বুধবার, ১ অক্টোবর, ২০২৫

গল্প * শাশ্বত বোস

 




ছাই রঙা মাটি

শাশ্বত বোস


ঝাঁ চকচকে একটা কর্পোরেট অফিস! এই অফিসের ক্যান্টিন থেকে বাথরুম সবজায়গায় একটা হাইফাই ব্যাপার আছে। একবার অফিসটায় ঢুকে পড়লেই মনে হয় যেন কোন ফাইভ স্টার হোটেলে এসেছি! বিশাল বড় ক্যান্টিন। সুবেশী স্টুয়ার্ডরা সর্বত্র হাসিমুখে বিরাজমান। প্রতিটা ফ্লোরে সুবাসিত মেল ও ফিমেল রেস্টরুম। দেওয়াল জুড়ে টাঙানো বিশাল বিশাল আয়নায় নিজেকে দেখতে পেলে মনে পড়ে যায় আগুপিছু তিরিশটা বছর। চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা মায়াময় বালকের মুখ।

দেওয়ালের খাঁজে রাখা ছোট্ট গোলাপ চারাটা হ্যান্ড ড্রায়ার থেকে বেরিয়ে আসা রোদ জলহীন ভিজে হাওয়ায় মাথা নাড়ছে সজোরে। প্রায় মাথা ছুঁতে চাওয়া আয়নাটার মাথায় আবার লেখা ‘Am I looking Smart?’ ঠিক তার পাশের দেওয়ালে ক্লঁদে মনেটের আঁকা একটা ছবি। ছবিটার ভেতর শূন্য হয়ে যাওয়া একটা বাড়ি। তার বাইরেটায় একটা জমাট বাঁধা অন্ধকার। তার থেকেও বেশী অন্ধকারে হয়তো সমর্পণ, ক্লান্তি আর অভিমানের নিঃশব্দ অভিসার ঘটে চলে প্রবালের মন আর মাথা জুড়ে। ছোট্ট গোলাপ গাছটাকে খুব সুন্দর মানিয়েছে এই পরিবেশটায়। গো গ্রীন ভাবনাটাও বেশ অভিনব! চারাটায় সবে একটা কুঁড়ি এসেছে। সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ টবের মাটিটায় চোখ আটকে গেল প্রবালের! কালো ভুসভুসে একটা মাটি, কালির মত কালো। শতেক রকমের জৈব অজৈব সার নিশ্চয়ই মিশেছে মাটিটায়। একটা অমেরুদণ্ডী কেঁচো হয়তো শুরু থেকে শুরু করে মাটিটার শরীর বেয়ে অনেকটা নীচে নেমে এসে কণাগুলির গভীরে বুনে চলেছে একটা যৌথজীবনের গল্প। কঠিন শাস্তির মত ওর এই জীবনচক্র, গাছটার শরীর জুড়ে এই কৃত্রিম শীতল সায়াহ্নে শারীরিক উষ্ণতার পরশ এনে দিচ্ছে হয়তো! হয়তো ওর অনায়াস নিস্পৃহ জীবনের বুকে পা দিয়ে, মাটিটা থেকে সব রস শুষে নিয়ে কাল সকালে গাছটায় ফুটে উঠবে সবুজের খিদে মেরে দেওয়া একটা কালো গোলাপ। একটা মধ্যবিত্ত উঠোনের নিকোনো গন্ধ সাথে কিছুটা লেবুপাতা ফেলা টকডাল আর আমচুর দেওয়া কামরাঙ্গার চাটনির গন্ধ, গাছটার গা থেকে ভেসে এসে বাথরুমটার বাতাসে বেশ খানিকক্ষণ আটকে থেকে, প্রবালের নাকের ভেতর দিয়ে ঢুকে ওর সুষুম্নাতন্ত্রে ভর দিয়ে, নেশার মত একটা কালের সামনে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করায় ওকে। এই গোলাপের আঁতুরঘর যেন অনেকদিন থেকে চেনে প্রবাল, অর্থহীন অথচ এক দৃঢ় মূক চেতনার ভেতর দিয়ে।

হাজার হাজার বছর অগেকার কাল থেকে বয়ে চলেছে নদীটা। ঢেউ তার অবিচল। কখনো তা ধীর শান্ত, কখনো তাকে ফুঁসে উঠে পাড় ভাঙতে দেখেছে প্রবাল! বর্ষাকালে তার উচ্ছাস দুপাশের বেলে মাটিতে ছোট ছোট গর্ত তৈরী করতো। সঙ্গে করে নিয়ে এসে ফেলতো ছোট ছোট মাছেদের স্তুপ। জল সরে গেলে সেগুলো খাবি খেত পাটের ব্যবসায় ফাঁপরে পড়া কলিম চাচার মত। তখন গামছায় করে ধরে নিয়ে এসে সেগুলোকে বাড়ির রান্নাঘরে চালান দিত ওরা। এই ওরা বলতে ঠিক কারা সেটা ঠিকঠাক মনে পরে না প্রবালের! শুধু ভেসে ওঠে ছায়া ছায়া কিছু শরীর। এই ছায়াগুলোর মাঝে কোথাও একটা তীব্র ‘আমি’ আছে বলে মনে করে প্রবাল। ও জানে অতীতকে নতুন করে কল্পনায় গড়ে তুলতে গেলে ফিরে ফিরে যেতে হয় ওই ছায়াদের কাছে। প্রায় সকলের অলক্ষ্যেই ওর সাথে কথা হয় ওর অতীতের ছায়ার। ছায়াটা ওকে দেখায় একটা নিটোল মুখ,টানা টানা দুটো চোখ, টিকোলো নাক, এক ঢাল এলো করে ছড়ানো চুল! ছায়াটা যেন সর্বক্ষণ চোখে চোখে আগলাচ্ছে প্রবালকে।

সেন্সর বেসড কলটা থেকে কিছুটা স্বচ্ছ জল আঁজলা করে তুলে নিয়ে চোখে মুখে ছেটায় প্রবাল। সামনের আয়নায় তখন ক্রমশঃ দূরের ছবি ফুটে উঠছে। একটা নদী, পাড়ে বাঁধা নৌকা, বাঁশের সাঁকোটার শুরুর দিকে জঞ্জালের মতন শিকড় ছড়ানো একটা জামরুল গাছ, সেই গাছের গায়ের ফাটলে বাসা বাঁধা দুটো প্যাঁচা আর তাদের ছানারা, যাদের ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যাবার জন্য গাছটার চারপাশে ঘুর ঘুর করত প্রকান্ড সব গাংচিল আর শিয়ালের দল। সেই ছবিটার ভেতর থেকেই প্রবাল শুনতে পায় একটা হিম ধরা গলার “বুলু, বুলু” ডাক! ডাকটা ভীষণ চেনা চেনা লাগে ওর। এই ডাকটা জুড়ে যেন জন্ম নেয় এক খণ্ড কালো মেঘের মতন পরিত্যক্ত ভালোবাসার গল্প! একটা নাম গোত্রহীন জগৎ থেকে দোষে গুণে ভরা এই পৃথিবীতে একটা উল্কা এসে পড়ার সময় মাঝপথে থেমে গেলে যেমন হয়, ঠিক তেমন একটা শূন্যতা নিয়ে ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে প্রবাল। কৌতূহল হয়তো খুব বেশী নেই ওর, শুধু একটাই প্রশ্ন জাগে ওর মনে। ওই “বুলু, বুলু” ডাকটা কার? এই বুলু টা ঠিক কে? বুলু নামটার সাথে ওই সুন্দর মুখটার কি আদৌ কোন সম্পর্ক আছে?

প্রবালের পুরো নাম প্রবাল কুমার বসু। একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে ডেলিভারি ম্যানেজার লেভেলে আছে ও। নিউটাউনের কাছে একটা অভিজাত আবাসনে প্রবালের নিজস্ব ফ্ল্যাট আছে। একাই থাকে। সদ্য একটা বিলিতি গাড়িও কিনেছে। চাকরিটা ওর দৈনন্দিন জীবনে বেশ একটা আভিজাত্যের ছাপ এনে দিয়েছে। আদপে ওরা নদীয়া জেলার বাসিন্দা। টবের মাটিটাকে এই মুহূর্তে ভীষণ আপনার বলে মনে হয় ওর! অতি প্রাচীন কালের থেকে যেন সেটা প্রতি শনিবার বিকেলে অনন্ত চালচিত্রের ছবি হয়ে ফুটে থেকেছে পশ্চিম আকাশের রামধনুর মতন। জীবনবাদী দার্শনিক শিল্পীর মতন গভীর রেখায় ধীর দাগে এঁকে চলেছে সর্বনাশের বিবর্ণ ক্যানভাস। মাটিটা ওকে যেন কিছু বলতে চায়। হয়তো কিছু ধরিয়ে দিতে চায়। কিন্তু সেটা ঠিক কি বুঝে উঠতে পারে না প্রবাল। যেন অনেক পুরোনো একটা ভাবনার সাথে নির্জনতা আর আধ্যাত্মিকতা মিশে গিয়ে একটা আপসোস জন্ম নেয় ওর মনে। নিজের ডেস্ক থেকে রিসিভারটা তুলে অ্যাডমিন অফিসারকে ওর কেবিনে ডেকে পাঠায় প্রবাল।

“আচ্ছা মিস্টার পাড়ুই, পাড়ুই তো?” একটু হোঁচট খায় প্রবাল। একবার উল্টোদিকে বসা ভদ্রলোকের বুকের কাছে সাঁটানো ছোট্ট ধাতব নেমপ্লেটটায় চোখ বুলিয়ে নেয়।

“গ্রাউন্ড ফ্লোরের মেল রেস্টরুমে একটা রোজ বুশ দেখলাম, ওটা কি ব্রীড বলতে পারেন? ডিটেল্সটা একটু আমার লাগবে মানে কোথা থেকে সাপ্লাই হয়, পার্টিকুলার কোন নার্সারী, এগুলো আর কি।”

“অ্যাকচুয়ালি স্যার, আমার মনে হয় দিশি। ইমপোর্টেড কিছু নয়। তবু স্যার একবার গার্ডেনিং কন্ট্রাক্টরের সাথে কন্ফার্ম করে আপনাকে জানাচ্ছি। আমরা কোথা থেকে নরমালি এই ফ্লাওয়ার প্লান্টস কিনি এন্ড মোর ডিটেলস আমি হাফ অ্যান আওয়ার এর ভেতর আপনাকে সব মেইল করে দিচ্ছি স্যার।”

লোকটি বেশ বেকায়দা পড়েছে বুঝতে পারে প্রবাল। হয়তো ইনি গার্ডেননিং সেকশনটা দেখেন না। হয়তো হেড অফিস থেকে সব অর্ডার ফাইনাল হয়। শুধু তো একটা কৌতূহল আর তো কিছু না! কিন্তু শুধুই কি একটা কৌতূহল? আদিম ধূসর প্রকান্ড একটা গাছের থেকে একটা সোঁদা সোঁদা সার মেশানো মাটির গন্ধ ভেসে আসে ওর নাকে। খুব মেপে মেপে পা ফেলে যেন ওর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল লোকটা। তবে আধঘন্টা নয় পরবর্তী দশ মিনিটেই প্রবালের মেলে নোটিফিকেশন এলো। কাজের এই গতি দেখে যেন একটু বিরক্তই হল প্রবাল। হয়তো এতটা তাড়াতাড়ি জবাব না এলেই ভালো হত। মাথার ভেতর ছবিটাকে আরো কিছুটা ভালোভাবে সেঁধিয়ে নেওয়া যেত। অভ্রমাখা মুখের চকচকে আয়নায় এবার ভেসে উঠলো ওর ছেলেবেলার সময়ের একটা ইঁটভাটার ছবি। ওর বয়সী অনেকে সেখানে কাজ করছে। মাথায় করে ইঁট বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। চুল্লির ঠিক সামনেটায় রাখছে। ওর বয়সী শ্রমিকদের কাজ অতটুকুই। এরপর থেকে কাজটাকে যারা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাদের মধ্যেও একটা চেনা মুখ দেখতে পেল প্রবাল। দেখতে অনেকটা ওর বাবার মতন। এই মানুষগুলো মানেই এঁদের সাথে জড়িয়ে থাকা ইতিহাস-স্মৃতি-দর্শন। সময়ের টানে ফুরিয়ে আসা বালিঘড়িটা ঠিক জানে, সময় কত নিঃশব্দে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে ক্ষয়ে যাওয়া সময়ের কিনারে। ডেস্কের উপর মাথাটা নীচু করে প্রবাল। ওর মাথার ভিতর প্রলাপের মন্বন্তর লাগে। আর কি কোন স্মৃতি নেই? নেই কি বেঁচে মনের ভিতর চিন্তার কোন ধূপছায়া তরঙ্গ? ইঁটভাটার পাশে আমবাগানে ছোট্ট একটা শিশুকে বসিয়ে দোল দিচ্ছে একটি বালিকার হাত। বয়স মেরে কেটে বছর দশেক হবে। কোমল হাতে ইঁট বয়ে বয়ে শিশুটির মত মেয়েটির হাতেও প্রোথিত হয়েছে কয়েকটি শুকনো ক্ষত। তার শুষ্ক চামড়া জৌলুস হারিয়েছে। বাতাসে ভেসে আসা আবছা আলোর মতোই ম্লান ছায়া ও অস্ফুট শব্দের চিত্রকল্পগুলো এই মুহূর্তে ভেসে আসে প্রবালের মাথার ভিতর। উকিলনাড়া মাঠের চড়ক, চূর্ণী নদীর পাড়ের মাটির ঢালে প্রায় শুয়ে পড়া শ্যাওড়া গাছ, তার তলায় জমা হওয়া পাতার অরণ্যে দমকা হাওয়া এসে লাগে ঘূর্ণির মতন। ভোঁতা শব্দের আলোড়ন তুলে সেখানে খুলে যায় হাজারখানা দুয়ার। বেরিয়ে আসে অনামী সুর, ‘আমি কৃষ্ণ ভালোবাসি গো, সখী আমি কৃষ্ণ ভালোবাসি।’

মেইলটা এতক্ষণ খোলা অবস্থায় পড়েছিল। হঠাৎই নতুন ইনকামিং মেইলের নোটিফিকেশন সাউন্ডে সম্বিৎ ফিরে পায় প্রবাল। মেল চেক করে প্রবাল দেখে অ্যাডমিন থেকে একটা কার্ড এসেছে মেলে। সাবজেক্ট ‘গার্ডেননিং ডিটেলস’। মেইল টা আবার ফরওয়ার্ড হয়েছে কর্পোরেট ইসথেটিক্স গ্রুপ থেকে। সেই মেলটা আবার এসেছে ভেন্ডরের কাছ থেকে। এই অতিরিক্ত বড় মেল চেনটা যেন প্রবালের সব চিন্তাভাবনাগুলোকে গুলিয়ে দিতে চায়। মেল থেকে ইমেজটা ডাউনলোড করে প্রবাল জুম করে পড়ে, ‘শ্রীগুরু নার্সারি, শিবপুর ঘাট, পায়রাডাঙ্গা’। চোখের সামনে একটা রেলস্টেশন দেখতে পায় প্রবাল। নদীর দিকে যাবার পথে যেন ওই স্টেশনেই একদিন অনেকক্ষণ বসে থেকেছে ও। বসে থাকতে থাকতে সে দেখতে চেয়েছে চোখের দেখা ছাড়িয়ে আরও অনেকটা। এই পায়রাডাঙ্গায় পুরো ছেলেবেলাটা কেটেছে প্রবালের, মা বাবা ঠাকুমার সাথে। একাত্তরে ওর বাবা ওপার থেকে ভিটেমাটির টান পাকাপাকিভাবে ছিন্ন করে এদেশে চলে এসেছিলেন। দেশান্তরের স্মৃতি ওর নেই, থাকবার কথাও নয়। ওদের দেশ, ওদের মাটি কখনও দেখা হয়ে ওঠেনি ওর। পায়রাডাঙার মাটিতেই অনস্তিত্ত্বের মাঝে নিজের একান্ত আপন অস্তিত্বকে খুব সচতন ভাবে খুঁজে নিয়েছিল প্রবাল। ওর মনে আছে দেলদার শেখ বেশ একজন প্রভাবশালী লোক ছিল এই পায়রাডাঙ্গা-রানাঘাট চত্ত্বরে। ওর শিবপুরের ইঁটভাটাতেই কাজ করত প্রবালের পুরো পরিবার। কানাঘুষো শোনা যেত দেলদার বর্ডার পেরিয়ে মেয়ে পাচার করে, বেচুয়া হাটের কেনা গরু পারাপারের মতো। ওই বয়সে লোকটাকে দেখলেই ভয়-ঘৃণা-ক্রোধ মিশিয়ে একটা নিয়ন্ত্রণহীন অন্ধকার চাগার দিয়ে উঠতো প্রবালের মনে। ওর ছোটবেলার জীবনটার শুরুর দিকে প্রবালের একটা দিদি ছিল বলে শুনেছিল ও। সেই দিদির যখন বছর দশেক বয়েস তখন কি যেন একটা ভয়ঙ্কর গন্ডগোল হয়েছিল। তার পর থেকেই প্রবাল দেখেছে অন্ধকার ঘরের এক কোণে ওর বাবা বসে বসে কাঁদত। সেসময় ভারী ফ্রেমের চশমার ঘষা কাঁচের ফাঁক দিয়ে তাঁর চোখদুটিকে দেখলে যন্ত্রণার বোধ থেকে সরে আসা একটা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন আত্মাকে দেখতে পেত প্রবাল। সেই দিদিরই কি নাম ছিল বুলু?

চূর্ণী নদীর বাঁকে ডুবে যাওয়া বিকেলটার শরীর জুড়ে ঘরে ফিরতে চাওয়া পাখি কিংবা পূর্বপুরুষের ভিটেকে স্বাক্ষী রেখে তৈরী হয় পৃথিবীপাড়ের গণসংগীত।

“মায়া নদী কেমনে যাবি বাইয়া?

রঙ্গীলা দেশের নাইয়া

মায়া নদী কেমনে যাবি বাইয়া।”

ইঁটভাটার কাজটা ওরা ছেড়ে দিয়েছিল। ঠিক কবে কখন সে স্মৃতি ফুরিয়ে গেছে। শিবপুরের ঘাটের কাছে ওই ইঁটভাটার পাশেই ওর বাবা কিছুটা দখলী জমিতে একটা গোলাপ নার্সারি খুলেছিল। ততদিনে অবশ্য দেলদার খুন হয়েছে নিজেরই ডান হাত রাফির হাতে। প্রবালের মা রানাঘাট, নিয়ামতপুর, মুকুন্দনগর, উকিলনাড়া, জগপুর পর্যন্ত্য বাড়ি বাড়ি ঠিকে ঝিয়ের কাজে যেত। পাতায় পাতায় কাটাকুটি খেলার মুহূর্তে বারবার প্রবাল নতুন করে ওর ছোটবেলার দিনগুলোকে পুনর্নির্মাণ করতে চেয়েছে। প্রতিবারই ওকে ফিরে ফিরে আসতে হয়েছে সেই আমবাগান জুড়ে নেমে আসা আয়তাকার রাতে। সেই “বুলু, বুলু” ডাকটা হঠাৎ করেই যেন হারিয়ে গেছিল ওর জীবন থেকে! বুলুকে কি ওরা রানাঘাটে পিসির বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিল নাকি দেলদার ওকে ভোগ করে বডিটা ছুড়ে দিয়েছিল ইঁটভাটার চুল্লিতে? সেই আগুনেই জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ওর সেই টিকোলো নাক, টানা টানা চোখ, লক্ষ্মী প্রতিমার মতো নিটোল মুখ আর কোমর ছাপানো চুলের বাহার। নাকি ওকে ধরে কেউ চালান করে দিয়েছে বর্ডার পেরিয়ে ওপারে, জীবনের স্বাভাবিক অনুভূতিগুলো যেখানে ভাবনা বা চিন্তার কোনো অদৃশ্য বলয়ে গিয়ে, খেই হারিয়ে ফেলে। তার পর থেকে ওর মা আর বাবা শ্মশানের আধপোড়া মড়াগুলোর হাড়গোড় জড়ো করে নিয়ে এসে, সারা রাত জেগে হামানদিস্তায় গুঁড়ো করতো। কার্বন! মাটিতে মিশে সার হয়ে গোলাপের পাপড়িকে সুগঠিত করে। বিছানায় শুয়ে অজানা কোনো বাড়ি থেকে আসা হারমোনিয়ামের সুরের মতন প্রবাল শুনতে পেত টং টং টং!

শত সহস্র আলোকবর্ষ থেকে ছুটে আসা শেষ রাতের ট্রেনের মাথা থেকে ছড়িয়ে পড়া আলোর পরে পড়ে থাকা চাপ চাপ অন্ধকারের মতন, ইঁটভাটার ছাই ঠিক যেখানটায় গিয়ে চূর্ণী নদীতে গিয়ে মিশে যেত সেই জায়গার জমাট বাঁধা কালো মাটিটার মতন, শ্রীগুরু নার্সারির গোলাপের মাটিতেও কি অল্প একটু দেলদার আর অল্প একটু বুলু পাশাপাশি মিশে আছে? অনেকগুলো মৃত্যুর মাঝে আরও অনেকখানি কালো হয়ে গোলাপটা ঝরে যাবে একদিন! বাথরুমটা থেকে একটা কটূ পেচ্ছাপের গন্ধ ভেসে আসে! মোমঝরা জাদুকরী আয়নাটার ওপারে তখন একটা নির্দিষ্ট ঘনত্ত্বের বুলু দাঁড়িয়ে থাকে। দেখতে অবিকল প্রবালেরই মতন!












***************************************************************************************




শাশ্বত বোস


লেখকের জন্ম ১৯৮৯ সালের জানুয়ারী মাসে পশ্চিমবঙ্গের  হুগলী জেলার শ্রীরামপুর শহরে । হুগলী জেলারই রিষড়া শহরে শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম বিদ্যালয় থেকে স্টার মার্কস নিয়ে যথাক্রমে ২০০৫ ও ২০০৭ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন । ছোটবেলা থেকেই তিনি লেখালেখির সাথে যুক্ত। বিভিন্ন নামী পত্রিকা যেমন সন্দেশ, জোয়ার, কোরক, পথ ও পাঁচালি ইত্যাদি পরিবারের তিনি নিয়মিত সদস্য ছিলেন । বহু স্বনামধন্য লেখক-লেখিকাদের সাথে তিনি বিভিন্ন পত্রিকার শারদসংখ্যায় লেখালিখি করতেন । 

পরবর্তীকালে উচ্চশিক্ষা ও কেরিয়ারের জন্য সাময়িকভাবে সাহিত্যচর্চার জগৎ থেকে বিরতি নিয়েছিলেন । ২০১১  সালে ইলেকট্রনিক্স এন্ড কমিউনিকেশন  ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক হবার পর একজন সফল আউটডোর ব্রডকাস্টিং ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে একটি খ্যাতনামা বাংলা স্যাটেলাইট চ্যানেলে যোগ দেন ও পরবর্তীতে তিনি ইন্ডিয়ান নেভি ডেপুটেশনেও কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে তিনি একটি নামি বহুজাতিক সংস্থায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কর্মরত । বর্তমানে তিনি পুনরায় সাহিত্যর্চচার জগতে প্রবেশ করেছেন। তার বিভিন্ন লেখালিখির মধ্যে উল্লেখযোগ্য রচনা “অনন্ত বিকেলের রূপকথারা” , “বৈশালী_পাড়ার_প্রতিমা রা”,  “অতঃপর অশুচি বনেদিয়ানা, পুজোর বনসাই এবং .....” ,  "কান্না রাগের 'হোমা পাখি'"  , “ডরাইয়া মরে”, “রূপান্তরের পথে”, “প্রবাসের বিভীষিকা”, “বইমেলা ও একটি গোলাপ”, “পুরোনো মর্গটার কাছে”, এবং “পিশাচসিদ্ধ”, যা একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখিত এবং ইতিমধ্যেই ইউ টিউবে অডিও স্টোরি হিসেবে সাড়া ফেলে দিয়েছে। এছাড়া ভ্রমণকাহিনীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য  “পরবাসী টুসুর দেশে”||
তার লিখিত কবিতাগুলির মধ্যে “একটি ব্যর্থ প্রেমের ক্ষুব্ধ আখ্যান”, “উদ্বর্তিনী”,   “প্রাণের পুজো”, “কালো মেয়ের উপাখ্যান”,  “বাংলা ভাষার দেশ”, “অন্য বসন্ত”, “ ভালোবাসা ও একটি বসন্ত”, “ মন- শরীরী”,  “হে নজরুল”  ,  “সমর শেষের অসিয়ৎনামা”  উল্লেখযোগ্য ও জনপ্রিয়||
এই স্বল্প কালেই বহু সংস্থা থেকে তিনি সেরার সেরা সম্মানে ভূষিত | এর মধ্যে “অচেনা পর্বত” সম্মান, রাজার কবিতা studio কর্তৃক প্রদত্ত “অয়ন সৃজন সম্মান” প্রণিধানযোগ্য|

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন