[ 'স্বরবর্ণ * ১২ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে বিশ্বনাথ পালের ধারাবাহিক উপন্যাস 'বামনের চন্দ্রাভিযান'। উপেক্ষা, অনাদর আর দারিদ্র্যের তীব্র দংশনজ্বালা দাঁতে দাঁত চেপে, একটি যুবক কী ভাবে একক নিঃসঙ্গ লড়াইয়ে জীবনের সাফল্য ছিনিয়ে আনে, এই উপন্যাস তারই জীবন্ত আখ্যান। লক্ষ লক্ষ বেকার যুবকের বেকারত্বের জ্বালার বাণীরূপই শুধু নয়, তা থেকে উত্তরণের অমোঘ বিশল্যকরণীও বটে এই উপন্যাস।]
বামনের চন্দ্রাভিযান
পর্ব * সাত
বিশ্বনাথ পাল

বিবেকানন্দ যেমন আমার মনোজগতে নায়কের আসনে ছিলেন, তেমনই আরেক মনীষীকেও অসম্ভব ভাল লাগতে শুরু করল তাঁর রচিত গানের মাধ্যমে। অথচ ছোটবেলায় আমার জ্যঠতুতো দিদি সীমাদি যখন জোরে তাঁর গার বাজাত টেপে বিশেষত সুচিত্রা মিত্রের গলায়— আমার ভাল তো লাগতই না, বরং বিরক্ত হতাম। কারণ গানের কথার প্রতি মনোযোগ ছিল না, ফলে কিছুই বোধগম্য হত না। তিনি রবীন্দ্রনাথ। যতদিন যেতে লাগল রবীন্দ্রনাথের গানে প্রাণের আরাম খুঁজে পেলাম। অনেক গানের বাণী শুনে মন হল এ যেন আমার জন্যই রচিত। এক দিনের কথা বলি।
তখন নেতাজীনগর ডে কলেজে ইকনমিক্স পড়ছি। আমাদের ব্যাচের ষোলো জনের মধ্যে চার-পাঁচ জন ছাত্রী। তার মধ্যে উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের কল্পনা বেশ দেখতে ছিল। দেখাটার থেকেও বড় কথা, ওর ব্যক্তিত্ব। আমি কবিতা লিখি পত্রিকা করি জানার পর আমাকে কল্পনা যথেষ্ট উৎসাহ দিত। সর্বোপরি আমাকে বেশ সপ্রতিভ উঁচু গলায় ‘সোমনাথ’ বলে ডাকত, শুনতে আমার ভালই লাগত। তো, অবচেতনের ডাকে সারা দিয়ে একদিন একটা কবিতা লিখে ফেলি কল্পনাকে নিয়ে। বিষয়টা এরকম— কবিকে কেউ ডাকে না। অথচ কল্পনা যখন ঝড়ের মতো গলায় ডাকে, কবি তখন গোপনে বৃষ্টি হয়ে ঝরেন। সেই বৃষ্টির নূপূরের শব্দ তার কল্পনাকে শোনাতে ইচ্ছে হয়... ইত্যাদি। লিখেছি তো লিখেছি। আবার মাথায় কী চাপল কল্পনাকে শোনানোও চাই। তাই একদিন বিকেলে ফোন করে সাইকেল চালিয়ে চলে গেলাম ওদের বাড়ি। গিয়ে জানাই যে ওকে নিয়ে কবিতা লেখার কথা। বলল, “পড়ে শোনা।”
শোনাই। তারপর বলে, “দেখি কবিতাটা।”
কাগজটা হাত বাড়িয়ে দিই।
কবিতাটা একবার খুঁটিয়ে পড়ল মনে হল। তারপর বলল, “তুই লাইটলি ভেবে কী সুন্দর কবিতা লিখিস।”
এই যেন এক মস্ত সুযোগ। যেন ফুলটোস বল, সপাটে মেরে ওভার বাউন্ডারি মারার সুযোগ। হাতছাড়া হতে দেওয়া যায় না। বলে ফেললাম, “যদি ডিপলি ভাবি?”
কল্পনার তৎক্ষণাৎ উত্তর, “তাহলে ঠকবি।”
এমন অকপট প্রাণবন্ত জবাবের জন্য কল্পনাকে কুর্নিশ জানানো যেত, কিন্তু আমার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেল ক’দিনের জন্য। অথচ বাইরে গণগণে রোদ। কোথায় বৃষ্টি! এ তো ঘন কালো মেঘ। রাশি রাশি মেঘের ভার মাথার ভিতরে। কোথায় গেলে যে একটু শান্তি পাব, শান্তির বারি সিঞ্চিত হবে বুকে— বুঝতে পারতাম না। তখন আমার দীপঙ্করদার সঙ্গে ওর বাঁশদ্রোণীর কাপড়ের দোকানে মাঝেমধ্যে আড্ডা হত। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পর দীপঙ্করদার সঙ্গে একটি কোচিঙে আবৃত্তি শিক্ষার তালিম নিয়েছিলাম কয়েক মাস। তো, একদিন দীপঙ্করদার বাড়িতে পেলাম শান্তির জল। আমার ক্ষত ও ক্ষতির নিরাময়। শান্তনু রায়চৌধুরির রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্যাসেট— ‘যৌবন বাউল’। আমাদের বাড়িতে তো টেপ রেকর্ডার ছিল না। ফলে ক্যাসেট কিনে পছন্দের গান শোনার সুযোগ নেই।দীপঙ্করদা বলল, “নতুন একজন গায়ক, খুব ভাল গাইছে, শোন।”
‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক আমি তোমায় ছাড়ব না মা
যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক
আমি তোমার চরণ মা গো, আমি তোমার চরণ করব স্মরণ
আর কারও ধার ধারব না মা’
শুনে যেন গায়ে কাঁটা দিল। শরীরে মনে বল পেলাম। অন্তরায় আবার যখন গেয়ে উঠছেন ‘...পরের আদর কাড়ব না মা’, তখন তা আমার কথা হয়ে উঠছে। পরের ভালবাসা পাওয়ার জন্য কাঙালপনা কীসের? যে আপন সে ঠিক ভালবাসবে।
বছরখানেকের মধ্যে একটা টেপ রেকর্ডার কিনি টিউশনির টাকায়। দেবব্রত বিশ্বাসের ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’ নামে একটা ক্যাসেট আমার সংগ্রহে ছিল। প্রায়ই সকালে ঘুম থেকে উঠে গানগুলো শুনতাম।একদিন ভোরে উঠে কিছুক্ষণ গান শুনে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।
বকুলতলার মাঠ, নেপালগঞ্জ, মন্মথ কয়ালের স্কুলমাঠ পেরিয়ে চলে গিয়েছি ওএনজিসি রোডে। জায়গাটা তখনও বেশ গ্রাম-গ্রাম। একটা-দুটো ধান খেত চোখে পড়েছে। রাস্তাটার নাম ওএনজিসি রোড, কারণ ওএনজিসি ওখানে খনিজতৈল আছে মনে করে খননকাজ চালায়, তবে তেল পাওয়া যায়নি। কিন্তু রাস্তাটা ওএনজিসি নামে পরিচিতি পেয়েছে। রাস্তাটার পাশে একটা ছোট কালীমন্দির, মন্দির সংলগ্ন গোড়া-বাঁধানো একটা অশ্বত্থ গাছ। সেই বাঁধানো বেদীতে বসে একটি গানের কথা মনে অনুরণিত হয়ে চলল।‘আকাশ জুড়ে শুনিনু ওই বাজে। তোমারই নাম সকল তারার মাঝে...’। এক মুহূর্তে গানটা যেন আমার মর্মে প্রবেশ করল। সমস্ত বিশ্ব প্রকৃতিতে যেন আমি ঈশ্বরের অস্তিত্ব টের পেলাম। রবীন্দ্রনাথের একটা গান উপলব্ধি করার যে এত আনন্দ আমার আগে জানা ছিল না।
এইভাবে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের আগ্রাসী বাণীর মাধ্যমে আমার হৃদয়ে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে লাগলেন।
দশ
আমাদের আকাশ গ্রুপের সদস্য রজতাভর বিয়ে ঠিক হয়েছে ওরই এক সহপাঠিনীর সঙ্গে। মেয়েটির বাড়ি শিলিগুড়ি। রজতাভ আর জি করে মেডিকেল পড়তে গেলে আলাপ। মেয়েটিও ডাক্তারির ছাত্রী ছিল। দুজনেই ডাক্তারী পাশ করে এখন কোনও সরকারি হাসপাতালে আছে। তো, বউভাতে আমাদের গ্রুপের সকলের নেমতন্ন। বরযাত্রী যাওয়ারও নেমতন্ন। শিলিগুড়ি যেতে হবে। রজতাভ বাস ঠিক করেছে। তাতে রজতাভর আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে আমরা আকাশ গ্রুপেরও চার-পাঁচজন আছি। আমার তো মনে বেশ আনন্দই হচ্ছে। হিমালয় পর্বতমালার এত কাছে এবং বাড়ি থেকে এত দূরে কখনও যাইনি। হোক না বিয়েবাড়ি উপলক্ষ্যে যাওয়া, তাও-কি একটু-আধটু প্রকৃতি, চা গাছ, ভূমিরূপের পরিবর্তন চোখে পড়বে না? ফলে বাড়িতে জানিয়ে রজতাভর বিয়েতে বরযাত্রী হিসেবে যাচ্ছি। চৌত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে বাসে যাওয়ার সময় এক অকল্পনীয় অভিজ্ঞতা হল। রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম আর রাস্তাঘাটের অবস্থা ভীষণ খারাপ। ফলে অসম্ভব ঝাঁকুনিসহ আমাদের বাসটা অত্যন্ত মন্থর গতিতে যাচ্ছিল। ঝাঁকুনির ফলে সামনের সিটের পিছনের দেয়ালে আমাদের হাঁটু বাড়ি খেতে খেতে বেশ কাহিল করে দিল। অবশেষে বাসটির বিয়ের আগের দিন রাত বারোটায় শিলিগুড়িতে পৌঁছনোর কথা থাকলেও বাসটি পৌঁছল বিয়ের দিন সকাল ৬ টায়। অর্থাৎ ঠিক ৬ ঘণ্টা দেরিতে। রজতাভরা আমাদের জন্য হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করেছিল। অথচ হোটেলে রাত কাটানো হল না। সকাল ৬টায় পৌঁছে মুখ হাত পা ধুয়ে আমরা একটা বড় খাটে পাঁচজন শুয়ে আছি। আমি, অয়ন, অনিন্দ্যদা এবং রজতাভর দুই বন্ধু। অনিন্দ্যদা অয়নদের পাড়াতেই থাকে এবং রজতাভর সঙ্গেও কীভাবে যেন সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। যাইহোক অয়ন বলছিল পাঁচজন ওই খাটে শুয়ে ঘুমাতে, রাতে যেহেতু বাসে ঝাঁকুনিতে ঘুম হয়নি। কিন্তু বিছানায় একটু গা লাগিয়ে খানিক চোখ বুজে থেকেই আমার মনে হল যতই রাতে ঘুম না হোক, দিনের বেলা এক খাটে পাঁচজন শুয়ে কিছুতেই ঘুম হবে না। তার চেয়ে বরং বাইরেটা একটু ঘোরাঘুরি করলে যদি কিছু দ্রষ্টব্য চোখে পড়ে, সেটা মস্ত লাভ হবে। অনিন্দ্যদার কানে কানে কথাটা বলতেই রাজি হয়ে গেল। আমরা দুজন হোটেলের ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম। সেদিন কী একটা কারণে যেন স্থানীয় ধর্মঘট ছিল। তবু স্ট্যান্ডে দাঁড়ানো একটা অটো বুক করা হল দেড়শো টাকায়। শিলিগুড়ির থেকে বাইশ কিলোমিটার দূরে সেবকে নিয়ে যাবে, নিয়ে আসবে। সেবকে শুনলাম তিস্তা ও পাহাড় দেখা যাবে। আমার তখন মনের অবস্থা চা গাছ দেখতে পেলেই ধন্য হই, সেখানে তিস্তা ও হিমালয়ের পাহাড় দেখা—এ তো সোনায় সোহাগা। আমাদের বাড়িতে একবার ঠাকুর নিতে আসা দলে একটি পাঁচ-ছ’ বছরের মেয়ে ছিল। বাচ্চাটা ভারি মিষ্টি। আলাপ করে জানি তার নাম তিস্তা। বলি, “উত্তরবঙ্গের নদীর নামে তোমার নাম রাখা হয়েছে?”
মেয়েটি বলল, “না-না, আমার নামে নদীটার নাম রাখা হয়েছে।”
সেবক রোড ধরে আমাদের অটো উত্তর দিকে এগিয়ে চলল। রাস্তায় চা বাগান চোখে পড়ল। সেবক স্টেশনের কাছে রেল লাইন পেরোতেই আমাদের অটো সমতল ছেড়ে পাহাড়ের পথ ধরল। ডান দিকে তিস্তার খাদ আর বাঁদিকে পাহাড়ের দেয়াল। অটো যত এগোচ্ছে খাদের গভীরতা তত বাড়ছে। পাহাড়ের দেয়ালও যেন আরও বেশি খাড়া হয়ে উঠছে। সেবক মোড়ে এসে চারিদিকের অপার্থিব সৌন্দর্যে মনে হল যেন স্বর্গে চলে এসেছি। তিন চারশো ফুট কি তারও বেশি নীচে তিস্তার সবুজ রঙের জলধারা। খরস্রোতা নদীর চলাচলের শো-শো শব্দ। তিস্তার বুকে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত তিস্তা করোনেশন ব্রিজ বা সেবক ব্রিজ। ব্রিজ পার হয়ে একটা রাস্তা চলে গিয়েছে ডুয়ার্সের দিকে। আর একটা রাস্তা ব্রিজকে ডান দিকে রেখে বাঁদিকের পাহাড়ের গা বেয়ে গিয়েছে গ্যাংটকে। ব্রিজের মাঝে দাঁড়িয়ে দক্ষিণে তাকালে চোখে পড়ে তিস্তার খাত সমতলে পড়ে ছড়িয়ে গিয়েছে বুকভরা বালির উপত্যকায় অগভীর জলধারা হয়ে। তারই উপরে রেলব্রিজ।আর ব্রিজের উত্তরে সরু কিন্তু গভীর উপত্যকা। দু’পাশে ঘন সবুজ বনে আচ্ছাদিত পাহাড় স্থানটাকে রহস্যে মুড়ে রেখেছে। ব্রিজে ওঠার আগে বাঁদিকের পাহাড় কেটে বানানো সিঁড়ি দিয়ে দেখলাম এক মন্দিরে ওঠার পথ। অন্দিন্দ্যদাকে রাজি করিয়ে জুতো খুলে পৌঁছে গেলাম মন্দিরে। শ্যামাকালীর ছোট মন্দির। মন্দিরের সামনেটা টিনের ছাউনি আর চতুর্দিকে রেলিং। একটা হাঁড়ি কাঠ। পুরোহিত ছিলেন। মা সেবকেশ্বরীর মন্দিরে সামান্য কয়েক টাকার পুজো দিলাম। মায়ের কাছে মনে মনে বললাম, “মা, একটা সরকারি চাকরি যেন পাই।” পরবর্তীকালে যে যে পরীক্ষায় বসেছি এই মন্দিরে পুরোহিতের দেওয়া মায়ের ফুল একটা খামে ভরে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছি। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু...।
এগারো
পারমিতাদির বন্ধু অরিন্দমদার সঙ্গে আমার যে কীভাবে সখ্যতা গড়ে উঠেছিল আজ আর মনে নেই। তবে অরিন্দমদা আমার কবিতা লেখা, পত্রিকা করা মোটের ওপর সাহিত্যচর্চাকে অনুপ্রাণিত করত। বেশ সপ্রতিভ অরিন্দমদা আমার থেকে বড় জোর বছর খানেকের বড় হবে হয়তো। কিন্তু যেহেতু বন্ধুর দিদির বন্ধু, তাই অরিন্দমদা ডাকতাম। অরিন্দমদার বেহালার বাড়িতে অনেক বার গিয়েছি।
একদিন অরিন্দমদা ফোন করে বলল, “সোমনাথ, সর্বশিক্ষা মিশনের বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে। বেশ কিছু স্কুলে প্যারাটিচার নিয়োগ হবে। তোমার এলাকায় কোন স্কুলে ভ্যাকেন্সি আছে একদিন সর্বশিক্ষা মিশনের অফিসে গিয়ে জেনে নাও। আর একটা অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম তুলে আনো।”
কোন কাগজে বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে তাও বলল।
কাগজটা জোগাড় করে বিজ্ঞাপনটা দেখি। আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা বি. এস-সি. পাশ। কিন্তু উৎসাহবোধ করি না।
কয়েকদিন পরে আবার অরিন্দমদার ফোন, “কীগো, গিয়েছিলে সর্বশিক্ষা মিশনের অফিসে?”
বললাম, “না। যাওয়া হয়নি। সর্বশিক্ষা মিশনের অফিসটা কোথায়?”
“গড়িয়াহাটে।”
বললাম, “আমার কি হবে? বি. এস-সি. চেয়েছে। আমার যদিও এম. এস-সি. ডিগ্রি, কিন্তু পিউর সায়েন্সের তো নয়।”
এখানে বলি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ইকনমিক্স অনার্সে ও মাস্টার্সে যথাক্রমে বি. এস-সি. ও এম. এস-সি. ডিগ্রি দেয়, যাদবপুর সেক্ষেত্রে দেয় বি. এ. ও এম. এ.। ইকনমিক্সে এত বেশি অঙ্কের প্রয়োগ একে বিজ্ঞান হিসাবে গণ্য করাই যায়।
অরিন্দমদা বলল, “দেখোই না চেষ্টা করে।”
এরপর যেন অরিন্দমদাকে খুশি করতেই একদিন দুপুরে গরিয়াহাটে সর্বশিক্ষা মিশনের অফিসে গিয়ে হানা দিলাম। খোঁজ নিয়ে জানলাম আমার এলাকায় বৈকুণ্ঠপুর শিক্ষা নিকেতনে ছ’টা ভ্যাকেন্সি আছে। আবেদনপত্রও সংগ্রহ করলাম।
প্রয়োজনীয় সমস্ত শর্ত পূরণ করে শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমাণ হিসাবে শংসাপত্রের কপিসহ আবেদন করলাম।
মাস দুই পর বাড়ির ঠিকানায় চিঠি এল। ইন্টারভিউয়ের জন্য আমাকে ডাকা হয়েছে।
দুরু দুরু বক্ষে ইন্টারভিউ দিতে গেলাম। বৈকুণ্ঠপুর শিক্ষা নিকেতন থেকে প্রায় নয় বছর আগে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছি। একাদশ-দ্বাদশ এই দু’বছর পড়েছি স্কুলটায়। এটা যদি ইন্টারভিউয়ে বলার সুযোগ পাই, আর তাতে যদি কর্তৃপক্ষের মনের বরফ গলে বেশ হয়।
ইন্টারভিউ বোর্ডে তিনজন ছিলেন, সম্ভবত সবাই স্কুলের শিক্ষক। কিন্তু তাঁরা আমাকে কেউ চিনতেন না। একজনের আমি মুখ চিনি। বৈকুণ্ঠপুর এতটাই ভাল স্কুল যে সূর্যপুর স্কুলের সাপেক্ষে আমার মতো ভাল ছাত্র বৈকুণ্ঠপুর সাপেক্ষে মাঝারি মানের। স্বভাবতই স্যারদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। পরে জানি সেদিন বোর্ডে হেডস্যার বুদ্ধদেব ঘোষও ছিলেন। দু’বছরে তাঁকে আমি কোনওদিন ক্লাসে পাইনি। কারণ তিনি ইতিহাসের শিক্ষক আর আমি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। তাছাড়া স্কুলের প্রশাসনিক বিষয় দেখতে হয় বলে হেড স্যারদের ক্লাস নেওয়ার সুযোগ খুব সীমিত।
মাধ্যমিক স্ট্যান্ডার্ডের ভৌতবিজ্ঞান থেকে আমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করা হল। পারলাম। কোন কোন স্কুলে আমার পড়াশোনা জানতে চাওয়া হলে বৈকুণ্ঠপুরের নাম বলারও সুযোগ পেলাম।
দিন পনেরো পরে আবার বাড়িতে চিঠি এল। এনগেজমেন্ট লেটার। বিশুদ্ধ চুক্তিভিত্তিক কাজ। মাসিক বেতন দু’হাজার টাকা। পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস নিতে হবে। হয়তো উঁচু গলায় বলার মতো নয়, তবু আমার জীবনে প্রথম সাফল্য। সৌজন্যে অরন্দমদা।
বৈকুণ্ঠপুর শিক্ষা নিকেতনে আমি প্যারাটিচার বা পার্শ্বশিক্ষক হিসাবে যোগ দিলাম। সেই সময় নিয়মিত ভাবে স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা হচ্ছে। তাতে পাশ করে অনেক অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা শিক্ষকতার পেশায় যোগ দিচ্ছেন। ঢুকেই তাঁদের বেতন সম্মাননীয় তো বটেই, ঈর্ষনীয়ও। সেখানে আমি প্রায় তিরিশের কাছাকাছি বয়স নিয়ে মাত্র দু’হাজার টাকার কাজে যোগ দিচ্ছি। সুতরাং স্থায়ী শিক্ষককুল যে আমার মতো শিক্ষকদের কিছুটা করুণা, অনুকম্পার চোখে দেখবেন তাতে আশ্চর্যের কথা কী!
কিন্তু দু-হাজার টাকার শিক্ষকতার কাজে গিয়েও আমার মস্ত লাভ হল। কয়েক দিনের মধ্যে আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা যে ইকনমিক্সে এম. এস-সি. তা সকলে জেনে গেলেন। কেউ হয়তো ভাবলেন, কতটা অপদার্থ হলে পরে এম. এস-সি. পাশ করেও কেউ এখানে প্যারাটিচারি করতে আসে। আবার কারও চোখে সমীহও ফুটে উঠল।
একদিন শ্যামসুন্দর গড়াই নামে একজন জীবন বিজ্ঞানের শিক্ষক আমাকে বললেন, “সোমনাথ, তোমার ইকনমিক্সে মাষ্টার ডিগ্রি না?”
বললাম, “হ্যাঁ স্যার।”
“আমার মেয়ে ক্লাস ইলেভেনে উঠল। ওকে তুমি ইকনমিক্সটা পড়াও।”
ফলে তাঁর মেয়ে সম্পাকে আমি পড়াতে শুরু করলাম। দু-তিন দিনের মধ্যেই ওর আরেক বন্ধু জয়িতা যোগ দিল। ফলে শ্যামসুন্দরবাবুর বাড়িতে আমি একাদশ শ্রেণির দু’জন ছাত্রীকে ইকনমিক্স পড়াতে থাকলাম সপ্তাহে একদিন করে। মাস না যেতেই ওই অঞ্চলে আরও তিনটে ব্যাচ তৈরি হয়ে গেল আমার। প্রতিটিতে চার-পাঁচ জন করে ছাত্র-ছাত্রী। তাদের মধ্যে কোনও একজনের বাড়িতে পড়াতাম। এক এক জনের থেকে দেড়শো টাকা করে ফি। আর এই ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে নিজের সম্মান রক্ষার তাগিদে আমাকেও ইকনমিক্সের বইপত্র বাড়িতে উল্টেপাল্টে দেখতে হত। ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্নের উত্তর দিতে যদি আমার আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা যায়, তাহলে তাদের চোখে যে অশ্রদ্ধা ফুটে উঠবে, তা কল্পনায় দেখে ডরাতাম।
ভেবে অবাকও হতাম। এম. এস-সি. পার্ট ওয়ানে ফেল করার ভয়ে পরীক্ষায় ড্রপ দেয় যে ছেলে সে-ও আজ ইকনমিক্সের টিউশন পড়াচ্ছে। নিজেকে আবিষ্কার করলাম যেন। মনে হতে লাগল সে সময় যদি প্রেমাকাঙ্ক্ষায় বিদ্ধ না হতাম, একটু সিরিয়াসলি পড়তাম, তবে আমারও ভাল রেজাল্ট হতে পারত। ইকনমিক্স মোটেই বোরিং সাবজেক্ট নয়।
বেশ কাটছিল দিনগুলি। আমার অন্যান্য টিউশনি তো ছিলই। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কয়েকটি ব্যাচে ইকনমিক্স পড়ানো। এরই ফাঁকে নিজের চাকরির জন্য পড়াশোনা এবং স্কুলের ক্লাস নেওয়া।
কয়েক জন মাস্টারমশাই পেলাম ক্লাস রুমে যাদের আমি উচ্চ মাধ্যমিকে শিক্ষকরূপে পেয়েছি। ফলে বেশির ভাগ শিক্ষকই আমাকে তুই করে বলেন, কয়েকজন তুমি করে।
কিছুদিন পরে স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা আমাকে পেয়ে বসল। এর আগে শিক্ষকমশাইদের দেখেছি দূর থেকে ক্লাসে। তাঁদের বেশির ভাগকেই দেখেছি শ্রদ্ধার চোখে। তাঁদের পড়ানোর গুণে তাঁরা আমার শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন। আবার কেউ কেউ ক্লাসে ঠিকমতো পড়াতে পারতেন না ব্যক্তিত্ব ও সদিচ্ছার অভাবে। তাঁরা সেই অনুপাতে ছাত্রের চোখে শ্রদ্ধা অর্জনে ব্যর্থ হতেন। কিন্তু মোটের ওপর শিক্ষকদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল শ্রদ্ধা ও স্নেহের। আমি তাঁদের শ্রদ্ধা করতাম, তাঁরা আমাকে করতেন স্নেহ। সূর্যপুর স্কুল যেহেতু নামডাকওয়ালা হাইফাই স্কুল ছিল না, বেশির ভাগ ছাত্রই আসত এমন পরিবার থেকে যারা নিম্নবিত্ত ও পরিবারে উদ্বাস্তু হওয়ার ইতিহাস আছে। ফলে সেখানে খানিকটা পড়ুয়া হিসাবে ক্লাসে প্রথম হয়ে আমি ভাল ছাত্রের তকমা পেয়ে স্যারদের স্নেহ অর্জনে সমর্থ হয়েছি।
কিন্তু বৈকুণ্ঠপুরে পড়াতে গিয়ে ক্লাস না থাকলে আমার ঠাঁই হল আর সব শিক্ষকদের সঙ্গে স্টাফরুমে। যতই দু’হাজার টাকা বেতনের প্যারাটিচার হই, আলাদা বসানোর বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার কথা কারও মাথায় আসেনি। আমার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আরও একজন মহিলা এই কাজে যোগ দেয়, তৃপ্তি। মাস চারেক পরে আরও চার জন। ছ’জনের মধ্যে তিনজন মহিলা, তিন জন পুরুষ। তো, ক্লাসে যে শিক্ষকদের আদর্শ মনে করতাম, শ্রদ্ধা করতাম, স্টাফরূমে তাদের ছেলেমানুষিতে আমি অবাক, ব্যথিত। তাদের স্বার্থচিন্তা আমাকে আহত করল।
একদিনের কথা বলি। স্কুলে স্টাফরুমে বসে আছি। নির্মলেন্দুবাবু আমার কানে কানে বললেন, “এটা ছেড়ে পালা। এর কোনও ভবিষ্যৎ নেই।”
বায়োলজির শিক্ষক নির্মলেন্দুবাবুকে আমিও শিক্ষক হিসাবে পেয়েছি ক্লাস টুয়েলভে পড়ার সময়। আপাতদৃষ্টিতে স্যারের কথায় কোনও বিষাক্ত স্বার্থগন্ধ নেই মনে হবে। কিন্তু ভুল ভাঙল ক’দিন পরেই। স্যারকে বলতে শোনা গেল অন্য এক স্যারকে, “আমরা দুশো টাকা নিয়ে পড়াই, এবার প্যারাটিচাররা যদি ষাট টাকা নিয়ে টিউশন পড়াতে শুরু করে, তাহলে আমাদের বাজার ডাউন খাবে।”
অর্থাৎ আমদের ভবিষৎচিন্তায় নয়, নির্মলেন্দুবাবু স্কুলে প্যারাটিচারদের আগমনে তাঁর টিউশনির বাজারে মন্দা দেখা দেওয়ার ভয়ে শঙ্কিত।
আরও দেখতাম বা উপলদ্ধি করতাম যে স্কুলের শিক্ষকদের প্রায় কারও ছেলেমেয়েই সমমানের সরকারি বা সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলে পড়ে না। তারা সব শহরের নামী ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রছাত্রী। আমার কেমন যেন মনে হত শিক্ষকরা নিজেরা যে সব স্কুলে পড়ান, সেখানে তাদের ছেলেমেয়েরা পড়লে যে মানুষ হবে না সে ব্যাপারে যেন তাদের স্থির বিশ্বাস। অথচ এই শিক্ষকদের সিংহভাগই বামপন্থায় বিশ্বাসী।
সব স্কুলেরই এই একই চিত্র কিনা কে জানে। অথচ অর্থনীতির দ্বার সবেমাত্র উন্মুক্ত হয়েছে সে সময় আমি যে স্কুল থেকে মাধ্যমিক দিয়ে বেরিয়েছি, তার পরিবেশ তো কখনও খারাপ মনে হয়নি। স্যাররা নিজের ছেলের মতনই আমাদের ভালবাসতেন, শাসন করতেন। শাসনের কথা উঠতেই একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল।
তখন ক্লাস টেনে পড়ি। ক্লাস নাইনে ত্রিপুরা থেকে নীলাদ্রী ভৌমিক নামে একটি ছেলে আমাদের স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। সে তখন আমাদেরই ব্যাচের ফোর্থ বয়। মাধ্যমিক পরীক্ষার আর মাস ছয়েক বাকি, সামনে প্রিটেষ্ট পরীক্ষা। এরকম সময়ে একদিন স্কুলে আসার পথে নীলাদ্রিকে দেখা গেল সিগারেট টানতে। দেখলেন আবার স্কুলেরই এক স্যার। সেদিন স্কুলে তো এক হুলুস্থূলু কাণ্ড। কারও আর জানতে বাকি থাকল না নীলাদ্রির কীর্তির কথা। স্যাররা নীলাদ্রীকে বেশ এক প্রস্থ উত্তম মধ্যম দেওয়ার পর প্রায় ঠিকই করে ফেললেন নীলাদ্রিকে আর স্কুলে রাখা হবে না। টিসি দিয়ে দেওয়া হবে। সেদিনই সন্ধ্যায় সুদীপ এবং আরও দু-একজন তড়িৎস্যারের বাড়িতে ছুটেছিল। স্যারকে বোঝানো হল। নীলাদ্রিকে টিসি দিয়ে দেবেন? ছেলেটার একটা বছর নষ্ট হবে। ও একটা ভুল করে ফেলেছে তার এত বড় শাস্তি দেবেন না। আর তাছাড়া ওকে টিসি দিলে এবছর আপনার স্কুলে মাধ্যমিকে কিন্তু একটা ফার্স্ট ডিভিশন কম আসবে।
সুদীপদের যুক্তি মেনে নিয়েছিলেন তড়িৎবাবু। কথা দিয়েছিলেন হেড স্যারকে বুঝিয়ে নীলাদ্রীর টিসি আটকাবেন।
নীলাদ্রিও মুখরক্ষা করেছিল। সেবার আমাদের ব্যাচের পাঁচটা প্রথম বিভাগের মধ্যে ওর নাম ছিল।
স্কুলের বাইরে কোনও ছাত্রের সিগারেট খাওয়া দেখে স্কুলের স্যারদের এমন প্রতিক্রিয়া মনে হয় এখন ইতিহাস। যুগ হয়তো পালটে গিয়েছে, বুনো রামনাথের যুগ আর নেই।
স্কুলে শুভেন্দু মণ্ডল নামে একজন মাষ্টারমশাই পড়াতে এলেন। স্থায়ী শিক্ষক, মানে এসএসসি-র মাধ্যমেই এসছেন। শুভেন্দুবাবুর চেহারাটা বেঢপ। মধ্যপ্রদেশ স্ফীত, দেখতে অনেকটা পটলের মতো। কিন্তু চেহারা নয়, কিছুটা ব্যক্তিত্বের অভাব ও অত্যধিক সারল্য শুভেন্দুবাবুকে আর সব শিক্ষকের বিনোদনের খোরাকে পরিণত করল। সবাই নয়, তবে অধিকাংশ শিক্ষকই তাঁদের সহকর্মী শুভেন্দুবাবুর পিছনে লেগে আনন্দলাভ করতেন। কিন্তু শুভেন্দুবাবু পেতেন কষ্ট, প্রায়ই রিঅ্যাক্ট করতেন। তাতে শিক্ষককুলের মজা আরও বেড়ে যেত। শিক্ষকদের আচরণের দু-একটা নমূনা পেশ করি। শুভেন্দুবাবুকে লক্ষ্য করে চক ছোড়া হত। স্কুলে প্রায়ই খাওয়া-দাওয়া হত। কখনও কারও ছেলে বা মেয়ের পরীক্ষায় পাশ করা বা সন্তান জন্মানোর আনন্দে প্রদত্ত টাকায় স্কুলে ভালমন্দ রান্না হত। ক্যান্টিন-পরিচালক প্রভাতদা রান্না করতেন। কিন্তু অনুষ্ঠানে খেয়ে মাংসের হাড়টি শুভেন্দুবাবুকে তাক করে ছোড়া হত। মাংসের তেল-হলুদের দাগে কতবার যে তাঁর জামা নোংরা হয়েছে! এসব দেখে আমার খারাপ লাগলেও প্রতিবাদ করতে পারতাম না। কেমন যেন মনে হত প্রতিবাদ করতে গেলেই আমিও চক্ষুশূল হয়ে যাব। কিন্তু একদিন আমার ক্ষোভ ব্যথা প্রকাশ হয়ে পড়ল।
ইন্দ্রায়ণ নামে মাস তিনেক আগে স্কুলে যোগ দেওয়া এক ইংরেজির স্থায়ী শিক্ষকের ছোড়া চক আমার গায়ে লাগল। আমিই লক্ষ্যবস্তু ছিলাম কিনা জানি না, কিন্তু সেই মুহূর্তে মনে হল আমাকেই টার্গেট করা হয়েছে। ফলে চোখের জল ধরে রাখতে পারলাম না। সহকারী প্রধানশিক্ষক আমাকে অনেক বোঝালেন, “আরে তোকে লক্ষ্য করে নয়। শুভেন্দুকে লক্ষ্য করে ইন্দ্র চক ছুড়েছে। কিন্তু মিসফায়ার হয়ে গেছে।”
বললাম, “ওনাকে লক্ষ্য করেই-বা ছুড়বে কেন? সরল হওয়াটা কি অপরাধ?”
কিজানি আজ এত বছর পরে স্কুলগুলির স্টাফরুমের পরিবেশ পাল্টেছে কিনা। আর এখন আমার মত কিছুটা পাল্টেছে তো বটেই। সংসারে থাকতে গেলে সংসারেই নিয়মরীতিকে মান্যতা দিতেই হয়। এখানে অতিরিক্ত সারল্যের স্থান সীমিত, নেই বললেই চলে।
এই ঘটনার পর থেকে দেখলাম অধিকাংশ শিক্ষকেরই আমাকে অপছন্দের মাত্রা বেড়ে গেল। অনেকেই আমার সঙ্গে কথাবার্তা বলা প্রায় বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু জগত এতটাই বড় যে সর্বত্রই দু-এক জন ভালবাসার মানুষ পাওয়া অসম্ভব হয় না। আমিও একজন ভালবাসার মানুষ পেলাম। চন্দন মুখার্জী। চন্দনদা বাংলার শিক্ষক। বারাসাত থেকে আসতেন স্কুলে। তাঁর সঙ্গে আমার একটা বিষয়ে খুব মিল। চন্দনদাও লেখেন। তবে আমি কবিতা আর চন্দনদা গল্প। বেশ কিছু নামী পত্র-পত্রিকায় চন্দনার গল্প বেরিয়েছে। আমাকে সেই সব পত্র-পত্রিকা ব্যাগে করে এনে দেখাতেন তিনি। বুঝতাম, আমি চন্দনদার পছন্দের পাত্র হয়ে উঠছি। আমার থেকে বছর পাঁচেকের বড় চন্দনদার তখনও বিয়ে হয়নি। কিন্তু বিয়ের জন্য দেখাশোনা চলছিল। চন্দনদার পিছনেও স্কুলের অনেকেই লাগত।তবে তা কথাতেই সীমাবদ্ধ থাকত। বেশির ভাগ সময়েই চন্দনদার এখনও বিয়ে হয়নি বলে প্রচ্ছন্ন খোঁচা থাকত সেই সব কথায়। আবার কখনও বলা হত যে সব শিক্ষকরা প্রাইভেট টিউশন পড়ায় না, তাঁরা ইনএফিসিয়েন্ট। তাঁরা ক্লাসে ভাল পড়াতে পারে না বলে তাঁদের ছাত্র জোটে না। কথাটা গায়ে লাগার মতনই কথা। কারণ চন্দনদা প্রাইভেট টিউশন পড়াত না। স্কুলে পড়ানোর পর যে অবসর মিলত তা চন্দনদা লেখালিখির কাজে ব্যয় করত। তবে বাঁকা কথায় চন্দনদা কষ্ট পেলেও রিঅ্যাক্ট করত না, প্রকাশ্যে গায়ে মাখত না। কারণ তাতে বক্তাদের খুশির মাত্রা বেড়ে গিয়ে আরও পিছনে লাগবে। প্রাইভেট টিউশন পড়ানো চন্দনদার নীতি-বিরুদ্ধ ছিল। বলত, “আমার তো রোজগার ভালই আছে। বেকার ছেলেরা করে খাক। আর তাছাড়া ক্লাসে ভাল করে পড়ালে প্রাইভেট টিউশন লাগবে কেন!” আমরা দু’জন প্রায়ই স্কুলের গেটের উল্টো দিকের চায়ের দোকানে চা খেতে ও খানিক আড্ডার লোভে যেতাম। একে অপরকে মনের কথা বলে হাল্কা হতাম।
তবে চন্দনদা বড্ড খুঁতখুঁতে মানুষ। বারাসাতে ভাড়া থাকত। একটা ফ্ল্যাট কেনার ইচ্ছের কথা প্রায়ই বলত। আমি বলতাম স্কুলের কাছেই একটা ফ্ল্যাট নিতে। বেশ কয়েকটা দেখেওছিল। কিন্তু মন স্থির করে আর এগোতে পারেনি। চন্দনদার যুক্তি— স্কুলের কাছে থাকা উচিত হবে না। কারণ স্কুলের কাঠিবাজ শিক্ষক-সহকর্মীদের থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই নাকি মঙ্গল। আমি আবার এ-যুক্তি মানতে পারতাম না। কারণ কর্মস্থলের কাছে থাকলে যাতায়াতের সময় ও গাড়িভাড়া বাঁচবে, লেখালিখিতেও আরও বেশি মন দেওয়া যাবে বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু চন্দনদার সঙ্গে মিশে বুঝেছি বারাসাতে দীর্ঘদিন ভাড়া থাকার ফলে মানুষজনের সঙ্গে যে আত্মীয়তা গড়ে উঠেছে তা উপড়ে ফেলতে খুব কষ্ট হবে। চন্দনদা সেই কষ্টের মুখোমুখি হতে চায় না।
আমাদের এই দুজনের বৃত্তে মাঝেমধ্যে ঢুকে পড়তেন অঞ্জন বিশ্বাস নামে আরেক ইংরেজির শিক্ষক। মধ্যবয়স্ক অঞ্জন বিশ্বাস কেন জানি না আমাকে বেশ স্নেহ করতেন।তাঁকে কখনও কারও পিছনে লাগতে দেখতাম না। কিন্তু স্কুলের যে এক শক্তিশালী লবির আমারা নীরব বিরোধিতা করছি, তা অঞ্জনবাবুর চোখ এড়ায়নি। তিনিও আমাদের পাশে থেকে সমর্থন যুগিয়েছেন। কিন্তু আমার অবস্থা তো স্কুলে খুব নড়বড়ে ছিল। বছরশেষে দু-তিন দিনের বিরতির পর যদি চুক্তি রিনিউ না-হয়, আমার চাকরি নট হয়ে যাবে। সে সময় খাতায়-কলমে দু-তিন দিনের বিরতির ব্যবস্থা ছিল, কারণ একটানা প্যারাটিচারি করলে স্থায়ী চাকরি দাবি জোরদার হত। তো, যাই হোক আমি কাউকে অত্যধিক চটানোর রাস্তায় না হেঁটে মোটামুটি এক ভারসাম্যের পথ বেছে নিলাম।
************************************************************
আগামী পর্বে
************************************************************