বৃহস্পতিবার, ২৫ আগস্ট, ২০২২

পাঠকের মতামত ** স্বরবর্ণ * ৯


কবি-লেখকেরাই স্বরবর্ণের মূল চালিকা শক্তি। তাঁদের সৃষ্টিকাজ বুকে ধরে স্বরবর্ণের পথ চলা।কোনও সন্দেহ নেই,সেই সঙ্গে তার চলার গতিকে ত্বরান্বিত করেছে পাঠকের সুচিন্তিত পাঠ-প্রতিক্রিয়া। প্রতি সংখ্যার মতো বর্তমান সংখ্যাটিরও বহু মতামত পেয়েছি আমরা। ক্রমান্বয়ে সেগুলি প্রকাশ করব। আজ, স্বরবর্ণ * ৯ সম্পর্কে, পাঠকের মতামতের প্রথম পর্ব -----


শতদল মিত্র লিখছেন * প্রথমেই অণুগল্পগুলো পড়লাম। শুভাশিস ঘোষের 'বিলম্বিত প্রেম' গল্পে অনেক দিন পর কারখানার পটভূমিতে শ্রমজীবনের নোনাগন্ধ খুঁজে পেলাম। দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়ের 'বাঁচার ঠিকানা' যেন এক আলোর ঠিকানা লিখল। মানসী কবিরাজের 'উপশম' সত্যিই ছায়া দিল। এ গল্পটি একটি নিখাদ অণুগল্প। তবে সোমা মুখোপাধ্যায়ের 'গ্রাম্য মুহূর্তরা' ঠিক গল্প নয়, বরং তা অণুস্মৃতি। সুধাংশুরঞ্জন সাহা-র অনুবাদে সিমাস হিনির কবিতায় অন্য আলো-হাওয়ার সন্ধান পেলাম। 'স্বরবর্ণ'কে অশেষ ধন্যবাদ নিয়মিত এমন সুচারু সাহিত্যস্বাদের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।  

চন্দন রায়ের কবিতা পড়ে বন্ধন পাল লিখছেন * বিমুগ্ধ করে রাখা কবিতা।

কবি গৌরীশঙ্কর দে-র কবিতা পড়ে সুদীপ দাস লিখছেন * খুবই ভালো কবিতা। বিশেষত "বিন্দু"।

দীপঙ্কর রায়ের গুচ্ছ কবিতা পড়ে শ্রীদাম কুমার লিখছেন * এবারের 'স্বরবর্ণ' নয়-এ প্রকাশিত কবি দীপঙ্কর রায়ের কবিতাগুচ্ছ "পাথুরে বোধনের কান্না শুনি কাশবনে"এক মগ্ন কবির অতলস্পর্শী ভাবনায় গহন ও অনন্য। মিত শব্দচয়ন নিটোল বাকবিন্যাস সাবলীল ভাষার স্বচ্ছন্দ গদ্যছন্দের সঙ্গে ভাবপ্রবাহের অন্তর্লীন মিতালী কবিতাপ্রেমীদের আবিষ্ট করে সহজেই । ঐতিহ্যকে স্বকীয়তায় জারিত করেই তার কবিতায় ধরা থাকে আধুনিকতার অভিমুখ। 

প্রদীপ ঘোষ এর কবিতা পড়ে নব নীতা লিখছেন * দুটো কবিতাই খুব সুন্দর ৷...একটু বেশী ভালো লাগল "কর্ণের পুনর্জন্মক্রিয়া"৷ 

 অমিত চক্রবর্তীর কবিতা পড়ে মীরা মুখার্জি লিখেছেন * নস্টালজিক সুন্দর লেখা। ' ক্যান্ডি প্রেমের ভগ্নাংশ ' এই হলো আপনার সিগনেচার। কিন্তু হবে কি ' হাত  বাড়ায় '!প্রথমদিকের তৃতীয় লাইনে।  

 শরদিন্দু সাহা-র গল্প পড়ে তন্ময় রায় জানাচ্ছেন * এক কথায় "মহাপ্রস্থানের পথে" একটি চমৎকার সার্থক ছোটগল্প। জীবনের ছুটন্ত ট্রেনের পাদানিতে পা রেখে যেন জীবনেরই দুঃখ- সুখের আস্বাদ চেটেপুটে নিতে চাইছে, অমৃতলাল---- দেহাতি চাষাভূষা মানুষটি। করিম চাচা হারু গায়েন দেবদাস মা মেয়ে ঠাকুমা... বটের ঝুরির মতো তারই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আত্মীয়- অনাত্মীয়ের শিকড়। যা তাকে অহরহ টানছে, চেতনে-অবচেতনে... তলপেটে কনুইয়ের গুঁতো খাওয়ায় অসহ্য যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়ার মুহূর্তেও। কিন্তু সার কথা "ওর জীবনের স্পন্দনটা ওকে ঘিরে এখন গোল্লাছুট খেলছে" তাই ডোমের কাছে অমৃতলালের কাতর অনুনয় "এবারের মত বাঁচিয়ে দাও ডোম বাবাজি ।" অতএব "মহা প্রস্থানের পথে" নয়, জীবনেরই পথে মহাআগমন ঘটছে অমৃতলালের (লালদের?)..। 

চন্দ্রাণী গোস্বামীর কবিতা পড়ে নব নীতা জানাচ্ছেন * "অনামিকা" ,"সেদিন আষাঢ়" মুগ্ধ করল দুই'ই ৷ তবে আমার একটু বেশী ভালো লাগল "সেদিন আষাঢ়"৷ বেশ কয়েবার পড়লাম ৷ আন্তরিক অভিনন্দন জানাই তোমায় ৷ 

স্বপ্নদীপ রায়ের কবিতা পড়ে অজিত কুমার পাল লিখেছেন * কবি জীবনশাস্ত্রের ডানায় ভর করে খুঁজে ফেরেন প্রেম-শাস্ত্রের কথাকলি । পাঠককে যেতে বলেন অনেক গভীরে সেই পরিচিত গানটির মতো  " গভীরে যাও ,আরও গভীরে যাও "। "করভাস এবং কুটুম কুটুম " দুটি ঘোড়ায় টানা রথ নিয়ে চলে সেই গভীরের সন্ধানে । 

শুভজিৎ দাস গুপ্ত স্বপন নাগ-এর কবিতা পড়ে লিখছেন * অপূর্ব কবিতাগুলি। পুরোনো স্বপ্ন আর নতুন স্বপন নাগ। আপ্লুত হলাম। 

কৌশিক সেনের কবিতা পড়ে কেতকী বসু লিখছেন * দুটো কবিতাই অসাধারণ

স্বপন নাথ লিখেছেন * সম্পাদকীয় অভিনবত্ব আপনার নতুন নয়,তাই নতুন করে কিছু বলার নেই।তবে অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারটি যে যথেষ্ট সমৃদ্ধ, তা বোঝা যাচ্ছে বিষয় বৈচিত্রের সমাহারে। এগিয়ে চলুন। সঙ্গে আছি। আনন্দে, স্বপন নাথ ।

( আগামী দিন )

সোমবার, ২২ আগস্ট, ২০২২



লেখা আহ্বান

স্বরবর্ণ * দশ * পুজো সংখ্যা

প্রকাশিত হবে মহালয়ার পুণ্যলগ্নে (২৫-৯-২০২২)

পুজো সংখ্যার জন্য লেখা জমা নেওয়া হবে 

৫-৯-২০২২ পর্যন্ত।

বিস্তারিত তথ্যের জন্য উপরের👆 লিংক টাচ করুন।

                 ******************

রবিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২২

প্রিয় কবি লেখক এবং পাঠকদের প্রতি

 


 

স্বরবর্ণ * নয় * ২০২২   

সংখ্যাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত আমাদের অকপটে জানান । প্রাপ্ত মতামতগুলি আমরা ক্রমান্বয়ে প্রকাশ  করব ২৫ আগস্টের পর থেকে । 


****************************

স্বরবর্ণ *দশ  * ২০২২  

দ্বিতীয় বর্ষ * চতুর্থ  সংখ্যা 

********************************

পুজো সংখ্যারূপে প্রকাশিত হবে আগামী  ৫ সেপ্টেম্বর ২০২ 


* এই সংখ্যার জন্য আপনার মৌলিক ও অপ্রকাশিত লেখা ( গল্প কবিতা প্রবন্ধ  অণুগল্প  অনুবাদ কবিতা  ভ্রমণ কাহিনি  ইত্যাদি  ) ৫ সেপ্টেম্বর  ২০২- এর মধ্যে পাঠিয়ে দিন । 

* শব্দসীমা অনির্দিষ্ট। 

কবিতার ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুটি কবিতা পাঠাবেন  

* লেখার সঙ্গে আপনার একটি ছবি এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, প্রকাশিত গ্রন্থ (থাকলে)  ছবিসহ পাঠান । 

* "স্বরবর্ণ " সামগ্রিক চিন্তার ফসল। প্রতি দুমাস অন্তর মাসের ১৫ তারিখ বেরো আগে থেকে লেখা পাঠানপরিকল্পনার সুবিধার জন্যলেখা পাঠাবেন ওয়ার্ড ফাইলে, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ই-মেইল বডিতে টাইপ করে 


* হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর   8777891532

*ই-মেইল --- debasishsaha610@gmail.com 


সম্পাদকমণ্ডলী                                                   

 ড : শুভঙ্কর দে           অলোক কোৱা

সৌম্যজিৎ দত্ত             দেবাশিস সাহা  

তোমায় খুঁজে ফিরি: স্বামী চেতনানন্দ



প্রাচীন সাধুদের কথা  

স্বামী ধর্মেশানন্দ (১৮৯৯-১৯৯৪)

        

১)

     স্বামী ধর্মেশানন্দকে (ধীরেন মহারাজ) ১৯৮২ সালে কাশীর অদ্বৈত আশ্রমে প্রশ্ন করে তাঁর স্মৃতিকথা টেপ করি। তিনি শ্রীম-র খুব ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসেছিলেন এবং ঠাকুরের অন্যান্য শিষ্যের সঙ্গেও বাস করেছেন। পুরোনো উদ্বোধনে আমি তাঁর 'শ্রীম সমীপে' পড়েছিলাম। তাঁকে শ্রীম সম্বন্ধে বলতে অনুরোধ করছিলাম।

     ১৯২১-২২ সালে আমি প্রথম শ্রীম-র কাছে যাই। তিনি আমহার্স্ট স্ট্রিটের মর্টন ইনস্টিটিউশনের চারতলায় থাকতেন। এরপূর্বে আমি সুরেনবাবুর কাছ থেকে নিয়ে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতর চতুর্থভাগ পড়ে খুব আনন্দ পাই। তিনি আমাকে বলেন, 'এই গ্রন্থের লেখক এখনও বেঁচে আছেন।' তারপর একদিন বিকালে আমরা দুজনে শ্রীম-র কাছে যাই। তিনি চেয়ারে বসেছিলেন এবং আমরা একটা বেঞ্চিতে বসলাম। আষাঢ় মাস। রথযাত্রা কয়েকদিন পরে। শ্রীম পুরীর জগন্নাথদেবের মহাপ্রসাদের গুণকীর্তন করতে লাগলেন। এই প্রসাদ ঠাকুর খেতেন। শ্রীম নিত্য খান। তিনি আমাদের সকলের হাতে ঐ প্রসাদ (শুকনো ভাত) দিয়ে বললেন, 'এই প্রসাদ ধারণ করলে ভক্তি হয়।' আমি তখন কলেজের ছাত্র, ব্রাহ্মসমাজে যাই। সব বিচার করে নিই। প্রসাদে কোনো বিশ্বাস ছিল না। আমি শ্রীমকে বললাম, ' হ্যাঁ কেউ যদি বিশ্বাস করে খায় তবে ভক্তি হতে পারে।' তিনি বললেন, 'ঠাকুর বলেছেন 'এই প্রসাদ খেলে ভক্তি হবে।' আমি বললাম, 'তা কি করে হবে?' আমার তর্ক যুক্তি শুনে বললেন, 'বিষ যদি তুমি না জেনে খাও, তাহলেও মৃত্যু হবে। দেখ হে, সব বস্তুরই একটা গুণ আছে।'

     তারপর তিনি গম্ভীর হয়ে আমার দিক থেকে মুখ সরিয়ে অন্য ভক্তদের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'দেখুন, এই বাবুটি ঠাকুরের কথা বিশ্বাস করছেন না।' সকলে নিস্তব্ধ। সুরেনবাবু আমার দিকে চেয়ে আছেন। আমি অপ্রস্তুত হয়ে তাঁর কাছ থেকে প্রসাদ-কণা গ্রহণ করলাম। তারপর থেকে আমি প্রায়ই শ্রীম-র কাছে যেতাম।

     ১৯২১ সালে স্বামী ব্রহ্মানন্দকে একবার বেলুড়মঠে দর্শন করেছি। ১৯২৪ সাল থেকে আমি বিবেকানন্দ সোসাইটিতে ছিলাম এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতাম। সেখানকার ব্রহ্মচারী তারকের সঙ্গে আমি আবার শ্রীম-র কাছে যাই। আমাদের দেখে শ্রীম তারককে জিজ্ঞাসা করেন, 'তুমি কি করো?' সে বলল, 'আমি সোসাইটির চাঁদা সংগ্রহ করি। সেখানে সাধুরা এসে সপ্তাহে দুটি ক্লাস নেন। ভজন আদি হয় এবং রামনাম সংকীর্তন হয়। আমি ঐসব ব্যবস্থা করি।' এরপর শ্রীম আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, 'তুমি কি করো?' আমি বললাম, 'আমি সকালে পূজা করি, সন্ধ্যায় আরতি করি এবং দু'ঘণ্টা লাইব্রেরীর কাজ করি।'

     শ্রীম শুনে বললেন, 'বাঃ, তোমার কাজটি তো বেশ! তুমি সুগন্ধি চন্দন ঘষছ পূজার জন্য, ফুল দিয়ে ঠাকুরকে সাজাচ্ছ। ঠাকুর পবিত্রতম। সেই ঠাকুরের পূজা করছ, সবকিছু নিবেদন করছ। তোমার এই কাজটি বেশ। এই কাজটি তুমি ছেড়ো না। পূজার দ্বারা শীঘ্রই ভগবানের কৃপা লাভ হয়।' এই বলে তিনি আমাকে খুব উৎসাহ দিলেন।

     তারপর আমি ঠিক করলাম সাধু হব এবং বেলুড়মঠে যোগ দেব। আমার ইচ্ছা জেনে শ্রীম বলেন, 'দেখ, সাধু হতে গেলে মৃত্যু-চিন্তা করতে হবে। কঠ-উপনিষদে আছে -নচিকেতা মৃত্যুর রাজা যমের কাছে গিয়েছিলেন মরণের পারে কী আছে তা জানবার জন্য। তিনি যমের কাছ থেকে জেনে নিয়েছিলেন মৃত্যুহীন অমর আত্মাকে। তুমি এখন থেকে রোজ শ্মশানে যাবে এবং সেখানে কি দেখলে তা আমাকে জানাবে।' আমি কয়েকদিন শ্মশানে গিয়েছিলাম। কটা মড়া পুড়ল এবং শ্মশানের পরিবেশ প্রভৃতি সব রিপোর্ট তাঁকে দিতাম। যাই হোক, একদিন কোনো কারণে যায়নি। তাতে শ্রীম বলেন, 'না, ঠিক হলো না। তোমাকে রোজ যেতে হবে।' আমি বললাম, 'আমি ঐদিন এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলাম। তার পাশের বাড়িতে একজন মারা যায়। আমি তাদের কান্না শুনলাম।' একথা শুনে শ্রীম বললেন, 'হ্যাঁ, এ-ও ভাল অভিজ্ঞতা। দেখ, মৃত্যুচিন্তা না করলে মরণের পারে যে ভগবান আছেন সে বোধ হয় না।' এই ভাবে তিনি আমার মনে বৈরাগ্যের ভাব ঢোকালেন।


২)

    ১৯২৬ সালে আমি কলকাতা ছেড়ে দেওঘর বিদ্যাপীঠে join করি। সেখানে চার বছর ছিলাম। ঐখানে আমার স্বাস্থ্য ভাল না থাকায় ১৯৩০ সালে আমি বেলুড়মঠে মহাপুরুষ মহারাজের কাছে আসি। তিনি আমাকে কাশীতে যেতে বললেন। কাশী যাওয়ার পূর্বে আমি প্রায়ই শ্রীম-কে দেখতে যেতাম। ঐ সময়ে প্রয়াগে কুম্ভমেলা হয়। শ্রীম আমাকে বলেন, 'ধীরেন, তুমি কুম্ভমেলায় যাও। বেশ হবে, দেখবে সাধুদের একটি সমাজ আছে। সংসারের প্রতি ঘনিষ্ঠতা কমে যাবে। ওখানে নানা সম্প্রদায়ের সাধুর সমাগম হয়। মাসাধিককাল প্রতিদিন সেখানে ঐসব সাধু-সমাজে ভগবত গুণগান, শাস্ত্রচর্চা, শোভাযাত্রা, ভাণ্ডারা দেখলে আনন্দ পাবে ও অনেক অভিজ্ঞতা হবে। তারপর ঐসব বিশদ বর্ণনা আমাকে লিখবে।

    তারপর বেলুড় মঠ থেকে অনেক সাধুর জন্য একটা রেলের কামরা reserved করা হয়েছিল। আমি তাঁদের সঙ্গে কুম্ভমেলায় গেলাম এবং গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমের কাছে একটি ক্যাম্পে থাকলাম। আমি কুম্ভমেলার বর্ণনা লিখে একটা বিস্তারিত পত্র শ্রীম-কে পাঠিয়েছিলাম। কুম্ভমেলার পর কাশী যাই এবং সেখান থেকে আলমোড়ায় তপস্যা করতে যাই। আলমোড়ার কুঠিয়ায় নির্জনবাস ও পরিবেশ সম্বন্ধে শ্রীম-কে চিঠি লিখি। তিনি উত্তরে লিখেছিলেন, 'এই নির্জন হিমালয়ে একমনে তুমি শ্রীশ্রীঠাকুরের চিন্তায় কাল কাটাইতেছ। কি সুন্দর পরিবেশ, ইচ্ছা হয় এই বৃদ্ধ বয়সে ঐ কুটিরে থাকিয়া তপস্যা করি। তপসা চীয়তে ব্রহ্ম। কিন্তু একাকী বাসকালে 'সাধু সাবধান' -শ্রীশ্রীঠাকুরের এই মহাবাক্য সর্বদা স্মরণ করিবে।'

    এর এক বছর পরে আমি কলকাতায় ফিরে শ্রীম-র সঙ্গে দেখা করি। তিনি বললেন, 'আহা! তোমার কুম্ভমেলার কী বর্ণনা! আমি সর্বপ্রথম তোমার চিঠি পাই। দেখ, ভারতবর্ষের মত এমন সুন্দর দেশ পৃথিবীতে নেই। এখানে সাধু-সন্তেরা তপস্যা করেন ও ভীক্ষার দ্বারা জীবন ধারণ করেন। লোকে সাধুদের ভিক্ষা দেয় যাতে তাঁরা ভগবানের ধ্যানে জীবন কাটাতে পারেন।'

    হরি মহারাজ নিজের জীবনে গীতা অভ্যাস করে তার মর্ম অনুভব করতেন। তিনি ছিলেন মূর্তিমান গীতা। তিনি শুকদেবের মতন শুদ্ধ ও পবিত্র ছিলেন। মহাপুরুষ মহারাজ আমাকে গীতার এই শ্লোকটি ধ্যান করতে বলেছিলেন, -'গতির্ভর্তা প্রভুঃ সাক্ষী নিবাসঃ শরণং সুহৃৎ। প্রভবঃ প্রলয়ঃ স্থানং নিধানং বীজামব্যয়ম্॥'(৯/১৮) - আমিই প্রাণীদের পরাগতি ও পরিপালক। আমি প্রভু ও সকল প্রাণীর বাসস্থান ও তাদের কৃতাকৃতের সাক্ষী। আমি রক্ষক ও হিতকারী। আমি স্রষ্টা এবং সংহর্তা। আমিই আধার ও প্রলয় স্থান এবং জগতের অক্ষয় কারণ।

    আলমোড়ায় থাকাকালে আমি রোজ গীতার নবম ও দশম অধ্যায় পাঠ করতাম। এই দুই অধ্যায়ে অনেক ভক্তির কথা আছে। কিন্তু ভাব-ভক্তি আমার তেমন বোধ হতো না। আমি ঠাকুরের কাছে খুব প্রার্থনা করতাম। তারপর ভাবলাম মহাপুরুষ মহারাজ রয়েছেন এবং শ্রীম এখনও জীবিত আছেন। এঁদের সঙ্গলাভ দুর্লভ। এঁদের কাছেই যাই। সৎসঙ্গ সাধু জীবনে অবশ্যই চাই।

    যাইহোক, ঠাকুর আমার প্রার্থনা শুনেছিলেন। কাশীতে ফিরে তিন-চার মাস থাকার পর অক্টোবর মাসে স্বামী বিরজানন্দ মহারাজের একটি চিঠি পাই। তিনি তখন জেনারেল সেক্রেটারি। তিনি লেখেন, 'উদ্বোধন পত্রিকার একজন Sub-Editor দরকার। তুমি সত্বর এখানে চলে এসো।' আমার খুব আনন্দ হল। আমার উদ্বোধনে খুব থাকার ইচ্ছা, কারণ মঠে আমার শরীর ভাল থাকত না। উদ্বোধনে থাকাকালে আমি সপ্তাহে তিন-চারদিন শ্রীম-র কাছে যেতাম।


৩)

     শ্রীম মর্টন স্কুলের চারতলায় একটা ঘরে থাকতেন। সেই ঘরে একটি খাট, কয়েকটা বইয়ের আলমারি, দেওয়ালে ঠাকুর, মা ও স্বামীজীর ছবি এবং একপাশে ঠাকুরের ব্যবহৃত কিছু জিনিসপত্র ছিল।

     একদিন তাঁকে দেখতে গিয়েছি। তিনি খাটে বসেছিলেন। আমি মেঝেতে বসলে তিনি আমাকে আবৃত্তি করতে বললেন, -'অসতো মা সদ্গময়। তমসো মা জ্যোতির্গময়। মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়।' -অসৎ থেকে আমাকে সৎ-এ নিয়ে যাও। অন্ধকার থেকে আমাকে আলোকে নিয়ে যাও। মৃত্যু থেকে আমাকে অমৃতে নিয়ে যাও। শ্রীম প্রার্থনার উপর খুব জোর দিতেন। বলতেন, prayer is golden link between the short life and eternal life. এই short life ভগবানকে দিতে হবে। খুব করে প্রার্থনা করো। দেখ, তাঁর কৃপা ছাড়া কিছু হয় না।'

     শ্রীম আমাকে খুব স্নেহ করতেন এবং ঠাকুরের কথা খুব বলতেন। তাঁর ঘরের সামনে ছিল এক বড় ছাদ এবং চারিদিকে উঁচু দেওয়াল। আকাশ ছাড়া আর কিছু দেখা যেত না। সেই ছাদের উপর টবে তিনি নানা ফুলগাছ, তুলসীগাছ প্রভৃতি লাগিয়ে ঋষিদের মতন তপোবন সৃষ্টি করেছিলেন। প্রতিদিন বিকালে ভক্তেরা এলে তাদের নিয়ে সেখানে ধ্যান করতেন। আমি একবার ভুল করে আসন ফেলে উদ্বোধনে চলে এসেছিলাম। তার পরদিন বেলা দুটোর সময় গোপনে আসনখানা আনতে যাই। শ্রীম আমাকে দেখে হাতটি ধরে তাঁর খাটের উপরে বসালেন। তারপর তিনি বললেন, 'তোমার কথাই ভাবছিলাম। তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।' আমি বললাম, 'আমাকে এখনই ফিরতে হবে। মায়ের বাড়িতে তিনটের সময় স্বামী বাসুদেবানন্দ ছান্দোগ্য-উপনিষদ-এর ক্লাস নেন, সেখানে আমাকে উপস্থিত থাকতে হবে।' তিনি বললেন, 'দেখ, অধ্যয়ন করে ভগবানের কাছে যাওয়া তো royal path. তা যুগ যুগ ধরে রয়েছে। দেখ, ঠাকুরকে ধরো। তাঁকে ধরে ক্লাস কর। তিনি এই সবে এসেছিলেন। এই সুবর্ণ সুযোগ। তিনি সাক্ষাৎ ভগবান। তাঁরই চরণতলে বেদ-বেদান্ত পড়ে রয়েছে। তাঁকে ধরলে এখনই ঐসব জ্ঞান পাবে। খুব তাড়াতাড়ি গন্তব্য স্থানে পৌঁছে যাবে, নতুবা দেরি হয়ে যাবে, অনেক দেরি হয়ে যাবে।'

     কিন্তু আমার তখন শাস্ত্রের প্রতি দারুণ আসক্তি। সবাই বলত যে, শাস্ত্র না পড়লে জ্ঞান হবে না। আমি শ্রীম-র কাছ থেকে হাত টেনে নিয়ে উদ্বোধনে চলে এলাম। আমি মূঢ়ের মতো তাঁর প্রতি অশ্রদ্ধা জানালাম ও তাঁর কথায় বিশ্বাস করলাম না। এখন মনে হয় তিনি আমাকে হয়ত কোন গূঢ় আধ্যাত্মিক তত্ত্ব বলতে চেয়েছিলেন।

     পরে শ্রীম-কে বলেছিলাম, 'আমার ধ্যান-ধারণা ঠিকমতো হচ্ছে না। আপনি কিছু করে দিন।' তখন তিনি বলেছিলেন, 'দেখ, যদি কেবল শাস্ত্র নিয়ে থাক, তবে ধ্যান-ধারণার গভীরে ঢুকতে পারবে না। ভগবানের কাছে প্রার্থনাই আসল। তুমি যখন তা পারলে না, এখন তোমার পক্ষে কেবল ভগবানের কথা কওয়া হচ্ছে সাধনা। 'কথয়ন্তশ্চ মাং নিত্যং তুষ্যন্তি চ রমন্তি চ।' (১০/৯) -আমার ভক্তেরা নিত্য আমার তত্ত্বগুণ ও লীলাকথা আলোচনা করে তুষ্ট হয় ও আনন্দ লাভ করে। 'পরস্পরং ভাবয়ন্তঃ শ্রেয়ঃ পরমবাপ্স্যথ।' (৩/১১) -এইরূপে পরস্পরের সন্তোষ সাধন দ্বারা মঙ্গল লাভ করবে। গীতার এই বাক্য অনুসরণ কর। ভক্তদের সঙ্গে ভগবানের কথা বলতে বলতে তোমার ভক্তি হবে। কেবল তাঁর বিষয়ে চিন্তা করবে।'


৪)

     শ্রীম ছিলেন আমার পরম হিতৈষী ও মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী। একদিন একজনের সঙ্গে আমার কথা কাটাকাটি হয়। দুপুরে খাওয়ার পর আমি তাঁর কাছে গেলাম সান্ত্বনা পাওয়ার জন্য। আমাকে দেখে তিনি আদরের সঙ্গে ডাকলেন, 'এস, এস।' আমাকে বেঞ্চিতে বসতে বললেন। তারপর আমার হাতে কয়েকটা pamphlet দিয়ে বললেন, 'এই দেখ, দেবাসুরের সংগ্রাম চলছে। একদল অপর দলকে নিন্দা করছে। মঠের এক বিরোধী দল বলছে, 'বেলুড় মঠের উপর বাঘ পড়েছে। বেলুড় মঠে বাঘ এসেছে।' এই কথা বলে শ্রীম হো হো করে হাসতে লাগলেন। তাঁর হাসি দেখে আমিও হেসে ফেললাম। আমার মর্মবেদনার কথা বলা হল না। তিনি ছিলেন ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ পার্ষদ। তাঁর বালকের মতো হাসিতে আমার মনের দুঃখ চলে গেল।

     আরেকদিন তাঁকে বললাম, 'ঠাকুর যে ভগবান, এই বিশ্বাস তো আমার হচ্ছে না।' শ্রীম বললেন, 'কি বল হে? এতসব পড়েও, ঠাকুরের পার্ষদদের সঙ্গ করেও ঠাকুর যে ভগবান, এই বিশ্বাস এল না? সাত কাণ্ড রামায়ণ পড়ে এখন তুমি বলছ সীতা কার মাসি? যাক, কখন কখনও মনের এইরূপ অবস্থা হয়। আমারও ঐরূপ হয়েছিল। মনে পড়ে, ১৮৮২ সালে এক দুপুরে খাওয়ার পর ঠাকুর বিছানায় শুয়ে আছেন। আমি পাপোশের উপর বসে তাঁর পায়ে হাত বোলাচ্ছি আর ভাবছি -ইনি সাধারণ মানুষের মতন খান, বেড়ান, ঘুমোন, সাধারণ মানুষের মতন ব্যবহার করেন, উনি কি করে জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-লয়কর্তা হবেন? ইনি কি মানুষরূপে এসেছেন মানুষকে কৃপা করবার জন্য, জগত উদ্ধার করবার জন্য? এ কী করে সম্ভব? ইনি তো দেহধারী মানুষ। আমি এরূপ ভাবছি, তখন হঠাৎ ঠাকুর উঠে বসলেন ও বললেন, 'মাস্টার, তুমি কি ভাবছ?' তারপর নিজের হৃদয়ে হাত রেখে বললেন, 'এখানেই সব। একে চিন্তা করলে সব হবে। একে চিন্তা করলে সব হবে। একে চিন্তা করলে সব হবে।' এই কথা তিনবার বলেই তিনি সমাধিস্থ হলেন।

     অনেকক্ষণ সমাধির পর তিনি নিম্নভূমিতে এসে মা জগদম্বার সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন, 'মা, আমি তো কিছু জানিনা। তুই যেমন বলালি, তেমনি বললাম। আমি তো বালক। মা, আমি কি কিছু দোষ করলাম? তুই আমার মুখ দিয়ে বলালি।' দেখ, এতেই বুঝলাম ঠাকুর ভগবান। মা জগদম্বা ও ঠাকুর এক।

     শ্রীম-কে লক্ষ্য করে দেখেছি তাঁর সত্যের প্রতি খুব আঁট ছিল। কখনও তাঁকে রাগতে দেখিনি। তবে কেউ কথা না রাখলে তিনি রেগে যেতেন। একদিন এক ভক্তের সঙ্গে কোথাও যাবেন, কিন্তু সেই ভক্ত কোন খবর দেননি বা আসেননি। তখন শ্রীম খুব ক্রোধ প্রকাশ করলেন এবং বললেন, 'সত্যের প্রতি আঁট না থাকলে কিছু হবে না। ঠাকুর সত্যস্বরূপ ছিলেন।' তাঁর এই কথা আমার খুব মনে আছে।


৫)

     শ্রীম-র জীবনযাত্রা খুব কঠোর ছিল। তিনি স্বাবলম্বী ছিলেন। নিজের রান্না তিনি একটা কুকারে তৈরি করতেন। তাতে ভাত ও তরকারি সেদ্ধ করতেন। দুধ খেতেন। বলতেন -দুধ খেলে মেধা হয়। রাতে এক চাকরকে দিয়ে একখানা পাউরুটি আনাতেন। তাই একটু তরকারি ও শেষে দুধ দিয়ে খেতেন। ভক্তেরা সন্দেশ, রসগোল্লা, মিষ্টি আনত। আমি গেলে আমাকে কিছু খেতে দিতেন। একদিন আমাকে সন্দেশ খেতে দেন। আমি বললাম, 'আমার খিদে নেই।' তিনি হাসতে হাসতে বললেন, 'দেখ, অরুচির রুচির জন্য সন্দেশের সৃষ্টি। আর তোমার এই সন্দেশে অরুচি! আচ্ছা থাক, তোমায় খেতে হবে না।'

     আমি ভাবতে লাগলাম শ্রীম আমাকে কত আদর করে খাওয়ান, আর আমি তাঁকে একটু কিছু খাওয়াতে পারলাম না। শ্রীম ছিলেন অন্তর্যামী। তিনি আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছেন। সন্ধ্যার পর সব ভক্ত চলে গেলে তিনি আমাকে বললেন, 'দেখ, আমার অসুখ হয়েছিল। শরীরটা ততো ভালো নেই। দিনে তো রান্না করে খেয়েছি। রাতে কি খাওয়া যায় বল তো?' আমি বললাম, 'আমার যখন টাইফয়েড হয়েছিল তখন আমি Milk-roll পাঁউরুটি খেতাম দুধ দিয়ে। এটি খুব তাড়াতাড়ি হজম হয়।' তিনি বললেন, 'কে আমাকে তা এনে দেবে?' আমি একখানা Milk-roll পাঁউরুটি একটা চায়ের দোকান থেকে কিনে আনলাম। ভাল দোকানে পেলাম না। তিনি গঙ্গাজলের ছিটা দিয়ে দুধের সঙ্গে সেই পাউরুটি খেলেন।

     তার পরদিন মর্টণ ইন্সটিটিউশনে পৌঁছে দেখলাম শ্রীম নিচের তলায় এক গৃহস্থের সঙ্গে কথা বলছেন। আমাকে দেখে তিনি দূরে এক বেঞ্চিতে বসতে বললেন। তারপর ঐ ভক্তের সঙ্গে কথা শেষ করে তিনি আমাকে চারতলায় তাঁর ঘরে নিয়ে গেলেন। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় তিনি আমার পকেটে পাউরুটি দেখেছিলেন। আমি তা তাঁকে দিলাম। ছাদের ঘরের সব ভক্ত তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সেদিন তিনি নানাবিধ ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ করেন। তারপর রাত নটায় সবাই চলে গেলে তিনি আমাকে থাকতে বললেন। সেদিন কেউ মা-জগদ্ধাত্রীর নানাবিধ একথালা প্রসাদ এনেছিল। তিনি ঐ প্রসাদ আমাকে খাওয়ালেন। তারপর আমার পাউরুটি তিনি একটু গঙ্গাজলের ছিটা দিয়ে দুধের সঙ্গে খেয়ে বললেন, 'বেশ রুটি।' এইভাবে আমি শ্রীম-র অনেক স্নেহ পেয়েছি।

     শ্রীম চাইতেন সাধুরা সদা ঈশ্বরের উপর নির্ভর করবে, কোন গৃহস্থের ওপর নির্ভর করবে না। আমি বাগবাজার উদ্বোধন বাড়ি থেকে তিন-চার মাইল হেঁটে শ্রীম-র কাছে যেতাম। শুকলালবাবু নামে এক ভক্ত আমাকে ট্রামের ভাড়া এক আনা দিতেন। একদিন আমি ফিরে চলে যাব, কিন্তু শ্রীম শুকলালবাবুকে আটকে রাখলেন। আমি তখন হেঁটেই ফিরে গেলাম।

     একবার স্বামী বিশ্বানন্দ বোম্বাই থেকে এক ধনী শেঠকে শ্রীম-র কাছে নিয়ে গিয়েছেন। তিনি তাঁকে ভগবানের কথা অনেক বললেন। তারপর তাঁরা যখন চলে যাচ্ছেন, শ্রীম বিশ্বানন্দ মহারাজকে ডেকে বললেন, 'দেখ, সাধুর পেছনে পেছনে ভক্ত যাওয়া ভাল, কিন্তু ধনী ভক্তের পিছনে পিছনে সাধুর যাওয়া ভাল নয়। তোমার প্রতি যদি তাদের শ্রদ্ধা না থাকে, তোমার কথার প্রতিও তাদের শ্রদ্ধা হবে না। ভগবানের উপর নির্ভর করবে, ধনীদের উপর নয়।



প্রিয় কবি প্রিয় কবিতা * বিনয় মজুমদার

 



এই বিভাগে আমরা এমন দু-একটি  কবিতা পড়ব , যে কবিতা আমাদের অন্তর্লোকে বিস্ময় সৃষ্টি করে শুধু নয় ,আমাদের কবিতা পড়ার আনন্দে অবগাহন করায় , প্রতি দিন  প্রতি মুহূর্তে | এই পর্যায়ের কবি যে সবসময়  বিখ্যাতই  হবেন , এমনটা নয় , তিনি অখ্যাত তরুণ তরুণতর কবিও হতে পারেন , কিন্তু ,শর্ত একটাই ,কবিতাটি যেন আমাদের মর্মলোক স্পর্শ করে | স্বরবর্ণ *নয়   সংখ্যায় 'প্রিয় কবি  প্রিয়  কবিতা ' বিভাগের কবি হলেন বিনয় মজুমদার ---- 









একটি উজ্জ্বল মাছ


একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে

দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত পস্তাবে স্বচ্ছ জলে

পুনরায় ডুবে গেলো — এই স্মিত দৃশ্য দেখে নিয়ে

বেগনার গাঢ় রসে আপক্ক রক্তিম হ’লো ফল |

বিপন্ন মরাল ওড়ে, অবিরাম পলায়ন করে,

যেহেতু সকলে জানে তার শাদা পালকের নিচে

রয়েছে উদগ্র উষ্ণ মাংস আর মেদ ;

স্বল্পায়ু বিশ্রাম নেয় পরিশ্রান্ত পাহাড়ে পাহাড়ে ;

সমস্ত জলীয় গান বাষ্পিভূত হ’য়ে যায়, তবু

এমন সময়ে তুমি, হে সমুদ্রমত্স্য, তুমি…তুমি…

কিংবা, দ্যাখো, ইতস্তত অসুস্থ বৃক্ষেরা

পৃথিবীর পল্লবিত ব্যাপ্ত বনস্থলী

দীর্ঘ-দীর্ঘ ক্লান্তশ্বাসে আলোড়িত করে ;

তবু সব বৃক্ষ আর পুষ্পকুঞ্জ যে যার ভূমিতে দূরে দূরে

চিরকাল থেকে ভাবে মিলনের শ্বাসরোধী কথা |



সময়ের সাথে এক বাজি ধরে


সময়ের সাথে এক বাজি ধরে পরাস্ত হয়েছি ।

ব্যর্থ আকাঙ্খায়, স্বপ্নে বৃষ্টি হয়ে মাটিতে যেখানে

একদিন জল জমে, আকাশ বিস্বিত হয়ে আসে

সেখানে সত্বর দেখি ,মশা জন্মে; অমল প্রতূষে

ঘুম ভেঙ্গে দেখা যায় ; আমাদের মুখের ভিতর

স্বাদ ছিল, তৃপ্তি ছিল জে সব আহার্য প’চে

ইতিহাস সৃষ্টি করে; সুখ ক্রমে ব্যথা হয়ে উঠে ।

অঙ্গুরীয় নীল পাথরের বিচ্ছুরিত আলো

অনুষ্ণো অনির্বাণ , জ্বলে যায় পিপাসার বেগে

ভয় হয় একদিন পালকের মত ঝরে যাব ।



মুকুরে প্রতিফলিত


মুকুরে প্রতিফলিত সূর্যালোক স্বল্পকাল হাসে |

শিক্ষায়তনের কাছে হে নিশ্চল, স্নিগ্ধ দেবদারু

জিহ্বার উপরে দ্রব লবণের মত কণা-কণা

কী ছড়ায়, কে ছড়ায় ; শোনো, কী অস্ফুট স্বর, শোনো

‘কোথায়, কোথায় তুমি, কোথায় তোমার ডানা, শ্বেত পক্ষীমাতা,

এই যে এখানে জন্ম, একি সেই জনশ্রুত নীড় না মৃত্তিকা?

নীড় না মৃত্তিকা পূর্ণ এ অস্বচ্ছ মৃত্যুময় হিমে…’

তুমি বৃক্ষ, জ্ঞানহীন, মরণের ক্লিষ্ট সমাচার

জানো না, এখন তবে স্বর শোনো,অবহিতহও |

সুস্থ মৃত্তিকার চেয়ে সমুদ্রেরাকত বেশি বিপদসংকুল

তারো বেশি বিপদের নীলিমায় প্রক্ষালিত বিভিন্ন আকাশ,

এ-সত্য জেনেও তবু আমরা তো সাগরে আকাশে

সঞ্চারিত হ’তে চাই, চিরকাল হ’তে অভিলাষী,

সকল প্রকার জ্বরে মাথা ধোয়া আমাদের ভালো লাগে ব’লে |

তবুও কেন যে আজো, হায় হাসি, হায় দেবদারু,

মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়!



কী উৎফুল্ল আশা নিয়ে

 

কী উৎফুল্ল আশা নিয়ে সকালে জেগেছি সবিনয়ে।

কৌটার মাংসের মতো সুরক্ষিত তোমার প্রতিভা

উদ্ভাসিত করেছিল ভবিষ্যৎ, দিকচক্রবাল।

সময়ে ভেবেছিলাম সম্মিলিত চায়ের ভাবনা,

বায়ুসেবনের কথা, চিরন্তন শিখরের বায়ু।

দৃষ্টিবিভ্রমের মতো কাল্পনিক বলে মনে হয়

তোমাকে অস্তিত্বহীনা, অথবা হয়তো লুপ্ত, মৃত।

অথবা করেছে ত্যাগ, অবৈধ পুত্রের মতো, পথে।

জীবনের কথা ভাবি, ক্ষত সেরে গেলে পরে ত্বকে

পুনরায় কেশোদ্গম হবে না; বিমর্ষ ভাবনায়

রাত্রির মাছির মতো শান্ত হয়ে রয়েছে বেদনা-

হাসপাতালের থেকে ফেরার সময়কার মনে।

মাঝে মাঝে অগোচরে বালকের ঘুমের ভিতরে

প্রস্রাব করার মতো অস্থানে বেদনা ঝরে যাবে।


গল্প * বিরথ চন্দ্র মণ্ডল




সোনামুখীর প্রেম 

বিরথ চন্দ্র মণ্ডল


সে কথা লোকের  মুখে মুখে।  যে, মেয়েটার গায়ের রং নাকি আহা - মরি। কী চমৎকার  ! কাজল টানা, পটল চেরা চোখ । কী সুন্দর ভ্রু জোড়া। তাকে কেউ কখনো পার্লারে যেতে দেখেনি। অথচ ;  এতো শোভমান ' ভ্রু ' নাকি পার্লারে গিয়ে করে মেয়েরা। তার  চিকন কালো ঢেউ খেলানো চুল  ! সে - কী লম্বা  - আহা  !. কাল্ - নাগ - নাগিনী  ও  এতো লম্বা হয় কি না লোকের জানা নেই। 

মেয়েটির শাড়ি পরার  বাহার ও সে- রকম।  দামী দামী বেনারসী শাড়ি । গরদের শাড়ি। গায়ের রং এর সাথে শাড়িগুলোও বেশ মানান সই। সব আইরণে পাট করা। কুচি করে ব্লাউজের সাথে একদমই ম্যাচিং  । কোথা থেকে বডি স্প্রে - সেন্ট - টেন্ট  গুলো আনে - কে - জানে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে  , রাস্তার হাওয়া গুলো ফুর - ফুরে হয়ে যায়। রাস্তার মানুষ - জন  , পশু - পাখি  , সাপ - ব্যাঙ - সবার মধ্যে একটা সাড়া পড়ে যায়। সবাই সহজেই বুঝে নেয় -" কেউ একজন হেঁটে গেল এই পথ দিয়ে "

চৌহদ্দি ঘেরা বাড়ির পেছনে বড়ো বড়ো নীম গাছ। করেঞ্জ গাছ। হাবলী গাছ। এই করেঞ্জ গাছের নীচে গর্তে বাসা করে আছে সোনামুখী। সোনার মতো গায়ের রং বলে সবাই সোনামুখী বলে ডাকে। সোনার আজকাল এসব ভালো লাগে না। কানের কাছে একই কথা। "গজর্ - গজর্,  গজর্ - গজর্ "

মাঝে মাঝে বড্ড সাধ হয় - 'কেমন সে মেয়েটা ' দেখে আসি  ! কিন্তু! ঐ যে ভয়! মানুষের নজরে পড়লে এক ডাঙে কুপোকাত। অথচ ; নিজের রুপ নিয়ে  বড্ড অহংকার তার। 

শুধু সাপের সমাজ কেন ? মানুষের সমাজেও তার মতো রুপবান  , গুণবান  , কেউ নেই। 

রঙে কেন -  লম্বায় কেন! এমনকি ক্ষমতায়ও সবাইকে হার মানাবে। এক ছোবলে মানুষ  'রা ' কাড়তে সময় পাবে না। 

অথচ  ;  ঐ মেয়ে মানুষটার কথা -- আকাশে -- বাতাসে.... ভালো লাগে না এসব শুনতে  ! 

একদিন খুব রিস্ক  নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো সোনা। তবে দিনে নয়। রাতের বেলা। শুনেছে -- মেয়েটির চার পাশে নাকি পারফিউমের সু-গন্ধ  . । এই গন্ধ হাতড়ে - হাতড়ে  ঠিক খুঁজে নেবে সে। 

বাড়ির মেইন গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলো সোনামুখী। রাস্তায় বিদ্যুতের আলো। অথচ ; এই বিশাল বাগান - বাড়ি  সুন-সান  । অন্ধকার। 


এতগুলি দরজা  । কোন দরজার নিরালায় মহারানী - কে জানে! মানুষের মতো গন্ধ শোঁকার মতো নাক না থাকলেও কী হবে? জিহ্বা তো আছেই  ? দু ' ফাঁক করা  বড়ো জিহ্বা বার বার উঁচিয়ে ঠিক খুঁজে নিল সে। পুরোনো বাড়ি। দেওয়ালের পাশে অর্ধেক ইটের সমান ফাঁকা ছিল। অতি সাবধানে ঢুকে পড়লো ফট্ করে। ঘরের ভিতরে ঢুকে মেয়েটাকে সে নিজের চোখে দেখে তো তাজ্জব  ! 

মেয়েটির গায়ের রঙ তো নয়  ! যেন আলো ঝলকাচ্ছে । বিনুনি করা চুলের গোছা  । বাম পাশ বরাবর লম্বা - লম্বি  , ওটাও যেন এক সাথে ঘুমাচ্ছে। দুক্ষ হচ্ছে সোনার ! সাপ  কূলে জন্মেছে বলে। যদি মানুষ হতো -- যে করেই হোক  - এই মেয়েটাকে সে বিয়ে করতোই। মনের দুঃখের  একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে সাপেদের দীর্ঘ শ্বাস মানে - ফোঁস শব্দ  ! আর এই ফোঁস শব্দে, সুন্দরীর ঘুম গেল ভেঙে। 

ভয় পেয়ে গেল 'সোনা 'ও। এ পৃথিবীতে মানুষকে একমাত্র ভয় তার। এমনিতেই সে জাত্ গোখরো। মানুষ যাকে কিং কোবরা নামেও চেনে। শুধু সোনার মতো রং... এই যা :। 

যাই হোক - যে পথে এসে ছিল, , সেই পথে পালাবে কী.... খ্প করে সুন্দরী ধরে ফেললো। বললো --এই পালাচ্ছো কোথায়  ? আ্যঁয়...! 

রূপসীর নরম হাতের ছোঁয়ায় সোনা  তো অবাক  ! সোনা বলে -- আমাকে দেখে ভয়ে শিউরে উঠবে কী- না আরও আমাকে ধরে আছো  ? বলি - তোমার জীবনের প্রতি কী কোন  ভয় - ডর বলতে কিচ্ছু কী নেই... ???? ইয়াব্বড়ো একটা সাপ দেখেও সুন্দরীর কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। আরো বলে -- বাঁচবো বলেই তো তোমাকে ধরলাম। 

সোনা বলে --- মানে  ??? রুপসী খেকরিয়ে বলে উঠে... পুরুষ হয়েছো  , মেয়ে মানুষের কথা বোঝ না  ! সোনা অবাক হয় -- এ বলে কী  ! 

ফ্যাল ফ্যালিয়ে দেখে নেয়  রুপসীকে। আর বলে -- এই সুন্দরী  ! ঠিক খোলসা করে বলো তো - কী বলতে চাইছো  ! 


রুপসী তার দীর্ঘ বিনুনি করা চুল দিয়ে সোনাকে তার বুকের সাথে বাঁধতে বাঁধতে বলে  --আমার এ বুকে মাথা রেখে দ্যাখো  , শুনতে পাবে নাগিনীর  শ্বাস - প্রশ্বাস। এই বলে সোনামুখীর মাথাটা বুকে জাপটে ধরে বলে, -- কী শুনতে পাচ্ছো  ! 

রুপসী সোনার গায়ে চুমু খায়। বলে -- আগে বলো  , প্রতিদিন তুমি এই ভাবে আসবে  ? কী বলো - আসবে  ! সোনা ঘাড় নেড়ে বলে -- আচ্ছা  ! তা না হয় হলো। কিন্তু কেন ? সোনা অবাক হয়ে প্রশ্ন ছোঁড়ে  ! সুন্দরী আবার চুমু খায়। বলে  ;-- এটা ও বুঝতে পারছো না আমার হাঁদুরাম  । তোমার সাথে " ই-য়ে " করবো। 

সোনা আবারও ঠিক বুঝলো না। বললো -- প্লীজ বুঝিয়ে দাও... !!!! এবার সুন্দরী সত্যি সত্যি রেগে গেল। মুহুর্তেই  ঘাড় - মাথাকে এক দিকে করে ফুৎকার ঝাড়ে ----- ধুর্   পালা..! এ আবার কার পাল্লায় পড়লাম  ! 

এতক্ষণে সোনার ধ্যান ভাঙলো। বললো -- হ্যাঁ  , বুঝেছি - বুঝেছি। কিন্তু  , আমি সাপের জাত। আর তুমি মানুষ.... 

সুন্দরী বলে --- তাতে, কী হয়েছে? অ্যাঁ...? সাপের মন আর মেয়েদের মন এক- ই  ! বুঝলে  ! 

মেয়েরাই কেবল সাপের সঙ্গে যুঝতে পারে। আমার এই ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে বিশ্বাস হচ্ছে না তোমার  ? 

সোনামুখী কথা গুলি শোনে। আর সুন্দরীর দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে খুশি ও হয় খুব। মনের ইচ্ছাটা , এভাবেই মেঘ না চাইতে জল হয়ে আসবে  , সে ভাবেনি আদৌ  । 

তো ; এই ভাবে রোজ সোনামুখী, সুন্দরীর কাছে আসে। তবে কিনা - সব রাতের বেলা। দিনে সোনা বেরোয় না। কারণ   , যদি কেউ দেখে ফেলে  ! - তাহলেই  কী এতবড় লম্বা সাপকে দেখেই ছেড়ে দেবে  ? সোজা এক ডাঙে সাবাড়  ! 

সারা দিনটা  সুন্দরীর  যেন কাটতেই চায় না। ঘোর অন্ধকার লাগে। আলোহীন মানুষ আর কতক্ষণ ই বা থাকতে পারে  ? 

আর রাতের বেলা  ? দিনের চেয়েও পরিস্কার । কত রঙ বেরঙের  রোশনাই আলো! মনে তখন খুশির ডানা। সোনার চিকন্ শরীরে সুন্দরী আলতো হাত বুলায়। চুমু খায়। আদর করে। মনের খুশিতে জড়ায় সোনাকে। 

এভাবেই বেশ দিন যায়। 


কথায় বলে -- সুখের দিন খুব অল্পই থাকে সবার জন্য। 

সুন্দরীর ও তাই হল , সিরিয়ায় গৃহ যুদ্ধ। প্রাণ বাঁচাতে দেশের মানুষ এদিক ওদিক ছুটছে। দেবজীৎও ঘর মুখো হল। বাড়িতে আগাম জানানোর আর সময় কোথায়  ? বাড়ি পৌঁছতে  সেই গভীর রাত।

এদিকে দ' জনে পরস্পরকে জড়িয়ে গভীর  নিদ্রায় আচ্ছন্ন। ঘুমের মধ্যে সুন্দরী শুনলো, তাকে কেউ যেন চিৎকার করে ডাকছে। বলছে -- সোলাঙ্কি দরজা খোল.... সোলাঙ্কি দরজা খোল..... 


সোনার লেজ ধরে খেলতে খেলতে দু ' জনে যে  কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল... খেয়াল নেই। কিন্তু এ গলার স্বর তো দেবজিতের  ! এতো রাতে দেবজিৎ.... ! অবাক হয় সোলাঙ্কি। 

আবার শুনতে পায় -- সোলাঙ্কি  , দরজাটা খোল প্লীজ... 

ঘুম ভেঙেছে সোনামুখীর ও  । এক অজানা ভয়ে  তার হার্ট- বিট  ফুলছে... আর সঙ্কুচিত হচ্ছে অজান্তেই বার বার ফোঁস - ফাঁস  বেরিয়ে আসছে তার মুখ থেকে। সে এসেছিল সামনের দরজার পাশের ছোট ফোকর দিয়ে। এখন পিছনের জানালা দিয়ে পালানো ছাড়া গত্যন্তর নেই। সে পালিয়ে যেতে চাইলে  , সুন্দরী তাকে জাপটে ধরে থাকে। বলে -- তুমি যাবে না। তুমি চলে গেলে, দরজা তো খুলবোই না। এই তোমার সামনে গলায় দড়ি দেবো  ।

সোনামুখীর  একে তো ভয়  ! আবার সুন্দরীর কথায় আরো ভয় পায় । কোন রকম আমতা আমতা করে বলে -- ওগো! আমাকে ছেড়ে দাও। আমি থাকলে তোমার আরো বিপদ বাড়বে। বলে  , সুন্দরীর গালে চুমু খায় সোনা। সুন্দরী ছাড়ে না তার প্রিয় সাপকে। 

বলে  , -- তুমি যদি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো  , আমি যা বলছি - তুমি তাই করবে বলো   ! সোনা সম্মতি জানিয়ে  মুখটাকে সুন্দরীর  আরো কাছে এগিয়ে নিয়ে আসে। ---- বলো  , কী বলছো  ? সুন্দরী বলে -- দরজা খোলার সাথে সাথে তুমি ঐ লোকটাকে তোমার এক  ছোবলে তার ভবলীলা সাঙ্গ করবে, বলো.. কথা দাও.... তোমার যা ফিগার  ! এক ছোবলেই কেল্লা ফতে  ! 

সোনামুখী মাথা নাড়ে । আর ভাবে  , কী করে এক ছোবলে কত বেশি বিষ উগরে দেওয়া যায়  ! 


একটা ফোঁস ফোঁস আওয়াজ সেই কখন থেকে শুনতে পাচ্ছে  দেবজিৎ। এই শব্দ ঘরের ভেতর থেকে আসছে। নিশ্চয়ই এক বিষাক্ত সাপ। ভয় পায় সে  । চিৎকার করে সোলাঙ্কিকে বার বার ডাকছে। ---- শোলাঙ্কি,  শোলাঙ্কি  । দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসো। ভেতরে বিষাক্ত সাপ। 

সুন্দরী বুঝে গেছে  , শেষ রক্ষা  বোধহয় আর হলো না। অগত্যা, যাবার বেলায় আদরের  সোহাগকে বার বার চুমু টুমু খেয়ে ফিস্ ফিস্ করে কীসব বলে টলে ছেড়ে দিল।  

সুন্দরী কিছু না বোঝার ভান্ করে বলে -- দাঁড়াও। দরজা খুলছি  । 

দেবজিৎ আরো জোরে চিৎকার লাগায় --- আরে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসো। ভিতরে বিষাক্ত কেউটে সাপ। 

সোলাঙ্কি দরজা খোলে। আলো জ্বালায়। বলে -- কী সাপ সাপ করছো  ? কিচ্ছু নেই তো  ! 

--- আমি ফোঁস ফোঁস আওয়াজ বাইরের থেকে শুনছি। আর তুমি কিনা ভেতরে থেকে ও কিছু শুনতে পাওনি...? 

---- আসলে বাইরের থেকে এলে  তো! ওটা তোমার মনে হচ্ছে। যাক গে.... 


মনে মনে রাগে গর্ গর্ করতে থাকে সুন্দরী। অসময়ে পোড়ারমুখো এসে ঘুমটা দিল ভাঙিয়ে। আসবি তো আয় - দিনের বেলা আয়.... তা নয়   , এলি সেই রাতের বেলা। যত্ত সব! বিষম রেগেও গেলে  মুখপানাকে খুব স্বাভাবিক রাখে। 

এসময় রাগামুখো হলে চলবে না। নিজেকে সামলে নেয় সুন্দরী। ঠোঁটের তলায় মুচকি হাসি  আনে। বলে -- অত রাতে আসতে তোমার কোন অসুবিধা হয়নি তো  ? বরের গায়ে আলতো ন্যাকা হাত বোলায়। শরীর - টরীর সব..... 

কথা শেষ করতে দেয় না দেবজিৎ। -- আগে বলো  , তুমি ভালো আছো তো...? 

শুনে সুন্দরী র মুখটা এক্কেবারে শুকিয়ে যায়। 

উত্তরে বলে --- কোথায় আর..! 

চোখ ফেটে জল আসতে চায় সুন্দরীর  ।

 

মনে মনে ভাবে - কি সুখেই না দিন কাটছিল। বলা নেই  , কওয়া নেই  , এসেই দিলে সব মাটি করে। 

মুখে বলে -- তোমার তো আবার খাওয়া - দাওয়া, বিশ্রাম  কিছুই নেই। হাঁড়িতে করে দুটো চাল বসিয়ে দিই  ! দেবজিৎ  হুড়মুড়িয়ে বলে --না -- না   ! অত রাতে আর কষ্ট করতে হবে না। আমি হোটেল থেকে খাবার নিয়ে এসেছি। এসো দু 'জনে খেয়ে নিই  । কতদিন একসাথে আমরা খাইনি বলোতো  ! 

--- না সে তুমি ই খেয়ে নাও।আমি তো এই সবে  খেলাম। ঘুম ধরে গেছিল। সুন্দরী বলে কথাগুলো। 


এ ক 'দিন তার খাবারের ধরণটাও  বদলে ফেলেছিল সুন্দরী। ইদানিং দুধ আর কলা ছাড়া আর কিছু ভালো লাগে না তার। বাজার থেকে ডোজন - ডোজন পাকা চিনি  কলা , দু 'সের করে গাই গরুর দুধ। দুধ - কলা যে সোনার প্রিয় আহার। তাই তার ও প্রিয়  হয়ে গেছে ইদানিং। 


সুন্দরীর মন থেকে রাগ, ক্ষোভ আর যায় না। মনে মনে বলে -- শুরু দিনটা আসতে দাও.... ! তবেই টের পাবে । সুখের ঘরে আগুন লাগানো - এ আমি হতে দেবো না। 

দেবজিৎ ঘরে ফেরায়, সে রাতে  স্বামী - স্ত্রীর মধ্যে যা কিছু হলো - সুন্দরীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে হল। দেবজিৎ এসবের কিছুই বুঝল না। 


সকাল হতেই স্বামীকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ন্যাকা গলায় সুন্দরী বললো -- ওগো জানো -- তুমি যে সোনার পাশাটা শ্যাকরাকে দিয়ে গড়িয়ে দিলে.... কত শখ করে। সারাটা দিন একা একা কিইবা করি... ! 

ঐ নীম গাছের ধারে কাছে এদিক ওদিক ঘুরছিলাম।  হঠাৎ দেখি পাশাটা নেই। আমি জানি ; নির্ঘাত ঐ জায়গায় খসে পড়েছে। দাও না ওটা খুঁজে  । লক্ষী বরটা আমার। যাও  ....! 

কথাটা শুনে দেবজিৎ চিন্তায় পড়ে। কত কষ্টের পয়সায় কেনা সোনার পাশা। সব সাধ আহ্লাদ ছেড়ে, বিদেশে পড়ে থেকে... সেই রোজগারের টাকায় কেনা.... ! না, এক্ষুনি যাই। খুঁজি। দেখি পাই কিনা।।।! 


বাড়ির পিছনের বড় বড় গাছের শুকনো পাতা। এটা ওটাতে জঙ্গলময়। এ নিরালায়.. সাপ কোপের বাসায় , কোথায় খুঁজি.... এসব ভাবতে থাকে। আর পায়ে পায়ে ডাঁই হয়ে থাকা শুকনো পাতাকে পা দিয়ে সরিয়ে দেয়। জঙ্গলের এদিকে ওদিকে তাকায়। হঠাৎ দেখলো  , বড়ো একটি গর্তের মুখে সোনার মতো কিছু একটা চিক- চিক করছে। কাছে গিয়ে দেখলো -- সেই পাশা। 

কিন্তু  , গর্তের ভেতর থেকে সেই ফোঁস ফোঁস শব্দ। এই একই শব্দ গতকাল রাতেও পেয়েছিল। কী করা যায় । ভাবতে থাকে সে। একটুখানি দূরে দেখলো  , এক মোটা বাঁশ  । ভেঙে নিল অর্ধেকটা। ভাবলো - এতেই চলবে। ওটা হাতে নিল  ।গর্তের কাছে গিয়ে সন্তর্পণে পাশাটা ছোঁ মেরে নেবে কী ---বিশাল এক সাপ বেরিয়ে দেয় আর কী ছোবল  ! 

মুহূর্তেই  সরে এসে বাঁশ উঁচিয়ে দিল ডাঙের পর ডাঙ। ইয়াব্বড় সাপ। ব্যাটা আধ মরা। আবার দিল এক ডাঙ। আবার.... আবার... ভয়ে কত ডাঙ যে পড়লো, দেবজিৎ গুনতি করেনি। বেচারা সাপটি মরে গেছে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। সারা শরীর তখনো ভয়ে কাঁপছে  তার। কী বিশাল লম্বা।কোন রকম পাশাটা ছোঁ মেরে সোজা ঘরে । 


সোয়ামীকে হাঁপাতে দেখে সুন্দরী বলে -কী হোল গো তোমার  ! হাঁপাচ্ছো যে বড়ো...! সে আর বলো না। বিষাক্ত সাপের ছোবল থেকে বেঁচে ফিরলাম। গর্ত থেকে  সাপটার বেরিয়ে আসার দৃশ্য ভাবে, আর বলে ---বাপরে্  , সে কি ফণা  ! সে কি লম্বা  ! 

সুন্দরী র হাত কপালে চলে যায় । এমন ভান্ করে  , যেন  এক্ষুনি আকাশ থেকে পড়ল। কিছু শোনার উদ্গ্রীবে সোয়ামীর দিকে তাকিয়ে থাকার ভান করে বলে ---তার পর -- তার পর ---

--তার পর আর কী...! লম্বা এক বাঁশ দিয়ে ঘা এর পর ঘা দিয়ে একদমই শেষ  ! 

শুনে মুর্ছা  যাবার উপক্রম সুন্দরীর। 

হায়! কতসাধ করে পাঠালাম  , পোড়ামুখোর মরা মুখটা দেখবো। তা না। শেষে আমার সাপটাকে মেরে ফেললে। এর মূলে যত রাগ, যত ক্রোধ  , যত অভিমান  আছড়ে পড়ল ঐ প্রেমিক পুরুষটির ওপর। যে সদ্য বাঁশের ঘায়ে মরল। 

বলতো - তার নাকি বিশাল ক্ষমতা। কই মরার আগে এক ছোবল  দিল না  কেন এই হাঁড়ির সোয়ামীকে। শত্রুটা বিদায় হতো! এখন এই জীবন থেকে ও কী আর মরে ও কী  ! মনে মনে ভাবছে সুন্দরী আর হাহুতাস করছে। রাগে সাপের মতো ফুলতে থাকে। ইচ্ছে হয়, সে নিজে গিয়ে সোয়ামীর উপর বিষ ঢেলে দেয়। কিন্তু বিধাতা তাকে মানুষের মূর্তি করে পাঠিয়েছে। এ কারণে বিধাতার প্রতিও রুষ্ট সে। এই ভাবে আপন মনে রাগে ফুটতে থাকে। টগবগে ফর্সা শরীর ফুলে ফেঁপে লালে লাল হয়েছে। সে দাড়িয়ে ছিল। হঠাৎ দুম্ করে পড়ে গেল মেঝেতে। 

দেবজিৎ দিশেহারা। মানুষ টা এত্তো তাকে ভালোবাসে ! মুখে - কপালে জল দিল। মেঝে থেকে কোলে তুলল। পাখা বাতাস করল। তবুও জ্ঞান ফিরল না সোলাঙ্কির। হাসপাতাল যেতে প্রায় চার কিলোমিটার পথ। যত কম সময়ে পারা যায় টোটো ব্যবস্তা করে সোজা হাসপাতাল। 

ডাক্তার দেখে বলল - হার্ট এটাকে পেশেন্টের মৃত্যু হয়েছে। দেবজিতের কান্না পাচ্ছে খুব। এ কষ্ট কাউকে বোঝাতে পারছে না সে । মানুষটা শুধু বিপদের কথা শুনে হার্ট ফেল করলো। তাহলে কতোখানি ভালো বাসতো তাকে। আর সে কিনা রোজগারের কথা ভেবে দিনের পর দি নয়, বছর ভর বিদেশে কাটিয়েছে। 

কী হবে এ টাকা - পয়সা! সোলাঙ্কিই তো তার জীবনের সব কিছুই ছিল। এ জীবনে বেঁচে থেকেও কী আর মরেও কী..... ! 

পাথরের মূর্তি র মতো ঠায় এক জায়গায় বসে থাকে দেবজিৎ  ।


**********************************************************************************************



বিরথ চন্দ্র মণ্ডল 

দীর্ঘদিন সাহিত্যচর্চা করছেন ।
 আশাবরী সাহিত্য পত্রিকা (২৬ বছর)- সম্পাদক। লিখছেন 
কাঁথি ,পূর্ব মেদিনীপুর থেকে। মূলত গল্প এবং কবিতা লেখার চেষ্টা করেন । 

উপন্যাস * দেবাশিস সাহা




ধুলোর সিংহাসন

দেবাশিস সাহা 

প র্ব -- নয় 


 [ পূর্বানুষঙ্গ: অলির সামান্য জ্বর সর্দি কাশি। অলি যতটা না, অশোক তার চেয়ে দ্বিগুণ উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। ডাক্তার দেখানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সংসারের দুরবস্থার কথা ভেবে, অলি সে প্রসঙ্গ কৌশলে এড়িয়ে যায়। ইতিমধ্যে ভাগনা নিলু আসে,খুশির খবর নিয়ে। ওর নেট কোয়ালিফাই করার খবর শোনায় । শুনে আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে অশোক। রাতে নিলুদের বাড়ি থেকে নেমন্তন্ন খেয়ে এসে লেখার টেবিলে বসে। কবিতার পরিবর্তে নিলুর কঠিন কঠোর জীবন সংগ্রামের কথা লেখে ডায়েরিতে। তারপর....]



ডিসেম্বরের শেষাশেষি।ইদানীং কোচিং-এর চাপটা অনেক কম। স্কুলের পরীক্ষাগুলো শেষ হয়েছে। ওরা কেউ আর পড়তে আসছে না। কলেজের দু'-একটা ক্লাস নিতে হয় শুধু। দু’দিন বাদে বড়দিন। ওরাও ছুটি ছুটি করছে। শীতের এই সময়টা সবাই পিকনিক বা পছন্দমত জায়গায় ঘুরতে যায়।ক’দিন আবহাওয়াটাও মনোরম। জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়েছে। রোদ ঝলমলে সকাল-দুপুর। অবশ্য যদি না হঠাৎ উদয় হওয়া নিম্নচাপের ভ্রুকুটি চোখ রাঙায়, আবহাওয়ার পূর্বাভাস কিন্তু সে রকমটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে। তা দিক। তাই বলে এই সময়টা কেউ গৃহবন্দি থাকতে চায় না। ওদেরকেও  তাই অশোক ছুটি দিয়েছে। নতুন ক্লাস শুরু হবে জানুয়ারির ৫ তারিখ থেকে, বোর্ডে ইতিমধ্যেই নোটিশ টাঙিয়ে দিয়েছে । এই সময়টা পছন্দের দু'চারটে বই পড়বে। ভাগনা নিলু প্রথমবার স্কলারশিপের টাকা পেয়ে অশোককে A.L.Basham এর 'The Wonder That Was India ' এবং অলিকে Abul kalam এর  'Wings of Fire' বই দুটো গিফট করেছিল। কোনওটাই পড়া হয়নি। অসমাপ্ত রয়ে গেছে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত-এর শেষ ক'টা অধ্যায়ও। কবে বইটা কিনেছিল। উদ্বোধন থেকে। কোনও  এক  বইমেলায়। তখন একটানা পড়েছিল। একটা ঘোরের মধ্যে। প্রায় নাওয়া-খাওয়া ভুলে। এ ক'দিনে সব শেষ করতে হবে। সকালে পড়ার টেবিলে বসে, এমন একটা সংকল্প মনে মনে তৈরি করে অশোক।এই মুহূর্তে  না-পড়া কথামৃতের সেই অংশটা খুলে পড়তে শুরু করেছে  ------


শ্রীরামকৃষ্ণ ও শ্রীযুক্ত বঙ্কিম

প্রথম পরিচ্ছেদ

[ শ্রীযুক্ত অধরলাল সেনের বাড়িতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্তসঙ্গে কীর্তনানন্দ ও শ্রীযুক্ত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ইত্যাদির সঙ্গে কথোপকথন ]


আজ ঠাকুর অধরের বাড়িতে আসিআছেন,২২ শে অগ্রহায়ণ, কৃষ্ণা চতুর্থী তিথি, শনিবার, ইংরেজি ৬ই  ডিসেম্বর, ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দ। ঠাকুর পুষ্যানক্ষত্রে আগমন করিয়াছেন।


 অধর ভারী ভক্ত, তিনি ডেপুটী  ম্যাজিস্ট্রেট। বয়:ক্রম ২৯/৩০ বৎসর হইবে। ঠাকুর তাহাকে অতিশয় ভালোবাসেন। অধরেরও কি ভক্তি! সমস্ত দিন অফিসের খাটুনির পর, মুখে ও হাতে একটু জল দিয়াই প্রায় প্রত্যহই সন্ধ্যার সময় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করিতে যাইতেন। তাহার বাড়ি শোভাবাজার বেনেটোলা। সেখান হইতে দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে ঠাকুরের কাছে গাড়ি করিয়া যাইতেন। এইরূপ প্রত্যহ প্রায় দুই টাকা গাড়ি ভাড়া দিতেন। কেবল ঠাকুরকে দর্শন করবেন, এই আনন্দ।


অধর ঠাকুরকে প্রায়ই শোভাবাজারের বাড়িতে লইয়া যাইতেন। ঠাকুর আসিলে তথায় উৎসব পড়িয়া যাইত। ঠাকুর ও ভক্তদের লইয়া অধর খুব আনন্দ করিতেন ও নানারূপে তাহাদিগকে পরিতোষ করিয়া  খাওয়াইতেন।


একদিন ঠাকুর তাঁহার বাড়িতে গিয়াছেন। অধর বলিলেন, আপনি অনেকদিন এ বাড়িতে আসেন নাই, ঘর মলিন হইয়াছিল, যেন কিরকম গন্ধ হইয়াছিল, আজ দেখুন, ঘরের কেমন শোভা হয়েছে! আর কেমন একটি সুগন্ধ হইয়াছে। আমি আজ ঈশ্বরকে ভারি  ডেকেছিলাম। এমনকি চোখ দিয়ে জল পড়েছিল। ঠাকুর বলিলেন, "বল কি গো! " ও অধরের দিকে সস্নেহে তাকাইয়া হাসিতে লাগিলেন।


আজও উৎসব হইবে। ঠাকুরও আনন্দময় ও ভক্তেরা আনন্দে পরিপূর্ণ। কেননা যেখানে ঠাকুর উপস্থিত, সেখানে ঈশ্বরের কথা বৈ আর কোন কথাও হইবে না। ভক্তেরা আসিয়াছেন ও ঠাকুরকে দেখিবার জন্য অনেকগুলি নূতন নূতন লোক আসিয়াছে। অধর নিজে ডেপুটী ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি তাঁহার কয়েকটি বন্ধু ডেপুটী ম্যাজিস্ট্রেটকে নিমন্ত্রণ করিয়া আনিয়াছেন। তাঁহারা নিজে ঠাকুরকে দেখিবেন ও বলিবেন, যথার্থ তিনি মহাপুরুষ কিনা।


ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সহাস্যবদনে ভক্তদের সহিত কথা কহিতেছেন।এমন সময় অধর কয়েকটি বন্ধু লইয়া ঠাকুরের কাছে আসিয়া বসিলেন।

অধর (বঙ্কিমকে দেখাইয়া ঠাকুরের প্রতি )---মহাশয়, ইনি ভারি পন্ডিত, অনেক বই-টই  লিখেছেন। আপনাকে দেখতে এসেছেন। ইঁহার নাম বঙ্কিমবাবু।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)--- বঙ্কিম! তুমি আবার কার ভাবে বাকা গো!

বঙ্কিম (হাসিতে হাসিতে)---আর মহাশয়!জুতোর চোটে ( সকলের হাস্য ) সাহেবদের জুতোর চোটে বাঁকা।


 এটুকু পড়েই সম্মোহিত অশোক। সরস্বতী অ্যাপার্টমেন্টের তিনতলায় সে আর বসে নেই, অতীত অন্ধকার ঠেলে পৌঁছে গেছে, ১৮৮৪ সালের ৬ ডিসেম্বর, শনিবার দিনটিতে। অধর প্রমুখ ভক্তের সঙ্গে ওই সে-ও বসে আছে শ্রীরামকৃষ্ণ সান্নিধ্যে।কী আশ্চর্য! আজ দিনটাও শনিবার। সব অনুকূল।ওর সমস্ত কৌতূহল, উৎসুক্য এই মুহূর্তে একটি কেন্দ্রবিন্দুতে ঘনীভূত। কী হয়, কোথায় পৌঁছয় এই দুই যুগন্ধর পুরুষের কথোপকথন, বিস্ফারিত চোখ মেলে দেখবে, সমস্ত শ্রবণ একত্র করে কান পেতে শুনবে। একজন সাহিত্যসম্রাট,ইংরাজি ও বাংলা ভাষার পাইওনিয়ার।  তাঁর প্রথম উপন্যাস 'দুর্গেশনন্দিনী'(১৮৬৫ ) প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই বাংলা সাহিত্যে তুমুল  আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে।পরের বছরই বেরিয়েছে 'কপালকুণ্ডলা'। তারপর একে একে মৃণালিনী, যুগলাঙ্গুরীয়,চন্দ্রশেখর,রাজসিংহ,আনন্দমঠ ইত্যাদি উপন্যাস প্রকাশিত হয়ে চলেছে । সম্প্রতি বেরিয়েছে দেবী চৌধুরানী (১৮৮৪) বইটি। আর  অপরজন কামারপুকুরের তথাকথিত 'মূর্খ ' ক্লাস টু থ্রি বিদ্যার শ্রীরামকৃষ্ণ। 'চাল কলা বাঁধা বিদ্যে' যাঁর ভালো লাগেনি। লাটে তুলেছেন প্রথাগত পড়াশোনা। বছর ২৬ হল, তিনি রানি রাসমণি প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণেশ্বরের এই কালীবাড়িতে অবস্থান করছেন। মা ভবতারিণীর পূজারী হিসাবে। দুই মেরুর দুইজন, মিল শুধু একটা জায়গাতে, দুজনেই 'চট্টোপাধ্যায় ' পদাধিকারী। রুদ্ধশ্বাসে পড়তে থাকে অশোক ----

 


[ বঙ্কিম ও রাধাকষ্ণ যুগলরূপের ব্যাখ্যা ]

শ্রীরামকৃষ্ণ -----না গো, শ্রীকৃষ্ণ প্রেমে বঙ্কিম হয়েছিলেন। শ্রীমতির প্রেমে  ত্রিভঙ্গ হয়েছিলেন কৃষ্ণরূপ এর ব্যাখ্যা কেউ কেউ করে,শ্রীরাধার প্রেমে ত্রিভঙ্গ। কালো কেন জানো? আর চৌদ্দপো  অত ছোট কেন? যতক্ষণ ঈশ্বর দূরে, ততক্ষণ  কালো দেখায়, সমুদ্রের জল দূর থেকে নীল বর্ণ দেখায় । সমুদ্রের জলের কাছে গেলে ও হাতে করে তুললে আর কালো থাকে না,তখন খুব পরিষ্কার,সাদা.।সূর্য দূরে বলে খুব ছোট দেখায়,কাছে গেলে আর ছোট থাকেনা। ঈশ্বরের স্বরূপ ঠিক জানতে পারলে আর কালোও থাকে না ছোটও থাকেনা।সে অনেক দূরের কথা সমাধিস্থ না হলে হয় না। যতক্ষণ আমি তুমি আছে, ততক্ষণ নাম-রুপও আছে। তারই সব লীলা। আমি তুমি যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ  তিনি নানারূপে প্রকাশ হন।



শ্রীকৃষ্ণ পুরুষ, শ্রীমতি তার শক্তি --- আদ্যশক্তি। পুরুষ আর প্রকৃতি। যুগলমূর্তির মানে কি? পুরুষ আর প্রকৃতি অভেদ, তাদের ভেদ নাই। পুরুষ, প্রকৃতি না হলে থাকতে পারে না, প্রকৃতিও পুরুষ না হলে থাকতে পারে না। একটি বললেই আরেকটি তার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে হবে। যেমন অগ্নি আর দাহিকাশক্তি। দাহিকা  শক্তি ছাড়া অগ্নিকে ভাবা যায় না। আর অগ্নি ছাড়া দাহিকাশক্তি ভাবা যায় না। তাই যুগল মূর্তিতে শ্রীকৃষ্ণের দৃষ্টি শ্রীমতীর দিকে, ও শ্রীমতীর দৃষ্টি কৃষ্ণের দিকে। শ্রীমতীর গৌর বর্ণ বিদ্যুতের মতো,তাই কৃষ্ণ পীতাম্বর পরেছেন। শ্রীকৃষ্ণের নীল বর্ণ মেঘের মতো, তাই শ্রীমতী  নীলাম্বর পরেছেন। আর শ্রীমতী  নীলকান্তমণি দিয়ে অঙ্গ সাজিয়েছেন। শ্রীমতীর পায়ে নূপুর, তাই শ্রীকৃষ্ণ নূপুর পরেছেন, অর্থাৎ প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষের অন্তরে বাহিরে মিল।


এই কথাগুলি সমস্ত সাঙ্গ হইল, এমন সময়ে অধরের বঙ্কিমাদি বন্ধুগণ পরস্পর ইংরেজিতে আস্তে আস্তে কথা কহিতে লাগিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ(সহাস্যে বঙ্কিমাদির প্রতি) কি গো। আপনারা ইংরাজিতে কি কথাবার্তা করছো? (সকলের হাস্য )। অশোকও হেসে ওঠে ।'আপনি' - 'তুমি' মিশিয়ে কী এক মধুর কণ্ঠস্বরে কথা বলছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। মনপ্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে।


অধর ---- আজ্ঞে, এই বিষয়ে একটু কথা হচ্ছিল, কৃষ্ণ রূপের ব্যাখ্যার কথা।


শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে সকলের প্রতি )----একটা কথা মনে পড়ে আমার হাসি পাচ্ছে। শুন,একটা গল্প বলি। একজন নাপিত কামাতে গিয়েছিল।একজন ভদ্রলোককে কামাচ্ছিল। এখন কামাতে কামাতে তার একটু লেগেছিল। আর সে লোকটি ড্যাম (Damn) বলে উঠেছিল। নাপিত কিন্তু ড্যামের মানে জানে না। তখন সে ক্ষুর টুর সব সেখানে রেখে, শীতকাল, জামার আস্তিন গুটিয়ে বলে, তুমি আমায় ড্যাম বললে, এর মানে কি এখন বল। সে লোকটি বললে, আরে তুই কামা না, ওর মানে এমন কিছু নয়, তবে একটু সাবধানে কামাস।নাপিত,সে ছাড়বার পাত্র নয়, সে বলতে লাগল, দেখ ড্যাম মানে যদি ভাল হয়, তাহলে আমি ড্যাম, আমার বাপ ড্যাম, আমার চৌদ্দ পুরুষ ড্যাম। (সকলের হাস্য) আর ড্যাম মানে যদি খারাপ হয়, তাহলে তুমি ড্যাম, তোমার বাবা ড্যাম, তোমার চৌদ্দপুরুষ ড্যাম। (সকলের হাস্য )আর শুধু ড্যাম নয়। ড্যাম ড্যাম ড্যাম ড্যা ড্যাম ড্যাম।(সকলের উচ্চ হাস্য)


 'হো: হো: হো: অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল অশোকও। কিচেনে সকালের টিফিন তৈরিতে ব্যস্ত অলি চমকে ওঠে। ইদানীং মানুষটাকে এমন প্রাণখোলা হাসি হাসতে দেখেনি। ব্যাপারটা কী! মাথাটা পুরোপুরিই  বিগড়াল নাকি! গ্যাসটা কমিয়ে ছুটে আসে অলি, ' কী গো, অমন পাগলের মতো হাসছ কেন?'

 '' হাসছি কেন? তবে শোনো, '' অলির হাত ধরে জোর করে বসাতে চায়।

''আরে দাঁড়াও দাঁড়াও,গ্যাসটা নিভিয়ে আসি, পুড়ে ঝুড়ে যাবে তো সব।''


ফিরে আসতেই, অশোক রসিয়ে রসিয়ে নাপিতের গল্পটা অলিকে ফের পড়ে শোনায় এবং যথারীতি অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।হাসি আর থামতেই চায় না। অলিও হাসে, তবে অশোকের মতো প্রাণখোলা হাসি হাসতে পারে না, কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ, ''সকালেই কথামৃত নিয়ে বসেছ, এদিকে সংসারের বিষামৃতে আমার যে প্রাণ ওষ্ঠগত। যাও, একটু বাজার থেকে ঘুরে আসো। দুপুরে রান্না করবটা কী?''


''প্লিজ অলি, আজ তুমি আমাকে কোথাও যেতে বলো না। দুপুরে তুমি যা দেবে,তাই খাব।''


''রোজ রোজ একঘেয়ে নিরামিষ ভালো লাগে? যাও না,একটু কম পয়সার লটে,বাটা বা তেলাপুইয়া মাছ নিয়ে আসো।''

অলি প্লিজ, শ্রীরামকৃষ্ণের কথার বঙ্কিম কী জবাব দেন...আজ আমাকে পড়তেই  হবে। হেব্বি ইন্টারেস্ট লাগছে.।

অলি আর কথা বাড়ায় না। কতদিন বাদে এমন আনন্দে মেতে আছে লোকটা! হাসি তো প্রায় নেই-ই। সারাক্ষণ লোন, না হয় সামনের সিজনের ছাত্রসংখ্য, নয়ত মেয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তা মাথায় চেপেই আছে।না যায়,থাক, টিফিন সেরে ও নিজেই যাবে।


অলি বাজারের দিকে পা বাড়াতেই, ফের ফের চতুর্পার্শ্ব ভুলে অধর-বঙ্কিম-শ্রীরামকৃষ্ণ সকাশে অশোক। নিজের অজান্তেই হাত রাখে বুকে। মনে হয়,বুকের কোন গহীন গভীর থেকে উঠে এসে ওর একান্ত আপন হোমপাখিটিও যেন কান  পেতে শুনছে, বঙ্কিমচন্দ্র ও শ্রীরামকৃষ্ণের কথোপকথন -------


দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও প্রচারকার্য 


সকলের হাস্য থামলে পর, বঙ্কিম আবার কথা আরম্ভ করিলেন। বঙ্কিম ---- মহাশয়, আপনি প্রচার করেন না কেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ (হাসিতে হাসিতে) প্রচার! ওগুলো অভিমানের কথা। মানুষ তো ক্ষুদ্র জীব। প্রচার তিনিই করবেন, যিনি চন্দ্র-সূর্য সৃষ্টি করে এই জগত প্রকাশ করেছেন। প্রচার করা কি  সামান্য কথা? তিনি সাক্ষাৎকার হয়ে আদেশ না দিলে প্রচার হয় না।তবে হবে না কেন? আদেশ হয়নি তুমি বকে যাচ্ছ, ওই দুদিন লোকে শুনবে তারপর ভুলে যাবে।যেমন একটা হুজুগ আর কি! যতক্ষণ তুমি বলবে ততক্ষণ লোকে বলবে, আহা ইনি বেশ বলেছেন। তুমি থামবে,তারপর কোথাও কিছুই নাই!


 যতক্ষণ দুধের নীচে আগুনের জ্বাল রয়েছে,ততক্ষণ দুধটা ফোঁস  করে ফুলে ওঠে। জ্বাল টেনে নিলে আর দুধও যেমন তেমনি! কমে গেল।


 আর সাধন করে নিজের শক্তি বাড়াতে হয়। তা না হলে প্রচার হয় না। 'আপনি শুতে স্থান পায় না, শংকরাকে ডাকে।' আপনারই শোবার জায়গা নাই, আবার ডাকে ওরে শংকরা আয়, আমার কাছে শুবি আয়। (হাস্য )


ওদেশে হালদার পুকুরের পাড়ে রোজ বাহ্যি করে যেত, লোকে সকালে এসে দেখে গালাগালি দিত। লোক গালাগালি দেয়, তবু বাহ্যি বন্ধ হয় না। শেষে পাড়ার লোক দরখাস্ত করে কোম্পানিকে জানালে। তারা একটি নোটিশ মেরে দিলে--'এখানে বাহ্যি, প্রস্রাব করিও না, তা করিলে শাস্তি পাইবে।' তখন একেবারে সব বন্ধ। আর কোনো গোলযোগ নাই। কোম্পানির হুকুম ---সকলের মানতে হবে।


তেমনি ঈশ্বর সাক্ষাৎকার হয়ে যদি আদেশ দেন, তবেই প্রচার হয়, লোকশিক্ষা হয়, তা না হলে কে তোমার কথা শুনবে? এই কথাগুলি সকলে গম্ভীরভাবে স্থির হইয়া শুনিতে লাগিলেন।


তাহলে শ্রীচৈতন্য, গুরু নানক, ভক্ত কবীর   ---এঁরা প্রচারের আদেশ পেয়েছিলেন, অধরের পাশে বসে শ্রীরামকৃষ্ণের উদ্দেশে যেই প্রশ্নটা করতে যাবে অশোক ,অমনি মাথায় টোকা মেরে অলি ডাকল, ''শোনো আমি বাজারে যাচ্ছি। উপমা উঠলে টিফিনটা খেয়ে নিতে বলবে। কিচেনে ঢাকা দাওয়া রইল।''

'' আচ্ছা। ''

''আর দরজাটা দিয়ে বসো। চোর-ডাকাত ঢুকলেও তো টের পাবে না, এত মজে আছ।''

''দিচ্ছি।'' ঝট করে ছিটকিনিটা লাগিয়ে ফের বইয়ে ডুব দেয় অশোক …


শ্রীযুক্ত বঙ্কিম ও পরকাল [Life after  Death---argument from analogy]


শ্রীরামকৃষ্ণ (বঙ্কিমের প্রতি )---আচ্ছা,আপনি তো খুব পণ্ডিত, আর কত বই লিখেছ, আপনি কি বলো, মানুষের কর্তব্য কি? কি সঙ্গে যাবে? পরকাল তো আছে?


বঙ্কিম--- পরকাল! সে আবার কি?


শ্রীরামকৃষ্ণ ---- হাঁ,জ্ঞানের পর আর অন্যলোকে যেতে হয় না, পুনর্জন্ম হয় না। কিন্তু যতক্ষণ না জ্ঞান হয়, ঈশ্বর লাভ হয়, ততক্ষণ সংসারে ফিরে ফিরে আসতে হয়, কোনমতে নিস্তার নাই। ততক্ষণ পরকালও আছে। জ্ঞানলাভ  হলে,ঈশ্বর দর্শন হলে মুক্তি হয়ে যায় ---আর আসতে হয় না। সিধোনো -ধান পুঁতলে আর গাছ হয় না। জ্ঞানাগ্নিতে সিদ্ধ যদি কেহ হয় তাকে নিয়ে আর সৃষ্টির খেলা হয় না। সে সংসার করতে পারে না, তার তো কামিনী-কাঞ্চনে  আসক্তি নাই। সিধোনো -ধান আর ক্ষেতে পুতলে কি হবে?


 বঙ্কিম (হাসিতে হাসিতে )---মহাশয়, তা আগাছাতেও কোন গাছের কাজ হয় না। শ্রীরামকৃষ্ণ ----জ্ঞানী তা বলে আগাছা নয়। যে ঈশ্বর দর্শন করেছে, সে অমৃত ফল লাভ করেছে --- লাউ,কুমড়ো ফল নয়! তার পুনর্জন্ম হয় না। পৃথিবী বল, সূর্যলোক বল, চন্দ্রলোক ----কোন জায়গায় তার আসতে হয় না।


 উপমা ---একদেশী। তুমি তো পন্ডিত, ন্যায় পড় নাই? বাঘের মতো ভয়ানক বললে যে বাঘের মত একটা ভয়ানক ন্যাজ বা হাঁড়ি মুখ থাকবে তা নয়। ( সকলের হাস্য)


 ডিং ডং ..ডিং ডং ...দু'চার মিনিটও হয়নি ছিটকিনি দিয়ে বসেছে অশোক। এরই মধ্যে বেজে উঠল কলিং বেল। বিরক্তির একশেষ।বই হাতে ছিটকিনি খুলতেই অবাক, অলি!

''চলে এলে?''

''সাধে এলাম! সিঁড়ি থেকে নামতেই চটির ফিতেটা গেল ছিঁড়ে। এই সেদিন পাড়ার মুচির কাছ থেকে সারালাম। ভালো লাগে! এখন কী পরে যাই।''

''উপমার একটা পরে যাও।''

''না ওরটা পায়ে লাগে না।''

''তুমি বরং আমার হাওয়াই চটিটাই  দাও।''

চটি দিতেই অলি বেরিয়ে পড়ে। অশোক পাঠে মনোনিবেশ করে...কী নিয়ে কথা হচ্ছিল যেন..হ্যাঁ পরকাল.. শ্রীরামকৃষ্ণ বঙ্কিমচন্দ্রকে বলছিলেন ----


আমি কেশব সেনকে ওই কথা বলেছিলাম। কেশব সেন! মনে মনে  ভাবে অশোক ---সেই বাগ্মী, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যাঁকে ব্রহ্মানন্দ উপাধি দিয়েছিলেন , যিনি 'নববিধান ব্রাহ্মসমাজে'র মাথা, মহারানী ভিক্টোরিয়া যাকে ইংল্যান্ডে নেমন্তন্ন করেছিলেন ,যিনি ' ইন্ডিয়ান মিরর ' কাগজের সম্পাদক, যে-কাগজে তিনি দক্ষিণেশ্বরের সাধু শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন, তারপরেই না কলকাতার শিক্ষিত সমাজ শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে জানতে পারল, এবং ক্রমে তিনি নিরাকার বহ্মের উপাসনা ছেড়ে কালীসাধক শ্রীরামকৃষ্ণের চরণে নিজেকে অঞ্জলি দিলেন ----সেই কেশব সেন! আহা,কী মাহেন্দ্রক্ষণ !


কেশব জিজ্ঞাসা করলে ---মহাশয়,পরকাল কি আছে? আমি না এদিক না ওদিক বললাম!! বললাম ----কুমোররা হাঁড়ি শুকোতে দেয়, তার ভিতর পাকা হাঁড়িও আছে, আবার কাঁচা হাঁড়িও আছে। কখনো গরুটরু এলে হাড়ি মাড়িয়ে যায়। পাকা হাঁড়ি ভেঙে গেলে কুমোর সেগুলোকে ফেলে দেয়। কিন্তু কাঁচা হাড়ি ভেঙে গেলে সেগুলি আবার ঘরে আনে। এনে জল দিয়ে মেখে আবার চাকে দিয়ে নূতুন হাঁড়ি করে, ছাড়ে না। তাই কেশবকে বললুম, যতক্ষণ কাঁচা থাকবে কুমোর ছাড়বে না, যতক্ষণ না জ্ঞান লাভ হয়, যতক্ষণ না ঈশ্বর দর্শন হয়, ততক্ষণ কুমোর আবার চাকে দেবে, ছাড়বে না,অর্থাৎ ফিরে ফিরে এ সংসারে আসতে হবে, নিস্তার নাই। তাঁকে  লাভ করলে তবে মুক্তি হয়, তবে কুমোর ছাড়ে, কেননা, তার দ্বারা মায়ের সৃষ্টির কোন কাজ আসে না জ্ঞানী মায়ার সৃষ্টির কোন কাজ আসে না। জ্ঞানী মায়াকে পার হয়ে গেছে। সে আর  মায়ার সংসারে কি করবে।


তবে কারুকে কারুকে তিনি রেখে দেন, মায়ার সংসারে লোকশিক্ষার জন্য।লোকশিক্ষা দেবার জন্য জ্ঞানী বিদ্যামায়া আশ্রয় করে থাকে। সে তাঁর কাজের জন্য তিনিই রেখে দেন, যেমন শুকদেব,শঙ্করাচার্য।


(বঙ্কিমের প্রতি )---আচ্ছা, আপনি কি বল, মানুষের কর্তব্য কি?

বঙ্কিম (হাসিতে হাসিতে)--- আজ্ঞা, তা যদি বলেন, তাহলে আহার, নিদ্রা ও মৈথুন।


 শ্রীরামকৃষ্ণ (বিরক্ত হইয়া )----তুমি তো বড় ছ্যাচড়া!  যা রাতদিন কর,তাই তোমার মুখে বেরুচ্ছে।লোকে যা খায়, তার ঢেকুর ওঠে,মূলো খেলে মূলোর ঢেকুর ওঠে ডাব খেলে ডাবের ঢেকুর ওঠে। কামিনী- কাঞ্চনের ভিতরে রাতদিন রয়েছো  আর ওই কথাই মুখ দিয়ে বেরুচ্ছে! কেবল বিষয় চিন্তা করলে পাটোয়ারী স্বভাব হয়, মানুষ কপট হয়। ঈশ্বর চিন্তা করলে সরল হয়, ঈশ্বর সাক্ষাৎকার হলে ওকথা কেউ বলবে না।


[ শ্রীযুক্ত বঙ্কিম --শুধু পাণ্ডিত্য ও কামিনী কাঞ্চন]

( বঙ্কিমের প্রতি )---শুধু পাণ্ডিত্য হলে কি হবে, যদি ঈশ্বরচিন্তা না থাকে? যদি বিবেক- বৈরাগ্য না থাকে? পান্ডিত্য কি হবে,যদি কামিনী-কাঞ্চনে মন থাকে?


 চিল শকুনি খুব উঁচুতে উঠে, কিন্তু ভাগাড়ের দিকে কেবল নজর।পন্ডিত অনেক বই শাস্ত্র পড়েছে,শোলক ঝাড়তে পারে, কি বই লিখেছে, কিন্তু মেয়েমানুষে     আসক্ত, টাকা, মান সার বস্তু মনে করেছে, সে আবার পন্ডিত কি? ঈশ্বরে মন না থাকলে,পন্ডিত কি?


 কেউ কেউ মনে করে এরা কেবল ঈশ্বর ঈশ্বর করছে, এরা পাগলা। বেহেড হয়েছে। আমরা কেমন স্যায়না, কেমন সুখ ভোগ করছি, টাকা মান ইন্দ্রিয়সুখ। কাকও  মনে করে আমি বড় স্যায়না, কিন্তু সকালবেলা উঠেই পরের গু খেয়ে মরে।কাক দেখ না কত উড়ুর পুরুড় করে। ভারী স্যায়না!(সকলে স্তব্ধ)


যারা কিন্তু ঈশ্বর চিন্তা করে,বিষয়ে আসক্তি, কামিনী- কাঞ্চনে  ভালবাসা চলে যাবার জন্যে রাতদিন প্রার্থনা করে,তাদের বিষয়রস তেঁতো লাগে, হরিপাদপদ্মের সুধা বই আর কিছু ভালো লাগে না, তাদের স্বভাব যেমন হাঁসের স্বভাব। হাঁসের সুমুখে দুধেজলে দাও, জল ত্যাগ করে দুধ খাবে। আর হাঁসের গতি দেখেছো একদিকে সোজা চলে যাবে।শুদ্ধভক্তের গতিও কেবল ঈশ্বরের দিকে। সে আর কিছু চায় না,তার আর কিছু ভাললাগে না।


(বঙ্কিমের প্রতি কোমলভাবে )---আপনি কিছু মনে করো না।

বঙ্কিম ---- আজ্ঞা,মিষ্টি শুনতে আসিনি।


অশোক চুপ করে ভাবে, একজন পড়াশোনা না-জানা ,প্রায় নিরক্ষর মানুষের পক্ষে এত গভীর উপলব্ধির কথা, বেদ-বেদান্তের এত তত্ত্বকথা জানা কী করে সম্ভব! বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায় কৌতূহলবশত ঠাকুরকে পরীক্ষা করতে এসে শেষ পর্যন্ত নিজেই লেজেগোবরে হচ্ছেন টুকলি করা ছাত্রের মতন। আর বলছেন,আজ্ঞা, মিষ্টি শুনতে আসিনি। তিনি কি শেষ পর্যন্ত নিজেকে সমর্পণ করবেন শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে, যেমনটি করেছেন শ্রীম। দেখা যাক, কী হয়...


তৃতীয় পরিচ্ছেদ

শ্রীরামকৃষ্ণ ও পরোপকার 


শ্রীরামকৃষ্ণ (বঙ্কিমের প্রতি )---কামিনী- কাঞ্চনই  সংসার।এরই নাম মায়া।ঈশ্বরকে দেখতে,চিন্তা করতে দেয় না, দু-একটি ছেলে হলে স্ত্রীর সঙ্গে ভাইবোনের মত থাকতে হয়, আর  তার সঙ্গে সর্বদা ঈশ্বরের কথা কইতে হয়। তাহলে দুজনেরই মন তার দিকে যাবে আর স্ত্রী ধর্মের সহায় হবে। পশুভাব না গেলে ঈশ্বরের আনন্দ আস্বাদন করতে পারে না। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে হয় যাতে প্রভাব যায়। ব্যাকুল হয়ে প্রার্থনা। তিনি অন্তর্যামী, শুনবেনই শুনবেন। যদি আন্তরিক হয়।

"আর 'কাঞ্চন'। আমি পঞ্চবটির তলায় গঙ্গার ধারে বসে 'টাকা মাটি' 'টাকা মাটি' 'মাটিই টাকা' 'টাকাই মাটি' বলে জলে ফেলে দিছলুম!" 

"বঙ্কিম --- টাকা মাটি! মহাশয় চারটা পয়সা থাকলে গরীবকে দেওয়া যায়। টাকা যদি মাটি, তাহলে দয়া পরোপকার করা হবে না ?"


 [ শ্রীযুক্ত বঙ্কিম জগতের উপকার ও কর্মযোগ]


শ্রীরামকৃষ্ণ (বঙ্কিমের প্রতি) --- দয়া! পরোপকার! তোমার সাধ্য কী যে তুমি পরোপকার করো? মানুষের এত নপর-চপর কিন্তু যখন ঘুমোয়, তখন যদি কেউ দাঁড়িয়ে মুখে মুতে দেয়, তো টের পায় না, মুখ ভেসে যায়। তখন অহংকার, অভিমান, দর্প কোথায় যায়?


সংসারী লোকের টাকার দরকার আছে। কেননা মাগ ছেলে আছে। তাদের সঞ্জয় করা দরকার। মাগ ছেলেদের খাওয়াতে হবে। সঞ্চয় করবে না, কেবল পঞ্ছী আউর দরবেশ অর্থাৎ পাখি আর সন্ন্যাসী। কিন্তু পাখির ছানা হলে সে মুখে করে খাবার আনে। তারও তখন সঞ্চয় করতে হয়। তাই সংসারী লোকের টাকার দরকার । পরিবার ভরণপোষণ করতে হয়।


সংসারীব্যক্তি নিষ্কামভাবে যদি কাউকে দান করে সে নিজের উপকারের জন্য, পরোপকারের জন্য নয়। সর্বভূতে হরি আছেন তারই সেবা করা হয়। হরিসেবা হলে নিজেরই উপকার হল, পরোপকার নয়। এই সর্বভূতে হরির সেবা ----শুধু মানুষের নয়, জীবজন্তুর মধ্যেও হরির সেবা , যদি কেউ করে, আর যদি সে মান চায় না, যশ চায় না, মরার পর স্বর্গ চায় না, যাদের সেবা করছে , তাদের কাছ থেকে উল্টে কোন উপকার চায় না, এরূপভাবে যদি সেবা করে , তাহলে তার যথার্থ নিষ্কাম কর্ম, অনাসক্ত কর্ম করা হয়।

এইরূপ নিষ্কাম কর্ম করলে তার নিজের কল্যাণ হয়, এরই নাম কর্মযোগ।এই কর্মযোগও ঈশ্বরলাভের একটি পথ।কিন্তু বড় কঠিন,কলিযুগের পক্ষে নয়।

 আহা! কর্মযোগের কী সহজ সরল ব্যাখ্যা। এমনটি তো আগে কখনও শুনিনি, ভাবে অশোক। সত্যিই, সংসারে নিষ্কাম কর্ম করা বড় কঠিন। মানুষ যে পরোপকার করতে চায়, রাজনৈতিক নেতারা যে উন্নয়নের ঢেড়া পেটান, তাতে মিশে থাকে ক্ষমতার দম্ভ, অহংকার। নিষ্কাম কর্ম, অনাসক্ত কর্ম অত সহজ! দেখি, ঠাকুর আর কী বলেন ----


চতুর্থ পরিচ্ছেদ

আগে বিদ্যা (science)না আগে ঈশ্বর


শ্রীরামকৃষ্ণ (বঙ্কিমের প্রতি--- কেউ কেউ মনে করে শাস্ত্র না পড়লে,বই না পড়লে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না।তারা মনে করে, আগে জগতের বিষয়,জীবের বিষয় জানতে হয়,আগে সায়েন্স পড়তে হয়। (সকলের হাস্য) তারা বলে ঈশ্বরের সৃষ্টি এসব না বুঝলে ঈশ্বরকে জানা যায় না।তুমি কি বল?আগে সায়েন্স না আগে ঈশ্বর?


বঙ্কিম --- হাঁ,আগে পাঁচটা জানতে হয়, জগতের বিষয়। একটু এ দিককার জ্ঞান না হলে, ঈশ্বর জানব কেমন করে? আগে পড়াশোনা করে জানতে হয়।


শ্রীরামকৃষ্ণ ----ওই তোমাদের এক...আগে ঈশ্বর,তারপর সৃষ্টি। তাঁকে লাভ করলে,দরকার হয় তো সবই জানতে পারবে।

আগে ঈশ্বরলাভ,তারপর সৃষ্টি বা অন্য কথা। বাল্মীকিকে  রাম মন্ত্র জপ করতে দেওয়া হল,কিন্তু তাকে বলা হল 'মরা ' 'মরা ' জপ করো।' ম ' মানে ঈশ্বর আর' রা 'মানে জগত। আগে ঈশ্বর তারপর জগত,এককে জানলে সব জানা যায়।১-এর পর যদি পঞ্চাশটা শূন্য থাকে অনেক হয়ে যায়।১কে পুছে ফেললে কিছুই থাকে না। ১কে নিয়েই অনেক।১আগে, তারপর অনেক,আগে ঈশ্বর তারপর জীবজগৎ।

তোমার দরকার ঈশ্বরকে লাভ করা!তুমি অত জগৎ, সৃষ্টি,সায়েন্স,এসব করছ কেন?তোমার আম খাবার দরকার।বাগানে কত শ আমগাছ,কত হাজার ডাল,কত লক্ষ কোটি পাতা, এসব খবরে তোমার কাজ কি? তুই আম খেতে এসেছিস আম খেয়ে যা। এ সংসারে মানুষ এসেছে ভগবানলাভের জন্য।সেটি ভুলে নানা বিষয়ে মন দেওয়া ভালো নয়। আম খেতে এসেছিস আম খেয়েই যা।


বঙ্কিম ----আম পাই কই? 

আহা!কী ব্যাকুল জিজ্ঞাসা। এ জিজ্ঞাসা তো আমারও, ভাবে অশোক। এবার কী বলবেন শ্রী রামকৃষ্ণ ।  মোক্ষম প্রশ্ন, দেখা যাক--- 

শ্রীরামকৃষ্ণ ---তাঁকে  ব্যাকুল হয়ে প্রার্থনা করো।আন্তরিক হলে তিনি শুনবেনই শুনবেন। হয়তো এমন হল  কোনও সৎ সঙ্গ জুটিয়ে দিলেন, যাতে সুবিধা হয়ে গেল। কেউ হয়তো বলে দেয়, এমনি এমনি করো তাহলে ঈশ্বরকে পাবে।


 বঙ্কিম --- কে? গুরু? তিনি আপনি ভালো আম খেয়ে,আমায় খারাপ আম দেন।(হাস্য )


 শ্রীরামকৃষ্ণ--- কেন গো! যার যা পেটে সয়। সকলে কি পলুয়া-কালিয়া খেলে হজম করতে পারে?বাড়িতে মাছ এলে মা সব ছেলেকে পলুয়া-কালিয়া দেন না। যে দুর্বল যার পেটের অসুখ,তাকে মাছের ঝোল দেন, তা বলে কি মা সে ছেলেকে কম ভালোবাসেন?


 ঠিক, মা সব সন্তানকেই সমান ভালবাসেন। আমাদের অবশ্য একটাই সন্তান। ভালবাসা বিন্দুমাত্র ভাগ হয়নি। তাই উপমা যখন 'পলুয়া-কালিয়া' মানে মাংস- বিরিয়ানি, ক্যাডবেরি -চকলেট-চিপস -চানাচুর জাতীয় ফাস্টফুড খাওয়ার বায়না ধরে, তখন অলি মাঝে মাঝে রেগে গিয়ে,  মুখের সামনে থেকে খাবার গুলো ছুড়ে ফেলে,তাতে উপমা হয়তো কান্নাকাটি করে। তার মানে তো এই নয়, যে ওকে আমরা ভালবাসি না। ওর তো এইসব পেটে সয় না। বছর দুয়েক আগে জন্ডিসে ভুগেছে। তেল-মশলা খাওয়া একদমই বারণ।


পঞ্চম পরিচ্ছেদ

শ্রীরামকৃষ্ণ কীর্তনানন্দে


ব্রাহ্মসমাজের শ্রীযুক্ত ত্রৈলোক্য গান করিতেছেন।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কীর্তন একটু শুনিতে শুনিতে হঠাৎ দণ্ডায়মান ও ঈশ্বরাবেশে বাহ্যশুন্য হইলেন।একেবারে অন্তর্মুখ,সমাধিস্থ। দাঁড়াইয়া সমাধিস্থ।সকলেই বেস্টন করিয়া দাঁড়াইলেন।বঙ্কিম ব্যস্ত হইয়া ভিড় ঠেলিয়ে ঠাকুরের কাছে গিয়া একদৃষ্টে দেখিতেছেন। তিনি সমাধি কখনো দেখেন নাই।বঙ্কিমের গা ঘেঁষে দাঁড়ায় অশোক। সে-ও তো এমন দৃশ্য জীবনে দেখেনি। নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে শ্রীরামকৃষ্ণের দিকে।


কিয়ৎক্ষণ পরে একটু বাহ্য হইবার পর ঠাকুর প্রেমে উন্মত্ত হইয়া নৃত্য করিতে লাগিলেন,যেন শ্রীগৌরাঙ্গ শ্রীবাসমন্দিরে ভক্ত সঙ্গে নাচিতেছেন। সে অদ্ভুত নৃত্য! বঙ্কিমদি ইংরেজি পড়া লোকেরা দেখিয়া অবাক।কি আশ্চর্য! এরই নাম কি প্রেমানন্দ?ঈশ্বরকে ভালোবেসে মানুষ কি এত মাতোয়ারা হয়? এইরূপ কান্ডই কি নবদ্বীপে শ্রীগৌরাঙ্গ করেছিলেন?এইরকম করেই কি তিনি নবদ্বীপে আর শ্রীক্ষেত্রে প্রেমের হাট বসিয়েছিলেন? এর ভিতর তো ঢং হতে পারে না। ইনি সর্বত্যাগী,এঁর টাকা মান, কাগজে নাম বেরুনো কিছুই দরকার নাই। তবে এই কি জীবনের উদ্দেশ্য? কোনদিকে মন না দিয়ে ঈশ্বরকে ভালোবাসাই কি জীবনের উদ্দেশ্য?এখন উপায় কি? ইনি বললেন,মার জন্য দিশেহারা হয়ে ব্যাকুল হওয়া, ব্যাকুলতা,ভালোবাসাই উপায়। ভালোবাসাই উদ্দেশ্য। ঠিক ভালোবাসা এলেই দর্শন হয়।


ভক্তরা এইরূপ চিন্তা চিন্তা করিতে লাগিলেন ও সেই অদ্ভুত দেবদুর্লভ নৃত্য ও কীর্তনানন্দ দেখিতে লাগিলেন। সকলেই দণ্ডায়মান --ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের চারিদিকে--- আর একদৃষ্টে তাঁকে দেখিতেছেন।

কীর্তনানন্দে ঠাকুর ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিতেছেন। 'ভাগবত ভক্ত ভগবান 'এই কথা উচ্চারণ করিয়া বলিতেছেন, জ্ঞানী -যোগী -ভক্ত সকলের চরণে প্রণাম।

আবার সকলে তাঁহাকে ঘেরিয়া আসন গ্রহণ করলেন। সকলের সঙ্গে অশোকও বসে পড়ল।


ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

শ্রীযুক্ত বঙ্কিম ও ভক্তিযোগ ---ঈশ্বর প্রেম

বঙ্কিম (ঠাকুরের প্রতি)--- ভক্তি কেমন করে হয়?

শ্রীরামকৃষ্ণ--- ব্যাকুলতা। ছেলে যেমন মার জন্য মাকে না দেখতে পেয়ে দিশেহারা হয়ে কাঁদে, সেই রকম ব্যাকুল হয়ে ঈশ্বরের জন্য কাঁদলে ঈশ্বরকে লাভ করা পর্যন্ত যায়। অরুণোদয় হলে পূর্বদিক লাল হয় তখন বোঝা যায় যে, সূর্যোদয়ের আর দেরি নাই।সেইরূপ যদি কারো ঈশ্বরের জন্য প্রাণ ব্যাকুল হয়েছে দেখা যায়, তখন বেশ বুঝতে পারা যায় যে, এ ব্যক্তির ঈশ্বর লাভের আর বেশী দেরী নাই।

একজন গুরুকে জিজ্ঞাসা করেছিল, মহাশয়,বলে দিন ঈশ্বরকে কেমন করে পাবো। গুরু বললে,এসো আমি তোমায় দেখিয়ে দিচ্ছি । এই বলে তাকে সঙ্গে করে একটি পুকুরের কাছে নিয়ে গেল। দুই জনেই জলে নামলে,এমন সময় হঠাৎ গুরু শিষ্যকে ধরে জলে চুবিয়ে ধরলে। খানিক পরে ছেড়ে দেবার পর শিষ্য মাথা তুলে দাঁড়াল।গুরু জিজ্ঞাসা করলে,তোমার কি রকম বোধ হচ্ছিল? শিষ্য  বললে,প্রাণ যায় যায় বোধ হচ্ছিল, প্রাণ আটু-পাটু করছিল। তখন গুরু বললে,ঈশ্বরের জন্য যখন প্রাণ ঐরূপ আটু-পাটু করবে,তখন জানবে যে,তাঁর সাক্ষাৎকারের দেখি নাই।

তোমায় বলি,উপরে ভাসলে কি হবে? একটু ডুব দাও। গভীর জলের নীচে রত্ন রয়েছে,জলের উপর হাত-পা ছুঁড়লে কি হবে? ঠিক মাণিক ভারী হয়,জলে ভাসে না, তলিয়ে গিয়ে জলের নিচে থাকে। ঠিক মাণিক লাভ করতে গেলে জলের ভেতর ডুব দিতে হয়।

বঙ্কিম -----মহাশয়,কি করি,পেছনে শোলা বাধা আছে। (সকলের হাস্য )ডুবতে দেয় না।


এ কথাটা বঙ্কিম খাসা বলেছেন 'পেছনে শোলা বাঁধা আছে'। আছেই তো, মনোযোগ দিয়ে বইটা পড়ছি, তার মধ্যে কত শোলা পেছনে টানছে...ছিটকানি দাও, উপমার টিফিন পাহারা দাও, অলির চটি এনে দাও... শোলার কি আর অভাব! সংসারীলোক ভাবসাগরে ডুববে কী করে।


এই শালা! বঙ্কিমের কথা তোর খুব মনে ধরেছে না রে? মিটিমিটি হাসছিস। অবাক হয় অশোক, কাকে মৃদু ধমক দিচ্ছেন ঠাকুর! অশোককে? হ্যাঁ,তাই তো! অশোকের দিকেই তো ঠাকুরের অন্তর্ভেদী শান্ত সৌম্য দৃষ্টি!


শ্রীরামকৃষ্ণ বলে চলেছেন--- শোন, তাঁকে স্মরণ করলে সব পাপ কেটে যায়। তাঁর নামেতে কালপাশ কাটে। ডুব দিতে হবে, তা না হলে রত্ন পাওয়া যাবে না। একটা গান শোন ----

ডুব ডুব ডুব রূপ-সাগরে আমার মন।

তলাতল পাতাল খুঁজলে পাবি রে প্রেমরত্নধন।।


ঠাকুর তাঁহার সেই দেবদুর্লভ মধুর কন্ঠে গানটি গাইলেন। সভাসুদ্ধ লোক আকৃষ্ট হইয়া একমনে এই গান শুনিতে লাগিলেন।গান সমাপ্ত হইলে আবার কথা আরম্ভ হইল।

 শ্রীরামকৃষ্ণ (বঙ্কিমের প্রতি)---- কেউ কেউ ডুব দিতে চায় না। তাঁরা বলে,ঈশ্বর ঈশ্বর করে বাড়াবাড়ি করে শেষকালে কি পাগল হয়ে যাব? যারা ঈশ্বরের প্রেমে মত্ত, তাদের তারা বলে বেহেড হয়ে গিয়েছে।কিন্তু এই সব লোকে  এটি বোঝে না যে সচ্চিদানন্দ অমৃতের সাগর। তাই বলছি ডুব দাও।কিছু ভয় নেই, ডুবলে অমর হয়।

এইবার বঙ্কিম ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন ---বিদায় গ্রহণ করিবেন। অশোকও ঠাকুরকে প্রণাম করল ।


বঙ্কিম----মহাশয়,যত আহাম্মক আমাকে ঠাওরেছেন তত নয়। 

বঙ্কিম কি সাফাই দিচ্ছেন, তিনি টুকলি করা ছাত্র নন,ভাবে অশোক।


বঙ্কিম----একটি প্রার্থনা আছে ,অনুগ্রহ করে কুটিরে একবার পায়ের ধূলা ----

শ্রীরামকৃষ্ণ -----তা বেশ তো,ঈশ্বরের ইচ্ছা।

বঙ্কিম ----সেখানেও দেখবেন,ভক্ত আছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ ----কি গো! কি রকম সব ভক্ত সেখানে? যারা গোপাল গোপাল,কেশব কেশব বলেছিল,তাদের মত কি? (সকলের হাস্য  )


বঙ্কিম বিদায় গ্রহণ করিলেন।কিন্তু একাগ্র হইয়া কি ভাবিতেছিলেন।ঘরের দরজার কাছে আসিয়া দেখেন, চাদর ফেলিয়া আসিয়াছেন। গায়ে শুধু জামা। একটি বাবু চাদরখানি কুড়াইয়া লইয়া ছুটিয়া আসিল। অশোক তাঁর হাত থেকে চাদরটি নিয়ে বঙ্কিম-এর হাতে তুলে দিল। কিন্তু লক্ষ করল,বঙ্কিম কেমন যেন অন্যমনস্ক, শ্রীরামকৃষ্ণের কথা শোনার পর থেকে কী গভীর চিন্তায় মগ্ন। 

বঙ্কিম কি ভাবিতেছিলেন?


আনমনে এইসব ভাবছে অশোক, ঠিক তখনই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল অলি। দু'হাতে বাজারের দুটো ব্যাগ। ঘেমে-নেয়ে একশা। ' কতবার বলে গেলাম,ছিটকানিটা লাগিয়ে বসো,তা এখনও লাগানোর সময় হয়নি ?'

অলির ঝাঁঝাল প্রশ্ন কানে ঢুকছে না অশোকের। সে তখনও বঙ্কিমের অন্তর্হিত হওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে...তার হাত পা চোখ মুখ পাঁজর ফুসফুস...তখনও ভাসছে কথামৃতের অগাধ জলে।

ব্যাগ দুটো এক হাতে নিয়ে অলি যেই ছিটকানিটা লাগাতে যাবে, অমনি ব্যাগ থেকে ছিটকে পড়ল  কেজি দেড়েক ওজনের এক বড়সড় কাতলা। 

মা'র গলা শুনে পাশের ঘর থেকে দৌড়ে আসে উপমা, '' ওমা, কত বড় মাছ !" দু'হাতে ধরতে যায়,হাত থেকে পিছলে মাছটা লাফ কাটে সোফার কোণায়।

"তুই পারবি না, ব্যাগটা নে, আমি ধরছি ।"

মা মেয়ের দাপাদাপিতে সংবিত ফেরে অশোকের, " এত বড় মাছ আনলে?"

"সব সময় সঞ্চয় করলে হবে ? মাঝে মাঝে পঞ্ছী আউর দরবেশ হতে হয় । আর হ্যাঁ, শোনো, বাজারে ছোট বৌদি-ডিম্পুর সঙ্গে দেখা , ওরা ইভিনিং শোয়ে সিনেমা যাচ্ছে, আমরাও যাব বলেছি,তৈরি থেকো।"

হাততালি দিয়ে ওঠে উপমা। চোখ বড়বড় করে অশোক জানতে চায় 

"কী বই ?"

"বেলা শেষে।"


(আগামী পর্বে )

উপন্যাস * দীপংকর রায়

 



'স্বরবর্ণে'র চতুর্থ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে কবি দীপংকর রায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে '। এই উপন্যাস লেখকের ষোল-সতের বছর বয়সের কালপর্ব থেকে শুরু। যদিও লেখকের জন্ম এপার বাংলায়, কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে থেকেছে ওপার বাংলায়। কাজেই যাতায়াত থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ ছেড়ে চলে আসা আর তারই নাছোড় এক টানাটানির মধ্যে যে জীবনের ক্রমাগত আসা আর যাওয়া ,এই উপন্যাস মূলত তারই এক নির্মম নিষ্ঠুর ভাঙা-গড়ার আশ্চর্য কথোপকথন। ধারাবাহিকভাবে যা আমরা পড়ছি, কবি দীপংকর রায়ের মায়াময় কলমে।



কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে 

পর্ব * ৬   

দীপংকর রায় 


 কালো গরুটা যে এত পরিকল্পনা করে কেনা হয়েছিল, সেও তো স্বাভাবিক না। এখনো সে দুধ দেয় ঠিকই --- কিন্তু পুনরায় তার গাভীন হবার কোনো লক্ষণই দেখা যায় না। যতবারই তাকে সে চেষ্টা করা হয়েছে , সবটাই বিফলে গেছে। সে কোনোভাবেই সেই সম্ভাবনার ডাক ধরে রাখতে পারে নি । 


      যে মানুষটি দু'বেলা তার দুধ দোহাই করতে আসে, সেও মাকে আধা বাংলায় আধা হিন্দিতে বুঝোয় , ইনকো ছোড়ানে হোগা মাইজী ; কিতনা দিন তুমনে ইসকো খিলায়েঙ্গে পিলায়েঙ্গে বলো ঘরসে ?


      মা বলে , হ্যাঁ বাবা, এবারেও যদি একই অবস্থা হয় , তাহলে একটা কিছু ভাবতেই হবে । নাঞ্জিকে তো বলেছি সব কথাই , তাতে ওই তো বলেছে , মাইজী আউর একটো আচ্ছা গাই দে দেঙ্গে আপকো ; 


     সে তা শুনে বলে , হাঁ , ওহি আচ্ছা হোগা, সছবাত ; নেহি তো কিতনা দিন আপনে ইসকো নুকসান মে খিলায়েঙ্গে পিলায়েঙ্গে বলিয়ে না !


       এই সব আলোচনা চলে গোয়ালা সুজিতের সঙ্গে ।

       ওদিকে বাড়তি উপার্জনের স্বপ্নও ঝাপসা।

       অন্যদিকে এই ক' মাসে আমার দিক দিয়েও সেরকম কোনো ভাবনা চিন্তার তোড়জোড় নেই । কিছুদিন হলো বাগান পরিচর্যাতেই দিন কাটছে বেশি । আর কখনো-সখনো ওপাড়ার দিকে ঢুঁ মারা । অর্থাৎ দিদির বাড়ি। বন্ধুবান্ধবদেরা এলে তাদের  সঙ্গে আড্ডা । তারা চলে গেলে সন্ধ্যার পরে শরৎ রচনাবলী না হলে খবরের কাগজ, না হলে বারান্দার কোনাটা তো রয়েছেই ---- মোড়াটা টেনে নিয়ে বসে পড়া । বসে বসে সামনের বাড়ির পেছনের সেই যে ঝাউগাছের সারি ; দাঁড়িয়ে রয়েছে আকাশচুম্বি হয়ে , সেদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আকাশ পাতাল ভাবনায় মন দেওয়া, এই তো সারাদিনের কাজ , এ ছাড়া তো আর কিছু নেই !


       মা বাড়ি থাকলে সবই লক্ষ্য করে। 

       এর বাইরে ওই তো ওইটুকু, গোরুটাকে গুড়ের সরবত খাইয়ে মাঠে বেঁধে দেওয়া । ওইটুকুই , তা ছাড়া আর কি ! 

      তাই দিয়ে কি ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবা হলো কিছু ?

      যদিও আমার মনে হয় আমিও তো ভাবছি অনেক কিছুই ;  ভাবছি না কি? এই তো, যত দিন যাচ্ছে ততই বেশি করে ভাবছি একটা কথাই যেন, নানা চিন্তার মধ্যে ; কীভাবে বাড়িটার  সামগ্রীক চেহারাটা পাল্টানো যেতে পারে খুব সহজ উপায়ে।

 

     যদিও সেরকম কোনো সহজ পথের সন্ধান এখনো পাইনি । আবিষ্কার করেও উঠতে পারিনি।  তাহলে কেনই বা ; কেনই বা এরকম ভাবনাচিন্তা মনের ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছে?  


       কিছুদিন যাবৎ একেবারে যেন আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ভাবছি , এইরকম একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষার পাল্লায় পড়লামই বা কেন!


      প্রতিদিন একটু একটু করে বেশ খানিকটা জায়গা করে নিতে চাইছে সে। সে সবের কারণ খুঁজতে গিয়েও হদিস পাই না কোনো । এই বিষয়টার তাৎপর্য মা'র চোখেও ধরা দিচ্ছে না যে তা না। সেও আমার এইসব ভাবনা চিন্তার কারণ খুঁজতে চাইছে যেন । মনে মনে ভাবছে হয়তো , কেন এতটা উতলা হয়ে উঠছি আমি !হয়তো বুঝতে পারছে। হয়তো, বুঝলেও ঠিক আমার মতো করে ধরতে পারছে না সবটা । তবে এ কথা তো ঠিক , নিজেকে এতটা উতলা করে তুলছিই বা কেন হঠাৎ-ই ?


     যদিও আমি নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন করা শুরু করেছি। কীভাবে একটা পরিবর্তন ঘটানো যায় এই অবস্থার! উত্তরও সেই একটাই। খুব সহজ ভাবে হবার নয়। সেরকম কোনো উপায় তো এখনো তৈরি হয়ে ওঠেনি ! পেরেছি কি তৈরি করতে?

   ‌   তাই এগিয়ে পিছিয়েও এসেছি । ভেবেছি , সহজ পথ যখন নেই তখন টানাহেঁচড়া করে কী আর হবে ? যা হবার তা আপন গতিতেই হয়ে উঠুক ।

     কখনো আবার মনে হয় , শুধু গতির উপরে ছেড়ে দিলে তো হবে না । তাই একটি রবিবার দিন মা'কে নিয়ে সেই নাঞ্জি নামক ব্যক্তিটির খাটালে গিয়ে উপস্থিত হই। নতুন আরেকটি গাই গোরু আনা যায় কিনা সেই ভেবে ।


     কেন জানি না নাঞ্জি ব্যক্তিটির সঙ্গে কথাবার্তা বলে যা মনে হলো------ না , ঠিক মতো করতে পারলে লাভ তো মন্দ নয়!


      তার দেওয়া নতুন সেই গাই গোরুটিকে দেখে আমারও বেশ পছন্দ হলো। মনে হলো ঠিক আছে খানিকটা সময় না হয় বেশিই দেওয়া যাবে এবারে , তাতে যদি সংসারের বাড়তি উপার্জন কিছু হয় , তাহলে সেই দিয়েই পারবো চারদিকের একটু শ্রী ফেরাতে ----- হয়তো ধীরে ধীরে বাইরেটা না হলেও ঘরের ভেতরটার একটা উন্নতিসাধন সম্ভব হতে পারে ; অন্তত দরমার দিয়ে সিলিংটা দেওয়া যেতে পারে। মেঝেটাকে সান করাও যেতে পারে। ঘরের উত্তর কোণের জানালাটারও তো পাল্লা নেই। সেটাও লাগানো যেতে পারে। তারপর আস্তে আস্তে না হয় বারান্দা রান্নাঘরের জানলা দরজার পাল্লাটাল্লা গুলোর কথাও ভাবা যেতে পারে । পায়খানার দরজাটাও তো সেরকম পাকাপোক্ত নেই , ওই তো টিনের দরজা , সেটাকেও অন্তত আর একটু  মজবুত করে তোলা যেতে পারে ! মা আলগা জায়গায় স্নান করে। সূর্য-প্রণাম সারতে সারতে , এরপর নব-গ্রহস্তোত্র ---- পাশের বাড়ির মানুষজন দেখতে পায়। রাস্তার সামনের মানুষজনও যেতে যেতে লক্ষ্য করে দেখেছি । কী জানি , হয়তো মনে মনে হাসাহাসিও করে। এ অঞ্চলে আসেপাশের কয়েকখানা বাড়ি- ঘর- দুয়োরের মধ্যে আমাদের বাড়ির চেহারা যেমন, আর সামনের বাড়ির মাসিমার , তার তো আরো খারাপ অবস্থা । বেড়ার ঘর। যদিও ইদানিং তাঁর বড় ছেলেটি চাকরিবাকরি পেয়ে বেড়ার ঘরের পেছনের দিকটায় , যেদিকটায় আরো খানিকটা সরে গেলে ঝাউবাগান , ঠিক ততখানি না গেলেও সেই বাগান ছুঁয়েই প্রায়, বেড়ার ঘরের ছাঁচ ঘেঁষে পুস্তন গেঁথে তুলেছে পাকা বাড়ি বানাবার জন্যে।

    এ ছাড়া আর সকলেরই পাকা বাড়ি ঘর-দুয়োর । শুধু এই দুটো বাড়িরই দুরাবস্থা বেশি। বাকি সকলেই বর্ষাকালেও তাদের ঘরের ভেতরে বাড়ির ভেতরে বেশ ঝরঝরে টনটনে । রঙচঙে ও চকচকে ।



       নাঞ্জির দেওয়া নতুন গোরু বাছুর এ বাড়িতে পৌঁছোনোর আগেই অসচ্ছল একটি পরিবারে সামান্য একটুখানি আলো ফুটে উঠতে না উঠতেই কত পরিকল্পনায় বুক বাঁধতে লাগলাম ! 

        গোরু বাছুর চলেছে  বাড়ির পথে এক পায়ে  দুই পায়ে দুলে দুলে , আর স্বপ্নেরাও হেঁটে চলেছে যেন এক পায়ে দুই পায়ে --- গোমাতার সাথে সাথে । 

       তারা বাড়িতে পৌঁছলে মা কোথা থেকে নতুন ধান এনে একমুঠো কুলোর উপর ছড়িয়ে দিয়ে তার মুখের সামনে ধরলো। ঘটিতে করে জল এনে তাদের পা ধুইয়ে দিলো । সিং-এর মাথায় বেশ খানিকটা তেল-সিঁদুর মাখিয়ে দেওয়া হলো । তার পরে দু'হাত তুলে প্রণাম করলো তাদের উদ্দেশ্যে।


       স্বপ্ন- আকাঙ্ক্ষারাও ঘুমে জাগরণে আমাকে যেন টেনে নিয়ে চলেছে জীবনের স্বাভাবিক নিয়মে ; কিন্তু তার ভেতরের সেই আমিটা যে কেবলই অন্য দিকে মাঝে মাঝেই  মুখটা ঘোরায় ; মুখ ভার করে থাকে একা একা ! তাকে কী দিয়ে শান্তনা দিই ? 


       তাই কীভাবে যেন আমিও ঢুকে পড়েছি নতুন এই গোধনের কাছে দু'হাত পেতে দাঁড়াতে। মনে মনে যেন বলেছি --- হে গোধন, তুমি বালতি বালতি দুধ দাও , আমি সেই দুধ বিক্রি করে আমাদের এই স্যাঁতসেতে  বাসস্থানটির  একটুখানি পরিবর্তন ঘটাই ।


       বন্ধু সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে । নতুন বাগানে গাছ সেরকম ভালো হলো না। না বুঝে অসময়ে লাগানোর কারণে। নানা পরিচর্যা সত্তেও ঠিক মতো হলো না যেন। এর মধ্যে একদিন কালো গোরুটি দড়ি খুলে সমস্ত রাত বাগানে চরে বেড়িয়েছে । ভোরবেলায় উঠে দেখি সব গাছগুলি খেয়ে-দেয়ে পায়খানা পেচ্ছাপ করে  মাঝ-বাগানে শুয়ে শুয়ে জাবর কাটছে বাছাধন।

     নতুন গ্যাঁদা ফুল গাছের চারা এনে লাগিয়েছিলাম --- সেগুলি ছোটোখাটো ছিল বলে , সেগুলিকে খেতে পারেনি। মাড়িয়ে দিয়েছে। নরম মাটিতে তাদের গেঁথে যেতে দেখে বড় কষ্ট হলো। যতটা পারলাম তাদের মাথাগুলিকে ধরে ধরে সোজা করে তাদের গোড়ায় একটি করে কাঠি গুঁজে দিলাম । গোরুটিকে তার জায়গায় বেঁধে দেবার পরে মনে মনে তার দিকে চেয়ে বললাম , এটা কি করলি রে তুই ? এত দিনের সব কষ্ট একেবারে বিফলে পাঠালি ! এতে তো তোর পেটও ভরলো না , কেন- ই বা করলি এমনটা ! একেবারে সব শেষ করে দিয়ে ভাবলেশহীন হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে জাবর কাটছিস ! 

     সে যেন মনে মনে বলছে, কী আর এমন করেছি তাই বলো তো দেখি , ক'দিন হলো দেখছিলাম বেশ লকলক করছিলো ডালিয়া না জিনিয়া কী বলো তোমরা ছাই , ওই তো রজনীগন্ধার গাছগুলো ; তা কী করবো, ছাড়া পেলাম তাই মনের মতো করে খেয়েদেয়ে একটু শুয়ে ছিলাম হাওয়ায়। এই বদ্ধ ঘরটার থেকে একটু মুখপাল্টে নিলাম এই যা ; তাও তোমার জ্বালায় হলো কোই ! আর একটু বেলায় তো উঠতে পারতে ছাই , তাহলে বেশ হতো। যাক গে, যা হয়েছে হয়েছে, বাবা আমার ঘাট হয়েছে। লোভ হয়েছিলো তাই সুযোগ পেয়ে একটু চড়ে নিলাম । মাপ করে দেও বাবা , এই কান মলছি আর ছুটবোও না , খাবোও না যাও, হয়েছে তো ! 


      এদিকে নাঞ্জির কাছ থেকে নানা ভাবে ধার দেনা করে যে লালচে রঙের গাইগোরুটিকে একটি বাছুর সহ এনেছিলাম , সেটিকে একদিন সুজিত গোয়ালা এনে বেঁধে দিয়ে গেল কালো গোরুটির পাশে, তার একটি নতুন নামকরণ করা হলো , লালি । আর তার মেয়ে বাচ্চাটির নাম রাখা হলো , আদুরী । 

      লালি দু'বেলায় প্রচুর দুধ দিতে লাগলো । তা প্রায় আট ন' কিলো । ভগ্নীপতি (অশোকদা) এসে প্রায় দিনই দেখে যেতে লাগলো সেসব । এ বিষয়ে তার আগ্রহের সীমা নেই । নানা পরিকল্পনা করে সে। বলেও সেসব কথা। তার মনে হচ্ছে আরো কয়েকটি গোরু এরকমের কিনে বেশ বড়সড় করে একটা ফার্ম মতো করলে কেমন হয় ! 

     আমাদের যে ভাগ্নেটি সম্প্রতি হাঁটা শিখেছে , তাকেও সঙ্গে নিয়ে এসে দিদিও একদিন দেখে গেছে নতুন এই লালিকে । ভাগ্নের নাম রাখা হয়েছে মুনাই ।প্রায় ছুটি-ছাটার দিনগুলিতে ইদানিং দিদিরা এ বাড়িতে আসছে। দিদিরা এলে , সেইসব দিনগুলিতে একটু ভালোমন্দ রান্নাবান্না হয় । মা যতটা পারে ততটা তো আছেই তারপর দিদিও এসে এটা ওটা, মাছটা মাংসটা চিংড়ি মাছটা আলাদা মাছের মাথা দিয়ে মুড়িঘন্টের ডাল হবে এইসব জোগাড় যাতি শুরু হয়ে যায় । মোটামোটি নানা কিছু পছন্দ মতো আয়োজন শুরু হয় মা মেয়ে মিলে । 

         এদিকে নানা আলোচনার মধ্যে ইদানিং দেখছি অশোকদার নজর পড়েছে কীভাবে সমগ্র বাড়ি ঘর দুয়োর সহ ছোটোখাটো একটা পরিবর্তন করা যায়,  তার একটা চেষ্টা। একদিন আমাকে ডেকে নির্দেশ দিল , এই দেখ তো কাকে পাওয়া যায় , সিলিংটা ঠিক মতো তৈরি করে দেবার জন্যে।

      বলি , ঠিক আছে, দ্যাখপানে দেহি শুনে-মেলে ওগের কাছে ; আমি তো ভালো জানিনে , দেহি , কিডা কনে আছে তেমন ; দাঁড়ান দেহি এট্ টু , ভালো করে খোঁজখবর নিতি পারি কিনা দেহি ----


     সে বলে , তা তো হলো , কী দিয়ে দিতে চাচ্ছিস ?

     বললাম , যা আপনি মনে করেন ,আমি আর কি 

কবো , যা কবেন তাই দিয়েই হতি পারে ! 


       ---- ঠিক আছে , বেড়াই দে । তাতে ঘর ঠাণ্ডা হবে খানিকটা যেমন তেমন খরচাটাও কম হবে ; হ্যাঁ শোন , একটা রাজমিস্ত্রিও দেখিস । তাকে ডেকে একটা এস্টিমেট নে তো , কলতলা আর বাথরুম বানাতে কত লাগতে পারে ।

      বললাম , আচ্ছা। দেখপানে । 


       ঠিক আছে বলার সঙ্গে সঙ্গে গলাটা কেন জানি না একটু কেঁপে উঠলো। আমার এই কেঁপে ওঠা গলার আওয়াজটা টের পেয়ে গেছে অশোকদা । সেটা অনুমান করতে পারলাম পরবর্তীতে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে। আর সেই জন্যে বিকেলবেলায় তাদের নেবার জন্যে রিক্সা এলে , সে রিক্সায় উঠে বসে , আমার পিঠে হাত দিয়ে বললো খুব আস্তে আস্তে , ভাবিস না , এগুলো একটা একটা এবারে করতে হবে। তুই লোকজনের কাছে খোঁজ নে, কাদের দিয়ে কি করা যাবে ভালো ভাবে। আমি তো আছি , চিন্তা করিস না একদম ।


 ( চলবে )


প্রবন্ধ * নিমিত দত্ত




কবিতার সন্ধানে

নিমিত দত্ত 


বেশ কিছু দিন ধরে যে প্রশ্নটা আমাকে ভাবাচ্ছে তা হল,আধুনিক কবিতা নামে যে অর্ধপাচ্য মিশ্র পাচনটি আমাদের বৌদ্ধিক সমাজে একটা ওলাওঠার মতো নতুনভাবে স্থানিক ও বৈদ্যুতিক সমাজ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে তার কতটুকু গ্রহনীয় আর কতটুকুই বা বর্জ্যপদার্থ? একটা কথা হয়তো সার্বিকভাবে ধরে নেওয়া যেতেই পারে যে অধুনা বাংলার শিক্ষিত সমাজের একটা বড় অংশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাহিত্যের ও বিশেষ অর্থে কবিতার দাসত্বের থেকে পুরোপুরি মুক্তি নিয়েছে। তাদের দৈনন্দিন কৃতকর্মের মধ্যে নেটফ্লিক্স ও ফেসবুক যেভাবে দাগা বসিয়েছে সেইভাবে শ্রীজাত বা পিনাকী ঠাকুর হামাগুড়ি মারতেই পারেনি। কিন্তু প্রথমেই যে প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেছি আবার ঘুরে ফিরে সেখানেই আসতে হচ্ছে অর্থাৎ সার্থক কবিতার অন্তস্থল এত বেশি কন্টকিত ও দুর্ঘট হয়ে উঠলো কি উপায়ে? 


এই প্রসঙ্গে আমার একটি ব্যক্তিগত থিওরি আছে,,,, আমাদের পুর্বপুরুষ কবিদের অধিকাংশ এক স্বতঃস্ফূর্ত সাধন প্রচেষ্টায় একদিন তারা কাব্য সরস্বতীর বরপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। এভাবেই সৃষ্টি হয়েছিল এমন গুটিকয়েক কবি যাদের এখন আমরা প্রাজ্ঞ মনীষা হিসাবেই ধরতে পারি। সেই বৃত্তের বাইরের অনেক কবিতাপ্রেমী কিংবা কবিতা যশোলিপ্সু কবি ছিলেন যারা আজ কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছেন।( উদাহরণ স্বরুপ তাদের দুচারজন এর নাম  না হয় উল্লেখ নাই করলাম) 


ঠিক  সেই একই রকমভাবে আমাদের যুগেও বেশ কিছু ফাকিবাজ কবিকুলের সৃষ্টি হয়েছে। তারই ফল স্বরুপ আজকের দিনের অধিকাংশ কবির সৃষ্টির মধ্যে সাহিত্যের ধন সত্যিই বড় বিরল। এক্ষেত্রে যদি একটা তুল্যমূল্য বিচারের পথে যেতে চাই তবে লক্ষ্য করবো বিনয় মজুমদার বা মনীন্দ্র গুপ্তের মতো উচ্চকোটির কাব্যস্রষ্টার মধ্যে সব সময় যে তিন সাহিত্যের মহাগুন ফুটে ওঠে এখনকার ভুইফোড় অনেক কবির কবিতায় তা অমিল। যেমন রাজনীতি ও মানুষ ; সমাজ ও তার সাম্প্রতিক মনস্তত্ত্ব সেইসাথে ইতিহাসবোধ বা কালচেতনা। সার্বিকভাবে এই তিন ধারার ত্রিবেণী সঙ্গমে নিষ্কাশিত হয় এক কাব্যিক সুষমা নামক পুন্যতোয়া নদীর। 


প্রকৃত কবির কলমের কবিতা ও  বহুপ্রজননক্ষম কবির কবিতায় কোনো তুলনায় চলে না। নমুনা হিসেবে রবীন্দ্রনাথের সহজপাঠের শিশুপাঠ্য থেকেই দুই একটা উদ্ধৃত করা যাক,,, রাম বনে ফুল পারে। গায়ে তার লাল শাল। লাল ফুল তোলে। নীল ফুল তোলে।,, " ইত্যাদি। যেহেতু এটা একটা শিশুসুলভ বই তাই কবি স্বাভাবিকভাবেই শিশু মনের সহজ গতির সাথে মিল রেখেই একটা  বর্ননাত্মক ভঙ্গিমায়  বহির্বিশ্বের সাথে কথা সাহিত্যের সংযোগ প্রয়াস করেছেন মাত্র।  বিদ্বোৎজন মাত্রেই স্বীকার করবেন  ভাব ও ভাষার ক্ষেত্রে একটা প্রাথমিক শিক্ষার গ্রন্থের জন্যে এইটুকুই যথেষ্ট। কিন্তু মজার ব্যাপার শুধু এইটুকুন শিখেই আজকের কবিতা-লেখক কবি যশোপ্রার্থী হতে চান। রসিকজন একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবেন যুগের যন্ত্রণা ও জটিলতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভাষাসাহিত্য এবং ভাষাকবিতার অনেক বাকবদল ঘটে গেছে। এখনকার কবিতা গতিশীলতায় ও রুপকধর্মীতায় অনেকটাই সেজে উঠেছে। এই প্রাথমিক গুনাবলীর সাথে সাথে আধুনিক যুগের একজন সার্থক কবির কবিতায় এই সময় এর যুগ যন্ত্রণার ও মানবিক বৈকল্যের পদচিহ্ন যেন অবশ্যই সঠিকভাবে ফুটে ওঠে,তাতেও কবিকে সচেতন থাকতে হবে। যেমন সুনীল কুমার মোদকের এই কবিতা,,,, 

"অভিযাত্রা",,,

অবসরে যাবো কটা মাস বাকি / সবাই নিজের নিজের খুজে নিয়েছে আশ্রয় / আমিই এক নন্দগোপাল, / রাধা নেই বাশিটিও কি আছে? /তবু খুজে ফিরি কদমের গাছ।

সন্ধ্যে হলেই নেশাগ্রস্থ চাঁদ /আমাকে নিয়ে যায় তরলের অভিযাত্রায়। "

এবার উপরের কবিতায় একটু মনোনিবেশ করুন। নিজে নিজে একান্তে ভাবতে গেলেই দেখুন সবটুকু না হলেও কবি কিন্ত বেশ মুন্সীয়ানার সাথেই কবিতার এই কয়েকটি চরণেই নিজ অভিজ্ঞতার নির্যাসমিশ্রিত একটা যুগ যন্ত্রণাকে তুলে এনেছেন। 

একটা  সম্পুর্ন মানুষের মতোই ভালো কবিতার মধ্যে কবি হাড়মাংস দিয়ে জলজ্যান্ত একটা কাঠামো খাড়া করে তোলেন। অনেক দোষগুণ নিয়ে ব্রনের দাগ আর থ্যাবড়া নাক নিয়েই সেই কবিতা সুন্দর হতে পারে। পটে আকা ছবির মতো চাকচিক্য আর রংবাহারি তার না হলেও  চলে। এই সময়ের অনেক কবিই নিজস্ব মেধা ও সাধন এর গুণে একটা কালচেতনা ও মনস্তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট সহ ভিন্নধারার কবিতা রচনায় পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। যেমন উদয়শংকর বাগের একটা কবিতা সাময়িকপত্রের থেকে উদ্ধার করা যায়----- 


"দরজা "

জানালার পাশে এসে দাড়িয়ে / কথা বলো কেন? /জানালা দিয়ে পুরো আকাশ দেখা যায় না / দরজা খুলে বেরিয়ে এসো /কথা বলো,,, 

দেখো, খোলা প্রান্তরে / কেমন নির্মল আকাশ মিশে গেছে। "


এইভাবে কবি যেটুকু দেখেছেন ও বুঝেছেন বাস্তবতার সাথে কোভিড মহামারী উত্তীর্ণ একটা নতুন জগতের সবচেয়ে দরকারী কথাটাই তার নিজস্ব মেধা মিশিয়ে সহজ সুন্দর ভঙ্গিমায় উচ্চারণ করেছেন। আর সেইকারনেই এইসব শব্দগুচ্ছ সাধারণ বিবরনমুলক গদ্যের সীমানা ছাড়িয়ে অনন্ত কাব্যিক আকাশে ঊড়ান দিতে পেরেছে। 

ঠিক এইভাবে মল্লিকা সেনগুপ্ত,অলোক সরকার, শঙখ ঘোষ,উতপল বসু, কবিতা সিংহ, অমিত কাশ্যপ, একরাম আলি, অজিত বাইরি,শ্যামলকান্তি দাস,  নাসের হোসেন প্রভৃতি অনেকের কবিতারই উল্লেখ করা যায়। বাহল্যবশত তা স্থগিত রাখলাম।


উপসংহারে  আবার যদি কবিগুরুর সহজপাঠেই ফিরে যাই এবং জিজ্ঞাসুভাবে একগুচ্ছ প্রশ্ন করা যায়,,, ১) রাম বনে কেন ফুল পারে? ২)এই উৎপাটিত হবার সময় ফুলের মনোভাবটি কি? ৩)রামের ও ফুলের মধ্যে কি একটা পারস্পরিক শত্রুতার সৃষ্টি হচ্ছে? ৪)আবার পারিপার্শ্বিক বিশ্ব রাম ও ফুলের বিষয় নিয়ে কি মনোভাব পোষণ করে এই মুহুর্তে এইসব নানাধরণের প্রশ্নের উত্তর যদি কোনো একটা রুপকভাষার মাধ্যমে ইশারাধর্মী শব্দ বুননে পারদর্শী কোনো এক আধুনিক কবির কবিতায় জারিত হয়ে উঠতো,, হয়তো বা সেটা খুবই সার্থক ও যুগোপযোগী হত।রাম ও ফুলের আশ্রয়ে একটা নতুন আলো - আধারি সম্ভাবনাময় কবিতায় উত্তীর্ণ হতে পারতাম আমরা। যেমন আবার সেই পাঠের সহজতায় ফিরে যাই,,, 


"কাল ছিল ডাল খালি /আজ ফুলে যায় ভরে, 

বল দেখি তুই মালি / হয় তা কেমন করে?,,,,


ভাষা অতি তরল, তবুও  কবি এখানে বিশ্বজগতের অপার রহস্যের প্রতি অপাপবিদ্ধ শিশুর মানসিক বিকাশধর্মীতা যে কোতুকে তুলে ধরেন, তা  এক কথায় অনবদ্য। শিশুর কৌতুহলপুর্ন চাহনিকে জগতের সাথে যেভাবে মিলিয়েছেন তাতেই একটা কাব্যিক সুষমা ছড়িয়ে পড়ছে বহুদূর।


**********************************************************************************************



নিমিত দত্ত 

 জন্ম ১৯৭৬ সালে, বসতবাড়ি শ্রীরামপুর।পিতা নিতাই চন্দ্র দত্ত ও মা বেলা রাণি দত্ত। শৈশব থেকেই সাহিত্যের প্রতি গভীর আগ্রহ। রবীন্দ্রনাথ, শরত,বিভুতি মানিকের থেকে শুরু তারপর  আলবেয়র কামু  বা ফ্রাঞ্জ কাফকা ইত্যাদি।   স্কুলের ম্যাগাজিন ( দোয়ালা) হাতেখড়ি। তারপর স্থানীয় ও কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি (অভিনব অগ্রনী/ শিশুমেলা /আম আদমি /শরতশশী / কিশোর বিজ্ঞান)  ইংরেজি সাম্মানিক স্নাতক ডিগ্রি ও বিএড করে ২০০৫ থেকে বীরভূমের গ্রামের স্কুলে শিক্ষাকার্যে লিপ্ত।এখন হুগলি জেলায় স্থানান্তর।   শিশুসাহিত্য, লৌকিক সংস্কৃতি ও অনুবাদ সাহিত্য রচনায় বেশি আগ্রহ। অবসরে গ্রন্থপাঠ, ভ্রমণ ও বিভিন্ন চলচ্চিত্র, নাটক দেখার শখ।