সোমবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

উপন্যাস * দেবাশিস সাহা





ধুলোর সিংহাসন

পর্ব * ছয়

দেবাশিস সাহা 


[ পূর্বানুষঙ্গ : বাড়ি পৌঁছেই অশোক স্ত্রী অলির চিৎকার শুনতে পায়। না পড়ে মেয়ে উপমা কানে হেডফোন গুঁজে কথা বলছিল,অথচ দুদিন বাদে বিএ ফাইনাল। চিৎকার চেঁচামেচি থামিয়ে অশোক ঘরের শান্ত পরিবেশ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে।রাতে খেয়েদেয়ে তিন জনে শুয়ে পড়ে। শুলেও অর্থ চিন্তায় অশোকের ঘুম আসেনা। অনেক রাতে যখন দুচোখের পাতা একটু জড়িয়ে এসেছে,অলি ডেকে দেখায়, চাদর মুড়ি দিয়ে উপমা তখনও ফোন নিয়ে ব্যস্ত । 

মেজাজ হারিয়ে অশোক ফোন কেড়ে নিয়ে মেঝেয় আছাড় মারে এবংপরপর দেওয়ালে ঘুসি মেরে নিজেকেও রক্তাক্ত করে। এই ঘটনার কয়েকদিন পর, এক ছুটির দিনে --] 



তোর জন্মকথা

২ /১২/৯৫ * শনিবার 

১৯৭ সুভাষ পার্ক  

                                                                                                                       

তখনও তুই তোর মায়ের গর্ভে। রামকৃষ্ণ মিশন শিশুমঙ্গল হাসপাতালের ভিজিটিং আওয়ারস  চারটা থেকে ছ'টা। কালকের মতো আমি ঠিক চারটেয় পৌঁছেছি হাসপাতালে। গিয়ে দেখি তোর দাদু-দিদা এসেছে। একটু পরে এল মেজবৌদি ও মমতা। আমার মনে তখন অজস্র চিন্তার স্রোত। সমুদ্রের মতো বুকটা উঠছে-নামছে। উপরে উঠে জানা গেল, তোর মাকে লেবার রুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সকাল থেকে স্যালাইন চলছে। ডক্টর গিরি ও ডক্টর বি চৌধুরী চেষ্টা করছেন নর্মাল ডেলিভারির। কিন্তু তা হল না।সাড়ে পাঁচটা নাগাদ আমাকে ডেকে এক মহিলা ডাক্তার জানালেন, এবার ওরা সিজার করবেন। আমাদের সম্মতি চাইলেন। আমি বললাম, 'যা ভালো বুঝবেন,করবেন। আমরা মা ও শিশু দু'জনকেই সুস্থ চাই।' বলে আমি ও তোর দাদু নীচে নেমে এলাম।


          রামকৃষ্ণ মিশন হাসপাতালের লম্বা বারান্দায় আমি তখন অস্থিরভাবে পায়চারি করছি। অসীম উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগের মধ্যে। কিন্তু কাউকে বুঝতে দিচ্ছি না। সবার সঙ্গেই স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে চেষ্টা করছি। ইতিমধ্যে দিলীপ এসেছে ডিউটি থেকে। ও আর আমি বাইরে বেরিয়ে ঘনঘন সিগারেট ধরাচ্ছি। মাঝে দু-একবার বাবলুদা, আমাদের বাড়ির উলটোদিকে ওদের বাড়ি,আমার বন্ধু কানুর দাদা, কাজ করে ওই হাসপাতালেই, এসে আমাদের আশ্বস্ত করে গেছে, চিন্তার কিছু নেই, অপারেশন হয়ে গেলেই ও আমাদের খবর দিয়ে যাবে।


         হলও ঠিক তাই। ৭টা ৪০ নাগাদ বাবলুদাই  প্রথমে এসে আমাদের জানাল তোর জন্মবার্তা। তুই হয়েছিস সুস্থ এবং স্বাভাবিক, জেনে বুকের ভেতর তোলপাড় করা ঢেউ অনেকটা শান্ত হয়ে এল। তুই আমার মেয়ে, তুই ১৯৯২ সালের ২৭ এপ্রিল মেঘের কোলে হারিয়ে যাওয়া আমার মা। কোনওদিন তুই আমাকে, তোর মাকে ছেড়ে ,যাবি নাতো???


৩/১২/৯৫ * রবিবার

১৯৭ সুভাষ পার্ক                                                                                                                                        

                                                                                                                      

              সকালে সিক্স এবং এইটের কয়েকজন এসেছিল পড়তে। ১/১২/৯৫ অলিকে হাসপাতলে ভর্তি করানোর পর থেকে ক'দিন ঠিকমত পড়ানো হচ্ছে না। আজও হল না। কোনওমতে ওদের একটু দেখিয়ে ছুটলাম হাসপাতালে উদ্দেশে। কিছু প্রয়োজনীয় ওষুধ কেনার কথা ছিল। আমার বন্ধু স্বপন এসেছিল। অলি যে হাসপাতলে ভর্তি ও জানত না। স্বপনও আমার সঙ্গে গেল। ওষুধ কিনে হাসপাতালের  এনকোয়ারি সেকশনে জমা দিয়ে,আমি ছুটলাম সোনারপুরে। বড়দাকে খবর দিতে। দুপুরে বড়দার ওখানে খাওয়া-দাওয়া সেরে বৌদি, টুকু ও আমি চারটেয় পৌঁছলাম হাসপাতালে। পাকান আসতে চাইছিল খুব। কিন্তু ওর টেস্ট চলছে। কাল ইংরেজি পরীক্ষা। তাই ওকে আনা হল না। আমরা এসে দেখি অলির মা ও বাবা এসেছেন। একটু পরেই এল মেজবৌদি ও মমতা। আমি প্রথম অলিকে দেখতে গেলাম। ও আছে চারতলায় এ-৩ ওয়ার্ডের সি-৩৯ বেডে। অলি  তখন বেডে শোয়া। সারা চোখে মুখে কালকের ধকল স্পষ্ট। উঠতে পারছে না। বলল একটু আগে নাকি স্যালাইন শেষ হয়েছে। ডাক্তার প্রেসক্রিপশন দিয়ে গেছেন। আমি ছুটলাম ওষুধ আনতে।


            আজ তোর বয়স এক দিন। যারা হাসপাতালে এসেছে,সবাই তোকে দেখার জন্য ব্যস্ত। আমি অবশ্য কালকেই তোর জন্ম হওয়ার আধ ঘণ্টার মধ্যেই তোকে দেখেছি। এমনিতে নিয়ম নেই। কিন্তু বাবলুদাই ভিতরে  নিয়ে গেল। তোর হাতের নম্বর ছিল ৪২৫ । বাবলুদা বলতেই একজন নার্স তোকে নিয়ে এল। কাচের ছোট ফুটো দিয়ে তোকে দেখলাম। সাদা কাপড়ে পেঁচানো তোর মুখটুকুই শুধু দেখা যাচ্ছিল। তোর চোখ বোজা। গালটা অসম্ভব লালাভ দেখাচ্ছিল।


           বড়বৌদি,টুকু,মেজবৌদি, মমতা তোর দাদু-দিদা সবাইকে নিয়ে সেই কাঁচের ঘরে গেলাম। সবাই তোকে দেখল উৎসুক হয়ে। ফেরার পথে আমি বড়দির বাড়ি হয়ে এলাম। তোর জন্মবার্তা দিয়ে।



৪ /১২/৯৫ * সোমবার 

১৯৭ সুভাষ পার্ক                                                                                                         


                 আজও সকালে হাসপাতালে গেলাম। একজন আয়া ঠিক করে এলাম। তোর ও তোর মাকে  দেখার জন্য। দুপুরে মেজবৌদির কাছে খেয়ে একটু ঘুমিয়ে তিনটে পনেরো নাগাদ বেরোলাম হাসপাতালে উদ্দেশে।


               গিয়ে দেখি, আজ তোকে তোর মায়ের কাছে দিয়ে গেছে। এইটুকুন পুঁচকি তুই, শুয়ে আছিস তোর মায়ের বাঁ দিকে কাত হয়ে। আমি ভালো করে তোকে দেখছিলাম। বড়সড় খেলার পুতুলের মত লাগছিল তোকে। ছোট্ট ছোট্ট এইটুকুন হাত-পা। আঙুলগুলো কী ছোট! এর আগেও অনেকবার ছোট বাচ্চা দেখেছি, কিন্তু এত ভালো করে,এত কাছ থেকে,এত মনোযোগ দিয়ে দেখিনি তো! তাই অবাক লাগছিল---এই তুই এক দিন কত বড় হবি! হাঁটতে শিখবি, স্কুল যাবি, কলেজ যাবি, চাকরি করবি, না না চাকরি না, আমার ইচ্ছে তুই ডাক্তার হবি, খু..উ..ব বড় ডাক্তার। কী রে ,পারবি না হতে? আমি আর তোর মা ,আমরা দু'জন , আমাদের সবকিছু দিয়ে তোকে মানুষের মত মানুষ করব।দ্যাখ,আজ তোর বয়স সবে দুই দিন। আর এখনই আমি কত কত বছর পরের স্বপ্ন দেখছি,তোকে নিয়ে--। আসলে স্বপ্ন ছাড়া কি বাঁচা যায়? নাকি বাঁচতে পেরেছে কেউ কোনওদিন? যে ভিখারি সে-ও একটি উজ্জ্বল রুটির স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখা মানুষ মাত্রেরই স্বধর্ম।


              যাইহোক, তোকে দেখে আমি তো তন্ময় হয়ে এইসব ভাবছিলাম, হঠাৎ তাকিয়ে দেখি বড়দা এসেছে। একটু দূরে দুলালদা, তোর পিসা। আর তোর মাথার দিকে দাঁড়িয়ে তোর দাদু। এর পর হাসপাতালের ক্যান্টিন থেকে তোর জন্য প্রথম জামা কিনলাম, তেরো  টাকা করে দুটো। সেইসাথে একটা অয়েলক্লথও, যেটার উপর তুই শুবি। আপাতত। ছ'টায় বেল বাজতেই বড়দা ও দুলালদা এবং তোর দাদু চলে গেল। আমি রয়ে গেলাম, মহারাজের সঙ্গে কথা বলে, আয়ার থাকার পারমিশন নেওয়ার জন্য। কাজ সেরে ন'টা নাগাদ বাড়ি ফিরলাম।


   

রবিবার সকালে স্তুপীকৃত বইপত্র গোছাতে গিয়ে  হঠাতই  চোখে পড়ল বহুকালের পুরনো একটা ডায়রি।পৃষ্ঠা উল্টাতেই খুলে গেল ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বর মাসের ২ তারিখের 'তোর জন্মকথা ' শিরোনামের এই লেখাগুলো।এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলল ২, ৩ এবং ৪ তারিখের  রোজনামচা। মনের আকাশে ঝিলিক দিয়ে উঠল স্মৃতির বিদ্যুৎ। একুশ বছর আগের মুহূর্তগুলো যেন কাটা মাছের মত ছটফট করতে লাগল চোখের সামনে...


            ভুলে যাচ্ছে অশোক আজ রবিবার। কাল থেকে শুরু উপমার পরীক্ষা । ও ঘরে পড়ছে এক মনে। সকালের টিফিন করতে ব্যস্ত অলি। ঘুম থেকে উঠে নিজেই বায়না করে এসেছে, ' অলি,আজ আর রুটি তরকারি না, টিফিনে চিড়ের পোলাও করো। রোজ রোজ এক খাবার ভালো লাগে না।' কথা শোনাতে ছাড়েনি অলিও, 'তুমি তো অর্ডার দিয়েই খালাস। চিড়েটা, ডিমটা আর একটু আলু-পিয়াজ এনে দাও নতুন বাজার থেকে।’

 ' তবে থাক। '

' থাকবে কেন, যাও না জিনিসটা একটু এনে দাও।'

' দেখ, আজ আমার অনেক কাজ। বইপত্রগুলো সিস্টেমেটিক্যালি গোছাতে  হবে , যখন যে -বইটা পড়ার ইচ্ছে হয়, কিছুতেই খুঁজে পাইনা, তারপর ---- ' মুখের কথা কেড়ে নিয়ে অলি বলল, 'দোকান থেকে এসে গোছাও না, কে বারণ করেছে, আজ তো পড়ানোও নেই।'

'নেই না, ছিল। ছুটি দিয়েছি। এই কাজটা করব বলে। তা ছাড়া উপমার পড়াগুলোও  একবার রিভিশন করাব, এখন ও পড়ছে,পড়ুক।'

 'তাহলে তুমি যাবে না?'

'না।'  বলল বটে, সাথে সাথে ভাবল, উপমাকে আজ অলি কিছুতেই দোকানে পাঠাবে না আর অলিকে  যেতে হলে এখন আবার ড্রেস চেঞ্জ করতে হবে,অতগুলো সিঁড়ি ঠ্যাঙাতে হবে। তা ছাড়া ওরও তো কত কাজ বাকি। সবে ঘর ঝাঁট দেওয়া হয়েছে, এখনও ঘর মোছা,কাচাকাচি,স্নান, ঠাকুর পুজো,রান্নাবান্না রাজ্যের কাজ পড়ে আছে ।

'ঠিক আছে,যাচ্ছি দাও।'


তারপর জিনিসগুলো এনে দিয়ে বসেছে বই গোছাতে। তারমধ্যে চোখে পড়ল ডায়রিটা...তোর জন্মকথা... আর অমনি ওলট-পালট অতীত-বর্তমান... ভুলতে শুরু করেছে পরিপার্শ্ব। কানে আসছে না আর উপমার পড়ার শব্দ। অলির  হাতা খুন্তির ঠুং ঠাং। চিঁড়ের পোলাও-এর সুবাস।


           

সত্যি, সময় কীভাবে,কত অবলীলায় ছিনিয়ে নেয় জীবনের নানা রঙের মুহূর্তগুলো। তারপর ছুঁড়ে ফেলে বার্ধক্যের আস্তাকুঁড়ে। উপমার জন্মমুহূর্তের সাক্ষী ছিল যারা, তারা অনেকেই আজ বার্ধক্যের ভারে ন্যুবজ। কোথায় ডক্টর গিরি আর ডক্টর বি চৌধুরী ,যাঁরা তোকে প্রথম পৃথিবীর আলো দেখাতে প্রাণপাত করেছিলেন, কী সুন্দর মিষ্টি ব্যবহার , এখনও মনে পড়ে অশোকের ,সেদিন ও খুব টেনশন করছিল দেখে ডক্টর গিরি মৃদু হেসে বলেছিলেন ,চিন্তা করবেন না মিস্টার সাহা ,ইউ আর গোয়িং টু বি এ ফাদার অফ এ হেলথি  চাইল্ড ভেরি সুন । কোথায় আছেন তারা আজ ,কেমন আছেন ,কে জানে ! তখন কিশোর ছিল যারা ,তারা হারিয়েছে ফুটবল খেলার মাঠ, ক্রিকেটের ব্যাট বল। ঘাড়ে পড়েছে সংসারের জোয়াল। আর কিশোরী ছিল যারা ,তারা অনেকেই এখন পাক্কা গিন্নি, দু'এক সন্তানের মা। কারও বা শেষ হয়েছে জীবনের পথ পাড়ি দেওয়া। যেমন তোর দাদুর, ছ'বছর হল তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু আমার চোখে ভাসছে একুশ বছর আগেকার  তোর দাদুর মুখখানা। ঠিক যেমনটি তোর জন্মদিনের দিনটিতে দেখেছিলাম । ধবধবে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি। চোখে হাই পাওয়ারের মোটা ফ্রেমের চশমা । আমরা দু'জন নামছি শিশুমঙ্গল হাসপাতালের  সিঁড়ি দিয়ে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ' মেয়ে হয়েছে, আপনি খুশি তো ?' ঠোঁটে  ঈষৎ হাসি ঝুলিয়ে তিনি বললেন, ' পোলা হইলেই ভালো হইতো। ' বাঙাল ভাষাতেই কথাবার্তা বলতেন তিনি। খাস বাঙাল কিনা । দেশ ভাগের পর এদেশে এসে অর্ধ শতাব্দী পার করে দিলেও কলকাতার পরিশীলিত ভাষার ধার ধারেননি কোনওদিন ,মাতৃভাষার টান তো ! মাটি কেড়েছ ,ভাষাটাকেও কেড়ে নেবে ,অত সহজ ! পঞ্চাশ বছরেও তো পারলে না ,এটাই যেন বোঝাতে চাইতেন বাঙাল ভাষায় উচ্চকিত কথাবার্তা ,অট্টহাসি দিয়ে । ' পোলা হইলেই ভাল হইত' কিন্তু কেন, সেই  কথাটা অবশ্য  আমি মুখ ফুটে শ্বশুরমশাইকে জিজ্ঞেস করতে পারিনি। লিঙ্গ ছাড়া ছেলে এবং মেয়ের মধ্যে কোনও পার্থক্য আছে বলে আমি সেদিনও মনে করিনি,আজও করি না। তোর জন্মের বার্তা বাড়িতে আনার সময় 'গৌরাঙ্গ মিষ্টান্ন ভান্ডার 'থেকে এক হাঁড়ি  রসগোল্লা কিনে এনেছিলাম। বড় বড় রসগোল্লার সেই সাইজটা এখনও যেন চোখে ভাসে ! পাড়া-প্রতিবেশীদের খাইয়েছিলাম আনন্দ করে।


  আর জানিস তো, দিলীপ, তোর পিসতুতো কাকা, সেই একুশ বছর আগের কর্মঠ চনমনে ছটফটে দিলীপকাকাইটি নেই! সে এখন স্নায়ু রোগের শিকার! হাত-পা কাঁপে। কথা বলতে গেলে মাথাটা দোলে এদিক-ওদিক।


   আর সেই বাবলুদা,যে নিয়ম ভেঙে তোর জন্ম মুহূর্তের আধ ঘন্টার মধ্যেই আমাকে দেখার সুযোগ করে দিয়েছিল, সেই বাবলুদা রিটায়ারের পর, আজ স্মৃতিভ্রংশ রোগে ভুগছে। এইতো সেদিন রাতে কী হুলুস্থুলু কাণ্ড ! শরীরে সোডিয়াম পটাশিয়াম লেভেল কমে গিয়ে সে কী  অবস্থা ! খালি চিৎকার করছে। উলঙ্গ হয়ে উঠোনে দৌড়োদৌড়ি  করছে আর অনর্গল বলে চলেছে, ' আমি অফিস যাব,আমি অফিস যাব ' ছেলেমেয়ে বউ কেউ ধরে রাখতে পারছে না।


     আর এই যে আমি,তোর বাবা , আমিও কি আর একুশ  বছর আগের আমিটি আছি ! এখন তো তুই দেখিস একমাথা পাকা চুল,একগাল পাকাদাড়ি,  হাঁটু কোমরের ব্যথায় কাহিল,সুগার প্রেশারের আক্রমণে ধরাশায়ী প্রায় বার্ধক্যে উপনীত তোর বাবাকে। আহা! তুই যদি তোর পঁচিশ বছর আগেকার বাবাকে একবার দেখতে পারতিস! কী দুরন্ত স্ট্রাইকার ছিল সে... বিপক্ষের রক্ষণভাগ ফালাফালা করে দৌড়োচ্ছে ... গোলমুখে... দুই ডিফেন্ডারকে চতুর ডজে কাত করে...  গোলকিপারকে ভেলকি দেখিয়ে... আলতো ছোঁয়ায় গো.. ও...ল। ছিয়াশি আর নব্বইয়ের মারাদোনা তখন রক্তে দৌড়োচ্ছে যে!


   ' কী গো, এই তোমার বই গোছানো?' এক হাতে প্লেটভর্তি চিড়ের পোলাও আর এক হাতে জলের গ্লাস অশোকের সামনে রাখতে রাখতে বলে অলি।


    কোনও সাড়াশব্দ নেই। কাকে ডাকছে অলি? যাকে ডাকছে, সে এখন দু'দিন বয়সি মেয়ের জন্য জামা কিনতে যাচ্ছে, শিশুমঙ্গল হাসপাতালের উল্টো দিকের দোকানে। তেরো  টাকা করে চারটে জামা কিনল। অলি দুটো কিনতে বলেছিল। অলির কোনও  বুদ্ধি আছে! ডিসেম্বর মাস। কী ঠান্ডাটাই না পড়েছে! দু'টো জামায় কী করে হবে? ঘনঘন হিসু পটি করলে গায়ে টানবে না! তাই চারটেই  কিনছে। বন্ধু স্বপনের কাছ থেকে কুড়ি টাকা ধার নিয়ে। দাম দিচ্ছে গুনে গুনে। চার তেরং বাহান্ন। এই নিন বাহান্ন টাকা। কী সুন্দর পুতুলের জামার মতো উজ্জ্বল  রং!



   আর ধৈর্য রাখতে পারে না অলি। পিছন থেকে আচমকা এক ধাক্কা লাগায়, ' কী গো, আবার ধ্যানস্থ হয়েছ? কী দেখছ পোকায় খাওয়া পুরনো একটা ডায়রি খুলে ? অশোকের হাত থেকে ডায়রিটা ছিনিয়ে নেয় অলি। অপ্রকৃতিস্থ দু'টি চোখ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে অলির দিকে।


 'বলি, ক'টা বই গোছালে? কেমন গোছালে দেখি? ' চারপাশে তাকায় অলি, ' কই! যেমন ছিল, তেমনই তো রয়েছে সব।'


  কী কাজ করতে বসেছিল এতক্ষণে মনে পড়ল যেন, ' হ্যাঁ হ্যাঁ গোছাব গোছাব, খাবারটা দাও, আগে খেয়ে নি।' প্লেটটা মুখের কাছে টেনে নিয়ে বলে ' বাহ! বেশ তো ঘ্রাণ বেরিয়েছে!'


   'আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান'  অলির ফোনের কলার টিউন ।

  ' মা, তোমার ফোন।'

  ' কে রে? '

  ' রিনা মাসি,নাও কথা বলো।'

  ' হ্যাঁ, রিনাদি বল। '

  ' কী রে, কেমন আছিস তোরা সব?'

  ' ভালো, তুই গোগল ,প্রদীপদা তোরা সবাই কেমন ?'

   ' সবাই ভালো আছি। শোন যে জন্য ফোনটা করলাম।'

   ' বল।'

   ' উপমার পরীক্ষা কবে শেষ যেন? '

   ' এইতো কাল সোমবার থেকে শুরু, শেষ শনিবার।'

    ' বাহ, শোন, তোর প্রদীপদা বলছিল,গোগলের পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে , উপমারটাও জেনে নাও, তারপর সবাই মিলে দিন সাতেকের জন্য হৈ হৈ করে পুরী ঘুরে আসি, যাবি?'

    অলি উত্তর দেওয়ার আগেই ফোনের কাছে মুখ এনে উপমা লাফাতে থাকে , ' যাব,যাব রিনা মাসি, যাব।'

   ' দাঁড়া ,তোর মা কী বলে আগে শুনি, কী রে,যাবি তো?'

   ' আমার তো খুবই ইচ্ছা,দিন রাত আর হেঁসেল ঠেলতে ভালো লাগে না , দেখি তোদের অশোকবাবু কী বলেন। '

   ' আচ্ছা। তোরা কথাবার্তা বলে দু-এক দিনের মধ্যে জানাস, তাহলে তোর প্রদীপদা সামনের সপ্তাহেই টিকিট বুকিং করে রাখবে।'

 ' আচ্ছা, রাখি তাহলে।'

  ' রাখ।'

  ' ওমা যাবে তো?'


 ' আমি কী জানি,তোমার বাবা জানে।'এবার বাবার গলা জড়িয়ে ধরে আবদার উপমার, ' বাবাই, কী বলবে রিনা মাসিকে? যাবে তো?

 ' দাঁড়াও দেখছি,আগে পরীক্ষাটা তো দাও ভাল করে ।'

' দেখছি টেখছি না, বলো যাবে।'

  ' বলছে তো দেখবে,অত ঝুলোঝুলি করছিস কেন, টিফিন হয়ে গেছে, যা না পড়তে বস গিয়ে। আর তো মাত্র ক'টা ঘন্টা!'

  ' সারাক্ষণ পড়ব নাকি? কোন সকাল থেকে পড়ছি বলতো , একটু বিশ্রাম নেব না! '

  ' হ্যাঁ নিবি, তা এখনও বিশ্রাম হয়নি? আধঘন্টার উপর তো হয়ে গেল গ্যাজাচ্ছিস ?'


          অলি--উপমার কথার মাঝখানে অশোকের ফোনটা বেজে উঠল হঠাৎ। ফোনটা এগিয়ে দেয় অলি। অচেনা নম্বর।

   ' হ্যালো?'

   ' অশোক বসু বলছেন?'

   ' বলছি।'

   ' অশোকদা ,আমি ' অবশ হাতের ক্ষ্যাপা বুলেট' লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক বলছি।'

   ' ও, চিরন্তন বিশ্বাস? বলো ভাই, কেমন আছ? এই অধমের শরণ কেন? '

   ' আমার নাম আপনার মনে আছে দাদা! '

   ' থাকবে না কেন, তরুণ প্রজন্মের অন্যতম শক্তিশালী কবি তুমি। তোমার কবিতা আমাকে খুব স্পর্শ করে। '

  ' ধন্যবাদ দাদা, আপনার একগুচ্ছ কবিতা চাই, আমাদের শারদ সংখ্যার জন্য।'

  ' একটু সময় দিতে হবে কিন্তু ভাই।'

  ' হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি এক মাসের মধ্যে পাঠান না।'

  ' বেশ বেশ, তাই পাঠাব।'

 ' ধন্যবাদ দাদা। এবার বইমেলায় আসছেন তো?'

  ' একদিনের জন্য হলেও যাব। নাহলে বইমেলার  ধুলো কাঁদবে যে!'

  ' দারুণ বললেন তো! '

  ' জানো চিরন্তন, সেই কলেজ লাইফ থেকে এ পর্যন্ত একটা মেলাও বাদ যায়নি। বইমেলাও তো আমাদের আর এক শারোদৎসব, কী বলো?'

 ' ঠিক তাই, দাদা। তাহলে মেলাতে দেখা হচ্ছে। ওখানেই আপনার কপিটা  দিয়ে দেব।'

  ' দিয়ো , কিন্তু আমার একটা অনুরোধ আছে, চিরন্তন।'

  ' কী বলুন।'

  ' তুমি আমাকে আমার কপিটি-সহ আরও পাঁচটি কপি দেবে এবং ছ'টির নির্ধারিত মূল্যই আমি তোমাকে দেব, কোনও কমিশন টমিশন লাগবে না, এবং সেটা তোমাকে নিতে হবে।'

  ' আশ্চর্য লাগছে অশোকদা আপনার কথাটা শুনে। পাঁচ বছর পত্রিকাটা চালাচ্ছি। এরকম কথা কারও  মুখে এ পর্যন্ত শুনিনি। সবাই তো সৌজন্য সংখ্যা পাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকেন। কোনো কারণে না পেলে সম্পাদকের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করেন। '

' সে করেন হয়তো। কিন্তু আমি তো জানি, লিটল ম্যাগাজিনের প্রতিটা পৃষ্ঠায় সম্পাদকের কতটা ঘাম,অশ্রু, ভালোবাসা লেগে থাকে। পয়সা দিয়ে তার মূল্য হয় না,তবুও যতটুকু পারি।'

' মন ভরে গেল আপনার কথা শুনে।'

' আর একটা কথা।'

' বলুন!'

' এমন সব লেখা ছাপো, যাতে ' অবশ হাতের ক্ষ্যাপা বুলেট 'সৌজন্য সংখ্যা পিপাসুদের বুকে গিয়ে লাগে।'

 ' দারুণ! দারুণ!!' এবার হো হো করে হেসে ওঠে  চিরন্তন। হাসতে হাসতেই বলে , 'ভালো থাকবেন দাদা,ভালো থাকবেন।'

' তুমিও।'


পাশে দাঁড়িয়ে  অশোক আর চিরন্তনের কথা শুনে মুখ টিপে টিপে হাসছিল অলি। খুব তৃপ্তি পাচ্ছিল । মনে মনে ক্ষ্যাপা স্বামীর জন্য একটু গর্বও হচ্ছিল যেন। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অশোকের দিকে।

' কী দেখছ?'

' না,ভাবছি। '

' কী?'

' চিরন্তন ' ছেলেটার নামটা যেমন অভিনব, তেমনই পত্রিকার নামটাও  ' অবশ হাতের ক্ষ্যাপা বুলেট...'


( আগামীপর্বে )


৫টি মন্তব্য:

  1. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  2. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  3. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  4. ডায়েরির অংশে লেখাটি নতুন মাত্রা নিল। অসাধারণ লাগছে।

    উত্তরমুছুন
  5. আগের কিস্তিগুলো পড়িনি। এটি পড়লাম। উপমাকে ঘিরে অশোকের পিতৃস্নেহ বিবৃত আছে ডায়েরির পাতায়। একুশ বছর পর খুঁজে পেয়ে বিহ্বল এক পিতার কাছে যেন পুরনো দিনকে খুঁজে পাওয়ারই উত্তাল এক অস্থিরতার সাবলীল বর্ণনায় ঋদ্ধ এই কিস্তি। এরপর? এমন আগ্রহ তৈরি হয় বৈকি। আর সেই আগ্রহকে চারিয়ে দেওয়াই তো উপন্যাসের গুন। চোখ ভীষণ বিরোধিতা করে ওয়েব ম্যাগাজিনের লেখা পড়তে। তবু অপেক্ষায় থাকব পরেরটুকু জানবার উৎকন্ঠায়।

    উত্তরমুছুন