রবিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

নীল কমল

 


কবি নীল কমল-এর দুটি কবিতা 


মধ্যরাত্রির একালাপ 

(একটি অসমাপ্ত কবিতা)


অন্ধকার ঘরে ঢুকেছে 

একটি জোনাকি

রাত এখনও অনেকটা বাকি 

কালিমাখা পিচ রাস্তায় 

হলুদমাখা আলো ঝরছে 

ফুটপাথের জীর্ণ ল্যাম্পপোস্ট থেকে 

নীলবাতি এম্বুলেন্স 

সাইরেন দিতে দিতে 

চলে যাচ্ছে হাসপাতালের দিকে

ঘড়ির কাঁটাগুলি 

একে অন্যের পিঠে চেপে 

টিক টিক শব্দ বাজছে আমার বুকে

পাগলা শিবু জেগে আছে এখনও

শিস দিয়ে গান ধরেছে - খোয়া খোয়া চাঁদ

(মোহম্মদ রফির বড় ভক্ত এই পাগলা শিবু)  

চাঁদ খোলা জানালার ফাঁক দিয়ে

দেখা যাচ্ছে আকাশের বুকে 

এম্বুলেন্সের গায়ে কি পড়ছে না 

একটুও চাঁদের জ্যোৎস্না?

কোন হাসপাতালের দিকে 

ছুঁটে চলেছে এম্বুলেন্স?

এমআর বাঙ্গুর কিংবা কেপিসি

নাকি রামকৃষ্ণ সেবা প্রতিষ্ঠানের দিকে? 

কোন দিকে ছুঁটে চলেছে এম্বুলেন্স?

স্বজন হারানো মানুষের কান্নায়

ভাসছে মাধ্যারাত্রির কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশ

শববাহী গাড়ি দৌড়চ্ছে শ্মশানের দিকে 

সুপুরি গাছের পাতার ডগায়

থমকে আছে এক ফোঁটা শিশির 


সময়টা বড় খারাপ

হাসপাতালে ফোন করলে ফোন ধরে না

ডাক্তারখানায় গড়ে উঠেছে বেড়াজাল 

ভয়াক্রান্ত মানুষ কোথায় যাবে 

কার কাছে যাবে ভেবে পাচ্ছে না 

সদর হাসপাতালের মর্গ ছুঁয়ে 

বাড়ির দিকে বইছে যে হাওয়া 

তাতে পচা লাশের বিরক্তিকর দুর্গন্ধ 

ডাক্তার বলছে দূরে দাঁড়াও 

দুই গজের দূরত্বে দাঁড়িয়ে মানবিকতা 

হাতে স্যানিটাইজার মুখে মাস্ক

এই খারাপ সময়ে নাকি ভালো 

খারাপ সময়ের স্মৃতিচারণায়

মনখারাপ করে উঠে বসেছি 

আজ এই মাধ্যারাত্রির নীরবতায় 

এমনই এক খারাপ সময়ে 

দাঁড়িয়ে আছি

ডেথ সার্টিফিকেট সংগ্ৰহ করব বলে

মাটাডোর ভাড়া করে তুলেছি

আত্মীয়ের মরদেহ 

এমনই এক খারাপ সময়ে 

শ্মশানে বসে আছি 

চল্লিশ মিনিটের ব্যবধানে

একটি মানুষ ইলেকট্রিক চুল্লিতে 

পুড়ে ছাই হয়ে যায়

এমনই এক খারাপ সময়ের মধ্যে 

ব্লাড ব্যাংকে হাজির হয়েছি 

রক্ত দিয়ে স্বজন কে বাঁচিয়ে তোলা

কি যে অপূর্ব আনন্দ! 


সারাদিনের ক্লান্তির শেষে 

পাখিরা ফিরে গেছে যে যার আশ্রয়ে

নেই তাদের চেনা ডাক আকাশে বাতাসে

রাস্তায় পড়ে থাকা কুকুরগুলি

অনেকক্ষন ঘেউ ঘেউ করে

ঘুমিয়ে পড়েছে বোধহয় 

ঘরের টিউবলাইটের পেছনে লুকোনো

টিকটিকি শুধু ডেকে ওঠে মাঝেমধ্যে 

এই নীরবতা বড় অসহ্য! 

মাধ্যরাত্রির এই নীরবতায় 

দূর থেকে শোনা যায় 

কারা যেন উল্লাস করছে 

এরা কারা মৃত্যূমিছিলের মধ্যে 

উল্লাসের জয়ধ্বনি দিয়ে যায়?

আমাদের কাছে যেটা বিপদ

ওদের কাছে সেটাই সুযোগ 

তাই মধ্যরাতে চলছে উল্লাস 

বিষণ্ন হয়ে আমি ভাবি

একটা অদৃশ্য শত্রুর ভয়ে 

যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত 

সেলুনে গিয়ে দাড়ি কাটতে পারছেন না 

দাড়ি কেটে যাদের সংসার চলে 

কোন উপায়ে তারা বাঁচবে এই দেশে?

হঠাৎই হোহো করে হাসছে পাগলা শিবু

সেকি শুনতে পাচ্ছে আমার একালাপ?

কিছু নির্বোধ মানুষ 

ঘন্টা বাজিয়ে

থালা বাসন পিটিয়ে

এমনকি মোমবাতি জ্বালিয়ে 

তাড়া করছে অদৃশ্য শত্রুকে!


অদৃশ্য শত্রুর ভয়ে 

দরজা বন্ধ করে লুকিয়ে আছে মানুষ

পাশেরবাড়ির মাসিমা এখন কোথায়?

সকালবেলা নিয়মকরে ছাদে আসত

অনেকক্ষন টবের গাছ গাছালি নিয়ে 

সময় কাটাত ও হরিনাম কীর্তন করত 

তাকে তো আর দেখা যায় না ছাদে 

তার হরিনাম শব্দও শোনা যায়না আর 

প্রায়দিনই জিজ্ঞাসা করে আমার মা

তাকে বলতে পারিনা মাসিমা আর নেই

চারজন শ্মশানবন্ধুও জোটেনি মাসিমার 

একজন মানুষ গোটা ভীরু সমাজের মুখে 

কালি মেখে নীরবে বিদায় নিল আক্ষেপে

এই নীরবতা বড় দুঃসহ !

কালিমাখা পিচ রাস্তায়

হলুদমাখা আলো এখনও ঝরে

ফুটপাথের ল্যাম্পপোস্ট থেকে 

ঘড়ির টিকটিক শব্দ বাজে আমার বুকে 

পাড়ার পোষা মার্জার কাঁদে করুণ গলায়

ভাবছি একটা সিগারেট ধরাব

(আহ! সিগারেট তো আমি খাইনা

তাহলে সিগারেট ধরানোর ইচছা আজ 

আমার জাগলই বা কেন?)

আগুনের টান হয়তো!

পৌষ মাসের হিমেল  শীতের রাতে

সুপুরি গাছের পাতায় পাতায় 

ঝরছে শিশির- 

একি উদাস সময়ের বিলাপ?

ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি 

ঘন্টা বাজাতে বাজাতে ছুঁটছে 

কোথায় যেন লেগেছে আগুন..












সুগন্ধ্যা সেন 

অনেকগুলো ব্যর্থ প্রেমের ক্ষত

বুকে করে প্রতিদিন অফিস করত

মুদিয়ালির সুগন্ধ্যা সেন 


আমার ডানদিকের টেবিলে বসত 

কাজ তেমন ভালো পারত না তবু

খুব ভালো কবিতা পারত 


কবি সুনীল গাঙ্গুলির ভীষন ভক্ত 

সুগন্ধ্যা সেন ছন্দ মেলাতে পারত


গানের গলা ছিল তার অতিমধুর 

সামনের দাঁতকটা উঁচু ছিল তার 

দেখা যেত হাসত যখন প্রাণ খুলে 


সমস্ত ব্যর্থ প্রেমের কথা বলত 

যেমন সে বলত তার প্রেমিকদের 

গায়ে নীল জামাই নাকি মানাত 


অগাধ প্রেম ছিল তার

ছিল না সংসার করার বাসনা

তাই ছেড়ে চলে গেছে প্রেমিকেরা


কাকতালীয় ভাবে আমিও পরতাম

নীল রঙের বিভিন্ন শেডের জামা 

আসমানী নীল তো কখনও নেভি ব্লু 


আসমানী নীলের প্রতি 

এতটাই দুর্বল ছিল সুগন্ধ্যা সেন

যে নীল আকাশকে দাঁতে চেপে

উড়ে যেতে পারত পাখির মত 

ডানা মেলে নীল আকাশে ।


***************************************************************



     নীল কমল

হিন্দি এবং বাংলা উভয় ভাষাতেই কবি নীল কমল সমান সাবলীল । দীর্ঘদিন কবিতা লিখছেন দুই ভাষাতেই ।তাঁর কবিতাতে যেমন উঠে আসে সমকালীন জীবনযন্ত্রণার ছবি তেমনি ভাষা পায় অন্তর্লীন মনের নানা সুর।


কবি নীল কমলের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ:


1. Haath Sundar Lagtey Hain (Hindi): 2010 - collection of poems.

2. Yah Pedon Ke Kapde Badalney Ka Samay Hai (Hindi): 2014 - collection of poems.


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন