রবিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২২

প্রবন্ধ * নিমিত দত্ত




কবিতার সন্ধানে

নিমিত দত্ত 


বেশ কিছু দিন ধরে যে প্রশ্নটা আমাকে ভাবাচ্ছে তা হল,আধুনিক কবিতা নামে যে অর্ধপাচ্য মিশ্র পাচনটি আমাদের বৌদ্ধিক সমাজে একটা ওলাওঠার মতো নতুনভাবে স্থানিক ও বৈদ্যুতিক সমাজ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে তার কতটুকু গ্রহনীয় আর কতটুকুই বা বর্জ্যপদার্থ? একটা কথা হয়তো সার্বিকভাবে ধরে নেওয়া যেতেই পারে যে অধুনা বাংলার শিক্ষিত সমাজের একটা বড় অংশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাহিত্যের ও বিশেষ অর্থে কবিতার দাসত্বের থেকে পুরোপুরি মুক্তি নিয়েছে। তাদের দৈনন্দিন কৃতকর্মের মধ্যে নেটফ্লিক্স ও ফেসবুক যেভাবে দাগা বসিয়েছে সেইভাবে শ্রীজাত বা পিনাকী ঠাকুর হামাগুড়ি মারতেই পারেনি। কিন্তু প্রথমেই যে প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেছি আবার ঘুরে ফিরে সেখানেই আসতে হচ্ছে অর্থাৎ সার্থক কবিতার অন্তস্থল এত বেশি কন্টকিত ও দুর্ঘট হয়ে উঠলো কি উপায়ে? 


এই প্রসঙ্গে আমার একটি ব্যক্তিগত থিওরি আছে,,,, আমাদের পুর্বপুরুষ কবিদের অধিকাংশ এক স্বতঃস্ফূর্ত সাধন প্রচেষ্টায় একদিন তারা কাব্য সরস্বতীর বরপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। এভাবেই সৃষ্টি হয়েছিল এমন গুটিকয়েক কবি যাদের এখন আমরা প্রাজ্ঞ মনীষা হিসাবেই ধরতে পারি। সেই বৃত্তের বাইরের অনেক কবিতাপ্রেমী কিংবা কবিতা যশোলিপ্সু কবি ছিলেন যারা আজ কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছেন।( উদাহরণ স্বরুপ তাদের দুচারজন এর নাম  না হয় উল্লেখ নাই করলাম) 


ঠিক  সেই একই রকমভাবে আমাদের যুগেও বেশ কিছু ফাকিবাজ কবিকুলের সৃষ্টি হয়েছে। তারই ফল স্বরুপ আজকের দিনের অধিকাংশ কবির সৃষ্টির মধ্যে সাহিত্যের ধন সত্যিই বড় বিরল। এক্ষেত্রে যদি একটা তুল্যমূল্য বিচারের পথে যেতে চাই তবে লক্ষ্য করবো বিনয় মজুমদার বা মনীন্দ্র গুপ্তের মতো উচ্চকোটির কাব্যস্রষ্টার মধ্যে সব সময় যে তিন সাহিত্যের মহাগুন ফুটে ওঠে এখনকার ভুইফোড় অনেক কবির কবিতায় তা অমিল। যেমন রাজনীতি ও মানুষ ; সমাজ ও তার সাম্প্রতিক মনস্তত্ত্ব সেইসাথে ইতিহাসবোধ বা কালচেতনা। সার্বিকভাবে এই তিন ধারার ত্রিবেণী সঙ্গমে নিষ্কাশিত হয় এক কাব্যিক সুষমা নামক পুন্যতোয়া নদীর। 


প্রকৃত কবির কলমের কবিতা ও  বহুপ্রজননক্ষম কবির কবিতায় কোনো তুলনায় চলে না। নমুনা হিসেবে রবীন্দ্রনাথের সহজপাঠের শিশুপাঠ্য থেকেই দুই একটা উদ্ধৃত করা যাক,,, রাম বনে ফুল পারে। গায়ে তার লাল শাল। লাল ফুল তোলে। নীল ফুল তোলে।,, " ইত্যাদি। যেহেতু এটা একটা শিশুসুলভ বই তাই কবি স্বাভাবিকভাবেই শিশু মনের সহজ গতির সাথে মিল রেখেই একটা  বর্ননাত্মক ভঙ্গিমায়  বহির্বিশ্বের সাথে কথা সাহিত্যের সংযোগ প্রয়াস করেছেন মাত্র।  বিদ্বোৎজন মাত্রেই স্বীকার করবেন  ভাব ও ভাষার ক্ষেত্রে একটা প্রাথমিক শিক্ষার গ্রন্থের জন্যে এইটুকুই যথেষ্ট। কিন্তু মজার ব্যাপার শুধু এইটুকুন শিখেই আজকের কবিতা-লেখক কবি যশোপ্রার্থী হতে চান। রসিকজন একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবেন যুগের যন্ত্রণা ও জটিলতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভাষাসাহিত্য এবং ভাষাকবিতার অনেক বাকবদল ঘটে গেছে। এখনকার কবিতা গতিশীলতায় ও রুপকধর্মীতায় অনেকটাই সেজে উঠেছে। এই প্রাথমিক গুনাবলীর সাথে সাথে আধুনিক যুগের একজন সার্থক কবির কবিতায় এই সময় এর যুগ যন্ত্রণার ও মানবিক বৈকল্যের পদচিহ্ন যেন অবশ্যই সঠিকভাবে ফুটে ওঠে,তাতেও কবিকে সচেতন থাকতে হবে। যেমন সুনীল কুমার মোদকের এই কবিতা,,,, 

"অভিযাত্রা",,,

অবসরে যাবো কটা মাস বাকি / সবাই নিজের নিজের খুজে নিয়েছে আশ্রয় / আমিই এক নন্দগোপাল, / রাধা নেই বাশিটিও কি আছে? /তবু খুজে ফিরি কদমের গাছ।

সন্ধ্যে হলেই নেশাগ্রস্থ চাঁদ /আমাকে নিয়ে যায় তরলের অভিযাত্রায়। "

এবার উপরের কবিতায় একটু মনোনিবেশ করুন। নিজে নিজে একান্তে ভাবতে গেলেই দেখুন সবটুকু না হলেও কবি কিন্ত বেশ মুন্সীয়ানার সাথেই কবিতার এই কয়েকটি চরণেই নিজ অভিজ্ঞতার নির্যাসমিশ্রিত একটা যুগ যন্ত্রণাকে তুলে এনেছেন। 

একটা  সম্পুর্ন মানুষের মতোই ভালো কবিতার মধ্যে কবি হাড়মাংস দিয়ে জলজ্যান্ত একটা কাঠামো খাড়া করে তোলেন। অনেক দোষগুণ নিয়ে ব্রনের দাগ আর থ্যাবড়া নাক নিয়েই সেই কবিতা সুন্দর হতে পারে। পটে আকা ছবির মতো চাকচিক্য আর রংবাহারি তার না হলেও  চলে। এই সময়ের অনেক কবিই নিজস্ব মেধা ও সাধন এর গুণে একটা কালচেতনা ও মনস্তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট সহ ভিন্নধারার কবিতা রচনায় পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। যেমন উদয়শংকর বাগের একটা কবিতা সাময়িকপত্রের থেকে উদ্ধার করা যায়----- 


"দরজা "

জানালার পাশে এসে দাড়িয়ে / কথা বলো কেন? /জানালা দিয়ে পুরো আকাশ দেখা যায় না / দরজা খুলে বেরিয়ে এসো /কথা বলো,,, 

দেখো, খোলা প্রান্তরে / কেমন নির্মল আকাশ মিশে গেছে। "


এইভাবে কবি যেটুকু দেখেছেন ও বুঝেছেন বাস্তবতার সাথে কোভিড মহামারী উত্তীর্ণ একটা নতুন জগতের সবচেয়ে দরকারী কথাটাই তার নিজস্ব মেধা মিশিয়ে সহজ সুন্দর ভঙ্গিমায় উচ্চারণ করেছেন। আর সেইকারনেই এইসব শব্দগুচ্ছ সাধারণ বিবরনমুলক গদ্যের সীমানা ছাড়িয়ে অনন্ত কাব্যিক আকাশে ঊড়ান দিতে পেরেছে। 

ঠিক এইভাবে মল্লিকা সেনগুপ্ত,অলোক সরকার, শঙখ ঘোষ,উতপল বসু, কবিতা সিংহ, অমিত কাশ্যপ, একরাম আলি, অজিত বাইরি,শ্যামলকান্তি দাস,  নাসের হোসেন প্রভৃতি অনেকের কবিতারই উল্লেখ করা যায়। বাহল্যবশত তা স্থগিত রাখলাম।


উপসংহারে  আবার যদি কবিগুরুর সহজপাঠেই ফিরে যাই এবং জিজ্ঞাসুভাবে একগুচ্ছ প্রশ্ন করা যায়,,, ১) রাম বনে কেন ফুল পারে? ২)এই উৎপাটিত হবার সময় ফুলের মনোভাবটি কি? ৩)রামের ও ফুলের মধ্যে কি একটা পারস্পরিক শত্রুতার সৃষ্টি হচ্ছে? ৪)আবার পারিপার্শ্বিক বিশ্ব রাম ও ফুলের বিষয় নিয়ে কি মনোভাব পোষণ করে এই মুহুর্তে এইসব নানাধরণের প্রশ্নের উত্তর যদি কোনো একটা রুপকভাষার মাধ্যমে ইশারাধর্মী শব্দ বুননে পারদর্শী কোনো এক আধুনিক কবির কবিতায় জারিত হয়ে উঠতো,, হয়তো বা সেটা খুবই সার্থক ও যুগোপযোগী হত।রাম ও ফুলের আশ্রয়ে একটা নতুন আলো - আধারি সম্ভাবনাময় কবিতায় উত্তীর্ণ হতে পারতাম আমরা। যেমন আবার সেই পাঠের সহজতায় ফিরে যাই,,, 


"কাল ছিল ডাল খালি /আজ ফুলে যায় ভরে, 

বল দেখি তুই মালি / হয় তা কেমন করে?,,,,


ভাষা অতি তরল, তবুও  কবি এখানে বিশ্বজগতের অপার রহস্যের প্রতি অপাপবিদ্ধ শিশুর মানসিক বিকাশধর্মীতা যে কোতুকে তুলে ধরেন, তা  এক কথায় অনবদ্য। শিশুর কৌতুহলপুর্ন চাহনিকে জগতের সাথে যেভাবে মিলিয়েছেন তাতেই একটা কাব্যিক সুষমা ছড়িয়ে পড়ছে বহুদূর।


**********************************************************************************************



নিমিত দত্ত 

 জন্ম ১৯৭৬ সালে, বসতবাড়ি শ্রীরামপুর।পিতা নিতাই চন্দ্র দত্ত ও মা বেলা রাণি দত্ত। শৈশব থেকেই সাহিত্যের প্রতি গভীর আগ্রহ। রবীন্দ্রনাথ, শরত,বিভুতি মানিকের থেকে শুরু তারপর  আলবেয়র কামু  বা ফ্রাঞ্জ কাফকা ইত্যাদি।   স্কুলের ম্যাগাজিন ( দোয়ালা) হাতেখড়ি। তারপর স্থানীয় ও কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি (অভিনব অগ্রনী/ শিশুমেলা /আম আদমি /শরতশশী / কিশোর বিজ্ঞান)  ইংরেজি সাম্মানিক স্নাতক ডিগ্রি ও বিএড করে ২০০৫ থেকে বীরভূমের গ্রামের স্কুলে শিক্ষাকার্যে লিপ্ত।এখন হুগলি জেলায় স্থানান্তর।   শিশুসাহিত্য, লৌকিক সংস্কৃতি ও অনুবাদ সাহিত্য রচনায় বেশি আগ্রহ। অবসরে গ্রন্থপাঠ, ভ্রমণ ও বিভিন্ন চলচ্চিত্র, নাটক দেখার শখ।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন