স্বরবর্ণ
সৃজনের মৌলিক স্বর
বুধবার, ১ অক্টোবর, ২০২৫
প্রসঙ্গ স্বরবর্ণ *
প্রভাত ভট্টাচার্য * ধারাবাহিক রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনী
ধারাবাহিক রহস্য রোমাঞ্চ গল্প
প্রভাত ভট্টাচার্য
পর্ব * ৫
কৃষ্ণ বিকেলেই বাড়ি ফিরে এল। এসেই ছাদে চলে গেল গাছগুলোর অবস্থা দেখতে । দু একটা গাছ নেতিয়ে আছে। দেখতে হবে ভালো করে। হলুদ গোলাপটা বেশ ভালো লাগছে। পেয়ারা হয়েছে চারটে। লাল টকটকে চেরী হয়েছে । খুব সুন্দর একটা প্রজাপতি ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেক কসরত করে মুবাইলে তার ছবি তুলতে পারল।
আমিও তুলেছি ।
কথা শুনে ফিরে তাকাল কৃষ্ণ। উজ্জ্বয়িনী চলে এসেছে।
আরে দিদি যে। কি করে এলে ?
কমলাদি খুলে দিয়েছে।
কমলাদির কাছে একটা চাবি থাকে।
যাক ভালো হয়েছে । চলো নীচে যাই। অন্ধকার হয়ে এসেছে।
হ্যাঁ চলো। আমি ফিশ কবিরাজি নিয়ে এসেছি।
বাঃ, চায়ের সঙ্গে জমবে ভালো। সূর্যদাও হয়ত এক্ষুণি চলে আসবে।
বলতে বলতেই সূর্য চলে এল।
কমলাদি চা আর কবিরাজি দিয়ে গেল ।
তুমিও কবিরাজি নিও। কমলাদিকে বলল উজ্জ্বয়িনী ।
আচ্ছা । তুমি খুব ভালো।
গল্প চলতে লাগলো।
হাতে তো এখন কোন কেস নেই ? বলল উজ্জ্বয়িনী ।
না গো। জবাব দিল কৃষ্ণ।
ভালো কথা, আমাকে দিল্লিতে যেতে হবে বিশেষ কাজে। সূর্য বলল।
একাই যাবে?
হ্যাঁ রে। ব্যাপারটা ভীষণ গোপনীয়। পরে সব বলবো। রাগ করিস না।
আরে, ঠিক আছে। কদিনের জন্যে ?
ঠিক বলতে পারছি না।
নতুন কোন রহস্যের ব্যাপার ? উজ্জ্বয়িনী বলে উঠল।
দেখা যাক।
তাহলে আমি এখন উঠি। বলে উজ্জ্বয়িনী বিদায় নিল।
মন খারাপ হয়ে গেল নাকি। সূর্য বলল কৃষ্ণকে।
না, ওরকম কিছু নয়।
সূর্য রওনা দিল দিল্লির উদ্দেশ্যে। কৃষ্ণ আর উজ্জ্বয়িনী তাকে এয়ারপোর্টে ছাড়তে এল।
প্লেনে বসে সূর্য ভাবতে লাগল পরবর্তী কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে।
দিল্লিতে তাকে স্বাগত জানানোর জন্য ছিল অনুজ শর্মা। প্রথমেই তাকে নিয়ে যাওয়া হল স্পেশাল অফিসার আনন্দ কুমারের কাছে। তার সঙ্গে বেশ খানিকক্ষণ কথা হল সূর্যর।
কাজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং কঠিন। আপনার এতটাই সুনাম আছে যে এই কাজের জন্য আপনাকেই যোগ্য বলে মনে করা হয়েছে। বললেন আনন্দ।
থ্যাঙ্ক ইউ।
আপনার সঙ্গে অনুজ থাকবে। ও খুবই দক্ষ অফিসার। আর কজন দরকার।
আর কাউকে এখন দরকার নেই। ঠিক সময়ে বলবো।
ঠিক আছে, অল দ্য বেস্ট। পরে দেখা হবে। আনন্দ
করমর্দন করলেন সূর্যের সঙ্গে।
এরপর একটা হোটেলের ঘরে সূর্য আর অনুজ মিলে
ছোটোখাটো একটা আলোচনা সেরে নিল।
পর্ব * ৬
নতুন সদস্যের আগমন
সেদিন সকালে অজয় তার কেবিনে বসেছিল । সেইসময় একজন দরজায় টোকা দিল।
ভেতরে আসুন। বলে উঠল অজয়। একজন প্রবেশ করল। লম্বা চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি , কেমন একটু খ্যাপাটে ভাব। কানের পাশে আবার হিয়ারিং এড রয়েছে।
আমি অতীশ দত্ত, একজন সায়েনন্টিস্ট । বিজ্ঞাপন দেখে এলাম। আসলে আমার কাজের মর্যাদা কেউ দেয় না। আমি এমন এক জিনিস বার করেছি যা একটুখানি ছড়িয়ে দিলেই লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাবে। আরো অনেক এরকম আবিস্কার আছে আমার।
বাঃ খুব ভালো ।
কি বললেন, আলো। হ্যাঁ, আলোহাওয়া থাকলে বেশ ভালো লাগে।
এর কানের অবস্থা দেখছি দারুণ। যাক, এ কাজের লোক। মনে মনে বলল অজয়। তারপর শার্দুলকে ডেকে রবিনসনের কাছে নিয়ে যেতে বললেন অতীশকে। ল্যাবরেটরিটা দেখিয়ে দেবে। ওকে দিয়ে অনেক কাজ হবে।
শার্দুলও কেমন বিরক্তমুখে নিয়ে গেল অতীশকে।
একটু পরেই আবার হাজির হল আর একজন। তার নাম সুমিত। সে কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ এবং হ্যাকার। বেশ চটপটে। সেও কোথাও পাত্তা না পেয়ে এখানে এসেছে। এরকম লোক তো ভীষণই দরকার। তাকেও শার্দুলের সাথে পাঠিয়ে দিল অজয়।
এতক্ষণে সম্পূর্ণ হল তার টীম। আর কদিন পরেই শুরু হবে অ্যাকশন।
এদিকে কৃষ্ণ সূর্যের মোবাইলে ফোন করে পেল না। তারপর দেখল , সূর্য মেসেজ পাঠিয়েছে , এখন বেশ কিছুদিন আমাকে ফোনে পাবি না। চিন্তার কিছু নেই। কাজে ব্যস্ত থাকবো। গৌরবের সঙ্গে বরং মাঝে মাঝে কথা বলে নিস আর নিজের খেয়াল রাখিস।
কৃষ্ণ উজ্জ্বয়িনীকে সব জানাল। তারপর ফোন করল গৌরবকে। গৌরব সূর্যের বন্ধু আর ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চে কাজ করে।
ফোন ধরে গৌরব বলে উঠল, আরে কৃষ্ণ ভাই, বলো কি খবর।
এমনি সব ঠিক আছে, সূর্যদার ব্যাপারে জানতে চাইছিলাম।
তোমার সূর্যদা তো এখন বেশ বড় একটা কাজ নিয়ে আছে। খানিকটা সময় তো লাগবেই। অত টেনশন করার দরকার নেই। পরে যাবো একদিন, তোমার হাতের রান্না খেয়ে আসবো।
নিশ্চয়ই।
কৃষ্ণ ফোন রেখে দিল।
************************************"**************************************************************
গুচ্ছ কবিতা * সন্তর্পণ ভৌমিক
কবিতাগুচ্ছ * সন্তর্পণ ভৌমিক
নির্ভেজাল নরক যেমন
নরক আসছে দেখি অকপটে
মাঝরাতে, রাতপাখি ঘুমিয়ে যখন
তোমার বারান্দা ঘেঁষে
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে পড়ে যাওয়া ভবিষ্যৎ
আর যত অকীর্তিকাণ্ডপ্রলাপ
ক্ষয়ে যাওয়া মন নিয়ে ভাবে
কিভাবে গ্রহের দোষে
তোমার চরিত্র আজ নু্লো হয়ে পড়ে
প্রশ্নবিদ্ধ জন্মসম্ভাবনা
কিভাবে মসৃন হলো
তোমাদের প্রজনন ক্রিয়া?
বিপরীত ঘরে আমি শ্বাসকষ্টে থাকি
কার পায়ে কে হেঁটে যায়, নরক অবধি।
ঘাতক প্রণালী
তুমি জন্ম থেকে জেগে উঠো রাত্রি গূঢ় হলে
এবং খোঁজো অন্ধ ময়াল নগর ঘুরে শেষে
পাতার গহন অন্ধকারে রিক্ত পেটে শোয়
কেমন তাদের অভিপ্রায়ে রাষ্ট্রে আসে ক্ষয়
নখর তোমার দৃষ্টি হলো মৃত্যুভীত কারা
জীবজগতে তোমার লাস্য রক্তঘামে আঁকা
হৃদয়গন্ধি আগুনে পুড়ে দাহ্য বর্তমান
ধবল মানুষ রাত্রে দেখি দুঃখে ম্রিয়মান।
অচিন পাখি
স্তব্ধপ্রায় পণ্যপাখি দেখি
বস্তুত বাড়ির কোনো ভগ্নপ্রশাখায়
নিরিবিলি, নির্বিরোধি, শব্দউৎসহীন
আমি আড়চোখে দেখি
ইশারা ইঙ্গিতে বুঝি সখ্যপ্রিয় নয়
উদাসী মনের কাছে অতীত প্রবল
কি হলো, না হলো রহস্য প্রাচীন
বিপন্ন বাতাস আসে আষাঢ়ি বর্ষণে
স্থলপাখি হারিয়েছে বাস্তুপুরুষের
বিপাকে বিক্রিত হলো লজ্জাদেহখোল
একদম শেষে গেল বিরহ আমূল।
দাহ ও দাহ্য
আচম্বিতে ঘুরি ফিরি
দীর্ঘ অববাহিকায়
সমুদ্রকন্যা খুঁজি, অথবা
নিঃশব্দ শ্মশানে খুব
সপ্তপিণ্ড পূর্বপুরুষের
তোমার কংকালও
আমার চাহিদাও
প্রতিরাতে তোমাদের ইচ্ছে অনুসারে
শ্মশানসমাধি হয়
চাপাকান্না মাটিচাপা হয়
নিজের বল্কল পুড়ি
নিখাদ লজ্জাও
অনুতপ্ত রিক্ততার শেষ ভালোবাসা
পুড়িয়েছি ইতিহাস
জনাকীর্ণ জনপদ
এবং বিরক্ত এক কবির খাতা।
স্তব্ধ রাত স্তব্ধ দিন
বিপন্ন অবস্থা থেকে
তুমি ফিরে আসো
আমাদের পুষ্পতীর্থে
যেখানে শিশির আসে
ধুয়ে দেয় সন্ন্যাসীর
পা, আর হাতখানা, যেখানে
পৃথিবীর চপল মতিগুলো
আজ ধীর হয়ে শুয়ে থাকে
গুনে নেয় দিনরাত
পৃথিবীর সব গতি,
দিক ও আহ্নিকগুলো
ঘৃণ্য ঘূর্ণাবর্তে শেষাবধি নিঃস্ব হয়ে গেলে
সমগ্র সমুদ্র হয়ে
আমি আসি ক্ষিপ্রকায় প্লাবনের রূপে
আজ আর লজ্জা নেই
দুই চোখ ছেয়ে আসে, দেখো, ব্যর্থতার জলে।
******************************************************************
উপন্যাস * সুদীপ ঘোষাল
জীবন হাটের কড়চা
সুদীপ ঘোষাল
পর্ব * ১০
গ্রীষ্ম অবকাশে বট গাছের ডালে পা ভাঁজ করে বাদুড়ঝোলা খেলতাম বিশুর নেতৃত্বে।তারপর ঝোল ঝাপটি। উঁচু ডাল থেকে লাফিয়ে পড়তাম খড়ের গাদায়। এসব খেলা বিশুর আবিষ্কার। তারপর সন্ধ্যা হলেই গ্রামের বদমাশ লোকটিকে ভয় দেখাত বিশু। সুদখোর সুরেশ মহাজন বটগাছের ডাল থেকে শুনলো, কি রে বেটা খুব তো চলেছিস হনহনিয়ে। আয় তোকে গাছে ঝোলাই। সুদখোর অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো। তারপর থেকে ও পথে যেত না মহাজন। সাদা চুলো গান্ধিবুড়িকে রোজ সন্ধ্যাবেলা নিজের মুড়ি খাইয়ে আসতো অতি আদরে। বিশু বলতো, আমি তো রাতে খাবো। বুড়ির কেউ নেই, আমি আছি তো। শ্রদ্ধায় মাথা নত হত নেতার হাসিতে।
একবার বন্যার সময় স্কুল যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন আমাদের নেতা। কোথাও সাঁতার জল কোথাও বুক অবধি জল। একটা সাপ বিশুর হাতে জড়িয়ে ধরেছে। বিশু এক ঝটকায় ঝেরে ফেলে দিলো সাপটা। স্কুল আমাদের যেতেই হবে। সাঁতার কাটতে কাটতে আমাদের সে কি উল্লাস। যে কোনো কঠিন কাজের সামনাসামনি বুক চিতিয়ে সমাধান করার মতো মানসিকতা বিশুর ছিলো। সে সামনে আর আমরা চলেছি তার পিছুপিছু। শেষ অবধি পৌঁছে গেলাম স্কুল। হেড মাষ্টারমশাই খুব বাহবা দিলেন স্কুলে আসার জন্য। তিনি বললেন, ইচ্ছা থাকলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।
টিফিনের সময় ছুটি হয়ে গেলো। আসার সময় একটা নৌকো পাওয়া গেলো। মাঝি বললেন, আমার বয়স হয়েছে আমি একা অতদূর নৌকা বাইতে পারবো নি বাবু। তাছাড়া আমার এখনও খাওয়া হয় নি।
বিশু সঙ্গে সঙ্গে নিজের টিফিন বের করে দিলো। আমরাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো টিফিন বের করে দিলাম। মাঝি ভাই বললেন, এসো সবাই এক হয়ে খেয়ে লি। তারপর নৌকার কান্ডারি হলো বিশু। আর আমরা সবাই মুড়ি মাখিয়ে খেতে শুরু করলাম। মাঝি ভাই ও বিশু খেলো। ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলাম গ্রামে। মাঝি ভাইকে পারিশ্রমিক দিয়ে বিদায় জানালাম।
পরের দিন রবিবার। রঙিন সকাল। আকাশে মেঘের আনাগোনা। কাশের কারসাজি নদীর তীর জুড়ে। বন্যার জল নেমে গিয়েছে। পুজো পুজো ভাব। বিশু কাশফুলের ভিড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। কয়েকদিন হলো তাকে দেখা যাচ্ছে না।
আমি ঘুরতে ঘুরতে পুজো বাড়ির ঠাকুর দেখতে গেলাম। সেখানে দেখি বিশু হাতে কাদা মেখে শিল্পীকে সাহায্য করছে। তিন দিন ধরে এখানেই তার ডেরা। এখন তার মনে বাজছে ঢাকের ঢ্যামকুড়াকুড়। মন মন্দিরে তার দুর্গা গ্রামদেশ ছাড়িয়ে অভাবি বাতাসে বাতাসে। পুজো বাড়িতে আমাকে দেখেও কোনো কথা না বলে হাঁটতে হাঁটতে বাইরে চলে গেলো।
আমি জানি সে এখন চাল, ডাল নিয়ে সর্দার বুড়িকে রেঁধে খাওয়াবে। সে বলে, ওর যে কেউ নেই। ও খাবে কি?
বিশুর বাবা বছরে একবার বাড়ি আসেন। তিনি ভারতীয় সৈন্য বিভাগে কাজ করেন। বাড়িতে এলেই বিশুর হাতে হাতখরচ বাবদ তিনি বেশ কিছু টাকা দিয়ে যান। সেই টাকা বিশু লোকের উপকারে কাজে লাগায়।
বড়ো অবাক হয়ে ভাবি, ছোটো বয়সে এতবড় মন সে পেল কোথা থেকে?
স্কুলের দূরত্ব অনেক বেশি হওয়ায় আমাদের চার বন্ধুর বাড়ির গার্জেনরা শলা পরামর্শ করে হোষ্টেলে থাকার কথা বললেন। দায়িত্ব নিলো বিশু। কিন্তু হেড মাষ্টারমশাই বললেন, সেশনের মাঝে হোষ্টেল পাবি না। ঘর ভাড়া নিয়ে চারজনে থাক। পরীক্ষা এসে গেছে। কাছাকাছি থাকিস তিনটি মাস। রেজাল্ট ভালো হবে।
ঘুরে ঘুরে অবশেষে ভাড়া ঘর পেলাম। কিন্তু বাড়িওয়ালার পাশের প্রতিবেশি বললেন, সাবধান ওই বাড়িতে ভূত আছে। আমরা ভয় পেয়ে তিনজনে বলে উঠলাম, তাহলে অন্য ঘর দেখি চল।
বিশু বললো, টাকা দেওয়া হয়ে গেছে। ভূতের বাড়িতেই থাকবো। বিশু যখন সঙ্গে আছে, ভয় কি তোদের।
তার অভয় বাণী ভরসা করে আমরা মাল পত্তর নিয়ে ঢুকে পড়লাম লড়াইয়ের কোর্টে। ক্যাপটেন বিশু বাড়িটা এক চক্কর পাক দিয়ে হাতে একটা লাঠি নিয়ে বললো, চলে আয় ভূতের বাচ্চা। আমরা ওর সাহস দেখে অবাক হতাম। রমেন বলে উঠলো, ভূতের শেষ দেখে ছাড়বো। জীবনের মরণের ভয় একটু বেশি। সে কাঁপা গলায় বলে উঠলো, যদি গলা টিপে ধরে ভূত। বিশু বললো, ভয় নেই, আমি একাই একশো। তোর কিছু হবে না। হলে আমার হবে।
এই বাড়ির নিচু তলায় কিছু অসামাজিক লোকের কাজকর্ম বিশু এক সপ্তাহের মধ্যেই টের পেয়ে গেলো। তারাই এই ভূতের ভয় দেখায়। একদিন জীবন বাথরুম গেছে এমন সময় নাকি সুরে একজন বলে উঠলো, এঁখান থেকে পাঁলা। ঘাড় মটকে দেবো। আবার একদিন রমেন ভয় পেলো। ঠিক সেই বাথরুমে। বিশু তদন্ত করে দেখলো বাথরুমের ভেন্টিলেটার ভেঙ্গে একটা সরু দড়ি ঢোকানো হয়েছে। বাইরে গিয়ে দেখলো দড়িটা নিচের ঘরের বারান্দায় শেষ হয়েছে। বাথরুমে ভাঙ্গা কাঁচে টান পরলে বিকট আওয়াজ হয়। আর মুখ বাড়িয়ে মুখোশ পড়ে নাকি সুরের কথায় সকলেই ভয় পাবে। বিশু বললো সবাই তৈরি থাকিস। আজ রাতেই ভূত ধরবো।
আজ আর কেউ স্কুল গেলাম না। একটা উত্তেজনা রাতে জাগিয়ে রেখেছে। এবার সেই বিকট শব্দ। বিশু বাঘের মতো লাফিয়ে লাঠি হাতে নিচের তলায় গিয়ে জলজ্যান্ত ভূতের পাছায় লাঠির আঘাতে ভূতকে কাবু করে ফেললো। ভূত বাবাজি জোড় হাতে বলছে, ছেড়ে দাও বাবা আমি আর ওসব করবো না। ভূতের সঙ্গিরা সব পালিয়েছে, আমাদের হাতে লাঠি দেখে। বিশু বললো, যাও, যেখানে বিশু আছে সেখানে চালাকি করার চেষ্টা কোরো না। বিপদে পড়বে।
তারপর থেকে আর কোনোদিন ভূতের উপদ্রব হয়নি সেই বাড়িতে।
বিশুর বাহাদুরি দেখেই আমরা সাহসী হয়ে উঠেছিলাম। বিশুর সঙ্গে আমরা বেরোলে সকলের চোখেমুখে একটা সাহসের,শান্তির ছাপ ফুটে উঠতো। পাড়ার কোনো মানুষ বিপদে পরলে বিপদের বন্ধু এই টাইগার বিশুকেই স্মরণ করতো। তার সঙ্গে আমরা তো থাকতাম অবশ্যই। রমেন, জীবন,বিশু,আমি একবার বন্যার সময় নৌকা করে মানুষের খাবার জোগাড় করতে চড়খী গ্রামে গিয়েছিলাম। হেলিকপ্টার থেকে চিড়ের বস্তা,গুড়ের বস্তা ফেলছে চড়খীর ব্রীজে যার আসল নাম কাশীরাম দাস সেতু। সেখান থেকে আমরা চিড়ে, গুড়ের পাটালি নৌকায় তুললাম। রমেন পেটুক। বললো, একটু টেষ্ট করলে হয় না। বিশু বললো, এখন এটা সকলের সম্পত্তি। যা হবে সকলের সামনে হবে। কেউ হাত দিবি না। এখন তাড়াতাড়ি চল। বান বাড়ছে। বিশু দাঁড় টানেআর আমরা সবাই সাহায্য করে নৌ্কা ও খাবার নিয়ে চলে এলাম নতুন পুকুরের পাড়ে। সেখানে বাড়ি বাড়ি সকলকে সমানভাবে খাবার ভাগ করে দিলো বিশু। তারপর আমরা বাড়ি এসে জীবনের মায়ের হাতের রান্না, গরম খিচুড়ি আর পেঁপের তরকারি খেলাম। অমৃতের স্বাদ। বিশু বললো, কাকীমা অনেক পেঁপে গাছ পড়ে গেছে বন্যার স্রোতে। আমরা আপনাকে অনেক পেঁপে এনে দেবো। সেবার বন্যায় পেঁপে, গ্রামের লোকের প্রাণ বাঁচিয়েছিলো। আমাদের গ্রাম অজয় নদীর ধারে। গ্রামগুলিও খুব নীচুস্থানে অবস্থিত। নদীর নাব্যতা বা গভীরতা অল্প। ফলে বন্যা প্রায় প্রতি বছর দেখা দিয়ে যেতো। জল যখন কমে যেতো তখন তোতনের মা ও পাড়ার মা বোনেরা মাঠে মাছ ধরার জন্য যেতো। নানারকমের শাক, ঢোল কলমি, শুশুনি তুলতো। খুব ভালো লাগতো নানারকমের মাছ ভাজা খেতে। আমি দেখলাম,
তোতনের মা মাঠ থেকে দুই তিন রকমের শাক তুলেছে। ওরা ভিটামিন বোঝে না, শরীরচর্চ্চাও বোঝে না। ওরা জানে খাটবো, রোজগার করবো আর খাবো পেট ভরে। মাঠেই পাওয়া যেতো বেশির ভাগ শাক, সব্জী। , খলসে, ওআরও নানারকমের মাছ মাঠের জলে সাঁতার কেটে বেড়াতো। বেলে, তে চোখো,চ্যাঙ,ছিঙুরি,গচিমাছ ছাড়াও ছোটো কাঁকড়া তাল কাঁকড়া পাওয়া যেতো। গর্তে হাত ঢুকিয়ে বিশু অনরকবার তআল কাঁকড়া বের করে আমাদের দেখিয়েছে। পাঁকাল,গুঁতে,কৈ,মাগুর,ল্যাটা প্রভৃতি অসংখ্য মাছ। বিত্তি পেতে দিতো স্রোতের মুখে।
বিশু বলছে, খাল কেটে মাঝখানে বিত্তি পেতে জল যাওয়ার নালা কেটে দিতো। মাছ লাফিয়ে ওই গর্তে পড়তো। টানা জাল,পাতা জাল দিয়ে মাছ ধরতো। এখন তোতনের মায়ের জায়গায বৌমা মাঠে যায়। কিন্তু কৃষিকাজে সার, ওষুধ প্রয়োগ করার ফলে সেইসব মাছ ইতিহাসের পাতায় চলে গেছে। শাকপাতাও পায় না মা বোনেরা। এখন সব বাজারমুখী।। তখন শাক আঁচলে করে নিয়ে গিয়ে বাউরীবউ মুড়ি নিয় আসতো চাষি বাড়ি থেকে। মাঠের টাটকা শাক সবাই নিতো জলের দরে। আজ আর টাটকা কিছু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশুর কথা একশো শতাংশ সত্য। এখন আমরা বড় হয়ে গেছি। কিন্তু, স্বর্ণ যুগের সেইসব স্মৃতি মনের মণিকোঠায়চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
পড়াশোনা আমার ভালোবাসা। মানুষ আমার দেবতা। মাষ্টার ডিগ্রী কমপ্লিট করে আমি বি,এড করেছি। তারপর স্কুল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়েছি। তিন মাস পরে রেজাল্ট। এই অবসরে আমার বন্ধু আশীষের কথা মনে পরছে।
আশীষ নামের সীমাহীন আনন্দমাখা ছেলেটা ভেলোরে গিয়ে জানতে পারলো,তার হার্ট বড়জোর আর দুবছর চলবে। এত কথা জেনেও কোনোদিন মুষড়ে পরেনি তার মন। ফুটবল খেলতে ভালোবাসতো ছেলেটা। সারা বিকেল ছুটে ছুটে সে আনন্দ মাখতো সারা গায়ে। আলো নামের আলো মনের মেয়েটা জেনেশুনে তার সমস্তকিছু দিয়েছিলো দুদিনের আনন্দের দেবদূতকে। পৃথিবীর রঙ,রূপ, রস সে একশো বছরের পরমায়ুর মতো পেয়ে গিয়েছিলো মনের প্রসারতায়। কেউ তাকে সান্ত্বনা দিতে এলেই কথা ঘুরিয়ে তার চোখে এঁকে দিতো স্বপ্ন।
তার সঙ্গে ঘুরতে গেছিলাম মুর্শিদাবাদের রামপাড়া। গঙ্গার ধারে গ্রামটি। ছোটো হলেও আমরা বন্ধুরা প্রত্যেকটি বাড়ি বাড়ি ঘুরেছি। কারো বাড়ি স্নান করা, কারও বাড়িতে খাওয়া দাওয়া।কারওবাড়িতে গান বাজনা করেই দিন চলে যেতো। দুর্গাপুজোর বিসর্জনের দিনে নৌকা করে ঠাকুর বিসর্জন দেখলাম। গঙ্গার ধারের সব গ্রামের ঠাকুর নৌকো করে মাঝ গঙ্গায়এনে বিসর্জন করা হচ্ছে ঢাক,ঢোল বাজিয়ে। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমেএলো। সন্ধ্যা নেমে এলো আশীষের জীবনে। রাত হওয়ার আগেই পাড়ি দিলো ভবসাগরের ওপাড়ে। তার সংসারে বাবা,মা, তিন বোন। আশীষের বাবাকে আমি জামাইবাবু বলতাম। তিনি কেলকাতা লালবাজারের কমিশনারের দপ্তরে কাজ করতেন। তার দাপ ছিলো ভীষণ। তার নামে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেতো। তিনি ছেলের শোকে মারা গেলেন। দিদি কয়েক মাসের মধ্যেই চলে গেলেন। বড্ড প্রাণপ্রিয় ছিলো তার আশীষ। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। রামপাড়ার বাড়িতে আর কেউ নেই। কতকগুলো ঘুঘু মনখারাপের ডাক ডেকে চলে নিশিদিন। ওই নিরীহ পাখি মানুষকে সত্য, সুন্দরের বাণী শোনায় আজীবন। বড্ড প্রিয় আমার এই ঘুঘু পাখি। ভিটেতে ঘুঘু চড়ে না,সে মনে রাখে এই ভিটের মালিক একদিন আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলো,আজও দিয়েছে। তাই কৃতজ্ঞ সুরে তার শোকপ্রকাশ মালিকের অবর্তমানে। আমার তাই মনে হয়। সত্য ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার নাম ধর্ম।
কি করে একটা সাজানো বাগান তছনছ হয়ে যায়। বন্ধু অমিত বললো। তবু মানুষের এত অহংকার। তারা মনে করে মৃত্যু বোধহয় তাদের ভুলে গেছে। সে ভোলে না। হঠাৎ চলে আসে। সময় থাকতে বাড়ির কাছের মানুষের সেবা করাই ভালো। পৃথিবী সুন্দর হয়ে উঠবে,পরস্পরের সেবা, ভালোবাসার মাধ্যমে।
আমার বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ দুই বছর নেই। কোনোদিন যদি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারি,তখন বাড়ি যাবো। মা, বাবার চিন্তা আমি দূর করবোই। আমি যেখানে ভাড়া আছি, তার পাশের বাড়ির ছেলেটা আমার কাছে পড়ে। ছেলে পড়িয়েই ভালোভাবে আমার চলে যায়। পাশের বাড়ির মর্মান্তিক ঘটনা আজও আমায় ব্যথিত করে। সেই ঘটনা ছবির মতো মনে পরছে...
বিয়ের পর থেকেই স্বামী স্ত্রী র মধ্যে বনিবনা ছিলো না। কথায় কথায় ঝগড়া। এমনি করেই দিনগুলো কেটে গেলো। সন্তান হলো। পুত্র সন্তান। ঝগড়া,অভাবের মধ্যে দিয়েই বেলা বয়ে গেলো। পানসি তরি। চর চর করে এগিয়ে যায় স্রোতের প্রতিকুলেও। থামা জানে না।
রুমা বললো, ছেলে বড়ো হলো। কলেজে পড়ছে। এবার আয় বাড়াও। এতে আর সংসার চলছে না।
বিমল সব বোঝে। কিন্তু উপায় নেই। ছোটো থেকে পরিশ্রমের কাজ করে নি। তাই পঞ্চাশ বছরে ভারি কাজ করতে পারে না। তাঁতি তাঁত বুনেই যায়। তারপর দোকানে দিয়ে আসে। এসব কাপড়ের কদর আগের মতো আর নেই। বিক্রি কমেছে। আয় কমেছে। বয়স, সংসারের খরচ বেড়েছে। তবু আলো খোঁজে বিমল। অবসর সময়ে কবিতা লেখে। ছবি আঁকে। রুমা দেখেছে কবিতা লেখার সময় বিমলের বয়স বোঝা যায় না। অনেকখানি কমে যায় বয়সের বল্লিরেখা।
ছেলে সবুজ। কলেজে পড়ে। মোবাইল চাই। বন্ধু বান্ধবীদের হাতে সব দামি দামি মোবাইল। এখনকার ছেলে মেয়েরা কথা কম বলে। কানে তাদের গোঁজা হেড ফোন। হাতে মোবাইল। আনলিমিটেড কল। তাই সব সময় ফোনে কথা। হেড ফোন গোঁজা। কথা শুনতে পায় না। ফোন করলেই পাওয়া যাবে। ভয় হয় বিমলের মানুষ কুড়ি বছর পরে কথা বলবে তো? সমাজ, আত্মীয় স্বজন থাকবে তো। সম্পর্ক ভালোবাসা বলতে কিছু থাকবে তো। সম্বিত ফিরে এলো রুমার রমণীয় গলার ডাকে।
---- কই শুনছো,বাজারে যাচ্ছি। দরজাটা ভেজিয়ে দাও।
আর কিছুদিন পরেই ভাইফোঁটা। রুমা বাবার বাড়ি যাবে। খুড়তুতো,জ্যাঠতুতো সব মিলিয়ে অনেক ভাই। ওর পাড়াশুদ্ধ ভাই। বাইরেআকর্ণ বিস্তৃত হাসি। স্বামীর কাছে এলেই গম্ভীর। তবু বিমল সম্পর্কটা টিকিয়ে রেখেছে। গড়াই তার ধর্ম, ভাঙ্গা নয়। কিন্তু বাড়ির লোক বোঝে না।
ভাইফোঁটায় নিজের ভাইয়ের কল্যাণ কে না চায়। বিমলের দুই বোন। আজ বোধহয় পাঁচবছর ফোঁটা পাইনি,বিমল ভাবে। তাতে কি? ওরা সুখে থাকুক।আমি বাড়ির প্রহরায় আছি। বিড় বিড় করে বিমল আপন মনে। মনটা ছিলো তাই,কথা বলে সুখ পায়।ছেলেটাও ভাইফোঁটায় খুড়তুতো বোনের কাছে ফোঁটা নিতে পারে নি পাঁচ বছর।বিমল বলেছে,তুমি একবার যাবে,আবার আমাদের এখানে ফোঁটা হবে পরের বছর। কিনতু রুম্পা রাগ করে। বলে, কতগুলো উপহার পাই বলতো। আর এখানে থাকলেই তোমার কৃপণতা। ফালতু বোকো না। আমি ভাইফোঁটায় বাবার বাড়ি যাবোই। কিন্তু তোমার ছেলে,আমার কারো ফোঁটা হবে না। সে বলে, তা আমি কি করবো। কিছু করার নেই। আমাকে দাদারা কত টাকা দেয় জানো।
---- না, তা জানি না। তবে জানি টাকাটা তুচ্ছ। ভাইবোনের ভালোবাসাই আসল। বোনের শুভ কামনায় যম দূরে থাকে। ভাইয়ের পরমায়ু বাড়ে। আবার ভাইদের আশীর্বাদে বোনের পরমায়ু বাড়ে।
---- থাকো তুমি তোমার শুকনো ভালোবাসা নিয়ে। আমার টাকা চাই। শাড়ি চাই। মাংস,মিষ্টি চাই। বাবাঃ এই সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে। শুধু বসে বসে বড়ো বড়ো কথা।
কিছু ক্ষে্ত্র আছে মানুষের কবছু করার থাকে না। তখন সময়ের উপর সব ছেড়ে দিতে হয়। তা না হলে অশান্তি বাড়ে, কমে না।
এদিকে বিমলের বোনরা চেপে ধরে দাদাকে। বলে, তোমার আস্কারা পেয়ে বৌটা একদম কোনো কথা শোনে না। কি আর বলবো। কোনো সময় দেখা হলেই কথা শোনাতে ছাড়ে না। মোবাইল নেই। তাই বোনরা ঠিকমতো যোগাযোগ রাখতে পারে না। তারা বলে , দাদা একটা মোবাইল কিনতে পারো না। তাহলে যোগাযোগ ভালো হয়। এখন আর পোষ্ট কার্ডে কেউ সংবাদ পাঠায় না। ওসব ব্যাক ডেটেড। বিমলের মোবাইল ভালো লাগে না। কবিতা আর কাজ নিয়েই তার সময় কেটে যায়।
দুদিন ধরে নিম্নচাপ। প্রচন্ড ঝড়, বৃষ্টি। তবু রুমা ছেলেকে নিয়ে চলে গেলো বাপের বাড়ি। যাক। ঠাকুর রক্ষা করো। বড়ো ভয় হয়। প্রিয়জন বাইরে গেলে সকলের হয়। রাস্তঘাট সারাই হচ্ছে। সাবধানে যেও... বিমলের আর্তি।
কিন্তু রুমা, ছেলের কোনো খবর নেই। দুপুরে রুমার মা জানালো, বাবা সবুজ আর নেই। বিমলের দম বন্ধ। নিশ্বাস নিতে পারছে না। ওরা বলেছে,বাসআ্যক্সিডেন্টে রুমা বাঁচলেও সবুজ রক্ষা পায় নি। তিনদিন খায় নি বিমল। আজকে বাইরে গেলো। কয়েন বুথ থেকে ফোন করে রুমার মাকে জানিয়ে দিলো,রুমাকে আর এখানে পাঠাবেন না। আমি সব বিক্রি করে আপনার মেয়েকে টাকা পয়সা দিয়ে আসবো।
***********************************************
আগামী পর্বে
***********************************************
সুদীপ ঘোষাল গল্প, উপন্যাস লিখতে ভালোবাসেন।সৃষ্টিসুখ থেকে, অন্তরে আলো জ্বলে ও এবং ছাপাছাপি থেকে, তিন এ নেত্র,এই দুটি গল্পসংকলন বের হয়েছে কলকাতা বইমেলায়।।এছাড়াও আরও পাঁচটি বই আছে বিভিন্ন প্রকাশনার।গল্প দিয়ে শুরু লেখা,ছোটোবলার স্কুলে পড়তে পড়তেই। পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া শহরে বাস করেন লেখক।জন্ম ১৯৬৫ সাল। সানন্দা ব্লগ ঈশানকোণ, আরম্ভ,ধুলামন্দির,অক্ষর ওয়েব,দৈনিক সংবাদ,তথ্যকেন্দ্র,যুগশঙ্খ,আবহমান,অপরজন,কৃত্তিবাসী ওয়েব,ম্যাজিকল্যাম্প,জয়ঢাক,অংশুমালী,প্রভাতফেরী,দৈনিক গতি প্রভৃতি পত্রিকায় লেখালেখি করেন নিয়মিত।
উপন্যাস * বিশ্বনাথ পাল
বামনের চন্দ্রাভিযান
পর্ব * ১৩
বিশ্বনাথ পাল
কুড়ি
পাড়ায় খবরটা এখনই চাউড় করার ইচ্ছে হল না। আর ক’টা দিন যাক। বাড়িতে চিঠি আসুক তারপর না-হয় জানানো যাবে।
দিন পনেরো পরেই বাড়িতে চিঠি এল ত্রাণভবন থেকে। আমি রিলিফ অফিসারের পোষ্ট পেয়েছি। মিসসেলেনিয়াস সার্ভিসে রাজ্যের বিভিন্ন দফতরের প্রায় সমান স্কেলের অফিসার নিয়োগের পরীক্ষা পিএসসি-র মাধ্যমে একসঙ্গে হয়। অধিকাংশ পোষ্টই ব্লকস্তরের। ইন্টারভিউয়ের চিঠির সঙ্গে পনেরোটি পোষ্টের নামের তালিকা এসেছিল। সেখানে এক নম্বরে ছিল এসিডিপিও, দু’নম্বরে বিআরও বা ব্লক রিলিফ অফিসার, এইভাবে বাকিগুলো। প্রতিটি নামের পাশে একটা চৌকো খোপ। সেখানে পছন্দের ক্রমানুসারে এক, দুই, তিন করে সংখ্যা লেখার নির্দেশ। কম সংখ্যা মানে বেশি পছন্দের। আমি সেই খোপগুলোয় পরপর এক, দুই, তিন, চার করে বসিয়ে গিয়েছি। দাশগুপ্ত স্যার বলেছিলেন যে যারা চাকরি করো না তাদের আবার পছন্দ কী? তারা তো একটা ব্রেক চাইছ। ফলে তারা এক, দুই, তিন, চার করে যেমন আছে সংখ্যা বসাবে।
আমি সেই নির্দেশ মেনেছি। পরে শুনি এসিডিপিও পদে ভ্যাকেন্সি ছিল না। ফলে আমি আমার দ্বিতীয় পছন্দের পদ বিআরও পেলাম। আমার র্যাঙ্ক যেহেতু প্রথমের দিকে তাই এমনটা ঘটল।
এক বন্ধুর দাদাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম ত্রাণভবনের অবস্থান। বলল, তালতলায়। এস এন ব্যানার্জী রোডে। এসপ্লানেড থেকে নেলিনসরণি বরাবর বাসে উঠে তালতলায় নেমে খানিকটা হাঁটতে হবে।
সেইমতো চিঠিতে উল্লিখিত নির্দিষ্ট দিনে ত্রাণভবনে গিয়ে আমার সমস্ত সার্টিফিকেট, মার্কশীট ইত্যাদি ভেরিফাই করালাম। এখানে মেডিকেল সার্টিফিকেট এবং ভেরিফিকেশন রোল জমা পড়ার আগে কিন্তু পোষ্টিং অর্ডার বেরবে না। আমার কথা বললাম যে আমি হাইকোর্টে আছি। ওখানে সম্প্রতি আমার ভেরিফিকেশন হয়েছে। মেডিকেল সার্টিফিকেটও আছে। একজন সিনিয়র রিলিফ অফিসার বললেন, তাহলে আর নতুন করে করতে হবে না। তুমি যদি এই চাকরিতে আসো, তাহলে আমাদের লিখিত জানাও যে হাইকোর্টে কাকে অ্যাড্রেস করে আমরা তোমার মেডিকেল এবং ভি আর চাইব।
আমি চুপ করে থাকায় তিনি বললেন, কী আসবে তো এই চাকরিতে?
আমি জোর গলায় বলতে পারলাম না যে আসব। বললাম, আসার তো ইচ্ছা আছে। এখন দেখি বাড়িতে ভাবনা চিন্তা করে।
হাইকোর্ট তো একটা বদ্ধ জায়গা। এখানে চলে এসো। মানুষের সঙ্গে মিশতে পারবে। সম্মান পাবে। বিভিন্ন জেলায় আমাদের ছেলেরা খুব সম্মানের সঙ্গে ভাল কাজ করছে। তবে অন্য চাকরিতে যে সুবিধা আছে এখানে তা নেই। আকাশে মেঘ করেছে আজ অফিসে যাব না এখানে তা চলবে না। এখানে বরং আকাশে মেঘ করলে আরও বেশি করে অফিস যেতে হবে।
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বললেন, আর এর চেয়েও ভাল চাকরি যদি পাও, ছেড়ে দেবে। কিন্তু যতদিন না পাচ্ছ এখানে কাজ করো।
আমি বললাম, কোথায় পোষ্টিং হবে?
পোষ্টিং এখন বলা যাবে না। তবে এই চাকরিতে তো পোষ্টিং দুর্যোগপ্রবণ এলাকাতেই হবে। ধরো পাথরপ্রতিমাতে হল।
আমার দাশগুপ্ত স্যারের কথা মনে পড়ে গেল। স্যার আমাকে বলেছিলেন, যদি দক্ষিণবঙ্গে হয়, মানে গঙ্গানদীর নীচে মানে আপটু মুর্শিদাবাদ পর্যন্ত, তাহলে যেয়ো। উত্তরবঙ্গ হলে যাওয়ার দরকার নেই। পাথরপ্রতিমা শুনে মনে আশা জাগল যে হয়তো অফিসারের চাকরিতে জয়েন করা হচ্ছে।
খবরটা দেখলাম বাতাসে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল। পাড়ায় আমার বাবার নাম ধরে অনেককে বলতে শুনলাম অমুকদার ছেলে হাইকোর্টে চাকরি করে, এখন আবার আরও ভাল অফিসারের চাকরির অফার এসেছে। রিলিফ অফিসার।
অপদার্থ মনে করত যারা তারাও দেখছি আমাকে সমীহ করছে। করুণার পাত্র দেখলাম কারও আবার ঈর্ষার পাত্রে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু আমার অশান্তি শুরু হল। সিদ্ধান্তহীনতার অশান্তি। বেকারত্বের সমস্যার সঙ্গে তুলনীয় না হলেও একাধিক চাকরিও সমস্যা বয়ে আনে। কোনটা ছেড়ে কোনটা করি। হাইকোর্টেই থাকব নাকি রিলিফ অফিসারের চাকরি নিয়ে চলে যাব প্রত্যন্ত গ্রামে? এযেন প্রথমবার এমএসসি পার্ট ওয়ান পরীক্ষা দেওয়ার আগে উদ্ভূত দ্বন্দ্ব ফের এসে হাজির। তখন ছিল ড্রপ দেব না পরীক্ষা দেব এই নিয়ে। আর এখন হাইকোর্ট নাকি ব্লক? কেরানির চাকরি নাকি রিলিফ অফিসারের চাকরি?
মা’র মতামতকে আমি বেশিরভাগ সময় গুরুত্ব দিই, কিন্তু সব সময় দিতে পারি না। মা যেমন একবার চেয়েছিল আমি গেঞ্জির কারখানায় ম্যানেজারের চাকরি করতে নেপাল চলে যাই। তখন মা’র কথা শুনলে আজ আর সরকারি চাকরির মুখ দেখতে হত না। কিন্তু এখন মাও স্পষ্ট কোনও মতামত দিতে পারল না। মায়ের মনের ইচ্ছা আমি হাইকোর্টেই থাকি। কারণ ট্রান্সফার নিয়ে অন্যত্র যেতে হবে না। বাড়ির ভাত খেয়ে অফিস করা যাবে। কিন্তু আমার মনের দিকে চেয়ে সেকথা জোর দিয়ে বলতে পারল না। পরে যদি আমিই আবার দোষ দিই যে তোমার জন্য আমার অফিসারের চাকরি করা হল না। আমার মনের কাঁটা যেন একটু অফিসারের দিকেই ঝুঁকে ছিল।
কখনও সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হলে আমি সাধারণত অন্য মানুষদের মতামত শুনি। কোনও একজনের নয়, অনেকের। তাতে প্রথমের দিকে মাথা একটু ঘেঁটে গেলেও শেষে ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধা হয় না দেখেছি। অনেকের মতামত খারিজ করি এই ভেবে যে লোকটা আমার ভাল চায় না, ঈর্ষাপরায়ণ। ফলে তার মতামতের উল্টো কাজটাই সঠিক।
তো, এবারেও অনেকে স্বপ্রবৃত হয়ে আবার কেউ কেউ আমার দ্বারা অনুরুদ্ধ হয়ে তাদের মতামত জানাতে লাগলেন।
একদিন আমার মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক তড়িৎস্যারের বাড়ি গেলাম। আমার রিলিফ অফিসারের চাকরিপ্রাপ্তির কথা জানিয়ে স্যারের মত জানতে চাইলাম।
স্যার বললেন, আমার মনে হয় তোর হাইকোর্টের চাকরিতে থাকাই ভাল। বাড়ির ভাত খেয়ে সকাল এগারোটায় পান চিবোতে চিবোতে অফিস যাবি। কোনও ঝুটঝমেলা নেই। সুখের চাকরি। প্রচুর ছুটি। কিন্তু সৎ থাকতে পারবি না।
আমি যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। স্যারের মুখে কী শুনছি এটা? যে চাকরিতে আমি সৎ থাকতে পারব না, তাকেই স্যার ভাল চাকরি বলছেন? স্যারকে খুব শ্রদ্ধা করতাম। স্যারের মতো পরোপকারী মানুষ আমি কম দেখছি। স্যার শুধু আমাকে নয়, স্কুলের অনেককেই বিনাবেতনে পড়াতেন।ঙ্কিন্তু ওই দিন স্যারের মুখে ওই কথা শুনে স্যারের প্রতি শ্রদ্ধা আমার যেন খানিক টলে গেল।
স্যার একটু থেমে আরও বললেন, আর রিলিফ অফিসারের চাকরি খুব দায়িত্বপূর্ণ। ঝুটঝামেলা আছে। পলিটিক্যাল প্রেসার থাকবে।
দু-এক দিন পর আমাদের বাড়িতে এলেন পাড়াতুতো এক দাদা। অনিল ধর।বললেন, শুনলাম তুমি একটা অফিসারের চাকরি পেয়েছ?
বললাম, হ্যাঁ অনিলদা। ঠিকই শুনেছেন।
কী চাকরি সেটা?
সংক্ষেপে বললাম।
এখন হাইকোর্টে আছো? কেরানির চাকরি?
হ্যাঁ।
আমার মত তোমার ওই রিলিফ অফিসারের চাকরিতেই যোগ দেওয়া উচিৎ। এখানে মায়নাও ভাল, উপরিও আছে।
আমার কান গরম হয়ে গেল। এই লোকটার কথা মতো দ্বিতীয় চাকরিটাও ঘুষের উর্দ্ধে নয়? আর যদি ঘুষের সুযোগ থাকেও, তবে সবাইকেই সেই সুযোগের সদব্যবহার করতে হবে?
বললাম, সে বাড়িতে আলোচনা করে ঠিক করব কোথায় জয়েন করব। কিন্তু আপনি কি এই কথা বলতেই এলেন?
না, আমি আসলে এসেছি তোমাকে এলআইসি-র পলিসি করাব বলে।
এতক্ষণে পরিষ্কার হল বিষয়টা। আমি ভাল চাকরি পেয়েছি শুনে ছিপ ফেলতে চলে এসেছেন। প্রিমিয়াম দিতে অসুবিধা হবে না ভেবে।
বললাম, কিন্তু আমি শুনেছি আপনি ইরিগেশনে ভাল চাকরি করেন, আপনি আবার এলআইসি-র এজেন্টও হয়েছেন? চাকরি করে এসব করা যায়?
এটা বউয়ের নামে করি।
ছোটবেলার একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। একবার পাড়ার একটা ছেলে অনিলদাদের গাছের জামরুল পেড়ে খাচ্ছিল। খবর পেয়ে লোকটা ছুটে এসে লাথি চালিয়ে ছিল। গায়ে লাগেনি, কারণ ছেলেটা ভয়ে দৌড় লাগিয়েছিল। কিন্তু লঘু পাপে এরকম লাথির গুরুদণ্ড আমার ভাল লাগেনি। ওই ঘটনার কারণে লোকটাকে আমি আর কোনওদিন ভাল চোখে দেখতে পারিনি। গাছের ফল ছোটরা যদি না বলে কয়েকটা পেড়ে খায়ই, তার জন্য লাথি চালাতে হবে? বললাম, দেখুন আমার এই মুহূর্তে কোনও এলআইসি করার প্ল্যান নেই। আর যদি করিও আপনার কাছে কেন করব? আমি কোনও বেকার ছেলের কাছে করব, যার এটাই একমাত্র জীবিকা। আপনি তো চাকরি করেন, এটা আপনার সাইড বিজনেস। আমি না করলে আপনার কোনও ক্ষতি হবে না।
লোকটা মুখের ওপর এত স্পষ্ট উত্তর মনে হয় আশা করেনি। বললেন, না, আমার কাছে করলে তুমি অনেক সুবিধা পেতে।
কী সুবিধা পেতাম?
কোনও মাসের প্রিমিয়াম দিতে অসুবিধা থাকলে আমি নিজেই তা দিয়ে দিই। কাস্টমার পরে আমাকে শোধ দেয়। এই যে অমল আছে না, ওকে জিজ্ঞেস কোরো।
মনে হল, লোকটার গায়ের চামড়া ভয়ানক মোটা। এখনও তদবির করে যাচ্ছে আমার স্পষ্ট বার্তা উপেক্ষা করে। বললাম, আচ্ছা, আমি যদি কখনও আপনার কাছে পলিসি করার সিদ্ধান্ত নিই, আমি নিজেই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব, আপনাকে আসতে হবে না।
আচ্ছা। বলে বিদায় নিলেন।
আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে একজনের কথা না বললেই নয়। যতদিন বাঁচব, আমার মনে থাকবে কথাটা। আমার বাবার পিসতুতো ভাই। মানে সম্পর্কে আমার দাদা। কিন্তু দাদা বলতে যেমন বয়সের ফারাক কম বোঝায়, তেমন নয়। আমার থেকে প্রায় বছর কুড়ির বড়। আমাদের পাড়াতেই থাকে। নিজে সরকারি চাকরি করে এবং পাশাপাশি ঠাকুর বানায়। তো, সেই দাদার সঙ্গে একদিন বাসে দেখা। বলল, তুই নাকি রিলিফ অফিসারের চাকরি পেয়েছিস?
আমি সম্মতি জানাতেই বলল, আমার মতে তোর হাইকোর্টের চাকরিই ভাল। ও চাকরিতে খবরদার যাস না। ওখানে গেলে জামা-প্যান্ট খুলে নিয়ে যাবে।
বাসে এক গাদা লোকের মধ্যে আমার আর এই নিয়ে কথা বলার প্রবৃত্তি হল না। দাদার কথায় খানিক আহত হলাম। এখানে দাদার একটা গল্প বলি। আমাদের বাড়িতে দাদা বা বউদি প্রায়ই আসত। দাদা হয়তো কোনও কাজে আসত। বউদি আসত মা’র সঙ্গে গল্প করতে বা বলা যায় ছেলের গুণকীর্তন করতে। হ্যাঁ, বউদির গল্প মানেই ছেলের প্রশংসায় পঞ্চ নয়, পঞ্চান্ন মুখে প্রচার চালানো। তো, যাইহোক, একদিন মেয়ের বিয়ের নেমতন্ন করতে এসেছে দাদা। নিকটাত্মীয়ের বিয়ে, তাই বউভাতের দিন কন্যাযাত্রীদলেও আমাদের আমন্ত্রণ জুটবে, এটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু দাদা মেয়ের বিয়ের নেমতন্ন করে আমার বাবাকে বলল, ছোটমামা, তোমার তো ভাল জামাকাপড় নেই, তাই তোমাকে আর কন্যাযাত্রী যেতে বলছি না।
আমার লেখাপড়া না জানা সাধাসিধে সরল বাবা এই কথার কোনও প্রতিবাদ করতে পারেনি। কষ্ট পেয়েছিল। তবে প্রতিবাদস্বরূপ আমরা দাদার মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান বয়কট করেছিলাম।
একদিন অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডস্যার অমলেন্দুবাবুর কাছে গেলাম।এই স্যারের মুখে একদিন শুনেছি ইচ্ছা থাকলেও ডবলুবিসিএস অফিসার আমি হতে পারব না। মানে আমার সেই যোগ্যতা নেই। এখন গ্রুপ বি অফিসার হওয়ার ছাড়পত্র পেয়েছি, যা আমার কাছে অন্তত গরিবের ডবলুবিসিএস। কিন্তু অমলেন্দু স্যারকে আমি যে অফিসার হওয়ার যোগ্যতা রাখি তা দেখাতে যাইনি, স্যারের মত জানতেই গিয়েছি। কারণ আড়ালে আমার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও স্যার আমাকে স্নেহও করতেন। মানুষ তো একরঙা হয় না। একবার একটা ডায়রি উপহার দিয়েছিলেন। বাবা মারা যাওয়ার পরে বাড়িতে এসেছিলেন।
স্যার বললেন, তুই অবশ্যই রিলিফ অফিসারের চাকরিতে যোগ দিবি। শুরুতেই অফিসার হিসাবে যোগ দিলে পরে তুই প্রোমোশন পেয়ে কোথায় চলে যাবি তুই জানিস না। আর এই সুযোগ যদি হাতছাড়া করিস, পরে দেখবি হাইকোর্টে আর কাজ করতে ভাল লাগছে না। তখন তোর আফশোসের সীমা থাকবে না। যে চেয়ারে বসিস রোজ, ওখানে আর বসতে ইচ্ছা করবে না।
খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পরে স্যার যোগ করলেন, আর বুদ্ধি করে চলবি। বেশি আবেগপ্রবণ হবি না। দেখবি কোনও সমস্যা হবে না। আমার মনে হয় তুই পারবি।
স্যারের কথায় বেশ ভরসা পেলাম।
চন্দনদা এবং হেডস্যার-সহ স্কুলের আরও অনেকের সঙ্গে সৌজন্যবশত দেখা করলাম।
হাইকোর্টে আমার অ্যাপয়ন্টমেন্ট সেকশনের সহকর্মীরা চাইছিলেন না যে আমি ব্লকে যাই। না, তার কারণ কোনও ঈর্ষা বা অসূয়া নয়। এই অল্প কয়েক মাসেই তারা আমাকে ভালবেসে ফেলেছেন। কিন্তু সরাসরি যেতে বারণ করলেন না কেউ। কিন্তু তাদের খারাপ লাগাটা চোখেমুখে প্রকাশ পেল।
সব থেকে খারাপ লেগেছিল মনে হয় আমার বাঁদিকের টেবিলের সুশোভনদার। প্রায় রোজই আমাকে একবার করে জিজ্ঞেস করত, কীরে কী ঠিক করলি?
বলতাম, কী ব্যাপারে বলো তো?
হাইকোর্টে থাকবি না ব্লক সার্ভিসে যাবি?
মুখের ওপর হাইকোর্ট ছাড়ব বলতে কেমন বাধো-বাধো ঠেকত। আবার ভাবতাম শেষে যদি মন পাল্টাই, তাই ঝুলিয়ে রাখা গোছের উত্তর দিতাম, এখনও ঠিক করিনি।
তা ঠিক কর। আর কবে করবি? দিন তো ঘনিয়ে এল।
এরকম কয়েক দিন চলার পর সুশোভনদা একদিন আমাকে দু’লাইন প্যারোডি শোনাল— এনেছিলে সাথে করে ধ্বজভঙ্গ *ড়া
মরণে তাহাই তুমি করে গেলে খাঁড়া।
বুঝলাম, আমার স্পষ্টবাদীতার অভাবে বিরক্ত হয়েই সুশোভনদা আজ এই কাণ্ড করল। মনে মনে বেশ আহত হলাম। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি কবিতা লিখেছিলেন। তারই দু’লাইনের স্ল্যাং ব্যবহার করে যে কেউ এমন প্যারোডি বানাতে পারে, আমার ধারণার অতীত ছিল।
মনের দ্বন্দ্ব আর বেশি দিন চলার পথ পেল না। ত্রাণভবনের ডিরেক্টরকে একটা চিঠি লিখলাম এই মর্মে যে শীঘ্রই হাইকোর্টের মাননীয় রেজিস্টার জেনারেলের কাছে আমার মেডিকেল সার্টিফিকেট এবং পুলিশ ভেরিফিকেশন রোল চাওয়া হোক। আমি ব্লক রিলিফ অফিসারের কাজে যোগ দিতে ইচ্ছুক। হাইকোর্ট থেকে একদিন হাফ সি এল নিয়ে ত্রাণভবনে গিয়ে হাতে-হাতে সেই চিঠি দিয়েও এলাম।
একুশ
কিগো, তুমি যাবে তো আমার সঙ্গে? দীপুদাকে জিজ্ঞেস করলাম।
দাঁড়া, একটু ভেবে দেখি সময় বার করতে পারব কিনা।
দীপুদা খানিকক্ষণ ভাবল। তারপর দেখি দীপুদার মুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল। বলল, যেতে পারি, কিন্তু তুই আমার থাকা খাওয়া গাড়িভাড়া ইত্যাদি খরচ বাবদ বেশি না দু’হাজার টাকা দিবি। আমি তোর সঙ্গে যাব।
কর্মস্থল গুজরাটের জামনগর থেকে পুজো উপলক্ষ্যে দীপুদা পনেরো দিনের ছুটি নিয়ে বাড়িতে এসেছে। দীপুদার আসার খবর আগেই পেয়েছিলাম ফোনে। আজ দেখা করতে এসেছি একটা আর্জি নিয়ে। আমাদের দু’জনেরই কমপিটিটিভ পরীক্ষা দেওয়ার মিশন সফল হয়েছে। দীপুদার ডবলুবিসিএস-এর এ,বি,সি গ্রুপ না হলেও ডি গ্রুপ লেগেছে। কোঅপারেটিভ ইন্সপেক্টরের চাকরিতে জয়েন করা এখন সময়ের অপেক্ষা। আমিও ব্লক রিলিফ অফিসারের কাজে যোগ দেব পোষ্টিং অর্ডার বেরলে। আমার পিভিআর ও মেডিকেল সার্টিফিকেট হাইকোর্ট থেকে ত্রাণভবনে পৌঁছলে পোষ্টিং অর্ডার বেরবে। একার বেরবে না। আমার মতো আরও কয়েক জনের একই সঙ্গে বেরবে। রজতাভর বিয়েতে বরযাত্রী হয়ে শিলিগুড়ি গিয়ে সেখান থেকে সেবক কালীমন্দির গিয়েছিলাম। পুজো দিয়ে মাকে মনে মনে বলেছিলাম চাকরি পেলে আবার আসব। সেই কথা ভুলিনি। কিন্তু একা অতদূর যাওয়ার সাহস পাচ্ছি না। ভাবলাম একজন সঙ্গী পেলে সেবকে পুজো দিয়ে দু-এক দিনের জন্য দার্জিলিংটাও ঘুরে আসব। কোথাও সেভাবে বেড়াতে যাওয়া তো হয়নি। তাই দীপুদাকে আমার সঙ্গী হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। আমি বললাম, তুমি ইয়ার্কি করছ। আমি টাকা দিতে চাইলেই তুমি নেবে নাকি!
দশমীর পরের দিন সন্ধ্যাবেলায় আমরা এসপ্লানেড থেকে রকেট বাসে উঠলাম। ঠিক সাড়ে ছ’টায় বাস ছাড়ল। ফেরার কথা মাথায় রেখে বাসের ড্রাইভারের ফোন নম্বর নিয়ে রাখলাম। পরদিন সকাল সাড়ে সাতটায় আমাদের বাস তেনজিন নোরগে বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছল। সেখানে লাগেজ রেখে দশ টাকার টিকিট কেটে যাত্রীনিবাসে আমারা স্নান করে কাঁচা জামাকাপড় পরে শেয়ার জিপে রওনা দিই সেবকের উদ্দেশ্যে। পুজো দেব বলে কিছু খেলাম না। গাড়ি যত সমতল ছেড়ে উপরে উঠতে লাগল আমার মনেও তত যেন আনন্দের ঢেউ উঠল। সেবক মোড়ে এসে গাড়ি থেকে নেমে আমরা দুজনে জুতো খুলে ডালা নিয়ে পাহাড়ের সিঁড়ি বেয়ে মন্দিরে উঠে পুজো দিলাম। তারপর নেমে আবার তিস্তাব্রিজে চলে এলাম। আগের বার যখন এসেছিলাম, আমার কাছে কোনও ক্যামেরা ছিল না। এবার একটা আছে। সস্তার ক্যামেরা— কোডাক কেবি টেন। তাতেই তিস্তার অপরূপ সৌন্দর্য লেন্সবন্দি করলাম।
দার্জিলিং যাওয়ার রুট আলাদা, তাই সেবক মোড় থেকে শিলিগুড়ি নেমে এলাম। একটা হোটেলে দুপুরের খাওয়া সেরে আবার দার্জিলিং-এর শেয়ার জিপ ধরলাম।
দার্জিলিং যখন পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা পার হয়ে গিয়েছে। দীপুদা একটা সস্তার হোটেল খুঁজে বার করল ম্যাল সংলগ্ন এলাকায়। খানিক পরেই শুরু হল তুমুল বৃষ্টি।
দীপুদাকে বললাম, এতদূর এসেছি যখন কাঞ্চনজঙ্ঘাটা দেখা হবে না?
দীপুদা বলল, কাল ভোরেও যদি ওয়েদার এরকম থাকে কী করে দেখা হবে বল? আকাশ পরিস্কার থাকতে হবে। তাও দেখব একবার চেষ্টা করে। কাল কিন্তু খুব ভোরে উঠতে হবে।
রাতে খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। ভোর তিন্টের সময় আমি দীপুদাকে ডাকব মনে করে উঠে দেখি দীপুদা আমার আগেই উঠে পড়েছে। বলল, ওঠ, সত্য। বৃষ্টি পড়ছে না। মনে হচ্ছে তোর কপালে কাঞ্চনজঙ্ঘা আছে। সাড়ে তিনটের মধ্যে দু’জনেই স্নান করে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। হোটেলের কাছেই দীপুদা শেয়ারে একটা জিপ পেয়ে গেল। টাইগার হিলে গিয়ে দেখি আমাদের মতো আরও অনেক পর্যটক। হিলটপ মানুষের মাথায় গিজগিজ করছে। ঠান্ডার মধ্যে পাহাড়ী মেয়েরা জিন্স দামি জুতো সোয়েটার পরে চা-কফি বিক্রি করছে। আমরা টাইগার হিলের রেলিং ধরে অপেক্ষা করতে থাকি সূর্য ওঠার। তারপর এল সেই আকাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। সূর্্যের আলোয় কাঞ্চনজঙ্ঘা দৃশ্যমান হল রঙের দ্যুতিতে উজ্জ্বল হয়ে। সেই দৃশ্য বর্ণানা করা আমার সাধ্যাতীত। কোডাক ক্যামেরায় কয়েকটা ছবি তুলে রাখি বাড়ির লোককে দেখাব বলে।
দার্জিলিং ভ্রমণের আর বিস্তৃত বর্ণনায় যাচ্ছি না। এরপর একে একে বাতাসীয়া লুপ, ঘুম মনাস্ট্রি, চিড়িয়াখানা, হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট দেখলাম। ম্যালে ঘুরে কিছু কেনাকাটা করার সময় আমার কাঞ্চনজঙ্ঘা সিনেমার কথা মনে পড়ল। দোর্দণ্ডপ্রতাপ রায়বাহাদুরের তিনশো টাকার চাকরির অফার ফিরিয়ে দিয়ে মাত্র পঞ্চাশ টাকার টিউশনি করাকেই শ্রেয় মনে করেছিল অরুণ মুখোপাধ্যায়। মনে পড়ল ...।।দির কথাও। তার হাজব্যান্ডের অফিসে চাকরি প্রস্তাব আমিও ফিয়েয়ে দিয়েছিলাম। তাই আজ আজ এই দিনটায় আসা সম্ভব হল। জীবনের প্রতি বিশ্বাস রাখলে জীবন কাউকে নিরাস করে না।
দুপুর নাগাদ দীপুদার সঙ্গে কথা বলে সেই রকেটের ড্রাইভারকে আবার ফোন করে আমাদের জন্য দুটো টিকিট রাখতে বললাম। সামান্য কিছু কেনাকাটার পর আমরা ফেরার পথ ধরলাম। দীপুদা বহুবার দার্জিলিং গিয়েছে। তবুও পুজোর ছুটির থেকে আড়াই দিন ছেটে আমার জন্য আমার সঙ্গে এসেছে বলে কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে গেল।
আগামী পর্বে
**************************************************
উপন্যাস * দীপংকর রায়
কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে
পর্ব * ২০
দীপংকর রায়

জন্মের পর সেই কোন্ শৈশবকাল থেকে এই ট্রেনের পথে শিয়ালদহ স্টেশন হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়া-আসা। মা বাবার সঙ্গে। তার সবটা আজ হয়তো অনেকটাই ঝাপসা। এরপর একটু বড় হয়ে বাবার মৃত্যুর পরে, জন্মস্থানের অবস্থান থেকেও ছাড়া হয়ে নতুন বাড়িতে ওঠার পরে, একটি বছর যেতে না যেতেই সেই যে একদিন দিদিমার হাতে তুলে দিলো মা আমাকে, তারপর মির্জাপুর স্ট্রিটের সেই পরিচিত জনের বাড়ি থেকে বাসে করে বসির হাটে একটি রাত্রি কাটিয়ে, পরদিন খুব ভোর ভোর ইছামতি নদী পেরিয়ে আবার একটি বাস ধরে সীমান্ত অঞ্চলের বিথারি নামক একটি জায়গার নদী-ঘাটে নেমে, সারাদিন টাবুরে নৌকায় কচুড়িপানার দাম ঢেলে, কখনো নৌকায় বাদাম টাঙ্গিয়ে দিয়ে মাঝি ভাসিয়ে নিয়ে চললো সোনাই নদীতে… মাথার উপর কত মেঘ ভেসে বেড়াতে লাগলো, কত বাঁক ঘুরে ঘুরে নদী কত কিছু মনে করাতে করাতে নিয়ে চললো আমাকে, তার কি ইয়ত্যা আছে!
তারপর ঝড় উঠলো কলারোয়া নামের একটি জায়গাতে, নদীর পাড়ে মাঝি যখন নামিয়ে দিলো আমাদের পাকিস্তান বর্ডারে। কোথায় সীমানা লেখা আছে, তখনো বুঝিনি তো কিছুই। ঝড়ের মাঝে হাওয়ায় এলোমেলো হতে হতে একটি বাড়ির ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে দালাল বললো, আজকের রাত্তির এখানেই থাকতে হবে।
এর পরের দিন দালাল চলে গেলো আবার যে পথে আমরা এসেছিলাম হয়ত সেই পথ ধরেই বসিরহাটে।
আমরা চললাম গরুর গাড়িতে চড়ে হেলতে দুলতে, ডাস মাছি মারা দেখতে দেখতে কখন যেন গাড়োয়ান নামিয়ে দিলো একটি জায়গায়, পুলিশ… পুলিশ….আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়ে ।
তারপর কত পথ পায়ে হেঁটে ছুটতে ছুটতে বাস রাস্তা পাওয়া, ভাবলে শিহরণ জাগে আজও….
আরো কত অধ্যায় পেরোতে হয়েছিলো সেই পথে, সে কথা না হয় থাক। সেই যে দিদিমার আশ্রয়ে কাটিয়ে দিলাম তারপরের কয়েকটি বছর কোথা দিয়ে যেন। তারপর সেই পরিবেশে সম্পূর্ণ রূপে মিশে যেতে না যেতেই এলো একাত্তর সাল। যুদ্ধ… স্বাধীনতা আন্দোলন… শরনার্থী হয়ে ফিরে আসা… তারপর আবার একটি বছর পার হতে না হতেই ফিরে যাওয়া বাংলাদেশ নামক একটি নতুন দেশে…
সেসব সবই তো একদিন আবার পিছনে চলে গেল ! একাত্তরে যে দেশটা স্বাধীন হলো যার হাত ধরে, সেই আন্দোলনের প্রধান এবং অন্যতম নায়কের মৃত্যুর আগের দিন কেন যেন মনে হলো এদেশ আমাকে আর চাইছে না!
কলকাতা থেকেও মায়ের নিরন্তর ডাক, ফিরে চলে এলাম সবকিছু ছেড়ে একদিন, সেই আতঙ্কগ্রস্ত সীমানার পথ ডিঙিয়েই।
আবার এই দেশের জীবন যাপনের সঙ্গে খানিকটা একাত্ত হয়ে শুরু হলো নতুন আর এক অধ্যায়ের জীবন সংগ্রাম।
যদিও হলো বলছি, তার আগের যে সময়টা, শিক্ষাদীক্ষায়, কৈশোর-বাল্যকাল-যৌবনের শুরু হলো যেখানে, সেখানের পিছুটান ছাড়লো না একটুও। সে কি ছাড়ানো সম্ভব? নিরন্তর সেই ফল্গুধারাই বয়ে যেতে থাকলো ভেতরে ভেতরে তার নানা অভিঘাত নিয়ে একাকী। কীভাবে তার থেকে নিজেকেই বা ছাড়াই? তাই সে মুর্ছনায় বিদ্ধ হতে থাকি, যখনই একা হয়ে যাই যেন কোথাও।
যাইহোক, সে যেমন থাকলো থাকুক। এখন যে অধ্যায়টি কাটিয়ে এলাম দিদির সঙ্গে, তা যেন জীবনের নতুন এক দিক দেখিয়ে দিল, খানিকটা একঘেয়ে সময়কে পাল্টে দিয়ে।
আবার এদেশের জীবন যাপনের সঙ্গে খানিকটা একাত্ম হয়ে বর্তমানে যে অধ্যায়টি অতিক্রম করছিলাম বেশ খানিকটা একঘেয়েমি নিয়েই, তার মধ্যে এই নেপাল ভ্রমণ খানিকটা যেন দেখিয়ে দিলো, শুনিয়েও দিলো, দ্যাখো খোকা, এই ভারতবর্ষের ভেতর আরো কত বড় আর একটি ভারত আছে। যাকে কতটুকুই বা চিনতে তুমি! আর তারও ওপারে আর এক প্রান্ত পেরিয়ে যেতে পারলেই দেখলে তো এই মানুষগুলি কেমন ভাবে জীবনযাপন করে। যার হয়তো কিছুই বুঝলে না তুমি। তবুও যা দেখলে, তা তো তোমারই দেখা! ঐ যে, একটি দেশের মধ্যে কত বৈচিত্র্য দেখেও, তুমি মনে করতে বুঝি সবটাই লুকোনো আছে আরো অন্যভাবে হয়তো; যা তোমার এতদিনের ধারণাতে ছিল, অথচ বাস্তবে সেটাই তো সব দেখা না! তারও বাইরে আরো কত দেশ আছে। তাঁদের নিজস্ব কত ধরণ ধারণ আছে, ঘরানা আছে; সেইসব মানুষজন প্রকৃতি, তাঁদের সমাজ, পরিবার প্রকৃতি সবকিছু নিয়ে যার যার একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। তাঁরা সেটাকে নিয়ে তাঁদের মতো করে বাঁচে-মরে, তার কতটুকুই বা এইটুকু চলার মধ্যে জানতে পারলে?
এই দেখার মধ্যে কতকিছুই না বাকি থেকে গেল! তার সবটা জানতে পারোনি। এবং যা জানা হয়তো সম্ভবও নয়। শুধু তোমার কেন, কারো পক্ষেই না।
সত্যিই তো কিছুই জানি না। তাও যেটুকু দেখলাম, তা সেইখানে না যেতে পারলে কি জানতে পারতাম তেমন করে?
ঐ যে পাহাড়ি দূর্গমতা, সেইসব মানুষগুলোর কীরকমের ঘ্যানঘেনে, ভ্যাপসা, শীতকাতুরে জীবন-যাপন করা; তাঁদের পোশাক পরিচ্ছদ, সমাজ, রীতিনীতি কত আলাদা আলাদা!
যাইহোক সেসব সবটাই দিদির দৌলতেই হয়েছে! ওঁর ভেতরে যে কী অদম্য ভ্রমণপিপাশা! সে দেখে আসছি ওঁর বিবাহের পর থেকেই। মাঝে মাঝেই ওঁরা এখানে ওখানে চলে যায় ক’দিনের জন্যে ঘুরে আসতে।
বড় ছেলেটির বয়স কতোই বা তখন; দিদি সেই যে ওর ছোটোবেলা থেকে ওকে একটি কাপড়ের টুকরো হাতে ধরিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়ানোর অভ্যাস করেছিলো, তা আজ পর্যন্ত একই রকম ভাবেই চলে আসছে। ও ঐ এক টুকরো কাপড়কেই জানে হয়তো ওর মায়ের আঁচল হিসেবে। সেটাকেই মুখের কাছে নাড়াচাড়া করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে।
ঠিক এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল আর একটি কথা, আমাকে যেমন আমার বাবা জোর করেই খুব ছোটোবেলা থেকে তাঁর বাবা-মায়ের কাছে রেখে তৈরি করতে চাইত, আমার মানসিক গঠন লেখাপড়া সব কিছুই। ঠাকুমা ও দাদুর ঘর থেকে চুরি করে এসে আমি নাকি আমার মায়ের বুকের দুধ পান করেছি। কিন্তু তার ভবিষ্যৎ দিনগুলি দেখে, যতটুকু সে দেখে যেতে পেরেছিলো, তাতে আমার বাবার ধারণা কি সেক্ষেত্রে একটুও মিলেছে কিছুই?
এক্ষেত্রে ঠিক তেমনটা না। কিন্তু আমার মা বরাবরই নিজের অফুরন্ত স্নেহে এবং নিজের একান্ত ইচ্ছায় নিজের নাতিকে আগলাতেই ভালো বাসতো। আর সেই জায়গা থেকে দিদিও বেশ খানিকটা নিশ্চিন্তে ওকে তার মায়ের কাছে রেখে দিয়ে এদেশ ওদেশ ঘুরে বেড়াতো।
এবারেও সেটাই হলো। ছেলে থাকলো তার মায়ের কাছে।
আমাদের দিন পনেরো কেটে গেল নেপাল ভ্রমণে।
এদিকে বিষনি ভাই থাকলো গরু-বাছুর দেখা-শোনায়। আর জটাভাই থাকলো গরুর দুধ দোহাই কাজে দু’বেলা। কাজের দিদি রান্নাবান্না সামলায়। ভাই ভাই-এর মতো। মা অফিস ছুটি নিয়ে বাকিটা দেখভাল করবে এই ক’দিন নাতি-সঙ্গে। যদিও এর মধ্যেই আমরা রওনা হবার পরেই মা পক্সে আক্রান্ত হয় এবং সেই অবস্থায় ছোট্ট এই নাতিকে নিয়েই সমস্যা বাধে। এই ছোঁয়াচে ব্যাধি তাকেও না না ধরে ! ধরেছিলো । তবে সেটা মায়ের সুস্থ হবার বেশ কিছুদিন পরে। আমরা ফিরে আসার পর।
মাকে এ বিষয়ে ভীষণ চিন্তিত হতে দেখলাম। আমরা ফিরে আসার পরেও সেই চিন্তা তার। যদিও ক’দিন যেতে না যেতেই আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যায়। আমিও আবার পশু বিশেষজ্ঞ জিঞ্জির শেখর সেনসর্মার পরামর্শ মতোন উঠে-পড়ে লেগে যাই কীভাবে কালো গরুটিকে কশাই-এর হাত থেকে বাঁচিয়ে তাকে ফের গর্ভবতী করে তোলা যেতে পারে, এই চিন্তায়। ওষুধ-বিষুধ, খাদ্য-খাবার সবই ডাক্তারের পরামর্শ মতো চলছে। এভাবে না ওভাবে, ওভাবে না এইভাবে, যেভাবেই হোক গর্ভবতী করাই এখন একমাত্র লক্ষ্য। এছাড়া আর কোনকিছুই করার নেই যেন। এই এলাকার এ খাটালে ঐ খাটালে ঘোরাঘুরি করা। কীভাবে কোন্ টোটকা কার কাছ থেকে জেনেশুনে যদি তাকে প্রয়োগ করে কিছু একটা হয়। যেনতেন ভাবে তাকে বিক্রি করতে না হয় এই অবস্থায়, কোনোভাবেই, এমনই একটা পন। তবে সকলে মিলে নিরাশ করতেই লাগলো বেশি করে। বলতে লাগলো, ‘ও খালি খালি বৃথা চেষ্টা করে চলেছো তোমরা। করো, তোমাগের টাকা পয়সা আছে যতদিন পারো করে যাও, তবে লাভ কিছুই হবে না যেন;….’
এই প্রচেষ্টায়, আগেই বলেছি, অনেকটাই সহযোগিতা করে চলেছে ভগ্নিপতি অশোকদা।
শিল্প চেতনার পাগলামিতেও কমতি নেই। কমতি নেই জানা-চেনার তৃষ্ণা নিয়ে একটু এদিক ওদিক ছুটতে থাকাতেও।
নিতাইদা ইদানীং সব সময়ের সঙ্গী। ফলে বাড়ির ভেতরের আড্ডায় ভাটা পড়েছে। বেড়েছে ক্লাবের আড্ডার স্বাদ নেওয়া। নিতাইদাদের পাড়ার ক্লাবের মেম্বার হয়েছি। এই অঞ্চলে তখন একাঙ্ক নাটকের একটা বেশ হিড়িক চলছে। এ মাঠে, ও পাড়ায়, সে-পাড়ায় চারদিকেই একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতা লেগেই আছে। সেই প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে ভিড়ে গেলাম আমিও নাটক পাগলদের দলে। চলতে লাগলো রিহার্সাল। সপ্তাহের দু-তিন দিন সন্ধ্যাবেলা হলেই ও পাড়ার নবনি রায়ের প্রশস্ত ছাদের উপরে নাটকের মহড়া চলতে থাকলো। এঁরা দুটি নাটক মঞ্চস্থ করতে চায়। একটি একাঙ্ক নাটক, স্ফিংস। আর একটি পূর্ণাঙ্গ, সেটি হলো চাক ভাঙা মধু। দুটিতেই আমি দুটি চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছি। তাই নিয়ম করে রিহার্সালে যাচ্ছি। নবনি রায়ের বড় ছেলে নিমাইদা হচ্ছেন নাটকের পরিচালক। আমাদের এ পাড়ার কিছু ছেলে-পেলেও আছে সেই দলে অভিনয় করবার জন্যে। এদের মধ্যেই সুভাষ এবং মানু। শুনলাম এরা আবার নাকি পেশাদারী নাটকেও অন্য জায়গায় অভিনয় করে। বুঝলাম, আরো অনেকেরই এই পথে অনেক কাল ধরেই আনাগোনা। এদের মধ্যে আমার মতো আরও কয়েকজন আছে নাকি আনকোরা? নবনি রায়ের এই ছাদের উপরে রিহার্সাল দিতে যেয়েই পরিচয় হলো প্রদীপ চ্যাটার্জী নামক এক ছেলের সঙ্গে। প্রথম পরিচয়ের পর-থেকেই কেন জানি না বেশ খানিকটা আন্তরিকতাও তৈরি হয়ে গেল তার সঙ্গে। প্রদীপের আচার-ব্যবহার বেশ খানিকটা পছন্দেরও হয়ে গেল। সে আমাদের বাড়িতেও সামান্য ক’দিনের মধ্যেই বেশ গ্রহণযোগ্য হয়েছে বুঝতে পারলাম।
নিতাইদার সুবাদে ক্লাব-জীবনের আমার এই আড্ডার অভিজ্ঞতা ক’দিন হয়েছে মাত্র। এবং নাটকের দলেও নাম লেখানো হলো সেই জন্যেই। ক্লাবের বাৎসরিক অনুষ্ঠানেও নাম দিলাম। দিতে না চাইলেও একরকম জোর করেই নাম দিয়ে দিলো সকলে মিলে । এবং সেই আমার প্রথম মাঠ ভর্তি বহু মানুষের মাঝখানে মঞ্চে উঠে স্বরচিত কবিতা পাঠ করা।
কেন জানি না, এই নিয়ে প্রদীপের খুব আনন্দ। আমি যখন মঞ্চ থেকে কবিতা পাঠ করে নেমে এলাম এ পাড়া ও পাড়ার সকল মানুষের সামনে, সেই আমায় প্রথম কবি বলে ডাক দিয়ে জড়িয়ে ধরলো।
কবি পরিচয় তো হলো। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আর একটি অন্য মুস্কিল হলো দেখতে পেলাম। পাড়ার একটু বয়স্ক লোকজন, একটু যাঁরা সংস্কৃতি মনস্ক, স্থানীয় সম্মানীয় মানুষজনও পথে-ঘাটে দেখলেই আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করছেন। এ রকমই একজন হরেন বাবু, একদিন সামনাসামনি দাঁড়িয়েই জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁ গো, এই শোনো ভাই, তোমাকে তো এইভাবে চিন্তাম না! তোমাদের বাড়ির সকলকেই তো চিনি জানি! কিন্তু ঐ বাড়ির মধ্যে থেকে যে এমন মানসিকতার একজন তৈরি হয়েছে, তা তো জানতাম না! তোমার কবিতা দুটিই বেশ হয়েছে। মন দিয়ে শুনেছি বুঝলে। নিয়মিত চর্চা করো, তাই না?
কিছুই বলতে পারলাম না ওনার কথা শুনে । একটুখানি জোর করে হাসলাম শুধু। ওনার এই বাহবা দেবার মধ্যে আমি যেন ওনার একটি অতি ক্ষুদ্র দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়ও পেলাম। খুব মনখারাপ হয়েছিলো ওঁর ইঙ্গিতপূর্ণ ঐ একটি কথার জন্যে। সেটা আর কিছুই না, এই যে, উনি বুঝতে পারেননি আমাদের মতো ঐ রকম একটি টালির চালের খোলামেলা বাড়ির মধ্যে এইসব শিল্প সংস্কৃতির চর্চা হওয়াটা যেন খুবই বিস্ময়কর একটা কিছু ! যা ওঁর চোখে বেশ বড় একটি আশ্চর্যের বিষয়বস্তু বলে মনে হয়েছে।
এই প্রথম জানতে পারলাম, প্রথাগত ধারাবাহিকতার বাইরে আর কোনো লিপি-জ্ঞানই সাধারণের জন্য মনে হয় গ্রহণযোগ্য নয়।
তাঁর এই অনুভবের জন্যে কোনো বিশেষ ধন্যবাদ জানাতে পারলাম না বলে, কেন জানি না নিজের মধ্যে নিজেরই একটা বেদনা জন্মালো। মাথা নিচু করে শুনেই গেলাম তাঁর অভিমত। কিন্তু একটা মন যেন বলতে চাইছিলো কিছু। বলতে পারলাম না সেভাবে। তবে একেবারে কিছুই না বলে, একজন মানুষের সামনে থেকে নীরবে সরে আসাটাও তো অসভ্যতা। তাই বললাম এইটুকুই খালি, ও কিছু না, ঐ তো ওগের জন্যেই তো আমার পড়াটা হলো। আমি খুব একটা পড়তে-টড়তে পারি না এতো মানুষজনের সামনে, তাই আর কি, তাহলে আসি এখন? আমার আবার একটু কালীবাড়ির দিকে যেতে হবে, তাড়া রয়েছে, …
তারপর হাঁটতে থাকলাম নিজের মতো ঠিকই, কিন্তু ওঁর জিজ্ঞাসা করা কথাগুলি কিছুতেই পিছু ছাড়ছিল না। উনি আমাদের বাড়ির সকলকেই চেনেন, জানেন। কিন্তু ওঁর ধারণায়, ঐ ধরণের একটি বাড়ির পরিবেশের মধ্যে থেকে এইসব চর্চা-টর্চা হয় যে তা ওনার কাছে অস্বাভাবিক বলে মনে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাড়ির গঠন প্রণালী দায়ী, নাকি অসচ্ছলতা? কোনটা? আর্থিক চাকচিক্যের উপর নির্ভর করে শিক্ষা এবং নান্দনিকতা বোধ তৈরি হয় নাকি? কোন্টাতে ওঁর সমস্যা মনে হয়েছে, বুঝতে পারলাম না। টালির চালের ঘরে নন্দনতত্ত্বের বিকাশ কী অসম্ভব মনে হলো ওঁর? সংস্কৃতি চর্চার অধিকার কি একমাত্র তাঁদের, যাঁদের তথাকথিত সামাজিক পরিচয়ের জায়গাটা আর্থিকভাবে বেশ স্বচ্ছল! এবং সেটাই কি প্রাথমিক শর্ত?
ফলে উৎসাহ পাবার চাইতে নিরুৎসাহই হলাম বেশি করে। হাঁটতে হাঁটতে সেই অল্প বয়সের জেদের মধ্যে আবারও “বাড়ির পরিবেশটাই এমন” ভাবে ইঙ্গিত করতে লাগলো, যেন সেটাই সবকিছু এখন!
পরের দিন নিতাইদাকে ওনার প্রশস্তি বাক্যের নির্যাসটুকু বলতেই, সে বললো, মানুষ তো কতকিছুই বলবে। তাই নিয়ে ভাবলে হবে! তোমাকে তোমার কাজটা করে যেতে হবে তোমার মতো করেই। কে একজন তোমাকে ডেকে কী বলেছে, প্রসংশা করেছে না বদনাম করেছে, তাই নিয়ে ভাবলে হবে না। পারলে তার ভালো বলা টুকুই নিও। আর বাকিটাকে ফেলে দিও, যেটুকু তোমার ভালো লাগেনি। আমি হলে সেটাই করতাম। তাই বলি, এরপর যেখানেই ডাকবে সেখানেই যাবে। নিজের লেখা মানুষের সামনে তুলে ধরবে। আর লেখা প্রকাশ করো না কেন? আমাদের ক্লাবের ওয়াল ম্যাগাজিনে তো লিখতে পারো।
সে কথার উত্তরে আমি তাকে বলি, ঠিক আছে এবারে দেবো।
— হ্যাঁ দেবে, এবারে পুজো সংখ্যাতে তোমার কাছ থেকে ওদেরকে লেখা চাইতে বলবো দেখি।
প্রদীপ কোথাও ছিলো, সে কাছে আসতে আসতে আমাদের কথাবার্তা শুনতে পেয়ে ঢুকে পড়লো আমাদের কথাবার্তার মধ্যে। বললো, ঠিকই তো, আমিও ওকে বলেছি, এইভাবে লুকিয়ে-চুরিয়ে লিখে ফেলে রাখলেই হবে না। নানা জায়গায় পাঠাতে হবে। নানা অনুষ্ঠানে পড়তে হবে। তবেই না জানতে পারবে সকলে। আর একটি বিষয় নিতাইদা, ওর আবার লেখার বিষয়বস্তুও তেমন, অ্যাতো ঘোরপ্যাঁচ লাগানো। ঠিক সোজাসাপ্টা কিছু না। আপনি পড়েছেন নিশ্চয়? ঠিক বুঝেছি ওর লেখা, এটা বললে ভুল হবে। তবে ভালো লেগেছে। একটা ভালোলাগা আছে কোথাও। মনে হয় একটা দিক আছে, তাই। যদিও সেটা হয়তো ও ওর বলার মধ্যে দিয়ে পরিষ্কার করে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে পারছে না ঠিক। তবে তার একটা ভালো দিক হলো, কীভাবে কীভাবে যেন একটা ভালোলাগা তৈরি করে দেয় দেখেছি। তবে সেটা বোঝার জন্যে ঠিক পরিষ্কার নয়, যতটা ভালোলাগার ক্ষেত্রে। আমি তো আর কবিতার বিশেষজ্ঞ নই। আমার জগত তো নাটকের। তাই এর চাইতে বিশদে আর কিছু বলতে পারবো না।
নিতাইদা চুপচাপ ওঁর কথাগুলি শুনছিলো। প্রদীপ যেভাবে হঠাৎ ঢুকে পড়ে এইভাবে বর্ণনা করতে লাগলো বেশ একান্ত হয়ে, এটা নিতাইদার খুব ভালো লেগেছে যে সে কথা সে তাকে বললো। বললো, এই যে প্রদীপ, তুমি আমাদের আলোচনার মধ্যে হঠাৎ করে এসেই এত মনখুলে ওর লেখালিখি নিয়ে বললে, এটা কি খুব সহজ? একেবারেই না। তুমি তো খুব ভালো ভাবেই শুনেছো বা পড়েছো ওর লেখা-পত্র, যা বুঝলাম। বা বা! আমিও তো এত ভালোভাবে বুঝতে চেষ্টা করিনি! যা তুমি করতে পেরেছো এর মধ্যেই। আমি যা জানি, খুব বেশি দিনের পরিচয় তো তোমাদের না? তুমি তো আমারও আগ্রহ বাড়িয়ে দিলে দেখছি ভাই! এই, সাম্প্রতিক কালের তোমার লেখা, যেগুলি আছে সামনে, একদিন তোমাদের বাড়ি গেলে আমাকে একবার শোনাবে তো?
জলকষ্ট শুরু হয়েছে কিছুদিন হলো। একে তো টিউকলের জল নোনা। তিনশো ফুট পাইপেও এই অঞ্চলে নোনতা জলই উঠে আসে। এই লেয়ারটিই রয়েছে এখানে, অথচ এই আমবাগান ছাড়ালেই মিষ্টি জল। প্রথম প্রথম ওদেশ থেকে ফিরে আসার পর খুব অসুবিধা হতো। এখন সেটা অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আগে ঠাকুমার বাড়িতে গেলে, বা দিদির বাড়িতে গেলে বেশ খানিকটা জল ঢকঢক করে খেয়ে নিতাম প্রাণ ভরে। আর রাইফেল ক্লাবের মাঠের পেছন দিকটায় শৈলেন মামাদের বাড়ির জল তো ওদের বাড়িতে গেলেই আগে চেয়ে নিয়ে বেশ পরিতৃপ্তির সঙ্গে এক গেলাস খেয়ে তারপরে বাকি সব কথাবার্তা যা হতো হতো। শৈলেন মামার বউ, মামিও সেটা জেনে গেছিলো ভালো করে। তাই সেখানে গেলেই আগে এক গেলাস জল হাতে ধরিয়ে দিয়ে তারপর কথা শুরু করতো নিজের।
যা বলছিলাম, জলকষ্টের কথা। কলে জল উঠছে না। ঘড়াং ঘড়াং করে পাম্প করাই সার। হাত ব্যথা করে তারপর হয়তো এক বালতি জল ওঠে। এরপর সেই জল খানিকক্ষণ রেখে দিলে দেখি কি রকম একটা হালকা গেরুয়া রং ধরে যায় বালতির ভেতরে নিচের দিকে। এদিকে বাড়িতে এতগুলি গরুবাছুর, তাদের স্নান খাওয়া। তাদের ঘর-দুয়োর পরিষ্কার পরিছন্ন করতেও তো জল লাগে। সব কিছু মিলে নতুন বাথরুমে চৌবাচ্চা বোঝাই করাই দুস্কর। একদিকে বাঁচোয়া, ভাগ্যিস শান্তি কাকুর কুয়ো ছিল, তা না হলে কী যে হতো! শান্তি কাকু বলেছেন, জল যত লাগে এখান থেকে নিয়ে যা তোরা।
বাড়ির লাগোয়া বাড়ি বলে বেশি দূর থেকে টেনে আনতে হচ্ছে না জল, তা না হলে হয়েছিল গরু পোষা। দক্ষিণ দিকে বাথরুমের পাঁচিলের ওপারেই তো শান্তি কাকুদের কুয়ো। তাই অনেক রাত অবধি তাদের ওখান থেকেই জল তুলে বালতি করে আনা আনি চলছে আমাদের বাড়ির সব কাজেই। সকলেই টেনে আনছি সেই জল। এ যেন আর একটা বাড়তি সমস্যা তৈরি হয়েছে ইদানীং। এ শুধু আমাদেরই না, পাড়ার অনেকেই শান্তি কাকুর এই কুয়োর ভরসাতেই চলছে এখন। খাবার জলের দায় মেটাচ্ছে, আমরা যেভাবে কল পাম্প করে জল তুলছি ঘটাং ঘটং করে, সেই ভাবেই হয়ত সকলেরই এক গতি এখন এখানে । না হলে কিছুটা পথের ধারে সম্প্রতি পুঁতে দিয়ে যাওয়া ছশোফুট কল ও অনেকটাই ভরসা ।
কিন্তু বাড়ির কল ঠিক করা যায় কীভাবে । তার জন্যে আবার সেই শান্তিনগরের সরকার মামাকেই তলপ করা হলো। তিনি সব দেখে-শুনে পান চিবোতে চিবোতে বললেন, দিদি, ঠিক করা যাবে হয়তো খানিকটা, তবে আমি বলি কি, এই লেয়ারে এর থেকে খুব বেশি ভালো জল আর পাইবেন না মনে হয়। এর চাইতে ভালো পাইতে হইলে ছশো ফুটে যাওন লাগবো। তা যদি না হয়, তা-হোইলে যা আছে তাই-ই না হয় থাউক। তাও দেহি, সরাইয়া বসায়ে যদি এর থিক্কা ভালো কিছু হয়। আর একটা কথা, ঐ পাইপগুলান তো তোলা যাইবো না। তাই কোই কি, নতুন পাইপ এবং নতুন ফিল্টার দিয়া দিতে হইবো কিন্তু। এই সব কোইরা দেহি কি করা যায় এবারে।
মার এইসব শুনে-মেলে মুখটা দেখলাম অন্ধকার হয়ে গেলো একটু। মা তাও বলে, সরকারদা, আমি কই পাই এতো টাকা কন দেখি! তাও দেখি, আপনি যেটা ভালো মনে করেন করেন তো দেখি, বারবার এই জিনিস কার আর ভালো লাগে, তাই কন তো?
মার আবার এই একটা স্বভাব, যদিও বিষয়টা আমার ভালোলাগে না মোটেই, যার যার সঙ্গে তার তার মুখের ভাষা আয়ত্ত করে নিয়ে খানিকটা তাদের মতো করে বলার একটা চেষ্টা করা, সে মনে করে এইটাই হয়তো ঠিক, এইভাবে তাদের মুখের ভাষায় কথা বললে তাঁরা হয়তো খানিকটা একাত্ম হয়ে যায়। এমন ধারণা হয়তো মার মধ্যে আছে। আর সেই জন্যেই তার এমন প্রচেষ্টা, এটা আমি বুঝেও মাকে জিজ্ঞাসা করিনি কোনদিন। তবে আমার বেশ বিরক্তিই লাগতো তাতে। কারণ ওদের এই ভাষা তো মায়ের দেশীয় মুখের ভাষা নয়!
মার মুখে ‘ঐ একটা ব্যবস্থা যা হয় করবেন,’ এই কথাটির তাৎপর্য কি, সেটা সরকারদা খুব ভালোই বোঝেন। তাই হয়তো সে বলে, ঠিক আছে ঠিক আছে, সে তো জানি দিদি আমি, দেখি কি করণ যায়। কতটা পুরানো পাইপ ভালো পাওয়া যায় দেহে নি আগে, তারপরে তো কথা? দেখুমখানে চেষ্টা কইরা, তয় কথা কিন্তু সেরকমের কিছু দিতে পারত্যাছি না কিন্তু; আচ্ছা ছাড়েন ওসব, সে যা-হয় হবে-খানে, দেখি কী হয় আগে, তারপরে তো! সগল চিন্তা যখন আমার উপরেই ছাইরা দিছেন, তহনে আর আপনার এত ভাবনার কি আছে? দেন দেহি, একটা পান দেন তো আগে। ওঁ, এটটা ভালো খবর দি, হয়তো কিছুদিনির মধ্যিই আপনাগের এখানে মিউনিসিপ্যালিটির থেকে বাড়ি বাড়ি জল আইসা যাইবো গিয়া। তইলে তো আর ঝামেলা থাকলো না! হ্যাঁ আমাগের কাজকম্ম হয়তো কিছু কমবো, তা কমুক, তাই বলে মানুষ তো আর রোজ রোজ এই রকম কইরা কষ্টে থাকবার পারে না!
এই বলে সে দমাস করে কি একটা ভেবে নিয়ে বলে, ঠিক আছে সে যা হয় হবে-খানে; কাইলই যদি লোকজন পাই তো চইলা আইতাছি…. ।
সরকারদার মতো মানুষ কিম্বা মুদির দোকানদার নীলু এঁদের মতো কিছু মানুষ ছিলো বলেই হয়তো আজও এইসব স্বল্প উপার্জনশীল মানুষজনেরা বা পরিবারগুলি কতটা যে উপকৃত হতো সেইসব দিনে, তা এদেশে ফিরে আসার পরে খুব হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছিলাম, যত দিন যাচ্ছে ততোই যেন।
যাক, শেষপর্যন্ত সরকারদার মিস্ত্রীদের নানা মুখভঙ্গি করে গান গাওয়াই সার হলো, পাইপ সবগুলো তোলা হলো না আর। মাত্র দুইখানা পাইপ ভালো উঠলো। ফিল্টার তোলা যাবে না, তারা বললো।
নতুন প্লাস্টিকের নেট দেওয়া ফিল্টার বেরিয়েছে আজকাল, সেটাই ভালো হবে বলে লাগিয়ে দিয়ে গেল। আর পাইপ সবই টাটা কম্পানির ভালো হবে বলে, সেটাই লাগিয়ে দিয়ে গেল সরকারদা।
হ্যাঁ, নতুন কলে জল পড়তে লাগলো ভালোই। তবে খরচা যা হবার হলোই।
বিষনি ভাইও বেশ খুশি হয়ে বললো, যাক, মা একটা ভালো বিবস্থা তো হলো, ই ভাবে কতদিনই বা চোলবে, তাই বলেন দিকিনি!
কাজের দিদিরও মুখে হাসি এলো বেশ। আমারও ঠাকুমার বাড়িতে দুপুর বেলায় স্নান করতে যাওয়া শৈলেন মামার বাড়ির উপর দিয়ে এবারে বন্ধ হলো। যদিও শৈলেন মামার বউ-এর জোরাজুরিতে ঠাকুমার বাড়িতে স্নান করতে যাওয়া এর মধ্যেই বন্ধ হয়েছে। তার কথায়, তারা থাকতে এই দুপুর রোদে আমি কেন অত দূরে যাবো স্নান করতে। মামি বলতো, ও ভাগ্নে, এই গরমের দুপুর রোদে, অত দূরে যাওয়ার কি আছে তাই বলো তো? আমি তোমারে নতুন তোয়ালে দিচ্ছি, নেও তো, আমাদের এখানেই স্নান করো তো দেখি।
এর আগেও প্রথম প্রথম মামি একই কথা বলেও পারেনি। আমি নানা সঙ্কোচে, নানান অজুহাত দেখিয়ে চলে গেছি গঙ্গাপুরীতে, ঠাকুমার বাড়িতে। কিন্তু সেদিন আর পারলাম না।
বিষয়টার গন্ডগোলটা তো অন্য জায়গায়। সেটা তো আর ভেঙে বলতে পারি না। আসলে আমি একটা ধারাবাহিকতাকে ভেঙে আর একটাতে যেতে ভীষণ অনভ্যস্ত। সেটা কাকে আর বুঝিয়ে বলতে পারি!
এই যে দুটো অভ্যাসের মধ্যবর্তী অবস্থান, এটাকে অতিক্রম করতে বরাবরই অনেকটা সময় লেগে যায় আমার। তাকে ডিঙ্গিয়ে যাওয়াটা কোনোভাবেই হয়ে উঠতে চায় না যেন। তাই না হলে বাড়ির আর সকলেই তো শান্তি কাকুর কুয়োর জলেই সব করছে। কিন্তু আমার কেন অত দূরে যাওয়া!
কাজের দিদি, বিষনি ভাই, ছোটো ভাই, সকলেই তো এরা কাছাকাছি থাকা পুকুরের জলেই স্নান সেরে নিয়েছে এতদিন। মায়ের স্নানের জল বাড়ির কল থেকেই যেটুকু উঠতো তাই দিয়েই হয়ে যায়। না হলে কুয়োর জলেই স্নান করতে হতো মাকে। কখনো কখনো রাস্তার মিউনিসিপ্যালিটির যে ছশোফুট কল আছে ইস্কুলের সামনে, তাতেও এরা স্নান করে আসতো সকলেই। শুধু আমারই হয়ে উঠতো না।
কেন যে হয়নি, সে কথা ভাবিনি যে তাও না। ভেবেছি। আসলে আলগা জায়গায় দাঁড়িয়ে রাস্তার পাশে স্নান করার যে সঙ্কোচ বোধ, সেটা কখন আমাকে এতটা নাগরিক করে তুললো সেটাই ভেবেছি। ভেবেছি, এই আমিই তো ওদেশে থাকতে নবগঙ্গায় ঝাঁপিয়ে বেরিয়েছি কতো! এপার ওপার করেছি কতো। একরকম প্রতিদিনই। কত বড় হয়ে নদী থেকে স্নান করে পরনের প্যান্টটাকে ধুয়ে হাতে করে ল্যাংটো অবস্থাতেই ছুট লাগিয়েছি মামাদের বাড়ির উপর দিয়ে! তবে নতুন মামি আসার পরে এমন কাজ আর কখনো করিনি, এটা বেশ মনে আছে।
জলের কল ঠিক হয়ে যাবার পরেও বেশ কিছুদিন শৈলেন মামার বাড়ি থেকেই স্নান করে এসেছি। কীভাবে যেন সেখানেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি এই কদিনে, তাই সেটা ছাড়িয়ে আসতে সময় লাগছে এই যা। যদিও তার জন্যে মামির আন্তরিকতাই অনেকটা দায়ী। আর স্নান শেষে মামির আপ্যায়নও উপেক্ষা করতে পারিনি। কিছু একটুখানি মুখে না দিয়ে যাওয়া যাবে না বাড়ি। তাহলে নাকি গৃহস্তের অকল্যাণ হয়। এদিকে ইদানীং আবার মামার ছোটো মেয়েটি খুনসুটি করা শুরু করেছে। বুঝতে পারছি ও বড় হচ্ছে। এই তো বছর খানেক হলো এই পরিবারের সঙ্গে আমাদের একটা আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। প্রথম প্রথম ওকে বেশ ছোট বলেই মনে করেছি। কিন্তু এর মধ্যেই ও কবে যে বড় হয়ে উঠলো তা আর বোঝা হয়ে ওঠেনি। এদিকে মামিও চায় ওর সঙ্গে আমার একটা আত্মিক টান গড়ে উঠুক। কখনো কখনো সন্ধ্যাবেলাতে বা বিকেল বেলাতে ওদের ওদিকে গেলেও এটা ওটার প্রয়োজন দেখিয়ে আমাকে সঙ্গে নিয়ে কালীবাড়ির ওদিকে যেতে বলে। যাইও কখনো কখনো। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, দেখছি, আমি ওদের বাড়িতে গেলে ও আর কিছুতেই আমার সঙ্গ ছাড়তে চায় না। একেবারে হাত চেপে ধরে রাখে। সবসময় একটি হাত বগলের নিচে দিয়ে জড়িয়ে ধরে। শরীরের খানিকটা ভার আমার উপরেই রাখতে চায়। ও যখন শরীরের খানিকটা ভর আমার উপর রেখে আমাকে নিয়ে রাস্তা পার হয় তখন আমারও ভেতরে একটা শিহরণ জাগে না যে সে কথা অস্বীকার করি কী করে! কিন্তু ঐ যে, সেই একই আতঙ্ক, শিক্ষাদীক্ষার কী হবে তাহলে আমার! এই মনটাকে তো অন্য কোনো কিছুতেই বাঁধতে দেওয়া যাবে না কোনভাবে।
তাই খানিকটা দূরত্ব রেখেই চলি নানাভাবে, হাসিঠাট্টা এইসব দিয়ে। খুব স্বাভাবিক আচরণের মধ্যে এই সবের অন্য কোনো পরিভাষা খুঁজতে দিই না, একরকম জোর করেই যেন খানিকটা। কিন্তু ওঁর ছেলেমানুষী, ওর খুনসুটি, অন্ধকার রাস্তায় আমার হাত ধরে রাস্তা চলা, সে সবের অর্থ, চোরাটান ইদানীং আমি যেন বেশ কিছুটা গুরুত্বের সঙ্গেই বুঝতে পারছি। মনের অজান্তেই সেসব বেশ খানিকটা প্রশ্রয় পেয়েও চলেছে যে সেটাও ধরতে পারছি। কখনো কখনো বেশ আসক্তও লাগছে না যে তাও না। ঠিক একশোভাগ কি ওর সঙ্গ আমিও পেতে চাইছি?
কই, তাও তো না! মাঝে মাঝে একটু বিরতি দিয়েও যাচ্ছি ওদের বাড়িতে।
একটা জিনিস লক্ষ্য করে দেখেছি, যে জিনিসটা আমার মধ্যে ভীষণ ভাবে কাজ করে, সেটা হলো, কোনকিছুরই একঘেয়েমি আমি খুব বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারি না। কে যেন ভেতরে ভেতরে তার একটি বিরতিপর্ব তৈরি করে দেয়, অন্তরাল থেকেই।
অথচ অদ্ভুত ভাবে সেই দিকেই চেয়ে থেকে উপলব্ধি করি কিছুকাল যাবার পরে সেই অতীতের পিছনেই আবার যেয়ে যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ি। সেই টানেই আবার ফিরে যাই কখন! তাহলে কি সেই নতুনকে একটু পুরাতন করে দেখার তৃষ্ণাই আমাকে এই খেলায় বাঁধে? সেই স্বাদ যেন পিছু টানে আবার।
যা আমার অজানা ছিল এতদিন, তাকেই আবার নতুন করে উপলব্ধি করতে পারলাম যেন।
যে জিনিসটিকে জানতে মানুষের কত কাল লেগে যায়। একসময় জীবন ফুরিয়ে যায়। তবু সেই জানা যেন আর হয়েই ওঠে না!
কালী বাড়িতে একটি বাৎসরিক অনুষ্ঠান হয় মাসাধিককাল ধরে। পালা কীর্তন বা পদাবলী গান বা গৌর কীর্তন যেটাই বলি না কেন।
সন্ধ্যাবেলাগুলিতে এ অঞ্চলের বয়স্ক কিম্বা আধ-বয়সী ছেলেমেয়েরা সকলেই সেখানে ভিড় করেন দাঁড়িয়ে। একেবারে সমস্ত রাস্তা জুড়ে সব মানুষজন দাঁড়িয়ে যান সেই নামকীর্তন শুনতে। আমরাও কখনো কখনো বেশ মুগ্ধ হয়ে শুনি সেসব গান-বাজনা। চেয়ে চেয়ে দেখি মানুষজনের এই সমাগম। কখনো টিঙ্কু আমাকে দেখলে আর কারো সঙ্গেই দাঁড়াবে না সেখানে। কখনো পেছন থেকে এসে আচমকা পিঠের মধ্যে একটা কিলও মেরে দেয় আস্তে করে। এবং এমন কথাও বলবে, এই তুই আমাকে দেখিস নি? নাকি দেখেও না দেখার ভান করছিস? এতবার যে ঐ পাশ থেকে চিৎকার করে ডাকলাম, তা একবারও ভ্রুক্ষেপ করলি না!
তার এই ধরণের আধিপত্য ইদানীং লক্ষ্য করছি। দেখা হলেই আহ্লাদের সঙ্গে পিঠে একটি কিল মেরে তারপরে একটি হাত তার হাতের মধ্যে নিয়ে কথা বলতে থাকবে। কথার বিষয়বস্তু সেরকমের কিছুই নেই হয়তো। তার মা আমার খোঁজ করছে, বা তাদের বাড়িতে কিছুদিন হলো যাচ্ছি না বলে নতুন নতুন কী কী সংযোজন হয়েছে তাদের বাড়িতে, বিষয় হলো এমনই সব, সেসব কথাবার্তার মধ্যে। আর এই সব বৈষয়িক কথাবার্তা সে যত গুরুত্ব দিয়ে বলতে চাইতো আমি ততোই বিরক্তবোধ করতাম। কিন্তু বুঝতে দিতাম না কখনোই। কারণ ওগুলো যে একটাও তার কথা না, তা তো তার চোখমুখের দিকে ভালো করে চেয়ে দেখতে পারলেই বোঝা যায়।
মধ্যবর্তী শূন্যতায় অনেক প্রিয়জনকেই হাবুডুবু খেতে দেখি। দেখে কষ্টও হয়। কেন যে সহজ অভিব্যক্তিটুকু সহজে এরা বলতে পারে না, সেটাই ভাবি শুধু। যে কারণে কোথাও সেই বলিষ্ঠ ভাবাবেগের ইশারা পাই না আর। তখন মনে পড়ে এমন একজন মানুষের কথা, যার প্রকাশভঙ্গিতে সরাসরি সেরকম কোনো স্বীকারোক্তি ছিলো না কিছু। তবে তাকে দেখলে যে-কেউ-ই বুঝতে পারবে, সে যা বলছে তা তার ভেতরের এবং বাইরের একই রকম কথা। কারণ তার বলার ভঙ্গির মধ্যে অন্যকে বুঝিয়ে বলার সেই সহজ সরল আগ্রহ ছিল। সেটা তার কথা বলার ভঙ্গির মধ্যেই প্রকাশ হয়ে পড়ত, অদ্ভুত এক সারল্যে। সেখানে কোনো রাখঢাক ছিল না। তাই কেন জানি না ইদানীং যখনই কাউকে মনে হয় তার ভেতরের কথা আর তার বলা কথার মধ্যে একটা আড়াল আছে, তখন ভীষণ বিরক্ত বোধ করি, সেই মুহুর্তে তাদের সংসর্গ থেকেই।
এই সঙ্কটে কিছুকাল বড়োই টালমাটাল কাটছে একথা স্বীকার করতেই হয়। সব স্বাভাবিককে মেনে নিতে পারছি না। তার ফলে খানিকটা বিভ্রান্তি পেয়ে বসেছে। মাঝে মাঝে পর্যুদস্তও করে ফেলছে সে।
খানিকটা সাংসারিক কাজের ভেতরেই ডুবে আছি বেশ কিছুদিন। গরু-বাছুরের খাবার-দাবার আনতে যেতে হয় যে দোকানটিতে, সেখানেই অহেতুক
গল্পগাথা করেই হয়তো দিনের অনেকটা সময় কাটিয়ে দিই আজকাল। কী এমন গল্পই বা হয় সেখানে? বেশিরভাগ সময়ই দোকানের মালিক রমনিদার বাবার সঙ্গে তার ফেলে আসা দেশ-গাঁয়ের গল্পই হয় বেশি। তাতে দুজনের খানিকটা দু’ রকমের আনন্দই হয় হয়তো; একজনের ছেড়ে আসা পল্লী প্রকৃতির ঋতু-বৈশিষ্টের নানা আনুষাঙ্গিক প্রভাবের কথাবার্তা বলাবলি, আর একজনের বয়সজনিত কারণে তার ফেলে আসা অতীত জীবনের নানা খাদ্য খাবার নিয়ে মুগ্ধতার কথাবার্তা বলাবলি করা।
দুজনের খানিকটা কাছাকাছি বিষয় হয়েও, বিষয় না-গোছের আলাপ আলোচনাতেই সময় মন দুটোই কেটে যাচ্ছে বেশ। কত সে-সব গল্প…! অনেক সময় নিজেই খেই পাই না যেন। আমি কি আর কুমিল্লার কিছু চিনি ছাই! কিছুই তো জানি না প্রায়, এক সময় ওদেশে থেকেও ওদেশের অনেক জনপদ সম্মন্ধে একেবারেই কিছুই তো জানি না! কিন্তু ঐ যে, দেশ তো একটিই, তাই আচার-আচরণের মধ্যে একেবারে আকাশ পাতাল পর্থক্য তো হতে পারে না! তার লোক-ঐতিহ্যে তো খুব একটা বিশেষ পার্থক্য হবার কথাও নয়, প্রাকৃতিক মিলনেও কি কোনো বিশেষ ফারাক আছে নাকি? হয়তো আছে খানিকটা। রমনিদার বাবা বলেন, ঐ তো, একোই তো! আমি অবশ্য আম-কাঠালের ঋতুর গল্পতে খানিকটা মিল পেলেও, জল জঙ্গলের সেরকম কোনো মিলই পাইনি তার মুখে শুনে। তবু সে বেশ মুখ ঘুরিয়ে-ফিরিয়েই বোঝাতে চায় আমাকে তার দেশের কথা, মানসভ্রমণে টেনে নিয়ে গিয়ে, যেন বেশ অন্যরকম এক অনুভব। বলে, তাদের দেশের বাড়ির পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে যে মেহের কালীবাড়ি আছে, তার সেইসব বিচিত্র অলৌকিক সব গল্পগাছার কথা। আমিও বেশ রোমাঞ্চিত হই তাতে। এঁরা সব বাহান্ন ছাপান্নতে ঐ দেশ ছেড়েছে। কিন্তু ছাড়লে কী হবে এখনও তার মায়ায়, গল্পগাছায়, প্রেমে-অপ্রেমেই মসগুল হয়ে ওঠে মুহূর্তে মুহূর্তে। আর তাই এইসব নিয়ে আমাকে কাছে পেলে সে বেশ আপ্লুতোই হয়ে পড়ে।
এদিকে আমার এই রমনিদার ওখানে এত গল্পগাছায় মসগুল হয়ে থাকাকে নিয়ে রিক্সা চালক নিতাই এবং জটাভাই দুজনেই বেশ ঠাট্টা তামাশা করে। নিতাই তো একদিন বলেই ফেলে, ও দাদা, কী অত দোকানের কোণার মধ্যি বসে বসে রমনিদার বাবার সঙ্গে গল্প করো তাই কও তো দেহিনি? ওদিকি তোমারে কী মাইপে দেচ্ছে রমনিদা, তার কি তুমি খেয়াল করো কিছু!
তাকে বেশ বিশ্বস্ত চিত্তেই বলি, না না নিতাই, তেমনটা কি রমনিদা হতে পারে! এসব আমি ভাবতেও পারি নে। তয়, ছোটো ভাইগের কথা তোমারে বলতি পারবোনানে। তহনে একটু লক্ষ্য রাখি তো! তবে এত সব ভেবেটেবে বেড়াই না কখনোই নিতাই। ওসব নিয়ে যদি ভাবতি যাও তাহলে আরো অনেককিছু নিয়েই তো সন্দিহান হতি হয় ভাই; ধরো, সবসময় তো আর আসতি পারি নে! তুমিই তো নিয়ে যাও। তুমি কি সবসময় দেখেশুনে সবকিছু নিয়ে যাতি পারো, তাই কও?
নিতাই অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে তার দেশিও ঢঙে ঠোঁট-টোট বাঁকিয়ে চুরিয়ে নিয়ে বলতে থাকে, কী যে
কও বড়দা, আমি এই হাত দিয়ে ঐ হাতে রে বিশ্বাস করি নে তো! বোঝলেন? এই শালার কলকাতায় কতো সৎ মানুষই তো চোর হয়ে যায়, বুঝতি পারলেন কিনা কন?
আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে, বুঝিয়ে বলি, না না নিতাই, এর আগে আমি বেশ কয়েকবার লক্ষ্য করে দেখিছি তো সেসব, ঐ বিষয়ে খুব ভালো করেই দেখিছি , কারণ এই ভুসিগুলি তো আমি নিজে হাতেই মেলাই , তাতে মেলাবার সময়েই মাপ ধরা পড়ে যায় খানিকটা। তাছাড়া হঠাৎ হঠাৎ বেশ লক্ষ্য করেও দেখিছি, রমনিদা একটুও কম দেয় না।
নিতাই কখনো কখনো কেন যেন ভীষণ বিরক্ত হয়, আমার এইখানে অনেকটা সময় কাটানোতেও, সেটার একটা বড় কারণ হলো, ও নিজেও চায় আমার সঙ্গ। আমার সঙ্গে খানিকটা বকবক করতে দেশিও আবেগে। তাতে নিতাইও বেশ আনন্দিত হয়ে থাকে সেটা আমি জানি। তাই ওর রাগ হয়, ওকে যখন একা একা দানাভুসিগুলিকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে যেতে হয় তখন। সে যাবার সময় জিজ্ঞাসা করে, কী বড়দা যাবা না এহোনে?
তাকে হয়তো তখন বলি, না নিতাই, তুমি যাও চলে, খানিকটা বাদে আমি যাচ্ছি, বলোগে যাইয়ে বাড়িতে, আজকে একটুখানি দেরি হবে যাতি আমার।
কোনদিন হয়তো নিতাই না যেয়ে বিড়ি নেবার নাম করে এপাশে মুদিখানার দিকটায় যেখানে মেসোমশাই বসে থাকেন চৌকিতে, সেই দিকটাতেই আসে। আমি হয়তো তখনও পাশটাতেই একটি চেয়ারে বসে রয়েছি। নিতাই বিড়ি নিতে এসে কিভাবে যেন কদিন দেখছে আমি মেশমশাই-এর সঙ্গে কথা বলছি। আমাদের গল্পের ভেতরে কোনো একটা প্রসঙ্গ নিয়ে সেও ঢুকে পড়ে, তারপর দেশের খানিকটা স্মৃতিচারণ করে। তার মধ্যে তার কথা বলার বিষয়ে থাকে মাছ ধরার কলাকৌশলের কথাবার্তাই বেশি করে। নদী, খাল-বিল ছাড়াও ক্ষেত খামারের কথাবার্তা। আর কীই বা এদের বিষয় হতে পারে?
নিতাইও এদেশে উদ্বাস্তু হয়েই এসেছে। বসিরহাট অঞ্চল দিয়ে একদিন মা-ভাই-বোন-বউদি, ছোটো ছোটো ভাইপো-ভাইঝিদের সকলকে চোখের জলে ভাসিয়ে চলে এসেছে সে, জেদ ধরেই খানিকটা। সে অবশ্য এখন মাঝেমাঝেই অনুশোচনা করে বলে, কেন যে আলাম চলে বড়দা, এহোনে ভাবি, না আলিই মনে হয় ঠিক ছিল, জানেন তো…? এ-শালার দ্যাশে আইসেই ভুল করিসি। আবার ভাবি অন্য কথাও। সেই জেদের কথা ভাবতি গেলি মনে হয়, না, ঠিকই করিসি। আসলে কোনোখানেই গরিবির কোনো জায়গা নেই বোঝলেন কিনা! তহনে আর একটা মন কয়, কি দরকার ছিলই বা! এহেনে আইসে তো রিক্সাওয়ালা বনে গেলাম শেষমেশ। এই তো হলো লাভের লাভ! যেটুক এহোনে দেখলাম যা। কেন যে আলাম বড়দা, তাতো বুঝি নে এহনে কিছু।
রমনিদার দোকানের যে পাশটায় মুদিমশলা-পান-বিড়ি-সিগারেট থাকে সেখানটাতে যেয়েই আমি বসি। ইদানীং কখনো কখনো রমনিদার বাবা না-থাকলে দোকানে আমিও এটা ওটা খরিদ্দারদের এগিয়ে দিই। পয়সাও নিই। বেশ খানিকক্ষণ দোকানদারি করে দিই ওঁদের। এই সূত্রে এখানকার স্থানীয় কয়েকজন মানুষজনও আমাকে দেখলেই বলে, এটা দিন,… ওটা দিন না, বা দেও না …। রমনিদাও বলে, দাও তো ভাই, একটু ওনাকে….।
সেই অভ্যাসে সামনে-পেছনের বাড়ির ছেলেপেলেরাও আমার কাছেই গিয়ে বসে, রমনিদাকে যদি দেখে দানাভুসির ওপাশে থাকতে। নিরুপায় হয়ে দুই ঘরের মাঝখানের সীমানা দেওয়া বেঞ্চিতে বসে থাকা আর হয় না আমারও— ঘুরে মুদিখানার ওদিকটায় যেতেই হয়।
এইসব করে বেশ কিছুটা সময় এখানেই কাটিয়ে দিই ইদানীং। কেন যে এমন একটা সম্পর্কের ঘেরে জড়িয়ে পড়ছি, তাও ভেবে পাইনে। এবং বেশ কিছুদিন এই ভালোলাগার পাল্লায় পড়ে বেলা গড়িয়ে বাড়ি ফেরার পর কাজের দিদির বকাবকিও শুনতে হচ্ছে হাসতে হাসতে। সে বলতে থাকে, কখনে আর স্নান-খাওয়া-করবে বলো দেখি দাদা? সেই যে কখধ দানাভুসি আনতে গেলে, দানা-ভুসি রেখে নিতাই কখন চলে গেল! কিন্তু তোমার আর বাড়ি ফিরে আসার আর নামগন্ধ নেই দেখছি।
আমি আর তাকে কী করে বোঝাই, আমি যে-এক নাম না জানা সম্পর্কের ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছি দিদি গো, এ কথা তোমারে কী করে বুঝোয়ে কোই, বলো দেখি?
বিষয়টা অনেকেরই বিরক্তির কারণ হয়েছে দেখছি। দশটা এগারোটা বেলায় গেলে ফিরতে তিনটে বাজিয়ে দিচ্ছি। সন্ধ্যায় গেলে রাত দশটা এগারোটা। এই বিষয় নিয়ে বন্ধুবান্ধবরাও ঠাট্টা ইয়ার্কি করছে ইদানীং। বলছে, কি রে ওখানে কি কোনো বিশেষ মানুষের দেখা পেলি নাকি? না হলে যখনই এসে খোঁজ নিই তোর, তখনই শুনতে পাই দানাভুসির দোকানে। বিষয়টা কি রে, বলতো দেখি?
কীই বা বলি! চুপ করেই থাকি। মনে মনে ভাবি, নিয়ন্ত্রণ সত্যিই এবারে প্রয়োজন দেখছি।
যে মনটা মনেরই অজান্তে সুদূরের সেই সামান্য ক’দিনের জীবন প্রবাহের তুচ্ছাতিতুচ্ছকে নিয়ে কী এক অপার মুগ্ধতা দিয়ে ভরে রেখেছে নিজেরই আড়ালে, যা-সে নিজেই জানে না স্পষ্ট করে; আর তাতে যদি কেউ একটুখানি দোলা লাগিয়ে দেয়, অমনি সে দুলে ওঠে অসীম মুগ্ধতায়, কেন যে! আসলে, অসম্পূর্ণ সেই মুগ্ধতার দোলায়ই তো দুলিয়ে চলেছে প্রাণের সকল প্রবাহ। যদিও তার সব খোঁজ স্পষ্ট করে এই মনটাও পায় না! সে যে কখনো কখনো কিছুই মানতে চায় না তাও। কোনো অজান্তেই আবার সে ভেসে পড়ে। ভেসে বেড়ায় যেন শ্যাওলার মতো। নাকি সে পানা-কচুড়ির-মতো ভেসে থাকা? নাকি জল-শ্যাওলার ধ্বনি তরঙ্গে বাজাচ্ছে যে বসে, সেই অসীম মুগ্ধতায় বাঁশিটি; যার সুর আমরা শুনেও শুনতে পাই না অনেক সময়ই। জেনেও জানতে জানি না। অজানার সেই পথ ধরেই সে তাঁর কত অতীত কালের মুখখানি তুলে ধরে এমনই কোনো এক রূপ মুগ্ধতায়, যে মুখখানি শুধুমাত্র স্বপ্নেই দোলা লাগিয়ে চলেছে… আমাদের সকল অজানা সেই ঋতু প্রবাহে? এমনই এক ভাবের ঘোরে, কত অজান্তেই হয়তো সে তার মনোজগতেই ডুবে মরে। আমরা তার উদ্দেশ্য-অনুদ্দেশ্যের কোনো খোঁজই পাই না কখনো।
তাই সেখানে নিতাই দা, প্রদীপ চ্যাটার্জী, শংকর, ফোচন, অলোক, কাল্টু, নিমাই, রতন, শৈলেন মামার বাড়ি, মামিমা, টিঙ্কু, রমনিদার দোকানের দুই পাশ, সেখানকার এপাশের ওপাশের ছেলেমেয়েদের রমনিদার দোকানে এসে এটা ওটা চেয়ে নিয়ে টাকা পয়সা বাড়িয়ে ধরা, কালীবাড়ির সিপিএম পার্টি অফিসের পাশে ঝন্টুদার চায়ের দোকান, সংকল্প ক্লাবের সদস্য হয়ে যাওয়া, এ সিনেমা হল, ও সিনেমা হলে ঢুকে যাওয়া, এইসব, সবেরই এক একটি মুহূর্ত সেই রচনা করে চলেছে, যার পেছনের তাড়নাটির দিকে যদি খুব ভালো করে লক্ষ্য করে দেখা যায়, তাহলে বিশেষ কোনো অর্থই খুঁজে পাওয়া যাবে না। যেন মনে হবে শুধু যাওয়া আর আসাই সেখানে শুধু। ঘোরাঘুরি। বসে থাকা। কিন্তু তার বিশেষ কোনো কার্য-কারণ আছে বলে তো মনে হয় না কোথায়ও এখন!
সেরকমের একটুখানি খোঁজ যখন করতে যাই কখনো, ঠিক তখনই ভীষণ এলোমেলো লাগে নিজেকে। চুপটি করে সেই বারান্দাটির কোণায় এসে বসে পড়ি রাতের অন্ধকারে। মন তখন কাউকে যেন খোঁজে একান্তে। কাকে খোঁজে? কার কাছে চেয়ে চেয়ে কাকে নিরন্তর খুঁজে চলা সেখানে… । কাকে দরবার করতে চাওয়া কারোর বিরুদ্ধে শুধুই! আর সেসব সব জানে শুধু সেইসব বর্ষণমুখর রাত… কুয়াশাচ্ছন্ন রাত… শীত-গ্রীষ্মের রাতের বেলাগুলিই সেসব জানে, হাঁ করে চেয়ে চেয়ে কীভাবে একাকী দেখেছিল, কেমন ভাবে?
ঐ ঝাউগাছের সারি, তার মাথার উপরে মধ্যরাতের আকাশ, কোনো কোনো দিন হয়তো চাঁদের আলোটুকু নিয়ে কি যে বিষন্ন হাওয়া বয়, বাতাসে দোলা লাগিয়ে নিয়ে চলে ঐ ঝাউ গাছের মাথাগুলি যে, তার কি জানি কিছুই? না তারপরও কোনো কিছুর কোনো অর্থ খুঁজে পাই আমরা কোথাও?
মনে মনে ভাবি, কেন যে এমন রাতের বেলাগুলি এমনভাবে এই বারান্দায় বসে বসে কাটিয়ে দিই কেনোই বা! কী এমন শান্তিই বা মেলে তাতে? কী এমন রূপময়তাই বা খুঁজে পাই ঐ ঝাউ গাছগুলির মাথা নাড়ানো দোলাদুলির মধ্যে? কি রচিত হয়ে চলে তাতে! তার সব স্বরূপটি কি ধরতে পেরেছি আদৌ কেউ?
তবু সেই রাতের আকাশের দিকেই চেয়ে থাকা আমার ।
আগামী পর্বে
********************************************************************************

















