পাথুরে বোধনের কান্না শুনি কাশবনে
(উৎসর্গ : দীপ্তিশিখা দাস )
দীপংকর রায়
২০৯.
ঘুরে ঘুরে
কত নৈঃশব্দের মুখে মুখ রেখে বলি
আর একটু উদাসী হাওয়ার কাছে
যাও সরে , দাঁড়াও অকৃপণ । ছোঁও .....
যে ছোঁয়ায়
ভালো হয়ে যায় সকল অদৃশ্য মনকেমন ;
উভয়েই পাই
অনন্ত কাজের প্রেরণা
উভয়ের চোখে-মুখে
নেমে আসে এক অবিনাশী আলো ......
২১০.
এত আয়োজনে
যে মঞ্চ সাজিয়েছো
সেই দাহ-পথে
কীভাবে যাবে ?
দেখোই নি তো
শুনেছ ,
দুয়ার ছুঁয়ে চলে গেল শত শত মুখোভঙ্গি
কারা যেন শহরের ভীড়ে ......;
মনুমেন্টের নিচেয়
পিঁপড়েদের সারি সারি মাথা ,
তারাও যেন পিষে গেল , ছায়ায় হারিয়ে গেল রোদ্দুরের মুখ !
ফুটপাতে ,ঝুপড়িতে ,হাইড্রেনে
জলের তোড়ে
মিলেমিশে একাকার হলো
ব্যাবহৃত বর্জ্য কতো যে ;
কাউকে আলাদা চিনে নেবার জো নেই ।
শেকড়ের উৎসের কথা
জানার উপায় নেই
যদিও বা
নাও থাকতে পারেই
তাও শুনতে কি পাও ?
জানো কিনা জানি না ।
সব আন্দোলন মিথ্যে হয়
আমরাই প্রমানিত করতে চাই যেন ;
ভাষার গান গাই
স্বাধীনতার কথা বলি
ছবি উঠে আসে , তাকে আরো ভালো করে বুঝতে চাই ;
তুমিও চাও বুঝতে , পিতামহের উঠোনে দাঁড়াও ,
জিজ্ঞাসা করো --- কে তাকে বলেছিল , ”ওই দ্যাশেই যান ----
আপনেগো আর রক্ষা করবার পারলাম না ।”
রক্তে রাঙ্গানো ভাষার মাসে ,
তাদের বৈঠকী আড্ডার কথা মনে পড়ে ।
একাত্তরে আতঙ্কিত
পথক্লান্তির কথা মনে পড়ে ।
মনে পড়ে সখিনার কথা :
২১১.
যত উঁচুতে উঠে চাই না কেন
আকাশগঙ্গায় মৃত নক্ষত্রদের ছোঁয়া
দুষ্কর ।
আশা তো করি
অনেক বোধের দরজা পার করবো ;
সময় দুহাত ছাড়িয়ে
অনেকটা পেছনে
সরে দাঁড়ায় ।
উত্তরণ কি এতোটাই সোজা
গালগপ্প... ?
দোষ কারো না ---- সেও তো সময়ের অভিশাপ ----
কে কাকে আজ কতটা
গামছায় নিঙড়ে নিল ?
হাসির আড়ালে যে মিথ্যে তালি বাজে ;
যে সত্যে পৌঁছতে সে হয় মূক্ত —
দুটি চোখের দরজা খুলে যেন
উড়ে যায়
অনেক মেঘ-বলাকাদের সারি তখন ......
২১২.
কার্নিস একটাও বাদ নেই
তরোয়াল উঁচিয়ে
চেয়ে আছে
সেই সব প্রাগৈতিহাসিক ছায়ারা ৷
একমুঠো ফাল্গুন চেয়েছিলাম
মানুষের মুখে .......
তাই অপরাধ ?
সেও বিরোধী হন্তারক ?
ছুঁড়ে দিল এত পাথরখণ্ড চারদিকে ...?
কোথায় কার কাছে জীবন চাইবো
রাইফেল -তলোয়ার -বল্লম
মিলেমিশে
শত আদিমতার উল্লাস দিকে দিকে এখনো !
শেষ চুমু নিয়ে পড়ে আছে বাঙ্কারে
অনেক অসাড় দেহের সারি ........
কে কার থেকে ছিটকে পড়লো
সেই আকাশ ছাড়িয়ে বজ্রগর্ভ মেঘের ভেতর ?
ওই সব কার্নিসে কার্নিসে
সকল ফাল্গুন-বেলাদের
শেষ চিহ্নের ভেতর মুখথুবড়ে ?
চিনতেই পারলাম না ৷
সেই তুমি কতবার
ছলনায় ঢাকো
ওই মুখ আজও ......?
২১৩,
অন্য কে পড়ার অর্থ
নিজেকে চেনা ।
নিজেকে দেখার অর্থ
অন্য কে পড়া ।
এই বিপরীত সত্যের
বিকল্প কিছুই নেই ।
যদি বিদীর্ণ করে জানার অন্তরায়
এই সত্য-মিথ্যার মূল্য কিছু তবেই ,
তা না হলে
আর পাঁচটা যেমন যেমন......
বিদ্রোহ বাইরে তো নয়
বিপ্লব আকাশ থেকে আসে না ।
দেখার উৎসে-ই
এর মূল
শেষ ও পরিশেষ ।
গননাবিহীন এমনই উজ্জ্বলতা সে ,
যাতে-ই তৈরি প্রকৃত সন্ন্যাস - - -
এই সন্ন্যাসী জঙ্গলে থাকেন না
পর্বতেও না
থাকেন এমন গহীনে
তাঁর যে কত রূপ
বিরাজে উভয়ে !
যদি হও
সে ও সখা , হও একাকীর !
বহুবার আসি
বহুবার যাই অন্তরীক্ষে ---- বহু বার —
বহু বহু বার, এই আসা ......
ছুঁতে চায় কেই বা !
সকলেই জড়িয়ে পড়ে পাঁকে
অব্যবহৃত মজা পুকুর যেন ।
পড়ে পড়ে ডেকে চলে
ব্যাঙের গলায়
ঝিঁঝিঁ পোকাদের সুরে ....
পেরোতে পেরোতে
কী যে বিষণ্ণতা !
কী যে কোলাহল !
কান্না দলা পাকিয়ে
উঠলো গলায় ----
আর কিছু না !
২১৪,
এই তো আছি
অনুপস্থিতিতে তার চোখের ভেতর ,
কাঁপা ঠোঁটে ;
আছি তো ---- অস্বাভাবিক
অস্থির সময়ে ;
সকল দুশ্চিন্তা জুড়ে
এই যে গোপন অস্থিরতা ,তারও ;
এই তো থাকা -----
এর চেয়ে বড় থাকা
বড় পাওনা
তাঁকে ছুঁয়ে পাওয়ায় কি আছে ?
অধিকার তো অধিকার না ,
সেও তো অলিখিত সামন্ততন্ত্রের নামান্তর ;
সেই সুখ তবুও চেয়ে চেয়ে
হন্যে এ জীবন ,
জীবনের অধিকার বড় প্রয়োজন -----
প্রশান্তির উল্টো পিঠেই আছে
যে সব একঘেয়েমি ----
মায়া আঁশ ছেড়ে গেলে
দগদগে পেটির আঁকাবাকা ছকে
যে সব সাপলুডু নামা ওঠা , প্রবৃত্তির অনুসরণ খোঁজে .....
সে সব সব সাঙ্গ হলে তারপর
অন্য এক অনন্তে যেতে চায়
যে হৃদয় ,
তার সাথেও মিল নেই কোনো
এই থাকায় ------
এ যেন
এক অপরিমেয় প্রশান্তি ......
২১৫.
যে বর্ণমালায় সাজানো
সে কাল্পনিক ৷
ঠোঁটের ইজারা শেষ হলে
সেও পাশ ফেরে
বুকের ভেতর ।
রাত শেষ হয়
যেখানে কুয়াশায় ঘেরা
দুই পাড় ।
তাকে এঁকে তুলি
কী দিয়ে তারপরেও?
যে ইশারায় দাহ হয়
এই জন্ম আমাদের ---
সে কি অভিশাপ
শুধুই ?
তবু বলি
নিও না , নিও না
সরিয়ে সেই সুখটুকু
তোমার আমার
সেই রেখা ঘুরিয়ে ৷
তাকেও এঁকেছি কি
তাঁরই নীরবতায় ?
নিভৃত সেই অসীম .....
২১৬.
পড়ন্ত আলোর পায়ে পায়ে চলেছি
শেষ বেলার পথে পথে......
দেখি
তাহাদের ছায়ারাও ঘরে ফিরে যায় যেন .....
জানলা দরজা ভেঙে
ঠিকরে বেরিয়ে আসে
অনেক পথের মুখ----
সেই সব আয়নায়
নিজের চুলের বিন্যাস বুঝতে
গভীর আঙুল চালাই নিঃশব্দে
কাউকে দেখতে দিই না
সেই মুখের বিষণ্ণতা ৷
কথা বলি
তারই ভাঙা ছবিতে
ছবির মুখটি রেখে ৷
গান শোনে সেও
আপন আনন্দের গান
সে সব ---- ঘরে ফেরে অনেক অখন্ড মায়া-প্রলাপ ?!
২১৭.
আমাদের দেশ নেই ।
তাহাদের আছে কি ?
সে কথা সেও
জানে নি ।
ইচ্ছারা বলে নি কখনো কানের কাছে কানটি রেখে .....
ভাঙা কাঁচের বয়াম কাঁধে
লজেন্সওয়ালা
হেঁকে গ্যাছে খালি খালি ......
কার গান
কে যে শোনে !
কে যে কাকে
বাড়ি ভুল করায় কেবলই......
আমাদের দেশ নেই ।
ঘর আছে ,
ঘরের ভেতর কারো কারো
দেশের বাড়ির
সুর আসে ভেসে ....
২১৮.
কোথাও লুকোতে পারি নি ।
ঠোঙাটি এক থাপ্পর মেরে
উড়ে চলে গেল দূরে …
মুছে নিয়েছি মুখ
ধুলোময় প্রলাপ শুনিয়ে
মেঘেদের মতো
চিৎকার করে গ্যালো…
বৃষ্টি আজ এতোই ৷
মুছে গ্যাছে সব চোখের কাজল —-
কাত হয়ে পড়েছে অবুঝ রেখায়
হুমড়ি খেয়ে ,
ক্যানভাস জুড়ে
তার মুখটি শুধুই ?
রং ছড়িয়ে গ্যাছে
তাই যেন .......
এমন সুখে
তাকেই আশা করা ,
ছোট্ট বিন্দুতে কতবার পরিব্রাজক আমি ....
অপমানিত
অসম্মানিত হতে হতেও
তারই বাতাসের মুখে মুখ রেখে দাঁড়াই -----
আজন্ম কালের ধুলো মাখি.....।
*************************************************************************



কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন