ওরা এসেছিলো
দেবাংশু সরকার
অনেক দিন ধরেই বরুণ বদলির চেষ্টা করছিল। এমনকি কর্নেল সুরিন্দার সিংয়ের কাছেও একান্তে আবদার করে বারে বারে বলেছিল যে, সে স্রেফ প্যারেড করার জন্য আর্মিতে ভর্তি হয়নি। ট্রেনিং পিরিয়ডে সে যা শিখেছে সেটাকে কাজে লাগিয়ে সে দেশ মাতৃকার সেবা করতে চায়। সে চায় তার মাতৃভূমির দিকে কুদৃষ্টি দেওয়া বিদেশী শত্রুদের চোখ উপড়ে নিতে। দেশের সীমানাকে সুরক্ষিত করতে।
অবশেষে বরুণের ইচ্ছা পুরণ হল। সে বদলি হল উত্তেজনা প্রবণ লাদাখে। কয়েক দিনের মধ্যেই সে চলে আসে। অবশ্য সে একা নয়, প্রায় কুড়ি হাজার সেনাকে আনা হয়েছে লাদাখে।কর্নেল সিংও এসেছেন।
কি অপুর্ব এই মালভূমি! প্রকৃতি দেবী যেন নিজের হাতে সাজিয়েছে এই মালভূমির কোনো কোনো অঞ্চলকে। বরফের মুকুট পরে মালভূমিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে পর্বতমালা। রুক্ষ্ম ধুসর পাহাড়ের মাঝে, সমতলে সবুজ বনানী। নাম না জানা হাজারো ফুলের মেলা। পাহাড়ি মানুষগুলো ভীষণ সাদাসিধে। সর্বদাই তাদের মুখে লেগে থাকে অনাবিল হাসি। মাঝে মাঝে বের হতে হয় বরুণকে পেট্রোলিংয়ের জন্য, সেই সঙ্গে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে উপভোগ করে।
গোয়েন্দা সুত্রে খবর এসেছে বিদেশী শত্রু একটু একটু করে সক্রিয় হতে শুরু করেছে লাদাখ সংলগ্ন বর্ডারে। সীমানার ওপারে শুরু হয়েছে রাস্তা তৈরী। ত্রিপল ছাউনির ফরওয়ার্ড ক্যাম্পগুলো যেন একটু একটু করে এগিয়ে আসছে! শুরু হয়েছে বিদেশী হেলিকপ্টারের সীমানার আকাশে আনাগোনা। কখনো সীমানা লঙ্ঘন। কখনো কখনো উড়ন্ত ড্রেন চোখে পড়ছে। কমান্ডার মিটিংয়ে অবশ্য অনিচ্ছাকৃত ভুল স্বীকার করলেও, ভুলগুলো বড়ই দৃষ্টিকটু।
বারে বারে মিটিং হচ্ছে আর ব্যর্থ হচ্ছে। হলুদ মুখো বিদেশী শত্রুদের উৎপাত ক্রমশ বেড়েই চলেছে। বিদেশী শত্রুরা কিছুতেই যেন তাদের আগ্রাসী মনোভাব থেকে বের হতে পারছে না। বারবার শেনপাও পর্বতের গুরুত্বপূর্ণ অংশ দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে হলুদ মুখো বিদেশী শত্রুরা। এল,এ,সির এপারেও ভীষণ ভাবে বেড়েছে সেনা সমাবেশ। পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, বিহার রেজিমেন্ট থেকে আসা প্রায় কুড়ি হাজার সেনাকে মোতায়েন হয়েছে লাদাখে। তুরতুক থেকে গালওয়ান পুরো এলাকাটাতেই প্রায় সর্বক্ষণ চলছে সেনা টহলদারি। এমনকি নুব্রা ভ্যালি, দুরবুকেও সেনা তৎপরতা চোখে পড়ছে। ডি এস ডি বি ও রোড ধরে সার দিয়ে চলছে সেনাবাহিনীর গাড়ি। লেহ্ থেকে ডি এস ডি বি ও রোড দুরবুক হয়ে দৌলত বেগ ওল্ডি এয়ার বেস অবধি নির্মিত হয়েছে। এই রাস্তায় সেনা তৎপরতা নজরে পড়ছে। এছাড়া গালওয়ানমুখী লিঙ্ক রোডেও সেনা তৎপরতা বিশেষ ভাবে নজরে পড়ছে। ব্যস্ততা বাড়ছে টাংসেতেও।
যুদ্ধকালীন তৎপরতা দৌলত বেগ ওল্ডি এয়ার বেসেও। এসে জড়ো হয়েছে এস ইউ থার্টি, এম কে আই এস, মিগ টোয়েন্টি নাইন এস, রাশিয়ান ইলিউশন সেভেনটি সিক্স, অ্যান্তনভ থার্টি টু, আমেরিকান সি সেভেনটিন, সি ওয়ান থার্টি জে। এছাড়াও এসেছে চিনুক হেলিকপ্টার। ঘটঘট শব্দে আকাশটাকে চষে বেড়াচ্ছে অ্যাপাচে। ফাইটার বিমানগুলোও রাত এগারোটা থেকে চক্কর দিতে শুরু করেছে। সারারাত ধরে টহল চলছে। সম্ভবত সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় ওড়া মিগ টোয়েন্টি নাইন এর বিকট শব্দ শত্রুর বুকে কাঁপন ধরিয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে পাহাড় থেকে পাহাড়ে। নাইট ভীষণ গগলস পরা সেনা পাইলটদের তৎপরতার খবর হয়ত পৌছে যাচ্ছে সীমানার ওপারে।
বরুণের পোস্টিং হয়েছে তুরতুক গ্রামের কাছাকাছি একটা আর্মি ক্যাম্পে। রুক্ষ্ম ধুসর পাহাড়ে ঘেরা তুরতুক গ্রামটিতে যেন সবুজের সমারোহ। সম্ভবত উত্তর পশ্চিম প্রান্তের শেষ গ্রাম। নাম না জানা হাজারো ফুল গাছের অবস্থান এই গ্রামে। কেউ কেউ একে 'ওয়ান্ডার ল্যান্ড' বলে। গ্রামের একদিকে ন্যুব্রা ভ্যালি, অন্যদিকে পাহাড়ের আড়ালে বালটিস্থান। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে শ্যায়ক নদী। ঝর্ণা, ছোট নদীগুলো যেন গ্রামটাকে আরো সাজিয়ে তুলেছে। ট্যুরিজম এখানকার অর্থনীতির মেরুদণ্ড হলেও, এই মুহুর্তে জনসমাগম খুব কম।
মাঝে মাঝে বরুণকে সদলবলে পেট্রোলিং করতে আসতে হয় এই গ্রামে। গ্রামের প্রাকৃতিক রূপ দেখে মোহিত হয়ে যায় সে। অবাক হয় অস্থায়ী নদীগুলোকে দেখে। সকালে হয়তো কোনো শুকনো জায়গা দিয়ে হেঁটে গেছে। দুপুরে ফেরার পথে সেই জায়গা দিয়েই তিরতির করে বয়ে চলেছে পাহাড়ের বরফ গলা জলে সৃষ্টি হওয়া কোনো ছোট নদী। অবাক হয়ে বরুণ ভাবে এমন স্বর্গরাজ্যও মাঝে মাঝে ভরে ওঠে বারুদের গন্ধে!
ক্রমশ ঘোরালো হয়ে উঠছে প্যাঙগং লেকের আশেপাশের এলাকা। বিদেশী শত্রুদের শকুনের দৃষ্টি পড়েছে গালওয়ান উপত্যকায়। প্রায়শই ছোটখাটো সংঘর্ষের খবর আসে। দুএক জন আহত হয়। কিন্তু এবারে এসেছে মারাত্মক খবর। তুমুল সংঘর্ষ হয়েছে গালওয়ানে। একজন কর্নেল সহ কুড়িজন জওয়ান শহীদ হয়েছেন। বন্দুক কামানের গুলিতে নয়। লোহার কাঁটা লাগানো মুগুরের মত হাতিয়ার দিয়ে আঘাত করতে করতে তাদের মারা হয়েছে। ভারতীয় জওয়ানেরাও কারো থেকে কম শক্তিশালী নয়। তারাও খালি হাতে পাল্টা মার দিয়ে অনেক বেশী ক্ষয় ক্ষতি করেছে বিদেশী শত্রুদের ।
সমস্ত খবর বরুণের কানে আসে। মনে মনে ছটফট করতে থাকে সে। তার সতীর্থরা মার খাচ্ছে অথচ সে হাত গুটিয়ে বসে আছে! ভৈরবও তার অমিত তেজ, শক্তি প্রয়োগ করতে পারছে না!
আবার কমান্ডার মিটিং। আবার মেকি হাসি। আবার নিয়মমাফিক হাত মেলানো। আবার অস্থায়ী শান্তি। কিন্তু সমস্যা সমাধানের যেন কোনো পথ নেই। সেনা সমাবেশ যথারীতি আছে। পেট্রোলিং যথারীতি চলছে। কেবল অস্থিরতা কিছুটা কমেছে। তবে বেশ বোঝা যাচ্ছে এই নিস্তব্ধতা ঝড়ের পূর্বাভাস। বরুণ ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছে, সে চাইছে একবার অন্তত শত্রুর মুখোমুখি হতে। আগ্নেয়াস্ত্র ছাড়াই লড়াই কাকে বলে সে দেখিয়ে দিতে চাইছে দুনিয়াকে। ভয় কি? সঙ্গেতো ভৈরব আছে। অবসর সময়ে ভৈরবের দিকে তাকিয়ে বরুণ ভাবে সেইসব দিনগুলোর কথা।
ছোটবেলা থেকেই বরুণ ছিল অন্য ধরনের। তার অনান্য বন্ধুদের থেকে সে ছিল অনেক বেশি প্রাণশক্তির অধিকারী। খেলাধুলোতেও সে ছিল বন্ধুদের মধ্যে সেরা। কিন্তু তার সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ ছিল খেলনা বন্দুকের দিকে। যতক্ষণ সে একা ঘরে থাকতো, খেলনা বন্দুক দিয়ে সে লড়াই চালাতো অজানা শত্রুদের সঙ্গে। রাস্তায় পুলিশের কাঁধের রাইফেলের দিকে সে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো। বরাবরই আগ্নেয়াস্ত্রের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ তার মনে।
বড় হয়ে স্কুলের গন্ডি টপকে, কলেজে পড়তে পড়তেই সে সুযোগ পেল সেনাবাহিনীতে। ভর্তি হল বিহার রেজিমেন্টে। দেখতে দেখতে ট্রেনিং নিতে যাওয়ার দিন এসে গেল। বরুণতো আনন্দে আত্মহারা। ঠিক মনের মত চাকরি সে পেয়েছে। বাড়ির লোকজন ছাড়াও পাড়া প্রতিবেশীরা এসেছে, বরুণকে বিদায় জানাতে। সবাইয়ের মুখে হাসি। কারো আবার কোনো অজানা আশংকায় চোখের কোনটা যেন চিক চিক করছে।
"অলক নিরঞ্জন।" জলদ গম্ভীর কন্ঠ থেকে উচ্চারিত হল অমোঘ বীজমন্ত্র। এসে দাঁড়িয়েছেন জটাজুটধারী এক সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী। বরুণের দিকে তাকিয়ে বললেন, "তুই দেশের হয়ে লড়াই করতে যাচ্ছিস। এটা সঙ্গে রাখ।" নিজের ঝোলা থেকে একটা ছুরি বের করে বরুণের হাতে দিলেন। বললেন, "এটা সব সময়ে সঙ্গে রাখবি। এটা কোনো সাধারণ ছুরি নয়। এটা মা ভবানীর আশীর্বাদ। এর নাম ভৈরব। শিবের ত্রিশূল, বিষ্ণুর চক্র, ইন্দ্রের বজ্রের সম্মিলিত শক্তির আধার এই ভৈরব। যতক্ষণ ভৈরব তোর সঙ্গে থাকবে, ততক্ষণ রণাঙ্গনে তুই অপরাজেয়। কেউ তোর কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারবে না। ভুলেও কখনো হাত ছাড়া করবি না। ভৈরব ঢাল হয়ে তোকে রক্ষা করবে, আবার তলোয়ার হয়ে শত্রু নিধন করবে। কিন্তু হাতছাড়া করলে সমূহ বিপদ। প্রাণ সংশয়ও হতে পারে। আবার বলছি সাবধান। কোনো অবস্থাতেই ভৈরবকে হাতছাড়া করবি না। তাহলে বিপদ।ভীষণ বিপদ।"
ধিরে ধিরে স্বাভাবিক হচ্ছে লাদাখের পরিবেশ। ফৌজি বিমানের উড়ানের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। ধাপে ধাপে চলছে সেনা প্রত্যাহার। ধির গতিতে হলেও ফিরে আসছে শান্তি। এমন সময়ে গোয়েন্দা সুত্রে খবর এসেছে অরুণাচলে আবার বেড়ে উঠেছে বিদেশী আগ্রাসন। মাঝে মাঝেই সীমানা টপকে ঢুকে পড়ছে এদেশে। তাসরি চু নদীর তীরে জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলগুলোতে বাড়ি ঘর তৈরি করছে। বসতি তৈরি করে কলোনি বানানোর চেষ্টা করছে। উত্তর সুবনসিরি জেলা জুড়ে এই অপচেষ্টা চলছে।
নতুন করে নজরদারি শুরু হল অরুণাচলে। শুরু হল সেনা পোস্টিং। লাদাখ থেকে বহু সেনাকে সরিয়ে নিয়ে আসা হল অরুণাচলে। সেই দলের সঙ্গে বরুণ এসেছে। কর্নেল সুরিন্দার সিং এসেছেন। ব্রিগেডিয়ার খুরাণা কাঁধে গুরু দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন অরুণাচলে।
নিয়মিত পেট্রোলিং চলছে। চলছে তল্লাশি। বরুণকে নিয়মিত দলের সঙ্গে বের হতে হয়। অঞ্চলটাকে সে ভালোভাবে চিনে নেওয়ার চেষ্টা করে। গাছ গাছালিতে ভরা এই অঞ্চলটাতে রয়েছে হাজারো অর্কিডের মেলা। ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী গুলো বয়ে চলেছে অরুণাচল জুড়ে। জঙ্গল জুড়ে হাতি, হরিণ, লাল পান্ডার সঙ্গে বাঘ, চিতার উপদ্রবও রয়েছে। লোক সংখ্যা তুলনায় কম হলেও বিভিন্ন জন বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। বাংলাভাষীও চোখে পড়ে বরুণের।
রুটিন পেট্রোলিং সেরে দলের সঙ্গে ক্যাম্পে ফিরেছে বরুণ। কিন্তু কোন এক অজানা কারনে মনের মধ্যে যেন এক অস্থিরতা কাজ করছে। কিছুতেই যেন স্থির হতে পারছে না। মাথাটাও ধরেছে। আবার ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে পড়ে সে। একাই। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে সে পৌছে যায় তাসরি চু নদীর তীরে। নদীর তীরে হালকা ঝোপ জঙ্গল। আসে পাশে কয়েক ঘর চাকমা উপজাতির বাস। নদীর অপর পারে ঘন জঙ্গল। সামনেই একটা কাঠের ব্রীজ। ব্রীজের পাশেই এক জায়গায় বসে পড়ে বরুণ। নদীর ঠান্ডা হাওয়ায় মাথা ধরাটা একটু একটু করে কমছে।
- নমস্কার সেনাপতি জি।
ঘুরে তাকায় বরুণ। দেখে পিটো নামের এক চাকমা তরুণ তার পেছনে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। স্থানীয় মানুষজনদের সাথে এর মধ্যে মিশুকে বরুণের বেশ আলাপ পরিচয় হয়ে গেছে। পিটো তাদের মধ্যে একজন।
- পিটো, নদীর ওপারে কি আছে রে? শুধু জঙ্গল নাকি লোক বসতি আছে?
- ওদিকে শুধু জঙ্গল। জঙ্গলে শের আছে। লোকজন থাকে না। তবে ইদানিং কিছু নাক চ্যাপ্টা বানজারা এসেছে। ঘর বেঁধেছে। একদিন কার্লো ওপারে গিয়েছিল কাঠ কাটতে। বানজারার দল কার্লোকে ইংরাজিতে খুব বকেছে। শের, ভালুর ভয় দেখিয়েছে। ওদিকে যেতে বারন করেছে। কার্লো দেখেছে ওরা অনেকগুলো ছোট ছোট ঘর তৈরী করেছে।
- বানজারা ইংরেজিতে বকুনি দিয়েছে! ব্যাপারটা সুবিধের মনে হচ্ছে না রে! দেখতে হচ্ছে ব্যাপারটা কি।
- ওপারে যেও না সেনাপতি। ওদিকে শের আছে।
- ভয় পাস না পিটো, আমার সঙ্গে সওয়া শের আছে।
কথা শেষ করেই বরুণ হাঁটতে থাকে ব্রীজের ওপর দিয়ে। পিটো 'হাঁ' করে তাকিয়ে থাকে।
প্রায় এক ঘন্টা হয়ে গেছে এখনো বরুণ ফিরছে না! চিন্তা বাড়তে থাকে পিটোর। কয়েকজন প্রতিবেশীর সঙ্গে আলোচনা করে, তাদের সঙ্গে মিলিটারি ক্যাম্পে গিয়ে খবর দেয় পিটো।
খবরটা শুনে তেলে বেগুনের জ্বলে ওঠেন ব্রিগেডিয়ার খুরাণা। চিৎকার করে বলতে থাকেন, "এই সব ছেলেগুলোর মধ্যে না আছে ডিসিপ্লিন না আছে রেসপন্সসিবিলিটি। এরা জানে না একজন জওয়ানকে হারালে আমাদের কতটা কষ্ট হয়, কতটা দুঃখ হয়। কোন প্ল্যান ছাড়া একা অ্যাকসনে চলে গেল! কার অনুমতি নিয়েছে? হি স্যুড বি পানিশড্।"
"কি বলছেন ব্রিগেডিয়ার!" বলতে থাকেন কর্নেল সিং, "গালওয়ানেও কোনো প্ল্যান ছাড়া মুভমেন্ট হয়েছিল। আমার মনে হয় হি স্যুড নট বি পানিশড্। হি স্যুড বি রিওয়ার্ডেড।"
"কিন্তু সেখানে একজন কর্নেল ছিলেন তিনিও শহীদ হয়ে ছিলেন।" তর্ক থামিয়ে ব্রিগেডিয়ার বলেন, "লিভ ইট নাউ। এখন আমাদের বরুণের পাশে দাঁড়াতে হবে। মিনিমাম এক কোম্পানি ফোর্স নিয়ে যেতে হবে। হারিআপ এন্ড লেট্স মুভ।"
এক কোম্পানি ফোর্স নিয়ে কুচ করলেন ব্রিগেডিয়ার খুরাণা, কর্নেল সিং।
নদী পার করে ব্রীজ থেকে নেমে হাঁটতে থাকে বরুণ। জঙ্গলের অজানা পথ। বেশ কষ্ট করেই এগোতে হচ্ছে। জঙ্গল ক্রমশ ঘন হচ্ছে। কোথাও কিছু নেই। বরুণ একবার ভাবে ফিরে যাবে। আবার ভাবে এতটা যখন এসে পড়েছে আরো কিছুটা দেখা যাক। আরো বেশ কিছুটা এগোতে চোখে পড়লো একটা ফাঁকা জমি। বেশ কয়েকটা কুঁড়ে ঘর রয়েছে সেখানে। খুব সন্তর্পণে এগোতে থাকে। দেখে শুনে মাটিতে পা ফেলে। শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনিও বিপদ ডেকে আনতে পারে। আরো কিছুটা এগোতেই বরুণ দেখে বেশ কয়েকজন হলুদ মুখো বিদেশী এক জায়গায় জড়ো হয়েছে। গুনে দেখে কুড়িজন। জঙ্গলের আড়াল থেকে বরুণ তাদের গতিবিধি লক্ষ করতে থাকে। হাতে তুলে নেয় ভৈরবকে। একবার ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বে বিদেশী শত্রুদের উপর। ছারখার করে দেবে তাদের। আবার ভাবে অভিমন্যু হয়ে এই চক্রব্যুহে ঢোকাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। এতজনের সঙ্গে একা লড়তে গেলে গেরিলা যুদ্ধ করতে হবে। অপেক্ষা করতে হবে সঠিক সময়ের জন্য।
চারটে দলের মধ্যে একটা দলকে শেষ করে বরুণ এগোতে থাকে অন্যদিকে। কিছুটা গিয়ে সে দেখতে পায় পাঁচ জনের দলটাকে। কিছুটা অসতর্ক দলটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বরুণ। বিদ্যুতের মত চমকাতে থাকে ভৈরব। একে একে পাঁচটা দেহ ভূপতিত হয়। দুটো দল খতম হয়েছে। আরো দুটো দল বাকি আছে। বড় দলটা গেছে নদীর দিকে, অন্য দলটা গেছে গভীর জঙ্গলের দিকে। ছোট দলটাকে আগে টার্গেট করলো বরুণ।
ব্রিগেডিয়ার খুরাণা, কর্নেল সিংএর নেতৃত্বে বেশ বড় একটা সেনা দল এসে হাজির হয়েছে নদীর তীরে। সঙ্গে পিটোরাও রয়েছে। নদীর তীরে এসে চমকে ওঠে সবাই। কাঠের ব্রীজটা ভেঙে ফেলা হয়েছে। ব্রিগেডিয়ার নির্দেশ দেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নতুন ব্রীজ তৈরী করতে হবে। পিটোরা ছুটলো গ্রামের দিকে লোক ডাকতে ব্রীজ তৈরীর জন্য।
ক্রমশ অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। গভীর জঙ্গলের অজানা পথ ধরে এগিয়ে চলেছে বরুণ। ভরা পূর্ণিমার চাঁদের আলোটুকু ভরসা। আবার কিছুটা ফাঁকা জায়গায় আরো কয়েকটা কুঁড়ে ঘর। ছোট্ট খুপরি জানালাগুলো দিয়ে সে দেখলো প্রতিটা ঘরেই একজন করে শুয়ে আছে। সাপ যেভাবে পাখির বাসায় হানা দেয়, বরুণ সেভাবে সন্তর্পণে এক একটা ঘরে ঢুকে খতম করতে লাগলো।
আর একটা দল বাকি আছে। যেটা নদীর দিকে গেছে। বেশ বড় দল। বরুণ বুঝতে পারে এই লড়াইটা সব থেকে কঠিন। সঙ্গে কয়েকজন সহযোদ্ধা থাকলে লড়াইটা সহজতর হত। অবশ্য এসব ভেবে এখন আর লাভ নেই। সতর্ক ভাবে নদীর দিকে এগোতে থাকে সে। এই পথ ধরেই সে এসেছে। চেনা পথ। খুব একটা অসুবিধে হচ্ছে না।
কিছুটা এগিয়ে বরুণ দেখে, একজন মাটিতে পড়ে আর্তনাদ করছে। তিনজন তাকে ঘিরে মাটিতে বসে আছে। মনে হয় সাপ বা বিষাক্ত কিছু কামড়েছে। অপর তিনজন তার শুশ্রূষা করছে। নিঃশব্দ তাদের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায় বরুণ। কেউ টের পায়নি। নিমেষের মধ্যে ভৈরবকে ঘষে দিল বসে থাকা তিন জনের গলায়। জীবিত তিনজন মুহুর্তের মধ্যে লাশে পরিনত হল।
হাতে অস্ত্র নিয়ে চিতাবাঘের সতর্কতায় নদীর দিকে এগোতে থাকে বরুণ। আচমকা দুজন হলুদ মুখো বিদেশীর মুখোমুখি হয়ে যায়। চকিতে একজনকে আঘাত করে সে। অপরজন দৌড়ে পালায়। উত্তেজিত বরুণ ছুঁড়ে দেয় হাতের অস্ত্র। অব্যর্থ নিশানায় আঘাত করে ভৈরব। তীব্র আর্তনাদ করতে করতে দৌড়ে পালায় বিদেশী শত্রু। বরুণ তাকে ধাওয়া করে। কিন্তু ধরতে পারে না। ভৈরব হাতছাড়া হয়ে গেল! তবে কি মহাবিপদ ধেয়ে আসছে তার দিকে? অজানা আতঙ্কের একটা স্রোত যেন নেমে যায় তার শিরদাঁড়া দিয়ে। যা খোয়া গেছে সেটা নিয়ে বেশি ভেবে লাভ নেই। ভারতীয় সেনা দেশ মাতৃকার চরণে আত্মবলিদান দিতে কখনো পিছপা হয় না। নিজেকেই যেন বোঝায় বরুণ। তাছাড়া অপারেশন প্রায় কমপ্লিট। যদিও দু একজন বেঁচে থাকে তাদের জন্য বরুণের দুটো হাতই যথেষ্ট।
হঠাৎ পিঠে তীব্র আঘাত পেয়ে চিৎকার করে পিছনে ফিরে দেখে আরো একজন হলুদ মুখো বিদেশী পেছন থেকে তার পিঠে একটা ছুরি বসিয়ে দিয়েছে। বজ্র মুষ্টিতে তার গলা চেপে ধরে বরুণ। বিদেশীটা এলোপাহাড়ি ছুরি চালাতে থাকে বরুণের শরীরের উপর। কাঁধে, বুকে, গলায় পরপর আঘাত হানতে থাকে। অবশ্য বরুণের হাতের চাপ বেশিক্ষণ সহ্য করতে না পেরে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে সে।
বরুণ মাটিতে বসে পড়ে। দেখে পুরো পোশাকটা রক্তে লাল হয়ে গেছে। প্রচুর পরিমাণে রক্তক্ষরণ হয়েছে। বরুণ ভাবে সামান্য অঞ্জলিই সে দিয়েছে দেশ মাতৃকাকে। প্রয়োজনে সে শেষ রক্ত বিন্দুও দিতে প্রস্তুত।
ঠান্ডা বাতাসে আহত, ক্লান্ত, অবসন্ন বরুণের চোখ বন্ধ হয়ে আসে। বহমান ঠান্ডা বাতাস যেন বরুণের সামনে এসে স্থির হয়ে যায়। সে বলে ওঠে,
- জাগো বরুণ, চোখ খোলো। ওরা যে আসছে।
- কারা?
- যারা স্বর্গগত, তারা এখনো জানে, স্বর্গের চেয়ে প্রিয় জন্মভূমি। তুমি একার হাতে ওদের জন্মভূমিকে রক্ষা করেছো। তাইতো ওরা আসছে তোমার কাছে। চোখ খোল, তাকিয়ে দেখো।
আস্তে আস্তে চোখ খোলে সে। অবাক বিস্ময়ে দেখে আলোয় আলো আকাশ। শত সহস্র আলোর বিন্দুতে ভরে গেছে আকাশটা। আলোর বিন্দুগুলো ক্রমশ যেন এগিয়ে আসছে তার দিকে। আরো, আরো কাছে এসেছে। ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে আলোর বিন্দুগুলো। বরুণ দেখছে এতো আলোর বিন্দু নয়, এতো তার চেনা! ভীষণ চেনা! জন্ম জন্মান্তরের চেনা! দিব্য জ্যোতিতে আলোকিত মহামানবরা! ঐতো, বরুণ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ফাঁসির মঞ্চে জয় গান গেয়ে যাওয়া বীর কিশোর! গলায় ফাঁসির দড়ির দাগটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ঐতো, ঐতো তিন অলিন্দ যোদ্ধা! ঐতো মাস্টার দা! ঐতো ঐ দিকে হ্যাট পরা উন্নত শিরের শিখ যুবক! ঐতো বুড়ি বালামের তীরের লড়াকু বীর, অমর শহীদ! ঐতো, ঐতো......!
বরুণ দুহাত বাড়িয়ে দিয়েছে মৃত্যুঞ্জয়ীদের চরণ ছোঁয়ার জন্য। ওরাও হাত বাড়িয়েছে তার দিকে। শত সহস্র হাত থেকে ঝরে পড়ছে শ্বেত শুভ্র পারিজাত। স্বর্গীয় পুস্পে ঢেকে যাচ্ছে বরুণের দেহ।
ভোর থেকেই গ্রামবাসীরা জড় হয়েছে নদীর ধারে। কারো হাতে ফুলের তোড়া, কারো হাতে মালা। কারো আবার জড়ো হওয়া দুহাতে উজাড় করে দেওয়া শ্রদ্ধা। সবই বরুণের জন্য। তারা অপেক্ষা করছে বরুণের প্রত্যাবর্তনের জন্য। অধীর আগ্রহের অপেক্ষা! অবশ্য গ্রামবাসীরা নদীর ধারে আসার অনেক আগেই ব্রিগেডিয়ার তার দলবল নিয়ে চলে গেছেন নদীর ওপারে।
জড়ো হওয়া গ্রামবাসীরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে বরুণকে নিয়ে।
- মনে হয় বরুণ পাঞ্জাবের ছেলে। চেহারাটা দেখেছো যেমন লম্বা তেমন চওড়া।
- কিন্তু ওতো ভালো বাংলা বলে। মনে হয় বাঙ্গালী।
- আমি দেখেছি কথা বলার সময়ে দক্ষিণীদের মত দুদিকে মাথা নাড়ে। তামিল বা হায়দ্রাবাদীও হতে পারে।
সরল গ্রাম্য মানুষগুলো হয়তো জানে না, বাংলা, পাঞ্জাব বা তামিলনাড়ুর গন্ডিতে বরুণদের আবদ্ধ করা যায় না। কোনো রাজ্য বা ভাষা বরুণদের পরিচয় নয়। বরুনদের একমাত্র পরিচয় তারা দেশ মাতৃকার সন্তান।
যখনই দেশ মাতৃকার ভাগ্যাকাশে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে, তখন ঘরে ঘরে বরুণেরা সন্ধ্যা প্রদীপ হয়ে জ্বলে উঠে অন্ধকারকে সরিয়ে দেশ মাতৃকাকে আলোর দিশাতে ফিরিয়ে আনে
নদীর ওপারে একদল সেনাকে দেখে সবাই চুপ করে যায়। দলটা ব্রীজের উপর দিয়ে আসছে। কর্নেলের কোলে বরুণ। এপারে এসে কর্নেল বললেন, "গ্রামবাসীগন, তোমাদের বন্ধু আজ আমাদের গর্ভ। অমর শহীদ বরুণ আমাদের গর্ভ... "। কথা শেষ না করেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেন কর্নেল। গ্রামবাসীদের হাত থেকে পড়ে গেল ফুলের তোড়া, ছিঁড়ে গেল মালা। কেবল রয়ে গেল অপরিসীম শ্রদ্ধা আর টুকরো কিছু স্মৃতি।
কর্নেলের ঠিক পেছনেই ব্রিগেডিয়ার। তার চোখও জলে ভেজা। রোদে পোড়া ফর্সা মুখটা অসম্ভব থমথমে। মাথাটা ঝুঁকে রয়েছে। ব্রিগেডিয়ার ভাবছেন মাত্র বাইশ বছর বয়সেই দেশ রক্ষার জন্য একটা তাজা প্রাণ মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়লো! নাকি নিজের কাজ সাঙ্গ করে অমৃতের পুত্র পাড়ি দিল অমৃত লোকে!
মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়ঃ
ওং শান্তি
**********************************************************************************************************
পেশা মেডিকেল রিপ্রেসেন্টেটিভ। স্কুলের পত্রিকায় নিয়মিত লেখার অভ্যাস থাকলেও। তারপর দীর্ঘ বিরতি। লকডাউনের প্রথম বছরটা(2020) কেটে যায় টিভিতে রামায়ণ, মহাভারত দেখে। লকডাউনের দ্বিতীয় বছরের (2021) অখন্ড অবসরে লেখালেখির দ্বিতীয় ইনিংসের শুরু ।
সাম্প্রতিক লেখা - প্রজাপতি সাহিত্য পত্রিকা/ সৃজন সাহিত্য পত্রিকা/ রংমিলন্তি প্রকাশন/ কারুলিপি অনুগল্প সংকলন/ অবেক্ষন/ ড্যাস সাহিত্য পত্রিকা/ লেখা ঘর সাহিত্য পত্রিকা/ মৌনমুখর সাহিত্য পত্রিকা/ তুলি কলম আকাশ/ ঘোড়সওয়ার/ স্নিগ্ধা প্রকাশন/ নীরব আলো প্রভৃতিতে প্রকাশিত হয়েছে ।


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন