উত্তরবঙ্গ চিরকালই বঞ্চিত ও রাজধানীর উপেক্ষায় অবহেলিত
জিষ্ণু নিয়োগী
উত্তরবঙ্গের কপালে দেশভাগের কোপ পড়েছিল যেমন তীব্র, রাজধানী কলকাতার উপরে পড়েছিল ছিন্নমূল সর্বহারার দল—এসব শুনেছি পূর্বপুরুষদের কাছে। শিয়ালদহ স্টেশনে শোনা যেত কাতারে কাতারে মানুষের ‘ভাত দাও, ফ্যান দাও’ চিৎকার। কম্যুনিস্ট পার্টির তৎকালীন মানুষ সর্বহারাদের বাসস্থান হিসাবে উত্তরে দমদম, সিঁথি আর দক্ষিণে যাদবপুর, গড়িয়া, সোনারপুর, আদিগঙ্গার খালপাড় ধরে জমি দখল করে পাইয়ে দিয়েছিল ছিন্নমূল মানুষকে। আজ অবশ্য তারাই প্রচুর সম্পত্তির অধিকারী, যদিও বালিগঞ্জ, গড়িয়াহাট, যোধপুর পার্ক, ঢাকুরিয়া্র উচ্চবিত্তরা তাদের বসতিবাসী ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না। দুধে জলে এক হয়ে তারাও আজ বৃহৎ কলকাতাবাসী।
এই দীর্ঘ ইতিহাসে বঞ্চিত উত্তরবঙ্গবাসী। কলকাতার সংস্কৃতি, কলকাতার মিথ্যে ঠাঁটবাট ক্রমশ গ্রাস করছে উত্তরবঙ্গকে—কেন? কারণ আমরা উত্তরবঙ্গবাসীরা হ্যাংলা এবং উচ্ছিষ্টই আমাদের পাথেয়। আমরা ওদের মিথ্যে বচনে আকৃষ্ট হই। একবার ভাবুন রাজধানীর কী আছে। পাট, চা, কাঠ, পর্যটন বা অন্যান্য যা সামগ্রী তা তো উত্তরবঙ্গের, অথচ আমরা উত্তরবঙ্গবাসীরা বঞ্চিত। কোনো প্রতিবাদ নেই। একটু অনুযোগ করলেই, এ মাও সে ছাও ছাপ্পা লাগিয়ে উত্তরবঙ্গের কণ্ঠরোধ করতে বদ্ধ পরিকর। উত্তরবঙ্গ এবং পূর্ববঙ্গের যত মেধাবীদের নিয়েই দম্ভ কলকাতাবাসীর। আর তারাও নীল জলে স্নান সেরে নিজেদের অদ্ভুত প্রাণী সাজাতে ব্যস্ত। উত্তরবঙ্গের মানুষ বেশির ভাগই অলস ও প্রতিবাদহীন, তাই তারা কোনোদিন গুরুত্ব পাবে না, রাজধানী যা ভাববে তাই মেনে নিতে হবে আমাদের মতো মেনিমুখোদের। এই প্রতিবাদহীনতার জন্যই ক্রমশ বঞ্চনার শিকার হচ্ছে উত্তরবঙ্গ। পত্র-পত্রিকায় ‘গৌড়বঙ্গ’, ‘উত্তরবঙ্গ’ করবে কর্পোরেট হাউস তথা প্রচারমাধ্যম, আর সরকারও ‘উত্তরবঙ্গ পর্ষদ’ তৈরি করবে, কিন্তু কিছু শিক্ষিত মানুষ প্রতিবাদ করলেই সেটা হবে অপরাধ। এভাবে সবাই নিশ্চুপ থাকলে উত্তরবঙ্গের উন্নতি কখনোই সম্ভব নয়। রাজধানী সব গ্রাস করে ঠিকই, কিন্তু পাশাপাশি শহর গ্রামও উন্নত হয়। স্বাধীনতার সত্তর পার হলেও উত্তরবঙ্গের উন্নতি তেমনভাবে হয়ে ওঠেনি। এর দায় উত্তরবঙ্গবাসীর, কারণ তারা আদায় করে নিতে পারেনি অধিকার। আসলে আমরা বেশির ভাগ উত্তরবঙ্গবাসী চিড়িয়াখানার অদ্ভুত প্রাণী—কিছুতেই হেলদোল নেই আমাদের। উত্তরবঙ্গের চিকিৎসা শিক্ষা সবই নির্ভর করে কিছু ডান-বাম ধান্দাবাজ রাজনৈতিক নেতাদের উপর। তারা জণগণকে যেভাবে পরিচালিত করে, অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত গরিবগুর্বোরা সেভাবেই চালিত হয়। নিজেদের স্বাভিমান বলে উত্তরবঙ্গের কিছুই নেই। মনে পড়ে ছেলেবেলায় পড়া লীলা মজুমদারের দুটি লাইন—‘বন থেকে জানোয়ার তুলে আনা যায়, জানোয়ারের মন থেকে বন তুলে ফেলা যায় না’। ‘কালকুট্টা’ যেমন ব্রিটিশরা ভুল উচ্চারণ করতেন, যেহেতু বাংলা বলতে পারতেন না তারা, তাই এখন আমরাও দাবি করছি কলকাতা বাদ দিয়ে সুতানটি, গোবিন্দপুরকে অবলুপ্ত না করে তিনটি নামই থাক রাজধানীর। কলকাতার নাম হোক ভিন্ন ভিন্ন। কারণ তারা যদি এক পশ্চিমবঙ্গকে উত্তরবঙ্গ, গৌড়বঙ্গ, রাঢ়বঙ্গ করতে পারেন, তাহলে কল্লোলিনী কলকাতা পুরনো নামেই চলে যাক। আমাদের আক্ষেপ একজন কবি যদি তার কবিতার বই ছাপাতে চান, তার প্রকাশনী সংস্থার ঠিকানা ঝামাপুকুর লেন বা কলেজস্ট্রিট, কলকাতা—৭০০০০৯ হতে হবে। উত্তরবঙ্গ থেকে প্রকাশিত হলে ওই বই কেউ ছুঁয়েও দেখবে না—এটাই পরিহাস এবং যন্ত্রণার।
(এই লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব)
**********************************************************
জিষ্ণু নিয়োগী
নাট্যচর্চায় নিবেদিত প্রাণ জিষ্ণু নিয়োগী ' তূনীর' নামে একটি নাট্যদল পরিচালনা করেন। এর পাশাপাশি মূলত প্রবন্ধ ও গল্প লেখেন। বালুরঘাটনিবাসী এই লেখকের লেখা বালুরঘাট বার্তা, বরেন্দ্রভূমি, দক্ষিণ দিনাজপুরবার্তা প্রভৃতি কাগজে প্রকাশিত হয়েছে।
নাটকের জন্য কয়েকটি পুরস্কারও আছে তাঁর মুকুটে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন