রবিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২২

গল্প * শরদিন্দু সাহা

 



মহাপ্রস্থানের পথে

শরদিন্দু সাহা


নিঃশ্বাসটার চলন তখনও ঘন ঘন। এত দ্রুত যে ঘটনাটা ঘটে যাবে অমৃতলাল ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। চারপাশের গরম হাওয়াটা যেন চু  কিত কিত খেলছে। দু-একটা মশামাছি কোন ফাঁকে এসে নাকের ছিদ্রের মধ্যে জয়ধ্বনি করছে এমন করে যেন বেঁচে থাকাকেই চাগিয়ে তুলছে। ওদের বনবন শব্দই একান্ত আপন হয়ে ওকে আগলে রাখছে, পরম আত্মীয় ছাড়া কিইবা ভাবা যায় এই অসময়ে। সময়টা যে এত অনাদরে এসে জড়িয়ে নেবে কে আর জানত। খাঁচাটা ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে যেন। কখন যে কে এনে এখানে ঢুকিয়ে দিয়েছে, সেটাও যে কিভাবে? চলন্ত ট্রেনের দম আটকানো এক বগির কায়াহীন ছায়াময় এক ছবির  মুহুর্তটাই ডুব সাঁতার কাটার সময়ে স্মৃতি-বিস্মৃতির মায়াজালে কারণে অকারণে ঘোরাফেরা করে।


 সময়টা জানিয়ে দিচ্ছিল অনেক কথাই বোঝা না বোঝার মাঝখানে। এ এক অদ্ভুত সন্ধিক্ষণ, স্মরণ-বিস্মরণের অতল তলে। জানার কথা তো অনেক কিছুই ছিল। কোনরকমে নাকে-মুখে গুঁজে বউয়ের আঁচল টেনে মুখটা মুছে সেই যে চণ্ডীমণ্ডপে নমস্কার সেরে দৌড় লাগালো সে তো আর থামলোই না। পথে দু-একটা বড় বড় গর্তের মুখ থেকে ধেড়ে ইঁদুরগুলোও ওর দৌড়ে যাওয়ার দিকে পলকহীন নেত্রে দেখল। ওরাও ওর পথের নিশানায় ছুটল, এই বুঝি বাঁচার রসদ জোগাড় করবে বলে একঘর ঢুঁ মেরে দেওয়া। ধুলো মাটির উপর সদ্য মোরাম মাটির রাস্তার দুধারে কাঁচাপাকা ঘাসগুলোর উপরই পা ফেলে ফেলে দমবন্ধ করে ছুটে যাওয়া। একগোছা ধান হাতের মুঠোয় ধরে কাস্তেটা উপরে তুলে করিম চাচা মাঠের মাঝখান থেকে ডাক দেয় – ও অমৃত, আস্তে যা, হোঁচট খাবি যে, পেটে খিদে নিয়ে এমন করে দৌড়তে আছে। সব কথাই কানে এসেছে। ভাবিস নি, সব ঠিক হয়ে যাবে। কাজে যাচ্ছিস যা, মাথাখানা ঠান্ডা রাখিস। গাঁ গঞ্জের  মানুষ আমরা, শহুরে মানুষগুলোর সঙ্গে মানিয়ে গুনিয়ে নিস।


আচ্ছা গো আচ্ছা, ছোটার বেগটা না হয় একটু থামিয়ে দিলুম, কিন্তু ওদিকে যে ট্রেনটা ছুটে যাবে। একবার চলে গেলে আর ধরব কেমন করে, সেই তো আবার বেলা গড়িয়ে গেলে…।


পায়রার গল্পটাই পাক খেয়ে হৃদয়ের পাঁজরে এসে ধাক্কা মারলো। খাঁচাটাও নড়েচড়ে উঠলো। মনটা তো বেজায় খারাপ। পায়রার ডিমগুলো জানালার নিচ থেকে বাসাশুদ্ধ এমন নিষ্ঠুর ভাবে লাঠির ঘায়ে টান মেরে ফেলে দিতে হল, পড়ে গিয়ে ফটাস ফট। মা পায়রা  কখন যে কোথায় উড়তে বেরিয়ে গেছে, কে জানে। উপায় তো ছিল না, এমন বিদঘুটে গন্ধ, গায়ের পোকাগুলো শেষে কানের  কাছে এসে  না বাসা বাঁধে। ঘরে ছেলেপুলে রয়েছে, ব্যামো হলে সারাবার কি কোন উপায় আছে? পাঁচ-সাত মাইলের মধ্যে কোন স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। ডাক্তার তো দূরের কথা, কোয়াকই না হয় সই, তাও-বা মিলে কই। মনের মধ্যে দলা পাকানো ব্যথাটা ওর দৌড়ানোর ফাঁকে-ফাঁকেই এসে ঝাঁকিয়ে দিচ্ছে বারে বারে। আরো তো অনেকটা পথ, জিরোতে তো একটু হবেই। অমৃতলাল বুকে হাত দিয়ে রাস্তার এক কোনেই বসে পড়ে। সাইকেল ভ্যানটা বেসামাল হয়ে কোমরে ধাক্কা দিলে ছিটকে বিলের ধারে পড়ে যায় – ও কাকা, লেগেছে বুঝি। দু চারজন এসে ধরাধরি করে উপরে তুলে বসিয়ে দেয়।

'নাগো, তেমন কিছু হয় নি, তোমাদের তো রোজ-এর কাজ। যাও কাজে যাও।' একটু ধাতস্থ হলে অমৃতলাল হাত-পা-টা ডানে-বাঁয়ে ছোঁড়াছুঁড়ি করে আবারো দৌড়াতে শুরু করে। ট্রেন কি আর দাঁড়ায়? স্টেশনের কাছে আসলেই ট্রেনের গতিটা ড্রাইভার সাহেবের দয়ায় একটুখানি ধীরগতি হলে অমৃতলাল কাঁধে ব্যাগটা ঝুলিয়ে মাটির নিচ থেকে দু-হাতেই হ্যান্ডেলটা তড়িঘড়ি করে জাপ্টে ধরে। ভিড়ে ঠাসা ট্রেনে দু'একজন টেনে তুললে ও কোনার দিকে একটু জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। কি জানি কেউ যদি আবার ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়, তাইতো লোহার রডটা উল্টো দিক থেকে হাত ঘুরিয়ে শক্ত করে চেপে ধরা।


ছবিটা ক্যামেরার রিলের মত ঘুরে ঘুরে এই অব্দি এসে আবার মিলিয়ে যায়। অবচেতন স্তর থেকে চেতন স্তরে ফিরে আসতে কত না সময় লাগে। গতি কখনও কখনও এগিয়ে তো দেয়ই না, পিছিয়ে দেওয়ার খেলা খেলে। কাছের ছবি, কত দূরের ছবি এসে ধরা দিতে শুরু করে, একটা অন্যটার উপর চেপে বসে। ইচ্ছে তো হয় দুই হাতে জড়িয়ে ধরে কিন্তু কোথায় যে ফাঁকতালে ফুরুত করে চলে যায়, ওর ঘরের কোনের কাছে জঙ্গলের শেয়ালগুলো হুক্কা হুয়া ডাক ছেড়ে যেমন করে পালায়। কত তো শব্দ আসছে - খচর-মচর, ধুপধাপ, ধমাস ধমাস, মচাৎ মচাৎ। সেইসব শব্দের বাজনাগুলো আজ যেন বড় বেশি করে বেজেই চলেছে, থামতেই চায় না। চোখের পাতাটা যে মেলে ধরে আলোর মেলায় খুনসুটি খেলবে, তা তো হওয়ার নয়, ভুলেই তো গেছে কেমন করে সেই খেলা শুরু করতে হয়। 


ফিরে ফিরে যায় অমৃতলাল খাঁচা টপকে ট্রেনের বগির দম বন্ধ হয়ে আসা জনরবে। খাঁচাটা ডানে-বাঁয়ে মোচড় খেয়ে ছুটে চলে যায়। উড়াল পুলটার ডানাটা সোজা নাক বরাবর গিয়ে বেঁকে গেছে একটু একটু করে। ব্রেকডাউন হওয়া গাড়িটার পেছনে থমকে গেলে কথাগুলো ভাঙতে শুরু করে। আরম্ভ তো করেছিল ওরা, যা মন চায়। গল্পের ফিরিস্তি কি আর থামে, যা নয় তাই বলে। এমন যে সেই গল্পের রস, জমাট বাঁধার আগেই ছড়িয়ে গিয়ে এর তার স্বরসন্ধিতে গিয়ে ধাক্কা মারে। কি নেই সেই গল্পে। চল্লিশ বছর আগের জমির মালিক হওয়ার গল্প, বাপ ঠাকুদ্দার মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জমি চাষের গল্প। কবে ভাগের মা গঙ্গা পায়নি, সেই সব দিন ফুরিয়ে যাওয়ার গল্প। মুখ থেকে সেই কথা টেনে নিয়ে কেউ আবার গৌড় বঙ্গের গল্প শোনায়।  আরেক জন যাত্রী এসে উঠতে না উঠতেই শরীরটাকে ঢুকিয়ে দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টায় অমৃতলালকে কনুইয়ের গুঁতো মারে। হোঁচট খেয়ে আরো এক পা পিছিয়ে যায়। দরদর করে ঘামতে শুরু করে, এক সময় গেঞ্জিটা ভিজে গিয়ে নোনা ঘাম জামার সামনে-পিছনে চুনের দাগের মতো ফুটে উঠলে অমৃতলাল ভয়ে চমকে যায়। বিড়বিড় করতেই থাকে - এইরে সর্বনাশ, এখন কি হবে? বাবু তো দরজা দিয়ে ঢোকার মুখেই হিড়হিড় করে বের করে দেবে। কত তোষামোদি করেই না চাকরিটা পেয়েছিল। না করেই বা উপায় কি ? পঞ্চায়েতে নালিশ জানিয়েও তো কোন ফয়সালা  হয়নি। হারু গায়েন, জোতদার নারু গায়েনের ছেলে জোর জবরদস্তি করে অপারেশন বর্গার সময়ে পাওয়া বাপকেলে তিন ফসলি জমিটা কেড়েই নিয়েছিল, হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল সামান্য কটা টাকা, বড় মেয়ের বিয়ের পণের টাকা না হয় কিভাবেই বা জোগাড় করতো। জামাইকে ফুসলিয়েই না হারু এইভাবে ওর জমিটা বাগিয়েছে। শুধুই কি জমি, গোপনে জানতে পারল ভিটে থেকে উচ্ছেদ করার অংক ও কষছে। দোষের মধ্যে এই ছিল যে  মেয়েটাকে  ভোগের জন্য ওর হাতে তুলে দেয় নি, তাই ওর এত কারসাজি। 'বাপ হয়ে এমন জল্লাদের হাতে মেয়েটাকে তুলে দিতে পারি আমি?' পেটে ভাত জুটছে না বলে পাশের পাড়ার দেবদাসদাকে হাতে পায়ে ধরাতে বলল, 'সিকিউরিটির কাজ করবি তো দেখতে পারি।' মাস দুয়েক পরে হাটে যাওয়ার পথে নদীর ঘাটে একটা লম্বা-চওড়া শব্দের অনুরণন কানে বাজলো – খবর আছে অমৃতলাল। 'কি খবর গো দাদা?' 'জবর খবর। একটা হিল্লে হয়েছে তোর। আর তোর কোন দুঃখ থাকবে না। জমিটাও ছাড়িয়ে নিতে পারবি।' কথাটা বিশ্বাস না করে পারলো না অমৃতলাল। শুনেছিল বটে, দেবদাস একটা ট্রান্সপোর্ট আর কনস্ট্রাকশন কোম্পানির সুপারভাইজার, মাইনেকড়িও নেহাত কম নয়। ঠাটবাট দেখেই অনুমান করা যায়। পাড়ার লোকেরা, হিন্দু-মুসলমান সবাই কথায় কথায় নমস্কার আর সেলাম ঠোকে। দেবদাসও বদান্যতা দেখাতে কসুর করে না। পরম আত্মীয়র মতো পরিবার-পরিজনদের ভালো-মন্দের খবর নেয়।  কোম্পানিতে যে ও বড় সাহেবের একেবারে ডান হাত, একথাটা পাড়ার লোকের মুখে মুখে ফেরে। কত ক্ষমতা, হেন কাজ নেই, দেবদাস আদায় করতে পারে না। সাহেবও নাকি অন্ধের মত বিশ্বাস করে। মারোয়ারি কোম্পানির বাঙালি সাহেব। 'স্যার, গাঁয়ের ছেলে, একটা ব্যবস্থা করে দিতেই হবে, যে করে হোক।' দেবদাস নাছোড়বান্দা,  না করে আর উপায় কি, কথায় যেন মধু ঝরে, তাতেই সাহেব গলে যায়। এমন একজন লোকের কথাকে ঘোড়ার মুখের কথা না ধরলে চলে। আহা, কী বড় মানুষের মন! না হলে আজকাল কে কার কথা মনে রাখে। কথায় কথায় সে কবে আর বলে রেখেছিল। 'অ দাদা, তোমার চরণে গড় করি গো।' নিজের মনেই বলতে থাকে অমৃতলাল

– লোকে বলে ভালো মানুষের আকাল পড়েছে, কই  তেমনটা তো নয়।


 হাজার পাঁচেক টাকা বেতন বটে, সারাদিন তো ওই গেইট আগলে বসে থাকা, খোলা আর বন্ধ করা। পেচ্ছাপ পেলে যে বাথরুমে ছুটবে তারও কি উপায় থাকবে, সেই তো চেপে বসে থাকতে হবে যদি দেখতে না পেয়ে বাবুর গোস্সা হয়, গালাগাল দিয়ে ভুত বানিয়ে দেয়, মোটা চামড়া না হলে সহ্য করা যারপরনাই  মুশকিল। দেবদাস  ডেকে বলল,'বুঝলি অমৃতলাল  অধৈর্য হলে কোম্পানিতে চাকরি টিকবে না। মন দিয়ে কাজ করিস। সাহেবের দয়া হলে বেতনটা দিনে দিনে ঠিক বাড়বে আর যদি মালিকের নজরে পড়ে যাস, তাহলে তো কথাই নেই, কপাল খুলতে সময় লাগবে না।  কথায় আছে না সবুরে মেওয়া ফলে।' বিশ্বাস না করেই বা উপায় কি। কি জানি বাবু আর দেবদাসের মাঝে অন্য হিসেব আছে কিনা, সে তো আর ওর জানার কথা নয়। কিন্তু আজ যে কি দশা হবে, ঈশ্বর জানে। বাবু নাকি বড্ড খুঁতখুঁতে, সিঙ্গেল লাইনের হাল হকিকত তো ওর জানার কথা নয়। লোকটা আবারো কনুই দিয়ে গুঁতো দিল। এবারের গুঁতোয় একদম সোজা গিয়ে তলপেটে এমনভাবে ধাক্কা খেলো নাড়িভুঁড়ি সব বের হয়ে যাবার জোগাড়। লোকটাকেই বা দোষ দেয় কি করে? ওর শরীরের অর্ধেকটাই তো বগির বাইরে ঝুলছে, লোহার পিলারের ধাক্কা খেলে মাথা ফেটে চৌচির হয়ে ছিটকে পড়বে ঝোপ-জঙ্গলে। ঘুঘনির ডেকচি মাথায়, আঁচার-মুড়ি-চানাচুরের বাক্স  কাঁধে ঝোলানো হকাররাও তো হোঁ হোঁ করে ধুস্ বলে গোত্তা মারছে।  অমৃতলালের পেটে শুরু হয় এক অসহনীয় যন্ত্রণা। কি যে করা যায়, কাকেই বা দুঃখের কথা বলবে। বগির বাকি সকলে ঘেঁষাঘেঁষি করে নানা গল্প-গুজবে মত্ত,  পাখাটাও এত জোরে বন বন করে ঘুরছে, কারো কথাই কানে আসছে না, ব্যথাটার কথা জানিয়ে যে জ্বালা জুড়োবে, তারও কি জো আছে। তবুও কথা যে বলেই চলে, কি জানি পথচলার কষ্টটা হয়তো ঝিমিয়ে থাকে। 


স্মৃতিটা আবারও যেন খানিকটা বেসুরো গাইল। অনেক করেও টানাটানি করল, কিছুতেই যেন কিছু হল না। মনে হল পাড়াগাঁয়ের হ্যারিকেনের সলতে উসকানোর মতো কে যেন এসে ডান দিক ঘোরালে জ্বলে উঠছে আবার বাঁ দিক ঘোরালে নিভে যাচ্ছে। অমৃতলালের বুকের দুপাশে হাত দুটো লম্বা হয়ে কাপড়ের সঙ্গে সেঁটে আছে, নড়াচড়ার ইচ্ছেটুকু ভোজবাজির মতো উবে গেছে। ভাবনাগুলো টুকরো-টাকরা হয়ে ছিটকে যাচ্ছে, আবার জমাট বাঁধছে। জীবনটা এমন করে কি দাগা দিয়ে যায়? একটা অবোধ কষ্ট ওর দুচোখের ভেতর থেকে টপটপ করে জল হয়ে গড়ালো। গড়িয়ে গড়িয়ে ওর জিভের ডগায় এসে ছুঁল। কই কোনো স্বাদ তো পেল না। তবে কি…। এবার ইচ্ছে করেই ও পা-দুটো গোড়ালি দিয়ে ঘষটাতে লাগল, না তেমন তো কোন শোধবোধ নেই, সবটাই অসাড়। চোখ দুটোও ঘোরাবার চেষ্টা করল, কই  কোন অনুভূতি এসে ধাক্কা তো মারল না! কি আর করে, আবার নিজে থেকেই নিজের ভুবনে ডুব দিল। কত কথাই তো ভেবেছে। কতবার করে মা ঠাকুমার কথা নিয়ে কত গল্পই না শুনিয়েছে ছেলেপুলেকে। বানভাসি জলে কতবার তো মাটির দেয়াল ভেঙ্গে তলিয়ে গেছে, হাঁড়িকুড়ি আর বাকি যে সম্বলটুকু ছিল, সেও কি আর বেঁচেছে। প্রতিবারই তো ভাঙ্গে আর সরে সরে যায়  দু-তিনশ ফুট দূরে দূরে মাথা গুঁজবে বলে। যেবার অমৃতলাল-এর ঠাকুরমা জলে ভেসে গেল, ঠিক তার তিন বছরের মাথায় মা-ও গেল ভেসে। কত কাঁদাই তো কাঁদল। মাটি আঁকড়ে পড়ে রইল, মাথা ঠুকলো, সান্তনা দেবার কেউ তো ছিল না হাতের কাছে। এসেছিল বটে দিন কয়েক বাদে দুরসম্পর্কের এক পিসি, সে আর কি বলবে! ওঁর কোমরটা তো ভেঙ্গে দিয়ে গেছে ভিটের অংশীদারিত্বের দাবি নিয়ে ভাসুরের ছেলেমেয়েরা। অবস্থা বুঝে ছেলে বউ দিয়েছে ভিন্ন করে। লাঠিতে ভর করে এসে মাথায় হাতখানা রাখলে জড়িয়ে ধরে ঝর ঝর করে কাঁদল অমৃতলাল, বলল, 'পিসি গো, তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? একটিবার সময় হলো না দেখে যেতে, কেমন আছি। তুমি ছাড়া আপন বলতে আমার আর কে আছে বল। তোমার চরণ দুটো দাও দেখিনি একটু পায়ের ধুলো মাথায় নি।' এতদিন বাদে ছয়-ছয়বার বাস্তুচ্যুত হবার পর সাত মাইল দূরে বিডিও সাহেবের দয়ায় ঘর বাঁধলে স্বস্তি হলো বটে, তবে কিনা এতদিনের সব হারানোর যন্ত্রণা কি পূরণ হয়! দুঃসময়ে কে আর এসে দুঃখের ভাগবাটোয়ারা করে। একি আর সেই সুখের দিন যে বসতে দিলে  শুয়ে পড়বে, পাত পেতে খেতেও লাজলজ্জার বালাই থাকবে না। সব কথাই এখন জাপটে ধরেছে এক এক করে। 


খাঁচাটা হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। অমৃতলাল-এর শরীরটা জোরে এক ঝাঁকুনি খায়। মিছিলের পাশ কাটাতে গিয়েই কী এমন দশা হল! শত শত লোকের কণ্ঠস্বরই ওর মিছিলের স্মৃতিকে উসকে দেয়। পঞ্চায়েত থেকে আবাস যোজনার টাকার লোভে, নাকি বিনে পয়সায় শহর দেখার টানে ছুটে এসেছিল ফ্ল্যাগ হাতে করে, সে এখন আর মনে পড়ে না। তবে বেশ লেগেছিল। শহরের বাবুরা, বউ-ঝিরা অফিস আদালত ঘরবাড়ির জানালা আর ছাদ থেকে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখেছিল ছাপোষা গেঁয়ো লোকগুলোর কাণ্ড কারখানা। লাখো লোকের সমাবেশে নিজেকে মনে হয়েছিল এইটুকুনি অথচ ওদের চার গাঁয়ে নিজেকে কত্ত বড় লাগে। 'কেন এমনটা হয় কি জানি? জীবনটাই বোধহয় এইরকম,  গরিব-গুরবো মানুষগুলোর জন্য এক নিয়ম আর বাবুলোকদের জন্য আরেক নিয়ম। কত তো নিয়মকানুন, ওরা কি ছাই জানে। গায়ে গতরে খেটেও তাদের দুবেলা দু'মুঠো ভাতই জোটে না, নিয়ম জেনে কী লাভ! আর নিজের কথা! তা বলতে কি কিছু আছে? ছাই ফেলতে ভাঙ্গা কুলো ওরাইতো পিঠ পেতে বসে আছে কখন বড়দা মেজদাদের কিল-চড় খেতে হবে, সে যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতা কি ওর আছে? তবে হ্যাঁ, ওদের গাঁখানা কিন্তু মনের মতো, তবুও কারা যেন সব ছারখার করে দিয়ে আহ্লাদে আটখানা হতে চায়। সকলের বলার ঢং আর ভাষাগুলো এখন কেমন যেন রসকস হারিয়েছে। দু'চারখান ঘরে, ক্লাবে টিভি এসেছে কিনা। সব গাঁয়ের মানুষগুলোকে কি গেলাবে আর কেমন করে গেলাবে, ওরা সব কায়দাকানুন জানে। কেমন সুন্দর গিলিয়ে দেয়। কিন্তু একটা জিনিস ওরা জানেনা, ওদের ঘরগেরস্তি, চাষবাসের রীতিনীতি আর জ্ঞানগম্মী। এ কথাখান ঠিক, ছেলেপুলেরা এখন আর মাঠের পানে যেতে চায়না। দোষের কি আছে ওদের! রোজগারপাতি তেমন আর আছে কই আগের মতো?  ফসলের দামও তেমন আর মেলেনা। ও কি নিজেও জানত, এই মনহীন শহরে এসে একদিন মাথা গলাতে হবে। ওদের গাঁয়ের মানুষের মনগুলোও কি কেউ চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে? খাল-বিলের জলের রং টা তাই কী এত লাল! পোড়া শরীরের গন্ধ ভাসে হাওয়ায় হাওয়ায়!


অমৃতলাল-এর মাথার স্নায়ুগুলো কেমন আপনা আপনি ঘুরতে থাকে। কত কথাই না মনে করে নিজেকে নেড়েচেড়ে দেখতে চায় – ঠিক আছে কি নেই, থাকলে কোথায় আছে? কোথায় যাবে ও এখন? তবুও নিজের বাড়ি ঘরের কথা ভাবে। কত পরিকল্পনাই না ছিল, সামনের ঘরখানার পাশাপাশি আরেকখানা ঘর তুলবে। মাটির হোক তাও সই। ঘরের চালে এবার খড়ের ছাউনি না দিয়ে এসবেস্টার দেবে। ভবিষ্যতের কথাটা ভাবতে হবে তো। ছেলেটা সেয়ানা হচ্ছে, এখন কত গোপনকথা জন্মাবে, কত আলোছায়ার জীবন এসে টানাহ্যাঁচড়া করবে। তা করছে করুক, বাপ হিসেবে একটা কর্তব্য তো আছে তার, নাকি।


এবার স্নায়ুগুলো একটু জ্যান্ত হতে শুরু করলে মনে করার চেষ্টা করে ঠিক কখন উল্টো দিক থেকে সজোরে হুড়মুড় করে চারপাঁচ জনের একটা ধাক্কা এসে ওকে আরো একটু পিছনের দিকে ঠেলে নিয়ে গেল। প্লাস্টিকের চটিটার উপরে দুপায়ের পাতায় চেপে ধরে। কিছু বলার আগেই ওরা নানা কথা বলাবলি করে। কথাটায় জাতপাতের প্রসঙ্গ উঠে আসলে একজন তো চিৎকারে গলা ফাটায় 'মশাই কি ছিলাম আমরা? পর্তুগিজ আর ওলন্দাজরা এইজন্যই আমাদের হীদেন (ধর্মহীন) বলতো।' 'আর এক যাত্রী তো বেফাঁস মন্তব্য করেই ফেলে, 'এই তো বাঙালির দোষ, আত্মসম্মান বলে কিছু নেই, এটা একটা হুজুকে জাত, নাচানাচি ছাড়া আর কি বা জানে।' আরেকজন তো তেড়েই মারতে আসে,'গুনে বলুন তো বাঙালিরা কটা নোবেল পুরস্কার পেয়েছে? সত্যজিৎ রায় ঋত্বিক ঘটক মৃণাল সেনদের একটা করে চলচ্চিত্রের নাম মনে আছে ?' 'হ্যাঁ ওদের ভেজে আর কতকাল খাবেন?' 'জীবনানন্দের নাম শুনেছেন? কে ছিলেন বলুনতো লোকটা?' 'হ্যাঁ শুনেছি, দু'চারটে কবিতা লিখে ট্রামে কাটা পড়েছেন।' 'তাই বুঝি!' ' বুঝলেন না, এখন মনে হচ্ছে রবি ঠাকুর ভুল জায়গায় জন্মে গেছেন' 'অতীত না হাতড়িয়ে এখন কি হচ্ছে বলুন?' 'ভালো করে চোখ মেলে দেখুন, তবেই না দেখতে পাবেন। রোজ রোজ তো মনীষী জন্মায় না! এই আপনাদের মতো নিন্দুকরা থাকলে ওরা আসবে কোন দুঃখে। কত অপমানই তো ওদের কপালে জুটেছে। বাংলা মায়ের কোলে আপনাদের মতো  সুসন্তানরা থাকতে ওঁদের আসার কি দরকার বলুন?' নজরটা ওদের হঠাৎই অমৃতলালের দিকে চলে যায়। 'উত্তরটা তুমি কি জান?' 'এটা আবার কেমন কথা! আমাকে দেখে মনে হচ্ছে এসব প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারব? আমি বরঞ্চ বলতে পারি, কখন আউশ আমন বরো ধানের চাষ হয়, কেমন করে বীজতলা তৈরি করতে হয়, কখন চারাগাছ রুইতে হয়, কি করে ধান ছাড়িয়ে খড়ের গাদা তৈরি করতে হয়। কেমন করে গোলায় ধান রাখতে হয়। আপনারা কিন্তু মোটেও রাগ করবেন না বাবুরা। এসব মামুলি কথা অবশ্য আপনাদের জেনে আর কোন কাজে লাগবে? আমাদের আবার এইসব কথা না জানা থাকলে না খেতে পেয়ে মরতে হবে যে, চাষাভূষা মানুষ তো।' 'তাহলে কলকাতা শহরে ছুটছ কেন?' উত্তরটা মুখ থেকে বেরোতে যাবে, ঠিক তক্ষুনিই ওকে আরো কয়জন এসে চেপে আরো দু'তিন হাত পেছনে ঠেলে দেয়। 


অমৃতলাল যেন জীবনের ফেলে আসা কিছু সময়ের সঙ্গে  এই পিছু হটার মিল খুঁজে পায়। নিজের মনের জানালাটা খুলে দিলে রাক্ষুসী নদীর ছবিটাই তো ভেসে ওঠে। কতবার যে ওদের ঘরছাড়া করেছে। তাহলে কি এই মানুষগুলোর অভিসন্ধিও তাই, ওকে এক সময় ঠেলতে ঠেলতে কোনঠাসা করে দিয়ে এমন জায়গায় নিয়ে ফেলবে আর ফেরার পথটুকু থাকবেনা। এই হাঁপধরা অবস্থায় ওর ভেতরে যেন একটা তোলপাড় শুরু হয়েছে, ভাঙ্গনের চেয়ে কমই বা কিসে!


প্রথম দিনের অভিজ্ঞতাটা  কেমন পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে, কেমন আলাদা ঢঙের। ওর মতো আকাট মূর্খের সঙ্গে এত বড় বড় শহুরে পণ্ডিতদের কথা চালাচালি। এদের মধ্যে একজন বঙ্গের উত্তর প্রান্তের যাত্রী ছিল, গর্ব করে কিছু বলার মত ইচ্ছে হলো ওর। কথাটা যখন সাধারণ জ্ঞানের মতই ফরফরিয়ে উঠল, তখন বলেই ফেলে, 'আচ্ছা বলেন দেখি মধ্যযুগের ছাগল ভেড়া কুকুর বিড়াল পাখিদের জন্য কোথায় হাসপাতাল ছিল?' কথাটা শুনে হো হো করে সে কি হাসি, একজন দুজন করে গোটা বগি যেন অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে, 'সেটা তো আমরা বেশ বুঝতে পারছি, তা না হলে এত কিছু থাকতে এমন প্রশ্ন কে আর করবে!' দু'চারজন ভদ্রলোক লোকটাকে এই কথা বলার জন্য বাহবা দেয় – যারা না-মানুষদের জন্য এত ভাবিত ছিল, না জানি মানুষদের জন্য ওদের কত প্রাণ কাঁদত। 'এইভাবে ব্যঙ্গ করতে একটুও লজ্জা হচ্ছে না আপনাদের!' 

অমৃত লাল একটু সংকোচের সঙ্গে মাথাটা বাড়িয়ে দু-চার কথা বলতে চায়। 'ও তুমিও বলবে? তবে বলেই ফেল।' 'যাদের নিয়ে এত কথা হচ্ছে, এরা সকলেই কিন্তু আমাদের রক্ষা করে। গরু ছাগল ভেড়ার পাল দেখেছেন, এরা কিন্তু একটা নিয়মে চলে, আর আমরা মানুষরা যা করে বেড়াচ্ছি তাকে বেনিয়ম ছাড়া কিইবা বলব বলেন, অধম আর কি।' এমন একটা উত্তর যে ও দিতে পারে ওদের ভাবনায়ও আসেনি। আগুনে ঘি পড়ল। কিল চড় ঘুসি লাথি এসে টপাটপ অমৃতলালকে টেনে-হিচড়ে অন্য যাত্রীদের পায়ের তলায় ফেলে দেয়। প্রাণটা আদৌ আছে কি নেই ফিরেও তাকায় না –  চেহারা সুরতখানা গাঁইয়া কিনা, অমানুষ না হয়ে যায় কোথায়।  ভাগ্যিস দেবদূতের মতো লম্বা-চওড়া স্বাস্থ্যবান লোকটা পেছনে ছিল। মায়া মমতায় মাখামাখি হলে মাথাটাকে আলতো করে সিটে বসাতে চেয়ে কত কসরতই না করল। 'এলেম আছে মশাই আপনার!'  'মনের জোর ছাড়া আমাদের  আছেটা কি? বাঙালিরা শংকর জাত, আর্য অস্ট্রিক দ্রাবিড় মিলেমিশে এই যে আমরা, কেউ লম্বা-বেঁটে-মাঝারি, আবার কেউ ফর্সা-শ্যামলা-কালো কুচকুচে আর ধর্মে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-জৈন-খ্রিষ্টান হয়েও সকলে বেঁচে-বর্তে তো আছি কেমন ঠাসাঠাসি করে। একই ডিঙিতে তো চড়েবসা, গঙ্গা-পদ্মা-মেঘনা-যমুনার খাঁড়িতে বাঁধা না পড়লে কেমন তরতরিয়ে এগিয়ে তো যেতাম বলেন। কী যেতাম না?'


এত মধুর বাক্য আর প্রবচন সবকিছু মিলে শব্দের এত রেষারেষি, এরই মাঝে কে যেন থু করে একদলা থুতু ফেলল পায়ের কাছে। অমৃতলাল জবাবটা দিয়েই দিল, 'একি করলেন দাদা?' 'ফেলবো না বলছেন, ঘেন্না হচ্ছে?' 'তাই বলে পায়ের কাছে!' 'বেশি কথা আর বাড়িও না, এক ধাক্কায় পিষে দেব, যেটুকু বাকি আছে, তাও যাবে।' বারংবার ধাক্কা খেয়ে অমৃতলাল সজাগ হয়ে যায়। লাথির ঘায়ে পেটের যন্ত্রণাটা বেড়েই চলে। উপশমের জন্য হঠাৎই হরিবোল হরিবোল শব্দে দু'হাত তুলে নাচতে শুরু করে, মুখে কীর্তনাঙ্গের গান…যদি হরি বলে মরতে পারি, এই জনমে নাইবা পেলাম।'  মানুষের স্রোতও যে বাঁধ মানে না। কে আর দরদ দিয়ে ভাবে, সকলেই তো চোখ উল্টে দেয় যে যার মতো।


কোলাহলের এই উৎসবে অমৃতলাল ক্রমশ যেন নিস্তেজ হতে থাকে। কখন যে ভুলে বসে যায়, ট্রেনের কোন এক বগিতে ও চৈতন্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর স্টেশন এরপর স্টেশন চলে যাচ্ছে, হাজারো মানুষের ভিড়ে কেউ যেন তোয়াক্কা করছে না ওর কী দশা হতে চলেছে। ঠিক এই সময় জানালার ফাঁকফোকর দিয়ে ঘাসুড়ে  পোকাগুলো ট্রেনের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কানের কাছে এসে বনবন করতে শুরু করে। যে লোকটা এতক্ষণ হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে ছিল, হঠাৎই ছিটকে গিয়ে ওর কাঁধের উপর গিয়ে পড়ল। অমৃতলাল মানুষের মুখগুলোই দেখছিল, খিদেতে পেটটা চোঁ চোঁ করে উঠল, সংগে জুড়ে গেল বাড়তি টেনশন। কখন যে গিয়ে ম্যাডান স্ট্রিটের উঁচু বাড়িটার চারতলার কাঁচের দরজার কাছে টুল নিয়ে বসে পড়ে মানুষের আসা-যাওয়ার হিসাব করবে আর প্রয়োজনে বেগতিক দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরাপত্তারক্ষীর ধর্ম পালন করবে, এই মুহূর্তে ফুঁড়ে বেরোল ওই চিন্তাগুলো। ক্ষণিকের জন্য হলেও এ ভাবনাটাও আসল – দেবদাসদা কেন যে এমন একটা জায়গায় এনে ঢুকিয়ে দিল? ধাক্কাটা আবারো গেট থেকে হামলে পড়ে পায়ে পায়ে লাথি খেতে খেতে অমৃতলালের শরীরে এসে ঝাঁপাল। মুখগুলো মুছে গেল, ঘরবাড়ি স্টেশন প্ল্যাটফর্ম উধাও হল, অফিসের জনজোয়ার সব উবে গেল চোখের নিমেষে। এরকমটাই বোধহয় হয়। কতগুলো লোকের চিৎকার চেঁচামেচিতে অমৃতলাল-এর কণ্ঠস্বর মিলিয়ে গেল হুই আকাশে। গুলির শব্দটা স্পষ্ট শুনতে পেল, ওর খাঁচার পাশ ঘেঁষে ছিটকে বেরিয়ে গেল যে। দুপাশ থেকে লোকজন বলে উঠল, 'গেল গেল গেল, ওই খাঁচাটাই  ভাঙল আর কি … মরা মানুষকেই মারতে হলো…পাগল নাকি…শহরে এরকম পাগল এখন রোজই আসছে…ওই মেয়েটাই শেষে…হায় হায় রে, যার গেল, তার গেল…রক্ত রক্ত, তাল তাল রক্ত.. কত রকমের পাগল যে হয়… এ দেশটা এখন পাগলের রাজত্ব…মাথার রোগ আছে বটে…। অমৃতলাল এই টুকরো-টাকরা কথার ভুবনে নিজেকে কখন যে জড়িয়ে ফেলে নিজেই জানে না। জন্ম মৃত্যুর মাঝখানের দেয়ালটা সাদা হয়ে গেলে ব্যবধানটা মুছে যেতে থাকে। তবে কি এই অনিশ্চল অবস্থাকেই মৃত্যু বলে? অনুভবটা কোন কষ্ট কল্পিত অবয়ব কিনা উত্তরটা ওকে খুঁজে বের করতেই হবে। কোনটা সত্য? ওর ফেলে আসা অতীত, না ঘটমান বর্তমান কিংবা ভবিষ্যতের নিরুত্তর ছবি। ভিআইপিদের গাড়িগুলো সাইরেন বাজিয়ে চলে যায়। কালচে হয়ে যাওয়া দেয়ালগুলো চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে থাকে মানুষের যাত্রাপথে কখন বেলাশেষের ছায়াগুলো এসে কোলাকুলি করবে। বৃষ্টিস্নাত গাছ-পাখিরা নেচে নেচে বেড়াবে। অমৃতলাল-এর খাঁচায় ঘটবে একরাশ ঘোমটা পরা অন্ধকার আর কৃত্রিম আলোর মুখ দেখাদেখি। দিগন্ত জোড়া মাঠে নাইবা হল চন্দ্রিমা আর সবুজ ঘাসের চুমুচুমি। শেষের বেলায় আবার কবে হবে এমন মিতালি। ঘরে তো ফিরে যাবে রাস্তায়  হেঁটে চলা অগণিত মানুষ, অনিশ্চিত জীবনে পা বাড়িয়েছে যারা, হেরে যাওয়া যাদের ভবিতব্য। কত কথাই না মনে আসে অমৃতলালের।


স্মৃতির ভান্ডারটা মস্তিষ্কের কোষে কোষে আবারো জ্যান্ত হয়ে উঠতে চাইল। হঠাৎই মনে হল হু হু করে কত ট্রাম বাস মিনিবাস ট্যাক্সি বেরিয়ে যাচ্ছে। ও কেন এমন একটা খাঁচার মতো গাড়িতে  চড়ে যাচ্ছে? ক্রিং ক্রিং করে শব্দ হল। কিছু কথার প্রতিধ্বনি কানের পর্দাটা ফাটিয়ে দিচ্ছে। কাদের এত কথা চালাচালি। দেবদাসদাকে কেউ যেন শাঁসাচ্ছে। হাতে পায়ে ধরে যেন কত উপরোধ, অনুরোধ ওর –'স্যার, আপনি চিন্তা করবেন না, ও ঠিক এসে যাবে। নিশ্চয়ই কোথায় আটকা পড়ে গেছে, অনেকটা দূরের পথ কিনা।' দেবদাসদা বারবার করে বলে দিয়েছে 'প্রথম দিন কাজে যাচ্ছিস, পৌঁছে যাবি কিন্তু ঠিক সময়ে। সময়ের এদিক ওদিক হলে সাহেব কিন্তু ছেড়ে কথা বলবেনা। কালকের মিটিংয়ে  কত  হোমরা চোমরারা আসবে, এ কথাটা মনে রাখিস। সত্যিই তো বাবু যদি বলে বসে, 'এখনো বেটার দেখা নেই। গায়ে তেল হয়েছে, ছাল ছাড়িয়ে যদি ডুগডুগি না বাজিয়েছি তো…..'। কথাগুলো বড্ড তেতো। কিভাবে যে কানের লতিটা ধরে আটকে দেয়। অমৃতলাল যখন বগির শেষ প্রান্তে এসে সেঁটে গিয়েছিল তখনো এই শাসানোর শব্দগুলো ওকে এসে জাপটে ধরেছিল। হাঁকডাক করেছিল যদি হাত বাড়িয়ে দরজাটা ছুঁয়ে ফেলতে পারে। কেউ কোনো সুযোগ করে দেয় নি। ট্রেনের গতিবেগ যখন আরো বেড়ে গেল, যেন নেই, নেই কিছু নেই, কেমন নিস্তেজ হয়ে গেল শরীর। শিরা উপশিরাগুলো চিচিং ফাঁক হয়ে দৌড়োদৌড়ি শুরু করল অন্দরে, ভেতরে যেন বয়ে চলল রক্তের স্রোত।


চলতে চলতেই গাড়িটা দুম করে কোন এক গর্তে এসে পড়ল। অমৃতলালের এখন কত তাড়া, না হলে যে দেবদাসদাও আস্ত রাখবে না। কত মানুষের কণ্ঠস্বর এসে এক জায়গায় জড়ো হল। গাড়িটা ঠেলে সরিয়ে দিতেই ছুটল তীব্র গতিতে। 'দেবদাসদার গলা না! কি যেন বলতে চাইছে। খানিকটা এরকম – হ্যাঁরে অমৃত, তুই এখন কোথায়? গেস্টরা আসতে আরম্ভ করেছে। ছি ছি, এইভাবে তুই আমার মান-সম্মান ডোবাচ্ছিস? কেন যে তোর নামটা আমি বলেছিলাম? আমার কপাল তো ফাটলই, সাহেবের রাগের পারদ যা চড়ছে, তোর মুণ্ডু না চটকায়।' সত্যি সত্যি শুনল তো! অমৃতলাল উত্তর দেওয়ার তাগিদে কিছুক্ষণ ছটফটালো, ভেতরটা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো তোলপাড় হলো, শেষে গরুর মতো দেয়ালে মাথা ঘষটানোর ইচ্ছে হল, নিজেই নিজের চুল ছিঁড়তে চাইল। মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলোর ইতঃস্তত ওঠানামায় আর বুকের ধুকপুকানিতে যে হাতটাকে টেনে তুলবে, তা আর সম্ভব হল না। অগত্যা পা-টাকে ঝাঁকিয়ে নিজেকে জানান দিতে গিয়ে মনে হল কোথাও ভেসে বেড়াচ্ছে, ও কিছুতেই খাঁচাটা ছেড়ে এক পা-ও বেরুতে পারছে না। কত কথাই না মনে এলো।  গাঁয়ের ছাপোষা মানুষগুলো কি এমনি করেই সব খাঁচায় বন্দি হয়ে আছে? ওদের মুখে কারা যেন সেলুটেপ মেরে দিয়েছে, পিছমোড়া করে বেঁধে রেখেছে হাতগুলো। মুখের সামনে থালায়  ছড়িয়ে রয়েছে ফ্যানে ভাত, কাঁচা পেঁয়াজ আর লঙ্কা, খাবার মুখে তুলতে পারছে না। লোকগুলো যাবে কোথায়? ভয়ে সিঁটিয়ে আছে যে। কারা যেন হাতে বন্দুক ছোরা আর বোমা নিয়ে প্রস্তুত হয়ে আছে, দাবি দাওয়া অপূরণ হলেই ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা করে দেবে, কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবেনা। ভয়ে জুজু হয়েই ছিল। হরু কাকার যুবতী মেয়েটা চোখের সামনেই নষ্ট হয়ে গেল, দরজা জানালা বন্ধ করে চুপটি করে বসে ছিল দশ-ঘর লোক। ওরা এতটাই চমকায় লাফায় ঝাপায় দাপায়,  জড়োসড়ো হয়ে জোড় হাত করে বসে থাকা ছাড়া কোন উপায় থাকে না। নালিশ শোনার লোকগুলোই যে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। কী এক অদ্ভুত দৃশ্য! কোথায় যাবে এখন অমৃতলাল? ট্রেনের বগি আর এই খাঁচা যেন একই সূত্রে গেঁথে গেছে। খাঁচার ভেতরে ভেসে বেড়াচ্ছে সেই দৃশ্যটা– বুকে লাথি খেয়ে  গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে ফসফস করে। কারা যেন চ্যাংদোলা করে রেখে দিয়ে এল প্লাটফর্মে। অমৃতলালের বুকের ভেতর বেজে উঠছে কত রকমের বাজনা। সেই বাজনায় মেয়েটার অন্তর্ভেদী কান্নার শব্দ ভেঙেচুরে খান খান হয়ে যাচ্ছে – বাবা, ওরা আমার ইজ্জত লুটছে, আমার শরীর ছিঁড়ে খাচ্ছে, জানিনা প্রাণে বাঁচবো কিনা, তুমি একবার আসো না বাবা। এবারও খাঁচাটা জোরে জোরে দুলে উঠল, অথচ কারো নজরেই এলো না।


 খাঁচাটা ওকে নিয়ে আরো জোরে ছুটছে।  ওর চিন্তার দরজাগুলো সপাটে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রেল পুলিশের রাইফেল হাতে উর্দি পরা চেহারাগুলো একে একে একে জায়গা নিল ওর স্নায়ুতে। এবার পেছনের কোন এক যান থেকে শব্দগুলো ভাসতে ভাসতে এসে খাঁচার বাহিরে থেমে গেল – বাবা, ও বাবাগো।


কেন? কেন এমন রোদন? তবে কি ও…!


কেউ নেই, কেউ নেই এখানে। বুড়োকাকা নেই,মনু জেঠু নেই, ঝুনু কাকিমা, অন্তরা জেঠি, কেউ কোথাও নেই। কোথায় বা আছে দেবদাসদা? অমৃতলাল এখানে বড় একা। কেউ জানে না। ওর জীবনের স্পন্দনটা ওকে ঘিরে এখন গোল্লাছুট খেলছে। কে যেন ওকে জিজ্ঞেস করছে,'কিরে ভাত খাবি?'

খাব, খাব। দাও, দাও। শব্দগুলো নেই, আবার শব্দগুলো আছেও। শব্দগুলো জুড়ে জুড়ে আছে। কথা হবে, কথা হতে চাইছে, শুধুই অমৃতলাল-এর কথা – কই দাও। পেটটা চোঁ চোঁ করছে গো।

নে নে খা – মায়ের মুখ, বউয়ের মুখ, নিজের বছর-ষোলর মেয়েটার মুখ ভাসে।

খাঁচাটা ছুটছে ওকে নিয়ে। কোথায় যে নিয়ে চলে যাবে? ওরা জানে, কোথায় নিয়ে যাবে। আসলে কি জানে এই যাত্রার শেষ কোথায়?

ঘন কালো আকাশের মুখটা আরো গম্ভীর হয়ে গেল মুহূর্তে। আঁধার আঁধার। কোন দৃশ্য নেই। অদৃশ্যের সীমানায় আটকে গিয়ে শুরু হয়ে গেছে সকলের হাপিত্যেশ। সবকিছু চুরমার হয়ে যাচ্ছে। শুধুই কান্নার রোল। কেউ বলছে আমাদের বাঁচতে দাও, আমরা বাঁচতে চাই। বাঁচার অধিকারটুকু দাও হে গণদেবতা। ওরা মরতে গিয়েও বাঁচতে চায়, বাঁচাতে চায়। খাঁচাটা দ্রুত বেরিয়ে গেল।


অমৃতলাল-এর খাঁচাটা তখন দাঁড়িয়ে পড়েছে আর বলছে – বাবু আমি আসছি। গেটের পাশে টুলটায় আমি  বসে থাকবো, এক পা-ও নড়ব না। একটা স্বপ্ন এসে সবকিছু ভুলিয়ে দেয় মুহূর্তে – ওদের ছোট্ট গাঁ। গাঁয়ের মাঝে  কংক্রিটের রাস্তা, হাসপাতাল, কাজকারবারের রমরমা, স্কুলবাড়ি, বড় বড় পুকুর, ক্ষেত খামার, বাগানে বাগানে ছয়লাপ, সকলে ধেই ধেই করে নাচছে, মানুষে মানুষে কত তো কোলাকুলি, দুবেলা  ভরাপেট খেয়ে রাতের বিছানায় নিশ্চিন্তে ঘুম। অমৃতলালের চোখ জুড়ে গভীর নীরবতা , স্বপ্নগুলো সব ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। কে যেন কানে কানে এসে বলে যায় 'অমৃতলাল তোর সময় ফুরিয়ে এসেছে'। চোখের সামনে ভেসে ওঠে কত মরা মানুষের মুখ। ওরা এক এক করে চুল্লিতে ঢুকে যাচ্ছে। গনগনে আগুনের বিরামহীন এই যাত্রাপথ। নিজের শরীরের পোড়া গন্ধটা ওর নাকের দুই পাশে এসে ঘুরঘুর করল, কখন সেঁধিয়ে যাবে।


অমৃতলাল চিৎকার করে উঠল – ও মাগো! আমি চাইনা, মানুষ হতে চাইনা আমি, আমি গাছ হতে চাই, বনে বনে হাওয়া হয়ে হাওয়ার সঙ্গে দুলতে চাই। বাঘ সিংহ আর হরিণের দেশে চলে যেতে চাই, সেটাই ঢের ভাল। কতকাল তো নিশ্চিন্তে বেঁচে থাকা যাবে।


শোরগোলটা কাছাকাছি এলে কারা যেন কানাকানি শুরু করে দিল। অস্ফুট অনেক অজানা না-শোনা কথার উৎপত্তি হয়ে গেল মুহূর্তেই। শব্দের দাপটে অমৃতলালকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায়, ওই রেলগাড়ির বগির সহযাত্রীরা যেমন করে ওকে পিষে দিয়েছিল কথার হুল ফুটিয়ে। অফিসের বাবু,  গ্রাম পঞ্চায়েত, যাত্রীদের মুখগুলো সব একই পংক্তিতে দাঁড়িয়ে আছে ওকে কোণঠাসা করবে বলে। ওই তো দূরে ডোম দাঁড়িয়ে আছে। মুখের ভাবে ও উচ্চারণে ওর স্বাভাবিক আচরণ ডিঙ্গিয়ে জন্ম নিচ্ছে অন্য স্বর, অন্য সুর  – ওরে মানুষটা তো মরে নি, চোখের মনি ঘুরছে, হৃদপিণ্ডটা ধড়াস ধড়াস করছে। তোমরা বাপু জ্যান্ত লোককেই নিয়ে এসেছ। শেষে আমি কি পাপের ভাগী হবো?

অনাত্মীয়দের কর্তাব্যক্তি বলল, তুমি কি ডাক্তার নাকি হে যে মরা-বাঁচার নিদান দিচ্ছ? অতশত জানিনা, তোমার যা কাজ, তুমি তাই করো।

না। না। না। না। মরা মানুষ পোড়াই বলে আমি কি মানুষ নই! উপরওয়ালা এসে যদি জানতে চায়, কি জবাব দেব। 

আর মানুষ যদি প্রশ্ন করে? 'মানুষের অত প্রশ্ন করার মুরোদ নেই বাবু! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালিয়ে বাঁচে। তিন পুরুষের পেশা বাবু, সব নাড়ীনক্ষত্র আমি জানি। বেওয়ারিশ মাল তো, তাই কারো জ্বালা নেই। ডোম বলে কি মানুষ নই, আমারও একটা মন আছে। পারবো না বাবু,জ্যান্ত মানুষ পুড়িয়ে মারতে।

অমৃতলালের খানিকটা হলেও স্বস্তি হল, বাঁচার ইচ্ছাটা আবার যেন চাগাড় দিয়ে উঠলো। বাইরে থেকে চুল্লির গনগনে আগুনের উত্তাপ ওর শরীর ছুঁয়ে গেলে জীবনের কাছে শেষবারের মতো ও ভিক্ষা চাইল। মনে মনে বলল, 'এবারের মত বাঁচিয়ে দাও ডোম বাবাজি'।

বাঁচবে তো, বাঁচতে তো তোমাকে হবেই। বউ ছেলে মেয়ের মুখ দেখবে না?

কথাটা শুনে অমৃতলালের বাঁচার সাধ জাগলো, চোখটা টানটান হলো। হৃদপিণ্ডটা আর পাঁচ জনের মতই সচল হয়ে চলতে শুরু করল যেন।

শুনতে পেল দেবদাসের সেই ডাক,'ওঠ, ওঠ, কিরে কাজে যাবি না, অমৃতলাল ?'

ঘর যাব গো, দেবদাসদা।


*******************************************************************************



শরদিন্দু সাহা

জন্ম:  ১৯৬০ এই পর্যন্ত প্রায় একশো কুড়িটার বেশি গল্প, দশটা উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্য মুদ্রিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, বাংলাদেশ মিলিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্যপত্রে লিখে চলেছেন। এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কিছু সাহিত্যপত্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছেন। ১৯৯৮ সালে 'কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগার পুরস্কার' পান। ২০০৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত 'সোমেন চন্দ স্মারক' পুরস্কার পান। ওই বছরই কাটোয়া লিটিল ম্যাগাজিন মেলা কর্তৃক সংবর্ধিত হন। 'ইন্ডিয়ান অয়েল' কর্তৃপক্ষ তাঁকে 'হল্ অব্ ফেম'-এ সম্মানিত করেন। ২০০৫ সালে 'ভাষা শহিদ বরকত স্মরণ পুরস্কার' পান। ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি'র আমন্ত্রণে গৌহাটিতে বাংলা-অসমিয়া গল্পকার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। প্রসার ভারতীর আমন্ত্রণে বিভিন্ন সাহিত্য সংস্কৃতি অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন। ২০১৩ সালে 'আমি সারা বাংলা কবিসভা' কর্তৃক সংবর্ধিত হন।

প্রকাশিত গ্রন্থ : উপন্যাস--উজানি মঙ্গল * নিষ্ক্রমণ * ভিটে মাটি *  চরণামৃত * মাটির মানুষ *  একটি শব্দের জন্য *  শব্দ কাঙাল * শব্দ-নৈঃশব্দ্য * আত্মগত আর্তনাদ * অনাত্মীয় আলাপন

    উপন্যাস সমগ্র ১

    উপন্যাস সমগ্র ২       

গল্প গ্রন্থ ---মেঘজীবন *  গুনাহর পটভূমি * চৈতন্য প্রাঙ্গণ *  পোস্টমর্টেম * হাওয়া বদলে যায় *  রোদপাখি

   গল্প সংগ্রহ

        


       

 



          


       




      



        

 


            


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন