ধুলোর সিংহাসন
দেবাশিস সাহা
প র্ব -- নয়
[ পূর্বানুষঙ্গ: অলির সামান্য জ্বর সর্দি কাশি। অলি যতটা না, অশোক তার চেয়ে দ্বিগুণ উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। ডাক্তার দেখানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সংসারের দুরবস্থার কথা ভেবে, অলি সে প্রসঙ্গ কৌশলে এড়িয়ে যায়। ইতিমধ্যে ভাগনা নিলু আসে,খুশির খবর নিয়ে। ওর নেট কোয়ালিফাই করার খবর শোনায় । শুনে আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে অশোক। রাতে নিলুদের বাড়ি থেকে নেমন্তন্ন খেয়ে এসে লেখার টেবিলে বসে। কবিতার পরিবর্তে নিলুর কঠিন কঠোর জীবন সংগ্রামের কথা লেখে ডায়েরিতে। তারপর....]

ডিসেম্বরের শেষাশেষি।ইদানীং কোচিং-এর চাপটা অনেক কম। স্কুলের পরীক্ষাগুলো শেষ হয়েছে। ওরা কেউ আর পড়তে আসছে না। কলেজের দু'-একটা ক্লাস নিতে হয় শুধু। দু’দিন বাদে বড়দিন। ওরাও ছুটি ছুটি করছে। শীতের এই সময়টা সবাই পিকনিক বা পছন্দমত জায়গায় ঘুরতে যায়।ক’দিন আবহাওয়াটাও মনোরম। জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়েছে। রোদ ঝলমলে সকাল-দুপুর। অবশ্য যদি না হঠাৎ উদয় হওয়া নিম্নচাপের ভ্রুকুটি চোখ রাঙায়, আবহাওয়ার পূর্বাভাস কিন্তু সে রকমটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে। তা দিক। তাই বলে এই সময়টা কেউ গৃহবন্দি থাকতে চায় না। ওদেরকেও তাই অশোক ছুটি দিয়েছে। নতুন ক্লাস শুরু হবে জানুয়ারির ৫ তারিখ থেকে, বোর্ডে ইতিমধ্যেই নোটিশ টাঙিয়ে দিয়েছে । এই সময়টা পছন্দের দু'চারটে বই পড়বে। ভাগনা নিলু প্রথমবার স্কলারশিপের টাকা পেয়ে অশোককে A.L.Basham এর 'The Wonder That Was India ' এবং অলিকে Abul kalam এর 'Wings of Fire' বই দুটো গিফট করেছিল। কোনওটাই পড়া হয়নি। অসমাপ্ত রয়ে গেছে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত-এর শেষ ক'টা অধ্যায়ও। কবে বইটা কিনেছিল। উদ্বোধন থেকে। কোনও এক বইমেলায়। তখন একটানা পড়েছিল। একটা ঘোরের মধ্যে। প্রায় নাওয়া-খাওয়া ভুলে। এ ক'দিনে সব শেষ করতে হবে। সকালে পড়ার টেবিলে বসে, এমন একটা সংকল্প মনে মনে তৈরি করে অশোক।এই মুহূর্তে না-পড়া কথামৃতের সেই অংশটা খুলে পড়তে শুরু করেছে ------
শ্রীরামকৃষ্ণ ও শ্রীযুক্ত বঙ্কিম
প্রথম পরিচ্ছেদ
[ শ্রীযুক্ত অধরলাল সেনের বাড়িতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্তসঙ্গে কীর্তনানন্দ ও শ্রীযুক্ত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ইত্যাদির সঙ্গে কথোপকথন ]
আজ ঠাকুর অধরের বাড়িতে আসিআছেন,২২ শে অগ্রহায়ণ, কৃষ্ণা চতুর্থী তিথি, শনিবার, ইংরেজি ৬ই ডিসেম্বর, ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দ। ঠাকুর পুষ্যানক্ষত্রে আগমন করিয়াছেন।
অধর ভারী ভক্ত, তিনি ডেপুটী ম্যাজিস্ট্রেট। বয়:ক্রম ২৯/৩০ বৎসর হইবে। ঠাকুর তাহাকে অতিশয় ভালোবাসেন। অধরেরও কি ভক্তি! সমস্ত দিন অফিসের খাটুনির পর, মুখে ও হাতে একটু জল দিয়াই প্রায় প্রত্যহই সন্ধ্যার সময় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করিতে যাইতেন। তাহার বাড়ি শোভাবাজার বেনেটোলা। সেখান হইতে দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে ঠাকুরের কাছে গাড়ি করিয়া যাইতেন। এইরূপ প্রত্যহ প্রায় দুই টাকা গাড়ি ভাড়া দিতেন। কেবল ঠাকুরকে দর্শন করবেন, এই আনন্দ।
অধর ঠাকুরকে প্রায়ই শোভাবাজারের বাড়িতে লইয়া যাইতেন। ঠাকুর আসিলে তথায় উৎসব পড়িয়া যাইত। ঠাকুর ও ভক্তদের লইয়া অধর খুব আনন্দ করিতেন ও নানারূপে তাহাদিগকে পরিতোষ করিয়া খাওয়াইতেন।
একদিন ঠাকুর তাঁহার বাড়িতে গিয়াছেন। অধর বলিলেন, আপনি অনেকদিন এ বাড়িতে আসেন নাই, ঘর মলিন হইয়াছিল, যেন কিরকম গন্ধ হইয়াছিল, আজ দেখুন, ঘরের কেমন শোভা হয়েছে! আর কেমন একটি সুগন্ধ হইয়াছে। আমি আজ ঈশ্বরকে ভারি ডেকেছিলাম। এমনকি চোখ দিয়ে জল পড়েছিল। ঠাকুর বলিলেন, "বল কি গো! " ও অধরের দিকে সস্নেহে তাকাইয়া হাসিতে লাগিলেন।
আজও উৎসব হইবে। ঠাকুরও আনন্দময় ও ভক্তেরা আনন্দে পরিপূর্ণ। কেননা যেখানে ঠাকুর উপস্থিত, সেখানে ঈশ্বরের কথা বৈ আর কোন কথাও হইবে না। ভক্তেরা আসিয়াছেন ও ঠাকুরকে দেখিবার জন্য অনেকগুলি নূতন নূতন লোক আসিয়াছে। অধর নিজে ডেপুটী ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি তাঁহার কয়েকটি বন্ধু ডেপুটী ম্যাজিস্ট্রেটকে নিমন্ত্রণ করিয়া আনিয়াছেন। তাঁহারা নিজে ঠাকুরকে দেখিবেন ও বলিবেন, যথার্থ তিনি মহাপুরুষ কিনা।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সহাস্যবদনে ভক্তদের সহিত কথা কহিতেছেন।এমন সময় অধর কয়েকটি বন্ধু লইয়া ঠাকুরের কাছে আসিয়া বসিলেন।
অধর (বঙ্কিমকে দেখাইয়া ঠাকুরের প্রতি )---মহাশয়, ইনি ভারি পন্ডিত, অনেক বই-টই লিখেছেন। আপনাকে দেখতে এসেছেন। ইঁহার নাম বঙ্কিমবাবু।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)--- বঙ্কিম! তুমি আবার কার ভাবে বাকা গো!
বঙ্কিম (হাসিতে হাসিতে)---আর মহাশয়!জুতোর চোটে ( সকলের হাস্য ) সাহেবদের জুতোর চোটে বাঁকা।
এটুকু পড়েই সম্মোহিত অশোক। সরস্বতী অ্যাপার্টমেন্টের তিনতলায় সে আর বসে নেই, অতীত অন্ধকার ঠেলে পৌঁছে গেছে, ১৮৮৪ সালের ৬ ডিসেম্বর, শনিবার দিনটিতে। অধর প্রমুখ ভক্তের সঙ্গে ওই সে-ও বসে আছে শ্রীরামকৃষ্ণ সান্নিধ্যে।কী আশ্চর্য! আজ দিনটাও শনিবার। সব অনুকূল।ওর সমস্ত কৌতূহল, উৎসুক্য এই মুহূর্তে একটি কেন্দ্রবিন্দুতে ঘনীভূত। কী হয়, কোথায় পৌঁছয় এই দুই যুগন্ধর পুরুষের কথোপকথন, বিস্ফারিত চোখ মেলে দেখবে, সমস্ত শ্রবণ একত্র করে কান পেতে শুনবে। একজন সাহিত্যসম্রাট,ইংরাজি ও বাংলা ভাষার পাইওনিয়ার। তাঁর প্রথম উপন্যাস 'দুর্গেশনন্দিনী'(১৮৬৫ ) প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই বাংলা সাহিত্যে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে।পরের বছরই বেরিয়েছে 'কপালকুণ্ডলা'। তারপর একে একে মৃণালিনী, যুগলাঙ্গুরীয়,চন্দ্রশেখর,রাজসিংহ,আনন্দমঠ ইত্যাদি উপন্যাস প্রকাশিত হয়ে চলেছে । সম্প্রতি বেরিয়েছে দেবী চৌধুরানী (১৮৮৪) বইটি। আর অপরজন কামারপুকুরের তথাকথিত 'মূর্খ ' ক্লাস টু থ্রি বিদ্যার শ্রীরামকৃষ্ণ। 'চাল কলা বাঁধা বিদ্যে' যাঁর ভালো লাগেনি। লাটে তুলেছেন প্রথাগত পড়াশোনা। বছর ২৬ হল, তিনি রানি রাসমণি প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণেশ্বরের এই কালীবাড়িতে অবস্থান করছেন। মা ভবতারিণীর পূজারী হিসাবে। দুই মেরুর দুইজন, মিল শুধু একটা জায়গাতে, দুজনেই 'চট্টোপাধ্যায় ' পদাধিকারী। রুদ্ধশ্বাসে পড়তে থাকে অশোক ----

[ বঙ্কিম ও রাধাকষ্ণ যুগলরূপের ব্যাখ্যা ]
শ্রীরামকৃষ্ণ -----না গো, শ্রীকৃষ্ণ প্রেমে বঙ্কিম হয়েছিলেন। শ্রীমতির প্রেমে ত্রিভঙ্গ হয়েছিলেন কৃষ্ণরূপ এর ব্যাখ্যা কেউ কেউ করে,শ্রীরাধার প্রেমে ত্রিভঙ্গ। কালো কেন জানো? আর চৌদ্দপো অত ছোট কেন? যতক্ষণ ঈশ্বর দূরে, ততক্ষণ কালো দেখায়, সমুদ্রের জল দূর থেকে নীল বর্ণ দেখায় । সমুদ্রের জলের কাছে গেলে ও হাতে করে তুললে আর কালো থাকে না,তখন খুব পরিষ্কার,সাদা.।সূর্য দূরে বলে খুব ছোট দেখায়,কাছে গেলে আর ছোট থাকেনা। ঈশ্বরের স্বরূপ ঠিক জানতে পারলে আর কালোও থাকে না ছোটও থাকেনা।সে অনেক দূরের কথা সমাধিস্থ না হলে হয় না। যতক্ষণ আমি তুমি আছে, ততক্ষণ নাম-রুপও আছে। তারই সব লীলা। আমি তুমি যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ তিনি নানারূপে প্রকাশ হন।
শ্রীকৃষ্ণ পুরুষ, শ্রীমতি তার শক্তি --- আদ্যশক্তি। পুরুষ আর প্রকৃতি। যুগলমূর্তির মানে কি? পুরুষ আর প্রকৃতি অভেদ, তাদের ভেদ নাই। পুরুষ, প্রকৃতি না হলে থাকতে পারে না, প্রকৃতিও পুরুষ না হলে থাকতে পারে না। একটি বললেই আরেকটি তার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে হবে। যেমন অগ্নি আর দাহিকাশক্তি। দাহিকা শক্তি ছাড়া অগ্নিকে ভাবা যায় না। আর অগ্নি ছাড়া দাহিকাশক্তি ভাবা যায় না। তাই যুগল মূর্তিতে শ্রীকৃষ্ণের দৃষ্টি শ্রীমতীর দিকে, ও শ্রীমতীর দৃষ্টি কৃষ্ণের দিকে। শ্রীমতীর গৌর বর্ণ বিদ্যুতের মতো,তাই কৃষ্ণ পীতাম্বর পরেছেন। শ্রীকৃষ্ণের নীল বর্ণ মেঘের মতো, তাই শ্রীমতী নীলাম্বর পরেছেন। আর শ্রীমতী নীলকান্তমণি দিয়ে অঙ্গ সাজিয়েছেন। শ্রীমতীর পায়ে নূপুর, তাই শ্রীকৃষ্ণ নূপুর পরেছেন, অর্থাৎ প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষের অন্তরে বাহিরে মিল।
এই কথাগুলি সমস্ত সাঙ্গ হইল, এমন সময়ে অধরের বঙ্কিমাদি বন্ধুগণ পরস্পর ইংরেজিতে আস্তে আস্তে কথা কহিতে লাগিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ(সহাস্যে বঙ্কিমাদির প্রতি) কি গো। আপনারা ইংরাজিতে কি কথাবার্তা করছো? (সকলের হাস্য )। অশোকও হেসে ওঠে ।'আপনি' - 'তুমি' মিশিয়ে কী এক মধুর কণ্ঠস্বরে কথা বলছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। মনপ্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে।
অধর ---- আজ্ঞে, এই বিষয়ে একটু কথা হচ্ছিল, কৃষ্ণ রূপের ব্যাখ্যার কথা।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে সকলের প্রতি )----একটা কথা মনে পড়ে আমার হাসি পাচ্ছে। শুন,একটা গল্প বলি। একজন নাপিত কামাতে গিয়েছিল।একজন ভদ্রলোককে কামাচ্ছিল। এখন কামাতে কামাতে তার একটু লেগেছিল। আর সে লোকটি ড্যাম (Damn) বলে উঠেছিল। নাপিত কিন্তু ড্যামের মানে জানে না। তখন সে ক্ষুর টুর সব সেখানে রেখে, শীতকাল, জামার আস্তিন গুটিয়ে বলে, তুমি আমায় ড্যাম বললে, এর মানে কি এখন বল। সে লোকটি বললে, আরে তুই কামা না, ওর মানে এমন কিছু নয়, তবে একটু সাবধানে কামাস।নাপিত,সে ছাড়বার পাত্র নয়, সে বলতে লাগল, দেখ ড্যাম মানে যদি ভাল হয়, তাহলে আমি ড্যাম, আমার বাপ ড্যাম, আমার চৌদ্দ পুরুষ ড্যাম। (সকলের হাস্য) আর ড্যাম মানে যদি খারাপ হয়, তাহলে তুমি ড্যাম, তোমার বাবা ড্যাম, তোমার চৌদ্দপুরুষ ড্যাম। (সকলের হাস্য )আর শুধু ড্যাম নয়। ড্যাম ড্যাম ড্যাম ড্যা ড্যাম ড্যাম।(সকলের উচ্চ হাস্য)
'হো: হো: হো: অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল অশোকও। কিচেনে সকালের টিফিন তৈরিতে ব্যস্ত অলি চমকে ওঠে। ইদানীং মানুষটাকে এমন প্রাণখোলা হাসি হাসতে দেখেনি। ব্যাপারটা কী! মাথাটা পুরোপুরিই বিগড়াল নাকি! গ্যাসটা কমিয়ে ছুটে আসে অলি, ' কী গো, অমন পাগলের মতো হাসছ কেন?'
'' হাসছি কেন? তবে শোনো, '' অলির হাত ধরে জোর করে বসাতে চায়।
''আরে দাঁড়াও দাঁড়াও,গ্যাসটা নিভিয়ে আসি, পুড়ে ঝুড়ে যাবে তো সব।''
ফিরে আসতেই, অশোক রসিয়ে রসিয়ে নাপিতের গল্পটা অলিকে ফের পড়ে শোনায় এবং যথারীতি অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।হাসি আর থামতেই চায় না। অলিও হাসে, তবে অশোকের মতো প্রাণখোলা হাসি হাসতে পারে না, কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ, ''সকালেই কথামৃত নিয়ে বসেছ, এদিকে সংসারের বিষামৃতে আমার যে প্রাণ ওষ্ঠগত। যাও, একটু বাজার থেকে ঘুরে আসো। দুপুরে রান্না করবটা কী?''
''প্লিজ অলি, আজ তুমি আমাকে কোথাও যেতে বলো না। দুপুরে তুমি যা দেবে,তাই খাব।''
''রোজ রোজ একঘেয়ে নিরামিষ ভালো লাগে? যাও না,একটু কম পয়সার লটে,বাটা বা তেলাপুইয়া মাছ নিয়ে আসো।''
অলি প্লিজ, শ্রীরামকৃষ্ণের কথার বঙ্কিম কী জবাব দেন...আজ আমাকে পড়তেই হবে। হেব্বি ইন্টারেস্ট লাগছে.।
অলি আর কথা বাড়ায় না। কতদিন বাদে এমন আনন্দে মেতে আছে লোকটা! হাসি তো প্রায় নেই-ই। সারাক্ষণ লোন, না হয় সামনের সিজনের ছাত্রসংখ্য, নয়ত মেয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তা মাথায় চেপেই আছে।না যায়,থাক, টিফিন সেরে ও নিজেই যাবে।
অলি বাজারের দিকে পা বাড়াতেই, ফের ফের চতুর্পার্শ্ব ভুলে অধর-বঙ্কিম-শ্রীরামকৃষ্ণ সকাশে অশোক। নিজের অজান্তেই হাত রাখে বুকে। মনে হয়,বুকের কোন গহীন গভীর থেকে উঠে এসে ওর একান্ত আপন হোমপাখিটিও যেন কান পেতে শুনছে, বঙ্কিমচন্দ্র ও শ্রীরামকৃষ্ণের কথোপকথন -------
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও প্রচারকার্য
সকলের হাস্য থামলে পর, বঙ্কিম আবার কথা আরম্ভ করিলেন। বঙ্কিম ---- মহাশয়, আপনি প্রচার করেন না কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাসিতে হাসিতে) প্রচার! ওগুলো অভিমানের কথা। মানুষ তো ক্ষুদ্র জীব। প্রচার তিনিই করবেন, যিনি চন্দ্র-সূর্য সৃষ্টি করে এই জগত প্রকাশ করেছেন। প্রচার করা কি সামান্য কথা? তিনি সাক্ষাৎকার হয়ে আদেশ না দিলে প্রচার হয় না।তবে হবে না কেন? আদেশ হয়নি তুমি বকে যাচ্ছ, ওই দুদিন লোকে শুনবে তারপর ভুলে যাবে।যেমন একটা হুজুগ আর কি! যতক্ষণ তুমি বলবে ততক্ষণ লোকে বলবে, আহা ইনি বেশ বলেছেন। তুমি থামবে,তারপর কোথাও কিছুই নাই!
যতক্ষণ দুধের নীচে আগুনের জ্বাল রয়েছে,ততক্ষণ দুধটা ফোঁস করে ফুলে ওঠে। জ্বাল টেনে নিলে আর দুধও যেমন তেমনি! কমে গেল।
আর সাধন করে নিজের শক্তি বাড়াতে হয়। তা না হলে প্রচার হয় না। 'আপনি শুতে স্থান পায় না, শংকরাকে ডাকে।' আপনারই শোবার জায়গা নাই, আবার ডাকে ওরে শংকরা আয়, আমার কাছে শুবি আয়। (হাস্য )
ওদেশে হালদার পুকুরের পাড়ে রোজ বাহ্যি করে যেত, লোকে সকালে এসে দেখে গালাগালি দিত। লোক গালাগালি দেয়, তবু বাহ্যি বন্ধ হয় না। শেষে পাড়ার লোক দরখাস্ত করে কোম্পানিকে জানালে। তারা একটি নোটিশ মেরে দিলে--'এখানে বাহ্যি, প্রস্রাব করিও না, তা করিলে শাস্তি পাইবে।' তখন একেবারে সব বন্ধ। আর কোনো গোলযোগ নাই। কোম্পানির হুকুম ---সকলের মানতে হবে।
তেমনি ঈশ্বর সাক্ষাৎকার হয়ে যদি আদেশ দেন, তবেই প্রচার হয়, লোকশিক্ষা হয়, তা না হলে কে তোমার কথা শুনবে? এই কথাগুলি সকলে গম্ভীরভাবে স্থির হইয়া শুনিতে লাগিলেন।
তাহলে শ্রীচৈতন্য, গুরু নানক, ভক্ত কবীর ---এঁরা প্রচারের আদেশ পেয়েছিলেন, অধরের পাশে বসে শ্রীরামকৃষ্ণের উদ্দেশে যেই প্রশ্নটা করতে যাবে অশোক ,অমনি মাথায় টোকা মেরে অলি ডাকল, ''শোনো আমি বাজারে যাচ্ছি। উপমা উঠলে টিফিনটা খেয়ে নিতে বলবে। কিচেনে ঢাকা দাওয়া রইল।''
'' আচ্ছা। ''
''আর দরজাটা দিয়ে বসো। চোর-ডাকাত ঢুকলেও তো টের পাবে না, এত মজে আছ।''
''দিচ্ছি।'' ঝট করে ছিটকিনিটা লাগিয়ে ফের বইয়ে ডুব দেয় অশোক …
শ্রীযুক্ত বঙ্কিম ও পরকাল [Life after Death---argument from analogy]
শ্রীরামকৃষ্ণ (বঙ্কিমের প্রতি )---আচ্ছা,আপনি তো খুব পণ্ডিত, আর কত বই লিখেছ, আপনি কি বলো, মানুষের কর্তব্য কি? কি সঙ্গে যাবে? পরকাল তো আছে?
বঙ্কিম--- পরকাল! সে আবার কি?
শ্রীরামকৃষ্ণ ---- হাঁ,জ্ঞানের পর আর অন্যলোকে যেতে হয় না, পুনর্জন্ম হয় না। কিন্তু যতক্ষণ না জ্ঞান হয়, ঈশ্বর লাভ হয়, ততক্ষণ সংসারে ফিরে ফিরে আসতে হয়, কোনমতে নিস্তার নাই। ততক্ষণ পরকালও আছে। জ্ঞানলাভ হলে,ঈশ্বর দর্শন হলে মুক্তি হয়ে যায় ---আর আসতে হয় না। সিধোনো -ধান পুঁতলে আর গাছ হয় না। জ্ঞানাগ্নিতে সিদ্ধ যদি কেহ হয় তাকে নিয়ে আর সৃষ্টির খেলা হয় না। সে সংসার করতে পারে না, তার তো কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি নাই। সিধোনো -ধান আর ক্ষেতে পুতলে কি হবে?
বঙ্কিম (হাসিতে হাসিতে )---মহাশয়, তা আগাছাতেও কোন গাছের কাজ হয় না। শ্রীরামকৃষ্ণ ----জ্ঞানী তা বলে আগাছা নয়। যে ঈশ্বর দর্শন করেছে, সে অমৃত ফল লাভ করেছে --- লাউ,কুমড়ো ফল নয়! তার পুনর্জন্ম হয় না। পৃথিবী বল, সূর্যলোক বল, চন্দ্রলোক ----কোন জায়গায় তার আসতে হয় না।
উপমা ---একদেশী। তুমি তো পন্ডিত, ন্যায় পড় নাই? বাঘের মতো ভয়ানক বললে যে বাঘের মত একটা ভয়ানক ন্যাজ বা হাঁড়ি মুখ থাকবে তা নয়। ( সকলের হাস্য)
ডিং ডং ..ডিং ডং ...দু'চার মিনিটও হয়নি ছিটকিনি দিয়ে বসেছে অশোক। এরই মধ্যে বেজে উঠল কলিং বেল। বিরক্তির একশেষ।বই হাতে ছিটকিনি খুলতেই অবাক, অলি!
''চলে এলে?''
''সাধে এলাম! সিঁড়ি থেকে নামতেই চটির ফিতেটা গেল ছিঁড়ে। এই সেদিন পাড়ার মুচির কাছ থেকে সারালাম। ভালো লাগে! এখন কী পরে যাই।''
''উপমার একটা পরে যাও।''
''না ওরটা পায়ে লাগে না।''
''তুমি বরং আমার হাওয়াই চটিটাই দাও।''
চটি দিতেই অলি বেরিয়ে পড়ে। অশোক পাঠে মনোনিবেশ করে...কী নিয়ে কথা হচ্ছিল যেন..হ্যাঁ পরকাল.. শ্রীরামকৃষ্ণ বঙ্কিমচন্দ্রকে বলছিলেন ----
আমি কেশব সেনকে ওই কথা বলেছিলাম। কেশব সেন! মনে মনে ভাবে অশোক ---সেই বাগ্মী, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যাঁকে ব্রহ্মানন্দ উপাধি দিয়েছিলেন , যিনি 'নববিধান ব্রাহ্মসমাজে'র মাথা, মহারানী ভিক্টোরিয়া যাকে ইংল্যান্ডে নেমন্তন্ন করেছিলেন ,যিনি ' ইন্ডিয়ান মিরর ' কাগজের সম্পাদক, যে-কাগজে তিনি দক্ষিণেশ্বরের সাধু শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন, তারপরেই না কলকাতার শিক্ষিত সমাজ শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে জানতে পারল, এবং ক্রমে তিনি নিরাকার বহ্মের উপাসনা ছেড়ে কালীসাধক শ্রীরামকৃষ্ণের চরণে নিজেকে অঞ্জলি দিলেন ----সেই কেশব সেন! আহা,কী মাহেন্দ্রক্ষণ !
কেশব জিজ্ঞাসা করলে ---মহাশয়,পরকাল কি আছে? আমি না এদিক না ওদিক বললাম!! বললাম ----কুমোররা হাঁড়ি শুকোতে দেয়, তার ভিতর পাকা হাঁড়িও আছে, আবার কাঁচা হাঁড়িও আছে। কখনো গরুটরু এলে হাড়ি মাড়িয়ে যায়। পাকা হাঁড়ি ভেঙে গেলে কুমোর সেগুলোকে ফেলে দেয়। কিন্তু কাঁচা হাড়ি ভেঙে গেলে সেগুলি আবার ঘরে আনে। এনে জল দিয়ে মেখে আবার চাকে দিয়ে নূতুন হাঁড়ি করে, ছাড়ে না। তাই কেশবকে বললুম, যতক্ষণ কাঁচা থাকবে কুমোর ছাড়বে না, যতক্ষণ না জ্ঞান লাভ হয়, যতক্ষণ না ঈশ্বর দর্শন হয়, ততক্ষণ কুমোর আবার চাকে দেবে, ছাড়বে না,অর্থাৎ ফিরে ফিরে এ সংসারে আসতে হবে, নিস্তার নাই। তাঁকে লাভ করলে তবে মুক্তি হয়, তবে কুমোর ছাড়ে, কেননা, তার দ্বারা মায়ের সৃষ্টির কোন কাজ আসে না জ্ঞানী মায়ার সৃষ্টির কোন কাজ আসে না। জ্ঞানী মায়াকে পার হয়ে গেছে। সে আর মায়ার সংসারে কি করবে।
তবে কারুকে কারুকে তিনি রেখে দেন, মায়ার সংসারে লোকশিক্ষার জন্য।লোকশিক্ষা দেবার জন্য জ্ঞানী বিদ্যামায়া আশ্রয় করে থাকে। সে তাঁর কাজের জন্য তিনিই রেখে দেন, যেমন শুকদেব,শঙ্করাচার্য।
(বঙ্কিমের প্রতি )---আচ্ছা, আপনি কি বল, মানুষের কর্তব্য কি?
বঙ্কিম (হাসিতে হাসিতে)--- আজ্ঞা, তা যদি বলেন, তাহলে আহার, নিদ্রা ও মৈথুন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (বিরক্ত হইয়া )----তুমি তো বড় ছ্যাচড়া! যা রাতদিন কর,তাই তোমার মুখে বেরুচ্ছে।লোকে যা খায়, তার ঢেকুর ওঠে,মূলো খেলে মূলোর ঢেকুর ওঠে ডাব খেলে ডাবের ঢেকুর ওঠে। কামিনী- কাঞ্চনের ভিতরে রাতদিন রয়েছো আর ওই কথাই মুখ দিয়ে বেরুচ্ছে! কেবল বিষয় চিন্তা করলে পাটোয়ারী স্বভাব হয়, মানুষ কপট হয়। ঈশ্বর চিন্তা করলে সরল হয়, ঈশ্বর সাক্ষাৎকার হলে ওকথা কেউ বলবে না।
[ শ্রীযুক্ত বঙ্কিম --শুধু পাণ্ডিত্য ও কামিনী কাঞ্চন]
( বঙ্কিমের প্রতি )---শুধু পাণ্ডিত্য হলে কি হবে, যদি ঈশ্বরচিন্তা না থাকে? যদি বিবেক- বৈরাগ্য না থাকে? পান্ডিত্য কি হবে,যদি কামিনী-কাঞ্চনে মন থাকে?
চিল শকুনি খুব উঁচুতে উঠে, কিন্তু ভাগাড়ের দিকে কেবল নজর।পন্ডিত অনেক বই শাস্ত্র পড়েছে,শোলক ঝাড়তে পারে, কি বই লিখেছে, কিন্তু মেয়েমানুষে আসক্ত, টাকা, মান সার বস্তু মনে করেছে, সে আবার পন্ডিত কি? ঈশ্বরে মন না থাকলে,পন্ডিত কি?
কেউ কেউ মনে করে এরা কেবল ঈশ্বর ঈশ্বর করছে, এরা পাগলা। বেহেড হয়েছে। আমরা কেমন স্যায়না, কেমন সুখ ভোগ করছি, টাকা মান ইন্দ্রিয়সুখ। কাকও মনে করে আমি বড় স্যায়না, কিন্তু সকালবেলা উঠেই পরের গু খেয়ে মরে।কাক দেখ না কত উড়ুর পুরুড় করে। ভারী স্যায়না!(সকলে স্তব্ধ)
যারা কিন্তু ঈশ্বর চিন্তা করে,বিষয়ে আসক্তি, কামিনী- কাঞ্চনে ভালবাসা চলে যাবার জন্যে রাতদিন প্রার্থনা করে,তাদের বিষয়রস তেঁতো লাগে, হরিপাদপদ্মের সুধা বই আর কিছু ভালো লাগে না, তাদের স্বভাব যেমন হাঁসের স্বভাব। হাঁসের সুমুখে দুধেজলে দাও, জল ত্যাগ করে দুধ খাবে। আর হাঁসের গতি দেখেছো একদিকে সোজা চলে যাবে।শুদ্ধভক্তের গতিও কেবল ঈশ্বরের দিকে। সে আর কিছু চায় না,তার আর কিছু ভাললাগে না।
(বঙ্কিমের প্রতি কোমলভাবে )---আপনি কিছু মনে করো না।
বঙ্কিম ---- আজ্ঞা,মিষ্টি শুনতে আসিনি।
অশোক চুপ করে ভাবে, একজন পড়াশোনা না-জানা ,প্রায় নিরক্ষর মানুষের পক্ষে এত গভীর উপলব্ধির কথা, বেদ-বেদান্তের এত তত্ত্বকথা জানা কী করে সম্ভব! বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায় কৌতূহলবশত ঠাকুরকে পরীক্ষা করতে এসে শেষ পর্যন্ত নিজেই লেজেগোবরে হচ্ছেন টুকলি করা ছাত্রের মতন। আর বলছেন,আজ্ঞা, মিষ্টি শুনতে আসিনি। তিনি কি শেষ পর্যন্ত নিজেকে সমর্পণ করবেন শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে, যেমনটি করেছেন শ্রীম। দেখা যাক, কী হয়...
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
শ্রীরামকৃষ্ণ ও পরোপকার
শ্রীরামকৃষ্ণ (বঙ্কিমের প্রতি )---কামিনী- কাঞ্চনই সংসার।এরই নাম মায়া।ঈশ্বরকে দেখতে,চিন্তা করতে দেয় না, দু-একটি ছেলে হলে স্ত্রীর সঙ্গে ভাইবোনের মত থাকতে হয়, আর তার সঙ্গে সর্বদা ঈশ্বরের কথা কইতে হয়। তাহলে দুজনেরই মন তার দিকে যাবে আর স্ত্রী ধর্মের সহায় হবে। পশুভাব না গেলে ঈশ্বরের আনন্দ আস্বাদন করতে পারে না। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে হয় যাতে প্রভাব যায়। ব্যাকুল হয়ে প্রার্থনা। তিনি অন্তর্যামী, শুনবেনই শুনবেন। যদি আন্তরিক হয়।
"আর 'কাঞ্চন'। আমি পঞ্চবটির তলায় গঙ্গার ধারে বসে 'টাকা মাটি' 'টাকা মাটি' 'মাটিই টাকা' 'টাকাই মাটি' বলে জলে ফেলে দিছলুম!"
"বঙ্কিম --- টাকা মাটি! মহাশয় চারটা পয়সা থাকলে গরীবকে দেওয়া যায়। টাকা যদি মাটি, তাহলে দয়া পরোপকার করা হবে না ?"
[ শ্রীযুক্ত বঙ্কিম জগতের উপকার ও কর্মযোগ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (বঙ্কিমের প্রতি) --- দয়া! পরোপকার! তোমার সাধ্য কী যে তুমি পরোপকার করো? মানুষের এত নপর-চপর কিন্তু যখন ঘুমোয়, তখন যদি কেউ দাঁড়িয়ে মুখে মুতে দেয়, তো টের পায় না, মুখ ভেসে যায়। তখন অহংকার, অভিমান, দর্প কোথায় যায়?
সংসারী লোকের টাকার দরকার আছে। কেননা মাগ ছেলে আছে। তাদের সঞ্জয় করা দরকার। মাগ ছেলেদের খাওয়াতে হবে। সঞ্চয় করবে না, কেবল পঞ্ছী আউর দরবেশ অর্থাৎ পাখি আর সন্ন্যাসী। কিন্তু পাখির ছানা হলে সে মুখে করে খাবার আনে। তারও তখন সঞ্চয় করতে হয়। তাই সংসারী লোকের টাকার দরকার । পরিবার ভরণপোষণ করতে হয়।
সংসারীব্যক্তি নিষ্কামভাবে যদি কাউকে দান করে সে নিজের উপকারের জন্য, পরোপকারের জন্য নয়। সর্বভূতে হরি আছেন তারই সেবা করা হয়। হরিসেবা হলে নিজেরই উপকার হল, পরোপকার নয়। এই সর্বভূতে হরির সেবা ----শুধু মানুষের নয়, জীবজন্তুর মধ্যেও হরির সেবা , যদি কেউ করে, আর যদি সে মান চায় না, যশ চায় না, মরার পর স্বর্গ চায় না, যাদের সেবা করছে , তাদের কাছ থেকে উল্টে কোন উপকার চায় না, এরূপভাবে যদি সেবা করে , তাহলে তার যথার্থ নিষ্কাম কর্ম, অনাসক্ত কর্ম করা হয়।
এইরূপ নিষ্কাম কর্ম করলে তার নিজের কল্যাণ হয়, এরই নাম কর্মযোগ।এই কর্মযোগও ঈশ্বরলাভের একটি পথ।কিন্তু বড় কঠিন,কলিযুগের পক্ষে নয়।
আহা! কর্মযোগের কী সহজ সরল ব্যাখ্যা। এমনটি তো আগে কখনও শুনিনি, ভাবে অশোক। সত্যিই, সংসারে নিষ্কাম কর্ম করা বড় কঠিন। মানুষ যে পরোপকার করতে চায়, রাজনৈতিক নেতারা যে উন্নয়নের ঢেড়া পেটান, তাতে মিশে থাকে ক্ষমতার দম্ভ, অহংকার। নিষ্কাম কর্ম, অনাসক্ত কর্ম অত সহজ! দেখি, ঠাকুর আর কী বলেন ----
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
আগে বিদ্যা (science)না আগে ঈশ্বর
শ্রীরামকৃষ্ণ (বঙ্কিমের প্রতি--- কেউ কেউ মনে করে শাস্ত্র না পড়লে,বই না পড়লে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না।তারা মনে করে, আগে জগতের বিষয়,জীবের বিষয় জানতে হয়,আগে সায়েন্স পড়তে হয়। (সকলের হাস্য) তারা বলে ঈশ্বরের সৃষ্টি এসব না বুঝলে ঈশ্বরকে জানা যায় না।তুমি কি বল?আগে সায়েন্স না আগে ঈশ্বর?
বঙ্কিম --- হাঁ,আগে পাঁচটা জানতে হয়, জগতের বিষয়। একটু এ দিককার জ্ঞান না হলে, ঈশ্বর জানব কেমন করে? আগে পড়াশোনা করে জানতে হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ ----ওই তোমাদের এক...আগে ঈশ্বর,তারপর সৃষ্টি। তাঁকে লাভ করলে,দরকার হয় তো সবই জানতে পারবে।
আগে ঈশ্বরলাভ,তারপর সৃষ্টি বা অন্য কথা। বাল্মীকিকে রাম মন্ত্র জপ করতে দেওয়া হল,কিন্তু তাকে বলা হল 'মরা ' 'মরা ' জপ করো।' ম ' মানে ঈশ্বর আর' রা 'মানে জগত। আগে ঈশ্বর তারপর জগত,এককে জানলে সব জানা যায়।১-এর পর যদি পঞ্চাশটা শূন্য থাকে অনেক হয়ে যায়।১কে পুছে ফেললে কিছুই থাকে না। ১কে নিয়েই অনেক।১আগে, তারপর অনেক,আগে ঈশ্বর তারপর জীবজগৎ।
তোমার দরকার ঈশ্বরকে লাভ করা!তুমি অত জগৎ, সৃষ্টি,সায়েন্স,এসব করছ কেন?তোমার আম খাবার দরকার।বাগানে কত শ আমগাছ,কত হাজার ডাল,কত লক্ষ কোটি পাতা, এসব খবরে তোমার কাজ কি? তুই আম খেতে এসেছিস আম খেয়ে যা। এ সংসারে মানুষ এসেছে ভগবানলাভের জন্য।সেটি ভুলে নানা বিষয়ে মন দেওয়া ভালো নয়। আম খেতে এসেছিস আম খেয়েই যা।
বঙ্কিম ----আম পাই কই?
আহা!কী ব্যাকুল জিজ্ঞাসা। এ জিজ্ঞাসা তো আমারও, ভাবে অশোক। এবার কী বলবেন শ্রী রামকৃষ্ণ । মোক্ষম প্রশ্ন, দেখা যাক---
শ্রীরামকৃষ্ণ ---তাঁকে ব্যাকুল হয়ে প্রার্থনা করো।আন্তরিক হলে তিনি শুনবেনই শুনবেন। হয়তো এমন হল কোনও সৎ সঙ্গ জুটিয়ে দিলেন, যাতে সুবিধা হয়ে গেল। কেউ হয়তো বলে দেয়, এমনি এমনি করো তাহলে ঈশ্বরকে পাবে।
বঙ্কিম --- কে? গুরু? তিনি আপনি ভালো আম খেয়ে,আমায় খারাপ আম দেন।(হাস্য )
শ্রীরামকৃষ্ণ--- কেন গো! যার যা পেটে সয়। সকলে কি পলুয়া-কালিয়া খেলে হজম করতে পারে?বাড়িতে মাছ এলে মা সব ছেলেকে পলুয়া-কালিয়া দেন না। যে দুর্বল যার পেটের অসুখ,তাকে মাছের ঝোল দেন, তা বলে কি মা সে ছেলেকে কম ভালোবাসেন?
ঠিক, মা সব সন্তানকেই সমান ভালবাসেন। আমাদের অবশ্য একটাই সন্তান। ভালবাসা বিন্দুমাত্র ভাগ হয়নি। তাই উপমা যখন 'পলুয়া-কালিয়া' মানে মাংস- বিরিয়ানি, ক্যাডবেরি -চকলেট-চিপস -চানাচুর জাতীয় ফাস্টফুড খাওয়ার বায়না ধরে, তখন অলি মাঝে মাঝে রেগে গিয়ে, মুখের সামনে থেকে খাবার গুলো ছুড়ে ফেলে,তাতে উপমা হয়তো কান্নাকাটি করে। তার মানে তো এই নয়, যে ওকে আমরা ভালবাসি না। ওর তো এইসব পেটে সয় না। বছর দুয়েক আগে জন্ডিসে ভুগেছে। তেল-মশলা খাওয়া একদমই বারণ।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
শ্রীরামকৃষ্ণ কীর্তনানন্দে
ব্রাহ্মসমাজের শ্রীযুক্ত ত্রৈলোক্য গান করিতেছেন।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কীর্তন একটু শুনিতে শুনিতে হঠাৎ দণ্ডায়মান ও ঈশ্বরাবেশে বাহ্যশুন্য হইলেন।একেবারে অন্তর্মুখ,সমাধিস্থ। দাঁড়াইয়া সমাধিস্থ।সকলেই বেস্টন করিয়া দাঁড়াইলেন।বঙ্কিম ব্যস্ত হইয়া ভিড় ঠেলিয়ে ঠাকুরের কাছে গিয়া একদৃষ্টে দেখিতেছেন। তিনি সমাধি কখনো দেখেন নাই।বঙ্কিমের গা ঘেঁষে দাঁড়ায় অশোক। সে-ও তো এমন দৃশ্য জীবনে দেখেনি। নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে শ্রীরামকৃষ্ণের দিকে।
কিয়ৎক্ষণ পরে একটু বাহ্য হইবার পর ঠাকুর প্রেমে উন্মত্ত হইয়া নৃত্য করিতে লাগিলেন,যেন শ্রীগৌরাঙ্গ শ্রীবাসমন্দিরে ভক্ত সঙ্গে নাচিতেছেন। সে অদ্ভুত নৃত্য! বঙ্কিমদি ইংরেজি পড়া লোকেরা দেখিয়া অবাক।কি আশ্চর্য! এরই নাম কি প্রেমানন্দ?ঈশ্বরকে ভালোবেসে মানুষ কি এত মাতোয়ারা হয়? এইরূপ কান্ডই কি নবদ্বীপে শ্রীগৌরাঙ্গ করেছিলেন?এইরকম করেই কি তিনি নবদ্বীপে আর শ্রীক্ষেত্রে প্রেমের হাট বসিয়েছিলেন? এর ভিতর তো ঢং হতে পারে না। ইনি সর্বত্যাগী,এঁর টাকা মান, কাগজে নাম বেরুনো কিছুই দরকার নাই। তবে এই কি জীবনের উদ্দেশ্য? কোনদিকে মন না দিয়ে ঈশ্বরকে ভালোবাসাই কি জীবনের উদ্দেশ্য?এখন উপায় কি? ইনি বললেন,মার জন্য দিশেহারা হয়ে ব্যাকুল হওয়া, ব্যাকুলতা,ভালোবাসাই উপায়। ভালোবাসাই উদ্দেশ্য। ঠিক ভালোবাসা এলেই দর্শন হয়।
ভক্তরা এইরূপ চিন্তা চিন্তা করিতে লাগিলেন ও সেই অদ্ভুত দেবদুর্লভ নৃত্য ও কীর্তনানন্দ দেখিতে লাগিলেন। সকলেই দণ্ডায়মান --ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের চারিদিকে--- আর একদৃষ্টে তাঁকে দেখিতেছেন।
কীর্তনানন্দে ঠাকুর ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিতেছেন। 'ভাগবত ভক্ত ভগবান 'এই কথা উচ্চারণ করিয়া বলিতেছেন, জ্ঞানী -যোগী -ভক্ত সকলের চরণে প্রণাম।
আবার সকলে তাঁহাকে ঘেরিয়া আসন গ্রহণ করলেন। সকলের সঙ্গে অশোকও বসে পড়ল।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
শ্রীযুক্ত বঙ্কিম ও ভক্তিযোগ ---ঈশ্বর প্রেম
বঙ্কিম (ঠাকুরের প্রতি)--- ভক্তি কেমন করে হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ--- ব্যাকুলতা। ছেলে যেমন মার জন্য মাকে না দেখতে পেয়ে দিশেহারা হয়ে কাঁদে, সেই রকম ব্যাকুল হয়ে ঈশ্বরের জন্য কাঁদলে ঈশ্বরকে লাভ করা পর্যন্ত যায়। অরুণোদয় হলে পূর্বদিক লাল হয় তখন বোঝা যায় যে, সূর্যোদয়ের আর দেরি নাই।সেইরূপ যদি কারো ঈশ্বরের জন্য প্রাণ ব্যাকুল হয়েছে দেখা যায়, তখন বেশ বুঝতে পারা যায় যে, এ ব্যক্তির ঈশ্বর লাভের আর বেশী দেরী নাই।
একজন গুরুকে জিজ্ঞাসা করেছিল, মহাশয়,বলে দিন ঈশ্বরকে কেমন করে পাবো। গুরু বললে,এসো আমি তোমায় দেখিয়ে দিচ্ছি । এই বলে তাকে সঙ্গে করে একটি পুকুরের কাছে নিয়ে গেল। দুই জনেই জলে নামলে,এমন সময় হঠাৎ গুরু শিষ্যকে ধরে জলে চুবিয়ে ধরলে। খানিক পরে ছেড়ে দেবার পর শিষ্য মাথা তুলে দাঁড়াল।গুরু জিজ্ঞাসা করলে,তোমার কি রকম বোধ হচ্ছিল? শিষ্য বললে,প্রাণ যায় যায় বোধ হচ্ছিল, প্রাণ আটু-পাটু করছিল। তখন গুরু বললে,ঈশ্বরের জন্য যখন প্রাণ ঐরূপ আটু-পাটু করবে,তখন জানবে যে,তাঁর সাক্ষাৎকারের দেখি নাই।
তোমায় বলি,উপরে ভাসলে কি হবে? একটু ডুব দাও। গভীর জলের নীচে রত্ন রয়েছে,জলের উপর হাত-পা ছুঁড়লে কি হবে? ঠিক মাণিক ভারী হয়,জলে ভাসে না, তলিয়ে গিয়ে জলের নিচে থাকে। ঠিক মাণিক লাভ করতে গেলে জলের ভেতর ডুব দিতে হয়।
বঙ্কিম -----মহাশয়,কি করি,পেছনে শোলা বাধা আছে। (সকলের হাস্য )ডুবতে দেয় না।
এ কথাটা বঙ্কিম খাসা বলেছেন 'পেছনে শোলা বাঁধা আছে'। আছেই তো, মনোযোগ দিয়ে বইটা পড়ছি, তার মধ্যে কত শোলা পেছনে টানছে...ছিটকানি দাও, উপমার টিফিন পাহারা দাও, অলির চটি এনে দাও... শোলার কি আর অভাব! সংসারীলোক ভাবসাগরে ডুববে কী করে।
এই শালা! বঙ্কিমের কথা তোর খুব মনে ধরেছে না রে? মিটিমিটি হাসছিস। অবাক হয় অশোক, কাকে মৃদু ধমক দিচ্ছেন ঠাকুর! অশোককে? হ্যাঁ,তাই তো! অশোকের দিকেই তো ঠাকুরের অন্তর্ভেদী শান্ত সৌম্য দৃষ্টি!
শ্রীরামকৃষ্ণ বলে চলেছেন--- শোন, তাঁকে স্মরণ করলে সব পাপ কেটে যায়। তাঁর নামেতে কালপাশ কাটে। ডুব দিতে হবে, তা না হলে রত্ন পাওয়া যাবে না। একটা গান শোন ----
ডুব ডুব ডুব রূপ-সাগরে আমার মন।
তলাতল পাতাল খুঁজলে পাবি রে প্রেমরত্নধন।।
ঠাকুর তাঁহার সেই দেবদুর্লভ মধুর কন্ঠে গানটি গাইলেন। সভাসুদ্ধ লোক আকৃষ্ট হইয়া একমনে এই গান শুনিতে লাগিলেন।গান সমাপ্ত হইলে আবার কথা আরম্ভ হইল।
শ্রীরামকৃষ্ণ (বঙ্কিমের প্রতি)---- কেউ কেউ ডুব দিতে চায় না। তাঁরা বলে,ঈশ্বর ঈশ্বর করে বাড়াবাড়ি করে শেষকালে কি পাগল হয়ে যাব? যারা ঈশ্বরের প্রেমে মত্ত, তাদের তারা বলে বেহেড হয়ে গিয়েছে।কিন্তু এই সব লোকে এটি বোঝে না যে সচ্চিদানন্দ অমৃতের সাগর। তাই বলছি ডুব দাও।কিছু ভয় নেই, ডুবলে অমর হয়।
এইবার বঙ্কিম ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন ---বিদায় গ্রহণ করিবেন। অশোকও ঠাকুরকে প্রণাম করল ।
বঙ্কিম----মহাশয়,যত আহাম্মক আমাকে ঠাওরেছেন তত নয়।
বঙ্কিম কি সাফাই দিচ্ছেন, তিনি টুকলি করা ছাত্র নন,ভাবে অশোক।
বঙ্কিম----একটি প্রার্থনা আছে ,অনুগ্রহ করে কুটিরে একবার পায়ের ধূলা ----
শ্রীরামকৃষ্ণ -----তা বেশ তো,ঈশ্বরের ইচ্ছা।
বঙ্কিম ----সেখানেও দেখবেন,ভক্ত আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ ----কি গো! কি রকম সব ভক্ত সেখানে? যারা গোপাল গোপাল,কেশব কেশব বলেছিল,তাদের মত কি? (সকলের হাস্য )
বঙ্কিম বিদায় গ্রহণ করিলেন।কিন্তু একাগ্র হইয়া কি ভাবিতেছিলেন।ঘরের দরজার কাছে আসিয়া দেখেন, চাদর ফেলিয়া আসিয়াছেন। গায়ে শুধু জামা। একটি বাবু চাদরখানি কুড়াইয়া লইয়া ছুটিয়া আসিল। অশোক তাঁর হাত থেকে চাদরটি নিয়ে বঙ্কিম-এর হাতে তুলে দিল। কিন্তু লক্ষ করল,বঙ্কিম কেমন যেন অন্যমনস্ক, শ্রীরামকৃষ্ণের কথা শোনার পর থেকে কী গভীর চিন্তায় মগ্ন।
বঙ্কিম কি ভাবিতেছিলেন?
আনমনে এইসব ভাবছে অশোক, ঠিক তখনই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল অলি। দু'হাতে বাজারের দুটো ব্যাগ। ঘেমে-নেয়ে একশা। ' কতবার বলে গেলাম,ছিটকানিটা লাগিয়ে বসো,তা এখনও লাগানোর সময় হয়নি ?'
অলির ঝাঁঝাল প্রশ্ন কানে ঢুকছে না অশোকের। সে তখনও বঙ্কিমের অন্তর্হিত হওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে...তার হাত পা চোখ মুখ পাঁজর ফুসফুস...তখনও ভাসছে কথামৃতের অগাধ জলে।
ব্যাগ দুটো এক হাতে নিয়ে অলি যেই ছিটকানিটা লাগাতে যাবে, অমনি ব্যাগ থেকে ছিটকে পড়ল কেজি দেড়েক ওজনের এক বড়সড় কাতলা।
মা'র গলা শুনে পাশের ঘর থেকে দৌড়ে আসে উপমা, '' ওমা, কত বড় মাছ !" দু'হাতে ধরতে যায়,হাত থেকে পিছলে মাছটা লাফ কাটে সোফার কোণায়।
"তুই পারবি না, ব্যাগটা নে, আমি ধরছি ।"
মা মেয়ের দাপাদাপিতে সংবিত ফেরে অশোকের, " এত বড় মাছ আনলে?"
"সব সময় সঞ্চয় করলে হবে ? মাঝে মাঝে পঞ্ছী আউর দরবেশ হতে হয় । আর হ্যাঁ, শোনো, বাজারে ছোট বৌদি-ডিম্পুর সঙ্গে দেখা , ওরা ইভিনিং শোয়ে সিনেমা যাচ্ছে, আমরাও যাব বলেছি,তৈরি থেকো।"
হাততালি দিয়ে ওঠে উপমা। চোখ বড়বড় করে অশোক জানতে চায়
"কী বই ?"
"বেলা শেষে।"
(আগামী পর্বে )