মঙ্গলবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৩

লেখা আহ্বান




******************************

স্বরবর্ণ * সতেরো

তৃতীয় বর্ষ * ষষ্ঠ সংখ্যা

*******************************


প্রকাশিত হবে আগামী  ১৫ ফেব্রুয়ারি  ২০২৪ 

এই সংখ্যার জন্য  লেখা জমা নেওয়া হবে  ১৫ জানুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত । 

লেখা পাঠানো যাবে নীচের দুটি নম্বরে। তবে মেলে পাঠালে w/a জানিয়ে দেবেন ।

বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে উপরের লিঙ্কে।


* হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর   8777891532

*ই-মেইল --- debasishsaha610@gmail.com 


সম্পাদকমণ্ডলী                                                   

ড : শুভঙ্কর দে           অলোক কোৱা

সৌম্যজিৎ দত্ত             দেবাশিস সাহা

সোমবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৩

লেখা আহ্বান





স্বরবর্ণ

সৃজনের মৌলিক স্বর


########################################

স্বরবর্ণ * ১৭ / ফেব্রুয়ারি সংখ্যা-র জন্য লেখা জমা নেওয়া হবে ১৫ জানুয়ারি ২০২ পর্যন্ত। পত্রিকা প্রকাশিত হবে 

১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২  

########################################


লেখা পাঠানোর আগে নীচের বিষয়গুলি নিশ্চিত হয়ে নিন 

---------------------------------------------------------------------------


১.  স্বরবর্ণ দ্বিমাসিক ওয়েব ম্যাগাজিন । 

২. লেখা মনোনয়নের ব্যাপারে সম্পাদকমন্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

৩. প্রাপ্তি সংবাদ জানানো সম্ভব নয়। নিৰ্বাচিত লেখকসূচি আমরা একমাসের মধ্যে ফেসবুকে প্রকাশ করি । 

৪.পরবর্তী  সংখ্যার জন্য আপনার মৌলিক ও অপ্রকাশিত লেখা ( গল্প কবিতা প্রবন্ধ  অণুগল্প  অনুবাদ কবিতা  ভ্রমণ কাহিনি  ইত্যাদি  ) ১৫ জানুয়ারি ২০২৪  - এর মধ্যে পাঠান । 

৫. শব্দসীমা অনির্দিষ্ট। 

৬. কবিতার ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুটি কবিতা পাঠাবেন।  

৭. লেখার সঙ্গে আপনার একটি ছবি এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, প্রকাশিত গ্রন্থ (থাকলে)  ছবিসহ পাঠান । 

৮. "স্বরবর্ণ " সামগ্রিক চিন্তার ফসল। আগে থেকে লেখা পাঠান। লেখা পাঠাবেন ওয়ার্ড ফাইলে, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ই-মেইল বডিতে টাইপ করে। পিডিএফ বা লেখার ছবি তুলে পাঠাবেন না।


* হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর   8777891532

*ই-মেইল --- debasishsaha610@gmail.com 


সম্পাদকমণ্ডলী                                             

ড : শুভঙ্কর দে           অলোক কোৱা

সৌম্যজিৎ দত্ত             দেবাশিস সাহা

বুধবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৩

পত্রিকা সম্পর্কে

 




স্বরবর্ণ

সৃজনের মৌলিক স্বর

স্বরবর্ণ * ১৬ / শীত সংখ্যা *১৪৩০

########################################

সংখ্যাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত আমাদের অকপটে জানান। প্রাপ্ত মতামতগুলি আমরা ক্রমান্বয়ে প্রকাশ করব ২৫ ডিসেম্বরের পর থেকে । স্বরবর্ণ * ১৭ ফেব্রুয়ারি  সংখ্যা-র জন্য লেখা জমা নেওয়া হবে ১৫ জানুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত।

########################################


লেখা পাঠানোর আগে নীচের বিষয়গুলি নিশ্চিত হয়ে নিন -----

১.  স্বরবর্ণ দ্বিমাসিক ওয়েব ম্যাগাজিন । 

২. লেখা মনোনয়নের ব্যাপারে সম্পাদকমন্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

৩. প্রাপ্তি সংবাদ জানানো সম্ভব নয়। নিৰ্বাচিত লেখকসূচি আমরা একমাসের মধ্যে ফেসবুকে প্রকাশ করি । 

৪.পরবর্তী  সংখ্যার জন্য আপনার মৌলিক ও অপ্রকাশিত লেখা ( গল্প কবিতা প্রবন্ধ  অণুগল্প  অনুবাদ কবিতা  ভ্রমণ কাহিনি  ইত্যাদি  ) ১৫ জানুয়ারি  ২০২৪ এর মধ্যে পাঠান । 

৫. শব্দসীমা অনির্দিষ্ট। 

৬. কবিতার ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুটি কবিতা পাঠাবেন।  

৭. লেখার সঙ্গে আপনার একটি ছবি এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, প্রকাশিত গ্রন্থ (থাকলে)  ছবিসহ পাঠান । 

৮. "স্বরবর্ণ " সামগ্রিক চিন্তার ফসল। আগে থেকে লেখা পাঠান। লেখা পাঠাবেন ওয়ার্ড ফাইলে, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ই-মেইল বডিতে টাইপ করে। পিডিএফ বা লেখার ছবি তুলে পাঠাবেন না।


* হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর   8777891532

*ই-মেইল --- debasishsaha610@gmail.com 


সম্পাদকমণ্ডলী                                             

ড : শুভঙ্কর দে           অলোক কোৱা

সৌম্যজিৎ দত্ত             দেবাশিস সাহা

প্রিয় কবি প্রিয় কবিতা









মাথা কেটে পাঠাচ্ছি, যত্ন করে রেখো

মলয় রায় চৌধুরী









মাথা কেটে পাঠাচ্ছি, যত্ন করে রেখো

মুখ দেখে ভালোবেসে বলেছিলে, “চলুন পালাই”

ভিতু বলে সাহস যোগাতে পারিনি সেই দিন, তাই

নিজের মাথা কেটে পাঠালুম, আজকে ভ্যালেনটাইনের দিন

ভালো করে গিফ্টপ্যাক করা আছে, “ভালোবাসি” লেখা কার্ডসহ

সব পাবে যা-যা চেয়েছিলে, ঘাম-লালা-অশ্রুজল, ফাটাফুটো ঠোঁট

তুমি ঝড় তুলেছিলে, বিদ্যুৎ খেলিয়েছিলে, জাহাজ ভাসিয়েছিলে

তার সব চিহ্ণ পাবে কাটা মাথাটায়, চুলে শ্যাম্পু করে পাঠিয়েছি

উলঙ্গ দেখার আতঙ্কে ভুগতে হবে না

গৌড়ীয় লবণাক্ত লিঙ্গ কোনো স্কোপ আর নেই

চোখ খোলা আছে, তোমাকে দেখার জন্য সব সময়, আইড্রপ দিও

গিফ্টপ্যাক আলতো করে খুলো, মুখ হাঁ-করাই আছে

আমার পছন্দের ননভেজ, সন্ধ্যায় সিঙ্গল মল্ট খাওয়াতে ভুলো না

মাথাকে কোলেতে রেখে কথা বোলো, গিটার বাজিয়ে গান গেও

ছ’মাস অন্তর ফেশিয়াল করিয়ে দিও, চন্দনের পাউডার মাখিও

ভোর বেলা উঠে আর ঘুমোতে যাবার আগে চুমু খেও ঠোঁটে

রাত হলে দু’চোখের পাতা বন্ধ করে দিও, জানো তো আলোতে ঘুমোতে পারি না

কানে কানে বোলো আজও উন্মাদের মতো ভালোবাসো

মাথা কেটে পাঠালুম, প্রাপ্তি জানিও, মোবাইল নং কার্ডে লেখা আছে




**************************************************************************************

উপন্যাস * বিশ্বনাথ পাল




[ 'স্বরবর্ণ * ১২ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে বিশ্বনাথ পালের ধারাবাহিক উপন্যাস 'বামনের চন্দ্রাভিযান'। উপেক্ষা, অনাদর আর দারিদ্র্যের তীব্র দংশনজ্বালা দাঁতে দাঁত চেপে, একটি যুবক কী ভাবে একক নিঃসঙ্গ লড়াইয়ে জীবনের সাফল্য ছিনিয়ে আনে, এই উপন্যাস তারই জীবন্ত আখ্যান। লক্ষ লক্ষ  বেকার যুবকের বেকারত্বের জ্বালার বাণীরূপই শুধু নয়, তা থেকে উত্তরণের অমোঘ বিশল্যকরণীও বটে এই উপন্যাস।]


বামনের চন্দ্রাভিযান 

পর্ব * 

বিশ্বনাথ পাল

সাত  

পুরুষ মানুষের হাতে যদি বলার মতো কাজ না থাকে, তাহলে তার একটা আইডেনটিটি ক্রাইসিস তৈরি হয়। আমার এই আত্মসংকট ছিলই। বন্ধুবান্ধবদের অনেকেই প্রতিষ্ঠিত। রাস্তাঘাটে কোনও পরিচিত মানুষজনের সঙ্গে দেখা হয়ে কথাবার্তা শুরু হলে এক অবধারিত প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। কী করি। বলতাম, “টিউশনি করছি।” এরপর একটা বাউন্সার ধেয়ে আসত। এম. এস-সি. পাশ করেও বেকার? কী বলব এর উত্তরে ভেবে পেতাম না। গতানুগতিক শিক্ষাগত যোগ্যতার যে কাজের বাজারে খুব একটা মূল্য নেই তা কে বোঝাবে! এদিকে টিউশনি করেও তো বহু মানুষ সংসার প্রতিপালন করে, কিন্তু সে সময় সমাজ তাকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনতে চাইত না। যদিও টিউশনিকে পাকাপাকি পেশা করার রাস্তায় আমি ছিলাম না। 

মৌমিতার সঙ্গে আলগা যোগাযোগ ছিল। মাঝেমধ্যে ফোন করতাম কোনও দোকানের থেকে। কখনও অনেকদিন পরে ফোন করলে পর ও নিজে থেকেই বলত, “অনেকদিন আসিস না, একদিন আসিস।”

এম. এস-সি.-তে ও খুব ভাল রেজাল্ট করেছিল। সাতান্ন শতাংশ নম্বর পেয়েছিল। পাশ করার সঙ্গে সঙ্গেই একটা বাংলা স্যাটেলাইট চ্যানেলে চাকরি পেয়ে যায়। আমি তখন চাকরি পাওয়া লোকজনদের থেকে শত হস্ত দূরে থাকি। এই দূরত্ব নিজের সম্মান বা আত্মরক্ষার একটা উপায়। কিন্তু মৌমিতা যখন বলত, ‘একদিন আসিস’— কী যেন থাকত সেই গলায়। এড়াতে পারতাম না। সাইকেল চালিয়ে ওদের নেতাজীনগরের বাড়িতে যেতাম। কিন্তু গিয়ে দেখতাম— কোথায় কী! মৌমিতা তো সেভাবে গল্প করছে না। আমি একাই বকবক করছি। ফলে খুব অভিমান হত।

এরই মধ্যে একদিন মৌমিতাকে ফোন করলাম। দুয়েকটা কথার পর ও বলল, “অ্যাই শোন, আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।”

বললাম, “প্রেম করে?”

“না, আলাপ করে।”

আমি কিছুক্ষণ চুপ থাকায় ও আবার বলল, “তুই আসবি তো?”

বললাম, “না।”

যতই বন্ধুর ভূমিকা পালন করি, বিয়ে দেখার কষ্ট নিতে পারতাম না।

মৌমিতা আমার কাছে ওর যে ভাবমূর্তি তৈরি করেছিল তা হল প্রেম-বিয়ে করে ঘর-সংসার করা ওর কম্ম নয়। ওর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য সিনেমা তৈরি করা। চিত্রপরিচালক হওয়ার স্বম্ন দেখত ও। মৌমিতার কথাবার্তায় মাঝেমধ্যে মনে হত কী সব দুঃখ যেন ওর ভিতরে ঘুমন্ত লাভার মতো শায়িত আছে। আবার মাঝেমধ্যে মনে হয়েছে, মেয়েটা হয়তো ভীষণ কামশীতল। সেই কারণেই প্রেমের ধার মারায় না। আবার মনে হয়েছে আমি গরিব বলেই প্রেমিকের যোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ। প্রেমও হয়তো পাটিগণিত মেনেই চলে। যাইহোক সেই মৌমিতা বিয়ে করছে। নেমতন্নটা মিস হল। তবে এবার থেকে একটি মেয়েকে নিয়ে অন্তত আর ভাবতে হবে না। নেক্সট?


বোড়াল গ্রামে সেনদিঘি বলে আমার একটা প্রিয় জায়গা ছিল। বল্লাল সেনের আমলে নাকি ওই দিঘিটা খনন করা হয়েছিল। দিঘিটাকে বাঁদিকে রেখে কিছুটা এগিয়ে গেলে ত্রিপুরসুন্দরীর মন্দির। মন্দির সংলগ্ন চত্বরে একটা বটগাছ। গাছটার গোড়ায় বাঁধানো বেদী। অজস্র ঝুরি নেমে  স্থানটাকে খানিক রহস্যময় করেছে। ঝুরিতে ঝুলছে লাল সুতোয় অজস্র মানতের ঢিল। কী জানি আমিও কি ওই গাছে কোনও লাল সুতো বেঁধেছিলাম চাকরি পাওয়ার মনস্কামনায়? মনে পড়ে না। কে বা কারা যে ছোটবেলায় আমাকে ওই জায়গাটা চিনিয়েছিল আজ আর মনে নেই। তবে শীতকালে কিছুদিন শরীরচর্চার টানে বেশ পাড়ার বড়দের সঙ্গে দৌড়তাম ভোরে উঠে। দৌড়ে কিংবা হেঁটে একদিন চলে গিয়েছিলাম ত্রিপুরসুন্দরীর মন্দির। ওই দিকটা তখনও গ্রাম-গ্রাম। কোনও খেতের থেকে কেউ একজন গাজর তুলে দিয়েছিল খেতে। আবছা মনে পড়ে। আরও কিছুদূর গেলে বকুলতলার মাঠ। সেখানে চৈত্রসংক্রান্তিতে গাজনের মেলা বসে। মাঠের পাশে পুকুরের ধারে একটা বিরাট বকুল গাছ। এখন আর সেই গাছটা নেই, কেটে দিয়েছে। জায়গাটার নাম তবে সেই বকুল গাছের নামে থেকে গেছে। মাঠের এক প্রান্তে টেরাকোটার আটচালা জোড়া  শিব মন্দির। মন্দিরের গায়ে লেখা ১৬৭৮ শকাব্দ। অর্থাৎ প্রায় আড়াইশো বছরের পুরনো ভগ্নপ্রায় মন্দিরটিও আমার বিস্ময় সৃষ্টিকারী অন্যতম দ্রষ্টব্য ছিল। মন্দিরের গায়ে আগাছা, বট-অশত্থের শিকড়, পিছনে জঙ্গল। মন্দিরের ইট নোনাধরা। কিন্তু ওই মন্দিরের সামনে দাঁড়ালে  আমার কেমন গা ছমছম রহস্যময় ভাল লাগার অনুভূতি হত। পরে সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ সিনেমা খুব মন দিয়ে দেখে ওই জোরা মন্দিরের অস্তিত্ব আমি এক ঝলকের জন্য আবিষ্কার করেছিলাম। বকুলতলার মাঠের উল্টোদিকে একটা পায়ে চলা পথে কিছুটা গেলেই সত্যজিৎ রায়ের আবক্ষ মূর্তি। ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত। পথের পাঁচালী নামের একটি সংগঠন  প্রতিষ্ঠা করে। পাশেই হরিহরের বাড়ি। মানে পথের পাঁচালী-র শ্যুটিঙে যে বাড়িকে হরিহরের বাড়ি দেখানো হয়েছিল। এইসব স্থানে সাইকেল নিয়ে যেতাম। একা একাই বেশি। আমার কেমন যেন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হত। কোথাও তো সেভাবে বেড়াতে যেতে পারিনি টাকার অভাবে। স্কুল থেকে শিক্ষামূলক ভ্রমণে নিয়ে যেত। আমাকে কখনও জিজ্ঞেসও করা হত না যাব কিনা। নির্ধারিত চাঁদা যে দিতে পারব না তা মুখ দেখেই বোঝা যেত। খাওয়া-পরার যাদের সমস্যা তাদের তো বেড়াতে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। 

সেনদিঘির পাড়ে কতদিন যে একা বসে থাকতাম। কত রকমের ভাবনা মনে ঢেউ তুলত। তখন আমার মনোজগতের নায়ক বিবেকানন্দ। মাধ্যমিক পাশের পর স্কুলের এক সহপাঠী  ইন্দ্রজিৎ আমাকে উদ্বোধন কার্যালয় প্রকাশিত বিবেকানন্দের একটি বই দিয়েছিল পড়তে। ‘আমার ভারত অমর ভারত’ নাম বইটার। বিবেকানন্দের রচনার নির্বাচিত অংশ। সেখানে অনেক জ্বালাময়ী বাণী আমার অন্তরে গভীর রেখাপাত করেছিল। পরে বইটা কিনেছিলাম। 

মন্দির বলতে যেমন আমাদের মনে ভক্তসমাগম, জনকোলাহল ভেসে ওঠে, ত্রিপুরসুন্দরীর মন্দির সেরকম নয়। বরং উল্টোটা। খুব নির্জন, নিস্তব্ধতার জন্য আমাকে টানত ওই চত্বর। নবরত্ন মন্দিরটি প্রায় পনেরো-ষোলো মিটার উচ্চতায়। মন্দিরে অষ্টধাতুর নির্মিত ত্রিপুরসুন্দরীর মূর্তি। মূল মূর্তিটি নাকি দারুবিগ্রহ ছিল। নাটমন্দিরটিও বেশ বড়। মন্দির সংলগ্ন একটি ঘরে ছিল সংগ্রহশালা। সেখানে বিভিন্নসময় বোড়াল গ্রামে খননের ফলে প্রাপ্ত পোড়ামাটির ইট, বাসনপত্র যত্ন করে সংরক্ষিত। মূল মন্দিরের পূর্ব দিকে আরও একটি ছোট মন্দির। সেখানে কালো কষ্টিপাথরে বিষ্ণুর অনন্তশয্যা। পিছনে ছাতার মতো ফনা ধরে বাসুকী। নীচে বেদীতে লেখা খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে নির্মিত। ফলে কোথাও বেড়াতে না যাওয়া আমার মনে বিস্ময়ের আনন্দ বইত। কল্পনা পাখা মেলত কোন অচীন প্রদেশে। বছরের কোনও এক নির্দিষ্ট দিনে মাঘী পূর্ণিমা না কোন তিথিতে যেন মন্দিরে উৎসব হত, ভোগ বিতরণ হত। তখন আর পাঁচটা মন্দিরের সঙ্গে এর পার্থক্য থাকত না। কিন্তু আমি তো সেসময় যেতাম না। 

সুধাংশু মুখোপাধ্যায়ের বই পড়ে পরে জেনেছি বোড়াল গ্রামের পাশ দিয়ে এক সময় প্রবাহিত হত প্রাচীন ভাগীরথীর স্রোত। গ্রামের উত্তর ও পশ্চিম দিক নদীর প্লাবনে ডুবে থাকত, মাঝেমধ্যে বাঁধ দিয়ে জল আটকানো হত, কিন্তু বাঁধ ছাপিয়ে জল গ্রামের নীচু জমি ডুবিয়ে দিত। ডুবে যাওয়াকে বলে ‘বুড়ে’ যাওয়া আর গ্রামের সীমানার বাঁধকে আলও বলা হত, সেই থেকে বুড়ে যাওয়া আল বা বোড়াল নামের উৎপত্তি। বোড়াল গ্রামের ঐতিহাসিক প্রাচীনত্ব প্রতিষ্ঠিত। জগদীশ ঘোষ নামে এক ব্যক্তির উদ্যোগে এখানে জঙ্গল কেটে বসতি শুরু হয়।  তিনিই জঙ্গলাকীর্ণ ইটের স্তূপ খনন করে ধ্বংসপ্রায় মন্দিরটির সন্ধান পান এবং সংস্কার করেন। মূল মন্দিরটি সম্ভবত ত্রয়োদশ শতকে সেন বংশের কোনও রাজা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

সেনদিঘির পাড়ে বসে আমার অনেক অলস দুপুর, মন খারাপের শান্ত বিকেল কেটেছে। কখনও মনে হয়েছে একটা চাকরি কি জীবনে পাব না? এত মানুষ এত কিছু সাফল্যের কাজ করছে জীবনে, কেউ অক্সিজেন ছাড়া এভারেস্ট জয় করে ফিরছে, কেউ সাত সমুদ্র সাঁতরে পার হচ্ছে, কেউ নতুন রেকর্ড করে অলিম্পিকে স্বর্ণপদক পাচ্ছে, আর আমি একটা চাকরি পাওরার সফলতা অর্জন করব না জীবনে? কখনও ভাবতাম সরকারি চাকরির চেষ্টাই করে যাব। যদি  পাই তো ভাল। না পেলে টিউশনিই করব। একা থাকব, বিয়ে করে সংসারি হব না। হঠাৎ খেয়াল হল মৌমিতার বিয়ের খবর শোনার শকে কিনা জানি না, সেনদিঘির পাড়ে বসে দিঘির জলে গোলা একরাশ সিঁদুরের অলস সূর্যাস্ত দেখছি। কাছেই একটি অশত্থ গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বাঁকাবিহারীর মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে আমার সাইকেল।


আট

সুদীপের দিদি পারমিতাদির সঙ্গে আমারও বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। সুদীপের বাড়ি তো আমার যাতায়াত ছিলই। যখন ওদের বাড়ি যেতাম পারমিতাদিও আমার সঙ্গে গল্প করত। কখনও কোনও বই হয়তো পড়তে দিত। আবার আমাদের লিটল ম্যাগাজিন বেরলে পর দিদিকে বিক্রি করতাম। 

আমাদের বাড়িতে তখন পাঁচশো টাকা জমা দিয়ে কিছুদিন হয়েছে ল্যান্ডলাইন টেলিফোন এসেছে। মোবাইল ফোন তখনও খুব দুর্লভ একটা ব্যাপার বা বাজারে আসেনি। বাড়িতে  ফোন  থাকলে টিউশনি পেতে সুবিধা হয়। কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় বাড়িতে ফোন ছিল না বলে কত যে সুন্দরী সহপাঠিনীর বন্ধুত্ব হাতছাড়া হয়ে গেল তার ইয়ত্তা নেই। দু-এক জন বান্ধবীর সঙ্গে একটু সখ্যতার সূচনা হলে পর যখন ফোন নম্বর চাইত, মুখ কালো করে জানাতাম, “আমাদের বাড়িতে টেলিফোন নেই।” ওই একটি উত্তরে পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থান যেন বেআব্রু হয়ে পড়ত। অবশ্য কাউকে কাউকে পাশের বাড়িতে সদ্য গজিয়ে ওঠা এসটিডি বুথের নম্বর দিতাম। (তখন পাড়ায় পাড়ায় এসটিডি বুথের রমরমা।) কিন্তু কেউ ফোন করত না। বাড়িতে ফোন না থাকলে অন্য কোথাও ফোন করে অমুককে ডেকে দিতে বলার মধ্যে যে বিরক্তির সম্মুখীন হওয়ার ঝুঁকি, তা অনেকেই নিতে চায় না। তবে এভাবে কেউ ফোন করেনি বললে ভুল হবে। একবার ব্যতিক্রম ঘটেছিল। স্বর্ণালি ফোন করেছিল। 

যাইহোক, আমার টিউশনির টাকাতেই ফোনের বিল মেটাতে পারব এই ভরসায় দু-এক দিন টেলিফোন এক্সচেঞ্জে ছোটাছুটির পর বাড়ি ফোন এল। তো, একদিন আমদের বাড়ির কালো রঙের টেলিফোনটা একদিন বেজে উঠল। আমি ধরলাম। ওপাশ থেকে বলল, “সোমনাথ  বলছ?” 

বলালাম, “হ্যাঁ বলছি।”

“আমার নাম দীপাঞ্জন রায়। সুদীপদের কোয়ার্টারেই আমরা থাকি। আমাকে হয়তো আগে দেখোনি, কারণ আমি বাইরে চাকরি করি। পারমিতা বলল যে তুমি ডবলুবিসিএসের প্রিপারেশন নিচ্ছ, আমিও বিসিএস দেব, একসঙ্গে পড়তে চাই।” 

এরপর দীপাঞ্জন রায় আমার দীপুদা হয়ে গেল। মানুষের সঙ্গে মিশতে গেলে আঘাত পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকেই, যেমন হয়েছিল বাপিদার সঙ্গে মিশে। কিন্তু তার জন্য মেশা বন্ধ করে দিলে আঘাত পাওয়া হয়তো আটকানো যায়, কিন্তু অমূল্য ভালবাসাও হাতছাড়া হয়ে যায়। তো, দীপুদার সঙ্গে আমার নতুন সম্পর্কের সেতু রচিত হল পড়াশোনার সূত্র ধরে।  দীপুদা এয়ার ফোর্সে চাকরি করে। অল্প বয়সে বাবা মারা গেছেন। হায়ার সেকেন্ডারির পরই এয়ার ফোর্সে যোগ দিয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কাজের জন্য থাকতে হয়। ছুটিছাটায় বাড়িতে আসা হয়। পড়াশোনায় উৎসাহী দীপুদা ডিসট্যান্স এডুকেশনে ইতিহাসে বি. এ. ও এম. এ. পাশ করেছে। একজন মানুষের কীরকম উৎসাহ থাকলে বাড়ির বাইরে থেকে চাকরি করে আবার গ্রাজুয়েশন ও মাস্টার ডিগ্রি অর্জন করা যায়, তার জ্বলন্ত উদাহরণ দীপুদা। 

দীপুদার পোষ্টিং তখন পুণেতে। দু’তিন মাস অন্তর ছুটি নিয়ে কলকাতায় আসত। এলে পর আমার সঙ্গেও দেখা হত। বাপিদার মতো দীপুদাও আমাদের বাড়ি এলে সঙ্কুচিত মনে হত না। দীপুদা এসে আমার বইয়ের তাক ঘেঁটে বলত, “এই বইটা তোর আছে…এটা আমি ক’দিনের জন্য নিয়ে যাচ্ছি।” হয়তো বইটা কিনে আমি ফেলে রেখেছি, পড়ার প্রয়োজন মনে করিনি বা  পরে পড়ার সময়টা অনির্দিষ্ট কালের জন্য পিছিয়ে দিয়েছি, কিন্তু দীপুদা যেই আমার সংগ্রহের বই বাড়ি নিয়ে যেতে চাইছে আমার তখন টনক নড়ল। তার মানে বইটা খুবই ভাল বই, ওটা  অবিলম্বে পড়া উচিত। এতটাই আস্থা ছিল দীপুদার প্রতি। উদ্দেশ্যের প্রতি সৎ, ভাল মানুষ দীপুদার সঙ্গে  আমি খুব বেশি গ্রুপ স্টাডি করতে পারিনি। কিন্তু আমার সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি পর্বে  উৎসাহ কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল দীপুদা। অনেক সময় কথাপ্রসঙ্গে কোনও বড়লোক বন্ধুর কথা উঠলে দীপুদা বলত, “আরে ভাই আমরা গরিব লোক। ওসব ছাড়! বড়লোকদের কথা আলাদা।” দীপুদা যেন আমার জীবনের ‘ক্ষিদ্দা’। যে অনবরত কানের কাছে বলে চলেছে, “ফাইট, সমু ফাইট।”  

দীপুদাকে গরিবের পর্যায়ে ফেলা যায় না। কারণ দীপুদার বাবা ভাল চাকরি করতেন। দীপুদাও সেসময় প্রায় বারো বছর চাকরি করে ফেলেছে এয়ার ফোর্সে। চোদ্দ বছর চাকরির পর এয়ার ফোর্স থেকে স্বেচ্ছাবসর নেওয়া যায়। দীপুদার ইচ্ছা এর মধ্যে ডবলুবিসিএস ক্লিয়ার করে সর্বভারতীয় চাকরি ছেড়ে রাজ্যের চাকরিতে যোগ দেওয়া। তাতে কিছুটা হলেও বাড়ির কাছে থাকা হবে। কপাল ভাল থাকলে কোনও এক পোষ্টিং-এ বাড়ি থেকেও যাতায়াতের সুবিধা মিলবে। বাড়িতে বয়স্ক মা রয়েছেন। এক দাদা কলকাতায় থাকলেও বাড়িতে মায়ের সঙ্গে থাকে না, অন্যত্র থাকে পরিবার নিয়ে। ফলে দীপুদা মাঝেমধ্যে পুণে থেকে ফোনে আমাকে যদি বলত মায়ের কাছে অমুক ওষুধটা কিনে পৌঁছে দিয়ে আয়, আমি তা পালন করতাম। দীপুদা পরে টাকা দিয়ে দিত। এভাবেই অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে। 

 

কৌশিকও সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বাপিদার সঙ্গে তো আমার সেভাবে একসঙ্গে পড়াশোনার সুযোগ হয়নি বাপিদার ব্যস্ততার কারণে। সেই অভাব পূরণ করল যেন কৌশিক। ওদের কালীতলার বাড়িতে আমি সাইকেল চালিয়ে সপ্তাহে দু-তিন দিন যেতাম দুপুর বেলা করে। পড়ার পাশাপাশি আড্ডাও চলত। কিন্তু পড়ায় উৎসাহ বাড়ত। কোনও একটি বিষয় আমার অজানা, কিন্তু কৌশিক জানে এটা জানার পর সেদিনই রাতে আমিও ওই বিষয়টা পড়তাম। উল্টোটা হত কিনা কৌশিক বলতে পারবে। কখনও আবার আমার কোনও বিষয় বুঝতে সমস্যা হলে কৌশিক খুব সহজ করে বুঝিয়ে দিত। কৌশিক একদিন আমাকে বলল, “সিভিল সার্ভিস ক্রনিকল ম্যাগাজিনটা পড়। না হলে চাকরি পাবি না।”

সিভিল সার্ভিস ক্রনিকল বা সিএসআর ইংরেজিতে একটি সর্বভারতীয় ম্যাগাজিন মূলত আইএএস মানের। সাম্প্রতিক ঘটনাবলী ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র থাকে এতে। দৈনিক খবরের কাগজের পাশাপাশি আমি রাজ্য সিভিল সার্ভিস মানের একটি বাংলা ম্যাগাজিন রাখতাম। কৌশিকের কথা পালন করতে দ্বিধা করিনি। সব পড়তে পারতাম না। কিন্তু যেটুকু পড়তাম তাতেও জানার পরিধি বাড়ত। কৌশিকও টিউশনি পড়াত। উচ্চমাধ্যমিক ও গ্রাজুয়েশনের কিছু ছাত্রছাত্রীদের ও ইকনমিক্স পড়াত।

এম. এস-সি. পার্ট ওয়ান পড়ার সময় কৌশিকদের বাড়িতে একদিন জয়েন্ট স্টাডি করে  বাড়ি ফিরব এমন সময় আবিষ্কার করলাম আমার লাল সাদা রেসিং কার সাইকেলটি হাওয়া। কোনও চোরের  হাতযশ। ওদের বাড়ির বাঁদিকের গলি পেরিয়ে সিঁড়ির ঘর দিয়ে ঢুকতে হত কৌশিকের দোতলার ঘরে। গলির একপাশে আমার সাইকেল দেয়ালে হেলান দিয়ে চাবি দেওয়া ছিল। দুপুর দুপুর এসেছিলাম। চারটে নাগাদ আকাশ অন্ধকার করে এক পশলা বৃষ্টিও হয়ে গিয়েছে। সাইকেলটিকে হয়তো গলিতে পড়ে পড়ে ভিজতে দেখে কোনও চোরের মনে তুমুল মায়া জন্মেছিল। তাই সমাদর করতে দেরি করেনি। কৌশিকের পরামর্শে ওকে নিয়ে গেলাম রিজেন্ট  পার্ক থানায়। বাঁশদ্রোণী থানার তখনও জন্ম হয়নি। একটা জেনারেল ডায়রি করা হল।  সাইকেলটি ফিরে পাওয়ার আশা ছিল না, কিন্তু চুরির প্রতিক্রিয়ায় কিছু একটা করা হল এই সান্ত্বনা।

সাইকেল তখন আমার জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ। ইউনিভার্সিটি যেতে না হলেও আমি তো তখনও বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র পড়াই। সাইকেল ছাড়া যাব কীভাবে! কারও বাড়ি হয়তো বাঘাযতীনে, আবার কারও বাড়ি পাটুলীতে। সাইকেল ছাড়া হেঁটে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। আর বাসে অটোতে করে যাওয়াটাও অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ। অথচ আরেকটা নতুন সাইকেল কেনাও এক কথায় অসম্ভব। টিউশনি পড়ানো বন্ধ করব শুধুমাত্র পরীক্ষার মাসটিতে। তাও আবার ওই এক মাস আমার হয়ে প্রক্সি দেবে প্রিয়ব্রত বলে এক বন্ধু। সেই মাসের মাইনেও ও-ই নেবে। নাহলে আমার টিউশনিগুলো হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। তো, এই অসুবিধায় আমার মুশকিল আসান হল সুমীত শীল। সেই সুমিত যার সঙ্গে একই সঙ্গে গ্রাজুয়েশন করেছি। ওর বাড়িতে আমার যাতায়াত ছিল। ও মাস্টার ডিগ্রি করতে যাদবপুরে ভর্তি হয়েছিল। আমার মনে পড়ে গেল, সুমিতের একটা সাইকেল আছে। রেসিং কার নয়, কালচে সবুজ রঙের একটু উঁচু সাইকেল। ওকে অনেক দিন সাইকেল চালাতে দেখি না। বোধহয় ঘরে পড়ে আছে। তবে গ্রাজুয়েশনের সময় ও আমার সঙ্গেই সাইকেল চালিয়ে কলেজ ও বিজি স্যারের কোচিঙে যেত। ওকে বললাম, “তোর সাইকেলটা তো পড়েই আছে। বিক্রি করবি?”

শুনেই প্রস্তাব নাকচ করে দিল। অদ্ভুত এক আভিজাত্যবোধ সুমিতের, টকার জন্য ঘরের  কোনও জিনিস বিক্রি করা ওর ধাতে নেই। বললাম, “তাহলে ধার দে। তোর সাইকেলটা আমাকে দু’মাসের জন্য ধার দে।”  

আমার প্রস্তাবে সুমিত রাজি হয়ে গেল। সুমিতের সাইকেল নিয়ে আমি টিউশনি পড়াতে যেতাম। আবার কাজ মিটে গেলে সাইকেলটা আমার বাড়িতেই রাখতাম। পুরনো সাইকেল কিনতে  চাইলেই চট করে বিক্রেতার  সন্ধান পাওয়া যায় না। সেদিন সুমিতের সাইকেল না পেলে আমার যে জীবনের চাকা কীভাবে গড়াত জানি না। সুমিত এখন আর বেঁচে নেই। দু’বছর আগে কিডনির অসুখে আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে। বছর খানেক ডায়ালিসিস চলেছিল। আমার কৃতজ্ঞতাস্বীকার ওর কাছে পৌঁছবে কিনা কে জানে!  

তো, যাইহোক কৌশিকের বাড়ি থেকে আমার সাইকেল খোয়া গিয়েছে বলে ওর বাড়ি গিয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দেব এমন ভাবনা মনে আসেনি। ফলে চাকরির পরীক্ষার জন্যও কৌশিকের বাড়িতে আমার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। আমরা যেন ছিলাম গুপ্ত সমিতির সদস্য। আর সব মানুষ আমাদের পরিকল্পনা অগ্রগতি কিছুই টের পেত না। হয়তো ভাবত, ছেলেগুলো সরকারি চাকরির চেষ্টা করছে, পাওয়ার ইচ্ছে আছে, কিন্তু পাবে না। সরকারি চাকরি পাওয়া কি মুখের কথা! 


******************************************************

আগামী পর্বে

*******************************************************

উপন্যাস * দীপংকর রায়

 



['স্বরবর্ণে'র চতুর্থ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে কবি দীপংকর রায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে '। এই উপন্যাস লেখকের ষোল-সতের বছর বয়সের কালপর্ব থেকে শুরু। যদিও লেখকের জন্ম এপার বাংলায়, কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে থেকেছে ওপার বাংলায়। কাজেই যাতায়াত থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ ছেড়ে চলে আসা আর তারই নাছোড় এক টানাটানির মধ্যে যে জীবনের ক্রমাগত আসা আর যাওয়া ,এই উপন্যাস মূলত তারই এক নির্মম নিষ্ঠুর ভাঙা-গড়ার আশ্চর্য কথোপকথন। ধারাবাহিকভাবে যা আমরা পড়ছি, কবি দীপংকর রায়ের মায়াময় কলমে।]



কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে 

পর্ব * ১২   

দীপংকর রায়


সেটি  সব গ্রামজীবন থেকেই নয় , বেশিরভাগটাই ছিল নগরকেন্দ্রিক । প্রকৃত অর্থে সব ওয়ামীলিগ সমর্থকদেরই তো দেশ ছাড়তে হয়নি ! তা যদি হোত তাহলে ধলা ভাই , দবির মিঁয়ারা কীভাবেই বা থেকে গেছিল সেই সময়ে ওদেশে? 

 

            যদিও সেসব কথা এখন আর কোনো কথাই যেন  না । কথা হচ্ছে , এই সব মানুষজনদের কাছে , আজও তাঁরা তাঁদের দেশের সেই মান অপমানের বাইরে যেয়েও ,আজও অনেকটাই সজীব, ও এতটা টাটকা বোধের কাছে মুহূর্তে মুহূর্তে ফিরে যেতে পারে কী করে , সেটাই আমাকে ভীষণ ভাবে ভাবায়। লাল লাল চালের ফেনা ভাত , আউস বালামের স্বাদে কতটা যে পরিপূর্ণ তাঁদের হৃদয়টি আজও , সে কথা তাঁদের কাছ থেকে একটু একটু করে শুনে শুনে , আমার কাছেও কখন যেন আরো অধিক গুরুত্ব পেয়ে যেতে থাকল  ওই দেশটি । যাদের একদিন আমি অতি সহজে আপনজনের মতো করে পেয়েছিলাম । তাহলে আমি কেন সেই সব ছেড়ে একটুখানি রোমাঞ্চের লোভে এমন নির্দয় নিষ্ঠুর  সিদ্ধান্ত অতি সহজেই নিয়ে নিলাম ? 

         যত দিন যায় ততোই এই সব মানুষজনগুলি তাঁদের অজান্তেই আমাকে ফের মোহাবিষ্ট করে তোলেন, সেই সহজ সরল ভাবে বুঝতে – ওই দেশটির অপার মাধুর্যের প্রতি । যা অজান্তে অধিক গুরুত্ব পাইয়েই দিতে থাকলো ,আরো কতদিন ধরে যেন ! 

         আর যতোই দিতে থাকে ততোই আমার একলার পথ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে থাকে সেই সব অতি সাধারণ জিনিসগুলি অতি মূল্যবান হয়ে । মনে মনে তাদের প্রত্যেকটা কোণাখুঁজিগুলো ফিরে ফিরে চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকি আরো গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে ।

         দিনলিপি লেখা শুরু করে দিলাম আবারও । 

     একদিন যে অভ্যাস ধরিয়ে দিয়েছিল রসিক দাদু , তার কাছে আবারও ফিরে যেয়ে দাঁড়ালাম । নিতান্ত তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনাগুলিও লিপিবদ্ধ করা শুরু করে দিলাম । যে অভ্যাসের কাছের থেকে অনেকদিন দূরে সরে ছিলাম , তাকেই আবার কাছে টেনে নিলাম । বারবার মনে পড়তে লাগলো রসিক দাদুর কথাটি। একদিন রাতের বারান্দায় বসে সেই দাদুকেই লেখা চিঠিটাই — আবার যেন আমাকে ফিরিয়ে দিল সেই পুরোনো অভ্যাসটাকে । তারপর থেকে কত পাতার পর পাতা যে প্রতিদিনকার এই সব চয় অপচয়ের বর্ণনায় ভরিয়ে রাখতে লাগলাম  , তা বলার নয় , লিখতে লিখতে প্রতিদিন একটি কথাই ভাবি , এই সব আমি কাকে পড়ানোর জন্যে লিখে রাখছি? সে কি শুধুই নিজের জন্যে ! যদি সেটাই হবে তাহলে সে সব আর ফিরে দেখি না কেন ?

    

         সেদিন রাতের বারান্দার এক কোণে বসে সামান্য ডুম লাইটের আলোয় রসিক দাদুকে লিখলাম অনেক কথা —- 

শ্রদ্ধেয় দাদু , 

এখানে ফিরে আসার পর থেকেই ভাবি আপনার কাছে একখানি চিঠি লিখবো , কিন্তু লিখবো লিখবো করেও লেখা আর হয়ে ওঠে না ।আজ লিখি কাল লিখি করে করে এতগুলি দিন কাবার করে দিলাম কেন যে তাও জানি নে । হয়তো আপনি ভাবছেন , কতটা অকৃতজ্ঞ আমি । এত করে যে দিনগুলি আপনাদের সকলের মধ্যে কাটিয়ে এলাম তার জন্যে কি কোন কৃতজ্ঞতা বোধই নেই আমার ? এ কথা তো খুব বড়ো সত্য যা কিছু জেনেছি ,যা কিছু বুঝেছি , তার সকলটাই তো আপনার অবদান। আপনার না বলে যদি বলি আপনাদের তাহলে মনে হয় আরো ভালো করে বলা হোল ।‌ আমার এই সামান্য বয়সে আপনার অবদান আমি আজও সকল অর্থে পাথেয় বলেই মনে করি । আপনার কথাতেই তো দীক্ষিত হবো বলে শিক্ষাগুরুর খোঁজে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছি । দেখা তো এখনও মিলছে না !

         এখানে আমার কিছু বন্ধু-বান্ধব তৈরি হয়েছে ।  বন্ধু -বান্ধবই বা ঠিক করে বলি কীভাবে —-  কারণ তাদের জীবনের সঙ্গে ,চিন্তা ভাবনার সঙ্গে আমার জীবনের ধারাবাহিকতার কোনো মিলই তো নেই ! তবু তারা আমার এখনকার বন্ধুই — কারণ কেন যেন মনে হয় তারা আমার থেকে অনেক কিছুই বেশিই জানে ।সাহিত্য-শিল্পের এক একটা দরজার মুখ যেন তাদের কাছ থেকেই জানতে পারছি । অথচ তারা কেউই আমার পথের পথিক না ।তাদের জীবনের পথ অনেক মসৃন এবং ধারাবাহিকতায় পরিপূর্ণ । তবুও তারাই আমার এখনকার বন্ধু । তাদের কাছ থেকেই জানতে পেরেছি  পড়তে হবে আমাকে অনেক কিছু । জানতে হবে সাহিত্য-শিল্পের মহীরুহদের অবদানের কথা । এখানে এসে এ পর্যন্ত সংগ্রহ করেছি বেশ কিছু বইপত্র । শরৎচন্দ্র পড়বার পর রবীন্দ্রনাথ পড়লে নাকি অনেকটা সহজ হবে সব কিছুই । তারপর মাইকেল মধুসূদন , বঙ্কিমচন্দ্র এবং আমাদের দর্শনের বইপত্র । ভারতীয় দর্শনটি কী জিনিস আপনি কি বলতে পারবেন কিছু ! এ বিষয়ে বেশ কিছু জিনিস খুব পরিষ্কার ভাবে বুঝতে হবে আমায় । জানতে হবে বেদ পুরান উপনিষদ । এ সব  নাকি আমাকে পরিষ্কার করে জানতে এবং বুঝতে হবে আগে । এ না হলে আমি নাকি কিছুই ধরতে পারবো না ! এসব শুনে মেলে ,এই সব জানার পথের দুর্গমতার কথাটিই ভাবছি কেবলই মনে মনে । ভয় হয় পারবো কি বুঝতে ? এত পড়াশুনো করে শেষে যদি কিছুই না ধরতে পারি ! তাহলে কী হবে ? 

        আপনি কি এ সম্মন্ধে কিছু বলতে পারবেন আমায় বিশদে? কোন পথে এগোলে আমার ধরতে পারাটা একটুখানি সহজ হতে পারে ? আমি যে বেশ খানিকটা সামনে থেকে ,  পেছনে ফেরার ঝামেলায় পড়েছি বলে মনে করছি । মানুষ তো শুরু থেকে সামনে আসে ? এ ক্ষেত্রে আমি কি সামনে থেকে পেছনে ফিরে যাচ্ছি নাকি ? সেটা কি আমার পেছনের কথা কিছুই জানা নেই বলে এই ভাবে এগোতে হবে ! নাকি পেছনের সব কথা একাকার করেই ধীরে ধীরে জেনে নেওয়া যায় না বলেই — আমি বড় জটিল সমস্যায় পড়ে গেছি ?

        এসব নিয়ে আলোচনা হলে এরা যদিও একটা কথাই বলে , ' ওরে , এরও পেছনের কথা তো তোকে জানতেই হবে ! না জানলে বিশুদ্ধ লেখা লিখবি কেমন ভাবে ? সে সব ভালো করে ভালোভাবে না জানলে সেই সময়কার ভালো মন্দটাই বা জানবি কীভাবে ? এই জানার পথ ধরেই তোকে এগোতে হবে । '

        এ ক্ষেত্রে একটা কথা আপনাকে আগেই বলে রেখেছি দাদু, এরা সাহিত্য- শিল্পের সঙ্গে কোনো ভাবেই যুক্ত না । ধারাবাহিক পড়াশোনাই করে , কিন্তু তার মধ্যেও এরা এসব কী করে জানে তা আমি জানি নে । আমাকে ইংরাজী ভাষাটা  জানতে বলে । সেটা না জানলে নাকি বিদেশি শিল্প-সাহিত্য সম্মন্ধে জানা যাবে না কিছুই । কারণ তারা নাকি এসব দিক থেকে আমাদের থেকে অনেক সমৃদ্ধ । শুনে মেলে ভীষণ ধন্দে পড়ি । চিন্তা করি ভাবি এ যে অকূল সমুদ্র। দুর্গম পাহাড় পর্বত ডিঙানোর মতো অবস্থা । এ সব পেরোবো কীভাবে আমি ! 

      এই সব নিয়েই দিনগুলি কাটাচ্ছি । সঙ্গে আমাদের বাড়িতে কটি গোধন আছে , তাদের পরিচর্যা নিয়েই কাটিয়ে দি বাকি সময়গুলি । জানি না এটাই আমার কর্মজীবনের সঠিক পথ কিনা ।

        এই গাভী গুলির দুধ দোহাই করবার জন্যে একজন বিহারী মানুষ আসে । সে এসে দুধ দোহাই করে দিয়ে যায় দুবেলা । তাকে আমি দেখি চেয়ে চেয়ে । তার সঙ্গে অবসর মত তার দেশের কথা শুনি । ঠিক আমাদের দেশটির মতোন তাদেরও দেশে নানা রকমের চাষবাস হয় । এরা দুভাই কয়েক মাস অন্তর পালা করে করে এখানের কাছে পিঠে কোথাও বাসা ভাড়া করে থাকে । এক ভাই কয়েক মাস এখানে থাকার পরে আবার অন্য ভাই আসে , সে এলে, এ দেশে যায় । কাছে পিঠে আরো যাদের গোরুবাছুর রয়েছে , তাদের ওখানেও এই একই কাজটি করে তারা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে । ঝড় জল বৃষ্টি মাথায় করে দুবেলা তাদের আসায় খামতি নেই একটুও‌ । এঁদের দেখে ভাবি , যদি জীবনটা এই সমস্তের মধ্যে দিয়েই কাটিয়ে দিতে হয় তাহলেই বা ক্ষতি কি ! উপার্জন একেবারে খারাপ না । বেশ ছোটখাটো সোজাসাপ্টা ভাবে চলে যাবে । বাড়তি সময় যেটুকু পাবো সেটাকেই কাজে লাগাতে পারবো অন্তত । 

    ওই আবার কাজের কথা নিয়ে বললাম ! এ আবার কী এমন কাজই বা ! 

         যাইহোক এতক্ষণ তো নিজের কথাই বললাম । এখন আপনার কথাটা শুনি একটু , শরীর ভালো আছে তো ? ছাত্ররা কি এখনো আপনাকে পড়ানোর জন্যে ধরাধরি করে ? আপনি কি এখনো হেঁটে হেঁটে শত্রুজিৎপুর হাটের দিন যান হাটে কেনাকাটা কিছু করতে, জানতে ইচ্ছা করে । 

       দিদিকে বলবেন আমার কথা । তাঁকে আমার প্রণাম জানাবেন । মামীদের কথা ভীষণ মনে হয় মাঝে মাঝে । মনে পড়ে কল্যানীর কথা । বেবির কথা । লিটুর মনে হয় এবার হাইস্কুলে যাবার পালা !  মন্টু মামা নারান মামাকে আমার প্রণাম জানাবেন । আপনি আমার ভূমিষ্ঠ প্রণাম গ্রহন করবেন । ইতি—--


           রসিক দাদুকে লেখার পরে মনে হোল এই সঙ্গে কি সঞ্চয়কে  লিখবো ? মনে হচ্ছে ওনাকে তো সব কথা লেখা গেল না , যে কথাগুলি ওনাকে লিখতে পারলাম না সেই কথাগুলি জানবার বড় ইচ্ছা যে করে , তা গোপন করে লাভ কি ? যদিও ওর তো সামনে পরীক্ষা , পড়াশোনায় তো ও আমার মতো গবেট না । ও তো একটা সময়ের পরের থেকে ফাস্ট সেকেন্ড হয়। পড়াশোনায় ও যথেষ্ট যত্নশীল । ওর বন্ধুবান্ধবরাও যথেষ্ট ভালো পড়াশোনায়। স্কুলে ওদের ভেতর কত একতা । ঠিক আমাদের সময়ের মতো না । আমাদের সময়টা কেমন যেন সব ছাড়া ছাড়া। তার ভেতর আমি তো পেছনের সারির ছাত্র । তাই হয়তো আমার সঙ্গে সেরকমের সম্পর্ক ছিল না সকলের সঙ্গে । 

   

      সে যা হয় হোক গে , আজ ওকেও একখানা চিঠি লিখি । লিখলাম —- প্রিয় সঞ্চয় , তোদের ছেড়ে সেই যে একদিন এক সকালবেলায় চলে এলাম , তারপর আর তো কারোর সঙ্গেই কোনো যোগাযোগ হয়নি আমার ! এ কদিনে তোদেরও কারোরই মনে পড়লো না ! না পড়ুক । আমার ভীষণ মনে পড়ে । জানতে ইচ্ছা করে । পড়া শোনা করা ছাড়া বাকি সময়গুলো আগে যেমন বিদ্যুৎ মামার সঙ্গে সঙ্গ দিতিস হাটে ঘাটে ,সেটা কি এখনো দিতে পারিস ? নাকি সব সময় পড়াশোনা নিয়েই থাকিস? 

     এবার যে বর্ষা গেল ,আগে যেমন বর্ষা শেষ হলে মাঠেঘাটের জল যখন একটু শুকিয়ে যায় তখন গলির ভেতর , আমরা যেমন‌ দল বেঁধে পোলো নিয়ে চলে‌ যেতাম এসব ছাড়াও আরো দূরে দূরে মাছ ধরতে ,তারপরে জলকাদা মেখে সেই যে আমাদের একেবারে ভূত হয়ে বাড়ি ফেরা ,শোল, ল্যাঠা, মাগুর, টাকি  , পুঁটি, জিয়া মাছ ধরতাম কত যে,খালুই বোঝাই হয়ে‌ যেত —সেই সব পোলো টানা দিন গুলি ; এবার গেছিলি তোরা নারানপুরের দিকগুলোয় ? বাবুদের ইটখোলায় , সুবোল ভূঁইয়ের আড়ার ভেতরে ? আমাদের বড় ভূঁইয়ের নালার ভেতর গেছিলি কি ! নালীর জমির কাছে ? কিম্বা ঈদ গাঁ ছাড়িয়ে কাওড়ার দিকটার মাঠের ভেতরে গেছিলি কি ? যেখানে মাঝিরা  ভেসাল পাততো ? সে সব জায়গা গুলোয় এবারে কি গেছিলি একবারও? 

    পুরো আমকালটা তো চলে গ্যালো —- ভোরবেলা গুলিতে পরে মামার সঙ্গে আমরা যেরকম ঘুরে বেড়াতাম অন্ধকার থাকতে থাকতে ,এ মাঠ ও মাঠ ডিঙিয়ে, এ বাগান ও বাগান ঘুরে,গামছায় করে সেই যে কটা আম কুড়িয়ে নিয়ে ফিরে আসতাম সকাল হলে , সেই আনন্দ তো এখানে নেই ! 

ভীষণ মনে পড়ছে সেই সব দিনগুলোর কথা ।

   জানি , তুই হয়তো এখন পরিমলের সঙ্গে গেলেও যেতে পারিস; কিন্তু আমার যে ভীষণ মনে পড়ে সব কথা । আচ্ছা , তোদের নতুন মটর পাম্প লাগানোয় ঠাকুর নালার মাঠ গুলোতে এখন ধান হচ্ছে কেমন ? সেই যে ,গরমের সময় গতবছর দমকলের আওয়াজের ভেতর নালি দিয়ে যে মাঠের ভেতর জল যেত বয়ে , আমরা সেই ক্যানালের পাশে যেয়ে চুপটি করে বসে‌ থাকতাম‌ , সেই যে জলধারার যে আওয়াজ হোত  নালিগুলির মধ্যে , তখন যে সদ্য থোড় আসা ধানগাছগুলি কালো হয়ে লকলক করে উঠত দূরের দূরের মাঠের ভেতর ; যেন ঠিক কালো নয় , গভীর সবুজ সে সব রং , আমরা যে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকতাম , আমাদের বুকের ভেতর কত আশা স্বপ্ন যে বুনে তুলতো কেউ যেন , সেই সব ধানগাছগুলি , আমাদের সেই সব উজ্জ্বলতম চোখগুলির স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষাকে ঘিরে কিসের যে এক গভীর প্রত্যাশা  তৈরি হোত মনের ভেতর , তা কি তুই ছাড়া আর কারো সঙ্গে আমি ভাগ করে নিতে পারতাম ? 

      সেই সব কথা এখানে আর কাকে বলিই বা ? কেই বা বুঝতে পারবে আমাদের সেই সব সামান্য সামান্য আনন্দময় মুহূর্তগুলির কথা !

     আচ্ছা এবারও কি পাটের জাগ উঠে গেলে নদীর জল লালচে ধরে গেছিল ? পাট পচানির সঙ্গে সঙ্গে মাছেদের সেই যে ভেসে বেড়ানো ,আমরা যে নৌকো নিয়ে হ্যাজাক জ্বালিয়ে সমস্ত নদীর ভেতর যে মেলা বসে যেত দূর থেকে দেখলে ,আলোয় আলোয় ভরে যেত একেবারে , কত মাছ তোলা হোত জল থেকে! কত চি়ংড়ি বেলে মাছেদের ভেসে ওঠা , কত রুই-কাতলা -বোয়াল- চিতল- আইড় মাছ যে ভেসে উঠত নদীতে — আমরা তিন-চার দিন ধরে রাত হলেই নদীর ভেতর ভেসে বেড়াতাম , সেই অবস্থা কি এবারও হয়েছিল  ? 

            ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে জানিস ! কি করলি এবারে তোরা , সেই সব উৎসবমুখর দিনগুলিতে ?

             শেষের দিকে কিছুদিন সত্তিজাতপুর হাট শেষ হয়ে গেলেও আমাদের আড্ডাটা ভাঙতে ভাঙতে দেরি হয়ে যেত একেবারে । সুধীর দাদুর দোকানের সেই আড্ডার কথা বলছি।ওদিকে খেয়া ঘাটে যদি নৌকা না পাই , তাই পড়ি কি মরি করে পয়ারীর পথ ভাঙতাম , নানা বুনো গন্ধের ভেতর ।গাছগাছালির ভেতরের ফাঁক ফোকর থেকে যে জোছনার আলো এসে পড়ত পথের চার ধারে —- আমরা যেন তখন ত্রাহি ত্রাহি ছুটতাম দুজনে খেয়া ঘাটের দিকে ! তারপর হয়তো পৌঁছে দেখলাম ঘাটে খেয়া নেই , খেয়া ওপারে । ডাকতে ডাকতে হয়তো এলো ঝন্টু দা —- কিন্তু সেই যে তখনকার নদীর চড়ের উপরের সেই সব দৃশ্য , তার আগে আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনুভব করতাম — তার কিছুই তো এখানে আমার কাছে নেই ! অথচ তোদের কাছে আছে এখনো সব ! আমি চলে আসার পরে সেগুলো কি তুই কারো সঙ্গে এখন সেই ভাবে উপভোগ করতে পারিস আগের মতো ! কারণ তোর বন্ধুবান্ধবরা তো বেশির ভাগ সত্তিজাতপুর ,পয়ারী ,গোয়ালবাতানের দিকেই থাকে বেশি বলেই আমি জানি । তাই ভীষণ মনে‌ হচ্ছে ,  এগুলো কি এখন করবার অবকাশ পাস আগের মতো ? 


      ঘুমের মধ্যে আজকাল ভীষণ স্বপ্ন দেখছি জানিস — !  দেখতে পাই গরমকালের ঢেউ ভাঙা জ্যোস্না রাতের মাতাল হাওয়ার ভেতরের নবগঙ্গার সেই রূপ , আমি যেন কোথায় ভেসে চলেছি —- কত দূরে যে তীরের মতোন ; তারপর কোথায় যেয়ে যে সেই রাতের জল -জ্যোস্নায় মিলে গেলাম কিসের সঙ্গে ,আর যেন নিজেকে খুঁজে পাচ্ছি নে , দেখতে পাচ্ছি না একেবারেই —- আর সেই খুঁজে না পাওয়া অবস্থাটার ভেতরেই ঘুমটা ভেঙে যেত। তখন যে আমার কী অবস্থা ঘেমে নেয়ে একেবারে একসার হয়ে ঘুম ভেঙে যায় জানিস ! কিছুক্ষণ একেবারে কথা বলতে পারতাম না । বিছানার উপরে চুপচাপ বসে থাকতাম ' থ ' মেরে একভাবে অনেকক্ষণ ।

       ভীষণ মনে পড়ে ….. ভীষণ মনে পড়ে …. জানিস ,  সেই সব দিনগুলোর কথা ।

          এখানে ইদানীং কিছু বন্ধুবান্ধব হয়েছে , তাদের কাছ থেকে কত কিছু জানতে পারছি ! সে কথাগুলি এর আগে যদি আমি এদেশে টানা থাকতে পারতাম তাহলে হয়তো সে সব এদের কাছ থেকে আমাকে জানতে হোত না ।সে সব আমার এমনি এমনিই হয়তো জানা‌ হয়ে যেত অনেক আগে থেকেই। যাইহোক এখন যা জানতে পারছি তাতে আমার নিজস্ব একটা মনের খোঁজ পেতে এখনো অনেক পথ পেরোতে হবে যে সেটা বুঝতে পারছি । সে অনেক পথ ! কিন্তু তার মাঝের এই দুর্গমতা ভাঙতে পারবো কিনা সেটাই জানিনে । তবে দুঃসহ বলে মনে হয় না তাকে । 

          এই মুহূর্তে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস পড়ছি।শ্রীকান্ত নামের চরিত্রটি আমার সমগ্র সত্তা ঘিরে রেখেছে।‌ সেই যে পাঠ্য বইয়ে ইন্দ্রনাথ নামের চরিত্রটির কথা আমরা পড়েছিলাম , এখানে তো জ্যান্ত ইন্দ্রনাথ কে উপলব্ধি করতে পেরে কতবার আমি আমার নবগঙ্গার কত রাত্তিরের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেছিলাম , ইন্দ্রনাথের শ্রীকান্ত কে নিয়ে নদীপথ অতিক্রম করার সেই সময়গুলির মধ্যে — তারপর যত এগোচ্ছি ততোই ভাবছি জীবনের চলার পথে শ্রীকান্ত যে সব বিষয়ের মধ্যে দিয়ে চলেছে , সে তো আমারও কথা , এসব কিছুই তো আমার অপরিচিত না ! কিন্তু তারপরও সবটা কি বুঝে উঠবার মতো ? রাজলক্ষী ! অন্নদা দিদি ! অভয়ারা যে সব কথা বলছে , তাদের জীবনের এক একটি অধ্যায়ের কথা ; যে যে ভাবে শরৎচন্দ্র দেখাচ্ছেন , তা ছায়াছবিতে  দেখার এবং পড়ার পর , মাঝে মাঝেই আমি যেন কোথায় কোথায় শ্রীকান্তের সঙ্গে সঙ্গে পথ হেঁটে বেড়াই । কত পথ সে সব যেন , যার আমি বিন্দুবিসর্গও জানতাম না আগে । আমার তো মনে হয় এমন একখানি লেখা আমাদের বাঙলা সাহিত্যে কত কাল আগে লেখা হয়ে গেছে ! এরপর আমরা আমাদের জীবনটাকে কতটুকু দিয়ে আর দেখতে পেতে পারি ? সত্যিই কি সব কথা লেখা ও বলা যায় এরকম ভাবে ! তোকে যদি পড়াতে পারতাম তাহলে ভীষণ ভালো লাগত আমার । 

          আমার এখানকার বন্ধুবান্ধবেরা অবশ্য বলেছে , আমাকে শিল্পসাহিত্য করতে হোলে নাকি আরো অনেক কিছু পড়তে হবে ,দর্শন , উপনিষদ , পুরান , বেদ এবং আরো কত কি! 

            এখনো তো রবীন্দ্রনাথ ,বঙ্কিমচন্দ্র ,মাইকেল মধুসূদন দত্ত , এঁদের কারো লেখা পড়িই নি , এরও পরে থাকলো বিদেশী সাহিত্য, দর্শন , এমন কি কুরান শরীফও একখানি কিনতে দিয়েছি জানিস ! এগুলো একে একে সব সংগ্রহ করার জন্যে চেষ্টা করছি ।

        ভাবছি , শুধুই ভাবছি , জানিস, ভাবছি কী করবো ? তাহলে কি এ সব লেখাটেখা ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে এখানে এখন যে গোধন দুটিকে পেয়েছি তাদের পাল আরো বাড়িয়ে নিয়ে ঐ সব নিয়েই এই জীবনটা সাদামাঠা ভাবে কাটিয়ে দেওয়া যায় কিনা সেটাই ভাবতে চেষ্টা করবো নাকি বেশি করে — ? 

       রসিক দাদু বলেছিল আমার নাকি শিক্ষে হবার প্রয়োজন — দীক্ষাটাও দরকার , সেটা না হলে আমি নাকি কিছুই বুঝতে পারবো না । তাই তো বড়ো জায়গায় ফিরে এলাম । 


         শেষে জানাই ,আমি কিন্তু এখানে এসে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ধার আর মাড়াই নি । ওসব বাঁধা গন্ডীর মধ্যে আর মানিয়ে উঠতে পারবো না যে সেটা ভালো করেই অনুভব করছি। তাই ওসব ছাড়লাম । ওসব আমার জন্যে না ।কিন্তু তাই বলে তুই কিন্তু থামিস না। তোর ভেতরে অনেক কিছু মানিয়ে নেবার ক্ষমতা আছে । তুই এগিয়ে যা। আমি নাহয় এই দুর্গমতাই গ্রহণ করলাম । যদিও জানি এ পথে কোনো সামাজিক স্বীকৃতি নেই । অনেক ঠোক্কোর খেতে হবে । কিন্তু কি করবো ! নিরুপায় । হয়তো এই ভাবেই আমার যাত্রাপথের লিখন তৈরি করে রেখেছেন বিধাতা ! ভয় হয় না যে তা না । ভীষণ ভয় হয় ।কারণ এখানে যাদের সঙ্গে এই মুহূর্তে চলাচল করছি তারা সকলেই প্রথাগত পথেরই পথিক । আমার মত কেউ না । একেবারেই মিল নেই । এরা কেউ শিল্পসাহিত্যের ধারও মাড়ায় না ! তবে এদের ভেতরে একটি ছেলে আছে সে হোল শংকর , সেও কিন্তু এসব নিয়ে খুব একটা‌ যে পড়ে থাকে তাও না । তবে ওর কথাগুলি আমি খুব একটা এড়িয়ে চলতে পারি না । ও লেখালেখি না করেও এত সব জানে কী করে !তাই ভাবি । ওর সব কথা একেবারে ভুল বলেও মনে হয় না তো ! 

       যদিও আর একটু ভালো হোত যদি সেই সব মানুষগুলোর কাছ থেকে কিছু জানতে পারতাম যারা ঠিকঠাক আমার পথের মানুষ । যদিও ইতিমধ্যে জানতে পেরেছি দুই একজনের কথা , কিন্তু তাঁরাও শুনেছি খুব পন্ডিত মানুষ । স্কুল কলেজের মাস্টারমশাই । এবং এঁরাই নাকি প্রকৃত পক্ষে এখন লেখালিখি করে । তাই ভাবছি আমার এইটুকু বিদ্যেবুদ্ধি নিয়ে তাঁদের কাছে দাঁড়াই কি করে ! 

     তাই এত খোঁজখবর করেও তাঁদের ধারে কাছেও যাই না । মনে হয় নিজেকে আরো খানিকটা তৈরি করে নেওয়া দরকার । তারপরে না হয় দেখা যাবে এঁরা কি ভাবছে ।

      এই মুহূর্তে একজন ইংরেজির মাস্টার মশাইয়ের খোঁজ খবর করছি । দেখি সেরকম কাউকে পাওয়া যায় কি না । 


       যাই হোক আজ থাক । দিদিভাইকে লিখবার চেষ্টা করছি এই সঙ্গে , যদিও না পারলে তুই তাঁকে বুঝিয়ে বলিস সব কিছু । তুই বললে সে বুঝবে । কারণ তোর উপরে তার বরাবরই ভরসা । এই মুহূর্তে তুইই তার সব চাইতে বড় অবলম্বন বললে কম বলা হবে ,তোকে নিয়ে তাঁর অনেকখানি গর্ব ।আমি তো তাঁকে নিরাশই করলাম  সব দিক দিয়ে । কি আর দিতে পারলাম ! আমি তো তাঁর কোনো আশাই পূরণ করতে পারি নি ।

       ভালো থাকিস । শুভেচ্ছা রইল । 

            দুখানি চিঠি একটি খামে পুরে পোষ্ট অফিসের ডাকে ফেলে এলাম । মনে মনে এমনই একটা তাড়া অনুভব করলাম এমন ভাবে যেন, আজই চিঠি দুখানি যদি পৌঁছে যেতে পারে তো খুব ভালো হয় । পোষ্টমাস্টার বললো , যা টিকিট খামে লাগানো আছে তারপরে দশ পয়শার টিকিট আরো লাগালে তবেই পৌঁছোবে । 

             ওদেশ ছেড়ে আসার পরে এই আমার প্রথম কারো কাছে চিঠি লেখা । এর মধ্যে আর কারো কাছেই লেখা হয়নি । আর এখন তর সইছে না যেন উত্তরের জন্যে‌ ! 

            ওদের দুখানা চিঠির সঙ্গে দিদিমাকে কিছু লিখতে পারলে ভালো হোত , কেন লিখলাম না ? মনে হোল মা তো ওদেশে গেছিলোই — সে তো সবকিছুই বলেছে হয়ত তাকে । তাই এই সঙ্গে আর লিখবার কীই বা আছে ? 

            মা যদি তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারত তাহলে তো চিঠির প্রাসঙ্গিকতাই থাকত না !

            নানা কিছু ভেবে চিঠিটি শত্রুজিৎপুরের ঠিকানাতেই পোষ্ট করলাম । কারণ শত্রুজিৎপুর তো সঞ্চয় একরকম প্রতিদিনই যায় ।

তাই প্রযত্নেতে লিখলাম সঞ্চয় কুমার কয়ালদার । 

           বিষয়টা এরকম কেন ?

           কারণ শত্রুজিৎপুর ওই গ্রামের পোষ্টাফিস নয় । ওই গ্রামের ডাক আসে বিনোদপুরের পোষ্টাফিসের ডাকে । বিনোদপুর সচরাচর কারোরই বিশেষ একটা যাওয়া আসা পরে না । একমাত্র গড়হাটের দিন এ অঞ্চলের চিঠি বেশ কিছু একসঙ্গে জমলে, ডাকপিয়ন এসে হাটের দিন চিঠি গুলি দিয়ে যায় পাড়ার মানুষজনের হাতে দেখে দেখে । তা

 না হোলে থাকলো পড়ে অনন্তকাল ধরে ডাক পিয়নের ঝোলায় পড়ে । 

           সেই সব বিলম্বের কথা চিন্তা করেই শত্রুজিৎপুরের ঠিকানায় ছাড়া হোল এই চিঠিটি ।

             কালীপুজো পেরিয়ে গেল । 


         এখানে কতকাল পরে এই সময়ে থাকলাম ! দোদমা আর কালীপটকায় চকলেট বোমের আওয়াজে ছয়লাপ চারদিক । কানে সহ্য করা দায় । 

            ফোচন ছুঁচো বাজি তৈরি করলো দেখলাম তার আগে ওদের ছাদে । সঙ্গে কয়েকটি বসনতুবড়ি ।সে সব কত যে আয়োজন তার ! নানারকমের সাবধানতা । সন্দক ,লোহাকুচি , আরো কত কি যে প্রয়োজন হয় , মনে রাখা দুষ্কর । বসন তুবড়ি আর উড়ন তুবড়ির মশলা আবার আলাদা নাকি ! 

খবরের কাগজ পেতে সে সব রোদ্দুরে শুকিয়ে কতরকমের কায়দায় দেখলাম সে সব বানিয়ে তুললো ! 

        তাই কালীপুজো মানে এখানে বাজির মহড়া !

         প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে দশাসই কালীমূর্তি । ওদেশের সঙ্গে এদেশের পুজোর কোন মিলই খুঁজে পাওয়ার উপায় নেই কোথাও । 

     ওখানে থাকতে আমাদের একখানি পুজোই হোত ও অঞ্চলে। তাতে পাল কাকা যদি বাড়ির উপরে এসে বানিয়ে দিতেন তাহলে সেই কদিনের আগে আগে আমাদের পাটকাঠির বেড়ার মণ্ডবে একটা মিনমিনে সোরগোল থাকত । আর যদি তাঁর দীঘল কান্দির বাড়িতে প্রতিমা তৈরি হোত ,  তাহলে প্রতিমা আনার দিনের সেই যে পুরোনো সোরগোলটুকু যেমন হোত , তা তেমনই। তাছাড়া আর বাড়তি তো তেমন কিছুই না ! এরপর পুজোর দিন একটু ঢাক কাঁশোর সানাই বাজত , এই তো । বাজি কোথায়‌ ! মধ্যরাত্তিরে পুজো । ছেলেমেয়েরা তো অর্ধেক ঘুমেই চলে যেত । হয়তো সন্ধেবেলাটুকু পাড়ার অল্প বয়সি ছেলেপেলেরা যা একটু কাঠিপটকা ঠকাস্ করে সানে বাড়ি মেরে হয়তো দুএকটা ফাটালো , আর কি ! বাজির বাহার কোথা থেকে আসবে সদ্য স্বাধীন হওয়ার পরে কতটুকুই বা বাইরের ঝাঁঝ পৌঁছনোর সময় পেল সে ! এর মধ্যেই তো‌ একটা ছোটখাটো দুর্ভিক্ষের মুখও দেখতে হয়েছে চেয়ে চেয়ে তাকে ।


       পুজোর দিনগুলিতে সমস্ত দিন দিদিমার বাড়তি একটা ব্যাস্ততা । একবার এ বাড়ি তো একবার ও বাড়ি । এ প্রয়োজন তো ও প্রয়োজন । তাঁর যেন উৎকন্ঠা আর যায় না কিছুতেই ! অথচ পাড়ার মামিমারা, দিদিমারা , সেই আয়োজনে সকলেই সামিল হোত একজোট হয়ে তাতেও তাঁর উৎকন্ঠার শেষ নেই‌ । " এটা হোল কি রে, আলো ক দেহি আমারে । আরে বুনডি কহনে আর হবেনে তা কিডা জানে ! এই তো ইবারে তো সন্ধে লাগতি না লাগতি অমবস্যা —- দাদাঠাকুর ও তো আলেন বলে‌ ! 

তহনে দেহেনে , তার ডা কী গোণ্ডগোল বাধবেনে !....... . " 

        কাঁচাগোল্লা সন্দেশের ভোগ হোত বলীর পরিবর্তে । বৈষ্ণবীয়‌ মতে পুজো হোত দিদিমার । রান্না ঘরের‌ বারান্দাতেই তৈরি হোত নাড়ু ,ক্ষীরের ছাপা ,সিঙ্গে সন্দেশ — সবই । 

          গ্যানেনদির দার স্ত্রী এবং নির্মলা দি ,ও বড় দিদিমা ছোট দিদিমা , অর্থাৎ দাদুদের স্ত্রীরা সকলেই একটা না একটা পর্বে এসে নাড়ু নারকোল ছাপা সন্দেশ বানানোতে বসে যেত । তবুও দিদিমার উৎকন্ঠার শেষ থাকত না , যতক্ষণ না পুজো শেষ হয়ে সকলে প্রসাদ নিয়ে চলে যেত । 

          এঁদের সকলের এই যে নিষ্ঠা–একাগ্রতা–আচার–অনুষ্ঠান — সব কিছু মেনে সমস্ত দিন এক একজন এক এক রকমের কাজের দায়িত্ব নিয়ে তা সামলে বেড়াত , সে সব কি কম কথা ! সে যেমন চিড়ের‌ ধান নিয়ে যেয়ে ঢেঁকিতে কুটে আনা ,আবার খই ভাজা —- তার পরে‌ আবার সেই খই দিয়ে নাড়ু , মুড়ির নাড়ুও ছিল সেই সঙ্গে , এই সব কিছু  তৈরি করে পুজোতে একসাথে একই দিনে দেওয়া , সে কি কম ঝক্কির ? 

         সবই এই পাড়ার মানুষজনেরা সামলাতো এক সঙ্গে হোয়ে‌। দিদিমার তো সেরকম কিছুই করতে হোত না ! তাও তাঁর ব্যাস্ততার শেষ নেই । দাঁতে তামাকের গুঁড়ো দিয়ে দাঁত ডলতে ডলতে এক এক জনকে এক এক রকমের নির্দেশ । সকলকেই ব্যাস্ত করে তুলতো — " এটা হোল না ওটা হোল না — ইবার তো সন্ধে লাগতি লাগতি পুজো , পারবেনেন তো দাদা ঠাকুর , সব কিছু এর মধ্যিই তো ; তাই কচ্ছি পারলি হয় ; ওলো , ও নিম্মলা — দ্যাখ ওদিকটা কত দূর আইগোলো ….! " 

          এই সব শুনে নির্মলা দি বলতো , " এই হোইসে তোমার বড্ড দোষ —- আরে বাবা দেখনা ক্যান , পেত্তেক বছর কি পড়ে থায়ে কাজ কিছু ! সবই তো হয় , নাকি হয় না , সেইডা কও দেহি নি ? "

            তারপরে একটু থেমেই বলতো ," এই তো সন্দেশ , ক্ষিরছাপাগুলোন হোলিই হোয়ে গ্যালো , ওগুলোই ইবার সুন্দরী আর সুষমারে দিয়ে পাঠায়ে দিছি —-- সবডা না পারলি মারে কোইছি একটু আগোয়ে দিবেনে —- তালিই তো হোয়ে গ্যালো সব । জলটলগুলোন নদীর থেকে আনা সাইরে ফেললিই হোলো ফাঁকে, তালিই তো হোল ! বাকি সগলে মিলে করলি কি আর পড়ে থাকবে কাজ কিছু …! "


**********************************************************************************************

আগামী সংখ্যায়

**********************************************************************************************

অণুগল্প * দেবাশিস সাহা

        



ণুগল্প সাহিত্যের একটি বিস্ময়কর শাখা। ' বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন ?' ঠিক তাও নয় যেন, বিন্দুতে সপ্তসিন্ধু দশ দিগন্ত চকিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সার্থক অণুগল্পে। তেমনই একটি অসাধারণ অণুগল্প এবার আমরা পড়ছি ----



ফেরা

দেবাশিস সাহা



"মা, শোনো শোনো--" আবেগ, উত্তেজনা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছিটকাচ্ছে তমালের গলায়। তার একটা টুকরো এসে লাগল অঞ্জলির কানে, 'কী হয়েছে কী, আনন্দে কথা আটকে যাচ্ছে যে!' একটু থেমে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'চাকরি-বাকরির পাকা খবর পেলি বুঝি!'

'তোমার খালি ওই এক কথা...'

'না তো কী, বয়সটা কী কম হল? গেল ফেব্রুয়ারিতে তিরিশ পেরোলি, কতকাল আর টিউশান পড়াবি, বল?' ছেলের মুখের দিকে অসহায় তাকান অঞ্জলি । সেই তাকানো কতটা অর্ন্তভেদী, তমাল পড়তে পারে। বাবা চলে যাবার পর নামমাত্র পেনশনটুকুই ভরসা, ডিভোর্সি বোনটাও ছেলেকে নিয়ে মায়ের ঘাড়ে। শরীরটাও মা-র চিন্তায় চিন্তায় জরাজীর্ণ। তমাল কি আর জানেনা এসব! জানে ঠিকই, তবু গলায় কৃত্রিম অভিমান টেনে বলল, ' তুমি আমার কথাটা শুনবে না তো, মা?' 

'শুনব না কেন, বল--'

আরো কাছে এগিয়ে এসে মায়ের হাতটা মুঠোয় চেপে তমাল বলল, ' মানিকের সঙ্গে বাংলাদেশ যাব, তুমি না কোরো না, মা। সপ্তাহখানেকের মধ্যে ফিরে আসব।'

'বাংলাদেশ! কেন ? কবে আমরা ও দেশ ছেড়ে ছুঁড়ে এসছি, জমিজিরেত, বাগান, পুকুর সব...তুই তখন কত ছোট!'

'সেই ছোটবেলাটাই আর একবার খুঁজতে যাব, মা!'

'পাবি?'

'না পাই, তবু---'

'মনে কর না আমিই তোর বাংলাদেশ, আমিই তোর ভারত, আমার গায়ে তো কোনো কাঁটাতার নেই।' বলতে বলতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন অঞ্জলি... ছেলে কথায় কথায় বলে,---চলো মা, বাংলাদেশ ঘুরে আসি। বাপ-ঠাকুরদার ভিটে...সেই পুকুর..বাগান...বাড়ি... আর একবার দেখে আসি...। আঁচলের খুঁটে চোখ মোছে অঞ্জলি, 'তবে যা, তাড়াতাড়ি ফিরিস কিন্তু বাবা।'

তাড়াতাড়ি ফেরা হয়নি তমালের। কাকা-কাকি, জ্যাঠা-জেঠু, ছোটবেলার বন্ধু অমর, প্রদীপ, কিশোর... সবার ভালোবাসার চাপে, এক সপ্তার জায়গায় ফিরল এক মাস  পরে। 

ততদিনে অঞ্জলি পাড়ি দিয়েছে কাঁটাতারহীন আকাশে, না-ফেরার দেশে।


***************************************************************

অণুগল্প * দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়




ণুগল্প সাহিত্যের একটি বিস্ময়কর শাখা। ' বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন ?' ঠিক তাও নয় যেন, বিন্দুতে সপ্তসিন্ধু দশ দিগন্ত চকিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সার্থক অণুগল্পে। তেমনই একটি অসাধারণ অণুগল্প এবার আমরা পড়ছি ----



আলোর প্রার্থনায়

দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়



অপারেশনের পর আজ তৃতীয় রাত।ঘুম আসছে না।রাত প্রায় দুটো।ঘাড় ঘোরাতেই দেখি কোণের দিকে আবছা এক মুখ। বিছানা থেকে নেমে এগোতেই দেখি সিস্টার পূর্ণিমা মোবাইলের আলোয় কিছু পড়ছে। পাশে দাঁড়াতেই চমকে উঠলো ও।  জানালো,বিএসসি নার্সিংএর পরীক্ষা পরের সপ্তাহে।সব কাজ সেরে একটু পড়া এই রাতে। বাঁকুড়ার খুব গরীব ঘরের মেয়ে।ও এখানে হোস্টেলে থাকে।মাইনে যা পায় কিছুটা রেখে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। তাই ওকে বড়ো হতেই হবে।

ওর ক্ষয়াটে জেদী মুখ জুড়ে আলো! বাইরে তাকাতেই দেখলাম পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় পৃথিবী ভাসছে। কোন পূর্ণিমার আলো বেশি উজ্জ্বল ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চললাম নিজের বিছানার দিকে। 



************************************************************************************************




দেবাশীষ মুখোপাধ্যায় 

 রয়েল কমপ্লেক্স ,কাঠালবাগান ,উত্তর পাড়া, হুগলী থেকে লিখছেন পেশা: শিক্ষকতা ,নেশা : কলম চারিতা ,সাপলুডো খেলা শব্দ নিয়ে ,অণুগল্প ,ছোট গল্প ,কবিতা, প্রবন্ধে  সুখ-দুঃখ ,হর্ষ-বিষাদ, আড়ি ভাবের অনুভবে থাকা ,জীবনের দুই স্তম্ভ রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দের আদর্শ মনন, যাপন ও শীলনে.. স্বপ্ন: পৃথিবীকে ভালবাসার যৌথ খামার বানানো..দিক চক্রবালে হিরণ্যগর্ভ আলোর খোঁজ ..পাখি ,গাছ আকাশের সাথে মন কি বাত.. সূর্যের নরম আলোয় সুখের আবিরে মানুষের সাথে হোলি খেলা..

                        

অণুগল্প * প্রভাত ভট্টাচার্য





ণুগল্প সাহিত্যের একটি বিস্ময়কর শাখা। ' বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন ?' ঠিক তাও নয় যেন, বিন্দুতে সপ্তসিন্ধু দশ দিগন্ত চকিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সার্থক অণুগল্পে। তেমনই একটি অসাধারণ অণুগল্প এবার আমরা পড়ছি ----



ক্ষিধে 

প্রভাত ভট্টাচার্য 


আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। জ্যোৎস্নার আলোয় ঝলমল করছে চারদিক। তারই মাঝে একজন এসে বসল পার্কের বেঞ্চে ।

লোকটাকে দেখে দুঃস্থ বলেই মনে হয়। হাতের ঠোঙা থেকে কিছু নিয়ে খাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে যে বেশ ক্ষুধার্ত রয়েছে সে। খাওয়া শেষ হতে তার মুখে চলে এল এক পরিতৃপ্তির ছাপ। 

     তারপর সে চেয়ে রইল আকাশের দিকে। চেয়েই রয়েছে শুধু। দেখছে অসীম আকাশ, পূর্ণচন্দ্র আর চন্দ্রালোকের স্নিগ্ধ ছটা। 

      আগে হয়তো সে এভাবে চাঁদের আলোয় বসে প্রকৃতিকে উপভোগ করে নি সে এখন অন্যরকমের ক্ষিধে মেটাচ্ছে  - দেখার ক্ষিধে, মনের ক্ষিধে।



************************************"**************************************************************



প্রভাত ভট্টাচার্য  

তিনি সব্যসাচী--- এক হাতে সামলান চিকিৎসকের গুরুভার দায়িত্ব আর এক হাতে ফোটান সাহিত্য সৃষ্টির ফুল। দ্য হার্ট, মিশন পসিবল, মাই ডটার, ডিটেক্টিভ সূর্য এবং কবিতা সংকলন - কাগজের মানুষ এবং ফিনিক্স পাখি তাঁর উজ্জ্বল সাহিত্যসৃষ্টি । সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর একটি গ্রন্থ --- 

গল্প * যুগল কিশোর দাস অধিকারী




শেষের শুরু

যুগল কিশোর দাস অধিকারী


হাওড়া থেকে লঞ্চটা ফেয়ারলি ঘাট যাচ্ছে। বেলা প্রায় ১০টা বা শোয়া দশটা হবে। ভিড়ে থিক থিক করছিল। বাসু ও ললিত মঙ্গলাহাট থেকে রেডিমেড কাপড়ের বাজার করে ফিরছিল। লঞ্চ পার হয়ে বাস ধরে ট্যাংরা যাবে। ভিড়ের মধ্যে এক মহিলা দু ' বছরের বাচ্চাকে নিয়ে কেমন যেন ইতস্তত করছিল। ব্যাগটা গুছিয়ে পাশে বসা মহিলাকে তার ছেলেটিকে কিছু সময় দেখার অনুরোধ করেছিল। মহিলা জিজ্ঞেস করল তুমি কোথায় যাবে?

- আমি আছি এই পাশেই যাব  এক্ষুনি ফিরে আসব। কিছু সময়ের জন্য ওকে লক্ষ্য রাখবেন।

আচ্ছা যাও তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। - হ্যাঁ হ্যাঁ এই যাবো আর আসবো।

লঞ্চ তখন মাঝ গঙ্গাতে, বেশ ঢেউ দিচ্ছে।

ললিত কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। মহিলার আচরণে কেমন যেন সন্দেহ ঠেকছে।

অপরিচিত উপযাচক হয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলে কি বলতে কি বলবে।

তাই মোবাইল ঘটছিল। তবে অজান্তে মহিলার উপর তার নজর ছিল। হঠাৎ

লঞ্চের কিনারায় এসে দিদি বাচ্চাটা রইলো। এই বলেই নদীতে ঝাঁপ। সবাই চিৎকার করছে। লঞ্চ থামান। জলে মহিলা ডুবছে উঠছে। ললিত বাসুর হাতে মোবাইলটা ছুঁড়ে দিয়েই জলে ঝাঁপ। লঞ্চ স্লো করে কেউ কেউ দড়ি

খুঁজছে। ওদিকে স্রোতের টানে মহিলাকে তুলতেও পারছে না। মহিলাকে ধরতে গেলে সে গলা জড়িয়ে ধরছে। লালিতের জীবন যায় রয়। যাত্রীরা ভাবছে মনে হয় দু ' জনেরই সলিল সমাধি হল।

এমন সময় লঞ্চ থেকে একটা মোটা দড়ি ছুঁড়ে দিয়ে বাসু চিৎকার করছে

ললিত দড়িটা ধর।

অনেক কষ্টে দড়িটা ধরে মহিলাকে নিয়ে লঞ্চের পাটাতনে উঠলো।

দুজনেই জল খেয়ে কাত হয়ে পড়েছে 

মহিলাকে শুইয়ে লঞ্চের এক নার্স জল বের করছিল। অবশেষে দুজনেই বিপদ মুক্ত হল। বাচ্চাটি সমানে কেঁদে চলেছে।

বাচ্চাটি যে মহিলার কাছে ছিল উনি এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন - তোমার নাম কি? কোথায় যাবে? জলেই বা কেন ঝাঁপ দিলে? তুমি মরে গেলে তোমার বাচ্চার কি হত? আরো নানা প্রশ্ন। 

মহিলা বিধস্ত। কোন কথা বলছে না।

ততক্ষণে লঞ্চ ফেয়ারেলি এসে গেছে।


ললিত দেখছিল যে কিছুক্ষন আগে মৃত্যুর জন্য জলে ঝাঁপ দিয়েছিল সে এখন তার সন্তানকে প্রাণপনে আগলে

কেঁদেই চলেছে। ভিজে সপসপে শাড়ি

শরীরে লেপটে শরীরের সৌন্দর্য্য ফুটে উঠছে। ললিত পাশে এসে জিজ্ঞেস করলো আপনি কিছু বলুন। এমন সুন্দর ছেলেটিকে ও আপনি জলে ভাসিয়ে দিচ্ছিলেন। কিন্তু কেন?

আপনার সমস্যা কি? কেউ কেউ বলছে ওকে পুলিশের হতে তুলে দাও। আবার অনেকের এত সময় নেই সময় দেওয়ার। যে যার কাজের জায়গায় রওনা দিচ্ছে।

ললিত মেয়েটি মুখ চোখ দেখে আন্দাজ করতে পারছে যে ওর সমস্যা আছে কিন্তু তা কোন অব্যক্ত কারনে ব্যক্ত করতে পারছে না

 তাই আবার জিজ্ঞেস করল আপনি যদি কিছু না বলেন তাহলে আমরা কোন সাহায্য করতে পারবো না। অগত্যা পুলিশের হাতেই তুলে দিতে হবে। এটা এটেম্পট টু সুইসাইড।

মেয়েটি তখন কান্নায় ভেঙে পড়ল।

দুঃখে হতাশায় বললো আমার সমস্যা শুনলে আপনার কি হবে? আপনি কি আমার সমস্যার সমাধান করতে পারবেন? আপনি আপনার জায়গায় যান।

ললিত প্রশ্ন না করে শান্ত হয়ে বললো আপনাকে অন্তত আপনার বাড়ি পৌঁছে দিই। কোথায় যাবেন বলুন।

আমার কোথাও যাবার জায়গা নেই।

দম নিয়ে বললো সাঁতরাগাচিতে বাবার বাড়ী গিয়েছিলাম। বাবা মা নেই। তাই দাদা বৌদি আমাকে রাখতে পারবেনা। এদিকে স্বামী এই ক ' দিন আগে অ্যাকসিডেন্ট এ মারা গেছেন। বৃদ্ধ শ্বশুর শাশুড়ি। তাদের তেমন রোজকার নেই। আমার স্বামীর উপার্জনেই  সংসার চলত। তাদের কাছে ও আমি বোঝা। তবে আমার বেঁচে থেকে লাভ কি?

শ্বশুর বাড়ী কোথায়? আমিকি যাব আপনার সঙ্গে ? যদি আপনি আপত্তি না করেন।

শ্বশুর বাড়ী সোনারপুর। আপনার নামটা কি জানতে পারি?

আমি লাবণ্য। ললিত বসুকে মালপত্র নিয়ে বাড়ী যেতে বললো। ললিত বললো এ অবস্থায় উনাকে একা ছাড়া ঠিক হবে না। তাই লাবণ্যকে নিয়ে ট্যাক্সি ধরে শিয়ালদহ এলো।

স্টেশন এ টিকিট কেটে ট্রেনে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলো কিছু খাবেন?

না।

বাচ্চাটার জন্য একটা ফ্রুটি, এক প্যাকেট বিস্কুট ও এক বোতল জল নিয়ে ট্রেনে উঠলো।

সোনারপুর লোকালে উঠেছে। জানালার ধারে বসে উদাস দৃষ্টিতে লাবন্য বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। সংসারের কোন কিছুর প্রতি তার টান ছিন্ন হয়েছে। ছেলেটির দিকেও তার নজর নেই। পৃথিবীটা তার কাছে শুন্য মনে হচ্ছে। হওয়ায় শুকিয়ে যাওয়া চুল উড়ছে। ভেজা শাড়ি ও শুকিয়ে এসেছে। লালিতের এই অসহায় মহিলার উপর, বিশেষত ছেলেটার জন্য ভীষণ মায়া পড়ে গেল।

  লাবণ্যর শ্বশুর বাড়ি পৌঁছে লালিত রাস্তার কোন ঘটনার কথা কিছুই বলেনি। অপরিচিত লোককে দেখে লাবণ্যর শ্বশুর শ্বাশুড়ি কেমন কেমন করছিল।

 শ্বশুর মশায় জিজ্ঞেস করলো বৌমা তুমি তো তোমার বাবার বাড়িতে থাকবে বলে কালই গেলে। আবার আজ ই ফিরে এলে যে? আর ইনিই বা কে?

 এবার ললিত তার শ্বশুর কে কাছে এনে বললো হ্যাঁ উনি উনার দাদা বৌদির কাছে গিয়েছিলেন কিন্তু ওরা কেউ ই ওর দায়িত্ব নিতে পারবে না বললো। তাই উনি চলে এলেন। কিন্তু বাবা আমার তো তেমন উপায় নেই।

আমরা নিজেদের সংস্থানই করতে পারছিনা। তা ছাড়া ওর বয়স ভীষণ কম ২৭ কি২৮ হবে এই বয়স থেকে সারাটা জীবন কিভাবে একা লড়বে?

ওর ছেলেটার কি হবে? আমরা বা আর ক দিন?

 আমাদের ছেলে এক ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করত। হটাৎ সিকিম গিয়ে অ্যাকসিডেন্ট এ মারা গেল। আমার বয়স হয়েছে। স্ত্রী ও অসুস্থ। আমরা নিরুপায় হয়ে ওকে ওর ভাইয়ের কাছে পাঠিয়েছিলাম। তা ছাড়া ওর গোটা জীবনটাই পড়ে আছে।

কিন্তু তুমি ই বা কে কি করে ওর  সম্মন্ধে জানলে?

   তখনই ললিত আদ্যপান্ত লঞ্চের ঘটনা বললো। এবং সে যে পৌঁছে দিতে এসেছে - না হলে আবার কোন বিপদ হতে পারে সেই ভয়েই সে নিজে এসেছে।

 তার কথা শুনে লাবণ্যর শ্বশুর শাশুড়ি

বললো ওর পোড়া কপাল। যা হয় হোক। আমার কাছেই থাক। কিন্তু আমার ইচ্ছে ছিল ও যদি আবার কাউকে বিয়ে করে ঘর বাঁধে তাহলে আমরা আরো খুশী হতাম।

লাবণ্যর শ্বশুর বললো ওর বিয়ে হলেএকটা হিল্লে হতো। আর বাচ্চাটার ও। কিন্তু কে এমন সহৃদয় আছে ?

বিশেষত ওকে বিয়ে করলে ও বাচ্চাটিকে হয়তো না ও নিতে পারে। আমরা পড়েছি অকূল পাথারে।

ঘটনা শোনার পর ওর শাশুড়ী ভিতরে গিয়ে নাতি ও বৌমার কাছে ছুটে গেল।

     সেই ফাঁকে ললিত লাবণ্যর শ্বশুরকে বললো যদি এমন কোন সহৃদয় ছেলের সন্ধান পাই, যে আপনার নাতি ও বৌমাকে নিতে রাজি আছে তাতে কি আপনাদের কোন আপত্তি আছে?

  না না একদম নয়। কিন্তু এমন ছেলে কোথায় পাবে?

আচ্ছা দেখছি, আমি দু এক দিন পরে এসে আপনাদের জানাবো। আজ উঠি।

 এত বেলায় কিছু মুখে না দিয়ে কেমন করে যাবে? যা হোক নুন ভাত খেয়ে যাও বাবা।

লাবন্য ধীরে ধীরে বাইরে এসে এক গ্লাস সরবত ও দুটো মিষ্টি নিয়ে এসে শ্বশুরকে বললো অনেক দিন।

 আরে তুমিই দাও না।

- এ সবের কোন দরকার ছিল না।

জল আর মিষ্টি খেয়ে ললিত উঠল।

 ললিতের বয়স ৩৭/৩৮ হবে। তবে বেশ সুঠাম চেহারা। ভদ্র, পরোপকারী। আড়াল থেকে লাবন্য ললিতকে লক্ষ্য করেছে। মুখের কোন হাসি লেগেই আছে। আজকালকার দিনে এমন ও মানুষ আছে, না কি অন্য কোন মতলব আছে কে জানে ?

 এখনো স্বামীর স্মৃতি দগদগ করছে।

হটাৎ এক ঝটকায় সমস্ত আলো নিভে গিয়ে চারদিক অন্ধকারে ঢেকে গেছে। বাঁচার আকাঙ্খা টুকু ও নেই। তবু ওই ছোট্ট শিশুটার দিকে তাকিয়ে আজ যেন নিজেকে স্বার্থপর মনে হল। আমি চলে গেলে ওর কি হত?

   কয়েকদিন পর ললিত তার মা কে নিয়ে লাবণ্যর বাড়িতে এল। লাবন্যর বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে উনি আবার আসবেন। ছেলের জন্য জামা কাপড়, শ্বশুর শাশুড়ি ও লাবণ্যর জন্য ও শাড়ি ইত্যাদি এনেছে। এ সব দেখে লাবণ্যর শ্বশুর শাশুড়ি কিছুটা অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে গেল। সঙ্গে মিষ্টি ফল বাচ্চার খেলনা। ললিতের মা লাবন্যর শাশুড়ি কে ডেকে বললেন দিদি আপনাদের সাথে আমার কিছু কথা আছে। যদি অভয় দেন তো বলি। তার আগে আপনার বৌমাকে দেখি। ললিতের মা লাবন্যকে একবার দেখেই ভীষণ মায়া পড়ে গেল। সদ্য আহত মৃগ সবিকার মতো ম্রিয়মাণ।

 তার শাশুড়িকে ডেকে বললেন আমি যদি আমার ছেলের জন্য লাবন্যকে নিয়ে যেতে চাই, আপনাদের কি কোন আপত্তি আছে?

 লাবন্যর শ্বশুর বিস্মিত হয়ে বললেন কিন্তু একদিনের পরিচয়, তা ছাড়া আপনারা কোথায় থাকেন, ছেলে কি করে, ইত্যাদি আমরা তো কিছুই জানি না। একবার ওর কপাল পুড়েছে, আর আঘাত পেলে সইতে পারবে না। তাছাড়া ওর ছেলেটির ই বা কি হবে?

 ললিতের মা বলল আমরা দু ' জনকেই

নিয়ে যেতে চাই। আপনারা যদি রাজি থাকেন। তবে ইতিমধ্যে আপনারা আমার বাড়িতে আসুন। ঘরবাড়ি সবকিছু দেখুন। আমার ছেলের রেডিমেড গার্মেন্টস র বিজনেস। ওর বাবা নেই। আমি আর ও থাকি। একজন কাজের ছেলে ও মেয়ে ও থাকে। আমি প্রাইমারি স্কুল শিক্ষিকা।

 তবে ওর আগে বিয়ে হয়েছিল। বৌমাই ওকে ছেড়ে চলে গেছে।

কিন্তু কেন? আপনারা এত স্বচ্ছল, ছেলে ও ভারি সুন্দর, তবে কেন বৌমা ছেড়ে চলে গেল?

  আপনাদের সত্যি কথাই বলি বলে মৃদু স্বরে বললেন লজ্জা লাগলেও বলতে হবে ওরা চার বছর বিয়ে করে ও কোন সন্তান হয়নি। অনেক ডাক্তার বৈদ্য ও করেছি। শেষে জানলাম আমার ছেলেই বাবা হতে অক্ষম। তাই সে আর থাকতে চায় নি। ওকে আমরা ছাড়িনি ও ই আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।

তাই আপনার নাতি আমার নিজের নাতির মতই মানুষ করবো  কোন ত্রুটি হবে না কথা দিচ্ছি।

 লাবন্য র বিশেষ আপত্তি ছিল না, তবু ছেলের জন্য ভীষণ ভয় করছিল।

যদি ওকে অবহেলা করে? ললিতের মায়ের সাথে ওর শ্বশুর শাশুড়ীর কথা লাবন্য জানতে পারেনি।

     বাসররাতে লাবন্য ছেলেকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে অপেক্ষা করছিল। রাতে ললিত এলো। লাবন্য কি করে না করে ভেবে পায় না । ললিত বিছানায় এসে ছেলেটিকে কোলে তুলে আদর করতে লাগলো। কিছু এ কথা ও কথা বলতে বলতে ঘুম চলে এল। লাবন্য সকালে ও দেখে সোফায় ছেলেকে নিয়ে ঘুমাচ্ছে। লাবন্য র ভীষণ লজ্জা করছিল।

  ললিত ন টায় অফিস চলে গেল। দাঁড়িয়ে আড়াল থেকে লাবন্য দেখছিল। অফিস গিয়ে ওর খাওয়া হয়েছে কি না, ছেলে কি করছে জানতে দু তিন বার ফোন করেছে।

শীতের রাতে বাড়ী ফিরতেই লাবন্য হাত পা ধোয়ার জন্য গরম জল আনলো। নিজের হাতে এগ চাউ করে রেখেছিল। হাত পা ধুতেই খাবার নিয়ে হাজির হল। কোন বেশি কথা বলত না।

 ললিত জানতে চাইলো তোমার বা আমার সোনার কোন অসুবিধে হয়নি তো?

লাবন্য বললো না মা, কাজের মাসী ও আমার খোকার বেশ খেয়াল রাখে । কিন্তু তুমি...

তুমি কি? না থাক।

ললিত এমনি ছেলের কাছে গিয়ে ওকে আদর করতে করতে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে দু জনে খেলতে লাগলো।

লাবন্যর মনটা খুশিতে ভরে উঠলো।

মনের মধ্যে দুশ্চিন্তার মেঘ কেটে গেল। ক দিনের মধ্যে ললিত ছেলেকে কি আপন করে নিয়েছে!

 সে রাতে লাবন্য তার পুরনো জীবন ফিরে পেল। মরা গাঙে বান ডাকলো।

কূল ছাপিয়ে জল বাইতে লাগলো। নিজেকে উজাড় করে ললিতের হতে সমর্পন করে দিল।









*******************************************************************************************


যুগল কিশোর দাস অধিকারী

 অবসর প্রাপ্ত কর্মচারী। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ফাইন্যান্স অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস ইনচার্জ ছিলেন। ২০২১ এ অবসর গ্রহণ করেছেন। শিক্ষা M  Com, B Ed, Foreign Trade Mgt  । বর্তমান লেখালেখি বাগান, ও কিছু সমাজসেবা মূলক কাজ করেন

গল্প * প্রদীপ কুমার দে





এমিলির বিশ্বাস

প্রদীপ কুমার দে


শনিবার এখানে ছুটির দিন। অধিকাংশ অফিস বন্ধ থাকে। রাজপুত্র আর রাজকুমারীরা ঘোরাঘুরি করে আর প্রকাশ্যে মাঠে ঘাটে বসে একে অন্যের কাঁধে মাথা রেখে বিশ্রামের দিন অতিবাহিত করে।

আর এই বিশ্রামের জন্য বে;শ ভাল মজুরি দিতে হয় এমিলিকে।

লন্ডন থেকে বেঙ্গালুরু এসেছিল সে সফটওয়্যার ট্রেনিং কোর্স করতে। কোর্স শেষে প্লেসমেন্ট এর বাহানা ছিল। ক্লাসেই পরিচয় হয় মান্টুর সাথে।  মান্টু হল বাবা মায়ের অবাধ্য সন্তান। পলিটিক্স করে, ঝামেলা বাঁধাতে ওস্তাদ। নিজের বিষয়ে খুব সজাগ আদায় করে নিতে জানে। এমিলিকে দেখেই তার মনে লাগে।

এনিলিকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। এমিলি এত কিছু বোঝে না। মান্টুর উদ্দাম উচ্ছ্বাস দেখে। মান্টুর লোভনীয় ফাঁদে পা দিয়ে ফেলে।

মান্টু শয়তান। হাজারো মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রাখে। ধরে,কাজ সারে ছেড়ে দেয়। ঘুড়ি যেমন করে ওড়ায় তেমন করে সুতা ছেড়ে ওড়ায় তারপর সুতা টেনে নামায় অথবা সুতা ছিঁড়ে ভোকাট্টা করে উড়িয়ে দেয়।

মেয়েরা মান্টুর বাহ্যিক রূপ আর পয়সায় মাতে। এমিলি বহিরাগত। সে এখানকার হালচাল বোঝে না। মান্টু কোর্স চলাকালীন ভদ্র ব্যবহারে এমিলির মন জয় করে। এমিলি খুব খুশী। তার কিশোরী মনে প্রেমের বিশাল প্রভাব পড়ে। 

কোর্স শেষে মান্টু তার পরিবারের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে একটা চাকরি জুটিয়ে নেয়। এমিলি এখনই চাকরি করতে রাজী নয়। সে চায় একবার লন্ডনে ফিরে যেতে। পাকা ডিসিশন পরে নিতে চায়। কাজ সে করবে তবে তা ইন্ডিয়ায় না লন্ডনে তা বলা বড় শক্ত।

এমিলি মান্টুকে জানায়,

--  এখনি চাকরি নিও না আমার সাথে চল আমাদের বাড়ি। সব জানাই তারপর না হোক চিন্তা কর।

মান্টু চালাক, তার মাথায় অনু মজা। এমিলিকে বোকা পেয়ে যথেচ্ছ ব্যবহার করা হয়ে গেছে। এখন নতুন মুরগি ধরেছে। তাই এমিলিকে বোঝায়,

--  সে কি করে হয়। তারচেয়ে তুমি লন্ডন ঘুরে এস। বাপ মাকে জানাও। আমি অপেক্ষা করবো। ফিরে এলে দুজনায় রেজেষ্টি করে নেব। নতুন চাকরি ছেড়ে লাভ নেই।

এমিলি কাঁদে। অনেক বোঝায়। হার মানে। উপরন্তু মান্টু একপ্রকার ভুলভাল বুঝিয়ে লন্ডনে ফেরত পাঠায়।

মান্টু বেঙ্গালুরু ছাড়ে। সঙ্গিনীর অভাব নেই। বাপের টাকায় অন্যত্র পাড়ি দেয়। বাপকে মানে না কিন্তু তার অর্থেই রোয়াব দেখায়। 

অন্যদিকে এমিলি লন্ডন ফিরে দেখে ইন্টারন্যাশনাল কলে মান্টু বেপাত্তা। বারাবার মান্টুকে খোঁজে, নিরাশ হয়ে ভয় পেয়ে যায়। ভয় পায় মান্তুর বিপদের আশংকায়। ছটফট করে তা ভালোবাসা। কিশোরী মনের মতই তার এই ছটফটে প্রেম।

বাবা মা কে সিব জানিয়ে ফিরে আসে বেঙ্গালুরু। পরিচিত স্থল, কোম্পানি , বন্ধু বান্ধব সব খুঁজে ফেরে কিন্তু মান্টু নেই। সে যেন হাওয়ায় হারিয়ে গেল। উবে গেল। তবুও বিশ্বাস রাখে, হন্যে হয়ে খোঁজ চালায় অবিরত দিনরাত!

আজও সেই সদ্য যুবতী এমিলি বসে অপেক্ষায় থাকে তার মলিন বেশে, উস্কখুস্ক চুলে, অসহায় অবস্থায় নির্লিপ্ততার দৃষ্টি মেলে রাখে দৃশ্যপটে যদি পার্কের গেটে মান্টুর পদচারণা দেখতে পায়!

বড় করুণ সে দৃশ্য!

আজ শনিবার। ছুটির দিন। বিকাল থেকেই পার্কে অবস্থানরত সব জোড়ায় জোড়ায় ঘনিষ্ঠ প্রেমিক প্রেমিকারা। 

এমিলি ই শুধু একা!

এ দৃশ্য বড় অসহনীয় এবং বেদনাদায়ক।

পরিচিত জনের থেকেই সব শোনা।



***********************************************************************************************************



প্রদীপ কুমার দে 

লেখক  নেশায়। পেশা ছিল হিসেবনিকেশ।  বয়স -৬২ । কলকাতা নিবাসী। বিবাহিত।
নিজের লেখা কয়েকটি বই আছে।


গল্প * মল্লিকা রায়




আততায়ী 

মল্লিকা রায়



রাত হলে পোড়ো প্রাসাদ থেকে ভেসে আসে শব্দ! সিন্দুকের কোণে ও কী? চমকে গেল পুলিশ এক সময় বাঁকুড়ার কালীতলা এলাকার বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের বাড়ি দেখতে আসতেন অনেকে। তিনতলা বিশাল ওই বাড়িটি স্থানীয়দের কাছে ‘রাজবাড়ি’ নামেই পরিচিত ওই বাড়ি তদন্ত করতে গিয়ে ঘরে ঢুকে সিন্দুকের পাশে হাড়গোড়, মাথার খুলি পেল পুলিশ।

কয়েক দিন ধরেই আতঙ্কে ভুগছিলেন স্থানীয়রা। রাত হলেই পরিত্যক্ত প্রাসাদোপম বাড়ি থেকে ভেসে আসে নানা অদ্ভুত শব্দ। কারা যেন রাতের অন্ধকারে যাতায়াত করে। সেই রহস্য ভেদ করতে গিয়ে চোখ ছানাবড়া হল সকলের। চমকে গেল পুলিশও। বাঁকুড়া সদর থানা এলাকার ঘটনা।এক সময় বাঁকুড়ার কালীতলা এলাকার বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের বাড়ি দেখতে আসতেন অনেকে। বাড়িটির নাম ‘প্রতিচী’। সেই নামকরণ নাকি করেছিলেন সাংবাদিক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। ওই পরিবারের সদস্যরা এখন কর্মসূত্রে নানা জায়গায় রয়েছেন। বিশাল বাড়িটি এখন পরিত্যক্ত। দিন কয়েক ধরেই প্রতিবেশীরা প্রতি রাতেই শুনতে পেতেন কেউ বা কারা যেন ওই বাড়িতে আসা যাওয়া করছে। বাড়ির বিভিন্ন অংশে ভাঙচুরের আওয়াজও শুনেছেন কেউ কেউ। কিন্তু তালাবন্ধ বাড়িতে রাতের অন্ধকারে কে যাতায়াত করছে? উদ্দেশ্যই বা কী? কৌতূহল নিরসন করতে সোমবার সকালে কয়েক জন প্রতিবেশী বাড়ির সদর দরজার তালা খুলে ভিতরে ঢোকেন। কিন্তু বাড়িতে ঢুকেই ঝটকা। তাঁরা দেখেন বাড়ির উঠোনে কাত হয়ে পড়ে আছে একটি পুরনো সিন্দুক। ভাঙা দরজার ভেতর দিয়ে বাড়ির একতলার একটি কক্ষে চোখ যেতেই শিউরে ওঠেন সবাই। দেখা যায় একটি তক্তার উপর পড়ে হাড়গোড়। ওগুলো কি মানুষের? আতঙ্ক এবং আশঙ্কায় স্থানীয়রা খবর দেন বাঁকুড়া সদর থানায়। পুলিশ এসে উদ্ধার করে হাড়গোড় এবং মাথার খুলি। সেগুলো ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয় বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজে।

এ ঘটনা প্রসঙ্গে প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, “১০ বছর ধরে ওই বাড়িতে কোনও লোকজন থাকেন না। ৩ বছর ওই বাড়িতে কেউ ঢোকেননি। মাঝেমধ্যেই দুষ্কৃতীরা ওই বাড়ির পাঁচিল ডিঙিয়ে ঢোকে। বাড়ির দরজা-জানালা থেকে শুরু করে রড সমস্ত কিছুই প্রায় চুরি হয়ে গিয়েছে। মঙ্গলবার বাড়ি‌তে ঢুকে পুলিশ একটি পুরাতন ভাঙা চোরা কাঠের বাক্সের পাশে বেশ কিছু হাড়গোড় উদ্ধার করে। বাঁকুড়া জেলা পুলিশের এক পদস্থ আধিকারিক বলেন, “হাড়গোড়গুলি মানুষের কি না তা জানতে ময়নাতদন্তে পাঠানো হয়েছে। প্রয়োজনে ফরেন্সিক পরীক্ষাও করানো হতে পারে। ওই বাড়ির উপর বিশেষ নজর রাখা হচ্ছে।”


আততায়ী :


'বাকুড়ার পুলিশ প্ৰশাসনের আৰ্জি মোতাবেক আমি এই পোড়ো বাড়ির দরজার তালা ভাঙছি, আপনারাও আমার সঙ্গে থাকুন - এগিয়ে গেলেন বহুজীর্ণ ভাঙা চোরা পরিত্যাক্ত তিনতলা বাড়িটার দিকে মি: প্রকাশ গোয়েঙ্কা। পেছনে সহকারী দু'জন ডিস্যুজা গর্গ ও মিঠু পাকড়াশি, দুজনেই সাহসী এসিস্টেন্ট। বছৱ পাঁচেক হল মি: প্রকাশের সহকারী হিসেবে ট্ৰেনিংয়ে আছে। ডিস্যুজা গর্গ ইউরোপবাসী এডভেঞ্চার নিয়ে এডিনবাৰ্গের স্কলার, সঙ্গী মিঠু ভারতীয় হলেও পড়াশুনা জীবনের শৈশব থেকে ট্যোটাল সময়টা ধনী গ্রান্ড গ্রান্ডির সঙ্গে ইউরোপে পাৰ্লেতে কাটিয়েছেন পড়েছেন একই কালেজে ।

তিনজনেই প্রবেশ করেন ঘরের ভেতর একঝাঁক বাদুরের ডানা ঝাপটানি মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল সহসা, মাকড়সার জালে দুই হাত সন্তরণরত জড়িয়ে যাচ্ছে শরীরের উৰ্ধাংশ, মুখ মাথা কে যেন কুয়াশাবৃত জালে জড়িয়ে বেঁধে ফেলতে চাইছে সহসা।বেলা এগাৱোটা, পুরাণো আসবাবের ও আবৰ্জনার গন্ধে গুলিয়ে উঠছে সৰ্ব শরীর,দ্বিতীয় ঘরটিও তদ্ৰুপ বেশ দামী সেগুণ কাঠের পালঙ্ক, দরজা জানালা বন্ধ, মাক্স ভেদ করেও বিশ্রী গন্ধ লাগছে নাকে। কব্জা ধরে টান দিতেই হুড়মুড় কৱে উড়ে গেল খেচর জাতীয় কিছু, হাতে ছোট লাঠি নিয়ে আপ্রাণ জাল সরিয়ে এগোতে হচ্ছে ক্রমে। 

'কুইক গর্গ' মৃদু অথচ চাপা কন্ঠে হাতের লাঠিটি উচিয়ে নিৰ্দেশ দিলেন মি: গোয়েঙ্কা।

'লুকস দ্যসট দ্য ওপেন উডেন বক্স, মনে হচ্ছে বহু শতাব্দী পুরোণো, আশে পাশে কি এসব ?

'ওহ্ হারি কাম অন' মাথার খুলি,হাড় গোড়,নখ,দাঁত

দেখতে পাচ্ছ তোমরা ?

'অব কোর্স স্যার ,এটা একটা মানুষের কঙ্কাল এবং শোয়ানো অবস্থায় রয়েছে, অর্থাৎ একজন মানুষ,হতেও পারে বাক্সের গয়না সম্পদ লুঠ করে আততায়ী খুন করে ফেলে রেখে পালিয়েছে টের পায়নি কেউই ,কেসটা কিন্তু স্যার কম করে হলেও তিন যুগেরও বেশি এবং বাক্সটি কাঠ ও আয়রণ মিশ্ৰিত।

'হুম্ কিন্তু আশ্চৰ্যের বিষয় হল বাক্স ও মৃতদেহটি খাটের ওপরে জানলার কাছেই উপুর করে রাখা হয়েছে কেন, স্ট্ৰেঞ্জ'!

'আমার মনে হয় স্যার ইটস নাথিং বাট এন ইস্টিংট টেনাসিটি অফ্ দ্যসট ক্রিমিন্যাল' জানায় গর্গ।

'য়্যু আর এ জিনিয়াস' একরাশ বিশৃঙ্খল কেশরাশির মধ্যে মাথায় হাত রেখে ঝাঁকুনি মি: গোয়েঙ্কার। বরাবরই তোমার এই তাৎক্ষণিক ধারালো বুদ্ধির আমি প্রশংসা করি , বি কেয়ারফুল মাই বয় '!

'ওহ্ থ্যাঙ্ক য়্যু স্যার'

বাড়িটির নাম 'প্ৰতিচী' সাদা পাথরে খোদাই করা বাইরের প্ৰবেশ দরজার বাম পাশে, নামের দু'পাশে দুটি সরু লতা ,এর অৰ্থ বাড়ির মালিক জমিদার অংশুমান সাহা মাল্টিপ্লেক্স বিসনেস ম্যানই শুধু নন একজন শৌখিন মানুষও ছিলেন। বাড়ির সমুখভাগ বেলজিয়াম কাঁচে ঘেরা সূক্ষ্ম সাদা কারুকার্য মন্ডিত ফ্রেমে সাজানো,ভেঙে গিয়েছে বেশ কিছু কাঁচ,ফ্রেম নষ্ট হয়েছে জৌলুস, ডানপাশে সুন্দর সাজানো বাগান,সুইমিং পুলসহ ছোট শুকনো,ভাঙা চোরা,একরাশ বন্য গাছ গাছালিৱ ঔদ্ধত্যে ভরপুর।একসময় বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেত না জমিদার অংশুমানের ভয়ে। বাঁকুড়া শহরটিকে ভেঙে চুরে সাজিয়েছিলেন নিজের সাধ্যমত। অতিথি নিবাস,বড় রাস্তা, সদর শহর, ইস্কুল,কলেজ, ছাত্ৰাবাস,অফিস আদালত, রেল স্টেষণ,মেট্ৰো,মাল্টিপ্লেক্স দোকান বাজার, শোরুম ইত্যাদিতে সাজিয়ে তুলেছিলেন গোটা শহরটাকে। এই ছিল জমিদার অংশুমান সাহার আপাত পরিচয়। স্ত্ৰীর মৃত্যুর পর তিন ছেলে নাতি,নাতনীসহ সকলেই কর্মসূত্রে জাপান ও অস্ট্ৰেলিয়ায় অবস্থাণরত। বহু চেষ্টা করেও একসাথে বিদেশে বসবাসের আবেদন জানিয়েও হতাশ হয়ে ফিরে গেছে ওরা। আসেননি কেউই প্ৰায় বহুবছর। শহরের এক প্ৰান্তে বিদ্ধস্ত পরে থাকা বাড়িটি আশেপাশে প্ৰতিবেশী গৃহস্থদের মনে এক আতঙ্কের সৃষ্টি করে। বেশিরভাগ মানুষের অভিযোগ রাত হলেই বাড়িটিতে প্ৰবেশ করে বহু মানুষ ,মাথা মুখ ঢাকা ওদের কাছ থেকে দেখেনি কেউ কখনও। শোনা যায় বাড়ির বিভিন্ন অংশের ভাঙচুরের আঁওয়াজ, ঘুঙুর পায়ে নৃত্যের আঁওয়াজ। চুরি হয়ে গেছে ছাদের লোহার রডের অবশিষ্টাংশ, দরজা জানালার পাল্লা ইত্যাদি । পাড়া প্ৰতিবেশি আতঙ্কিত ও ভয়ার্ত। তালাবন্ধ ঘরে কে ঢোকে ,কেনইবা ঢোকে সকলেই কৌতূহলী। প্রায় প্রতিদিনই পেছনের পাঁচিল টপকে তালা খুলে ঘরে ঢোকে বেশ কিছু মানুষ লক্ষ্য করেছেন অনেকেই কিন্তু ,সামনে এসে ধরে ফেলবার সাহস হয়নি কারোরই। একসময় প্ৰাসাদোপম বাড়িটি এলাকার বিখ্যাত বাড়ি হিসেবে নাম ডাকও ছিল খুব। বহু সাংবাদিক জনসাধারণ দেখতে আসতেন, ভবনটির সৌন্দৰ্য্যে মুগ্ধ হতেন । বিদেশি গ্লাস টালি মাৰ্বলে খচিত নিঁপুন শিল্পশৈলীর ভাস্কৰ্যে অবাক হতেন অনেকেই। 

কিন্তু এসব কি ঘটছে ইদানিং ? রাতের অন্ধকারে ওরা কারা, ঢুকছে ফাঁকা বাড়িতে তালা খুলে? উদ্দেশ্যই বা কি ওদের ? আতঙ্কিত হয়ে দু' একজন খবর দেন স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে। পুলিশ এসে তদন্ত করার পর দায়িত্ব দেওয়া হয় ডিটেক্টিভ মি: প্রকাশ গোয়েঙ্কার গ্ৰুপকে।


'তাহলে স্যার মোটামুটি ক্লিয়ার' প্ৰশ্ন গর্গের।

'তিনভাগ, ইটস আ মাৰ্ডার কেস এন্ড টোট্যালি কুল মাৰ্ডার। কিন্তু প্ৰশ্ন হল কে সেই আততায়ী ? কিভাবেই বা সম্ভব তাকে সনাক্তকরণ ? ভাবো ভাবো গর্গ এন্ড মিস্ মিঠু। ভাবো !

এরপর নিৰ্দেশ আসে মন্ত্ৰী মহল থেকে, নড়েচড়ে বসেন বাঁকুড়া সন্মিলনীৱ মেডিক্যাল গ্রুপ। মৃতের হাড়,দাঁত,নখ,চুল ইত্যাদি নিয়ে চালানো হয় দীর্ঘ গবেষণা।

দীর্ঘ এক সপ্তাহ পর হাতে আসে ফরেন্সিক রিপোর্ট 

সুন্দর দু'পাটি দাঁত অক্ষত কোথাও কোন আঁকাবাকা নেই শুধুমাত্র নিচের পাটির জোড়া দাঁত সোনায় বাঁধানো। সেকেলে দেরাজ ভেঙে পাওয়া যায় দীর্ঘ আটাত্তর বছরের জীবনে মাত্ৰ তিন বার অপারেশন হয়েছে তার প্রথমবার পরে গিয়ে কাঁধ ও বাহুর সংযোগস্থলের হাড় ভেঙে গেলে ,দ্বিতীয়বার হার্ট ব্লকেজে ছোট্ট একটা অপারেশন পেসমেকার নিতে হয়নি রেস্ট্রিকশনে থাকতে বলা হয়েছিল। 

সবশেষে দাঁত, শৌখিন মানুষ হিসেবে নিচের পাটির একজোড়া দাঁত সোনায় বাঁধান শখ করেই। প্ৰাণখুলে হাসলে অসাধারণ সুন্দর দেখাত তাকে। পাওয়া গেছে ফাইলবন্দী সমস্ত রিপোর্ট। ফলে সহজসাধ্য ইনভেষ্টিগেশনে সুবিধা হয়েছে অনেকটা।

সময়টা প্ৰায় দুই দশক,সার্জারির এত পরিমাণ উন্নত পরিকাঠামো না থাকলেও শহরের জমিদার হিসেবে বিদেশ থেকে আনানো হয় চিকিৎসক এবং চিকিৎসার সমস্ত সরঞ্জাম।এছাড়া সমস্তক্ষণ দেখভাল খাবার তৈরী ও ঘরদোরের সাফাই সংক্ৰান্ত সমস্ত কাজই করত স্থানীয় ওই কেয়ারটেকারের (মনোজ) বাড়ির লোকজন। বেঁচে আছে তার নাতি পুতির বংশধরেরা। ভাসা ভাসা জানা যায় তাদের কাছ থেকেই। প্রায়ই তাদের পরিবারের আত্মীয় স্বজনের যাতায়াত ছিল ওই বাড়িতে বৃদ্ধের খোঁজ খবর নেবার জন্য।


রাত দু'টো, একদল কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দের গগনবিদারী কান্না রাতের অন্ধকার চিরে ভয়াবহ হয়ে উঠছে।ঘুম ভেঙে চেঁচিয়ে উঠছে একদল রাতপাখি।

আচমকা পেছন থেকে মুখ চেপে ধরেছে কেউ,হাত মুখ ঢাকা -

'দাদু ও দাদু,ভয় পেওনা গো, যাও পেচ্ছাবটা করে নাও আর তারপর - তুমি আর আমি, আমি আর তুমি ,দারুণ তাই না দাদু'

ঘুমের ঘোর কাটেনি তখনও,জিরো পাওয়ারের আবছা আলোতে লক্ষ্য করেন কে একজন ছোকড়া মত - ভাবলেন মদনা বুঝি। শরীর খারাপ শুনে দেখতে এসেছে ,আহা কি ভালো ছেলেটা।

ভয়ংকর চেচাচ্ছে কুকুরগুলো, বুকের ভেতরটা ছ্যাত্ করে উঠছে , হাউউউউউউ, অমন করে কাঁদছে কেন কুকুরগুলো ! শুনেছিলেন প্রাণীরাই প্রথম টের পায় বিপদ আপদ। কি জানি !

'কে মদনা ? কখন এলি ? বেশ করেছিস শরীরটা খুব  খারাপ হয়েছে বুঝলি'

- হু, জানি তো। সংক্ষিপ্ত উত্তর আগন্তুকের।

হালকা আলোয় ভেসে যাচ্ছে 'প্ৰতিচী'র বিলাসী অন্দরমহল, ঘন্টায় ঘন্টায় নেচে উঠছে মিশরীয় সঙ্গমরত ব্ৰোঞ্জ মূর্তিগুলিতে নেপাল থেকে আনা মিউজিক ঘড়িগুলি। অদ্ভুত আলোর ফোকাস ছড়িয়ে পরছে সমস্ত দেওয়াল জুড়ে। প্ৰথম প্ৰথম গুরবক্ত সিংয়ের পরিবার নিচেই গেস্টরুমে থাকত, ফাইফরমাশ খাটত বৌটা, ছেলেটাকে নিয়ে মেতে থাকতেন অংশুমান, গাড়ি করে স্কুলে দিয়ে আসা নিয়ে আসা, বিকেলে পাৰ্কে ময়দানে ব্যাডমিন্টন, ফুটবল নিয়ে উচ্ছ্বাসে মেতে উঠতেন তিনি। সন্দেহ হত গুরবক্তের। এত আদিখ্যেতা কেন বুড়োর।সুন্দরী বৌটাকে আবার মনে ধরে নি তো। হিরহির করে চুলের মুঠি ধরে ঘরে টেনে এনে দোর দিয়ে জম্মের পেটান পিটিয়ে সাধ মিটত লোকটার। 

কি ছিলনা - ড্রাইভার, রাঁধুনী, নোকর,চাকর,মালী সব সকলেই চেয়ে থাকত মালিনীর সুন্দর মুখের দিকে। মালকিনের আশীৰ্বাদ একটু যদি পাওয়া যায়। তিন দিনের জ্বরে বিদায় নিলেন অকস্মাৎই। 

একা হয়ে গেলেন জমিদার অংশুমান সাহা,ধীরে ধীরে চড়তে থাকল মেজাজ, বদ রাগ।বৌমনির মৃত্যুর পর ব্যবহার নিষ্ঠুর হলে পালাতে থাকল কাজের লোকজন।


'কি হল দাদু, কাগজ কলমটা তো-ল, সইটা লাগবে তো'

ভোর চারটের আজান শুরু হল। অদ্ভুত কালো মুখোশে ঢাকা লোকটাকে ঠাহর করতে পারেননি তখনও। কিছুই নেই হাতের কাছে, ফোনটা পর্যন্ত। বিস্ময়ে চেয়ে থাকেন ওর মুখের দিকে।

হঠাৎই আঁওয়াজ মাথায়, চোখে অন্ধকার নেমে আসে বনবন ঘুরে ওঠে মাথাটা,ঝাপসা হয়ে আসে দৃষ্টি।

শুতেও পারেননি তখনও বসেই ছিলেন, ভাবছিলেন বুঝি ভয় দেখাচ্ছে ছেলেটা এক্ষুনি বেড়িয়ে যাবে নিশ্চয়ই। ধপ্ করে শুয়ে গেলেন বিছানায়।

আবারও আঁওয়াজ। থরথর কেঁপে উঠল হাতের পায়ের আঙুলসহ সর্ব শরীরটা,নড়ে উঠল ঠোঁটজোড়া। আর একটা কোপ, এটাও মাথায় সরাসরি। নিস্তেজ হল সমস্ত জ্বালা,যন্ত্ৰণা সব। এরপর তিন প্যাঁচ ঘোরাতেই খুলে গেল সিন্দুকটা। সবকিছু গুছিয়ে বাক্সটি উল্টো করে মৃতের মাথার কাছে রাখা হল, মৃতের শরীর থেকে বয়ে যাওয়া রক্ত মুছিয়ে টানটান করে শুইয়ে গায়ে জড়িয়ে হালকা চাদরে ঢেকে ঢাউস ট্ৰাভেল ব্যাগ পিঠে নিয়ে আবছা অন্ধকারে মিলিয়ে গেল মাথা মুখ ঢাকা ছায়া মূৰ্তিটি।


'কিহল মিঠু, এম আই রাইট'? হঠাৎ চমকে উঠল সকলেই যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল - 

'সেন্ট পারসেন্ট স্যার' কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে উত্তর দিল মিস মিঠু। থমথমে পরিবেশ সকলেই ভারাক্ৰান্ত।


এর বেশ কিছু বছর পর তালাবন্ধ ঐ ঘরে তালা ভেঙে জবর দখল করে কিছু দুষ্কৃতি,চোর, কেউ নিরাপদে গাঁজা,ভাঙ সেবনের উদ্দেশ্যে কেউ খারাপ কিছু কাজের উদ্দেশ্যে, কেউ পুলিশের চোখ এরিয়ে নিরাপদে জুয়ার ঠেক বসাতে।রাতভোর স্ফূৰ্তি করে কেউ কেটে পরত মধ্য রাতে, কেউ ঢুকত মধ্যরাতে মেয়েছেলে নিয়ে।চাবিটা কিন্তু থাকত পাড়ারই এক ঠেক কারোবারীর কাছে। গ্রামের মানুষের তৎপরতায় দীর্ঘ সময় পরে ধরা পরে পুরো গ্যাংটাই।

জায়গা জমি বাড়ি ঘর বিক্ৰী করে কেয়ারটেকার রাতারাতি পালায় গাঁও ছেড়ে। বৰ্তমানে সে দিল্লীর এক প্ৰাসাদোপম ভিলার মালিক। মাল্টিপ্লেক্সের একাধিক ব্যাবসার নাম মনোজ এন্ড কোম্পানী । সপ্তাহে দুই তিনবার দুবাই,সিঙ্গাপুর ইংল্যান্ডে যাতায়াত করতে হয় তাকে ব্যাবসার খাতিরে। 


এক্ষণে প্ৰমাণাভাবে অট্টালিকাটি অধিগ্ৰহণ করে রাজ্য সরকার।


*********************************************************************************************



মল্লিকা রায়

প্রিয় নেশা: লেখালেখি
ব‌ই প্রকাশের সংখ্যা ২ টি একটি কবিতার অপরটি তিনটি উপন্যাস নিয়ে একক ব‌ই। এছাড়া ষান্মাষিক সাহিত্য পত্রিকা পদক্ষেপের সম্পাদিকা।