সোমবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

তোমায় খুঁজে ফিরি * স্বামী নির্বাণানন্দ




মায়ের কথা 

স্বামী নির্বাণানন্দ


(৪)

মাস পাঁচ-ছয় পর ছোট্ট একটা ঝুলি নিয়ে একদিন শেষ রাত্রে গঙ্গা স্নান করে কাশীর উদ্দেশ্যে মঠ থেকে বেরলাম। একগাছা লাঠি একহাতে, আরেক হাতে একটা কমন্ডলু। তখন ব্রহ্মচারী, তাই সাদা কাপড়। একটা কাপড় কেটে অর্ধেক পরেছি, অর্ধেক গায়ে দিয়েছি। একা একা গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে বুঝলাম পায়ে হেঁটে যাওয়া মায়ের ইচ্ছা নয়। খুব অসুস্থ এবং দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। দুইদিন প্রায় কিছুই পেটে পড়েনি। মাঝে মাঝে মায়ের প্রতি অভিমান হচ্ছে। তৃতীয় দিন সকালে পথে একটা বড় আম গাছের তলায় ক্লান্ত হয়ে শুয়ে আছি। মনে মনে বলছি, মা তুমি আশীর্বাদ করলে, তার ফল কি এই? খানিক বাদে ওই গাছের তলায় একটা মোটর গাড়ি এসে দাঁড়াল। সেই গাড়ি থেকে একটা পরিবার নামলেন। তারা ঐ গাছের ছায়ায় বসে খাওয়া দাওয়া করবেন। আমি শুয়েই আছি। কে কি তা দেখার মত মন বা ইচ্ছাও নেই। হঠাৎ এক পরিচিত পুরুষ কন্ঠের আওয়াজ, -'সূর্যি মহারাজ না? কি ব্যাপার, এখানে? তাকিয়ে দেখি মঠের এক পরিচিত ভক্ত। কাশী যাচ্ছি শুনে বললেন, -'চলুন আমাদের গাড়িতে। আমরা মধুপুর যাব। যতখানি সম্ভব এগিয়ে দেব।' আমি বললাম, -'ধন্যবাদ, কিন্তু আমি যে পদব্রজে যাব সঙ্কল্প করেছি।' তখন ভদ্রলোক তাদের সঙ্গে আনা নানা খাবার থেকে আমাকে পরোটা, ফল, মিষ্টি দিয়ে আগে খাওয়ালেন। কমন্ডলুতে জল ভরে দিলেন। খেলাম, কিন্তু তাদের অনেক অনুরোধেও গাড়িতে উঠলাম না বা পয়সা নিলাম না। কিছুক্ষণ পর খাওয়া-দাওয়া করে ওরা চলে গেলেন। আবার আমার যাত্রা শুরু হলো। হাঁটছি তো হাঁটছি। খালি পায়ে হাঁটার জন্য পায়ে ফোসকা পড়ে গিয়েছে, গায়ে ব্যথা। দিনে কষ্ট হয় বলে রাত্রেই বেশি হাঁটি। এভাবে আরো তিনটে দিন গেল। এই তিনদিন কয়েকটা পেয়ারা ছাড়া পেটে আর কিছু পরেনি। মনে হলো ওই ভদ্রলোকরা তাদের সঙ্গে গাড়িতে করে আমাকে এগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি তা শুনিনি। মা আমাকে বলেছিলেন, -'ইচ্ছে করে অনর্থক কঠোরতা করবেনা'। ভক্তটির কথা না শুনে মায়ের কথার অবাধ্য হয়েছি, তাই বোধ হয় এই কষ্ট।  ভিক্ষা চাইতে গেলে লোকের উপহাসের পাত্র হয়েছি। সাদা কাপড়ে ব্রহ্মচারীর পোশাকও হয়তো ভিক্ষা না পাওয়ার একটা কারণ। যাই হোক প্রতিদিন মাইল বিশেক করে হাঁটতাম। এভাবে যাত্রার সপ্তম দিন সন্ধ্যায় বাংলা-বিহার বর্ডারে একটা গ্রামে গিয়ে পৌঁছলাম। জায়গাটা হাজারীবাগ জেলার একটি গ্রাম।


(৫)

     গ্রামটির নাম বীরপুর। খোঁজাখুঁজির পর একটা শিব মন্দিরের সন্ধান পেলাম। সেখানেই রাতের মত আশ্রয় নিলাম। প্রচন্ড মশা, বুঝলাম রাত্রে সেখানে থাকা অসম্ভব হবে। বসে বসে মশা তাড়াচ্ছি। আবার মায়ের আশীর্বাদের খেলা দেখলাম। প্রায় রাত্রি নটার সময় মন্দিরের পূজারী এলেন। আমাকে খুঁটিয়ে দেখলেন। বয়সে যুবক। আমাকে কয়েকটি প্রশ্ন করলেন। তারপর পূজায় বসলেন। পূজা শেষ হলে আমাকে বললেন, -'মেরে সাথ ঘরমে চলিয়ে। ইঁহা রাতমে ভালু ঔর জানওয়ার ভী আতা হ্যায়।'  আমি 'না' বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু মায়ের কথা মনে পরল - 'ইচ্ছে করে কঠোরতা করবে না'। কাজেই বিনা বাক্যব্যয়ে তার সঙ্গ নিলাম। পূজারীর সঙ্গে তাদের বাড়িতে গেলাম। বেশ সম্পন্ন পরিবার। পূজারীর বৃদ্ধা মা আমাকে দেখে খুব খুশী হলেন। জপ-আহ্নিক করার জন্য তাদের ঠাকুরঘরে আমাকে বৃদ্ধা নিয়ে গেলেন। ঠাকুর ঘরে গিয়ে আমি তো চমকে উঠলাম। দেখি, যে দেবদেবীদের মধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণের ছবিও রয়েছে। অভিভূত হয়ে গেলাম। চোখে জল এসে গেছে নিজের অজান্তেই। বাংলা-বিহার সীমান্তে এই অজ পাড়াগাঁয়ে কিভাবে তিনি এলেন? মনে যে কি আনন্দ আর বিশ্বাস এল তা কি বলব! বৃদ্ধার স্নেহে যত্নে তিনরাত্রি ওখানে আটকে থাকলাম। খিচুড়ি, মালপোয়া কত কি নিজের হাতে বানিয়ে তিনি খাওয়ালেন আমাকে। পায়ের ফোস্কায় মলম লাগালেন। পায়ের মচকে যাওয়া ব্যাথায় চুন-হলুদ দিলেন। তিনদিন পরে মনে হলো আমি বেশ সুস্থ হয়েছি, এবার আবার হাঁটা শুরু করতে পারি। কিন্তু সেই বৃদ্ধা বললেন, -'না বাবা, তুমি এখনো দুর্বল। একা এতটা পথ হেঁটে কাশীতে গিয়ে তুমি আর তপস্যা করতে পারবে না। এই তোমার ট্রেনের টিকিট। তুমি ট্রেনে যাবে।' মায়ের কথা মনে পড়ল, কাজেই এবারেও 'না' বলতে পারলাম না। তারা আমাকে কাছাকাছি একটা স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে তুলে দিলেন।

     বৃদ্ধা এবং তার ছেলের কাছে তাদের ঠাকুর ঘরের ছবিটির ইতিহাস শুনেছিলাম। ছেলেটি একবার কাশী বেড়াতে যান। সেখানে একটা হোমিওপ্যাথি ওষুধের দোকানে ক্যালেন্ডারে ঠাকুরের ছবিটা দেখে চেয়ে নিয়ে আসেন। মনে হয় এম ভট্টাচার্যের দোকান থেকে। দোকানেই জিজ্ঞেস করে জেনেছিলেন যে ছবিটি শ্রীরামকৃষ্ণের, -'রামকিষেণ- কই বাঙালি অবতার হোঙ্গে'। মা ও ছেলে দুজনেই বললেন, -'লেকিন ইয়ে ফটো ঘরমে লে আনেকা বাদ সব কুছ আচ্ছা চল রাহা হ্যায় (কিন্তু এই ফটোটি ঘরে আনার পর থেকে সংসারে সবকিছু ভালভাবে চলছে)। ফটোটি তিনি কেন দোকান থেকে চেয়েছিলেন তা জিজ্ঞাসা করায় তার ছেলে বললেন, -'রামকৃষ্ণের চোখ দুটিতে যেন একটা জাদু আছে। এই চোখ দুটি আমাকে বড় টানছিল। তাই ক্যালেন্ডারটি চেয়েছিলাম। পরে ফ্রেমে বাঁধিয়ে নিই।'

    

(৬)

      যাইহোক, ট্রেনে কাশী পৌঁছলাম। বৃদ্ধা এবং তার ছেলে আমাকে আরো কয়েকটা দিন তাদের বাড়িতে রাখতে চেয়েছিলেন। শেষে অনেক করে বলে তাদের রাজি করিয়েছিলাম এবং চারদিনের দিন ওদের একান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিদায় নিলাম। কাশী পৌঁছান পর্যন্ত আর কোনো অসুবিধা হয়নি। দেখলাম মঠ থেকে বেরোনোর পর মা আমার সঙ্গে সঙ্গেই ছিলেন।

      ‎মা বলেছিলেন, -'সেবাশ্রমে থাকবে, আর খুব ইচ্ছে হলে বাইরে মাধুকরী করে খেতে পার।' কিন্তু তপস্যার প্রবল প্রেরণায় আমি ঠিক করলাম -যেকটা দিন তপস্যা করব, বাইরেই থাকব। সেবাশ্রমে থাকলে বাসস্থানের নিশ্চিন্ততায় তপস্যার ক্ষতি হবে। সুতরাং বাইরে থাকবো এবং ভিক্ষা করে খাব। গঙ্গার কাছে একটা পুরনো বাগানবাড়িতে জায়গাও পেলাম এবং সত্যি সত্যিই কেবল ভিক্ষার ওপর নির্ভর করে ধ্যান- জপ-তপস্যায় দিন কাটাতে লাগলাম। যেখানে থাকতাম সে জায়গাটা মোটেই স্বাস্থ্যকর ছিলনা। নানারকম পোকামাকড় ও মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ হতে হতো। বুঝলাম, কেন মা সেবাশ্রমে থাকতে এবং খুব ইচ্ছে হলে মাধুকরী করে খেতে পারি বলেছিলেন। উত্তর ভারতের মাধুকরীর ডাল-রুটি আমার সহ্য হলো না, শীঘ্রই দুর্বল বোধ করতে লাগলাম। মনে হল, মনের উৎসাহ যেন কমে আসছে। মনে উদ্দীপনা আনার জন্য পূজ্যপাদ লাটু মহারাজের কাছে গেলাম। তিনি তখন সেখানে গঙ্গার কাছে একটা ঘাটে থাকতেন। আমাকে দেখে তিনি পরম স্নেহে বললেন, -'সুয্যি, তোমার কি হয়েছে? এত দুর্বল দেখাচ্ছে? আমার মনে হচ্ছে, ভিক্ষা তোমার সহ্য হচ্ছে না। ঠিক আছে, এই দুই টাকা তুমি রাখ -মাস্টার মশাই আমাকে প্রতিমাসে পাঠান দুধ খাওয়ার জন্য। ঠিক আছে এই দু টাকা তুমি নাও। এই দিয়ে আজ থেকে প্রতিদিন একটু দুধ খাবে' কিন্তু তিনি নিজেই তো অত্যন্ত কৃচ্ছতা করে থাকতেন। খুব খারাপ লাগছিল তাঁর কাছ থেকে টাকা নিতে। কিন্তু আমার মায়ের কথা মনে পড়ল -ইচ্ছে করে কঠোরতা করবেনা। কাজেই নিতে বাধ্য হলাম। চোখে জল এসে গেল তাঁর ভালোবাসা দেখে।




1 টি মন্তব্য:

  1. অভয় পদে প্রাণ সঁপেছি। মা যার আনন্দময়ী সে কি গো নিরানন্দে থাকে?
    প্রণাম মা🙏🌺✍️🐚🌾💐🙏

    উত্তরমুছুন