শুক্রবার, ১৪ জুন, ২০২৪

গল্প * প্রদীপ কুমার দে

 

















অচল কথা 

প্রদীপ কুমার দে 


বর্ধমানের অজগাঁ। দীপেন্দু স্কুল পাশ করার পর পালিয়ে আসতে চায় শহরে। মনের ইচ্ছেগুলো গরীবদের ঘরে শুকিয়ে যায়। কোনক্রমে বর্ধমানের কলেজ থেকে পাশও করে। এবার জীবিকা নির্বাহের চিন্তা করতে হবে। ঘরে অসুস্থ বাবা। মা কষ্টের সংসারে দিনাতিপাত করে।

এরমধ্যে বসন্ত কাল এসে হাজির হল দীপেন্দুর হৃদয়ে। আসলে কিন্তু গ্রীষ্মকাল।

--  একটু জল হবে আপনার কাছে? ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তাই?

বর্ধমান রেলস্টেশন দুপুরবেলা, একেবারেই ফাঁকা। তারই মধ্যে এক কিশোরী কলেজের সবুজপার শাড়িতে সাধারণ ভাবেই স্টেশনের সিমেন্ট বাঁধানো  বেঞ্চে এসে এই কাতর প্রশ্নে চেয়ে থাকে।

দীপেন্দু বড় ঢাউস ব্যাগের চেন খুলে জলের বোতল এগিয়ে দেয়। মেয়েটি ইতস্তত করে বোতলে হাত দিতে। দীপেন্দু সাহস দেয়,
--  কিছু হবে না। আমি এসব মানি না। নিন।

মেয়েটি সংকোচের মধ্যেও জল পান করে,
--  ধন্যবাদ। খুব বাঁচালেন আমায়, আমি যে শ্বাসকষ্টের রোগে আক্রান্ত।

--  সে কি?

--  ভয়ের কিছু নেই। আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। কিন্তু আজ এক বোতল জল শেষ হয়ে গেছে। 

--  সঙ্গে ওষুধ নেই?

--  কলেজেই ওষুধ নিয়েছি। তাই আরো জল চাইছিল শরীর। এই ভরদুপুরে আপনার কাছে তাই বাধ্য হয়ে চাইলাম। আপনাকে ধন্যবাদ। আচ্ছা আমি চলি।

দীপেন্দু অনেক কথা বলতে চাইছিল কিন্তু সব গুড়ে বালি ঢেলে বাইশের সেই তরুনী লম্বা বিনুনি দুলিয়ে  প্ল্যাটফর্ম ধরে শেষ প্রান্তে এগিয়ে গেল। একবারও ফিরে তাকালো না। দীপেন্দুর কাছ থেকে কোন কথা শুনতে চাইলো না, স্রেফ আলতো করে ধন্যবাদ দিয়ে এগিয়ে গেল তার গন্তব্যে। দীর্ঘাঙ্গী তরুনী ক্রমশই ছোট হতে হতে ক্ষুদ্রকায় বস্তুতে পরিণত হয়ে গেল। দীপ একনজরে ওর গতিবিধি অনুসরণ করতে থাকলো আর মেয়েটির প্রতি রাগ জমাতে থাকলো। মেয়েটার নামটাও সে জানলো না। কলেজে পড়ে এটা শুনলো কিন্তু দীপেন্দুর তো কলেজ জীবন একবছর আগেই শেষ হয়ে গেছে। ওখান থেকে কোন খবর আসার সুযোগও নেই। রাগ হলো নিজের প্রতি।  ছিঃ এইসব কি ভাবছে সে? একটা মেয়ে বিপদে পড়ে এবং নিরুপায় না হলে কোন যুবকের কাছ থেকে জল চেয়ে খায়? আর সেটার সুযোগ নিয়ে আলাপ জমাতে চাইছে সে? ছিঃ এটা প্রকৃত তরুণের কাজই নয়।

বাড়িতে ফিরে আসে দীপেন্দু, কিন্তু বার বার মেয়েটাকে মনে পড়ে যাচ্ছে যে তার। কাজ খোঁজার জগৎ তার হারিয়ে যাচ্ছে, শুধুই ভেসে আসছে বসন্তের হাওয়া তার হৃদয়কুঠী থেকে।
দীপেন্দুর মনে একটা ঝড় বইতে থাকে। দিনে কিছু কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে মাঝেমধ্যে মেয়েটার মুখটা ভেসে আসে। এড়িয়ে যায়। ধুৎ শালা এ আবার কি শুরু হলো?  সামান্য একটু জল দিয়ে এতসব ভাবা? কিন্ত রাতের বিছানায় তাকে ছটফট করতে হয়। ঠিক করে কালকেই সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বর্ধমান স্টেশনে সে তার জন্য অপেক্ষায় থাকবে। 

তাই করলো দীপেন্দু, দুপুর বারোটা থেকে স্টেশনে বসে রইলো। জনপ্রানীর দেখা নেই। গরমে এই সময়ে কে আসবে? বিকালে কলেজ শেষে ভিড় হয় আর তখন ট্রেনও থাকে। তাহলে মেয়েটা কাল এরকম সময় এল কেন? এবার দীপেন্দুর মাথা খুলে গেল কাল ও আগেই বেরিয়ে গেছিলো। দীপেন্দু বাড়ির পথ ধরলো ফিরে যাওয়া ছাড়া আর যে তার উপায় ছিল না বিকাল পর্যন্ত থাকার।

নিজেকে খুব ছোট বলেই মনে হল তার। কাজের ব্যবস্থা না করে একটা মেয়ের পিছনে ছুটে চলা ঠিক নয়। না এসব কি চিন্তা তার? এখনই এই চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সে অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

রাতে নিজেকে অনেক বুঝিয়ে শুধরে নিল। কাল হল পরের দিন দুপুরের শেষে বিকালবেলা। মাথায় চাপলো, বিকালে গিয়ে একবার দেখা যাক!
যথারীতি দৌড়। গন্তব্য বর্ধমান স্টেশন। স্টেশনে ঢুকতে সময় লাগলো কারণ রেলক্রশিং বন্ধ ছিল। হাওড়া লোকাল বেরিয়ে গেল।

সত্যি কলেজ ফেরত বহু মেয়ে। অনেকে আবার ট্রেনেও উঠে গেছে। দীপেন্দু ধারে দাঁড়িয়েই রইল, খোঁজে সে এল না। ধোকা খেয়ে গেল।

বাড়িতে বিমর্ষ মন নিয়ে নিজের কাজগুলো পরিবারের জন্য করে দিল। কিন্তু প্রতিজ্ঞা করলো আজ তিনসত্যি সে করেই ছাড়বে।
 
কোন এক অমোঘ আকর্ষণে সে ধরাশায়ী।  হাজার বুঝিয়েও নিজের মনকে সে তার নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলো না। প্রেম এক মারাত্মক রোগ, যাকে কাবু করে সে সকল ওষুধের বাইরে চলে যায় তাই ছুটতেই হল তার আকুল টানে।

বর্ধমান স্টেশন। সীটে বসে রইল দীপ। হাওড়া লোকাল দাঁড়িয়ে। ছাড়তে দেড়ি আছে। কলেজ এবার ছুটি হবে। আজ মোক্ষম সময়ে এসেছে সে। আজ সে বড় মন নিয়েই এসেছে। পাল পাল ছাত্রীরা প্ল্যাটফর্মে চলে এল। দীপের চোখ ঘুরছে। প্ল্যাটফর্মের দুই প্রান্ত ধরে হাঁটা পথে সবাই বেড়িয়ে যাচ্ছে। দীপ টিকিট ঘরের সামনে মাঝামাঝি অবস্থায় বসে, কলেজের মেয়েরা এই গেট দিয়েই ঢুকে বেড়িয়ে গেল। ট্রেন হুইসেল মারতেই দীপেন্দুর বুকে ধরাস করে আওয়াজ উঠলো, ও অসুস্থ হলো না তো? স্টেশন ফাঁকা হয়ে গেল। দীপ একা …

--  রোজ রোজ কেন কষ্ট করছেন?

চমকে উঠলো দীপেন্দু। তার পিছনে দাঁড়িয়ে তার বিনুনিউলি।

--  বুঝলাম। হয়তো এক‌টি ভুল।

মেয়েটি দীপের পাশে বসে পড়লো। কিছুক্ষণ সময় নিল। দীপেন্দুর দিকে তাকালো। সে চোখ যে বড় করুণ। আয়ত চোখের চাউনিতে বুক কেঁপে উঠলো দিপেন্দুর।

--  আমারও কষ্ট বাড়াচ্ছেন।

দীপেন্দু মিথ্যার আশ্রয় নেয় নিজেকেই লুকাতে,
--  ভাবলাম অসুস্থ তাই খোঁজ নিই ...

--  ওহঃ সুস্থ হলে আসতেন না?

দীপের কাছে কোন উত্তর নেই। ধরা পড়ে গেছে যে।
খুব কাছ থেকে সে দেখছে মেয়েটার মধ্যে একটা কমনীয় আদুর আকর্ষণ আছে। শ্যামবর্ণা, রোগাটে কিন্তু দীর্ঘাঙ্গী এক যুবতী যার দুটি আয়ত চক্ষে দীপের হৃদয়ে শরাঘাত ঘটে গেছে।

মেয়েটিও ভালো করে দেখে, এক যুবক যে তার হাত ভরে প্রেম নিয়ে তারই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে, 
--  আপনাকে আমি চিনি।

--  কিরকম?

--  আপনার পিস্তুতো বোন মউ আমাদের ব্যাচে পড়ে।

দীপেন্দু বঝে যায় তার সব জানে ও, আর সে নিজে কি বোকা? মেয়েরা কত চালাক। সব খবর রেখেও নীরব। ওই জন্যই ওদের ধৈর্য প্রশংসনীয়। সে যেখানে ছটফট করে মরেছে সেখানে মেয়েটি সব জেনে বুঝে চুপ করে রয়েছে, যার বহিঃপ্রকাশ কিছুমাত্র বোঝার উপায় নেই। তাইতো সেও খোঁজ চালিয়েছে গোপনে কোন হোলদোল ছাড়াই।
--  বলেছে তো বেকার?

--  দোষ ধরে কি হয়?

--  তাই আমি যে আর থাকতে পারিনি তোমায় দেখে। নচেৎ আমি অচল।

মেয়েটি হাসে,
--  অচলবাবু আমার নাম জানতে চান না?

--  খুব জরুরী নয়। কিন্তু ডাকতে ইচ্ছে করে যে খুব তোমার নাম ধরে।

--  আমি কথা, 

--  তুমি জানো তাও বলি আমি দীপেন্দু।

--  ঠিকই। তাহলে এবার একটিবার তোমার মনের সাধটা মেটাও, শুনি ……

দীপেন্দুর বুকে হিল্লোল ওঠে। মনে হল আজ যে সে রাজা হয়ে গেছে। এত বড় পাওয়া!  এত বড়?
চারিপাশ একবার ভালো করে দেখে নেয় সে। স্টেশন চত্বর ফাঁকা। না কেউ নেই আশেপাশে। 
চিৎকার করে আওয়াজে ভরিয়ে দেয় তার মনের কথা,
--  কথা, আমার প্রানের কথা, কথা তুমি আমার হও ……

কথা চিৎকার শুনে হেসে ওঠে খিলখিলিয়ে, আকাশে বাতাসে এক লোমহর্ষক মুহূর্ত যেন ধ্বনিত হয়, হৃদয় হারায় একে ওপরের। কথা মুহুর্তে দীপেন্দুর হাত চেপে ধরে, এক লম্বা বিনুনী বাঁধা মাথা এলিয়ে দেয় তার শক্ত কাঁধে, মুখ দিয়ে গোঙানি ভাঙে,
--  আমার অচলবাবু ...













***********************************************************************************************************



প্রদীপ কুমার দে 

লেখক  নেশায় । 
   বয়স -৬৪ । কলকাতা নিবাসী। উপন্যাস গল্প     কবিতা লেখেন । কয়েকটি বই আছে।





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন