স্বামী বিশুদ্ধানন্দ
জীবনালেখ্য : রূপরেখা
১)
"এতদিন প্রায় বাইরে-বাইরেই ছিলুম। দ্বারকা ঘুরে কাশী এলুম। মনে হল মা'র কাছে একবার যাই, বহুদিন মা'র শ্রীচরণদর্শন করিনি। পূজনীয় অচলানন্দ স্বামী তখন কাশীতে। তাঁকে বললুম 'চলুন কেদারবাবা, মা কেমন করে ঠাকুরের তিথিপূজা করেন দেখে আসি।' তিনি রাজী হলেন।
"বিষ্ণুপুর পর্যন্ত ট্রেনে, তারপর বাইশ মাইল গরুর-গাড়িতে। তখনও বাস হয়নি। সে বেশ মজার ব্যাপার, যেতে যেতে গাড়োয়ান গরু সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, গাড়ি আর চলে না। কী হল? অনেক ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকির পর আবার চলতে আরম্ভ করল। শেষে জয়রামবাটী পৌঁছুলুম।
"তিথিপূজার দিন ক্রমশঃ এগিয়ে আসছে, অথচ বিশেষ কোন উদ্যোগ-আয়োজন নেই। আর দু-তিনদিন মাত্র বাকি, আমি ত মনে মনে বেশ চিন্তিত হয়ে উঠলুম, কী হবে তিথিপূজার? শেষে আর স্থির থাকতে না পেরে পুরানো বাড়ির ভেতরে যেয়ে জিজ্ঞাসা করে বসলুম, 'মা ঠাকুরের তিথিপূজা হবেনা?' তাই শুনে মায়ের মুখে অদ্ভুত একটা হাসি খেলে গেল, আহা, সে-হাসিটি এখনও মনে আছে। বললেন, 'বাবা, কি হবে জানিনা। সে-শক্তিও নেই ভক্তিও নেই।' উত্তর শুনে হতাশ হয়ে গেলুম। তারপর হঠাৎ দেখি বাঁকুড়ার এক ভক্ত এসে উপস্থিত, সঙ্গে দুগরুর-গাড়ি ভর্তি নানান জিনিস, পূজার উপচার থেকে আরম্ভ করে প্রায় হাজার লোকের খাওয়া-দাওয়ার সমস্ত উপকরণ!
“দেখ কাণ্ড, ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা! বলেন কিনা, 'শক্তিও নেই ভক্তিও নেই'। শক্তি ভক্তি সবই যে তুমি মা।... ঠাকুর আর মা কি আলাদা, টাকার এপিঠ-ওপিঠ।
"মা এমন অপূর্ব তিথিপূজা করলেন যা আমার কল্পনারও বাইরে ছিল। ভাষায় কি তার প্রকাশ সম্ভব? মা'র পূজায় বিধিনিয়ম নেই, তাঁর রাগভক্তির পূজা। পূজ্যকে সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ করছেন, জাগ্রতজীবন্তভাবে সেবা করছেন। ঠাকুর যেমন ভবতারিণীকে পূজা করতেন -বালকের সরল বিশ্বাস পবিত্রতা অনুরাগ নিয়ে, -মায়েরও ঠিক তেমনি সেবাপূজা। সেই রাগভক্তি প্রেম-অনুরাগের পূজা দেখে জীবন ধন্য হল।"
২)
শ্রীধাম হইতে পূজ্যপাদ স্বামী অচলানন্দজীর সহিত তিনি বেলুড় মঠ আগমন করেন ও দুই-তিন সপ্তাহকাল মঠবাসের পর ২০/২১ এপ্রিল (১৯১৬) কাশীধামে প্রত্যাগত হন।
কাশী অদ্বৈত-আশ্রমে নিরবছিন্ন তপস্যায় প্রায় ষোলমাস অতিবাহিত হয়। অনন্তর শ্রীরামকৃষ্ণ-মানসপুত্রের আদেশ শিরোধার্য করিয়া ১৯১৭ খৃষ্টাব্দে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে শিবপুরী ছাড়িয়া মায়াবতীর পথে শ্রীবৃন্দাবনে উপস্থিত হইয়া ব্রজমণ্ডলের অন্তর্গত ভগবদ্-লীলাস্থান সকল প্রাণ ভরিয়া দর্শন করিলেন। পক্ষকাল ব্রজভূমে অতিবাহিত হইলে লিখিলেন, "সেদিন বারো ক্রোশ দূরে গোবর্ধন দর্শন করিতে গিয়াছিলাম, কী আনন্দ হইয়াছিল তাহা লিখিয়া আর কি জানাইব। মহাপ্রভু ও পরিকরগণ এখানে যোগসমাধি দ্বারা শ্রীকৃষ্ণের বিশেষ বিশেষ লীলাস্থলী সকল আবিষ্কার করিয়া গিয়াছেন,-পূর্বে ঐ সকল লুপ্ত অবস্থায় ছিল।
"এই স্থানে কিছুদিন থাকিলে শ্রীভগবানের আবির্ভাব বেশ উপলব্ধি হয়। শ্রীবৃন্দাবনে ভক্তেরা এখনও তাঁর নিত্যলীলা দর্শন করিয়া থাকেন।”
অপ্রাকৃত শ্রীবৃন্দাবনলীলার নিবিড় পরিচয় লাভে দিব্যানন্দে বিভোর সন্ন্যাসী হিমালয় অভিমুখে অগ্রসর হইলেন এবং পথে শ্যামলাতালের শান্তিনিলয় 'বিবেকানন্দ কুটিরে' প্রেমময় শ্রীমদ্ বিরজানন্দজী মহারাজের সকাশে দুই-একদিন সানন্দে বিশ্রাম করিয়া অচিরে মনোরম মায়াবতী অদ্বৈত-আশ্রমে পৌঁছিলেন।
অতঃপর ধ্যানগম্ভীর হিমাদ্রির ক্রোড়ে এই নির্জন নিসর্গশোভাময় স্থানে বর্ষচতুষ্টয় নিরবছিন্ন সাধনার আসন পাতিয়াছিলেন,- 'বাহিরের' কাজ বলিতে ইংরাজি 'প্রবুদ্ধ ভারত' পত্রিকার কাজ মাসে দুই-পাঁচদিন যৎসামান্য কিছু করিতেন। তথায় পূজ্য সাধুগণ পত্রিকার সম্পাদন, মুদ্রণ ও প্রকাশনের যাবতীয় কাজ নিজেরা করিতেন, বেতনভুক কর্মীর দ্বারা নয়। …
৩)
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য, এইকালেই মহাসঙ্ঘে এক মহাবেদনাময় ঘটনা সমুপস্থিত হয়: কলিকাতা উদ্বোধন-বাড়ীতে দ্বারী সারদানন্দজীর পাঁচ মাসের অতন্দ্রসেবা ব্যর্থ করিয়া সাধককূল ও ভক্তমণ্ডলীকে অশ্রুজলে ভাসাইয়া পরমাপ্রকৃতি শ্রীশ্রীমা স্ব-স্বরূপে লীন হইলেন। (২১ জুলাই ১৯২০, মঙ্গলবার, রাত্রি ১॥ ঘটিকা)।
শান্তানন্দজী প্রমুখ সন্ন্যাসী-সন্তানেরা কিয়দ্দিন পূর্ব হইতে উদ্বোধন-বাড়ীতে শ্রীশ্রীমায়ের অন্তিমশয্যাপার্শ্বে উপস্থিত হইয়াছিলেন। কিন্তু বিশুদ্ধানন্দ মায়াবতী হইতে নামেন নাই; কেন কে বলিবে! কিছুদিন মৌনমুখরতার মধ্যেই কাটে।
'বার্ধক্যের বারাণসীতে' তিনি কলিকাতার একটি ভক্তকে সান্ত্বনাচ্ছলে বলিয়াছিলেন, "যতদিন মা স্থূলশরীরে ছিলেন কত ছুটোছুটি -জয়রামবাটী, কলকাতা। ...তারপর, আর দৌড়ঝাঁপ নেই, বুকের ভেতর, স্থির! একবারে এইখানে বসে আছেন।"... শেষের কথাটি বলিবার কালে দক্ষিণ কর হৃদয়ে রাখিয়াছিলেন।
শ্রীশ্রীমার লীলাসম্বরণের প্রায় আড়াই মাস পরে বিশুদ্ধানন্দ হিমালয়ের ক্রোড় হইতে কাশীধামে নামিয়া সপ্তাহকাল পরে বেলুড় মঠ আগমন করেন। অনন্তর কয়েকদিন সঙ্গত কারণে উদ্বোধন-বাড়ীতে বাস করিয়া ভুবনেশ্বর যাত্রা করেন। পূজ্যপাদ স্বামী ব্রহ্মানন্দজী মহারাজ বেশ কিছুকাল যাবৎ নূতন ভুবনেশ্বর মঠে অবস্থান করিতেছিলেন। বিশুদ্ধানন্দ তাঁহার সান্নিধ্যে কিয়দ্দিন কাটাইলেন এবং ঐ অবসরে একদিন নীলাচলচন্দ্রকেও দর্শন করিয়া আসিলেন। এইসময় কলিকাতা হইতে স্বামী সারদানন্দজী মহারাজ ভুবনেশ্বরে সমাগত হন -পূজ্য সঙ্ঘাধ্যক্ষকে কাশীধামে লইয়া যাইবার জন্য অনুরোধ জানাইতে। সকলে একত্র বেলুড় মঠ আগমন করেন। সঙ্ঘাধ্যক্ষের পূতসঙ্গে বিশুদ্ধানন্দ সপ্তাহকাল মঠবাস করিয়া তাঁহার সহিত বলরাম-মন্দিরে আগমন করেন। তথা হইতে ২০ জানুয়ারি ১৯২১ শ্রীরামকৃষ্ণ মানসপুত্র বারাণসী সমাগত হইলেন -ভ্রাতা সারদানন্দজী ও বিশুদ্ধানন্দ প্রমুখ সহায়ক-সন্ন্যাসী সমভিব্যাহারে। উল্লেখযোগ্য, সংগঠনগত বিশেষ কোন সমস্যার নিরসনকল্পেই পূজ্য সঙ্ঘাধ্যক্ষের এই কাশী-আগমন। শ্রীশ্রীমহারাজ ও স্বামী সারদানন্দজীর মঠ প্রত্যাবর্তনের কিছুদিন পরে বিশুদ্ধানন্দ কাশীধাম হইতে মায়াবতী প্রত্যাগত হইলেন।
***********************************************************


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন