শনিবার, ১৩ আগস্ট, ২০২২

সম্পাদকীয়



********************************************

স্বরবর্ণ 

সৃজনের মৌলিক স্বর 


দ্বিতীয় বর্ষ * তৃতীয় সংখ্যা
৩০ শ্রাবণ ১৪২৯ * ১৫ আগস্ট ২০২২

*********************************************


স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে, প্রথাগত সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে, এবার আমরা এই কলামে রাখছি, জেলখানা থেকে লেখা শহীদ দীনেশ গুপ্ত এবং মাস্টারদা সূর্য সেনের কয়েকটি চিঠি....যার মধ্য দিয়ে আমরা স্মরণ করছি সেইসব বীর বিপ্লবী স্বদেশপ্রেমী শহীদদের, মাতৃমুক্তিযঞ্জে যাঁরা নিঃশেষে  আত্মাহুতি দিয়েছিলেন।


দীনেশ গুপ্ত : জন্ম - ৬ ডিসেম্বর ১৯১১ 

ফাঁসি - ৭ জুলাই ১৯৩১ 


আলিপুর সেন্ট্রাল জেল

কলিকাতা

১৮ জুন, ১৯৩১


বউদি,

তোমার দীর্ঘ পত্র পাইলাম। অ-সময়ে কাহারও জীবনের পরিসমাপ্তি হইতে পারে না। যাহার যে কাজ করিবার আছে, তাহা শেষ হইলেই ভগবান তাহাকে নিজের কাছে টানিয়া লন। কাজ শেষ হইবার পূর্বে তিনি কাহাকেও ডাক দেন না।

তোমার মনে থাকিতে পারে, তোমার চুল দিয়া আমি পুতুল নাচাইতাম। পুতুল আসিয়া গান গাহিত, ‘কেন ডাকিছ আমার মোহন ঢুলী?’ যে পুতুলের পার্ট শেষ হইয়া গেল, তাহাকে আর স্টেজে আসিতে হইত না। ভগবানও আমাদের নিয়া পুতুল নাচ নাচাইতেছেন। আমরা এক একজন পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে পার্ট করিতে আসিয়াছি। পার্ট করা শেষ হইলে প্রয়োজন ফুরাইয়া যাইবে। তিনি রঙ্গমঞ্চ হইতে আমাদের সরাইয়া লইয়া যাইবেন। ইহাতে আপশোস করিবার আছে কি?

ভারতবাসী আমরা নাকি বড় ধর্মপ্রবণ। ধর্মের নামে ভক্তিতে আমাদের পণ্ডিতদের টিকি খাড়া হইয়া উঠে। কিন্তু তবে আমাদের মরণকে এত ভয় কেন? বলি ধর্ম কি আছে আমাদের দেশে? যে দেশে মানুষকে স্পর্শ করিলে মানুষের ধর্ম নষ্ট হয়, সে দেশের ধর্ম আজই গঙ্গার জলে বিসর্জন দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া উচিত। সবার চেয়ে বড় ধর্ম মানুষের বিবেক। সেই বিবেককে উপেক্ষা করিয়া আমরা ধর্মের নামে অধর্মের স্রোতে গা ভাসাইয়া দিয়াছি। একটা তুচ্ছ গোরুর জন্য, না হয় একটু ঢাকের বাদ্য শুনিয়া আমরা ভাই-ভাই খুনোখুনি করিয়া মরিতেছি। এতে কি ‘ভগবান’ আমাদের জন্য বৈকুণ্ঠের দ্বার খুলিয়া রাখিবেন, না ‘খোদা’ বেহেস্তে স্থান দিবেন?

যে দেশ জন্মের মত ছাড়িয়া যাইতেছি, যার ধূলিকণাটুকু পর্যন্ত আমার কাছে পরম পবিত্র, আজ বড় কষ্টে তার সম্বন্ধে এসব কথা বলিতে হইল।

আমরা ভাল আছি। ভালবাসা ও প্রণাম লইবে।


          ---স্নেহের ছোট ঠাকুরপো।



আলিপুর সেন্ট্রাল জেল

৩০. ৬. ৩১. কলিকাতা


মা,

যদিও ভাবিতেছি কাল ভোরে তুমি আসিবে, তবু তোমার কাছে না লিখিয়া পারিলাম না।তুমি হয়তো ভাবিতেছ, ভগবানের কাছে এত প্রার্থনা করিলাম, তবুও তিনি শুনিলেন না! তিনি নিশ্চয় পাষাণ, কাহারও বুক-ভাঙা আর্তনাদ তাঁহার কানে পৌঁছায় না।

ভগবান কি, আমি জানি না, তাঁহার স্বরূপ কল্পনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তবু একথাটা বুঝি, তাঁহার সৃষ্টিতে কখনও অবিচার হইতে পারে না। তাঁহার বিচার চলিতেছে। তাঁহার বিচারের উপর অবিশ্বাস করিও না, সন্তুষ্ট চিত্তে সে বিচার মাথা পাতিয়া নিতে চেষ্টা কর। কি দিয়া যে তিনি কি করিতে চান, তাহা আমরা বুঝিব কি করিয়া?

মৃত্যুটাকে আমরা এত বড় করিয়া দেখি বলিয়াই সে আমাদিগকে ভয় দেখাইতে পারে। এ যেন ছোট ছেলের মিথ্যা জুজুবুড়ির ভয়। যে মরণকে একদিন সকলেরই বরণ করিয়া লইতে হইবে, সে আমাদের হিসাবে দুই দিন আগে আসিল বলিয়াই কি আমাদের এত বিক্ষোভ, এত চাঞ্চল্য?

যে খবর না দিয়া আসিত, সে খবর দিয়া আসিল বলিয়াই কি আমরা তাহাকে পরম শত্রু মনে করিব? ভুল, ভুল। মৃত্যু ‘মিত্র’ রূপেই আমার কাছে দেখা দিয়াছে। আমার ভালোবাসা ও প্রণাম জানিবে।


                 ----- তোমার  নসু 



আলিপুর সেন্ট্রাল জেল

৩০. ৬. ৩১. কলিকাতা


স্নেহের ভাইটি,

তুমি আমাকে চিঠি লিখিতে বলিয়াছ, কিন্তু লিখিবার সুযোগ করিয়া উঠিতে জীবন-সন্ধ্যা হইয়া আসিল।যাবার বেলায় তোমাকে কি বলিব? শুধু এইটুকু বলিয়া আজ তোমাকে আশীর্বাদ করিতেছি, তুমি নিঃস্বার্থপর হও, পরের দুঃখে তোমার হৃদয়ে করুণার মন্দাকিনী-ধারা প্রবাহিত হউক।

আমি আজ তোমাদের ছাড়িয়া যাইতেছি বলিয়া দুঃখ করিও না, ভাই। যুগ যুগ ধরিয়া এই যাওয়া-আসাই বিশ্বকে সজীব করিয়া রাখিয়াছে, তাহার বুকের প্রাণস্পন্দনকে থামিতে দেয় নাই। আর কিছু লিখিবার নাই। আমার অশেষ ভালবাসা ও আশিস জানিবে।


           -----তোমার দাদা



আলিপুর সেন্ট্রাল জেল, কলিকাতা 

৭-৭-৩১ (প্রত্যুষে) * ফাঁসির কয়েক ঘন্টা আগে লেখা 


বৌদি, 

এইমাত্র তোমার চিঠিখানা পাইলাম। আমার জীবন কাহিনী জানাইবার সুযোগ হইল না। কি-ইবা জানাইব বল তো? আমার সব কথাই তো তোমাদের বুকে চিরকাল আঁকা থাকিবে। তুচ্ছ কালির আঁচড় কি তাহাকে আরো উজ্জ্বল করিয়া তুলিতে পারিবে? আমার যত অপরাধ ক্ষমা করিবে। এ জন্মের মত বিদায়। ভালোবাসা ও প্রণাম জানিবে। 

    

      ----তোমার ঠাকুরপো।



স্নেহের বেল্টু ভাই,

একটি গান আজ বারবার মনের পর্দায় ভেসে উঠছে ----


আমার দিন ফুরালো ব্যাকুল বাদল সাঁঝে

গহন মেঘের নিবিড় ধারার মাঝে।।

কোন দূরের মানুষ যেন এলো আজ কাছে, 

তিমির-আড়ালে নীরবে দাঁড়ায়ে আছে ।

বুকে দোলে তার বিরহব্যথার মালা 

গোপন-মিলন-অমৃতগন্ধ-ঢালা। 

মনে হয় তার চরণের ধ্বনি জানি--- 

হার মানি তার অজানা জনের সাজে।। 


শীতের কুজ্ঝটিকার সঙ্গে সঙ্গে আমার দিনও ফুরিয়ে এলো। আমায় ভুলো না ভাই। শীতের পুনরাগমনের সঙ্গে আমিও আবার তোমাদের মধ্যে ফিরে আসব। উত্তুরে বাতাসের পরশ পেলে মনে কোরো, আমি এসেছি তোমাদের আলিঙ্গন করতে, তোমাদের ভালোবাসা কুড়িয়ে নিতে ।

                     ----দাদা।


** বউদির কাছে তিনি ‘স্নেহের ঠাকুরপো’। ছোটভাইয়ের কাছে ‘স্নেহশীল দাদা’। আর মায়ের কাছে আদরের ‘নসু'।


সূর্য সেন : জন্ম - ২২ মার্চ ১৮৯৪ 

ফাঁসি - ১২ জানুয়ারি ১৯৩৪ 


মাস্টারদা সূর্য সেন-এর  লেখা শেষ চিঠি, সহযোদ্ধাদের উদ্দেশে  


আমার শেষ বাণী-আদর্শ ও একতা। ফাঁসির রজ্জু আমার মাথার উপর ঝুলছে। মৃত্যু আমার দরজায় করাঘাত করছে। মন আমার অসীমের পানে ছুটে চলছে। এই ত’ সাধনার সময়। বন্ধুরূপে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার এই ত সময়। ফেলে আসা দিনগুলোকেও স্মরণ করার এই ত সময়।

কত মধুর তোমাদের সকলের স্মৃতি। তোমরা আমার ভাইবোনেরা, তোমাদের মধুর স্মৃতি বৈচিএ্যহীন আমার এই জীবনের একঘেঁয়েমিকে ভেঙ্গে দেয়। উৎসাহ দেয় আমাকে। এই সুন্দর পরম মুহুর্তে আমি তোমাদের জন্য দিয়ে গেলাম স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন। আমার জীবনের এক শুভ মুহুর্তে এই স্বপ্ন আমাকে অনুপ্রাণিত করছিল। জীবনভর উৎসাহ ভরে ও অক্লান্তভাবে পাগলের মত সেই স্বপ্নের পিছনে আমি ছুটেছি। জানিনা কোথায় আজ আমাকে থেমে যেতে হচ্ছে। লক্ষে পৌছানোর আগে মৃত্যুর হিমশীতল হাত আমার মত তোমাদের স্পর্শ করলে তোমরাও তোমাদের অনুগামীদের হাতে এই ভার তুলে দেবে, আজ যেমন আমি তোমাদের হাতে তুলে দিয়ে যাচ্ছি। আমার বন্ধু্রা- এগিয়ে চল। এগিয়ে চল- কখনো পিছিয়ে যেও না। পরাধীনতার অন্ধকার দূরে সরে যাচ্ছে। ঐ দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতার নবারুন। কখনো হতাশ হয়ো না। সাফল্য আমাদের হবেই। ভগবান তোমাদের আশির্বাদ করুন।

১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিল চট্টগ্রাম ইস্টার বিদ্রোহের কথা কোন দিনই ভুলে যেও না। জালালাবাদ, জুলধা, চন্দননগর ও ধলঘাটের সংগ্রামের কথা সব সময় মনে রেখো। ভারতের স্বাধীনতার বেদীমূলে যে সব দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের নাম রক্তাক্ষরে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে লিখে রেখো।

আমাদের সংগঠনে বিভেদ না আসে- এই আমার একান্ত আবেদন। যারা কারাগারের ভিতরে ও বাইরে রয়েছে, তাদের সকলকে জানাই আমার আশির্বাদ। বিদায় নিলাম তোমাদের কাছ থেকে।


বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক

বন্দে মাতরম্‌।



শ্রীচরণকমলেষু ---আমার বৌদি ---স্নেহময়ী বৌদি, 

আমার ভক্তি প্রণতি নিন। আপনার কাছে হয়তো আমার এই শেষ চিঠি। জানি না আর চিঠি লিখবার সময় হয় কিনা। অন্য কাগজখানাতে গোপাল রাখাল এবং বাদলের কাছে কয়েক লাইন করে লিখলাম, তাহাদিগকে দেবেন। দাদা মেজদি এবং অন্যান্য গুরুজনকে প্রণাম ও বৌমাদিগকে আমার স্নেহাশীষ জানাবেন। হাইকোর্টের হুকুম জানবার পর আপনাদের কাছে কয়েকখানা চিঠি লিখেছি, আশা করি পেয়েছেন। বৌদি আমি চললাম। আপনাদের অকৃত্রিম স্নেহের মধুর স্মৃতি নিয়েই আমি যাচ্ছি। আপনাদের অগাধ স্নেহ আমায় পৃথিবীতে বেঁধে রাখতে পারল না বলে দুঃখ করবেন না। স্নেহ মমতা ভালোবাসা যতই গভীর হোক, যতই অপরিসীম হোক, তা কখনো মানুষকে চিরদিন সংসারে বেঁধে রাখতে পারেনা। একদিন ভগবানের বিধানে সমস্ত বন্ধন কেটে সে অসীমের পানে ছুটে চলে যায়। ইহাই সৃষ্টিকর্তার বিধান। আমার কোন দুঃখ নেই । আমার মন আজ অসীমকে চায়,ভগবানের সান্নিধ্য চায়। দিন ভালই কাটছে।

চার-পাঁচ দিন আগে একদিন সন্ধ্যার সময় একদৃষ্টে একমনে আকাশের দিকে চেয়েছিলাম। নির্মল জোৎস্নায় সমস্ত নীল আকাশ ভরে গিয়েছিল। অসংখ্য নক্ষত্র সুন্দর ফুলের মতো সারা আকাশে ফুটে রয়েছিল। গাছগুলি নীরবে যেন প্রকৃতির এই বিমল সৌন্দর্যের মধ্যে ডুবে গেল। মনে পড়ে গেল তাঁর কথা, যিনি এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছেন, যিনি আমাদের আনন্দের জন্য প্রকৃতির অনন্ত সৌন্দর্যের ভাণ্ডার খুলে রেখেছেন।তাঁর কথা ভাবতে ভাবতে মনে বেশ আনন্দ হল। অনেকক্ষণ এভাবে কেটে গেল। আজকাল প্রায়ই এভাবে অসীমের চিন্তাতেই মন ভরপুর হয়ে থাকে। ...দার্শনিক এবং কবিরা মরণ জিনিসটাকে কত সুন্দরভাবে চিত্রিত করেছেন। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, মানুষ যেমন জীর্ণবস্ত্র পরিত্যাগ করে নূতন বস্ত্র গ্রহণ করে, সেরূপ আত্মা জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে অন্য নূতন দেহ ধারণ করে। কবি বলছেন, মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান। মানুষ এত সুন্দর লেখা পড়েও উপলব্ধি করতে পারে না বলেই কি মৃত্যুকে ভয়ের জিনিস বলে মনে করে?

বৌদি, যাই তবে,আমায় আশীর্বাদ করুন। আপনাদের কাছে কত অপরাধই করেছি---আমায় ক্ষমা করুন। ভগবানের বিধানকে তাঁর শুভ আশীর্বাদ বলেই গ্রহণ করবেন। 

ইতি---

আপনার স্নেহের শ্রীসূর্য কুমার সেন।।


************************************************************************************

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন