বুধবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৩

উপন্যাস * বিশ্বনাথ পাল




[ 'স্বরবর্ণ * ১২ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে বিশ্বনাথ পালের ধারাবাহিক উপন্যাস 'বামনের চন্দ্রাভিযান'। উপেক্ষা, অনাদর আর দারিদ্র্যের তীব্র দংশনজ্বালা দাঁতে দাঁত চেপে, একটি যুবক কী ভাবে একক নিঃসঙ্গ লড়াইয়ে জীবনের সাফল্য ছিনিয়ে আনে, এই উপন্যাস তারই জীবন্ত আখ্যান। লক্ষ লক্ষ  বেকার যুবকের বেকারত্বের জ্বালার বাণীরূপই শুধু নয়, তা থেকে উত্তরণের অমোঘ বিশল্যকরণীও বটে এই উপন্যাস।]


বামনের চন্দ্রাভিযান 

পর্ব * 

বিশ্বনাথ পাল

সাত  

পুরুষ মানুষের হাতে যদি বলার মতো কাজ না থাকে, তাহলে তার একটা আইডেনটিটি ক্রাইসিস তৈরি হয়। আমার এই আত্মসংকট ছিলই। বন্ধুবান্ধবদের অনেকেই প্রতিষ্ঠিত। রাস্তাঘাটে কোনও পরিচিত মানুষজনের সঙ্গে দেখা হয়ে কথাবার্তা শুরু হলে এক অবধারিত প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। কী করি। বলতাম, “টিউশনি করছি।” এরপর একটা বাউন্সার ধেয়ে আসত। এম. এস-সি. পাশ করেও বেকার? কী বলব এর উত্তরে ভেবে পেতাম না। গতানুগতিক শিক্ষাগত যোগ্যতার যে কাজের বাজারে খুব একটা মূল্য নেই তা কে বোঝাবে! এদিকে টিউশনি করেও তো বহু মানুষ সংসার প্রতিপালন করে, কিন্তু সে সময় সমাজ তাকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনতে চাইত না। যদিও টিউশনিকে পাকাপাকি পেশা করার রাস্তায় আমি ছিলাম না। 

মৌমিতার সঙ্গে আলগা যোগাযোগ ছিল। মাঝেমধ্যে ফোন করতাম কোনও দোকানের থেকে। কখনও অনেকদিন পরে ফোন করলে পর ও নিজে থেকেই বলত, “অনেকদিন আসিস না, একদিন আসিস।”

এম. এস-সি.-তে ও খুব ভাল রেজাল্ট করেছিল। সাতান্ন শতাংশ নম্বর পেয়েছিল। পাশ করার সঙ্গে সঙ্গেই একটা বাংলা স্যাটেলাইট চ্যানেলে চাকরি পেয়ে যায়। আমি তখন চাকরি পাওয়া লোকজনদের থেকে শত হস্ত দূরে থাকি। এই দূরত্ব নিজের সম্মান বা আত্মরক্ষার একটা উপায়। কিন্তু মৌমিতা যখন বলত, ‘একদিন আসিস’— কী যেন থাকত সেই গলায়। এড়াতে পারতাম না। সাইকেল চালিয়ে ওদের নেতাজীনগরের বাড়িতে যেতাম। কিন্তু গিয়ে দেখতাম— কোথায় কী! মৌমিতা তো সেভাবে গল্প করছে না। আমি একাই বকবক করছি। ফলে খুব অভিমান হত।

এরই মধ্যে একদিন মৌমিতাকে ফোন করলাম। দুয়েকটা কথার পর ও বলল, “অ্যাই শোন, আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।”

বললাম, “প্রেম করে?”

“না, আলাপ করে।”

আমি কিছুক্ষণ চুপ থাকায় ও আবার বলল, “তুই আসবি তো?”

বললাম, “না।”

যতই বন্ধুর ভূমিকা পালন করি, বিয়ে দেখার কষ্ট নিতে পারতাম না।

মৌমিতা আমার কাছে ওর যে ভাবমূর্তি তৈরি করেছিল তা হল প্রেম-বিয়ে করে ঘর-সংসার করা ওর কম্ম নয়। ওর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য সিনেমা তৈরি করা। চিত্রপরিচালক হওয়ার স্বম্ন দেখত ও। মৌমিতার কথাবার্তায় মাঝেমধ্যে মনে হত কী সব দুঃখ যেন ওর ভিতরে ঘুমন্ত লাভার মতো শায়িত আছে। আবার মাঝেমধ্যে মনে হয়েছে, মেয়েটা হয়তো ভীষণ কামশীতল। সেই কারণেই প্রেমের ধার মারায় না। আবার মনে হয়েছে আমি গরিব বলেই প্রেমিকের যোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ। প্রেমও হয়তো পাটিগণিত মেনেই চলে। যাইহোক সেই মৌমিতা বিয়ে করছে। নেমতন্নটা মিস হল। তবে এবার থেকে একটি মেয়েকে নিয়ে অন্তত আর ভাবতে হবে না। নেক্সট?


বোড়াল গ্রামে সেনদিঘি বলে আমার একটা প্রিয় জায়গা ছিল। বল্লাল সেনের আমলে নাকি ওই দিঘিটা খনন করা হয়েছিল। দিঘিটাকে বাঁদিকে রেখে কিছুটা এগিয়ে গেলে ত্রিপুরসুন্দরীর মন্দির। মন্দির সংলগ্ন চত্বরে একটা বটগাছ। গাছটার গোড়ায় বাঁধানো বেদী। অজস্র ঝুরি নেমে  স্থানটাকে খানিক রহস্যময় করেছে। ঝুরিতে ঝুলছে লাল সুতোয় অজস্র মানতের ঢিল। কী জানি আমিও কি ওই গাছে কোনও লাল সুতো বেঁধেছিলাম চাকরি পাওয়ার মনস্কামনায়? মনে পড়ে না। কে বা কারা যে ছোটবেলায় আমাকে ওই জায়গাটা চিনিয়েছিল আজ আর মনে নেই। তবে শীতকালে কিছুদিন শরীরচর্চার টানে বেশ পাড়ার বড়দের সঙ্গে দৌড়তাম ভোরে উঠে। দৌড়ে কিংবা হেঁটে একদিন চলে গিয়েছিলাম ত্রিপুরসুন্দরীর মন্দির। ওই দিকটা তখনও গ্রাম-গ্রাম। কোনও খেতের থেকে কেউ একজন গাজর তুলে দিয়েছিল খেতে। আবছা মনে পড়ে। আরও কিছুদূর গেলে বকুলতলার মাঠ। সেখানে চৈত্রসংক্রান্তিতে গাজনের মেলা বসে। মাঠের পাশে পুকুরের ধারে একটা বিরাট বকুল গাছ। এখন আর সেই গাছটা নেই, কেটে দিয়েছে। জায়গাটার নাম তবে সেই বকুল গাছের নামে থেকে গেছে। মাঠের এক প্রান্তে টেরাকোটার আটচালা জোড়া  শিব মন্দির। মন্দিরের গায়ে লেখা ১৬৭৮ শকাব্দ। অর্থাৎ প্রায় আড়াইশো বছরের পুরনো ভগ্নপ্রায় মন্দিরটিও আমার বিস্ময় সৃষ্টিকারী অন্যতম দ্রষ্টব্য ছিল। মন্দিরের গায়ে আগাছা, বট-অশত্থের শিকড়, পিছনে জঙ্গল। মন্দিরের ইট নোনাধরা। কিন্তু ওই মন্দিরের সামনে দাঁড়ালে  আমার কেমন গা ছমছম রহস্যময় ভাল লাগার অনুভূতি হত। পরে সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ সিনেমা খুব মন দিয়ে দেখে ওই জোরা মন্দিরের অস্তিত্ব আমি এক ঝলকের জন্য আবিষ্কার করেছিলাম। বকুলতলার মাঠের উল্টোদিকে একটা পায়ে চলা পথে কিছুটা গেলেই সত্যজিৎ রায়ের আবক্ষ মূর্তি। ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত। পথের পাঁচালী নামের একটি সংগঠন  প্রতিষ্ঠা করে। পাশেই হরিহরের বাড়ি। মানে পথের পাঁচালী-র শ্যুটিঙে যে বাড়িকে হরিহরের বাড়ি দেখানো হয়েছিল। এইসব স্থানে সাইকেল নিয়ে যেতাম। একা একাই বেশি। আমার কেমন যেন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হত। কোথাও তো সেভাবে বেড়াতে যেতে পারিনি টাকার অভাবে। স্কুল থেকে শিক্ষামূলক ভ্রমণে নিয়ে যেত। আমাকে কখনও জিজ্ঞেসও করা হত না যাব কিনা। নির্ধারিত চাঁদা যে দিতে পারব না তা মুখ দেখেই বোঝা যেত। খাওয়া-পরার যাদের সমস্যা তাদের তো বেড়াতে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। 

সেনদিঘির পাড়ে কতদিন যে একা বসে থাকতাম। কত রকমের ভাবনা মনে ঢেউ তুলত। তখন আমার মনোজগতের নায়ক বিবেকানন্দ। মাধ্যমিক পাশের পর স্কুলের এক সহপাঠী  ইন্দ্রজিৎ আমাকে উদ্বোধন কার্যালয় প্রকাশিত বিবেকানন্দের একটি বই দিয়েছিল পড়তে। ‘আমার ভারত অমর ভারত’ নাম বইটার। বিবেকানন্দের রচনার নির্বাচিত অংশ। সেখানে অনেক জ্বালাময়ী বাণী আমার অন্তরে গভীর রেখাপাত করেছিল। পরে বইটা কিনেছিলাম। 

মন্দির বলতে যেমন আমাদের মনে ভক্তসমাগম, জনকোলাহল ভেসে ওঠে, ত্রিপুরসুন্দরীর মন্দির সেরকম নয়। বরং উল্টোটা। খুব নির্জন, নিস্তব্ধতার জন্য আমাকে টানত ওই চত্বর। নবরত্ন মন্দিরটি প্রায় পনেরো-ষোলো মিটার উচ্চতায়। মন্দিরে অষ্টধাতুর নির্মিত ত্রিপুরসুন্দরীর মূর্তি। মূল মূর্তিটি নাকি দারুবিগ্রহ ছিল। নাটমন্দিরটিও বেশ বড়। মন্দির সংলগ্ন একটি ঘরে ছিল সংগ্রহশালা। সেখানে বিভিন্নসময় বোড়াল গ্রামে খননের ফলে প্রাপ্ত পোড়ামাটির ইট, বাসনপত্র যত্ন করে সংরক্ষিত। মূল মন্দিরের পূর্ব দিকে আরও একটি ছোট মন্দির। সেখানে কালো কষ্টিপাথরে বিষ্ণুর অনন্তশয্যা। পিছনে ছাতার মতো ফনা ধরে বাসুকী। নীচে বেদীতে লেখা খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে নির্মিত। ফলে কোথাও বেড়াতে না যাওয়া আমার মনে বিস্ময়ের আনন্দ বইত। কল্পনা পাখা মেলত কোন অচীন প্রদেশে। বছরের কোনও এক নির্দিষ্ট দিনে মাঘী পূর্ণিমা না কোন তিথিতে যেন মন্দিরে উৎসব হত, ভোগ বিতরণ হত। তখন আর পাঁচটা মন্দিরের সঙ্গে এর পার্থক্য থাকত না। কিন্তু আমি তো সেসময় যেতাম না। 

সুধাংশু মুখোপাধ্যায়ের বই পড়ে পরে জেনেছি বোড়াল গ্রামের পাশ দিয়ে এক সময় প্রবাহিত হত প্রাচীন ভাগীরথীর স্রোত। গ্রামের উত্তর ও পশ্চিম দিক নদীর প্লাবনে ডুবে থাকত, মাঝেমধ্যে বাঁধ দিয়ে জল আটকানো হত, কিন্তু বাঁধ ছাপিয়ে জল গ্রামের নীচু জমি ডুবিয়ে দিত। ডুবে যাওয়াকে বলে ‘বুড়ে’ যাওয়া আর গ্রামের সীমানার বাঁধকে আলও বলা হত, সেই থেকে বুড়ে যাওয়া আল বা বোড়াল নামের উৎপত্তি। বোড়াল গ্রামের ঐতিহাসিক প্রাচীনত্ব প্রতিষ্ঠিত। জগদীশ ঘোষ নামে এক ব্যক্তির উদ্যোগে এখানে জঙ্গল কেটে বসতি শুরু হয়।  তিনিই জঙ্গলাকীর্ণ ইটের স্তূপ খনন করে ধ্বংসপ্রায় মন্দিরটির সন্ধান পান এবং সংস্কার করেন। মূল মন্দিরটি সম্ভবত ত্রয়োদশ শতকে সেন বংশের কোনও রাজা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

সেনদিঘির পাড়ে বসে আমার অনেক অলস দুপুর, মন খারাপের শান্ত বিকেল কেটেছে। কখনও মনে হয়েছে একটা চাকরি কি জীবনে পাব না? এত মানুষ এত কিছু সাফল্যের কাজ করছে জীবনে, কেউ অক্সিজেন ছাড়া এভারেস্ট জয় করে ফিরছে, কেউ সাত সমুদ্র সাঁতরে পার হচ্ছে, কেউ নতুন রেকর্ড করে অলিম্পিকে স্বর্ণপদক পাচ্ছে, আর আমি একটা চাকরি পাওরার সফলতা অর্জন করব না জীবনে? কখনও ভাবতাম সরকারি চাকরির চেষ্টাই করে যাব। যদি  পাই তো ভাল। না পেলে টিউশনিই করব। একা থাকব, বিয়ে করে সংসারি হব না। হঠাৎ খেয়াল হল মৌমিতার বিয়ের খবর শোনার শকে কিনা জানি না, সেনদিঘির পাড়ে বসে দিঘির জলে গোলা একরাশ সিঁদুরের অলস সূর্যাস্ত দেখছি। কাছেই একটি অশত্থ গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বাঁকাবিহারীর মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে আমার সাইকেল।


আট

সুদীপের দিদি পারমিতাদির সঙ্গে আমারও বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। সুদীপের বাড়ি তো আমার যাতায়াত ছিলই। যখন ওদের বাড়ি যেতাম পারমিতাদিও আমার সঙ্গে গল্প করত। কখনও কোনও বই হয়তো পড়তে দিত। আবার আমাদের লিটল ম্যাগাজিন বেরলে পর দিদিকে বিক্রি করতাম। 

আমাদের বাড়িতে তখন পাঁচশো টাকা জমা দিয়ে কিছুদিন হয়েছে ল্যান্ডলাইন টেলিফোন এসেছে। মোবাইল ফোন তখনও খুব দুর্লভ একটা ব্যাপার বা বাজারে আসেনি। বাড়িতে  ফোন  থাকলে টিউশনি পেতে সুবিধা হয়। কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় বাড়িতে ফোন ছিল না বলে কত যে সুন্দরী সহপাঠিনীর বন্ধুত্ব হাতছাড়া হয়ে গেল তার ইয়ত্তা নেই। দু-এক জন বান্ধবীর সঙ্গে একটু সখ্যতার সূচনা হলে পর যখন ফোন নম্বর চাইত, মুখ কালো করে জানাতাম, “আমাদের বাড়িতে টেলিফোন নেই।” ওই একটি উত্তরে পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থান যেন বেআব্রু হয়ে পড়ত। অবশ্য কাউকে কাউকে পাশের বাড়িতে সদ্য গজিয়ে ওঠা এসটিডি বুথের নম্বর দিতাম। (তখন পাড়ায় পাড়ায় এসটিডি বুথের রমরমা।) কিন্তু কেউ ফোন করত না। বাড়িতে ফোন না থাকলে অন্য কোথাও ফোন করে অমুককে ডেকে দিতে বলার মধ্যে যে বিরক্তির সম্মুখীন হওয়ার ঝুঁকি, তা অনেকেই নিতে চায় না। তবে এভাবে কেউ ফোন করেনি বললে ভুল হবে। একবার ব্যতিক্রম ঘটেছিল। স্বর্ণালি ফোন করেছিল। 

যাইহোক, আমার টিউশনির টাকাতেই ফোনের বিল মেটাতে পারব এই ভরসায় দু-এক দিন টেলিফোন এক্সচেঞ্জে ছোটাছুটির পর বাড়ি ফোন এল। তো, একদিন আমদের বাড়ির কালো রঙের টেলিফোনটা একদিন বেজে উঠল। আমি ধরলাম। ওপাশ থেকে বলল, “সোমনাথ  বলছ?” 

বলালাম, “হ্যাঁ বলছি।”

“আমার নাম দীপাঞ্জন রায়। সুদীপদের কোয়ার্টারেই আমরা থাকি। আমাকে হয়তো আগে দেখোনি, কারণ আমি বাইরে চাকরি করি। পারমিতা বলল যে তুমি ডবলুবিসিএসের প্রিপারেশন নিচ্ছ, আমিও বিসিএস দেব, একসঙ্গে পড়তে চাই।” 

এরপর দীপাঞ্জন রায় আমার দীপুদা হয়ে গেল। মানুষের সঙ্গে মিশতে গেলে আঘাত পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকেই, যেমন হয়েছিল বাপিদার সঙ্গে মিশে। কিন্তু তার জন্য মেশা বন্ধ করে দিলে আঘাত পাওয়া হয়তো আটকানো যায়, কিন্তু অমূল্য ভালবাসাও হাতছাড়া হয়ে যায়। তো, দীপুদার সঙ্গে আমার নতুন সম্পর্কের সেতু রচিত হল পড়াশোনার সূত্র ধরে।  দীপুদা এয়ার ফোর্সে চাকরি করে। অল্প বয়সে বাবা মারা গেছেন। হায়ার সেকেন্ডারির পরই এয়ার ফোর্সে যোগ দিয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কাজের জন্য থাকতে হয়। ছুটিছাটায় বাড়িতে আসা হয়। পড়াশোনায় উৎসাহী দীপুদা ডিসট্যান্স এডুকেশনে ইতিহাসে বি. এ. ও এম. এ. পাশ করেছে। একজন মানুষের কীরকম উৎসাহ থাকলে বাড়ির বাইরে থেকে চাকরি করে আবার গ্রাজুয়েশন ও মাস্টার ডিগ্রি অর্জন করা যায়, তার জ্বলন্ত উদাহরণ দীপুদা। 

দীপুদার পোষ্টিং তখন পুণেতে। দু’তিন মাস অন্তর ছুটি নিয়ে কলকাতায় আসত। এলে পর আমার সঙ্গেও দেখা হত। বাপিদার মতো দীপুদাও আমাদের বাড়ি এলে সঙ্কুচিত মনে হত না। দীপুদা এসে আমার বইয়ের তাক ঘেঁটে বলত, “এই বইটা তোর আছে…এটা আমি ক’দিনের জন্য নিয়ে যাচ্ছি।” হয়তো বইটা কিনে আমি ফেলে রেখেছি, পড়ার প্রয়োজন মনে করিনি বা  পরে পড়ার সময়টা অনির্দিষ্ট কালের জন্য পিছিয়ে দিয়েছি, কিন্তু দীপুদা যেই আমার সংগ্রহের বই বাড়ি নিয়ে যেতে চাইছে আমার তখন টনক নড়ল। তার মানে বইটা খুবই ভাল বই, ওটা  অবিলম্বে পড়া উচিত। এতটাই আস্থা ছিল দীপুদার প্রতি। উদ্দেশ্যের প্রতি সৎ, ভাল মানুষ দীপুদার সঙ্গে  আমি খুব বেশি গ্রুপ স্টাডি করতে পারিনি। কিন্তু আমার সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি পর্বে  উৎসাহ কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল দীপুদা। অনেক সময় কথাপ্রসঙ্গে কোনও বড়লোক বন্ধুর কথা উঠলে দীপুদা বলত, “আরে ভাই আমরা গরিব লোক। ওসব ছাড়! বড়লোকদের কথা আলাদা।” দীপুদা যেন আমার জীবনের ‘ক্ষিদ্দা’। যে অনবরত কানের কাছে বলে চলেছে, “ফাইট, সমু ফাইট।”  

দীপুদাকে গরিবের পর্যায়ে ফেলা যায় না। কারণ দীপুদার বাবা ভাল চাকরি করতেন। দীপুদাও সেসময় প্রায় বারো বছর চাকরি করে ফেলেছে এয়ার ফোর্সে। চোদ্দ বছর চাকরির পর এয়ার ফোর্স থেকে স্বেচ্ছাবসর নেওয়া যায়। দীপুদার ইচ্ছা এর মধ্যে ডবলুবিসিএস ক্লিয়ার করে সর্বভারতীয় চাকরি ছেড়ে রাজ্যের চাকরিতে যোগ দেওয়া। তাতে কিছুটা হলেও বাড়ির কাছে থাকা হবে। কপাল ভাল থাকলে কোনও এক পোষ্টিং-এ বাড়ি থেকেও যাতায়াতের সুবিধা মিলবে। বাড়িতে বয়স্ক মা রয়েছেন। এক দাদা কলকাতায় থাকলেও বাড়িতে মায়ের সঙ্গে থাকে না, অন্যত্র থাকে পরিবার নিয়ে। ফলে দীপুদা মাঝেমধ্যে পুণে থেকে ফোনে আমাকে যদি বলত মায়ের কাছে অমুক ওষুধটা কিনে পৌঁছে দিয়ে আয়, আমি তা পালন করতাম। দীপুদা পরে টাকা দিয়ে দিত। এভাবেই অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে। 

 

কৌশিকও সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বাপিদার সঙ্গে তো আমার সেভাবে একসঙ্গে পড়াশোনার সুযোগ হয়নি বাপিদার ব্যস্ততার কারণে। সেই অভাব পূরণ করল যেন কৌশিক। ওদের কালীতলার বাড়িতে আমি সাইকেল চালিয়ে সপ্তাহে দু-তিন দিন যেতাম দুপুর বেলা করে। পড়ার পাশাপাশি আড্ডাও চলত। কিন্তু পড়ায় উৎসাহ বাড়ত। কোনও একটি বিষয় আমার অজানা, কিন্তু কৌশিক জানে এটা জানার পর সেদিনই রাতে আমিও ওই বিষয়টা পড়তাম। উল্টোটা হত কিনা কৌশিক বলতে পারবে। কখনও আবার আমার কোনও বিষয় বুঝতে সমস্যা হলে কৌশিক খুব সহজ করে বুঝিয়ে দিত। কৌশিক একদিন আমাকে বলল, “সিভিল সার্ভিস ক্রনিকল ম্যাগাজিনটা পড়। না হলে চাকরি পাবি না।”

সিভিল সার্ভিস ক্রনিকল বা সিএসআর ইংরেজিতে একটি সর্বভারতীয় ম্যাগাজিন মূলত আইএএস মানের। সাম্প্রতিক ঘটনাবলী ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র থাকে এতে। দৈনিক খবরের কাগজের পাশাপাশি আমি রাজ্য সিভিল সার্ভিস মানের একটি বাংলা ম্যাগাজিন রাখতাম। কৌশিকের কথা পালন করতে দ্বিধা করিনি। সব পড়তে পারতাম না। কিন্তু যেটুকু পড়তাম তাতেও জানার পরিধি বাড়ত। কৌশিকও টিউশনি পড়াত। উচ্চমাধ্যমিক ও গ্রাজুয়েশনের কিছু ছাত্রছাত্রীদের ও ইকনমিক্স পড়াত।

এম. এস-সি. পার্ট ওয়ান পড়ার সময় কৌশিকদের বাড়িতে একদিন জয়েন্ট স্টাডি করে  বাড়ি ফিরব এমন সময় আবিষ্কার করলাম আমার লাল সাদা রেসিং কার সাইকেলটি হাওয়া। কোনও চোরের  হাতযশ। ওদের বাড়ির বাঁদিকের গলি পেরিয়ে সিঁড়ির ঘর দিয়ে ঢুকতে হত কৌশিকের দোতলার ঘরে। গলির একপাশে আমার সাইকেল দেয়ালে হেলান দিয়ে চাবি দেওয়া ছিল। দুপুর দুপুর এসেছিলাম। চারটে নাগাদ আকাশ অন্ধকার করে এক পশলা বৃষ্টিও হয়ে গিয়েছে। সাইকেলটিকে হয়তো গলিতে পড়ে পড়ে ভিজতে দেখে কোনও চোরের মনে তুমুল মায়া জন্মেছিল। তাই সমাদর করতে দেরি করেনি। কৌশিকের পরামর্শে ওকে নিয়ে গেলাম রিজেন্ট  পার্ক থানায়। বাঁশদ্রোণী থানার তখনও জন্ম হয়নি। একটা জেনারেল ডায়রি করা হল।  সাইকেলটি ফিরে পাওয়ার আশা ছিল না, কিন্তু চুরির প্রতিক্রিয়ায় কিছু একটা করা হল এই সান্ত্বনা।

সাইকেল তখন আমার জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ। ইউনিভার্সিটি যেতে না হলেও আমি তো তখনও বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র পড়াই। সাইকেল ছাড়া যাব কীভাবে! কারও বাড়ি হয়তো বাঘাযতীনে, আবার কারও বাড়ি পাটুলীতে। সাইকেল ছাড়া হেঁটে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। আর বাসে অটোতে করে যাওয়াটাও অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ। অথচ আরেকটা নতুন সাইকেল কেনাও এক কথায় অসম্ভব। টিউশনি পড়ানো বন্ধ করব শুধুমাত্র পরীক্ষার মাসটিতে। তাও আবার ওই এক মাস আমার হয়ে প্রক্সি দেবে প্রিয়ব্রত বলে এক বন্ধু। সেই মাসের মাইনেও ও-ই নেবে। নাহলে আমার টিউশনিগুলো হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। তো, এই অসুবিধায় আমার মুশকিল আসান হল সুমীত শীল। সেই সুমিত যার সঙ্গে একই সঙ্গে গ্রাজুয়েশন করেছি। ওর বাড়িতে আমার যাতায়াত ছিল। ও মাস্টার ডিগ্রি করতে যাদবপুরে ভর্তি হয়েছিল। আমার মনে পড়ে গেল, সুমিতের একটা সাইকেল আছে। রেসিং কার নয়, কালচে সবুজ রঙের একটু উঁচু সাইকেল। ওকে অনেক দিন সাইকেল চালাতে দেখি না। বোধহয় ঘরে পড়ে আছে। তবে গ্রাজুয়েশনের সময় ও আমার সঙ্গেই সাইকেল চালিয়ে কলেজ ও বিজি স্যারের কোচিঙে যেত। ওকে বললাম, “তোর সাইকেলটা তো পড়েই আছে। বিক্রি করবি?”

শুনেই প্রস্তাব নাকচ করে দিল। অদ্ভুত এক আভিজাত্যবোধ সুমিতের, টকার জন্য ঘরের  কোনও জিনিস বিক্রি করা ওর ধাতে নেই। বললাম, “তাহলে ধার দে। তোর সাইকেলটা আমাকে দু’মাসের জন্য ধার দে।”  

আমার প্রস্তাবে সুমিত রাজি হয়ে গেল। সুমিতের সাইকেল নিয়ে আমি টিউশনি পড়াতে যেতাম। আবার কাজ মিটে গেলে সাইকেলটা আমার বাড়িতেই রাখতাম। পুরনো সাইকেল কিনতে  চাইলেই চট করে বিক্রেতার  সন্ধান পাওয়া যায় না। সেদিন সুমিতের সাইকেল না পেলে আমার যে জীবনের চাকা কীভাবে গড়াত জানি না। সুমিত এখন আর বেঁচে নেই। দু’বছর আগে কিডনির অসুখে আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে। বছর খানেক ডায়ালিসিস চলেছিল। আমার কৃতজ্ঞতাস্বীকার ওর কাছে পৌঁছবে কিনা কে জানে!  

তো, যাইহোক কৌশিকের বাড়ি থেকে আমার সাইকেল খোয়া গিয়েছে বলে ওর বাড়ি গিয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দেব এমন ভাবনা মনে আসেনি। ফলে চাকরির পরীক্ষার জন্যও কৌশিকের বাড়িতে আমার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। আমরা যেন ছিলাম গুপ্ত সমিতির সদস্য। আর সব মানুষ আমাদের পরিকল্পনা অগ্রগতি কিছুই টের পেত না। হয়তো ভাবত, ছেলেগুলো সরকারি চাকরির চেষ্টা করছে, পাওয়ার ইচ্ছে আছে, কিন্তু পাবে না। সরকারি চাকরি পাওয়া কি মুখের কথা! 


******************************************************

আগামী পর্বে

*******************************************************

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন