রবিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২২

প্রবন্ধ * স্বপন নাথ



বৈতরণীর  সাতকাহন 

স্বপন নাথ 


ব্যবহারিক জীবনে আমরা প্রায়শই  এমন কিছু শব্দ বা শব্দ গুচ্ছের সঙ্গে পরিচিত হই , যার  অর্থ ব্যঞ্জনা  আদিতে যা ছিল বর্তমানে তা নেই। হয়তো তা ব্যাপ্তির বিড়ম্বনায় ডানা ছেঁটে বনসাই । কিংবা বিস্তারে বিবৃত আকাশ । নয়তো নিম্ন  গতি নদীর স্রোতহারা আবেদন  অশ্বক্ষুরের বিপ্রতীপে বহমান নোনা লাগা দ্বীপ।

              শব্দার্থ পরিবর্তনের  এই ধারা অর্থ সংকোচন , অর্থ বিস্তার , অর্থের  উৎকর্ষ , অর্থের  অপকর্ষ  প্রভৃতি  রীতিকে অবলম্বন করে চলে। এই রীতির পরাকাষ্ঠায় শব্দ কখনো কখনো আদি অর্থের ব্যাঞ্জনাকে নিছক পুঁথিগন্ধময় ধর্মীয় বাতাবরণে বেঁধে দেয় । আবার কখনো বা মোটা দাগের কোনো ভাবনাকে  ইঙ্গিতায়িত করে । 

            আমরা তার অন্তর্গত আলো খোঁজার চেষ্টা করি না । আর তা না করেই আমরা আমাদের অজ্ঞতার বিমূঢ় বাটখারা চাপিয়ে অতীত  ঐতিহ্যের মহ্ত্ত্ব  বা মানস বিকাশকে খাটো করি। অলৌকিক ঈশ্বর তত্ত্বের  উপর স্ট্যাম্প সিল দিই।

            তেমনি  একটি শব্দ "বৈতরণী "। শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে পুরাণ প্রসঙ্গ  এসে পড়ে।এসে পড়ে স্বর্গ নরক প্রভৃতি কাল্পনিক ছবি।

             কিন্তু আমি বলতে চাই শব্দটি নিছক কোনো ঈশ্বর লোককে ইঙ্গিতায়িত করে না। বরং শব্দটি সেই যুগের মানস চৈতন্যের  ঊর্ধতন বিকাশ সামর্থ্যকেই প্রকাশ কেরছে । অর্থাৎ শব্দটির মাধ্যমে তথাকথিত  ঈশ্বর বলে কোনো বস্তগত স্থানের কথা বলা হয়নি । বা অলৌকিকতাকে প্রকাশ করেনি।

           সংস্কৃত "বৈতরণী "র ব্যুৎপত্তি গত অর্থ বিন্যাস =  বিতরণ+ অ+ই/ঈ ।পুরাণ মতে যমদ্বারের নিকটস্ত নদী । ইংরেজি  অভিধানে বলা হচ্ছে "The River of Hades ( হেইডীজ)" ।  Hades থেকে এসেছে  Hades শব্দটি , যার ইংরাজি প্রতিশব্দ Hell . বাংলায় নরক । মতান্তরে "The abode of the dead " বা মৃতের আলয়। এবং The under world বা পাতালও বলা হচ্ছে ।


             এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে প্রতিটি শব্দ বা প্রতিশব্দের  সঙ্গে  যুক্ত রয়েছে অবক্ষয় , অবনতি  ও নিম্নরুচির সীমা লঙ্ঘনের  এক যন্ত্রণাময় পরিণতির ছবি। তা শারীরিক , মানসিক , সামাজিক ও রাষ্ট্রীক্ সর্বত্রগামী । যা ক্ষিতি, অপ,  তেজ, মরুৎ,  ব্যোম --- এই পঞ্চধারার ভিতরে ভিতরে "তুঁষের  অঙ্কুর সম ক্ষুদ্র কিন্তু তীক্ষ্মতম ।" 

             সেই অস্বস্তিকর পরিবেশ পরিস্থিতি থেকে মুক্তির বোধই  মনে হয় "বৈতরণী পার " পদবাচ্যটির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত ।

             অন্য মতে " বৈকুণ্ঠে গমন কারী নৌকো" ব্যাস বাক্যটিও সাজুয্য দেয় বৈতরণীকে । 

             সুতরাং বৈতরণীর সঙ্গে পারাপারের সম্পর্ক চলে এলো । কাজেই এপার ওপার প্রসঙ্গও ।তাহলে পেরিয়ে কোথায় যাওয়া । স্বর্গে  ? সেই স্বর্গ কোথায়  ? জানি না । সে ব্যাখ্যায় ধর্মীয় বাতাবরণ অপার্থিবের এলাকা থেকে পার্থিবের  এলাকায় টেনে নামানোরও প্রয়োজন দেখি না ।

               বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক  আবুল ফজল "মানবতন্ত্র" প্রবন্ধে  তথাকথিত আচরণসর্বস্ব ধর্ম পালনের মদমত্ততায় লৌকিক জীবন কিভাবে দূর্বিষহ হয়ে ওঠে তা দেখাতে গিয়ে লিখেছেন--- "যা অপার্থিব তা অপার্থিবের র্অলৌকিক বিশ্বাসেই থাক । সেই অলৌকিক জীবনকে পার্থিবের লৌকিক জীবনে টেনে আনলে সে বিরোধ মুহূর্তে হয় বারুদ  ।" 

             তাই পুরাণ কথিত স্বর্গ নরকের অলৌকিক ঘরানায় না গিয়ে কাজী নজরুল ইসলামের মতটি গ্রহণযোগ্য ---" মানুষের মাঝেই স্বর্গ নরক মানুষই সূরাসুর।" পার্থিবের এই প্রসঙ্গটিকেই যদি প্রাধান্য দিই তবে স্বর্গ শব্দটির সঙ্গে দুঃখ কষ্ট হীন , যন্ত্রণা হীন, স্নেহ প্রীতি পুর্ণ প্রাণোচ্ছল প্রবাহের চিত্রটি মজ্জাগত হয়। তেমনি নরক্ শব্দটির সঙ্গে  অস্বাস্থ্যকর অপ্রীতিকর নৈরাজ্যের যন্ত্রণাক্লীষ্ট চিত্রটি ফুটে ওঠে । 

             সুতরাং এই নৈরাজ্যের নিঃসীম নিরানন্দ থেকে আনন্দময় মননের মরমীয়ানায়  উত্তীর্ণ হওয়াটি কী বৈতরণী পারের সামিল নয় ? মনে হয় শিল্পীর সঙ্ঘবদ্ধ বিবেকী চেতনায় ধরা পড়ে ঐতিহ্যের অতীত ।

 

শব্দটির  আদি উৎসের দিকে পশ্চাৎগমনের  উদ্দেশ্য এটাই যে যাকে আমরা অলৌকিক জগৎ বলে ভাবছি তা হয়তো আদৌ অলৌকিক ছিল না । সেই সময়ের মেধা মনন বিশ্লেষণে তা হয়তো উক্ত বাস্তবতাকেই সাব্যস্ত করে। কিন্তু আমরা আমাদের  অজ্ঞতা দিয়ে একটা অলৌকিক জগতে বেঁধে দিয়েছি। এবং অন্ধ ভাবে অনুসরণ করতে করতে  ইহোকাল পরোকালের পরাকাষ্ঠায় আগলে সেপারেশান করে ফেলেছি ।


                সুতরাং স্বর্গ ও নরকের পাশে পার্থিবের উক্ত প্রতিচ্ছবি গুলো যদি বাগ্ময় হয় তবে বলা যায়, অজ্ঞানতার  অন্ধকারে ডুবে থাকাই নরক। আর যে বা যারা থাকে সে বা তারাই অসুর বা রাক্ষস । বিপ্রতীপে  অজ্ঞানতার অন্ধকার সরিয়ে প্রাণময় চৈতন্যে উত্তীর্ণ হওয়ায় স্বর্গযাত্রা । এবং সেটা যে বা যারা করে সে বা তারাই সুর অর্থাৎ দেবতা।

                এখানে বলে রাখা ভালো যে দেবতা প্রসঙ্গে  এমনটাই বলেছেন বিভিন্ন মণীষী। বলেছেন  দেবতা , "অলীক ঈশ্বর নয়"। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বৈদান্তিক দর্শন প্রবন্ধ গ্রন্থে জানাচ্ছেন " সুউচ্চ মেধা ও সুতীক্ষ্ণবোধ শক্তি সম্পন্ন মানুষই হলো দেবতা ।"

               এমনকি মানুষের কল্যাণে উৎস্বর্গীকৃত নিম্নতর  প্রাণ কিংবা নিষ্প্রাণ বস্তুকেও (চাঁদ, সূর্য, গ্রহ,তারা ,পাহাড়, পর্বত,নদী)বৈদান্তিক পুরুষ দেবতাজ্ঞান করে মরমের  অন্তর্গত প্রণাম জানিয়েছেন । অর্থাৎ দেবতা বলতেও আমরা আমাদের  অজ্ঞতায় যা ঈশ্বর মেনে  অপার্থিবের এলাকায় ঠেলে দিয়েছি তাও ছিল সম্পূর্ণ পার্থিব  এবং বাস্তবও বটে।


 2


এই বাস্তবতার নিরিখেই যদি "বৈতরণী "শব্দটি রাখি এবং বিশ্লেষণ করি তবে তার পরিবর্তিত অর্থও পার্থিবের  এলাকায় তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। যেমন শব্দটিকে যুক্তাক্ষরের মোড়ক থেকে বের করে আনলে পাই " বই+তরণী " অর্থাৎ বই নৌকা বা বইয়ের নৌকা ।

               গোল বাধলো বোধহয় ! নৌকা কী আবার বইয়ের হয় ? স্বাভাবিক প্রশ্ন । কিন্তু নৌকার কাজটি ভাবুন । ভার বহন। আবার ভার মানেই কী শুধু  ওজন ? বাধা বা প্রতিবন্দকতা হয় না ? শব্দের সম্প্রসারণ করে এবার ভাবুন -- বোধবুদ্ধি হীন, কুসংস্কারাচ্ছন্ন , নিশ্চল , জড়ত্বযুক্ত মনোভাব প্রগতির পথে কি অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় না ? এবং সেটা তো এক প্রকার বাধাই ।

                আবার খুটিনাটি কথার মারপ্যাঁচে কিংবা গোপনীয় কোনো তুচ্ছ  কথার আড়ালে আমাদের মনের দিগন্তের স্তব্ধ হয়ে যাওয়া । হাঁফ ধরা । একটা বোবা দীর্ঘশ্বাস ! যেন একটা  অদৃশ্য দেয়াল লম্বা হয়ে যাচ্ছে কোথাও  । এমন মনে হওয়া । এ সবই কী প্রতিবন্ধকতারই নামান্তর নয় ? 

                 এই সমূহ বাধা দূর করে শুদ্ধজ্ঞান যা সরবরাহ করে বা বিতরণ করে সাযুজ্য দেয়  সংস্কৃত "বিতরণ+ অ+ই/ঈ" নামক ব্যুৎপত্তিকে । তাহলে বইয়ের নৌকা অভিধা তাৎপর্য পেয়ে গেল নাকি! অর্থাৎ বই হলো বাহন । এখন প্রশ্ন, কার বাহন ? স্বামী বিবেকানন্দ বৈদান্তিক ভাষ্য বিশ্লেষণ করে জানাচ্ছেন 'সমগ্র জগৎ তোমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ।' সেই তোমার বাহন। এখানেও প্রশ্ন,  'কে তুমি  ? ' সেখানেও  তিনি বেদকে পার্থিবের বাস্তবতায় বিশ্লেষণ করে দেখালেন, ' আই অ্যাম হি '/আমিই সে।' ব্রহ্মের পূর্ণ স্বরূপ ' । সেই স্বরূপের যে " তুমি " তাঁর বাহন। অর্থাৎ মানুষের বাহন। বেদে যাকে বলা হয়েছে " অমৃতস্য পুত্র" সেই অমৃত পুত্রের বাহন ।

               আবার তোমার মধ্যে আমার বা আমির মধ্যে তোমার উপস্থিতির যে অখণ্ড সত্ত্বা উপলব্ধি  সেও তো ব্রহ্মত্বেরই সামিল। অর্থাৎ গোটা জগতের বাহন (বই+ তরণী) বৈতরণী ।


                 বিজ্ঞানী  ই হেকেল তাঁর " অনটোজেনি রিপিটস  অফ ফাইলোজেনি " বা পুনরাবৃত্তি সূত্রে সেই মানব সন্তানকেই সমর্থন করলেন  তবে অন্য পরিভাষায় । তিনি বললেন "মাতৃগর্ভে প্রস্ফুটিত ভ্রূণের মধ্যে নিম্নতর জীবের জীনগত বৈশিষ্ট্য ক্রমরূপান্তরের পর সর্বোত্তম মনুষ্য জীনের বিকাশ ঘটে।" সেই উৎকৃষ্ট জীনের পূর্ণ প্রকাশ স্বরূপ যে মানুষ রূপ, সেই তুমি বা আমির বাহন।

                তাহলে বৈতরণী শব্দটির অলীক ঈশ্বরত্ব ঘুচিয়ে বাস্তবের অনৈস্বর্গীক দ্যোৎনায় বই+ তরণী  সাযুজ্য পেল নাকি  ?


*********************************************************************************



স্বপন নাথ 

পিতা : বলাই চন্দ্র দেবনাথ।মাতা:শ্রীমতি মায়া নাথ।গ্রাম-বেটিয়ারী, ডাকঘর- নলপুর,  থানা-সাঁকরাইল, জেলা- হাওড়া,পেশা- শিক্ষকতা ।
নেশা-লেখা , মূলত কবিতা ও প্রবন্ধ ।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : আটটি। প্রথম প্রকাশ (2006)বাতুল বালিয়াড়ি। পর্যায়ক্রমে মৃত্যুজপ শীলিত পরিক্রমা, চন্দ্র হলো না,সেই হরিণী যেই হরিণী, দ্বীপজন্ম, আয়াত পেরনো জল, গ্রহণ,   প্রভৃতি । সবকটিই শ্রদ্ধেয় কবি শঙ্খ ঘোষের তদারকিতে প্রকাশিত । প্রকাশিতব্য "ছিপ ধরা প্রহর "2022কোলকাতা বইমেলা ।
"আয়াত পেরনো জল" কাব্যগ্রন্থটি 2020 অন্নদাশঙ্কর রায় স্মৃতি পুরস্কারে মনোনিত হয়েছিল। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আবৃত্তি বিভাকর সম্মানে ভূষিত ।

1 টি মন্তব্য: