পর্ব- ৩
কিছু আশ্চর্য চরিত্রের মানুষজন আমার পরিবার ও আত্মীয় স্বজন! প্রয়াত কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের আছে অনেক দীর্ঘ দীর্ঘ কবিতা আর আমার প্রয়াত বাবার আছে বেয়াল্লিশের আগস্ট আন্দোলনে ভগবানপুর থানা ভাঙার দী-র্ঘ গানের রেকর্ড স্বকন্ঠে। কেন্দ্রীয় সরকার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পেনশন দেওয়া শুরু করলে ইংরেজ বিরোধী বহু কার্যকলাপে অংশ গ্রহণকারী বাবাকে সেজদা যখন জিজ্ঞেস করেন পেনশন পেতে চান কিনা তখন বাবার উত্তর ছিল 'সরকারি সাহায্য পাব বলে তো লড়াই করিনি।' সংসারে অভাব থাকলেও সেখানেই হয় চেষ্টার ইতি। সব দিক দিয়ে বাবা ছিলেন কড়া আর সব দিক দিয়ে নরম ও সরল প্রকৃতির আমার শ্বশুরমশায়। কিন্তু বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর আছে স্বচ্ছ জ্ঞান। বিনে পয়সায় পড়ানো তাঁর ছাত্রদের মধ্যে যেমন আছে আই আই টি-র অধ্যাপক তেমনি ছড়িয়ে আছে অন্যান্য দিকেও। সেই শ্বশুরমশাই আমার মেয়ের স্কুলে ভর্তির সময় খবর পাঠালেন সাউথ পয়েন্টের মতো স্কুলে যেন না ভর্তি করি, ওখানে পড়লে ব্রেনে চাপ পড়ে।
মাধ্যমিক থেকে এম.এসসি পর্যন্ত এক দাঁড়ি পাওয়া স্ত্রী মধুমিতা কিছু বছর বিরাটির মৃণালিনী দত্ত কলেজে পড়ানোর পর এখন পাড়ার স্কুলে বিজ্ঞানের শিক্ষক, গোটা লকডাউন পিরিয়ড ও করোনাকালে তার নিষ্ঠাভরে নিয়মিত অনলাইনে পড়ানো দেখে আমি তো অবাক।
কাঁথিতে থাকে ছোটো বোন। ভাইফোঁটায় আমরা তিন ভাই মিলিত হলে কপালকুণ্ডলা মন্দির দেখাতে নিয়ে যায় ভাগনে, এবার 'নিটে' সে যে ফল করেছে তাতে স্পষ্ট কলকাতার প্রথম শ্রেণির মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হতে পারবে এবং আশা করি একদিন টাকা আয়ে নয়, মন দেবে চিকিৎসায়। কিন্তু হঠাৎ সেখানে ছোটো ভাই-র আক্ষেপঃ নামে মাত্র পেনশন পেয়ে সে অবসর নিয়েছে সেন্ট স্টিফেন্স শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। বিরক্ত হয়ে বলি ১৯৮৭ সালে কলেজ সার্ভিস কমিশন প্রকাশিত রসায়ন লিস্টে তার নাম যে দ্বিতীয় স্থানে জ্বলজ্বল করছিল দুই আড়াই মাস অন্তর যখনই গেছি বিস্মিতভাব করে অফিস বলেছেঃ 'যায়নি অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার? আজই যাবে।' আসেনি কোনো দিন। 'কিন্তু তুই নিজে একবার গিয়ে কি চাপ দিয়ে বলেছিস্ না দিলে কোর্টে যাব?' কারণ লিস্টের এগারতম ব্যক্তি চাকরি পেলে দ্বিতীয় স্থানাধিকারী তো অবশ্যই পেত। তাহলে অবসর-ই তো হত না এখন।
তমলুকে থাকে ভায়রাভাই অপূর্ব। জেলার অন্যতম সেরা অঙ্কের শিক্ষক। লকডাউনে মাসের পর মাস না পড়িয়ে বেতন পেয়েছে বলে তার বাড়ে মনোকষ্ট। শেষে জেলা প্রশাসনকে জাগিয়ে শুরু করে অনলাইনে পড়ানো, প্রথমে অঙ্ক, পরে অন্য বিষয়। সেই অপূর্ব আজ বিজয়া দশমীর দিনে দায়িত্ব নিয়েছে তমলুক শহরটা ঘুরিয়ে দেখানোর।
সকাল সকাল দু'হাত চওড়া রাস্তায়ও যেতে পারে যে আধুনিক যান টোটো তাতে চড়ে বসি পাঁচজন। আমরা তিন জন, অপূর্ব, তার বড় মেয়ে অলি। মেচেদা থেকে তমলুক মহিষাদল হয়ে হলদিয়া পর্যন্ত যে রাজ্যসড়ক তার তমলুকের অংশটি খুবই প্রশস্ত করা হয়েছে সম্প্রতি। মূল রাস্তার দু'ধারে এতো ডাক্তার ও নার্সিং হোম যেন বকুল ফুলের মালা। বার ক্লাসের আমার সহপাঠী ডাক্তার সুদীপ এতো ব্যস্ত খাওয়ারও সময় নেই।
তিন চারটি সুসজ্জিত মন্ডপে প্রতিমা দেখে পৌঁছোই ঐতিহ্য মন্ডিত হ্যামিল্টন স্কুলে। থিম নয় করোনাকাল বলে স্কুলের ভেতর পুজোটি অনাড়ম্বর। অনেক বার এসেছি তমলুক কিন্তু তেমন করে দেখা হয়নি কোনোকিছু তবে কথায় কথায় এখানকার মানুষজন একবার হ্যামিল্টন স্কুলের কথা পাড়বেই, কেন পাড়ে আজ তা বোঝা গেলঃ ১৮৫২ সালে রবার্ট চার্লস হ্যামিল্টন প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলের ছাত্র ছিলেন কারা! শহীদ ক্ষুদিরাম বসু বিপ্লবী যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায় ধন গোপাল মুখোপাধ্যায় আগস্ট আন্দোলনের প্রধান হোতা প্রিয়নাথ জানা অজয় মুখোপাধ্যায় বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় সুশীল ধাড়া অমলেশ ত্রিপাঠী শিল্পী মুকুল দে পরেশ মাইতি অভিনেতা সমিত ভঞ্জ...
অগ্নিযুগের অনির্বাণ শিখা ক্ষুদিরাম ১৯০১ সাল থেকে ১৯০৪ সাল পর্যন্ত যখন এই স্কুলের ছাত্র পাশেই রক্ষিতদের বাড়িতে বসত বিপ্লবীদের আড্ডা এবং চলত শলা পরামর্শ। সম্প্রতি তাঁদের পুরোনো বিল্ডিং ভেঙে ফাঁকা করা হয়েছে, সেখানে গড়ে উঠবে বিপ্লবী যুগের স্মারক। ক্ষুদিরামের আসল গুরু কিন্তু মেদিনীপুরের সত্যেন্দ্রনাথ বসু। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু নন, ইনি ঋষি রাজনারায়ণ বসুর ভাতুষ্পুত্র। প্রেসিডেন্সি জেলের ভেতর রাজসাক্ষী নরেন গোঁসাইকে একইসঙ্গে গুলি করেন বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও কানাইলাল দত্ত। ফাঁসির পর কানাইলালকে দাহ করা হয় কেওড়া তলা শ্মশানে, তখন যে জনজোয়ার ও জনরোষ দেখা যায় তার কথা ভেবে কোর্টের নির্দেশ নিয়ে ফাঁসির পর সত্যেন্দ্রনাথকে দাহ করা হয় জেলের ভেতরেই।
তমলুকে জন্ম যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায় ও ধনগোপাল মুখোপাধ্যায় দুই ভাই।
অগ্নিযুগের আর এক বিপ্লবী যাদুগোপাল ছিলেন প্রথমে অনুশীলন সমিতি এবং পরে যুগান্তর দলের সক্রিয় সদস্য। বাঘাযতীন অরবিন্দ ঘোষ এম এন রায় মোতিলাল রায়-দের ঘনিষ্ঠ। ১৯১৫ সালে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় জার্মান থেকে অস্ত্র এনে সশস্ত্র সংগ্রামের আয়োজন করেন যাদুগোপাল কিন্তু বুড়িবালামের যুদ্ধে বাঘাযতীনের মৃত্যু হলে তিনি ছিলেন যুগান্তর দলের মাথা। তখন তাঁকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য সরকার ঘোষণা করে কুড়ি হাজার টাকা। আত্মগোপন করে তিনি বাংলা আসাম চিন সীমান্ত বিহারের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে দলের কাজ চালিয়ে যান। ১৯২১ সালে আত্মপ্রকাশ করে ফাইনাল এম বি পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে ডাক্তারি পাশ করেন। অনেকে মনে করেন শরৎচন্দ্রের 'পথের দাবী'-র সব্যসাচী পেশায় ডাক্তার যাদুগোপালকে অনুসরণ করে লেখা। ১৯২৩ সাল থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত কারাবন্দী থাকেন।। মুক্তি পেলে বাংলা থেকে বহিষ্কৃত হন। রাঁচিতে স্থায়ীভাবে বাস করে ডাক্তারি ও বিপ্লবী কার্যকলাপ চালিয়ে যান। বিয়াল্লিশের আগস্ট আন্দোলনে আবার তাঁর জেল হয়। হাজারিবাগ জেলে তাঁর রুমমেট হন জয়প্রকাশ নারায়ণ প্রমুখ জাতীয়তাবাদী নেতা।
ছাত্র হিসেবে ভাই ধনগোপাল মুখোপাধ্যায় ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। বিপ্লবী জীবনের এতো জ্বালা যন্ত্রনা যাতে না সইতে হয় তাই দাদা ভাইকে পাঠিয়ে দেন দেশের বাইরে। জাপান হয়ে ধনগোপাল পৌঁছোন আমেরিকার সান ফ্রান্সিসকোতে।তাঁর শিক্ষা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলে ও স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। ধনগোপাল মুখোপাধ্যায় ছিলেন আমেরিকার প্রথম সফল বাঙালি বুদ্ধিজীবী। তিনি ছিলেন ইংরেজি ভাষার অসাধারণ শিশু সাহিত্যিক। অনুবাদে আমরা পড়েছি তাঁর 'চিত্রগ্রীব', এক পায়রার গল্প, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সের রণাঙ্গনে যার ভূমিকা ছিল রোমাঞ্চকর। 'গে-নেক' পায়রার কাহিনি পুস্তকের জন্য ধনগোপাল একমাত্র বাঙালি তথা ভারতীয় যিনি শিশু সাহিত্যের জন্য আমেরিকা থেকে পান 'জন নিউবেরি' মেডেল। রামকৃষ্ণ পরমহংসকে নিয়ে লেখা তাঁর 'ফেস অফ্ সাইলেন্স' পড়ে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন রোমাঁ রোলাঁ আর শিশু সাহিত্য পড়ে 'জাঙ্গলবুক' লিখতে উৎসাহিত হন রুডইয়ার্ড কিপ লিং...
পর্ব -৪
চক্রবর্তীর উদ্যোগে স্কুল প্রাঙ্গণে বসে স্বদেশী মেলা। উদ্বোধন করেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, স্বদেশী গান করেন চারণ কবি মুকুন্দ দাস। পরের বছর আসেন দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমল, স্বরচিত গান শোনান কাজী নজরুল ইসলাম। এই বছরই মেলায় স্বদেশ মন্ত্রে দীক্ষা নেন সতীশ সামন্ত, অজয় মুখোপাধ্যায়, সুশীল ধাড়া...। ১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে সাড়া দিয়ে পদত্যাগ করেন প্রধান শিক্ষক অশ্রুরঞ্জন মিত্র। ১৯৪২ -এ তমলুক থানা দখল অভিযানে অংশ নেন প্রিয়নাথ জানা।
বিভিন্ন সময়ে এই স্কুলে এসেছেন ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর আচার্য বিনোভাভাবে প্রতাপ চন্দ্র চন্দ প্রমুখ।
শহীদ ক্ষুদিরামের সঙ্গে হৃদ্যতা ছিল শিল্পী মুকুল দে-র। ১৯০৭ সালে মুকুল দে এই স্কুল থেকে গিয়ে ভর্তি হন শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমে। তাঁর শিল্পগুরু মা পূর্ণশশী অসিত হালদার নন্দলাল বসু।পিয়ারসন ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহচর্য ও ভালোবাসায় সমৃদ্ধ দীর্ঘজীবী মুকুল দে রবীন্দ্রনাথের সহযাত্রী হয়ে জাপানের ইয়োকোহামায় একসঙ্গে বসবাস করেছেন তমিতারো হারার বিখ্যাত গেস্ট হাউসে। প্রতিভাবান দে পরিবারের সকল সদস্য। মুকুল দে-র বোন রাণী চন্দের লেখার প্রসাদগুণ তো বিস্ময়কর ভাবে উৎকর্ষ মানের।
হ্যামিল্টনের প্রাক্তন ছাত্র পদ্মশ্রী শিল্পী পরেশ মাইতি এখন আরো বেশি ব্যস্ত দেশে বিদেশে।
যুক্তফ্রন্ট, বাংলা কংগ্রেস, কংগ্রেস দলের হয়ে মোট তিনবার কিছুদিনের জন্য হলেও পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন অজয় মুখোপাধ্যায়। বিপরীত বাম রাজনৈতিক বিশ্বাসে আস্থা ছিল ভাই বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় ও ভ্রাতৃবধু গীতা মুখোপাধ্যায়ের, তবু একই বাড়িতে থাকতেন তিনজনে কারণ নিঃস্বার্থপর স্বাধীনতা সংগ্রামী অজয় মুখোপাধ্যায় ছিলেন আমৃত্যু স্বদেশপ্রেমিক ও মানবদরদী।
১৭ ডিসেম্বর ১৯৪২ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৪৪ পর্যন্ত সতীশ সামন্ত অজয় মুখোপাধ্যায় ও সুশীল ধাড়ার অধীনে তাঁদের প্রতিষ্ঠিত 'তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার'-ই ছিল পরাধীন ভারতে ইংরেজ সরকারের সমান্তরাল সবথেকে দীর্ঘস্থায়ী স্বাধীন সরকার, যাঁদের সবথেকে বড়ো সাফল্য বাংলাসন ঊনপঞ্চাশের ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত ও পঞ্চাশের মন্বন্তরে আক্রান্ত মেদিনীপুর জেলায় অভূতপূর্ব ও কার্যকরী ত্রাণকার্য চালিয়ে যাওয়া।
প্রাক্তন ছাত্র ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠী 'আনন্দ পুরষ্কার' পান 'ইতিহাস ও ঐতিহাসিক' বই লিখে। যে কোনো ইতিহাস মনস্ক ব্যক্তির কাছেই রেফারেন্স হতে পারে তাঁর লেখা গ্রন্থ 'স্বাধীনতার মুখ', 'স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস', 'ভারতের মুক্তি সংগ্রামে চরমপন্থী পর্ব ', 'শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দ' ইত্যাদি।
অতি তরুণ বয়সে সবিতাব্রত দত্ত-র গ্রুপ থিয়েটারে যোগ দিয়েছিলেন সমিত ভঞ্জ। একটি সিনেমার শুটিং দেখতে গিয়ে পেয়ে গেলেন অভিনয়ের সুযোগ। 'সুরের আগুন' দিয়ে শুরু করে 'হাটে বাজারে', অরণ্যের দিনরাত্রি', 'সবুজ দ্বীপের রাজা' -র মতো সিনেমায় এমনকি সুচিত্রা সেনের বিপরীতে অভিনয় করার সুযোগ পেলেও 'ফুলেশ্বরী' ছায়াছবিতে তাঁর লিপে 'ফুলেশ্বরী ফুলেশ্বরী ফুলের মতো নাম / তোমার দেওয়া দুঃখের কমল বুকে ধরিলাম' গানের এই রেশ নিয়েই পেরিয়ে গেছে আমাদের কৈশোর বেলা।
হ্যামিল্টন স্কুল পেরোলেই বর্গভীমা মন্দির। একান্ন পীঠের একটি। সতীর বাম পায়ের গোড়ালি পড়েছিল এখানে।দেবী এখানে বর্গভীমা বা ভীমরূপা। ১৪৬৬ খৃষ্টাব্দে মুকুন্দরামের লেখা 'চণ্ডীমঙ্গল' কাব্যে তাম্রলিপ্ত বর্গভীমার উল্লেখ আছে। এছাড়া 'দেবীপুরাণ', 'ব্রহ্মপুরাণ' ও 'ভবিষ্যপুরাণ' এবং 'অন্নদামঙ্গলে'ও বর্গভীমার উল্লেখ পাওয়া যায়। ভেতরে অনেকটা অঞ্চল জুড়ে বিভিন্ন নামের কক্ষ। নিয়মিত দেবীর পুজো ছাড়া কী হয় না এখানে! অন্নপ্রাশন থেকে বিয়ের আসর, দিনক্ষণ পাওয়াই দুরুহ এমনই ভীড় লেগে আছে সারাবছর প্রাচীন ও পবিত্র এই দেবীস্থানে।
কিছু দূরে আছে গৌড়ীয় মঠ। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু দুবার এসেছিলেন। ১৫১০ সালে ও ১৫১৫ সালে। গ্রীষ্মের আগে দু'বারই দুসপ্তাহ ধরে ছিলেন। দুপুর হয়ে গেছে তবু ছেড়ে যেতে মন চায় না কিছুতেই এমন স্নিগ্ধ ও ছায়াশীতল এখানকার পরিবেশ...
পর্ব-৫
তমলুক থানার সামান্য উত্তরে তমলুক রাজবাড়ি। খ্রিষ্টিয় যুগের সূচনা পর্ব থেকে তাম্রলিপ্ত পূর্বভারতে জলপথে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক বানিজ্য বন্দর। সপ্তম শতাব্দীতে হিউয়েং সাং এখানে এসেছিলেন এবং বন্দরের যে ছবি বর্ণনা করেছেন তার একটি সাক্ষাৎ প্রমাণ বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত এই রাজবাড়ি।। মধ্যোত্তর যুগেরএই ইন্দো-ইসলামীয় বিশাল স্থাপত্যের একদা অধিবাসী রাজা আনন্দ নারায়ণ রায় ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে সল্ট এজেন্ট উইলিয়াম ডেন্টকে কিছু জায়গা দেন নমকমহলের কাছারি বাড়ি তৈরি করতে। কাছারি বাড়িতে নুনের ব্যবসায় অংশ গ্রহণ উপলক্ষে আসতেন এলাকার শিক্ষিত লোকজের সঙ্গে ব্রিটিশ রাজকর্মচারী এবং ঠাকুর বাড়ির অনেকেইঃ লালমোহন, রাধানাথ,, গোপীমোহন এমনকি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরও। ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে পত্তন যে তমলুক শহরের তার মুন্সেফি আদালত গঠিত হয় ১৮৩২ সালে মহকুমার শুরু ১৮৫২ তে এবং পৌরসভা তৈরি ১৮৬৪ তে।
এই রাজবাড়ির প্রধান বৈশিষ্ট্য সর্বকালে সব রাজা-ই জনসাধারণকে সঙ্গে নিয়েই চলেছেন। এবছরও রাজবাড়ির মাঠেই হচ্ছে আদি তাম্রলিপ্ত সার্ব্বজনীন দুর্গোৎসব।। রাজবাড়ির লোকজন থাকেন তাঁদের কুলদেবতা ও অন্যান্য মন্দির সংলগ্ন এলাকায়। এই দুর্গোৎসবে তাঁদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। রাজময়দানে সারাবছর লেগেই থাকে কৃষি মেলা শিল্পমেলা ও নানা উৎসব পার্বণ।
স্বাধীনতা সংগ্রামেও রাজবাড়ির ভূমিকা অনস্বীকার্য। ১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে লবন আইন ভঙ্গের ডাকে তমলুক মহকুমার সত্যাগ্রহ পরিচালনার জন্য যে কমিটি গঠিত হয় রাজবাড়ির একটি অংশেই রাজা সুরেন্দ্রনাথ রায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি হয় স্বেচ্ছাসেবী শিবির। যে শিবির পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন সতীশ সামন্ত তরুণ কর্মী সুশীল ধাড়া, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান হন অজয় মুখোপাধ্যায়ের ভগ্নিপতি মধূসুদন বন্দ্যোপাধ্যায়।
১২ কিমি দূরে দিঘা যাওয়ার পথে হলদি নদীর ধারে নগরঘাটে হয় শিবির। নোনাজল জ্বালন দিয়ে নুন তৈরি করে বিতরণ হচ্ছিল। দুমাইল ব্যাপী তার শোভাযাত্রা। পুলিশ এসে ভাঙতে থাকে হাঁড়ি কড়া উনুন। শাঁক বাজিয়ে দেয় গাঁয়ের বধূরা। বেরিয়ে পড়ে হাজারে হাজারে গ্রামবাসী। বাড়তে থাকে পুলিশি জুলুমঃ গোলা থেকে ধান বের করে আগুন ধরিয়ে দেয়, ঠাকুরঘরে ঢুকে ভাঙতে থাকে পবিত্র শাঁখ, চলে নারী লাঞ্ছনা। যে জেলাশাসকের নির্দেশে চলে এই চরম অত্যাচার সত্যাগ্রহীরা নন, বিপ্লবীরা স্থির করে হত্যা করা হবে সেই পেডি সাহেবকে।
১১ই এপ্রিল ১৯৩৮ নেতাজি সুভাষচন্দ্র এসেছিলেন রাজবাড়ি ও পৌরসভার আহ্বানে। রাজময়দানে সত্যাগ্রহীদের সমাবেশে সভাপতির বক্তব্য রেখে আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন রাজার।
জীবনানন্দ দাশের বোন সুচরিতা দাশ প্রধান শিক্ষিক ছিলেন যে সান্ত্বনাময়ী বালিকা বিদ্যাপীঠের বা জেলমোড়ের অনুষ্ঠান হল একদিন কবিতা পাঠ করতে এসেছি সেগুলোয় এখন বিরাজ করছে নিঃঝুম দুপুরের রুদ্ধশাস। হরিরহাট, ১৮ সংখ্যক স্লুইসগেট, ও অন্যত্র দেখার মতো থিমপুজোর সঙ্গে আছে নানা সামাজিক প্রকল্প।
ভরদুপুরেই যাই রূপনারায়ণ নদীকূলে। ভাটা চলছে, দেখা যায় না ওপার। উদাসী নদীর ভাবখানা এমন যেন পওহারী বাবা,হাওয়া খেয়ে থাকে, কিছুটি জানে না অথচ মাত্র ক'দিন আগে 'যশ'এ ৩০ ফুট উঁচু বিধ্বংসী ঢেউ এসে গ্রাস করেছে পাড়ের ছোটো ছোটো দোকানঘর। ৫ হাহার টাকা করে সরকারি সাহায্য পেলেও ক্ষত সারতে লাগবে অনেকটা সময়...
( সমাপ্ত )
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন