শুক্রবার, ২৮ জুন, ২০২৪

লেখা আহ্বান

 



 

#################################

স্বরবর্ণ * ২৫ 

শারদ সংখ্যা (১৪৩২)-এর জন্য লেখা জমা নেওয়া হবে ৩০ জুলাই, বুধবার পর্যন্ত। কী ধরনের লেখা, লেখা পাঠানোর ঠিকানা-সহ যাবতীয় তথ্য পাওয়া যাবে উপরের লিঙ্কে। 

##################################
  
লেখা পাঠানোর আগে নীচের বিষয়গুলি নিশ্চিত হয়ে নিন -----

১.  স্বরবর্ণ দ্বিমাসিক ওয়েব ম্যাগাজিন । 

২. লেখা মনোনয়নের ব্যাপারে সম্পাদকমন্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

৩. প্রাপ্তি সংবাদ জানানো সম্ভব নয়। নিৰ্বাচিত লেখকসূচি আমরা একমাসের মধ্যে ফেসবুকে প্রকাশ করি । 

৪. শারদ সংখ্যার জন্য আপনার মৌলিক ও অপ্রকাশিত লেখা ( গল্প কবিতা প্রবন্ধ  অণুগল্প  অনুবাদ কবিতা  ভ্রমণ কাহিনি  ইত্যাদি  ) ৩ জুলাই ০২ এর মধ্যে পাঠান । 

৫. শব্দসীমা অনির্দিষ্ট। 

৬. কবিতার ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুটি কবিতা পাঠাবেন।  

৭. লেখার সঙ্গে আপনার একটি ছবি এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, প্রকাশিত গ্রন্থ (থাকলে)  ছবিসহ পাঠান । 

৮. "স্বরবর্ণ " সামগ্রিক চিন্তার ফসল। আগে থেকে লেখা পাঠান। লেখা পাঠাবেন ওয়ার্ড ফাইলে, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ই-মেইল বডিতে টাইপ করে। পিডিএফ বা লেখার ছবি তুলে পাঠাবেন না।


* হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর   8777891532

*ই-মেইল --- debasishsaha610@gmail.com 


সম্পাদকমণ্ডলী                                             

ড : শুভঙ্কর দে           অলোক কোৱা

সৌম্যজিৎ দত্ত             দেবাশিস সাহা



শুক্রবার, ১৪ জুন, ২০২৪

তোমায় খুঁজে ফিরি * স্বামী বিশুদ্ধানন্দ




স্বামী বিশুদ্ধানন্দ

জীবনালেখ্য : রূপরেখা


১)



শ্রীশ্রীঠাকুরের তিথিপূজা উপলক্ষ্যে কাশীধাম হইতে স্বামী অচলানন্দজী মহারাজের সহিত শ্রীধাম জয়রামবাটী যাইয়া শ্রীশ্রীমায়ের চরণকমল দর্শন করেন। তাঁহার স্বকথিত বিবরণ নিম্নরূপ:

"এতদিন প্রায় বাইরে-বাইরেই ছিলুম। দ্বারকা ঘুরে কাশী এলুম। মনে হল মা'র কাছে একবার যাই, বহুদিন মা'র শ্রীচরণদর্শন করিনি। পূজনীয় অচলানন্দ স্বামী তখন কাশীতে। তাঁকে বললুম 'চলুন কেদারবাবা, মা কেমন করে ঠাকুরের তিথিপূজা করেন দেখে আসি।' তিনি রাজী হলেন।

     "বিষ্ণুপুর পর্যন্ত ট্রেনে, তারপর বাইশ মাইল গরুর-গাড়িতে। তখনও বাস হয়নি। সে বেশ মজার ব্যাপার, যেতে যেতে গাড়োয়ান গরু সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, গাড়ি আর চলে না। কী হল? অনেক ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকির পর আবার চলতে আরম্ভ করল। শেষে জয়রামবাটী পৌঁছুলুম।

     "তিথিপূজার দিন ক্রমশঃ এগিয়ে আসছে, অথচ বিশেষ কোন উদ্যোগ-আয়োজন নেই। আর দু-তিনদিন মাত্র বাকি, আমি ত মনে মনে বেশ চিন্তিত হয়ে উঠলুম, কী হবে তিথিপূজার? শেষে আর স্থির থাকতে না পেরে পুরানো বাড়ির ভেতরে যেয়ে জিজ্ঞাসা করে বসলুম, 'মা ঠাকুরের তিথিপূজা হবেনা?' তাই শুনে মায়ের মুখে অদ্ভুত একটা হাসি খেলে গেল, আহা, সে-হাসিটি এখনও মনে আছে। বললেন, 'বাবা, কি হবে জানিনা। সে-শক্তিও নেই ভক্তিও নেই।' উত্তর শুনে হতাশ হয়ে গেলুম। তারপর হঠাৎ দেখি বাঁকুড়ার এক ভক্ত এসে উপস্থিত, সঙ্গে দুগরুর-গাড়ি ভর্তি নানান জিনিস, পূজার উপচার থেকে আরম্ভ করে প্রায় হাজার লোকের খাওয়া-দাওয়ার সমস্ত উপকরণ!

     “দেখ কাণ্ড, ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা! বলেন কিনা, 'শক্তিও নেই ভক্তিও নেই'। শক্তি ভক্তি সবই যে তুমি মা।... ঠাকুর আর মা কি আলাদা, টাকার এপিঠ-ওপিঠ। 

     "মা এমন অপূর্ব তিথিপূজা করলেন যা আমার কল্পনারও বাইরে ছিল। ভাষায় কি তার প্রকাশ সম্ভব? মা'র পূজায় বিধিনিয়ম নেই, তাঁর রাগভক্তির পূজা। পূজ্যকে সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ করছেন, জাগ্রতজীবন্তভাবে সেবা করছেন। ঠাকুর যেমন ভবতারিণীকে পূজা করতেন -বালকের সরল বিশ্বাস পবিত্রতা অনুরাগ নিয়ে, -মায়েরও ঠিক তেমনি সেবাপূজা। সেই রাগভক্তি প্রেম-অনুরাগের পূজা দেখে জীবন ধন্য হল।" 


২)


শ্রীধাম হইতে পূজ্যপাদ স্বামী অচলানন্দজীর সহিত তিনি বেলুড় মঠ আগমন করেন ও দুই-তিন সপ্তাহকাল মঠবাসের পর ২০/২১ এপ্রিল (১৯১৬) কাশীধামে প্রত্যাগত হন।

     কাশী অদ্বৈত-আশ্রমে নিরবছিন্ন তপস্যায় প্রায় ষোলমাস অতিবাহিত হয়। অনন্তর শ্রীরামকৃষ্ণ-মানসপুত্রের আদেশ শিরোধার্য করিয়া ১৯১৭ খৃষ্টাব্দে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে শিবপুরী ছাড়িয়া মায়াবতীর পথে শ্রীবৃন্দাবনে উপস্থিত হইয়া ব্রজমণ্ডলের অন্তর্গত ভগবদ্-লীলাস্থান সকল প্রাণ ভরিয়া দর্শন করিলেন। পক্ষকাল ব্রজভূমে অতিবাহিত হইলে লিখিলেন, "সেদিন বারো ক্রোশ দূরে গোবর্ধন দর্শন করিতে গিয়াছিলাম, কী আনন্দ হইয়াছিল তাহা লিখিয়া আর কি জানাইব। মহাপ্রভু ও পরিকরগণ এখানে যোগসমাধি দ্বারা শ্রীকৃষ্ণের বিশেষ বিশেষ লীলাস্থলী সকল আবিষ্কার করিয়া গিয়াছেন,-পূর্বে ঐ সকল লুপ্ত অবস্থায় ছিল।

     "এই স্থানে কিছুদিন থাকিলে শ্রীভগবানের আবির্ভাব বেশ উপলব্ধি হয়। শ্রীবৃন্দাবনে ভক্তেরা এখনও তাঁর নিত্যলীলা দর্শন করিয়া থাকেন।”

     অপ্রাকৃত শ্রীবৃন্দাবনলীলার নিবিড় পরিচয় লাভে দিব্যানন্দে বিভোর সন্ন্যাসী হিমালয় অভিমুখে অগ্রসর হইলেন এবং পথে শ্যামলাতালের শান্তিনিলয় 'বিবেকানন্দ কুটিরে' প্রেমময় শ্রীমদ্ বিরজানন্দজী মহারাজের সকাশে দুই-একদিন সানন্দে বিশ্রাম করিয়া অচিরে মনোরম মায়াবতী অদ্বৈত-আশ্রমে পৌঁছিলেন। 

     অতঃপর ধ্যানগম্ভীর হিমাদ্রির ক্রোড়ে এই নির্জন নিসর্গশোভাময় স্থানে বর্ষচতুষ্টয় নিরবছিন্ন সাধনার আসন পাতিয়াছিলেন,- 'বাহিরের' কাজ বলিতে ইংরাজি 'প্রবুদ্ধ ভারত' পত্রিকার কাজ মাসে দুই-পাঁচদিন যৎসামান্য কিছু করিতেন। তথায় পূজ্য সাধুগণ পত্রিকার সম্পাদন, মুদ্রণ ও প্রকাশনের যাবতীয় কাজ নিজেরা করিতেন, বেতনভুক কর্মীর দ্বারা নয়। …


৩)


প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য, এইকালেই মহাসঙ্ঘে এক মহাবেদনাময় ঘটনা সমুপস্থিত হয়: কলিকাতা উদ্বোধন-বাড়ীতে দ্বারী সারদানন্দজীর পাঁচ মাসের অতন্দ্রসেবা ব্যর্থ করিয়া সাধককূল ও ভক্তমণ্ডলীকে অশ্রুজলে ভাসাইয়া পরমাপ্রকৃতি শ্রীশ্রীমা স্ব-স্বরূপে লীন হইলেন। (২১ জুলাই ১৯২০, মঙ্গলবার, রাত্রি ১॥ ঘটিকা)। 

     শান্তানন্দজী প্রমুখ সন্ন্যাসী-সন্তানেরা কিয়দ্দিন পূর্ব হইতে উদ্বোধন-বাড়ীতে শ্রীশ্রীমায়ের অন্তিমশয্যাপার্শ্বে উপস্থিত হইয়াছিলেন। কিন্তু বিশুদ্ধানন্দ মায়াবতী হইতে নামেন নাই; কেন কে বলিবে! কিছুদিন মৌনমুখরতার মধ্যেই কাটে।

     'বার্ধক্যের বারাণসীতে' তিনি কলিকাতার একটি ভক্তকে সান্ত্বনাচ্ছলে বলিয়াছিলেন, "যতদিন মা স্থূলশরীরে ছিলেন কত ছুটোছুটি -জয়রামবাটী, কলকাতা। ...তারপর, আর দৌড়ঝাঁপ নেই, বুকের ভেতর, স্থির! একবারে এইখানে বসে আছেন।"... শেষের কথাটি বলিবার কালে দক্ষিণ কর হৃদয়ে রাখিয়াছিলেন।

     শ্রীশ্রীমার লীলাসম্বরণের প্রায় আড়াই মাস পরে বিশুদ্ধানন্দ হিমালয়ের ক্রোড় হইতে কাশীধামে নামিয়া সপ্তাহকাল পরে বেলুড় মঠ আগমন করেন। অনন্তর কয়েকদিন সঙ্গত কারণে উদ্বোধন-বাড়ীতে বাস করিয়া ভুবনেশ্বর যাত্রা করেন। পূজ্যপাদ স্বামী ব্রহ্মানন্দজী মহারাজ বেশ কিছুকাল যাবৎ নূতন ভুবনেশ্বর মঠে অবস্থান করিতেছিলেন। বিশুদ্ধানন্দ তাঁহার সান্নিধ্যে কিয়দ্দিন কাটাইলেন এবং ঐ অবসরে একদিন নীলাচলচন্দ্রকেও দর্শন করিয়া আসিলেন। এইসময় কলিকাতা হইতে স্বামী সারদানন্দজী মহারাজ ভুবনেশ্বরে সমাগত হন -পূজ্য সঙ্ঘাধ্যক্ষকে কাশীধামে লইয়া যাইবার জন্য অনুরোধ জানাইতে। সকলে একত্র বেলুড় মঠ আগমন করেন। সঙ্ঘাধ্যক্ষের পূতসঙ্গে বিশুদ্ধানন্দ সপ্তাহকাল মঠবাস করিয়া তাঁহার সহিত বলরাম-মন্দিরে আগমন করেন। তথা হইতে ২০ জানুয়ারি ১৯২১ শ্রীরামকৃষ্ণ মানসপুত্র বারাণসী সমাগত হইলেন -ভ্রাতা সারদানন্দজী ও বিশুদ্ধানন্দ প্রমুখ সহায়ক-সন্ন্যাসী সমভিব্যাহারে। উল্লেখযোগ্য, সংগঠনগত বিশেষ কোন সমস্যার নিরসনকল্পেই পূজ্য সঙ্ঘাধ্যক্ষের এই কাশী-আগমন। শ্রীশ্রীমহারাজ ও স্বামী সারদানন্দজীর মঠ প্রত্যাবর্তনের কিছুদিন পরে বিশুদ্ধানন্দ কাশীধাম হইতে মায়াবতী প্রত্যাগত হইলেন। 


***********************************************************

প্রিয় কবি প্রিয় কবিতা * শঙ্খ ঘোষ




শঙ্খ ঘোষের পাঁচটি কবিতা









মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে

 একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি

… তোমার জন্যে গলির কোণে

ভাবি আমার মুখ দেখাব

মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।


একটা দুটো সহজ কথা

….বলব ভাবি চোখের আড়ে

জৌলুশে তা ঝলসে ওঠে

বিজ্ঞাপনে, রংবাহারে।


কে কাকে ঠিক কেমন দেখে

…. বুঝতে পারা শক্ত খুবই

হা রে আমার বাড়িয়ে বলা

হা রে আমার জন্মভূমি।


বিকিয়ে গেছে চোখের চাওয়া

…. তোমার সঙ্গে ওতপ্রত

নিয়ন আলোয় পণ্য হলো

যা-কিছু আজ ব্যক্তিগত।


মুখের কথা একলা হয়ে

   রইল পড়ে গলির কোণে

ক্লান্ত আমার মুখোশ শুধু

ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে।


চুপ করো, শব্দহীন হও

এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো

শব্দহীন হও

শষ্পমূলে ঘিরে রাখো আদরের সম্পূর্ণ মর্মর


লেখো আয়ু লেখো আয়ু


ভেঙে পড়ে ঝাউ, বালির উত্থান, ওড়ে ঝড়

তোমার চোখের নিচে আমার চোখের চরাচর

ওঠে জেগে


স্রোতের ভিতরে ঘূর্ণি, ঘূর্ণির ভিতরে স্তব্ধ

আয়ু

লেখো আয়ু লেখো আয়ু

চুপ করো, শব্দহীন হও


সবিনয় নিবেদন

আমি তো আমার শপথ রেখেছি

অক্ষরে অক্ষরে

যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন

দিয়েছি নরক করে।

দাপিয়ে বেড়াবে আমাদের দল

অন্যে কবে না কথা

বজ্র কঠিন রাজ্যশাসনে

সেটাই স্বাভাবিকতা ।

গুলির জন্য সমস্ত রাত

সমস্ত দিন খোলা

বজ্র কঠিন রাজ্যে এটাই

শান্তি শৃঙ্খলা ।

যে মরে মরুক, অথবা জীবন

কেটে যাক শোক করে—

আমি আজ জয়ী, সবার জীবন

দিয়েছি নরক করে।


বুক পেতে শুয়ে আছি ঘাসের উপরে চক্রবালে

বুক পেতে শুয়ে আছি ঘাসের উপরে চক্রবালে

তোমার ধানের মুখে ধরে আছি আর্ত দুই ঠোঁট

তুমি চোখ বন্ধ করো, আমিও দুচোখ ঢেকে শুনি

যেন কোন্ তল থেকে উঠে আসে পাতালের শ্বাস

সমস্ত দিনের মূর্ছা সেচন পেয়েছে এইখানে

মুহূর্ত এখানে এসে হঠাত্ পেয়েছে তার মানে

নিজের পায়ের চিহ্ন নিজে আর মনেও রাখেনি

আমিও রাখিনি কিছু, তবু হাত রাখে পিছুটান

মাটিতে বসানো জালা, ঠান্ডা বুক ভরে আছে জলে

এখনও বুঝিনি ভালো কাকে ঠিক ভালোবাসা বলে।


হওয়া

হলে হলো, না হলে নেই।

এইভাবেই

জীবনটাকে রেখো

তাছাড়া, কিছু শেখো

পথেবসানো ওই

উলঙ্গিনী ভিখারিনীর

দু-চোখে ধীর

প্রতিবাদের কাছে


আছে, এসবও আছে।


*******************************************************************



উপন্যাস * বিশ্বনাথ পাল



[ 'স্বরবর্ণ * ১২ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে বিশ্বনাথ পালের ধারাবাহিক উপন্যাস 'বামনের চন্দ্রাভিযান'। উপেক্ষা, অনাদর আর দারিদ্র্যের তীব্র দংশনজ্বালা দাঁতে দাঁত চেপে, একটি যুবক কী ভাবে একক নিঃসঙ্গ লড়াইয়ে জীবনের সাফল্য ছিনিয়ে আনে, এই উপন্যাস তারই জীবন্ত আখ্যান। লক্ষ লক্ষ  বেকার যুবকের বেকারত্বের জ্বালার বাণীরূপই শুধু নয়, তা থেকে উত্তরণের অমোঘ বিশল্যকরণীও বটে এই উপন্যাস।]


বামনের চন্দ্রাভিযান 

পর্ব * সাত 

বিশ্বনাথ পাল

 বিবেকানন্দ যেমন আমার মনোজগতে নায়কের আসনে ছিলেন, তেমনই আরেক মনীষীকেও অসম্ভব ভাল লাগতে শুরু করল তাঁর রচিত গানের মাধ্যমে। অথচ ছোটবেলায় আমার জ্যঠতুতো দিদি সীমাদি যখন জোরে তাঁর গার বাজাত টেপে বিশেষত সুচিত্রা মিত্রের গলায়— আমার ভাল তো লাগতই না, বরং বিরক্ত হতাম। কারণ গানের কথার প্রতি মনোযোগ ছিল না, ফলে কিছুই বোধগম্য হত না। তিনি  রবীন্দ্রনাথ। যতদিন যেতে লাগল রবীন্দ্রনাথের গানে প্রাণের আরাম খুঁজে পেলাম। অনেক গানের বাণী শুনে মন হল এ যেন আমার জন্যই রচিত। এক দিনের কথা বলি। 

তখন নেতাজীনগর ডে কলেজে ইকনমিক্স পড়ছি। আমাদের ব্যাচের ষোলো জনের মধ্যে  চার-পাঁচ জন ছাত্রী। তার মধ্যে উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের কল্পনা বেশ দেখতে ছিল। দেখাটার থেকেও বড় কথা, ওর ব্যক্তিত্ব। আমি কবিতা লিখি পত্রিকা করি জানার পর আমাকে কল্পনা যথেষ্ট উৎসাহ দিত। সর্বোপরি আমাকে বেশ সপ্রতিভ উঁচু গলায় ‘সোমনাথ’ বলে ডাকত, শুনতে আমার ভালই লাগত। তো, অবচেতনের ডাকে সারা দিয়ে একদিন একটা কবিতা লিখে ফেলি কল্পনাকে নিয়ে। বিষয়টা এরকম— কবিকে কেউ ডাকে না। অথচ কল্পনা যখন ঝড়ের মতো গলায় ডাকে, কবি তখন গোপনে বৃষ্টি হয়ে ঝরেন। সেই বৃষ্টির নূপূরের শব্দ তার কল্পনাকে শোনাতে ইচ্ছে হয়... ইত্যাদি। লিখেছি তো লিখেছি। আবার মাথায় কী চাপল কল্পনাকে শোনানোও চাই। তাই একদিন বিকেলে ফোন করে সাইকেল চালিয়ে চলে গেলাম ওদের বাড়ি। গিয়ে জানাই যে ওকে নিয়ে কবিতা লেখার কথা। বলল, “পড়ে শোনা।”

শোনাই। তারপর বলে, “দেখি কবিতাটা।” 

কাগজটা হাত বাড়িয়ে দিই।

কবিতাটা একবার খুঁটিয়ে পড়ল মনে হল। তারপর বলল, “তুই লাইটলি ভেবে কী সুন্দর কবিতা লিখিস।”

এই যেন এক মস্ত সুযোগ। যেন ফুলটোস বল, সপাটে মেরে ওভার বাউন্ডারি মারার সুযোগ। হাতছাড়া হতে দেওয়া যায় না। বলে ফেললাম, “যদি ডিপলি ভাবি?”

কল্পনার তৎক্ষণাৎ উত্তর, “তাহলে ঠকবি।” 

এমন অকপট প্রাণবন্ত জবাবের জন্য কল্পনাকে কুর্নিশ জানানো যেত, কিন্তু আমার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেল ক’দিনের জন্য। অথচ বাইরে গণগণে রোদ। কোথায় বৃষ্টি! এ তো ঘন কালো মেঘ। রাশি রাশি মেঘের ভার মাথার ভিতরে। কোথায় গেলে যে একটু শান্তি পাব, শান্তির বারি সিঞ্চিত হবে বুকে— বুঝতে পারতাম না। তখন আমার দীপঙ্করদার সঙ্গে ওর বাঁশদ্রোণীর কাপড়ের দোকানে মাঝেমধ্যে আড্ডা হত। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পর দীপঙ্করদার সঙ্গে একটি কোচিঙে আবৃত্তি শিক্ষার তালিম নিয়েছিলাম কয়েক মাস। তো, একদিন  দীপঙ্করদার বাড়িতে পেলাম শান্তির জল। আমার ক্ষত ও ক্ষতির নিরাময়। শান্তনু রায়চৌধুরির রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্যাসেট— ‘যৌবন বাউল’। আমাদের বাড়িতে তো টেপ রেকর্ডার ছিল না। ফলে ক্যাসেট কিনে পছন্দের গান শোনার সুযোগ নেই।দীপঙ্করদা বলল, “নতুন একজন গায়ক, খুব ভাল গাইছে, শোন।” 

‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক আমি তোমায় ছাড়ব না মা

  যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক

আমি তোমার চরণ মা গো, আমি তোমার চরণ করব স্মরণ

আর কারও ধার ধারব না মা’


শুনে যেন গায়ে কাঁটা দিল। শরীরে মনে বল পেলাম। অন্তরায় আবার যখন গেয়ে উঠছেন ‘...পরের আদর কাড়ব না মা’, তখন তা আমার কথা হয়ে উঠছে। পরের ভালবাসা পাওয়ার জন্য কাঙালপনা কীসের? যে আপন সে ঠিক ভালবাসবে। 

বছরখানেকের মধ্যে একটা টেপ রেকর্ডার কিনি টিউশনির টাকায়। দেবব্রত বিশ্বাসের ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’ নামে একটা ক্যাসেট আমার সংগ্রহে ছিল। প্রায়ই সকালে ঘুম থেকে উঠে গানগুলো শুনতাম।একদিন ভোরে উঠে কিছুক্ষণ গান শুনে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।  

বকুলতলার মাঠ, নেপালগঞ্জ, মন্মথ কয়ালের স্কুলমাঠ পেরিয়ে চলে গিয়েছি ওএনজিসি রোডে। জায়গাটা তখনও বেশ গ্রাম-গ্রাম। একটা-দুটো ধান খেত চোখে পড়েছে। রাস্তাটার নাম ওএনজিসি রোড, কারণ ওএনজিসি ওখানে খনিজতৈল আছে মনে করে খননকাজ চালায়, তবে তেল পাওয়া যায়নি। কিন্তু রাস্তাটা ওএনজিসি নামে পরিচিতি পেয়েছে। রাস্তাটার পাশে একটা ছোট কালীমন্দির, মন্দির সংলগ্ন গোড়া-বাঁধানো একটা অশ্বত্থ গাছ। সেই বাঁধানো বেদীতে বসে একটি গানের কথা মনে অনুরণিত হয়ে চলল।‘আকাশ জুড়ে শুনিনু ওই বাজে। তোমারই নাম সকল তারার মাঝে...’। এক মুহূর্তে গানটা যেন আমার মর্মে প্রবেশ করল। সমস্ত বিশ্ব প্রকৃতিতে যেন আমি ঈশ্বরের অস্তিত্ব টের পেলাম। রবীন্দ্রনাথের একটা গান উপলব্ধি করার যে এত আনন্দ আমার আগে জানা ছিল না।

এইভাবে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের আগ্রাসী বাণীর মাধ্যমে আমার হৃদয়ে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে লাগলেন। 


দশ

আমাদের আকাশ গ্রুপের সদস্য রজতাভর বিয়ে ঠিক হয়েছে ওরই এক সহপাঠিনীর সঙ্গে। মেয়েটির বাড়ি শিলিগুড়ি। রজতাভ আর জি করে মেডিকেল পড়তে গেলে আলাপ। মেয়েটিও ডাক্তারির ছাত্রী ছিল। দুজনেই ডাক্তারী পাশ করে এখন কোনও সরকারি হাসপাতালে আছে। তো, বউভাতে আমাদের গ্রুপের সকলের নেমতন্ন। বরযাত্রী যাওয়ারও নেমতন্ন। শিলিগুড়ি যেতে  হবে। রজতাভ বাস ঠিক করেছে। তাতে রজতাভর আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে আমরা আকাশ গ্রুপেরও চার-পাঁচজন আছি। আমার তো মনে বেশ আনন্দই হচ্ছে। হিমালয় পর্বতমালার এত কাছে এবং বাড়ি থেকে এত দূরে কখনও যাইনি। হোক না বিয়েবাড়ি উপলক্ষ্যে যাওয়া, তাও-কি একটু-আধটু প্রকৃতি, চা গাছ, ভূমিরূপের পরিবর্তন চোখে পড়বে না? ফলে বাড়িতে জানিয়ে রজতাভর বিয়েতে বরযাত্রী হিসেবে যাচ্ছি। চৌত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে বাসে যাওয়ার   সময়  এক অকল্পনীয় অভিজ্ঞতা হল। রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম আর রাস্তাঘাটের অবস্থা ভীষণ খারাপ। ফলে অসম্ভব ঝাঁকুনিসহ আমাদের বাসটা অত্যন্ত মন্থর গতিতে যাচ্ছিল। ঝাঁকুনির ফলে সামনের সিটের পিছনের দেয়ালে আমাদের হাঁটু বাড়ি খেতে খেতে বেশ কাহিল করে দিল। অবশেষে বাসটির বিয়ের আগের দিন রাত বারোটায় শিলিগুড়িতে পৌঁছনোর কথা থাকলেও বাসটি পৌঁছল বিয়ের দিন সকাল ৬ টায়। অর্থাৎ ঠিক ৬ ঘণ্টা দেরিতে। রজতাভরা আমাদের জন্য হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করেছিল। অথচ হোটেলে রাত কাটানো হল না। সকাল ৬টায় পৌঁছে মুখ হাত পা ধুয়ে আমরা একটা বড় খাটে পাঁচজন শুয়ে আছি। আমি, অয়ন, অনিন্দ্যদা এবং রজতাভর দুই বন্ধু। অনিন্দ্যদা অয়নদের পাড়াতেই থাকে এবং রজতাভর সঙ্গেও কীভাবে যেন সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। যাইহোক অয়ন বলছিল পাঁচজন ওই খাটে শুয়ে ঘুমাতে, রাতে যেহেতু বাসে ঝাঁকুনিতে ঘুম হয়নি। কিন্তু বিছানায় একটু গা লাগিয়ে খানিক চোখ বুজে থেকেই আমার মনে হল যতই রাতে ঘুম না হোক, দিনের বেলা এক খাটে পাঁচজন শুয়ে কিছুতেই ঘুম হবে না। তার চেয়ে বরং বাইরেটা একটু ঘোরাঘুরি করলে যদি কিছু দ্রষ্টব্য চোখে পড়ে, সেটা মস্ত লাভ হবে। অনিন্দ্যদার কানে কানে কথাটা বলতেই রাজি হয়ে গেল। আমরা দুজন হোটেলের ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম। সেদিন কী একটা কারণে যেন স্থানীয় ধর্মঘট ছিল। তবু স্ট্যান্ডে দাঁড়ানো একটা অটো বুক করা হল দেড়শো টাকায়। শিলিগুড়ির থেকে বাইশ কিলোমিটার দূরে সেবকে নিয়ে যাবে, নিয়ে আসবে। সেবকে শুনলাম তিস্তা ও পাহাড় দেখা যাবে। আমার তখন মনের অবস্থা চা গাছ দেখতে পেলেই ধন্য হই, সেখানে তিস্তা ও হিমালয়ের পাহাড় দেখা—এ তো সোনায় সোহাগা। আমাদের বাড়িতে একবার ঠাকুর নিতে আসা দলে একটি পাঁচ-ছ’ বছরের মেয়ে ছিল। বাচ্চাটা ভারি মিষ্টি। আলাপ করে জানি তার নাম তিস্তা। বলি, “উত্তরবঙ্গের নদীর নামে তোমার নাম রাখা হয়েছে?” 

মেয়েটি বলল, “না-না, আমার নামে নদীটার নাম রাখা হয়েছে।” 

সেবক রোড ধরে আমাদের অটো উত্তর দিকে এগিয়ে চলল। রাস্তায় চা বাগান চোখে পড়ল। সেবক স্টেশনের কাছে রেল লাইন পেরোতেই আমাদের অটো সমতল ছেড়ে পাহাড়ের পথ  ধরল। ডান দিকে তিস্তার খাদ আর বাঁদিকে পাহাড়ের দেয়াল। অটো যত এগোচ্ছে খাদের গভীরতা তত বাড়ছে। পাহাড়ের দেয়ালও যেন আরও বেশি খাড়া হয়ে উঠছে। সেবক মোড়ে এসে চারিদিকের অপার্থিব সৌন্দর্যে মনে হল যেন স্বর্গে চলে এসেছি। তিন চারশো ফুট কি তারও বেশি নীচে তিস্তার সবুজ রঙের জলধারা। খরস্রোতা নদীর চলাচলের শো-শো শব্দ। তিস্তার বুকে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত তিস্তা করোনেশন ব্রিজ বা সেবক ব্রিজ। ব্রিজ পার হয়ে একটা রাস্তা চলে গিয়েছে ডুয়ার্সের দিকে। আর একটা রাস্তা ব্রিজকে ডান দিকে রেখে বাঁদিকের পাহাড়ের গা বেয়ে গিয়েছে গ্যাংটকে। ব্রিজের মাঝে দাঁড়িয়ে দক্ষিণে তাকালে চোখে পড়ে তিস্তার খাত সমতলে পড়ে ছড়িয়ে গিয়েছে বুকভরা বালির উপত্যকায় অগভীর জলধারা হয়ে। তারই উপরে রেলব্রিজ।আর ব্রিজের উত্তরে সরু কিন্তু গভীর উপত্যকা। দু’পাশে ঘন সবুজ বনে আচ্ছাদিত পাহাড় স্থানটাকে রহস্যে মুড়ে রেখেছে। ব্রিজে ওঠার আগে বাঁদিকের পাহাড় কেটে বানানো সিঁড়ি দিয়ে দেখলাম এক মন্দিরে ওঠার পথ। অন্দিন্দ্যদাকে রাজি করিয়ে জুতো খুলে পৌঁছে গেলাম মন্দিরে। শ্যামাকালীর ছোট মন্দির। মন্দিরের সামনেটা টিনের ছাউনি আর চতুর্দিকে রেলিং। একটা হাঁড়ি কাঠ।  পুরোহিত ছিলেন। মা সেবকেশ্বরীর মন্দিরে সামান্য কয়েক টাকার পুজো দিলাম। মায়ের কাছে মনে মনে বললাম, “মা, একটা সরকারি চাকরি যেন পাই।” পরবর্তীকালে যে যে পরীক্ষায় বসেছি এই মন্দিরে পুরোহিতের দেওয়া মায়ের ফুল একটা খামে ভরে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছি। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু...।


এগারো

পারমিতাদির বন্ধু অরিন্দমদার সঙ্গে আমার যে কীভাবে সখ্যতা গড়ে উঠেছিল আজ আর মনে নেই। তবে অরিন্দমদা আমার কবিতা লেখা, পত্রিকা করা মোটের ওপর সাহিত্যচর্চাকে অনুপ্রাণিত করত। বেশ সপ্রতিভ অরিন্দমদা আমার থেকে বড় জোর বছর খানেকের বড় হবে হয়তো। কিন্তু যেহেতু বন্ধুর দিদির বন্ধু, তাই অরিন্দমদা ডাকতাম। অরিন্দমদার বেহালার বাড়িতে অনেক বার গিয়েছি। 

একদিন অরিন্দমদা ফোন করে বলল, “সোমনাথ, সর্বশিক্ষা মিশনের বিজ্ঞাপন  বেরিয়েছে। বেশ কিছু স্কুলে প্যারাটিচার নিয়োগ হবে। তোমার এলাকায় কোন স্কুলে ভ্যাকেন্সি আছে একদিন সর্বশিক্ষা মিশনের অফিসে গিয়ে জেনে নাও। আর একটা অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম তুলে আনো।” 

কোন কাগজে বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে তাও বলল।  

কাগজটা জোগাড় করে বিজ্ঞাপনটা দেখি। আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা বি. এস-সি. পাশ। কিন্তু উৎসাহবোধ করি না।

কয়েকদিন পরে আবার অরিন্দমদার ফোন, “কীগো, গিয়েছিলে সর্বশিক্ষা মিশনের অফিসে?”

বললাম, “না। যাওয়া হয়নি। সর্বশিক্ষা মিশনের অফিসটা কোথায়?”

“গড়িয়াহাটে।” 

বললাম, “আমার কি হবে? বি. এস-সি. চেয়েছে। আমার যদিও এম. এস-সি. ডিগ্রি, কিন্তু পিউর সায়েন্সের তো নয়।” 

এখানে বলি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ইকনমিক্স অনার্সে ও মাস্টার্সে যথাক্রমে বি. এস-সি.  ও এম. এস-সি. ডিগ্রি দেয়, যাদবপুর সেক্ষেত্রে দেয় বি. এ. ও এম. এ.। ইকনমিক্সে এত বেশি  অঙ্কের প্রয়োগ একে বিজ্ঞান হিসাবে গণ্য করাই যায়।  

অরিন্দমদা বলল, “দেখোই না চেষ্টা করে।”


এরপর যেন অরিন্দমদাকে খুশি করতেই একদিন দুপুরে গরিয়াহাটে সর্বশিক্ষা মিশনের অফিসে গিয়ে হানা দিলাম। খোঁজ নিয়ে জানলাম আমার এলাকায় বৈকুণ্ঠপুর শিক্ষা নিকেতনে   ছ’টা ভ্যাকেন্সি আছে। আবেদনপত্রও সংগ্রহ করলাম।  

প্রয়োজনীয় সমস্ত শর্ত পূরণ করে শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমাণ হিসাবে শংসাপত্রের কপিসহ আবেদন করলাম। 

মাস দুই পর বাড়ির ঠিকানায় চিঠি এল। ইন্টারভিউয়ের জন্য আমাকে ডাকা হয়েছে।

দুরু দুরু বক্ষে ইন্টারভিউ দিতে গেলাম। বৈকুণ্ঠপুর শিক্ষা নিকেতন থেকে প্রায় নয় বছর আগে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছি। একাদশ-দ্বাদশ এই দু’বছর পড়েছি স্কুলটায়। এটা যদি  ইন্টারভিউয়ে বলার সুযোগ পাই, আর তাতে যদি কর্তৃপক্ষের মনের বরফ গলে বেশ হয়।  

ইন্টারভিউ বোর্ডে তিনজন ছিলেন, সম্ভবত সবাই স্কুলের শিক্ষক। কিন্তু তাঁরা আমাকে কেউ চিনতেন না। একজনের আমি মুখ চিনি। বৈকুণ্ঠপুর এতটাই ভাল স্কুল যে সূর্যপুর স্কুলের সাপেক্ষে আমার মতো ভাল ছাত্র বৈকুণ্ঠপুর সাপেক্ষে মাঝারি মানের। স্বভাবতই স্যারদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। পরে জানি সেদিন বোর্ডে হেডস্যার বুদ্ধদেব ঘোষও ছিলেন। দু’বছরে তাঁকে আমি কোনওদিন ক্লাসে পাইনি। কারণ তিনি ইতিহাসের শিক্ষক আর আমি বিজ্ঞান  বিভাগের ছাত্র। তাছাড়া স্কুলের প্রশাসনিক বিষয় দেখতে হয় বলে হেড স্যারদের ক্লাস নেওয়ার সুযোগ খুব সীমিত।  

মাধ্যমিক স্ট্যান্ডার্ডের ভৌতবিজ্ঞান থেকে আমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করা হল। পারলাম। কোন কোন স্কুলে আমার পড়াশোনা জানতে চাওয়া হলে বৈকুণ্ঠপুরের নাম বলারও সুযোগ পেলাম।  

দিন পনেরো পরে আবার বাড়িতে চিঠি এল। এনগেজমেন্ট লেটার। বিশুদ্ধ চুক্তিভিত্তিক কাজ। মাসিক বেতন দু’হাজার টাকা। পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস নিতে হবে। হয়তো উঁচু গলায় বলার মতো নয়, তবু আমার জীবনে প্রথম সাফল্য। সৌজন্যে অরন্দমদা।

বৈকুণ্ঠপুর শিক্ষা নিকেতনে আমি প্যারাটিচার বা পার্শ্বশিক্ষক হিসাবে যোগ দিলাম। সেই সময় নিয়মিত ভাবে স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা হচ্ছে। তাতে পাশ করে অনেক অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা শিক্ষকতার পেশায় যোগ দিচ্ছেন। ঢুকেই তাঁদের বেতন সম্মাননীয় তো বটেই, ঈর্ষনীয়ও। সেখানে আমি প্রায় তিরিশের কাছাকাছি বয়স নিয়ে মাত্র দু’হাজার টাকার কাজে যোগ দিচ্ছি। সুতরাং স্থায়ী শিক্ষককুল যে আমার মতো শিক্ষকদের কিছুটা করুণা, অনুকম্পার চোখে দেখবেন তাতে আশ্চর্যের কথা কী! 

 কিন্তু দু-হাজার টাকার শিক্ষকতার কাজে গিয়েও আমার মস্ত লাভ হল। কয়েক দিনের মধ্যে আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা যে ইকনমিক্সে এম. এস-সি. তা সকলে জেনে গেলেন। কেউ  হয়তো ভাবলেন, কতটা অপদার্থ হলে পরে এম. এস-সি. পাশ করেও কেউ এখানে প্যারাটিচারি করতে আসে। আবার কারও চোখে সমীহও ফুটে উঠল। 

একদিন শ্যামসুন্দর গড়াই নামে একজন জীবন বিজ্ঞানের শিক্ষক আমাকে বললেন, “সোমনাথ, তোমার ইকনমিক্সে মাষ্টার ডিগ্রি না?”

বললাম, “হ্যাঁ স্যার।”

“আমার মেয়ে ক্লাস ইলেভেনে উঠল। ওকে তুমি ইকনমিক্সটা পড়াও।”

ফলে তাঁর মেয়ে সম্পাকে আমি পড়াতে শুরু করলাম। দু-তিন দিনের মধ্যেই ওর আরেক বন্ধু জয়িতা যোগ দিল। ফলে শ্যামসুন্দরবাবুর বাড়িতে আমি একাদশ শ্রেণির দু’জন ছাত্রীকে ইকনমিক্স পড়াতে থাকলাম সপ্তাহে একদিন করে। মাস না যেতেই ওই অঞ্চলে আরও তিনটে ব্যাচ তৈরি হয়ে গেল আমার। প্রতিটিতে চার-পাঁচ জন করে ছাত্র-ছাত্রী। তাদের মধ্যে কোনও একজনের বাড়িতে পড়াতাম। এক এক জনের থেকে দেড়শো টাকা করে ফি। আর এই ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে নিজের সম্মান রক্ষার তাগিদে আমাকেও ইকনমিক্সের বইপত্র বাড়িতে উল্টেপাল্টে দেখতে হত। ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্নের উত্তর দিতে যদি আমার আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা যায়, তাহলে তাদের চোখে যে অশ্রদ্ধা ফুটে উঠবে, তা কল্পনায় দেখে ডরাতাম।  

ভেবে অবাকও হতাম। এম. এস-সি. পার্ট ওয়ানে ফেল করার ভয়ে পরীক্ষায় ড্রপ দেয় যে ছেলে সে-ও আজ ইকনমিক্সের টিউশন পড়াচ্ছে। নিজেকে আবিষ্কার করলাম যেন। মনে হতে লাগল সে সময় যদি প্রেমাকাঙ্ক্ষায় বিদ্ধ না হতাম, একটু সিরিয়াসলি পড়তাম, তবে আমারও ভাল রেজাল্ট হতে পারত। ইকনমিক্স মোটেই বোরিং সাবজেক্ট নয়।  

বেশ কাটছিল দিনগুলি। আমার অন্যান্য টিউশনি তো ছিলই। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কয়েকটি ব্যাচে ইকনমিক্স পড়ানো। এরই ফাঁকে নিজের চাকরির জন্য পড়াশোনা এবং স্কুলের ক্লাস নেওয়া। 

কয়েক জন মাস্টারমশাই পেলাম ক্লাস রুমে যাদের আমি উচ্চ মাধ্যমিকে শিক্ষকরূপে পেয়েছি। ফলে বেশির ভাগ শিক্ষকই আমাকে তুই করে বলেন, কয়েকজন তুমি করে।

কিছুদিন পরে স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা আমাকে পেয়ে বসল। এর আগে শিক্ষকমশাইদের দেখেছি দূর থেকে ক্লাসে। তাঁদের বেশির ভাগকেই দেখেছি শ্রদ্ধার চোখে। তাঁদের পড়ানোর গুণে তাঁরা আমার শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন। আবার কেউ কেউ ক্লাসে ঠিকমতো পড়াতে পারতেন না ব্যক্তিত্ব ও সদিচ্ছার অভাবে। তাঁরা সেই অনুপাতে ছাত্রের চোখে শ্রদ্ধা অর্জনে ব্যর্থ হতেন। কিন্তু মোটের ওপর শিক্ষকদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল শ্রদ্ধা ও স্নেহের। আমি তাঁদের শ্রদ্ধা করতাম, তাঁরা আমাকে করতেন স্নেহ। সূর্যপুর স্কুল যেহেতু নামডাকওয়ালা হাইফাই স্কুল ছিল না, বেশির ভাগ ছাত্রই আসত এমন পরিবার থেকে যারা নিম্নবিত্ত ও পরিবারে উদ্বাস্তু হওয়ার ইতিহাস আছে। ফলে সেখানে খানিকটা পড়ুয়া হিসাবে ক্লাসে প্রথম হয়ে আমি ভাল ছাত্রের তকমা পেয়ে স্যারদের স্নেহ অর্জনে সমর্থ হয়েছি।

কিন্তু বৈকুণ্ঠপুরে পড়াতে গিয়ে ক্লাস না থাকলে আমার ঠাঁই হল আর সব শিক্ষকদের সঙ্গে স্টাফরুমে। যতই দু’হাজার টাকা বেতনের প্যারাটিচার হই, আলাদা বসানোর বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার কথা কারও মাথায় আসেনি। আমার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আরও একজন মহিলা এই কাজে যোগ দেয়, তৃপ্তি। মাস চারেক পরে আরও চার জন। ছ’জনের মধ্যে তিনজন মহিলা, তিন জন পুরুষ। তো, ক্লাসে যে শিক্ষকদের আদর্শ মনে করতাম, শ্রদ্ধা করতাম, স্টাফরূমে তাদের ছেলেমানুষিতে আমি অবাক, ব্যথিত। তাদের স্বার্থচিন্তা আমাকে আহত করল।

একদিনের কথা বলি। স্কুলে স্টাফরুমে বসে আছি। নির্মলেন্দুবাবু আমার কানে কানে বললেন, “এটা ছেড়ে পালা। এর কোনও ভবিষ্যৎ নেই।”

বায়োলজির শিক্ষক নির্মলেন্দুবাবুকে আমিও শিক্ষক হিসাবে পেয়েছি ক্লাস টুয়েলভে পড়ার সময়। আপাতদৃষ্টিতে স্যারের কথায় কোনও বিষাক্ত স্বার্থগন্ধ নেই মনে হবে। কিন্তু ভুল ভাঙল ক’দিন পরেই। স্যারকে বলতে শোনা গেল অন্য এক স্যারকে, “আমরা দুশো টাকা নিয়ে পড়াই, এবার প্যারাটিচাররা যদি ষাট টাকা নিয়ে টিউশন পড়াতে শুরু করে, তাহলে আমাদের বাজার ডাউন খাবে।” 

অর্থাৎ আমদের ভবিষৎচিন্তায় নয়, নির্মলেন্দুবাবু স্কুলে প্যারাটিচারদের আগমনে তাঁর টিউশনির বাজারে মন্দা দেখা দেওয়ার ভয়ে শঙ্কিত।

আরও দেখতাম বা উপলদ্ধি করতাম যে স্কুলের শিক্ষকদের প্রায় কারও ছেলেমেয়েই সমমানের সরকারি বা সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলে পড়ে না। তারা সব শহরের নামী ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রছাত্রী। আমার কেমন যেন মনে হত শিক্ষকরা নিজেরা যে সব স্কুলে পড়ান, সেখানে তাদের ছেলেমেয়েরা পড়লে যে মানুষ হবে না সে ব্যাপারে যেন তাদের স্থির বিশ্বাস। অথচ এই শিক্ষকদের সিংহভাগই বামপন্থায় বিশ্বাসী। 

সব স্কুলেরই এই একই চিত্র কিনা কে জানে। অথচ অর্থনীতির দ্বার সবেমাত্র উন্মুক্ত হয়েছে সে সময় আমি যে স্কুল থেকে মাধ্যমিক দিয়ে বেরিয়েছি, তার পরিবেশ তো কখনও  খারাপ মনে হয়নি। স্যাররা নিজের ছেলের মতনই আমাদের ভালবাসতেন, শাসন করতেন। শাসনের কথা উঠতেই একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল।

তখন ক্লাস টেনে পড়ি। ক্লাস নাইনে ত্রিপুরা থেকে নীলাদ্রী ভৌমিক নামে একটি ছেলে আমাদের স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। সে তখন আমাদেরই ব্যাচের ফোর্থ বয়। মাধ্যমিক পরীক্ষার আর  মাস ছয়েক বাকি, সামনে প্রিটেষ্ট পরীক্ষা। এরকম সময়ে একদিন স্কুলে আসার পথে নীলাদ্রিকে  দেখা গেল সিগারেট টানতে। দেখলেন আবার স্কুলেরই এক স্যার। সেদিন স্কুলে তো এক হুলুস্থূলু কাণ্ড। কারও আর জানতে বাকি থাকল না নীলাদ্রির কীর্তির কথা। স্যাররা নীলাদ্রীকে বেশ এক প্রস্থ উত্তম মধ্যম দেওয়ার পর প্রায় ঠিকই করে ফেললেন নীলাদ্রিকে আর স্কুলে রাখা হবে না। টিসি দিয়ে দেওয়া হবে। সেদিনই সন্ধ্যায় সুদীপ এবং আরও দু-একজন তড়িৎস্যারের বাড়িতে ছুটেছিল। স্যারকে বোঝানো হল। নীলাদ্রিকে টিসি দিয়ে দেবেন? ছেলেটার একটা বছর নষ্ট হবে। ও একটা ভুল করে ফেলেছে তার এত বড় শাস্তি দেবেন না। আর তাছাড়া ওকে টিসি দিলে এবছর আপনার স্কুলে মাধ্যমিকে কিন্তু একটা ফার্স্ট ডিভিশন কম আসবে।

সুদীপদের যুক্তি মেনে নিয়েছিলেন তড়িৎবাবু। কথা দিয়েছিলেন হেড স্যারকে বুঝিয়ে নীলাদ্রীর টিসি আটকাবেন।

নীলাদ্রিও মুখরক্ষা করেছিল। সেবার আমাদের ব্যাচের পাঁচটা প্রথম বিভাগের মধ্যে ওর নাম ছিল।

স্কুলের বাইরে কোনও ছাত্রের সিগারেট খাওয়া দেখে স্কুলের স্যারদের এমন প্রতিক্রিয়া মনে হয় এখন ইতিহাস। যুগ হয়তো পালটে গিয়েছে, বুনো রামনাথের যুগ আর নেই। 

স্কুলে শুভেন্দু মণ্ডল নামে একজন মাষ্টারমশাই পড়াতে এলেন। স্থায়ী শিক্ষক, মানে এসএসসি-র মাধ্যমেই এসছেন। শুভেন্দুবাবুর চেহারাটা বেঢপ। মধ্যপ্রদেশ স্ফীত, দেখতে অনেকটা পটলের মতো। কিন্তু চেহারা নয়, কিছুটা ব্যক্তিত্বের অভাব ও অত্যধিক সারল্য শুভেন্দুবাবুকে আর সব শিক্ষকের বিনোদনের খোরাকে পরিণত করল। সবাই নয়, তবে অধিকাংশ শিক্ষকই  তাঁদের সহকর্মী শুভেন্দুবাবুর পিছনে লেগে আনন্দলাভ করতেন। কিন্তু শুভেন্দুবাবু পেতেন কষ্ট, প্রায়ই রিঅ্যাক্ট করতেন। তাতে শিক্ষককুলের মজা আরও বেড়ে যেত। শিক্ষকদের আচরণের দু-একটা নমূনা পেশ করি। শুভেন্দুবাবুকে লক্ষ্য করে চক ছোড়া হত। স্কুলে প্রায়ই খাওয়া-দাওয়া হত। কখনও কারও ছেলে বা মেয়ের পরীক্ষায় পাশ করা বা সন্তান জন্মানোর আনন্দে প্রদত্ত টাকায় স্কুলে ভালমন্দ রান্না হত। ক্যান্টিন-পরিচালক প্রভাতদা রান্না করতেন। কিন্তু অনুষ্ঠানে  খেয়ে মাংসের হাড়টি  শুভেন্দুবাবুকে তাক করে ছোড়া হত। মাংসের তেল-হলুদের দাগে কতবার যে তাঁর জামা নোংরা হয়েছে! এসব দেখে আমার খারাপ লাগলেও প্রতিবাদ করতে পারতাম না। কেমন যেন মনে হত প্রতিবাদ করতে গেলেই আমিও চক্ষুশূল হয়ে যাব। কিন্তু একদিন আমার ক্ষোভ ব্যথা প্রকাশ হয়ে পড়ল।

ইন্দ্রায়ণ নামে মাস তিনেক আগে স্কুলে যোগ দেওয়া এক ইংরেজির স্থায়ী শিক্ষকের ছোড়া চক আমার গায়ে লাগল। আমিই লক্ষ্যবস্তু ছিলাম কিনা জানি না, কিন্তু সেই মুহূর্তে মনে হল আমাকেই টার্গেট করা হয়েছে। ফলে চোখের জল ধরে রাখতে পারলাম না। সহকারী প্রধানশিক্ষক  আমাকে অনেক বোঝালেন, “আরে তোকে লক্ষ্য করে নয়। শুভেন্দুকে লক্ষ্য করে ইন্দ্র চক  ছুড়েছে। কিন্তু মিসফায়ার হয়ে গেছে।”  

বললাম, “ওনাকে লক্ষ্য করেই-বা ছুড়বে কেন? সরল হওয়াটা কি অপরাধ?” 

কিজানি আজ এত বছর পরে স্কুলগুলির স্টাফরুমের পরিবেশ পাল্টেছে কিনা। আর এখন আমার মত কিছুটা পাল্টেছে তো বটেই। সংসারে থাকতে গেলে সংসারেই নিয়মরীতিকে মান্যতা দিতেই হয়। এখানে অতিরিক্ত সারল্যের স্থান সীমিত, নেই বললেই চলে।

এই ঘটনার পর থেকে দেখলাম অধিকাংশ শিক্ষকেরই আমাকে অপছন্দের মাত্রা বেড়ে গেল। অনেকেই আমার সঙ্গে কথাবার্তা বলা প্রায় বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু জগত এতটাই বড় যে সর্বত্রই দু-এক জন ভালবাসার মানুষ পাওয়া অসম্ভব হয় না। আমিও একজন ভালবাসার মানুষ পেলাম। চন্দন মুখার্জী। চন্দনদা বাংলার শিক্ষক। বারাসাত থেকে আসতেন স্কুলে। তাঁর সঙ্গে আমার একটা বিষয়ে খুব মিল। চন্দনদাও লেখেন। তবে আমি কবিতা আর চন্দনদা গল্প। বেশ কিছু নামী পত্র-পত্রিকায় চন্দনার গল্প বেরিয়েছে। আমাকে সেই সব পত্র-পত্রিকা ব্যাগে করে এনে দেখাতেন তিনি। বুঝতাম, আমি চন্দনদার পছন্দের পাত্র হয়ে উঠছি। আমার থেকে বছর পাঁচেকের বড় চন্দনদার তখনও বিয়ে হয়নি। কিন্তু বিয়ের জন্য দেখাশোনা চলছিল। চন্দনদার পিছনেও স্কুলের অনেকেই লাগত।তবে তা কথাতেই সীমাবদ্ধ থাকত। বেশির ভাগ সময়েই চন্দনদার এখনও বিয়ে হয়নি বলে প্রচ্ছন্ন খোঁচা থাকত সেই সব কথায়। আবার কখনও বলা হত যে সব শিক্ষকরা প্রাইভেট টিউশন পড়ায় না, তাঁরা ইনএফিসিয়েন্ট। তাঁরা ক্লাসে ভাল পড়াতে পারে না বলে তাঁদের ছাত্র জোটে না। কথাটা গায়ে লাগার মতনই কথা। কারণ চন্দনদা  প্রাইভেট টিউশন পড়াত না। স্কুলে পড়ানোর পর যে অবসর মিলত তা চন্দনদা লেখালিখির  কাজে ব্যয় করত। তবে বাঁকা কথায় চন্দনদা কষ্ট পেলেও রিঅ্যাক্ট করত না, প্রকাশ্যে গায়ে মাখত না। কারণ তাতে বক্তাদের খুশির মাত্রা বেড়ে গিয়ে আরও পিছনে লাগবে। প্রাইভেট টিউশন পড়ানো চন্দনদার নীতি-বিরুদ্ধ ছিল। বলত, “আমার তো রোজগার ভালই আছে।  বেকার ছেলেরা করে খাক। আর তাছাড়া ক্লাসে ভাল করে পড়ালে প্রাইভেট টিউশন লাগবে কেন!” আমরা দু’জন প্রায়ই স্কুলের গেটের উল্টো দিকের চায়ের দোকানে চা খেতে ও খানিক আড্ডার লোভে যেতাম। একে অপরকে মনের কথা বলে হাল্কা হতাম। 

তবে চন্দনদা বড্ড খুঁতখুঁতে মানুষ। বারাসাতে ভাড়া থাকত। একটা ফ্ল্যাট কেনার ইচ্ছের কথা প্রায়ই বলত। আমি বলতাম স্কুলের কাছেই একটা ফ্ল্যাট নিতে। বেশ কয়েকটা দেখেওছিল। কিন্তু মন স্থির করে আর এগোতে পারেনি। চন্দনদার যুক্তি— স্কুলের কাছে থাকা উচিত হবে না। কারণ  স্কুলের কাঠিবাজ শিক্ষক-সহকর্মীদের থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই নাকি মঙ্গল। আমি আবার এ-যুক্তি মানতে পারতাম না। কারণ কর্মস্থলের কাছে থাকলে যাতায়াতের সময় ও গাড়িভাড়া বাঁচবে, লেখালিখিতেও আরও বেশি মন দেওয়া যাবে বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু চন্দনদার সঙ্গে মিশে বুঝেছি বারাসাতে দীর্ঘদিন ভাড়া থাকার ফলে মানুষজনের সঙ্গে যে আত্মীয়তা গড়ে উঠেছে তা উপড়ে ফেলতে খুব কষ্ট হবে। চন্দনদা সেই কষ্টের মুখোমুখি হতে চায় না। 

আমাদের এই দুজনের বৃত্তে মাঝেমধ্যে ঢুকে পড়তেন অঞ্জন বিশ্বাস নামে আরেক ইংরেজির শিক্ষক। মধ্যবয়স্ক অঞ্জন বিশ্বাস কেন জানি না আমাকে বেশ স্নেহ করতেন।তাঁকে কখনও কারও পিছনে লাগতে দেখতাম না। কিন্তু স্কুলের যে এক শক্তিশালী লবির আমারা নীরব বিরোধিতা করছি, তা অঞ্জনবাবুর চোখ এড়ায়নি। তিনিও আমাদের পাশে থেকে সমর্থন যুগিয়েছেন। কিন্তু আমার অবস্থা তো স্কুলে খুব নড়বড়ে ছিল। বছরশেষে দু-তিন দিনের বিরতির পর যদি চুক্তি রিনিউ না-হয়, আমার চাকরি নট হয়ে যাবে। সে সময় খাতায়-কলমে দু-তিন দিনের বিরতির ব্যবস্থা ছিল, কারণ একটানা প্যারাটিচারি করলে স্থায়ী চাকরি দাবি জোরদার হত। তো, যাই হোক আমি কাউকে অত্যধিক চটানোর রাস্তায় না হেঁটে মোটামুটি এক ভারসাম্যের পথ বেছে নিলাম।

************************************************************

আগামী পর্বে 

************************************************************

উপন্যাস * দীপংকর রায়

   



['স্বরবর্ণে'র চতুর্থ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে কবি দীপংকর রায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে '। এই উপন্যাস লেখকের ষোল-সতের বছর বয়সের কালপর্ব থেকে শুরু। যদিও লেখকের জন্ম এপার বাংলায়, কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে থেকেছে ওপার বাংলায়। কাজেই যাতায়াত থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ ছেড়ে চলে আসা আর তারই নাছোড় এক টানাটানির মধ্যে যে জীবনের ক্রমাগত আসা আর যাওয়া ,এই উপন্যাস মূলত তারই এক নির্মম নিষ্ঠুর ভাঙা-গড়ার আশ্চর্য কথোপকথন। ধারাবাহিকভাবে যা আমরা পড়ছি, কবি দীপংকর রায়ের মায়াময় কলমে।]


কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে 

পর্ব * ১৪   

দীপংকর রায়


   


একাত্ম করছি না বা পার্থক্যও করছি না  । তবুও কোথাও একটি সমান্তরাল রেখার দেখা যেন মিলে যায় । তাই হয়তো অনুভব করতে বাধ্য করায় ।

     তখন এদের সকলের সঙ্গে কোনো একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছিল , সকলের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতেই । তাতে বিশেষ মনোনিবেশ না করতে পেরে‌ আমি হয়তো একটু বিচ্ছিন্ন হয়ে ভাবছিলাম , আচ্ছা , প্রকৃত অর্থে আমার জীবনে প্রকৃত উদ্দেশ্যের জায়গা কোনটি ? আমি কি এই গোপালনকেই মোক্ষ ভেবে নিয়ে বৃন্দাবনবাসীর জীবন বেছে‌ নেবো হে কানাই ? তাহলে আমার‌ যে জন্যে ফিরে আসা এই শহরে—  তার‌ কী হবে ? 

এই সব ভাবনা দিন দিন এমন জায়গায় পৌঁছাচ্ছে দেখতে‌ পাচ্ছি , যখন ভেতরটায় ভীষণ অস্থিরতায় পেয়ে বসে । নিজের জায়গাটি  নিজেই আর ঠিক করতে পারি না ।  যদিও ঘুরে দাঁড়িয়েই ভাবি , ঠিক আছে , কেনই বা হবে না‌ ? এই কাজটিকে আরো বড় করেও তো‌ ভাবতে পারি ! এবং যেটা ভাবা , সেটাই , সে দিন থেকেই ভাবতে শুরু করলাম । স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম তেমন করেই । ভাবতে‌ থাকলাম যেমন করেই হোক আরো কিছু গোরু বাছুরের সংগ্রহ বাড়াতে হবে , এবং সেটা যে করেই হোক । কারণ কালো গোরুটি তো ইতিমধ্যেই ঠাট হয়ে ঘরে বসেই খাবে । এখনো পর্যন্ত তো গাভীন হওয়ার কোনো লক্ষণই নেই  । তাহলে ? 

  শেষমেষ কান্ডারী তো সেই অশোকদাই । তাকেই বিস্তারিত জানালাম । সেও রাজি হলো । শেষে লম্বা করে বাথরূমের ধার থেকে  দক্ষিণের ডোবাটিকে বুজিয়ে দিয়ে একেবারে দক্ষিণের সীমানা ঘেঁষে লম্বা করে টালির চাল দিয়ে পাকা করে ঘর তৈরি করা হলো । শুধু গোরু বাছুর রাখবার জন্যেই । তারা তখন আর বাড়ির মধ্যে চলাচল করতে পারে না । একেবারে আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে থাকে । হুঁশ করে শোয় নাকে শব্দ করে । বাঁশ গলিয়ে দিয়ে যেভাবে বিভাজন রেখা তৈরি করা হয়েছে তাদের খাবারদাবার দেবার জন্যে সামনে থেকে , তাতে একেবারে একটি পাকাপাকি বন্দোবস্ত হয়ে গেছে এখন । একজন গোরুর খামারী তৈরি হয়ে যাওয়াতে এখন আর কোনো অসুবিধা রইলো না । 


       কালো গোরুটিকে নিয়ে ছুটোছুটির অন্ত রইল না যদিও । একবার তাকে নিয়ে মুরএভিনিউ ফার্মে ষাঁড়ের কাছে নিয়ে যাওয়া , আর একবার নরেন্দ্রপুর । এ পর্ব চলতেই থাকলো কৃত্রিম উপায়ের কাছে আর না যেয়ে ।

        এদিকে নতুন গোরুর আর অধিক ব্যবস্থা না করতে পারলেও একজন সব সময়ের কাজের লোকের ব্যবস্থা করে দিলো পন্ডিতজি । তার সহযোগিতায় এই বিহারী মানুষটিকে পাওয়া গেল । কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতে তাকে নিয়ে এমনই এক সমস্যা বেঁধে বসলো যে সে সময় সুযোগ পেলেই বাংলা মদ পেটে পুরে দেয় । এবং একবার পেটে পড়লে তখন সে মুখ দিয়ে খাওয়াও যেন ভুলে যায় । মাংসের টুকরো প্রবেশ করাতে চায়  মুখের বদলে নাক দিয়ে ।

         এ সব ছাড়া গোরু বাছুরের দেখা শোনায় সে একেবারে পাকাপোক্ত। সকালে খুব সকাল সকাল উঠে গোরু বাছুরের স্নান খাওয়ানো দাওয়ানো দুধ দোহাই করা সব সেরে সে একেবারে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে গোরু বাছুরদের পাশের মাঠে বেঁধে দিয়ে ,  একেবারে বিচালির বস্তা পেতে টান হয়ে ঘুম দিতে চলে যায় দশটা বাজতে না বাজতেই । তার কাজের কায়দা গোছগাছ দেখে সত্যিই ভরসা না করে পারি না । মনে মনে বলিও , এই না হলে জাত গোয়ালা বলে কি এমনি এমনি ! সবাইকে দিয়ে কি সব কাজ হয় ?

      বিশনি চন্দ্রের গন্ডগোলের জায়গা ঐ একটিই । বাকি সব ক্ষেত্রেই সে কাজের দিক দিয়ে একেবারে পাকাপোক্ত । কিন্তু ঐ , ফাঁক পেলেই পেটে ঢেলে দেও । আর তারপরেই সব উল্টোপাল্টা । এলোমেলো । একদিন পন্ডিতজির সামনে বসিয়ে বেশ খানিকক্ষণ বুঝো বুঝি চালালাম । তারপরে বেশ কিছুদিন ভালো চললো । সেও তার নাক মলা কান মলা তওবা-তৌবি সব যেন পন্ডিতজির সামনে দেওয়া কথা রাখছে বলেই মনে হলো । বললো , দারু আর সে পিইবে না । কিন্তু সে কি হয় ! কদিন যেতে না যেতে আবার নেশা করে একদিন দুপুরের পরে উপস্থিত । কী করা ? শীত কাল । ঐ শীতের সন্ধ্যায় তাকে বেশ করে মাথায় জল ঢেলে দিলাম কয়েক বালতি সকলে মিলে । নেশা খানিকটা ছুটলো ।  কিন্তু এবার তাকে দেখে নিজের-ই কষ্ট হতে লাগলো । শীতে কাঁপতে লাগলো তার সমস্ত শরীর ঠক ঠক করে । সে বলতে লাগলো , ‘ আর কভি নেহি পিউংগা , আউর কভি নেহি ….’ এই বলতে‌ বলতে একসময় সে ঘুমিয়ে পড়লো একেবারে অসাড় হয়ে । রাতে আর খাবার খেতেও উঠলো না সে দিনের মতো ।

    বিশনিকে নিয়ে সেদিন আমাদের সকলেরই বেশ মনটা খারাপ হয়েছিল এই ভেবে ,  কেন তাকে স্নান করাতেই বা গেলাম , সকলে মিলে আনন্দ উল্লাস সহকারে ? আহা , বেচারি শীতে একেবারে কুঁকড়ে পড়ে থাকলো কেমন দেখ সারা রাত ধরে বারান্দার কোণাটিতে জড়োসড়ো হয়ে ! আজ সে তার শোবার জায়গাতেও শুতে যায় নি ।

     যাক এতকিছুর পরেও একটা কথা তো বলতেই হয় — সে এ বাড়িতে আসার পর থেকে আমাকে আর গোরুর বিষয় নিয়ে কোনো দিকেই তাকাতে হয় না । সে কাজে সে ভীষণ পরিপাটি ও গোছালো ।এক মুহুর্তও গোরুর ঘরে গোবরের ছড়াছড়ি থাকে না । বা আমাকেও আর দুহাতে গোবর তুলতে হয়‌ না , চোনা-গোবর-ময়লা-সহ । নেশা পর্ব‌ 

বাদে বাকি আর সবটাতেই সে সময় অনুযায়ী একেবারে পাকাপাকি সিদ্ধহস্তই বলা চলে । 

      জটা ভাই এর উপস্থিতিতেও দুবেলা রয়েছে । কারণ তাকে ছাড়িয়ে দিলেই দেওয়া যেতো , কিন্তু বিষনি ভাইএর উপর ভরসা পুরোটা তো করা যায় না ! তাই উভয়ের উপস্থিতিতে মিলেমিশে বেশ‌ই চলছিল‌ ।

       আমিও মন দিয়ে শরৎ সাহিত্যের একের পর এক খন্ডগুলি শেষ করতে থাকি । ব্রজ দাও একের‌ পর‌ এক সঙ্গে মধুসূদন রচনাবলী ও রবীন্দ্রনাথ সাপ্লাই দেওয়া শুরু করেছে দেখছি । কিন্তু তাও আমাকে প্রতিমুহূর্তে উপলব্ধি করতে বাধ্য হতে হচ্ছে , ‘ সাহিত্য তো এখানেই শেষ‌ নয় ! দেশ পত্রিকা পড়তে পড়তে‌ মনে‌ হয় , কত শাখা প্রশাখা তার ‌! আর আধুনিক কবিতা তো অনেক এগিয়ে   তার  থেকেও ! আধুনিক গদ্য সাহিত্যও এদের পরে আরো আনেক‌ দূর এগিয়ে গেছে —- কিন্তু সে সবের সঠিক খোঁজ কে আর আমাকে দেবে ?

      ছোটো ভাইএর গৃহ শিক্ষক নিতাই দার সঙ্গে আস্তে আস্তে বেশ একটা অন্যরকম সম্পর্ক তৈরি হয়েছে । 

       ভাইকে পড়ানো হয়ে গেলে ভাই তো তার বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে খেলার‌ মাঠে দৌড় দেয় , তখন নিতাই দা গল্পে গল্পে খানিকটা সময় কাটাতে চায় দেখি আমার সঙ্গে । সেই আমাকে অনেক লেখক কবিদের নাম বলে । জিজ্ঞাসা করে এঁদের লেখা পত্র সম্বন্ধে আমার জানা চেনা আছে কিনা । এদের মধ্যে রয়েছেন প্রেমেন মিত্র , সুধীন্দ্রনাথ , বিষ্ণু দে , জীবনানন্দ , মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর , বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় , এই সব কবি সাহিত্যিকদের লেখা পত্র সম্বন্ধে আমি কতটুকুই বা আর জানি । 

       প্রথমটায় আমি তালহারা হয়ে পড়ি । সত্যিই তো , আমি তো এঁদের সম্মন্ধে কিছুই জানি না ! এত সব লেখক সাহিত্যিকদের খোঁজ খবর আমি পাবো কী করে ? এঁদের মধ্যে কারো কারো নাম শুনলেও পাঠ্য বই তে কাউকে কাউকে একটু আধটু নাম ধাম শুনলেও বিস্তৃত ভাবে কতটুকুই বা জানি আমি ?

     তাই তাল কেটে যায় বুঝি । অনেকটাই হাঁ করে শুনি নিতাই দার মুখে নানা গল্পে গল্পে । তবে এঁদের মধ্যে তার প্রিয় লেখক হলো যা বুঝতে পারলাম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় । বিশেষ করে তাঁর ছোটো গল্প নিয়ে নিতাই দার উচ্ছ্বাসের অন্ত নেই । সে যখন একটি একটি করে কিছু কিছু গল্পের অংশ বলতে থাকে আমি আশ্চর্য হয়ে শুনতে থাকি । আর পরদিনই মাকে এই সব লেখকদের বই পত্রের লিস্ট ধরিয়ে দিতে বলি ব্রজদাকে । ব্রজদা এক সপ্তাহের ভেতর সেই লেখকের একটা না একটা গ্রন্থ পাঠিয়ে দেয় মার হাতে । মা অফিস থেকে এসে বইটির প্যাকেট খুলে হাতে দিতে না দিতে আমি সেটি নিয়ে বসে যাই বারান্দার এক কোণে পাতা সেই মোড়াটির উপরে । যেন এখুনি সেটিকে আদ্যপান্ত না দেখতে পেলে রাতের ঘুম আসবে না এমনই‌ একটা অবস্থা ।

      সামনের বাড়ির মাসিমার বোনঝি ইদানীং দেখছি এখানেই যেন পাকাপাকি বন্দোবস্ত করে নিয়েছে বুঝি ! আজকাল ঘনো ঘনো তার আসা যাওয়া চলছে দেখতে পারছি ।

      ছোটো ভাই ওদেশের থেকে ফিরে আসার পরে তাকে দেখতে পেয়ে একদিন আমাদের বাড়িতে চলে আসে । আমার লাগানো ফুল গাছের বাগান নিয়ে ছোটোভাইকে নানা রকমের উপদেশ দিয়ে যায় শুনতে পাই ঘরের ভেতরে বসে বসেই ।কিন্তু সে কখনো এগিয়ে এসে আমার সঙ্গে আলাপ জমাতে আসে না । আড়ে আড়ে চায় আর আমাকে উদ্দেশ্য করে বুঝতে পারি নানা কথা ভাইকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে বলতে থাকে শুনতে পাই । 

      দুপুর বেলা হলে সেই উঁকিঝুঁকি ও বাড়ি থেকে । অনেক রাত অবধি গলা চড়িয়ে উচ্চগ্রামে নানা কথা ছুঁড়ে দেয় , যাতে সেই কথাগুলি আমার কানে পৌঁছোয় যেন বাতাসে বাতাসে । আর সেটা আমি বুঝতেও পারি বেশ । হয়তো সেই বয়েস বুঝতে সাহায্যও করে এই সব বুঝি , খুব তাড়াতাড়িই ! 

     এ এক অদ্ভুত খেলা শুরু হয়েছে। আর সেই খেলায় জড়িয়ে পড়ছি  অজান্তে যেন কেমন করে ! এই বিষয়গুলি এমনই —- যা কাউকে বলার মতোও নয় ।

      ইতিমধ্যে মাসিমার বেড়ার ঘর ভাঙাচোরাও হয়ে গেছে । দালান ঘরে মাসিমারা উঠেও গেছে । মাসিমার বোঋলঝিও পাকা ঘরের মাঝখানের লম্বা করিডোর থেকে সকাল বিকাল রাত্তির এক এক সময় এক এক ধরণের অভিব্যক্তি ছুঁড়ে মারছে । বুঝতে পারছি তার এই খেলায় আমি বেশ খানিকটা জড়িয়ে পড়ছি । আর সেও তার গুরুত্ব বুঝিয়ে দিয়ে ক্রমাগত এক ধরণের উপস্থাপনায় মেতে উঠছে । আর যত তার মেতে ওঠা ততোই আমি মাসিমার বাড়ির পেছনের সেই মাথা উঁচু করা ঝাউ গাছ গুলির মধ্যে রাতের আলোআঁধারিতে নিজেকে ভাসিয়ে দিই  নানা স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষার জালে জালে ….  আমি ঘুরপাক খাই অনেক রাত অবধি একাকী ।  কখনো আঁধার রাতের আকাশে । কখনো চাঁদনি রাতে প্রচুর হাওয়ার ভেতর ঝাউ গাছের মাথা দুলুনির ভেতর এমন এক অদ্ভুত সুগন্ধ‌ ভেসে আসতে দেখি আমার নাকে , কিন্তু আমি কি বুঝতে পারি এই কথাটি, আমি মজেছি মিথ্যে স্বপ্নের ভ্রমে ?

    প্রকৃতিও আমার এই দুর্বলতার গন্ধ পেয়ে বেশ মজায় মেতেছে যেন।

পেয়েছে যেন এমন এক ভ্রান্ত পথিককে , বলছে যেন ঠিক আছে , কী আর হয়েছে এমন , এসো খেলি‌ । এই সময় খেলবে না তো কবে আর খেলবে !

    মনে মনে ভাবি , কী ঝামেলায় পড়লাম রে বাবা ! এ যে সবটুকু সময় জুড়ে বসতে চায় ! কিন্তু সে কী করে ? আমি কি সত্যিই ভুলের ঘোরে পড়েছি ! কীভাবে ছাড়াই ? মন যে কিছুতেই ফেরে না পেছনে ! কী করি আমি তাহলে ? পালাবো কোথাও ? কোথাও চলে যেতে পারলে হয়তো একটা কোনো পরিণতি ঘটলেও ঘটতে পারতো হয়তো ! অন্তত বোঝা যেত , সত্যি সত্যিই এ সবের প্রকৃত কোনো পরিণতি আছে কি না । নাকি সে সব শুধু মাত্রই একটা উপস্থাপনা এই বয়েসের ; যে ধরণটি প্রাথমিকভাবে মেয়েদের । অন্যের বাকিটা ভাববার সময় থাকে না তখন তাদের। সে শুধুই ভাসিয়ে নিয়ে চলবার দিন বুঝি এই বয়েসে তাদের! 

         এ বাড়ির আড্ডাটা খানিকটা কমে এসেছে । কারণ মা এবং ভাই ওদেশ থেকে ফিরে এসেছে । 

         নিতাইদা ভাইকে পড়াতে আসে বিকেলের দিকটাতে । এ ক্ষেত্রে আর একটি বিষয়ও নতুন যুক্ত হয়েছে নিতাই দার সঙ্গে আমারও। নিতাই দার সাহিত্য প্রীতি আছে একটু আধটু আগেই বলেছি । তার সঙ্গে ভাইএর পড়াশোনা হয়ে গেলে অনেকটা সময় কাটে তারপর আমাদের একসঙ্গে । সে যেন আজ কদিন হলো বেশ খানিকটা সময় নিয়ে নিয়েছে ।যদিও তার সাহিত্য অনুরাগের মধ্যে খানিকটা শ্রেণী সংগ্রামের ঝাঁঝ গন্ধ মিশে আছে । সে থাক । আমারও যে তার দর্শণে একেবারে সমর্থন নেই তা তো না ! কিন্তু তারপরেও যে আমার দেখায় আরো একটু অন্যরকম স্বাদ-গন্ধের কথা রয়েছে ; সে কথাটা তাকে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিতে না পারলেও , খানিকটা যেন সে নিজের মতো করে বুঝে নিয়েই আমাকে বুঝোতে চায় সুকান্ত ভট্টাচার্য নজরুলের কবিতার খানিকটা খানিকটা । সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও‌ বুঝোয় । আমিও গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করি তার সব কথা । স্বীকার করি তাঁদেরও  আগে পরে সকলের কথাই । সমসাময়িক পরিস্থিতির প্রভাব ,  প্রতিবাদী দিকগুলির সব বৈশিষ্ট্যগুলিই মানি । কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও বলি , দেখুন সময়ের দাবি তো থাকবেই শিল্পে , কবিতায় , গদ্যসাহিতে । সে কথা কে অস্বীকার করছে ! কোনোভাবেই সেই সবকে অস্বীকার করা যায় না । কিন্তু সময়কে অতিক্রম করে যে লেখা আরো দূরের কথা ভাবে , আরো বড় সময়ের কথা , সেখানে যে লেখা পৌঁছোয় , যাকে ধরেও ধরা যায় না! সেই লেখার প্রতিই আমার আকর্ষণ অনুভব করি বেশি । অর্থাৎ দুটি দিককেই যে দেখা সমানভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায় ,  তার প্রতিই আমার টান অনুভব করি বেশি । কেউ কারো কাছে ছোটোও না বড়ও না । জীবনকে বাদ দিয়ে জীবনের প্রয়োজনকে বাদ দিয়ে , শিল্পের কোনো গ্রহণযোগ্যতা যেমন নেই — তেমন জীবনের ওপারে আরো বড় জীবনের সত্যকেও তো অস্বীকার করা যায় না ! দুটি দিকই দুটি দিকের স্রোতে ভেসে চলেছে সমান ভাবে । আমাকে সেই মিশ্রণের স্বরূপকে ছুঁতে হবে ! সেই সুরের প্রতি আকর্ষণকেই প্রকৃত শিল্পদৃষ্টি বলে মনে করি আমি । 


        নিতাই দা সে প্রসঙ্গের কতোটা ধার কাছ দিয়ে পৌঁছোতে চাইলো বা চাইলো না , তা জানি না । তবে সে তার পরে যে কথা বললো সেটা সত্যিই ভেবাচেকা খাইয়ে দেয় যেনো আরো খানিকটাই । সে বলে , তাহলে কি তাকে তুমি রবীন্দ্রনাথের প্রেম ও পূজা পর্যায়ের ধারায় সব কিছুকেই  ফেলতে চাইছো ? তাহলে তো তার কোনোই শেষ নেই ! 

        এবারে আমি  বেশ খানিকটা ঝামেলায় পড়ি । বলি , না না সেই ক্ষেত্রে অনেকটাই যেমন ঠিক , আবার অনেকটাই ঠিক সেরকমই না ! হ্যাঁ , তাকে আপনি প্রেমও বলতে পারেন , আবার শুধুই প্রেমও নয় । সে সব মিলিয়ে মিশিয়ে আরো অনেকটাই বড় সে জিনিস । সে ঠিক ছোটো প্রেম নয় । অনেকটাই বড় । 

     আচ্ছা এই ছোটো প্রেম আর নিরন্নতা , এই নিয়েই কি সব কথা শেষ করা যায় ? মানুষের যে জটিল মনস্তত্ত্ব রয়েছে , তার কত অভিমুখ ! সেগুলিকে খুব ভালো করে লক্ষ্য করে দেখেছেন কি কখনো ? যার ভেতরের অপূর্ণতা ! যার জটিল গতিবিধি! যা ঐ প্রেম অপ্রেম সকল কিছুকেই ছাড়িয়ে এমন ধাঁধা ধরায় ;  সে সব নিয়ে ভেবে দেখেছেন কি কখনো ? তারপরেও আপনি রবীন্দ্রনাথের গানের কাছে পৌঁছতে যেয়ে দেখবেন , যে জিনিসটিকে  আপনি অতি সহজে ধরতে পারছেন না , তার অনেক দরজা জানলা খুলে যাচ্ছে যেন ;  আমি ঠিক ঐখানের হাহাকারের কথা বলছি । অনেক সময় আমিও ঠিক ধরতে পারি না জানেন তো ! এই যে আপনাকে যেসব বলে গেলাম তার কতটুকু ছুঁতে পারিই বা আমি নিজেই ? তবে যেটুকু অনুভবে ধরা দেয় , যতটুকু বুঝতে পারি , তাতে এইটুকুই বুঝি , মানুষের জীবনে আরো অনেকগুলি  অনুভবের জায়গা আছে , আরো কতরকমের হাহাকার আছে , দৈন্য আছে , আমাদের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের মধ্যে তার কত অভিমুখ ! সেই সব । তাঁদের সামাজিক দাবিদাওয়াকে এক বিন্দুও খাটো করছি না । কিন্তু সমাজ সংস্কার তো তখনই হবে , যখন সংস্কারক এবং সাংস্কারিকের মধ্যে বোঝাপড়াটি খুব সহজ ভাবে হয়ে যাবে । কিন্তু সেটা হয় কোই ? যদি হয়‌ , তখনই তো তাদের মধ্যকার সকল দৈন্যের সমাধান হয়ে যেতে পারে  একটু একটু করে ! আমার মনে হয় সে জিনিস দিতে পারে কে জানেন , আমার মনে হয় একমাত্র বোধের শিক্ষাই । আমাদের প্রকৃত শিক্ষিত হয়ে উঠবার গন্ডগোলের মধ্যেই রয়েছে সঠিক বিচার বিবেচনার দিকটার সমাধান । সেটার গ্রহণযোগ্যতা যদি সমাজ ব্যাবস্থার মধ্যে ঠিকঠাক ঘটতো , তাহলে একটি বড় জায়গা দিয়ে আমরা এগিয়ে যেয়ে দাঁড়াতে পারতাম হয়তো অনেকটা ঠিক জায়গায় ।

 

      যাইহোক , কোথা থেকে কোথায় এসে ঠেকালাম দেখেন ! হচ্ছিল লেখার কথা , আর আমি কোথায় কী সব বকে যাচ্ছি দেখেন । আসলে আমি হয়তো বলতে চাইছিলাম , শিল্প শিক্ষার জায়গাটির কথা । আসলে মহান লেখা বলে ঠিক পরিষ্কার কিছু না বললেও , যেটা বলার , যে জায়গাটির বিভ্রান্তির কথা নিয়ে আমাদের আলোচনা আরম্ভ হয়েছিল , সেটা কোথায় কোথায় আমরা পেতে পারি ? যা আমাদের এই প্রথাগত ধারণার বাইরে নিয়ে যেয়ে স্বভাবের মূল অবক্ষয়ের জায়গাটাকে দেখিয়ে দিতে পারবে ? আমি সেই জায়গার কথা ভাবি । কেই বা ভাবায় তাও জানি না ! তবে ভাবায় । ভাবায় বলেই সেই অনুসন্ধানের দিকেই আমি বিশেষ ভাবে ঝুঁকে পরি । তাই , আমি কাউকেই ছোটো বড় না করে বলতে পারি , কোনোরকম এক মাত্রায় গণ্ডিবদ্ধ হবার প্রবণতাই আমার বিশ্বাসে জায়গা করে নিতে পারে না খুব সহজ কিছু দিয়ে । তার দিকে যাত্রায় যে দুরুহতা রয়েছে —  তাকে অতিক্রম করার যাত্রা পথে যে অন্তরের মুর্ছনাকে স্পর্শ করতে হয় , সে পথেই আমার যাত্রা । 

     নিতাইদা একটি কথাও না বলে আমার মুখের দিকে অনেকক্ষণ হাঁ করে চেয়ে রইল । 

    তাতে আমার খুবই অস্বস্তি হলো খানিকক্ষণ , কিন্তু কী আর করা ! আমি কীই বা বললাম এতক্ষণ , যাতে সে ওরকম হতভম্ব হয়ে চেয়ে থাকলো খানিকক্ষণ !

      এই কথাগুলি আমিও তো আর একবার সবটা বলতে পারবো না একই  রকমভাবে ! 

    তাহলে কি আমি কিছু ভুলভাল বলে ফেলেছি ? যাতে নিতাই দা চেয়ে আছে কিছু একটা বলবে বলে, নাকি সে আমাকে পাগল টাগল কিছু একটা ভাবছে হয়তো । 

     সে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে চেয়ে থেকে এবারে এই কথাটিই বললো শুধু দেখলাম—- আমি তোমার সব কথা ঠিক ভাবে বুঝতেই পারলাম না ভাই ।



**********************************************************************************************

আগামী পর্বে 

**********************************************************************************************

গল্প * যুগল কিশোর দাস অধিকারী




ছদ্মবেশের আড়ালে

যুগল কিশোর দাস অধিকারী 


হাওড়া থেকে করুণাময়ী যাওয়ার শেষ বাস রাত সাড়ে দশটায় ছাড়ে। বাসটা শিয়ালদা হয়ে ঘুরে যায়। অত রাতে প্যাসেঞ্জার খুব কম থাকে। বিশেষত হাওড়াতে মাত্র তিনজন প্যাসেঞ্জার ওঠে। দুলালদা করুণাময়ী যান। কোন প্রাইভেট অফিসে কাজ করেন। বাকি আর দু জন।

তিনি একটা জিনিস প্রতিদিন লক্ষ্য করে অবাক হয়ে যান কিন্ত কিছু বলতে সাহস করেন না। একদিন মনের ইচ্ছা চেপে রাখতে না পেরে মরিয়া হয়ে এক কো প্যাসেঞ্জার কে প্রশ্ন করে বসলেন।

    প্যাসেঞ্জারটি  প্রতিদিন উনার মতই লাস্ট বাস ধরেন। কিন্তু চালচলন অদ্ভুত রকমের। ছেঁড়া ময়লা জামাকাপড় , চোখে কালো সানগ্লাস, চোখে কালি লাগানো, হাতে লাঠি। অথচ বৃদ্ধ বা অন্ধ নয়। এসেই বাসের কন্ডাক্টরকে একটা থলে ছুঁড়ে দেয় । দাদা গুনে দেখুন তো কত আছে। কন্ডাক্টর টাকা গুনে খুচরো নিয়ে ওকে নোট ধরিয়ে দেয়।  ও বাস থেকে নেমেই বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বেশ ভালো জামাকাপড় পরে এসেও কন্ডাক্টরর থেকে টাকা নিয়ে গুনে পকেটে ঢুকিয়ে দেয়। এটা প্রতি দিনই হয়।

 দুলালদা ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলেন ভাই তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো ভাবছি। কিছু মনে করবে না তো?

 ছেলেটির নাম পলাশ। তার বাড়ী বারুইপুরে।সে বুঝতে পেরেছে কি জানতে চায় ভদ্রলোক। বললো হ্যাঁ নিঃসন্দেহে জিজ্ঞেস করতে পারেন।

আমি অন্ধ নই, তবু লাঠি হাতে হাঁটি, চোখে কালো চশমা পরি কেন ইত্যাদি ইত্যাদি। এই তো? 

 বাহ তুমি কি করে আন্দাজ করলে?

প্রতিদিন আপনি আমাকে দেখে চেয়ে থাকেন, মনে মনে কিছু ভাবেন। কি আর ভাববেন এ ছাড়া। আমি তো কোন কেষ্ট বিষ্টু নই।

 দুলালদা বললেন কিছুটা তাই। কিন্তু কেন ?

কেন এই অন্ধ সেজে ভিক্ষা বৃত্তি করি এইতো?

হুঁ তুমি তো বেশ শক্ত সামর্থ্য যুবক। কথে শুনে মনে হয় শিক্ষিত ও।

 হুঁ তা বটে। পলসাইন্স এ এম এ।

বিস্মিত চোখে দুলালদা বলেন তাহলে?

তাহলে আপনাকে বড় ইতিহাস শুনতে হবে। ধৈর্য্য আছে তো?

বলো শুনি। খুব জানতে ইচ্ছে করছে।

মাস্টার্সের লাস্ট ইয়ার। বাবা  প্রাইভেট কোম্পানিতে কারখানায় কাজ করতেন। লেদের মিস্ত্রি। ডান হাত এক্সিডেন্ট এ কাটা গেল।  কাজ করতে পারবেন না তাই চাকরি গেল।

আমার পড়াশুনো লাটে উঠলো। কম্পেনসেশন যা দিল তা না দেবারই সমান।

 নিরুপায় হয়ে বাড়িতে টিউশন পড়াতে শুরু করলাম। কিন্তু যা আয় হয় ব্যয় অনেক বেশি। প্রাইভেট কোম্পানিতে ঢুকলাম । কাজের চাপ সময় অনেক দিতে হয়।আমদানি তেমন নেই। চাকরির পরীক্ষা দিয়ে দিয়ে হাঁপিয়ে উঠলাম রাইটিং এ পাস করলে ও

ইন্টারভিউতে কাট। তিতিবিরক্ত। মা, বাবা, বোন সবাই আমার উপর নির্ভরশীল। কি করি না করি। এমন সময় আমার এক বন্ধু দিল্লীর এক ভিখারীর গল্প শোনাল, তার বাড়ী গাড়ি সবই ভিক্ষা করে অর্জন করেছে। আইডিয়া টা মাথায় খেলে গেল। কিন্তু বিবেকে বাধছিল শেষে কি না এই?

    এটা ওটা করে হাঁপিয়ে উঠছি। শেষে ভাবলাম যা থাকে কপালে একবার বন্ধুটার কথা শুনেই দেখি। যাদের পেটে ভাত জোটে না, রাতে জোটে না লেপ কম্বল। তাদের কি হবে বেঁচে থেকে ইগো করে সম্বল?

     একদিন ব্যাগে করে পুরানো ছেঁড়া জামাকাপড় বের করলাম। সাথে নিলাম একটা ব্যাগ তাতে ভালো জামা কাপড়। বারুইপুরে থাকি।

তাই ঠিক করলাম হাওড়া লাইনে কাজ করবো। শিয়ালদা লাইনে কাজ করলে চেনা লোক দেখে ফেললে কেলো।

   নেমে পড়লাম। দশটা থেকে পাঁচটা ।দু'চারটে গান গেয়ে কাজ করি। দিন গেলে চার শ থেকে পাঁচ শ। সংসার চালিয়ে ও কিছু বাঁচে।

দুলালদা বললেন এ তো লোককে ধোঁকা দেওয়ার সমান।

 মশাই ক জন সৎ ভাবে উপার্জন করে। সৎভাবেই তো বাঁচার চেষ্টা করে ছিলাম। 

   কেউ টিউশন এর টাকা দেয় না। খুঁটির জোর না  থাকলে বা ঘুষ না দিলে চাকরি ও জুটছে না। যেখানে চাকরি করতে যাই মালিকের ধোঁকাবাজি, প্রাইভেটে গরুর মতো খাটিয়ে লেবারকে মাইনে দিতে চায় না। স্ট্রাইক করে আন্দোলন করে মালিকের বিরুদ্ধে লড়লে ছাঁটাই। ইউনিয়ন লিডার তাঁর ও ভেতরে ভেতরে মালিকের সাথে আঁতাত থাকে। এক শ দিনের কাজে লোকাল লিডেরকে কিছু কাট মানি দিতে হয়। সব জায়গায় ঘাপলা। আপনি বলছেন সৎভাবে বাঁচতে? পুকুরে লোক খোলামেলা স্নান করে। বাথরুমে দরজা এঁটে ঢোকে কেন। কেন না ওখানে উদোম ল্যাংটো হয়ে স্নান করা যায়। মাঝে মাঝে জীবনে পর্দা টানতে হয়। জীবনটা তো রঙ্গমঞ্চ যে সাধু সে মাতাল সাজছে, যে মাতাল সে সজ্জন হিরো সাজছে , কেউ আমীর সে হয়তো ভিখারী সাজছে, অতি আটপৌরে হিরোইন সাজছে,মোটামুটি যে যত ভাল অভিনয় করতে পারবে জীবন রঙ্গ মঞ্চে তার তত নাম ডাক, তত উন্নতি।

   দেখতে দেখতে বাস শিয়ালদা এসে গেল পলাশ টা টা করে নেমে গেলো। বললো  বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে।

     দুলাল দা হতবম্ভের মতো ও র চলার পথের দিকে তাকিয়ে ছিল , চোখের থেকে  পর্দা যেন সরছিল না।











*******************************************************************************************


যুগল কিশোর দাস অধিকারী

 অবসর প্রাপ্ত কর্মচারী। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ফাইন্যান্স অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস ইনচার্জ ছিলেন। ২০২১ এ অবসর গ্রহণ করেছেন। শিক্ষা M  Com, B Ed, Foreign Trade Mgt  । বর্তমান লেখালেখি বাগান, ও কিছু সমাজসেবা মূলক কাজ করেন

গল্প * প্রদীপ কুমার দে

 

















অচল কথা 

প্রদীপ কুমার দে 


বর্ধমানের অজগাঁ। দীপেন্দু স্কুল পাশ করার পর পালিয়ে আসতে চায় শহরে। মনের ইচ্ছেগুলো গরীবদের ঘরে শুকিয়ে যায়। কোনক্রমে বর্ধমানের কলেজ থেকে পাশও করে। এবার জীবিকা নির্বাহের চিন্তা করতে হবে। ঘরে অসুস্থ বাবা। মা কষ্টের সংসারে দিনাতিপাত করে।

এরমধ্যে বসন্ত কাল এসে হাজির হল দীপেন্দুর হৃদয়ে। আসলে কিন্তু গ্রীষ্মকাল।

--  একটু জল হবে আপনার কাছে? ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তাই?

বর্ধমান রেলস্টেশন দুপুরবেলা, একেবারেই ফাঁকা। তারই মধ্যে এক কিশোরী কলেজের সবুজপার শাড়িতে সাধারণ ভাবেই স্টেশনের সিমেন্ট বাঁধানো  বেঞ্চে এসে এই কাতর প্রশ্নে চেয়ে থাকে।

দীপেন্দু বড় ঢাউস ব্যাগের চেন খুলে জলের বোতল এগিয়ে দেয়। মেয়েটি ইতস্তত করে বোতলে হাত দিতে। দীপেন্দু সাহস দেয়,
--  কিছু হবে না। আমি এসব মানি না। নিন।

মেয়েটি সংকোচের মধ্যেও জল পান করে,
--  ধন্যবাদ। খুব বাঁচালেন আমায়, আমি যে শ্বাসকষ্টের রোগে আক্রান্ত।

--  সে কি?

--  ভয়ের কিছু নেই। আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। কিন্তু আজ এক বোতল জল শেষ হয়ে গেছে। 

--  সঙ্গে ওষুধ নেই?

--  কলেজেই ওষুধ নিয়েছি। তাই আরো জল চাইছিল শরীর। এই ভরদুপুরে আপনার কাছে তাই বাধ্য হয়ে চাইলাম। আপনাকে ধন্যবাদ। আচ্ছা আমি চলি।

দীপেন্দু অনেক কথা বলতে চাইছিল কিন্তু সব গুড়ে বালি ঢেলে বাইশের সেই তরুনী লম্বা বিনুনি দুলিয়ে  প্ল্যাটফর্ম ধরে শেষ প্রান্তে এগিয়ে গেল। একবারও ফিরে তাকালো না। দীপেন্দুর কাছ থেকে কোন কথা শুনতে চাইলো না, স্রেফ আলতো করে ধন্যবাদ দিয়ে এগিয়ে গেল তার গন্তব্যে। দীর্ঘাঙ্গী তরুনী ক্রমশই ছোট হতে হতে ক্ষুদ্রকায় বস্তুতে পরিণত হয়ে গেল। দীপ একনজরে ওর গতিবিধি অনুসরণ করতে থাকলো আর মেয়েটির প্রতি রাগ জমাতে থাকলো। মেয়েটার নামটাও সে জানলো না। কলেজে পড়ে এটা শুনলো কিন্তু দীপেন্দুর তো কলেজ জীবন একবছর আগেই শেষ হয়ে গেছে। ওখান থেকে কোন খবর আসার সুযোগও নেই। রাগ হলো নিজের প্রতি।  ছিঃ এইসব কি ভাবছে সে? একটা মেয়ে বিপদে পড়ে এবং নিরুপায় না হলে কোন যুবকের কাছ থেকে জল চেয়ে খায়? আর সেটার সুযোগ নিয়ে আলাপ জমাতে চাইছে সে? ছিঃ এটা প্রকৃত তরুণের কাজই নয়।

বাড়িতে ফিরে আসে দীপেন্দু, কিন্তু বার বার মেয়েটাকে মনে পড়ে যাচ্ছে যে তার। কাজ খোঁজার জগৎ তার হারিয়ে যাচ্ছে, শুধুই ভেসে আসছে বসন্তের হাওয়া তার হৃদয়কুঠী থেকে।
দীপেন্দুর মনে একটা ঝড় বইতে থাকে। দিনে কিছু কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে মাঝেমধ্যে মেয়েটার মুখটা ভেসে আসে। এড়িয়ে যায়। ধুৎ শালা এ আবার কি শুরু হলো?  সামান্য একটু জল দিয়ে এতসব ভাবা? কিন্ত রাতের বিছানায় তাকে ছটফট করতে হয়। ঠিক করে কালকেই সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বর্ধমান স্টেশনে সে তার জন্য অপেক্ষায় থাকবে। 

তাই করলো দীপেন্দু, দুপুর বারোটা থেকে স্টেশনে বসে রইলো। জনপ্রানীর দেখা নেই। গরমে এই সময়ে কে আসবে? বিকালে কলেজ শেষে ভিড় হয় আর তখন ট্রেনও থাকে। তাহলে মেয়েটা কাল এরকম সময় এল কেন? এবার দীপেন্দুর মাথা খুলে গেল কাল ও আগেই বেরিয়ে গেছিলো। দীপেন্দু বাড়ির পথ ধরলো ফিরে যাওয়া ছাড়া আর যে তার উপায় ছিল না বিকাল পর্যন্ত থাকার।

নিজেকে খুব ছোট বলেই মনে হল তার। কাজের ব্যবস্থা না করে একটা মেয়ের পিছনে ছুটে চলা ঠিক নয়। না এসব কি চিন্তা তার? এখনই এই চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সে অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

রাতে নিজেকে অনেক বুঝিয়ে শুধরে নিল। কাল হল পরের দিন দুপুরের শেষে বিকালবেলা। মাথায় চাপলো, বিকালে গিয়ে একবার দেখা যাক!
যথারীতি দৌড়। গন্তব্য বর্ধমান স্টেশন। স্টেশনে ঢুকতে সময় লাগলো কারণ রেলক্রশিং বন্ধ ছিল। হাওড়া লোকাল বেরিয়ে গেল।

সত্যি কলেজ ফেরত বহু মেয়ে। অনেকে আবার ট্রেনেও উঠে গেছে। দীপেন্দু ধারে দাঁড়িয়েই রইল, খোঁজে সে এল না। ধোকা খেয়ে গেল।

বাড়িতে বিমর্ষ মন নিয়ে নিজের কাজগুলো পরিবারের জন্য করে দিল। কিন্তু প্রতিজ্ঞা করলো আজ তিনসত্যি সে করেই ছাড়বে।
 
কোন এক অমোঘ আকর্ষণে সে ধরাশায়ী।  হাজার বুঝিয়েও নিজের মনকে সে তার নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলো না। প্রেম এক মারাত্মক রোগ, যাকে কাবু করে সে সকল ওষুধের বাইরে চলে যায় তাই ছুটতেই হল তার আকুল টানে।

বর্ধমান স্টেশন। সীটে বসে রইল দীপ। হাওড়া লোকাল দাঁড়িয়ে। ছাড়তে দেড়ি আছে। কলেজ এবার ছুটি হবে। আজ মোক্ষম সময়ে এসেছে সে। আজ সে বড় মন নিয়েই এসেছে। পাল পাল ছাত্রীরা প্ল্যাটফর্মে চলে এল। দীপের চোখ ঘুরছে। প্ল্যাটফর্মের দুই প্রান্ত ধরে হাঁটা পথে সবাই বেড়িয়ে যাচ্ছে। দীপ টিকিট ঘরের সামনে মাঝামাঝি অবস্থায় বসে, কলেজের মেয়েরা এই গেট দিয়েই ঢুকে বেড়িয়ে গেল। ট্রেন হুইসেল মারতেই দীপেন্দুর বুকে ধরাস করে আওয়াজ উঠলো, ও অসুস্থ হলো না তো? স্টেশন ফাঁকা হয়ে গেল। দীপ একা …

--  রোজ রোজ কেন কষ্ট করছেন?

চমকে উঠলো দীপেন্দু। তার পিছনে দাঁড়িয়ে তার বিনুনিউলি।

--  বুঝলাম। হয়তো এক‌টি ভুল।

মেয়েটি দীপের পাশে বসে পড়লো। কিছুক্ষণ সময় নিল। দীপেন্দুর দিকে তাকালো। সে চোখ যে বড় করুণ। আয়ত চোখের চাউনিতে বুক কেঁপে উঠলো দিপেন্দুর।

--  আমারও কষ্ট বাড়াচ্ছেন।

দীপেন্দু মিথ্যার আশ্রয় নেয় নিজেকেই লুকাতে,
--  ভাবলাম অসুস্থ তাই খোঁজ নিই ...

--  ওহঃ সুস্থ হলে আসতেন না?

দীপের কাছে কোন উত্তর নেই। ধরা পড়ে গেছে যে।
খুব কাছ থেকে সে দেখছে মেয়েটার মধ্যে একটা কমনীয় আদুর আকর্ষণ আছে। শ্যামবর্ণা, রোগাটে কিন্তু দীর্ঘাঙ্গী এক যুবতী যার দুটি আয়ত চক্ষে দীপের হৃদয়ে শরাঘাত ঘটে গেছে।

মেয়েটিও ভালো করে দেখে, এক যুবক যে তার হাত ভরে প্রেম নিয়ে তারই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে, 
--  আপনাকে আমি চিনি।

--  কিরকম?

--  আপনার পিস্তুতো বোন মউ আমাদের ব্যাচে পড়ে।

দীপেন্দু বঝে যায় তার সব জানে ও, আর সে নিজে কি বোকা? মেয়েরা কত চালাক। সব খবর রেখেও নীরব। ওই জন্যই ওদের ধৈর্য প্রশংসনীয়। সে যেখানে ছটফট করে মরেছে সেখানে মেয়েটি সব জেনে বুঝে চুপ করে রয়েছে, যার বহিঃপ্রকাশ কিছুমাত্র বোঝার উপায় নেই। তাইতো সেও খোঁজ চালিয়েছে গোপনে কোন হোলদোল ছাড়াই।
--  বলেছে তো বেকার?

--  দোষ ধরে কি হয়?

--  তাই আমি যে আর থাকতে পারিনি তোমায় দেখে। নচেৎ আমি অচল।

মেয়েটি হাসে,
--  অচলবাবু আমার নাম জানতে চান না?

--  খুব জরুরী নয়। কিন্তু ডাকতে ইচ্ছে করে যে খুব তোমার নাম ধরে।

--  আমি কথা, 

--  তুমি জানো তাও বলি আমি দীপেন্দু।

--  ঠিকই। তাহলে এবার একটিবার তোমার মনের সাধটা মেটাও, শুনি ……

দীপেন্দুর বুকে হিল্লোল ওঠে। মনে হল আজ যে সে রাজা হয়ে গেছে। এত বড় পাওয়া!  এত বড়?
চারিপাশ একবার ভালো করে দেখে নেয় সে। স্টেশন চত্বর ফাঁকা। না কেউ নেই আশেপাশে। 
চিৎকার করে আওয়াজে ভরিয়ে দেয় তার মনের কথা,
--  কথা, আমার প্রানের কথা, কথা তুমি আমার হও ……

কথা চিৎকার শুনে হেসে ওঠে খিলখিলিয়ে, আকাশে বাতাসে এক লোমহর্ষক মুহূর্ত যেন ধ্বনিত হয়, হৃদয় হারায় একে ওপরের। কথা মুহুর্তে দীপেন্দুর হাত চেপে ধরে, এক লম্বা বিনুনী বাঁধা মাথা এলিয়ে দেয় তার শক্ত কাঁধে, মুখ দিয়ে গোঙানি ভাঙে,
--  আমার অচলবাবু ...













***********************************************************************************************************



প্রদীপ কুমার দে 

লেখক  নেশায় । 
   বয়স -৬৪ । কলকাতা নিবাসী। উপন্যাস গল্প     কবিতা লেখেন । কয়েকটি বই আছে।





অণুগল্প * দেবাশিস সাহা

 



ফেরত
দেবাশিস সাহা 

বাজার করার জন্য মা একটা পাঁচশো টাকার নোট দিয়েছিল। বলেছিল, কিলো খানেক মাংস, হাফ কেজি পেঁয়াজ, অল্প করে একটু আদা আর রসুন আনতে। তা তো এনেইছে। বাড়তি সাতটা কমলালেবু পঞ্চাশ টাকা দিয়ে। বাবা প্রায়ই বলে, খাওয়া-দাওয়ার পর একটু ফল খাওয়া ভালো। কথাটা মাথায় ঘোরে বাজার করার সময়। সব সময় পয়সা থাকে না। থাকলেও বাড়তি কিছু কেনার সাহস পায় না। মা খিচ খিচ করে। আজ কী মনে হল, সাহস করে কিনেই ফেলল। এখন বাড়ি ফিরে হিসেব করে দেখছে, এত কিছু কিনেও চারশো তিরিশ টাকা রয়ে গেছে। কী ব্যাপার! ম্যাজিক না কী! এক কিলো মুরগির মাংসই তো একশো সত্তর টাকা,পাঁচশো পেঁয়াজ কুড়ি টাকা, আদা-রসুন মিলিয়ে তিরিশ টাকা আর লেবু পঞ্চাশ টাকা। সব মিলিয়ে দুশো সত্তর টাকা। তাহলে? মনে করার চেষ্টা করে ঋজু। মাংসের দোকানে যা ভিড় ছিল। দোকানদার তাড়াহুড়ো করছিল খুব...বলো ভাই, কতটা?
এক কেজি, দুটো লেগ দেবে কিন্তু।
যে ছেলেটা মাংস কাটছিল নিমেষে দিয়ে দিল ওজন করে।
দোকানদার হাত বাড়িয়ে আছে। ঋজু পকেট থেকে পাঁচশো টাকার নোটটা বার করে দিল।
‘কী রে ঋজু, আজ হেব্বি সাটাবি, নারে?' ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, ওর বন্ধু সমীর, দাঁত কেলিয়ে হাসছে।
ব্যালেন্সটা কোনও রকমে পকেটে গুঁজে, ঋজু বলতে থাকে, ‘নারে ব্যাটা, আজ দিদি-জামাইবাবু আসবে, তাই মা বলল..'
‘সে আসুক, আমি কিন্তু দুপুরে যাচ্ছি।'
‘আসিস, কী আছে, না হয় ভাগ করেই খাব।'
'ভাগাভাগী চলবে না, আমি একাই গিলব' বলতে বলতে একটা বিটকেল হাসি দিয়ে শাঁ করে সাইকেল নিয়ে ছুট লাগায় ছোটু।
যাঃ, ব্যালেন্সটা গোনাই হলো না! যেই পকেটে হাত ঢুকিয়েছে, অমনি এক ফেরিওয়ালা হাঁক পাড়তে শুরু করল --‘ বাঁশদ্রোণীতে দার্জিলিং... লেবু সাতটা পঞ্চাশ.. সাতটা পঞ্চাশ..’ 
বেশ টাটকা মনে হচ্ছে লেবুগুলো, অমনি বাবার কথাটা মনে পড়ে গেল। মা বলেনি, তবু কিনে ফেলল।
ফলওয়ালাকে একটা দুশো টাকার নোট দিল। ও দেড়শ টাকা ফেরত দিল, পষ্ট মনে আছে। এই টাকা থেকেই তো পেঁয়াজ, আদা-রসুন কিনল।
তাহলে মাংসওলাই ভুল করে দুটো দুশো টাকার কড় কড়ে নোট দিয়েছিল, এমনভাবে সেঁটেছিল, মাংস ওয়ালা কি ঋজু ---কেউই বুঝতে পারেনি।

‘ঋজু, কোথায় গেলি রে, তাড়াতাড়ি চান করে নে বাবা, খেতে দেব, জলি-অমরদার হয়ে গেছে।’ রান্নাঘর থেকে মা হাঁক পাড়ে।

‘এক সেকেন্ড এক সেকেন্ড, মা দাঁড়াও, একটু আসছি।’
‘কোত্থেকে?’
‘টাকাটা ফেরত দিয়ে আসি।’
‘কার টাকা? কিসের টাকা?’ ঘাড় ঘোরাতেই মা দেখেন ছেলে সাইকেল নিয়ে উধাও।

















*********************************************************************

অণুগল্প * প্রভাত ভট্টাচার্য

 



হংসসুখ 

প্রভাত ভট্টাচার্য 


ভীষণ গরম পড়েছে এবারে। বাইরে বেরোলে শরীর যেন ঝলসে যাচ্ছে। সবাই গরমে কাবু। 

এবারে তো চল আমাদের দেশের বাড়িতে। কতদিন ধরে বলছি। সৌরভ বলল বিক্রমকে। 

ঠিক আছে। কিন্ত এই গরমে  !

তাছাড়া আর কবে যাবি। তুই তো চাকরি ছেড়ে দিচ্ছিস।  আবার কবে তোর সাথে দেখা হবে তার ঠিক নেই। 

তা ঠিক। আচ্ছা, সামনের রোববার যাবো। 

ঠিক আছে, তাহলে ঐ কথাই রইলো। 

সৌরভ আর বিক্রম দুই বন্ধু। কাজ করে একই অফিসে। বিক্রম কাজ ছেড়ে দিচ্ছে। তার আর ভালো লাগছে না চাকরি করতে। সে চায় ব্যবসা করতে। সে খুব ভালোবাসে ছবি আঁকতে, আর তার আঁকার হাতও বেশ ভালো। তার বাড়ির অবস্থা বেশ সচ্ছল। 

রোববার সকালে দুজনে রওনা হল সৌরভের দেশের বাড়ির দিকে , মেদিনীপুরের ঘাটালে। গরম লাগলেও বিক্রমের ভালোই লাগছিল । নতুন জায়গা দেখার একটা আলাদা আনন্দ  আছে। 

গ্রামটা খুব সুন্দর। প্রচুর গাছপালা, পুকুর রয়েছে। এখানে আর অতটা গরম লাগছে না। 

সৌরভের মা বাবা খুব খাতিরযত্ন করলেন। বেশ জমিয়ে খাওয়াদাওয়া হল। 

এবারে একটু আশপাশটা ঘুরে দেখলে হয় না। বিক্রম বলল। 

হ্যাঁ, চল না। 

দুই বন্ধু মিলে চলল গ্রাম ঘুরে দেখতে। 

একটা পুকুরের কাছে এসে বিক্রম বলল, কি সুন্দর পুকুরটা। চল না, সামনে গিয়ে বসি। 

ঠিক আছে, চল। 

বেশ গভীর মনে হয় পুকুরটা। টলমলে জল। হাঁস চরে বেড়াচ্ছে। 

কেমন লাগছে জায়গাটা? বলল সৌরভ। 

ভীষণ সুন্দর। হাঁসগুলো কেমন মনের সুখে ভেসে চলেছে। 

বিক্রমের কাছে কাগজ কলম ছিল, তাই দিয়ে সে ছবি আঁকতে লাগল, পুকুর, হাঁস, গাছপালা। 

 কি সুন্দর ছবি এঁকেছিস তুই! ছবির একটা নাম দিই  ? বলে উঠলো সৌরভ। 

 কি নাম? 

 হংসসুখ। 

 ভারী সুন্দর নাম দিলি তো।











************************************"**************************************************************


প্রভাত ভট্টাচার্য  

তিনি সব্যসাচী--- এক হাতে সামলান চিকিৎসকের গুরুভার দায়িত্ব আর এক হাতে ফোটান সাহিত্য সৃষ্টির ফুল। দ্য হার্ট, মিশন পসিবল, মাই ডটার, রাজবাড়িতে রক্তপাত , ডিটেক্টিভ সূর্য এবং কবিতা সংকলন - কাগজের মানুষ এবং ফিনিক্স পাখি তাঁর উজ্জ্বল সাহিত্যসৃষ্টি । সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর  তিনটি ভিন্ন ধরনের উপন্যাস - দশভুজা, কাগজের মানুষ ও মায়াবী গ্রাম। এছাড়াও তাঁর আর একটি মনভোলানো সৃষ্টি 'গুহা মানবের ডায়েরি'