['স্বরবর্ণে'র চতুর্থ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে কবি দীপংকর রায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে '। এই উপন্যাস লেখকের ষোল-সতের বছর বয়সের কালপর্ব থেকে শুরু। যদিও লেখকের জন্ম এপার বাংলায়, কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে থেকেছে ওপার বাংলায়। কাজেই যাতায়াত থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ ছেড়ে চলে আসা আর তারই নাছোড় এক টানাটানির মধ্যে যে জীবনের ক্রমাগত আসা আর যাওয়া ,এই উপন্যাস মূলত তারই এক নির্মম নিষ্ঠুর ভাঙা-গড়ার আশ্চর্য কথোপকথন। ধারাবাহিকভাবে যা আমরা পড়ছি, কবি দীপংকর রায়ের মায়াময় কলমে।]
কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে
পর্ব * ১৩
দীপংকর রায়
মা বললো , হ্যাঁ , মাগরোয় গেছিলাম কেষ্ট মামার ওখানে ;সেখান থেকে মিহিরগের ওখানেও গেছিলাম । গোপাল ছবিরা ওখানে ছিল তো , তাই এক বেলা ওগের ওখান থেকেও সকলের সঙ্গে দেখা করে এলাম ।
জিজ্ঞাসা করলাম রাড়ীখালীর কথা । বললাম , তা তো হলো , রাড়ীখালীতে কালীপুজোয় সকলে একজায়গায় ছিলো তো এবার ? নাকি আবার দল পাকিয়েছে ?
—-- না না , দল-টল নেই এখন; সকলে মিলেই তো কাজকম্ম করলো দেখলাম ।
—--- তাই নাকি ! তাহলে তো ভালো , সুবুদ্ধি হইছে কতি হবে ৷ সেবারে যা দেখিছিলাম , তাতিই তো মনে হইছিলো , আবারও না আলাদা হয়ে যায় ৷
—- ছাড়ো ওসব , সে সব নিয়েও মারে একদিন কইছিলাম ,পুজো ওখেনে নিয়ে চলো । তোমার এখেনের মতো না হয় না হবে ৷ তবে খুব একটা খারাপও হবে না , এ কথা তোমারে জোর দিয়েই কতি পারি । তাতে তার কী কথা শুনবা ?
সে বলে কি জানো , তোমার ওখেনে ? তালিই হইছে ! তোমাগের দ্যাশের পুজো তো দেহিসি সেবারে ৷ওরে কি পুজো করা কয় ? ও আর কতি হবেনানে রে মণি ; যা সব অবস্থা তোমাদের ! খাইয়েদায়ে চা বিড়ি ফুকতি ফুকতি চোদ্দবার পুরুতঠাকুর নমো নমো করে ওঙবঙ আওড়াতি আওড়াতি কিছুক্ষণের মধ্যিই হয়ে গ্যালো সব…. ! শুধুই পোটলা বাঁধার তাল | ওরে কি কালীপুজো করা কয় , তুমিই কও?
নেহাত গন্ডগোলের মধ্যি বলে দেখতি পাইছিলাম ৷ .না হলি তো আর পাতাম না জানতি , এই সব !
আমি তাতে তারে এও কলাম ,
সে না হয় দরকার হলি পুরোহিত মামারে আমি পাসপোর্ট ভিসা করায়ে ঐ সময় ওদ্যাশেই নিয়ে যাবো ....
সে তাতি কী কয় সিডা শোনো একবার , .... সে না হয় নিলে, আচ্ছা , আমি ধরে নিলাম তাও , পাল কাকারে কী করবা ? সে তো আর তোমার ওখেনে যাবেনানে…?
এর পর আমি আর কী কতি পারি তারে কও ? …. শোনো বাবা , তার নানা অজুহাত ; অজুহাতের আর শেষ নেই… ! ওঁ…, সে তো এবারে আর এক ফন্দি আঁটিছে ; তোমারে তো ওদেশে বিয়ে দেবার ফন্দি করতিছে ৷আমার কাছে তো একদিন শুনলো , হ্যাঁরে , জ্ঞানেনদিরির মাইয়েডা কি খারাপ ? আমি তো ভাবতিসি ওর মাইয়েডার সঙ্গেই তোমার বড়ো ছেলের বিয়ে দেবো । এখন তুমি ভালো করে ভাইবে-চিন্তে দেহে-শুনে ঠিক করো , কিছু ভুল কচ্ছি নাকি ?
তাতে বললাম , সে কি মা ! তোমার নাতির বয়স কত , এখনি যে তার বিয়ের কথা ভাবতিছো?
সে তাতি কী কয় আরো জানো? না না , এহনে না হয় না হবেনে; দু-চার বছর পরেই না হয় দিয়েনে; …..সে আমার কথাডা জ্ঞানেনদির ফেলবেনানে ; তাই , আমি যা কই সিডা তুমি ভালো ভাবে ভাইবে-চিন্তে দ্যাহো একবার ৷ তবে এহেনে যদি হ’ত তালি তো আমার সকল সমস্যারই সমাধান হয়ে যেত একরকম ৷ শোনো শোনো , একটা কথা কয়ে রাখি তোমারে , এইসব নিয়ে যত ভাববা ততোই কাকবাড়ে বাইছে আনবা ; তাই কচ্ছি , আমার কথাটা মানো ; আমি যেটা ক’তি চাচ্ছি সেটা বোঝো । তা না হলি পরে পস্তাবা ।
. তোমার দিদিমা এখন তোমার বিয়ে নিয়ে ভাবছে । এ দেশে আসার কথা নিয়ে নয় । এ দেশে আসা নিয়ে তার অত গরজ নেই কিছু । তুমিই বলো , আমি কি তার এইসব নিয়ে ভাবতে বসবো এখনি ? এখন দেখো বাবা , তুমি কি মনে করছো ? হ্যাঁ …. মেয়েটি কিন্তু খুব একটা খারাপ লাগেনি আমারও। জ্ঞানেনদির মামাও যদিও আঁচ পাইছে , এইসব নিয়ে কিছু একটা । এবং সেই জন্যি একটু খাতির যত্নও করলো বেশ-ই বলা চলে। সে করুক , তাই বলে তো আমি এখনি পাগল হতে পারি না মায়ের মতো ? সে না হয় তার সয়াল-সম্পত্তি রক্ষা করা নিয়ে এইসব অকাল বোধনের কথা ভাইবে বেড়াচ্ছে ৷
চুপ করে শুনছিলাম মায়ের কথা আর হাসছিলাম মনেমনে ।
যদিও সেই সব কৌতুকপ্রিয়তা সরিয়েই বললাম কিছুক্ষনের মধ্যেই — তাহলে তুমিও পাগল হলে নাকি ?
— না না বাবা , একেবারেই না ৷একটুও পাগল হইনি ।কিন্তু দেখো, আমাগের মামিও বললো একই কথা —- তা মণি ভালোই হবেনে ; ধরো জ্ঞনেনদিরির মাইয়েডাতো একেবারে ফেলে দেবার মতো না ৷ কাছাকাছির মধ্যি ? ,…. কাজডা করে ফেল গে মণি, আমিও কচ্ছি…. ।
সব শুনে-মেলে মাকে বললাম -- তাহলে এর মধ্যিই পার্ষদবর্গও বেশ জুঠিয়ে ফেলিছে বল? কী কও, তাই তো ? …. মোটামুটি একটা সোরগোল বাধায়ে নাচা-কোদাও শুরু হয়ে গেছে কতি পারো একেবারে ৷
তা শুনে মা বললো , সে সব কি তোমার অজানা ? ওখানকার মানুষজনদের হাবভাব সবই তো তোমার জানা । নির্মলা মাসিমাও — দিদিমাও —- সকলেরই একই অভিমত , তারাও আমাকে ডাইকে বলতি লাগলো — ভালোই হবেনে রে মণি , তুমি মাইনে নেও । শোনো , এই মেয়েডারে যদি তুমি নিতি পারো, তাহলি মানুষ করে নিতি পারবা। দুডো ভাতজল পাবা । দেশের মেয়ে তো !যেমন নম্র সভ্য তেমন দেখতিশুনতিও তো একেবারে ফেলায়ে দেবার মতোন নয় ?
মার মুখে এইসব শুনে সত্যিই সত্যিই আমি হতবাক হয়ে যাইনি একটুও । দিদিমার এধরণের চিন্তা-ভাবনা ছিলো যে , তা জানতাম, এর আগে অনেকগুলো ঘটনা নিয়েই — কিন্তু সেটা যে এরকম একটা রূপ নিয়েছে ইতিমধ্যেই , সেটা ভাবতে পারিনি ৷ এ ধরণের চিন্তাভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে ফেলেছে সে যে এর মধ্যেই , এত তাড়াতাড়ি —- সেটাও ভাবতে পারিনি । তাই , পাকাপাকি একটা বন্দবস্ত চাইছে যে সে , মাকে এবারে কাছাকাছি পেয়ে , সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না একটুও ।
সুশীলা মাসি এই সব কথাবার্তা এতক্ষণ ধরে কান পেতে শুনে, সেও বলে , তা দিদি ভালোই তো হবে , মেয়েটা দেখতে শুনতে যখন ভালো। তা যদি হয় তাহলে তুমি এককথায়
বউমা করে নিয়ে আসতেই পারো ৷
সুশীলা মাসি আরো কতো কথাই না বলতে চায় যেন ! একেবারে পরিতৃপ্তির সঙ্গে দুপা ছড়িয়ে , চায়ের গেলাসের ভেতরে রুটি পাকিয়ে চুবিয়ে নিতে নিতে , হুশহাশ করতে করতে চা খেতে খেতে যেন আরো কিছু একটা রুগীর নিদান দিয়ে দিতে পারার কথাই বলতে লাগলো ; সে একেবারে পাকা ডাক্তার বাবুর গলায় এই বিষয়ে নানা অনুসঙ্গ টেনে এনে রুগীর ঔষধ পথ্য সব একেবারে বাতলে দিতে লাগলো । মাকে একেবারে বুঝিয়ে বুঝিয়ে বলতে লাগলো যেন কত ভাবে , কাজটা তুমি করে ফেলো গে দিদি ৷
গঙ্গাপুরী থেকে এখানে উঠে আসার . পর থেকে সে এ বাড়ির ঠিকে কাজ করে । কিন্তু ঠিকে কাজের লোক হলে কী হবে — এর আগে রাত্রে খাবার রুটি-টুটিও করে দিয়ে যেতো —-সে সেই একাত্তরেরর পরের থেকেই পাকাপাকি । সকালবেলায় সে যেখানে যে বাড়িতেই কাজ করুক না কেন , সকালের চাটা সে এখানে এসেই খায় —- একেবারে বারান্দার পিলারে হেলান দিয়ে বসে রুটি পাকিয়ে পাকিয়ে চায়ের গেলাসের মধ্যে চোবাবে আর বকবক করতে করতে চা পান করবে । আর সে আজকের এই বিষয়টায় বেশ মজা পেয়ে গেছে যেন ! তাই সেটাকে ছেড়ে সে আর নড়তে চাইছে না একেবারেই । আর এই আলোচনা তো এখানেই থেমে থাকবে না ! সে তো এবারে সারা পাড়া ছড়িয়ে পড়বে বেশ ঘটা করে । এ বাড়িতে তো কোনো আড়াল আবডাল বলে কিছু নেই ! যদিও কোনোকালেই ছিলো না সে সবের কোনো বালাই । আজকে মাও একেবারে তার সামনেই সব খুলে বলে ফেললো দেখে , আমার আরো লজ্জা হতে লাগলো । কারণ এইরকম একটা বিষয় পেলে এদের কাজকম্মে বেশ একটা অন্য জোর চলে আসে এটা তো ঠিক ! এই সবেতেই পরম শান্তি তাদেরও |এর পর এই বাড়ির কথা ঐ বাড়িতে রসিয়ে রসিয়ে বলে বেড়ানোতে আরো আনন্দ ৷
খুব অদ্ভুত লাগতে লাগলো সবটা ভেবেই । ভাবতে লাগলাম সত্যিই তো একটা ঝামেলার বিষয় হয়ে দাঁড়ালো এই বিবাহ প্রসঙ্গটা নিয়ে ৷ শেষে কিনা জ্ঞানেনদির দার মেয়েকে আমাকে বিয়ে করতে হবে ?
এই তো সেদিন দেখলাম তাকে , একগাদা বইপত্র হাতে করে রাড়ীখালীর স্কুল মুখো হেলতে দুলতে চলেছে ! শেষে কিনা তাকেই বিয়ে করতে হবে ? শেষে কিনা জ্ঞানেনদির দাকে শ্বশুর মশাই ভাবতে হবে ? যে মানুষটির সঙ্গে এই তো কিছুদিন আগে এদেশে আসার পরিকল্পনা করে মেহেরপুর বর্ডার পর্যন্ত পৌঁছেও, শেষে সীমানা পেরোনো হয়েছিল না সেবারে । কিন্তু কই , তখনো কি ভাবতে পারা গেছিল এরকম একটা বিষয় ? দিদিমার এইরকম একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা যত ভাবছি ততোই একটা মন হাসছে । আবার একটি মন শুধুই ভাবছে , শেষে কি এমন একটা
বিষয় মেনে নিতে হবে তার সিদ্ধান্ত মতো ?
জীবনের নানা বাঁক । কখন কোন ঘটনা যে কার উপর দিয়ে কেমন ভাবে নেমে আসে , সে সব নিয়ে ভাবতে বসলে কোনো কূলকিনারা খুঁজে পাওয়া যায় না ।
ভাবছি , এরপরে ওদেশে গেলে আমার অবস্থাটা কী হবে ? পাড়ার ভেতর দিয়ে কি স্বাভাবিক ভাবে হাঁটতে পারবো আগের মতোন ? সেভাবে কি সব বাড়িতে খুব সোজা ভাবে দাঁড়িয়ে তাঁদের কুশল জেনেই শুধু সরে আসতে পারবো ? কেউ কি ছাড়বে এই বিষয়টা নিয়ে আমার ইচ্ছা অনিচ্ছার কথাটি না জেনে তারা ? তখনকার অবস্থাটা কেমন হবে আমার , সেটা যতো ভাবছি ততোই চুপসে যাচ্ছি ।
ঘরের ভেতর থেকে এই সব শুনে ভাইয়ের ঘুম ভেঙে গেল । সে বলতে শুরু করলো এবারে , শোন দাদা , আমি কিন্তু ওকে একেবারে বউদি বলে ডেকেই এসেছি ; — আরে , একবার খাইয়ে দেখিস খানে , তোর হবু শ্বশুরমশাই কী সুন্দর নলেন গুড়ের প্যারা সন্দেশ বেঁধে দিয়েছে । খাঁটি দুধের প্যারা । আরে , আমারেও যা খাতির-যত্ন করেছে না ওরা — তা বলার নয় ৷ সে সব পেলে তুইও না গলে যেয়ে পারতিস না ৷ বড্ড মায়া লাগছিলো আসার সময় জানিস ! ওদের খুব আগ্রহ দেখলাম! সে তুই না দেখলে , কথা না রেখে পারতিস না, এ আমি কয়ে রাখলাম এখনই ।
—- তাহলি শুনলে তো আমার কথা ঠিক কিনা ? তাই তো আমিও আর পারলাম না । তবু ঐটুকু বাধায়ে রাখে আসলাম । আসার সময় জ্ঞানেনদির মামার বউ তো একেবারে নদীর ঘাট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে আসতে আসতে আমার হাত দুখানা ধরে একেবারে বলতি লাগলো , ও মণি , একটু ভাইবে দেখো তাহলি ভালোভাবে ৷আমার তো প্রথম মেয়ে , তবু সে না হয় দুই চার বছর দেরি হয় হোক না ! সে একটু দেরি করতি হয় করবানে ! একেবারে এখনেই সাততাড়াতাড়ি কিছু নেই অত ; তবে তোমার মণির সঙ্গে একবার একটু কথাবার্তা কয়ে একটা পাকা কথাবার্তা করে রাখলিই আমরা নিশ্চিন্ত হবানে , এই যা ।
মণি মানে , আমার পছন্দ অপছন্দের কথা নিয়ে বলছে । সেই কথাটিই মা জ্ঞানেনদির দার মুখের কথা বসিয়ে এখানে বলে গেল ।
মণি, ওদেশের ছেলেমেয়েদের আহ্লাদ করে ডাকা একটি সম্বোধন। সে ছেলে হলেও ‘ মণি ’ মেয়ে হলেও ‘ মণি ’ । এটাই ধরণ । নাম ধরে বলে না কেউই সব সময় ।
আমি ওদের এই সব পরিকল্পনার কথা শুনে নিজের মনে নিজে একটা কথাই ভাবতে থাকলাম , জীবন কি তাহলে এই সব অকাল সিদ্ধান্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেল এখনই ?
দিদিমার এই সব অত্যন্ত বিষয়ী চিন্তাভাবনা বরাবরই আমাকে ক্লান্ত করে ফেলেছে আগেও । সে যে এই সব ভাবনা চিন্তার পেছনে কোন বিচক্ষণতার নিদর্শন রাখছে , তা তো আমি ভালো ভাবেই জানি । সে যে কী হিসেব মেলাতে চাইছে , তাও আমি বুঝতে পারছি । কিন্তু সে যে কতটা জটিল করে ফেলছে সবটা, তা সে কোনোদিনই বুঝতে চায় না , তার চিন্তা ভাবনার বাইরে যেয়ে ।
সেদিনের সেই সকালবেলাটি সত্যি সত্যিই ছিলো বেশ খানিকটা তাৎপর্যপূর্ণ ।
এক দিকে ভাই প্রায় বছর কাটিয়ে দিয়ে ফিরে এলো । আর এক দিকে মা , সেও তার জন্মভূমিতে কতকাল পরে গেল যে , সে কথা কি মনে আছে তার ?
যদিও এইসব সব কিছুর গল্প আরো ভালো হতে পারত , কিন্তু সে সব বলা-কওয়া না হয়ে , এমন একটা বিষয় ঢুকে পড়লো এর ভেতরে , যাতে একেবারে সবটা গন্ডগোল পাকিয়ে ছাড়লো । শুধু পাকিয়েই ছাড়লো না ; এর প্রভাব যে কত দূর গড়াবে , সেটা তো এখনি সবটা ভাবতে পারছি না ৷ আমার কাছে সবটা বেশ হাসির হলেও ওদের কাছে সেটা না ।
কোথায় আমি কি সব ভেবে বেড়াচ্ছি , আর এরা ? এরা কিনা আমার বিয়ে দেবে কীভাবে , তাই নিয়ে সোরগোল বাধিয়ে দিয়ে চলে এলো ?
এই সব এখনি ভাবতে হবে তা কি ভেবেছি কখনো ? গতকালকেও কি জানতাম আজকে এই সব নিয়ে ভেবে বেড়াতে হবে ? অথচ দেখ আমার তো কত কথাই মার কাছে জানবার ছিলো! জিজ্ঞাসা করবার ছিল । সে কীরকম দেখে এলো সব কিছু ? এতবছর পরে সে তার জন্মভূমিতে গেল , তাতে তার অনুভব কেমন হলো ? তার কতটা উচ্ছাস আজ মায়ের গলায় শুনতে পাবো আমি , আমার তো সেটাই ছিলো মার কাছে জানার । অথচ দ্যাখো , এমন একটা বিষয় নিয়ে সাতসকালে ঝাঁপি খুলে বসলো লোকজনের মাঝে মা — এই সব কি ভাবতে পেরেছিলাম, এই সব কিছু বিষয় হয়ে উঠবে এমন ভাবে ? সব কিছু আজকে কেমন যেন গুলিয়ে গেল । এরপরে মাকে কি আর এসব নিয়ে প্রসঙ্গ তুলতে পারি আমি ? যতোই যা বলি না কেন ঘুরে-ফিরে বিষয় চলে যাবে হয়তো ঐ দিকেই । অথচ আমার তো কত কিছু জানার ছিলো । সেই যে সে , যেসব অনেক কাল আগে দেখে এসেছে , তারপরে এত ঝক্কি-ঝামেলা কাটিয়ে সেই দেশটা যখন একটু একটু করে আবার গড়ে উঠছে , সেই সব পার্থক্যগুলো তো মায়ের কাছে অন্য রকমের অবশ্যই ! সেই নবগঙ্গাও আর আগের মায়ের দেখা নবগঙ্গার মতো নেই ৷সেই তার মুখে শোনা যে গতিবিধির কথা আগে জেনেছি , সেকি আর এখন তেমনটা আছে ? কিম্বা জীবনযাপনেও তো মানুষের কত পরিবর্তন এখন! সে সব মায়ের কাছে কেমনভাবে ধরা দিলো ? এই যেমন , দিদিমার কাছে ওখানকার যে জঙ্গলাকীর্ণ দিনগুলির কথা শুনেছি , সেটাই তো মায়ের কাছে শুনে আগে মেলাতে পারিনি ! বা রসিক দাদুর মুখে যে গল্প শুনেছি , তার সঙ্গে কি আমার দেখা ঐ দেশটার প্রকৃতি মেলাতে পেরেছি আমি কোনোদিনও ? সেসব শুনতে শুনতে তো কত অচেনা লাগতো ঐ প্রকৃতিকে ! আজ তো আমার মায়ের চোখ দিয়ে দেখা তার এতদিন পরের অভিজ্ঞতার কথাগুলিই জানবার ছিল ! তা না সে এসব কী বিষয় সকাল সকাল বলে, সব কিছুই একেবারে মাটি করে দিলো ! আমি তো আরো একটা কথা শুনবো ভেবেছিলাম , আচ্ছা, নতুন মামিমা কি তার কাছে একবারও শুনেছে আমার কথা ? নাকি কল্যাণী শুনেছে একবারও আমার বিষয়ে কোনো কিছু ? সে কি শুনেছে , আমার এখনো মাছ ধরার বাতিক আছে কিনা ?
কই , মাতো সে সব নিয়ে একবারও কোনো কিছুই বললো না ! বললো না , এই , মীরা কিন্তু বারবার তোর কথা শুনেছিলো । কল্যাণী কিন্তু ঘুরে ফিরে আমার কাছে বারবার জিজ্ঞাসা করেছিলো , ও পিসি , সে কি ওদ্যাশে যাইয়ে এখনো মাছ ধরতিসে নাকি ?….. কিম্বা রসিক দাদুর কথাও তো কিছুই বললো না মা !
ভাবলাম , বলবে হয়তো এরপরে আস্তে আস্তে সে সব কিছু । এখন , এই মুহূর্তে , যেটা একেবারে জ্যান্ত এবং গরম গরম বিষয় , তারা হয়তো সেই সব নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বেশি ! তাই ঐ সব বিষয়গুলোই আজকে পরিবেশিত হলো । পরে হয়তো আস্তে আস্তে অন্যগুলো সব বলবে ৷
যদিও এই সব আলোচনার মধ্যে আমি তো আর জিজ্ঞাসা করতে পারি না , সেই সব বিষয় নিয়ে কিছু ? তাই আশায় আশায় চেয়ে বসে থাকলাম এই ভেবে , মা হয়ত পরে অন্য কোনোদিন আমার মনের কথাগুলি ঠিকই বলবে একে একে । তারা কি আর আমার কথা জিজ্ঞাসা না করে কেউ থাকতে পারে ! অন্তত কেউ না জিজ্ঞাসা করুক , এরা , এই কজন অন্তত ঠিকই জিজ্ঞাসা করেছে ৷ অন্তত একবারের জন্যে হলেও আমার কথাটা যে — সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি ।
শুরু হয়ে গেল আবার আগের মতো মায়ের অফিস । ভাইও তার পুরোনো স্কুলে ফিরে গেল । পাশের পাড়ার আমবাগান থেকে নিতাই দা বলে একজন নতুন প্রাইভেট টিউটর আসতে লাগলো তাকে টিউশন পড়াতে । আর আমি শরৎ সাহিত্য নিয়ে , দেশ পত্রিকা , খবরের কাগজ , রেডিও, আরো অন্যান্য নতুন কিছু যা পাই তাই নিয়ে ; আর সঙ্গে দুএক প্রস্থ গাইবাছুরের পরিচর্যায় আরো বেশি করে মনোনিবেশ করতে চেষ্টায় থাকলাম ।
সুজিত গোয়ালারা দুই ভাই পালা করে,অদলবদল করে , হাতে একগাছা দড়ি ঝুলিয়ে হন হন করে হেঁটে আসে । ঠিক যেন স্টেথোস্কোপের মতো এক হাতের মুঠির ভেতর পেঁচানো থাকে দড়িটা । যেটা দিয়ে দুধ দোহাই করবার সময় গোরুর দুই পায়ে বাঁধতে লাগে । সন্ধ্যা উৎরিয়ে গেলেও এ রাস্তা ও রাস্তা এ গলির মাঝে , বা অন্য গলির মুখ দিয়ে , তাদের দেখা যায় ঐ দড়ি গাছি নিয়ে হনহন করে ছুটছে ।
এ পাড়া ও পাড়া মিলে তাদের অনেকগুলি বাড়িতে বা ছোটোখাটো খাটাল গুলিতেও এই কাজ করতে হয় প্রতিদিন দুবেলা । ঝড়-জল-শীত -গ্রীষ্ম-বর্ষা সব কিছু পেরিয়েই করতে দেখি বেশ দায়িত্ব সহকারেই । তারা থাকে শুনেছি নেতাজী নগরের নারকোল বাগানের খাটালে । ওখানেই তাদের দেশওয়ালি ভাইয়েদের সঙ্গে একই সঙ্গে থাকে নাকি । শুনেছি ওখানেই নাকি তাদের আর এক ভাইয়ের একটি অংশে কয়েকটি গোরুমোষ রাখা আছে । এরকম কয়েকজনের মিলেমিশে বেশ কিছু গোরুমোষের একটি বড়সর খাটাল আছে তাদের । শুনেছি দেশেও তারা যৌথ সংসার জীবনযাপন করে নাকি । সেটা অবশ্য ঠিকই হয়ত , কারণ তা না হলে এইভাবে পালা করে তারা আসে কী করে ?
কেন জানিনা আমার মনে মনে তাদের এই মিল দেখে কোথাও একটা বিশেষ ভালোলাগা থাকে তাদের জন্যে । মাঝে মধ্যেই তাদের মুখ দিয়ে তাদের দেশের কথা শুনতাম । সঙ্গে সঙ্গে আমিও তাদের সঙ্গে মনে মনে চলে যেতাম তাদের সেই দেশ সমস্তিপুরে ।
আমাদের ওদেশের মানুষজন যেমন ফসলের উপর নির্ভর করে তাদের সকল বাঁচা মরা সামলায় এদেরও তেমনই খানিকটা যেন। এরাও জমিতে ক্ষেতে ধান আবজায়। গম । সঙ্গে আমাদের ওখানের মতো বাকি অনেক কিছুই আবাজায় তারা ক্ষেতে । তবে তাদের ওখানে একটি ফসল হয় যার চাষ তখনও পর্যন্ত ওদেশে হতে দেখিনি ।সেটা হলো ভুট্টা । এ ছাড়া সরিষা, মুসুর, খেসারি , ধনে , তিল সে সব সবই হয় শুনি আমাদের ঐ দেশের মতো । শুধু একটা জায়গায়ই পার্থক্য মনে হয় তারা আমাদের মতো তিনবেলা ভাত মাছ খায় না । সঙ্গে ছাতু রুটি এসবই বেশি খায় নাকি । মাছের চল সব সময় নেই । তার চেয়ে মাংসের চল আছে । আর একটা পার্থক্যও আছে, তাদের অঞ্চলে যেমন গরম তেমন শীত ৷ বাকি আর সবই আমাদের ওখানেরই মত । গল্পে গল্পে আমি তাদের সঙ্গে সঙ্গে মনে মনে যাতায়াত করি ৷তারাও কি করতে পারে আমার মুখে আমার দেশের কথা শুনে, তাতো জানি না !
এ অঞ্চলে অনেকগুলি খাটাল আছে । ওপাশে যেমন নাঞ্জিরা থাকে । তেমন গ্লাস কারখানার মাঠের সেই বাড়িগুলোতে দখল নিয়েছে এখন গনেশ , পাতিরাম , উগন গোয়ালারা । সকলেই এরা একত্রিত হয়ে ঐ পুরোনো গ্লাস কারখানার লম্বা করে টানা টালির চালার ঘরগুলির মধ্যে গোরু বাছুর মোষ সব কিছুই নিয়ে একজায়গায় পাশাপাশি বসবাস করে বেশ কিছু দিন হলো । ঐ পাশে হিরণ সরকারের মস্ত বড় আর এক কারখানা ছিলো আগে , পরে কিছুদিন নাট্যশালাও হতে দেখেছিলাম এক সময় ওদেশে চলে যাবার আগে । সেই নাট্যশালার চারধার ঘিরেও অনেক গোয়ালাদের বসবাস এখন। তা ছাড়াও আর একটু এগিয়ে একটি বড়সড় জলাশয়কে ঘিরে তার দুই পাড় জুড়েও ছোট ছোট ঘরদুয়ার । শুনি ওখানেও বসে গেছে নাকি অনেকগুলি খাটাল এক দল লোকের ।
আমাদের পরিবারের মত এ পাড়া ও পাড়া মিলে বেশ আরো কিছু আমাদের মতো গৃহস্থ বাঙালিরও এই বাড়তি উপার্জনের জন্যে গোরুবাছুর পোষা শুরু করেছে যে তা বিশেষ ভাবে দুটি জায়গা থেকে বুঝতে পারি ৷ এক , রমণী দার দোকানে যখন দানা ভুসি আনতে যাই । আর এক ভাবে বোঝা যায় যখন বাঁশদ্রোণী পোষ্ট অফিসের রাস্তায় খাল পাড়ে পণ্ডিতজির খড়ের গোলায় যাই ।
সন্ধ্যাবেলাগুলোতে বগলে কয়েকটি বস্তা নিয়ে , কেউ বা সাইকেলের কেরিয়ারে বাঁধিয়ে খড়ের বস্তাগুলি পণ্ডিতের গোলায় নিয়ে পৌঁছায় যখন ;-- আমি অবশ্য নিতাইএর রিক্সায় চড়ে একটি প্লাস্টিকের ব্যাগের মধ্যে ভালো করে গুছিয়ে পাকিয়ে বেশ একটা ভদ্রস্থ অবস্থায় নিয়ে যেয়ে পণ্ডিতজির ছেলের কাছে রেখে দিতে দিতে বলি , পাঁচ তরফা দিয়ে দিও সুরেন্দর ভাই ।
দু’বস্তায় চার তরফা হলে ঢিলেঢালা থাকে বস্তা । তাই পাঁচ তরফা হলে কিছুটা সাশ্রয় হয় এই জন্যে ।
এরপর খড় কাটা হয়ে গেলে নিতাই সেগুলি তার সময় মতো রিক্সায় করে পৌঁছে দিয়ে যাবে । আমি শুধু বস্তাগুলি পৌঁছে দিতে পারলেই খালাস ।
এর পরে আমি আর এই গোয়ালাদের গোষ্ঠিভুক্ত কেউ নই ।তখন আমি কোনো উকিল বাবুর ছেলের বন্ধু । বা কোনো সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ছেলের বন্ধু । পড়াশোনা করা ভদ্রলোকের ছেলেপেলেদেরই একজন । তখন আমি যেন বিকেলের পথে বেরিয়েছি এই সব পরিচয় লুকিয়ে রেখে দিয়ে ,কখন যেন মিশে যাই বাঁশদ্রোণী নেতাজিনগরের রাস্তায় যেভাবে আর পাঁচটা ছেলেপেলেরা বাইরের পথে সান্ধ্য ভ্রমনে বের হয় । আমিও তেমন ভাবেই ঘুরতে ঘুরতে কখনো দেখি বাড়ি বাড়ি , খাটালে , গোরু মোষ দোহাই করে সুজিত ভাই বা জটা ভাইও তার হাতের দড়িগাছি নিয়ে রাস্তা পার হয়ে চলে যাচ্ছে । আমাকে দেখে হয়তো জিজ্ঞাসা করলো , ‘ঘোরাঘুরি হচ্ছে ?’ দলের মধ্যে থেকেও সাড়া দিই , ‘ জটা ভাই , তোমার হলো ?’
পণ্ডিতের গোলায় আমি যেমন খড় বিচালি কাটতে দিয়ে নিজেকে মুক্ত করে একেবারে অন্য স্টাইলে বন্ধু সঙ্গ করি । জটা ভাইও তার গোরু দোহাই করার সময়ের বেড়
দিয়ে পেঁচিয়ে পরা পরনের গামছাটা খুলে ফেলে বেশ একটি ধুতি এবং গায়ে একটি পরিষ্কার জামা পরে গুটি গুটি চলেছে তার ডেরায় দেখি ।
*********************************************************************
আগামী পর্বে
*************************************************************************