ছদ্মবেশের আড়ালে
যুগল কিশোর দাস অধিকারী
হাওড়া থেকে করুণাময়ী যাওয়ার শেষ বাস রাত সাড়ে দশটায় ছাড়ে। বাসটা শিয়ালদা হয়ে ঘুরে যায়। অত রাতে প্যাসেঞ্জার খুব কম থাকে। বিশেষত হাওড়াতে মাত্র তিনজন প্যাসেঞ্জার ওঠে। দুলালদা করুণাময়ী যান। কোন প্রাইভেট অফিসে কাজ করেন। বাকি আর দু জন।
তিনি একটা জিনিস প্রতিদিন লক্ষ্য করে অবাক হয়ে যান কিন্ত কিছু বলতে সাহস করেন না। একদিন মনের ইচ্ছা চেপে রাখতে না পেরে মরিয়া হয়ে এক কো প্যাসেঞ্জার কে প্রশ্ন করে বসলেন।
প্যাসেঞ্জারটি প্রতিদিন উনার মতই লাস্ট বাস ধরেন। কিন্তু চালচলন অদ্ভুত রকমের। ছেঁড়া ময়লা জামাকাপড় , চোখে কালো সানগ্লাস, চোখে কালি লাগানো, হাতে লাঠি। অথচ বৃদ্ধ বা অন্ধ নয়। এসেই বাসের কন্ডাক্টরকে একটা থলে ছুঁড়ে দেয় । দাদা গুনে দেখুন তো কত আছে। কন্ডাক্টর টাকা গুনে খুচরো নিয়ে ওকে নোট ধরিয়ে দেয়। ও বাস থেকে নেমেই বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বেশ ভালো জামাকাপড় পরে এসেও কন্ডাক্টরর থেকে টাকা নিয়ে গুনে পকেটে ঢুকিয়ে দেয়। এটা প্রতি দিনই হয়।
দুলালদা ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলেন ভাই তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো ভাবছি। কিছু মনে করবে না তো?
ছেলেটির নাম পলাশ। তার বাড়ী বারুইপুরে।সে বুঝতে পেরেছে কি জানতে চায় ভদ্রলোক। বললো হ্যাঁ নিঃসন্দেহে জিজ্ঞেস করতে পারেন।
আমি অন্ধ নই, তবু লাঠি হাতে হাঁটি, চোখে কালো চশমা পরি কেন ইত্যাদি ইত্যাদি। এই তো?
বাহ তুমি কি করে আন্দাজ করলে?
প্রতিদিন আপনি আমাকে দেখে চেয়ে থাকেন, মনে মনে কিছু ভাবেন। কি আর ভাববেন এ ছাড়া। আমি তো কোন কেষ্ট বিষ্টু নই।
দুলালদা বললেন কিছুটা তাই। কিন্তু কেন ?
কেন এই অন্ধ সেজে ভিক্ষা বৃত্তি করি এইতো?
হুঁ তুমি তো বেশ শক্ত সামর্থ্য যুবক। কথে শুনে মনে হয় শিক্ষিত ও।
হুঁ তা বটে। পলসাইন্স এ এম এ।
বিস্মিত চোখে দুলালদা বলেন তাহলে?
তাহলে আপনাকে বড় ইতিহাস শুনতে হবে। ধৈর্য্য আছে তো?
বলো শুনি। খুব জানতে ইচ্ছে করছে।
মাস্টার্সের লাস্ট ইয়ার। বাবা প্রাইভেট কোম্পানিতে কারখানায় কাজ করতেন। লেদের মিস্ত্রি। ডান হাত এক্সিডেন্ট এ কাটা গেল। কাজ করতে পারবেন না তাই চাকরি গেল।
আমার পড়াশুনো লাটে উঠলো। কম্পেনসেশন যা দিল তা না দেবারই সমান।
নিরুপায় হয়ে বাড়িতে টিউশন পড়াতে শুরু করলাম। কিন্তু যা আয় হয় ব্যয় অনেক বেশি। প্রাইভেট কোম্পানিতে ঢুকলাম । কাজের চাপ সময় অনেক দিতে হয়।আমদানি তেমন নেই। চাকরির পরীক্ষা দিয়ে দিয়ে হাঁপিয়ে উঠলাম রাইটিং এ পাস করলে ও
ইন্টারভিউতে কাট। তিতিবিরক্ত। মা, বাবা, বোন সবাই আমার উপর নির্ভরশীল। কি করি না করি। এমন সময় আমার এক বন্ধু দিল্লীর এক ভিখারীর গল্প শোনাল, তার বাড়ী গাড়ি সবই ভিক্ষা করে অর্জন করেছে। আইডিয়া টা মাথায় খেলে গেল। কিন্তু বিবেকে বাধছিল শেষে কি না এই?
এটা ওটা করে হাঁপিয়ে উঠছি। শেষে ভাবলাম যা থাকে কপালে একবার বন্ধুটার কথা শুনেই দেখি। যাদের পেটে ভাত জোটে না, রাতে জোটে না লেপ কম্বল। তাদের কি হবে বেঁচে থেকে ইগো করে সম্বল?
একদিন ব্যাগে করে পুরানো ছেঁড়া জামাকাপড় বের করলাম। সাথে নিলাম একটা ব্যাগ তাতে ভালো জামা কাপড়। বারুইপুরে থাকি।
তাই ঠিক করলাম হাওড়া লাইনে কাজ করবো। শিয়ালদা লাইনে কাজ করলে চেনা লোক দেখে ফেললে কেলো।
নেমে পড়লাম। দশটা থেকে পাঁচটা ।দু'চারটে গান গেয়ে কাজ করি। দিন গেলে চার শ থেকে পাঁচ শ। সংসার চালিয়ে ও কিছু বাঁচে।
দুলালদা বললেন এ তো লোককে ধোঁকা দেওয়ার সমান।
মশাই ক জন সৎ ভাবে উপার্জন করে। সৎভাবেই তো বাঁচার চেষ্টা করে ছিলাম।
কেউ টিউশন এর টাকা দেয় না। খুঁটির জোর না থাকলে বা ঘুষ না দিলে চাকরি ও জুটছে না। যেখানে চাকরি করতে যাই মালিকের ধোঁকাবাজি, প্রাইভেটে গরুর মতো খাটিয়ে লেবারকে মাইনে দিতে চায় না। স্ট্রাইক করে আন্দোলন করে মালিকের বিরুদ্ধে লড়লে ছাঁটাই। ইউনিয়ন লিডার তাঁর ও ভেতরে ভেতরে মালিকের সাথে আঁতাত থাকে। এক শ দিনের কাজে লোকাল লিডেরকে কিছু কাট মানি দিতে হয়। সব জায়গায় ঘাপলা। আপনি বলছেন সৎভাবে বাঁচতে? পুকুরে লোক খোলামেলা স্নান করে। বাথরুমে দরজা এঁটে ঢোকে কেন। কেন না ওখানে উদোম ল্যাংটো হয়ে স্নান করা যায়। মাঝে মাঝে জীবনে পর্দা টানতে হয়। জীবনটা তো রঙ্গমঞ্চ যে সাধু সে মাতাল সাজছে, যে মাতাল সে সজ্জন হিরো সাজছে , কেউ আমীর সে হয়তো ভিখারী সাজছে, অতি আটপৌরে হিরোইন সাজছে,মোটামুটি যে যত ভাল অভিনয় করতে পারবে জীবন রঙ্গ মঞ্চে তার তত নাম ডাক, তত উন্নতি।
দেখতে দেখতে বাস শিয়ালদা এসে গেল পলাশ টা টা করে নেমে গেলো। বললো বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে।
দুলাল দা হতবম্ভের মতো ও র চলার পথের দিকে তাকিয়ে ছিল , চোখের থেকে পর্দা যেন সরছিল না।
*******************************************************************************************



কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন