মহাদেশীয় উদ্বেগ ও মনীষী ভাবনা
স্বপন নাথ
ধর্ম যেন ক্লাব সংগঠন। মেম্বার ছাড়া প্রবেশ নিষেধ । তফাৎ শুধু এই যে : একটির সূচনা পাড়ার মাচা। অন্যটির নিগঢ় জাতিতত্ত্বের শেকড় । উৎস কিন্তু একই । অনিশ্চয়তা । এই নিয়েই " উপমহাদেশীয় উদ্বেগ ও মণীষী ভাবনা"।
বিশিষ্ট জার্মান দার্শনিক শোপেনহাওয়ার বলেছেন, "আশ্রয়হীনতা থেকে ঈশ্বরের সৃষ্টি ।" অর্থাৎ ঈশ্বর গড আল্লা যে যে নামেই ডাকি না কেন , সেই একই পরমের অনৈস্বর্গীক অস্তিত্ব সম্পর্কিত ইজম বা মতবাদ পুষ্ট করেছে ধর্মকে। আর সেই অনিশ্চয়তা জাত ধর্মের আচরণসর্বস্বতার প্রতিযোগিতা নিয়েই সাম্প্রদায়িক মারপিট , দাঙ্গা , রক্ত ক্ষরণ , যুদ্ধ ।
গোটা বিশ্ব যতবার বৈরী বিদ্বেষে জ্বলে পুড়ে খাক হয়েছে, এবং বর্তমান সময় সারণির ভিতর যা হিমশীতল প্রবাহে, দূর্বোধ্য স্নায়ুরোগের মতো কাঁপিয়ে দিচ্ছে -- মন , মেজাজ , মানসিকতা তথা সভ্যতার ভীত : তা হলো এই ধর্মের নামে ঘৃণ্য বেসাতি ।
এ প্রসঙ্গে তুলে নেব স্বয়ং প্রবর্তক হৃদয়ের কান্না কুড়োনো বিশিষ্ট মণীষীদের হৃদয় চঞ্চলতার দুঃখ জল । এবং দেখে নেব চলমান বর্তমানের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত লাগবার ফন্দি ফিকিরি অজুহাতের কুলুপ রংমশাল । তার আগে আর একটু মুখ বাড়িয়ে দেখি উভয়ের লক্ষ্যও কিন্তু একই এবং অদ্বিতীয়। তা হলো মান্যতা। অধিকার আদায়ের সংহতি । উন্নতি ।
এখন প্রশ্ন কেমন উন্নতি ? কিসের এতো ক্রীচ্ছসাধন ? যাতে প্রাণ যায় যাক। জেহাদ !
মোক্ষলাভ ?
সে তো দূস্তর ব্যাপার ! ঘষে মেজে রপ্ত করা যায় না তা । মোক্ষের মানুষেরা জন্মায়।তবে যে চৌকাঠ ডিঙ্গলেই এতো মোক্ষ মোক্ষ সাজ ? এতো যে গগন বিদারি মোক্ষ মোক্ষ আওয়াজ ? তাহলে কি স্রেফ সেফগার্ড ? ক্ষমতার বিস্তার ? নৈয়ায়িক শৃঙ্খলে টান টান উন্নয়ন বিষয়ক ফরমান সেকি শুধুই বৈষয়িক?নাকি আত্মিক ?
বৈষয়িক উন্নতি স্থানান্তর ঘটায়। আত্মিক উন্নতি মনান্তর । বিষয়টি একটু খোলসা করা যাক। ধরো কোনো অপ্রাপ্ত কিশোর পৈতৃক সম্পত্তি পেল প্রচুর । তিনি পড়া শোনাকে কচু দেখিয়ে সম্পত্তি বিক্রি করলেন। প্রচুর অর্থ পেলেন। প্রাসাদোপম বাড়ি বানালেন। দু চাকা, চারচাকা করলেন। দু চারজন পেটোয়া বানালেন। মোড়ের মাথায় একটা দোকান বা কিছু একটা অর্থ উপার্জনের ব্যবস্থা করলেন। কিংবা ওসব কিছুই করলেন না ।জমি বিক্রির সব টাকা ব্যাঙ্কে জমা রেখে মাসিক সুদে স্বাচ্ছন্দ্য রাখলেন। অথবা দাদাগিরি টাইপের কিছু একটা । কিংবা সেটাও করলেন না ।কিন্তু জলের সমোচ্চশীলতা মেনে কড়ার জলটুকুও কাউকে দিলেন না। অর্থাৎ ছিন্ন বেশ রাজবেশ হলো বটে কিন্তু মন যে তিমিরে সেই তিমিরেই । এক কথায় স্থানান্তর হয়েছে ঠিকিই মনান্তর হয়নি।
এর ঠিক বিপরীতে একজন নিঃস্ব । প্রচুর দুঃখ কষ্ট মাথায় নিয়ে পড়াশোনা করলেন। সাধ্যমতো পরিশ্রম করে একটা চাকরি । কিংবা দু বেলা দু মুঠো অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা করলেন। তেঁতুল পাতায় ন জন হয়ে বসবাস করলেন। জীব জড়ের সংহতি বজায় রেখে মানুষের কল্যাণ কর্মে নিযুক্ত থাকলেন সাধ্যমতো । তো বলা যায় বৈষয়িক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা হলেও আত্মিক উন্নতি বা স্থানান্তরের সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা মনান্তরও হয়েছে ।
এই আত্মিক উন্নতির পলকা হাওয়া আধ্যাত্মিক শব্দটিকেও যেন কিঞ্চিত সাযুজ্য দিয়ে যাচ্ছে ।কিন্তু ঠিক কী তাই ? বিস্তর ফারাক ।কারণ বৈষয়িক উন্নতির তৃপ্তি আসে ভোগে ।আর ভোগের তারতম্যের কারণেই হিংসা । হিংসা থেকেই লড়াই । অধিকার বলবৎ করার রক্ত ক্ষরণ। আগ্রাসন ।
এইখানে এসে থমকে যাই নিজেই । প্রশ্ন জাগে মনে । ত্রিকালোজ্ঞ ঋষি তুল্য দৃষ্টিতে ভবিষ্য ভয়াবহ পরিণাম কী ধরা পড়েনি ? তা তো হবার নয় । তাহলে এমন একটা মারনঘাতী শক্তিকে ধর্মের প্রবর্তক গণ দানা বাঁধতে দিলেন কেন ? আচরণসর্বস্বতার নিগঢ়ে বাঁধলেন কেন ?
আসলে গঠন পর্বের প্রাক লগ্নে প্রকৃতি শাসিত লোকসাধারণ , দিশেহারা , নীতিহারা মানহারা, গৃহহারা, ছিন্ন ভিন্ন । কাজেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা স্থানিকদের একটা আশ্রয় দেওয়া, ভরসা দেওয়াই প্রাথমিক ও প্রধান কাজ। একটা সংহতি দান করাই ছিল প্রধান লক্ষ্য ।
এখানে বলে নেওয়া ভালো , ধর্মের প্রবরপ্রবর্তক গণও তো রক্ত মাংসের মানুষ । তাঁরাও তো আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভোগা লোক হতে পারে ? কেননা এক দিনেই তো লক্ষ লক্ষ অনুগত ভক্ত মণ্ডলীর বিশাল সাম্রাজ্যের শিরোমণি হয়ে জাননি তাঁরা । তাই সিম্বোলাইজড করে দলভূক্তের সংখ্যা দেখে তৃপ্তি , এবং জোটবদ্ধ শক্তি দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার একটা দার্শনিক বার্তা কাজ করেছে ভিতের ভিতরে। এ কথা কী বলা যায় না ? এও তো একটা বিচক্ষণতা ।
অবশ্য একথা অনস্বীকার্য যে বিশ্বাত্মাবোধে উদ্বুদ্ধ মানুষের হৃদয় বিগলিত বিবেকী চেতনাই চালিত করে দেশের জন্য দশের জন্য নিজেকে উৎস্বর্গীকৃত করতে।
ফলে কল্পলোকের ঈশ্বর, গড, আল্লা যাই বলি না কেন তাঁর আশীর্বাদ ধন্য সামিয়ানার নিচে অনুগত করার নানা প্রকার নীতি নির্দেশনা ও তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার ফতোয়া জারি প্রবর্তক গণের কাছে অত্যাবশ্যক ছিল ।
বোধগম্য হলো না বলছো? রাজনীতির বাস্তবতায় আসা যাক । সেখানে দেখছি কী ? না , কোনো একজন মুখ্যমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রীত্বকালে নিজের প্রচারের জন্য কিছু প্রকল্প ঘোষণা করে ছিলো । এবং সরকারি , আধাসরকারি কিংবা সরকার পোষিত সব সংস্থার রং লাল করে ছিলো । এবার সরকার বদল হলো। নতুন দলের নতুন মুখ্যমন্ত্রী কার্যভার নেওয়ার পরও দেখলো সবই আগের মতো লাল ---লাল---! আত্মশ্লাঘায় লাগলো । তো দাও আরো কিছু উপচে পড়ার মতো প্রকল্প ।যাতে আগের জনকে টপকে যায় । এবং একটা অর্ডার , 'পথে নেমেই যেন আর দেখতে না হয় লাল ; দাও সবে নীল--নীল -- করে ।' করে দেওয়া হলো । নিজের একটা আইডেন্টিটি তৈরী হলো । আমরা "ক' অক্ষর গো মাংস " পাঠ প্রতিক্রিয়ায় অক্ষম । তাই চোখে দেখেই যাতে বুঝতে পারি ঐ চিহ্ন কার স্বাক্ষর বহন করছে। তবেই না সার্থকতা । নিজেকে প্রতিষ্ঠা ! মনে হয় এভাবেই ধর্মের আইডেণ্টিটির প্রতিষ্ঠা।
যাক সে কথা। এই বিচক্ষণতা তো খারাপ নয়। দোষেরও নয়। অবশ্য সেটা বিচার্য নয়। কিন্তু আচরণসর্বস্বতার অভ্যাস বলতে মনে পড়ে গেল সদ্য প্রয়াত কবি শঙ্খ ঘোষের সেই বিখ্যাত পংকতি যুগল ---- "মদ খেয়ে তো মাতাল হতো সবাই/ কবিই শুধু নিজের জোরে মাতাল ।" অর্থাৎ আচরণসর্বস্বতার মদ খেয়ে নকল ধার্মিক সাজা যায় বটে । কিন্তু প্রকৃত ধার্মিক হওয়া যায় না।
গঠন পর্বে সেকথা না হয় বাদই দিলাম । একটা জাতি তো সংস্কার পেল ! এটাই যথেষ্ট ।
এইভাবেই তপোবনীয় ভারতবর্ষের লক্ষ লক্ষ বৈদান্তিক ঋষীর সংস্কার নিয়ে বরিষ্ঠ সনাতন হিন্দু সমাজ। পরবর্তীতে সে ঠাঁই দিয়েছে শক হূল দল পাঠান মোগল। খ্রিস্টান জরথ্রুস্টিও এবং ইসলাম ধর্মকেও তাঁর যোগ্য মর্যাদায় সম্মান দিয়েছে । এবং কবিগুরুর ভাষায় ভারতবর্ষ এক সুবিশাল " তীর্থনীড়ে"পরিণত হয়েছে।
কালক্রমে ভারতীয় সভ্যতার বহুত্ববাদী সনাতন হিন্দু ধর্ম বহু ধারায় বৌদ্ধ,জৈন, শৈব, শাক্ত , বৈষ্ণব শিক ও অন্যান্য হিন্দু সমাজ প্রবর্তক গণের দ্বারা নতুন নতুন খাতে প্রবাহিত হয়েছে । এবং বহিরাগত খ্রীষ্টান জরথ্রুস্টীয়ান, ইসলাম ও অন্যান্য হাজারো সমাজের প্রবর্তক গণের মাধ্যমে তাঁদের নিজ নিজ সমাজ একইভাবে সংঙ্ঘবদ্ধ হয়েছে । সহমর্মিতার হাত প্রসারিত করেছে। সহানুভূতি ও সমানুভূতির মাধ্যমে অনৈক্যের মাঝে ঐক্যের ধ্বজা ওড়াতে সক্ষম হয়েছে । সুস্থ সমাজ বিকাশের একটা প্রগতিপথে কালের রথচক্র এগিয়ে যেতে পেরেছে ।
এর চেয়ে ভালো তো আর কিছু হতে পারে না। এতো পরমের আশীর্বাদেরই নামান্তর । হলোও তাই। এই সব মহামানবেরাই আমাদের ত্রাতা । সুদৃঢ় অতীত থেকে আজো তারাই আমাদের আলোর দিশারী । আমাদের জপ তপ তপস্যা ।
কিন্তু গোল বাধছে অন্যত্র।সুদূর অতীতের উক্ত একক ব্যক্তি কেন্দ্রিক উপলব্ধি জাত নীতি নির্দেশনাগুলির অধিকাংশ প্রকৃতিবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত । এবং অবশ্যই তৎকালীন আর্থ সামাজিক পরিস্থিতি ও পরিবেশ নিয়ন্ত্রিত । এমনকি স্থান কাল পাত্র সম্পৃক্ত ।ফলে সেই যুগের বিন্যাস নিরিখে যা সত্য, আজকের এই জনস্ফীতি,সম্পদ সরবরাহের ক্লীণ্যতা আর অত্যুগ্র লালসার ভারসাম্যহীন জগৎ সংসারে তা অনেকটাই অসত্য হতে পারে । অর্থাৎ সেই নীতি নির্দেশনাগুলির অনেকটা আজকের বাস্তবায়নের নিরিখে যুগোপযোগী সংস্কারের দাবি রাখে । তা না হলে সাম্প্রদায়িক সঙ্কটের ঘনীভূত এরোসোল উপমহাদেশীয় উদ্বেগের আকাশ ঢেকে দেবেই ।
1329 সালে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন থেকে কালিদাস নাগকে এক চিঠিতে লিখেছেন, --"হিন্দু ধর্মকে ভারতবাসী প্রকাণ্ড একটা বেড়ার মতো করেই গড়ে তুলেছিল । এর প্রকৃতিই হচ্ছে নিষেধ এবং প্রত্যাখ্যান । সকল প্রকার মিলনের পক্ষে এমন সুনিপুণ কৌশলে রচিত বাধা জগতে আর কোথাও সৃষ্টি হয় নি। এই বাধা কেবল হিন্দু মূসুলমানে তা নয়। তোমার আমার মতো মানুষ যারা আচারে স্বাধীনতা রক্ষা করতে চাই , আমরাও পৃথক বাধাগ্রস্থ ।"
আবার "হিন্দু মুসলমান " নামক প্রবন্ধে তিনি লিখছেন- -"পৃথিবীতে দুটি ধর্ম সম্প্রদায় আছে , অন্য সমস্ত ধর্ম মতের সঙ্গে যাদের বিরুদ্ধতা অত্যুগ্র- -সে হচ্ছে খ্রিস্টান আর মুসলমান ধর্ম ।তারা নিজের ধর্মকে পালন করেই সন্তুষ্ট নয় , অন্য ধর্মকে সংহার করতে উদ্যত।"
"ব্যক্তিগত প্রবন্ধে" তিনি আরো জানাচ্ছেন- -"ভারতবর্ষের এমনি কপাল যে , এখানে হিন্দু মুসলমানেব মতো দুই জাত একত্র হয়েছে , ধর্মমতে হিন্দুর বাধা প্রবল নয় , আচারে প্রবল। আচারে মুসলমানের বাধা প্রবল নয় , ধর্মমতে প্রবল্ । এক পক্ষের যে দিকে দ্বার খোলা , অন্য পক্ষের সে দিকে দ্বার রুদ্ধ । এরা কী করে মিলবে ?"
সুতরাং মূলের সংস্কার ভিন্ন ধর্ম যন্ত্রের নিয়ত উৎপাদিত লাখো লাখো ধর্মের ষাঁড়ের তেঁড়েল মস্তিষ্ক কাজের কাজ কিছু করবে বলে মনে হয় না।
তার উপর রাষ্ট্রীয় তোষণ । এ প্রসঙ্গে 1324 সালে " ছোটো ও বড়ো" প্রবন্ধে তিনি জানাচ্ছেন- -"পশ্চিম মহাদেশে সাম্প্রদায়িক বিরোধের সময় দুই পক্ষ থাকে। এক পক্ষ উৎপাত করে , আর এক পক্ষ উৎপাত নিবারণের উপায় চিন্তা করে। ব্যঙ্গ প্রিয় কোনো তৃতীয় পক্ষ সেখানে বাহির হইতে দুয়ো দেয় না। কিন্তু আমাদের দুঃখের বাসর ঘরে শুধু যে বর ও কনের দ্বৈততত্ত্ব
তাহা নহে , তৃতীয় একটি কুটুম্বিনী আছেন , অট্টহাস্য এবং কানমলার কাজে তিনি প্রস্তুত ।"
রবীন্দ্রনাথ নির্দেশিত বৃটিশসাম্রাজ্যবাদের সেই কুটুম্বিনী ইংরেজ আজ নেই কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে ইংরেজ পরবর্তী সময়ে এই কুটুম্বিনীটির আসন নিয়েছে রাজনৈতিক তোষণ । সুতরাং রাজনৈতিক নেতৃবর্গ যদি গদির
সুরক্ষা স্বার্থে সুপরিকল্পিত ভাবে মাঝে মধ্যেই সাম্প্রদায়িক বিষবৃক্ষটির ছায়ায় আশ্রয় নেয় তবে এই উপমহাদেশীয় উদ্বেগের শেকড় বহুধা বিস্তৃত হয়ে বিস্তার লাভ করবে তাতে আর সন্দেহ কি ! কাজেই বিরোধ কালে সম্প্রীতি সম্প্রীতি বলে যতই চিৎকার করি না কেন , আস্তিনের তলায় শাণিত হতেই থাকবে বাঘের নখ। অর্থাৎ মূলের সংস্কার বা পরিবর্তন ভিন্ন প্রকৃত সম্প্রীতি সুদূরপরাহত । এক পক্ষ প্রকাশ্য গো-মাংস ভক্ষণ করে যতই অসাম্প্রদায়িক বাহবা কুড়োনোর চেষ্টা করুক না কেন , অন্য পক্ষ শুয়োরের মাংস নেওয়া তো দূরের কথা উচ্চারণ পর্যন্ত হয়ে গেলে পাপস্খালন করলে আর যাই হোক বিভেদ ঘুচবে না।
এ প্রসঙ্গেও আমাদের আশ্রয় সেই রবীন্দ্রনাথ ।1329 এ কালিদাস নাগকে লেখা আর এক চিঠিতে তিনি লিখছেন --"যুরোপের সত্যসাধনা ও জ্ঞানের ব্যাপ্তির ভিতর দিয়ে যেমন করে মধ্যযুগ আধুনিক যুগে এসে পৌঁছেছে হিন্দুকে
মুসলমানকেও তেমনি গণ্ডীর বাইরে যাত্রা করতে হবে। ধর্মকে কবরের মতো তৈরী করে তারই মধ্যে সমগ্র জাতিকে ভূতকালের মধ্যে সর্বতোভাবে নিহিত করে রাখলে উন্নতির পথে চলবার উপায় নেই। কারও সঙ্গে কারও মেলবার
উপায় নেই । আমাদের মানস প্রকৃতির মধ্যে যে অবরোধ রয়েছে তাকে ঘোচাতে না পারলে আমরা কোনোরকমের স্বাধীনতাই পাব না। শিক্ষার দ্বারা, সাধনার দ্বারা,সেই মূলের পরিবর্তন ঘটাতে হবে। ডানার চেয়ে খাঁচাটায় বড়ো- -এই সংস্কারটাই বদলে ফেলতে হবে----তারপরে আমাদের কল্যাণ হতে পারে।"
এই সত্য আপন আপন সমাজের প্রবর্তক গণ কী উপলব্ধি করেন নি ? হতেই পারে না। নিশ্চয় ভাবিত ছিলেন । কিন্তু লেখার চল তখন ছিল না। তাই তাঁরা তা লিখে যাননি। পরবর্তীতে কোনো অনুগত ভক্ত তা লিখেছেন । হয়তো এই সময় কথ্যরূপের রূপান্তর হয়েছে । কিংবা আরো পরে যুগোপযোগী রূপান্তরের আশায় অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। কিন্তু তা পরিবর্তনের অবসর পাননি। হয়তো ভবিষ্যতের বিশ্বাস পূর্ণ মর্যাদাকে সম্মান জানাতেই এমনটি করা হয়েছে ।
এটাই স্বাভাবিক । মনে পড়ে যাচ্ছে কবি জগদীশ গুপ্তের সেই পংকতি চছটা -- "একবার ঝরে গেলে মন/সে ফুল কুড়োবার /নেই অবসর/ তখন জীবনের মুখের উপর/ প্রখর সূর্যের প্রকোপ/ তখন জীবন শুধু /পৃথিবীর আহ্নিক জীবন।"
তাছাড়া ধর্মের প্রবর্তক গণ প্রত্যেকই ছিলেন স্পিরিচ্যুয়ালিটির পূর্ণ প্রতীক । তাঁরা মানুষের মুক্তির কথা বলতে এসেছিলেন । "আপন শৃঙ্খল মাঝে আপনি প্রভু "--এই কথা বলে তাদের জাগাতে এসেছিলেন । একে অন্যের সহায়ক হিসাবে পাশে রাখতে চেয়েছিলেন । ঠিক যেন আধুনিক কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো ভাষা দিয়ে বলতে চেয়েছিলেন ---"মানুষ বড়ো একলা তুমি তাহার পাশে/এসে দাঁড়াও/হেসে দাঁড়াও, ভেসে দাঁড়াও/এবং ভালোবেসে দাঁড়াও/মানুষ বড়ো কাঁদছে/তুমি তাহার পাশে/এসে দাঁড়াও/"
কিন্তু মানুষের পাশে মানুষ হয়ে দাঁড়ানো মানুষ গুলো পরবর্তীতে জোটবদ্ধ শক্তি হয়ে অন্যায় অধিকার আদায়ের হাতিয়ার হয়ে উঠবে বা ভাঙচুর লুটপাট খুন জখম ও হত্যা লীলায় মাতবে কিংবা অন্য ধর্মের প্রতি আঘাত হানবে, এ কল্পনা যেন ধর্ম প্রবর্তক গণের ও জ্ঞানের অতীত ।
এ যেন কবিগুরুর কালজয়ী রূপক সাংকেতিক নাটক"রক্তকরবী "র রাজা প্রতীকে স্বয়ং ধর্ম প্রবর্তকগণেরই কান্না- -"ঠকিয়েছে আমাকে , ঠকিয়েছে ---- আমারই শক্তি দিয়ে আমাকে সম্পূর্ণ করে বেঁধেছে । আমাকে ঠকিয়েছে ।" কিংবা সফোক্লিসের রাজা ওয়াদিপাউসের সেই মর্মর মৃর্তির ভেঙে পড়ার যন্ত্রণা- --"চক্রী তাঁর চক্রান্তের জাল দ্রুত বিস্তার করে চলেছে । এবং আমি যদি তার প্রতিরোধ দ্রুত নিষ্পন্ন না করি তবে ঐ চক্রান্তকারী জয়লাভ করবে আর আমি পরাজিত হবো ।"
কাজেই সাম্প্রদায়িকতা অস্পৃশ্যতা ও ধর্মের নামে ঘৃণ্য বেসাতি , এই যে উদ্বেগের ঘনঘটা ; বাহ্যিকতার বিকাশ প্রতিযোগিতা--এ আমাদের কোন উন্নয়নের দিকে ধাবিত করছে ?
এই উন্নতির অন্তরতম প্রদেশে পৌঁছানোর নামই যদি সাধনা হয় , তবে এই সীমায়িত গণ্ডীর সোপানই কী রিলিজিয়ন বা ধর্ম ? অর্থাৎ এর মধ্যে আছি মানে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা পংকতি ধার নিয়ে বলি "ধর্মে আছি জিরাফেও আছি ।"মানে, বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী কিছু লাভ দিয়েছে । কারো দুঃখে করুণা করাই যায় । করলামও। বাণিজ্যিক পন্থায়। ইণ্টারেস্টে। কিংবা সরাসরি ইন্টারেস্ট নিলাম না । প্রচ্ছদেই প্রকৃষ্ট প্রদর্শন মেনে মহাপুরুষদের বাণী বর্ষণ করে প্রভু প্রজার সাইন বোর্ডটা ঝুলিয়ে দিলাম অদৃশ্যে । মানবতার গায়ে কালি লেপে। যেমনটি জিরাফে।
কিন্তু এসবের উর্ধে ত্যাগে আর ত্যাগে সিদ্ধি লাভ ! সৃষ্টি রহস্যের ব্রম্ভাণ্ডময় শূন্যের ভিতরে ঝাঁপ । মোক্ষ লাভ ! সমস্ত মহাপুরুষদের যেখানে বিচরণ । আমার তো মনে হয় বড়ো বড়ো লেখক কবি শিল্পী এবং বিজ্ঞানীরা এই স্তরের। এও কি লপ্ত রিলিজিয়নে ? মানে অভ্যাসগত আচরণসর্বস্বতা দিয়ে ? মানে আগ্রাসন দিয়ে ? মনে হয় না। কেননা রিলিজিয়ন যেখানে শেষ স্পিরিচ্যুয়ালিটির সেখানে শুরু । সুতরাং রিলিজিয়ন বা ধর্ম ও স্পিরিচ্যুয়ালিটি বা আধ্যাত্মিকতা দুটো এক জিনিস নয়। এটা স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন । তা যদি না হতো তবে আচরণসর্বস্বতার যে ক্রীচ্ছসাধন দুগ্ধপোষ্য থেকে শ্মশান যাত্রী পর্যন্ত সকলের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় তাতে আমাদের ঘরে ঘরে শ্রীরাম , শ্রীকৃষ্ণ , বুদ্ধ, মহাবীর খ্রীষ্ট ,হজরত মহন্মদ , শঙ্করাচার্য, শ্রীচৈতন্য , নানক , কবির ,লালন, শ্রীরামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ উপছে পড়ার কথা। কিন্তু তা হয়নি। তা হবার নয়। তাঁরা জন্মায় ।
তাই গৃহস্থের কল্যাণের স্বার্থে , সামাজিক স্থিতির স্বার্থে , ভুল মানুষদের আটকানোর স্বার্থে , আপামর অল্পবিদ্যে ভয়ংকরীদের হাত থেকে মানবতাকে রক্ষার স্বার্থে মূলের ধর্মীয় অনুশাসনের যুগোপযোগী সংস্কারের প্রয়োজন।
এ কাজে আপন আপন সমাজের গোঁড়ামি মুক্ত মানুষের হস্তক্ষেপ দাবি করে । সেই সঙ্গে শিকাগোর বিশ্বধর্ম সম্মেলনে স্বীকৃত সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম সংস্কারক স্বামী বিবেকানন্দের "বিশ্বজনীন ধর্ম "বোধের প্রচার ও প্রসার ঘটাতে হবে । সেটা আবার কি জিনিস ? পরে আসবো সে কথায় । আপাতত তা পালনের জন্য রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্রকে মুক্তমনা ও সক্রিয় হতে হবে। তা যদি না হয় , তবে ধর্মতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত আচরণসর্বস্ব মূলের অভ্যাসে শুধু একটা পশুর সেবা করা হবে ।
সে ক্ষেত্রে মনে পড়ে যাচ্ছে কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের সেই বিখ্যাত পংকতিচ্ছটা ---"সে পশু বাঘ সিংহের বাচ্চা নয়/ নয় কুলীন কুকুর বেড়াল/ সেই পশুর নাম অভ্যাস/ পুবোনো প্ররোচনা এখন প্রথার খুঁটিতে বাঁধা/ সোনার গাছে চেয়েছিলে হিরের ফুল/ সোনা নিয়েছে ডাকাতে/ হিরেগুলি সব অঙ্গার ।"
*********************************************************************************************************


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন