বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৪

লেখা আহ্বান

  




স্বরবর্ণ

সৃজনের মৌলিক স্বর

স্বরবর্ণ * ৯  

########################################

সংখ্যাটির জন্য লেখা জমা নেওয়া হবে ১৫ মে , ২০২৪ পর্যন্ত। কী ধরণের লেখা, লেখা পাঠানোর ঠিকানা এবং অন্যান্য জরুরি তথ্য পাওয়া যাবে উপরের লিংকে।পত্রিকার নিয়ম বহিৰ্ভূত কোনো লেখা গ্রহণ করা হবে না। মনোনয়ন সাপেক্ষে নির্বাচিত লেখক তালিকা ১৬ মে সমাজ মাধ্যমে প্রকাশ করা হবে। পত্রিকা প্রকাশিত হবে ১৫ জুন । 

########################################


লেখা পাঠানোর আগে নীচের বিষয়গুলি নিশ্চিত হয়ে নিন -----

১.  স্বরবর্ণ দ্বিমাসিক ওয়েব ম্যাগাজিন । 

২. লেখা মনোনয়নের ব্যাপারে সম্পাদকমন্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

৩. প্রাপ্তি সংবাদ জানানো সম্ভব নয়। নিৰ্বাচিত লেখকসূচি আমরা একমাসের মধ্যে ফেসবুকে প্রকাশ করি । 

৪.পরবর্তী  সংখ্যার জন্য আপনার মৌলিক ও অপ্রকাশিত লেখা ( গল্প কবিতা প্রবন্ধ  অণুগল্প  অনুবাদ কবিতা  ভ্রমণ কাহিনি  ইত্যাদি  ) ১৫মে ০২৪ এর মধ্যে পাঠান । 

৫. শব্দসীমা অনির্দিষ্ট। 

৬. কবিতার ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুটি কবিতা পাঠাবেন।  

৭. লেখার সঙ্গে আপনার একটি ছবি এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, প্রকাশিত গ্রন্থ (থাকলে)  ছবিসহ পাঠান । 

৮. "স্বরবর্ণ " সামগ্রিক চিন্তার ফসল। আগে থেকে লেখা পাঠান। লেখা পাঠাবেন ওয়ার্ড ফাইলে, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ই-মেইল বডিতে টাইপ করে। পিডিএফ বা লেখার ছবি তুলে পাঠাবেন না।


* হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর   8777891532

*ই-মেইল --- debasishsaha610@gmail.com 


সম্পাদকমণ্ডলী                                             

ড : শুভঙ্কর দে           অলোক কোৱা

সৌম্যজিৎ দত্ত             দেবাশিস সাহা

রবিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২৪

‘স্বরবর্ণ-এ’ লেখার নিয়মাবলী

 



স্বরবর্ণ

সৃজনের মৌলিক স্বর

স্বরবর্ণ * ৯  

########################################

সংখ্যাটির জন্য লেখা জমা নেওয়া হবে ১৫ মে , ২০২৪ পর্যন্ত। কী ধরণের লেখা, লেখা পাঠানোর ঠিকানা এবং অন্যান্য জরুরি তথ্য পাওয়া যাবে উপরের লিংকে।পত্রিকার নিয়ম বহিৰ্ভূত কোনো লেখা গ্রহণ করা হবে না। মনোনয়ন সাপেক্ষে নির্বাচিত লেখক তালিকা ১৬ মে সমাজ মাধ্যমে প্রকাশ করা হবে। পত্রিকা প্রকাশিত হবে ১৫ জুন । 

########################################


লেখা পাঠানোর আগে নীচের বিষয়গুলি নিশ্চিত হয়ে নিন -----

১.  স্বরবর্ণ দ্বিমাসিক ওয়েব ম্যাগাজিন । 

২. লেখা মনোনয়নের ব্যাপারে সম্পাদকমন্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

৩. প্রাপ্তি সংবাদ জানানো সম্ভব নয়। নিৰ্বাচিত লেখকসূচি আমরা একমাসের মধ্যে ফেসবুকে প্রকাশ করি । 

৪.পরবর্তী  সংখ্যার জন্য আপনার মৌলিক ও অপ্রকাশিত লেখা ( গল্প কবিতা প্রবন্ধ  অণুগল্প  অনুবাদ কবিতা  ভ্রমণ কাহিনি  ইত্যাদি  ) ১৫মে ০২৪ এর মধ্যে পাঠান । 

৫. শব্দসীমা অনির্দিষ্ট। 

৬. কবিতার ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুটি কবিতা পাঠাবেন।  

৭. লেখার সঙ্গে আপনার একটি ছবি এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, প্রকাশিত গ্রন্থ (থাকলে)  ছবিসহ পাঠান । 

৮. "স্বরবর্ণ " সামগ্রিক চিন্তার ফসল। আগে থেকে লেখা পাঠান। লেখা পাঠাবেন ওয়ার্ড ফাইলে, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ই-মেইল বডিতে টাইপ করে। পিডিএফ বা লেখার ছবি তুলে পাঠাবেন না।


* হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর   8777891532

*ই-মেইল --- debasishsaha610@gmail.com 


সম্পাদকমণ্ডলী                                             

ড : শুভঙ্কর দে           অলোক কোৱা

সৌম্যজিৎ দত্ত             দেবাশিস সাহা

উপন্যাস * দীপংকর রায়

 




['স্বরবর্ণে'র চতুর্থ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে কবি দীপংকর রায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে '। এই উপন্যাস লেখকের ষোল-সতের বছর বয়সের কালপর্ব থেকে শুরু। যদিও লেখকের জন্ম এপার বাংলায়, কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে থেকেছে ওপার বাংলায়। কাজেই যাতায়াত থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ ছেড়ে চলে আসা আর তারই নাছোড় এক টানাটানির মধ্যে যে জীবনের ক্রমাগত আসা আর যাওয়া ,এই উপন্যাস মূলত তারই এক নির্মম নিষ্ঠুর ভাঙা-গড়ার আশ্চর্য কথোপকথন। ধারাবাহিকভাবে যা আমরা পড়ছি, কবি দীপংকর রায়ের মায়াময় কলমে।]



কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে 

পর্ব * ১৩   

দীপংকর রায়


 


মা বললো , হ্যাঁ , মাগরোয় গেছিলাম কেষ্ট মামার ওখানে ;সেখান থেকে  মিহিরগের ওখানেও গেছিলাম । গোপাল ছবিরা ওখানে ছিল তো , তাই এক বেলা ওগের ওখান থেকেও সকলের সঙ্গে দেখা করে এলাম । 

         জিজ্ঞাসা করলাম রাড়ীখালীর কথা । বললাম , তা তো হলো , রাড়ীখালীতে কালীপুজোয় সকলে একজায়গায় ছিলো তো এবার ? নাকি আবার দল পাকিয়েছে ?

        —-- না না , দল-টল নেই এখন;  সকলে মিলেই তো কাজকম্ম করলো দেখলাম ।

        —--- তাই নাকি ! তাহলে তো ভালো , সুবুদ্ধি হইছে কতি হবে ৷ সেবারে যা দেখিছিলাম , তাতিই তো মনে হইছিলো , আবারও না আলাদা হয়ে যায় ৷

           —- ছাড়ো ওসব , সে সব নিয়েও মারে একদিন কইছিলাম ,পুজো ওখেনে নিয়ে চলো । তোমার এখেনের মতো না হয় না হবে ৷ তবে খুব একটা খারাপও হবে না , এ কথা তোমারে জোর দিয়েই কতি পারি । তাতে তার কী কথা শুনবা ?

সে বলে কি জানো , তোমার ওখেনে ? তালিই হইছে ! তোমাগের দ্যাশের পুজো তো দেহিসি সেবারে ৷ওরে কি পুজো করা কয় ? ও আর কতি হবেনানে রে মণি ; যা সব অবস্থা তোমাদের ! খাইয়েদায়ে চা বিড়ি ফুকতি ফুকতি চোদ্দবার পুরুতঠাকুর নমো নমো করে ওঙবঙ আওড়াতি আওড়াতি কিছুক্ষণের মধ্যিই হয়ে গ্যালো সব…. ! শুধুই পোটলা বাঁধার তাল | ওরে কি কালীপুজো করা কয় , তুমিই কও?

নেহাত গন্ডগোলের মধ্যি বলে দেখতি পাইছিলাম ৷ .না হলি তো আর পাতাম না জানতি , এই সব ! 

আমি তাতে তারে এও কলাম , 

সে না হয় দরকার হলি পুরোহিত মামারে আমি পাসপোর্ট ভিসা করায়ে ঐ সময় ওদ্যাশেই নিয়ে যাবো ....

সে তাতি কী কয় সিডা শোনো একবার , .... সে না হয় নিলে, আচ্ছা , আমি ধরে নিলাম তাও , পাল কাকারে কী করবা ? সে তো আর তোমার ওখেনে যাবেনানে…?

       এর পর আমি আর কী কতি পারি তারে কও ? …. শোনো বাবা , তার নানা অজুহাত ; অজুহাতের আর শেষ নেই… ! ওঁ…, সে তো এবারে আর এক ফন্দি আঁটিছে ; তোমারে তো ওদেশে বিয়ে দেবার ফন্দি করতিছে ৷আমার কাছে তো একদিন শুনলো , হ্যাঁরে , জ্ঞানেনদিরির মাইয়েডা কি খারাপ ? আমি তো ভাবতিসি ওর মাইয়েডার সঙ্গেই তোমার বড়ো ছেলের বিয়ে দেবো । এখন তুমি ভালো করে ভাইবে-চিন্তে দেহে-শুনে ঠিক করো ,  কিছু ভুল কচ্ছি নাকি  ? 

      তাতে বললাম , সে কি মা ! তোমার নাতির বয়স কত , এখনি যে তার বিয়ের কথা ভাবতিছো?

    সে তাতি কী কয় আরো জানো? না না , এহনে না হয় না হবেনে; দু-চার বছর পরেই না হয় দিয়েনে; …..সে আমার কথাডা জ্ঞানেনদির ফেলবেনানে ; তাই , আমি যা কই সিডা তুমি ভালো ভাবে ভাইবে-চিন্তে দ্যাহো একবার ৷ তবে এহেনে যদি হ’ত তালি তো আমার সকল সমস্যারই সমাধান হয়ে যেত একরকম ৷ শোনো শোনো , একটা কথা কয়ে রাখি তোমারে , এইসব নিয়ে যত ভাববা ততোই কাকবাড়ে বাইছে আনবা ; তাই কচ্ছি , আমার কথাটা মানো ; আমি যেটা ক’তি চাচ্ছি সেটা বোঝো । তা না হলি পরে পস্তাবা ।  

 . তোমার দিদিমা এখন তোমার বিয়ে নিয়ে ভাবছে । এ দেশে আসার কথা নিয়ে নয় । এ দেশে আসা নিয়ে তার অত গরজ নেই কিছু । তুমিই বলো , আমি কি তার এইসব নিয়ে ভাবতে বসবো এখনি ? এখন দেখো বাবা , তুমি কি মনে করছো ? হ্যাঁ …. মেয়েটি কিন্তু খুব একটা খারাপ লাগেনি আমারও। জ্ঞানেনদির মামাও যদিও আঁচ পাইছে , এইসব নিয়ে কিছু একটা  । এবং সেই জন্যি একটু খাতির যত্নও করলো বেশ-ই বলা চলে।  সে করুক , তাই বলে তো আমি এখনি পাগল হতে পারি না মায়ের মতো ? সে না হয় তার সয়াল-সম্পত্তি রক্ষা করা নিয়ে এইসব অকাল বোধনের কথা ভাইবে বেড়াচ্ছে  ৷

      চুপ করে শুনছিলাম মায়ের কথা  আর হাসছিলাম মনেমনে । 

      যদিও সেই সব কৌতুকপ্রিয়তা সরিয়েই বললাম কিছুক্ষনের মধ্যেই — তাহলে তুমিও পাগল হলে নাকি ?

     — না না বাবা , একেবারেই না ৷একটুও পাগল হইনি ।কিন্তু দেখো, আমাগের মামিও বললো একই কথা —-  তা মণি ভালোই হবেনে ; ধরো জ্ঞনেনদিরির মাইয়েডাতো একেবারে ফেলে দেবার মতো না ৷ কাছাকাছির মধ্যি ? ,….  কাজডা করে ফেল গে মণি, আমিও কচ্ছি…. ।

      সব শুনে-মেলে মাকে বললাম -- তাহলে এর মধ্যিই পার্ষদবর্গও বেশ জুঠিয়ে ফেলিছে  বল? কী কও, তাই তো ? …. মোটামুটি একটা সোরগোল বাধায়ে নাচা-কোদাও শুরু হয়ে গেছে কতি পারো একেবারে ৷

     তা শুনে মা বললো , সে সব কি তোমার অজানা ? ওখানকার মানুষজনদের হাবভাব সবই তো তোমার জানা । নির্মলা মাসিমাও — দিদিমাও —- সকলেরই একই অভিমত , তারাও আমাকে ডাইকে বলতি লাগলো  — ভালোই হবেনে রে মণি , তুমি মাইনে নেও । শোনো , এই মেয়েডারে যদি তুমি নিতি পারো, তাহলি মানুষ করে নিতি পারবা। দুডো ভাতজল পাবা ।‌ দেশের মেয়ে তো !যেমন নম্র সভ্য তেমন দেখতিশুনতিও তো একেবারে ফেলায়ে দেবার মতোন নয় ?

      মার মুখে এইসব শুনে সত্যিই সত্যিই আমি হতবাক হয়ে যাইনি একটুও । দিদিমার এধরণের চিন্তা-ভাবনা ছিলো যে , তা জানতাম,  এর আগে অনেকগুলো ঘটনা নিয়েই — কিন্তু সেটা যে এরকম একটা রূপ নিয়েছে ইতিমধ্যেই , সেটা ভাবতে পারিনি ৷ এ ধরণের চিন্তাভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে ফেলেছে সে যে এর মধ্যেই , এত তাড়াতাড়ি —- সেটাও ভাবতে পারিনি । তাই , পাকাপাকি একটা বন্দবস্ত চাইছে যে সে , মাকে এবারে কাছাকাছি পেয়ে , সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না একটুও ।

       সুশীলা মাসি এই সব কথাবার্তা এতক্ষণ ধরে কান পেতে শুনে‌, সেও বলে , তা দিদি ভালোই তো হবে , মেয়েটা দেখতে শুনতে যখন  ভালো। তা যদি হয় তাহলে তুমি এককথায়

বউমা করে নিয়ে আসতেই পারো ৷

      সুশীলা মাসি আরো কতো কথাই না বলতে চায় যেন ! একেবারে পরিতৃপ্তির সঙ্গে দুপা ছড়িয়ে , চায়ের গেলাসের ভেতরে রুটি পাকিয়ে চুবিয়ে নিতে নিতে , হুশহাশ করতে করতে চা খেতে খেতে যেন আরো কিছু একটা রুগীর নিদান দিয়ে দিতে পারার কথাই বলতে লাগলো ; সে একেবারে পাকা ডাক্তার বাবুর গলায় এই বিষয়ে নানা অনুসঙ্গ টেনে এনে রুগীর ঔষধ পথ্য সব একেবারে বাতলে দিতে লাগলো । মাকে একেবারে বুঝিয়ে বুঝিয়ে বলতে লাগলো যেন কত ভাবে , কাজটা তুমি করে ফেলো গে দিদি ৷ 

        গঙ্গাপুরী থেকে এখানে উঠে আসার . পর থেকে সে এ বাড়ির ঠিকে কাজ করে । কিন্তু ঠিকে কাজের লোক হলে কী হবে — এর আগে রাত্রে খাবার রুটি-টুটিও করে দিয়ে যেতো —-সে সেই একাত্তরেরর পরের থেকেই পাকাপাকি । সকালবেলায় সে যেখানে যে বাড়িতেই কাজ করুক না কেন , সকালের চাটা সে এখানে এসেই খায় —- একেবারে বারান্দার পিলারে হেলান দিয়ে বসে রুটি পাকিয়ে পাকিয়ে চায়ের গেলাসের মধ্যে চোবাবে আর বকবক করতে করতে চা পান করবে । আর সে  আজকের এই বিষয়টায় বেশ মজা পেয়ে গেছে  যেন ! তাই সেটাকে ছেড়ে সে আর নড়তে চাইছে না একেবারেই । আর এই আলোচনা তো এখানেই থেমে থাকবে না ! সে তো এবারে সারা পাড়া ছড়িয়ে পড়বে বেশ ঘটা করে । এ বাড়িতে তো কোনো আড়াল আবডাল বলে কিছু নেই ! যদিও কোনোকালেই ছিলো না সে সবের কোনো বালাই । আজকে মাও একেবারে তার সামনেই সব খুলে বলে ফেললো দেখে ,  আমার আরো লজ্জা হতে লাগলো । কারণ এইরকম একটা বিষয় পেলে এদের কাজকম্মে বেশ একটা অন্য জোর চলে আসে এটা তো ঠিক ! এই সবেতেই পরম শান্তি তাদেরও |এর পর এই বাড়ির কথা ঐ বাড়িতে রসিয়ে রসিয়ে বলে বেড়ানোতে আরো আনন্দ  ৷ 

          খুব অদ্ভুত লাগতে লাগলো সবটা ভেবেই । ভাবতে লাগলাম সত্যিই তো একটা ঝামেলার বিষয় হয়ে দাঁড়ালো এই বিবাহ প্রসঙ্গটা নিয়ে ৷ শেষে কিনা জ্ঞানেনদির দার মেয়েকে আমাকে বিয়ে করতে হবে ?

এই তো সেদিন দেখলাম তাকে , একগাদা বইপত্র হাতে করে রাড়ীখালীর স্কুল মুখো হেলতে দুলতে চলেছে ! শেষে কিনা তাকেই বিয়ে করতে হবে ? শেষে কিনা জ্ঞানেনদির দাকে শ্বশুর মশাই ভাবতে হবে ? যে মানুষটির সঙ্গে এই তো কিছুদিন আগে এদেশে আসার পরিকল্পনা করে মেহেরপুর বর্ডার পর্যন্ত পৌঁছেও, শেষে  সীমানা পেরোনো হয়েছিল না সেবারে । কিন্তু কই , তখনো কি ভাবতে পারা গেছিল এরকম একটা বিষয় ? দিদিমার এইরকম একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা যত ভাবছি ততোই একটা মন হাসছে । আবার একটি মন শুধুই ভাবছে , শেষে কি এমন একটা 

বিষয় মেনে নিতে হবে তার সিদ্ধান্ত মতো ?

           জীবনের নানা বাঁক । কখন কোন ঘটনা যে কার উপর দিয়ে কেমন ভাবে নেমে আসে , সে সব নিয়ে ভাবতে বসলে কোনো কূলকিনারা খুঁজে পাওয়া যায় না ।

          ভাবছি , এরপরে ওদেশে গেলে আমার অবস্থাটা কী হবে ? পাড়ার ভেতর দিয়ে কি স্বাভাবিক ভাবে হাঁটতে পারবো আগের মতোন ? সেভাবে কি সব বাড়িতে খুব সোজা ভাবে দাঁড়িয়ে তাঁদের কুশল জেনেই শুধু সরে আসতে পারবো ? কেউ কি ছাড়বে এই বিষয়টা নিয়ে আমার ইচ্ছা অনিচ্ছার কথাটি না জেনে তারা ? তখনকার অবস্থাটা কেমন হবে আমার , সেটা যতো ভাবছি ততোই চুপসে যাচ্ছি  ।

       ঘরের ভেতর থেকে এই সব শুনে ভাইয়ের  ঘুম ভেঙে গেল । সে বলতে শুরু করলো এবারে , শোন দাদা , আমি কিন্তু ওকে একেবারে বউদি বলে ডেকেই এসেছি ; — আরে , একবার খাইয়ে দেখিস খানে , তোর হবু শ্বশুরমশাই কী সুন্দর নলেন গুড়ের প্যারা সন্দেশ বেঁধে দিয়েছে । খাঁটি দুধের প্যারা । আরে , আমারেও যা খাতির-যত্ন করেছে না ওরা — তা বলার নয় ৷ সে সব পেলে তুইও না গলে যেয়ে পারতিস না ৷ বড্ড মায়া লাগছিলো আসার সময় জানিস ! ওদের খুব আগ্রহ দেখলাম! সে  তুই না দেখলে , কথা না রেখে পারতিস না, এ আমি কয়ে রাখলাম এখনই । 

         —- তাহলি শুনলে তো আমার কথা ঠিক কিনা ? তাই তো আমিও আর পারলাম না । তবু ঐটুকু বাধায়ে রাখে আসলাম । আসার সময় জ্ঞানেনদির মামার বউ তো একেবারে নদীর ঘাট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে আসতে আসতে আমার হাত দুখানা ধরে একেবারে বলতি লাগলো , ও মণি , একটু ভাইবে দেখো তাহলি ভালোভাবে ৷আমার তো প্রথম মেয়ে , তবু সে না হয় দুই চার বছর দেরি হয় হোক না ! সে একটু দেরি করতি হয় করবানে ! একেবারে এখনেই সাততাড়াতাড়ি কিছু নেই অত ; তবে তোমার মণির সঙ্গে একবার একটু কথাবার্তা কয়ে একটা পাকা কথাবার্তা করে রাখলিই আমরা নিশ্চিন্ত হবানে , এই যা ।

         মণি মানে , আমার পছন্দ অপছন্দের কথা নিয়ে বলছে । সেই কথাটিই মা জ্ঞানেনদির দার মুখের কথা বসিয়ে এখানে বলে গেল ।

         মণি, ওদেশের ছেলেমেয়েদের আহ্লাদ করে ডাকা একটি সম্বোধন। সে ছেলে হলেও ‘ মণি ’ মেয়ে হলেও ‘ মণি ’ । এটাই ধরণ । নাম ধরে বলে না কেউই সব সময় । 

      আমি ওদের এই সব পরিকল্পনার কথা শুনে নিজের মনে নিজে একটা কথাই ভাবতে থাকলাম , জীবন কি তাহলে এই সব অকাল সিদ্ধান্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেল এখনই ?

         দিদিমার এই সব অত্যন্ত বিষয়ী চিন্তাভাবনা বরাবরই আমাকে ক্লান্ত করে ফেলেছে আগেও । সে যে এই সব ভাবনা চিন্তার পেছনে কোন বিচক্ষণতার নিদর্শন রাখছে , তা তো আমি ভালো ভাবেই জানি । সে যে কী হিসেব মেলাতে চাইছে , তাও আমি বুঝতে পারছি । কিন্তু সে যে কতটা জটিল করে ফেলছে‌ সবটা, তা সে কোনোদিনই বুঝতে চায় না , তার চিন্তা ভাবনার বাইরে যেয়ে‌ ।


        সেদিনের সেই সকালবেলাটি সত্যি সত্যিই ছিলো বেশ খানিকটা তাৎপর্যপূর্ণ ।

          এক দিকে ভাই প্রায় বছর কাটিয়ে দিয়ে ফিরে এলো । আর এক দিকে মা , সেও তার জন্মভূমিতে কতকাল পরে গেল যে , সে কথা কি মনে আছে তার ?

         যদিও এইসব  সব কিছুর গল্প আরো ভালো হতে পারত , কিন্তু সে সব বলা-কওয়া না হয়ে , এমন একটা বিষয় ঢুকে পড়লো এর ভেতরে , যাতে একেবারে সবটা গন্ডগোল পাকিয়ে ছাড়লো । শুধু পাকিয়েই ছাড়লো না ; এর প্রভাব যে কত দূর গড়াবে , সেটা তো এখনি সবটা ভাবতে পারছি না ৷ আমার কাছে সবটা বেশ হাসির হলেও ওদের কাছে সেটা না । 

          কোথায় আমি কি সব ভেবে বেড়াচ্ছি ,  আর এরা ? এরা কিনা আমার বিয়ে দেবে কীভাবে , তাই নিয়ে সোরগোল বাধিয়ে দিয়ে চলে এলো ?

           এই সব এখনি ভাবতে হবে তা কি ভেবেছি কখনো ? গতকালকেও কি জানতাম আজকে এই সব নিয়ে ভেবে বেড়াতে হবে ? অথচ দেখ আমার তো কত কথাই মার কাছে জানবার ছিলো! জিজ্ঞাসা করবার ছিল । সে কীরকম দেখে এলো সব কিছু ? এতবছর পরে সে তার জন্মভূমিতে গেল , তাতে তার অনুভব কেমন হলো ? তার কতটা উচ্ছাস আজ মায়ের গলায় শুনতে পাবো আমি ,  আমার তো সেটাই ছিলো মার কাছে জানার । অথচ দ্যাখো , এমন একটা বিষয় নিয়ে সাতসকালে ঝাঁপি খুলে বসলো লোকজনের মাঝে মা — এই সব কি ভাবতে পেরেছিলাম, এই সব কিছু বিষয় হয়ে উঠবে এমন ভাবে ? সব কিছু আজকে কেমন যেন গুলিয়ে গেল । এরপরে মাকে কি আর এসব নিয়ে প্রসঙ্গ তুলতে পারি আমি ? যতোই যা বলি না কেন ঘুরে-ফিরে বিষয় চলে যাবে হয়তো ঐ দিকেই । অথচ আমার তো কত কিছু জানার ছিলো । সেই যে সে , যেসব অনেক কাল আগে দেখে এসেছে , তারপরে এত ঝক্কি-ঝামেলা কাটিয়ে সেই দেশটা যখন একটু একটু করে আবার গড়ে উঠছে , সেই সব পার্থক্যগুলো তো মায়ের কাছে অন্য রকমের অবশ্যই ! সেই নবগঙ্গাও আর আগের মায়ের দেখা নবগঙ্গার মতো নেই ৷সেই তার মুখে শোনা যে গতিবিধির কথা আগে জেনেছি , সেকি আর এখন তেমনটা আছে ? কিম্বা জীবনযাপনেও তো মানুষের কত পরিবর্তন এখন! সে সব মায়ের কাছে কেমনভাবে ধরা দিলো ? এই যেমন , দিদিমার কাছে ওখানকার যে জঙ্গলাকীর্ণ দিনগুলির কথা শুনেছি , সেটাই তো মায়ের কাছে শুনে আগে মেলাতে পারিনি ! বা রসিক দাদুর মুখে যে গল্প শুনেছি , তার সঙ্গে কি আমার দেখা ঐ দেশটার প্রকৃতি মেলাতে পেরেছি আমি কোনোদিনও ? সেসব শুনতে শুনতে তো কত অচেনা লাগতো ঐ প্রকৃতিকে ! আজ তো আমার মায়ের চোখ দিয়ে দেখা তার এতদিন পরের অভিজ্ঞতার কথাগুলিই জানবার ছিল ! তা না সে এসব কী বিষয় সকাল সকাল বলে,  সব কিছুই একেবারে মাটি করে দিলো ! আমি তো আরো একটা কথা শুনবো ভেবেছিলাম , আচ্ছা, নতুন মামিমা কি তার কাছে একবারও শুনেছে আমার কথা ? নাকি কল্যাণী শুনেছে একবারও আমার বিষয়ে কোনো কিছু ? সে কি শুনেছে ,  আমার এখনো মাছ ধরার বাতিক আছে কিনা ? 

          কই , মাতো সে সব নিয়ে একবারও কোনো কিছুই বললো না ! বললো না , এই , মীরা কিন্তু বারবার তোর কথা শুনেছিলো । কল্যাণী কিন্তু ঘুরে ফিরে আমার কাছে বারবার জিজ্ঞাসা করেছিলো , ও পিসি , সে কি ওদ্যাশে যাইয়ে এখনো মাছ ধরতিসে নাকি ?….. কিম্বা রসিক দাদুর কথাও তো কিছুই বললো না‌ মা ! 

          ভাবলাম ,  বলবে হয়তো এরপরে আস্তে আস্তে সে সব কিছু । এখন , এই মুহূর্তে , যেটা একেবারে জ্যান্ত এবং গরম গরম বিষয় , তারা হয়তো সেই সব নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বেশি ! তাই ঐ সব বিষয়গুলোই আজকে পরিবেশিত হলো । পরে হয়তো আস্তে আস্তে অন্যগুলো সব বলবে ৷

             যদিও এই সব আলোচনার মধ্যে আমি তো আর জিজ্ঞাসা করতে পারি না , সেই সব বিষয় নিয়ে কিছু ? তাই আশায় আশায় চেয়ে বসে থাকলাম এই ভেবে , মা হয়ত পরে অন্য কোনোদিন আমার মনের কথাগুলি ঠিকই বলবে একে একে । তারা কি আর আমার কথা জিজ্ঞাসা না করে কেউ থাকতে পারে ! অন্তত কেউ না জিজ্ঞাসা করুক , এরা , এই কজন অন্তত ঠিকই জিজ্ঞাসা করেছে ৷  অন্তত একবারের জন্যে হলেও আমার কথাটা যে — সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি  ।

            শুরু হয়ে গেল আবার আগের মতো মায়ের অফিস । ভাইও তার পুরোনো স্কুলে ফিরে গেল । পাশের পাড়ার আমবাগান থেকে নিতাই দা বলে একজন নতুন প্রাইভেট টিউটর আসতে লাগলো তাকে টিউশন পড়াতে । আর আমি শরৎ সাহিত্য নিয়ে , দেশ পত্রিকা , খবরের কাগজ , রেডিও, আরো অন্যান্য নতুন কিছু যা পাই তাই নিয়ে ;  আর সঙ্গে দুএক প্রস্থ গাইবাছুরের পরিচর্যায় আরো বেশি করে মনোনিবেশ করতে চেষ্টায় থাকলাম । 

        সুজিত গোয়ালারা দুই ভাই  পালা করে,অদলবদল করে , হাতে একগাছা দড়ি  ঝুলিয়ে হন হন করে হেঁটে আসে । ঠিক যেন স্টেথোস্কোপের মতো এক হাতের মুঠির ভেতর পেঁচানো থাকে দড়িটা । যেটা দিয়ে দুধ দোহাই করবার সময় গোরুর দুই পায়ে বাঁধতে লাগে । সন্ধ্যা উৎরিয়ে গেলেও এ রাস্তা ও রাস্তা এ গলির মাঝে , বা অন্য গলির মুখ দিয়ে , তাদের দেখা যায় ঐ দড়ি গাছি নিয়ে হনহন করে  ছুটছে । 

এ পাড়া ও পাড়া মিলে তাদের অনেকগুলি বাড়িতে বা ছোটোখাটো খাটাল গুলিতেও এই কাজ করতে হয় প্রতিদিন দুবেলা  । ঝড়-জল-শীত -গ্রীষ্ম-বর্ষা সব কিছু পেরিয়েই করতে দেখি  বেশ দায়িত্ব সহকারেই । তারা থাকে শুনেছি নেতাজী নগরের নারকোল বাগানের খাটালে । ওখানেই তাদের দেশওয়ালি ভাইয়েদের সঙ্গে একই সঙ্গে থাকে নাকি । শুনেছি ওখানেই নাকি তাদের আর এক ভাইয়ের একটি অংশে কয়েকটি গোরুমোষ রাখা আছে । এরকম কয়েকজনের মিলেমিশে বেশ কিছু গোরুমোষের একটি বড়সর খাটাল আছে তাদের । শুনেছি দেশেও তারা যৌথ সংসার জীবনযাপন করে নাকি  । সেটা অবশ্য ঠিকই হয়ত , কারণ তা না হলে এইভাবে পালা করে তারা আসে কী করে ? 

       কেন জানিনা আমার মনে মনে তাদের এই মিল দেখে কোথাও একটা বিশেষ ভালোলাগা থাকে তাদের জন্যে । মাঝে মধ্যেই তাদের মুখ দিয়ে তাদের দেশের কথা শুনতাম । সঙ্গে সঙ্গে আমিও তাদের সঙ্গে মনে মনে চলে যেতাম তাদের সেই দেশ সমস্তিপুরে । 

          আমাদের ওদেশের মানুষজন যেমন ফসলের উপর নির্ভর করে তাদের সকল বাঁচা মরা সামলায়  এদেরও তেমনই খানিকটা যেন। এরাও জমিতে ক্ষেতে ধান আবজায়। গম । সঙ্গে আমাদের ওখানের মতো বাকি অনেক কিছুই আবাজায় তারা ক্ষেতে । তবে তাদের ওখানে একটি ফসল হয় যার চাষ তখনও পর্যন্ত ওদেশে হতে দেখিনি ।সেটা হলো ভুট্টা । এ ছাড়া সরিষা, মুসুর, খেসারি , ধনে , তিল সে সব সবই হয় শুনি আমাদের ঐ দেশের মতো । শুধু একটা জায়গায়ই পার্থক্য মনে হয় তারা আমাদের মতো তিনবেলা ভাত মাছ খায় না । সঙ্গে ছাতু রুটি এসবই বেশি খায় নাকি । মাছের চল সব সময় নেই । তার চেয়ে মাংসের চল আছে । আর একটা পার্থক্যও আছে, তাদের অঞ্চলে যেমন গরম তেমন শীত ৷ বাকি আর সবই আমাদের ওখানেরই মত । গল্পে গল্পে আমি তাদের সঙ্গে সঙ্গে মনে মনে যাতায়াত করি ৷তারাও কি করতে পারে  আমার মুখে আমার দেশের কথা শুনে, তাতো জানি না ! 


         এ অঞ্চলে অনেকগুলি খাটাল আছে । ওপাশে যেমন নাঞ্জিরা থাকে । তেমন গ্লাস কারখানার মাঠের সেই বাড়িগুলোতে দখল নিয়েছে এখন গনেশ , পাতিরাম , উগন গোয়ালারা । সকলেই এরা একত্রিত হয়ে ঐ পুরোনো গ্লাস কারখানার লম্বা করে টানা টালির চালার ঘরগুলির মধ্যে গোরু বাছুর মোষ সব কিছুই নিয়ে একজায়গায় পাশাপাশি বসবাস করে বেশ কিছু দিন হলো । ঐ পাশে হিরণ সরকারের মস্ত বড় আর এক কারখানা ছিলো আগে , পরে কিছুদিন নাট্যশালাও হতে দেখেছিলাম এক সময় ওদেশে চলে যাবার আগে । সেই নাট্যশালার চারধার ঘিরেও অনেক গোয়ালাদের বসবাস এখন। তা ছাড়াও আর একটু এগিয়ে একটি বড়সড় জলাশয়কে ঘিরে তার দুই পাড় জুড়েও ছোট ছোট ঘরদুয়ার । শুনি ওখানেও বসে গেছে নাকি অনেকগুলি খাটাল এক দল লোকের । 

      আমাদের পরিবারের মত এ পাড়া ও পাড়া মিলে বেশ আরো কিছু আমাদের মতো গৃহস্থ বাঙালিরও এই বাড়তি উপার্জনের জন্যে গোরুবাছুর পোষা শুরু করেছে যে তা বিশেষ ভাবে দুটি জায়গা থেকে বুঝতে পারি ৷ এক , রমণী দার দোকানে যখন দানা ভুসি আনতে যাই । আর এক ভাবে বোঝা যায় যখন বাঁশদ্রোণী পোষ্ট অফিসের রাস্তায় খাল পাড়ে পণ্ডিতজির খড়ের গোলায় যাই ।

 সন্ধ্যাবেলাগুলোতে বগলে কয়েকটি বস্তা নিয়ে , কেউ বা সাইকেলের কেরিয়ারে বাঁধিয়ে খড়ের বস্তাগুলি পণ্ডিতের গোলায় নিয়ে পৌঁছায় যখন ;-- আমি অবশ্য নিতাইএর রিক্সায় চড়ে একটি প্লাস্টিকের ব্যাগের মধ্যে ভালো করে গুছিয়ে পাকিয়ে বেশ একটা ভদ্রস্থ অবস্থায় নিয়ে যেয়ে পণ্ডিতজির ছেলের কাছে রেখে দিতে দিতে বলি , পাঁচ তরফা দিয়ে দিও সুরেন্দর ভাই । 

        দু’বস্তায় চার তরফা হলে ঢিলেঢালা থাকে বস্তা । তাই পাঁচ তরফা হলে কিছুটা সাশ্রয় হয় এই জন্যে । 

       এরপর খড় কাটা হয়ে গেলে নিতাই সেগুলি তার সময় মতো রিক্সায় করে পৌঁছে দিয়ে যাবে । আমি শুধু বস্তাগুলি পৌঁছে দিতে পারলেই খালাস । 

          এর পরে আমি আর এই গোয়ালাদের গোষ্ঠিভুক্ত কেউ নই ।তখন আমি কোনো উকিল বাবুর ছেলের বন্ধু । বা কোনো সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ছেলের বন্ধু । পড়াশোনা করা ভদ্রলোকের ছেলেপেলেদেরই একজন । তখন আমি যেন বিকেলের পথে বেরিয়েছি এই সব পরিচয় লুকিয়ে রেখে দিয়ে ,কখন যেন মিশে যাই বাঁশদ্রোণী নেতাজিনগরের রাস্তায় যেভাবে আর পাঁচটা ছেলেপেলেরা বাইরের পথে সান্ধ্য ভ্রমনে বের হয় । আমিও তেমন ভাবেই ঘুরতে ঘুরতে কখনো দেখি বাড়ি বাড়ি , খাটালে ,  গোরু মোষ দোহাই করে সুজিত ভাই বা জটা  ভাইও তার হাতের দড়িগাছি নিয়ে রাস্তা পার হয়ে চলে যাচ্ছে । আমাকে দেখে হয়তো জিজ্ঞাসা করলো , ‘ঘোরাঘুরি হচ্ছে ?’ দলের মধ্যে থেকেও সাড়া দিই , ‘ জটা ভাই  , তোমার হলো ?’

       পণ্ডিতের গোলায় আমি যেমন খড় বিচালি কাটতে দিয়ে নিজেকে মুক্ত করে একেবারে অন্য স্টাইলে বন্ধু সঙ্গ করি । জটা ভাইও তার গোরু দোহাই করার সময়ের বেড়

দিয়ে পেঁচিয়ে পরা পরনের গামছাটা খুলে ফেলে বেশ একটি ধুতি এবং গায়ে একটি পরিষ্কার জামা পরে গুটি গুটি চলেছে তার ডেরায় দেখি ।




*********************************************************************

আগামী পর্বে 

*************************************************************************

বিকাশ চন্দ

 


বিকাশ চন্দ * দুটি কবিতা 



পুণ্যি পুকুরের জলে বিষের যন্ত্রণা 
 
শরীর জড়িয়ে বাঁচি দু'হাতে মানুষের প্রার্থনায়
অগুনতি আহুতি কালে ভেসে যায় নক্ষত্রের গান
বুক ভাসানো সমর্পণের খেলায় বেড়ে ওঠে জীবনের ঋন
উজানী সময়ে অনন্ত ঘূর্ণি ডাকে কক্ষ পথে
ভাসানী সময়ে জড়িয়ে গাঙচিল-পালকের নরম উত্তাপে
সকল ধর্মাধর্ম বেঁধে রাখি অচেনা জাতিকা আঁচলে 

কোন শুভ লগ্ন এঁকে ছিল জন্ম ঠিকুজী কে জানে
মড়ক মরশুমে আমাদের ভেতরে ও আত্মা ভাঙে বিন্দু বিন্দু 
কুণ্ডলী পাকানো পদ্ম নাভি পোড়ে জ্বলে নম্র বৃত্তের ছায়ায়
ঘরে বাইরে অসহ্য অসুখ বেঁচে থাকে আত্মার উত্তাপে
আযানে সান্ধ্য উজানে নশ্বর হৃদয় খোঁজে অমৃত আলো
চিত্রিত পাথরে স্তব্ধতা খোঁজে বিমূর্ত সময়ের শ্বাস 

সকল ঋতু কাল শেখায় বেঁচে থাকার কসরত 
উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সীমারেখা ডাকে নিশীথ বিলাস
বেঁচে  থাকার অস্থির রাতে শুয়ে সকালের লাশ
অচ্ছুৎ শরীর বুকে কান পেতে কে শোনে আত্মার ঘ্রাণ 
খাঁচার পাখিও জানে নিষিদ্ধ সময়ে স্থির ব্যাধের নিশানা
হৃদয় জুড়ে এখন পুণ্যি পুকুরের জলে বিষের যন্ত্রণা






















বিচ্ছিন্ন চিত্রকলা 

জ্যোতির্ময় সময় জানে ভেঙেছে স্থিরচিত্র আত্মার ভেতর
অসংখ্য টুকরো টুকরো সঙ্গীত ছুঁয়েছে হৃদয় অসুখ
স্বপ্ন মেঘ বৃষ্টি মেলামেশা অফুরান মায়া টান
শরীর পাঁজর উজাড় জড়িয়ে মানব মানবী দেওয়াল
অথচ কেউ কেউ টেনে নিয়ে যায় রাতের গুহায় 
পরিত্রাণের স্বর হারায় জল জমি জিরেতে
ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে ঈশ্বর ঈশ্বরী ছিন্ন শরীর 
ঘিরে আছে সুন্দরী অরণ্য আর জল পাখি পালক

রাতের আগুনের ফুলকি উল্কি আঁকে অদ্ভুত মায়ায়
বিচ্ছিন্ন সময়ে কেবলই কি অশৌচ হাতে স্পর্শের অধিকার
উপচানো নদী জল ভাসানী বেলায় চর আঁচল ভেজায়
দাঁড়াবার মাটি কেড়ে নেয় রাতের সংকেত 
ঝলসে যাওয়া শরীর ছুঁয়ে অশ্রুত কান্না ভাঙে কথা ঘর
বিহ্বল বাতাসে অক্ষত মহিমা ভেসে যায় চৈতন্য গোধূলি 

আড়ালে রয়েছে উর্ধ্ব তর্জনী উন্মুখ হিংস্র জহ্লাদেরা 
প্রলুব্ধ বন্ধুদেরও চেনা মুখ বদলে যায় একাকী 
হিংসা হীন সকল প্রতিবেশী ঘিরে রাখে উষ্ণ অনুভূতি 
কেউ বলে পুনরুদ্ধার নাকি বেজোড় মানচিত্রে বিচ্ছিন্ন চিত্রকলা 




******************************************************************



বিকাশ চন্দ 

 জন্ম ১লা এপ্রিল ১৯৫৫
লেখা শুরু ১৯৭২ থেকেই। গল্প, কবিতা, কাব্য নাটক,
গল্প, প্রবন্ধ নিয়ে এখনো জীবনচর্যা। প্রকাশিত 
কাব্যগ্রন্থ  :  বীজে অঙ্কুরে বিনষ্ট শিকড়ে ২০০৭,
বর্ণবিহীন বর্ণবিকাশ ২০১৬, ঋতু বদলের ছবি ২০১৭,
আকাশ গঙ্গায় নক্ষত্র ভেলা ২০১৭, বিষণ্ণ দ্রোহ কাল ২০১৮,
শূন্য শরীরে স্থপতির হাত ১৪২৫, সাদা ফুলের কফিন ২০২০,
অনুচ্চারিত শব্দের কোলাহল ১৪২৭, হৃদয় বাঁচে আত্মার 
আড়ালে ১৪২৮, প্রকাশ অপেক্ষায় : কাব্য নাটক "ঝিনুকের
চোখে মুক্তা জল " কাব্যগ্রন্থ "কোন যতি চিহ্ন নেই, শরীরী দেয়ালে আলোর স্তব ২০২২,
জন্মের হৃদপিণ্ডে জীবন আঁকি ২০২৩। 
 প্রকাশ অপেক্ষায় " ছেঁড়া মানচিত্রের চিঠি"। 
কাব্যনাট্য - ঝিনুকের চোখে মুক্ত জল ২০২১। 
কলম আঁকড়ে বেঁচে থাকার প্রয়াসেই কালাতিপাত।

বিকাশ চন্দ 

 জন্ম ১লা এপ্রিল ১৯৫৫
লেখা শুরু ১৯৭২ থেকেই। গল্প, কবিতা, কাব্য নাটক,
গল্প, প্রবন্ধ নিয়ে এখনো জীবনচর্যা। প্রকাশিত 
কাব্যগ্রন্থ  :  বীজে অঙ্কুরে বিনষ্ট শিকড়ে ২০০৭,
বর্ণবিহীন বর্ণবিকাশ ২০১৬, ঋতু বদলের ছবি ২০১৭,
আকাশ গঙ্গায় নক্ষত্র ভেলা ২০১৭, বিষণ্ণ দ্রোহ কাল ২০১৮,
শূন্য শরীরে স্থপতির হাত ১৪২৫, সাদা ফুলের কফিন ২০২০,
অনুচ্চারিত শব্দের কোলাহল ১৪২৭, হৃদয় বাঁচে আত্মার 
আড়ালে ১৪২৮, প্রকাশ অপেক্ষায় : কাব্য নাটক "ঝিনুকের
চোখে মুক্তা জল " কাব্যগ্রন্থ "কোন যতি চিহ্ন নেই, শরীরী দেয়ালে আলোর স্তব ২০২২,
জন্মের হৃদপিণ্ডে জীবন আঁকি ২০২৩। 
 প্রকাশ অপেক্ষায় " ছেঁড়া মানচিত্রের চিঠি"। 
কাব্যনাট্য - ঝিনুকের চোখে মুক্ত জল ২০২১। 
কলম আঁকড়ে বেঁচে থাকার প্রয়াসেই কালাতিপাত।


শনিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২৪

অণুগল্প * প্রদীপ কুমার দে


 


উপরে চলে যান

প্রদীপ কুমার দে


অমর একুশে। নানা প্রান্তে নানান গ্রুপের শহীদ স্মরণের অনুষ্ঠান হচ্ছে। একজন মানুষ একপ্রান্ত সেরে অন্যপ্রান্তে শহীদ বেদীতে ফুল দিয়ে ভাষণ দিয়ে ছুটছে। ঠিক পুজোর দিনের পুরোহিতদের মত। সকলের মন রাখতে হবে যে....


ক্লান্ত হৃদয়ে শেষ অনুষ্ঠানে হাজির। অনুষ্ঠান বাড়ির নীচে রাস্তায় গভীর শ্রদ্ধার সাথে মিটিং শুরু হল। ফুল মালা দিয়ে বেদীতে সাদাময় করে তোলা হল। শোকাবহ পরিবেশ। শহীদদের জন্য শোক প্রকাশ হচ্ছে। মনটা বড় দুর্বল। শরীর প্রায় ছেড়ে যাই যাই করছে! রোগবালাই অর্থকষ্টে মৃতপ্রায়। এর মধ্যেই একমিনিটের নীরবতা পালন হল। 


সবাই সেই দিনের কথা ভেবে ভেবে দুঃখে কাতর! মহিলা সম্প্রদায়ের শরীর কালো অথবা সাদা শাড়িতে বেদনাবিধুর। মালা দিতে গিয়ে অনেক বয়স্কা কেঁদেও ফেললেন। নেতারা ভাষণে অনেক তথ্য দিলেন, বার বার বুঝিয়ে দিলেন আজ শোকের দিন,

--  বীরেরা আমাদের মাতৃভাষা রক্ষার্থে প্রান দিলেন, আজ তাদের কথা মনে রেখে আমাদেরও আরো কিছু করে দেখাতে হবে, আমাদের সকলকেই যেতে হবে আপনারাও দয়া করে একে একে উপরে চলে যান,  ওখানেই বাকী .....


পুরোকথা শেষ হল না,সবাইয়ের মত আমিও চমকে গেলাম, বলে কি?

আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বয়স্ক মহিলা কেটে পড়তে চাইলেন।

বেশী না হলেও আমার মত অনেক বোকাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।

আর ওক মহিলা বলেই বসলেন,

--  নাতিটাকে যে বড় করতে হবে। ছেলে বৌমা দুজনেই যে চাকরি করে .....?


পরিস্থিতি গোলমেলে দেখে কে একজন মাইকে ঘোষণা করে দিলেন,

--  সিঁড়ি দিয়ে উপরের ছাদে চলে যান, আরো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এখনও যে বাকী,ওখানেই হবে ......












***********************************************************************************************************



প্রদীপ কুমার দে 

লেখক  নেশায়। পেশা ছিল হিসেবনিকেশ।  বয়স -৬২ । কলকাতা নিবাসী। বিবাহিত।
নিজের লেখা কয়েকটি বই আছে।



অণুগল্প * মালা ঘোষ মিত্র


 


ভাবনা   

মালা ঘোষ মিত্র


পায়েলের দুচোখে জল, সুজাতা তো তার নিজের মেয়ের থেকেও বেশি। দুই ছেলেকে মানুষ করার জন্য দীর্ঘ জীবন সংগ্রাম করতে হয়েছেপায়েলকে। দীর্ঘ ১০ বছর আগে দুই ছেলেকে বাপের বাড়ি রেখে এই বোবা, অর্থব মেয়েকে দেখভালের কাজ নিয়েছে। বিনিময়ে মোটা টাকা পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু কঠোর পরিশ্রম, এতোটুকু পান থেকে চুন খসতে দেননি। হাসিমুখে সংসারের যাবতীয় কাজ করেছে। দাদাবৌদি নিশ্চিতে এক বিশ্বস্ত নারীর ওপর ভরসা করেছে। দুদন্ড বিশ্রাম করতেও পারিনি। সুজাতা অমনি মনিমা,মনিমা করে ডেকে উঠেছে।এই 'মনিমা'ছাড়া ও তো কিছুই বলতে পারে না।ওরচোখে কি গভীর আকুতি-----। 

পায়েলদেবীর জীবনসংগ্রামে ছেলেদুটি পড়াশোনা করছে কিন্তু কঠোরপরিশ্রম, বয়স তো হচ্ছে, কবে যে ছেলে দুটো একটু দাঁড়াবে, সমাজে প্রতিষ্ঠিতা পাবে , দীর্ঘশ্বাস বাতাসে ওড়ে------। 












**************************************************************************************************



মালা ঘোষ মিত্র


 কোড়ার বাগান বনগ্রাম, উওর ২৪ পরগণা
থেকে লিখছেন 
পিতা- কালীপদ ঘোষ  মাতা- মায়া রাণী ঘোষ।
জন্মস্থান--বনগ্রাম।
শিক্ষাগত যোগ্যতা----- বাংলায় অনার্স, এম.এ,
বি. এড (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়)
দেশে বিদেশে প্রচুর লেখা
প্রকাশিত হয়েছে,
নিজ কবিতা লিখতে, কবিতা পড়তে ও সাহিত্য চর্চা করতে ভালোবাসেন।

অণুগল্প * দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়




পলাশে খিদের রঙ 

দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়



সারা বছর অপেক্ষা দোলের এই কটা দিনের জন্য।।ভুবনডাঙ্গার মাঠের মুখটায় বুবলা গাড়ি দাঁড় করালো।করিমচাচার দোকানে এককাপ এলাচ চা খেতে দাঁড়াই প্রতিবার।দেখি রাস্তায় পলাশের মালা বিক্রি করতে একটা মেয়ে ছুটছে পথচলতি গাড়ির পিছনে । ছেঁড়া জামা,খালি পা, সারা মুখ খিদেমাখা।। হঠাৎ মেয়েটি পলাশের মালা বাড়িয়ে বলে উঠলো :" নাও না গো একটা মালা। তুমি মালা কিনলে মায়ের জন্য ওষুধ কিনতে পারবো। মায়ের খুব জ্বর কদিন ধরে "।বুকের ভেতর একটা মোচড় দিয়ে উঠলো।ওর হাতে পাঁচশো টাকার একটা নোট দিয়ে বললাম:"মায়ের জন্য ওষুধ আর তোদের বাড়ির সকলের জন্য কিছু খাবার কিনে নিয়ে যাস"।

মেয়েটা একমুখ হাসি নিয়ে দৌড় লাগালো। অবাক বিস্ময়ে দেখলাম একমুখ লম্বা দাড়ির আমার ঈশ্বর হাসছেন পলাশের রঙে।




************************************************************************************************


দেবাশীষ মুখোপাধ্যায় 

 রয়েল কমপ্লেক্স ,কাঠালবাগান ,উত্তর পাড়া, হুগলী থেকে লিখছেন পেশা: শিক্ষকতা ,নেশা : কলম চারিতা ,সাপলুডো খেলা শব্দ নিয়ে ,অণুগল্প ,ছোট গল্প ,কবিতা, প্রবন্ধে  সুখ-দুঃখ ,হর্ষ-বিষাদ, আড়ি ভাবের অনুভবে থাকা ,জীবনের দুই স্তম্ভ রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দের আদর্শ মনন, যাপন ও শীলনে.. স্বপ্ন: পৃথিবীকে ভালবাসার যৌথ খামার বানানো..দিক চক্রবালে হিরণ্যগর্ভ আলোর খোঁজ ..পাখি ,গাছ আকাশের সাথে মন কি বাত.. সূর্যের নরম আলোয় সুখের আবিরে মানুষের সাথে হোলি খেলা..


                

অণুগল্ল * প্রভাত ভট্টাচার্য

 

ণুগল্প সাহিত্যের একটি বিস্ময়কর শাখা। ' বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন ?' ঠিক তাও নয় যেন, বিন্দুতে সপ্তসিন্ধু দশ দিগন্ত চকিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সার্থক অণুগল্পে। তেমনই একটি অসাধারণ অণুগল্প এবার আমরা পড়ছি ----


রাজপুত্তুর

প্রভাত ভট্টাচার্য 



রাজপুত্তুর বেরিয়েছে দেশভ্রমণে । এই প্রথমবার সে সুযোগ পেয়েছে বেরোবার। লোকলস্কর কাউকে সঙ্গে নেয় নি। একা ঘোরার ব্যাপারটাই আলাদা। 

     সন্ধে নেমে আসছে। এবারে একটু বিশ্রাম নেওয়া দরকার। সামনে জঙ্গল। আশেপাশে বাড়িঘরদোর কিছু নেই। একটা বড় গাছ দেখে তাতে উঠে বসল সে। পছন্দমতো জায়গায় বসে নিজেকে গাছের সঙ্গে বেঁধে নিল সে। অনেক কিছুর সঙ্গে সঙ্গে গাছে চড়াটাও সে শিখে নিয়েছে। 

    ক্ষিধেও পেয়েছে বেশ। সঙ্গে কিছু খাবার ছিল, খেয়ে নিল সে। 

    ওপরের ডালে বসে সবই দেখছিল ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী । আজ কতদিন পরে আবার রাজপুত্তুর এলো। 

    ও যে রাজপুত্তুর বুঝলে কি করে?  ব্যাঙ্গমা বলল। 

    সাজপোষাক নাই বা থাকলো, আমি সব বুঝতে পারি। 

   রাজপুত্তুরের কিন্তু অনেক কিছু করার আছে। 

    জানি । রাক্ষস রাক্ষসীরা এখন অন্য রূপ ধারণ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর যতরকমের অনিষ্ট করছে। 

    আর তাদের প্রাণভোমরা? 

    সে তো রাজপুত্তুরকেই খুঁজে বার করতে হবে আর তাদের দমন করতে হবে। 

   ও কি পারবে? 

    ঠিক পারবে। 

   রাজপুত্তুর এতক্ষণ সব শুনছিল। কি করতে হবে, বুঝে গেছে সে। 

   ভোর হয়ে গেছে । আকাশে উঁকি দিচ্ছে নতুন সূর্যের আলো। 

   গাছ থেকে নেমে পড়ল রাজপুত্তুর । সামনে বিরাট লক্ষ্য। ঝলসে উঠলো তরোয়াল।









************************************"**************************************************************



প্রভাত ভট্টাচার্য  

তিনি সব্যসাচী--- এক হাতে সামলান চিকিৎসকের গুরুভার দায়িত্ব আর এক হাতে ফোটান সাহিত্য সৃষ্টির ফুল। দ্য হার্ট, মিশন পসিবল, মাই ডটার, রাজবাড়িতে রক্তপাত , ডিটেক্টিভ সূর্য এবং কবিতা সংকলন - কাগজের মানুষ এবং ফিনিক্স পাখি তাঁর উজ্জ্বল সাহিত্যসৃষ্টি । সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর  তিনটি ভিন্ন ধরনের উপন্যাস - দশভুজা, কাগজের মানুষ ও মায়াবী গ্রাম। এছাড়াও তাঁর আর একটি মনভোলানো সৃষ্টি 'গুহা মানবের ডায়েরি'  


প্রবন্ধ * তুষার ভট্টাচার্য



বিস্মৃত কল্লোল যুগের কবি মণীশ ঘটক ( যুবনাশ্ব ) 

তুষার ভট্টাচার্য                


''আরে কে ও স্যাঙাৎ যুবনাশ্ব না ? শালা তোমার আমলের আর কেউ বেঁচে নেই এই অধম ছাড়া।'' 

'মান্ধাতার বাবার আমল' স্মৃতিকথা গ্রন্থে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করেছিলেন কল্লোল যুগের প্রথম মশালচি কবি মণীশ ঘটক ( যুবনাশ্ব - ১৯০২---১৯৭৯ )। একজন শক্তিশালী কবি হিসেবে, কল্লোল যুগের প্রথম সারির কবি হিসেবে পরিচিতি থাকা সত্বেও তিনি একালের বাংলা সাহিত্যের  বিশাল আঙিনায় বিস্মৃত হয়ে গেলেন ।

তাঁর কন্যা প্রখ্যাত লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী 'বর্তিকা' পত্রিকার একটি সংখ্যা ' মণীশ ঘটক' সংখ্যা হিসেবে প্রকাশ করেছিলেন ।

তাঁর জন্মশতবর্ষে বহরমপুরের দু'একটি পত্রিকাও প্রকাশ করেছিল মণীশ ঘটক সংখ্যা । এরপরে মণীশ ঘটককে নিয়ে কোথাও তেমন করে প্রাসঙ্গিক আলোচনা আদৌ হয়নি । তাঁর উপরে প্রচারের আলোও তেমন করে আর পড়েনি ।

                     লেখকদের প্রসঙ্গে  একদা রুশ সাহিত্যিক ম্যাক্সি গোর্কি বলেছিলেন -  'লেখক হচ্ছেন তাঁর দেশের ও শ্রেণীর ভাবপ্রবণ মুখপাত্র । তাঁদের চোখ, কান ও হৃদয় তিনি । লেখক হচ্ছেন তাঁর সমকালের কণ্ঠস্বর'।

                               কল্লোল যুগের কবি মণীশ ঘটককে বিচার করতে গেলে দেখা যায় যে, তাঁর সমস্ত কবিতা, উপন্যাস, স্মৃতি কথা এবং আত্মজীবনীতে সমকালীন সময়ের অর্থাৎ কালের কণ্ঠস্বর , উচ্চারণের একটি ঝোঁক লক্ষ্য করা যায় ।তিনি তাঁর সময়কে ,পারিপার্শ্বিককে অবহেলা করতে পারেননি।যদিও তিনি আদ্যন্ত রোম্যান্টিক মেজাজের ছিলেন ।কিন্তু তাঁর কবিতায় যখন ধ্বনিত হয় -

   'চোখ বুজলে সব দেখতে পাওয়ার

    ক্ষমতা কেড়ে নিও না ;

    বন্ধ চোখের পাতার তলায়

    মনের দরজা যেন খোলা থাকে।'

এখানে কবির আর্তি, সামগ্রিকভাবে সমস্ত মানুষের আর্তি হিসেবে পরিগণিত হয় ।এখানে তিনি রোম্যান্টিক মেজাজের কবি নন, তিনি সাধারণ মানুষের কবি হয়ে ওঠেন এক লহমায় । যে ক'জন সাহসী যুবক লেখক, কবির দল আজ থেকে কয়েক দশক আগে , গতানুগতিকতার গন্ডীর বাইরে গিয়ে ভিন্নতর মূল্যবোধের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য রবীন্দ্রনাথ থেকে অন্যতর প্রবাহে বাংলা সাহিত্যকে বইয়ে দিতে এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন মণীশ ঘটক ।

                                 গল্প, উপন্যাস, স্মৃতিকথার মধ্যে দিয়ে তিনি গদ্য সাহিত্যে যেমন নিজস্বতা বা স্বাতন্ত্রের পরিচয় দিয়েছেন, ঠিক তেমনই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ও পরবর্তী বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের মূল্যবোধের বহুমুখী অবক্ষয় বা ভাঙনের প্রেক্ষিতে কাব্যসাহিত্যেও তিনি একটি স্বতন্ত্র সুর বা কণ্ঠস্বরের পরিচয় স্পষ্ট করে রেখে গেছেন । বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের সাহিত্য বিলাসকে ,তিনি একেবারে মাটির কাছাকাছি পৌঁছে দেবার যে প্রয়াস সমগ্র লেখনীর মাধ্যমে নিয়েছিলেন, ত্রিশের দশকে , তা পটল ডাঙার পাঁচালীর মধ্যে দিয়ে শুরু হয় ।পরবর্তী জীবনেও সেই ধারা অব্যাহত তাঁর সমস্ত লেখায় ফুটে উঠেছে ।

                    বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের নীচতা ,ক্ষুদ্রতা, ভীরুতা, লোভ, খর্বতা যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আবিল পরিবেশে সমস্ত মানবিক মূল্যবোধ , মননকে ভিতর থেকে কুরে কুরে ধ্বংস করছিল তখনই মণীশ ঘটক তাঁর নির্মোহ ঋজুতার সঙ্গে অপ্রিয় সত্যভাষণের মাধ্যমে সেগুলিকে উন্মোচিত করে দিচ্ছিলেন এবং নির্মম ব্যঙ্গের কশাঘাতে পিউরিটান  মানসিকতা স্বর্বস্ব বাঙালি মধ্যবিত্তের ছোট হয়ে আসা মনের গন্ডীকে ভেঙে চুরমার করে দিতে বরাবর  সচেষ্ট ছিলেন  তিনি ।

               যদিও কবি মণীশ ঘটক কখনও জীবনের প্রতি আশাবাদ হারাননি ।তাঁর কবিতায় ( একটি বিশাল গাছ, অকুণ্ঠ প্রেম, আগুন ওদের প্রাণ, দুঃখী দরিদ্র দুর্বল, রক্তবীজ, বাঘের ছানা, যা ইচ্ছে তাই, অনর্গল রক্তপাত, যদ্দিন না, আত্ম সমীক্ষা, কী করেছ যাও বলে, যুবনাশ্ব না ? ) প্রেম, প্রকৃতি এবং জীবনের প্রতি অকুণ্ঠ আশা, প্রত্যয় ফুটে উঠেছে বিভিন্ন চিত্রকল্প এবং রূপকের আড়ালে ।


   দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও সচেতন মননের প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর বিভিন্ন কবিতায় ।১৯৬৭ সালে তিনি শাসকদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লিখলেন 'জন্মাষ্টমী' কবিতা । গদি সর্বস্বতার মোহের বিরুদ্ধে তাঁর সতর্ক উচ্চারণ  - ' যুদ্ধ হোক যুদ্ধ হোক',  ভন্ড সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার  লেখনী - 'স্বাধীনতা', 'পাপীকেও ঘৃণা করো', 'দোস্ত তাদের জাগাও', 'এদের চিনে রাখো' , 'ঘোড়সওয়ার' , 'গৃহ নেই' , 'এসেছে লগ্ন' প্রভৃতি কবিতার মধ্যে দিয়ে একজন সমাজ সচেতন কবি হিসেবে বাংলা সাহিত্যে তাঁর একটি আলাদা স্বতন্ত্ররূপ প্রকাশ পেয়েছে ।

বস্তুত, দুটি বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ের আর্থ- সামাজিক টানাপোড়েনের পটভূমিকায় বাংলা সাহিত্যে কল্লোল যুগের সূচনা । কল্লোল যুগের অধিকাংশ লেখকই ছিলেন অত্যন্ত সমাজ সচেতন ।কল্লোল যুগের লেখকদের  লেখনীতে রোম্যান্টিকতার অনাবশ্যক বিলাস ছিলনা। তাই তাঁদের লেখায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে।ত্তর বাঙালি সমাজের সার্বিক অবক্ষয়ের চালচিত্রই নিপুন কলমে  ফুটে উঠেছে ।

           মণীশ ঘটক কল্লোল যুগের প্রথম মশালচি  হিসেবে তাঁর লেখার টানটা ছিল নিচুতলার মানুষের জীবনের বিভিন্ন পারিপার্শ্বিকতার দিকে ।তাঁর 'পটলডাঙার পাঁচালীর' সচেতন সাহিত্যায়ন সমগ্র বাংলা কথাসাহিত্যে নিসন্দেহে পথিকৃৎ এর ভূমিকা নিয়েছে ।

               মণীশ ঘটকের গল্প, উপন্যাস, স্মৃতি কথায় ছড়িয়ে আছে তিনটি ভিন্নমুখী ধারা ।একদিকে পটলডাঙা - কলকাতার ভিখারী গুন্ডা, বস্তিবাসীদের আন্ডার ওয়ার্ল্ড,যার ছবি তিনি এঁকেছেন অবক্ষয়ী জীবনের প্রতি সমমর্মী দুঃখবোধ থেকে ।

এর বিপরীতে কলকাতার বাঙালি অভিজাত সমাজের ছবি তিনি তুলে ধরেছেন যেখানে মানবিকতার লেশ মাত্র নেই ।আছে শুধু অর্থের আস্ফালন ।ত্রিশ- চল্লিশের দশকে বাঙালি অভিজাত ধনী সমাজের দেশজ সংস্কৃতির মূল প্রবাহ ও মূল্যবোধ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করতে করতে একধরনের কৃত্তিমতার খোলসে নিজেদের গন্ডীবদ্ধ ও অবরুদ্ধ করার প্রক্রিয়াকে তীব্র ব্যঙ্গ, বিদ্রূপে কশাঘাত করেছেন মণীশ ঘটক ।

তাঁর স্মৃতিমূলক আত্ম জৈবনিক গ্রন্থ  ' মান্ধাতার বাবার আমল' এ মণীশ ঘটকের লেখার তৃতীয় ধারাটি হচ্ছে সাধারণ মানুষের জীবনচরিত এবং তার সঙ্গে বাংলার রূপকথা, লোককথার আবেগ উদ্ভাসিত যন্ত্রণার বাস্তব আখ্যানপর্ব ।

'কনখল' উপন্যাসটি এই তৃতীয় ধারার উজ্জ্বল নিদর্শন, এই উপন্যাসে লোক সমাজের অন্তর্নিহিত জীবনীশক্তি যা প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার কথা বলে, যাতে মানুষের জীবনের শুদ্ধতার এক অপরিসীম আলোক সন্ধান রয়েছে, যা কিনা মেকি নাগরিক জীবনের সম্পূর্ণ বাইরে এসে, বাল্যজীবনের নির্মল কোমলতার স্মৃতিবিলাসের কাব্যিক মেজাজে 'কনখল ' উপন্যাস  হয়ে উঠেছে লোকায়ত জীবনের এক অপূর্ব আখ্যানপর্ব । যেখানে মানুষ কখনও মনুষ্যত্ব হারায় না । এই উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রই  বেঁচে থাকার কথা বলে ।

            প্রসঙ্গত, মণীশ ঘটকের সমস্ত লেখনীতেই ছিল তারুণ্যের স্পর্ধা ও দীপ্তির মাধুর্য । সমকালের কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয়ে ছিল তাঁর কবিতায়, স্মৃতিকথায় ।ছদ্মনাম যুবনাশ্বর লেখনী ছিল ব্যঙ্গ বিদ্রূপে ভরা ,সমাজের বিভিন্ন অবক্ষয়, কৃত্তিম উন্নাসিকতা, মেকি অনুশাসন প্রভৃতির বিরুদ্ধে তীব্র কশাঘাত ।

                              অত্যন্ত আক্ষেপের বিষয় , বর্তমানকালের বাংলা সাহিত্যের পাঠকরা কবি লেখক মণীশ ঘটকের নাম তেমন করে জানেন না । তিনি বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় অনালোচিতই থেকে গেলেন ।কল্লোল যুগে যাঁরা অগ্রণী কবি সাহিত্যিক  ছিলেন, তাঁদের কারও থেকে মণীশ ঘটকের প্রতিভা কম ছিল না ।আসলে তিনি তেমন করে প্রাতিষ্ঠানিক প্রচার পাননি । এই আধুনিক প্রচারসর্বস্ব যুগে তেমনভাবে  প্রচার না পেলে  সাহিত্যের পাঠকরা জানবেন কীভাবে কল্লোল যুগের শক্তিমান কবি মণীশ ঘটকের লেখালেখির অন্তর্লীন জগতের কথা !

বাংলা সাহিত্যে কত প্রতিভাবান কবি, সাহিত্যিক সামান্য প্রচারের আলো না পেয়ে হারিয়ে গিয়েছে তার হিসেব আর কে রাখে । 

গ্রন্থ সূত্র : শিলালিপি  (কাব্য গ্রন্থ ),পটল ডাঙার পাঁচালী ( গল্প গ্রন্থ ),কনখল ( উপন্যাস ), বিদূষীবাক ( কাব্য গ্রন্থ ),নামায়ন  ( কবিতা গ্রন্থ ),যুবনাশ্বের নেরুদা ( অনুবাদ গ্রন্থ ),এক চক্রা ( কবিতা গ্রন্থ ) এবং মান্ধাতার বাবার আমল ( স্মৃতি কথা )।


















*******************************************************************************************************



     তুষার ভট্টাচাৰ্য


তুষার ভট্টাচাৰ্যর জন্ম ১৯৬২ সালে মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে l স্নাতকোত্তর পাশ  ( কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়  ) সরকারি কর্মী l দীর্ঘদিন ধরে কবিতা লেখেন l সিগনেট প্রেস থেকে ২ টি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে l

প্রবন্ধ * স্বপন নাথ




মহাদেশীয় উদ্বেগ ও মনীষী ভাবনা 







স্বপন নাথ 

ধর্ম যেন ক্লাব সংগঠন। মেম্বার ছাড়া প্রবেশ নিষেধ । তফাৎ শুধু এই যে : একটির সূচনা পাড়ার মাচা। অন্যটির নিগঢ় জাতিতত্ত্বের শেকড় । উৎস কিন্তু একই । অনিশ্চয়তা । এই নিয়েই " উপমহাদেশীয়  উদ্বেগ ও মণীষী ভাবনা"।

 বিশিষ্ট জার্মান দার্শনিক শোপেনহাওয়ার বলেছেন, "আশ্রয়হীনতা থেকে ঈশ্বরের সৃষ্টি ।" অর্থাৎ ঈশ্বর গড আল্লা যে যে নামেই ডাকি না কেন , সেই একই পরমের  অনৈস্বর্গীক অস্তিত্ব সম্পর্কিত  ইজম বা মতবাদ পুষ্ট করেছে ধর্মকে। আর সেই অনিশ্চয়তা জাত ধর্মের আচরণসর্বস্বতার প্রতিযোগিতা নিয়েই সাম্প্রদায়িক মারপিট , দাঙ্গা , রক্ত ক্ষরণ , যুদ্ধ । 

গোটা বিশ্ব যতবার বৈরী বিদ্বেষে জ্বলে পুড়ে খাক হয়েছে, এবং বর্তমান সময় সারণির ভিতর যা হিমশীতল প্রবাহে, দূর্বোধ্য স্নায়ুরোগের মতো কাঁপিয়ে দিচ্ছে -- মন , মেজাজ , মানসিকতা তথা সভ্যতার ভীত :  তা হলো এই ধর্মের নামে ঘৃণ্য বেসাতি ।

এ প্রসঙ্গে তুলে নেব  স্বয়ং প্রবর্তক হৃদয়ের কান্না কুড়োনো বিশিষ্ট মণীষীদের হৃদয় চঞ্চলতার দুঃখ জল । এবং দেখে নেব চলমান বর্তমানের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত লাগবার ফন্দি ফিকিরি অজুহাতের কুলুপ রংমশাল । তার  আগে আর একটু মুখ বাড়িয়ে  দেখি উভয়ের লক্ষ্যও কিন্তু   একই এবং অদ্বিতীয়। তা হলো মান্যতা। অধিকার আদায়ের সংহতি । উন্নতি ।

এখন প্রশ্ন  কেমন  উন্নতি  ? কিসের এতো  ক্রীচ্ছসাধন ? যাতে প্রাণ যায় যাক। জেহাদ !

মোক্ষলাভ ? 

সে তো দূস্তর ব্যাপার ! ঘষে মেজে রপ্ত করা যায় না তা । মোক্ষের মানুষেরা জন্মায়।তবে যে চৌকাঠ ডিঙ্গলেই এতো মোক্ষ মোক্ষ সাজ ? এতো যে গগন বিদারি মোক্ষ মোক্ষ আওয়াজ ? তাহলে কি স্রেফ সেফগার্ড ? ক্ষমতার বিস্তার ? নৈয়ায়িক শৃঙ্খলে টান টান  উন্নয়ন বিষয়ক ফরমান সেকি শুধুই বৈষয়িক?নাকি আত্মিক ? 

 বৈষয়িক উন্নতি স্থানান্তর ঘটায়। আত্মিক উন্নতি মনান্তর । বিষয়টি একটু খোলসা করা যাক। ধরো কোনো অপ্রাপ্ত কিশোর পৈতৃক সম্পত্তি পেল প্রচুর । তিনি  পড়া শোনাকে কচু দেখিয়ে সম্পত্তি বিক্রি করলেন। প্রচুর অর্থ পেলেন। প্রাসাদোপম বাড়ি বানালেন। দু চাকা, চারচাকা করলেন। দু চারজন পেটোয়া বানালেন। মোড়ের মাথায় একটা দোকান বা কিছু  একটা অর্থ  উপার্জনের ব্যবস্থা করলেন। কিংবা ওসব কিছুই করলেন না ।জমি বিক্রির সব টাকা ব্যাঙ্কে জমা রেখে মাসিক সুদে স্বাচ্ছন্দ্য রাখলেন। অথবা দাদাগিরি টাইপের কিছু একটা । কিংবা সেটাও করলেন না ।কিন্তু জলের সমোচ্চশীলতা মেনে কড়ার জলটুকুও কাউকে দিলেন না। অর্থাৎ ছিন্ন বেশ রাজবেশ হলো বটে কিন্তু মন যে তিমিরে সেই তিমিরেই । এক কথায়  স্থানান্তর হয়েছে ঠিকিই মনান্তর হয়নি।

এর ঠিক বিপরীতে একজন নিঃস্ব । প্রচুর দুঃখ কষ্ট মাথায় নিয়ে পড়াশোনা করলেন। সাধ্যমতো পরিশ্রম করে একটা চাকরি । কিংবা দু বেলা দু মুঠো অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা করলেন। তেঁতুল পাতায় ন জন হয়ে বসবাস করলেন। জীব জড়ের সংহতি বজায় রেখে মানুষের কল্যাণ কর্মে নিযুক্ত থাকলেন সাধ্যমতো । তো বলা যায় বৈষয়িক  উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা হলেও আত্মিক উন্নতি বা স্থানান্তরের সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা  মনান্তরও হয়েছে ।

 এই আত্মিক  উন্নতির পলকা হাওয়া আধ্যাত্মিক শব্দটিকেও যেন কিঞ্চিত সাযুজ্য দিয়ে যাচ্ছে ।কিন্তু ঠিক কী তাই ? বিস্তর ফারাক ।কারণ বৈষয়িক উন্নতির তৃপ্তি  আসে ভোগে ।আর ভোগের তারতম্যের কারণেই হিংসা । হিংসা থেকেই লড়াই । অধিকার বলবৎ করার রক্ত ক্ষরণ। আগ্রাসন ।

এইখানে এসে থমকে যাই নিজেই । প্রশ্ন জাগে মনে । ত্রিকালোজ্ঞ ঋষি তুল্য  দৃষ্টিতে ভবিষ্য ভয়াবহ পরিণাম কী ধরা পড়েনি ? তা তো হবার নয় । তাহলে  এমন একটা মারনঘাতী শক্তিকে ধর্মের প্রবর্তক গণ দানা বাঁধতে দিলেন কেন ? আচরণসর্বস্বতার নিগঢ়ে বাঁধলেন কেন ?

 আসলে গঠন পর্বের প্রাক লগ্নে প্রকৃতি শাসিত লোকসাধারণ , দিশেহারা , নীতিহারা   মানহারা, গৃহহারা, ছিন্ন ভিন্ন । কাজেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা স্থানিকদের একটা আশ্রয় দেওয়া, ভরসা দেওয়াই প্রাথমিক ও প্রধান  কাজ। একটা সংহতি দান করাই ছিল প্রধান লক্ষ্য ।


এখানে বলে নেওয়া ভালো , ধর্মের প্রবরপ্রবর্তক গণও তো রক্ত মাংসের মানুষ । তাঁরাও তো আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভোগা লোক হতে পারে ? কেননা এক দিনেই তো লক্ষ লক্ষ  অনুগত  ভক্ত মণ্ডলীর বিশাল সাম্রাজ্যের শিরোমণি হয়ে জাননি তাঁরা । তাই সিম্বোলাইজড করে দলভূক্তের সংখ্যা দেখে তৃপ্তি , এবং জোটবদ্ধ শক্তি দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার একটা দার্শনিক বার্তা কাজ করেছে ভিতের ভিতরে। এ কথা কী বলা যায় না ?  এও তো একটা বিচক্ষণতা ।   

অবশ্য  একথা অনস্বীকার্য যে বিশ্বাত্মাবোধে উদ্বুদ্ধ মানুষের হৃদয় বিগলিত বিবেকী চেতনাই   চালিত করে দেশের জন্য দশের জন্য নিজেকে   উৎস্বর্গীকৃত করতে।

ফলে কল্পলোকের ঈশ্বর, গড, আল্লা যাই বলি না কেন তাঁর  আশীর্বাদ ধন্য সামিয়ানার নিচে অনুগত করার নানা প্রকার নীতি নির্দেশনা  ও তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার ফতোয়া  জারি প্রবর্তক গণের কাছে অত্যাবশ্যক ছিল ।

বোধগম্য হলো না বলছো?  রাজনীতির বাস্তবতায় আসা যাক । সেখানে  দেখছি কী ? না , কোনো একজন মুখ্যমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রীত্বকালে নিজের প্রচারের জন্য কিছু প্রকল্প ঘোষণা করে ছিলো  । এবং সরকারি , আধাসরকারি কিংবা সরকার পোষিত সব সংস্থার রং লাল করে ছিলো । এবার  সরকার বদল হলো। নতুন দলের নতুন মুখ্যমন্ত্রী কার্যভার নেওয়ার পরও দেখলো সবই আগের মতো  লাল ---লাল---! আত্মশ্লাঘায় লাগলো । তো দাও আরো কিছু উপচে পড়ার মতো প্রকল্প ।যাতে আগের জনকে টপকে যায় । এবং একটা অর্ডার , 'পথে নেমেই যেন আর দেখতে না হয় লাল ; দাও সবে নীল--নীল -- করে ।' করে দেওয়া হলো । নিজের একটা আইডেন্টিটি তৈরী হলো ।  আমরা "ক' অক্ষর গো মাংস " পাঠ  প্রতিক্রিয়ায় অক্ষম । তাই চোখে দেখেই যাতে বুঝতে পারি ঐ চিহ্ন কার স্বাক্ষর বহন করছে। তবেই না সার্থকতা । নিজেকে প্রতিষ্ঠা  ! মনে হয় এভাবেই ধর্মের আইডেণ্টিটির প্রতিষ্ঠা।

যাক সে কথা। এই বিচক্ষণতা তো খারাপ নয়। দোষেরও নয়। অবশ্য সেটা বিচার্য নয়। কিন্তু আচরণসর্বস্বতার অভ্যাস বলতে মনে পড়ে গেল  সদ্য প্রয়াত কবি শঙ্খ ঘোষের সেই বিখ্যাত পংকতি যুগল ----  "মদ খেয়ে তো মাতাল হতো সবাই/ কবিই শুধু নিজের জোরে মাতাল ।" অর্থাৎ আচরণসর্বস্বতার মদ খেয়ে নকল ধার্মিক সাজা যায় বটে । কিন্তু প্রকৃত ধার্মিক হওয়া যায় না। 

গঠন পর্বে সেকথা না হয় বাদই দিলাম । একটা জাতি তো সংস্কার পেল ! এটাই যথেষ্ট ।

এইভাবেই তপোবনীয় ভারতবর্ষের লক্ষ লক্ষ বৈদান্তিক ঋষীর সংস্কার নিয়ে বরিষ্ঠ সনাতন হিন্দু সমাজ। পরবর্তীতে সে ঠাঁই দিয়েছে শক হূল দল পাঠান মোগল। খ্রিস্টান জরথ্রুস্টিও এবং ইসলাম ধর্মকেও তাঁর যোগ্য মর্যাদায় সম্মান দিয়েছে । এবং কবিগুরুর ভাষায়  ভারতবর্ষ  এক সুবিশাল " তীর্থনীড়ে"পরিণত হয়েছে। 

কালক্রমে ভারতীয় সভ্যতার বহুত্ববাদী সনাতন হিন্দু ধর্ম বহু ধারায়  বৌদ্ধ,জৈন, শৈব, শাক্ত , বৈষ্ণব  শিক ও অন্যান্য হিন্দু  সমাজ প্রবর্তক গণের দ্বারা নতুন নতুন খাতে প্রবাহিত হয়েছে । এবং বহিরাগত খ্রীষ্টান জরথ্রুস্টীয়ান, ইসলাম ও অন্যান্য হাজারো সমাজের প্রবর্তক গণের মাধ্যমে তাঁদের নিজ নিজ সমাজ একইভাবে সংঙ্ঘবদ্ধ হয়েছে । সহমর্মিতার হাত প্রসারিত করেছে। সহানুভূতি  ও সমানুভূতির মাধ্যমে অনৈক্যের মাঝে ঐক্যের ধ্বজা ওড়াতে সক্ষম হয়েছে । সুস্থ সমাজ বিকাশের  একটা প্রগতিপথে কালের রথচক্র  এগিয়ে যেতে পেরেছে । 

এর চেয়ে ভালো তো আর কিছু হতে পারে না। এতো পরমের  আশীর্বাদেরই নামান্তর । হলোও তাই। এই সব মহামানবেরাই আমাদের ত্রাতা । সুদৃঢ় অতীত থেকে আজো তারাই আমাদের আলোর দিশারী । আমাদের জপ তপ তপস্যা ।

কিন্তু গোল বাধছে অন্যত্র।সুদূর অতীতের উক্ত  একক ব্যক্তি কেন্দ্রিক উপলব্ধি জাত নীতি   নির্দেশনাগুলির অধিকাংশ  প্রকৃতিবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত । এবং অবশ্যই তৎকালীন আর্থ সামাজিক পরিস্থিতি ও পরিবেশ নিয়ন্ত্রিত । এমনকি স্থান কাল পাত্র সম্পৃক্ত ।ফলে সেই যুগের  বিন্যাস  নিরিখে যা সত্য, আজকের  এই জনস্ফীতি,সম্পদ সরবরাহের ক্লীণ্যতা  আর অত্যুগ্র লালসার   ভারসাম্যহীন জগৎ সংসারে তা অনেকটাই অসত্য হতে পারে । অর্থাৎ সেই নীতি নির্দেশনাগুলির  অনেকটা  আজকের বাস্তবায়নের নিরিখে যুগোপযোগী সংস্কারের দাবি রাখে । তা না হলে সাম্প্রদায়িক সঙ্কটের ঘনীভূত  এরোসোল  উপমহাদেশীয় উদ্বেগের আকাশ ঢেকে দেবেই ।

1329 সালে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন থেকে কালিদাস নাগকে  এক চিঠিতে লিখেছেন, --"হিন্দু ধর্মকে ভারতবাসী প্রকাণ্ড  একটা বেড়ার মতো করেই গড়ে তুলেছিল । এর প্রকৃতিই হচ্ছে নিষেধ  এবং প্রত্যাখ্যান । সকল প্রকার মিলনের পক্ষে এমন সুনিপুণ কৌশলে রচিত বাধা জগতে আর কোথাও সৃষ্টি হয় নি। এই বাধা কেবল হিন্দু মূসুলমানে তা নয়। তোমার আমার মতো মানুষ যারা আচারে স্বাধীনতা রক্ষা করতে চাই , আমরাও পৃথক বাধাগ্রস্থ ।"

আবার "হিন্দু মুসলমান " নামক প্রবন্ধে তিনি লিখছেন- -"পৃথিবীতে দুটি ধর্ম সম্প্রদায়  আছে , অন্য সমস্ত ধর্ম মতের সঙ্গে যাদের বিরুদ্ধতা অত্যুগ্র- -সে হচ্ছে খ্রিস্টান  আর মুসলমান ধর্ম ।তারা নিজের ধর্মকে পালন করেই সন্তুষ্ট নয় , অন্য ধর্মকে  সংহার করতে  উদ্যত।"

"ব্যক্তিগত প্রবন্ধে" তিনি আরো জানাচ্ছেন- -"ভারতবর্ষের  এমনি কপাল যে , এখানে হিন্দু মুসলমানেব মতো দুই জাত একত্র হয়েছে  , ধর্মমতে হিন্দুর বাধা প্রবল নয় , আচারে প্রবল। আচারে মুসলমানের বাধা প্রবল নয় , ধর্মমতে প্রবল্ । এক পক্ষের যে দিকে দ্বার খোলা , অন্য পক্ষের  সে দিকে দ্বার রুদ্ধ । এরা কী করে মিলবে ?"

সুতরাং মূলের সংস্কার ভিন্ন ধর্ম যন্ত্রের নিয়ত উৎপাদিত লাখো লাখো ধর্মের ষাঁড়ের তেঁড়েল মস্তিষ্ক কাজের কাজ কিছু  করবে বলে  মনে হয় না। 

তার উপর রাষ্ট্রীয় তোষণ । এ প্রসঙ্গে  1324 সালে " ছোটো ও বড়ো" প্রবন্ধে তিনি জানাচ্ছেন- -"পশ্চিম মহাদেশে সাম্প্রদায়িক বিরোধের সময় দুই পক্ষ থাকে। এক পক্ষ উৎপাত করে , আর এক পক্ষ  উৎপাত নিবারণের  উপায় চিন্তা করে। ব্যঙ্গ প্রিয় কোনো তৃতীয় পক্ষ সেখানে বাহির হইতে দুয়ো দেয় না। কিন্তু আমাদের দুঃখের বাসর ঘরে শুধু যে বর ও কনের দ্বৈততত্ত্ব

তাহা নহে , তৃতীয় একটি কুটুম্বিনী আছেন , অট্টহাস্য  এবং কানমলার কাজে তিনি প্রস্তুত ।"

রবীন্দ্রনাথ নির্দেশিত বৃটিশসাম্রাজ্যবাদের সেই কুটুম্বিনী ইংরেজ  আজ নেই কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে ইংরেজ পরবর্তী সময়ে  এই কুটুম্বিনীটির  আসন নিয়েছে রাজনৈতিক  তোষণ । সুতরাং রাজনৈতিক নেতৃবর্গ যদি গদির

সুরক্ষা স্বার্থে সুপরিকল্পিত ভাবে মাঝে মধ্যেই সাম্প্রদায়িক বিষবৃক্ষটির ছায়ায়  আশ্রয় নেয় তবে এই উপমহাদেশীয়  উদ্বেগের শেকড়  বহুধা বিস্তৃত হয়ে বিস্তার লাভ করবে তাতে আর সন্দেহ কি ! কাজেই বিরোধ কালে সম্প্রীতি সম্প্রীতি বলে যতই চিৎকার করি না কেন , আস্তিনের তলায় শাণিত হতেই থাকবে বাঘের নখ। অর্থাৎ মূলের সংস্কার  বা পরিবর্তন ভিন্ন প্রকৃত  সম্প্রীতি সুদূরপরাহত । এক পক্ষ প্রকাশ্য গো-মাংস ভক্ষণ করে যতই অসাম্প্রদায়িক বাহবা কুড়োনোর চেষ্টা করুক না কেন , অন্য পক্ষ শুয়োরের মাংস নেওয়া তো দূরের কথা উচ্চারণ পর্যন্ত হয়ে গেলে পাপস্খালন করলে আর যাই হোক বিভেদ ঘুচবে না।

এ প্রসঙ্গেও আমাদের  আশ্রয় সেই রবীন্দ্রনাথ ।1329 এ কালিদাস নাগকে লেখা  আর এক চিঠিতে তিনি লিখছেন --"যুরোপের সত্যসাধনা  ও জ্ঞানের ব্যাপ্তির ভিতর দিয়ে যেমন করে মধ্যযুগ আধুনিক যুগে এসে পৌঁছেছে হিন্দুকে

মুসলমানকেও তেমনি গণ্ডীর বাইরে যাত্রা করতে হবে। ধর্মকে কবরের মতো তৈরী করে তারই মধ্যে সমগ্র জাতিকে ভূতকালের মধ্যে সর্বতোভাবে নিহিত করে রাখলে উন্নতির পথে চলবার উপায় নেই। কারও সঙ্গে কারও মেলবার

উপায় নেই । আমাদের মানস প্রকৃতির মধ্যে যে অবরোধ রয়েছে তাকে ঘোচাতে না পারলে  আমরা কোনোরকমের স্বাধীনতাই পাব না। শিক্ষার দ্বারা, সাধনার দ্বারা,সেই মূলের পরিবর্তন ঘটাতে হবে। ডানার চেয়ে খাঁচাটায় বড়ো- -এই সংস্কারটাই বদলে ফেলতে হবে----তারপরে  আমাদের কল্যাণ হতে পারে।"

 এই সত্য  আপন আপন সমাজের প্রবর্তক গণ    কী উপলব্ধি করেন নি ? হতেই পারে না। নিশ্চয় ভাবিত ছিলেন । কিন্তু  লেখার চল তখন ছিল না। তাই তাঁরা তা লিখে যাননি। পরবর্তীতে কোনো  অনুগত ভক্ত তা  লিখেছেন । হয়তো এই সময় কথ্যরূপের রূপান্তর হয়েছে । কিংবা আরো পরে যুগোপযোগী রূপান্তরের  আশায় অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। কিন্তু তা পরিবর্তনের অবসর পাননি। হয়তো ভবিষ্যতের বিশ্বাস পূর্ণ মর্যাদাকে সম্মান জানাতেই এমনটি করা হয়েছে ।

এটাই স্বাভাবিক । মনে পড়ে যাচ্ছে  কবি জগদীশ গুপ্তের সেই পংকতি চছটা -- "একবার ঝরে গেলে মন/সে ফুল কুড়োবার /নেই  অবসর/ তখন জীবনের মুখের উপর/ প্রখর সূর্যের প্রকোপ/ তখন জীবন শুধু /পৃথিবীর আহ্নিক জীবন।"

তাছাড়া  ধর্মের প্রবর্তক গণ প্রত্যেকই ছিলেন স্পিরিচ্যুয়ালিটির পূর্ণ প্রতীক । তাঁরা মানুষের মুক্তির কথা বলতে এসেছিলেন । "আপন শৃঙ্খল মাঝে আপনি প্রভু "--এই কথা বলে তাদের জাগাতে এসেছিলেন । একে অন্যের সহায়ক হিসাবে পাশে রাখতে চেয়েছিলেন । ঠিক যেন আধুনিক কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো ভাষা দিয়ে বলতে চেয়েছিলেন ---"মানুষ বড়ো একলা তুমি তাহার পাশে/এসে দাঁড়াও/হেসে দাঁড়াও, ভেসে দাঁড়াও/এবং ভালোবেসে দাঁড়াও/মানুষ বড়ো কাঁদছে/তুমি তাহার পাশে/এসে দাঁড়াও/"


কিন্তু  মানুষের পাশে মানুষ হয়ে দাঁড়ানো মানুষ গুলো পরবর্তীতে জোটবদ্ধ শক্তি হয়ে অন্যায় অধিকার আদায়ের হাতিয়ার হয়ে উঠবে বা ভাঙচুর লুটপাট খুন জখম ও হত্যা লীলায় মাতবে কিংবা অন্য ধর্মের প্রতি আঘাত হানবে,  এ কল্পনা যেন ধর্ম প্রবর্তক গণের ও জ্ঞানের অতীত ।

এ যেন কবিগুরুর কালজয়ী  রূপক সাংকেতিক নাটক"রক্তকরবী "র রাজা প্রতীকে স্বয়ং ধর্ম প্রবর্তকগণেরই কান্না- -"ঠকিয়েছে আমাকে , ঠকিয়েছে ---- আমারই শক্তি দিয়ে আমাকে সম্পূর্ণ করে বেঁধেছে । আমাকে ঠকিয়েছে ।" কিংবা  সফোক্লিসের রাজা ওয়াদিপাউসের সেই মর্মর মৃর্তির ভেঙে পড়ার যন্ত্রণা- --"চক্রী তাঁর চক্রান্তের জাল দ্রুত বিস্তার করে চলেছে । এবং আমি যদি তার প্রতিরোধ দ্রুত নিষ্পন্ন না করি তবে ঐ চক্রান্তকারী জয়লাভ করবে আর আমি পরাজিত হবো ।" 

কাজেই সাম্প্রদায়িকতা  অস্পৃশ্যতা  ও ধর্মের নামে ঘৃণ্য বেসাতি , এই যে উদ্বেগের ঘনঘটা ; বাহ্যিকতার  বিকাশ প্রতিযোগিতা--এ আমাদের কোন উন্নয়নের দিকে ধাবিত করছে  ?

এই উন্নতির অন্তরতম প্রদেশে পৌঁছানোর নামই যদি সাধনা হয় , তবে এই সীমায়িত গণ্ডীর সোপানই কী রিলিজিয়ন বা ধর্ম ?  অর্থাৎ এর মধ্যে  আছি মানে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা পংকতি ধার নিয়ে বলি "ধর্মে আছি জিরাফেও আছি ।"মানে, বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী কিছু লাভ দিয়েছে । কারো দুঃখে করুণা করাই যায় । করলামও। বাণিজ্যিক পন্থায়। ইণ্টারেস্টে। কিংবা সরাসরি  ইন্টারেস্ট নিলাম না । প্রচ্ছদেই প্রকৃষ্ট প্রদর্শন মেনে মহাপুরুষদের বাণী বর্ষণ করে প্রভু প্রজার সাইন বোর্ডটা ঝুলিয়ে দিলাম অদৃশ্যে । মানবতার গায়ে কালি লেপে। যেমনটি জিরাফে।

কিন্তু  এসবের উর্ধে ত্যাগে আর ত্যাগে সিদ্ধি লাভ !  সৃষ্টি রহস্যের ব্রম্ভাণ্ডময় শূন্যের ভিতরে ঝাঁপ । মোক্ষ লাভ ! সমস্ত মহাপুরুষদের যেখানে বিচরণ । আমার তো মনে হয় বড়ো বড়ো লেখক কবি শিল্পী এবং বিজ্ঞানীরা এই স্তরের। এও কি লপ্ত রিলিজিয়নে ? মানে অভ্যাসগত আচরণসর্বস্বতা দিয়ে ? মানে আগ্রাসন দিয়ে ?  মনে হয়  না। কেননা রিলিজিয়ন যেখানে শেষ স্পিরিচ্যুয়ালিটির সেখানে শুরু । সুতরাং রিলিজিয়ন বা ধর্ম  ও  স্পিরিচ্যুয়ালিটি বা আধ্যাত্মিকতা দুটো  এক জিনিস  নয়। এটা স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন । তা যদি না হতো তবে আচরণসর্বস্বতার যে ক্রীচ্ছসাধন দুগ্ধপোষ্য থেকে শ্মশান যাত্রী পর্যন্ত সকলের  উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় তাতে আমাদের ঘরে ঘরে শ্রীরাম , শ্রীকৃষ্ণ , বুদ্ধ,  মহাবীর খ্রীষ্ট ,হজরত মহন্মদ , শঙ্করাচার্য,  শ্রীচৈতন্য , নানক , কবির ,লালন, শ্রীরামকৃষ্ণ  বিবেকানন্দ  উপছে পড়ার কথা। কিন্তু তা হয়নি। তা হবার নয়। তাঁরা জন্মায় । 

তাই  গৃহস্থের কল্যাণের  স্বার্থে , সামাজিক স্থিতির স্বার্থে , ভুল মানুষদের  আটকানোর স্বার্থে , আপামর  অল্পবিদ্যে ভয়ংকরীদের হাত থেকে মানবতাকে রক্ষার স্বার্থে মূলের ধর্মীয় অনুশাসনের যুগোপযোগী সংস্কারের  প্রয়োজন।

 এ কাজে  আপন আপন সমাজের গোঁড়ামি মুক্ত মানুষের হস্তক্ষেপ দাবি করে । সেই সঙ্গে শিকাগোর বিশ্বধর্ম সম্মেলনে স্বীকৃত সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম সংস্কারক স্বামী বিবেকানন্দের "বিশ্বজনীন ধর্ম "বোধের প্রচার ও প্রসার ঘটাতে হবে । সেটা  আবার কি জিনিস ? পরে আসবো সে কথায় । আপাতত তা পালনের জন্য রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্রকে মুক্তমনা ও সক্রিয় হতে হবে। তা যদি না হয় , তবে ধর্মতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত আচরণসর্বস্ব মূলের  অভ্যাসে শুধু একটা পশুর সেবা করা হবে ।

 সে ক্ষেত্রে মনে পড়ে যাচ্ছে কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের সেই বিখ্যাত পংকতিচ্ছটা ---"সে পশু বাঘ সিংহের বাচ্চা নয়/ নয় কুলীন কুকুর বেড়াল/ সেই পশুর নাম অভ্যাস/ পুবোনো প্ররোচনা এখন প্রথার খুঁটিতে বাঁধা/ সোনার গাছে চেয়েছিলে হিরের ফুল/ সোনা নিয়েছে ডাকাতে/ হিরেগুলি সব অঙ্গার ।"

 


*********************************************************************************************************



স্বপন নাথ 

পিতা : বলাই চন্দ্র দেবনাথ।মাতা:শ্রীমতি মায়া নাথ।গ্রাম-বেটিয়ারী, ডাকঘর- নলপুর,  থানা-সাঁকরাইল, জেলা- হাওড়া,পেশা- শিক্ষকতা ।
নেশা-লেখা , মূলত কবিতা ও প্রবন্ধ ।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : আটটি। প্রথম প্রকাশ (2006)বাতুল বালিয়াড়ি। পর্যায়ক্রমে মৃত্যুজপ শীলিত পরিক্রমা, চন্দ্র হলো না,সেই হরিণী যেই হরিণী, দ্বীপজন্ম, আয়াত পেরনো জল, গ্রহণ,   প্রভৃতি । সবকটিই শ্রদ্ধেয় কবি শঙ্খ ঘোষের তদারকিতে প্রকাশিত । প্রকাশিতব্য "ছিপ ধরা প্রহর "2022কোলকাতা বইমেলা ।
"আয়াত পেরনো জল" কাব্যগ্রন্থটি 2020 অন্নদাশঙ্কর রায় স্মৃতি পুরস্কারে মনোনিত হয়েছিল। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আবৃত্তি বিভাকর সম্মানে ভূষিত ।