রবিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

কবিতাগুচ্ছ * রাহুল দাশগুপ্ত



কবিতাগুচ্ছ * রাহুল দাশগুপ্ত


সে তাকিয়ে থাকবে 


পৃথিবীর কাছে কত আশা ছিল তার 

                                      মানুষের কাছেও 

নিরীহ, নিষ্পাপ,অবাক চোখে সে তাকিয়ে থাকত 

পৃথিবী ও মানুষের দিকে 

আর ভাবত,তার হৃদয়ের দাম সে পাবে 

তার জীবনের দাম সে পাবে

এই হৃদয় সে বিলিয়ে দিয়েছে মানুষের ভালো চেয়ে 

এই জীবন সে বিলিয়ে দিয়েছে দুনিয়ার ভালো চেয়ে 

তাকে দেখে কেউ ভাবত শিশু

                    আর কেউ বা হয়ত নির্বোধ 

তাকে নিয়ে ওরা হাসাহাসি করত 

কিন্তু অস্বীকার করতে পারত না তাকে 

                                    কেন কে জানে !

তারা জানত, তাকে ব্যবহার করা যায় অনায়াসেই 

তার হৃদয় সরল , ব্যৱহৃত  হলেও সে বুঝতে পারবে না 

                                  অথবা তার করার কিছুই থাকবে না 

সে শুধু ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাবে ,ফুঁসতে থাকবে 

               এক অদৃশ্য দেয়ালে গিয়ে মাথা ঠুকতে থাকবে 

আর এসবই কী কৌতুকের  ব্যাপার নয় ?

যে আত্মরক্ষা  করতে জানে না 

সে যখন মাথা উঁচু করে বাঁচার কথা ভাবে 

সম্মান পাওয়ার কথা ভাবে 

প্রেমে পড়ে দিশেহারা হয়ে যায় 

      আর ভাবে সাড়া পাবে ,মর্যাদা পাবে

তখন বলাই যায় ,তার শৈশব অন্তহীন 

তাকে কেউ নির্বোধ ভাবলেও অভিমান করার কিছু নেই 

ক্ষতিপূরণ তাকে দিতেই হবে 

ওরা পাথর ছুড়তে থাকবে আর সে কুড়োতে কুড়োতে 

অবাক চোখে তাকিয়ে থাকবে পৃথিবী ও মানুষের দিকে ....



মানুষ যেভাবে বাঁচে


মানুষ বাঁচে তাৎক্ষণিকতায়

বুদ্ধ অপেক্ষা করেন

মানুষের সময় নেই সে দিকে তাকানোর...


শপিংমল আর রেস্তোরাঁগুলো 

                                উপচে পড়েছে

দামি দামি খাবার

রঙিন বস্ত্র

বিনোদনের অজস্র উপকরণ


আকাশে ঝকঝক করছে নক্ষত্র 

নদী,সমুদ্র,পাহাড় আর আগুনকে ছুঁয়ে 

বয়ে চলেছে বাতাস। নিরন্তর... 

মাটির গায়ে পড়েছে বুদ্ধের ছায়া


ওদিকে শ্লোগান চলছে

পোস্টার,ফেস্টুন,প্ল্যাকার্ডের ভিড়ে

কেউ দেখছে না সেই শিশুটিকে 

দেবদূতের মতো তার মুখ


কী অপার্থিব সৌন্দর্য সেই মুখে 

চোখের তারায়,ঠোঁটে,হাসির আভাসে 

মানুষের সময় নেই

বুদ্ধ তাকিয়ে আছেন। শিশুটির দিকে...



আগুন আমাকে ছুঁয়ে যায়


কারো ভেতরে আগুন যদি থাকে 

সে আগুন আমাকে ছুঁয়ে যায় 

সে যাক বা না যাক 


তোমরা দেখছ সবুজ তৃণভূমি, নিরীহ মেষপালক 

আমি দেখছি ,আগুন 

এমনও তো হয় 


আগুন যদি থাকে আমি টের পাই 

যখন কেউ মার খায়, লাথি খায় ,অপমান সহ্য করে 

যখন কেউ লড়াই করে ,ফিরিয়ে দেয় পাল্টা আঘাত 

যখন কেউ প্রতারণা করে ,খেলা করে, রক্তাক্ত করে 


আগুন যদি থাকে তার ভেতরে 

পরিস্থিতি যেমনই হোক 

সে আগুন আমাকে ছুঁয়ে যায় 

আমি ঠিক টের পাই ,আগুন আছে কি নেই 


আমি ঠিক টের পাই কোথায় আগুন 

কতটুকু আছে, ঠিক কোনখানে আছে 

কতটা শুশ্রূষা তার প্রয়োজন 

দমে আছে নাকি জ্বলে  আছে ধিকিধিকি করে 


মানুষের রক্তের মধ্যে মিশে থাকা আগুন 

মানুষের চোখের তারায় জ্বলে থাকা আগুন 

মানুষের বুকের গভীরে শ্বাসে -বাতাসে মাখামাখি আগুন 

আমি টের পাই, সে চাক বা না চাক...













দেশের কথা 


আমরা সবাই ভিখিরির দেশে জন্মেছি 

উপায় নেই 

এই দেশ সবাইকেই ভিখিরি বানিয়ে দেবে 

ভিখিরি না হলে এদেশে কেউ টিকতে পারবে না 

কেউ মাথা উঁচু করে বাঁচতে গেলেই 

সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়বে তার ওপর 

তার গলা কাটার জন্য 

এদেশে মানুষের আত্মার জায়গায় রয়েছে 

মস্ত একটা অন্ধকার গর্ত  

উজ্জ্বল দৃশ্যের দিকে এরা অন্ধের মত তাকিয়ে থাকে 

আর ঈর্ষার গরম শ্বাস- প্রশ্বাস ফেলে 

এদের ঘাড় বাঁকা ,মাথা উঁচু করে তাকাতে পারে না 

কতদিন আকাশের ছড়িয়ে -ছিটিয়ে থাকা 

                ঝলমলে নক্ষত্র দেখেনি এরা 

সস্তা জিনিসের দিকেই ঝোঁক 

রাস্তার কুকুরের মত ছুটে যাবে সেদিকে 

দামি জিনিসের দিকে ফিরেও তাকাবে না 

এই দেশকে যারা ভালোবেসেছিল 

তারা প্রতারিত হতে হতে মিশে গেছে সাদা পৃষ্ঠায় 

এখানে চেয়ারগুলো থেকে দুর্গন্ধ বেরোয় 

একদল ভাঁড়  সেগুলোয়  পাশাপাশি বসে 

একে অপরের গা-শোঁকাশুঁকি  করে চলে 

ক্ষমতাকে যারা পৌষ মানিয়েছে 

এদেশের মানুষকে তারা করুণা করে 

আমরা বেঁচে আছি পদ্মপাতায় জলের মতো 

আমাদের জীবনের কোনও দাম নেই 

আমাদের জড়বৎ হৃদয় নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে মৃত্যুর....



একটা চেয়ারের কথা 


একটাই জানলা ,ফাঁকা ঘর ,জানলার পাশেই  

                                     চেয়ারটাকে রেখেছিলাম 

কেউ এসে বসেছিল চেয়ারটায় 

সে উঠে চলে গেছে 

কেউ এসে বসার কথা ছিল চেয়ারটায় 

সে আসেনি 

চেয়ারটা ফাঁকাই পড়ে আছে 

কে এসে বসেছিল ওখানে ,উঠে গেছে তারপর ?

ওখানে কার এসে বসার কথা ছিল ?

আমি জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াই 

একটা রাস্তা যা ক্রমেই ধূসর হয়ে গেছে 

একটা দৃশ্য যা ঢেকে যাচ্ছে কুয়াশায় 

কে এসে বসেছিল ? কেন সে চলে গিয়েছিল ?

ওই চেয়ার কি বসার যোগ্য ছিল না ? 

যে আসার কথা ছিল ,সে কেন এলো না ?

ওই চেয়ার কি বসার যোগ্য ছিল না ?  

যে চলে গেছে, সে ফিরে এলেও 

                    আমি তাকে ফিরিয়ে দেব 

যে আসেনি, সে যদি আসতে চায় 

                      তাকেও আমি ফিরিয়ে দেব 

অতটা যত্নের ছাপ ,তবু তারা ফিরেও তাকায়নি 

দূরে কোলাহলে মিলিয়ে গেছিল তাদের কণ্ঠস্বর... 

একটা চেয়ারের কাছে যাওয়া অত সহজ নয় 

একটা চেয়ারে গিয়ে বসা অত সহজ নয় 

একটা চেয়ারের দাম বোঝা অত সহজ নয় 

গোটা একটা হৃদয়ের ভার বহন করছে ওই চেয়ার 

গোটা একটা হৃদয়ের উষ্ণতা 

কান পাতলেই ওরা শুনতে পেত 

             সেই স্পন্দন ,কম্পন আর উষ্ণতা......


*************************************************************



রাহুল দাশগুপ্ত


বিশ্ব সাহিত্য ও বাংলা সাহিত্যের অলিগলি তাঁর নখদর্পণে। গল্প , কবিতা , উপন্যাস --- সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তাঁর  স্বচ্ছন্দ  বিহার। কবিতা ও উপন্যাসের উপর আলোচনা গ্রন্থও রয়েছে রাহুলের | তাঁর সুসম্পাদনায় ' চিন্তা ' সাময়িকপত্রটি ইতিমধ্যেই সাহিত্যমোদীদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে

গল্প কবিতা প্রবন্ধ উপন্যাস মিলিয়ে রাহুল এ পর্যন্ত কুড়িটিরও বেশি বই লিখেছেন |
তাঁর কয়েকটি  ------

গল্প সংকলন 

গল্প সমগ্র (প্রথম খন্ড )
প্রভু ও তাঁর পৃথিবীতে এক দেবদূত 

কবিতা সংকলন 
শিরামুখ খুলে গেছে ক্ষতে  * প্রার্থনার স্পর্শে একা  * এক অবিরাম স্বীকারোক্তি 

উপন্যাস 

সার্টিফিকেট * বাতাসে এখন ফুলের গন্ধ নেই * 
যখন কেউ হত্যাকারী হয়ে ওঠে  * একলা চলার পথ ইত্যাদি 

প্রবন্ধ সংকলন 

বাংলা উপন্যাসকোশ
উপন্যাসের মহাবিশ্ব 

সম্পাদনা গ্রন্থ 

বব ডিলান:কবিতায় ,গানে ,প্রতিবাদে    




1 টি মন্তব্য:

  1. কবি রাহুল দাশগুপ্ত-এর কবিতাগুলো এক গভীর প্রত্যয়ে বলে গেল
    যেন নিজস্ব বিশ্বাসই অন্তর্নিহিত আস্তিকতা। শিরদাঁড়া সোজা রেখে চলাই
    জীবন। কুর্ণিশ জানাই।

    উত্তরমুছুন