অণুগল্প সাহিত্যের একটি বিস্ময়কর শাখা। ' বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন ?' ঠিক তাও নয় যেন, বিন্দুতে সপ্তসিন্ধু দশ দিগন্ত চকিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সার্থক অণুগল্পে। তেমনই একটি অসাধারণ অণুগল্প এবার আমরা পড়ছি ---
প্রাণের টান
দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়
মহাকাল মন্দিরে ওঠার সিঁড়ির মুখটায় দোকানগুলো আজ বন্ধ। কিছুক্ষণ আগে মুষলধারে বৃষ্টি হয়ে গেছে। এখনো ম্যালে মেঘের আনাগোনা চারপাশে। বৃষ্টিতে পাহাড়ের যেন অন্য রূপ।চুপ করে কোনের বেঞ্চটায় বসলো সুন্দর। চেয়ে আছে দূরের পাহাড়ের দিকে। একটু একটু করে সন্ধ্যা নেমে আসছে। দার্জিলিং ই এখন ওর স্থায়ী ঠিকানা। এখানকার হাসপাতালের ডাক্তার।কেউ এখানে বেশিদিন থাকতে চায় না। মা মারা যাবার পর সুন্দরের আর কোন পিছুটান নেই। জীবন যেভাবে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে, সেভাবেই ও ভেসে যেতে চায় কচুরিপানার মতো ঠিকানাহীন।
হাসপাতালের কোয়ার্টারেই থাকে ও। বাহাদুর ওর দেখা শোনা করে।ওর স্বঘোষিত অভিভাবক। দার্জিলিং এর মানুষও ওকে খুব ভালোভাবে। ওকে ' ডাক্তার ভগবান' বলে ওরা।কারো কোন বিপদ হলেই জিপ নিয়ে ছুটবে সুন্দর।মহারাজের কথাটা মনে পড়ে, মানুষের সেবাই হলো প্রকৃত ঈশ্বর সেবা।এর জন্য যাগ যজ্ঞ করার প্রয়োজন নেই। সুন্দর নীরবে করে চলে মানুষের সেবা। আসলে মানুষের জন্যই ও ওর বাকি জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছে কবেই।
ম্যালের এই বেঞ্চে বসলেই সঞ্চিতা ফিরে ফিরে আসে ওর কাছে।যেন পাশে বসে মুচকি হেসে তাকিয়ে থাকে চুপ করে। হেসে ফেলে সুন্দর। সঞ্চিতার হাসির পিছনে যে ছলনার আশ্রয় ছিল তা ও কোনদিনও বুঝতে পারেনি। নিজের ওপর রাগ হয় খুব সুন্দরের। ঐভাবে ঠকে যাবার জন্য !
বিয়ের পর হনিমুনে এসে এই বেঞ্চটাতেই বসতো ওরা। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত্রি। সঞ্চিতা উঠতেই চাইতো না তখন। সুন্দরেরও পাহাড় খুব প্রিয়। ভালোবাসায় বুঁদ হয়ে হাতে হাত বসে থাকতো ঘন্টার পর ঘন্টা। সুন্দর দার্জিলিং থেকে ফিরে পুরুলিয়া হাসপাতালে কাজে চলে যায়। অসুস্থ মায়ের দেখাশোনার জন্য কলকাতায় থেকে যায় সঞ্চিতা। প্রতি শনিবার বাড়ি ফিরতো সুন্দর।সব ঠিকঠাকই চলছিল। একদিন মায়ের মুখে সব শুনে অসহায় হয়ে পড়ে ও। প্রতি দুপুরে সঞ্চিতা বাইরে বেরিয়ে যায়।মাকে বলে ,ওর মায়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে।মা মানা করে নি কোনদিন। একদিন মাসতুতো ভাই বাবু নন্দনে সঞ্চিতাকে দেখে একটা ছেলের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে বসে। ওর মাকে বাবু বলে কথাটা।
সুন্দর সব জানার পর প্রশ্ন করে সঞ্চিতাকে।ও কিছুতেই মানতে চায় না। বলে ,বাবু ভুল দেখেছে।পরে সেই কান্নার নাটক। "অবিশ্বাস করো আমাকে", "এভাবে থাকা যায় না" ইত্যাদি ইত্যাদি।এর মাসখানেক পরেই সঞ্চিতা চলে যায় বাড়ি ছেড়ে। মিউচুয়াল ডিভোর্স চায় ও। সুন্দর বুঝতে পারে সব।জোর করে ভালোবাসা হয় না, সুন্দর এটা ভালো করেই জানে।তাই না করেনি ও।ও জানতো , সঞ্চিতা আবার ওর প্রেমিককেই বিয়ে করতে চাইছে। তাহলে ওর সাথে বিয়ের এই ছলনা কেন? উত্তর আজও পায়নি সুন্দর।এখন শুধু স্মৃতিতেই বাস ওর।
আজ দুপুরে জাপানের নোবেলজয়ী লেখক ওশিনরি ওসুমির ' অটোফেজি' নিয়ে লেখা পড়ছিল সুন্দর।২০১৬ সালে নোবেল পান তিনি। আমাদের শরীরের কোষগুলো বাইরে থেকে কোন খাবার না পেয়ে নিজেই যখন নিজের অসুস্থ কোষগুলো খেতে শুরু করে , চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় তাকেই ' অটোফেজি' বলে। সুন্দরের এখন স্মৃতির অটোফেজি চলে নিশিদিন সুখহীন। স্মৃতিরা যেন কুড়ে কুড়ে খেয়ে যায় ওর শরীর।শত চেষ্টাতেও ভুলতে পারেনা ওর বিবাহিত জীবনের নিবিড় মূহুর্তগুলো। গালিবের শায়েরীটা মনে পড়ে যায় ওর...
"দর্দ যব দিলমে হো তো দবা কিজিয়ে
দিল হি দর্দ হো তো ক্যা কিজিয়ে"।
সত্যিই মনটাই এখন একটা যন্ত্রণার আধার হয়ে থাকে । কিছু করারও নেই ওর এখন শুধু নিরুপায় সমর্পন ছাড়া। ভেতরে ভেতরে পুড়তে থাকা যেন ওর একটা বিলাসী অভ্যাস হয়ে গেছে।
হঠাৎ বাহাদুরের চিৎকার কানে এলো," ডাক্তার সাব, ডাক্তার সাব"। ঘাড় ঘোড়াতেই দেখতে পেল কয়েকজন আবছায়া মূর্তি ওর সামনে । হাঁপাতে হাঁপাতে বাহাদুর যা বললো তাতে বোঝা গেল অ্যাক্সিডেন্টে প্রায় মরতে বসা দুজনকে স্থানীয় মানুষ রক গার্ডেন থেকে নিয়ে এসেছে হাসপাতালে। ছুটলো সুন্দর ওদের সাথে। বাহাদুর জোরে জিপ ছুটিয়ে দিল। হাসপাতালে পৌঁছে দেখতে পেল থ্যাতলানো দুটো শরীর। স্বামী স্ত্রী মনে হল।আলোয় মহিলার মুখটা দেখতেই চমকে উঠল সুন্দর। সঞ্চিতা ! মাথা ফেটে ঘিলু বেড়িয়ে এসেছে। মুখের বাঁদিকটা থেঁতলে গেছে। ভয়ঙ্কর রূপ! প্রাণ আছে দেখলো। সঙ্গে পুরুষটিকে পরীক্ষা করে বুঝতে পারলো , ঘন্টা খানেক আগেই মারা গেছে।
বুঝতে পারলো , প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে ইতিমধ্যে। রক্ত চালিয়ে দিল সুন্দর এখনি অস্ত্রোপচার দরকার সঞ্চিতার। হঠাৎ সুন্দর বুঝতে পারলো সঞ্চিতার পেটে আছে একটা বাচ্ছা এবং বাচ্ছাটার মাথাটা কিছুটা বেড়িয়ে এসেছে।বাচ্চাটাকে বাঁচাতে হলে এক্ষণি প্রসব করাতে হবে। প্রসবের চাপ সহ্য করতে পারবে কি সঞ্চিতা? মারা যেতে পারে ও। কাকে বাঁচাবে ও? মা না বাচ্ছা?
বাচ্চাটাকে প্রসব করানোর সময়ই সঞ্চিতা মারা গেল। সুস্থ বাচ্ছার জন্ম দিয়ে গেল ও। আশ্চর্যের বিষয় ,দুজনের এতো বড় অ্যাক্সিডেন্টেও বাচ্চাটার কিছু ক্ষতি হয়নি। বাচ্চাটা সুন্দরকে যেন খুব দুর্বল করে তুলছে।বাচ্চাটাকে দুহাতে নিয়ে ও হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। উপস্থিত সকলে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল ডাক্তার সাহেবের দিকে।
************************************************************************************************


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন