কবিতাগুচ্ছ * মনোজ বাগ
আলোকণা
ধুলো ঝেড়ে নিই --
ধুলো-বালি ধুয়ে , মুছে পরিচ্ছন্ন হই ।
ধুলো বালিদের গায়ে লেগে থাকা আলোর কণাগুলি
সারা অঙ্গে জড়িয়ে রাখি ।
আলোকিত হলে তুচ্ছ কীটপতঙ্গকেও মনে হয়
আলোরই কণা ।
যে কণাগুলি ঘন অন্ধকারেও জ্বলে ।
রাত্রি সান্দ্র হলে এই কণাগুলিই ধ্যানকেও
অন্য মাত্রা দেয় ।
অন্তর্লোকের জমাট অন্ধকার সরে গেলে
তখন ভিতর ও বাহিরের সব দেওয়াল
ঐ আলোয় মিলিয়ে যায় ।
প্রকৃতি
প্রকৃতি ভিতরে , বাইরে গড়ে ।
যার ভিতরে যতটা ধরে ,
যার বাইরে যতটা ধরে ,
তাকে ততটা দিয়েই ভরে ।
এভাবে ভরে উঠতে উঠতেই
একদিন ভরে ওঠে সব ,
এভাবেই বাড়ে প্রতিপত্তি ও বৈভব ।
একদিন ভাঙা গড়ার এই ঘোর থেকে বেরিয়ে এসে
প্রকৃতি নিজেও সারেন তাঁর পুণ্যস্নান -
কোন এক অনিবার্যতার কাছে ।
যা বাইরে নির্বাপিত দীপশিখাটির মতো ,
অথচ ভিতরে ভিতরে চির অমোঘ , অনির্বাণ ।
অলোকঝোরা
শুধুই সান্ত্বনার কথা ! শুশ্রূষার কথা ! আর চাওয়া !
বলি ও মন , দিতে অভ্যস্ত হও -- দাও -- দাও যে চায় ,
যে প্রকৃত কাঙাল , তাকে ।
সরীসৃপের মতো গায়ে জড়ানো নির্মোক ।
নির্মোকগুলি ফেলে যেতে যেতেও ভাবি -
প্রকৃতির কাছে , পিপাসীর কাছে নিজেকে
উজাড় করেও বিনিময়ে কি চাই ?
নাহ্ , কোন সুখ-বোধ বা দুঃখ-বোধ নয় -
আমি চাই , আমাকে সদা সর্বদাই উদ্দীপিত রাখে ,
আমারই অন্তর্গত যে আলো , সেই আলো ।
যখন আলোটি চাই , দেখি --
বরফের মত জমাট একটা হিমবাহ থেকে গলে গলে এসে ,
অলোকঝোরার মতই তা অঝোরে ঝরে পড়ছে
আমারই করপুটে ।
পদ্ম পাতার জল
জীবনে প্রাণ , পদ্ম পাতার জল ।
পাতায় ধরা থাকলে তা এতটাই নিটোল থাকে
যে টলটল করে ।
বিন্দু বিন্দু ওই জলে একটু আধটু আলো পড়লেই
মনে হতে পারে কোনও দুর্মূল্য হীরে ।
যে হীরেগুলি ধারণ করেই গড়ে উঠেছে
আমাদের জীবন , সভ্যতা ।
সইতে সইতে
সইতে সইতেই একদিন সয়ে যায় ,
সুতীব্র আলো , জমাট অন্ধকার ,
অবর্ণনীয় দুঃখ-দৈন্য , দুরারোগ্য ব্যাধির প্রকোপ ,
অন্ধত্ব , পঙ্গুত্ব , বধিরতা ।
পঙ্গুও লঙ্ঘন করে গিরি ,
বধিরও রচনা করেন সঙ্গীত ।
অন্ধও আলোর ভাষ্য লেখেন ।
হাজারো বিঘ্ন সত্ত্বেও মানুষ অকূলে ভাসায় সাম্পান ।
অকুস্থলের দমবন্ধ পরিস্থিতিতেও
যে মানুষ এক মুহূর্তও শ্বাস নিতে ভোলে না ,
শুধু মাত্র বাঁচার জন্য ;
সেই মানুষই ধ্যান-প্রাণায়ামের মাধ্যমে
সুদীর্ঘক্ষণ দম বন্ধ রাখার ও ছাড়ার অভ্যাস করে ,
জীবনকে আরো গভীর ভাবে পাবার জন্য ।
সাধতে সাধতেই যেমন সহজ হয় তান-সরগম ,
তেমনি সইতে সইতেই
জীবনে সবই সহজ ও সুন্দর হয় ।
এর নিরন্তর সাধনায় স্বতঃসিদ্ধ প্রতিটি জীবনই ।
অগ্নিময় যে শিখা
সময়ের অনিবার্যতায় যে অগ্নি জ্বলে ওঠে ,
সম্পূর্ণ নিভে যাওয়ার আগেও তা বহুক্ষণ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে কাঁপে ।
বিন্দুমাত্র হয়েও থাকে তার অবশেষ ।
আমি প্রতিনিয়তই নিজেকে ঐ অগ্নিরই প্রজ্জ্বলন রূপে দেখি ।
তার অনন্য তাপ নিজের ভিতরেও অনুভব করি ।
অনুভূত এই সত্যই যদি কোন মুহূর্তে জেগে ওঠে !
তার জ্বলন অনেকটা আলোর সঙ্গে কিছুটা তাপও হয়তো ছড়াবে ।
চারপাশে প্রতিচ্ছবির মতই প্রতিটি মুহূর্তই ঐ অগ্নিকে আমি দেখি ।
এই ইন্ধন এতটাই সত্য ও অমোঘ -- কিছুতেই নিভতে চায় না ।
যা ঐশ্বরিক
স্নেহ আচ্ছন্ন করে ।
মোহ-মায়া-প্রেম বড় বেশি আচ্ছন্ন করে ।
আঁটোসাঁটো এত বাঁধনের মধ্যেও মুক্ত বিহঙ্গ আমি ।
ভেসে আছি নীল শূন্যে ।
শূন্য , নীল -- শূন্য , সাদা ।
যত ব্যাপ্ত , ততটাই উদার ।
এই ব্যাপ্তি , এই উদারতা --
যা চিরন্তন , যা অমোঘ , যা পরম ,
সেই সব সত্যেরই স্মারক ।
বিরাট এক বর্তমানতার মধ্যেই এদের অবস্থান ।
বর্তমানতার মধ্যেই প্রকাশিত হয়ে আছে
ঈশ্বরের সব কটি গুণ ।
তুমি
যা কিছু গৌরবের , তুমি বরাবরই চেয়েছ
তার প্রচার হোক প্রকাশ্য দিবালোকে ।
তার কথা ছড়িয়ে যাক আবিশ্বে ।
যা তোমার স্বচ্ছ-সাদা ভাবমূর্তির হানিকারক -
আজীবন তুমি তা ঢেকেই রাখতে চেয়েছ অন্ধকারের গূঢ় অন্তরালে ।
এখন তোমার ভিতরের যেটা আপাত বাস্তব , তা হল -
তোমারই অন্তরের সাদা-কালোর প্রতিনিত্যের দ্বন্দ্ব ।
আলোর মতো অন্ধকারের সঙ্গেও তোমার নিত্য সহাবস্থান ।
অথচ তোমার যা স্বভাব , তাতে তোমার মুখ
সদা সর্বদাই থাকার কথা আলোরই অভিমুখে ।
কোন একদিন সমস্ত রকমের দ্বন্দ্ব-সংঘাত থেকে সরে এসে , তুমি দেখো -
আলো নয় , আবার ঠিক অন্ধকারও নয় ,
আলোতে আঁধারে মেশা সব ছায়া মূর্তি ।
সময় ঐ ছায়া মূর্তিগুলিকেই ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে
আলোর ভিতর দিয়েই আরো ব্যাপ্ত আলোর দিকে ।
অন্ধকারের ভিতর দিয়ে আরো গাঢ় অন্ধকারের দিকে ।
আছে আলো-অন্ধকারে মেশা ছোট বড় মাঝারি সব আবছায়ারাও ।
এই ত্রিধারায় মূর্তিমান এক অনন্যতা তুমি , ভেসে আছ ....
সময়
সময়ের দিকে চেয়ে আছি ।
সময় যে ভাবে যায় , যে ভাবে ভাবে , যে ভাবে চায় ,
দেখছি তারই গতি প্রকৃতি ।
বর্তমানতাই ধারণ করে আছে সমস্ত অতীত ও আগামী ।
যা নশ্বর তা ধারণ করে আছে ।
যা অমোঘ -- ধারণ করে আছে ।
রূপে অরূপ , অরূপে রূপ ,
মধু , অধরা মাধুরী --
সবই ধারণ করে আছে ।
যত নির্বিশেষ , নির্বিষয় -- একে অন্যতে মিশে আছে ।
যে আদি নাদ বিরাজ করছেন সব বাকে , সব ধ্বণিতে , প্রতিধ্বণিতে ,
তার শ্রুতিই জাগাচ্ছে সুর , তাতে বাণী মিশে জাগছে সঙ্গীত ...
ভিতরে , বাহিরে ঐ তরঙ্গেই ভেসে যেতে যেতেও
আছড়ে পড়ছি মূর্ছনায় ।
প্রতিটি মুহূর্তই কানে বাজছে জয়ধ্বণি !
কার !
ঝরে পড়ছে পল --
তাতে ভিজে যেতে যেতে দেখছি ,
অজস্র জলের পুতুল -- অকূল অতল জলে বিহার করছে আর
তাদের অঙ্গে অঙ্গ লেগে বেজে বেজে উঠছে
রঙ-বেরঙের সব জল তরঙ্গ ...
*********************************************************************************************
পেশায় ব্যবসাজীবী । কবিতা বেঁচে থাকার রসদ ; অনিবার্য এক ইন্ধনও । প্রিয় কবিতার গ্রন্থ : গীতা , ঈশোপনিষদ , গীতবিতান , আমিই মাটি , আমিই আকাশ (সুজিত সরকার) । কবিতা প্রিয় বিষয় হলেও সাহিত্যের প্রতিটি শাখাই টানে । সঙ্গীত ও চিত্রকলার প্রতিও প্রবল আকর্ষণ আছে । ভালো লাগে ভাবতে : আপাত যা কিছু -- এই সবই এক পরম সত্যেরই প্রকাশ ।





কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন