রবিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২২

গুচ্ছ কবিতা * শান্তনু চট্টোপাধ্যায়

 



কবিতাগুচ্ছ * শান্তনু চট্টোপাধ্যায়


পড়ন্ত রাত্রির কথা 


সেদিন তুমুল বাজ,

আহেলী নামের গাঢ় মেয়ে

নিবিড় নিশীথবেলা সাবেকি উঠোনে একা রঙে

রসে রি রি করে বেজায় চমকাল


অবশেষে  একাকিনী নিষ্প্রভ গন্ধটুকু মেখে 

নিথর যমুনাজলে ভয়ানক চৌষট্টি কলায় ইনিয়ে বিনিয়ে 

ঠিক পরাগের মনের অন্দরে বিরহীর মতো 

এক মিনমিনে গান বেঁধেছিল


উহার সহস্র ভাব এবং যা গুহ্য কেরামতি ---

সবটুকু শুষেছিল পরাগ মণ্ডল


সেই থেকে  ইত্যকার ভাবসম্মিলনে নতুন সুরের সাথে 

স্বমেহন বড়ই মিশেছে


নিভৃত পায়ের ছাপে আহেলী  সিন্ধিয়া কেমন 

নিটোল ছবি বুকে সেঁটে দগ্ধ দীপশিখা


প্রতিটি রাত্রি জুড়ে অঙ্গে-উপাঙ্গে যেন মৃদু 

সেই ছৌনাচ  খামোকা গর্জায়


এইভাবে রাত্রিকাল লুপ্ত হয় 

    শঙ্কা মুছে যায়...



একটি নাকচ গল্প


 ধরো এইপথ শেষ হলে 

      আর কোনোই গন্তব্য নেই

চালচুলো চুকে গেছে  

        পুকুরের জলও ফ্যাকাশে


নিবাধুই ইস্কুলের শেষের 

                 দালানে যে ছায়াটি

ইতিউতি তামিল কায়দায় 

চোখে আঁকে বেখুশ বিকেল

তার কোনো তুতোভাই 

           তোমার  দয়িত

কীর্তনের এই আসর হরিকথা-হরবোলায়             

বহুত  জমাটি

ছায়াটি তথাপি ওই বেলাগাম বিজন দরিয়ায় যেন 

কোনো মেহনতী ইশতেহার  বুকে করে ধুকপুক 

স্বপ্ন এঁকেই যাচ্ছে বেজায় নেশায়


তামাটে  ইস্কুলঘর 

                    ওলোটপালোট 

মধুবাতা ঋতায়তে কেমন আধুরি কাহানী

মুঘলযুগের পাখি উড়ে উড়ে ঘুরে আসে বেহেস্তের দিকে 


ছায়াটি প্রলাপ ঢাকে,

     জাদুময় রাতবাতি ক্রমশই         

                   ফিকে হয়ে আসে 


সলমা-জরির মতো উশখুশ …



তোমার জন্য এই আয়োজন


এসো দুর্বহ মৃত্যুর কাছে খানিক দাঁড়াই

এসো দুস্তর বাধার সামনে একটুকু ঝুঁকি

এসো মহীয়ান স্বর্গের খোঁজে কিছুটা হারাই

এসো জীবনের পথে পথে শুধু শুধুই  টুকি-টাকি 

          আর কিছু সুরের মতন অশ্রুকে আঁকি


অশ্রুত সেই প্রণবের ঘন গহন ছটায়

মায়া ছায়া মুছে এমনি এমনি একগাল হেসে

এসো হে আমার অবদমিত ঝলমল হেসে

নূতন শোভায় দেখি আজ ভয়ানক সে তোমায়

এই বাতিঘর দীন-চৌকাঠ  দেহাতি ও-গান

ক্রমশ মিলাক মর্মান্তিক ঘোর সংলাপে


শুধু জেগে থাক দুইচোখ জোড়া ঘন নদীপথ

যেন সে ভোরের কুঁড়িটিরে ঢাকে প্রেমে ও প্রমায়



হয়তো কিছুই নয়


দেখো ভৈঁরোতে  চুপটি হারাবে,  ছায়াটি ছোঁবে না

ছিন্নভিন্ন তারের সুরেতে বেশ প্রণোদনা 

আপনি আপনি জাগলে শুনবে পাখিদের মতো


তোমার আমার সবটুকু অভিমান পরাহত 

 শরের আঘাতে কেবলই বাজাবে নষ্ট জীবন---

শ্বাসাঘাতে আর অচিন ঘোরেতে মোহের স্বপন 

যেন আনকোরা নতুন ফুলের পাপড়িতে ক্ষত

ঢেকে রেখে দেয় ,মর্মের ঘরে   মায়া অযাচিত

রাতের ছোবলে ম্লান হয়ে আসে  ,কুহেকের নেশা

বর্ষামুখর তীব্র এ-বুকে ---- গর্জায় হ্রেষা

 









পথ 

আলোর বাইরেই ছিল মেরুন  তামাসা

তমিস্র এসরাজে তাই যেন কেউ আঙুল ছোঁয়াতে 

 চিনচিন ব্যথাটিও কেমন লোপাট

বুকের বাঁ-দিক ঘেঁষে দিব্যি ফাগুন-হাওয়া  ছিনিমিনি খেলে


সমূহ আঁধার রাতে একলাটি হেঁটে হেঁটে ঘোর কোলাহলে

যখন ছিপটি মেলে ভেবেছি ধরবো সব ভান ও ভণিতা 

তখনই চাক্ষুষ দেখি 

      ----- কথাহীন অন্ধ-প্রবণতা

 

কেমন হাঁসফাঁস করে এ ধুলোয় ,এই পিচ-পথে

ম্লান কুসুমের মতো গান বেজে ওঠে 

আর সীমাহীন ধোঁয়ায় ধোঁয়ায়

অনাহতচক্রময়  মুগ্ধ শৃঙ্গার



এমনি দিনের স্রোতে 


ঝোলাতে কিচ্ছুটি নেই ।

হট্টিটি দুপুরের পথে এক আস্ত মরা-পাহাড়ের মতন জৌলুস নিয়ে --- 

মেচেদার  পবিত্র এলো ,সাথে ছিল অদ্ভুত গৌতম।


উহাদের তামাদী আক্কেল দেখে জেঠুমণি চরম খ্যাপাটে ,

আর সপাটে প্রবল আলো ঢলে পড়ল পবিত্রর কানে ও মগজে।


ও তখন ঠারেঠোরে সলজ্জ  বিনোদিনী রাই।

ঝুমকোলতার ফাঁকে একটুকু সৌদামিনী --- 

যেন গূঢ় আষাঢ়ের মৌন খেয়ালে জ্যেঠুমণির  

সামান্য দু'পায়ে চরম বিশ্বাসী এক স্তিমিত ঝলক।


এ হেন ধোঁয়াশালিপি অকপট বলছিল  শান্ত গৌতম।

ওর চোখে-মুখে ,রক্তের স্রোতে ,নাড়ীর রহস্যময় 

মায়াজালে বেধড়ক ঘুমের তোলপাড় ।


জ্যেঠুমণি এখনো সজাগ বেহাগ হাতে রাত 

পারাপার করে  খুব নাজেহাল।


বাতাসে হাওয়ায় বাজে উল্লোল সেই হাহাকার।



বর্ষাতি হারিয়েছে তাই 


উদোম সন্ধ্যেবেলা ' বেলা গেল  তোমার পথ চেয়ে...' গাইতে গাইতে 

কেমন লুটিয়ে পড়ল লীলামাসি 


আমাদের হরেকৃষ্ণকাকার তলপেটে খয়াটে দুঃখরাত 

ঢিবি হয়ে ন্যাবার  মতন এক ঝিকিমিকি কাহিনীর বই


লীলামাসি   একমনে অথই শ্রাবণদিন যেন

মাঝে মাঝে খোল বেজে ওঠে তার  লিপ্ত তানপুরার 

সোহাগে সুঠাম হয় হরেকৃষ্ণকাকার ওই জাদুদণ্ডের 

মতো  তীব্র পাখোয়াজ


আড়ালে নিশপিশ করে চলে এই মোহন ফিনালে


লীলামাসি নড়ে ওঠে 

           যুগপৎ ঘুমের খেয়ালে

হরেকৃষ্ণকাকটিও বেমক্কা  দুমদাম


রসকলি  খুব কাটে 

মন্দিরায় মন্দ বয় এইমতো  গোপন সংকট


******************************************************************************************************



শান্তনু চট্টোপাধ্যায়

জন্ম : ২৮.০৪.১৯৮১,সীমান্ত শহর বনগাঁয়। বর্তমানে ২০০২ থেকে বারাসতের বাসিন্দা। ইংরাজী সাহিত্যে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর,পেশাগত ভাবে একটি ইংরাজী মিডিয়াম স্কুলে শিক্ষতায় নিযুক্ত,লেখালিখির শুরু  স্কুলবেলাতেই সেই ৯এর দশকের মাঝামাঝি থেকে, নিয়মিত কবিতা,কবিতা বিষয়ক আলোচনা,সাহিত্য তত্ত্ব বিষয়ক প্রবন্ধ ,কাব্যগ্রন্থালোচনা, অণুগল্প চর্চায় নিয়োজিত। অল্পস্বল্প অনুবাদও করেন । বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ড. শৈলেন দাস প্রতিষ্ঠিত 'বাতায়নিক'- এর একজন আজীবন শিক্ষার্থী। কবিতাগ্রন্থ  'বিষাদ হরফের আলো'।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন