শনিবার, ৮ জুলাই, ২০২৩

গল্প * যুগল কিশোর দাস অধিকারী



অ - কৃপণ

যুগল কিশোর দাস অধিকারী


পাড়ার দূর্গা পূজা। ছেলেরা দল বেঁধে চাঁদা কালেকসন করতে বেরিয়েছে। সারা পাড়া ঘুরে  এল মিত্তির বাবুর বাড়ী। ভদ্রলোক এ পাড়াতে বেশিদিন আসেনি। শুধু পাশের বাড়ীর দত্ত বাবুর সাথেই ওনার ওঠা বসা। বাকিদের সাথে মেশে না বরং এড়িয়েই যায়।

সারাদিন গাছ গাছালি নিয়েই ব্যস্ত থাকে। রাত্তিরে দোতলা ঘরের উপর তলায় বসে নিজের মনে কি যেন লেখা লেখি করেন। পোশাক আশাক তেমন কেতা দুরস্ত নয়, বেশ সাদামাঠা। স্বামী স্ত্রী দুজনের বাস।


শোনা যায় উনি রিটায়ার ( retired) গেজেটেড অফিসার। কাজের জায়গায় সততা ও নিষ্ঠার জন্য বহুবার পুরষ্কৃত হয়েছেন। কেমন যেন খ্যাপাটে গোছের। গাছগুলোকে ধরে যেন আদর করে  ওদের সাথেই কথা বলে।

বাজার যান বেশ বেলায়। সস্তার জিনিসই তার কেনাকাটার তালিকায় বেশি থাকে। যাতায়াতের সঙ্গী ছিল সাইকেল।

ছেলেরা দরজায় বেল বাজলো। মিত্তির বাবু পুজোর চাঁদার রসিদ দেখেই চক্ষু ছানাবড়া। পাঁচ শ টা কা ..।

দেখ বাপু আমি পঞ্চাশ টাকার বেশি দিতে পারব না।

ছেলেরা ক্ষেপে ওঠে। কি মশাই  বছরে একবার দূর্গা পূজা। তাও পাড়ার মধ্যে।

লাইট , প্যান্ডেল, ডি জে, প্রতিমা , ঢাকি, হাঙ্গামা, নবমীতে প্রসাদ বিতরণ , হাবিজাবি কত খরচ - আপনার হাত দিয়ে জল গলছে না। আপনার তো মশাই ছেলেপুলে কেউ নেই। অত পয়সা জমিয়ে কি করবেন??

  মিত্তির বাবুর মুখটা কেমন বিবর্ণ হয়ে গেল। অন্তরের দুর্বল জায়গায় আঘাত লাগলে যেমন হয়। পরক্ষণে সামলে নিয়েই বললেন তোমাদের পোশায় নাও, না নিলে না নাও। আমার কি খরচাপাতি আছে তার হিসেব আমি তোমাদের দেব না। পুজোতে কি হয় না হয় তা আমার ভালোমত জানা আছে।

তোমাদের অসুবিধা হলে আমার নামে থানায় জানাতে পার। ঐ সব হাঙ্গামা, কান ফাটানো মাইক বাজিয়ে মানুষকে অত্তিষ্ট করে তুলবে। পাড়ার ছেলেমেয়েদের নিয়ে ফাংশান, খেলাধুলা ও সব তো করতে পার।


ছেলেরা উত্তেজিত হয়ে বলল - জ্ঞান দেবেন না, ও সব আর চলে না রবীন্দ্রনৃত্য, আবৃত্তি, খেলাধুলো ও সব করলে লোকই আসবেনা ।

আপনি কি দিচ্ছেন দিন। 

আমি যা বলেছি তার এক পয়সাও বেশি দিতে পারব না। কেউ ভীড়ের থেকে বললো সময় নষ্ট করে লাভ নেই। শালা হাড় কিপটে। যা দেয় তাই নিয়ে কেটে পড়। কেউ বলে এ কি ভিক্ষে দিচ্ছেন?

তোমরা যা ভাব তাই ।

শেষ পর্যন্ত পঞ্চাশ টাকা নিয়েই বিদেয় হল।


এ গ্রামের থেকে যে দিকেই যাও হসপিটাল কম করে সাত আট কিলোমিটার দূরে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ও ভালো নয়। রাতভিতে কেউ অসুস্থ হলে ভ্যান রিক্সা বা টোটই ভরসা। ট্যাক্সি খোঁজ করে আনতে আনতে রোগীর বারোটা বেজে যায়।


দু একটা গ্রামের পর বড় রাস্তার ধারে নতুন হসপিটাল হচ্ছে। লোকেরা আশায় বুক বাঁধছে আর বিনে চিকিৎসায় মারতে হবে না।

প্রায় বছর দুই পরে হসপিটালের কাজ শেষ হল। উদ্বোধন করতে মন্ত্রী, ডি এম, বি ডি ও, এস ডি ও আসবে। চারদিকে সাজ সাজ রব।

২৩শে জানুয়ারী উদ্বোধন। পাশাপাশি দু  চারটা গ্রামে আনন্দের হওয়া বইছে।

পাড়ার ছেলেরা মিত্তির কাকুকে বললো শুনছেন মশাই আমাদের এখানে একটা ভালো হসপিটাল হচ্ছে।

আপনাদের মত কিপটে লোকের সুবিধা হল, অসুস্থ হলে নার্সিং হোমে যেতে হবে না। মিত্তির বাবু কথাটা না শোনার ভান করে বললেন ত ভালো।

ছেলেরা উপেক্ষার সুরে বলল লোকটা কেমন যেন। শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত।

কোথায় বলবে ঠিক আছে আমিও যাব - না কেমন নিস্পৃহ।

দেখতে দেখতে ২৩শে জানুয়ারী এসে গেল। হসপিটাল চত্বরে লোকে লোকারণ্য। রাস্তায় বড় বড় গাড়ী। মন্ত্রী আমলা সব হাইফাই লোক। ফুল দিয়ে সাজানো মঞ্চ। ঐ দিন দেখা গেল আমাদের মিত্তির বাবু ও দত্ত বাবু টোটো করে ওখানে এল।

পাড়ার লোকেরা আড়ালে বলছে এ আবার এই অনুষ্ঠানে কেন  এর পয়সা তো ভূতে খাবে।

যা হোক মঞ্চে উপবিষ্ট অতিথিরা। উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করছে আসল লোক কোথায়। কে সে লোক, যিনি এমন মহান কাজ করলেন তাকে দেখার জন্য সবাই উৎসুক। শুনলাম সেই লোকের নাম নাকি মাইকে ঘোষণা করা যাবে না। প্রচারের যুগে এমন প্রচারবিমুখ লোকটি কে?

কিছু ভালেন্টিয়ার দেখি মিত্তির বাবুকে দেখেই উচ্ছাসে ফেটে পড়ল, আর ব্যারিকেড করে ভিড়ের ভিতর থেকে মঞ্চের মধ্যে বিশেষ ভি আই পি দের সীটে গিয়ে মধ্যমনি করে ওনাকে বসালো।

প্রাক্তন আমলা হয়ত কোন জানাশোনা আছে। তবু সবার মধ্যে যেন কেমন বিস্ময়।

একে একে অতিথি বরণ হচ্ছে।

মিত্তিরবাবুকে মন্ত্রী থেকে ডি এম বি ডি ও সবাই করমর্দন করে পুষ্প চন্দনে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। বেশ কয়েকজন এসে প্রমাণ করছে। ব্যাপার টা কি বোঝা যাচ্ছে না।

অনেকের ভাষণের শেষে উঠলেন মিত্তির বাবু। কিন্তু পূর্ববর্তি বক্তারা কেউ ই এই হসপিটালের দাতার নাম ঘোষণা করেননি, তা নাকি বারন ছিল।


মিত্তিরবাবুর ভাষন শুরু হল। তিনি অল্প বয়সে ভিন ধর্মে মেয়েকে বিবাহ করায় তার বাবা তাকে তেজ্যপুত্র করেন। তখনো চাকরি বাকরি জোটেনি।

টিউশন করে চলত। তার মাঝে তাদের এক পুত্র সন্তান হলো। চার পাঁচ বছরের হতে জানা গেল বোন ক্যান্সার। তিনি অনেকের কাছে ভিক্ষা চেয়েও সেই ব্যাধি সরাবার অর্থ জোগাড় করতে পারলেন না। অবশেষে ছয় সাত বছরের মাথায় তার পুত্র সন্তান অকাল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। কিছুদিন পর wbcs পরীক্ষা দিয়ে ভিডিও হলেন। কিন্তু তার স্ত্রীর আর কোন সন্তান হল না। তত দিনে তার পিতা ও গত হয়েছেন তিনি তার নিজের ভুল স্বীকার করে তার সমস্ত সম্পত্তি ছেলেকে উইল করে যান। কিন্তু তখন সে সম্পত্তির কোন মূল্য

তার কাছে ছি ল না। তাই তার জীবনের সমস্ত আয় ও সম্পত্তি দিয়ে ওই হসপিটাল তৈরীর পরিকল্পনা করেন।


তার সঙ্গে পাঁচ টি অনাথ শিশুর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। যাদের দুজন ডাক্তার, এক জন ইঞ্জিনিয়র ও আর এক জন ভাবা রিসার্চ সেন্টারের বিজ্ঞানী। তারা সবাই আজ উপস্থিত আছ। তারাই তাকে পিতা জ্ঞানে সম্ভাষণ করে।

এবং ভবিষ্যতে এই আজাদ হিন্দ হসপিটালের উন্নতির জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার জন্য তারাই যথাসাধ্য সাহায্য করার জন্য প্রতিশ্রুতি বদ্ধ্ব।

আমার এক সন্তান হারিয়ে অনেক সন্তান পেয়েছি। একজনের চিকিৎসা করতে পারিনি ঠিকই হাজার হাজার ছেলের  মানুষের, প্রসূতির, চিকিৎসা করে হাসি ফুটবে সে আনন্দ কম কিসের?

পাড়ার সেই ছেলেরা যারা মিত্তির বাবুকে দেখে হাসি ঠাট্টা করতো তাদের মাথা যে মাটিতে মিশে যেতে চাইছে।

ওনার পায়ের ধুলো পেলে যেন নিজেদের ধন্য মনে করবে। সকলে সদল বলে পরের দিন সকালেই ওনার বাড়ির বাইরে এসে হাজির হল। কিন্তু

একি ওনার বাড়িতে তলা ঝুলছে।

শুনলাম ওটাও উনি হসপিটালে দান করে দিয়েগেছেন।


**********************************************************************************************

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন