বুধবার, ১ অক্টোবর, ২০২৫

উপন্যাস * বিশ্বনাথ পাল

 



বামনের চন্দ্রাভিযান 

পর্ব * ১৩

বিশ্বনাথ পাল

 

কুড়ি













পাড়ায় খবরটা এখনই চাউড় করার ইচ্ছে হল না। আর ক’টা দিন যাক। বাড়িতে চিঠি আসুক তারপর না-হয় জানানো যাবে।

দিন পনেরো পরেই বাড়িতে চিঠি এল ত্রাণভবন থেকে। আমি রিলিফ অফিসারের পোষ্ট পেয়েছি। মিসসেলেনিয়াস সার্ভিসে রাজ্যের বিভিন্ন দফতরের প্রায় সমান স্কেলের অফিসার নিয়োগের পরীক্ষা পিএসসি-র মাধ্যমে একসঙ্গে হয়। অধিকাংশ  পোষ্টই ব্লকস্তরের। ইন্টারভিউয়ের চিঠির সঙ্গে পনেরোটি পোষ্টের নামের তালিকা এসেছিল। সেখানে এক নম্বরে ছিল এসিডিপিও, দু’নম্বরে বিআরও বা ব্লক রিলিফ অফিসার, এইভাবে বাকিগুলো। প্রতিটি নামের পাশে একটা চৌকো খোপ। সেখানে  পছন্দের ক্রমানুসারে এক, দুই, তিন করে সংখ্যা লেখার নির্দেশ। কম সংখ্যা মানে বেশি পছন্দের। আমি সেই খোপগুলোয় পরপর এক, দুই, তিন, চার করে বসিয়ে গিয়েছি। দাশগুপ্ত স্যার বলেছিলেন যে যারা চাকরি করো না তাদের আবার পছন্দ কী? তারা তো একটা ব্রেক চাইছ। ফলে তারা এক, দুই, তিন, চার করে যেমন আছে সংখ্যা বসাবে।

আমি সেই নির্দেশ মেনেছি। পরে শুনি এসিডিপিও পদে ভ্যাকেন্সি ছিল না। ফলে আমি আমার দ্বিতীয় পছন্দের পদ বিআরও পেলাম। আমার র‍্যাঙ্ক যেহেতু প্রথমের দিকে তাই এমনটা ঘটল।

এক বন্ধুর দাদাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম ত্রাণভবনের অবস্থান। বলল, তালতলায়। এস এন ব্যানার্জী রোডে। এসপ্লানেড থেকে নেলিনসরণি বরাবর বাসে উঠে তালতলায় নেমে খানিকটা হাঁটতে হবে।

সেইমতো চিঠিতে উল্লিখিত নির্দিষ্ট দিনে ত্রাণভবনে গিয়ে আমার সমস্ত সার্টিফিকেট, মার্কশীট ইত্যাদি ভেরিফাই করালাম। এখানে মেডিকেল সার্টিফিকেট এবং ভেরিফিকেশন রোল জমা পড়ার আগে কিন্তু পোষ্টিং অর্ডার বেরবে না। আমার  কথা বললাম যে আমি হাইকোর্টে আছি। ওখানে সম্প্রতি আমার ভেরিফিকেশন হয়েছে। মেডিকেল সার্টিফিকেটও আছে। একজন সিনিয়র রিলিফ অফিসার বললেন, তাহলে আর নতুন করে করতে হবে না। তুমি যদি এই চাকরিতে আসো, তাহলে আমাদের লিখিত জানাও যে হাইকোর্টে কাকে অ্যাড্রেস করে আমরা তোমার মেডিকেল এবং ভি আর চাইব।

আমি চুপ করে থাকায় তিনি বললেন, কী আসবে তো এই চাকরিতে?

আমি জোর গলায় বলতে পারলাম না যে আসব। বললাম, আসার তো ইচ্ছা আছে। এখন দেখি বাড়িতে ভাবনা চিন্তা করে।

হাইকোর্ট তো একটা বদ্ধ জায়গা। এখানে চলে এসো। মানুষের সঙ্গে মিশতে পারবে। সম্মান পাবে। বিভিন্ন জেলায় আমাদের ছেলেরা খুব সম্মানের সঙ্গে ভাল কাজ করছে। তবে অন্য চাকরিতে যে সুবিধা আছে এখানে তা নেই। আকাশে মেঘ করেছে আজ অফিসে যাব না এখানে তা চলবে না। এখানে বরং আকাশে মেঘ করলে আরও বেশি করে অফিস যেতে হবে।

খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বললেন, আর এর চেয়েও ভাল চাকরি যদি পাও, ছেড়ে দেবে। কিন্তু যতদিন না পাচ্ছ এখানে কাজ করো।

আমি বললাম, কোথায় পোষ্টিং হবে?

পোষ্টিং এখন বলা যাবে না। তবে এই চাকরিতে তো পোষ্টিং দুর্যোগপ্রবণ এলাকাতেই হবে। ধরো পাথরপ্রতিমাতে হল।

আমার দাশগুপ্ত স্যারের কথা মনে পড়ে গেল। স্যার আমাকে বলেছিলেন, যদি দক্ষিণবঙ্গে হয়, মানে গঙ্গানদীর নীচে মানে আপটু মুর্শিদাবাদ পর্যন্ততাহলে যেয়ো। উত্তরবঙ্গ হলে যাওয়ার দরকার নেই। পাথরপ্রতিমা শুনে মনে আশা জাগল যে হয়তো অফিসারের চাকরিতে জয়েন করা হচ্ছে।

খবরটা দেখলাম বাতাসে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল। পাড়ায় আমার বাবার নাম ধরে অনেককে বলতে শুনলাম অমুকদার ছেলে হাইকোর্টে চাকরি করে, এখন আবার আরও ভাল অফিসারের চাকরির অফার এসেছে। রিলিফ অফিসার।

অপদার্থ মনে করত যারা তারাও দেখছি আমাকে সমীহ করছে। করুণার পাত্র দেখলাম কারও আবার ঈর্ষার পাত্রে পরিণত হয়েছে।

কিন্তু আমার অশান্তি শুরু হল। সিদ্ধান্তহীনতার অশান্তি। বেকারত্বের সমস্যার সঙ্গে তুলনীয় না হলেও একাধিক চাকরিও সমস্যা বয়ে আনে। কোনটা ছেড়ে কোনটা করি। হাইকোর্টেই থাকব নাকি রিলিফ অফিসারের চাকরি নিয়ে চলে যাব প্রত্যন্ত গ্রামে? এযেন প্রথমবার এমএসসি পার্ট ওয়ান পরীক্ষা দেওয়ার আগে উদ্ভূত দ্বন্দ্ব ফের এসে হাজির। তখন ছিল ড্রপ দেব না পরীক্ষা দেব এই নিয়ে। আর এখন হাইকোর্ট নাকি ব্লক? কেরানির চাকরি নাকি রিলিফ অফিসারের চাকরি?

মা’র মতামতকে আমি বেশিরভাগ সময় গুরুত্ব দিই, কিন্তু সব সময় দিতে পারি না। মা যেমন একবার চেয়েছিল আমি গেঞ্জির কারখানায় ম্যানেজারের চাকরি করতে নেপাল চলে যাই। তখন মা’র কথা শুনলে আজ আর সরকারি চাকরির মুখ দেখতে হত না। কিন্তু এখন মাও স্পষ্ট কোনও মতামত দিতে পারল না। মায়ের মনের ইচ্ছা আমি হাইকোর্টেই থাকি। কারণ ট্রান্সফার নিয়ে অন্যত্র যেতে হবে না। বাড়ির ভাত খেয়ে অফিস করা যাবে। কিন্তু আমার মনের দিকে চেয়ে সেকথা জোর দিয়ে বলতে পারল না। পরে যদি আমিই আবার দোষ দিই যে তোমার জন্য আমার অফিসারের চাকরি করা হল না। আমার মনের কাঁটা যেন একটু অফিসারের দিকেই ঝুঁকে ছিল।

 কখনও সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হলে আমি সাধারণত অন্য মানুষদের মতামত শুনি। কোনও একজনের নয়, অনেকের। তাতে প্রথমের দিকে মাথা একটু ঘেঁটে গেলেও শেষে ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধা হয় না দেখেছি। অনেকের মতামত খারিজ করি এই ভেবে যে লোকটা আমার ভাল চায় না, ঈর্ষাপরায়ণ। ফলে তার মতামতের উল্টো কাজটাই সঠিক।

তো, এবারেও অনেকে স্বপ্রবৃত হয়ে আবার কেউ কেউ আমার দ্বারা অনুরুদ্ধ হয়ে তাদের মতামত জানাতে লাগলেন।

একদিন আমার মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক তড়িৎস্যারের বাড়ি গেলাম। আমার রিলিফ অফিসারের চাকরিপ্রাপ্তির কথা জানিয়ে স্যারের মত জানতে চাইলাম।

স্যার বললেন, আমার মনে হয় তোর হাইকোর্টের চাকরিতে থাকাই ভাল। বাড়ির ভাত খেয়ে সকাল এগারোটায় পান চিবোতে চিবোতে অফিস যাবি। কোনও ঝুটঝমেলা নেই। সুখের চাকরি। প্রচুর ছুটি। কিন্তু সৎ থাকতে পারবি না।

আমি যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। স্যারের মুখে কী শুনছি এটা? যে চাকরিতে আমি সৎ থাকতে পারব না, তাকেই স্যার ভাল চাকরি বলছেন? স্যারকে খুব শ্রদ্ধা করতাম। স্যারের মতো পরোপকারী মানুষ আমি কম দেখছি। স্যার শুধু আমাকে নয়, স্কুলের অনেককেই বিনাবেতনে পড়াতেন।ঙ্কিন্তু ওই দিন স্যারের মুখে ওই কথা শুনে স্যারের প্রতি শ্রদ্ধা আমার যেন খানিক টলে গেল।

স্যার একটু থেমে আরও বললেন, আর রিলিফ অফিসারের চাকরি খুব দায়িত্বপূর্ণ। ঝুটঝামেলা আছে। পলিটিক্যাল প্রেসার থাকবে।

দু-এক দিন পর আমাদের বাড়িতে এলেন পাড়াতুতো এক দাদা। অনিল ধর।বললেন, শুনলাম তুমি একটা অফিসারের চাকরি পেয়েছ?

বললাম, হ্যাঁ অনিলদা। ঠিকই শুনেছেন।

কী চাকরি সেটা?

সংক্ষেপে বললাম।

এখন হাইকোর্টে আছো? কেরানির চাকরি?

হ্যাঁ।

আমার মত তোমার ওই রিলিফ অফিসারের চাকরিতেই যোগ দেওয়া উচিৎ। এখানে মায়নাও ভাল, উপরিও আছে।

আমার কান গরম হয়ে গেল। এই লোকটার কথা মতো দ্বিতীয় চাকরিটাও ঘুষের উর্দ্ধে নয়? আর যদি ঘুষের সুযোগ থাকেও, তবে সবাইকেই সেই সুযোগের সদব্যবহার করতে হবে?

বললাম, সে বাড়িতে আলোচনা করে ঠিক করব কোথায় জয়েন করব। কিন্তু আপনি কি এই কথা বলতেই এলেন?

না, আমি আসলে এসেছি তোমাকে এলআইসি-র পলিসি করাব বলে।

এতক্ষণে পরিষ্কার হল বিষয়টা। আমি ভাল চাকরি পেয়েছি শুনে ছিপ ফেলতে চলে এসেছেন। প্রিমিয়াম দিতে অসুবিধা হবে না ভেবে।

বললাম, কিন্তু আমি শুনেছি আপনি ইরিগেশনে ভাল চাকরি করেন, আপনি আবার এলআইসি-র এজেন্টও হয়েছেন? চাকরি করে এসব করা যায়?

এটা বউয়ের নামে করি।

ছোটবেলার একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। একবার পাড়ার একটা ছেলে অনিলদাদের গাছের জামরুল পেড়ে খাচ্ছিল। খবর পেয়ে লোকটা ছুটে এসে লাথি চালিয়ে ছিল। গায়ে লাগেনি, কারণ ছেলেটা ভয়ে দৌড় লাগিয়েছিল। কিন্তু লঘু পাপে এরকম লাথির গুরুদণ্ড আমার ভাল লাগেনি। ওই ঘটনার কারণে লোকটাকে আমি আর কোনওদিন ভাল চোখে দেখতে পারিনি। গাছের ফল ছোটরা যদি না বলে কয়েকটা পেড়ে খায়ই, তার জন্য লাথি চালাতে হবে? বললাম, দেখুন আমার এই মুহূর্তে কোনও এলআইসি করার প্ল্যান নেই। আর যদি করিও আপনার কাছে কেন করব? আমি কোনও বেকার ছেলের কাছে করব, যার এটাই একমাত্র জীবিকা। আপনি তো চাকরি করেন, এটা আপনার সাইড বিজনেস। আমি না করলে আপনার কোনও ক্ষতি হবে না।

লোকটা মুখের ওপর এত স্পষ্ট উত্তর মনে হয় আশা করেনি। বললেন, না, আমার কাছে করলে তুমি অনেক সুবিধা পেতে।

কী সুবিধা পেতাম?

কোনও মাসের প্রিমিয়াম দিতে অসুবিধা থাকলে আমি নিজেই তা দিয়ে দিই। কাস্টমার পরে আমাকে শোধ দেয়। এই যে অমল আছে না, ওকে জিজ্ঞেস কোরো।

মনে হল, লোকটার গায়ের চামড়া ভয়ানক মোটা। এখনও তদবির করে যাচ্ছে আমার স্পষ্ট বার্তা উপেক্ষা করে। বললাম, আচ্ছা, আমি যদি কখনও আপনার কাছে পলিসি করার সিদ্ধান্ত নিই, আমি নিজেই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব, আপনাকে আসতে হবে না।

আচ্ছা। বলে বিদায় নিলেন।

আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে একজনের কথা না বললেই নয়। যতদিন বাঁচব, আমার মনে থাকবে কথাটা। আমার বাবার পিসতুতো ভাই। মানে সম্পর্কে আমার দাদা। কিন্তু দাদা বলতে যেমন বয়সের ফারাক কম বোঝায়, তেমন নয়। আমার থেকে প্রায় বছর কুড়ির বড়। আমাদের পাড়াতেই থাকে। নিজে সরকারি চাকরি করে এবং পাশাপাশি ঠাকুর বানায়। তো, সেই দাদার সঙ্গে একদিন বাসে দেখা। বলল, তুই নাকি রিলিফ অফিসারের চাকরি পেয়েছিস?

আমি সম্মতি জানাতেই বলল, আমার মতে তোর হাইকোর্টের চাকরিই ভাল। ও চাকরিতে খবরদার যাস না। ওখানে গেলে জামা-প্যান্ট খুলে নিয়ে যাবে।

বাসে এক গাদা লোকের মধ্যে আমার আর এই নিয়ে কথা বলার প্রবৃত্তি হল না। দাদার কথায় খানিক আহত হলাম। এখানে দাদার একটা গল্প বলি। আমাদের বাড়িতে দাদা বা বউদি প্রায়ই আসত। দাদা হয়তো কোনও কাজে আসত। বউদি আসত মা’র সঙ্গে গল্প করতে বা বলা যায় ছেলের গুণকীর্তন করতে। হ্যাঁ, বউদির গল্প মানেই ছেলের প্রশংসায় পঞ্চ নয়, পঞ্চান্ন মুখে প্রচার চালানো। তো, যাইহোক, একদিন মেয়ের বিয়ের নেমতন্ন করতে এসেছে দাদা। নিকটাত্মীয়ের বিয়ে, তাই বউভাতের দিন কন্যাযাত্রীদলেও আমাদের আমন্ত্রণ জুটবে, এটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু দাদা মেয়ের বিয়ের নেমতন্ন করে আমার বাবাকে বলল, ছোটমামা, তোমার তো ভাল জামাকাপড় নেই, তাই তোমাকে আর কন্যাযাত্রী যেতে বলছি না।

আমার লেখাপড়া না জানা সাধাসিধে সরল বাবা এই কথার কোনও প্রতিবাদ করতে পারেনি। কষ্ট পেয়েছিল। তবে প্রতিবাদস্বরূপ আমরা দাদার মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান বয়কট করেছিলাম।

একদিন অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডস্যার অমলেন্দুবাবুর কাছে গেলামএই স্যারের মুখে একদিন শুনেছি ইচ্ছা থাকলেও ডবলুবিসিএস অফিসার আমি হতে পারব না। মানে আমার সেই যোগ্যতা নেই। এখন গ্রুপ বি অফিসার হওয়ার ছাড়পত্র পেয়েছি, যা আমার কাছে অন্তত গরিবের ডবলুবিসিএস। কিন্তু অমলেন্দু স্যারকে আমি যে অফিসার হওয়ার যোগ্যতা রাখি তা দেখাতে যাইনি, স্যারের মত জানতেই গিয়েছি। কারণ আড়ালে আমার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও স্যার আমাকে স্নেহও করতেন। মানুষ তো একরঙা হয় না। একবার একটা ডায়রি উপহার দিয়েছিলেন। বাবা মারা যাওয়ার পরে বাড়িতে এসেছিলেন।

স্যার বললেন, তুই অবশ্যই রিলিফ অফিসারের চাকরিতে যোগ দিবি। শুরুতেই অফিসার হিসাবে যোগ দিলে পরে তুই প্রোমোশন পেয়ে কোথায় চলে যাবি তুই জানিস না। আর এই সুযোগ যদি হাতছাড়া করিস, পরে দেখবি হাইকোর্টে আর কাজ করতে ভাল লাগছে না। তখন তোর আফশোসের সীমা থাকবে না। যে চেয়ারে বসিস রোজ, ওখানে আর বসতে ইচ্ছা করবে না।

খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পরে স্যার যোগ করলেন, আর বুদ্ধি করে চলবি। বেশি আবেগপ্রবণ হবি না। দেখবি কোনও সমস্যা হবে না। আমার মনে হয় তুই পারবি।

স্যারের কথায় বেশ ভরসা পেলাম

চন্দনদা এবং হেডস্যার-সহ স্কুলের আরও অনেকের সঙ্গে সৌজন্যবশত দেখা করলাম।

হাইকোর্টে আমার অ্যাপয়ন্টমেন্ট সেকশনের সহকর্মীরা চাইছিলেন না যে আমি ব্লকে যাই। না, তার কারণ কোনও ঈর্ষা বা অসূয়া নয়। এই অল্প কয়েক মাসেই তারা আমাকে ভালবেসে ফেলেছেন। কিন্তু সরাসরি যেতে বারণ করলেন না কেউ। কিন্তু তাদের খারাপ লাগাটা চোখেমুখে প্রকাশ পেল

সব থেকে খারাপ লেগেছিল মনে হয় আমার বাঁদিকের টেবিলের সুশোভনদার। প্রায় রোজই আমাকে একবার করে জিজ্ঞেস করত, কীরে কী ঠিক করলি?

বলতাম, কী ব্যাপারে বলো তো?

হাইকোর্টে থাকবি না ব্লক সার্ভিসে যাবি?

মুখের ওপর হাইকোর্ট ছাড়ব বলতে কেমন বাধো-বাধো ঠেকত। আবার ভাবতাম শেষে যদি মন পাল্টাই, তাই ঝুলিয়ে রাখা গোছের উত্তর দিতাম, এখনও ঠিক করিনি।

তা ঠিক কর। আর কবে করবি? দিন তো ঘনিয়ে এল।

এরকম কয়েক দিন চলার পর সুশোভনদা একদিন আমাকে দু’লাইন প্যারোডি শোনাল— এনেছিলে সাথে করে ধ্বজভঙ্গ *ড়া

   মরণে তাহাই তুমি করে গেলে খাঁড়া।

বুঝলাম, আমার স্পষ্টবাদীতার অভাবে বিরক্ত হয়েই সুশোভনদা আজ এই কাণ্ড করল। মনে মনে বেশ আহত হলাম। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি কবিতা লিখেছিলেন। তারই দু’লাইনের স্ল্যাং ব্যবহার করে যে কেউ এমন প্যারোডি বানাতে পারে, আমার ধারণার অতীত ছিল।

মনের দ্বন্দ্ব আর বেশি দিন চলার পথ পেল না। ত্রাণভবনের ডিরেক্টরকে একটা চিঠি লিখলাম এই মর্মে যে শীঘ্রই হাইকোর্টের মাননীয় রেজিস্টার জেনারেলের কাছে আমার মেডিকেল সার্টিফিকেট এবং পুলিশ ভেরিফিকেশন রোল চাওয়া হোক। আমি ব্লক রিলিফ অফিসারের কাজে যোগ দিতে ইচ্ছুক। হাইকোর্ট থেকে একদিন হাফ সি এল নিয়ে ত্রাণভবনে গিয়ে হাতে-হাতে সেই চিঠি দিয়েও এলাম।

একুশ

কিগো, তুমি যাবে তো আমার সঙ্গে? দীপুদাকে জিজ্ঞেস করলাম।

       দাঁড়া, একটু ভেবে দেখি সময় বার করতে পারব কিনা।

       দীপুদা খানিকক্ষণ ভাবল। তারপর দেখি দীপুদার মুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল। বলল, যেতে পারি, কিন্তু তুই আমার থাকা খাওয়া গাড়িভাড়া ইত্যাদি খরচ বাবদ বেশি না দু’হাজার টাকা দিবি। আমি তোর সঙ্গে যাব।

       কর্মস্থল গুজরাটের জামনগর থেকে পুজো উপলক্ষ্যে দীপুদা পনেরো দিনের ছুটি নিয়ে বাড়িতে এসেছে। দীপুদার আসার খবর আগেই পেয়েছিলাম ফোনে। আজ দেখা করতে এসেছি একটা আর্জি নিয়ে। আমাদের দু’জনেরই কমপিটিটিভ পরীক্ষা দেওয়ার মিশন সফল হয়েছে। দীপুদার ডবলুবিসিএস-এর এ,বি,সি গ্রুপ না হলেও ডি গ্রুপ লেগেছে। কোঅপারেটিভ ইন্সপেক্টরের চাকরিতে জয়েন করা এখন সময়ের অপেক্ষা। আমিও  ব্লক রিলিফ অফিসারের কাজে যোগ দেব পোষ্টিং অর্ডার বেরলে। আমার পিভিআর ও মেডিকেল সার্টিফিকেট হাইকোর্ট থেকে ত্রাণভবনে পৌঁছলে পোষ্টিং অর্ডার বেরবে। একার বেরবে না। আমার মতো আরও কয়েক জনের একই সঙ্গে বেরবে। রজতাভর বিয়েতে বরযাত্রী হয়ে শিলিগুড়ি গিয়ে সেখান থেকে সেবক কালীমন্দির গিয়েছিলাম। পুজো দিয়ে মাকে মনে মনে বলেছিলাম চাকরি পেলে আবার আসব। সেই কথা ভুলিনি। কিন্তু একা অতদূর যাওয়ার সাহস পাচ্ছি না। ভাবলাম একজন সঙ্গী পেলে সেবকে পুজো দিয়ে দু-এক দিনের জন্য দার্জিলিংটাও ঘুরে আসব। কোথাও সেভাবে বেড়াতে যাওয়া তো হয়নি। তাই দীপুদাকে আমার সঙ্গী হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। আমি বললাম, তুমি ইয়ার্কি করছ। আমি টাকা দিতে চাইলেই তুমি নেবে নাকি!

       দশমীর পরের দিন সন্ধ্যাবেলায় আমরা এসপ্লানেড থেকে রকেট বাসে উঠলাম। ঠিক সাড়ে ছ’টায় বাস ছাড়ল। ফেরার কথা মাথায় রেখে বাসের ড্রাইভারের ফোন নম্বর নিয়ে রাখলাম। পরদিন সকাল সাড়ে সাতটায় আমাদের বাস তেনজিন নোরগে বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছল। সেখানে লাগেজ রেখে দশ টাকার টিকিট কেটে যাত্রীনিবাসে আমারা স্নান করে কাঁচা জামাকাপড় পরে শেয়ার জিপে রওনা দিই সেবকের উদ্দেশ্যে। পুজো দেব বলে কিছু খেলাম না। গাড়ি যত সমতল ছেড়ে উপরে উঠতে লাগল আমার মনেও তত যেন আনন্দের ঢেউ উঠল। সেবক মোড়ে এসে গাড়ি থেকে নেমে আমরা দুজনে জুতো খুলে ডালা নিয়ে পাহাড়ের সিঁড়ি বেয়ে মন্দিরে উঠে পুজো দিলাম। তারপর নেমে আবার তিস্তাব্রিজে চলে এলাম। আগের বার যখন এসেছিলাম, আমার কাছে কোনও ক্যামেরা ছিল না। এবার একটা আছে। সস্তার ক্যামেরা— কোডাক কেবি টেন। তাতেই তিস্তার অপরূপ সৌন্দর্য লেন্সবন্দি করলাম।

       দার্জিলিং যাওয়ার রুট আলাদা, তাই সেবক মোড় থেকে শিলিগুড়ি নেমে এলাম। একটা হোটেলে দুপুরের খাওয়া সেরে আবার দার্জিলিং-এর শেয়ার জিপ ধরলাম

দার্জিলিং যখন পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা পার হয়ে গিয়েছে। দীপুদা একটা সস্তার হোটেল খুঁজে বার করল ম্যাল সংলগ্ন এলাকায়। খানিক পরেই শুরু হল তুমুল বৃষ্টি।

দীপুদাকে বললাম, এতদূর এসেছি যখন কাঞ্চনজঙ্ঘাটা দেখা হবে না?

দীপুদা বলল, কাল ভোরেও যদি ওয়েদার এরকম থাকে কী করে দেখা হবে বল? আকাশ পরিস্কার থাকতে হবে। তাও দেখব একবার চেষ্টা করে। কাল কিন্তু খুব ভোরে উঠতে হবে।

রাতে খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। ভোর তিন্টের সময় আমি দীপুদাকে ডাকব মনে করে উঠে দেখি দীপুদা আমার আগেই উঠে পড়েছে। বলল, ওঠ, সত্য। বৃষ্টি পড়ছে না। মনে হচ্ছে তোর কপালে কাঞ্চনজঙ্ঘা আছে। সাড়ে তিনটের মধ্যে দু’জনেই স্নান করে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। হোটেলের কাছেই দীপুদা শেয়ারে একটা জিপ পেয়ে গেল। টাইগার হিলে গিয়ে দেখি আমাদের মতো আরও অনেক পর্যটক। হিলটপ মানুষের মাথায় গিজগিজ করছে। ঠান্ডার মধ্যে পাহাড়ী মেয়েরা জিন্স দামি জুতো সোয়েটার পরে চা-কফি বিক্রি করছে। আমরা টাইগার হিলের রেলিং ধরে অপেক্ষা করতে থাকি সূর্য ওঠার। তারপর এল সেই আকাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। সূর্‍্যের আলোয় কাঞ্চনজঙ্ঘা দৃশ্যমান হল রঙের দ্যুতিতে উজ্জ্বল হয়ে। সেই দৃশ্য বর্ণানা করা আমার সাধ্যাতীত। কোডাক ক্যামেরায় কয়েকটা ছবি তুলে রাখি বাড়ির লোককে দেখাব বলে।

দার্জিলিং ভ্রমণের আর বিস্তৃত বর্ণনায় যাচ্ছি না। এরপর একে একে বাতাসীয়া লুপ, ঘুম মনাস্ট্রি, চিড়িয়াখানা, হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট দেখলাম। ম্যালে ঘুরে কিছু কেনাকাটা করার সময় আমার কাঞ্চনজঙ্ঘা সিনেমার কথা মনে পড়ল। দোর্দণ্ডপ্রতাপ রায়বাহাদুরের তিনশো টাকার চাকরির অফার ফিরিয়ে দিয়ে মাত্র পঞ্চাশ টাকার টিউশনি করাকেই শ্রেয় মনে করেছিল অরুণ মুখোপাধ্যায়। মনে পড়ল ...।।দির কথাও। তার হাজব্যান্ডের অফিসে চাকরি প্রস্তাব আমিও ফিয়েয়ে দিয়েছিলাম। তাই আজ আজ এই দিনটায় আসা সম্ভব হল। জীবনের প্রতি বিশ্বাস রাখলে জীবন কাউকে নিরাস করে না।

দুপুর নাগাদ দীপুদার সঙ্গে কথা বলে সেই রকেটের ড্রাইভারকে আবার ফোন করে আমাদের জন্য দুটো টিকিট রাখতে বললাম। সামান্য কিছু কেনাকাটার পর আমরা ফেরার পথ ধরলাম। দীপুদা বহুবার দার্জিলিং গিয়েছে। তবুও পুজোর ছুটির থেকে আড়াই দিন ছেটে আমার জন্য আমার সঙ্গে এসেছে বলে কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে গেল।




 আগামী পর্বে


**************************************************


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন