['স্বরবর্ণে'র চতুর্থ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে কবি দীপংকর রায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে '। এই উপন্যাস লেখকের ষোল-সতের বছর বয়সের কালপর্ব থেকে শুরু। যদিও লেখকের জন্ম এপার বাংলায়, কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে থেকেছে ওপার বাংলায়। কাজেই যাতায়াত থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ ছেড়ে চলে আসা আর তারই নাছোড় এক টানাটানির মধ্যে যে জীবনের ক্রমাগত আসা আর যাওয়া ,এই উপন্যাস মূলত তারই এক নির্মম নিষ্ঠুর ভাঙা-গড়ার আশ্চর্য কথোপকথন। ধারাবাহিকভাবে যা আমরা পড়ছি, কবি দীপংকর রায়ের মায়াময় কলমে।]
কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে
পর্ব * ১২
দীপংকর রায়

সেটি সব গ্রামজীবন থেকেই নয় , বেশিরভাগটাই ছিল নগরকেন্দ্রিক । প্রকৃত অর্থে সব ওয়ামীলিগ সমর্থকদেরই তো দেশ ছাড়তে হয়নি ! তা যদি হোত তাহলে ধলা ভাই , দবির মিঁয়ারা কীভাবেই বা থেকে গেছিল সেই সময়ে ওদেশে?
যদিও সেসব কথা এখন আর কোনো কথাই যেন না । কথা হচ্ছে , এই সব মানুষজনদের কাছে , আজও তাঁরা তাঁদের দেশের সেই মান অপমানের বাইরে যেয়েও ,আজও অনেকটাই সজীব, ও এতটা টাটকা বোধের কাছে মুহূর্তে মুহূর্তে ফিরে যেতে পারে কী করে , সেটাই আমাকে ভীষণ ভাবে ভাবায়। লাল লাল চালের ফেনা ভাত , আউস বালামের স্বাদে কতটা যে পরিপূর্ণ তাঁদের হৃদয়টি আজও , সে কথা তাঁদের কাছ থেকে একটু একটু করে শুনে শুনে , আমার কাছেও কখন যেন আরো অধিক গুরুত্ব পেয়ে যেতে থাকল ওই দেশটি । যাদের একদিন আমি অতি সহজে আপনজনের মতো করে পেয়েছিলাম । তাহলে আমি কেন সেই সব ছেড়ে একটুখানি রোমাঞ্চের লোভে এমন নির্দয় নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত অতি সহজেই নিয়ে নিলাম ?
যত দিন যায় ততোই এই সব মানুষজনগুলি তাঁদের অজান্তেই আমাকে ফের মোহাবিষ্ট করে তোলেন, সেই সহজ সরল ভাবে বুঝতে – ওই দেশটির অপার মাধুর্যের প্রতি । যা অজান্তে অধিক গুরুত্ব পাইয়েই দিতে থাকলো ,আরো কতদিন ধরে যেন !
আর যতোই দিতে থাকে ততোই আমার একলার পথ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে থাকে সেই সব অতি সাধারণ জিনিসগুলি অতি মূল্যবান হয়ে । মনে মনে তাদের প্রত্যেকটা কোণাখুঁজিগুলো ফিরে ফিরে চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকি আরো গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে ।
দিনলিপি লেখা শুরু করে দিলাম আবারও ।
একদিন যে অভ্যাস ধরিয়ে দিয়েছিল রসিক দাদু , তার কাছে আবারও ফিরে যেয়ে দাঁড়ালাম । নিতান্ত তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনাগুলিও লিপিবদ্ধ করা শুরু করে দিলাম । যে অভ্যাসের কাছের থেকে অনেকদিন দূরে সরে ছিলাম , তাকেই আবার কাছে টেনে নিলাম । বারবার মনে পড়তে লাগলো রসিক দাদুর কথাটি। একদিন রাতের বারান্দায় বসে সেই দাদুকেই লেখা চিঠিটাই — আবার যেন আমাকে ফিরিয়ে দিল সেই পুরোনো অভ্যাসটাকে । তারপর থেকে কত পাতার পর পাতা যে প্রতিদিনকার এই সব চয় অপচয়ের বর্ণনায় ভরিয়ে রাখতে লাগলাম , তা বলার নয় , লিখতে লিখতে প্রতিদিন একটি কথাই ভাবি , এই সব আমি কাকে পড়ানোর জন্যে লিখে রাখছি? সে কি শুধুই নিজের জন্যে ! যদি সেটাই হবে তাহলে সে সব আর ফিরে দেখি না কেন ?
সেদিন রাতের বারান্দার এক কোণে বসে সামান্য ডুম লাইটের আলোয় রসিক দাদুকে লিখলাম অনেক কথা —-
শ্রদ্ধেয় দাদু ,
এখানে ফিরে আসার পর থেকেই ভাবি আপনার কাছে একখানি চিঠি লিখবো , কিন্তু লিখবো লিখবো করেও লেখা আর হয়ে ওঠে না ।আজ লিখি কাল লিখি করে করে এতগুলি দিন কাবার করে দিলাম কেন যে তাও জানি নে । হয়তো আপনি ভাবছেন , কতটা অকৃতজ্ঞ আমি । এত করে যে দিনগুলি আপনাদের সকলের মধ্যে কাটিয়ে এলাম তার জন্যে কি কোন কৃতজ্ঞতা বোধই নেই আমার ? এ কথা তো খুব বড়ো সত্য যা কিছু জেনেছি ,যা কিছু বুঝেছি , তার সকলটাই তো আপনার অবদান। আপনার না বলে যদি বলি আপনাদের তাহলে মনে হয় আরো ভালো করে বলা হোল । আমার এই সামান্য বয়সে আপনার অবদান আমি আজও সকল অর্থে পাথেয় বলেই মনে করি । আপনার কথাতেই তো দীক্ষিত হবো বলে শিক্ষাগুরুর খোঁজে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছি । দেখা তো এখনও মিলছে না !
এখানে আমার কিছু বন্ধু-বান্ধব তৈরি হয়েছে । বন্ধু -বান্ধবই বা ঠিক করে বলি কীভাবে —- কারণ তাদের জীবনের সঙ্গে ,চিন্তা ভাবনার সঙ্গে আমার জীবনের ধারাবাহিকতার কোনো মিলই তো নেই ! তবু তারা আমার এখনকার বন্ধুই — কারণ কেন যেন মনে হয় তারা আমার থেকে অনেক কিছুই বেশিই জানে ।সাহিত্য-শিল্পের এক একটা দরজার মুখ যেন তাদের কাছ থেকেই জানতে পারছি । অথচ তারা কেউই আমার পথের পথিক না ।তাদের জীবনের পথ অনেক মসৃন এবং ধারাবাহিকতায় পরিপূর্ণ । তবুও তারাই আমার এখনকার বন্ধু । তাদের কাছ থেকেই জানতে পেরেছি পড়তে হবে আমাকে অনেক কিছু । জানতে হবে সাহিত্য-শিল্পের মহীরুহদের অবদানের কথা । এখানে এসে এ পর্যন্ত সংগ্রহ করেছি বেশ কিছু বইপত্র । শরৎচন্দ্র পড়বার পর রবীন্দ্রনাথ পড়লে নাকি অনেকটা সহজ হবে সব কিছুই । তারপর মাইকেল মধুসূদন , বঙ্কিমচন্দ্র এবং আমাদের দর্শনের বইপত্র । ভারতীয় দর্শনটি কী জিনিস আপনি কি বলতে পারবেন কিছু ! এ বিষয়ে বেশ কিছু জিনিস খুব পরিষ্কার ভাবে বুঝতে হবে আমায় । জানতে হবে বেদ পুরান উপনিষদ । এ সব নাকি আমাকে পরিষ্কার করে জানতে এবং বুঝতে হবে আগে । এ না হলে আমি নাকি কিছুই ধরতে পারবো না ! এসব শুনে মেলে ,এই সব জানার পথের দুর্গমতার কথাটিই ভাবছি কেবলই মনে মনে । ভয় হয় পারবো কি বুঝতে ? এত পড়াশুনো করে শেষে যদি কিছুই না ধরতে পারি ! তাহলে কী হবে ?
আপনি কি এ সম্মন্ধে কিছু বলতে পারবেন আমায় বিশদে? কোন পথে এগোলে আমার ধরতে পারাটা একটুখানি সহজ হতে পারে ? আমি যে বেশ খানিকটা সামনে থেকে , পেছনে ফেরার ঝামেলায় পড়েছি বলে মনে করছি । মানুষ তো শুরু থেকে সামনে আসে ? এ ক্ষেত্রে আমি কি সামনে থেকে পেছনে ফিরে যাচ্ছি নাকি ? সেটা কি আমার পেছনের কথা কিছুই জানা নেই বলে এই ভাবে এগোতে হবে ! নাকি পেছনের সব কথা একাকার করেই ধীরে ধীরে জেনে নেওয়া যায় না বলেই — আমি বড় জটিল সমস্যায় পড়ে গেছি ?
এসব নিয়ে আলোচনা হলে এরা যদিও একটা কথাই বলে , ' ওরে , এরও পেছনের কথা তো তোকে জানতেই হবে ! না জানলে বিশুদ্ধ লেখা লিখবি কেমন ভাবে ? সে সব ভালো করে ভালোভাবে না জানলে সেই সময়কার ভালো মন্দটাই বা জানবি কীভাবে ? এই জানার পথ ধরেই তোকে এগোতে হবে । '
এ ক্ষেত্রে একটা কথা আপনাকে আগেই বলে রেখেছি দাদু, এরা সাহিত্য- শিল্পের সঙ্গে কোনো ভাবেই যুক্ত না । ধারাবাহিক পড়াশোনাই করে , কিন্তু তার মধ্যেও এরা এসব কী করে জানে তা আমি জানি নে । আমাকে ইংরাজী ভাষাটা জানতে বলে । সেটা না জানলে নাকি বিদেশি শিল্প-সাহিত্য সম্মন্ধে জানা যাবে না কিছুই । কারণ তারা নাকি এসব দিক থেকে আমাদের থেকে অনেক সমৃদ্ধ । শুনে মেলে ভীষণ ধন্দে পড়ি । চিন্তা করি ভাবি এ যে অকূল সমুদ্র। দুর্গম পাহাড় পর্বত ডিঙানোর মতো অবস্থা । এ সব পেরোবো কীভাবে আমি !
এই সব নিয়েই দিনগুলি কাটাচ্ছি । সঙ্গে আমাদের বাড়িতে কটি গোধন আছে , তাদের পরিচর্যা নিয়েই কাটিয়ে দি বাকি সময়গুলি । জানি না এটাই আমার কর্মজীবনের সঠিক পথ কিনা ।
এই গাভী গুলির দুধ দোহাই করবার জন্যে একজন বিহারী মানুষ আসে । সে এসে দুধ দোহাই করে দিয়ে যায় দুবেলা । তাকে আমি দেখি চেয়ে চেয়ে । তার সঙ্গে অবসর মত তার দেশের কথা শুনি । ঠিক আমাদের দেশটির মতোন তাদেরও দেশে নানা রকমের চাষবাস হয় । এরা দুভাই কয়েক মাস অন্তর পালা করে করে এখানের কাছে পিঠে কোথাও বাসা ভাড়া করে থাকে । এক ভাই কয়েক মাস এখানে থাকার পরে আবার অন্য ভাই আসে , সে এলে, এ দেশে যায় । কাছে পিঠে আরো যাদের গোরুবাছুর রয়েছে , তাদের ওখানেও এই একই কাজটি করে তারা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে । ঝড় জল বৃষ্টি মাথায় করে দুবেলা তাদের আসায় খামতি নেই একটুও । এঁদের দেখে ভাবি , যদি জীবনটা এই সমস্তের মধ্যে দিয়েই কাটিয়ে দিতে হয় তাহলেই বা ক্ষতি কি ! উপার্জন একেবারে খারাপ না । বেশ ছোটখাটো সোজাসাপ্টা ভাবে চলে যাবে । বাড়তি সময় যেটুকু পাবো সেটাকেই কাজে লাগাতে পারবো অন্তত ।
ওই আবার কাজের কথা নিয়ে বললাম ! এ আবার কী এমন কাজই বা !
যাইহোক এতক্ষণ তো নিজের কথাই বললাম । এখন আপনার কথাটা শুনি একটু , শরীর ভালো আছে তো ? ছাত্ররা কি এখনো আপনাকে পড়ানোর জন্যে ধরাধরি করে ? আপনি কি এখনো হেঁটে হেঁটে শত্রুজিৎপুর হাটের দিন যান হাটে কেনাকাটা কিছু করতে, জানতে ইচ্ছা করে ।
দিদিকে বলবেন আমার কথা । তাঁকে আমার প্রণাম জানাবেন । মামীদের কথা ভীষণ মনে হয় মাঝে মাঝে । মনে পড়ে কল্যানীর কথা । বেবির কথা । লিটুর মনে হয় এবার হাইস্কুলে যাবার পালা ! মন্টু মামা নারান মামাকে আমার প্রণাম জানাবেন । আপনি আমার ভূমিষ্ঠ প্রণাম গ্রহন করবেন । ইতি—--
রসিক দাদুকে লেখার পরে মনে হোল এই সঙ্গে কি সঞ্চয়কে লিখবো ? মনে হচ্ছে ওনাকে তো সব কথা লেখা গেল না , যে কথাগুলি ওনাকে লিখতে পারলাম না সেই কথাগুলি জানবার বড় ইচ্ছা যে করে , তা গোপন করে লাভ কি ? যদিও ওর তো সামনে পরীক্ষা , পড়াশোনায় তো ও আমার মতো গবেট না । ও তো একটা সময়ের পরের থেকে ফাস্ট সেকেন্ড হয়। পড়াশোনায় ও যথেষ্ট যত্নশীল । ওর বন্ধুবান্ধবরাও যথেষ্ট ভালো পড়াশোনায়। স্কুলে ওদের ভেতর কত একতা । ঠিক আমাদের সময়ের মতো না । আমাদের সময়টা কেমন যেন সব ছাড়া ছাড়া। তার ভেতর আমি তো পেছনের সারির ছাত্র । তাই হয়তো আমার সঙ্গে সেরকমের সম্পর্ক ছিল না সকলের সঙ্গে ।
সে যা হয় হোক গে , আজ ওকেও একখানা চিঠি লিখি । লিখলাম —- প্রিয় সঞ্চয় , তোদের ছেড়ে সেই যে একদিন এক সকালবেলায় চলে এলাম , তারপর আর তো কারোর সঙ্গেই কোনো যোগাযোগ হয়নি আমার ! এ কদিনে তোদেরও কারোরই মনে পড়লো না ! না পড়ুক । আমার ভীষণ মনে পড়ে । জানতে ইচ্ছা করে । পড়া শোনা করা ছাড়া বাকি সময়গুলো আগে যেমন বিদ্যুৎ মামার সঙ্গে সঙ্গ দিতিস হাটে ঘাটে ,সেটা কি এখনো দিতে পারিস ? নাকি সব সময় পড়াশোনা নিয়েই থাকিস?
এবার যে বর্ষা গেল ,আগে যেমন বর্ষা শেষ হলে মাঠেঘাটের জল যখন একটু শুকিয়ে যায় তখন গলির ভেতর , আমরা যেমন দল বেঁধে পোলো নিয়ে চলে যেতাম এসব ছাড়াও আরো দূরে দূরে মাছ ধরতে ,তারপরে জলকাদা মেখে সেই যে আমাদের একেবারে ভূত হয়ে বাড়ি ফেরা ,শোল, ল্যাঠা, মাগুর, টাকি , পুঁটি, জিয়া মাছ ধরতাম কত যে,খালুই বোঝাই হয়ে যেত —সেই সব পোলো টানা দিন গুলি ; এবার গেছিলি তোরা নারানপুরের দিকগুলোয় ? বাবুদের ইটখোলায় , সুবোল ভূঁইয়ের আড়ার ভেতরে ? আমাদের বড় ভূঁইয়ের নালার ভেতর গেছিলি কি ! নালীর জমির কাছে ? কিম্বা ঈদ গাঁ ছাড়িয়ে কাওড়ার দিকটার মাঠের ভেতরে গেছিলি কি ? যেখানে মাঝিরা ভেসাল পাততো ? সে সব জায়গা গুলোয় এবারে কি গেছিলি একবারও?
পুরো আমকালটা তো চলে গ্যালো —- ভোরবেলা গুলিতে পরে মামার সঙ্গে আমরা যেরকম ঘুরে বেড়াতাম অন্ধকার থাকতে থাকতে ,এ মাঠ ও মাঠ ডিঙিয়ে, এ বাগান ও বাগান ঘুরে,গামছায় করে সেই যে কটা আম কুড়িয়ে নিয়ে ফিরে আসতাম সকাল হলে , সেই আনন্দ তো এখানে নেই !
ভীষণ মনে পড়ছে সেই সব দিনগুলোর কথা ।
জানি , তুই হয়তো এখন পরিমলের সঙ্গে গেলেও যেতে পারিস; কিন্তু আমার যে ভীষণ মনে পড়ে সব কথা । আচ্ছা , তোদের নতুন মটর পাম্প লাগানোয় ঠাকুর নালার মাঠ গুলোতে এখন ধান হচ্ছে কেমন ? সেই যে ,গরমের সময় গতবছর দমকলের আওয়াজের ভেতর নালি দিয়ে যে মাঠের ভেতর জল যেত বয়ে , আমরা সেই ক্যানালের পাশে যেয়ে চুপটি করে বসে থাকতাম , সেই যে জলধারার যে আওয়াজ হোত নালিগুলির মধ্যে , তখন যে সদ্য থোড় আসা ধানগাছগুলি কালো হয়ে লকলক করে উঠত দূরের দূরের মাঠের ভেতর ; যেন ঠিক কালো নয় , গভীর সবুজ সে সব রং , আমরা যে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকতাম , আমাদের বুকের ভেতর কত আশা স্বপ্ন যে বুনে তুলতো কেউ যেন , সেই সব ধানগাছগুলি , আমাদের সেই সব উজ্জ্বলতম চোখগুলির স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষাকে ঘিরে কিসের যে এক গভীর প্রত্যাশা তৈরি হোত মনের ভেতর , তা কি তুই ছাড়া আর কারো সঙ্গে আমি ভাগ করে নিতে পারতাম ?
সেই সব কথা এখানে আর কাকে বলিই বা ? কেই বা বুঝতে পারবে আমাদের সেই সব সামান্য সামান্য আনন্দময় মুহূর্তগুলির কথা !
আচ্ছা এবারও কি পাটের জাগ উঠে গেলে নদীর জল লালচে ধরে গেছিল ? পাট পচানির সঙ্গে সঙ্গে মাছেদের সেই যে ভেসে বেড়ানো ,আমরা যে নৌকো নিয়ে হ্যাজাক জ্বালিয়ে সমস্ত নদীর ভেতর যে মেলা বসে যেত দূর থেকে দেখলে ,আলোয় আলোয় ভরে যেত একেবারে , কত মাছ তোলা হোত জল থেকে! কত চি়ংড়ি বেলে মাছেদের ভেসে ওঠা , কত রুই-কাতলা -বোয়াল- চিতল- আইড় মাছ যে ভেসে উঠত নদীতে — আমরা তিন-চার দিন ধরে রাত হলেই নদীর ভেতর ভেসে বেড়াতাম , সেই অবস্থা কি এবারও হয়েছিল ?
ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে জানিস ! কি করলি এবারে তোরা , সেই সব উৎসবমুখর দিনগুলিতে ?
শেষের দিকে কিছুদিন সত্তিজাতপুর হাট শেষ হয়ে গেলেও আমাদের আড্ডাটা ভাঙতে ভাঙতে দেরি হয়ে যেত একেবারে । সুধীর দাদুর দোকানের সেই আড্ডার কথা বলছি।ওদিকে খেয়া ঘাটে যদি নৌকা না পাই , তাই পড়ি কি মরি করে পয়ারীর পথ ভাঙতাম , নানা বুনো গন্ধের ভেতর ।গাছগাছালির ভেতরের ফাঁক ফোকর থেকে যে জোছনার আলো এসে পড়ত পথের চার ধারে —- আমরা যেন তখন ত্রাহি ত্রাহি ছুটতাম দুজনে খেয়া ঘাটের দিকে ! তারপর হয়তো পৌঁছে দেখলাম ঘাটে খেয়া নেই , খেয়া ওপারে । ডাকতে ডাকতে হয়তো এলো ঝন্টু দা —- কিন্তু সেই যে তখনকার নদীর চড়ের উপরের সেই সব দৃশ্য , তার আগে আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনুভব করতাম — তার কিছুই তো এখানে আমার কাছে নেই ! অথচ তোদের কাছে আছে এখনো সব ! আমি চলে আসার পরে সেগুলো কি তুই কারো সঙ্গে এখন সেই ভাবে উপভোগ করতে পারিস আগের মতো ! কারণ তোর বন্ধুবান্ধবরা তো বেশির ভাগ সত্তিজাতপুর ,পয়ারী ,গোয়ালবাতানের দিকেই থাকে বেশি বলেই আমি জানি । তাই ভীষণ মনে হচ্ছে , এগুলো কি এখন করবার অবকাশ পাস আগের মতো ?
ঘুমের মধ্যে আজকাল ভীষণ স্বপ্ন দেখছি জানিস — ! দেখতে পাই গরমকালের ঢেউ ভাঙা জ্যোস্না রাতের মাতাল হাওয়ার ভেতরের নবগঙ্গার সেই রূপ , আমি যেন কোথায় ভেসে চলেছি —- কত দূরে যে তীরের মতোন ; তারপর কোথায় যেয়ে যে সেই রাতের জল -জ্যোস্নায় মিলে গেলাম কিসের সঙ্গে ,আর যেন নিজেকে খুঁজে পাচ্ছি নে , দেখতে পাচ্ছি না একেবারেই —- আর সেই খুঁজে না পাওয়া অবস্থাটার ভেতরেই ঘুমটা ভেঙে যেত। তখন যে আমার কী অবস্থা ঘেমে নেয়ে একেবারে একসার হয়ে ঘুম ভেঙে যায় জানিস ! কিছুক্ষণ একেবারে কথা বলতে পারতাম না । বিছানার উপরে চুপচাপ বসে থাকতাম ' থ ' মেরে একভাবে অনেকক্ষণ ।
ভীষণ মনে পড়ে ….. ভীষণ মনে পড়ে …. জানিস , সেই সব দিনগুলোর কথা ।
এখানে ইদানীং কিছু বন্ধুবান্ধব হয়েছে , তাদের কাছ থেকে কত কিছু জানতে পারছি ! সে কথাগুলি এর আগে যদি আমি এদেশে টানা থাকতে পারতাম তাহলে হয়তো সে সব এদের কাছ থেকে আমাকে জানতে হোত না ।সে সব আমার এমনি এমনিই হয়তো জানা হয়ে যেত অনেক আগে থেকেই। যাইহোক এখন যা জানতে পারছি তাতে আমার নিজস্ব একটা মনের খোঁজ পেতে এখনো অনেক পথ পেরোতে হবে যে সেটা বুঝতে পারছি । সে অনেক পথ ! কিন্তু তার মাঝের এই দুর্গমতা ভাঙতে পারবো কিনা সেটাই জানিনে । তবে দুঃসহ বলে মনে হয় না তাকে ।
এই মুহূর্তে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস পড়ছি।শ্রীকান্ত নামের চরিত্রটি আমার সমগ্র সত্তা ঘিরে রেখেছে। সেই যে পাঠ্য বইয়ে ইন্দ্রনাথ নামের চরিত্রটির কথা আমরা পড়েছিলাম , এখানে তো জ্যান্ত ইন্দ্রনাথ কে উপলব্ধি করতে পেরে কতবার আমি আমার নবগঙ্গার কত রাত্তিরের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেছিলাম , ইন্দ্রনাথের শ্রীকান্ত কে নিয়ে নদীপথ অতিক্রম করার সেই সময়গুলির মধ্যে — তারপর যত এগোচ্ছি ততোই ভাবছি জীবনের চলার পথে শ্রীকান্ত যে সব বিষয়ের মধ্যে দিয়ে চলেছে , সে তো আমারও কথা , এসব কিছুই তো আমার অপরিচিত না ! কিন্তু তারপরও সবটা কি বুঝে উঠবার মতো ? রাজলক্ষী ! অন্নদা দিদি ! অভয়ারা যে সব কথা বলছে , তাদের জীবনের এক একটি অধ্যায়ের কথা ; যে যে ভাবে শরৎচন্দ্র দেখাচ্ছেন , তা ছায়াছবিতে দেখার এবং পড়ার পর , মাঝে মাঝেই আমি যেন কোথায় কোথায় শ্রীকান্তের সঙ্গে সঙ্গে পথ হেঁটে বেড়াই । কত পথ সে সব যেন , যার আমি বিন্দুবিসর্গও জানতাম না আগে । আমার তো মনে হয় এমন একখানি লেখা আমাদের বাঙলা সাহিত্যে কত কাল আগে লেখা হয়ে গেছে ! এরপর আমরা আমাদের জীবনটাকে কতটুকু দিয়ে আর দেখতে পেতে পারি ? সত্যিই কি সব কথা লেখা ও বলা যায় এরকম ভাবে ! তোকে যদি পড়াতে পারতাম তাহলে ভীষণ ভালো লাগত আমার ।
আমার এখানকার বন্ধুবান্ধবেরা অবশ্য বলেছে , আমাকে শিল্পসাহিত্য করতে হোলে নাকি আরো অনেক কিছু পড়তে হবে ,দর্শন , উপনিষদ , পুরান , বেদ এবং আরো কত কি!
এখনো তো রবীন্দ্রনাথ ,বঙ্কিমচন্দ্র ,মাইকেল মধুসূদন দত্ত , এঁদের কারো লেখা পড়িই নি , এরও পরে থাকলো বিদেশী সাহিত্য, দর্শন , এমন কি কুরান শরীফও একখানি কিনতে দিয়েছি জানিস ! এগুলো একে একে সব সংগ্রহ করার জন্যে চেষ্টা করছি ।
ভাবছি , শুধুই ভাবছি , জানিস, ভাবছি কী করবো ? তাহলে কি এ সব লেখাটেখা ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে এখানে এখন যে গোধন দুটিকে পেয়েছি তাদের পাল আরো বাড়িয়ে নিয়ে ঐ সব নিয়েই এই জীবনটা সাদামাঠা ভাবে কাটিয়ে দেওয়া যায় কিনা সেটাই ভাবতে চেষ্টা করবো নাকি বেশি করে — ?
রসিক দাদু বলেছিল আমার নাকি শিক্ষে হবার প্রয়োজন — দীক্ষাটাও দরকার , সেটা না হলে আমি নাকি কিছুই বুঝতে পারবো না । তাই তো বড়ো জায়গায় ফিরে এলাম ।
শেষে জানাই ,আমি কিন্তু এখানে এসে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ধার আর মাড়াই নি । ওসব বাঁধা গন্ডীর মধ্যে আর মানিয়ে উঠতে পারবো না যে সেটা ভালো করেই অনুভব করছি। তাই ওসব ছাড়লাম । ওসব আমার জন্যে না ।কিন্তু তাই বলে তুই কিন্তু থামিস না। তোর ভেতরে অনেক কিছু মানিয়ে নেবার ক্ষমতা আছে । তুই এগিয়ে যা। আমি নাহয় এই দুর্গমতাই গ্রহণ করলাম । যদিও জানি এ পথে কোনো সামাজিক স্বীকৃতি নেই । অনেক ঠোক্কোর খেতে হবে । কিন্তু কি করবো ! নিরুপায় । হয়তো এই ভাবেই আমার যাত্রাপথের লিখন তৈরি করে রেখেছেন বিধাতা ! ভয় হয় না যে তা না । ভীষণ ভয় হয় ।কারণ এখানে যাদের সঙ্গে এই মুহূর্তে চলাচল করছি তারা সকলেই প্রথাগত পথেরই পথিক । আমার মত কেউ না । একেবারেই মিল নেই । এরা কেউ শিল্পসাহিত্যের ধারও মাড়ায় না ! তবে এদের ভেতরে একটি ছেলে আছে সে হোল শংকর , সেও কিন্তু এসব নিয়ে খুব একটা যে পড়ে থাকে তাও না । তবে ওর কথাগুলি আমি খুব একটা এড়িয়ে চলতে পারি না । ও লেখালেখি না করেও এত সব জানে কী করে !তাই ভাবি । ওর সব কথা একেবারে ভুল বলেও মনে হয় না তো !
যদিও আর একটু ভালো হোত যদি সেই সব মানুষগুলোর কাছ থেকে কিছু জানতে পারতাম যারা ঠিকঠাক আমার পথের মানুষ । যদিও ইতিমধ্যে জানতে পেরেছি দুই একজনের কথা , কিন্তু তাঁরাও শুনেছি খুব পন্ডিত মানুষ । স্কুল কলেজের মাস্টারমশাই । এবং এঁরাই নাকি প্রকৃত পক্ষে এখন লেখালিখি করে । তাই ভাবছি আমার এইটুকু বিদ্যেবুদ্ধি নিয়ে তাঁদের কাছে দাঁড়াই কি করে !
তাই এত খোঁজখবর করেও তাঁদের ধারে কাছেও যাই না । মনে হয় নিজেকে আরো খানিকটা তৈরি করে নেওয়া দরকার । তারপরে না হয় দেখা যাবে এঁরা কি ভাবছে ।
এই মুহূর্তে একজন ইংরেজির মাস্টার মশাইয়ের খোঁজ খবর করছি । দেখি সেরকম কাউকে পাওয়া যায় কি না ।
যাই হোক আজ থাক । দিদিভাইকে লিখবার চেষ্টা করছি এই সঙ্গে , যদিও না পারলে তুই তাঁকে বুঝিয়ে বলিস সব কিছু । তুই বললে সে বুঝবে । কারণ তোর উপরে তার বরাবরই ভরসা । এই মুহূর্তে তুইই তার সব চাইতে বড় অবলম্বন বললে কম বলা হবে ,তোকে নিয়ে তাঁর অনেকখানি গর্ব ।আমি তো তাঁকে নিরাশই করলাম সব দিক দিয়ে । কি আর দিতে পারলাম ! আমি তো তাঁর কোনো আশাই পূরণ করতে পারি নি ।
ভালো থাকিস । শুভেচ্ছা রইল ।
দুখানি চিঠি একটি খামে পুরে পোষ্ট অফিসের ডাকে ফেলে এলাম । মনে মনে এমনই একটা তাড়া অনুভব করলাম এমন ভাবে যেন, আজই চিঠি দুখানি যদি পৌঁছে যেতে পারে তো খুব ভালো হয় । পোষ্টমাস্টার বললো , যা টিকিট খামে লাগানো আছে তারপরে দশ পয়শার টিকিট আরো লাগালে তবেই পৌঁছোবে ।
ওদেশ ছেড়ে আসার পরে এই আমার প্রথম কারো কাছে চিঠি লেখা । এর মধ্যে আর কারো কাছেই লেখা হয়নি । আর এখন তর সইছে না যেন উত্তরের জন্যে !
ওদের দুখানা চিঠির সঙ্গে দিদিমাকে কিছু লিখতে পারলে ভালো হোত , কেন লিখলাম না ? মনে হোল মা তো ওদেশে গেছিলোই — সে তো সবকিছুই বলেছে হয়ত তাকে । তাই এই সঙ্গে আর লিখবার কীই বা আছে ?
মা যদি তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারত তাহলে তো চিঠির প্রাসঙ্গিকতাই থাকত না !
নানা কিছু ভেবে চিঠিটি শত্রুজিৎপুরের ঠিকানাতেই পোষ্ট করলাম । কারণ শত্রুজিৎপুর তো সঞ্চয় একরকম প্রতিদিনই যায় ।
তাই প্রযত্নেতে লিখলাম সঞ্চয় কুমার কয়ালদার ।
বিষয়টা এরকম কেন ?
কারণ শত্রুজিৎপুর ওই গ্রামের পোষ্টাফিস নয় । ওই গ্রামের ডাক আসে বিনোদপুরের পোষ্টাফিসের ডাকে । বিনোদপুর সচরাচর কারোরই বিশেষ একটা যাওয়া আসা পরে না । একমাত্র গড়হাটের দিন এ অঞ্চলের চিঠি বেশ কিছু একসঙ্গে জমলে, ডাকপিয়ন এসে হাটের দিন চিঠি গুলি দিয়ে যায় পাড়ার মানুষজনের হাতে দেখে দেখে । তা
না হোলে থাকলো পড়ে অনন্তকাল ধরে ডাক পিয়নের ঝোলায় পড়ে ।
সেই সব বিলম্বের কথা চিন্তা করেই শত্রুজিৎপুরের ঠিকানায় ছাড়া হোল এই চিঠিটি ।
কালীপুজো পেরিয়ে গেল ।
এখানে কতকাল পরে এই সময়ে থাকলাম ! দোদমা আর কালীপটকায় চকলেট বোমের আওয়াজে ছয়লাপ চারদিক । কানে সহ্য করা দায় ।
ফোচন ছুঁচো বাজি তৈরি করলো দেখলাম তার আগে ওদের ছাদে । সঙ্গে কয়েকটি বসনতুবড়ি ।সে সব কত যে আয়োজন তার ! নানারকমের সাবধানতা । সন্দক ,লোহাকুচি , আরো কত কি যে প্রয়োজন হয় , মনে রাখা দুষ্কর । বসন তুবড়ি আর উড়ন তুবড়ির মশলা আবার আলাদা নাকি !
খবরের কাগজ পেতে সে সব রোদ্দুরে শুকিয়ে কতরকমের কায়দায় দেখলাম সে সব বানিয়ে তুললো !
তাই কালীপুজো মানে এখানে বাজির মহড়া !
প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে দশাসই কালীমূর্তি । ওদেশের সঙ্গে এদেশের পুজোর কোন মিলই খুঁজে পাওয়ার উপায় নেই কোথাও ।
ওখানে থাকতে আমাদের একখানি পুজোই হোত ও অঞ্চলে। তাতে পাল কাকা যদি বাড়ির উপরে এসে বানিয়ে দিতেন তাহলে সেই কদিনের আগে আগে আমাদের পাটকাঠির বেড়ার মণ্ডবে একটা মিনমিনে সোরগোল থাকত । আর যদি তাঁর দীঘল কান্দির বাড়িতে প্রতিমা তৈরি হোত , তাহলে প্রতিমা আনার দিনের সেই যে পুরোনো সোরগোলটুকু যেমন হোত , তা তেমনই। তাছাড়া আর বাড়তি তো তেমন কিছুই না ! এরপর পুজোর দিন একটু ঢাক কাঁশোর সানাই বাজত , এই তো । বাজি কোথায় ! মধ্যরাত্তিরে পুজো । ছেলেমেয়েরা তো অর্ধেক ঘুমেই চলে যেত । হয়তো সন্ধেবেলাটুকু পাড়ার অল্প বয়সি ছেলেপেলেরা যা একটু কাঠিপটকা ঠকাস্ করে সানে বাড়ি মেরে হয়তো দুএকটা ফাটালো , আর কি ! বাজির বাহার কোথা থেকে আসবে সদ্য স্বাধীন হওয়ার পরে কতটুকুই বা বাইরের ঝাঁঝ পৌঁছনোর সময় পেল সে ! এর মধ্যেই তো একটা ছোটখাটো দুর্ভিক্ষের মুখও দেখতে হয়েছে চেয়ে চেয়ে তাকে ।
পুজোর দিনগুলিতে সমস্ত দিন দিদিমার বাড়তি একটা ব্যাস্ততা । একবার এ বাড়ি তো একবার ও বাড়ি । এ প্রয়োজন তো ও প্রয়োজন । তাঁর যেন উৎকন্ঠা আর যায় না কিছুতেই ! অথচ পাড়ার মামিমারা, দিদিমারা , সেই আয়োজনে সকলেই সামিল হোত একজোট হয়ে তাতেও তাঁর উৎকন্ঠার শেষ নেই । " এটা হোল কি রে, আলো ক দেহি আমারে । আরে বুনডি কহনে আর হবেনে তা কিডা জানে ! এই তো ইবারে তো সন্ধে লাগতি না লাগতি অমবস্যা —- দাদাঠাকুর ও তো আলেন বলে !
তহনে দেহেনে , তার ডা কী গোণ্ডগোল বাধবেনে !....... . "
কাঁচাগোল্লা সন্দেশের ভোগ হোত বলীর পরিবর্তে । বৈষ্ণবীয় মতে পুজো হোত দিদিমার । রান্না ঘরের বারান্দাতেই তৈরি হোত নাড়ু ,ক্ষীরের ছাপা ,সিঙ্গে সন্দেশ — সবই ।
গ্যানেনদির দার স্ত্রী এবং নির্মলা দি ,ও বড় দিদিমা ছোট দিদিমা , অর্থাৎ দাদুদের স্ত্রীরা সকলেই একটা না একটা পর্বে এসে নাড়ু নারকোল ছাপা সন্দেশ বানানোতে বসে যেত । তবুও দিদিমার উৎকন্ঠার শেষ থাকত না , যতক্ষণ না পুজো শেষ হয়ে সকলে প্রসাদ নিয়ে চলে যেত ।
এঁদের সকলের এই যে নিষ্ঠা–একাগ্রতা–আচার–অনুষ্ঠান — সব কিছু মেনে সমস্ত দিন এক একজন এক এক রকমের কাজের দায়িত্ব নিয়ে তা সামলে বেড়াত , সে সব কি কম কথা ! সে যেমন চিড়ের ধান নিয়ে যেয়ে ঢেঁকিতে কুটে আনা ,আবার খই ভাজা —- তার পরে আবার সেই খই দিয়ে নাড়ু , মুড়ির নাড়ুও ছিল সেই সঙ্গে , এই সব কিছু তৈরি করে পুজোতে একসাথে একই দিনে দেওয়া , সে কি কম ঝক্কির ?
সবই এই পাড়ার মানুষজনেরা সামলাতো এক সঙ্গে হোয়ে। দিদিমার তো সেরকম কিছুই করতে হোত না ! তাও তাঁর ব্যাস্ততার শেষ নেই । দাঁতে তামাকের গুঁড়ো দিয়ে দাঁত ডলতে ডলতে এক এক জনকে এক এক রকমের নির্দেশ । সকলকেই ব্যাস্ত করে তুলতো — " এটা হোল না ওটা হোল না — ইবার তো সন্ধে লাগতি লাগতি পুজো , পারবেনেন তো দাদা ঠাকুর , সব কিছু এর মধ্যিই তো ; তাই কচ্ছি পারলি হয় ; ওলো , ও নিম্মলা — দ্যাখ ওদিকটা কত দূর আইগোলো ….! "
এই সব শুনে নির্মলা দি বলতো , " এই হোইসে তোমার বড্ড দোষ —- আরে বাবা দেখনা ক্যান , পেত্তেক বছর কি পড়ে থায়ে কাজ কিছু ! সবই তো হয় , নাকি হয় না , সেইডা কও দেহি নি ? "
তারপরে একটু থেমেই বলতো ," এই তো সন্দেশ , ক্ষিরছাপাগুলোন হোলিই হোয়ে গ্যালো , ওগুলোই ইবার সুন্দরী আর সুষমারে দিয়ে পাঠায়ে দিছি —-- সবডা না পারলি মারে কোইছি একটু আগোয়ে দিবেনে —- তালিই তো হোয়ে গ্যালো সব । জলটলগুলোন নদীর থেকে আনা সাইরে ফেললিই হোলো ফাঁকে, তালিই তো হোল ! বাকি সগলে মিলে করলি কি আর পড়ে থাকবে কাজ কিছু …! "
**********************************************************************************************
আগামী সংখ্যায়
**********************************************************************************************