শুক্রবার, ২৮ জুলাই, ২০২৩

লেখা আহ্বান

স্বরবর্ণ 

সৃজনের মৌলিক স্বর 

পুজো সংখ্যা ১৪৩০ -এর জন্য লেখা জমা নেওয়া হবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। কী ধরনের লেখা, লেখা পাঠাবার ঠিকানা প্রভৃতি জরুরী তথ্য পাওয়া যাবে উপরের লিঙ্কে।


লেখা পাঠানোর আগে নীচের বিষয়গুলি নিশ্চিত হয়ে নিন ------


* স্বরবর্ণ দ্বিমাসিক ওয়েব ম্যাগাজিন ।

* লেখা মনোনয়নের ব্যাপারে সম্পাদকমন্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

* প্রাপ্তি সংবাদ জানানো সম্ভব নয়। নিৰ্বাচিত লেখকসূচি আমরা একমাসের মধ্যেই ফেসবুকে প্রকাশ করি । 

*  পুজো  সংখ্যার জন্য আপনার মৌলিক ও অপ্রকাশিত লেখা ( গল্প কবিতা প্রবন্ধ  অণুগল্প  অনুবাদ কবিতা  ভ্রমণ কাহিনি  ইত্যাদি  )  ৩১ আগষ্ট ২০২৩  এর মধ্যে পাঠান । 

* শব্দসীমা অনির্দিষ্ট। 

* কবিতার ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুটি কবিতা পাঠাবেন।  

* লেখার সঙ্গে আপনার একটি ছবি এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, প্রকাশিত গ্রন্থ (থাকলে)  ছবিসহ পাঠান । 

* "স্বরবর্ণ " সামগ্রিক চিন্তার ফসল। আগে থেকে লেখা পাঠান। পরিকল্পনার সুবিধার জন্য। লেখা পাঠাবেন ওয়ার্ড ফাইলে, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ই-মেইল বডিতে টাইপ করে ।


* হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর   8777891532

*ই-মেইল --- debasishsaha610@gmail.com 


সম্পাদকমণ্ডলী                                                   

ড : শুভঙ্কর দে           অলোক কোৱা

সৌম্যজিৎ দত্ত             দেবাশিস সাহা


শনিবার, ৮ জুলাই, ২০২৩

প্রিয় কবি লেখক এবং পাঠকদের প্রতি

 



স্বরবর্ণ

সৃজনের মৌলিক স্বর


লেখা পাঠানোর আগে নীচের বিষয়গুলি নিশ্চিত হয়ে নিন ------


* স্বরবর্ণ দ্বিমাসিক ওয়েব ম্যাগাজিন ।

* লেখা মনোনয়নের ব্যাপারে সম্পাদকমন্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

* প্রাপ্তি সংবাদ জানানো সম্ভব নয়। নিৰ্বাচিত লেখকসূচি আমরা একমাসের মধ্যে ফেসবুকে প্রকাশ করি । 

* পরবর্তী  সংখ্যার জন্য আপনার মৌলিক ও অপ্রকাশিত লেখা ( গল্প কবিতা প্রবন্ধ  অণুগল্প  অনুবাদ কবিতা  ভ্রমণ কাহিনি  ইত্যাদি  ) ১৫ নভেম্বর  ২০২৩  এর মধ্যে পাঠান । 

* শব্দসীমা অনির্দিষ্ট। 

* কবিতার ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুটি কবিতা পাঠাবেন।  

* লেখার সঙ্গে আপনার একটি ছবি এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, প্রকাশিত গ্রন্থ (থাকলে)  ছবিসহ পাঠান । 

* "স্বরবর্ণ " সামগ্রিক চিন্তার ফসল। আগে থেকে লেখা পাঠান। পরিকল্পনার সুবিধার জন্য। লেখা পাঠাবেন ওয়ার্ড ফাইলে, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ই-মেইল বডিতে টাইপ করে। পিডিএফ বা লেখার ছবি তুলে পাঠাবেন না।


* হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর   8777891532

*ই-মেইল --- debasishsaha610@gmail.com 


সম্পাদকমণ্ডলী                                                   

ড : শুভঙ্কর দে           অলোক কোৱা

সৌম্যজিৎ দত্ত             দেবাশিস সাহা


********************************************************************************************************************************

প্রিয় কবি প্রিয় কবিতা * জীবনানন্দ দাশ



{ এই বিভাগে আমরা এমন দু-একটি  কবিতা পড়ব , যে কবিতা আমাদের অন্তর্লোকে বিস্ময় সৃষ্টি করে শুধু নয় ,আমাদের কবিতা পড়ার আনন্দে অবগাহন করায় , প্রতি দিন  প্রতি মুহূর্তে | এই পর্যায়ের কবি যে সবসময়  বিখ্যাতই  হবেন , এমনটা নয় , তিনি অখ্যাত তরুণ তরুণতর কবিও হতে পারেন , কিন্তু ,শর্ত একটাই ,কবিতাটি যেন আমাদের মর্মলোক স্পর্শ করে | স্বরবর্ণ / ১৪ সংখ্যায় 'প্রিয় কবি  প্রিয়  কবিতা ' বিভাগের কবি হলেন জীবনানন্দ দাশ  |}



পঁচিশ বছর পরে

জীবনানন্দ দাশ












শেষবার তার সাথে যখন হয়েছে দেখা মাঠেরউপরে  

 বলিলাম: ‘একদিন এমন সময়  

 আবার আসিয়ো তুমি, আসিবার ইচ্ছা যদি হয়!–  

 পঁচিশ বছর পরে!’  

 এই বলে ফিরে আমি আসিলাম ঘরে;  

 তারপর কতবার চাঁদ আর তারা,  

 মাঠে মাঠে মরে গেল, ইদুর — পেচাঁরা  

 জোছনায় ধানক্ষেতে খুঁজে  

 এল-গেল। –চোখ বুজে  

 কতবার ডানে আর বায়ে  

 পড়িল ঘুমায়ে  

 কত-কেউ! — রহিলাম জেগে  

 আমি একা — নক্ষত্র যে বেগে  

 ছুটিছে আকাশে  

 তার চেয়ে আগে চলে আসে  

 যদিও সময়–  

 পঁচিশ বছর তবু কই শেষ হয়!–  

 তারপর — একদিন  

 আবার হলদে তৃণ  

 ভরে আছে মাঠে- -  

 পাতায় শুকনো ডাঁটে  

 ভাসিছে কুয়াশা  

 দিকে দিকে, চুড়ায়ের ভাঙা বাসা  

 শিশিরে গিয়েছে ভিজে — পথের উপর  

 পাখির ডিমের খোলা, ঠান্ডা-কড়কড়!  

 শসাফুল — দু-একটা নষ্ট শাদা শসা  

 মাকড়ের ছেঁড়া জাল, শুকনো মাকড়সা  

 লতায় — পাতায়;  

 ফুটফুটে জোছনারাতে পথ চেনা যায়;  

 দেখা যায় কয়েকটা তারা  

 হিম আকাশের গায় — ইদুর পেঁচারা  

 ঘুরে যায় মাঠে মাঠে, ক্ষুদ খেয়ে ওদের পিপাসা আজও মেটে,  

 পঁচিশ বছর তবু গেছে কবে কেটে!













***********************************************************************************************


পাঠ প্রতিক্রিয়া * দেবাশিস সাহা



কল্পনায় আঁকা সত্যের নিরাভরণ রূপ 

দেবাশিস সাহা



ক্ষণজন্মা অগ্নি স্ফুলিঙ্গ তিনি। তিনি 'ঝড়ের পাখি'। সমকাল থেকে লক্ষ যোজন এগিয়ে থাকা এক প্রচন্ড উল্কাপাত। মাত্র ২২ বছর ৮ মাস ৮ দিনের সংক্ষিপ্ত পরমায়ু নিয়ে তিনি জন্মেছিলেন এই পৃথিবীতে।  আরও স্পষ্ট করে বললে, এই বঙ্গভূমে। এই কলকাতায়। কী ওলটপালটাই না তিনি করেছিলেন, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ঘুণ ধরা গলা পচা সমাজটাকে শিকড় বাকড় সমেত প্রচন্ড ঝাঁকুনি দিয়ে। তিনি---  উনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ --- হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও।


কেন এই প্রহেলিকা, অসময়ে কেনই-বা এই গৌরচন্দ্রিকা? বলি। সম্প্রতি একটি বই পড়লাম। নাম 'কিছু কাল্পনিক সংলাপ'। লেখক বরুণ দাস। এত ভালো লাগল বইটি, কিছু লিখে ফেলতে ইচ্ছে হল। নামকরণ থেকে বইটির বিষয়বস্তু অনুমান করা মোটেই অসম্ভব নয়। কিন্তু প্রশ্ন, কার সঙ্গে সংলাপ? কাদের সঙ্গে সংলাপ? পাতা উল্টাতেই, পাঠক বিস্ফারিত চোখে দেখছেন, তাঁরা এলেবেলে কেউ নন, তাঁরা বাংলা তথা ভারতের ঠোঁটে ঠোঁটে উচ্চারিত এক একটি ধ্রুবতারাসম নামঃ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর স্বামী বিবেকানন্দ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু দ্বিজেন্দ্রলাল-রজনীকান্ত-অতুল প্রসাদ চিরন্তন তিন সংগীত সাধক কিংবা ড.শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মতো বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ যেমন আছেন, তেমনই রয়েছেন সাম্প্রতিক কালের কম.জ্যোতি বসু মাদার টেরেসা-র মতো উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বও। বইটি পড়ে মনে হচ্ছিল, এইসব প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব নেহাতই ইতিহাসের চরিত্র নন, রক্তমাংসে গড়া ভীষণ চেনা মানুষজন। তাঁরা যেন চোখের সামনে হেঁটেচলে বেড়াচ্ছেন আর তুখোড় সাংবাদিক বরুণ দাসের সঙ্গে জন্ম-মৃত্যুর পর্দা সরিয়ে, কথোপকথনে মজেছেন হাসিমুখে। আর, তাঁদের এই মধুর আলাপন থেকে উঠে আসছে ইতিহাসের অজস্র টুকরো টুকরো ঘটনা, অসংখ্য অজানা তথ্য, বহু বিতর্কিত বিষয়, যে বিষয়ে সত্যের আলো ফেলছেন লেখক, যে আলো, নিঃসংশয়ে বলা যায়, তাঁর একনিষ্ঠ অধ্যবসায় ও গবেষণার ফল। এখানে, স্বল্প পরিসরে, আমি শুধু ভূমিকায় উল্লিখিত ব্যক্তিত্বটির সঙ্গে লেখকের সংলাপে চোখ রাখব।


ডিরোজিও। জন্ম ১৮ এপ্রিল ১৮০৯ কলকাতা। মৃত্যু ২২ ডিসেম্বর ১৮৩১। তিনি রাজা রামমোহন রায়ের চেয়ে ৩৭ বছরের ছোট আর বিদ্যাসাগরের চেয়ে ১১ বছরের বড়। শিক্ষা ধর্মতলা একাডেমি স্কুল। শিক্ষা গুরু ডেভিড ড্রামন্ড। ডিরোজিও নিজেই জানিয়েছেন, তাঁর শিক্ষা ও দর্শন মানবতাবাদী যুক্তিবাদী চিন্তা ভাবনা সব সবকিছুর জন্যই তিনি ডেভিড ড্রামন্ডের কাছে ঋণী। ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি হিন্দু কলেজে চতুর্থ শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। বেতন ১৫০ টাকা। তখন তাঁর বয়স ১৭ বছর। তাঁর ছাত্রদের বয়স ১২ থেকে ১৫ -এর মধ্যে। পড়ানোর দায়িত্ব পেলেন ইংরেজি পাশ্চাত্য দর্শন ইতিহাস ভূগোল। পড়ানোর সুযোগ পেলেন মাত্র পাঁচ বছর। ১৮২৬ থেকে ১৮৩১। তারপরই বিপর্যয় ঘনালো তাঁর জীবনে। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। হিন্দু কলেজে, অচিরেই তাঁর পড়ানো এক নতুন মাত্রা পেল। ক্ষুরধার বিশ্লেষণ যুক্তি তর্ক বিতর্ক বিচার বিশ্লেষণের শানিত ফলায় সমাজের পুরনো যা কিছু অন্ধ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন, খড়কুটোর মতো উড়িয়ে দিতে চাইলেন। নবজাগরণের ঝড় তুললেন ডিরোজিও এবং তাঁর শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ 'ইয়ং বেঙ্গল'-- হিন্দু কলেজে 'আগুনের ফুলকি' নামে পরিচিত রামগোপাল ঘোষ কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায় রসিক কৃষ্ণ মল্লিক দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়-সহ রাধানাথ শিকদার শিবচন্দ্র দেব প্যারীচাঁদ মিত্র রামতনু লাহিড়ী প্রমুখ ছাত্রবৃন্দ। শুধু তাঁর কলেজ ছাত্ররাই নয়, তাঁর শিক্ষা ও মোহিনী ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে বহু যুবক ছুটে এল। 'রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ' বইতে শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছেন, 'চুম্বক যেমন লৌহকে আকর্ষণ করে তেমনই তিনিও বিভিন্ন শ্রেণির অপরাপর বালকদিগকে আকর্ষণ করিলেন।' তিনি হয়ে উঠলেন ছাত্রদের 'friend philosopher and guide ছাত্রদের বিজ্ঞান যুক্তি তর্কবিতর্কের মধ্য দিয়ে সত্যকে জানার উদ্দেশ্যে নিজের বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করলেন 'একাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন' আর তার মুখপত্র হিসেবে প্রকাশ করলেন 'এথেনিয়াম' 'পার্থেনন' 'হেসপেরাস' 'ক্যালিডোস্কোপ' ইত্যাদি পত্র পত্রিকা। আর তাঁর গড়া 'ইয়ংবেঙ্গল' সমবেত প্রচেষ্টায় একটা র পর একটা দুঃসাহসিক কাজে মাতলেন।  প্রকাশ্যে মদ্যপান থেকে শুরু করে গোঁড়া ব্রাহ্মণদের 'আমরা গরু খাই গো' বলে টিটকিরি কিংবা মা কালীর মন্দিরে গিয়ে 'গুড মর্নিং ম্যাডাম' সম্মোধন কিছুই বাদ গেল না।


প্রমাদ গুনলেন রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ। বিরুদ্ধে গেলেন গোঁড়া খৃষ্ট ধর্মাবলম্বীরাও। কারণ তিনি জাতে ফিরিঙ্গি। ইউরেশিও। তাই তিনি খ্রিস্টানদের কাছে যেমন উপেক্ষার পাত্র, তেমনই  হিন্দুদের কাছে বিদ্রুপের 'দ্রজু ফিরিঙ্গি'। এদিকে 'সংবাদ প্রভাকর' 'সমাচার দর্পণ' প্রতিনিয়ত বিষোদগার করে চলেছে ডিরোজিওর কাজকে। সমাজ প্রতিভূ রাধাকান্ত দেব রামকমল সেনরা (কেশবচন্দ্র সেনের পিতামহ) হিন্দু কলেজের তরফে জরুরী মিটিং ডাকলেন। অভিযোগ তাঁর সংস্পর্শে হিন্দু ছাত্রদের গুরুতর ক্ষতি হচ্ছে। 'ডিরোজিও অযোগ্য শিক্ষক' এমনটা দেগে দেওয়ার সাহস তাঁদের ছিল না। কারণ, হিন্দু কলেজ পরিদর্শক খোদ উইলসন সাহেব ছিলেন ডিরোজিওর শিক্ষকতায় মুগ্ধ। আর তাঁর প্রাণাধিক 'ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠী' তো ছিলই। কাজেই, ডিরোজিওকে বহিষ্কার করার প্রস্তাব ৬-৩  ভোটে খারিজ হয়ে গেল। ড. উইলসন ডেভিড হেয়ার শ্রীকৃষ্ণ সিংহ ডিরোজিওর পক্ষে ভোট দিলেন। 


এ যাত্রায় তিনি বেঁচে গেলেন বটে, কিন্তু এই পরাজয় বিরোধীপক্ষ হজম করতে পারলেন না। তাঁরা ফের অভিযোগ আনলেন। মারাত্মক অভিযোগ। অভিযোগ মূলত তিনটি--- এক. ডিরোজিও নাস্তিক, ঈশ্বর মানেন না। দুই. পিতা-মাতাকে শ্রদ্ধা ও আনুগত্য দেখানো তিনি ছাত্রদের শেখান না। তিন. ভাইবোনের মধ্যে বিয়েতে কোনো দোষ নেই, তিনি বলেন।


১৮৩১ সালের ২৩ এপ্রিল। বিরোধী পক্ষের চাপে কলেজ কর্তৃপক্ষ ডিরোজিওকে একতরফাবহিষ্কারের স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত নিলেন। যদিও বহিষ্কারের চিঠি পাওয়ার আগেই সসম্মানে ডিরোজিও কলেজ কর্তৃপক্ষকে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। এবং সেটা উইলসনেরই পরামর্শে। যেদিন ডিরোজিওকে মিথ্যা অপবাদে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে হিন্দু কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হল, প্রতিবেদক বরুণ দাস কল্পচক্ষে দেখতে পাচ্ছেন ডিরোজিওর ছলছল চোখ, জিজ্ঞাসা করছেন, 'আপনার চোখে জল!' এইখানে পাঠকের চোখও বাষ্পাকুল না হয়ে পারে না।


পরে অবশ্য প্রতিটি অভিযোগের উত্তর দিয়েছিলেন ডিরোজিও, উইলসন সাহেবকে লেখা এক চিঠিতে, ১৮৩১ সালের ২৬ এপ্রিল। চিঠিতে তিনি জানান, ' For myself the consciousness of right is my safeguard.আমি কোনো মানুষের কাছেই ভগবানের অস্তিত্বের কথা অস্বীকার করিনি...ছাত্রদেরকে বলেছিলাম,দার্শনিক হিউমের বিখ্যাত সংলাপ রচনার কথা। ক্লিনথেস এবং ফিলো-র মধ্যে যে সংলাপ তিনি রচনা করেছিলেন, যা ঈশ্বর বিশ্বাস বা আস্তিকতার বিরুদ্ধে। পাশাপাশি আমি ছাত্রদের Dr.Reid এবং Dugal Stewart -এর কথাও বলেছি, যাঁরা হিউমের কথার সঠিক জবাব দিয়েছিলেন।


দ্বিতীয় অভিযোগ অর্থাৎ বাবা-মাকে মেনে চলতে বারণ করার বিষয় ---এ ধরনের কোনো কুৎসিত অস্বাভাবিক এবং ঘৃণ্য কথা আমি কখনো বলিনি।


তৃতীয় অভিযোগ অর্থাৎ ভাইবোনের বিয়ের কথা প্রচার ---এটা আসলে আমার এক ছাত্র দরিদ্র ব্রাহ্মণ বৃন্দাবন ঘোষালের কাজ, সেই আমার নামে অপপ্রচার করেছে 'I can hardly bring myself to think that one of the college student with whom I have been connected could be either such a fool as to mistake everything I ever said or a knave as wilfully to mistake my opinions.'


হিন্দু কলেজের চাকরি গেল। অভাব অনটন জড়িয়ে ধরল আষ্টেপৃষ্টে। কিন্তু তিনি ডিরোজিও। দমবার পাত্র নন। ২১/ ২২ বছরের আয়ু নিয়ে জন্মালেও, তিনি যে বেঁচে থাকবেন আগামী বহু বছর বহু প্রজন্মের ওর প্রজন্ম। তাঁকে থেমে থাকলে চলে! নিজের লক্ষ্য নিজের আদর্শ দর্শন সমাজ সংস্কারের কাজে ফের ঝাঁপালেন। কলেজের চাকরি যাওয়ার পর তিনি বেঁচে থাকবেন আর মাত্র আটটি মাস। এরই মধ্যে শুরু করলেন 'দি ইস্ট ইন্ডিয়ান' পত্রিকা সম্পাদনার কাজ। কিন্তু অর্থ? আপাতত তিনি যে নিঃস্ব! বিক্রি করে দিলেন লাইব্রেরীর প্রিয় সব বইপত্র এবং দামী আসবাবপত্র। সম্পাদনা ও লেখালেখি শুরু করলেন 'ইন্ডিয়া গেজেট' 'ক্যালকাটা লিটারেরি গেজেট' 'ক্যালকাটা ম্যাগাজিন' 'ইন্ডিয়ান ম্যাগাজিন' 'বেঙ্গল অ্যানুয়াল' ইত্যাদি কাগজে। এদিকে তাঁর ছাত্র কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হল 'দ্য এনকোয়ারার' দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় প্রকাশ করলেন 'জ্ঞানান্বেষণ'।প্রথমে বাংলা পরে ইংরেজিতে। আর তার দেখভালের দায়িত্বে ডিরোজিও। লড়াই জারি রইল। সমাজে যুক্তি আর সত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই।


আট মাস ফুরোতে কতদিন লাগে?পায়ে পায়ে এগিয়ে এল অন্তিমকাল। ১৮৩১ এর ১৭ ডিসেম্বর 'ধর্মতলা একাডেমিতে' গিয়েছিলেন পরীক্ষা নিতে। ফিরলেন কলেরায় আক্রান্ত হয়ে। ছ'দিনের মাথায় এই পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিলেন ডিরোজিও। তাঁর মৃত্যুশয্যা পাশে বিহ্বল দাঁড়িয়ে রইলেন মা সোফিয়া জনসন বোন এমিলিয়া ডঃ উইলসন ডেভিড হেয়ার ডক্টর গ্রান্ট প্রমুখ বিখ্যাত জনেরা।


ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যাবে, যাঁরাই প্রচলিত বিশ্বাস ও ধ্যান ধারণার বিরুদ্ধে গিয়ে দেশ ও দশের স্বার্থে নিজেকে নিঃশেষে অঞ্জলি দিয়েছেন, তাঁদের কপালে জুটেছে দুঃখ কষ্ট লাঞ্ছনা অপমান আর অপবাদ। ডিরোজিও-ও তার ব্যতিক্রম নন। জীবনে যেমন অপমান কুড়িয়েছেন দুহাত ভরে, মৃত্যুর পরেও তাঁর লাঞ্ছনার শেষ হয়নি। চার্চ এবং গির্জার বিরুদ্ধে কথা বলায় তাঁর ঠাঁই হয়নি পার্ক স্ট্রিটের গোরস্থানে। কবরস্থানের বাইরের রাস্তায় তাকে সমাহিত করা হয়।

এখানেই শেষ নয়, বরুণ দাসের লেখা থেকে জানতে পারছি, ডিরোজিওর মৃত্যুর ১০ দিনের মাথায় ১৮৩২ সালের ৫ জানুয়ারি একটা শোক সভা হয় ১২ নং ওয়েলিংটন স্কোয়ারে, তাঁর তৈরি 'প্যারেন্টাল একাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন' হলে। তাঁর স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটিতে কৃষ্ণমোহন-- দক্ষিণারঞ্জনেরাও ছিলেন। সভায় সিদ্ধান্ত হয় চাঁদা তোলার টাকা থেকে স্মৃতিস্তম্ভের খরচ বাদে যদি টাকা বাঁচে, তাহলে তা দিয়ে দেওয়া হবে ডিরোজিওর পরিবারকে। এখাতে ৮০০ টাকা উঠেছিল। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের কথা, সে চাঁদার টাকা তছরুপ হয়ে যায়। স্মৃতিস্তম্ভ আর বসেনি।  পরে তাঁর অনুরাগীরা কবরের উপর একটা বেদি নির্মাণ করেন। সেটি জীর্ণ হতে থাকলে কবরের উপর বসানো হয় খোদাই করা শ্বেত পাথর। হায়! সে শিলাপাট-ও চুরি হয়ে যায়। বর্তমানে অল ইন্ডিয়া অ্যাংলো ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের কলকাতা শাখার তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠিত শিলালিপি ডিরোজিওর কবরের স্মৃতি বহন করছে।


ঐতিহাসিক ড. নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন, '  ডিরোজিওকে ভুলে যাওয়া বা উপেক্ষা করা জাতীয় জীবনে আত্মহত্যার সামিল।'

বাঙালি কী করে ভুলবে, এই শিক্ষাবিদ কবি দার্শনিক কর্মবীর সমাজ সংস্কারক স্বদেশপ্রেমী স্বাধীনতাপ্রিয় 'বিস্ময় বালক' বীর ডিরোজিওকে, সত্যিই তা যে হবে আত্মহত্যার-ই সামিল। বেঁচে থাকুন তিনি যুগ-যুগান্তর, বাঙালির কর্মে ও সাধনায়।

বইটি পড়ে পাঠক বাংলা তথা ভারতের কর্মবীর মহান কিছু পুরুষদের অসম্ভব কীর্তি সম্পর্কে ভিন্নতর আস্বাদ পাবেন, নিঃসন্দেহে বলা যায়।


কিছু কাল্পনিক সংলাপ 

বরুণ দাস

প্রকাশক 

দেবেন্দ্রনাথ দত্ত  ৩/৭৯ যতীনদাস নগর, কলকাতা ৫৬

মূল্য * ২০০ টাকা


*************************************************************************************

গল্প * যুগল কিশোর দাস অধিকারী



অ - কৃপণ

যুগল কিশোর দাস অধিকারী


পাড়ার দূর্গা পূজা। ছেলেরা দল বেঁধে চাঁদা কালেকসন করতে বেরিয়েছে। সারা পাড়া ঘুরে  এল মিত্তির বাবুর বাড়ী। ভদ্রলোক এ পাড়াতে বেশিদিন আসেনি। শুধু পাশের বাড়ীর দত্ত বাবুর সাথেই ওনার ওঠা বসা। বাকিদের সাথে মেশে না বরং এড়িয়েই যায়।

সারাদিন গাছ গাছালি নিয়েই ব্যস্ত থাকে। রাত্তিরে দোতলা ঘরের উপর তলায় বসে নিজের মনে কি যেন লেখা লেখি করেন। পোশাক আশাক তেমন কেতা দুরস্ত নয়, বেশ সাদামাঠা। স্বামী স্ত্রী দুজনের বাস।


শোনা যায় উনি রিটায়ার ( retired) গেজেটেড অফিসার। কাজের জায়গায় সততা ও নিষ্ঠার জন্য বহুবার পুরষ্কৃত হয়েছেন। কেমন যেন খ্যাপাটে গোছের। গাছগুলোকে ধরে যেন আদর করে  ওদের সাথেই কথা বলে।

বাজার যান বেশ বেলায়। সস্তার জিনিসই তার কেনাকাটার তালিকায় বেশি থাকে। যাতায়াতের সঙ্গী ছিল সাইকেল।

ছেলেরা দরজায় বেল বাজলো। মিত্তির বাবু পুজোর চাঁদার রসিদ দেখেই চক্ষু ছানাবড়া। পাঁচ শ টা কা ..।

দেখ বাপু আমি পঞ্চাশ টাকার বেশি দিতে পারব না।

ছেলেরা ক্ষেপে ওঠে। কি মশাই  বছরে একবার দূর্গা পূজা। তাও পাড়ার মধ্যে।

লাইট , প্যান্ডেল, ডি জে, প্রতিমা , ঢাকি, হাঙ্গামা, নবমীতে প্রসাদ বিতরণ , হাবিজাবি কত খরচ - আপনার হাত দিয়ে জল গলছে না। আপনার তো মশাই ছেলেপুলে কেউ নেই। অত পয়সা জমিয়ে কি করবেন??

  মিত্তির বাবুর মুখটা কেমন বিবর্ণ হয়ে গেল। অন্তরের দুর্বল জায়গায় আঘাত লাগলে যেমন হয়। পরক্ষণে সামলে নিয়েই বললেন তোমাদের পোশায় নাও, না নিলে না নাও। আমার কি খরচাপাতি আছে তার হিসেব আমি তোমাদের দেব না। পুজোতে কি হয় না হয় তা আমার ভালোমত জানা আছে।

তোমাদের অসুবিধা হলে আমার নামে থানায় জানাতে পার। ঐ সব হাঙ্গামা, কান ফাটানো মাইক বাজিয়ে মানুষকে অত্তিষ্ট করে তুলবে। পাড়ার ছেলেমেয়েদের নিয়ে ফাংশান, খেলাধুলা ও সব তো করতে পার।


ছেলেরা উত্তেজিত হয়ে বলল - জ্ঞান দেবেন না, ও সব আর চলে না রবীন্দ্রনৃত্য, আবৃত্তি, খেলাধুলো ও সব করলে লোকই আসবেনা ।

আপনি কি দিচ্ছেন দিন। 

আমি যা বলেছি তার এক পয়সাও বেশি দিতে পারব না। কেউ ভীড়ের থেকে বললো সময় নষ্ট করে লাভ নেই। শালা হাড় কিপটে। যা দেয় তাই নিয়ে কেটে পড়। কেউ বলে এ কি ভিক্ষে দিচ্ছেন?

তোমরা যা ভাব তাই ।

শেষ পর্যন্ত পঞ্চাশ টাকা নিয়েই বিদেয় হল।


এ গ্রামের থেকে যে দিকেই যাও হসপিটাল কম করে সাত আট কিলোমিটার দূরে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ও ভালো নয়। রাতভিতে কেউ অসুস্থ হলে ভ্যান রিক্সা বা টোটই ভরসা। ট্যাক্সি খোঁজ করে আনতে আনতে রোগীর বারোটা বেজে যায়।


দু একটা গ্রামের পর বড় রাস্তার ধারে নতুন হসপিটাল হচ্ছে। লোকেরা আশায় বুক বাঁধছে আর বিনে চিকিৎসায় মারতে হবে না।

প্রায় বছর দুই পরে হসপিটালের কাজ শেষ হল। উদ্বোধন করতে মন্ত্রী, ডি এম, বি ডি ও, এস ডি ও আসবে। চারদিকে সাজ সাজ রব।

২৩শে জানুয়ারী উদ্বোধন। পাশাপাশি দু  চারটা গ্রামে আনন্দের হওয়া বইছে।

পাড়ার ছেলেরা মিত্তির কাকুকে বললো শুনছেন মশাই আমাদের এখানে একটা ভালো হসপিটাল হচ্ছে।

আপনাদের মত কিপটে লোকের সুবিধা হল, অসুস্থ হলে নার্সিং হোমে যেতে হবে না। মিত্তির বাবু কথাটা না শোনার ভান করে বললেন ত ভালো।

ছেলেরা উপেক্ষার সুরে বলল লোকটা কেমন যেন। শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত।

কোথায় বলবে ঠিক আছে আমিও যাব - না কেমন নিস্পৃহ।

দেখতে দেখতে ২৩শে জানুয়ারী এসে গেল। হসপিটাল চত্বরে লোকে লোকারণ্য। রাস্তায় বড় বড় গাড়ী। মন্ত্রী আমলা সব হাইফাই লোক। ফুল দিয়ে সাজানো মঞ্চ। ঐ দিন দেখা গেল আমাদের মিত্তির বাবু ও দত্ত বাবু টোটো করে ওখানে এল।

পাড়ার লোকেরা আড়ালে বলছে এ আবার এই অনুষ্ঠানে কেন  এর পয়সা তো ভূতে খাবে।

যা হোক মঞ্চে উপবিষ্ট অতিথিরা। উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করছে আসল লোক কোথায়। কে সে লোক, যিনি এমন মহান কাজ করলেন তাকে দেখার জন্য সবাই উৎসুক। শুনলাম সেই লোকের নাম নাকি মাইকে ঘোষণা করা যাবে না। প্রচারের যুগে এমন প্রচারবিমুখ লোকটি কে?

কিছু ভালেন্টিয়ার দেখি মিত্তির বাবুকে দেখেই উচ্ছাসে ফেটে পড়ল, আর ব্যারিকেড করে ভিড়ের ভিতর থেকে মঞ্চের মধ্যে বিশেষ ভি আই পি দের সীটে গিয়ে মধ্যমনি করে ওনাকে বসালো।

প্রাক্তন আমলা হয়ত কোন জানাশোনা আছে। তবু সবার মধ্যে যেন কেমন বিস্ময়।

একে একে অতিথি বরণ হচ্ছে।

মিত্তিরবাবুকে মন্ত্রী থেকে ডি এম বি ডি ও সবাই করমর্দন করে পুষ্প চন্দনে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। বেশ কয়েকজন এসে প্রমাণ করছে। ব্যাপার টা কি বোঝা যাচ্ছে না।

অনেকের ভাষণের শেষে উঠলেন মিত্তির বাবু। কিন্তু পূর্ববর্তি বক্তারা কেউ ই এই হসপিটালের দাতার নাম ঘোষণা করেননি, তা নাকি বারন ছিল।


মিত্তিরবাবুর ভাষন শুরু হল। তিনি অল্প বয়সে ভিন ধর্মে মেয়েকে বিবাহ করায় তার বাবা তাকে তেজ্যপুত্র করেন। তখনো চাকরি বাকরি জোটেনি।

টিউশন করে চলত। তার মাঝে তাদের এক পুত্র সন্তান হলো। চার পাঁচ বছরের হতে জানা গেল বোন ক্যান্সার। তিনি অনেকের কাছে ভিক্ষা চেয়েও সেই ব্যাধি সরাবার অর্থ জোগাড় করতে পারলেন না। অবশেষে ছয় সাত বছরের মাথায় তার পুত্র সন্তান অকাল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। কিছুদিন পর wbcs পরীক্ষা দিয়ে ভিডিও হলেন। কিন্তু তার স্ত্রীর আর কোন সন্তান হল না। তত দিনে তার পিতা ও গত হয়েছেন তিনি তার নিজের ভুল স্বীকার করে তার সমস্ত সম্পত্তি ছেলেকে উইল করে যান। কিন্তু তখন সে সম্পত্তির কোন মূল্য

তার কাছে ছি ল না। তাই তার জীবনের সমস্ত আয় ও সম্পত্তি দিয়ে ওই হসপিটাল তৈরীর পরিকল্পনা করেন।


তার সঙ্গে পাঁচ টি অনাথ শিশুর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। যাদের দুজন ডাক্তার, এক জন ইঞ্জিনিয়র ও আর এক জন ভাবা রিসার্চ সেন্টারের বিজ্ঞানী। তারা সবাই আজ উপস্থিত আছ। তারাই তাকে পিতা জ্ঞানে সম্ভাষণ করে।

এবং ভবিষ্যতে এই আজাদ হিন্দ হসপিটালের উন্নতির জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার জন্য তারাই যথাসাধ্য সাহায্য করার জন্য প্রতিশ্রুতি বদ্ধ্ব।

আমার এক সন্তান হারিয়ে অনেক সন্তান পেয়েছি। একজনের চিকিৎসা করতে পারিনি ঠিকই হাজার হাজার ছেলের  মানুষের, প্রসূতির, চিকিৎসা করে হাসি ফুটবে সে আনন্দ কম কিসের?

পাড়ার সেই ছেলেরা যারা মিত্তির বাবুকে দেখে হাসি ঠাট্টা করতো তাদের মাথা যে মাটিতে মিশে যেতে চাইছে।

ওনার পায়ের ধুলো পেলে যেন নিজেদের ধন্য মনে করবে। সকলে সদল বলে পরের দিন সকালেই ওনার বাড়ির বাইরে এসে হাজির হল। কিন্তু

একি ওনার বাড়িতে তলা ঝুলছে।

শুনলাম ওটাও উনি হসপিটালে দান করে দিয়েগেছেন।


**********************************************************************************************

উপন্যাস * বিশ্বনাথ পাল



[ 'স্বরবর্ণ * ১২ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে বিশ্বনাথ পালের ধারাবাহিক উপন্যাস 'বামনের চন্দ্রাভিযান'। উপেক্ষা, অনাদর আর দারিদ্র্যের তীব্র দংশনজ্বালা দাঁতে দাঁত চেপে, একটি যুবক কী ভাবে একক নিঃসঙ্গ লড়াইয়ে জীবনের সাফল্য ছিনিয়ে আনে, এই উপন্যাস তারই জীবন্ত আখ্যান। লক্ষ লক্ষ  বেকার যুবকের বেকারত্বের জ্বালার বাণীরূপই শুধু নয়, তা থেকে উত্তরণের অমোঘ বিশল্যকরণীও বটে এই উপন্যাস।]


বামনের চন্দ্রাভিযান 

পর্ব * তিন

বিশ্বনাথ পাল

 কিছুদিন পরেই অবশ্য জানা গেল যে এম. এস-সি. প্রথম বর্ষে কেউ ড্রপ দিলে পরের বছর পরীক্ষায় বসার জন্য তার আর ক্লাস না করলেও চলে। শর্ত শুধু একটাই প্রথম বর্ষে ক্লাসে উপস্থিতির হার কমপক্ষে পঁচাত্তর শতাংশ থাকতে হবে। এই নিয়ম আমাকে বাঁচিয়ে দিল।

এক শীতের সন্ধ্যায় বেহালা থেকে ইউনিভার্সিটির সহপাঠী দেবাশিস এল আমাদের বাড়িতে। আমাদের বাড়ি আসবে বলে ও আসেনি। এসেছিল পিসির বাড়ি কালীপুজো উপলক্ষে।  আমাদের বাড়িও একই এলাকায় জেনে দেখা করতে এসেছে। ওর কাছে শুনলাম ও-ও এবছর ড্রপ দিয়েছে।কিন্তু ওর ড্রপ দেওয়া আর আমার ড্রপ দেওয়া এক জিনিস নয়। ও দিয়েছে ভাল রেজাল্টের প্রত্যাশিত প্রস্তুতি হয়নি বলে, আর আমি ফেল করার ভয়ে।

দেবাশিসকে মা বলল, “ওর একেবি-র পেপারটা নাকি কিছুতেই মাথায় ঢোকে না।”

ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়া আমার আটপৌরে মায়ের মুখে ‘একেবি’-র কথা শুনে দেবাশিস খুব মজা পেল।

‘একেবি’ মানে আশীষকুমার ব্যানার্জী। পড়াতেন রিভিল্ড প্রেফারেন্স থিওরি। একেবি-র ক্লাসে নেওয়া নোট পড়ে বুঝতে গিয়ে বেশ কয়েকবার ব্যর্থ হয়েছিলাম। কখনও স্বগোতোক্তি করেছি ব্যর্থতার। ধুত্তরি! এই একেবি-র নোট মনে রাখা আমার কর্ম নয়। নামটা আমার মুখে শুনে শুনে মায়ের মনে গেঁথে গেছে। 

দেবাশিস জানাল যে প্রতিবছর শীতে নাকি ওর জীবনে একজন করে নতুন বন্ধু আসে। আমি ওর বন্ধুতালিকায় নবতম সংযোজন। এর আগে ওর সঙ্গে যেটুকু আলাপ ও মেলামেশা, তাতে আমাকে ওর বন্ধু না বলে পরিচিত বলাই শ্রেয় ছিল। 

ওর কাছেই জানলাম যে ড্রপ দেওয়ার পর পরের বছর পরীক্ষায় বসতে গেলে ইউনিভার্সিটি গিয়ে নির্ধারিত ফর্ম পূরণ, টাকা জমা দেওয়া ইত্যাদি কিছু অফিসিয়াল কাজ করতে হবে। তবে নতুন করে আর ক্লাস করার দরকার নেই। আগের বছর ক্লাসে যদি পচাত্তর শতাংশ উপস্থিতি থাকে, তবে এতেই পরের বার পরীক্ষায় বসার অনুমতি মিলবে ক্লাস না করেই।

দেবাশিসের কথায় যেন আলোর রেখা দেখতে পেলাম। বুঝলাম আগের সহপাঠীদের মুখ না দেখেও পরীক্ষায় বসা যাবে। এটা বেশ ভাল ব্যাপার। কারণ ওদের মুখোমুখি হতে হলে পরীক্ষা দিতে না পারার জন্য লজ্জা, অপরাধবোধে কুঁকড়ে যেতে হোত। মনে মনে আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। এম. এস-সি. পাশের স্বপ্ন।

এরপর থেকে সত্যিই দেবাশিসের সঙ্গে আমার এক বন্ধুত্বের গিঁট বাঁধল, যা আজও ছিন্ন হয়নি।


পাঁচ 

 

আমাদের পাড়ায় ছিল তুষারের মামাবাড়ি। ও প্রায়ই মামাবাড়ি আসত। রাস্তাঘাটে দেখা হত। রোগা, কালো, চশমায় ঢাকা উজ্জ্বল চোখের তুষারের সঙ্গে একদিন নিজেই আলাপ করে বন্ধুত্ব জমাতে সময় লাগেনি। তখন মাধ্যমিক পাশ করেছি, ইলেভেনে না টুয়েলভে পড়ি। দেখি ও-ও একই ক্লাসে পড়ে। আমাদের বাড়িতে ওর যাতায়াত শুরু হল। মামাবাড়ি এলে ও আমাদের বাড়িও আসত। আমরা পড়াশোনা নিয়ে আলোচনা চালাতাম আড্ডা মারার ফাঁকে। দুজনে দুই আলাদা টেষ্ট পেপার কিনে পরীক্ষার আগে সেগুলি বিনিময় করেও সমাধান করতাম। ওর  মামাবাড়ি অবস্থাপন্ন হলেও ওর সঙ্গে আমার কমন ফ্যাক্টর ছিল দুজনেরই পারিবারিক অসাচ্ছল্য। ওদের বাড়ি গেলে ওর বাবাকে কখনও দেখতাম না। কেমন যেন আশঙ্কা হত যে এ নিয়ে প্রশ্ন করলে ও অপ্রস্তুত হবে, তাই বিরত থাকতাম। ওর মা কাজ করে দুই ছেলেকে নিয়ে সংসার চালাতেন। তুষার ছিল বড়। ছোট ভাইটার নাম মনে নেই। যাইহোক, উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে নেতাজীনগর ডে কলেজে ভর্তি হলাম। তুষার অন্যত্র। ফলে আমাদের যোগাযোগে ভাটা পড়ল। কিন্তু জোয়ার এল ড্রপ দেওয়ার পর আবার পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে। কারণ ওকে ইউনিভার্সিটিতে নতুন ভর্তি হওয়া প্রথমবর্ষের সতীর্থ হিসাবে পেলাম।

উচ্চমাধ্যমিকের পর ইচ্ছা ছিল ফিজিক্স বা কেমিস্ট্রিতে অনার্স নেব। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিকে  নম্বর ছিল ৫৭২। অর্থাৎ প্রথম বিভাগের থেকে ২৮ নম্বর কম। ফলে বিএসসি পাসে ভর্তি হলাম নেতাজীনগর ডে কলেজে। অর্ণব স্যারের কাছে পড়তে গিয়েছিলাম অংক। স্যার বললেন, “পাশ কোর্সে পড়ে কী করবে? গ্রাজুয়েশনের পর তো তোমার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে। তোমার যা নম্বর আছে তাতে ইকনমিক্সে অনার্স পেয়ে যাবে।” 

তখন ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ। স্যার বললেন, “নেতাজীনগর কলেজে আমার একজন বন্ধু অধ্যাপক আছেন। ওঁকে আমি একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি। চিঠিটা নিয়ে তুমি ওঁর সঙ্গে দেখা করো, তোমার ইকনমিক্সে অনার্স হয়ে যাবে।” 

হলও তাই। এক সন্ধ্যায় রাস্তা চিনে চিনে বিশ্ববন্ধু ঘোষ বা বিজি স্যারের বাড়ি গেলাম। অর্ণব স্যারের চিঠি দেখাতেই বললেন কাল কলেজে দেখা করতে।

তারপর নেতাজীনগর কলেজে বিএসসি পাশ কোর্স থেকে আবার ইকনমিক্স অনার্সে শিফট করলাম। এভাবেই বাড়ির অভিভাবকের পরামর্শে নয়, কোচিঙের স্যারের কথায় কেরিরারের রাস্তা নির্বাচন। 

ইকনমিক্সে ষোলো জন ছাত্রছাত্রী ছিলাম অনার্সে। এখানে আমার এক স্কুলের বন্ধুকে ফিরে পেলাম। সুমিত শীল। লম্বা, ফর্সা, লাজুক স্বভাবের সুমিতের সঙ্গ আমার বেশ পছন্দের ছিল।

বিশ্ববন্ধু ঘোষ বা বিজি স্যার অর্থনীতির অধ্যাপক। ফলে কলেজের পাশাপাশি তাঁর কোচিঙেও ভর্তি হলাম। কিন্তু কোচিঙে তাঁর পড়ানোর স্টাইলে আমরা, যারা উচ্চমাধ্যমিকে অর্থনীতি পড়িনি, ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি পড়েছি, তাদের বেশ সমস্যা হত। কোনও বিষয়ে বুঝতে না  পারলে স্যার বলতেন—ওদিকের আলমারিটা খোলো, তিন নম্বর তাকের লাল মলাটের বাঁধানো বইটা আনো।

বই থেকে স্যার একটা নির্দিষ্ট পৃষ্ঠা বা অধ্যায় বের করে দিতেন বোঝার জন্য। আমরা টুকতাম। কখনও বই সঙ্গে নিয়ে নিকটবর্তী জেরক্সের দোকানে যেতাম। সেইসব জেরক্সকপি অধিকাংশ সময়ই ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে থাকত। কিন্তু তবু আমরা বিজি স্যার ব্যতীত অন্য কারও কাছে পড়ার কথা ভাবতে পারিনি। ভাবতাম ইকনমিক্স বোধহয় এভাবেই পড়ানো হয়।

ভুল ভাঙল পার্ট ওয়ানের রেজাল্ট বেরনোর পর।

রেজাল্টে দেখা গেল ষোলো জন ছাত্রীছাত্রীর মধ্যে মাত্র তিন জন ছাত্র পাস ও অনার্স   দুটি ক্ষেত্রেই পাশ করেছে। কোনও ছাত্রীর নাম ছিল না সেই তিন জনের মধ্যে। যে ছেলেটি অনার্সে কলেজে সর্বোচ্চ নম্বর ২০৩ অর্থাৎ পঞ্চাশ শতাংশের বেশি নম্বর পেয়েছে, তার নাম অভিজিৎ। কিন্তু সে অংকে ফেল করেছে এবং সে বিজি স্যারের কাছে ইকনমিক্স পড়েনি। তাকে খুব একটা ক্লাস করতেও দেখা যায়নি। কারণ সে অধিকাংশ সময় শুনতাম ক্রিকেট কোচিং ক্লাসে প্র্যাক্টিস করতে ব্যস্ত থাকত। 

আমাকেও সবাই অকৃতকার্যের দলেই ধরে রেখেছিল।কারণও ছিল। ক্লাসে পারতপক্ষে মুখ খুলতাম না। কারণ  অধিকাংশ সময় কী বুঝছি, তা-ই ভাল বুঝতাম না। ক্লাসে পড়ানোর সময় কোনও প্রশ্ন করব, আর সেই প্রশ্ন যদি বোকার মতো হয়ে যায় এই ভয় পেতাম।আর সুমিত বাদে অন্যান্য ছাত্রছাত্রীরা দেখতাম বেশ ফটর ফটর করত। তাদের অনেকেরই অর্থনীতি নতুন বিষয় নয়, উচ্চমাধ্যমিকে পড়েছে। ফলে তাদের সামনে স্বভাব-লাজুক হওয়ায় ও সাহসের  অভাবে সিঁটিয়েই থাকতাম।বিষয়টাও আমার ক্ষেত্রে নতুন তো বটেই, তারওপর বইপত্রও বলতে গেলে ইংরেজিতে। মনে সন্দেহ হত যা বুঝছি তা কি ঠিক বুঝছি?

রেজাল্ট বেরনোর দিন সন্ধ্যায় ছাত্রছাত্রীদের একটি দল বিজি স্যারের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। যেন একসঙ্গে এত ছাত্রছাত্রীর অংকে ফেল করায় তাদের কোনও দোষ নেই, দোষটা ইউনিভার্সিটির বা পরীক্ষকের। হয়তো খাতাগুলোই ঠিকমতো দেখা হয়নি। অনেকটা ডেপুটেশন দেওয়ার ভঙ্গিতে দলটা এগিয়ে যাচ্ছিল বিজি স্যারের বাড়ির দিকে। আমিও ছিলাম সেই দলে। আমাকে সহসা এক সহপাঠিনী প্রশ্ন করল, “সোমনাথ, তোর ম্যাথস ক্লিয়ার?”

বললাম, “হ্যাঁ।”

আমার উত্তরে মেয়েটি যেন আকাশ থেকে পড়ল। মানে মুখচোরা ক্লাসে প্রশ্ন না করা ছেলেটির এক চান্সে পাশ করায় সে বেশ অবাক।

একদিন আমি আর তুষার রাণীকুঠিতে অভিজিতের সঙ্গে দেখা করলাম। কলেজে ক্লাস না করেও ওর অনার্সে হায়েস্ট পাওয়ার রহস্য কী জানাটা আমাদের উদ্দেশ্য। 

অভিজিৎ বলল, “আমি এজি স্যারের কোচিঙে পড়েছি। পরীক্ষায় এজি স্যারের নোট লিখেছি। তাই হয়তো অনার্সে ভাল রেজাল্ট হয়েছে।” 

এজি মানে অমিতাভ ঘোষ। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের অধ্যাপক অমিতাভ ঘোষ পরে শুনি এক বিখ্যাত চিত্র-পরিচালকের তুতো ভাই।

অভিজিৎ আরও বলল যে এজি স্যারের কাছে অ্যাডমিশন ফি ও প্রথম মাসের মাইনে দিয়ে ভর্তি হতে হয়। 

আমি সংশয় প্রকাশ করলাম যে সুমিত কি অ্যাডভান্স দিয়ে পড়বে! শুনে অভিজিৎ বলল, “দ্যাখ, এটা ক্যারিয়ারের ব্যাপার, সুমিত না পড়লেও তোর পড়া উচিত।”

সুমিতকে গিয়ে বললাম, এজি-র কোচিঙে পড়তে চাই। কিন্তু ওখানে অ্যাডভান্স দিয়ে পড়তে হবে।

সুমিত প্রথমে অ্যাডভান্স দিয়ে পড়ায় আপত্তি জানাল। বলল, “একবার উচ্চমাধ্যমিকে একজন স্যারের কোচিঙে ইংরেজি পড়তে গেছি। স্যার বললেন, ‘অ্যাডভান্স এনেছ? অ্যাডভান্স ছাড়া আমি পড়াই না।’ আমি বললাম, ‘আমিও অ্যাডভান্স দিয়ে পড়ি না।’ বলে বেরিয়ে এসেছিলাম।”

তো, এহেন সুমিতকেও রাজি করাতে আমাকে বেগ পেতে হল না। কারণ এজি-র কাছে পড়ার হাতে গরম ফলাফল অভিজিৎ। ওর ক্লাস না করে বিজির কাছে না পড়ে হায়েস্ট নম্বর পাওয়া।

গ্রাজুয়েশনে পার্ট ওয়ানে তুষার  গড়িয়ার এন্ড্রুস কলেজে ভর্তি হয়েছিল। কী কারণে যেন ওর একটা বছর নষ্ট হয়েছিল। কৌশিকেরও এক বছর নষ্ট হয়েছে পক্স হওয়ায়। একদিন  তুষারের সঙ্গে গেলাম বালিগঞ্জে এজি স্যারের কোচিঙে। গিয়ে দেখি স্যারের সঙ্গে পড়ার ব্যাপারে কথা বলার কোনও সুযোগ নেই বললেই চলে।কারণ পড়ানোর রুমের পাশেই আরেকটা অফিসরুম। সেখানে বসে এক রিসেপসনিস্ট ভদ্রমহিলা। কোচিঙে ভর্তি সংক্রান্ত যাবতীয় কথা তার সঙ্গেই বলতে হবে। আমরা জেনেছি পার্ট ওয়ান ও পার্ট টু-তে পড়ার মাসিক মাইনে যথাক্রমে আড়াইশো ও সাড়ে তিনশো টাকা আর ভর্তির ফি দেড়শো টাকা। অর্থাৎ তুষারকে পার্ট ওয়ানের জন্য দিতে হত মোট চারশো টাকা, আমাকে পাঁচশো টাকা। 

আমরা গিয়ে রিসেপসনিস্ট ম্যাডামকে বললাম যে স্যারের কাছে পড়তে চাই। কিন্তু অত টাকা দিয়ে পড়া আমাদের পক্ষে অসম্ভব। ম্যাডাম আশ্বাস দিলেন যে এ ব্যাপারে তিনি স্যারের সঙ্গে কথা বলবেন।

এর দু-তিন দিন বাদে তুষার আমাদের বাড়িতে হাজির। ও যা বলল তার মর্মার্থ হল মাঝে আরেক দিন ও এজি স্যারের কোচিঙে গিয়ে ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলে। ম্যাডামকে ফি  কমাতে রাজি করানোর জন্য আমার সম্পর্কে প্রশংসাসূচক অনেক কথা বলে। যেমন আমি কবিতা লিখি, বন্ধুদের সঙ্গে ম্যাগাজিন বার করি। আমাদের বাড়িতে মূর্তি বানানো হয়, সেই কাজেও আমার পারদর্শিতা আছে, আমি পড়াশোনায় ভাল, অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করছি টিউশনি করে ইত্যাদি। কিন্তু পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ।

তুষার ঘটনার বর্ণনা দেওয়ার পর বলল, “তোর সম্পর্কে নিজের থেকে একটু বেশি বলা হয়ে গেছে বুঝলি।”               

আমার মন কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল। ম্যাডাম তুষারের কাছে আমাদের দুজনের ফিসই একশো টাকা করে কমাতে রাজি হয়েছেন। অর্থাৎ আমাকে চারশো টাকা দিয়ে ভর্তি হয়ে মাসে আড়াইশো দিতে হবে। তুষারের ক্ষেত্রে তা যথাক্রমে তিনশো ও দেড়শো।

এবার আমি গেলাম সুমিতের কাছে। এজি স্যারের কোচিঙে কবে থেকে পড়তে যাব ঠিক করতে। কারণ আমি আর সুমিত একই সঙ্গে নেতাজীনগর কলেজে ও বিজি স্যারের কোচিঙে যেতাম। সুমিতকে আমার ফি কমানোর কথাও বললাম। ও কিছু মনে করল না। তাছাড়া আমার মতো অসচ্ছলতার সমস্যা ওর ছিল না।

অমিতাভ ঘোষের কোচিঙে পড়া শুরু করলেও বিজি স্যারের কোচিং কিন্তু আমরা ছাড়লাম না। কলেজে ক্লাস করতে গেলে স্যারের সঙ্গে দেখা হত। পড়া ছেড়ে দিলে মনোমালিন্য হতে পারত। তবে অন্যত্র পড়ার খবর বিজি স্যারকে বলিনি। তাছাড়া স্যারের বাড়ির বিশাল বইয়ের সংগ্রহ-ও আমাদের পার্ট-টু-তে কাজে লাগতে পারে মনে হল।

এজি স্যারের কোচিঙে পড়ার কল্যাণেই আমি ও সুমিত দুজনেই পার্ট-টু-তে তুলনামূলক ভাবে ভাল রেজাল্ট করলাম। আমি চারশোতে ২০৭, সুমিত কত মনে নেই, তবে ২০০-র বেশিই। পার্ট ওয়ান ও পার্ট-টু মিলিয়ে অনার্সে আমার নম্বর দাঁড়াল ৩৯১। নয় নম্বরের জন্য পঞ্চাশ শতাংশ হল না। যাইহোক, এই নম্বরে যে এমএসসি পড়ার সুযোগ পাব তার একটা ক্ষীণ আশা ছিল। কারণ ইকনমিক্স খুব একটা সহজ বিষয় নয়। নম্বর তোলা শক্ত। ফলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএসসিতে ভর্তির ফর্ম পূরণ করে জমা দিলাম।

প্রথম তালিকা প্রকাশের দিন নাম দেখতে ইউনিভার্সিটি যাইনি। মনে হয়েছিল প্রথম তালিকায় জায়গা হবে না। কিছু ছাত্রছাত্রী জেএনইউ বা প্রেসিডেন্সিতে চলে গেলে দ্বিতীয় বা তৃতীয় তালিকায় স্থান হলেও হতে পারে। এক বন্ধুর থেকে ইউনিভার্সিটির ফোন নম্বর জোগাড় করে ফোন করলাম, “আচ্ছা এমএসসি-তে ভর্তির সেকেন্ড লিস্ট কবে বেরোবে?”

অপর প্রান্তের ভদ্রলোক বললেন,  “কত নম্বর ছিল?”

বললাম, “৩৯১।”

আমাকে অবাক করে ভদ্রলোক বললেন, “ফার্স্ট লিস্টেই হয়ে গেছে।”

বুঝলাম ইকনমিক্স সত্যিই কঠিন বিষয়। 


এম.এস-সি. পার্ট ওয়ানে ড্রপ দেবার পর মনে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলাম না।

মা ইউনিভার্সিটির পড়া ছেড়ে ডবলু.বি.সি.এস.-এর জন্য তৈরি হতে বলল। কিন্তু যে ছেলে ফেল করার ভয়ে পরীক্ষায় বসে না, সে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সফল হবে? ব্যাপারটা আমার অদ্ভূত ঠেকল। ড্রপ অনেকেই দেয়, হয়তো ফেলও করে কেউ কেউ, কিন্তু পরের বার পাশ করার জন্য ঝাঁপায় না?

তো নতুন ব্যাচে আমার সহায় হল কৌশিক ও তুষার। ওদের সুবাদে অনির্বাণ ও বিকাশের সঙ্গে আলাপ হল। এম.এস-সি. পার্ট ওয়ানে বসার জন্য গত বছরের নোট, খাতাপত্তর আমার ছিলই। তবে প্রতিবারই সিলেবাস একটু অদলবদল হয়। সেই বদলটুকুর কোনও ক্লাস না করেই কৌশিক ও তুষারের থেকে নোট পেতে কোনও সমস্যা হল না। এম.এস-সি. পার্ট ওয়ান পাশ করলাম, পেলাম  ৫০০-তে মাত্র ২০৮। ৪১ শতাংশের সামান্য বেশি। আমার টনক নড়ল। সূর্যপুর স্কুলের পরীক্ষায় ফার্স্ট হতাম। মাধ্যমিকেও স্কুলের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলাম। স্কুলের স্যাররা আমাকে ভালবাসতেন। ক্যারিয়ারের কথা ভেবে কোনওদিন পড়াশোনা করিনি। পড়াশোনা না করলে স্যারদের ভালবাসা হারাব ভেবে পড়তাম। ক্লাসে দু-এক জন স্যার আমার খাতা দেখার পরে অন্য ছাত্রদের তা পড়তে বলতেন আদর্শ উত্তর কেমন হবে বোঝাতে। মাধ্যমিকে স্টার  মার্কস না পেলেও সত্তর শতাংশের কাছাকাছি নম্বর পেয়েছিলাম। গত শতাব্দীর সেই সময়ে মাধ্যমিকে ভুড়ি ভুড়ি নম্বর তো উঠত না, ফার্স্ট ডিভিশন পাওয়াও তখন পাড়ায় খবর হত। আর সেখানে এম. এস-সি.-তে মাত্র ৪১ শতাংশ! অর্থাৎ থার্ড ডিভিশন।

ইতিমধ্যে মৌমিতার সৌজন্যে বয়ে চলা ঝড় থামাতে রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দের বই পড়তে শুরু করলাম। বিবেকানন্দের একটি কথা মনে দাগ কেটেছিল। নচিকেতা কোথায় যেন বলেছিল, অনেকের মধ্যে আমি প্রথম, মধ্যম কিন্তু অধম কখনও নই।

আমারও মনে হল যে করেই হোক ফেল করার ভয় যেমন পার হয়েছি, এবার তৃতীয় বিভাগও পরিবর্তন করতে হবে। সামনে পার্ট-টু-র তিনশো নম্বরের পরীক্ষা আমার হাতে আছে। এই তিনশো নম্বরে যদি ভাল নম্বর তুলতে পারি তবে এগ্রিগেটে থার্ড ডিভিশন পালটানো সম্ভব হবে। 

ইতিমধ্যে জেনেছি মাস্টার ডিগ্রিতে পঞ্চান্ন শতাংশ নম্বর থাকলে কলেজে পড়ানো সুযোগ থাকে, নেট স্লেট পরীক্ষায় বসা যায়। অর্থনীতিতে আমার যা জ্ঞানগম্যি, তাতে কলেজে পড়ানোর কথা কষ্টকল্পনায়ও আসত না। কিন্তু বন্ধুরা যখন এই ক্ষেত্রে তাদের কেরিয়ার গড়ার আলোচনা করত, তখন সুযোগ কাজে লাগাতে না পারার জন্য আপশোশ যে হত না টা নয়। কোনও প্রেমের মোহে আক্রান্ত না হয়ে প্রথম থেকেই  সিরিয়াসলি পড়লে আমারও ভাল রেজাল্ট হতে পারত। যাই হোক একটা শেষ চেষ্টার সূক্ষ্ম আশা মনে দেখা দিল। অলীক আশা ছিল হয়তো, তা-ও। পার্ট ওয়ানে ২০৮, অর্থাৎ পার্ট-টুতে যদি ২৩২ পাই, তাহলে আমারও প্রাপ্ত নম্বর হবে   ৪৪০, অর্থাৎ কাঙ্খিত পঞ্চান্ন শতাংশ। কাউকে বলার সাহস হল না। পার্ট-টুতে বিষয় নির্বাচনের একটা ব্যাপার থাকে— ২০০ নম্বরের স্পেশাল পেপার আর একটা ১০০ নম্বরের অপশনাল। বেশি নম্বর উঠতে পারে ভেবে দুটোই অংক সংক্রান্ত বিষয় বেছে নিলাম— স্পেশাল পেপার ইকনমেট্রিক্স  ও স্ট্যাটিসটিক্স আর অপশনাল পেপার অপারেশন রিসার্চ। দেখাই যাক বেশি নম্বর ওঠে কিনা। 

উঠল না। পার্ট-টুতে ক্লাস করেছি। কারণ পুরনো সতীর্থরা ততদিনে পাশ করে বেরিয়ে গেছে। ফলে তাদের সাক্ষাতে লজ্জিত হওয়ার আশঙ্কা ছিল না। তুষার, কৌশিক, বিকাশ,  অনির্বাণ-সহ আমরা সবাই এই কম্বিনেশনের বিষয় নিয়ে এক সঙ্গে ক্লাস করলাম। কিন্তু আমার কাঙ্ক্ষিত নম্বরের ধারে কাছে পৌঁছতে পারলাম না। কিন্তু থার্ড ডিভিশনের গ্লানি থেকে মুক্তি পেয়ে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হলাম। পার্ট-টুতে আমার প্রাপ্ত নম্বর হল ৩০০-তে ১৭১, অর্থাৎ সাতান্ন শতাংশ, কিন্তু এগ্রিগেটে আমার নম্বর দাঁড়াল ৪৭ শতাংশের সামান্য বেশি। যাইহোক এবার আমি ইকনমিক্সে এমএসসি পাশ, বেশ গালভারি শুনতে। 

অমর্ত্য সেন যে বছর নোবেল পুরস্কার পেলেন, সেই বছর ঢুকেছিলাম ইউনিভার্সিটতে। রাজ্যের অর্থমন্ত্রী সপ্তাহে একদিন করে ক্লাস নিতেন আমাদের। যতদূর মনে পড়ে তাঁরই প্রচেষ্টায় নোবেল পাওয়ার পর আমাদের ডিপার্টমেন্টে আনা হয়েছিল অমর্ত্যবাবুকে একটি সেমিনার উপলক্ষ্যে। সেই প্রথম আমার কোনও নোবেল লরিয়েটকে কাছ থেকে দেখা। যদিও আলফ্রেড বেনহার্ড নোবেলের উইলে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার উল্লেখ ছিল না। কিন্তু এই বিষয়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করে কমিটি ১৯৭৯ সালে একে তালিকায় ঢোকায়। আর বেরোলাম ইউনিভার্সিটি থেকে তিন বছর পর, একবিংশ শতাব্দির শুরুতে।

এবার কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা। কিন্তু আমার যা রেজাল্ট, তাতে  চাকরি জোটানো দুষ্কর মনে হল। তবে মনে আশা পোষণ করতাম সরকারি চাকরির। কারণ আমার বাবা কখনও সরকারি কাজ করেনি। ঊষা কোম্পানি বদলি শ্রমিক ছিলেন, যার একটা ভাল নাম ছিল—জয় ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্ক্স। বাবা যেহেতু বদলি শ্রমিক ছিলেন, তাই কাজ না থাকলে বেতনের গল্প ছিল না— নো ওয়ার্ক, নো পে। অথচ বাবার নিজের ভাই ও খুড়তুতো ভাই-সহ তিন ভাই সরকারি চাকরি করতেন। ফলে তাদের ছেলেমেয়েরা ছোট থেকে যে সাচ্ছন্দ্য ভোগ করত, আমরা পেতাম না। 

ঊষা ফানের একটা সময় রমরমা বাজার ছিল। সিলিঙে ঊষা ফ্যান ঝোলানো ছিল আভিজাত্যের পরিচায়ক। কলকাতায় জয় ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্ক্সের দু’টি কারখানা ছিল, যার একটি বাঁশদ্রোণীতে আর একটি আনোয়ার শাহ রোডে। দ্বিতীয়টিতে তৈরি হত সেলাই মেশিন। প্রথমটির আজও অস্তিত্ব আছে। আর দ্বিতীয়টির জায়গায় গড়ে উঠেছে অতিকায় বিপনিকেন্দ্র ও বহুতল, যার পোশাকি নাম সাউথ সিটি।  প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সস্তায় উন্নত মানের ফ্যান বাজারে এসে ঊষা ফ্যানকে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দিল। ফলে প্রায়ই উৎপাদন বন্ধ, কারখানার গেটে তালা ঝুলতে লাগল। আমাদের সে সময় অন্ধকার নেমে আসত সংসারে। কারখানা খোলা থাকলে যাও-বা একটা রোজগারের যোগান অব্যাহত থাকত, বন্ধ হলে অনিশ্চয়তার মেঘ দেখা দিত। কারখানায় কাজের পাশাপাশি বাবা টুকটাক ঠাকুর বানাত বলে আমাদের কখনও না খেয়ে থাকতে হয়নি। হয়তো এমন হয়েছে বাবার হাতে একটা টাকাও নেই, বাড়িতে চালও বাড়ন্ত। বাবা ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে কোথায় বেরিয়েছে মা বা আমরা কেউ জানি না। দেখা গেল দশটা নাগাদ বাবা ফিরে এল দু-চার কিলো চাল ও রুমালে মাছ বেঁধে নিয়ে। কোনও এক জায়গায় গিয়ে ঠাকুর বানাতে হবে, বাবার থেকেই তারা ঠাকুর নেয়, তাই বাবা নিজে গিয়ে বায়না নিয়ে এসেছে। আবার ঠাকুর নিয়ে গেছে, কিন্তু কিছু টাকা বাকি আছে হয়তো, এভাবে গিয়েও তা আদায় হত। ফলে অভাব থাকলেও আমাদের হাঁড়ি চড়েনি এমন হয়নি। সরকারি  চাকরির সুখ জ্যাঠাদের ছিল। আমরা পাশে থেকে তা অনুভব করতাম।ওদের সচ্ছলতার অহংকার টের পেতাম। ওরা আমাদের ছোট নজরে দেখত। অর্থহীনকে কে-বা কবে বড় নজরে দেখেছে?

ফেল করার ভয়ে পালিয়ে যাওয়ার গ্লানিমুক্ত আমার এবার সরকারি চাকরির জন্য তৈরি হতে কোনও বাধা নেই। কিন্তু কী উপায়ে যে পড়াশোনাটা শুরু করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। সরকারি চাকরির পরীক্ষার ফর্ম পূরণ করতাম, পরীক্ষাও দিতে যেতাম, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সংখ্যক প্রশ্নের উত্তর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে করতে পারতাম না বা আমার সেই এলেম ছিল না। কোন বিষয়ের জন্য কোন বই পড়া উচি্ত তা-ও অজানা ছিল। সোজা কথায় গাইডেন্সের অভাব ছিল। এদিকে ট্যাঁকের জোর ও সাহস নেই। বছর দুয়েক আগে মায়ের কথায় রাজি হলে হয়তো বাবার কাছ থেকে কোনও কোচিঙে পড়ার টাকাটা পাওয়া যেত। কিন্তু আমিই রাজি হইনি আর এম.এস-সি.ও পড়া হও না, ফেল করার ভয়ের গ্লানিটা থেকেই যেত।  


ছয় 


সুদীপ একদিন আমাকে বলল, “তুই সরকারি চাকরির প্রিপারেশন নিচ্ছিস না?”

বললাম, “হ্যাঁ। কিন্তু কেন?”

“তাহলে বাপিদার সঙ্গে দেখা কর। বাপিদা বলে বলে প্রিলিমিনারি ক্লিয়ার করে।” 

সুদীপ আমার স্কুলের বন্ধু। ওদের গভর্মেন্ট কোয়ার্টারে আমার যাতায়াত ছিল। হায়ার সেকেন্ডারিতে ওদের বাড়িতে কেমিস্ট্রি পড়তে যেতাম। কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাঠরত আমাদের এক বন্ধুর দাদা ওদের বাড়িতে সুদীপ, বাবাই ও আমাকে পড়াতে আসত। বাপিদারাও ওই একই কোয়ার্টারে থাকত। বাপিদার বাবা অবসরের পর  ফ্ল্যাট কিনে সুবোধ পার্কে শিফট করেন। তো, বাপিদার সঙ্গে আমার আলাপ ছিলই। সুদীপের কাছে বাপিদার বাড়ির অবস্থান ভাল করে বুঝে নিলাম। সঙ্গে নিলাম ফোন নম্বর। 

ফোনে যোগাযোগ করে একদিন সাইকেল চালিয়ে বাপিদার বাড়ি গিয়ে আমার উদ্দেশ্য  ব্যক্ত করলাম, “সুদীপ বলছিল যে তুমি বলে বলে প্রিলিমিনারি ক্লিয়ার করো, আমিও তো সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছি, যদি একসঙ্গে পড়াশোনা করা যায়…”   

আর বিশেষ কিছু বলতে হয়নি। আমার থেকে বছর দুয়েকের বড় বাপিদার মনে  আমার সম্পর্কেও ভাল ছাত্র বলে ধারণা ছিল। ফলে বাপিদার সম্মতিতে যেন এক অসম বয়সি বন্ধুত্বের সূচনা হল। যদিও সে বন্ধুত্বে খাদ ছিল কিনা সেই মুহূর্তে জানা যায়নি। আর তাছাড়া খাদ ছাড়া যেমন সোনার গয়না গড়া হয় না, তেমনি জীবনের সৌন্দর্যসৃষ্টিও খাদছাড়া অসম্পূর্ণ থেকে যায়।  

শিক্ষাগ্রহণে যেমন গুরুর কাছে  নাড়া বাঁধার ব্যাপার থাকে, তেমনই আমার সরকারি চাকরির প্রস্তুতির প্রথম গুরু বাপিদা্র কাছেও আমি নাড়া বাঁধলাম সেই দিন।যদিও গুরুর মোটিভেশনে ছাত্রের শেষে ষন্দেহ দেখা দেবে।   

বাপিদার পরামর্শে আমি রাজ্য সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য টাটা ম্যাকগ্রহিলের জেনারেল স্টাডিস ম্যানুয়াল বইটি কিনলাম। কলেজস্ট্রিট থেকে প্রায় ছ’শো টাকা দিয়ে। টাকার পরিমাণটা তখনকার বিচারে কম নয়। টাটা ম্যাকগ্রহিলের বইটা একটা থান ইটের থেকেও বেশি ভারি। 

ইতিমধ্যে আমার এম. এস-সি. পাশের যোগ্যতায় কোনও বেসরকারি চাকরি জোটে কিনা তা পরখ করে দেখছি। একদিন মা বলল, “ছোটন তোকে দেখা করতে বলেছে।” 

আমার বাবার এক খুড়তুতো দাদা যিনি সরকারি চাকরি করতেন, তার ছোট ছেলে ছোটনদা। ছোটনদা কোনও এক বেসরকারি ব্যাঙ্কে চাকরি করে। বেশ ফিটফাট থাকে। স্মার্ট বলতে যা বোঝায় ছোটনদা তাই। তো, গেলাম একদিন ছোটনদার কাছে। বলল, “তুই     এম. এস-সি. পাশ?” 

বললাম, “হ্যাঁ।”  

“কম্পিউটার জানিস?” 


***********************************************************************************************

(আগামী সংখ্যায়)

************************************************************************************************

উপন্যাস * দীপংকর রায়



['স্বরবর্ণে'র চতুর্থ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে কবি দীপংকর রায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে '। এই উপন্যাস লেখকের ষোল-সতের বছর বয়সের কালপর্ব থেকে শুরু। যদিও লেখকের জন্ম এপার বাংলায়, কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে থেকেছে ওপার বাংলায়। কাজেই যাতায়াত থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ ছেড়ে চলে আসা আর তারই নাছোড় এক টানাটানির মধ্যে যে জীবনের ক্রমাগত আসা আর যাওয়া ,এই উপন্যাস মূলত তারই এক নির্মম নিষ্ঠুর ভাঙা-গড়ার আশ্চর্য কথোপকথন। ধারাবাহিকভাবে যা আমরা পড়ছি, কবি দীপংকর রায়ের মায়াময় কলমে।]


কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে 

পর্ব * ১০  

দীপংকর রায়


যদিও এ পাড়ায় আর কারো বাড়িতে যে গোরু মোষ নেই তেমনটাও তো নয় ; এই তো , এই যেমন , পেছনের যে বাঁশ-জঙ্গল ডোবা-পুকুরের দিকে তাকিয়ে ফিরে যাই বারবার ওদেশের সেই সব প্রকৃতির কাছে ; তার পূর্ব-দক্ষিণ কোণের জঙ্গলাকীর্ণ পরিসরটাতেই তো রয়েছে বেশ কয়েকটি গোরু মোষের থাকবার জায়গা । মালিক শ্রীমন্ত দাশ । এ পাড়ার হোমিওপ্যাথির এক মাত্র চিকিৎসক। আমাদের বাড়ির সঙ্গে অদ্ভূৎ এক সম্পর্ক যার । সেটা মোটেও খুব একটা স্বাভাবিক না । আর তার কারণ একটাই , আমাদের ঘরের পেছনে তার বাঁশ-জঙ্গল ডোবা-পুকুর ঘেরা জায়গাটির যথেচ্ছভাবে ব্যবহারের কারণ নিয়েই ;---- যেমন বাঁশ গাছগুলি ঝুঁকে পড়েছে আমাদের টালির চালের উপরে । মা তাকে কঞ্চি-টঞ্চি গুলি একটু পরিষ্কার করে ছেঁটে কেটে দিতে বলাতেই তার যত আপত্তি । এ ছাড়া কলা - কচু- সুপারি- নারকোল‌ , কী নেই ডোবাটির চার পাশ ঘিরে । তার ভেতরেই আবার মোষ গুলির জলকাদা ঘেঁটে পাঁক করা । সে এক পরিস্থিতি তৈরি হয় যখন মোষগুলি ডোবাটিতে নামে এদিক ওদিক দিয়ে —- মশার উপদ্রব তৈরি হয় নাকি তাতেই । আর এই সব একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে বলাতেই তার যত আপত্তির কারণ । তাতে নাকি তার স্বাধীন সত্তায় বেঘাত ঘটানো হয়  । আর এই কারণেই তার ক্রোধের মাত্রা সমস্ত সামাজিক সীমা ছাড়িয়ে যায় । যথেচ্ছ খিস্তি-খেউর গালিগালাজ নানা রকমের আস্ফালন দেখান তিনি । যে ভাষায় তখন তিনি চিৎকার করেন , সে ভাষা  একজন সামাজিক মানুষের মুখ দিয়ে বের হওয়ার কথা— কেউই আশা করতে পারে না । 

       আবার আশ্চর্যের বিষয় হলো এই মানুষটির কাছেই যদি কখনো এটা ওটা ছোটো খাটো অসুস্থতার কারণে তার সামনে যেয়ে দাঁড়ানো গেছে , তখন দেখেছি সেই মানুষটিই যেন আলাদা আবার । যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে রোগের কারণ অনুসন্ধানে  খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন । আর সেটা  শুধুমাত্র পাড়াপ্রতিবেশীর মতোনই নয় —- অনেকটা আন্তরিক ভাবে সমীহর সঙ্গেই বেশ আচার আচরণ করছেন দেখি ! তখন তার ব্যবহারের মাধ্যমে কোথাও এমন কোনো রকমের অসঙ্গতি বা অসম্মান করার চিহ্ন মাত্রও লক্ষ্য করতে পারিনি কোনোদিন । সে ক্ষেত্রে দু'একবার যেয়ে তার কাছে যখনই দাঁড়িয়েছি , দেখেছি বেশ আগবাড়িয়েই জিজ্ঞাসা করেছেন বেশ আন্তরিক ভাবেই — " কও দেহি কী হইছে তোমার ……. ? "

         সেই ডাকের মধ্যে এতটাই আন্তরিক টান , এতটাই মার্জিত স্বভাবের পরিচয় পেয়েছি যে তখন আর পূর্বের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলাতে পারিনি তাকে ।

         অনেকগুলি সন্তান সন্ততি তার । এ ছাড়াও আত্মীয় স্বজনের ছেলেপেলেরাও বেশ কয়েকজন আশ্রিত তার কাছে । তাদের সঙ্গে তার কেমন  সম্পর্ক‌ তা জানা ছিল না । তবে তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে তো জানতাম আশ্রিত বলেই । তার নিজের সন্তান সন্ততিদের তো এ পাড়ার অনেকটা পরিসর জুড়েই ঘোরাঘুরি করতে দেখি । তার মধ্যে বিশেষ করে যেমন জানি বাদল কে । যার কৌতুকপ্রিয় স্বভাবের পরিচয় দিতে গেলে বিষয়টা এরকম , যাকে পারতপক্ষে এড়িয়েই চলি । তার এমন কিছু ক্ষমতা ছিল , সে , এ পাড়ায় এক একটি বাড়ির নতুন নতুন নামকরণ , এক এক রকমভাবে , খুব সহজেই করে দিত । পাড়ায় কোন বাড়ির মহিলা একটু মুখড়া , দেও তার একটা নামকরণ করে । হয়তো কারো শারীরিক গঠন একটু মোটাসোটা গোছের , আচ্ছা , এর নামকরণ করে দেও ' ধোলি বুড়ি ' বলে । আবার ফোচন সুভাষের বাবার নাম কেন যে সে কি মনে করে 'আব্দুল মাঝী ' করে দিল তা হয়তো সে নিজেই জানে না ।

       এরকম কত যে নামের সংগ্রহ নিয়ে সে ঘুরে বেড়ায় , তা সেই ভালো জানে হয়তো, বা আগে ভাগে কিছুই ভালো করে ঠিক না করেই করে দেয় একটা হঠাৎ করেই হয়তো ! সদা সর্বদা তার মাথায় শুধু কি এইসব-ই ঘুরে বেড়ায়‌ ? 

         ঠিক এরকম ভাবেই সে আমাদের এই বাড়িটারও নাম করণ করেছে কখনো ' গোরুওয়ালা বাড়ি ' বলে তো কখনো করে দিয়েছে ' জয় বাংলা বাড়ি । '

          এই সব নিয়েই পাড়ার মোড়ে তাদের আড্ডা । কাকে কোন নামে মানাবে এই সব পর্যালোচনা চলে । দেও ওকে এই নামে ডেকে , দেও ,আর তারপরে এই সব নিয়েই কাটিয়ে দেও আজকের আড্ডাটা হাতে তালি দিয়ে…. । 

        আমার অবশ্য একটি কথা প্রায়ই মনে হতো , আচ্ছা , ওদের বাড়িটার নামকরণ যদি করে দেওয়া যায় , ' মোষেদের বাড়ি ' বলে , তাহলে বিষয়টা কেমন হয় ?

      যদিও সে ঘোষণার কথা পাড়ার মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে কে আর কাকে বলতে পারবে ।

         এ পাড়ার ডান পাশ ও বাঁ পাশ মিলে তখনো পর্যন্ত ঘন বসতি স্থাপন হয়ে ওঠেনি । সামনের বাড়ির টুকুন দির মা মাসিমার বাড়ির দক্ষিণে খেলার মাঠ । খালি জমি । দুখানা প্লট পার করে তবেই মুক্তধারা স্কুলের দালান বাড়িটি । স্কুলের পূর্ব দিকে তার গা ঘেঁষে একখানি খালি ভিত তৈরি করে রাখা আছে । এর পরই খালি জমিটি —- তার যে ফাঁকা অংশ দিয়ে মলি শিবানীদের বাড়ির পর পর দালান ঘরগুলির জানলা খোলা দেখা যায় , যে জানলা গুলিই আমার মায়ের চিৎকার করে ডাক পৌঁছে দেয় —- ও শিবানী , ও মলি একবার শোন রে মা , আজ আর ঠাকুরদের কে জল মিষ্টি দিতে পারলাম নারে মা  , তোরা একটু ঠাকুর পুজোটা করে দিয়ে যাস রে মা ….। 

         জানলা দিয়ে শিবানী না হলে মলি মুখ বাড়িয়ে সাড়া দিত এই বলে —-- ঠিক আছে মাসিমা ….. আপনি আসেন গিয়ে ……,  এই যাইতাছি , একটু খানিক বাদেই —-- ।

         বাড়ির বাঁ পাশে জগদীশ বাবুর খালি জমি । তার ও পাশের বাড়িটি-ই ফোচনদের বাড়ি । লম্বা বারান্দা টা দেখা যায় — একেবারে খোলামেলা । এমনিতে ব্যাবহারে , আচার আচরণে , এরাও তেমনই খোলামেলা  —- যেমন ফোচনের দাদু ঠাকুমা,  তেমনই ওদের বাবা কাকাও , সকলের সঙ্গেই একটা খোলামেলা আন্তরিক সম্পর্ক যেন । সব সময় গলা ছেড়ে-ই কথা বলে এরা । অর্থাৎ তথাকথিত শহুরে মিনমিনে বিনয়মিশ্রিত কথা বলার ধরণ ধারণের কোনো সংস্রব তখনো পর্যন্ত এদের কারোরই ব্যাবহারিক জীবনে প্রবেশ পথ পায় নি । 

        সুভাষ ফোচনেরা তিন ভাই দুই বোন । ওদের কাকার দুটি কন্যা সন্তান । তারা নিতান্তই শিশু । 

         ওদের দাদু , এ পাড়ার সকলের দাদু । সকলের সঙ্গেই বেশ একটা আত্মীয় সুলভ আন্তরিক সম্পর্ক তাঁর । 

          আমাদের বাড়িতেও এদের সকলেরই অবাধ যাওয়া আসা । বিশেষ করে ফোচন কাবেরী সরবরী আর ওদের ঠাকুমা । ঠাকুমা তো সবসময়েরই আসা- যাওয়ার মানুষ । ইদানিং তো আমার একটু সময় খোঁজখবর না পেলেই বারবার এসে খোঁজ নেয় , বলে , " কই , হ্যাঁ রে ভাই , সে আইলো নাকি ? দ্যাহ দি দেহিনি , মা ডায় গ্যাছে দ্যাশে , আর এডায় কি করতাছে তাই কও দি দিনি ভাই একবার ; ওর এহনেই যত ঘোরোনের ঠেলা দেছে —- এই খানিক বেলা যায় , এহনো পোলার ঘরের নাম নেওনের কথা নাই ! ও ভাই , আপনি খাইয়া লন তো দেহি ; ও আসুক আজ , তারপর দ্যাখবো আনে ,  কি ভাবছে ডা কি ও — ? "

   

      এই সব কথা আমার বেশ কিছুদিন এলোমেলো ঘোরাঘুরি পর্বের । সেই সময়ে ঠাকুমার উৎকন্ঠাজনিত খেদ উক্তি বা অধিকার জনিত কর্তব্যবোধের কথোপকথন সে সব । 

   

         সুভাষ সম্প্রতি আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছে । প্রায়ই ওদের বাড়ির উঠোনের সিঁড়ির উপর বসে আমাদের বাড়ির টালির চালের উপর নুয়ে পড়া বাঁশ গাছের ঝুঁকে থাকা কঞ্চির ডালপাতার বর্ণ দেয় পেন্সিল দিয়ে ঘসঘস করে সাদা কাগজের উপর । এই সব দেখে ভারি অন্যরকমের একটা অনুভূতি জাগে আমার ভেতরেও ; বলি , " বা ! সুন্দর হইছে তো রে ! " 

            সুভাষদের বাড়ির পেছনের পথটার ওপাশে ফাঁকা জমি , যেটা পুকুরের ভাঙনে বেশ খানিকটা ভেঙে থাকে প্রায়শঃই । তার পরের প্লটটি-ই হচ্ছে বাদলের নামকরণে ধোলিবুড়ির । আর আমাদের সম্পর্কে ভূবন দার মা মাসিমাদের । এ ছাড়াও এই বাড়িটির সঙ্গে আমার জীবনের এমনই একটি দিনের স্মৃতি জড়িয়ে আছে ,  যাকে কোনো ভাবেই ভুলবার না । সেই যখন এদেশ থেকে ওদেশে চলে যাই দিদিমার হাত ধরে , সেই দিনটি ছিল আমার জন্মবার । তাই সে ক্ষেত্রে ওই দিন আমার বাড়ি থেকে কোথাও যাত্রা করাটা সংস্কার বিরুদ্ধ । ওই দিন বাড়ির ছেলে কোথাও বাড়ি থেকে রওনা হওয়াটা কোনো ভাবেই সম্ভব না । তাই সিদ্ধান্ত বের করে ফেলা হলো মাসিমার ভাড়াটিয়া তপুদার ঘরে আগের দিন রাত্রে আমাকে রাত্রি যাপন করে , পর দিন সেখান থেকেই রওনা হতে হবে । তপু দা ঠাকুমার বাপের বাড়ির সম্পর্কে আত্মীয় । তাই সেখানেই রাত্রি যাপন করে পর দিন নিজেদের বাড়ির ছায়াও না দেখে , রওনা হয়ে ছিলাম সেই মির্জাপুর স্ট্রিটের বাড়ি হয়ে দালালের হাত ধরে বসিরহাটে আর একটি রাত কাটিয়ে রাত ভোর হতে না হতে স্থানীয় গাড়িতে চড়ে বিথাড়ি নামক একটি জায়গায় নেমে সোনাই নদীতে সারাদিন টাবুরে নৌকোয় মেঘ-রোদের নানা খেলা দেখতে দেখতে তারপর কালবৈশাখীর কবলে পড়ে ছুটতে ছুটতে নৌকো থেকে নেমে যে বাড়িটাতে দালাল আমাদের আর একটি রাত কাটাবার বন্দোবস্ত করে ছিল , সে গল্পের কথা কি সবটা বলেও বুঝোতে পারবো ? সে স্মৃতি তো সারা জীবন ধরেই বয়ে বেড়াতে হবে জানি ।

       একাত্তরে যখন আমাদের এই বাড়িটা শরনার্থী পরিবৃত একেবারে , তখনও অধিক মানুষ-জনের থাকার ব্যাবস্থা এই মাসিমার বাড়িতেই । এবং ওই সময় থেকেই মাসিমার সঙ্গে দিদিমার একটা নিকট সম্পর্ক তৈরি হয় । পরে সেটা এমন পর্যায়ে পৌঁছোয় যে মাসিমা দিদিমাকে নিজের মায়ের সম্মান দিতে আরম্ভ করে দেন । সে সম্পর্ক যত দিন তাঁরা জীবিত ছিলেন ততদিন 

পর্যন্ত একই রকম ভাবে অটুট ছিল ।

         মাসিমার বাড়ির সামনের ডান পাশে বা  বাঁ পাশে দুদিক দিয়েই রাস্তা এদিক ওদিকের । মাসিমার বাড়ির উল্টো দিকেই শংকর দের বাড়ি । শংকর দের বাড়ি সুভাষদের বাড়ির পেছন দিক দিয়ে রাস্তা ধরে যেতে হয় । তাছাড়া আর একটা পথ হচ্ছে মাঠ আড়াআড়ি । শুকনোর সময় হলে সেই পথটাই সকলে ব্যাবহার করে সোজাসুজি। যে পথটি বা তার মাঠের উপর সকাল বিকেল আমাদের বাড়ির গোরুগুলি ঘাস পাতা খায় বা একটু খোলামেলা ঘোরাঘুরি করে ঘাস-মাটির উপরে । 

        আমাদের বাড়ির সেই উত্তর পশ্চিমের পথটাই আমাদের ঘরের উত্তরের জানলা খুললে শংকর দের বাড়ির বারান্দার কোনাটা দেখা যায় স্পষ্ট । কখনো কখনো খুব উচ্চস্বরে ঐ উত্তরের জানলা দিয়েই মার সঙ্গে কথা হয় শংকরের মায়ের….. । 


               তাই গঙ্গাপুরী , কুঁদঘাট বা ওয়ারলেসের জীবনযাপনের নাগরিক সম্পর্কের আলগা ভাবটা এই পাড়াতে অনেকটাই আলাদা । অনেক জায়গাতেই মেলানো যায় না দুটোকে এক সঙ্গে করে ; যে সব দুরত্বের রেশটা ওদিকে কথায় কথায় অনুভব করা যায় ,  এখানে এখনো তেমনটা নয় যেন । তাও গঙ্গাপুরীর পাড়ায় চারপাশের মানুষজনদের মধ্যেও আগে যে সব সম্পর্কের আদানপ্রদান দেখেছি ; যখন শৈশবে দিনগুলির আনা-নেওয়া সেরকম ছিল , তা যেন আমার ওদেশের থেকে ফিরে আসার 

পর আর সেরকম ভাবে খুঁজে পেলাম না ! ঠাকুমার সঙ্গে হয়তো প্রতিবেশী দু-একজনের সম্পর্ক এখনো আগের মতো থাকলেও থাকতে পারে , কিন্তু আমাদের সঙ্গে সেটাও আর ওপাড়ায় গেলে আগের মতো কোথাও কিছু খুঁজে পাই না । কখনো সখনো যদিও বা কারো সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয়েওছে  যদি , হঠাৎ করে , তারা হয়তো পূর্বের সম্পর্কের রেশটুকু ধরে একটুখানি মুখচাওয়াচায়ী করেও যদিও বা , কিন্তু সেখানেও কোথায় যেন বিরাট একটা ব্যাবধান কীভাবে যেন তৈরি হয়ে গেছে , এই কয়েক বছরের মধ্যেই । শুধু মাত্র একজনকেই দেখতাম সেই আগের সম্পর্কের রেশটুকু ধরে আন্তরিকতা দেখাতে এখনো , সে হলো গৌরীর মা ঠাকুমা । যদিও পরবর্তীতে তাঁর সন্তান সন্ততিরা তাঁর অবর্তমানে তা আর রক্ষা করবে কিনা জানিনা ,তবে তার সূচনা যেন ইতিমধ্যেই লক্ষ্য করা যায় ভালো করে দেখতে গেলেই — ।

          তাই , যে প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু হয়েছিল , বাদলের রসিকতা —- সে কথাতেই ফিরে আসি । একদিন সেই বাদলকেই আবার অন্য রকম দেখলাম , সে যখন তাদের বাড়ির ভেতরে থাকত । অথচ পাড়ার মোড়ে সেই বাদলই আবার অন্য আর একজন মানুষ । 

        যাইহোক , ওদের এই দলটার দিকে পারতপক্ষে না তাকিয়েই চলাচল করতাম । মোটমাট এড়িয়ে চলা যাকে বলে ।

         শংকর ওদের সঙ্গে থাকলে ,কিম্বা ওদের স্কুল কলেজের দু একজন বন্ধুবান্ধব রা যখন আসা যাওয়া করছে আমাদের বাড়ির সেই আড্ডায় ; বা আমরা যখন এদিক ওদিক যাই বিকেল বেলার দিকে পথে ঘোরাঘুরি করতে , তখন হয়তো তারাও আমাদের সঙ্গে একসঙ্গেই চলতে থাকে । এসব দেখেও বাদলের দলের ভেতর একটা গুঞ্জন তৈরি হয় —- যার ফিসফিসানো যেতে আসতে পেছন থেকে কানে আসে , শুনতে পাই । 

          কিন্তু অদ্ভূৎ বিষয় হলো শংকরের স্বভাবে , চালচলনের ভেতর এমনই একটা ধরণ ছিল , যার কাছে বাদলের সমস্ত রকমের ঠাট্টা ইয়ার্কি খুনসুটি বা ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য সব কিরকম যেন  ও সঙ্গে থাকলে , নিমেষে চুপসে গুটিয়ে যেত । 

        কেন এমনটা হতো ? 

        সে সব জানতে একটু সময় নিয়েছে । পরে অনুমানে যা ধরা দিয়েছিল , বাস্তবেও সেটাই জেনেছিলাম । কারণ শংকরের বাবার সঙ্গে বাদলের বাবার একটা কেজো সম্পর্ক ছিল । তার পরে দেশের বাড়ির জেলাভিত্তিক একটা টান ও তার সঙ্গে জুড়ে ছিল । 

       জানি না দেশের বাড়ির সেই জেলাভিত্তিক টানাটানির অস্তিত্ব কি এই সব শেকড় ছিঁড়ে চলে আসা মানুষজনের অন্তরে আর কোনো অবশিষ্ট কিছু এখনো পর্যন্ত ধরে বা  জুড়ে রাখতে পেরেছে  কি না ।

       তবে ,  এ প্রসঙ্গে এটাই বলা যায় , যেভাবেই হোক , এই সব এমন কিছুর প্রভাব শংকর এবং বাদলের মধ্যে জুড়ে আছে যে , তাতে করে শংকর আমাদের সঙ্গে থাকলে বাদলের চ্যাংড়ামির লেশ মাত্রও আর দেখা যেত না ।  অন্তত সামনাসামনি বা পেছনে ।


         জীবনের অনেকটা পথটা চলতে চলতে এই সব বিষয় গুলো নিয়ে ভাবতে যেয়ে বুঝতে পেরেছি , এই সব সম্পর্কের শাখাপ্রশাখা গুলি এতটাই পলকা বা ক্ষীণ , দুর্বল , এতটাই তুচ্ছ সে সব বিষয় , যা কিছুর সূত্র ধরে এমন সব সম্পর্ক গুলি শুধু মাত্র হাত কচলাকচলি-ই করে , নিজস্ব কিছু স্বার্থ বিনিময়ের কারণেই হয়তো ;  যে সবের সঙ্গে হৃদয়বিত্তির কোনো গভীর সম্মন্ধই নেই । যা মানুষ মানুষের কাছ থেকে আশা করে । 


       এক এক সময় মনে হয় , এই কঠিন নগর সভ্যতার কাছে যদি আবার ফিরে না আসতে হতো তাহলেই হয়তো ভালো হতো বুঝি ।   পর মুহূর্তেই আবার মনে হতো , তাহলে হয়তো কত কথাই অজানা থেকে যেত ! যে সব আরো খানিকটা পথ চলতে চলতে কত বাদল , বিমল , অমল , তাপসদের সঙ্গে যে দেখা হয়েছে , কথা হয়েছে !  অথচ পর মুহূর্তেই মনে হয়েছে , কই , কখনো কি কথা হয়েছিল ! কই , মনে পড়ছে না তো ! 

            কদিন হলো ওদের পেয়ে বসেছে গোরুর দুধ দুহিয়ে দিয়ে যাবার পর সেই গ্যাজা ওঠা গরম দুধ চুমুক দিয়ে কাঁচা খেয়ে নেওয়া । এতে নাকি বিশেষ উপকার । এসব সব শংকরের আবিষ্কার । এবং তাতেই প্রভাবিত হয়েছে কাল্টুও ।        

             তাই সকাল বেলা হলেই ওরা চলে আসে সেই গ্যাজা ওঠা কাঁচা গরম দুধ গেলাসে পান করতে । ইতিমধ্যে আমিও তাতে প্রভাবিত ; তাই কাঁচা দুধ খাওয়ার হিরিকে মন দিয়ে চোঁ চোঁ করে খেয়ে নিচ্ছি আমিও ওদের সঙ্গে খানিকটা গরম দুধ । 

               এর আগে আর এক পর্ব শুরু হয়েছে ইদানিং , খুব ভোর ভোর উঠে হাঁটতে হাঁটতে তিন জনে চলে যাই একেবারে সোজা কংগ্রেস নগরের রাস্তা ধরে খাড়া মাঠের দিকে —- একেবারে রাণিয়ার তারের কাছে সূর্যরশ্মী দু'চোখে মাখতে । 

      পুব দিক থেকে মাঠের উপরে থালার মতন যে সূর্যকে দেখা যায় । আমরা তার দিকে বিশেষ এক ধরণ নিয়ে দাঁড়িয়ে যাই পর পর । তার পর সে সব নেওয়া হলে বাড়ি ফিরে সুজিৎ ভাইএর গোরু দোহাই পর্ব হয়ে গেলে ,সেই কাঁচা দুধের গেলাস ,  তিনজনই এক এক করে মুখে তুলে নিই। 

        ফিরে আসার পথে বিশেষ একটা কথাবার্তা বলতে চাইতাম না বলে কাল্টু অভিযোগ জানাত আমার এই নীরব থাকা দেখে । বলত, " তুই এরকম চুপ করে থাকিস কেন রে ?" 

         বলতাম ," কই,কিছু না তো ! দেখ , সকাল বেলাডায় যত কোম কথা কতি পারবি , ততোই ভালো তো ! বেশি কথা না কওয়াই তো ভালো এহনে ; পরে অভ্যেস হয়ে গেলি দেহিসেনে সব ঠিক হয়ে যাবেনে; —

            অথচ তাতো না ! মনে মনে কত কথাই তো বলতাম নিজের সঙ্গে নিজে । আর সকাল ? এর চাইতেও কত দিনের কত সকাল ভোরবেলা গুলি একদিন কত কথারই না ছিল ; সে সব আর এদের কি বলে বোঝাবো ! 

               বলতাম না । বলতাম না আমার পেছনের সময়ের কোনো কথাই । বলতে মন যেন চাইতো না 

। তাই এমন একটা ভাব করতাম , আমি যা কিছু করছি তা এখনেরই —- তার পূর্ব অভিজ্ঞতা কিছুই যেন নেই !  যা কিছু দেখছি , তা যেন আগে কখনো দেখি নি । ভাবি নি । মাঝখানের বা পেছনের ছেদ টা নিয়ে কোনো কথাই যেন নেই কোথাও । এ ছাড়া ওই দেশটি সম্মন্ধে , তার প্রকৃতি সম্মন্ধে , আচার আচরণ সম্মন্ধে কত কথাই তো বলা যায় এই পথে চলতে চলতে ; বিনিময় করাও যায় তো ? কিন্তু না , একটি কথাও নয় এদের সাথে । তার কারণ ?

কারণ ও তো শংকর ,  শংকরই তো প্রকাশ্যে বলে ," বোঙলাদেশ । ওখানে আবার কোনো সভ্য মানুষ জন থাকে নাকি ?"

        ওর এই কথায় মনে মনে কেন জানি না খুব আহত হতাম । মনে হতো ওকে কিছু বলি , কিন্তু সে সুযোগ পেতাম না । এ ক্ষেত্রে ও এতটাই একগুঁয়ে , এবং এত সব অবজ্ঞাসূচক কথাবার্তা বলতো যে না জেনে না বুঝে , তাকে ঠিক এই ভাবে বলে বা তর্কাতর্কি করে ঠিক করা যাবে না ।  তার চাইতে ওর ধারণার কথা ও যা বলছে বলুক গিয়ে , তা আর কেই বা শুনছে ; কেই বা জানতে যাচ্ছে ; তাই থেমে থাকতাম খারাপ লাগলেও । শুধু ভাবতাম , এই ভাবে একটা গোটা  দেশের সম্মন্ধে , তার মানুষ জন সম্মন্ধে ,এমন ধারণা পোষণ করা কি ঠিক ! কেন যে ওর মনের ভেতর এমন একটা দৃষ্টান্তমূলক বিদ্বেষ তৈরি হলো ! আচ্ছা , তার কারণ কি ওর শৈশবে শোনা ওর পরিবারের দিক দিয়ে এমন কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা লব্ধ কোনো ঘটনার বর্ণনা ,  এরকম একটা একগুঁয়ে বদ্ধমূল ধারণার জন্ম দিয়েছে কি ?


        প্রায়শই শুনে শুনে , একদিন আর যেন না পেরে  বলে বসলাম   কয়েকটি কথা , বললাম , " এতটা অবহেলার চোখে একটি দেশ কে দেখা মনে হয় ঠিক না । কারণ কোনো একটা বিশেষ খারাপ অভিজ্ঞতার ফল একটি দেশের সকল মানুষ জনের উপর চাপানোটা কি ঠিক ! ধর , সেই দেশের প্রকৃতিকেও  এমন ভাবে সবটা খাটো করে দেখলি , সেই দেশের মানুষ জন বা সমাজের কাছে তো তোদের এই সকল ধারণার কোনো অংশ পৌঁছবে না !  আর সেই দেশটায় রাতারাতি কোনো বিপ্লবও তৈরি হয়ে যাবে না তোদের এই সব ধারণায় ,  সে যেমন ছিল তার মতো তেমনই থাকবে । সে তার  ভালো মন্দ সব মিলেই তো সে ! তাকে তার আপন গতিতেই এই ভালো এবং মন্দের জন্মের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে —- এবং এগোচ্ছেও হয়তো সে তা ,  কিন্তু আমাদের সেটা ভালো করে কাছে থেকে বুঝতে হবে । দূর থেকে শুধু মাত্র প্রচার মাধ্যমের উপরে নির্ভর করে বা তার অতীতের কয়েকটি ভুলের উপরে দাঁড়িয়ে একটা গোটা দেশের মানুষ জনকে দূরে সরিয়ে রাখলে কি সব টা ঠিক ভাবা হলো বলে মনে হবে তোর ? তার ভালো ভালো কত সম্ভাবনার দিক আছে ! মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের দোষ ত্রুটি ভুল দিয়ে তার সকল ঐতিহ্য কে অস্বীকার করা মনে হয় খুব একটা শিক্ষিত দৃষ্টিকোণ দিয়ে তাকে বিচার করা হলো না বলেই মনে করি আমি । 

      একেবারে টানা এবং এখানের‌ ও ওখানের মিশ্রিত ভাষার টানেই এই কথা গুলি একদিন বলে ফেলেছিলাম ওদের অনেকের সামনেই ।

        আমার এই ভাবে বলা কথাগুলি শুনে শংকরকে  খুব একটা উত্তেজিত হতে দেখলাম না সেদিন । তাও বলতে কিছু ছাড়ল না , একটু নিচু স্বরেই বলতে লাগলো , " শোন , যা জানি তাতে অভিজ্ঞতা টা খুব খারাপ । মোটেই ভালো না । যত দিন যাচ্ছে ,তাতে খারাপের দিকেই যাচ্ছে ওই দেশটা । ওরা এখনো জঙলিই থেকে গেল , তা না হলে বল না , যে মানুষটি যে দেশের জন্যে , তার স্বাধীনতার জন্যে , সমস্ত টা জীবন দিল , তাকেই ওরকম ভাবে সকল আত্মীয় পরিজন সহ নিধন হতে হলো ! যে ভারতবর্ষ ওদেশের জন্যে এত গুলি মানুষকে বুক পেতে আশ্রয় দিল , আগে এবং পরে , তারাই এখন খারাপ হয়ে গেল ? এটাকে কি কৃতজ্ঞতার নিদর্শণ বলে গণ্য করা চলে ?  তাই আমার ধারণা , ওদের সিভিলাইজ্ড হতে এখনো অনেক পথ হাঁটতে হবে । তাও এখন যেমন দেখছি তাতে মনে হচ্ছে আদেও পারবে বলে মনে হয় না । জানি না , আমার ওই দেশের প্রতি তাই কোনো টান নেই । শ্রদ্ধা ভক্তিও নেই । এপিঠ আর ওপিঠ , সব একই রকম । "

       সময়টা সেই সময় খুব একটা ভালো সময় ছিল না । ওখানে তখনো সামরিক শাসন চলছে টানা ।

         নিজের অজান্তে কখন যেন সেই বিতর্কে ঢুকে পড়েছি যে , সেটা বুঝতে পারছি । তাই খানিকটা সংযত হলেও , ওর বলা কথাগুলি একভাবে না একভাবে শুনতে তো বাধ্য হলাম ! সেটাও কি ঠিক হলো‌ ? মতামতও তো তুলে ধরলাম ! তাহলে আর নীরব রইলামটা কোনখানে ?


******************************************************************************************

আগামী পর্বে

********************************************************************************************

অণুগল্প * শর্বরী চৌধুরী



অণুগল্প সাহিত্যের একটি বিস্ময়কর শাখা। ' বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন ?' ঠিক তাও নয় যেন, বিন্দুতে সপ্তসিন্ধু দশ দিগন্ত চকিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সার্থক অণুগল্পে। তেমনই একটি অসাধারণ অণুগল্প এবার আমরা পড়ছি ----


অভাব

শর্বরী চৌধুরী 

রুনা আর নীলেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে তিক্ততা চলছিল। সন্তানহীনতা নিয়ে চাপা অশান্তি তো ছিলই। তার সঙ্গে নীলেশের নারীসঙ্গ, অতিব্যস্ত কর্মজীবন সব মিলিয়ে চরম একাকীত্বে ভুগছিল রুনা। অবশেষে রুনা সিদ্ধান্ত নিল বিচ্ছেদের। সেদিন সন্ধ্যায় নিজের সিদ্ধান্ত জানাবে বলে রুনা বসল নীলেশের মুখোমুখি। রুনা বলতে শুরু করল- কী দিয়েছ তুমি আমায় ? না দিতে পেরেছ সন্তান, না একটু সময় ! অফিসের কলিগদের ডেকে এনে পার্টি,  মদ খাওয়া, হল্লাবাজি, একটুও শান্তি দাওনি আমায় ! 

নীলেশ অদ্ভুত একটু হাসে। তারপর মৃদুস্বরে বলে-তুমিও একটা জিনিস দাওনি আমায় ! 

_কী?

_ভালোবাসা।  









***************************************************************************************************



শর্বরী চৌধুরী

 সিস্টার নিবেদিতা ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির অধ্যাপিকা। আজকাল, কবি সম্মেলন, অনুষ্টুপ, আদম প্রভৃতি পত্রিকায় কবিতা প্রকাশিত। তিনটি গল্পের বই, একটি প্রবন্ধের বই ও তিনটি কবিতার বই--- মায়াঘর-প্রকাশক ধানসিড়ি, মখমলের ইস্তেহার -প্রকাশক পাঠক, অন্ধের সাইকেল ভ্রমণ -প্রকাশক আদম। 

অণুগল্প * প্রদীপ কুমার দে


অণুগল্প সাহিত্যের একটি বিস্ময়কর শাখা। ' বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন ?' ঠিক তাও নয় যেন, বিন্দুতে সপ্তসিন্ধু দশ দিগন্ত চকিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সার্থক অণুগল্পে। তেমনই একটি অসাধারণ অণুগল্প এবার আমরা পড়ছি ----


একটা খাস্তা কঙ্কাল 

প্রদীপ কুমার দে 

সন্ধ্যাবেলায় লোডশেডিং হয়ে গেল। প্যান্ট জামা গায়ে সেঁটে বেড়িয়ে পড়লাম। হঠাৎই যেন সব কালো অন্ধকারে মুড়ে গেল। বাড়ি থেকে বেড়িয়ে কয়েক পা এগিয়েছি, পিছন থেকে ডাক এলো,

--  কি প্রদীপবাবু রাগ করেছেন ?

ঘুরে দেখি পিছনে কাকের মতো চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে নিলয়দা। উনি আমার প্রতিবেশী এবং লেখালেখি করার সুবাদে ঘনিষ্ঠ। কিন্তু ওনার ব্যবহার এযাবৎ আমাকে ভীষণই পীড়া দিত তাই এড়িয়ে চলতাম। একবছর ধরে এড়িয়ে চলছি ওনাকে আর অবশ্যই উনিও আমাকে। উনি পিছুডাক দিয়েছেন, আমি উত্তর দিয়েই দিলাম,

--  এ বয়সে আর রাগ?

--  তাহলে চলেন না আমার ঘরে, বসে আমি আর আপনি মিলে কবিতা আর গল্প পাঠ করি ?

--  এই লোডশেডিং অন্ধকারে আলো কোথায় পাবেন?

--  আপনার সাথে অনেকদিন পর দেখা হল তাই জানেন না, আমি একটা এমার্জেন্সি লাইট কিনেছি। অসুবিধা হবে না। 

--  কি বলেন ?  এমার্জেন্সি আলো?  তাতে কি হবে?

--  প্রচুর আলো। কোন অসুবিধা হবে না, বলছি তো। নচেৎ অন্ধকারে কোথায় যাবেন?

কথাগুলো বলে দাঁত বার করে হাসলো নিলয়দা।

চললাম ওনার সাথে। ঘুটঘুটে অন্ধকার কাটিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম। উনি ঘরে আমাকে নিয়ে ঢূকেই দরজায় চিটকানি দিয়ে দিলেন। ঘরের মধ্যে ঢুকতেই কিরকম একটা পচা গন্ধ নাকে এল। আমি বললাম,

--  নিলয়দা আগে লাইটটা জ্বালান।

--  হ্যাঁ এই যে …

আমি একপাশে অপেক্ষায়। লাইট কই। একটু অন্ধকার সহ্য করে নিলে যা হয় চোখ যেন কিছু দেখতে পেল। দেখি কই নিলয়দা তো নেই। ওমাঃ কি দেখছি? একটা লিকলিকে কঙ্কাল তার সরু সরু আঙুল দিয়ে একটা বই তুলে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে।

ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম,

--  নিলয়দা? নিলয়দা?

বিকট শব্দ হল। কেমন ' হে -হে ' শব্দে নেকো সুরে হাসলো কেউ।

ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। অন্ধকারে দরজার চিটকিনি খুঁজতে লাগলাম। মুখে রামনাম।


বরাত জোরে বেঁচে গেলাম। হঠাৎই আলো চলে এল। ঘরে আলোর সুইচ অন করাই ছিল। আলো জ্বলতেই দেখি বিছানায় শায়িত একটি লিকলিকে কঙ্কাল।

চিটকিনি খুলে পড়িমড়ি করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামছি। আওয়াজে নীচের ফ্ল্যাটের বৌদি বেড়িয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন,

--  কি ভয় পেয়েছেন তো? ইদানীং আমরা সব্বাই পাচ্ছি।









***********************************************************************************************************



প্রদীপ দে 

লেখক  নেশায়। পেশা ছিল হিসেবনিকেশ।  বয়স -৬২ । কলকাতা নিবাসী। বিবাহিত।
নিজের লেখা কয়েকটি বই আছে।

অণুগল্প * প্রভাত ভট্টাচার্য



অণুগল্প সাহিত্যের একটি বিস্ময়কর শাখা। ' বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন ?' ঠিক তাও নয় যেন, বিন্দুতে সপ্তসিন্ধু দশ দিগন্ত চকিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সার্থক অণুগল্পে। তেমনই একটি অসাধারণ অণুগল্প এবার আমরা পড়ছি ----


অতীত ভবিষ্যৎ 

প্রভাত ভট্টাচার্য 







সৌম্য শ্যামবাজারে চায়ের দোকানে চেয়ারে বসে টোস্ট খাচ্ছে। একটু বাদেই চা চলে এল। আরো কয়েকজন বসে চা টা খাচ্ছে আর কথাবার্তা বলছে। বেশ একটা চমৎকার পরিবেশ, অন্তত তার পক্ষে। গভীর চিন্তাভাবনা করবার আদর্শ জায়গা। 

       মাঝে মধ্যেই সে চলে আসে এখানে। বেশ ভালোই লাগে। 

      চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সে তাকিয়ে ছিল সামনের দিকে। সামনেই রাস্তা। ব্যস্ত পাঁচমাথার মোড়। 

     আচ্ছা, সিন্ধু সভ্যতার যুগে  এখানে কি ছিল? চায়ের দোকান নিশ্চয়ই ছিল না। তখন তো চা খাওয়ার ব্যপার ই ছিল না। ছিল না বাস, গাড়ি, বাইক, ট্রাফিক পুলিশ। হয়তো এখান দিয়ে বয়ে যেত এক নদী। নদীর ওপর দিয়ে জলযানে চলেছে, কল্পনা করল সে। 

      আর কী নেবেন দাদা? 

      একটা অমলেট। 

      শুধু শুধু বসে থাকাটা ভালো দেখায় না। তখন অমলেট বানানো বা খাওয়া হত বলে তো মনে হয় না। 

      এসব গভীর কথা নিয়ে কারোর সঙ্গে আলোচনা করাও মুশকিল। কি ভাববে আবার। 

হাজার বছর কিংবা তারও পরে এখানে কি এই চায়ের দোকান থাকবে, না কি  অন্য কিছু হবে। তখনও কি লোকে চা খাবে? 

    হঠাৎ চোখ গেল ঘড়ির দিকে। চারটের সময় যাওয়ার আছে এক জায়গায়। 

   সিন্ধু সভ্যতার যুগে ঘড়ি ছিল না বোধহয়।



***********************************************************************************************



প্রভাত ভট্টাচার্য  

তিনি সব্যসাচী--- এক হাতে সামলান চিকিৎসকের গুরুভার দায়িত্ব আর এক হাতে ফোটান সাহিত্য সৃষ্টির ফুল। দ্য হার্ট, মিশন পসিবল, মাই ডটার, ডিটেক্টিভ সূর্য এবং কবিতা সংকলন - কাগজের মানুষ এবং ফিনিক্স পাখি তাঁর উজ্জ্বল সাহিত্যসৃষ্টি । সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর একটি গ্রন্থ ---