শুক্রবার, ১৪ জুন, ২০২৪

উপন্যাস * দীপংকর রায়

   



['স্বরবর্ণে'র চতুর্থ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে কবি দীপংকর রায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে '। এই উপন্যাস লেখকের ষোল-সতের বছর বয়সের কালপর্ব থেকে শুরু। যদিও লেখকের জন্ম এপার বাংলায়, কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে থেকেছে ওপার বাংলায়। কাজেই যাতায়াত থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ ছেড়ে চলে আসা আর তারই নাছোড় এক টানাটানির মধ্যে যে জীবনের ক্রমাগত আসা আর যাওয়া ,এই উপন্যাস মূলত তারই এক নির্মম নিষ্ঠুর ভাঙা-গড়ার আশ্চর্য কথোপকথন। ধারাবাহিকভাবে যা আমরা পড়ছি, কবি দীপংকর রায়ের মায়াময় কলমে।]


কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে 

পর্ব * ১৪   

দীপংকর রায়


   


একাত্ম করছি না বা পার্থক্যও করছি না  । তবুও কোথাও একটি সমান্তরাল রেখার দেখা যেন মিলে যায় । তাই হয়তো অনুভব করতে বাধ্য করায় ।

     তখন এদের সকলের সঙ্গে কোনো একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছিল , সকলের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতেই । তাতে বিশেষ মনোনিবেশ না করতে পেরে‌ আমি হয়তো একটু বিচ্ছিন্ন হয়ে ভাবছিলাম , আচ্ছা , প্রকৃত অর্থে আমার জীবনে প্রকৃত উদ্দেশ্যের জায়গা কোনটি ? আমি কি এই গোপালনকেই মোক্ষ ভেবে নিয়ে বৃন্দাবনবাসীর জীবন বেছে‌ নেবো হে কানাই ? তাহলে আমার‌ যে জন্যে ফিরে আসা এই শহরে—  তার‌ কী হবে ? 

এই সব ভাবনা দিন দিন এমন জায়গায় পৌঁছাচ্ছে দেখতে‌ পাচ্ছি , যখন ভেতরটায় ভীষণ অস্থিরতায় পেয়ে বসে । নিজের জায়গাটি  নিজেই আর ঠিক করতে পারি না ।  যদিও ঘুরে দাঁড়িয়েই ভাবি , ঠিক আছে , কেনই বা হবে না‌ ? এই কাজটিকে আরো বড় করেও তো‌ ভাবতে পারি ! এবং যেটা ভাবা , সেটাই , সে দিন থেকেই ভাবতে শুরু করলাম । স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম তেমন করেই । ভাবতে‌ থাকলাম যেমন করেই হোক আরো কিছু গোরু বাছুরের সংগ্রহ বাড়াতে হবে , এবং সেটা যে করেই হোক । কারণ কালো গোরুটি তো ইতিমধ্যেই ঠাট হয়ে ঘরে বসেই খাবে । এখনো পর্যন্ত তো গাভীন হওয়ার কোনো লক্ষণই নেই  । তাহলে ? 

  শেষমেষ কান্ডারী তো সেই অশোকদাই । তাকেই বিস্তারিত জানালাম । সেও রাজি হলো । শেষে লম্বা করে বাথরূমের ধার থেকে  দক্ষিণের ডোবাটিকে বুজিয়ে দিয়ে একেবারে দক্ষিণের সীমানা ঘেঁষে লম্বা করে টালির চাল দিয়ে পাকা করে ঘর তৈরি করা হলো । শুধু গোরু বাছুর রাখবার জন্যেই । তারা তখন আর বাড়ির মধ্যে চলাচল করতে পারে না । একেবারে আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে থাকে । হুঁশ করে শোয় নাকে শব্দ করে । বাঁশ গলিয়ে দিয়ে যেভাবে বিভাজন রেখা তৈরি করা হয়েছে তাদের খাবারদাবার দেবার জন্যে সামনে থেকে , তাতে একেবারে একটি পাকাপাকি বন্দোবস্ত হয়ে গেছে এখন । একজন গোরুর খামারী তৈরি হয়ে যাওয়াতে এখন আর কোনো অসুবিধা রইলো না । 


       কালো গোরুটিকে নিয়ে ছুটোছুটির অন্ত রইল না যদিও । একবার তাকে নিয়ে মুরএভিনিউ ফার্মে ষাঁড়ের কাছে নিয়ে যাওয়া , আর একবার নরেন্দ্রপুর । এ পর্ব চলতেই থাকলো কৃত্রিম উপায়ের কাছে আর না যেয়ে ।

        এদিকে নতুন গোরুর আর অধিক ব্যবস্থা না করতে পারলেও একজন সব সময়ের কাজের লোকের ব্যবস্থা করে দিলো পন্ডিতজি । তার সহযোগিতায় এই বিহারী মানুষটিকে পাওয়া গেল । কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতে তাকে নিয়ে এমনই এক সমস্যা বেঁধে বসলো যে সে সময় সুযোগ পেলেই বাংলা মদ পেটে পুরে দেয় । এবং একবার পেটে পড়লে তখন সে মুখ দিয়ে খাওয়াও যেন ভুলে যায় । মাংসের টুকরো প্রবেশ করাতে চায়  মুখের বদলে নাক দিয়ে ।

         এ সব ছাড়া গোরু বাছুরের দেখা শোনায় সে একেবারে পাকাপোক্ত। সকালে খুব সকাল সকাল উঠে গোরু বাছুরের স্নান খাওয়ানো দাওয়ানো দুধ দোহাই করা সব সেরে সে একেবারে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে গোরু বাছুরদের পাশের মাঠে বেঁধে দিয়ে ,  একেবারে বিচালির বস্তা পেতে টান হয়ে ঘুম দিতে চলে যায় দশটা বাজতে না বাজতেই । তার কাজের কায়দা গোছগাছ দেখে সত্যিই ভরসা না করে পারি না । মনে মনে বলিও , এই না হলে জাত গোয়ালা বলে কি এমনি এমনি ! সবাইকে দিয়ে কি সব কাজ হয় ?

      বিশনি চন্দ্রের গন্ডগোলের জায়গা ঐ একটিই । বাকি সব ক্ষেত্রেই সে কাজের দিক দিয়ে একেবারে পাকাপোক্ত । কিন্তু ঐ , ফাঁক পেলেই পেটে ঢেলে দেও । আর তারপরেই সব উল্টোপাল্টা । এলোমেলো । একদিন পন্ডিতজির সামনে বসিয়ে বেশ খানিকক্ষণ বুঝো বুঝি চালালাম । তারপরে বেশ কিছুদিন ভালো চললো । সেও তার নাক মলা কান মলা তওবা-তৌবি সব যেন পন্ডিতজির সামনে দেওয়া কথা রাখছে বলেই মনে হলো । বললো , দারু আর সে পিইবে না । কিন্তু সে কি হয় ! কদিন যেতে না যেতে আবার নেশা করে একদিন দুপুরের পরে উপস্থিত । কী করা ? শীত কাল । ঐ শীতের সন্ধ্যায় তাকে বেশ করে মাথায় জল ঢেলে দিলাম কয়েক বালতি সকলে মিলে । নেশা খানিকটা ছুটলো ।  কিন্তু এবার তাকে দেখে নিজের-ই কষ্ট হতে লাগলো । শীতে কাঁপতে লাগলো তার সমস্ত শরীর ঠক ঠক করে । সে বলতে লাগলো , ‘ আর কভি নেহি পিউংগা , আউর কভি নেহি ….’ এই বলতে‌ বলতে একসময় সে ঘুমিয়ে পড়লো একেবারে অসাড় হয়ে । রাতে আর খাবার খেতেও উঠলো না সে দিনের মতো ।

    বিশনিকে নিয়ে সেদিন আমাদের সকলেরই বেশ মনটা খারাপ হয়েছিল এই ভেবে ,  কেন তাকে স্নান করাতেই বা গেলাম , সকলে মিলে আনন্দ উল্লাস সহকারে ? আহা , বেচারি শীতে একেবারে কুঁকড়ে পড়ে থাকলো কেমন দেখ সারা রাত ধরে বারান্দার কোণাটিতে জড়োসড়ো হয়ে ! আজ সে তার শোবার জায়গাতেও শুতে যায় নি ।

     যাক এতকিছুর পরেও একটা কথা তো বলতেই হয় — সে এ বাড়িতে আসার পর থেকে আমাকে আর গোরুর বিষয় নিয়ে কোনো দিকেই তাকাতে হয় না । সে কাজে সে ভীষণ পরিপাটি ও গোছালো ।এক মুহুর্তও গোরুর ঘরে গোবরের ছড়াছড়ি থাকে না । বা আমাকেও আর দুহাতে গোবর তুলতে হয়‌ না , চোনা-গোবর-ময়লা-সহ । নেশা পর্ব‌ 

বাদে বাকি আর সবটাতেই সে সময় অনুযায়ী একেবারে পাকাপাকি সিদ্ধহস্তই বলা চলে । 

      জটা ভাই এর উপস্থিতিতেও দুবেলা রয়েছে । কারণ তাকে ছাড়িয়ে দিলেই দেওয়া যেতো , কিন্তু বিষনি ভাইএর উপর ভরসা পুরোটা তো করা যায় না ! তাই উভয়ের উপস্থিতিতে মিলেমিশে বেশ‌ই চলছিল‌ ।

       আমিও মন দিয়ে শরৎ সাহিত্যের একের পর এক খন্ডগুলি শেষ করতে থাকি । ব্রজ দাও একের‌ পর‌ এক সঙ্গে মধুসূদন রচনাবলী ও রবীন্দ্রনাথ সাপ্লাই দেওয়া শুরু করেছে দেখছি । কিন্তু তাও আমাকে প্রতিমুহূর্তে উপলব্ধি করতে বাধ্য হতে হচ্ছে , ‘ সাহিত্য তো এখানেই শেষ‌ নয় ! দেশ পত্রিকা পড়তে পড়তে‌ মনে‌ হয় , কত শাখা প্রশাখা তার ‌! আর আধুনিক কবিতা তো অনেক এগিয়ে   তার  থেকেও ! আধুনিক গদ্য সাহিত্যও এদের পরে আরো আনেক‌ দূর এগিয়ে গেছে —- কিন্তু সে সবের সঠিক খোঁজ কে আর আমাকে দেবে ?

      ছোটো ভাইএর গৃহ শিক্ষক নিতাই দার সঙ্গে আস্তে আস্তে বেশ একটা অন্যরকম সম্পর্ক তৈরি হয়েছে । 

       ভাইকে পড়ানো হয়ে গেলে ভাই তো তার বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে খেলার‌ মাঠে দৌড় দেয় , তখন নিতাই দা গল্পে গল্পে খানিকটা সময় কাটাতে চায় দেখি আমার সঙ্গে । সেই আমাকে অনেক লেখক কবিদের নাম বলে । জিজ্ঞাসা করে এঁদের লেখা পত্র সম্বন্ধে আমার জানা চেনা আছে কিনা । এদের মধ্যে রয়েছেন প্রেমেন মিত্র , সুধীন্দ্রনাথ , বিষ্ণু দে , জীবনানন্দ , মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর , বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় , এই সব কবি সাহিত্যিকদের লেখা পত্র সম্বন্ধে আমি কতটুকুই বা আর জানি । 

       প্রথমটায় আমি তালহারা হয়ে পড়ি । সত্যিই তো , আমি তো এঁদের সম্মন্ধে কিছুই জানি না ! এত সব লেখক সাহিত্যিকদের খোঁজ খবর আমি পাবো কী করে ? এঁদের মধ্যে কারো কারো নাম শুনলেও পাঠ্য বই তে কাউকে কাউকে একটু আধটু নাম ধাম শুনলেও বিস্তৃত ভাবে কতটুকুই বা জানি আমি ?

     তাই তাল কেটে যায় বুঝি । অনেকটাই হাঁ করে শুনি নিতাই দার মুখে নানা গল্পে গল্পে । তবে এঁদের মধ্যে তার প্রিয় লেখক হলো যা বুঝতে পারলাম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় । বিশেষ করে তাঁর ছোটো গল্প নিয়ে নিতাই দার উচ্ছ্বাসের অন্ত নেই । সে যখন একটি একটি করে কিছু কিছু গল্পের অংশ বলতে থাকে আমি আশ্চর্য হয়ে শুনতে থাকি । আর পরদিনই মাকে এই সব লেখকদের বই পত্রের লিস্ট ধরিয়ে দিতে বলি ব্রজদাকে । ব্রজদা এক সপ্তাহের ভেতর সেই লেখকের একটা না একটা গ্রন্থ পাঠিয়ে দেয় মার হাতে । মা অফিস থেকে এসে বইটির প্যাকেট খুলে হাতে দিতে না দিতে আমি সেটি নিয়ে বসে যাই বারান্দার এক কোণে পাতা সেই মোড়াটির উপরে । যেন এখুনি সেটিকে আদ্যপান্ত না দেখতে পেলে রাতের ঘুম আসবে না এমনই‌ একটা অবস্থা ।

      সামনের বাড়ির মাসিমার বোনঝি ইদানীং দেখছি এখানেই যেন পাকাপাকি বন্দোবস্ত করে নিয়েছে বুঝি ! আজকাল ঘনো ঘনো তার আসা যাওয়া চলছে দেখতে পারছি ।

      ছোটো ভাই ওদেশের থেকে ফিরে আসার পরে তাকে দেখতে পেয়ে একদিন আমাদের বাড়িতে চলে আসে । আমার লাগানো ফুল গাছের বাগান নিয়ে ছোটোভাইকে নানা রকমের উপদেশ দিয়ে যায় শুনতে পাই ঘরের ভেতরে বসে বসেই ।কিন্তু সে কখনো এগিয়ে এসে আমার সঙ্গে আলাপ জমাতে আসে না । আড়ে আড়ে চায় আর আমাকে উদ্দেশ্য করে বুঝতে পারি নানা কথা ভাইকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে বলতে থাকে শুনতে পাই । 

      দুপুর বেলা হলে সেই উঁকিঝুঁকি ও বাড়ি থেকে । অনেক রাত অবধি গলা চড়িয়ে উচ্চগ্রামে নানা কথা ছুঁড়ে দেয় , যাতে সেই কথাগুলি আমার কানে পৌঁছোয় যেন বাতাসে বাতাসে । আর সেটা আমি বুঝতেও পারি বেশ । হয়তো সেই বয়েস বুঝতে সাহায্যও করে এই সব বুঝি , খুব তাড়াতাড়িই ! 

     এ এক অদ্ভুত খেলা শুরু হয়েছে। আর সেই খেলায় জড়িয়ে পড়ছি  অজান্তে যেন কেমন করে ! এই বিষয়গুলি এমনই —- যা কাউকে বলার মতোও নয় ।

      ইতিমধ্যে মাসিমার বেড়ার ঘর ভাঙাচোরাও হয়ে গেছে । দালান ঘরে মাসিমারা উঠেও গেছে । মাসিমার বোঋলঝিও পাকা ঘরের মাঝখানের লম্বা করিডোর থেকে সকাল বিকাল রাত্তির এক এক সময় এক এক ধরণের অভিব্যক্তি ছুঁড়ে মারছে । বুঝতে পারছি তার এই খেলায় আমি বেশ খানিকটা জড়িয়ে পড়ছি । আর সেও তার গুরুত্ব বুঝিয়ে দিয়ে ক্রমাগত এক ধরণের উপস্থাপনায় মেতে উঠছে । আর যত তার মেতে ওঠা ততোই আমি মাসিমার বাড়ির পেছনের সেই মাথা উঁচু করা ঝাউ গাছ গুলির মধ্যে রাতের আলোআঁধারিতে নিজেকে ভাসিয়ে দিই  নানা স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষার জালে জালে ….  আমি ঘুরপাক খাই অনেক রাত অবধি একাকী ।  কখনো আঁধার রাতের আকাশে । কখনো চাঁদনি রাতে প্রচুর হাওয়ার ভেতর ঝাউ গাছের মাথা দুলুনির ভেতর এমন এক অদ্ভুত সুগন্ধ‌ ভেসে আসতে দেখি আমার নাকে , কিন্তু আমি কি বুঝতে পারি এই কথাটি, আমি মজেছি মিথ্যে স্বপ্নের ভ্রমে ?

    প্রকৃতিও আমার এই দুর্বলতার গন্ধ পেয়ে বেশ মজায় মেতেছে যেন।

পেয়েছে যেন এমন এক ভ্রান্ত পথিককে , বলছে যেন ঠিক আছে , কী আর হয়েছে এমন , এসো খেলি‌ । এই সময় খেলবে না তো কবে আর খেলবে !

    মনে মনে ভাবি , কী ঝামেলায় পড়লাম রে বাবা ! এ যে সবটুকু সময় জুড়ে বসতে চায় ! কিন্তু সে কী করে ? আমি কি সত্যিই ভুলের ঘোরে পড়েছি ! কীভাবে ছাড়াই ? মন যে কিছুতেই ফেরে না পেছনে ! কী করি আমি তাহলে ? পালাবো কোথাও ? কোথাও চলে যেতে পারলে হয়তো একটা কোনো পরিণতি ঘটলেও ঘটতে পারতো হয়তো ! অন্তত বোঝা যেত , সত্যি সত্যিই এ সবের প্রকৃত কোনো পরিণতি আছে কি না । নাকি সে সব শুধু মাত্রই একটা উপস্থাপনা এই বয়েসের ; যে ধরণটি প্রাথমিকভাবে মেয়েদের । অন্যের বাকিটা ভাববার সময় থাকে না তখন তাদের। সে শুধুই ভাসিয়ে নিয়ে চলবার দিন বুঝি এই বয়েসে তাদের! 

         এ বাড়ির আড্ডাটা খানিকটা কমে এসেছে । কারণ মা এবং ভাই ওদেশ থেকে ফিরে এসেছে । 

         নিতাইদা ভাইকে পড়াতে আসে বিকেলের দিকটাতে । এ ক্ষেত্রে আর একটি বিষয়ও নতুন যুক্ত হয়েছে নিতাই দার সঙ্গে আমারও। নিতাই দার সাহিত্য প্রীতি আছে একটু আধটু আগেই বলেছি । তার সঙ্গে ভাইএর পড়াশোনা হয়ে গেলে অনেকটা সময় কাটে তারপর আমাদের একসঙ্গে । সে যেন আজ কদিন হলো বেশ খানিকটা সময় নিয়ে নিয়েছে ।যদিও তার সাহিত্য অনুরাগের মধ্যে খানিকটা শ্রেণী সংগ্রামের ঝাঁঝ গন্ধ মিশে আছে । সে থাক । আমারও যে তার দর্শণে একেবারে সমর্থন নেই তা তো না ! কিন্তু তারপরেও যে আমার দেখায় আরো একটু অন্যরকম স্বাদ-গন্ধের কথা রয়েছে ; সে কথাটা তাকে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিতে না পারলেও , খানিকটা যেন সে নিজের মতো করে বুঝে নিয়েই আমাকে বুঝোতে চায় সুকান্ত ভট্টাচার্য নজরুলের কবিতার খানিকটা খানিকটা । সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও‌ বুঝোয় । আমিও গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করি তার সব কথা । স্বীকার করি তাঁদেরও  আগে পরে সকলের কথাই । সমসাময়িক পরিস্থিতির প্রভাব ,  প্রতিবাদী দিকগুলির সব বৈশিষ্ট্যগুলিই মানি । কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও বলি , দেখুন সময়ের দাবি তো থাকবেই শিল্পে , কবিতায় , গদ্যসাহিতে । সে কথা কে অস্বীকার করছে ! কোনোভাবেই সেই সবকে অস্বীকার করা যায় না । কিন্তু সময়কে অতিক্রম করে যে লেখা আরো দূরের কথা ভাবে , আরো বড় সময়ের কথা , সেখানে যে লেখা পৌঁছোয় , যাকে ধরেও ধরা যায় না! সেই লেখার প্রতিই আমার আকর্ষণ অনুভব করি বেশি । অর্থাৎ দুটি দিককেই যে দেখা সমানভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায় ,  তার প্রতিই আমার টান অনুভব করি বেশি । কেউ কারো কাছে ছোটোও না বড়ও না । জীবনকে বাদ দিয়ে জীবনের প্রয়োজনকে বাদ দিয়ে , শিল্পের কোনো গ্রহণযোগ্যতা যেমন নেই — তেমন জীবনের ওপারে আরো বড় জীবনের সত্যকেও তো অস্বীকার করা যায় না ! দুটি দিকই দুটি দিকের স্রোতে ভেসে চলেছে সমান ভাবে । আমাকে সেই মিশ্রণের স্বরূপকে ছুঁতে হবে ! সেই সুরের প্রতি আকর্ষণকেই প্রকৃত শিল্পদৃষ্টি বলে মনে করি আমি । 


        নিতাই দা সে প্রসঙ্গের কতোটা ধার কাছ দিয়ে পৌঁছোতে চাইলো বা চাইলো না , তা জানি না । তবে সে তার পরে যে কথা বললো সেটা সত্যিই ভেবাচেকা খাইয়ে দেয় যেনো আরো খানিকটাই । সে বলে , তাহলে কি তাকে তুমি রবীন্দ্রনাথের প্রেম ও পূজা পর্যায়ের ধারায় সব কিছুকেই  ফেলতে চাইছো ? তাহলে তো তার কোনোই শেষ নেই ! 

        এবারে আমি  বেশ খানিকটা ঝামেলায় পড়ি । বলি , না না সেই ক্ষেত্রে অনেকটাই যেমন ঠিক , আবার অনেকটাই ঠিক সেরকমই না ! হ্যাঁ , তাকে আপনি প্রেমও বলতে পারেন , আবার শুধুই প্রেমও নয় । সে সব মিলিয়ে মিশিয়ে আরো অনেকটাই বড় সে জিনিস । সে ঠিক ছোটো প্রেম নয় । অনেকটাই বড় । 

     আচ্ছা এই ছোটো প্রেম আর নিরন্নতা , এই নিয়েই কি সব কথা শেষ করা যায় ? মানুষের যে জটিল মনস্তত্ত্ব রয়েছে , তার কত অভিমুখ ! সেগুলিকে খুব ভালো করে লক্ষ্য করে দেখেছেন কি কখনো ? যার ভেতরের অপূর্ণতা ! যার জটিল গতিবিধি! যা ঐ প্রেম অপ্রেম সকল কিছুকেই ছাড়িয়ে এমন ধাঁধা ধরায় ;  সে সব নিয়ে ভেবে দেখেছেন কি কখনো ? তারপরেও আপনি রবীন্দ্রনাথের গানের কাছে পৌঁছতে যেয়ে দেখবেন , যে জিনিসটিকে  আপনি অতি সহজে ধরতে পারছেন না , তার অনেক দরজা জানলা খুলে যাচ্ছে যেন ;  আমি ঠিক ঐখানের হাহাকারের কথা বলছি । অনেক সময় আমিও ঠিক ধরতে পারি না জানেন তো ! এই যে আপনাকে যেসব বলে গেলাম তার কতটুকু ছুঁতে পারিই বা আমি নিজেই ? তবে যেটুকু অনুভবে ধরা দেয় , যতটুকু বুঝতে পারি , তাতে এইটুকুই বুঝি , মানুষের জীবনে আরো অনেকগুলি  অনুভবের জায়গা আছে , আরো কতরকমের হাহাকার আছে , দৈন্য আছে , আমাদের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের মধ্যে তার কত অভিমুখ ! সেই সব । তাঁদের সামাজিক দাবিদাওয়াকে এক বিন্দুও খাটো করছি না । কিন্তু সমাজ সংস্কার তো তখনই হবে , যখন সংস্কারক এবং সাংস্কারিকের মধ্যে বোঝাপড়াটি খুব সহজ ভাবে হয়ে যাবে । কিন্তু সেটা হয় কোই ? যদি হয়‌ , তখনই তো তাদের মধ্যকার সকল দৈন্যের সমাধান হয়ে যেতে পারে  একটু একটু করে ! আমার মনে হয় সে জিনিস দিতে পারে কে জানেন , আমার মনে হয় একমাত্র বোধের শিক্ষাই । আমাদের প্রকৃত শিক্ষিত হয়ে উঠবার গন্ডগোলের মধ্যেই রয়েছে সঠিক বিচার বিবেচনার দিকটার সমাধান । সেটার গ্রহণযোগ্যতা যদি সমাজ ব্যাবস্থার মধ্যে ঠিকঠাক ঘটতো , তাহলে একটি বড় জায়গা দিয়ে আমরা এগিয়ে যেয়ে দাঁড়াতে পারতাম হয়তো অনেকটা ঠিক জায়গায় ।

 

      যাইহোক , কোথা থেকে কোথায় এসে ঠেকালাম দেখেন ! হচ্ছিল লেখার কথা , আর আমি কোথায় কী সব বকে যাচ্ছি দেখেন । আসলে আমি হয়তো বলতে চাইছিলাম , শিল্প শিক্ষার জায়গাটির কথা । আসলে মহান লেখা বলে ঠিক পরিষ্কার কিছু না বললেও , যেটা বলার , যে জায়গাটির বিভ্রান্তির কথা নিয়ে আমাদের আলোচনা আরম্ভ হয়েছিল , সেটা কোথায় কোথায় আমরা পেতে পারি ? যা আমাদের এই প্রথাগত ধারণার বাইরে নিয়ে যেয়ে স্বভাবের মূল অবক্ষয়ের জায়গাটাকে দেখিয়ে দিতে পারবে ? আমি সেই জায়গার কথা ভাবি । কেই বা ভাবায় তাও জানি না ! তবে ভাবায় । ভাবায় বলেই সেই অনুসন্ধানের দিকেই আমি বিশেষ ভাবে ঝুঁকে পরি । তাই , আমি কাউকেই ছোটো বড় না করে বলতে পারি , কোনোরকম এক মাত্রায় গণ্ডিবদ্ধ হবার প্রবণতাই আমার বিশ্বাসে জায়গা করে নিতে পারে না খুব সহজ কিছু দিয়ে । তার দিকে যাত্রায় যে দুরুহতা রয়েছে —  তাকে অতিক্রম করার যাত্রা পথে যে অন্তরের মুর্ছনাকে স্পর্শ করতে হয় , সে পথেই আমার যাত্রা । 

     নিতাইদা একটি কথাও না বলে আমার মুখের দিকে অনেকক্ষণ হাঁ করে চেয়ে রইল । 

    তাতে আমার খুবই অস্বস্তি হলো খানিকক্ষণ , কিন্তু কী আর করা ! আমি কীই বা বললাম এতক্ষণ , যাতে সে ওরকম হতভম্ব হয়ে চেয়ে থাকলো খানিকক্ষণ !

      এই কথাগুলি আমিও তো আর একবার সবটা বলতে পারবো না একই  রকমভাবে ! 

    তাহলে কি আমি কিছু ভুলভাল বলে ফেলেছি ? যাতে নিতাই দা চেয়ে আছে কিছু একটা বলবে বলে, নাকি সে আমাকে পাগল টাগল কিছু একটা ভাবছে হয়তো । 

     সে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে চেয়ে থেকে এবারে এই কথাটিই বললো শুধু দেখলাম—- আমি তোমার সব কথা ঠিক ভাবে বুঝতেই পারলাম না ভাই ।



**********************************************************************************************

আগামী পর্বে 

**********************************************************************************************

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন