কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে
পর্ব * ২০
দীপংকর রায়

জন্মের পর সেই কোন্ শৈশবকাল থেকে এই ট্রেনের পথে শিয়ালদহ স্টেশন হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়া-আসা। মা বাবার সঙ্গে। তার সবটা আজ হয়তো অনেকটাই ঝাপসা। এরপর একটু বড় হয়ে বাবার মৃত্যুর পরে, জন্মস্থানের অবস্থান থেকেও ছাড়া হয়ে নতুন বাড়িতে ওঠার পরে, একটি বছর যেতে না যেতেই সেই যে একদিন দিদিমার হাতে তুলে দিলো মা আমাকে, তারপর মির্জাপুর স্ট্রিটের সেই পরিচিত জনের বাড়ি থেকে বাসে করে বসির হাটে একটি রাত্রি কাটিয়ে, পরদিন খুব ভোর ভোর ইছামতি নদী পেরিয়ে আবার একটি বাস ধরে সীমান্ত অঞ্চলের বিথারি নামক একটি জায়গার নদী-ঘাটে নেমে, সারাদিন টাবুরে নৌকায় কচুড়িপানার দাম ঢেলে, কখনো নৌকায় বাদাম টাঙ্গিয়ে দিয়ে মাঝি ভাসিয়ে নিয়ে চললো সোনাই নদীতে… মাথার উপর কত মেঘ ভেসে বেড়াতে লাগলো, কত বাঁক ঘুরে ঘুরে নদী কত কিছু মনে করাতে করাতে নিয়ে চললো আমাকে, তার কি ইয়ত্যা আছে!
তারপর ঝড় উঠলো কলারোয়া নামের একটি জায়গাতে, নদীর পাড়ে মাঝি যখন নামিয়ে দিলো আমাদের পাকিস্তান বর্ডারে। কোথায় সীমানা লেখা আছে, তখনো বুঝিনি তো কিছুই। ঝড়ের মাঝে হাওয়ায় এলোমেলো হতে হতে একটি বাড়ির ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে দালাল বললো, আজকের রাত্তির এখানেই থাকতে হবে।
এর পরের দিন দালাল চলে গেলো আবার যে পথে আমরা এসেছিলাম হয়ত সেই পথ ধরেই বসিরহাটে।
আমরা চললাম গরুর গাড়িতে চড়ে হেলতে দুলতে, ডাস মাছি মারা দেখতে দেখতে কখন যেন গাড়োয়ান নামিয়ে দিলো একটি জায়গায়, পুলিশ… পুলিশ….আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়ে ।
তারপর কত পথ পায়ে হেঁটে ছুটতে ছুটতে বাস রাস্তা পাওয়া, ভাবলে শিহরণ জাগে আজও….
আরো কত অধ্যায় পেরোতে হয়েছিলো সেই পথে, সে কথা না হয় থাক। সেই যে দিদিমার আশ্রয়ে কাটিয়ে দিলাম তারপরের কয়েকটি বছর কোথা দিয়ে যেন। তারপর সেই পরিবেশে সম্পূর্ণ রূপে মিশে যেতে না যেতেই এলো একাত্তর সাল। যুদ্ধ… স্বাধীনতা আন্দোলন… শরনার্থী হয়ে ফিরে আসা… তারপর আবার একটি বছর পার হতে না হতেই ফিরে যাওয়া বাংলাদেশ নামক একটি নতুন দেশে…
সেসব সবই তো একদিন আবার পিছনে চলে গেল ! একাত্তরে যে দেশটা স্বাধীন হলো যার হাত ধরে, সেই আন্দোলনের প্রধান এবং অন্যতম নায়কের মৃত্যুর আগের দিন কেন যেন মনে হলো এদেশ আমাকে আর চাইছে না!
কলকাতা থেকেও মায়ের নিরন্তর ডাক, ফিরে চলে এলাম সবকিছু ছেড়ে একদিন, সেই আতঙ্কগ্রস্ত সীমানার পথ ডিঙিয়েই।
আবার এই দেশের জীবন যাপনের সঙ্গে খানিকটা একাত্ত হয়ে শুরু হলো নতুন আর এক অধ্যায়ের জীবন সংগ্রাম।
যদিও হলো বলছি, তার আগের যে সময়টা, শিক্ষাদীক্ষায়, কৈশোর-বাল্যকাল-যৌবনের শুরু হলো যেখানে, সেখানের পিছুটান ছাড়লো না একটুও। সে কি ছাড়ানো সম্ভব? নিরন্তর সেই ফল্গুধারাই বয়ে যেতে থাকলো ভেতরে ভেতরে তার নানা অভিঘাত নিয়ে একাকী। কীভাবে তার থেকে নিজেকেই বা ছাড়াই? তাই সে মুর্ছনায় বিদ্ধ হতে থাকি, যখনই একা হয়ে যাই যেন কোথাও।
যাইহোক, সে যেমন থাকলো থাকুক। এখন যে অধ্যায়টি কাটিয়ে এলাম দিদির সঙ্গে, তা যেন জীবনের নতুন এক দিক দেখিয়ে দিল, খানিকটা একঘেয়ে সময়কে পাল্টে দিয়ে।
আবার এদেশের জীবন যাপনের সঙ্গে খানিকটা একাত্ম হয়ে বর্তমানে যে অধ্যায়টি অতিক্রম করছিলাম বেশ খানিকটা একঘেয়েমি নিয়েই, তার মধ্যে এই নেপাল ভ্রমণ খানিকটা যেন দেখিয়ে দিলো, শুনিয়েও দিলো, দ্যাখো খোকা, এই ভারতবর্ষের ভেতর আরো কত বড় আর একটি ভারত আছে। যাকে কতটুকুই বা চিনতে তুমি! আর তারও ওপারে আর এক প্রান্ত পেরিয়ে যেতে পারলেই দেখলে তো এই মানুষগুলি কেমন ভাবে জীবনযাপন করে। যার হয়তো কিছুই বুঝলে না তুমি। তবুও যা দেখলে, তা তো তোমারই দেখা! ঐ যে, একটি দেশের মধ্যে কত বৈচিত্র্য দেখেও, তুমি মনে করতে বুঝি সবটাই লুকোনো আছে আরো অন্যভাবে হয়তো; যা তোমার এতদিনের ধারণাতে ছিল, অথচ বাস্তবে সেটাই তো সব দেখা না! তারও বাইরে আরো কত দেশ আছে। তাঁদের নিজস্ব কত ধরণ ধারণ আছে, ঘরানা আছে; সেইসব মানুষজন প্রকৃতি, তাঁদের সমাজ, পরিবার প্রকৃতি সবকিছু নিয়ে যার যার একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। তাঁরা সেটাকে নিয়ে তাঁদের মতো করে বাঁচে-মরে, তার কতটুকুই বা এইটুকু চলার মধ্যে জানতে পারলে?
এই দেখার মধ্যে কতকিছুই না বাকি থেকে গেল! তার সবটা জানতে পারোনি। এবং যা জানা হয়তো সম্ভবও নয়। শুধু তোমার কেন, কারো পক্ষেই না।
সত্যিই তো কিছুই জানি না। তাও যেটুকু দেখলাম, তা সেইখানে না যেতে পারলে কি জানতে পারতাম তেমন করে?
ঐ যে পাহাড়ি দূর্গমতা, সেইসব মানুষগুলোর কীরকমের ঘ্যানঘেনে, ভ্যাপসা, শীতকাতুরে জীবন-যাপন করা; তাঁদের পোশাক পরিচ্ছদ, সমাজ, রীতিনীতি কত আলাদা আলাদা!
যাইহোক সেসব সবটাই দিদির দৌলতেই হয়েছে! ওঁর ভেতরে যে কী অদম্য ভ্রমণপিপাশা! সে দেখে আসছি ওঁর বিবাহের পর থেকেই। মাঝে মাঝেই ওঁরা এখানে ওখানে চলে যায় ক’দিনের জন্যে ঘুরে আসতে।
বড় ছেলেটির বয়স কতোই বা তখন; দিদি সেই যে ওর ছোটোবেলা থেকে ওকে একটি কাপড়ের টুকরো হাতে ধরিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়ানোর অভ্যাস করেছিলো, তা আজ পর্যন্ত একই রকম ভাবেই চলে আসছে। ও ঐ এক টুকরো কাপড়কেই জানে হয়তো ওর মায়ের আঁচল হিসেবে। সেটাকেই মুখের কাছে নাড়াচাড়া করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে।
ঠিক এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল আর একটি কথা, আমাকে যেমন আমার বাবা জোর করেই খুব ছোটোবেলা থেকে তাঁর বাবা-মায়ের কাছে রেখে তৈরি করতে চাইত, আমার মানসিক গঠন লেখাপড়া সব কিছুই। ঠাকুমা ও দাদুর ঘর থেকে চুরি করে এসে আমি নাকি আমার মায়ের বুকের দুধ পান করেছি। কিন্তু তার ভবিষ্যৎ দিনগুলি দেখে, যতটুকু সে দেখে যেতে পেরেছিলো, তাতে আমার বাবার ধারণা কি সেক্ষেত্রে একটুও মিলেছে কিছুই?
এক্ষেত্রে ঠিক তেমনটা না। কিন্তু আমার মা বরাবরই নিজের অফুরন্ত স্নেহে এবং নিজের একান্ত ইচ্ছায় নিজের নাতিকে আগলাতেই ভালো বাসতো। আর সেই জায়গা থেকে দিদিও বেশ খানিকটা নিশ্চিন্তে ওকে তার মায়ের কাছে রেখে দিয়ে এদেশ ওদেশ ঘুরে বেড়াতো।
এবারেও সেটাই হলো। ছেলে থাকলো তার মায়ের কাছে।
আমাদের দিন পনেরো কেটে গেল নেপাল ভ্রমণে।
এদিকে বিষনি ভাই থাকলো গরু-বাছুর দেখা-শোনায়। আর জটাভাই থাকলো গরুর দুধ দোহাই কাজে দু’বেলা। কাজের দিদি রান্নাবান্না সামলায়। ভাই ভাই-এর মতো। মা অফিস ছুটি নিয়ে বাকিটা দেখভাল করবে এই ক’দিন নাতি-সঙ্গে। যদিও এর মধ্যেই আমরা রওনা হবার পরেই মা পক্সে আক্রান্ত হয় এবং সেই অবস্থায় ছোট্ট এই নাতিকে নিয়েই সমস্যা বাধে। এই ছোঁয়াচে ব্যাধি তাকেও না না ধরে ! ধরেছিলো । তবে সেটা মায়ের সুস্থ হবার বেশ কিছুদিন পরে। আমরা ফিরে আসার পর।
মাকে এ বিষয়ে ভীষণ চিন্তিত হতে দেখলাম। আমরা ফিরে আসার পরেও সেই চিন্তা তার। যদিও ক’দিন যেতে না যেতেই আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যায়। আমিও আবার পশু বিশেষজ্ঞ জিঞ্জির শেখর সেনসর্মার পরামর্শ মতোন উঠে-পড়ে লেগে যাই কীভাবে কালো গরুটিকে কশাই-এর হাত থেকে বাঁচিয়ে তাকে ফের গর্ভবতী করে তোলা যেতে পারে, এই চিন্তায়। ওষুধ-বিষুধ, খাদ্য-খাবার সবই ডাক্তারের পরামর্শ মতো চলছে। এভাবে না ওভাবে, ওভাবে না এইভাবে, যেভাবেই হোক গর্ভবতী করাই এখন একমাত্র লক্ষ্য। এছাড়া আর কোনকিছুই করার নেই যেন। এই এলাকার এ খাটালে ঐ খাটালে ঘোরাঘুরি করা। কীভাবে কোন্ টোটকা কার কাছ থেকে জেনেশুনে যদি তাকে প্রয়োগ করে কিছু একটা হয়। যেনতেন ভাবে তাকে বিক্রি করতে না হয় এই অবস্থায়, কোনোভাবেই, এমনই একটা পন। তবে সকলে মিলে নিরাশ করতেই লাগলো বেশি করে। বলতে লাগলো, ‘ও খালি খালি বৃথা চেষ্টা করে চলেছো তোমরা। করো, তোমাগের টাকা পয়সা আছে যতদিন পারো করে যাও, তবে লাভ কিছুই হবে না যেন;….’
এই প্রচেষ্টায়, আগেই বলেছি, অনেকটাই সহযোগিতা করে চলেছে ভগ্নিপতি অশোকদা।
শিল্প চেতনার পাগলামিতেও কমতি নেই। কমতি নেই জানা-চেনার তৃষ্ণা নিয়ে একটু এদিক ওদিক ছুটতে থাকাতেও।
নিতাইদা ইদানীং সব সময়ের সঙ্গী। ফলে বাড়ির ভেতরের আড্ডায় ভাটা পড়েছে। বেড়েছে ক্লাবের আড্ডার স্বাদ নেওয়া। নিতাইদাদের পাড়ার ক্লাবের মেম্বার হয়েছি। এই অঞ্চলে তখন একাঙ্ক নাটকের একটা বেশ হিড়িক চলছে। এ মাঠে, ও পাড়ায়, সে-পাড়ায় চারদিকেই একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতা লেগেই আছে। সেই প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে ভিড়ে গেলাম আমিও নাটক পাগলদের দলে। চলতে লাগলো রিহার্সাল। সপ্তাহের দু-তিন দিন সন্ধ্যাবেলা হলেই ও পাড়ার নবনি রায়ের প্রশস্ত ছাদের উপরে নাটকের মহড়া চলতে থাকলো। এঁরা দুটি নাটক মঞ্চস্থ করতে চায়। একটি একাঙ্ক নাটক, স্ফিংস। আর একটি পূর্ণাঙ্গ, সেটি হলো চাক ভাঙা মধু। দুটিতেই আমি দুটি চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছি। তাই নিয়ম করে রিহার্সালে যাচ্ছি। নবনি রায়ের বড় ছেলে নিমাইদা হচ্ছেন নাটকের পরিচালক। আমাদের এ পাড়ার কিছু ছেলে-পেলেও আছে সেই দলে অভিনয় করবার জন্যে। এদের মধ্যেই সুভাষ এবং মানু। শুনলাম এরা আবার নাকি পেশাদারী নাটকেও অন্য জায়গায় অভিনয় করে। বুঝলাম, আরো অনেকেরই এই পথে অনেক কাল ধরেই আনাগোনা। এদের মধ্যে আমার মতো আরও কয়েকজন আছে নাকি আনকোরা? নবনি রায়ের এই ছাদের উপরে রিহার্সাল দিতে যেয়েই পরিচয় হলো প্রদীপ চ্যাটার্জী নামক এক ছেলের সঙ্গে। প্রথম পরিচয়ের পর-থেকেই কেন জানি না বেশ খানিকটা আন্তরিকতাও তৈরি হয়ে গেল তার সঙ্গে। প্রদীপের আচার-ব্যবহার বেশ খানিকটা পছন্দেরও হয়ে গেল। সে আমাদের বাড়িতেও সামান্য ক’দিনের মধ্যেই বেশ গ্রহণযোগ্য হয়েছে বুঝতে পারলাম।
নিতাইদার সুবাদে ক্লাব-জীবনের আমার এই আড্ডার অভিজ্ঞতা ক’দিন হয়েছে মাত্র। এবং নাটকের দলেও নাম লেখানো হলো সেই জন্যেই। ক্লাবের বাৎসরিক অনুষ্ঠানেও নাম দিলাম। দিতে না চাইলেও একরকম জোর করেই নাম দিয়ে দিলো সকলে মিলে । এবং সেই আমার প্রথম মাঠ ভর্তি বহু মানুষের মাঝখানে মঞ্চে উঠে স্বরচিত কবিতা পাঠ করা।
কেন জানি না, এই নিয়ে প্রদীপের খুব আনন্দ। আমি যখন মঞ্চ থেকে কবিতা পাঠ করে নেমে এলাম এ পাড়া ও পাড়ার সকল মানুষের সামনে, সেই আমায় প্রথম কবি বলে ডাক দিয়ে জড়িয়ে ধরলো।
কবি পরিচয় তো হলো। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আর একটি অন্য মুস্কিল হলো দেখতে পেলাম। পাড়ার একটু বয়স্ক লোকজন, একটু যাঁরা সংস্কৃতি মনস্ক, স্থানীয় সম্মানীয় মানুষজনও পথে-ঘাটে দেখলেই আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করছেন। এ রকমই একজন হরেন বাবু, একদিন সামনাসামনি দাঁড়িয়েই জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁ গো, এই শোনো ভাই, তোমাকে তো এইভাবে চিন্তাম না! তোমাদের বাড়ির সকলকেই তো চিনি জানি! কিন্তু ঐ বাড়ির মধ্যে থেকে যে এমন মানসিকতার একজন তৈরি হয়েছে, তা তো জানতাম না! তোমার কবিতা দুটিই বেশ হয়েছে। মন দিয়ে শুনেছি বুঝলে। নিয়মিত চর্চা করো, তাই না?
কিছুই বলতে পারলাম না ওনার কথা শুনে । একটুখানি জোর করে হাসলাম শুধু। ওনার এই বাহবা দেবার মধ্যে আমি যেন ওনার একটি অতি ক্ষুদ্র দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়ও পেলাম। খুব মনখারাপ হয়েছিলো ওঁর ইঙ্গিতপূর্ণ ঐ একটি কথার জন্যে। সেটা আর কিছুই না, এই যে, উনি বুঝতে পারেননি আমাদের মতো ঐ রকম একটি টালির চালের খোলামেলা বাড়ির মধ্যে এইসব শিল্প সংস্কৃতির চর্চা হওয়াটা যেন খুবই বিস্ময়কর একটা কিছু ! যা ওঁর চোখে বেশ বড় একটি আশ্চর্যের বিষয়বস্তু বলে মনে হয়েছে।
এই প্রথম জানতে পারলাম, প্রথাগত ধারাবাহিকতার বাইরে আর কোনো লিপি-জ্ঞানই সাধারণের জন্য মনে হয় গ্রহণযোগ্য নয়।
তাঁর এই অনুভবের জন্যে কোনো বিশেষ ধন্যবাদ জানাতে পারলাম না বলে, কেন জানি না নিজের মধ্যে নিজেরই একটা বেদনা জন্মালো। মাথা নিচু করে শুনেই গেলাম তাঁর অভিমত। কিন্তু একটা মন যেন বলতে চাইছিলো কিছু। বলতে পারলাম না সেভাবে। তবে একেবারে কিছুই না বলে, একজন মানুষের সামনে থেকে নীরবে সরে আসাটাও তো অসভ্যতা। তাই বললাম এইটুকুই খালি, ও কিছু না, ঐ তো ওগের জন্যেই তো আমার পড়াটা হলো। আমি খুব একটা পড়তে-টড়তে পারি না এতো মানুষজনের সামনে, তাই আর কি, তাহলে আসি এখন? আমার আবার একটু কালীবাড়ির দিকে যেতে হবে, তাড়া রয়েছে, …
তারপর হাঁটতে থাকলাম নিজের মতো ঠিকই, কিন্তু ওঁর জিজ্ঞাসা করা কথাগুলি কিছুতেই পিছু ছাড়ছিল না। উনি আমাদের বাড়ির সকলকেই চেনেন, জানেন। কিন্তু ওঁর ধারণায়, ঐ ধরণের একটি বাড়ির পরিবেশের মধ্যে থেকে এইসব চর্চা-টর্চা হয় যে তা ওনার কাছে অস্বাভাবিক বলে মনে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাড়ির গঠন প্রণালী দায়ী, নাকি অসচ্ছলতা? কোনটা? আর্থিক চাকচিক্যের উপর নির্ভর করে শিক্ষা এবং নান্দনিকতা বোধ তৈরি হয় নাকি? কোন্টাতে ওঁর সমস্যা মনে হয়েছে, বুঝতে পারলাম না। টালির চালের ঘরে নন্দনতত্ত্বের বিকাশ কী অসম্ভব মনে হলো ওঁর? সংস্কৃতি চর্চার অধিকার কি একমাত্র তাঁদের, যাঁদের তথাকথিত সামাজিক পরিচয়ের জায়গাটা আর্থিকভাবে বেশ স্বচ্ছল! এবং সেটাই কি প্রাথমিক শর্ত?
ফলে উৎসাহ পাবার চাইতে নিরুৎসাহই হলাম বেশি করে। হাঁটতে হাঁটতে সেই অল্প বয়সের জেদের মধ্যে আবারও “বাড়ির পরিবেশটাই এমন” ভাবে ইঙ্গিত করতে লাগলো, যেন সেটাই সবকিছু এখন!
পরের দিন নিতাইদাকে ওনার প্রশস্তি বাক্যের নির্যাসটুকু বলতেই, সে বললো, মানুষ তো কতকিছুই বলবে। তাই নিয়ে ভাবলে হবে! তোমাকে তোমার কাজটা করে যেতে হবে তোমার মতো করেই। কে একজন তোমাকে ডেকে কী বলেছে, প্রসংশা করেছে না বদনাম করেছে, তাই নিয়ে ভাবলে হবে না। পারলে তার ভালো বলা টুকুই নিও। আর বাকিটাকে ফেলে দিও, যেটুকু তোমার ভালো লাগেনি। আমি হলে সেটাই করতাম। তাই বলি, এরপর যেখানেই ডাকবে সেখানেই যাবে। নিজের লেখা মানুষের সামনে তুলে ধরবে। আর লেখা প্রকাশ করো না কেন? আমাদের ক্লাবের ওয়াল ম্যাগাজিনে তো লিখতে পারো।
সে কথার উত্তরে আমি তাকে বলি, ঠিক আছে এবারে দেবো।
— হ্যাঁ দেবে, এবারে পুজো সংখ্যাতে তোমার কাছ থেকে ওদেরকে লেখা চাইতে বলবো দেখি।
প্রদীপ কোথাও ছিলো, সে কাছে আসতে আসতে আমাদের কথাবার্তা শুনতে পেয়ে ঢুকে পড়লো আমাদের কথাবার্তার মধ্যে। বললো, ঠিকই তো, আমিও ওকে বলেছি, এইভাবে লুকিয়ে-চুরিয়ে লিখে ফেলে রাখলেই হবে না। নানা জায়গায় পাঠাতে হবে। নানা অনুষ্ঠানে পড়তে হবে। তবেই না জানতে পারবে সকলে। আর একটি বিষয় নিতাইদা, ওর আবার লেখার বিষয়বস্তুও তেমন, অ্যাতো ঘোরপ্যাঁচ লাগানো। ঠিক সোজাসাপ্টা কিছু না। আপনি পড়েছেন নিশ্চয়? ঠিক বুঝেছি ওর লেখা, এটা বললে ভুল হবে। তবে ভালো লেগেছে। একটা ভালোলাগা আছে কোথাও। মনে হয় একটা দিক আছে, তাই। যদিও সেটা হয়তো ও ওর বলার মধ্যে দিয়ে পরিষ্কার করে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে পারছে না ঠিক। তবে তার একটা ভালো দিক হলো, কীভাবে কীভাবে যেন একটা ভালোলাগা তৈরি করে দেয় দেখেছি। তবে সেটা বোঝার জন্যে ঠিক পরিষ্কার নয়, যতটা ভালোলাগার ক্ষেত্রে। আমি তো আর কবিতার বিশেষজ্ঞ নই। আমার জগত তো নাটকের। তাই এর চাইতে বিশদে আর কিছু বলতে পারবো না।
নিতাইদা চুপচাপ ওঁর কথাগুলি শুনছিলো। প্রদীপ যেভাবে হঠাৎ ঢুকে পড়ে এইভাবে বর্ণনা করতে লাগলো বেশ একান্ত হয়ে, এটা নিতাইদার খুব ভালো লেগেছে যে সে কথা সে তাকে বললো। বললো, এই যে প্রদীপ, তুমি আমাদের আলোচনার মধ্যে হঠাৎ করে এসেই এত মনখুলে ওর লেখালিখি নিয়ে বললে, এটা কি খুব সহজ? একেবারেই না। তুমি তো খুব ভালো ভাবেই শুনেছো বা পড়েছো ওর লেখা-পত্র, যা বুঝলাম। বা বা! আমিও তো এত ভালোভাবে বুঝতে চেষ্টা করিনি! যা তুমি করতে পেরেছো এর মধ্যেই। আমি যা জানি, খুব বেশি দিনের পরিচয় তো তোমাদের না? তুমি তো আমারও আগ্রহ বাড়িয়ে দিলে দেখছি ভাই! এই, সাম্প্রতিক কালের তোমার লেখা, যেগুলি আছে সামনে, একদিন তোমাদের বাড়ি গেলে আমাকে একবার শোনাবে তো?
জলকষ্ট শুরু হয়েছে কিছুদিন হলো। একে তো টিউকলের জল নোনা। তিনশো ফুট পাইপেও এই অঞ্চলে নোনতা জলই উঠে আসে। এই লেয়ারটিই রয়েছে এখানে, অথচ এই আমবাগান ছাড়ালেই মিষ্টি জল। প্রথম প্রথম ওদেশ থেকে ফিরে আসার পর খুব অসুবিধা হতো। এখন সেটা অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আগে ঠাকুমার বাড়িতে গেলে, বা দিদির বাড়িতে গেলে বেশ খানিকটা জল ঢকঢক করে খেয়ে নিতাম প্রাণ ভরে। আর রাইফেল ক্লাবের মাঠের পেছন দিকটায় শৈলেন মামাদের বাড়ির জল তো ওদের বাড়িতে গেলেই আগে চেয়ে নিয়ে বেশ পরিতৃপ্তির সঙ্গে এক গেলাস খেয়ে তারপরে বাকি সব কথাবার্তা যা হতো হতো। শৈলেন মামার বউ, মামিও সেটা জেনে গেছিলো ভালো করে। তাই সেখানে গেলেই আগে এক গেলাস জল হাতে ধরিয়ে দিয়ে তারপর কথা শুরু করতো নিজের।
যা বলছিলাম, জলকষ্টের কথা। কলে জল উঠছে না। ঘড়াং ঘড়াং করে পাম্প করাই সার। হাত ব্যথা করে তারপর হয়তো এক বালতি জল ওঠে। এরপর সেই জল খানিকক্ষণ রেখে দিলে দেখি কি রকম একটা হালকা গেরুয়া রং ধরে যায় বালতির ভেতরে নিচের দিকে। এদিকে বাড়িতে এতগুলি গরুবাছুর, তাদের স্নান খাওয়া। তাদের ঘর-দুয়োর পরিষ্কার পরিছন্ন করতেও তো জল লাগে। সব কিছু মিলে নতুন বাথরুমে চৌবাচ্চা বোঝাই করাই দুস্কর। একদিকে বাঁচোয়া, ভাগ্যিস শান্তি কাকুর কুয়ো ছিল, তা না হলে কী যে হতো! শান্তি কাকু বলেছেন, জল যত লাগে এখান থেকে নিয়ে যা তোরা।
বাড়ির লাগোয়া বাড়ি বলে বেশি দূর থেকে টেনে আনতে হচ্ছে না জল, তা না হলে হয়েছিল গরু পোষা। দক্ষিণ দিকে বাথরুমের পাঁচিলের ওপারেই তো শান্তি কাকুদের কুয়ো। তাই অনেক রাত অবধি তাদের ওখান থেকেই জল তুলে বালতি করে আনা আনি চলছে আমাদের বাড়ির সব কাজেই। সকলেই টেনে আনছি সেই জল। এ যেন আর একটা বাড়তি সমস্যা তৈরি হয়েছে ইদানীং। এ শুধু আমাদেরই না, পাড়ার অনেকেই শান্তি কাকুর এই কুয়োর ভরসাতেই চলছে এখন। খাবার জলের দায় মেটাচ্ছে, আমরা যেভাবে কল পাম্প করে জল তুলছি ঘটাং ঘটং করে, সেই ভাবেই হয়ত সকলেরই এক গতি এখন এখানে । না হলে কিছুটা পথের ধারে সম্প্রতি পুঁতে দিয়ে যাওয়া ছশোফুট কল ও অনেকটাই ভরসা ।
কিন্তু বাড়ির কল ঠিক করা যায় কীভাবে । তার জন্যে আবার সেই শান্তিনগরের সরকার মামাকেই তলপ করা হলো। তিনি সব দেখে-শুনে পান চিবোতে চিবোতে বললেন, দিদি, ঠিক করা যাবে হয়তো খানিকটা, তবে আমি বলি কি, এই লেয়ারে এর থেকে খুব বেশি ভালো জল আর পাইবেন না মনে হয়। এর চাইতে ভালো পাইতে হইলে ছশো ফুটে যাওন লাগবো। তা যদি না হয়, তা-হোইলে যা আছে তাই-ই না হয় থাউক। তাও দেহি, সরাইয়া বসায়ে যদি এর থিক্কা ভালো কিছু হয়। আর একটা কথা, ঐ পাইপগুলান তো তোলা যাইবো না। তাই কোই কি, নতুন পাইপ এবং নতুন ফিল্টার দিয়া দিতে হইবো কিন্তু। এই সব কোইরা দেহি কি করা যায় এবারে।
মার এইসব শুনে-মেলে মুখটা দেখলাম অন্ধকার হয়ে গেলো একটু। মা তাও বলে, সরকারদা, আমি কই পাই এতো টাকা কন দেখি! তাও দেখি, আপনি যেটা ভালো মনে করেন করেন তো দেখি, বারবার এই জিনিস কার আর ভালো লাগে, তাই কন তো?
মার আবার এই একটা স্বভাব, যদিও বিষয়টা আমার ভালোলাগে না মোটেই, যার যার সঙ্গে তার তার মুখের ভাষা আয়ত্ত করে নিয়ে খানিকটা তাদের মতো করে বলার একটা চেষ্টা করা, সে মনে করে এইটাই হয়তো ঠিক, এইভাবে তাদের মুখের ভাষায় কথা বললে তাঁরা হয়তো খানিকটা একাত্ম হয়ে যায়। এমন ধারণা হয়তো মার মধ্যে আছে। আর সেই জন্যেই তার এমন প্রচেষ্টা, এটা আমি বুঝেও মাকে জিজ্ঞাসা করিনি কোনদিন। তবে আমার বেশ বিরক্তিই লাগতো তাতে। কারণ ওদের এই ভাষা তো মায়ের দেশীয় মুখের ভাষা নয়!
মার মুখে ‘ঐ একটা ব্যবস্থা যা হয় করবেন,’ এই কথাটির তাৎপর্য কি, সেটা সরকারদা খুব ভালোই বোঝেন। তাই হয়তো সে বলে, ঠিক আছে ঠিক আছে, সে তো জানি দিদি আমি, দেখি কি করণ যায়। কতটা পুরানো পাইপ ভালো পাওয়া যায় দেহে নি আগে, তারপরে তো কথা? দেখুমখানে চেষ্টা কইরা, তয় কথা কিন্তু সেরকমের কিছু দিতে পারত্যাছি না কিন্তু; আচ্ছা ছাড়েন ওসব, সে যা-হয় হবে-খানে, দেখি কী হয় আগে, তারপরে তো! সগল চিন্তা যখন আমার উপরেই ছাইরা দিছেন, তহনে আর আপনার এত ভাবনার কি আছে? দেন দেহি, একটা পান দেন তো আগে। ওঁ, এটটা ভালো খবর দি, হয়তো কিছুদিনির মধ্যিই আপনাগের এখানে মিউনিসিপ্যালিটির থেকে বাড়ি বাড়ি জল আইসা যাইবো গিয়া। তইলে তো আর ঝামেলা থাকলো না! হ্যাঁ আমাগের কাজকম্ম হয়তো কিছু কমবো, তা কমুক, তাই বলে মানুষ তো আর রোজ রোজ এই রকম কইরা কষ্টে থাকবার পারে না!
এই বলে সে দমাস করে কি একটা ভেবে নিয়ে বলে, ঠিক আছে সে যা হয় হবে-খানে; কাইলই যদি লোকজন পাই তো চইলা আইতাছি…. ।
সরকারদার মতো মানুষ কিম্বা মুদির দোকানদার নীলু এঁদের মতো কিছু মানুষ ছিলো বলেই হয়তো আজও এইসব স্বল্প উপার্জনশীল মানুষজনেরা বা পরিবারগুলি কতটা যে উপকৃত হতো সেইসব দিনে, তা এদেশে ফিরে আসার পরে খুব হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছিলাম, যত দিন যাচ্ছে ততোই যেন।
যাক, শেষপর্যন্ত সরকারদার মিস্ত্রীদের নানা মুখভঙ্গি করে গান গাওয়াই সার হলো, পাইপ সবগুলো তোলা হলো না আর। মাত্র দুইখানা পাইপ ভালো উঠলো। ফিল্টার তোলা যাবে না, তারা বললো।
নতুন প্লাস্টিকের নেট দেওয়া ফিল্টার বেরিয়েছে আজকাল, সেটাই ভালো হবে বলে লাগিয়ে দিয়ে গেল। আর পাইপ সবই টাটা কম্পানির ভালো হবে বলে, সেটাই লাগিয়ে দিয়ে গেল সরকারদা।
হ্যাঁ, নতুন কলে জল পড়তে লাগলো ভালোই। তবে খরচা যা হবার হলোই।
বিষনি ভাইও বেশ খুশি হয়ে বললো, যাক, মা একটা ভালো বিবস্থা তো হলো, ই ভাবে কতদিনই বা চোলবে, তাই বলেন দিকিনি!
কাজের দিদিরও মুখে হাসি এলো বেশ। আমারও ঠাকুমার বাড়িতে দুপুর বেলায় স্নান করতে যাওয়া শৈলেন মামার বাড়ির উপর দিয়ে এবারে বন্ধ হলো। যদিও শৈলেন মামার বউ-এর জোরাজুরিতে ঠাকুমার বাড়িতে স্নান করতে যাওয়া এর মধ্যেই বন্ধ হয়েছে। তার কথায়, তারা থাকতে এই দুপুর রোদে আমি কেন অত দূরে যাবো স্নান করতে। মামি বলতো, ও ভাগ্নে, এই গরমের দুপুর রোদে, অত দূরে যাওয়ার কি আছে তাই বলো তো? আমি তোমারে নতুন তোয়ালে দিচ্ছি, নেও তো, আমাদের এখানেই স্নান করো তো দেখি।
এর আগেও প্রথম প্রথম মামি একই কথা বলেও পারেনি। আমি নানা সঙ্কোচে, নানান অজুহাত দেখিয়ে চলে গেছি গঙ্গাপুরীতে, ঠাকুমার বাড়িতে। কিন্তু সেদিন আর পারলাম না।
বিষয়টার গন্ডগোলটা তো অন্য জায়গায়। সেটা তো আর ভেঙে বলতে পারি না। আসলে আমি একটা ধারাবাহিকতাকে ভেঙে আর একটাতে যেতে ভীষণ অনভ্যস্ত। সেটা কাকে আর বুঝিয়ে বলতে পারি!
এই যে দুটো অভ্যাসের মধ্যবর্তী অবস্থান, এটাকে অতিক্রম করতে বরাবরই অনেকটা সময় লেগে যায় আমার। তাকে ডিঙ্গিয়ে যাওয়াটা কোনোভাবেই হয়ে উঠতে চায় না যেন। তাই না হলে বাড়ির আর সকলেই তো শান্তি কাকুর কুয়োর জলেই সব করছে। কিন্তু আমার কেন অত দূরে যাওয়া!
কাজের দিদি, বিষনি ভাই, ছোটো ভাই, সকলেই তো এরা কাছাকাছি থাকা পুকুরের জলেই স্নান সেরে নিয়েছে এতদিন। মায়ের স্নানের জল বাড়ির কল থেকেই যেটুকু উঠতো তাই দিয়েই হয়ে যায়। না হলে কুয়োর জলেই স্নান করতে হতো মাকে। কখনো কখনো রাস্তার মিউনিসিপ্যালিটির যে ছশোফুট কল আছে ইস্কুলের সামনে, তাতেও এরা স্নান করে আসতো সকলেই। শুধু আমারই হয়ে উঠতো না।
কেন যে হয়নি, সে কথা ভাবিনি যে তাও না। ভেবেছি। আসলে আলগা জায়গায় দাঁড়িয়ে রাস্তার পাশে স্নান করার যে সঙ্কোচ বোধ, সেটা কখন আমাকে এতটা নাগরিক করে তুললো সেটাই ভেবেছি। ভেবেছি, এই আমিই তো ওদেশে থাকতে নবগঙ্গায় ঝাঁপিয়ে বেরিয়েছি কতো! এপার ওপার করেছি কতো। একরকম প্রতিদিনই। কত বড় হয়ে নদী থেকে স্নান করে পরনের প্যান্টটাকে ধুয়ে হাতে করে ল্যাংটো অবস্থাতেই ছুট লাগিয়েছি মামাদের বাড়ির উপর দিয়ে! তবে নতুন মামি আসার পরে এমন কাজ আর কখনো করিনি, এটা বেশ মনে আছে।
জলের কল ঠিক হয়ে যাবার পরেও বেশ কিছুদিন শৈলেন মামার বাড়ি থেকেই স্নান করে এসেছি। কীভাবে যেন সেখানেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি এই কদিনে, তাই সেটা ছাড়িয়ে আসতে সময় লাগছে এই যা। যদিও তার জন্যে মামির আন্তরিকতাই অনেকটা দায়ী। আর স্নান শেষে মামির আপ্যায়নও উপেক্ষা করতে পারিনি। কিছু একটুখানি মুখে না দিয়ে যাওয়া যাবে না বাড়ি। তাহলে নাকি গৃহস্তের অকল্যাণ হয়। এদিকে ইদানীং আবার মামার ছোটো মেয়েটি খুনসুটি করা শুরু করেছে। বুঝতে পারছি ও বড় হচ্ছে। এই তো বছর খানেক হলো এই পরিবারের সঙ্গে আমাদের একটা আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। প্রথম প্রথম ওকে বেশ ছোট বলেই মনে করেছি। কিন্তু এর মধ্যেই ও কবে যে বড় হয়ে উঠলো তা আর বোঝা হয়ে ওঠেনি। এদিকে মামিও চায় ওর সঙ্গে আমার একটা আত্মিক টান গড়ে উঠুক। কখনো কখনো সন্ধ্যাবেলাতে বা বিকেল বেলাতে ওদের ওদিকে গেলেও এটা ওটার প্রয়োজন দেখিয়ে আমাকে সঙ্গে নিয়ে কালীবাড়ির ওদিকে যেতে বলে। যাইও কখনো কখনো। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, দেখছি, আমি ওদের বাড়িতে গেলে ও আর কিছুতেই আমার সঙ্গ ছাড়তে চায় না। একেবারে হাত চেপে ধরে রাখে। সবসময় একটি হাত বগলের নিচে দিয়ে জড়িয়ে ধরে। শরীরের খানিকটা ভার আমার উপরেই রাখতে চায়। ও যখন শরীরের খানিকটা ভর আমার উপর রেখে আমাকে নিয়ে রাস্তা পার হয় তখন আমারও ভেতরে একটা শিহরণ জাগে না যে সে কথা অস্বীকার করি কী করে! কিন্তু ঐ যে, সেই একই আতঙ্ক, শিক্ষাদীক্ষার কী হবে তাহলে আমার! এই মনটাকে তো অন্য কোনো কিছুতেই বাঁধতে দেওয়া যাবে না কোনভাবে।
তাই খানিকটা দূরত্ব রেখেই চলি নানাভাবে, হাসিঠাট্টা এইসব দিয়ে। খুব স্বাভাবিক আচরণের মধ্যে এই সবের অন্য কোনো পরিভাষা খুঁজতে দিই না, একরকম জোর করেই যেন খানিকটা। কিন্তু ওঁর ছেলেমানুষী, ওর খুনসুটি, অন্ধকার রাস্তায় আমার হাত ধরে রাস্তা চলা, সে সবের অর্থ, চোরাটান ইদানীং আমি যেন বেশ কিছুটা গুরুত্বের সঙ্গেই বুঝতে পারছি। মনের অজান্তেই সেসব বেশ খানিকটা প্রশ্রয় পেয়েও চলেছে যে সেটাও ধরতে পারছি। কখনো কখনো বেশ আসক্তও লাগছে না যে তাও না। ঠিক একশোভাগ কি ওর সঙ্গ আমিও পেতে চাইছি?
কই, তাও তো না! মাঝে মাঝে একটু বিরতি দিয়েও যাচ্ছি ওদের বাড়িতে।
একটা জিনিস লক্ষ্য করে দেখেছি, যে জিনিসটা আমার মধ্যে ভীষণ ভাবে কাজ করে, সেটা হলো, কোনকিছুরই একঘেয়েমি আমি খুব বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারি না। কে যেন ভেতরে ভেতরে তার একটি বিরতিপর্ব তৈরি করে দেয়, অন্তরাল থেকেই।
অথচ অদ্ভুত ভাবে সেই দিকেই চেয়ে থেকে উপলব্ধি করি কিছুকাল যাবার পরে সেই অতীতের পিছনেই আবার যেয়ে যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ি। সেই টানেই আবার ফিরে যাই কখন! তাহলে কি সেই নতুনকে একটু পুরাতন করে দেখার তৃষ্ণাই আমাকে এই খেলায় বাঁধে? সেই স্বাদ যেন পিছু টানে আবার।
যা আমার অজানা ছিল এতদিন, তাকেই আবার নতুন করে উপলব্ধি করতে পারলাম যেন।
যে জিনিসটিকে জানতে মানুষের কত কাল লেগে যায়। একসময় জীবন ফুরিয়ে যায়। তবু সেই জানা যেন আর হয়েই ওঠে না!
কালী বাড়িতে একটি বাৎসরিক অনুষ্ঠান হয় মাসাধিককাল ধরে। পালা কীর্তন বা পদাবলী গান বা গৌর কীর্তন যেটাই বলি না কেন।
সন্ধ্যাবেলাগুলিতে এ অঞ্চলের বয়স্ক কিম্বা আধ-বয়সী ছেলেমেয়েরা সকলেই সেখানে ভিড় করেন দাঁড়িয়ে। একেবারে সমস্ত রাস্তা জুড়ে সব মানুষজন দাঁড়িয়ে যান সেই নামকীর্তন শুনতে। আমরাও কখনো কখনো বেশ মুগ্ধ হয়ে শুনি সেসব গান-বাজনা। চেয়ে চেয়ে দেখি মানুষজনের এই সমাগম। কখনো টিঙ্কু আমাকে দেখলে আর কারো সঙ্গেই দাঁড়াবে না সেখানে। কখনো পেছন থেকে এসে আচমকা পিঠের মধ্যে একটা কিলও মেরে দেয় আস্তে করে। এবং এমন কথাও বলবে, এই তুই আমাকে দেখিস নি? নাকি দেখেও না দেখার ভান করছিস? এতবার যে ঐ পাশ থেকে চিৎকার করে ডাকলাম, তা একবারও ভ্রুক্ষেপ করলি না!
তার এই ধরণের আধিপত্য ইদানীং লক্ষ্য করছি। দেখা হলেই আহ্লাদের সঙ্গে পিঠে একটি কিল মেরে তারপরে একটি হাত তার হাতের মধ্যে নিয়ে কথা বলতে থাকবে। কথার বিষয়বস্তু সেরকমের কিছুই নেই হয়তো। তার মা আমার খোঁজ করছে, বা তাদের বাড়িতে কিছুদিন হলো যাচ্ছি না বলে নতুন নতুন কী কী সংযোজন হয়েছে তাদের বাড়িতে, বিষয় হলো এমনই সব, সেসব কথাবার্তার মধ্যে। আর এই সব বৈষয়িক কথাবার্তা সে যত গুরুত্ব দিয়ে বলতে চাইতো আমি ততোই বিরক্তবোধ করতাম। কিন্তু বুঝতে দিতাম না কখনোই। কারণ ওগুলো যে একটাও তার কথা না, তা তো তার চোখমুখের দিকে ভালো করে চেয়ে দেখতে পারলেই বোঝা যায়।
মধ্যবর্তী শূন্যতায় অনেক প্রিয়জনকেই হাবুডুবু খেতে দেখি। দেখে কষ্টও হয়। কেন যে সহজ অভিব্যক্তিটুকু সহজে এরা বলতে পারে না, সেটাই ভাবি শুধু। যে কারণে কোথাও সেই বলিষ্ঠ ভাবাবেগের ইশারা পাই না আর। তখন মনে পড়ে এমন একজন মানুষের কথা, যার প্রকাশভঙ্গিতে সরাসরি সেরকম কোনো স্বীকারোক্তি ছিলো না কিছু। তবে তাকে দেখলে যে-কেউ-ই বুঝতে পারবে, সে যা বলছে তা তার ভেতরের এবং বাইরের একই রকম কথা। কারণ তার বলার ভঙ্গির মধ্যে অন্যকে বুঝিয়ে বলার সেই সহজ সরল আগ্রহ ছিল। সেটা তার কথা বলার ভঙ্গির মধ্যেই প্রকাশ হয়ে পড়ত, অদ্ভুত এক সারল্যে। সেখানে কোনো রাখঢাক ছিল না। তাই কেন জানি না ইদানীং যখনই কাউকে মনে হয় তার ভেতরের কথা আর তার বলা কথার মধ্যে একটা আড়াল আছে, তখন ভীষণ বিরক্ত বোধ করি, সেই মুহুর্তে তাদের সংসর্গ থেকেই।
এই সঙ্কটে কিছুকাল বড়োই টালমাটাল কাটছে একথা স্বীকার করতেই হয়। সব স্বাভাবিককে মেনে নিতে পারছি না। তার ফলে খানিকটা বিভ্রান্তি পেয়ে বসেছে। মাঝে মাঝে পর্যুদস্তও করে ফেলছে সে।
খানিকটা সাংসারিক কাজের ভেতরেই ডুবে আছি বেশ কিছুদিন। গরু-বাছুরের খাবার-দাবার আনতে যেতে হয় যে দোকানটিতে, সেখানেই অহেতুক
গল্পগাথা করেই হয়তো দিনের অনেকটা সময় কাটিয়ে দিই আজকাল। কী এমন গল্পই বা হয় সেখানে? বেশিরভাগ সময়ই দোকানের মালিক রমনিদার বাবার সঙ্গে তার ফেলে আসা দেশ-গাঁয়ের গল্পই হয় বেশি। তাতে দুজনের খানিকটা দু’ রকমের আনন্দই হয় হয়তো; একজনের ছেড়ে আসা পল্লী প্রকৃতির ঋতু-বৈশিষ্টের নানা আনুষাঙ্গিক প্রভাবের কথাবার্তা বলাবলি, আর একজনের বয়সজনিত কারণে তার ফেলে আসা অতীত জীবনের নানা খাদ্য খাবার নিয়ে মুগ্ধতার কথাবার্তা বলাবলি করা।
দুজনের খানিকটা কাছাকাছি বিষয় হয়েও, বিষয় না-গোছের আলাপ আলোচনাতেই সময় মন দুটোই কেটে যাচ্ছে বেশ। কত সে-সব গল্প…! অনেক সময় নিজেই খেই পাই না যেন। আমি কি আর কুমিল্লার কিছু চিনি ছাই! কিছুই তো জানি না প্রায়, এক সময় ওদেশে থেকেও ওদেশের অনেক জনপদ সম্মন্ধে একেবারেই কিছুই তো জানি না! কিন্তু ঐ যে, দেশ তো একটিই, তাই আচার-আচরণের মধ্যে একেবারে আকাশ পাতাল পর্থক্য তো হতে পারে না! তার লোক-ঐতিহ্যে তো খুব একটা বিশেষ পার্থক্য হবার কথাও নয়, প্রাকৃতিক মিলনেও কি কোনো বিশেষ ফারাক আছে নাকি? হয়তো আছে খানিকটা। রমনিদার বাবা বলেন, ঐ তো, একোই তো! আমি অবশ্য আম-কাঠালের ঋতুর গল্পতে খানিকটা মিল পেলেও, জল জঙ্গলের সেরকম কোনো মিলই পাইনি তার মুখে শুনে। তবু সে বেশ মুখ ঘুরিয়ে-ফিরিয়েই বোঝাতে চায় আমাকে তার দেশের কথা, মানসভ্রমণে টেনে নিয়ে গিয়ে, যেন বেশ অন্যরকম এক অনুভব। বলে, তাদের দেশের বাড়ির পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে যে মেহের কালীবাড়ি আছে, তার সেইসব বিচিত্র অলৌকিক সব গল্পগাছার কথা। আমিও বেশ রোমাঞ্চিত হই তাতে। এঁরা সব বাহান্ন ছাপান্নতে ঐ দেশ ছেড়েছে। কিন্তু ছাড়লে কী হবে এখনও তার মায়ায়, গল্পগাছায়, প্রেমে-অপ্রেমেই মসগুল হয়ে ওঠে মুহূর্তে মুহূর্তে। আর তাই এইসব নিয়ে আমাকে কাছে পেলে সে বেশ আপ্লুতোই হয়ে পড়ে।
এদিকে আমার এই রমনিদার ওখানে এত গল্পগাছায় মসগুল হয়ে থাকাকে নিয়ে রিক্সা চালক নিতাই এবং জটাভাই দুজনেই বেশ ঠাট্টা তামাশা করে। নিতাই তো একদিন বলেই ফেলে, ও দাদা, কী অত দোকানের কোণার মধ্যি বসে বসে রমনিদার বাবার সঙ্গে গল্প করো তাই কও তো দেহিনি? ওদিকি তোমারে কী মাইপে দেচ্ছে রমনিদা, তার কি তুমি খেয়াল করো কিছু!
তাকে বেশ বিশ্বস্ত চিত্তেই বলি, না না নিতাই, তেমনটা কি রমনিদা হতে পারে! এসব আমি ভাবতেও পারি নে। তয়, ছোটো ভাইগের কথা তোমারে বলতি পারবোনানে। তহনে একটু লক্ষ্য রাখি তো! তবে এত সব ভেবেটেবে বেড়াই না কখনোই নিতাই। ওসব নিয়ে যদি ভাবতি যাও তাহলে আরো অনেককিছু নিয়েই তো সন্দিহান হতি হয় ভাই; ধরো, সবসময় তো আর আসতি পারি নে! তুমিই তো নিয়ে যাও। তুমি কি সবসময় দেখেশুনে সবকিছু নিয়ে যাতি পারো, তাই কও?
নিতাই অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে তার দেশিও ঢঙে ঠোঁট-টোট বাঁকিয়ে চুরিয়ে নিয়ে বলতে থাকে, কী যে
কও বড়দা, আমি এই হাত দিয়ে ঐ হাতে রে বিশ্বাস করি নে তো! বোঝলেন? এই শালার কলকাতায় কতো সৎ মানুষই তো চোর হয়ে যায়, বুঝতি পারলেন কিনা কন?
আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে, বুঝিয়ে বলি, না না নিতাই, এর আগে আমি বেশ কয়েকবার লক্ষ্য করে দেখিছি তো সেসব, ঐ বিষয়ে খুব ভালো করেই দেখিছি , কারণ এই ভুসিগুলি তো আমি নিজে হাতেই মেলাই , তাতে মেলাবার সময়েই মাপ ধরা পড়ে যায় খানিকটা। তাছাড়া হঠাৎ হঠাৎ বেশ লক্ষ্য করেও দেখিছি, রমনিদা একটুও কম দেয় না।
নিতাই কখনো কখনো কেন যেন ভীষণ বিরক্ত হয়, আমার এইখানে অনেকটা সময় কাটানোতেও, সেটার একটা বড় কারণ হলো, ও নিজেও চায় আমার সঙ্গ। আমার সঙ্গে খানিকটা বকবক করতে দেশিও আবেগে। তাতে নিতাইও বেশ আনন্দিত হয়ে থাকে সেটা আমি জানি। তাই ওর রাগ হয়, ওকে যখন একা একা দানাভুসিগুলিকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে যেতে হয় তখন। সে যাবার সময় জিজ্ঞাসা করে, কী বড়দা যাবা না এহোনে?
তাকে হয়তো তখন বলি, না নিতাই, তুমি যাও চলে, খানিকটা বাদে আমি যাচ্ছি, বলোগে যাইয়ে বাড়িতে, আজকে একটুখানি দেরি হবে যাতি আমার।
কোনদিন হয়তো নিতাই না যেয়ে বিড়ি নেবার নাম করে এপাশে মুদিখানার দিকটায় যেখানে মেসোমশাই বসে থাকেন চৌকিতে, সেই দিকটাতেই আসে। আমি হয়তো তখনও পাশটাতেই একটি চেয়ারে বসে রয়েছি। নিতাই বিড়ি নিতে এসে কিভাবে যেন কদিন দেখছে আমি মেশমশাই-এর সঙ্গে কথা বলছি। আমাদের গল্পের ভেতরে কোনো একটা প্রসঙ্গ নিয়ে সেও ঢুকে পড়ে, তারপর দেশের খানিকটা স্মৃতিচারণ করে। তার মধ্যে তার কথা বলার বিষয়ে থাকে মাছ ধরার কলাকৌশলের কথাবার্তাই বেশি করে। নদী, খাল-বিল ছাড়াও ক্ষেত খামারের কথাবার্তা। আর কীই বা এদের বিষয় হতে পারে?
নিতাইও এদেশে উদ্বাস্তু হয়েই এসেছে। বসিরহাট অঞ্চল দিয়ে একদিন মা-ভাই-বোন-বউদি, ছোটো ছোটো ভাইপো-ভাইঝিদের সকলকে চোখের জলে ভাসিয়ে চলে এসেছে সে, জেদ ধরেই খানিকটা। সে অবশ্য এখন মাঝেমাঝেই অনুশোচনা করে বলে, কেন যে আলাম চলে বড়দা, এহোনে ভাবি, না আলিই মনে হয় ঠিক ছিল, জানেন তো…? এ-শালার দ্যাশে আইসেই ভুল করিসি। আবার ভাবি অন্য কথাও। সেই জেদের কথা ভাবতি গেলি মনে হয়, না, ঠিকই করিসি। আসলে কোনোখানেই গরিবির কোনো জায়গা নেই বোঝলেন কিনা! তহনে আর একটা মন কয়, কি দরকার ছিলই বা! এহেনে আইসে তো রিক্সাওয়ালা বনে গেলাম শেষমেশ। এই তো হলো লাভের লাভ! যেটুক এহোনে দেখলাম যা। কেন যে আলাম বড়দা, তাতো বুঝি নে এহনে কিছু।
রমনিদার দোকানের যে পাশটায় মুদিমশলা-পান-বিড়ি-সিগারেট থাকে সেখানটাতে যেয়েই আমি বসি। ইদানীং কখনো কখনো রমনিদার বাবা না-থাকলে দোকানে আমিও এটা ওটা খরিদ্দারদের এগিয়ে দিই। পয়সাও নিই। বেশ খানিকক্ষণ দোকানদারি করে দিই ওঁদের। এই সূত্রে এখানকার স্থানীয় কয়েকজন মানুষজনও আমাকে দেখলেই বলে, এটা দিন,… ওটা দিন না, বা দেও না …। রমনিদাও বলে, দাও তো ভাই, একটু ওনাকে….।
সেই অভ্যাসে সামনে-পেছনের বাড়ির ছেলেপেলেরাও আমার কাছেই গিয়ে বসে, রমনিদাকে যদি দেখে দানাভুসির ওপাশে থাকতে। নিরুপায় হয়ে দুই ঘরের মাঝখানের সীমানা দেওয়া বেঞ্চিতে বসে থাকা আর হয় না আমারও— ঘুরে মুদিখানার ওদিকটায় যেতেই হয়।
এইসব করে বেশ কিছুটা সময় এখানেই কাটিয়ে দিই ইদানীং। কেন যে এমন একটা সম্পর্কের ঘেরে জড়িয়ে পড়ছি, তাও ভেবে পাইনে। এবং বেশ কিছুদিন এই ভালোলাগার পাল্লায় পড়ে বেলা গড়িয়ে বাড়ি ফেরার পর কাজের দিদির বকাবকিও শুনতে হচ্ছে হাসতে হাসতে। সে বলতে থাকে, কখনে আর স্নান-খাওয়া-করবে বলো দেখি দাদা? সেই যে কখধ দানাভুসি আনতে গেলে, দানা-ভুসি রেখে নিতাই কখন চলে গেল! কিন্তু তোমার আর বাড়ি ফিরে আসার আর নামগন্ধ নেই দেখছি।
আমি আর তাকে কী করে বোঝাই, আমি যে-এক নাম না জানা সম্পর্কের ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছি দিদি গো, এ কথা তোমারে কী করে বুঝোয়ে কোই, বলো দেখি?
বিষয়টা অনেকেরই বিরক্তির কারণ হয়েছে দেখছি। দশটা এগারোটা বেলায় গেলে ফিরতে তিনটে বাজিয়ে দিচ্ছি। সন্ধ্যায় গেলে রাত দশটা এগারোটা। এই বিষয় নিয়ে বন্ধুবান্ধবরাও ঠাট্টা ইয়ার্কি করছে ইদানীং। বলছে, কি রে ওখানে কি কোনো বিশেষ মানুষের দেখা পেলি নাকি? না হলে যখনই এসে খোঁজ নিই তোর, তখনই শুনতে পাই দানাভুসির দোকানে। বিষয়টা কি রে, বলতো দেখি?
কীই বা বলি! চুপ করেই থাকি। মনে মনে ভাবি, নিয়ন্ত্রণ সত্যিই এবারে প্রয়োজন দেখছি।
যে মনটা মনেরই অজান্তে সুদূরের সেই সামান্য ক’দিনের জীবন প্রবাহের তুচ্ছাতিতুচ্ছকে নিয়ে কী এক অপার মুগ্ধতা দিয়ে ভরে রেখেছে নিজেরই আড়ালে, যা-সে নিজেই জানে না স্পষ্ট করে; আর তাতে যদি কেউ একটুখানি দোলা লাগিয়ে দেয়, অমনি সে দুলে ওঠে অসীম মুগ্ধতায়, কেন যে! আসলে, অসম্পূর্ণ সেই মুগ্ধতার দোলায়ই তো দুলিয়ে চলেছে প্রাণের সকল প্রবাহ। যদিও তার সব খোঁজ স্পষ্ট করে এই মনটাও পায় না! সে যে কখনো কখনো কিছুই মানতে চায় না তাও। কোনো অজান্তেই আবার সে ভেসে পড়ে। ভেসে বেড়ায় যেন শ্যাওলার মতো। নাকি সে পানা-কচুড়ির-মতো ভেসে থাকা? নাকি জল-শ্যাওলার ধ্বনি তরঙ্গে বাজাচ্ছে যে বসে, সেই অসীম মুগ্ধতায় বাঁশিটি; যার সুর আমরা শুনেও শুনতে পাই না অনেক সময়ই। জেনেও জানতে জানি না। অজানার সেই পথ ধরেই সে তাঁর কত অতীত কালের মুখখানি তুলে ধরে এমনই কোনো এক রূপ মুগ্ধতায়, যে মুখখানি শুধুমাত্র স্বপ্নেই দোলা লাগিয়ে চলেছে… আমাদের সকল অজানা সেই ঋতু প্রবাহে? এমনই এক ভাবের ঘোরে, কত অজান্তেই হয়তো সে তার মনোজগতেই ডুবে মরে। আমরা তার উদ্দেশ্য-অনুদ্দেশ্যের কোনো খোঁজই পাই না কখনো।
তাই সেখানে নিতাই দা, প্রদীপ চ্যাটার্জী, শংকর, ফোচন, অলোক, কাল্টু, নিমাই, রতন, শৈলেন মামার বাড়ি, মামিমা, টিঙ্কু, রমনিদার দোকানের দুই পাশ, সেখানকার এপাশের ওপাশের ছেলেমেয়েদের রমনিদার দোকানে এসে এটা ওটা চেয়ে নিয়ে টাকা পয়সা বাড়িয়ে ধরা, কালীবাড়ির সিপিএম পার্টি অফিসের পাশে ঝন্টুদার চায়ের দোকান, সংকল্প ক্লাবের সদস্য হয়ে যাওয়া, এ সিনেমা হল, ও সিনেমা হলে ঢুকে যাওয়া, এইসব, সবেরই এক একটি মুহূর্ত সেই রচনা করে চলেছে, যার পেছনের তাড়নাটির দিকে যদি খুব ভালো করে লক্ষ্য করে দেখা যায়, তাহলে বিশেষ কোনো অর্থই খুঁজে পাওয়া যাবে না। যেন মনে হবে শুধু যাওয়া আর আসাই সেখানে শুধু। ঘোরাঘুরি। বসে থাকা। কিন্তু তার বিশেষ কোনো কার্য-কারণ আছে বলে তো মনে হয় না কোথায়ও এখন!
সেরকমের একটুখানি খোঁজ যখন করতে যাই কখনো, ঠিক তখনই ভীষণ এলোমেলো লাগে নিজেকে। চুপটি করে সেই বারান্দাটির কোণায় এসে বসে পড়ি রাতের অন্ধকারে। মন তখন কাউকে যেন খোঁজে একান্তে। কাকে খোঁজে? কার কাছে চেয়ে চেয়ে কাকে নিরন্তর খুঁজে চলা সেখানে… । কাকে দরবার করতে চাওয়া কারোর বিরুদ্ধে শুধুই! আর সেসব সব জানে শুধু সেইসব বর্ষণমুখর রাত… কুয়াশাচ্ছন্ন রাত… শীত-গ্রীষ্মের রাতের বেলাগুলিই সেসব জানে, হাঁ করে চেয়ে চেয়ে কীভাবে একাকী দেখেছিল, কেমন ভাবে?
ঐ ঝাউগাছের সারি, তার মাথার উপরে মধ্যরাতের আকাশ, কোনো কোনো দিন হয়তো চাঁদের আলোটুকু নিয়ে কি যে বিষন্ন হাওয়া বয়, বাতাসে দোলা লাগিয়ে নিয়ে চলে ঐ ঝাউ গাছের মাথাগুলি যে, তার কি জানি কিছুই? না তারপরও কোনো কিছুর কোনো অর্থ খুঁজে পাই আমরা কোথাও?
মনে মনে ভাবি, কেন যে এমন রাতের বেলাগুলি এমনভাবে এই বারান্দায় বসে বসে কাটিয়ে দিই কেনোই বা! কী এমন শান্তিই বা মেলে তাতে? কী এমন রূপময়তাই বা খুঁজে পাই ঐ ঝাউ গাছগুলির মাথা নাড়ানো দোলাদুলির মধ্যে? কি রচিত হয়ে চলে তাতে! তার সব স্বরূপটি কি ধরতে পেরেছি আদৌ কেউ?
তবু সেই রাতের আকাশের দিকেই চেয়ে থাকা আমার ।
আগামী পর্বে
********************************************************************************


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন