রবিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২২

তোমায় খুঁজে ফিরি: স্বামী চেতনানন্দ



প্রাচীন সাধুদের কথা  

স্বামী ধর্মেশানন্দ (১৮৯৯-১৯৯৪)

        

১)

     স্বামী ধর্মেশানন্দকে (ধীরেন মহারাজ) ১৯৮২ সালে কাশীর অদ্বৈত আশ্রমে প্রশ্ন করে তাঁর স্মৃতিকথা টেপ করি। তিনি শ্রীম-র খুব ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসেছিলেন এবং ঠাকুরের অন্যান্য শিষ্যের সঙ্গেও বাস করেছেন। পুরোনো উদ্বোধনে আমি তাঁর 'শ্রীম সমীপে' পড়েছিলাম। তাঁকে শ্রীম সম্বন্ধে বলতে অনুরোধ করছিলাম।

     ১৯২১-২২ সালে আমি প্রথম শ্রীম-র কাছে যাই। তিনি আমহার্স্ট স্ট্রিটের মর্টন ইনস্টিটিউশনের চারতলায় থাকতেন। এরপূর্বে আমি সুরেনবাবুর কাছ থেকে নিয়ে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতর চতুর্থভাগ পড়ে খুব আনন্দ পাই। তিনি আমাকে বলেন, 'এই গ্রন্থের লেখক এখনও বেঁচে আছেন।' তারপর একদিন বিকালে আমরা দুজনে শ্রীম-র কাছে যাই। তিনি চেয়ারে বসেছিলেন এবং আমরা একটা বেঞ্চিতে বসলাম। আষাঢ় মাস। রথযাত্রা কয়েকদিন পরে। শ্রীম পুরীর জগন্নাথদেবের মহাপ্রসাদের গুণকীর্তন করতে লাগলেন। এই প্রসাদ ঠাকুর খেতেন। শ্রীম নিত্য খান। তিনি আমাদের সকলের হাতে ঐ প্রসাদ (শুকনো ভাত) দিয়ে বললেন, 'এই প্রসাদ ধারণ করলে ভক্তি হয়।' আমি তখন কলেজের ছাত্র, ব্রাহ্মসমাজে যাই। সব বিচার করে নিই। প্রসাদে কোনো বিশ্বাস ছিল না। আমি শ্রীমকে বললাম, ' হ্যাঁ কেউ যদি বিশ্বাস করে খায় তবে ভক্তি হতে পারে।' তিনি বললেন, 'ঠাকুর বলেছেন 'এই প্রসাদ খেলে ভক্তি হবে।' আমি বললাম, 'তা কি করে হবে?' আমার তর্ক যুক্তি শুনে বললেন, 'বিষ যদি তুমি না জেনে খাও, তাহলেও মৃত্যু হবে। দেখ হে, সব বস্তুরই একটা গুণ আছে।'

     তারপর তিনি গম্ভীর হয়ে আমার দিক থেকে মুখ সরিয়ে অন্য ভক্তদের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'দেখুন, এই বাবুটি ঠাকুরের কথা বিশ্বাস করছেন না।' সকলে নিস্তব্ধ। সুরেনবাবু আমার দিকে চেয়ে আছেন। আমি অপ্রস্তুত হয়ে তাঁর কাছ থেকে প্রসাদ-কণা গ্রহণ করলাম। তারপর থেকে আমি প্রায়ই শ্রীম-র কাছে যেতাম।

     ১৯২১ সালে স্বামী ব্রহ্মানন্দকে একবার বেলুড়মঠে দর্শন করেছি। ১৯২৪ সাল থেকে আমি বিবেকানন্দ সোসাইটিতে ছিলাম এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতাম। সেখানকার ব্রহ্মচারী তারকের সঙ্গে আমি আবার শ্রীম-র কাছে যাই। আমাদের দেখে শ্রীম তারককে জিজ্ঞাসা করেন, 'তুমি কি করো?' সে বলল, 'আমি সোসাইটির চাঁদা সংগ্রহ করি। সেখানে সাধুরা এসে সপ্তাহে দুটি ক্লাস নেন। ভজন আদি হয় এবং রামনাম সংকীর্তন হয়। আমি ঐসব ব্যবস্থা করি।' এরপর শ্রীম আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, 'তুমি কি করো?' আমি বললাম, 'আমি সকালে পূজা করি, সন্ধ্যায় আরতি করি এবং দু'ঘণ্টা লাইব্রেরীর কাজ করি।'

     শ্রীম শুনে বললেন, 'বাঃ, তোমার কাজটি তো বেশ! তুমি সুগন্ধি চন্দন ঘষছ পূজার জন্য, ফুল দিয়ে ঠাকুরকে সাজাচ্ছ। ঠাকুর পবিত্রতম। সেই ঠাকুরের পূজা করছ, সবকিছু নিবেদন করছ। তোমার এই কাজটি বেশ। এই কাজটি তুমি ছেড়ো না। পূজার দ্বারা শীঘ্রই ভগবানের কৃপা লাভ হয়।' এই বলে তিনি আমাকে খুব উৎসাহ দিলেন।

     তারপর আমি ঠিক করলাম সাধু হব এবং বেলুড়মঠে যোগ দেব। আমার ইচ্ছা জেনে শ্রীম বলেন, 'দেখ, সাধু হতে গেলে মৃত্যু-চিন্তা করতে হবে। কঠ-উপনিষদে আছে -নচিকেতা মৃত্যুর রাজা যমের কাছে গিয়েছিলেন মরণের পারে কী আছে তা জানবার জন্য। তিনি যমের কাছ থেকে জেনে নিয়েছিলেন মৃত্যুহীন অমর আত্মাকে। তুমি এখন থেকে রোজ শ্মশানে যাবে এবং সেখানে কি দেখলে তা আমাকে জানাবে।' আমি কয়েকদিন শ্মশানে গিয়েছিলাম। কটা মড়া পুড়ল এবং শ্মশানের পরিবেশ প্রভৃতি সব রিপোর্ট তাঁকে দিতাম। যাই হোক, একদিন কোনো কারণে যায়নি। তাতে শ্রীম বলেন, 'না, ঠিক হলো না। তোমাকে রোজ যেতে হবে।' আমি বললাম, 'আমি ঐদিন এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলাম। তার পাশের বাড়িতে একজন মারা যায়। আমি তাদের কান্না শুনলাম।' একথা শুনে শ্রীম বললেন, 'হ্যাঁ, এ-ও ভাল অভিজ্ঞতা। দেখ, মৃত্যুচিন্তা না করলে মরণের পারে যে ভগবান আছেন সে বোধ হয় না।' এই ভাবে তিনি আমার মনে বৈরাগ্যের ভাব ঢোকালেন।


২)

    ১৯২৬ সালে আমি কলকাতা ছেড়ে দেওঘর বিদ্যাপীঠে join করি। সেখানে চার বছর ছিলাম। ঐখানে আমার স্বাস্থ্য ভাল না থাকায় ১৯৩০ সালে আমি বেলুড়মঠে মহাপুরুষ মহারাজের কাছে আসি। তিনি আমাকে কাশীতে যেতে বললেন। কাশী যাওয়ার পূর্বে আমি প্রায়ই শ্রীম-কে দেখতে যেতাম। ঐ সময়ে প্রয়াগে কুম্ভমেলা হয়। শ্রীম আমাকে বলেন, 'ধীরেন, তুমি কুম্ভমেলায় যাও। বেশ হবে, দেখবে সাধুদের একটি সমাজ আছে। সংসারের প্রতি ঘনিষ্ঠতা কমে যাবে। ওখানে নানা সম্প্রদায়ের সাধুর সমাগম হয়। মাসাধিককাল প্রতিদিন সেখানে ঐসব সাধু-সমাজে ভগবত গুণগান, শাস্ত্রচর্চা, শোভাযাত্রা, ভাণ্ডারা দেখলে আনন্দ পাবে ও অনেক অভিজ্ঞতা হবে। তারপর ঐসব বিশদ বর্ণনা আমাকে লিখবে।

    তারপর বেলুড় মঠ থেকে অনেক সাধুর জন্য একটা রেলের কামরা reserved করা হয়েছিল। আমি তাঁদের সঙ্গে কুম্ভমেলায় গেলাম এবং গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমের কাছে একটি ক্যাম্পে থাকলাম। আমি কুম্ভমেলার বর্ণনা লিখে একটা বিস্তারিত পত্র শ্রীম-কে পাঠিয়েছিলাম। কুম্ভমেলার পর কাশী যাই এবং সেখান থেকে আলমোড়ায় তপস্যা করতে যাই। আলমোড়ার কুঠিয়ায় নির্জনবাস ও পরিবেশ সম্বন্ধে শ্রীম-কে চিঠি লিখি। তিনি উত্তরে লিখেছিলেন, 'এই নির্জন হিমালয়ে একমনে তুমি শ্রীশ্রীঠাকুরের চিন্তায় কাল কাটাইতেছ। কি সুন্দর পরিবেশ, ইচ্ছা হয় এই বৃদ্ধ বয়সে ঐ কুটিরে থাকিয়া তপস্যা করি। তপসা চীয়তে ব্রহ্ম। কিন্তু একাকী বাসকালে 'সাধু সাবধান' -শ্রীশ্রীঠাকুরের এই মহাবাক্য সর্বদা স্মরণ করিবে।'

    এর এক বছর পরে আমি কলকাতায় ফিরে শ্রীম-র সঙ্গে দেখা করি। তিনি বললেন, 'আহা! তোমার কুম্ভমেলার কী বর্ণনা! আমি সর্বপ্রথম তোমার চিঠি পাই। দেখ, ভারতবর্ষের মত এমন সুন্দর দেশ পৃথিবীতে নেই। এখানে সাধু-সন্তেরা তপস্যা করেন ও ভীক্ষার দ্বারা জীবন ধারণ করেন। লোকে সাধুদের ভিক্ষা দেয় যাতে তাঁরা ভগবানের ধ্যানে জীবন কাটাতে পারেন।'

    হরি মহারাজ নিজের জীবনে গীতা অভ্যাস করে তার মর্ম অনুভব করতেন। তিনি ছিলেন মূর্তিমান গীতা। তিনি শুকদেবের মতন শুদ্ধ ও পবিত্র ছিলেন। মহাপুরুষ মহারাজ আমাকে গীতার এই শ্লোকটি ধ্যান করতে বলেছিলেন, -'গতির্ভর্তা প্রভুঃ সাক্ষী নিবাসঃ শরণং সুহৃৎ। প্রভবঃ প্রলয়ঃ স্থানং নিধানং বীজামব্যয়ম্॥'(৯/১৮) - আমিই প্রাণীদের পরাগতি ও পরিপালক। আমি প্রভু ও সকল প্রাণীর বাসস্থান ও তাদের কৃতাকৃতের সাক্ষী। আমি রক্ষক ও হিতকারী। আমি স্রষ্টা এবং সংহর্তা। আমিই আধার ও প্রলয় স্থান এবং জগতের অক্ষয় কারণ।

    আলমোড়ায় থাকাকালে আমি রোজ গীতার নবম ও দশম অধ্যায় পাঠ করতাম। এই দুই অধ্যায়ে অনেক ভক্তির কথা আছে। কিন্তু ভাব-ভক্তি আমার তেমন বোধ হতো না। আমি ঠাকুরের কাছে খুব প্রার্থনা করতাম। তারপর ভাবলাম মহাপুরুষ মহারাজ রয়েছেন এবং শ্রীম এখনও জীবিত আছেন। এঁদের সঙ্গলাভ দুর্লভ। এঁদের কাছেই যাই। সৎসঙ্গ সাধু জীবনে অবশ্যই চাই।

    যাইহোক, ঠাকুর আমার প্রার্থনা শুনেছিলেন। কাশীতে ফিরে তিন-চার মাস থাকার পর অক্টোবর মাসে স্বামী বিরজানন্দ মহারাজের একটি চিঠি পাই। তিনি তখন জেনারেল সেক্রেটারি। তিনি লেখেন, 'উদ্বোধন পত্রিকার একজন Sub-Editor দরকার। তুমি সত্বর এখানে চলে এসো।' আমার খুব আনন্দ হল। আমার উদ্বোধনে খুব থাকার ইচ্ছা, কারণ মঠে আমার শরীর ভাল থাকত না। উদ্বোধনে থাকাকালে আমি সপ্তাহে তিন-চারদিন শ্রীম-র কাছে যেতাম।


৩)

     শ্রীম মর্টন স্কুলের চারতলায় একটা ঘরে থাকতেন। সেই ঘরে একটি খাট, কয়েকটা বইয়ের আলমারি, দেওয়ালে ঠাকুর, মা ও স্বামীজীর ছবি এবং একপাশে ঠাকুরের ব্যবহৃত কিছু জিনিসপত্র ছিল।

     একদিন তাঁকে দেখতে গিয়েছি। তিনি খাটে বসেছিলেন। আমি মেঝেতে বসলে তিনি আমাকে আবৃত্তি করতে বললেন, -'অসতো মা সদ্গময়। তমসো মা জ্যোতির্গময়। মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়।' -অসৎ থেকে আমাকে সৎ-এ নিয়ে যাও। অন্ধকার থেকে আমাকে আলোকে নিয়ে যাও। মৃত্যু থেকে আমাকে অমৃতে নিয়ে যাও। শ্রীম প্রার্থনার উপর খুব জোর দিতেন। বলতেন, prayer is golden link between the short life and eternal life. এই short life ভগবানকে দিতে হবে। খুব করে প্রার্থনা করো। দেখ, তাঁর কৃপা ছাড়া কিছু হয় না।'

     শ্রীম আমাকে খুব স্নেহ করতেন এবং ঠাকুরের কথা খুব বলতেন। তাঁর ঘরের সামনে ছিল এক বড় ছাদ এবং চারিদিকে উঁচু দেওয়াল। আকাশ ছাড়া আর কিছু দেখা যেত না। সেই ছাদের উপর টবে তিনি নানা ফুলগাছ, তুলসীগাছ প্রভৃতি লাগিয়ে ঋষিদের মতন তপোবন সৃষ্টি করেছিলেন। প্রতিদিন বিকালে ভক্তেরা এলে তাদের নিয়ে সেখানে ধ্যান করতেন। আমি একবার ভুল করে আসন ফেলে উদ্বোধনে চলে এসেছিলাম। তার পরদিন বেলা দুটোর সময় গোপনে আসনখানা আনতে যাই। শ্রীম আমাকে দেখে হাতটি ধরে তাঁর খাটের উপরে বসালেন। তারপর তিনি বললেন, 'তোমার কথাই ভাবছিলাম। তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।' আমি বললাম, 'আমাকে এখনই ফিরতে হবে। মায়ের বাড়িতে তিনটের সময় স্বামী বাসুদেবানন্দ ছান্দোগ্য-উপনিষদ-এর ক্লাস নেন, সেখানে আমাকে উপস্থিত থাকতে হবে।' তিনি বললেন, 'দেখ, অধ্যয়ন করে ভগবানের কাছে যাওয়া তো royal path. তা যুগ যুগ ধরে রয়েছে। দেখ, ঠাকুরকে ধরো। তাঁকে ধরে ক্লাস কর। তিনি এই সবে এসেছিলেন। এই সুবর্ণ সুযোগ। তিনি সাক্ষাৎ ভগবান। তাঁরই চরণতলে বেদ-বেদান্ত পড়ে রয়েছে। তাঁকে ধরলে এখনই ঐসব জ্ঞান পাবে। খুব তাড়াতাড়ি গন্তব্য স্থানে পৌঁছে যাবে, নতুবা দেরি হয়ে যাবে, অনেক দেরি হয়ে যাবে।'

     কিন্তু আমার তখন শাস্ত্রের প্রতি দারুণ আসক্তি। সবাই বলত যে, শাস্ত্র না পড়লে জ্ঞান হবে না। আমি শ্রীম-র কাছ থেকে হাত টেনে নিয়ে উদ্বোধনে চলে এলাম। আমি মূঢ়ের মতো তাঁর প্রতি অশ্রদ্ধা জানালাম ও তাঁর কথায় বিশ্বাস করলাম না। এখন মনে হয় তিনি আমাকে হয়ত কোন গূঢ় আধ্যাত্মিক তত্ত্ব বলতে চেয়েছিলেন।

     পরে শ্রীম-কে বলেছিলাম, 'আমার ধ্যান-ধারণা ঠিকমতো হচ্ছে না। আপনি কিছু করে দিন।' তখন তিনি বলেছিলেন, 'দেখ, যদি কেবল শাস্ত্র নিয়ে থাক, তবে ধ্যান-ধারণার গভীরে ঢুকতে পারবে না। ভগবানের কাছে প্রার্থনাই আসল। তুমি যখন তা পারলে না, এখন তোমার পক্ষে কেবল ভগবানের কথা কওয়া হচ্ছে সাধনা। 'কথয়ন্তশ্চ মাং নিত্যং তুষ্যন্তি চ রমন্তি চ।' (১০/৯) -আমার ভক্তেরা নিত্য আমার তত্ত্বগুণ ও লীলাকথা আলোচনা করে তুষ্ট হয় ও আনন্দ লাভ করে। 'পরস্পরং ভাবয়ন্তঃ শ্রেয়ঃ পরমবাপ্স্যথ।' (৩/১১) -এইরূপে পরস্পরের সন্তোষ সাধন দ্বারা মঙ্গল লাভ করবে। গীতার এই বাক্য অনুসরণ কর। ভক্তদের সঙ্গে ভগবানের কথা বলতে বলতে তোমার ভক্তি হবে। কেবল তাঁর বিষয়ে চিন্তা করবে।'


৪)

     শ্রীম ছিলেন আমার পরম হিতৈষী ও মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী। একদিন একজনের সঙ্গে আমার কথা কাটাকাটি হয়। দুপুরে খাওয়ার পর আমি তাঁর কাছে গেলাম সান্ত্বনা পাওয়ার জন্য। আমাকে দেখে তিনি আদরের সঙ্গে ডাকলেন, 'এস, এস।' আমাকে বেঞ্চিতে বসতে বললেন। তারপর আমার হাতে কয়েকটা pamphlet দিয়ে বললেন, 'এই দেখ, দেবাসুরের সংগ্রাম চলছে। একদল অপর দলকে নিন্দা করছে। মঠের এক বিরোধী দল বলছে, 'বেলুড় মঠের উপর বাঘ পড়েছে। বেলুড় মঠে বাঘ এসেছে।' এই কথা বলে শ্রীম হো হো করে হাসতে লাগলেন। তাঁর হাসি দেখে আমিও হেসে ফেললাম। আমার মর্মবেদনার কথা বলা হল না। তিনি ছিলেন ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ পার্ষদ। তাঁর বালকের মতো হাসিতে আমার মনের দুঃখ চলে গেল।

     আরেকদিন তাঁকে বললাম, 'ঠাকুর যে ভগবান, এই বিশ্বাস তো আমার হচ্ছে না।' শ্রীম বললেন, 'কি বল হে? এতসব পড়েও, ঠাকুরের পার্ষদদের সঙ্গ করেও ঠাকুর যে ভগবান, এই বিশ্বাস এল না? সাত কাণ্ড রামায়ণ পড়ে এখন তুমি বলছ সীতা কার মাসি? যাক, কখন কখনও মনের এইরূপ অবস্থা হয়। আমারও ঐরূপ হয়েছিল। মনে পড়ে, ১৮৮২ সালে এক দুপুরে খাওয়ার পর ঠাকুর বিছানায় শুয়ে আছেন। আমি পাপোশের উপর বসে তাঁর পায়ে হাত বোলাচ্ছি আর ভাবছি -ইনি সাধারণ মানুষের মতন খান, বেড়ান, ঘুমোন, সাধারণ মানুষের মতন ব্যবহার করেন, উনি কি করে জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-লয়কর্তা হবেন? ইনি কি মানুষরূপে এসেছেন মানুষকে কৃপা করবার জন্য, জগত উদ্ধার করবার জন্য? এ কী করে সম্ভব? ইনি তো দেহধারী মানুষ। আমি এরূপ ভাবছি, তখন হঠাৎ ঠাকুর উঠে বসলেন ও বললেন, 'মাস্টার, তুমি কি ভাবছ?' তারপর নিজের হৃদয়ে হাত রেখে বললেন, 'এখানেই সব। একে চিন্তা করলে সব হবে। একে চিন্তা করলে সব হবে। একে চিন্তা করলে সব হবে।' এই কথা তিনবার বলেই তিনি সমাধিস্থ হলেন।

     অনেকক্ষণ সমাধির পর তিনি নিম্নভূমিতে এসে মা জগদম্বার সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন, 'মা, আমি তো কিছু জানিনা। তুই যেমন বলালি, তেমনি বললাম। আমি তো বালক। মা, আমি কি কিছু দোষ করলাম? তুই আমার মুখ দিয়ে বলালি।' দেখ, এতেই বুঝলাম ঠাকুর ভগবান। মা জগদম্বা ও ঠাকুর এক।

     শ্রীম-কে লক্ষ্য করে দেখেছি তাঁর সত্যের প্রতি খুব আঁট ছিল। কখনও তাঁকে রাগতে দেখিনি। তবে কেউ কথা না রাখলে তিনি রেগে যেতেন। একদিন এক ভক্তের সঙ্গে কোথাও যাবেন, কিন্তু সেই ভক্ত কোন খবর দেননি বা আসেননি। তখন শ্রীম খুব ক্রোধ প্রকাশ করলেন এবং বললেন, 'সত্যের প্রতি আঁট না থাকলে কিছু হবে না। ঠাকুর সত্যস্বরূপ ছিলেন।' তাঁর এই কথা আমার খুব মনে আছে।


৫)

     শ্রীম-র জীবনযাত্রা খুব কঠোর ছিল। তিনি স্বাবলম্বী ছিলেন। নিজের রান্না তিনি একটা কুকারে তৈরি করতেন। তাতে ভাত ও তরকারি সেদ্ধ করতেন। দুধ খেতেন। বলতেন -দুধ খেলে মেধা হয়। রাতে এক চাকরকে দিয়ে একখানা পাউরুটি আনাতেন। তাই একটু তরকারি ও শেষে দুধ দিয়ে খেতেন। ভক্তেরা সন্দেশ, রসগোল্লা, মিষ্টি আনত। আমি গেলে আমাকে কিছু খেতে দিতেন। একদিন আমাকে সন্দেশ খেতে দেন। আমি বললাম, 'আমার খিদে নেই।' তিনি হাসতে হাসতে বললেন, 'দেখ, অরুচির রুচির জন্য সন্দেশের সৃষ্টি। আর তোমার এই সন্দেশে অরুচি! আচ্ছা থাক, তোমায় খেতে হবে না।'

     আমি ভাবতে লাগলাম শ্রীম আমাকে কত আদর করে খাওয়ান, আর আমি তাঁকে একটু কিছু খাওয়াতে পারলাম না। শ্রীম ছিলেন অন্তর্যামী। তিনি আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছেন। সন্ধ্যার পর সব ভক্ত চলে গেলে তিনি আমাকে বললেন, 'দেখ, আমার অসুখ হয়েছিল। শরীরটা ততো ভালো নেই। দিনে তো রান্না করে খেয়েছি। রাতে কি খাওয়া যায় বল তো?' আমি বললাম, 'আমার যখন টাইফয়েড হয়েছিল তখন আমি Milk-roll পাঁউরুটি খেতাম দুধ দিয়ে। এটি খুব তাড়াতাড়ি হজম হয়।' তিনি বললেন, 'কে আমাকে তা এনে দেবে?' আমি একখানা Milk-roll পাঁউরুটি একটা চায়ের দোকান থেকে কিনে আনলাম। ভাল দোকানে পেলাম না। তিনি গঙ্গাজলের ছিটা দিয়ে দুধের সঙ্গে সেই পাউরুটি খেলেন।

     তার পরদিন মর্টণ ইন্সটিটিউশনে পৌঁছে দেখলাম শ্রীম নিচের তলায় এক গৃহস্থের সঙ্গে কথা বলছেন। আমাকে দেখে তিনি দূরে এক বেঞ্চিতে বসতে বললেন। তারপর ঐ ভক্তের সঙ্গে কথা শেষ করে তিনি আমাকে চারতলায় তাঁর ঘরে নিয়ে গেলেন। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় তিনি আমার পকেটে পাউরুটি দেখেছিলেন। আমি তা তাঁকে দিলাম। ছাদের ঘরের সব ভক্ত তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সেদিন তিনি নানাবিধ ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ করেন। তারপর রাত নটায় সবাই চলে গেলে তিনি আমাকে থাকতে বললেন। সেদিন কেউ মা-জগদ্ধাত্রীর নানাবিধ একথালা প্রসাদ এনেছিল। তিনি ঐ প্রসাদ আমাকে খাওয়ালেন। তারপর আমার পাউরুটি তিনি একটু গঙ্গাজলের ছিটা দিয়ে দুধের সঙ্গে খেয়ে বললেন, 'বেশ রুটি।' এইভাবে আমি শ্রীম-র অনেক স্নেহ পেয়েছি।

     শ্রীম চাইতেন সাধুরা সদা ঈশ্বরের উপর নির্ভর করবে, কোন গৃহস্থের ওপর নির্ভর করবে না। আমি বাগবাজার উদ্বোধন বাড়ি থেকে তিন-চার মাইল হেঁটে শ্রীম-র কাছে যেতাম। শুকলালবাবু নামে এক ভক্ত আমাকে ট্রামের ভাড়া এক আনা দিতেন। একদিন আমি ফিরে চলে যাব, কিন্তু শ্রীম শুকলালবাবুকে আটকে রাখলেন। আমি তখন হেঁটেই ফিরে গেলাম।

     একবার স্বামী বিশ্বানন্দ বোম্বাই থেকে এক ধনী শেঠকে শ্রীম-র কাছে নিয়ে গিয়েছেন। তিনি তাঁকে ভগবানের কথা অনেক বললেন। তারপর তাঁরা যখন চলে যাচ্ছেন, শ্রীম বিশ্বানন্দ মহারাজকে ডেকে বললেন, 'দেখ, সাধুর পেছনে পেছনে ভক্ত যাওয়া ভাল, কিন্তু ধনী ভক্তের পিছনে পিছনে সাধুর যাওয়া ভাল নয়। তোমার প্রতি যদি তাদের শ্রদ্ধা না থাকে, তোমার কথার প্রতিও তাদের শ্রদ্ধা হবে না। ভগবানের উপর নির্ভর করবে, ধনীদের উপর নয়।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন