রবিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২২

অণুগল্প * শুভাশিস ঘোষ



ণুগল্প সাহিত্যের একটি বিস্ময়কর শাখা। ' বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন ?' ঠিক তাও নয় যেন, বিন্দুতে সপ্তসিন্ধু দশ দিগন্ত চকিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সার্থক অণুগল্পে। তেমনই একটি অসাধারণ অণুগল্প এবার আমরা পড়ছি ,শুভাশিস ঘোষ-এর কলমে -----

       

বিলম্বিত প্রেম

শুভাশিস ঘোষ 



পাঁচটা বাজতে এখনো মিনিট আষ্টেক বাকি। সবার আগে সাইকেল নিয়ে সোজা মিলের গেটে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল রতন। ঠিক পাঁচটায় বাজবে সাইরেন, তার পর খুলবে গেট। এক শিফটের লোক ঢুকবে, অন্য শিফটের ছুটি। চটকলের কাজের শিফটের একটা বিশেষ রীতি আছে। এক টানা আট ঘন্টার বদলে দু'খেপে শ্রমিকেরা যাতায়াত করে। এ শিফটের ছুটি পাঁচটায়। আজ হপ্তার দিন। পকেটে হপ্তার টাকা, এক হাতে সাইকেলের হ্যান্ডেল, হা পিত্যেস করে দাঁড়িয়ে রতন। কখন বাজবে পাঁচটা। সাইরেন বাজতেই রতনের বুকের মধ্যে একটা ঢেউ খেলে গেল। বুঝি অবসান ঘটল এক অনন্ত অপেক্ষার ।


গেট খুলতেই হুড়োহুড়ি। এক বিচিত্র কৌশলে অন্যদের পিছনে ফেলে সবার আগে বাইরে আসে রতন। আজ হপ্তাবাজার। চটকলে হপ্তার দিনে মিলের গেটে বসে অস্থায়ী বাজার। অনেকটা সাপ্তাহিক হাটের মতো। রতন জানে কাজলি কোথায় দোকান সাজায়। এগিয়ে চলে কাজলির দোকানের দিকে। কাল ছিল উল্টোরথ। আজ মধুময়রার গরম জিলিপি কাজলিকে খাওয়াবার ইচ্ছেটা এক সপ্তাহ ধরে মনে পুষে রেখেছে রতন। সপ্তাহে এক দিন মাত্র কিছুক্ষণের জন্য একটু দেখা, দুটো চারটে সাধারণ কথাবার্তা হয় কাজলির সাথে। তাই হপ্তার দিন সকাল থেকেই মনটা একটু লাবডুব লাবডুব করে বৈকি । গত সপ্তাহে কাজলি লজ্জার মাথা খেয়ে একটা কথা অবশ্য বলেছিল রতনকে। এড়িয়ে গেছে সে। আজ খদ্দেরের চাপ কমলে গরম জিলিপি খেতে খেতে উত্তরটা দেবে রতন। সাত দিন ধরে মনে মনে রিহার্সাল করছে সে। আজ ফাইনাল ষ্টেজ। তাই একটু ভালো লাগা, একটু উৎকন্ঠা মেশানো অনুভূতি নিয়েই হাজির হল কাজলির দোকানের সামনে। রেডিমেড জামা কাপড়ের দোকান। বেশ ভিড় লেগেছে আজ। দুটো দোকানের ফাঁক দিয়ে পিছনে গিয়ে সাইকেলটা ঠেকালো শিউলি গাছের গায়ে। অনুসন্ধানী চোখ দুটো খুঁজছে কাজলিকে। কিন্তু সে কোথায় ? আজ দোকান দিয়েছে ঘেঁটু। কাজলির মাসির ছেলে। আগে দু একবার ঘেঁটুকে অবশ্য দেখেছে রতন। কিন্তু কাজলি কোথায় ?

ভিড় বাড়ছে দোকানে। দু'হাতে খৈনি ডলে আর দুচোখে কাজলিকে খুঁজে চলে রতন। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে এ দোকান একাই সামলায় কাজলি। যে দিন যে মিলে হপ্তা সেখানেই চলে ওর ভবঘুরে দোকান। মেয়েটা একাই সাইকেল চালিয়ে এদিক ওদিক দোকান নিয়ে ঘোরে। অবশ্য এই ভবঘুরে দোকানদারদের একটা দল আছে বটে। প্রতি সপ্তাহেই মিল থেকে বেরিয়ে রতন একটু জিরিয়ে নেয় এই শিউলি গাছের তলায়। প্লাষ্টিকের ছাউনীর নিচে বসে দোকান সামলায় কাজলি। ভিড় বাড়লে মাঝেমধ্যে দোকানে একটু হাত লাগায় রতন। বেশিরভাগ দিনই খাস্তা বিস্কুট আর চায়ের খরচ মেটায় রতন। মাঝেমধ্যে বাড়ি থেকে মোচার ঘন্ট, লাউ চিংড়ি নিয়ে আসে কাজলি। দোকানে খদ্দের কমলে একটু গল্পসল্প করে দুজনে। মামার বাড়ির পাশেই যে থাকে ওরা। কাজলিদের মা-মেয়ের সংসারে পুরুষ বলতে কেউ নেই। তাই একটু কর্তব্য করে রতন। ভিড় কমতেই রতন বলে, "ও ঘেঁটু, কাজলি কোথায় রে ?"

- ওমা তুমি জানুনি ? কাজলি দিদির তো কাল বে হয়ে গেল গো । এবার থেকে এ দোকান আমি দেকবো। ওর আর দোকান করার দরকার নেই গো। ওর বরের কোটাবাড়ি, বড়ো ব্যওসা!

বুকের ভিতরে যেন সজোরে ধাক্কা দিল কে! কিন্তু কেন ? রতন তো কোনো দিন কাজলিকে মনের কথা কিছু বলনি। বরং গত সপ্তাহে কাজলিই বলেছিল,"রতনদা, তুমি বিয়ে করছো না কেন ?" কোনো উত্তর না দিয়ে কেবল হেসেছিল রতন। ঘেঁটু জানায় কাজলির বাবার অসুখের সময় ছ'হাজার টাকা ধার দিয়েছিল রেশন ডিলার তিনকড়ি। গত বছর তার বউটা মরেছে করোনায়। সাত বছরের মেয়েকে তার মামার বাড়িতে পাঠিয়ে কাজলির মাকে তিনকড়ি ঋণ মকুবের প্রস্তাব দেয়। তারপর ...


পিছনের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে চোখ তুলে শিউলি গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকে রতন। চোখ দুটো  ঝাপসা হয়ে আসে। আকাশে ক্রমশ কালো হচ্ছে মেঘ। বৃষ্টি আসবে একটু পরেই। হঠাৎ মৃদু স্বরে স্বগক্তি করে রতন, "একটু দেরি হয়ে গেল"।


******************************************************************************************



শুভাশিস ঘোষ 

জন্ম ২৫ আগষ্ট ১৯৬৬। বেড়ে ওঠা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার শিল্পশহর বজবজে। বানিজ্য বিভাগে স্নাতকোত্তর, ইনস্টিটিউট অব কষ্ট এন্ড ওয়ার্কস এ্যাকাউন্টেট অব ইন্ডিয়ার স্বীকৃত পেশাদার। পেশা সূত্রে বিভিন্ন কর্পোরেট হাউজ ঘুরে বর্তমানে রিলায়েন্স জিও-তে কর্মরত। দক্ষিণ বঙ্গের সংবাদ সাপ্তাহিক 'বার্তা এখন'-এর প্রধান সম্পাদকের দায়িত্বে ২০০২ থেকে। সংবাদ প্রতিবেদন, প্রবন্ধ, রম্যরচনায় বিচরণ তিন দশকের ওপর। ছোটগল্প, অণুগল্প, কবিতা,ছড়ায় সমৃদ্ধ লিটলম্যাগ সহ বিভিন্ন বানিজ্যিক পত্র-পত্রিকা। প্রকাশিত প্রবন্ধ সংকলন একটি, গল্প সংকলন দুটি। 'শিল্পের জন্য শিল্প' নয়, 'মানুষের জন্য শিল্প'তে পূর্ণ বিশ্বাস। তাই কঠিন বাস্তবের মাটিতে পা রেখেই সাহিত্য চর্চা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন