শনিবার, ৮ জুলাই, ২০২৩

উপন্যাস * দীপংকর রায়



['স্বরবর্ণে'র চতুর্থ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে কবি দীপংকর রায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে '। এই উপন্যাস লেখকের ষোল-সতের বছর বয়সের কালপর্ব থেকে শুরু। যদিও লেখকের জন্ম এপার বাংলায়, কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে থেকেছে ওপার বাংলায়। কাজেই যাতায়াত থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ ছেড়ে চলে আসা আর তারই নাছোড় এক টানাটানির মধ্যে যে জীবনের ক্রমাগত আসা আর যাওয়া ,এই উপন্যাস মূলত তারই এক নির্মম নিষ্ঠুর ভাঙা-গড়ার আশ্চর্য কথোপকথন। ধারাবাহিকভাবে যা আমরা পড়ছি, কবি দীপংকর রায়ের মায়াময় কলমে।]


কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে 

পর্ব * ১০  

দীপংকর রায়


যদিও এ পাড়ায় আর কারো বাড়িতে যে গোরু মোষ নেই তেমনটাও তো নয় ; এই তো , এই যেমন , পেছনের যে বাঁশ-জঙ্গল ডোবা-পুকুরের দিকে তাকিয়ে ফিরে যাই বারবার ওদেশের সেই সব প্রকৃতির কাছে ; তার পূর্ব-দক্ষিণ কোণের জঙ্গলাকীর্ণ পরিসরটাতেই তো রয়েছে বেশ কয়েকটি গোরু মোষের থাকবার জায়গা । মালিক শ্রীমন্ত দাশ । এ পাড়ার হোমিওপ্যাথির এক মাত্র চিকিৎসক। আমাদের বাড়ির সঙ্গে অদ্ভূৎ এক সম্পর্ক যার । সেটা মোটেও খুব একটা স্বাভাবিক না । আর তার কারণ একটাই , আমাদের ঘরের পেছনে তার বাঁশ-জঙ্গল ডোবা-পুকুর ঘেরা জায়গাটির যথেচ্ছভাবে ব্যবহারের কারণ নিয়েই ;---- যেমন বাঁশ গাছগুলি ঝুঁকে পড়েছে আমাদের টালির চালের উপরে । মা তাকে কঞ্চি-টঞ্চি গুলি একটু পরিষ্কার করে ছেঁটে কেটে দিতে বলাতেই তার যত আপত্তি । এ ছাড়া কলা - কচু- সুপারি- নারকোল‌ , কী নেই ডোবাটির চার পাশ ঘিরে । তার ভেতরেই আবার মোষ গুলির জলকাদা ঘেঁটে পাঁক করা । সে এক পরিস্থিতি তৈরি হয় যখন মোষগুলি ডোবাটিতে নামে এদিক ওদিক দিয়ে —- মশার উপদ্রব তৈরি হয় নাকি তাতেই । আর এই সব একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে বলাতেই তার যত আপত্তির কারণ । তাতে নাকি তার স্বাধীন সত্তায় বেঘাত ঘটানো হয়  । আর এই কারণেই তার ক্রোধের মাত্রা সমস্ত সামাজিক সীমা ছাড়িয়ে যায় । যথেচ্ছ খিস্তি-খেউর গালিগালাজ নানা রকমের আস্ফালন দেখান তিনি । যে ভাষায় তখন তিনি চিৎকার করেন , সে ভাষা  একজন সামাজিক মানুষের মুখ দিয়ে বের হওয়ার কথা— কেউই আশা করতে পারে না । 

       আবার আশ্চর্যের বিষয় হলো এই মানুষটির কাছেই যদি কখনো এটা ওটা ছোটো খাটো অসুস্থতার কারণে তার সামনে যেয়ে দাঁড়ানো গেছে , তখন দেখেছি সেই মানুষটিই যেন আলাদা আবার । যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে রোগের কারণ অনুসন্ধানে  খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন । আর সেটা  শুধুমাত্র পাড়াপ্রতিবেশীর মতোনই নয় —- অনেকটা আন্তরিক ভাবে সমীহর সঙ্গেই বেশ আচার আচরণ করছেন দেখি ! তখন তার ব্যবহারের মাধ্যমে কোথাও এমন কোনো রকমের অসঙ্গতি বা অসম্মান করার চিহ্ন মাত্রও লক্ষ্য করতে পারিনি কোনোদিন । সে ক্ষেত্রে দু'একবার যেয়ে তার কাছে যখনই দাঁড়িয়েছি , দেখেছি বেশ আগবাড়িয়েই জিজ্ঞাসা করেছেন বেশ আন্তরিক ভাবেই — " কও দেহি কী হইছে তোমার ……. ? "

         সেই ডাকের মধ্যে এতটাই আন্তরিক টান , এতটাই মার্জিত স্বভাবের পরিচয় পেয়েছি যে তখন আর পূর্বের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলাতে পারিনি তাকে ।

         অনেকগুলি সন্তান সন্ততি তার । এ ছাড়াও আত্মীয় স্বজনের ছেলেপেলেরাও বেশ কয়েকজন আশ্রিত তার কাছে । তাদের সঙ্গে তার কেমন  সম্পর্ক‌ তা জানা ছিল না । তবে তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে তো জানতাম আশ্রিত বলেই । তার নিজের সন্তান সন্ততিদের তো এ পাড়ার অনেকটা পরিসর জুড়েই ঘোরাঘুরি করতে দেখি । তার মধ্যে বিশেষ করে যেমন জানি বাদল কে । যার কৌতুকপ্রিয় স্বভাবের পরিচয় দিতে গেলে বিষয়টা এরকম , যাকে পারতপক্ষে এড়িয়েই চলি । তার এমন কিছু ক্ষমতা ছিল , সে , এ পাড়ায় এক একটি বাড়ির নতুন নতুন নামকরণ , এক এক রকমভাবে , খুব সহজেই করে দিত । পাড়ায় কোন বাড়ির মহিলা একটু মুখড়া , দেও তার একটা নামকরণ করে । হয়তো কারো শারীরিক গঠন একটু মোটাসোটা গোছের , আচ্ছা , এর নামকরণ করে দেও ' ধোলি বুড়ি ' বলে । আবার ফোচন সুভাষের বাবার নাম কেন যে সে কি মনে করে 'আব্দুল মাঝী ' করে দিল তা হয়তো সে নিজেই জানে না ।

       এরকম কত যে নামের সংগ্রহ নিয়ে সে ঘুরে বেড়ায় , তা সেই ভালো জানে হয়তো, বা আগে ভাগে কিছুই ভালো করে ঠিক না করেই করে দেয় একটা হঠাৎ করেই হয়তো ! সদা সর্বদা তার মাথায় শুধু কি এইসব-ই ঘুরে বেড়ায়‌ ? 

         ঠিক এরকম ভাবেই সে আমাদের এই বাড়িটারও নাম করণ করেছে কখনো ' গোরুওয়ালা বাড়ি ' বলে তো কখনো করে দিয়েছে ' জয় বাংলা বাড়ি । '

          এই সব নিয়েই পাড়ার মোড়ে তাদের আড্ডা । কাকে কোন নামে মানাবে এই সব পর্যালোচনা চলে । দেও ওকে এই নামে ডেকে , দেও ,আর তারপরে এই সব নিয়েই কাটিয়ে দেও আজকের আড্ডাটা হাতে তালি দিয়ে…. । 

        আমার অবশ্য একটি কথা প্রায়ই মনে হতো , আচ্ছা , ওদের বাড়িটার নামকরণ যদি করে দেওয়া যায় , ' মোষেদের বাড়ি ' বলে , তাহলে বিষয়টা কেমন হয় ?

      যদিও সে ঘোষণার কথা পাড়ার মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে কে আর কাকে বলতে পারবে ।

         এ পাড়ার ডান পাশ ও বাঁ পাশ মিলে তখনো পর্যন্ত ঘন বসতি স্থাপন হয়ে ওঠেনি । সামনের বাড়ির টুকুন দির মা মাসিমার বাড়ির দক্ষিণে খেলার মাঠ । খালি জমি । দুখানা প্লট পার করে তবেই মুক্তধারা স্কুলের দালান বাড়িটি । স্কুলের পূর্ব দিকে তার গা ঘেঁষে একখানি খালি ভিত তৈরি করে রাখা আছে । এর পরই খালি জমিটি —- তার যে ফাঁকা অংশ দিয়ে মলি শিবানীদের বাড়ির পর পর দালান ঘরগুলির জানলা খোলা দেখা যায় , যে জানলা গুলিই আমার মায়ের চিৎকার করে ডাক পৌঁছে দেয় —- ও শিবানী , ও মলি একবার শোন রে মা , আজ আর ঠাকুরদের কে জল মিষ্টি দিতে পারলাম নারে মা  , তোরা একটু ঠাকুর পুজোটা করে দিয়ে যাস রে মা ….। 

         জানলা দিয়ে শিবানী না হলে মলি মুখ বাড়িয়ে সাড়া দিত এই বলে —-- ঠিক আছে মাসিমা ….. আপনি আসেন গিয়ে ……,  এই যাইতাছি , একটু খানিক বাদেই —-- ।

         বাড়ির বাঁ পাশে জগদীশ বাবুর খালি জমি । তার ও পাশের বাড়িটি-ই ফোচনদের বাড়ি । লম্বা বারান্দা টা দেখা যায় — একেবারে খোলামেলা । এমনিতে ব্যাবহারে , আচার আচরণে , এরাও তেমনই খোলামেলা  —- যেমন ফোচনের দাদু ঠাকুমা,  তেমনই ওদের বাবা কাকাও , সকলের সঙ্গেই একটা খোলামেলা আন্তরিক সম্পর্ক যেন । সব সময় গলা ছেড়ে-ই কথা বলে এরা । অর্থাৎ তথাকথিত শহুরে মিনমিনে বিনয়মিশ্রিত কথা বলার ধরণ ধারণের কোনো সংস্রব তখনো পর্যন্ত এদের কারোরই ব্যাবহারিক জীবনে প্রবেশ পথ পায় নি । 

        সুভাষ ফোচনেরা তিন ভাই দুই বোন । ওদের কাকার দুটি কন্যা সন্তান । তারা নিতান্তই শিশু । 

         ওদের দাদু , এ পাড়ার সকলের দাদু । সকলের সঙ্গেই বেশ একটা আত্মীয় সুলভ আন্তরিক সম্পর্ক তাঁর । 

          আমাদের বাড়িতেও এদের সকলেরই অবাধ যাওয়া আসা । বিশেষ করে ফোচন কাবেরী সরবরী আর ওদের ঠাকুমা । ঠাকুমা তো সবসময়েরই আসা- যাওয়ার মানুষ । ইদানিং তো আমার একটু সময় খোঁজখবর না পেলেই বারবার এসে খোঁজ নেয় , বলে , " কই , হ্যাঁ রে ভাই , সে আইলো নাকি ? দ্যাহ দি দেহিনি , মা ডায় গ্যাছে দ্যাশে , আর এডায় কি করতাছে তাই কও দি দিনি ভাই একবার ; ওর এহনেই যত ঘোরোনের ঠেলা দেছে —- এই খানিক বেলা যায় , এহনো পোলার ঘরের নাম নেওনের কথা নাই ! ও ভাই , আপনি খাইয়া লন তো দেহি ; ও আসুক আজ , তারপর দ্যাখবো আনে ,  কি ভাবছে ডা কি ও — ? "

   

      এই সব কথা আমার বেশ কিছুদিন এলোমেলো ঘোরাঘুরি পর্বের । সেই সময়ে ঠাকুমার উৎকন্ঠাজনিত খেদ উক্তি বা অধিকার জনিত কর্তব্যবোধের কথোপকথন সে সব । 

   

         সুভাষ সম্প্রতি আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছে । প্রায়ই ওদের বাড়ির উঠোনের সিঁড়ির উপর বসে আমাদের বাড়ির টালির চালের উপর নুয়ে পড়া বাঁশ গাছের ঝুঁকে থাকা কঞ্চির ডালপাতার বর্ণ দেয় পেন্সিল দিয়ে ঘসঘস করে সাদা কাগজের উপর । এই সব দেখে ভারি অন্যরকমের একটা অনুভূতি জাগে আমার ভেতরেও ; বলি , " বা ! সুন্দর হইছে তো রে ! " 

            সুভাষদের বাড়ির পেছনের পথটার ওপাশে ফাঁকা জমি , যেটা পুকুরের ভাঙনে বেশ খানিকটা ভেঙে থাকে প্রায়শঃই । তার পরের প্লটটি-ই হচ্ছে বাদলের নামকরণে ধোলিবুড়ির । আর আমাদের সম্পর্কে ভূবন দার মা মাসিমাদের । এ ছাড়াও এই বাড়িটির সঙ্গে আমার জীবনের এমনই একটি দিনের স্মৃতি জড়িয়ে আছে ,  যাকে কোনো ভাবেই ভুলবার না । সেই যখন এদেশ থেকে ওদেশে চলে যাই দিদিমার হাত ধরে , সেই দিনটি ছিল আমার জন্মবার । তাই সে ক্ষেত্রে ওই দিন আমার বাড়ি থেকে কোথাও যাত্রা করাটা সংস্কার বিরুদ্ধ । ওই দিন বাড়ির ছেলে কোথাও বাড়ি থেকে রওনা হওয়াটা কোনো ভাবেই সম্ভব না । তাই সিদ্ধান্ত বের করে ফেলা হলো মাসিমার ভাড়াটিয়া তপুদার ঘরে আগের দিন রাত্রে আমাকে রাত্রি যাপন করে , পর দিন সেখান থেকেই রওনা হতে হবে । তপু দা ঠাকুমার বাপের বাড়ির সম্পর্কে আত্মীয় । তাই সেখানেই রাত্রি যাপন করে পর দিন নিজেদের বাড়ির ছায়াও না দেখে , রওনা হয়ে ছিলাম সেই মির্জাপুর স্ট্রিটের বাড়ি হয়ে দালালের হাত ধরে বসিরহাটে আর একটি রাত কাটিয়ে রাত ভোর হতে না হতে স্থানীয় গাড়িতে চড়ে বিথাড়ি নামক একটি জায়গায় নেমে সোনাই নদীতে সারাদিন টাবুরে নৌকোয় মেঘ-রোদের নানা খেলা দেখতে দেখতে তারপর কালবৈশাখীর কবলে পড়ে ছুটতে ছুটতে নৌকো থেকে নেমে যে বাড়িটাতে দালাল আমাদের আর একটি রাত কাটাবার বন্দোবস্ত করে ছিল , সে গল্পের কথা কি সবটা বলেও বুঝোতে পারবো ? সে স্মৃতি তো সারা জীবন ধরেই বয়ে বেড়াতে হবে জানি ।

       একাত্তরে যখন আমাদের এই বাড়িটা শরনার্থী পরিবৃত একেবারে , তখনও অধিক মানুষ-জনের থাকার ব্যাবস্থা এই মাসিমার বাড়িতেই । এবং ওই সময় থেকেই মাসিমার সঙ্গে দিদিমার একটা নিকট সম্পর্ক তৈরি হয় । পরে সেটা এমন পর্যায়ে পৌঁছোয় যে মাসিমা দিদিমাকে নিজের মায়ের সম্মান দিতে আরম্ভ করে দেন । সে সম্পর্ক যত দিন তাঁরা জীবিত ছিলেন ততদিন 

পর্যন্ত একই রকম ভাবে অটুট ছিল ।

         মাসিমার বাড়ির সামনের ডান পাশে বা  বাঁ পাশে দুদিক দিয়েই রাস্তা এদিক ওদিকের । মাসিমার বাড়ির উল্টো দিকেই শংকর দের বাড়ি । শংকর দের বাড়ি সুভাষদের বাড়ির পেছন দিক দিয়ে রাস্তা ধরে যেতে হয় । তাছাড়া আর একটা পথ হচ্ছে মাঠ আড়াআড়ি । শুকনোর সময় হলে সেই পথটাই সকলে ব্যাবহার করে সোজাসুজি। যে পথটি বা তার মাঠের উপর সকাল বিকেল আমাদের বাড়ির গোরুগুলি ঘাস পাতা খায় বা একটু খোলামেলা ঘোরাঘুরি করে ঘাস-মাটির উপরে । 

        আমাদের বাড়ির সেই উত্তর পশ্চিমের পথটাই আমাদের ঘরের উত্তরের জানলা খুললে শংকর দের বাড়ির বারান্দার কোনাটা দেখা যায় স্পষ্ট । কখনো কখনো খুব উচ্চস্বরে ঐ উত্তরের জানলা দিয়েই মার সঙ্গে কথা হয় শংকরের মায়ের….. । 


               তাই গঙ্গাপুরী , কুঁদঘাট বা ওয়ারলেসের জীবনযাপনের নাগরিক সম্পর্কের আলগা ভাবটা এই পাড়াতে অনেকটাই আলাদা । অনেক জায়গাতেই মেলানো যায় না দুটোকে এক সঙ্গে করে ; যে সব দুরত্বের রেশটা ওদিকে কথায় কথায় অনুভব করা যায় ,  এখানে এখনো তেমনটা নয় যেন । তাও গঙ্গাপুরীর পাড়ায় চারপাশের মানুষজনদের মধ্যেও আগে যে সব সম্পর্কের আদানপ্রদান দেখেছি ; যখন শৈশবে দিনগুলির আনা-নেওয়া সেরকম ছিল , তা যেন আমার ওদেশের থেকে ফিরে আসার 

পর আর সেরকম ভাবে খুঁজে পেলাম না ! ঠাকুমার সঙ্গে হয়তো প্রতিবেশী দু-একজনের সম্পর্ক এখনো আগের মতো থাকলেও থাকতে পারে , কিন্তু আমাদের সঙ্গে সেটাও আর ওপাড়ায় গেলে আগের মতো কোথাও কিছু খুঁজে পাই না । কখনো সখনো যদিও বা কারো সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয়েওছে  যদি , হঠাৎ করে , তারা হয়তো পূর্বের সম্পর্কের রেশটুকু ধরে একটুখানি মুখচাওয়াচায়ী করেও যদিও বা , কিন্তু সেখানেও কোথায় যেন বিরাট একটা ব্যাবধান কীভাবে যেন তৈরি হয়ে গেছে , এই কয়েক বছরের মধ্যেই । শুধু মাত্র একজনকেই দেখতাম সেই আগের সম্পর্কের রেশটুকু ধরে আন্তরিকতা দেখাতে এখনো , সে হলো গৌরীর মা ঠাকুমা । যদিও পরবর্তীতে তাঁর সন্তান সন্ততিরা তাঁর অবর্তমানে তা আর রক্ষা করবে কিনা জানিনা ,তবে তার সূচনা যেন ইতিমধ্যেই লক্ষ্য করা যায় ভালো করে দেখতে গেলেই — ।

          তাই , যে প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু হয়েছিল , বাদলের রসিকতা —- সে কথাতেই ফিরে আসি । একদিন সেই বাদলকেই আবার অন্য রকম দেখলাম , সে যখন তাদের বাড়ির ভেতরে থাকত । অথচ পাড়ার মোড়ে সেই বাদলই আবার অন্য আর একজন মানুষ । 

        যাইহোক , ওদের এই দলটার দিকে পারতপক্ষে না তাকিয়েই চলাচল করতাম । মোটমাট এড়িয়ে চলা যাকে বলে ।

         শংকর ওদের সঙ্গে থাকলে ,কিম্বা ওদের স্কুল কলেজের দু একজন বন্ধুবান্ধব রা যখন আসা যাওয়া করছে আমাদের বাড়ির সেই আড্ডায় ; বা আমরা যখন এদিক ওদিক যাই বিকেল বেলার দিকে পথে ঘোরাঘুরি করতে , তখন হয়তো তারাও আমাদের সঙ্গে একসঙ্গেই চলতে থাকে । এসব দেখেও বাদলের দলের ভেতর একটা গুঞ্জন তৈরি হয় —- যার ফিসফিসানো যেতে আসতে পেছন থেকে কানে আসে , শুনতে পাই । 

          কিন্তু অদ্ভূৎ বিষয় হলো শংকরের স্বভাবে , চালচলনের ভেতর এমনই একটা ধরণ ছিল , যার কাছে বাদলের সমস্ত রকমের ঠাট্টা ইয়ার্কি খুনসুটি বা ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য সব কিরকম যেন  ও সঙ্গে থাকলে , নিমেষে চুপসে গুটিয়ে যেত । 

        কেন এমনটা হতো ? 

        সে সব জানতে একটু সময় নিয়েছে । পরে অনুমানে যা ধরা দিয়েছিল , বাস্তবেও সেটাই জেনেছিলাম । কারণ শংকরের বাবার সঙ্গে বাদলের বাবার একটা কেজো সম্পর্ক ছিল । তার পরে দেশের বাড়ির জেলাভিত্তিক একটা টান ও তার সঙ্গে জুড়ে ছিল । 

       জানি না দেশের বাড়ির সেই জেলাভিত্তিক টানাটানির অস্তিত্ব কি এই সব শেকড় ছিঁড়ে চলে আসা মানুষজনের অন্তরে আর কোনো অবশিষ্ট কিছু এখনো পর্যন্ত ধরে বা  জুড়ে রাখতে পেরেছে  কি না ।

       তবে ,  এ প্রসঙ্গে এটাই বলা যায় , যেভাবেই হোক , এই সব এমন কিছুর প্রভাব শংকর এবং বাদলের মধ্যে জুড়ে আছে যে , তাতে করে শংকর আমাদের সঙ্গে থাকলে বাদলের চ্যাংড়ামির লেশ মাত্রও আর দেখা যেত না ।  অন্তত সামনাসামনি বা পেছনে ।


         জীবনের অনেকটা পথটা চলতে চলতে এই সব বিষয় গুলো নিয়ে ভাবতে যেয়ে বুঝতে পেরেছি , এই সব সম্পর্কের শাখাপ্রশাখা গুলি এতটাই পলকা বা ক্ষীণ , দুর্বল , এতটাই তুচ্ছ সে সব বিষয় , যা কিছুর সূত্র ধরে এমন সব সম্পর্ক গুলি শুধু মাত্র হাত কচলাকচলি-ই করে , নিজস্ব কিছু স্বার্থ বিনিময়ের কারণেই হয়তো ;  যে সবের সঙ্গে হৃদয়বিত্তির কোনো গভীর সম্মন্ধই নেই । যা মানুষ মানুষের কাছ থেকে আশা করে । 


       এক এক সময় মনে হয় , এই কঠিন নগর সভ্যতার কাছে যদি আবার ফিরে না আসতে হতো তাহলেই হয়তো ভালো হতো বুঝি ।   পর মুহূর্তেই আবার মনে হতো , তাহলে হয়তো কত কথাই অজানা থেকে যেত ! যে সব আরো খানিকটা পথ চলতে চলতে কত বাদল , বিমল , অমল , তাপসদের সঙ্গে যে দেখা হয়েছে , কথা হয়েছে !  অথচ পর মুহূর্তেই মনে হয়েছে , কই , কখনো কি কথা হয়েছিল ! কই , মনে পড়ছে না তো ! 

            কদিন হলো ওদের পেয়ে বসেছে গোরুর দুধ দুহিয়ে দিয়ে যাবার পর সেই গ্যাজা ওঠা গরম দুধ চুমুক দিয়ে কাঁচা খেয়ে নেওয়া । এতে নাকি বিশেষ উপকার । এসব সব শংকরের আবিষ্কার । এবং তাতেই প্রভাবিত হয়েছে কাল্টুও ।        

             তাই সকাল বেলা হলেই ওরা চলে আসে সেই গ্যাজা ওঠা কাঁচা গরম দুধ গেলাসে পান করতে । ইতিমধ্যে আমিও তাতে প্রভাবিত ; তাই কাঁচা দুধ খাওয়ার হিরিকে মন দিয়ে চোঁ চোঁ করে খেয়ে নিচ্ছি আমিও ওদের সঙ্গে খানিকটা গরম দুধ । 

               এর আগে আর এক পর্ব শুরু হয়েছে ইদানিং , খুব ভোর ভোর উঠে হাঁটতে হাঁটতে তিন জনে চলে যাই একেবারে সোজা কংগ্রেস নগরের রাস্তা ধরে খাড়া মাঠের দিকে —- একেবারে রাণিয়ার তারের কাছে সূর্যরশ্মী দু'চোখে মাখতে । 

      পুব দিক থেকে মাঠের উপরে থালার মতন যে সূর্যকে দেখা যায় । আমরা তার দিকে বিশেষ এক ধরণ নিয়ে দাঁড়িয়ে যাই পর পর । তার পর সে সব নেওয়া হলে বাড়ি ফিরে সুজিৎ ভাইএর গোরু দোহাই পর্ব হয়ে গেলে ,সেই কাঁচা দুধের গেলাস ,  তিনজনই এক এক করে মুখে তুলে নিই। 

        ফিরে আসার পথে বিশেষ একটা কথাবার্তা বলতে চাইতাম না বলে কাল্টু অভিযোগ জানাত আমার এই নীরব থাকা দেখে । বলত, " তুই এরকম চুপ করে থাকিস কেন রে ?" 

         বলতাম ," কই,কিছু না তো ! দেখ , সকাল বেলাডায় যত কোম কথা কতি পারবি , ততোই ভালো তো ! বেশি কথা না কওয়াই তো ভালো এহনে ; পরে অভ্যেস হয়ে গেলি দেহিসেনে সব ঠিক হয়ে যাবেনে; —

            অথচ তাতো না ! মনে মনে কত কথাই তো বলতাম নিজের সঙ্গে নিজে । আর সকাল ? এর চাইতেও কত দিনের কত সকাল ভোরবেলা গুলি একদিন কত কথারই না ছিল ; সে সব আর এদের কি বলে বোঝাবো ! 

               বলতাম না । বলতাম না আমার পেছনের সময়ের কোনো কথাই । বলতে মন যেন চাইতো না 

। তাই এমন একটা ভাব করতাম , আমি যা কিছু করছি তা এখনেরই —- তার পূর্ব অভিজ্ঞতা কিছুই যেন নেই !  যা কিছু দেখছি , তা যেন আগে কখনো দেখি নি । ভাবি নি । মাঝখানের বা পেছনের ছেদ টা নিয়ে কোনো কথাই যেন নেই কোথাও । এ ছাড়া ওই দেশটি সম্মন্ধে , তার প্রকৃতি সম্মন্ধে , আচার আচরণ সম্মন্ধে কত কথাই তো বলা যায় এই পথে চলতে চলতে ; বিনিময় করাও যায় তো ? কিন্তু না , একটি কথাও নয় এদের সাথে । তার কারণ ?

কারণ ও তো শংকর ,  শংকরই তো প্রকাশ্যে বলে ," বোঙলাদেশ । ওখানে আবার কোনো সভ্য মানুষ জন থাকে নাকি ?"

        ওর এই কথায় মনে মনে কেন জানি না খুব আহত হতাম । মনে হতো ওকে কিছু বলি , কিন্তু সে সুযোগ পেতাম না । এ ক্ষেত্রে ও এতটাই একগুঁয়ে , এবং এত সব অবজ্ঞাসূচক কথাবার্তা বলতো যে না জেনে না বুঝে , তাকে ঠিক এই ভাবে বলে বা তর্কাতর্কি করে ঠিক করা যাবে না ।  তার চাইতে ওর ধারণার কথা ও যা বলছে বলুক গিয়ে , তা আর কেই বা শুনছে ; কেই বা জানতে যাচ্ছে ; তাই থেমে থাকতাম খারাপ লাগলেও । শুধু ভাবতাম , এই ভাবে একটা গোটা  দেশের সম্মন্ধে , তার মানুষ জন সম্মন্ধে ,এমন ধারণা পোষণ করা কি ঠিক ! কেন যে ওর মনের ভেতর এমন একটা দৃষ্টান্তমূলক বিদ্বেষ তৈরি হলো ! আচ্ছা , তার কারণ কি ওর শৈশবে শোনা ওর পরিবারের দিক দিয়ে এমন কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা লব্ধ কোনো ঘটনার বর্ণনা ,  এরকম একটা একগুঁয়ে বদ্ধমূল ধারণার জন্ম দিয়েছে কি ?


        প্রায়শই শুনে শুনে , একদিন আর যেন না পেরে  বলে বসলাম   কয়েকটি কথা , বললাম , " এতটা অবহেলার চোখে একটি দেশ কে দেখা মনে হয় ঠিক না । কারণ কোনো একটা বিশেষ খারাপ অভিজ্ঞতার ফল একটি দেশের সকল মানুষ জনের উপর চাপানোটা কি ঠিক ! ধর , সেই দেশের প্রকৃতিকেও  এমন ভাবে সবটা খাটো করে দেখলি , সেই দেশের মানুষ জন বা সমাজের কাছে তো তোদের এই সকল ধারণার কোনো অংশ পৌঁছবে না !  আর সেই দেশটায় রাতারাতি কোনো বিপ্লবও তৈরি হয়ে যাবে না তোদের এই সব ধারণায় ,  সে যেমন ছিল তার মতো তেমনই থাকবে । সে তার  ভালো মন্দ সব মিলেই তো সে ! তাকে তার আপন গতিতেই এই ভালো এবং মন্দের জন্মের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে —- এবং এগোচ্ছেও হয়তো সে তা ,  কিন্তু আমাদের সেটা ভালো করে কাছে থেকে বুঝতে হবে । দূর থেকে শুধু মাত্র প্রচার মাধ্যমের উপরে নির্ভর করে বা তার অতীতের কয়েকটি ভুলের উপরে দাঁড়িয়ে একটা গোটা দেশের মানুষ জনকে দূরে সরিয়ে রাখলে কি সব টা ঠিক ভাবা হলো বলে মনে হবে তোর ? তার ভালো ভালো কত সম্ভাবনার দিক আছে ! মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের দোষ ত্রুটি ভুল দিয়ে তার সকল ঐতিহ্য কে অস্বীকার করা মনে হয় খুব একটা শিক্ষিত দৃষ্টিকোণ দিয়ে তাকে বিচার করা হলো না বলেই মনে করি আমি । 

      একেবারে টানা এবং এখানের‌ ও ওখানের মিশ্রিত ভাষার টানেই এই কথা গুলি একদিন বলে ফেলেছিলাম ওদের অনেকের সামনেই ।

        আমার এই ভাবে বলা কথাগুলি শুনে শংকরকে  খুব একটা উত্তেজিত হতে দেখলাম না সেদিন । তাও বলতে কিছু ছাড়ল না , একটু নিচু স্বরেই বলতে লাগলো , " শোন , যা জানি তাতে অভিজ্ঞতা টা খুব খারাপ । মোটেই ভালো না । যত দিন যাচ্ছে ,তাতে খারাপের দিকেই যাচ্ছে ওই দেশটা । ওরা এখনো জঙলিই থেকে গেল , তা না হলে বল না , যে মানুষটি যে দেশের জন্যে , তার স্বাধীনতার জন্যে , সমস্ত টা জীবন দিল , তাকেই ওরকম ভাবে সকল আত্মীয় পরিজন সহ নিধন হতে হলো ! যে ভারতবর্ষ ওদেশের জন্যে এত গুলি মানুষকে বুক পেতে আশ্রয় দিল , আগে এবং পরে , তারাই এখন খারাপ হয়ে গেল ? এটাকে কি কৃতজ্ঞতার নিদর্শণ বলে গণ্য করা চলে ?  তাই আমার ধারণা , ওদের সিভিলাইজ্ড হতে এখনো অনেক পথ হাঁটতে হবে । তাও এখন যেমন দেখছি তাতে মনে হচ্ছে আদেও পারবে বলে মনে হয় না । জানি না , আমার ওই দেশের প্রতি তাই কোনো টান নেই । শ্রদ্ধা ভক্তিও নেই । এপিঠ আর ওপিঠ , সব একই রকম । "

       সময়টা সেই সময় খুব একটা ভালো সময় ছিল না । ওখানে তখনো সামরিক শাসন চলছে টানা ।

         নিজের অজান্তে কখন যেন সেই বিতর্কে ঢুকে পড়েছি যে , সেটা বুঝতে পারছি । তাই খানিকটা সংযত হলেও , ওর বলা কথাগুলি একভাবে না একভাবে শুনতে তো বাধ্য হলাম ! সেটাও কি ঠিক হলো‌ ? মতামতও তো তুলে ধরলাম ! তাহলে আর নীরব রইলামটা কোনখানে ?


******************************************************************************************

আগামী পর্বে

********************************************************************************************

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন