সোমবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

অণুগল্প * দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়



ণুগল্প সাহিত্যের একটি বিস্ময়কর শাখা। ' বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন ?' ঠিক তাও নয় যেন, বিন্দুতে সপ্তসিন্ধু দশ দিগন্ত চকিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সার্থক অণুগল্পে। তেমনই একটি অসাধারণ অণুগল্প এবার আমরা পড়ছি দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়-র কলমে -----


পবিত্র শিখা জ্বালো

দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়


রাস্তা বা ডাস্টবিন ঘেঁটে প্লাস্টিক কুড়োয় হারু।তারপর প্রদীপদার গোলায় বিক্রি করে যা টাকা পায় তাতেই দিন গুজরান। কলোনিতে এক কামরার টালির চালের ছোট্ট ঘরে বউ-ছেলে নিয়ে ওর সংসার। স্বপ্নও নেই।তাই স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনাও নেই।এ জীবনে ও বুঝে গেছে, সকলে সব কিছু পায় না। চায়ের দোকানে বসে মাষ্টারমশাই বলেন,"ভগবানের একটা অঙ্ক আছে, সকলকেই সমান দেন। কাউকে টাকা দিলে শান্তি দেন না। আবার কাউকে শান্তি দেন,টাকা নয়। বড়ো বিচিত্র এ লীলা "! মাঝে মাঝে রেডিওয় মজার গানটা শোনে:"মাথা ভরা টাক দিলি,আ-কার দিলি না"। মনে মনে হেসে ফেলে হারু।

           প্রতিদিনের মতো সেদিনও ভোরবেলা বস্তা কাঁধে রাস্তায় ও। রাস্তার কুকুরগুলো প্রথমদিকে আঁচড়াতে কামড়াতে এলেও এখন আর তাড়া করে না। ওরা বুঝে গেছে এর থেকে ওদের বিপদের সম্ভাবনা নেই।বাজারের ডাস্টবিনে প্রচুর প্লাষ্টিক থাকে বলে ও আগে ওখানে যায়।আজ ডাস্টবিনে হাত দিতেই একটা ভারী ব্যাগ পেল। ব্যাগের চেন খুলতেই ওর মাথা ঘুরে গেল।থোক থোক পাঁচশো , দু'হাজার টাকার বান্ডিল।অতো টাকা দেখে বুকের ভেতর ভয়ের এক ঠান্ডা স্রোত বইতে লাগলো। ব্যাগটা ওখানেই ফেলে এগিয়ে এলো কিছুটা।পরে মনে হলো, ঈশ্বর বোধহয় মুখ তুলে চাইলেন ওর দিকে।এ ওনারই দান।ছুটে গিয়ে ব্যাগটা তুলে নিয়ে বস্তায় ঢুকিয়ে দিয়ে সোজা বাড়ির পথে ও।আজ আর কোথাও নয়।

          বাড়িতে গিয়ে বউকে সব বললো ও।বউয়ের তো  টাকা দেছে মূর্ছা যাবার অবস্থা।অতো টাকা ! ভয় আনন্দ মিলে এক অদ্ভুত অনুভূতি সারা শরীরে। সেদিন হারু আর বাইরে বের হলো না।মন পড়ে খাটের নিচে ঢেকে রাখা ব্যাগে।বার বার মনের ভেতর কে যেন বলতে লাগলো,এ ঠিক নয়।এ পাপের টাকা। সারা শরীরে জ্বালা ! এ টাকা নেওয়া ঠিক হবে না।চাই না এ টাকা।

        রাতে বউকে বলল ওর মনের কথা।বউও বুঝেছে সব।এক দিনেই ওদের সে শান্তি উধাও।

কেউ ভালো করে কথা পর্যন্ত বলেনি।ছেলেটা শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছে। চেনা বাবা মাকে যেন ও খুঁজে পাচ্ছে না।ভয়ে কেমন সিঁটিয়ে আছে ছেলেটা।বউও এ টাকা চায় না।ও সেই আগের আনন্দ চায় বাড়িতে।

           সকাল হতেই হারু বস্তা নিয়ে থানায়। কিছুতেই পুলিশ ঢুকতে দেবে না।হারুর কাকুতি মিনতি চলতে থাকে। হঠাৎ বাইরে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে বড়বাবু ঘরের বাইরে।হারু এক ছুটে ওনার কাছে।গড়গড় করে বলে গেল সব কথা। টেবিলে টাকার ব্যাগ রাখতেই সকলে তাজ্জব। এতো টাকা ! টাকাটা পেয়েও কেন ফেরত নিতে চায় ও? বড়বাবুর প্রশ্নের উত্তরে হারু জানাল মাষ্টারমশাইয়ের সেই কথাটা :"পরিশ্রম করে যা উপার্জন করবি তাই তোর টাকা। বাকি সব পাপ। তাতে মনের আনন্দ সুখ নেই "।এক অশিক্ষিত প্লাষ্টিক কুড়িয়ে সংসার চালানো লোকের এই জীবনবোধে সকলে থ। বড়বাবু জড়িয়ে ধরে ভেতরে নিয়ে গেলেন ওকে।

          এক দিন আগের ব্যাঙ্ক ডাকাতির টাকা এভাবে উদ্ধার হবে বড়বাবু ভাবতেই পারেননি। পুলিশ তাড়া করেছিল বাইকটাকে । কিন্তু কোথায় যে গা ঢাকা দিল  তখন ঐ রাতের অন্ধকারে !এখন বুঝলেন, ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিল টাকাটা ধরা পড়ার ভয়ে।পরে এসে নিয়ে যাবার তালে ছিল।

         ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের সাথে কথা বললেন বড়বাবু। চুরি যাওয়া বারো লাখ টাকার পুরোটাই উদ্ধার হয়েছে জানালেন ওকে।ঘোষিত পুরস্কারের পঞ্চাশ হাজার টাকা হারু যাতে পায় তার জন্য অনুরোধ করলেন ম্যানেজারবাবুকে ।হারুর সততায় মুগ্ধ সকলে।চা জলখাবার খাইয়ে নিঃস্ব এক মানুষের সততার পুজো করলেন যেন বড়বাবু। হারুর চোখে জল। এতোটা সন্মান ও ভাবতেও পারেনি কখনো !একবুক ভালোলাগা নিয়ে বেড়িয়ে এলো থানার বাইরে। আকাশের দিকে দুহাত তুলে প্রণাম জানাল ঈশ্বরকে নিশ্চিত পাপের হাত থেকে ওকে রক্ষা করার জন্য।


**************************************************************



দেবাশীষ মুখোপাধ্যায় 


  রয়েল কমপ্লেক্স ,কাঠালবাগান ,উত্তর পাড়া, হুগলী থেকে লিখছেন পেশা: শিক্ষকতা ,নেশা : কলম চারিতা ,সাপলুডো খেলা শব্দ নিয়ে ,অণুগল্প ,ছোট গল্প ,কবিতা, প্রবন্ধে  সুখ-দুঃখ ,হর্ষ-বিষাদ, আড়ি ভাবের অনুভবে থাকা ,জীবনের দুই স্তম্ভ রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দের আদর্শ মনন, যাপন ও শীলনে.. স্বপ্ন: পৃথিবীকে ভালবাসার যৌথ খামার বানানো..দিক চক্রবালে হিরণ্যগর্ভ আলোর খোঁজ ..পাখি ,গাছ আকাশের সাথে মন কি বাত.. সূর্যের নরম আলোয় সুখের আবিরে মানুষের সাথে হোলি খেলা..


২টি মন্তব্য:

  1. আগে অনেক বেশি ধন্যবাদ ও নমস্কার জানাই। খুব ই ভালো লাগলো অনুগল্প টি পড়ে। সত্যিই বিন্দুর মধ্যে সিন্ধু এঁকেছেন আপনি। আগামী দিনে আরও বেশি পাওয়ার আশায় থাকলাম।
    "বেশি পাওয়ার এই আশা কিন্তু আমায় দুঃখ দেবেনা।

    উত্তরমুছুন