সোমবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

অনুবাদ কবিতা * স্বপন নাগ

 


প্রতিবেশী সাহিত্যের প্রতি বাঙালি পাঠকের উদাসীনতা বরাবরই। এই উদাসীনতা যত না পাঠকদের, তারও বেশি প্রকাশনা সংস্থাগুলোর। বহু ভাষার এই ভারতবর্ষে আমরা খোঁজ রাখি না অন্য ভাষার লেখালেখির। ফলে জানতেও পারি না, কী আর কেমন চর্চা হয় সেই সব ভাষার সাহিত্য। খুব সামান্য সন্ধিৎসু পাঠক ছাড়া হিন্দি, অসমীয়া, ওড়িয়া, পাঞ্জাবি, তামিল, তেলুগু প্রভৃতি ভাষার লেখালেখির সঙ্গে অপরিচিত।

          অনুবাদেই সম্ভব সেই অপরিচয়ের অন্ধকার সরিয়ে সব প্রতিবেশী ভাষার সাহিত্যের আস্বাদন নেওয়া। নাগার্জুন, নরেশ মেহতা, সর্বেশ্বরদয়াল সাক্সেনা, ওমপ্রকাশ বাল্মীকি এবং হূবনাথ পান্ডে এই নির্বাচিত পাঁচ জন কবির পাঁচটি কবিতা পড়া যাক বাংলায়নে।পরিশ্রমসাধ্য এই কাজটি করেছেন আর এক বাঙালি কবি স্বপন নাগ । পড়ছি দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পাঁচজন কবির পাঁচটি কবিতা সংক্ষিপ্ত পরিচিতি-সহ


পাঁচটি হিন্দি কবিতা * পাঁচজন কবি

                 

             

নাগার্জুন : বিহারের দারভাঙ্গায় জন্ম হিন্দি কবিতা জগতের জনপ্রিয় এই কবির, ১৯১১ সালের ৩০শে জুন। আসল নাম বৈদ্যনাথ মিশ্র। হিন্দি ছাড়া মৈথিলী ভাষাতেও কবির অবদান উল্লেখযোগ্য। মৈথিলী ভাষায় লেখা কাব্যগ্রন্থ 'পত্রহীন নগ্ন গাছ'- এর জন্য কবিকে অকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়। 'রতিনাথ কী চাচী', 'বাবা বটেসরনাথ', 'দুখমোচন', 'বরুণ কে বেটে' প্রমুখ তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হিন্দি কাব্যগ্রন্থের নাম। ১৯৯৮ সালের ৫ই নভেম্বর কবি নাগার্জুন প্রয়াত হন।         



 বাঁচল শুধুই আন্ডা * নাগার্জুন     


পাঁচ  পুত্র   ভারতমাতার ,  শত্রুও  দুর্বার

গুলিতে খতম এক পুত্র, বাঁচল বাকি চার

চার পুত্র ভারতমাতার, চতুর এবং প্রবীণ

দেশান্তরী হল  একজন , বাকি রইল  তিন

তিন পুত্র ভারতমাতার, মারামারিতেই মত্ত

একটি হল পৃথক, এবার থাকল দুজন মাত্র

দুই  পুত্র ভারতমাতার , একজন তার থেকে

যেই বসল আঁকড়ে গদি, ঠেকল শেষে একে

এক পুত্র ভারতমাতার, কাঁধেতে তার  ঝান্ডা

পুলিশ ধরে ভরলে জেলে, বাঁচল শুধুই আন্ডা













 

নরেশ মেহতা : মধ্যপ্রদেশের মালওয়া অঞ্চলের শাজাপুরে ১৯২২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন কবি নরেশ মেহতা। তাঁর 'অরণ্যা' কাব্যগ্রন্থকে পুরস্কৃত করে সাহিত্য আকাদেমি। ১৯৯২ সালে কবিকে সম্মানিত করা হয় জ্ঞানপীঠ পুরস্কারে।১৯৯৮ সালের ৫ই নভেম্বর কবির জীবনাবসান হয়। 


মা * নরেশ মেহতা


জানি না,

কেননা কখনোই দেখিনি সেভাবে -

তবে যতটুকু

যেখানেই গোবর-লেপা ঘর উঠোন

যেটুকু

যেখানেই চালগুঁড়োর আলপনায়

প্রতিদিন সেজে-ওঠা চৌকাঠ,

অথবা যতখানি

ফোড়ন দেবার সময়

মেথি ভাজার সুগন্ধ,

যা-কিছু

যেখানেই দেখি দূর পথের দিকে

আশঙ্কা-ভরা তাকিয়ে থাকা -


সেখানেই,

হ্যাঁ সেখানেই দেখি মা !



সর্বেশ্বরদয়াল সাক্সেনা : কবি সর্বেশ্বরদয়াল সাক্সেনার জন্ম উত্তর প্রদেশের বস্তী জেলায়, ১৫ই সেপ্টেম্বর ১৯২৭। তাঁর কয়েকটি কাব্যগ্রন্থের নাম 'কাঠ কী ঘন্টিয়াঁ', 'বাঁস কা পুল', 'এক সুনী নাও', 'গর্ম হবায়েঁ' প্রভৃতি। ১৯৮৩ সালে 'খুঁটিয়োঁ পর টঙ্গে লোগ' কাব্যগ্রন্থের জন্য তাঁকে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার প্রদান করা হয়। সে বছরই ২৪শে সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।


তোমাকে * সর্বেশ্বরদয়াল সাক্সেনা


এলাম ফিরে, কোনো কথা বললাম আর কই !

শব্দে শুধু হাহাকার আজ

ব্যথা যেন হয়েছে দরাজ

যা বলেছি এতদিনে, রইল অব্যক্তই।


রাস্তা ক্রমেই যাচ্ছে বেড়ে

ঘর ছেড়ে যায় নিকট ছেড়ে

চলেছি একসাথে, তবু অজানা হয়েই  রই !


বিস্তারে গিয়েছি যত

নিজেকে গুটোলে তত

দুঃখ অসহ্য তোমার, আমি কিন্তু সই !


এলাম ফিরে, কোনো কথা বললাম আর কই !





ওমপ্রকাশ বাল্মীকি : উত্তর প্রদেশের মুজফ্ফরনগরের প্রান্তিক এক গ্রাম বরলা। ১৯৫০ সালের ৩০শে জুন এই গ্রামের অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে জন্ম কবি ওমপ্রকাশের। হিন্দি দলিত সাহিত্যে তিনি একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কবি। জাতপাত, সামাজিক বৈষম্য এবং সেসবের বিরুদ্ধে কন্ঠস্বরকে জোরালো করার ডাক তাঁর কবিতার বৈশিষ্ট্য। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলির নামকরণ থেকেই আন্দাজ করা যায় কবিতার বক্তব্য - 'সদিয়োঁ কা সন্তাপ', 'বস্ বহুত হো চুকা', 'অব অওর নহী' প্রভৃতি। ২০১৩ সালের ১৭ই নভেম্বর কবি ওমপ্রকাশ বাল্মীকি প্রয়াত হন।


ঠাকুরের কুয়ো * ওমপ্রকাশ বাল্মীকি


উনুন মাটির

মাটি পুকুরের

পুকুর ঠাকুরের।


খিদে রুটির

রুটি বজরার

বজরা ক্ষেতের

ক্ষেত ঠাকুরের।


বলদ ঠাকুরের

লাঙল ঠাকুরের

লাঙলের মুঠো আমার হাতে

ফসল কিন্তু ঠাকুরের।


কুয়ো ঠাকুরের

জল ঠাকুরের

ক্ষেতখামার ঠাকুরের

গলি-মহল্লা ঠাকুরের

আমার, তাহলে আমার কী ?


গাঁ ?

শহর ?

দেশ ?




হূবনাথ পান্ডে : ১৯৬৫ সালের ১৩ই এপ্রিল বেনারস শহরে জন্ম কবি হূবনাথ পান্ডের। সমাজ ও রাজনীতি সচেতন এই কবির কবিতা অত্যন্ত দক্ষতায় ধারণ করে সমসময়কে। তাঁর এযাবৎ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের নাম 'মিট্টী', 'কৌয়ে', 'লোয়ার পরেল' এবং 'অকাল'। কবি হূবনাথ পান্ডে মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দি বিভাগের অধ্যাপক।


গল্প রয়ে যাবে * হূবনাথ পান্ডে


গল্পের বাইরে কিছুই নেই।


আমরা আছি পৃথিবীতে আর

এই পৃথিবী আছে এক গল্পে।


শতাব্দী-প্রাচীন এক বুড়ি আমাদের গল্প শোনায় :

সূর্য পিতা, ধরিত্রী মাতা, চাঁদ মামা আর

আকাশজোড়া নক্ষত্র রামের ধেনু।

পিতার কোল থেকে বেরিয়ে

প্রিয়ার মিলনে বয়ে চলেছে নদী ;

গল্পের রাজা বৃদ্ধ, অশক্ত ও নিরাশ

আর রাণী চির প্রতীক্ষিত।

সেই গল্পের রাজকুমার হারিয়ে যায় বনে,

চোখের জলে ভাসে রাজকুমারী।

যত রাক্ষস সব অবরুদ্ধ

আমাদের হৃদয়ে বন্দি যে তোতা

তাতে নাকি আটকে আছে সব রাক্ষসের প্রাণ !


গল্পে পেরিয়ে যায় শতসহস্র বছর

এক একটি মুহূর্তের মত

আমরাও থেকে যাই এই গল্পের ভিতর।

গল্পের ভিতর থেকে আর্তনাদ করে ওঠে

বিশাল বিশাল সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ,

স্বৈরাচারীদের পরিত্যক্ত কবর,

কানাকড়ির দামে কুবের আর

ঝনঝনিয়ে ওঠে জংধরা ভাঙা তরবারি ...


বুড়ি গল্প বলে -

একদিন আমি গল্প হয়ে যাব, তুমিও।

রয়ে যাবে শুধু সেই বুড়ি আর

রয়ে যাবে কখনো শেষ-না-হওয়া এই গল্প !


••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••

'বাকী বচ গয়া অন্ডা', 'মা', 'তুমসে', 'ঠাকুর কা কুয়াঁ', এবং 'কহানী রহ জায়গী' মূল শিরোনামের এই কবিতাগুলির হিন্দি থেকে অনুবাদ : স্বপন নাগ

••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••



স্বপন নাগ


২টি মন্তব্য: