শেষের শুরু
যুগল কিশোর দাস অধিকারী
হাওড়া থেকে লঞ্চটা ফেয়ারলি ঘাট যাচ্ছে। বেলা প্রায় ১০টা বা শোয়া দশটা হবে। ভিড়ে থিক থিক করছিল। বাসু ও ললিত মঙ্গলাহাট থেকে রেডিমেড কাপড়ের বাজার করে ফিরছিল। লঞ্চ পার হয়ে বাস ধরে ট্যাংরা যাবে। ভিড়ের মধ্যে এক মহিলা দু ' বছরের বাচ্চাকে নিয়ে কেমন যেন ইতস্তত করছিল। ব্যাগটা গুছিয়ে পাশে বসা মহিলাকে তার ছেলেটিকে কিছু সময় দেখার অনুরোধ করেছিল। মহিলা জিজ্ঞেস করল তুমি কোথায় যাবে?
- আমি আছি এই পাশেই যাব এক্ষুনি ফিরে আসব। কিছু সময়ের জন্য ওকে লক্ষ্য রাখবেন।
আচ্ছা যাও তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। - হ্যাঁ হ্যাঁ এই যাবো আর আসবো।
লঞ্চ তখন মাঝ গঙ্গাতে, বেশ ঢেউ দিচ্ছে।
ললিত কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। মহিলার আচরণে কেমন যেন সন্দেহ ঠেকছে।
অপরিচিত উপযাচক হয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলে কি বলতে কি বলবে।
তাই মোবাইল ঘটছিল। তবে অজান্তে মহিলার উপর তার নজর ছিল। হঠাৎ
লঞ্চের কিনারায় এসে দিদি বাচ্চাটা রইলো। এই বলেই নদীতে ঝাঁপ। সবাই চিৎকার করছে। লঞ্চ থামান। জলে মহিলা ডুবছে উঠছে। ললিত বাসুর হাতে মোবাইলটা ছুঁড়ে দিয়েই জলে ঝাঁপ। লঞ্চ স্লো করে কেউ কেউ দড়ি
খুঁজছে। ওদিকে স্রোতের টানে মহিলাকে তুলতেও পারছে না। মহিলাকে ধরতে গেলে সে গলা জড়িয়ে ধরছে। লালিতের জীবন যায় রয়। যাত্রীরা ভাবছে মনে হয় দু ' জনেরই সলিল সমাধি হল।
এমন সময় লঞ্চ থেকে একটা মোটা দড়ি ছুঁড়ে দিয়ে বাসু চিৎকার করছে
ললিত দড়িটা ধর।
অনেক কষ্টে দড়িটা ধরে মহিলাকে নিয়ে লঞ্চের পাটাতনে উঠলো।
দুজনেই জল খেয়ে কাত হয়ে পড়েছে
মহিলাকে শুইয়ে লঞ্চের এক নার্স জল বের করছিল। অবশেষে দুজনেই বিপদ মুক্ত হল। বাচ্চাটি সমানে কেঁদে চলেছে।
বাচ্চাটি যে মহিলার কাছে ছিল উনি এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন - তোমার নাম কি? কোথায় যাবে? জলেই বা কেন ঝাঁপ দিলে? তুমি মরে গেলে তোমার বাচ্চার কি হত? আরো নানা প্রশ্ন।
মহিলা বিধস্ত। কোন কথা বলছে না।
ততক্ষণে লঞ্চ ফেয়ারেলি এসে গেছে।
ললিত দেখছিল যে কিছুক্ষন আগে মৃত্যুর জন্য জলে ঝাঁপ দিয়েছিল সে এখন তার সন্তানকে প্রাণপনে আগলে
কেঁদেই চলেছে। ভিজে সপসপে শাড়ি
শরীরে লেপটে শরীরের সৌন্দর্য্য ফুটে উঠছে। ললিত পাশে এসে জিজ্ঞেস করলো আপনি কিছু বলুন। এমন সুন্দর ছেলেটিকে ও আপনি জলে ভাসিয়ে দিচ্ছিলেন। কিন্তু কেন?
আপনার সমস্যা কি? কেউ কেউ বলছে ওকে পুলিশের হতে তুলে দাও। আবার অনেকের এত সময় নেই সময় দেওয়ার। যে যার কাজের জায়গায় রওনা দিচ্ছে।
ললিত মেয়েটি মুখ চোখ দেখে আন্দাজ করতে পারছে যে ওর সমস্যা আছে কিন্তু তা কোন অব্যক্ত কারনে ব্যক্ত করতে পারছে না
তাই আবার জিজ্ঞেস করল আপনি যদি কিছু না বলেন তাহলে আমরা কোন সাহায্য করতে পারবো না। অগত্যা পুলিশের হাতেই তুলে দিতে হবে। এটা এটেম্পট টু সুইসাইড।
মেয়েটি তখন কান্নায় ভেঙে পড়ল।
দুঃখে হতাশায় বললো আমার সমস্যা শুনলে আপনার কি হবে? আপনি কি আমার সমস্যার সমাধান করতে পারবেন? আপনি আপনার জায়গায় যান।
ললিত প্রশ্ন না করে শান্ত হয়ে বললো আপনাকে অন্তত আপনার বাড়ি পৌঁছে দিই। কোথায় যাবেন বলুন।
আমার কোথাও যাবার জায়গা নেই।
দম নিয়ে বললো সাঁতরাগাচিতে বাবার বাড়ী গিয়েছিলাম। বাবা মা নেই। তাই দাদা বৌদি আমাকে রাখতে পারবেনা। এদিকে স্বামী এই ক ' দিন আগে অ্যাকসিডেন্ট এ মারা গেছেন। বৃদ্ধ শ্বশুর শাশুড়ি। তাদের তেমন রোজকার নেই। আমার স্বামীর উপার্জনেই সংসার চলত। তাদের কাছে ও আমি বোঝা। তবে আমার বেঁচে থেকে লাভ কি?
শ্বশুর বাড়ী কোথায়? আমিকি যাব আপনার সঙ্গে ? যদি আপনি আপত্তি না করেন।
শ্বশুর বাড়ী সোনারপুর। আপনার নামটা কি জানতে পারি?
আমি লাবণ্য। ললিত বসুকে মালপত্র নিয়ে বাড়ী যেতে বললো। ললিত বললো এ অবস্থায় উনাকে একা ছাড়া ঠিক হবে না। তাই লাবণ্যকে নিয়ে ট্যাক্সি ধরে শিয়ালদহ এলো।
স্টেশন এ টিকিট কেটে ট্রেনে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলো কিছু খাবেন?
না।
বাচ্চাটার জন্য একটা ফ্রুটি, এক প্যাকেট বিস্কুট ও এক বোতল জল নিয়ে ট্রেনে উঠলো।
সোনারপুর লোকালে উঠেছে। জানালার ধারে বসে উদাস দৃষ্টিতে লাবন্য বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। সংসারের কোন কিছুর প্রতি তার টান ছিন্ন হয়েছে। ছেলেটির দিকেও তার নজর নেই। পৃথিবীটা তার কাছে শুন্য মনে হচ্ছে। হওয়ায় শুকিয়ে যাওয়া চুল উড়ছে। ভেজা শাড়ি ও শুকিয়ে এসেছে। লালিতের এই অসহায় মহিলার উপর, বিশেষত ছেলেটার জন্য ভীষণ মায়া পড়ে গেল।
লাবণ্যর শ্বশুর বাড়ি পৌঁছে লালিত রাস্তার কোন ঘটনার কথা কিছুই বলেনি। অপরিচিত লোককে দেখে লাবণ্যর শ্বশুর শ্বাশুড়ি কেমন কেমন করছিল।
শ্বশুর মশায় জিজ্ঞেস করলো বৌমা তুমি তো তোমার বাবার বাড়িতে থাকবে বলে কালই গেলে। আবার আজ ই ফিরে এলে যে? আর ইনিই বা কে?
এবার ললিত তার শ্বশুর কে কাছে এনে বললো হ্যাঁ উনি উনার দাদা বৌদির কাছে গিয়েছিলেন কিন্তু ওরা কেউ ই ওর দায়িত্ব নিতে পারবে না বললো। তাই উনি চলে এলেন। কিন্তু বাবা আমার তো তেমন উপায় নেই।
আমরা নিজেদের সংস্থানই করতে পারছিনা। তা ছাড়া ওর বয়স ভীষণ কম ২৭ কি২৮ হবে এই বয়স থেকে সারাটা জীবন কিভাবে একা লড়বে?
ওর ছেলেটার কি হবে? আমরা বা আর ক দিন?
আমাদের ছেলে এক ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করত। হটাৎ সিকিম গিয়ে অ্যাকসিডেন্ট এ মারা গেল। আমার বয়স হয়েছে। স্ত্রী ও অসুস্থ। আমরা নিরুপায় হয়ে ওকে ওর ভাইয়ের কাছে পাঠিয়েছিলাম। তা ছাড়া ওর গোটা জীবনটাই পড়ে আছে।
কিন্তু তুমি ই বা কে কি করে ওর সম্মন্ধে জানলে?
তখনই ললিত আদ্যপান্ত লঞ্চের ঘটনা বললো। এবং সে যে পৌঁছে দিতে এসেছে - না হলে আবার কোন বিপদ হতে পারে সেই ভয়েই সে নিজে এসেছে।
তার কথা শুনে লাবণ্যর শ্বশুর শাশুড়ি
বললো ওর পোড়া কপাল। যা হয় হোক। আমার কাছেই থাক। কিন্তু আমার ইচ্ছে ছিল ও যদি আবার কাউকে বিয়ে করে ঘর বাঁধে তাহলে আমরা আরো খুশী হতাম।
লাবণ্যর শ্বশুর বললো ওর বিয়ে হলেএকটা হিল্লে হতো। আর বাচ্চাটার ও। কিন্তু কে এমন সহৃদয় আছে ?
বিশেষত ওকে বিয়ে করলে ও বাচ্চাটিকে হয়তো না ও নিতে পারে। আমরা পড়েছি অকূল পাথারে।
ঘটনা শোনার পর ওর শাশুড়ী ভিতরে গিয়ে নাতি ও বৌমার কাছে ছুটে গেল।
সেই ফাঁকে ললিত লাবণ্যর শ্বশুরকে বললো যদি এমন কোন সহৃদয় ছেলের সন্ধান পাই, যে আপনার নাতি ও বৌমাকে নিতে রাজি আছে তাতে কি আপনাদের কোন আপত্তি আছে?
না না একদম নয়। কিন্তু এমন ছেলে কোথায় পাবে?
আচ্ছা দেখছি, আমি দু এক দিন পরে এসে আপনাদের জানাবো। আজ উঠি।
এত বেলায় কিছু মুখে না দিয়ে কেমন করে যাবে? যা হোক নুন ভাত খেয়ে যাও বাবা।
লাবন্য ধীরে ধীরে বাইরে এসে এক গ্লাস সরবত ও দুটো মিষ্টি নিয়ে এসে শ্বশুরকে বললো অনেক দিন।
আরে তুমিই দাও না।
- এ সবের কোন দরকার ছিল না।
জল আর মিষ্টি খেয়ে ললিত উঠল।
ললিতের বয়স ৩৭/৩৮ হবে। তবে বেশ সুঠাম চেহারা। ভদ্র, পরোপকারী। আড়াল থেকে লাবন্য ললিতকে লক্ষ্য করেছে। মুখের কোন হাসি লেগেই আছে। আজকালকার দিনে এমন ও মানুষ আছে, না কি অন্য কোন মতলব আছে কে জানে ?
এখনো স্বামীর স্মৃতি দগদগ করছে।
হটাৎ এক ঝটকায় সমস্ত আলো নিভে গিয়ে চারদিক অন্ধকারে ঢেকে গেছে। বাঁচার আকাঙ্খা টুকু ও নেই। তবু ওই ছোট্ট শিশুটার দিকে তাকিয়ে আজ যেন নিজেকে স্বার্থপর মনে হল। আমি চলে গেলে ওর কি হত?
কয়েকদিন পর ললিত তার মা কে নিয়ে লাবণ্যর বাড়িতে এল। লাবন্যর বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে উনি আবার আসবেন। ছেলের জন্য জামা কাপড়, শ্বশুর শাশুড়ি ও লাবণ্যর জন্য ও শাড়ি ইত্যাদি এনেছে। এ সব দেখে লাবণ্যর শ্বশুর শাশুড়ি কিছুটা অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে গেল। সঙ্গে মিষ্টি ফল বাচ্চার খেলনা। ললিতের মা লাবন্যর শাশুড়ি কে ডেকে বললেন দিদি আপনাদের সাথে আমার কিছু কথা আছে। যদি অভয় দেন তো বলি। তার আগে আপনার বৌমাকে দেখি। ললিতের মা লাবন্যকে একবার দেখেই ভীষণ মায়া পড়ে গেল। সদ্য আহত মৃগ সবিকার মতো ম্রিয়মাণ।
তার শাশুড়িকে ডেকে বললেন আমি যদি আমার ছেলের জন্য লাবন্যকে নিয়ে যেতে চাই, আপনাদের কি কোন আপত্তি আছে?
লাবন্যর শ্বশুর বিস্মিত হয়ে বললেন কিন্তু একদিনের পরিচয়, তা ছাড়া আপনারা কোথায় থাকেন, ছেলে কি করে, ইত্যাদি আমরা তো কিছুই জানি না। একবার ওর কপাল পুড়েছে, আর আঘাত পেলে সইতে পারবে না। তাছাড়া ওর ছেলেটির ই বা কি হবে?
ললিতের মা বলল আমরা দু ' জনকেই
নিয়ে যেতে চাই। আপনারা যদি রাজি থাকেন। তবে ইতিমধ্যে আপনারা আমার বাড়িতে আসুন। ঘরবাড়ি সবকিছু দেখুন। আমার ছেলের রেডিমেড গার্মেন্টস র বিজনেস। ওর বাবা নেই। আমি আর ও থাকি। একজন কাজের ছেলে ও মেয়ে ও থাকে। আমি প্রাইমারি স্কুল শিক্ষিকা।
তবে ওর আগে বিয়ে হয়েছিল। বৌমাই ওকে ছেড়ে চলে গেছে।
কিন্তু কেন? আপনারা এত স্বচ্ছল, ছেলে ও ভারি সুন্দর, তবে কেন বৌমা ছেড়ে চলে গেল?
আপনাদের সত্যি কথাই বলি বলে মৃদু স্বরে বললেন লজ্জা লাগলেও বলতে হবে ওরা চার বছর বিয়ে করে ও কোন সন্তান হয়নি। অনেক ডাক্তার বৈদ্য ও করেছি। শেষে জানলাম আমার ছেলেই বাবা হতে অক্ষম। তাই সে আর থাকতে চায় নি। ওকে আমরা ছাড়িনি ও ই আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।
তাই আপনার নাতি আমার নিজের নাতির মতই মানুষ করবো কোন ত্রুটি হবে না কথা দিচ্ছি।
লাবন্য র বিশেষ আপত্তি ছিল না, তবু ছেলের জন্য ভীষণ ভয় করছিল।
যদি ওকে অবহেলা করে? ললিতের মায়ের সাথে ওর শ্বশুর শাশুড়ীর কথা লাবন্য জানতে পারেনি।
বাসররাতে লাবন্য ছেলেকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে অপেক্ষা করছিল। রাতে ললিত এলো। লাবন্য কি করে না করে ভেবে পায় না । ললিত বিছানায় এসে ছেলেটিকে কোলে তুলে আদর করতে লাগলো। কিছু এ কথা ও কথা বলতে বলতে ঘুম চলে এল। লাবন্য সকালে ও দেখে সোফায় ছেলেকে নিয়ে ঘুমাচ্ছে। লাবন্য র ভীষণ লজ্জা করছিল।
ললিত ন টায় অফিস চলে গেল। দাঁড়িয়ে আড়াল থেকে লাবন্য দেখছিল। অফিস গিয়ে ওর খাওয়া হয়েছে কি না, ছেলে কি করছে জানতে দু তিন বার ফোন করেছে।
শীতের রাতে বাড়ী ফিরতেই লাবন্য হাত পা ধোয়ার জন্য গরম জল আনলো। নিজের হাতে এগ চাউ করে রেখেছিল। হাত পা ধুতেই খাবার নিয়ে হাজির হল। কোন বেশি কথা বলত না।
ললিত জানতে চাইলো তোমার বা আমার সোনার কোন অসুবিধে হয়নি তো?
লাবন্য বললো না মা, কাজের মাসী ও আমার খোকার বেশ খেয়াল রাখে । কিন্তু তুমি...
তুমি কি? না থাক।
ললিত এমনি ছেলের কাছে গিয়ে ওকে আদর করতে করতে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে দু জনে খেলতে লাগলো।
লাবন্যর মনটা খুশিতে ভরে উঠলো।
মনের মধ্যে দুশ্চিন্তার মেঘ কেটে গেল। ক দিনের মধ্যে ললিত ছেলেকে কি আপন করে নিয়েছে!
সে রাতে লাবন্য তার পুরনো জীবন ফিরে পেল। মরা গাঙে বান ডাকলো।
কূল ছাপিয়ে জল বাইতে লাগলো। নিজেকে উজাড় করে ললিতের হতে সমর্পন করে দিল।
*******************************************************************************************



কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন