপাশের ব্যানার্জি বাড়ির বড় ছেলেটা তো আমি এখানে আসার আগেই জলে ডুবে মারা গেছে। তার পরেরটা কাল্টু , ওই ইদানিং মাঝে মাঝে আসে। আর আসে ওপাশের কর্মকার বাড়ির ছেলে শঙ্কর। আসে মজুমদার বাড়ির ফোচন। ওদের সঙ্গে ইদানিং বেশ কিছুটা সময় কাটছে আমার।
দুপুরে ফোচনের ঠাকুমা এসে কাজের দিদির সঙ্গে লুডুর কোট বসায়। মাঝে মধ্যে শিবানী মলিরাও ভিড়ে যায় সেই সঙ্গে।
যদিও আমি কয়েকদিন সন্ধেবেলা হলে দিদির বাড়িতে চলে যাই। ফিরে আসি একেবারে রাতে মায়ের সঙ্গে। ততক্ষণ কাজের দিদি একাই বাড়ি পাহারা দেয়।
দিদির ছেলেটি তখনও খুব একটা ভালো করে হাঁটা শেখেনি । নানা পোশাকে -আসাকে তাকে সাজিয়ে রাখে দিদি। সে টলমল পায়ে বারান্দার গ্রিলের ভেতরে নানা ধরণের খেলনা নিয়ে নাড়াচাড়া করে।
মা অফিস ফেরত এখানে আসে দুটি কারণে। একদিকে নাতির পরিচর্যা আর একদিকে মা এলে দিদির একটু বাইরে বেরোনো হয়।
আমার বাড়তি একটা আনন্দ হয়েছে এখানে, সেটা হলো নতুন শাদাকালো টেলিভিশনে নানা অনুষ্ঠান দেখা । তখনও পর্যন্ত টেলিভিশনের জল-চল এতটা শাদামাঠা এলেবেলে হয়নি। ও পাড়াতে ওদের বাড়িতেই প্রথম টেলিভিশন আসে। এবং সে কারণে পাড়ার বেশ কয়েকজন সন্ধেবেলা হলে এ বাড়িতে চলে আসে ।
দিদির বাড়িতেই প্রথম রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত দেখি। দেখি অন্নদাদি শ্রীকান্ত। অন্নদাদি শ্রীকান্ত দেখে রাতের বালির চরের পাউড়ি ধরে সেই ইন্দ্রনাথের নৌকো ভাসানো --- অন্নদাদির ওখানে যাবার জন্যে, তাই দেখে কী স্বাভাবিক ভাবেই না বুকের ভেতরটায় মোচোড় দিয়ে উঠেই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো আপনা আপনিই । তারপরে কখন যে ভেসে চলে গেছিলাম নবগঙ্গার কাছে, তা আমি নিজেও জানি না। আজ আবার এই প্রথম তার টান নতুন করে অনুভব করতে থাকলাম বুকের ভেতরে ।কাউকে বলতে পারিনি তা। শ্রীকান্তের সঙ্গে সঙ্গে আমিও কখন আখড়া বাড়ির পথে নৌকো চালিয়ে ডাঙায় নৌকোটি বেঁধে রেখে জোছনা রাতে উঠে চলে গেছিলাম নদীর পাউড়ি বেয়ে সুপুরি জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যে পথটি আখড়া বাড়ির ভেতরে উঠেছে, সেখানে!
কিন্তু সেখানে তো অন্নদিদির মতো কেউ নেই! তাহলে---?
মনে মনে এই যে চলাচল, এই যে ছায়াছবির শ্রীকান্ত আর ইন্দ্রনাথ, ইন্দ্রনাথ আর শ্রীকান্তের কথোপকথন, এ যে কী ভাবে যেন আমায় একাত্ম করে ফেলতে লাগলো। তার রেশ পরদিন পর্যন্তও লেগে থাকলো মনের ভেতরে। শ্রীকান্ত কার লেখা, এর মধ্যে জেনেছি। মার কাছে বলেও রেখেছি, মা, দেখ তো , যদি পারো আমার জন্যে শরৎচন্দ্রের রচনাবলীর এক দুই খন্ড এনে দেওয়া যায় কি না।
তা শুনে মা বলেছে, আচ্ছা দেখি ব্রোজদাকে বলে দেখি, সে এনে দিতে পারে কি না।
বললাম, ব্রোজদা কে গো ?
মা বললো, ও আছে, তুই চিনবি না। ব্রোজদা আমাদের অফিসের একজন মানুষ। অফিসে অনেককেই দেখেছি কলেজস্ট্রিট থেকে বইপত্র এনে দেয়।
আমি বললাম, এনে দেয় মানে, টাকা নেয় না ?
----- নেবে না কেন , মাসে মাসে নেয়। দেখি, আমি তোর কথা বলবো, দেখি পারে কিনা এনে দিতে।
----- তাহলে তাকেই বলো। বেশ তো, ভালোই হবে, একখণ্ড একখণ্ড করে প্রতিমাসে তোমাকে দিক না উনি না হয় !
----- ঠিক আছে। শ্রীকান্ত পর্বটা যেখান থেকে শুরু হয়েছে সেটাই আগে দিতে বলবো তো ?
----- হ্যাঁ…. দেখ মনেহয় তাইই হবে, শ্রীকান্ত দিয়েই শুরু হয়েছে মনে হয়, তাই তো শুনেছি----- দেখ ----- প্রথম খণ্ডটাই দিক না আগে ;
কী যে আনন্দ হচ্ছে, কী যে একটা আহ্লাদিত হয়ে পড়ছে ভেতরটা ----- সমস্ত দিনই বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি তাই। বইগুলি নেড়েচেড়ে দেখতে পাবো ! সেই প্রথম শরৎচন্দ্রের লেখার সঙ্গে কয়েকদিনের মধ্যেই পরিচয় ঘটলো।
একদিন বেশ বিকেল বিকেল মা বাড়ি চলে এল। সন্ধ্যার প্রথম আলোয় সেই আমার বই পাওয়ার আনন্দ ! সেই শরৎচন্দ্রের চেহারাটি আলাদা ভাবে দেখা মলিটটি খুলেই। কিন্তু রচনাবলী বস্তুটি কি তখনও ভালো করে পরিষ্কার তো বুঝতাম না, তাই ভাবছি, কটি খণ্ড তাই বা কে জানে ! যদিও পরে সে চিন্তার অবসান ঘটলো, তবে সে তো অনেক দিনের পরের কথা-----
( ক্রমশ )