বুধবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৩

গুচ্ছ কবিতা * মনোজ বাগ



কবিতাগুচ্ছ * মনোজ বাগ








আলোকণা

ধুলো ঝেড়ে নিই -- 

ধুলো-বালি ধুয়ে , মুছে পরিচ্ছন্ন হই  ।

ধুলো বালিদের গায়ে লেগে থাকা আলোর কণাগুলি 

সারা অঙ্গে জড়িয়ে রাখি ।


আলোকিত হলে তুচ্ছ কীটপতঙ্গকেও মনে হয় 

আলোরই কণা ।

যে কণাগুলি ঘন অন্ধকারেও জ্বলে ।


রাত্রি সান্দ্র হলে এই কণাগুলিই ধ্যানকেও 

অন্য মাত্রা দেয় ।

অন্তর্লোকের জমাট অন্ধকার সরে গেলে 

তখন ভিতর ও বাহিরের সব দেওয়াল 

ঐ আলোয় মিলিয়ে যায় ।



প্রকৃতি

প্রকৃতি ভিতরে , বাইরে গড়ে ।

যার ভিতরে যতটা ধরে ,

যার বাইরে যতটা ধরে ,

তাকে ততটা দিয়েই ভরে ।


এভাবে ভরে উঠতে উঠতেই 

একদিন ভরে ওঠে সব ,

এভাবেই বাড়ে প্রতিপত্তি ও বৈভব ।


একদিন ভাঙা গড়ার এই ঘোর থেকে বেরিয়ে এসে

প্রকৃতি নিজেও সারেন তাঁর পুণ্যস্নান -

কোন এক অনিবার্যতার কাছে ।


যা বাইরে নির্বাপিত দীপশিখাটির মতো ,

অথচ ভিতরে ভিতরে চির অমোঘ , অনির্বাণ ।


  

অলোকঝোরা 

শুধুই সান্ত্বনার কথা ! শুশ্রূষার কথা ! আর চাওয়া !

বলি ও মন , দিতে অভ্যস্ত হও -- দাও -- দাও যে চায় , 

যে প্রকৃত কাঙাল , তাকে ।


সরীসৃপের মতো গায়ে জড়ানো নির্মোক ।

নির্মোকগুলি ফেলে যেতে যেতেও ভাবি  -

প্রকৃতির কাছে , পিপাসীর কাছে নিজেকে 

উজাড় করেও বিনিময়ে কি চাই ?


নাহ্  , কোন সুখ-বোধ বা দুঃখ-বোধ নয় - 

আমি চাই , আমাকে সদা সর্বদাই উদ্দীপিত রাখে , 

আমারই অন্তর্গত যে আলো , সেই আলো ।


যখন আলোটি চাই , দেখি -- 

বরফের মত জমাট একটা হিমবাহ থেকে গলে গলে এসে ,

অলোকঝোরার মতই তা অঝোরে ঝরে পড়ছে 

আমারই করপুটে ।



পদ্ম পাতার জল

জীবনে প্রাণ , পদ্ম পাতার জল ।

পাতায় ধরা থাকলে তা এতটাই নিটোল থাকে 

যে টলটল করে ।

বিন্দু বিন্দু ওই জলে একটু আধটু আলো পড়লেই 

মনে হতে পারে কোনও দুর্মূল্য হীরে ।

যে হীরেগুলি ধারণ করেই গড়ে উঠেছে 

আমাদের জীবন , সভ্যতা ।



সইতে সইতে 

সইতে সইতেই একদিন সয়ে যায় ,

সুতীব্র আলো , জমাট অন্ধকার ,

অবর্ণনীয় দুঃখ-দৈন্য , দুরারোগ্য ব্যাধির প্রকোপ ,

অন্ধত্ব , পঙ্গুত্ব , বধিরতা ।


পঙ্গুও লঙ্ঘন করে গিরি ,

বধিরও  রচনা করেন সঙ্গীত  ।

অন্ধও আলোর ভাষ্য লেখেন ।

হাজারো বিঘ্ন সত্ত্বেও মানুষ অকূলে ভাসায় সাম্পান ।


অকুস্থলের দমবন্ধ পরিস্থিতিতেও 

যে মানুষ এক মুহূর্তও শ্বাস নিতে ভোলে না ,

শুধু মাত্র বাঁচার জন্য ;

সেই মানুষই ধ্যান-প্রাণায়ামের মাধ্যমে

সুদীর্ঘক্ষণ দম বন্ধ রাখার ও ছাড়ার অভ্যাস করে ,

জীবনকে আরো গভীর ভাবে পাবার জন্য ।


সাধতে সাধতেই যেমন সহজ হয় তান-সরগম ,

তেমনি সইতে সইতেই 

জীবনে সবই সহজ ও সুন্দর হয়  ।


এর নিরন্তর সাধনায় স্বতঃসিদ্ধ প্রতিটি জীবনই ।



অগ্নিময় যে শিখা

সময়ের অনিবার্যতায় যে অগ্নি জ্বলে ওঠে ,

সম্পূর্ণ নিভে যাওয়ার আগেও তা বহুক্ষণ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে কাঁপে ।

বিন্দুমাত্র হয়েও থাকে তার অবশেষ ।


আমি প্রতিনিয়তই নিজেকে ঐ অগ্নিরই প্রজ্জ্বলন রূপে দেখি ।

তার অনন্য তাপ নিজের ভিতরেও অনুভব করি ।


অনুভূত এই সত্যই যদি কোন মুহূর্তে জেগে ওঠে !

তার জ্বলন অনেকটা আলোর সঙ্গে কিছুটা তাপও হয়তো ছড়াবে ।


চারপাশে প্রতিচ্ছবির মতই প্রতিটি মুহূর্তই ঐ অগ্নিকে আমি দেখি ।

এই ইন্ধন এতটাই সত্য ও অমোঘ -- কিছুতেই নিভতে চায় না ।











যা ঐশ্বরিক 

স্নেহ আচ্ছন্ন করে ।

মোহ-মায়া-প্রেম বড় বেশি আচ্ছন্ন করে ।

আঁটোসাঁটো এত বাঁধনের মধ্যেও মুক্ত বিহঙ্গ আমি ।

ভেসে আছি নীল শূন্যে ।


শূন্য , নীল  --  শূন্য , সাদা  ।

যত ব্যাপ্ত , ততটাই উদার ।

এই ব্যাপ্তি , এই উদারতা --

যা চিরন্তন , যা অমোঘ , যা পরম ,

সেই সব সত্যেরই স্মারক ।

বিরাট এক বর্তমানতার মধ্যেই এদের অবস্থান ।


বর্তমানতার মধ্যেই প্রকাশিত হয়ে আছে 

ঈশ্বরের সব কটি গুণ ।



তুমি

যা কিছু গৌরবের , তুমি বরাবরই চেয়েছ 

তার প্রচার হোক প্রকাশ্য দিবালোকে ।

তার কথা ছড়িয়ে যাক আবিশ্বে ।

যা তোমার স্বচ্ছ-সাদা ভাবমূর্তির হানিকারক -

আজীবন তুমি তা ঢেকেই রাখতে চেয়েছ অন্ধকারের গূঢ় অন্তরালে ।


এখন তোমার ভিতরের যেটা আপাত বাস্তব , তা হল -

তোমারই অন্তরের সাদা-কালোর প্রতিনিত্যের দ্বন্দ্ব ।

আলোর মতো অন্ধকারের সঙ্গেও তোমার নিত্য সহাবস্থান ।

অথচ তোমার যা স্বভাব , তাতে তোমার মুখ 

সদা সর্বদাই থাকার কথা আলোরই অভিমুখে ।


কোন একদিন সমস্ত রকমের দ্বন্দ্ব-সংঘাত থেকে সরে এসে , তুমি দেখো -

আলো নয় , আবার ঠিক অন্ধকারও নয় ,

আলোতে আঁধারে মেশা সব ছায়া মূর্তি ।


সময় ঐ ছায়া মূর্তিগুলিকেই ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে 

আলোর ভিতর দিয়েই আরো ব্যাপ্ত আলোর দিকে ।

অন্ধকারের ভিতর দিয়ে আরো গাঢ় অন্ধকারের দিকে ।

আছে আলো-অন্ধকারে মেশা ছোট বড় মাঝারি সব আবছায়ারাও ।


এই ত্রিধারায় মূর্তিমান এক অনন্যতা তুমি , ভেসে আছ ....



সময়

সময়ের দিকে চেয়ে আছি ।

সময় যে ভাবে যায়  , যে ভাবে ভাবে , যে ভাবে চায় ,

দেখছি তারই গতি প্রকৃতি ।


বর্তমানতাই ধারণ করে আছে সমস্ত অতীত ও আগামী ।

যা নশ্বর তা ধারণ করে আছে ।

যা অমোঘ -- ধারণ করে আছে ।

রূপে অরূপ , অরূপে রূপ , 

মধু , অধরা মাধুরী --

সবই ধারণ করে আছে ।


যত নির্বিশেষ , নির্বিষয় -- একে অন্যতে মিশে আছে ।

যে আদি নাদ বিরাজ করছেন সব বাকে , সব ধ্বণিতে , প্রতিধ্বণিতে ,

তার শ্রুতিই জাগাচ্ছে সুর , তাতে বাণী মিশে জাগছে সঙ্গীত ...

ভিতরে , বাহিরে ঐ তরঙ্গেই ভেসে যেতে যেতেও 

আছড়ে পড়ছি মূর্ছনায় ।


প্রতিটি মুহূর্তই  কানে বাজছে জয়ধ্বণি !

কার !


ঝরে পড়ছে পল -- 

তাতে ভিজে যেতে যেতে দেখছি , 

অজস্র জলের পুতুল -- অকূল অতল জলে বিহার করছে  আর

তাদের অঙ্গে অঙ্গ লেগে বেজে বেজে উঠছে 

রঙ-বেরঙের সব জল তরঙ্গ ...













*********************************************************************************************



মনোজ বাগ

পেশায় ব্যবসাজীবী । কবিতা বেঁচে থাকার রসদ ; অনিবার্য এক ইন্ধনও । প্রিয় কবিতার গ্রন্থ : গীতা , ঈশোপনিষদ , গীতবিতান , আমিই মাটি , আমিই আকাশ (সুজিত সরকার) । কবিতা প্রিয় বিষয় হলেও সাহিত্যের প্রতিটি শাখাই টানে । সঙ্গীত ও চিত্রকলার প্রতিও প্রবল আকর্ষণ আছে । ভালো লাগে ভাবতে : আপাত যা কিছু -- এই সবই এক পরম সত্যেরই প্রকাশ ।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন