জীবন হাটের কড়চা
সুদীপ ঘোষাল
পর্ব * ১০
গ্রীষ্ম অবকাশে বট গাছের ডালে পা ভাঁজ করে বাদুড়ঝোলা খেলতাম বিশুর নেতৃত্বে।তারপর ঝোল ঝাপটি। উঁচু ডাল থেকে লাফিয়ে পড়তাম খড়ের গাদায়। এসব খেলা বিশুর আবিষ্কার। তারপর সন্ধ্যা হলেই গ্রামের বদমাশ লোকটিকে ভয় দেখাত বিশু। সুদখোর সুরেশ মহাজন বটগাছের ডাল থেকে শুনলো, কি রে বেটা খুব তো চলেছিস হনহনিয়ে। আয় তোকে গাছে ঝোলাই। সুদখোর অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো। তারপর থেকে ও পথে যেত না মহাজন। সাদা চুলো গান্ধিবুড়িকে রোজ সন্ধ্যাবেলা নিজের মুড়ি খাইয়ে আসতো অতি আদরে। বিশু বলতো, আমি তো রাতে খাবো। বুড়ির কেউ নেই, আমি আছি তো। শ্রদ্ধায় মাথা নত হত নেতার হাসিতে।
একবার বন্যার সময় স্কুল যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন আমাদের নেতা। কোথাও সাঁতার জল কোথাও বুক অবধি জল। একটা সাপ বিশুর হাতে জড়িয়ে ধরেছে। বিশু এক ঝটকায় ঝেরে ফেলে দিলো সাপটা। স্কুল আমাদের যেতেই হবে। সাঁতার কাটতে কাটতে আমাদের সে কি উল্লাস। যে কোনো কঠিন কাজের সামনাসামনি বুক চিতিয়ে সমাধান করার মতো মানসিকতা বিশুর ছিলো। সে সামনে আর আমরা চলেছি তার পিছুপিছু। শেষ অবধি পৌঁছে গেলাম স্কুল। হেড মাষ্টারমশাই খুব বাহবা দিলেন স্কুলে আসার জন্য। তিনি বললেন, ইচ্ছা থাকলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।
টিফিনের সময় ছুটি হয়ে গেলো। আসার সময় একটা নৌকো পাওয়া গেলো। মাঝি বললেন, আমার বয়স হয়েছে আমি একা অতদূর নৌকা বাইতে পারবো নি বাবু। তাছাড়া আমার এখনও খাওয়া হয় নি।
বিশু সঙ্গে সঙ্গে নিজের টিফিন বের করে দিলো। আমরাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো টিফিন বের করে দিলাম। মাঝি ভাই বললেন, এসো সবাই এক হয়ে খেয়ে লি। তারপর নৌকার কান্ডারি হলো বিশু। আর আমরা সবাই মুড়ি মাখিয়ে খেতে শুরু করলাম। মাঝি ভাই ও বিশু খেলো। ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলাম গ্রামে। মাঝি ভাইকে পারিশ্রমিক দিয়ে বিদায় জানালাম।
পরের দিন রবিবার। রঙিন সকাল। আকাশে মেঘের আনাগোনা। কাশের কারসাজি নদীর তীর জুড়ে। বন্যার জল নেমে গিয়েছে। পুজো পুজো ভাব। বিশু কাশফুলের ভিড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। কয়েকদিন হলো তাকে দেখা যাচ্ছে না।
আমি ঘুরতে ঘুরতে পুজো বাড়ির ঠাকুর দেখতে গেলাম। সেখানে দেখি বিশু হাতে কাদা মেখে শিল্পীকে সাহায্য করছে। তিন দিন ধরে এখানেই তার ডেরা। এখন তার মনে বাজছে ঢাকের ঢ্যামকুড়াকুড়। মন মন্দিরে তার দুর্গা গ্রামদেশ ছাড়িয়ে অভাবি বাতাসে বাতাসে। পুজো বাড়িতে আমাকে দেখেও কোনো কথা না বলে হাঁটতে হাঁটতে বাইরে চলে গেলো।
আমি জানি সে এখন চাল, ডাল নিয়ে সর্দার বুড়িকে রেঁধে খাওয়াবে। সে বলে, ওর যে কেউ নেই। ও খাবে কি?
বিশুর বাবা বছরে একবার বাড়ি আসেন। তিনি ভারতীয় সৈন্য বিভাগে কাজ করেন। বাড়িতে এলেই বিশুর হাতে হাতখরচ বাবদ তিনি বেশ কিছু টাকা দিয়ে যান। সেই টাকা বিশু লোকের উপকারে কাজে লাগায়।
বড়ো অবাক হয়ে ভাবি, ছোটো বয়সে এতবড় মন সে পেল কোথা থেকে?
স্কুলের দূরত্ব অনেক বেশি হওয়ায় আমাদের চার বন্ধুর বাড়ির গার্জেনরা শলা পরামর্শ করে হোষ্টেলে থাকার কথা বললেন। দায়িত্ব নিলো বিশু। কিন্তু হেড মাষ্টারমশাই বললেন, সেশনের মাঝে হোষ্টেল পাবি না। ঘর ভাড়া নিয়ে চারজনে থাক। পরীক্ষা এসে গেছে। কাছাকাছি থাকিস তিনটি মাস। রেজাল্ট ভালো হবে।
ঘুরে ঘুরে অবশেষে ভাড়া ঘর পেলাম। কিন্তু বাড়িওয়ালার পাশের প্রতিবেশি বললেন, সাবধান ওই বাড়িতে ভূত আছে। আমরা ভয় পেয়ে তিনজনে বলে উঠলাম, তাহলে অন্য ঘর দেখি চল।
বিশু বললো, টাকা দেওয়া হয়ে গেছে। ভূতের বাড়িতেই থাকবো। বিশু যখন সঙ্গে আছে, ভয় কি তোদের।
তার অভয় বাণী ভরসা করে আমরা মাল পত্তর নিয়ে ঢুকে পড়লাম লড়াইয়ের কোর্টে। ক্যাপটেন বিশু বাড়িটা এক চক্কর পাক দিয়ে হাতে একটা লাঠি নিয়ে বললো, চলে আয় ভূতের বাচ্চা। আমরা ওর সাহস দেখে অবাক হতাম। রমেন বলে উঠলো, ভূতের শেষ দেখে ছাড়বো। জীবনের মরণের ভয় একটু বেশি। সে কাঁপা গলায় বলে উঠলো, যদি গলা টিপে ধরে ভূত। বিশু বললো, ভয় নেই, আমি একাই একশো। তোর কিছু হবে না। হলে আমার হবে।
এই বাড়ির নিচু তলায় কিছু অসামাজিক লোকের কাজকর্ম বিশু এক সপ্তাহের মধ্যেই টের পেয়ে গেলো। তারাই এই ভূতের ভয় দেখায়। একদিন জীবন বাথরুম গেছে এমন সময় নাকি সুরে একজন বলে উঠলো, এঁখান থেকে পাঁলা। ঘাড় মটকে দেবো। আবার একদিন রমেন ভয় পেলো। ঠিক সেই বাথরুমে। বিশু তদন্ত করে দেখলো বাথরুমের ভেন্টিলেটার ভেঙ্গে একটা সরু দড়ি ঢোকানো হয়েছে। বাইরে গিয়ে দেখলো দড়িটা নিচের ঘরের বারান্দায় শেষ হয়েছে। বাথরুমে ভাঙ্গা কাঁচে টান পরলে বিকট আওয়াজ হয়। আর মুখ বাড়িয়ে মুখোশ পড়ে নাকি সুরের কথায় সকলেই ভয় পাবে। বিশু বললো সবাই তৈরি থাকিস। আজ রাতেই ভূত ধরবো।
আজ আর কেউ স্কুল গেলাম না। একটা উত্তেজনা রাতে জাগিয়ে রেখেছে। এবার সেই বিকট শব্দ। বিশু বাঘের মতো লাফিয়ে লাঠি হাতে নিচের তলায় গিয়ে জলজ্যান্ত ভূতের পাছায় লাঠির আঘাতে ভূতকে কাবু করে ফেললো। ভূত বাবাজি জোড় হাতে বলছে, ছেড়ে দাও বাবা আমি আর ওসব করবো না। ভূতের সঙ্গিরা সব পালিয়েছে, আমাদের হাতে লাঠি দেখে। বিশু বললো, যাও, যেখানে বিশু আছে সেখানে চালাকি করার চেষ্টা কোরো না। বিপদে পড়বে।
তারপর থেকে আর কোনোদিন ভূতের উপদ্রব হয়নি সেই বাড়িতে।
বিশুর বাহাদুরি দেখেই আমরা সাহসী হয়ে উঠেছিলাম। বিশুর সঙ্গে আমরা বেরোলে সকলের চোখেমুখে একটা সাহসের,শান্তির ছাপ ফুটে উঠতো। পাড়ার কোনো মানুষ বিপদে পরলে বিপদের বন্ধু এই টাইগার বিশুকেই স্মরণ করতো। তার সঙ্গে আমরা তো থাকতাম অবশ্যই। রমেন, জীবন,বিশু,আমি একবার বন্যার সময় নৌকা করে মানুষের খাবার জোগাড় করতে চড়খী গ্রামে গিয়েছিলাম। হেলিকপ্টার থেকে চিড়ের বস্তা,গুড়ের বস্তা ফেলছে চড়খীর ব্রীজে যার আসল নাম কাশীরাম দাস সেতু। সেখান থেকে আমরা চিড়ে, গুড়ের পাটালি নৌকায় তুললাম। রমেন পেটুক। বললো, একটু টেষ্ট করলে হয় না। বিশু বললো, এখন এটা সকলের সম্পত্তি। যা হবে সকলের সামনে হবে। কেউ হাত দিবি না। এখন তাড়াতাড়ি চল। বান বাড়ছে। বিশু দাঁড় টানেআর আমরা সবাই সাহায্য করে নৌ্কা ও খাবার নিয়ে চলে এলাম নতুন পুকুরের পাড়ে। সেখানে বাড়ি বাড়ি সকলকে সমানভাবে খাবার ভাগ করে দিলো বিশু। তারপর আমরা বাড়ি এসে জীবনের মায়ের হাতের রান্না, গরম খিচুড়ি আর পেঁপের তরকারি খেলাম। অমৃতের স্বাদ। বিশু বললো, কাকীমা অনেক পেঁপে গাছ পড়ে গেছে বন্যার স্রোতে। আমরা আপনাকে অনেক পেঁপে এনে দেবো। সেবার বন্যায় পেঁপে, গ্রামের লোকের প্রাণ বাঁচিয়েছিলো। আমাদের গ্রাম অজয় নদীর ধারে। গ্রামগুলিও খুব নীচুস্থানে অবস্থিত। নদীর নাব্যতা বা গভীরতা অল্প। ফলে বন্যা প্রায় প্রতি বছর দেখা দিয়ে যেতো। জল যখন কমে যেতো তখন তোতনের মা ও পাড়ার মা বোনেরা মাঠে মাছ ধরার জন্য যেতো। নানারকমের শাক, ঢোল কলমি, শুশুনি তুলতো। খুব ভালো লাগতো নানারকমের মাছ ভাজা খেতে। আমি দেখলাম,
তোতনের মা মাঠ থেকে দুই তিন রকমের শাক তুলেছে। ওরা ভিটামিন বোঝে না, শরীরচর্চ্চাও বোঝে না। ওরা জানে খাটবো, রোজগার করবো আর খাবো পেট ভরে। মাঠেই পাওয়া যেতো বেশির ভাগ শাক, সব্জী। , খলসে, ওআরও নানারকমের মাছ মাঠের জলে সাঁতার কেটে বেড়াতো। বেলে, তে চোখো,চ্যাঙ,ছিঙুরি,গচিমাছ ছাড়াও ছোটো কাঁকড়া তাল কাঁকড়া পাওয়া যেতো। গর্তে হাত ঢুকিয়ে বিশু অনরকবার তআল কাঁকড়া বের করে আমাদের দেখিয়েছে। পাঁকাল,গুঁতে,কৈ,মাগুর,ল্যাটা প্রভৃতি অসংখ্য মাছ। বিত্তি পেতে দিতো স্রোতের মুখে।
বিশু বলছে, খাল কেটে মাঝখানে বিত্তি পেতে জল যাওয়ার নালা কেটে দিতো। মাছ লাফিয়ে ওই গর্তে পড়তো। টানা জাল,পাতা জাল দিয়ে মাছ ধরতো। এখন তোতনের মায়ের জায়গায বৌমা মাঠে যায়। কিন্তু কৃষিকাজে সার, ওষুধ প্রয়োগ করার ফলে সেইসব মাছ ইতিহাসের পাতায় চলে গেছে। শাকপাতাও পায় না মা বোনেরা। এখন সব বাজারমুখী।। তখন শাক আঁচলে করে নিয়ে গিয়ে বাউরীবউ মুড়ি নিয় আসতো চাষি বাড়ি থেকে। মাঠের টাটকা শাক সবাই নিতো জলের দরে। আজ আর টাটকা কিছু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশুর কথা একশো শতাংশ সত্য। এখন আমরা বড় হয়ে গেছি। কিন্তু, স্বর্ণ যুগের সেইসব স্মৃতি মনের মণিকোঠায়চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
পড়াশোনা আমার ভালোবাসা। মানুষ আমার দেবতা। মাষ্টার ডিগ্রী কমপ্লিট করে আমি বি,এড করেছি। তারপর স্কুল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়েছি। তিন মাস পরে রেজাল্ট। এই অবসরে আমার বন্ধু আশীষের কথা মনে পরছে।
আশীষ নামের সীমাহীন আনন্দমাখা ছেলেটা ভেলোরে গিয়ে জানতে পারলো,তার হার্ট বড়জোর আর দুবছর চলবে। এত কথা জেনেও কোনোদিন মুষড়ে পরেনি তার মন। ফুটবল খেলতে ভালোবাসতো ছেলেটা। সারা বিকেল ছুটে ছুটে সে আনন্দ মাখতো সারা গায়ে। আলো নামের আলো মনের মেয়েটা জেনেশুনে তার সমস্তকিছু দিয়েছিলো দুদিনের আনন্দের দেবদূতকে। পৃথিবীর রঙ,রূপ, রস সে একশো বছরের পরমায়ুর মতো পেয়ে গিয়েছিলো মনের প্রসারতায়। কেউ তাকে সান্ত্বনা দিতে এলেই কথা ঘুরিয়ে তার চোখে এঁকে দিতো স্বপ্ন।
তার সঙ্গে ঘুরতে গেছিলাম মুর্শিদাবাদের রামপাড়া। গঙ্গার ধারে গ্রামটি। ছোটো হলেও আমরা বন্ধুরা প্রত্যেকটি বাড়ি বাড়ি ঘুরেছি। কারো বাড়ি স্নান করা, কারও বাড়িতে খাওয়া দাওয়া।কারওবাড়িতে গান বাজনা করেই দিন চলে যেতো। দুর্গাপুজোর বিসর্জনের দিনে নৌকা করে ঠাকুর বিসর্জন দেখলাম। গঙ্গার ধারের সব গ্রামের ঠাকুর নৌকো করে মাঝ গঙ্গায়এনে বিসর্জন করা হচ্ছে ঢাক,ঢোল বাজিয়ে। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমেএলো। সন্ধ্যা নেমে এলো আশীষের জীবনে। রাত হওয়ার আগেই পাড়ি দিলো ভবসাগরের ওপাড়ে। তার সংসারে বাবা,মা, তিন বোন। আশীষের বাবাকে আমি জামাইবাবু বলতাম। তিনি কেলকাতা লালবাজারের কমিশনারের দপ্তরে কাজ করতেন। তার দাপ ছিলো ভীষণ। তার নামে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেতো। তিনি ছেলের শোকে মারা গেলেন। দিদি কয়েক মাসের মধ্যেই চলে গেলেন। বড্ড প্রাণপ্রিয় ছিলো তার আশীষ। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। রামপাড়ার বাড়িতে আর কেউ নেই। কতকগুলো ঘুঘু মনখারাপের ডাক ডেকে চলে নিশিদিন। ওই নিরীহ পাখি মানুষকে সত্য, সুন্দরের বাণী শোনায় আজীবন। বড্ড প্রিয় আমার এই ঘুঘু পাখি। ভিটেতে ঘুঘু চড়ে না,সে মনে রাখে এই ভিটের মালিক একদিন আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলো,আজও দিয়েছে। তাই কৃতজ্ঞ সুরে তার শোকপ্রকাশ মালিকের অবর্তমানে। আমার তাই মনে হয়। সত্য ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার নাম ধর্ম।
কি করে একটা সাজানো বাগান তছনছ হয়ে যায়। বন্ধু অমিত বললো। তবু মানুষের এত অহংকার। তারা মনে করে মৃত্যু বোধহয় তাদের ভুলে গেছে। সে ভোলে না। হঠাৎ চলে আসে। সময় থাকতে বাড়ির কাছের মানুষের সেবা করাই ভালো। পৃথিবী সুন্দর হয়ে উঠবে,পরস্পরের সেবা, ভালোবাসার মাধ্যমে।
আমার বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ দুই বছর নেই। কোনোদিন যদি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারি,তখন বাড়ি যাবো। মা, বাবার চিন্তা আমি দূর করবোই। আমি যেখানে ভাড়া আছি, তার পাশের বাড়ির ছেলেটা আমার কাছে পড়ে। ছেলে পড়িয়েই ভালোভাবে আমার চলে যায়। পাশের বাড়ির মর্মান্তিক ঘটনা আজও আমায় ব্যথিত করে। সেই ঘটনা ছবির মতো মনে পরছে...
বিয়ের পর থেকেই স্বামী স্ত্রী র মধ্যে বনিবনা ছিলো না। কথায় কথায় ঝগড়া। এমনি করেই দিনগুলো কেটে গেলো। সন্তান হলো। পুত্র সন্তান। ঝগড়া,অভাবের মধ্যে দিয়েই বেলা বয়ে গেলো। পানসি তরি। চর চর করে এগিয়ে যায় স্রোতের প্রতিকুলেও। থামা জানে না।
রুমা বললো, ছেলে বড়ো হলো। কলেজে পড়ছে। এবার আয় বাড়াও। এতে আর সংসার চলছে না।
বিমল সব বোঝে। কিন্তু উপায় নেই। ছোটো থেকে পরিশ্রমের কাজ করে নি। তাই পঞ্চাশ বছরে ভারি কাজ করতে পারে না। তাঁতি তাঁত বুনেই যায়। তারপর দোকানে দিয়ে আসে। এসব কাপড়ের কদর আগের মতো আর নেই। বিক্রি কমেছে। আয় কমেছে। বয়স, সংসারের খরচ বেড়েছে। তবু আলো খোঁজে বিমল। অবসর সময়ে কবিতা লেখে। ছবি আঁকে। রুমা দেখেছে কবিতা লেখার সময় বিমলের বয়স বোঝা যায় না। অনেকখানি কমে যায় বয়সের বল্লিরেখা।
ছেলে সবুজ। কলেজে পড়ে। মোবাইল চাই। বন্ধু বান্ধবীদের হাতে সব দামি দামি মোবাইল। এখনকার ছেলে মেয়েরা কথা কম বলে। কানে তাদের গোঁজা হেড ফোন। হাতে মোবাইল। আনলিমিটেড কল। তাই সব সময় ফোনে কথা। হেড ফোন গোঁজা। কথা শুনতে পায় না। ফোন করলেই পাওয়া যাবে। ভয় হয় বিমলের মানুষ কুড়ি বছর পরে কথা বলবে তো? সমাজ, আত্মীয় স্বজন থাকবে তো। সম্পর্ক ভালোবাসা বলতে কিছু থাকবে তো। সম্বিত ফিরে এলো রুমার রমণীয় গলার ডাকে।
---- কই শুনছো,বাজারে যাচ্ছি। দরজাটা ভেজিয়ে দাও।
আর কিছুদিন পরেই ভাইফোঁটা। রুমা বাবার বাড়ি যাবে। খুড়তুতো,জ্যাঠতুতো সব মিলিয়ে অনেক ভাই। ওর পাড়াশুদ্ধ ভাই। বাইরেআকর্ণ বিস্তৃত হাসি। স্বামীর কাছে এলেই গম্ভীর। তবু বিমল সম্পর্কটা টিকিয়ে রেখেছে। গড়াই তার ধর্ম, ভাঙ্গা নয়। কিন্তু বাড়ির লোক বোঝে না।
ভাইফোঁটায় নিজের ভাইয়ের কল্যাণ কে না চায়। বিমলের দুই বোন। আজ বোধহয় পাঁচবছর ফোঁটা পাইনি,বিমল ভাবে। তাতে কি? ওরা সুখে থাকুক।আমি বাড়ির প্রহরায় আছি। বিড় বিড় করে বিমল আপন মনে। মনটা ছিলো তাই,কথা বলে সুখ পায়।ছেলেটাও ভাইফোঁটায় খুড়তুতো বোনের কাছে ফোঁটা নিতে পারে নি পাঁচ বছর।বিমল বলেছে,তুমি একবার যাবে,আবার আমাদের এখানে ফোঁটা হবে পরের বছর। কিনতু রুম্পা রাগ করে। বলে, কতগুলো উপহার পাই বলতো। আর এখানে থাকলেই তোমার কৃপণতা। ফালতু বোকো না। আমি ভাইফোঁটায় বাবার বাড়ি যাবোই। কিন্তু তোমার ছেলে,আমার কারো ফোঁটা হবে না। সে বলে, তা আমি কি করবো। কিছু করার নেই। আমাকে দাদারা কত টাকা দেয় জানো।
---- না, তা জানি না। তবে জানি টাকাটা তুচ্ছ। ভাইবোনের ভালোবাসাই আসল। বোনের শুভ কামনায় যম দূরে থাকে। ভাইয়ের পরমায়ু বাড়ে। আবার ভাইদের আশীর্বাদে বোনের পরমায়ু বাড়ে।
---- থাকো তুমি তোমার শুকনো ভালোবাসা নিয়ে। আমার টাকা চাই। শাড়ি চাই। মাংস,মিষ্টি চাই। বাবাঃ এই সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে। শুধু বসে বসে বড়ো বড়ো কথা।
কিছু ক্ষে্ত্র আছে মানুষের কবছু করার থাকে না। তখন সময়ের উপর সব ছেড়ে দিতে হয়। তা না হলে অশান্তি বাড়ে, কমে না।
এদিকে বিমলের বোনরা চেপে ধরে দাদাকে। বলে, তোমার আস্কারা পেয়ে বৌটা একদম কোনো কথা শোনে না। কি আর বলবো। কোনো সময় দেখা হলেই কথা শোনাতে ছাড়ে না। মোবাইল নেই। তাই বোনরা ঠিকমতো যোগাযোগ রাখতে পারে না। তারা বলে , দাদা একটা মোবাইল কিনতে পারো না। তাহলে যোগাযোগ ভালো হয়। এখন আর পোষ্ট কার্ডে কেউ সংবাদ পাঠায় না। ওসব ব্যাক ডেটেড। বিমলের মোবাইল ভালো লাগে না। কবিতা আর কাজ নিয়েই তার সময় কেটে যায়।
দুদিন ধরে নিম্নচাপ। প্রচন্ড ঝড়, বৃষ্টি। তবু রুমা ছেলেকে নিয়ে চলে গেলো বাপের বাড়ি। যাক। ঠাকুর রক্ষা করো। বড়ো ভয় হয়। প্রিয়জন বাইরে গেলে সকলের হয়। রাস্তঘাট সারাই হচ্ছে। সাবধানে যেও... বিমলের আর্তি।
কিন্তু রুমা, ছেলের কোনো খবর নেই। দুপুরে রুমার মা জানালো, বাবা সবুজ আর নেই। বিমলের দম বন্ধ। নিশ্বাস নিতে পারছে না। ওরা বলেছে,বাসআ্যক্সিডেন্টে রুমা বাঁচলেও সবুজ রক্ষা পায় নি। তিনদিন খায় নি বিমল। আজকে বাইরে গেলো। কয়েন বুথ থেকে ফোন করে রুমার মাকে জানিয়ে দিলো,রুমাকে আর এখানে পাঠাবেন না। আমি সব বিক্রি করে আপনার মেয়েকে টাকা পয়সা দিয়ে আসবো।
***********************************************
আগামী পর্বে
***********************************************
সুদীপ ঘোষাল গল্প, উপন্যাস লিখতে ভালোবাসেন।সৃষ্টিসুখ থেকে, অন্তরে আলো জ্বলে ও এবং ছাপাছাপি থেকে, তিন এ নেত্র,এই দুটি গল্পসংকলন বের হয়েছে কলকাতা বইমেলায়।।এছাড়াও আরও পাঁচটি বই আছে বিভিন্ন প্রকাশনার।গল্প দিয়ে শুরু লেখা,ছোটোবলার স্কুলে পড়তে পড়তেই। পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া শহরে বাস করেন লেখক।জন্ম ১৯৬৫ সাল। সানন্দা ব্লগ ঈশানকোণ, আরম্ভ,ধুলামন্দির,অক্ষর ওয়েব,দৈনিক সংবাদ,তথ্যকেন্দ্র,যুগশঙ্খ,আবহমান,অপরজন,কৃত্তিবাসী ওয়েব,ম্যাজিকল্যাম্প,জয়ঢাক,অংশুমালী,প্রভাতফেরী,দৈনিক গতি প্রভৃতি পত্রিকায় লেখালেখি করেন নিয়মিত।




কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন