পিদিম
যুগল কিশোর দাস অধিকারী
গ্রামের ঘরে ঘরে গুঞ্জন আকাশ শহর থেকে কোন ভালো মেয়ে পটিয়ে লাভম্যারেজ করে এনেছে। আকাশ বড় লোকের ছেলে। তবে কাজকর্ম কিছুই করে না।
কুঁড়ে। শোনা যায় দিন রাত্রি ছবি আঁকে, অবসর সময়ে গান শোনে, দু একটা কবিতা লেখার ও বাতিক আছে। তবে বাপু এই কবিতা লিখে, ছবি এঁকে কি পেটের ভাত জোগাড় হয়?
বাবা সাকারী কর্মচারী ছিলেন। বাবা মারা যাওয়ার পর মা পেনশন পায়। বাবা থাকাকালীন ঘরবাড়ি করে রেখে গেছেন। দু ' খানা পুকুর। বিঘে খানিক জমি ও আছে । তবে ছেলে জমির ধারে ও যায় না। যারা চাষ করে তারা যা দেয় তাতে ওদের চালের অভাব হয় না।
কিন্তু সবাই ভাবছিল ওই শহুরে মেয়েটার কথা। ও বা কেমন করে বেকার ছেলেকে বিয়ে করলো। প্রেমে পড়লে যা হয়! অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা থাকে না। যে মেয়েটির সাথে বিয়ে হয়েছে ওর নাম দিপালী। সে স্কুলে কাজ করে । তা বাপু তুই তো অনেক ভালো ছেলে পেতিস, খামোখা কেন এই বেকারের গলায় মালা গলাতে গেলি?
পূর্ব মেদিনীপুরের যে গ্রামে দীপালীর বিয়ে হল, সে গ্রামের ছেলেমেয়েরা বিশেষ উচ্চশিক্ষিত নয়। চাষবাস খাটাখাটনি করে অধিকাংশ লোকের সংসার চলে। দু চারটে পরিবার সব্জি ব্যবসা, মাদুর বোনা এই সব করে। গ্রামের একপ্রান্তে একটা দেশি মদের দোকান আছে গ্রামের শ্রমিকরা সন্ধ্যে হলে ওখানে গিয়ে তরল আগুন গলায় ঢেলে আনন্দ পায়।
তাই নিয়ে অনেকের বাড়িতে কেচাল বাধে । মারামারি পর্যন্ত গড়ায়। কেউ কেউ জল খেয়ে ঢিস খেলে কষ্টার্জিত পয়সা উড়িয়ে দিয়ে আসে।
দিপালী যাতায়াতের ফাঁকে এসব খেয়াল করে।গ্রামের মেয়েরা ১৪/১৫ হলেই মা বাবার রক্তচাপ বেড়ে যায়। অনেকেরই ১৫/১৬ তে বিয়ে হয়ে যায়। কেউ প্রতিবাদ করে না। তিন চার বছরে দুটো করে বাচ্চা বিইয়ে আধবুড়ি হয়ে যায়। এসব দীপালিকে ভাবায়। সে এর বিহিত করবে মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়। এখনো সাপেকাটা রোগী হাসপাতালে না পাঠিয়ে প্রথমে ওঝা বা গুনীন ডাকে। শেষে মরমর হলে হাসপাতালে যায়, তখন সে আর বেঁচে ফেরে না ।
কবে এদের জ্ঞান চক্ষু খুলবে?
এরই মধ্যে একদিন রাস্তায় এক মহিলাকে কাঁদতে দেখে জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে?
সে জানালো স্বামী মাদ খেয়ে, ঢিস খেলে সব টাকা উড়িয়ে দিয়ে এসেছে, প্রতিবাদ করতেই মেরে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে ।দীপ বলল তোমাদের যাদের এমন মদো মাতাল স্বামী আছে তারা আজ সন্ধ্যায় আমার বাড়ি এসো। দেখি এর কি বিহিত করতে পারি ।
সে স্কুল যাওয়ার পথে থানায় ফোন করে দিল।
সন্ধের পর সব মহিলাদের নিয়ে প্রথমে চোলাইয়ের ঠেকে হানা দিল। সবাই লাঠি দিয়ে চোলাইয়ের বোতল ভাঙলো। যারা বসে ছিল তারা হতচকিত হয়ে দৌর দিল। ভাবছে হয়তো থানা থেকে এসেছে।
চোলাইয়ের মালিক রেগে খুন । অনেক হম্বিতম্বি করলো। থানায় জানিয়েও কোন লাভ হল না । দিপালী দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। সবাইকে উৎসাহিত করছিল ভয় পেলে চলবে না।
চোলাই মালিক খবর নিয়ে জানতে পারল ওই শহুরে মেয়েটার আসকারায় এই বৌয়েরা এমন সাহস পেয়েছে । ওকে উচিৎ শিক্ষা দিতে হবে ।পরদিন প্রায় সন্ধ্যায় দু তিনটে সন্ডা গন্ডা লোক পাঠিয়ে দীপালিকে ফাঁকা রাস্তায় আটকালো। সে জিজ্ঞেস করল কি ব্যাপার? পথ ছাড়।
- ব্যাপার জানোনা? ন্যাকা! ভাজামাছটা
উল্টে খেতে জানে না।
গ্রামের বউদের দিয়ে কে চোলাইয়ের ঠেক ভেঙেছে, আমরা কি কিছুই বুঝতে পারিনি?
- ও তবে তোমরা ওরই লোক। শোন যাদের বাড়িঘর উজাড় হয়েছে ওরা প্রতিবাদ করেছে।এতে ওদের কোন দোষ নেই। আমার ও কোন হাত নেই।
- থানা থেকে আমরা সব খবর পে। ওরা আমদের থেকে মাসোহারা পায়।দেখবি কি করতে পারি?
- আর এগুবে না - খারাপ হবে।
- একজন এগিয়ে গিয়ে স্কুটির হ্যান্ডেলে টান মারতে দীপা নেমে এল।
- সীমা ছড়াবে না । তাতে ভালো হবে না ।
- আর একজন এগিয়ে গিয়ে বলে ধরত মাগীকে, কি করে দেখি।
- এমনি সপাটে ঘুষি, আর একজনকে লাথি। ছিটকে পড়ে আরো রাগ বাড়ল। তিনজন মিলে ছুটে আসতে, ক্যারেটের প্যাঁচে একজনকে ধরাশায়ী করল। বলল আমাকে কোনদিন আটকাবি না । বাঁচতে চাস তো পালা। সাথে তিন মূর্তির ছবি ও তুলে রাখল । দেখ পর কিছু হলে সোজা থানায় চালান করে দেব
কথাটা আগুনের মতো পরদিন গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। রবিবার করে বৌ। রা এসে তার সাথে শলাপরামর্শ করে। স্কুলছুট ছেলেমেয়েদের ধরে ধরে স্কুলে দিল । নাবালিকার বিয়ে দেখলেই সেখানে উপস্থিত। থানা পুলিশ করে বিয়ে রদ করেই ক্ষান্ত হত। ক্রমশ তাকে গ্রামের লোকেরা সমীহ করতে লাগল । কেউ কেউ বিরক্ত হলে ও, অনেকেই বুঝতে পারছিল গ্রামের মধ্যে এই মেয়েটির হাত ধরে ভালো পরিবর্তন আসছে। বিশেষত মহিলারা তাকে দেবীর মত মানত। যার যা সমস্যা হত দিদির বাড়িতে হাজির হত।
আকাশ বৌ র সাহস দেখে, সংস্কারর্ধর্মী কাজের সঙ্গী হল। প্রথমে এসব কাজে নাক গলাতে বারন করত। উটকো ঝামেলা সইতে হত। তাই ভয় ও হত।
এখন পুরো গ্রামটাই দীপালীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এমনকি এখন মদোমাতালরা ও বলে দিদিমনিকে আমরা খারাপ ভেবেছি, গালমন্দ করেছি, কিন্তু আজ বুজছি উনিই আমদেরকে বাঁচিয়েছেন । ঘরে সুখশান্তি ওনার জন্যই এসেছে ।
রবিবার হলেই গ্রামে টহল মারা অভ্যেসে পরিনত হয়েছিল। সবাই বাড়িতে খাতির করে ডাকে । এক কাপ চা খাওয়ায় জন্য অনুনয় বিনয় করে। ওকে দেখে সবার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে । এ রবিবার সবাইকে নিয়ে গ্রামের রাস্তায় গাছ বসালেন। ২৫ শে বৈশাখ গ্রামের ছেলে মেয়ে বাউদের তালিম দিয়ে নাচ, গান, আবৃত্তি, খেলাধুলার অনুষ্ঠান করে গ্রামের মধ্যে আনন্দের নতুন হওয়া বইয়ে দিলেন
ক ' দিন পরে আকাশকে নিয়ে কলকাতায় রও না দিলেন আকাশের ছবির আর্ট এক্সিবিশন হবে। ক দিন কলকাতায় থেকে বাড়ী ফিরে হই হই ব্যাপার। আকাশের চারটে ছবি এক্সিবিশন এ ভীষন প্রশংসিত হয়েছে। প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তার সাথে অনেক পুরস্কার সম্মান ও পেয়েছে কয়েকটি ছবি বিদেশ পাড়ি দিয়েছে। এতদিনে ওর কুঁড়ে নামের দুর্নাম ঘুচল। দীপালীর জহুরী চোখ। ও ওর কুঁড়ে স্বামীর মধ্যে প্রতিভার খোঁজ পেয়েছিল। তারই পরিনাম ও পুরস্কার তাকে মান্যতা দিল।
পুরো গ্রামের লোক ওদের পরিবারকে নিয়ে উৎসবে মেতে উঠল। লোকেরা বলল ওদের স্বামী স্ত্রী আমাদের গ্রামের নাম উজ্জ্বল করেছে। সব্বাইকে ডেকে দিপালী মিষ্টি মুখ করাল।
গ্রামকে যেমন অনেক দিয়েছে এইসব সরল সাদাসিদে মানুষ গুলোর থেকে অকুণ্ঠ ভালবাসা ও আশীর্বাদ ও পেয়েছে।
সে গ্রামের মেয়েদের মতো মাথায় ঘোমটা দিয়ে তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বালে, এর মধ্যে এক অপার শান্তি অনুভব করে।
ক দিন পরেই একটা খবর এল। খবরটা জানাজানি হতে গ্রামের সবার মন খারাপ। দিপালী প্রাইমারী থেকে আপার প্রাইমারীতে শিক্ষক হওয়ার সুযোগ পেয়েছে, তাকে চলে যেতে হবে। তার নিজের ও খুব খারাপ লাগছিল। আকাশ কোনদিন তার কাজে বাধা দেয়নি। সে অভিনন্দিত করে আগামী কাজের জন্য শুভেচ্ছা জানাল।
আজ সন্ধ্যায় যাবার প্রস্তুতি চলছে। আগামী কাল নতুন কাজে জয়েন করতে হবে।
হঠাৎ বেরুবার মুখে রাস্তার ধারে ধারে সারে সারে প্রদীপ নিয়ে মেয়েরা হাজির হয়েছে। তারা কোন কথা বলছে না। সেই নিরবতার গভীর অভিব্যক্তি আছে। শুধু একজন বলল তুমিই এ গাঁয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে ছিলে, তুমি আজ সব প্রদীপ নিভিয়ে দিয়ে আমদের আবার অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়ে যাও। আমার তোমার কে?
দীপালীর পায়ে কে যেন পেরেক মেরে দিয়ে কাঠের পাটাতনে আটকে দিল। সে থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখ দিয়ে অশ্রুধারা নামল। আকাশকে বলল সব জিনিসপত্র ঘরে নিয়ে যাও। আমি স্বর্গ ছেড়ে যেতে পারব না।
*********************************************************************************************************************



কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন