রবিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

সম্পাদকীয়

 *****************************

১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২

স্বরবর্ণ * ছয়  

*****************************


' Miles to go before I sleep ....'   Robert Frost 

 

 " বিস্ময়ই দর্শনের জনক " প্লেটো বলেছিলেন। আজ নয় । যিশু খ্রিষ্টের জন্মেরও চারশো  বছর আগে । তারপর পৃথিবী কত পথ পেরিয়ে এল। " হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে " । বিরামহীন । বিশ্রামহীন । কিন্তু , কথাটা  আজও সমান সত্যি । যে কোনো সৃষ্টির পিছনে কাজ করে এই বিস্ময়বোধ । বিস্ময়বোধ থেকে আসে আবেগ, অনুভূতি । আবেগ ধরতে চায় ব্যাখ্যাতীতকে শিল্পীর তুলিতে, কবির কলমে । কবিতা কী সংজ্ঞা দিতে গিয়ে পরবর্তীকালে ওয়ার্ডসওয়ার্থও  বলবেন, "Poetry is the spontaneous overflow of powerful feelings : it takes its origin from emotion recollected in tranquility." কিন্তু সেই tranquility  বা মনের প্রশান্তির স্থিতাবস্থা আসবে কেমন করে, বিস্ময়বোধই যদি কাজ না করে ।


 এই যে চিরপরিচিত পৃথিবী, যেখানে আমি রয়েছি, হাসছি, খেলছি , মুহূর্তকাল পরেই হয়ত আর আমার এখানে থাকা চলবে না " কখন যে গাঙচিল ছিড়ে ফেলে শালিকের প্রাণ "। প্রশ্ন এই, তাহলে কোথায় ছিলাম আমি, এই জন্মের আগে ? থাকব কোথায় এই জন্মের পরে ? থাকব না যে , সে তো ধ্রুব সত্য । কিন্তু সত্য এ-ও, আমি না থাকি, আমার সৃষ্টিরা থাকবে এই ধুলায়, মৃত্তিকায়, " যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে " । এমন স্থির বিশ্বাসে, বিস্ময়বোধকে অন্য মাত্রায়  উস্কে দিয়ে সুধীন্দ্রনাথও  বলেন " রুপ যে অশেষ ! হেথাকার ফুল এমনি ফুটিয়া রবে  / আমাদের মত কত বিহঙ্গ কত বিচিত্র ক্ষণ পতঙ্গ / লভি তার সেই রূপের সঙ্গ / বসন্ত উৎসবে লইবে বিদায় / ধরণীর ফুল এমনি ফুটিয়া রবে । "


  সৃষ্টির এমনই অমলিন ফুল তুলতে চায় স্বরবর্ণ। চর্বিতচর্বণ নয় । এঁটোকাটা নয় । সৃষ্টির অবিনশ্বর ফুল তোলার সেই অভিপ্রায়ে তার যাত্রা । কয়েকটি নির্দিষ্ট পথে । গল্প-কবিতা- প্রবন্ধের চেনা পথ তো রয়েইছে । সেই সঙ্গে রয়েছে অন্তত দু'টি নতুন বিভাগ । চেনা ছকের বাইরে । একটি "কবিতা উপন্যাস " যেখানে কবিতা ও উপন্যাসের মূল স্বর মিলেমিশে পৌঁছতে চাইছে অন্য এক উচ্চতায় , ভিন্ন  মাত্রায়, ভিন্ন  আঙ্গিকে ।  আরেকটি বিভাগ " তোমায় খুঁজে ফিরি " যেখানে আমরা খুঁজবো জীবন-মৃত্যুর অমীমাংসিত জিজ্ঞাসা । যদিও দুইয়েরই লক্ষ্য শিল্পের মধ্য দিয়ে স্বরবর্ণে পৌঁছনো।


এবার একটু চোখ ফেরাই চলমান সময় স্রোতে। সময়ের মতো উচিত শিক্ষক আর নেই, বলাইবাহুল্য । কখনো পার্থিব কোন ঘটনার অভিঘাতে, সে আমাদের দুটো চোখের বদলে হাজারটা চোখ খুলে দেয়। কখনো হাজারটা দূরে থাক, ঈশ্বরদত্ত দুটো  চোখকেই একেবারে দৃষ্টিহীন করে রাখে । যেমন রাখছে নির্বাচনের মুহূর্তে । দল বদল, ভোল বদলের সময় । অবশ্য শুধু নির্বাচনই  বা কেন, ব্যক্তিজীবনে কি সমাজজীবনে, অনেক সময়েই  আমরা দৃষ্টিহীন হয়ে যাই, অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র সাজি, চোখের সামনে ন্যায়-নীতি -মূল্যবোধ বিসর্জিত হতে দেখলেও। আবার হাজারটা চোখ খুলে দেয় কোন কোন ঘটনা । যেমন দিল বিভীষিকাময় মহামারী কোভিড নাইনটিন । এই অভূতপূর্ব প্যান্ডেমিক  ভিতরে-বাইরে সহস্র চোখ খুলে দিল আমাদের। কী দেখলাম আমরা ? দেখলাম মৃত্যু মিছিল সমস্ত পৃথিবী জুড়ে । দেখলাম  লকডাউন সোশ্যাল ডিসটেন্স মাস্ক স্যানিটাইজ অর্ধাহার অনাহার পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু ইত্যাকার  অসহনীয় ঘটনাবলী । সাক্ষী হয়ে রইলাম এক ভয়াবহ দুঃসময়ের, যেরকম দুঃসময় এর আগে,  জ্ঞানত আমরা কোনদিন দেখিনি ।


 তবু আমরা বিশ্বাস রাখি, এই দুঃসময় কেটে যাবে, পৃথিবী আবার শান্ত হবে । সেই আশা নিয়ে আমরা দাঁড়াব মানুষের পাশে। মিথ্যা বুলিতে নয় । শিল্প-সাহিত্যের অমোঘ শুশ্রূষা নিয়ে । কেননা আমরা বিশ্বাস করি " Pen is mighter than the sword  " যা আমরা দেখেছি ফরাসি বিপ্লবে, রুশ বিপ্লবে  কি আমাদের দেশে রামমোহন- বিদ্যাসাগর - মধুসূদনে । কবির সুরে সুর মিলিয়ে আমরা বলব, " এ কোন অন্ত্যেষ্টি যার লক্ষ বছর পরেও / আমাদের কোন ইতিহাস থাকবে না ! / আর বিবাহ একটা রাষ্ট্রের অরণ্যে স্বপ্ন দেখবে / নদী বেঁচে উঠছে ... তীরে তীরে ঢেউ লাগছে / শব্দ হচ্ছে...অবিরল শব্দে শব্দে লুন্ঠনের শস্য ভাসে... /  কতটা জরুরি তবে একটা হাত থেকে আর একটা হাতের দিকে যাওয়া " ( সব্যসাচী মজুমদার )। হীন রাজনীতি দলাদলির উর্দ্ধে, এই কঠিন সময়ে একটা হাত আর একটা হাতের দিকে এগিয়ে যাবে মমতায়, ভালোবাসায় এটাই কাম্য ।


 পরিশেষে কৃতজ্ঞতা জানাই সেই সব কবি-লেখকদের, যাঁরা তাঁদের মূল্যবান রচনা দিয়ে  সমৃদ্ধ করলেন বর্তমান সংখ্যাটিকে । আগামীতে যেমন তাঁদের প্রশ্রয় পাব, তেমনই , প্রিয় পাঠক, আমাদের পথ চলায় আপনাকেও সঙ্গে পাব, আশা ।


* এক বছর আগে যে সম্পাদকীয়টি দিয়ে স্বরবর্ণর পথ চলা শুরু হয়েছিল, সেটি দিয়েই শুরু হল দ্বিতীয় বর্ষের পথ চলা *    

                                                                  

দেবাশিস সাহা    

সম্পাদক * স্বরবর্ণ 


২টি মন্তব্য:

  1. সম্পাদকীয় পড়ে পত্রিকার সঞ্চারপথটিকে চেনা যায়। জ্ঞানের গরিমা নেই,উদ্ধার করেছি গোছের কোনো প্রতিবর্তী ক্রিয়ার সোল্লাস নেই, স্নিগ্ধ মাধুর্য নিয়ে অনায়াসে নিজকে, নিজস্ব দলবৃত্তের বাইরে বেরিয়ে ডাক দিল শিল্পের সতীর্থ-সুজনবর্গকে। এই ডাক তিতিরের, এই হাত নগ্ন নির্জন। Hat's off.

    উত্তরমুছুন
  2. আপনার এই সৃজনশীলতা কে আগলে রাখার যে সুন্দর প্রচেষ্টা তাতে সাথে থাকব আমৃত্যু । সবাই আসুক সাহিত্যের আলোয় নিশ্বাস নিই প্রাণ ভরে ।

    উত্তরমুছুন