শনিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

পাঠকের মতামত * স্বরবর্ণ * বারো



কবি-লেখকেরাই স্বরবর্ণের মূল চালিকা শক্তি। তাঁদের সৃষ্টিকাজ বুকে ধরে 'স্বরবর্ণে'র পথ চলা। কোনও সন্দেহ নেই,সেই সঙ্গে তার চলার গতিকে ত্বরান্বিত করেছে পাঠকের সুচিন্তিত মতামত। পাঠকের মতামতের আজ প্রথম পর্ব ----


রাজেশ গঙ্গোপাধ্যায় সোহম চক্রবর্তী এর কবিতা পড়ে লিখছেন   সোহম, আমার অন্যতম প্রিয় কবি এবং সমকালীন বাংলা কবিতায় এক দৃপ্ত, সংবেদনশীল, সৌম্য কন্ঠস্বর। এই কবিকে পাঠ অনিবার্যভাবে অনাস্বাদিতপূর্ব অভিজ্ঞতা। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল মাত্র পঁচিশ বছর বয়সেই সোহম নিজস্ব অবস্থান সুনিশ্চিত করেছে। যদিও এ এক নির্বোধের মত মন্তব্য হয়ে গেল। প্রতিভার বিচ্ছুরণ তো বয়সের সমানুপাতিক হবে, তেমন কোন প্রতিপাদ্য নেই। এখানে দুটি কবিতায় আবার সোহমের জাঁক পাওয়া গেল। প্রথম কবিতায় যে অভিজাত নিস্পৃহার ভেতরে চরম বিবিক্ততা ঘনিয়ে রয়েছে এবং এভাবেই যে আসক্তির স্পষ্ট আদল প্রতীয়মান হয়ে উঠেছে, তার মৌজই আলাদা। প্রতিটি স্তবকে মুক্ত হয়ে বিস্তারিত হয়ে উঠছে সংশ্লেষ আর এই প্যাটার্নেই সমকাল এসে চুপ করে বসছে লেখার শান্ত ঘাটে, যেখানে ছায়ার আলোয় দীপ্ত হয়ে আছে চারপাশ। এই পূর্ণতা কবিতাটিকে যে ঋদ্ধতা দিল, তার তুলনীয় সে নিজেই। এভাবে লেখার শরীর থেকে লেখাকেই বের করে নিয়ে আসার বিত্তে ভরে ওঠার সামর্থ্য সব ক্ষেত্রে থাকেনা, যখন সে দৃষ্টান্ত নির্মিত গয়...আহা! সে এক কালোত্তীর্ণ অভিজ্ঞান।

আর দ্বিতীয় লেখাটি তো মহাকাব্যিক জমকের সার্থক নিদর্শন! শুধুমাত্র 'রমণসম্ভবা' শব্দটির প্রয়োগে, অবিশ্বাস্য প্রয়োগে যে মৌতাত তৈরী হয়েছে, তার বিকল্প হয়না! সোহমের কাব্যভাষায় এ এক আশ্চর্য রীতি, শব্দের সনাতনী রূপ চূড়ান্ত আধুনিক প্রয়োগে ব্যবহার করার অবিসংবাদী দক্ষতা! অনেকদূর যাবেন এই কবি। বাংলা কবিতাকে স্নেহের আশ্রয় দিতে যোগ্যতম কলমের সন্ধান আজ সুনিশ্চিত।

শীলা দাশ লিখেছেন  তৈমুর খানের গুচ্ছ কবিতা পড়লাম  সচেতনতার নানা রঙ। ভালো লাগলো। দেবার্ঘ সেনের কবিতা আরো স্পষ্ট প্রতিবাদী। এমন কবিতা আরো আসুক। 

দীপংকর রায় লিখছেন  আজ নীল কমল ও তৈমুর খানের এবং ঋতুপর্ণ খাটুয়ার লেখা পড়লাম । নীল কমলের এই পর্বের লেখাগুলি ভীষণ মর্মভেদী। তৈমুর খান বরাবরের মতোই আমাকে ঝাঁকি দিয়ে জাগিয়ে তোলে ।আর ঋতুপর্ণ খাটুয়া এর লেখাগুলি যথেষ্ট সাহসী লেখা । চিত্ররূপময় ও বলতে হবে । আরো পথ পেরোতে পারলে হয়তো সেই অধরাকে ধরবার প্রচেষ্টায় গভীর অভিনিবেশ সহ তাকে আমরা পরিপূর্ণ রূপে দেখতে পাবো ।

পল্লববরন পাল দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়-এর অণুগল্প পড়ে লিখেছেন  বাঃ। ভারি সুন্দর জীবনের কথা।

রুমা ঢ্যাং অধিকারীর কবিতা পড়ে লেখনি লিখছেন  তোমার কবিতা সবকটাই দারুন "গল্প * দেবাশিস সাহা" সম্পর্কে তার মন্তব্য   অসাধারণ একটি লেখা।

তৈমুর খান দীপংকর রায়ের গুচ্ছ কবিতা পড়ে লিখছেন  এক অন্তর্গত আত্মার বিষন্নতা ছেয়ে আছে কবিতাগুলিতে। নিজস্ব উপলব্ধি তীব্রতা বারবার অভিঘাত তুলেছে।

বাসুদেব চন্দ জবা ভট্টাচার্য-এর কবিতা পড়ে লিখেছেন  দুটিই অনবদ্য! এমন কয়েকটি লাইন আছে যেগুলির আস্তরণ ছাড়াতে পারলে সুন্দর অর্থ নিঃসৃত হতে পারে। এখানেই তো কবিতার সার্থকতা! 

কিঙ্কর দাস নিমাই জানা-র কবিতা পড়ে লিখছেন  দুটোই অসাধারণ কবিতা...আপনার সুন্দর সৃষ্টির গুলোর মতোই উজ্জ্বল সুন্দর...মুগ্ধতার আবেশ ছড়ালো

মৌমিতা দে সেনগুপ্ত চন্দ্রাণী গোস্বামীর কবিতা পড়ে লিখেছেন   অনবদ্য কবিতা দুটি।

শতদল মিত্রের কবিতা পড়ে সিক্তা মুৎসুদ্দি লিখছেন  প্রজাতান্ত্রিক জ্যোৎস্নায় প্রস্ফুটিত কথারা জমাটবাঁধা পাথরে ফুল ফোটাক ফাল্গুনী শুভেচ্ছায়।  

মধুমিতা বসু সরকারের কবিতা পড়ে মানস মন্ডল লিখছেন  হননে ও অনুভবে একটি সুন্দর কবিতা। 

 শ্রীতমা লিখছেন পার্থ প্রতিম গোস্বামীর কবিতা পড়ে  কবিতাজোড়া ভাঙচুর ও গঠন । 

শতদল মিত্র দেবাশিস সাহার ছোটগল্প পড়ে লিখছেন * 'গোধূলির ধূলি' পড়লাম। জীবনছোঁয়া লেখা। গল্পটা পাঠক আমার হয়ে উঠল যেন! অনেক ধন্যবাদ।

আবদুস সালাম সামগ্রিক ভাবে পত্রিকা সম্পর্কে জানাচ্ছেন  অসাধারণ একটা সংখ্যা উপহার দেওয়ার জন্য সম্পাদক মন্ডলীর প্রত্যেককে ধন্যবাদ। 


রবিবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

লেখা আহ্বান







*********************

স্বরবর্ণ * তেরো 

তৃতীয় বর্ষ *  প্রথম সংখ্যা

*********************

প্রকাশিত হবে আগামী  ১৫ এপ্রিল ২০২৩ 

এই সংখ্যার জন্য  লেখা জমা নেওয়া হবে  ১৫ মার্চ ২০২৩ পর্যন্ত । 

লেখা পাঠানো যাবে নীচের দুটি নম্বরে। তবে মেলে পাঠালে w/a জানিয়ে দেবেন ।

বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে উপরের লিঙ্কে।

* হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর   8777891532

*ই-মেইল --- debasishsaha610@gmail.com 


সম্পাদকমণ্ডলী                                                   

ড : শুভঙ্কর দে           অলোক কোৱা

সৌম্যজিৎ দত্ত             দেবাশিস সাহা

মঙ্গলবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

প্রিয় কবি লেখক এবং পাঠকদের প্রতি


 


স্বরবর্ণ

সৃজনের মৌলিক স্বর

স্বরবর্ণ * ১২ * বসন্ত  সংখ্যা * ১৪২৯   

সংখ্যাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত আমাদের অকপটে জানান । প্রাপ্ত মতামতগুলি আমরা ক্রমান্বয়ে প্রকাশ করব ২৫ ফেব্রুয়ারির পর থেকে । 

************************

স্বরবর্ণ * ১৩ 

তৃতীয় বর্ষ * প্রথম সংখ্যা

*************************

প্রকাশিত হবে আগামী  ১৫ এপ্রিল * ২০২৩ 

লেখা পাঠানোর আগে নীচের বিষয়গুলি নিশ্চিত হয়ে নিন ------


* স্বরবর্ণ দ্বিমাসিক ওয়েব ম্যাগাজিন ।

* লেখা মনোনয়নের ব্যাপারে সম্পাদকমন্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

* প্রাপ্তি সংবাদ জানানো সম্ভব নয়। নিৰ্বাচিত লেখকসূচি আমরা একমাসের মধ্যেই ফেসবুকে প্রকাশ করি । 

* পরবর্তী  সংখ্যার জন্য আপনার মৌলিক ও অপ্রকাশিত লেখা ( গল্প কবিতা প্রবন্ধ  অণুগল্প  অনুবাদ কবিতা  ভ্রমণ কাহিনি  ইত্যাদি  ) ১৫ মার্চ  ২০২৩  এর মধ্যে পাঠান । 

* শব্দসীমা অনির্দিষ্ট। 

* কবিতার ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুটি কবিতা পাঠাবেন।  

* লেখার সঙ্গে আপনার একটি ছবি এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, প্রকাশিত গ্রন্থ (থাকলে)  ছবিসহ পাঠান । 

* "স্বরবর্ণ " সামগ্রিক চিন্তার ফসল। আগে থেকে লেখা পাঠান। পরিকল্পনার সুবিধার জন্য। লেখা পাঠাবেন ওয়ার্ড ফাইলে, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ই-মেইল বডিতে টাইপ করে ।


* হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর   8777891532

*ই-মেইল --- debasishsaha610@gmail.com 


সম্পাদকমণ্ডলী                                                   

ড : শুভঙ্কর দে           অলোক কোৱা

সৌম্যজিৎ দত্ত             দেবাশিস সাহা 

তোমায় খুঁজে ফিরি * স্বামী বিমোক্ষানন্দ



পুণ্যব্রতে পূর্ণযোগী : স্বামী আত্মস্থানন্দ 

এক প্রেরণার উৎস : অমলিন স্মৃতিসমূহ

          - স্বামী বিমোক্ষানন্দ     

১) 

     সাধুজীবন সর্বদাই স্বচ্ছন্দে বয়ে যায় না।‌এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নানা বাধাবিঘ্ন। পরম করুণাময় ঈশ্বরের ইচ্ছা অনুযায়ী মহান সাধুদের সংস্পর্শে না আসা পর্যন্ত সাধকের সাধনা (গভীর ধ্যান, গুরুর নির্দেশ, ঐকান্তিকভাবে মেনে চলা এবং বিপদ-প্রলোভন বিষয়ে সতর্ক থাকা) কোনভাবেই মান্যতা পায় না। ঈশ্বরের আশীর্বাদে বেলুড় মঠের ট্রেনিং সেন্টারে আমার প্রশিক্ষণ চলাকালীন (১৯৭৬ -৭৮) আমি প্রয়াত পরম পূজ্যপাদ পঞ্চদশ সঙ্ঘগুরু স্বামী আত্মস্থানন্দজী মহারাজের সান্নিধ্য লাভ করার সুযোগ পাই। 

     ১৯৭৮ সালে আমার প্রশিক্ষণকাল সমাপ্ত হওয়ার তিনমাস আগে অন্ধ্রপ্রদেশের উপকূলবর্তী অঞ্চলে তীব্র সাইক্লোন ঝড় আছড়ে পরে।‌সেই ভয়ঙ্কর বিধ্বংসী ঝড়কে ডিভিসীমা প্রলয় বলে অভিহিত করা হয়। এখানে রিলিফ ও পুনর্বাসনের কাজে পূজ্যপাদ আত্মস্থানন্দজী মহারাজ আমাকে ও আরও চারজন ব্রহ্মচারীকে নিযুক্ত করলেন। যার নেতৃত্বে ছিলেন প্রীতি মহারাজ। 

     এই রিলিফের কাজ চলাকালীন পূজনীয় স্বামী আত্মস্থানন্দজীকে খুব কাছে থেকে সেবা কর্মে মুখর অবস্থায় দেখার আমার সুযোগ হয়। তাঁর ছিল অফুরান প্রাণশক্তি ও অদম্য ইচ্ছাশক্তি। ত্রাণশিবিরের দায়িত্বপ্রাপ্ত সন্ন্যাসী, ব্রহ্মচারী ও স্বেচ্ছাসেবকদের খুব উৎসাহ ও নৈতিক সমর্থন জোগাতেন তিনি। সাইক্লোনের কারণে রাস্তাঘাট নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ায় বিপদগ্রস্তদের কাছে ন্যূনতম ত্রাণসামগ্রী সরবরাহ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এছাড়া এই কারণে প্রায় ১২০০ সাইক্লোন নিরোধকারী বাড়ি নির্মাণে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রগুলি কিভাবে নিয়ে আসা যায় তা নিয়ে দেখা দিল সমস্যা। 

     প্রারম্ভিক পর্যায়ে সরকারি আধিকারীকরাও আমাদের বিপুল ত্রাণকার্যের বিরোধী ছিলেন। এইভাবে সবকিছুই যখন আমাদের বিপক্ষে, যখন কোনও আশার আলো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না, ঠিক তখনই পূজনীয় আত্মস্থানন্দজী মহারাজ দেবদূতের মতো আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়ে ত্রাণকার্যে প্রেরণা জুগিয়ে চাঙ্গা করে তুললেন। ওঁর ব্যক্তিত্বটাই ছিল এমন! সাধারণ করণিক হোক কিংবা ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর, সিমেন্ট সংগ্রহের কাজই হোক কিংবা কন্ট্রাক্টরদের নিয়োগ, সর্বক্ষেত্রেই তাঁর ব্যক্তিত্বের জাদু কাজ করত -ইতিবাচক ভাবে। সমস্ত রকম কাজের মধ্যেই অদ্ভুতভাবে তিনি উৎসাহ সঞ্চার করতে পারতেন। ত্রাণকার্যে এইভাবে একজন পিতৃসম ব্যক্তিত্ব হিসেবে রক্ষকের ভূমিকা নিয়ে সন্ন্যাসী ও ব্রহ্মচারী দলকে এক গৌরবের ভাগী করতেন। কেননা আমরাই ছিলাম সেই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন যারা অন্ধ্রপ্রদেশে সেই ত্রাণকার্য প্রথম সম্পন্ন করতে সক্ষম হই।

     

২)

     ১৯৭৯ সালে পূজনীয় স্বামী আত্মস্থানন্দজী মহারাজ আমায় মঠের নতুন কেন্দ্র ইটানগরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সেইসময় আমি তাঁর নিকটতর সংস্পর্শে আসি। ভারত সরকারের নির্দেশে অরুণাচল প্রদেশের এই রাজধানী শহরে তখন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরির তোড়জোড় চলছে। কিন্তু ইতিমধ্যে অরুণাচল প্রদেশের আলং এবং নরোত্তমনগরে রামকৃষ্ণ মিশন পরিচালিত দুটি স্কুল থাকায় পূজনীয় মহারাজ মনে করতেন সেখানে একটি ভাল চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপনের আশু প্রয়োজন। কেননা কোনও উল্লেখযোগ্য হাসপাতাল সেইসময়ে অরুণাচল প্রদেশে ছিল না। সংকটাপন্ন রোগীদের হেলিকপ্টারে করে নিকটবর্তী আসামের হাসপাতালগুলিতে নিয়ে যেতে হতো। পূজনীয় মহারাজই একক প্রচেষ্টায় সরকারকে স্কুল তৈরির পরিকল্পনা থেকে সরিয়ে নিয়ে হাসপাতাল তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণে রাজি করান। নবনির্মিত রামকৃষ্ণ মিশন হাসপাতাল সমগ্র অরুণাচল প্রদেশের একটি সেরা হাসপাতালে পরিণত হয়। এবং এই হাসপাতালের মাধ্যমেই এই রাজ্যে ঘরে ঘরে শ্রীরামকৃষ্ণের নাম ছড়িয়ে পড়ে, মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেন তিনি। 

     ১৯৮৮ সালে আমি রামকৃষ্ণ মিশন সেবাপ্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত হই। এই মুখ্য চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে পোস্ট গ্রাজুয়েট কোর্সও রয়েছে। পূজনীয় মহারাজ এখানকার প্রেমানন্দ ওয়ার্ডে অসুস্থ সন্ন্যাসীদের দেখতে প্রায়ই আসতেন। যেহেতু আমি ওই ওয়ার্ডের ভারপ্রাপ্ত ছিলাম, তাই হাসপাতাল গেট থেকে মহারাজকে রিসিভ করে নিয়ে ওয়ার্ডে ঘোরানোর কাজ আমার উপরই ন্যস্ত ছিল। অসুস্থ সন্ন্যাসী মহারাজদের সঙ্গে মহারাজ কিভাবে কথাবার্তা বলতেন, পারস্পরিক আলোচনা করতেন, তা আমি গভীরভাবে লক্ষ্য করতাম। কঠোর শৃঙ্খলাপরায়ণ ও দক্ষ প্রশাসকের (কয়েক বছর আগে রেঙ্গুনে একটি বড় হাসপাতাল দক্ষতার সাথে চালিয়ে এসেছেন) সমস্ত বৈশিষ্ট্যই তাঁর মধ্যে ছিল। কিন্তু অসুস্থ সাধুদের সঙ্গে তাঁর সস্নেহ, সহানুভূতি ও প্রেমপূর্ণ বাক্য বিনিময় ছিল বিশেষভাবে লক্ষ্য করার মত। একবার তিনি চলে যাওয়ার পর অসুস্থ-সাধুরা আমাকে জানিয়েছিলেন পূজনীয় মহারাজের পরিদর্শন তাঁদের কাছে কতটা শান্তি ও স্বস্তিদায়ক হয়ে উঠত। মহারাজের মধ্যে তাঁরা বুদ্ধের হৃদয়কে অনুভব করতেন।

 

 ৩)

      সাধারণ সম্পাদকের পদে থাকাকালীন পূজনীয় মহারাজ আমায় ১৯৯৫ সালে রাচি টিবি স্যানেটারিয়ামে নিযুক্ত করেন। এই স্থানটি তাঁর খুব প্রিয় ছিল। আমি সেখানে দীর্ঘ ১২ বছর ছিলাম। এই সময়কালের ভিতর পূজ্যপাদ মহারাজ সেখানে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে একবার যান। পরে এখানে সহ-সঙ্ঘাধ্যক্ষ হিসেবেও তাঁর তিনবার (১৯৯৯, ২০০২ ও ২০০৫ সালে) শুভাগমন ঘটেছিল। আমি থাকাকালীন ১৯৯৯ সালে তাঁর সহ-সঙ্ঘাধ্যক্ষ রূপে প্রথম শুভাগমনের স্মৃতি কখনও ভোলার নয়। মনে পড়ে, ক্যাম্পাসের চারিপাশ পরিদর্শনকালে আমি তাঁকে কর্দমাক্ত পিচ্ছিল রাস্তা সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছিলাম। সকালে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হওয়ায় পথ কর্দমাক্ত পিচ্ছিল হয়ে পড়েছিল। উনি শান্তানন্দ কুঠিয়ার দিকে যেতে চাইছেন, আমি জানতাম। কুঠিয়ার কয়েক গজ দূরে পৌঁছে ঐ কর্দমাক্ত পথের উপরেই সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করলেন, যা দেখে উপস্থিত আমরা সকলে হতবাক হয়ে গেলাম। স্বামী শান্তানন্দজী সম্পর্কে কোনও প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলে, কিংবা পূজনীয় মহারাজ তাঁর সম্পর্কে যখন কিছু বলতেন, তখন ভক্তি, আবেগ, বিশ্বাস, তাঁর মধ্যে যেন ঘনীভূত হয়ে উঠত। যাইহোক, কুঠিয়ার অবহেলিত ভগ্নদশা দেখে তিনি সেদিনই সেটি সংস্কার সাধনের উদ্দেশ্যে পিয়ারলেসের সুনীলবাবুকে আশি হাজার টাকা অনুদান পাঠানোর নির্দেশ দিলেন। সংস্কারের কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার পর ১৯৯৯ সালে পূজনীয় মহারাজই এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন, এবং কুঠিয়ার নামকরণ করা হয় -শান্তানন্দ কুঠিয়া। 

      পূজ্যপাদ মহারাজ পরম পূজনীয় শান্তানন্দজী সম্পর্কে কি বলেছিলেন তা বলব। শান্তানন্দজী শ্রীশ্রীমায়ের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতেন! ১৯৫২ থেকে ৫৮ সাল পর্যন্ত আত্মস্থানন্দজী এই রাঁচি কেন্দ্রে সহ-সম্পাদক হিসাবে কর্মরত ছিলেন। সেই সময়ে হাসপাতাল চালানোর প্রয়োজনীয় অর্থবল না থাকায় ওই কেন্দ্রের তৎকালীন সম্পাদক স্বামী বেদন্তানন্দজী (অনুকূল মহারাজ) ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। একদিন শান্তানন্দ মহারাজ তাঁর কুঠিয়ার (এখন যার নাম শান্তানন্দ কুঠিয়া) বারান্দা থেকে লক্ষ্য করলেন যে অনুকূল মহারাজ বেশ মনমরা অবস্থায় রয়েছেন। এর কারণ জানতে চাইলে অনুকূল মহারাজ জানালেন যে হাসপাতালের কাজ চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থবল এতই অল্প হয়ে পড়েছে যে, তিনি ভাবছেন স্যানেটারিয়াম বন্ধ করে দেওয়ার কথা বেলুড় মঠ কর্তৃপক্ষকে জানাবেন। 

      এই কথা শুনে শান্তানন্দজী তৎক্ষণাৎ মৃদু ভর্ৎসনা করে তাঁকে বললেন যে, তিনি প্রথমে মায়ের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলবেন, তারপর ফলাফল কি হয় জানাবেন। এরপর তিনদিন কেটে গেল, অনুকূল মহারাজ কুঠিয়াসংলগ্ন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন এমন সময় কুঠিয়া থেকে বেরিয়ে এসে শান্তানন্দজী চিৎকার করে তাঁকে ডাকলেন, "অনুকূল তাড়াতাড়ি এস। তোমার জন্য একটা খুশির সংবাদ আছে।" অনুকূল মহারাজকে তিনি বললেন যে, তাঁর সঙ্গে শ্রীশ্রীমায়ের কথা হয়েছে এবং তিনি জানিয়েছেন স্যানেটারিয়াম বন্ধ করে দেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই, প্রয়োজনীয় অর্থ শীঘ্রই পাঠিয়ে দেবেন। কয়েকদিনের মধ্যেই ঘটে গেল সেই আশ্চর্য ঘটনা লণ্ডনের এক ব্যারিস্টার পূজ্যপাদ আত্মস্থানন্দজীর হাতে তুলে দিলেন পনেরো লক্ষ টাকার একটি চেক।

    ৪)

      আত্মস্থানন্দজী মহারাজ সহ-সঙ্ঘাধ্যক্ষ হওয়ার পর প্রথমবার রাঁচি কেন্দ্রে আসার আগে এখানকার ডুংরি গ্রামের অধিবাসীদের জানিয়ে দিলাম, মহারাজ এখন দীক্ষা দান করছেন। দীক্ষাদানের অধিকারী হয়েছেন তিনি। পঞ্চাশের দশকে এই সেনেটারিয়ামের সহ-সম্পাদক পদে থাকাকালীন বিভিন্ন ওয়ার্ডের নির্মাণ কাজে তিনি ছিলেন মূল উদ্যোগী। শুধু তাই নয়, আমাদের ক্যাম্পাসের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীতে একটি প্রয়োজনীয় বাঁধ বিশেষভাবে নির্মাণ করিয়েছিলেন। মুণ্ডা উপজাতি অধ্যুষিত গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরা মহারাজকে এক হৃদয়বান উদ্দীপ্ত সন্ন্যাসী হিসেবে মনে রেখেছিলেন। এর ফলে সহ-সঙ্ঘাধ্যক্ষ হয়ে এখানে আসার পর অনেকেই মহারাজের কাছে মন্ত্র দীক্ষা গ্রহণ করেন। 

      ২০০২ সালে ২৬ শে মে পূজ্যপাদ মহারাজ তৃতীয়বারের জন্য সেনেটারিয়াম পরিদর্শনে আসেন। এখানে তাঁর অবস্থানকালের সঙ্গে বুদ্ধপূর্ণিমা তথা বহু পরিচিত Thrice-Blessed-Day-এর যেন সমাপতন ঘটে। বুদ্ধ পূর্ণিমাকে thrice blessed day বলা হয় কারণ এই পূর্ণিমা তিথিতে বুদ্ধর জন্মদিন, তাঁর নির্বাণের দিন, ও তাঁর মহাপ্রয়াণের দিন, একসঙ্গে পড়ে। সেনেটারিয়ামে আগত ভক্তদের কাছে পূজনীয় মহারাজের অবস্থান কিভাবে এমন হয়ে উঠেছিল তা কলকাতা থেকে আগত এক ভক্তের কথায় বোঝা যায় : 'বাস্তবিকই ২০০২ সালের ২৬ শে মে'র দিনটি আমাদের কাছেও হয়ে উঠেছিল Thrice Blessed Day. কেননা ওই দিনটিতে আমরা তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী হয়েছিলাম। প্রথমত সকালে মন্দিরে ঠাকুর, শ্রীশ্রীমা ও স্বামীজীর পুরনো ফটো সরিয়ে নতুন ফটো স্থাপন করেন পূজ্যপাদ সহ-সঙ্ঘাধ্যক্ষ মহারাজ। দ্বিতীয়ত পরম পূজনীয় একাদশ সঙ্ঘগুরু গম্ভীরানন্দজীর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে একটি স্মারক পুস্তিকা প্রকাশ করেন তিনি। সেইদিন গম্ভীরানন্দজীর শততম জন্মদিন আনন্দের সঙ্গে উদযাপন করেন উপস্থিত সন্ন্যাসীবৃন্দ।  তৃতীয়ত সন্ধ্যাবেলায় মহারাজ ভগবান বুদ্ধের বিষয়ে একটি বক্তৃতা প্রদান করেন এবং এরপরে ধ্যান প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় তাঁর নির্দেশনায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই দিনটি ছিল পূজনীয় মহারাজেরও জন্মদিন। 

      যেহেতু পূজনীয় মহারাজ এই রাঁচি কেন্দ্রে আগে সহ-সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাই তিনি সংলগ্ন গ্রামের দারিদ্র বিষয়ে সম্যকভাবে জানতেন। এই গ্রামের শিশুদের অপুষ্টিজনিত সমস্যা, তাঁর তীক্ষ্ণ নজর এড়িয়ে যায়নি। ১৯৯৯ সালের এক সকালে মর্নিং-ওয়াক করতে করতে মহারাজের সঙ্গে ইন্ডোর ওয়ার্ডের দিকে যাচ্ছি, হঠাৎ তিনি আমার দিকে ঘুরে জিজ্ঞাসা করলেন, "এখানকার শিশুদের জন্য দুধ দেওয়ার বন্দোবস্ত করছ না কেন তুমি? আমি দেখছি তোমার ডেয়ারি ফার্ম এখন আকারে অনেক বেড়েছে এবং এখানকার দুধ প্রকৃতই ভাল গুণমানের।" কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলতে শুরু করলেন, "শিবলিঙ্গের অভিষেক অনুষ্ঠানে আমরা কত দুধ ব্যবহার করি, ভেবে দেখ! এই দুধ যদি এইসব শিশুদের উদরপূর্তিতে ব্যবহার করা হয়, তাহলে শিব প্রকৃতই তুষ্ট হবেন।


*********************************************************************************************


*******************************************************************************************

প্রিয় কবি প্রিয় কবিতা * শক্তি চট্টোপাধ্যায়



[এই বিভাগে আমরা এমন দু-একটি  কবিতা পড়ব , যে কবিতা আমাদের অন্তর্লোকে বিস্ময় সৃষ্টি করে শুধু নয় ,আমাদের কবিতা পড়ার আনন্দে অবগাহন করায় , প্রতি দিন  প্রতি মুহূর্তে | এই পর্যায়ের কবি যে সবসময়  বিখ্যাতই  হবেন , এমনটা নয় , তিনি অখ্যাত তরুণ তরুণতর কবিও হতে পারেন , কিন্তু ,শর্ত একটাই ,কবিতাটি যেন আমাদের মর্মলোক স্পর্শ করে | স্বরবর্ণ / ১২  সংখ্যায় 'প্রিয় কবি  প্রিয়  কবিতা ' বিভাগের কবি হলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়|]


যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব  

শক্তি চট্টোপাধ্যায়








ভাবছি, ঘুরে দাঁড়ানোই ভাল

এত কালো মেখেছি দু হাতে

এত কাল ধরে।

কখনো তোমার করে, তোমাকে ভাবিনি।


এখন খাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে

চাঁদ্ ডাকে আয়, আয়, আয়।

এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে

চিতা কাঠ ডাকে আয়, আয়, আয়।


যেতে পারি,

যেকোনো দিকেই আমি চলে যেতে পারি

কিন্তু, কেন যাবো?


সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমো খাবো

যাবো

কিন্তু, এখনি যাবো না

তোমাদেরও সঙ্গে নিয়ে যাবো

একাকী যাবো না অসময়ে।


********************************************************************************************


*********************************************************************************************

গল্প * দেবাশিস সাহা



গোধূলির ধূলি

দেবাশিস সাহা

 

কোনও কারণ নেই, মেয়ের গালে ঠাটিয়ে এক চড় কষিয়ে খিলখিল করে হাসতে লাগল পরিমল। চোখ মুছতে মুছতে মায়ের কাছে ছুটল তিতলি, " মা দেখো, খালি খালি বাবা আমাকে কী জোর মেরে দিল। " রান্নাঘরে শেফালি তখন রুটি সেঁকছিল। ফিরে মেয়ের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠল, "ওমা,পাঁচ আঙুলের দাগ বসে গেছে যে রে! কই চল তো দেখি, কী কারণে মিনসেটা এমন মারল তোকে। "

 

 গ্যাস নিভিয়ে মেয়ের হাত ধরে টানতে টানতে বড় ঘরে এল শেফালি। সেখানে তখন আর-এক ধুন্ধুমার কান্ডবন্ধ দরজায় দমাদম লাথি মারছে পরিমল আর সমানে চিল্লাচ্ছে, "খোল শালা, তালা খোল, কারখানায় তালা ঝোলালো! " তিতলির হাত ছেড়ে, পেছন থেকে পরিমলকে জাপটে ধরে শেফালি, " করছ কী? নতুন দরজাটা ভেঙে যাবে যে! " কে শোনে কার কথা! এক ঝটকায় শিউলির হাত ছাড়িয়ে ফের পরিমলের সেই রনংদেহী মূর্তি আর সেই এক বুলি , " খোলা শালা,তালা খোল, কারখানায় তালা ঝোলানো! " বলতে বলতে বন্ধ দরজায় দমাদম লাথি, সাথে নাগাড়ে ঘুসিও চালাতে লাগল এবার আঙুল ফেটে গলগল করে রক্ত ঝরছে, তবুও হুঁশ নেই।

 

 " বাবা, ওরকম করছ কেন, ভেতরে ভাই ঘুমাচ্ছে তো, উঠে পড়বে, " কাঁদতে কাঁদতে বলে তিতলি।

 

সকালবেলার এই চিল্লামিল্লিতে ততক্ষণে ঘুম ভেঙে গেছে শেফালির শাশুড়ি সরস্বতীর। ঘুম জড়ানো চোখে দৌড়ে আসে সরস্বতী, " বাবা পরি, কী হয়েছে তোর? অমন করছিস কেন? কারখানা কোথায়! ওটা যে তোদের শোয়ার ঘর।ছিটকানি দেওয়া। দাঁড়া খুলে দিচ্ছি। "

 " ম্যাডাম, তুই চুপ কর, তুইও মালিকের সাগরেদ, " বলতে বলতে ফের লাথি, "শাল্লা, কারখানা খুলবে না, মগের মুল্লুক! "

  " এই ছেলে, আমি তোর ম্যাডাম? মা না! আয়, এদিকে আয়, " ছেলের মাথায় স্নেহস্পর্শ বোলাতে বোলাতে বলল সরস্বতী।

 " মা! " অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল পরিমল, " কেউ আমার মা না , আমিও কারও ছেলে না , " বলতে বলতে সদর দরজা দিয়ে ঊর্ধশ্বাসে দৌড় দিল পরিমল।

 

শেফালি- সরস্বতী -তিতলি পিছন পিছন দৌড়োতে দৌড়োতে অনেকটা দূর এল। একটাসময় আর পেরে উঠল না। হাঁপিয়ে পড়ল। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিল পলাশ,পঙ্কজ। ক্লাবের ছেলে। ওদের ডেকে শেফালি বলল, " কাকুকে একটু থামা। ধরে আন। "

 

 " আবার বিগড়েছে,কাকি? "

" আগে ধরে আন, পরে বলছি। "

 

পলাশ,পঙ্কজ দুজনেরই জিম করা বডি। একজনের সিক্স আর একজনের এইট প্যাক। পলাশকে পাড়ার ছেলে- ছোকড়ারা জন সিনহা আর পঙ্কজকে দ্য গ্রেট খালি বলে মজা পায়। ওরাও খুশিতে ডগমগ হয়।

 

 মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ওরা পরিমলকে চ্যাংদোলা করে ধরে আনল। তখনও থেকে থেকে চেল্লাচ্ছে পরিমল, " খোল শালা, তালা খোল " চিল্লাতে চিল্লাতে গলা বসে গেছে, তবুও ফ্যাসফেসে গলায় বলার চেষ্টা করছে, " কারখানায় তালা ঝোলানো! মগের মুল্লুক! " চ্যাঁচালে আর হবে কী! চোদ্দ প্যাকের সম্মিলিত চাপে বাচাধন তখন চুপসে এত্তটুকু। জারিজুরি শেষ। কেমন যেন নেতিয়ে পড়েছে। পলাশ পঙ্কজ ধরাধরি করে শুইয়ে দিল খাটের ওপর।

 

" কাল রাতে পরিকে মাথার ওষুধটা খাইয়েছিলে, বউমা? "

 "না মা, দু'দিন ধরে খাওয়ানো হচ্ছে না।"

 "কেন?"

 "ফুরিয়ে গেছে। "

 " ওষুধটা আনাওনি কেন? " প্রশ্নটা সরস্বতী করল বটে, কিন্তু উত্তরটা তার ভালমতোই জানা। দিন- তিনেক আগে, তিতলি এসেছিল দুপুরবেলায়,পা টিপে টিপে, জেঠু -জেঠি যাতে শুনতে না পায়, ফিসফিস করে কানে কানে বলেছিল, "ঠাম্মা,মা বলল,'পাঁচেক  টাকা ধার দিতে, বাবার ওষুধ ফুরিয়ে গেছে।"

 

" ফুরিয়ে গেছে তা আমি কি করব? আমি কি টাকার গাছ লাগিয়েছি,ঝাড়া দিলেই পড়বে? আজ ইলেকট্রিক বিল, কাল ট্যাক্স-এর বিল, পরশু মেটাও গ্যাসের বিল, নয়তো ব্যাঙ্কের লোনের ঘাটতি --- বলি, আমি কোথায় পাব,এত ? আমি কি পেনশন পাই? যা, বলগে তোর মাকে,বাপের বাড়ি থেকে এই অসময়ে কিছু আনতে। "

 


                                 দুই

 


"রাশিয়া কবে ইউক্রেন আক্রমণ করেছিল,মা?"

"সে খবরে তোর কাজ কী,বাছা? "

" কাজ আছে মা,স্কুলে একটা ক্যুইজ কম্পিটিশন হবে নাইন আর টেনদের নিয়ে। আন্টি বলেছে,এবার আর আগের মত বই-টই পুরস্কার দেওয়া হবে না। করোনার জন্য সবারই সংসারে টানাটানি। তাই এবার দেওয়া হবে ক্যাশ পুরস্কার। কত জানো? এক হাজার টাকা।" মায়ের মুখের কাছে মুখ এনে 'এক হাজার' কথাটার উপর বেশ জোর দিয়ে উচ্চারণ করে তিতলি।

"অত জোরে চেঁচাচ্ছিস কেন? দেখছিস না, ভাই ঘুমাচ্ছে। এতক্ষণ খেয়াল করেনি তিতলি, মাই চুষতে চুষতে মা' বাঁ দিকে কাত হয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে তাতান। মাঝে মাঝে আঁচলটা নাড়ছে মা, মশা যাতে না কামড়ায়।

 ক্যুইজের পোকা ঘুরছে তিতলির মাথায়। মহুয়া ম্যাম  বলেছিল, কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স-এর ওপর জোর দিতে।

নেটো, ইউএনও, পিএলও, আইএমএফ... এমনসব  অ্যাব্রিভিয়েশন-এর ফুল ফর্ম কী জেনে রেখো, এই জাতীয় প্রশ্নই বেশি আসবে,বলেছিল ম্যাম। 

"আচ্ছা মা,লীগ অব নেশনস কবে প্রতিষ্টিত হয়েছিল,

এর প্রথম সভাপতির নাম কী, জানো?"

"একটু চুপ করবি,তুই! " এইবার ক্ষেপে যায় শেফালি। অত যদি জানার ইচ্ছে, টিভির খবর শুনবি দুইবেলা। "

" কী করে শুনব? কাল না পরশু নান্টুকাকু কেবল লাইনই তো কেটে দিয়ে গেল।"

 চুপ করে যায় শেফালি। সত্যিই তো, তিন মাসের টাকা জমে গেছে। সেট টপ বক্স লাগানোর কিছু টাকাও বাকি। সেদিন নান্টু এসে বলল, " কিচ্ছু করার নেই বৌদি, বাধ্য হলাম লাইন কাটতে।আমাদের তো এক তারিখের মধ্যেই কোম্পানিতে টাকা ফেলতে হয়। গাঁটের পয়সা দিয়ে আর কত চালানো যায়? "

নান্টুর শেষ কথাটা তিরের মতো বিঁধেছিল শেফালির বুকে। অনেক কষ্টে বলেছিল, "আমরা তোর টাকা মারব না নান্টু, দে কেটে দে।"

 

 মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কী ভেবে তার পর বলল, " তাহলে যা, পলাশদের বাড়ি থেকে পেপারটা চেয়ে আন। দু'চার দিন পড়। দেখবি এইসব প্রশ্নের উত্তর জলভাত হয়ে গেছে। "

 

পলাশদের বাড়ি মিনিট পাঁচ সাতের পথ। দৌড় লাগায় তিতলি। কিছুদুর গিয়ে কী ভেবে আবার ফিরে আসে, " আচ্ছা মা, এক হাজার টাকায় বাবার 'মাসের ওষুধ কেনা যাবে? "

" 'মাসের কী রে! বড়জোর দিন পনেরো। " উচ্ছ্বাসটা কেমন যেন নিভে যায় তিতলির। মুখ কালো করে ধীরে ধীরে পা বাড়ায়।

 

 মেয়ের কালো মুখটা দেখে শেফালির চোখ ছলছল করে ওঠে। এই বয়সেই কী প্রখর বাস্তববোধ। সবে ক্লাস টেন। এই ষোলোয় পড়ল। এই বয়সের মেয়ে কোথায় হাসবে -খেলবে, ঘুরবে- ফিরবে,নিত্য নতুন ড্রেস পরার বায়না ধরবে, লুকিয়ে-চুরিয়ে প্রেম করবে... তা না, কী করে কেরিয়ার গড়বে, খালি সেই ভাবনা। শেফালি কত বলেযা না,বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে একটা সিনেমা দেখে আয়। নয়তো মামাবাড়ি থেকে দুদিন ঘুরে আয়। তা যাবে না। বলবে, মা এখন ওসব থাক। এক বছর বাদেই মাধ্যমিক। মাধ্যমিক আর টুয়েলভে ভাল করে পড়লে,তবেই তো জয়েন্টে  বসতে পারব। এসব কথা শেফালি ওকে কোনওদিন শেখায়নি। মাথার গন্ডগোল হওয়ার আগে,পরিমলই  মেয়ের মাথায় এইসব চিন্তা ঢুকিয়েছে। সেই ছেলেবেলা থেকে। কতবার বলতে শুনেছে শেফালি, পরিমল বলছে, " তিতলি মা, তুই খুব বড় ইঞ্জিনিয়ার হবি। যেমন তেমন না। তোর উদ্ভাবনী শক্তি দেখে সারা দেশ অবাক হবে। ভাব তো হাওড়া ব্রিজটার নকশা যে ইঞ্জিনিয়ার করেছিলকী ব্রেন তার ! একটা পিলার নেই, অত বড় গঙ্গার উপর দিব্যি  দাঁড়িয়ে আছে ব্রিজটা। হাসতে হাসতে হাওড়া- কলকাতাকে হ্যান্ডশেক করছে সকাল বিকাল। কিংবা ভাব,সুন্দর পিচাই-এর কথা। খড়গপুর আইআইটি থেকে পাশ করা ছেলে। এখন গুগলের সিইও। এত বড় প্রতিষ্ঠানের সর্বেসর্বা। বুঝতে পারছিস, কী মেধা! তুই হবি ওই মাপের ইঞ্জিনিয়ার। বাবার মুখে কথাগুলো শুনতে শুনতে তিতলির মুখ প্রতিজ্ঞায় কঠোর হচ্ছে,বুঝতে পারত শেফালি।

 

তাছাড়া, তিতলি মা আমার দেখতে শুনতেও খুব একটা খারাপ না, ভাবে শেফালি। গায়ের রঙ একটু চাপা ঠিকই, কিন্তু নাক-মুখ-চোখ -এর গড়ন দেখে সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। পাড়া-প্রতিবেশী, শেফালির বন্ধুবান্ধবরা তো হামেশাই বলে , "তোর মেয়েটা যেন  সুচিত্রা সেন-এর ডিটো  "

 

পরিমল, বন্ধু-বান্ধব বা পাড়া-প্রতিবেশীদের কথায় শেফালি খুব একটা পাত্তা দেয়নি কোনওকালেই। ওর ইচ্ছে, মেয়েটা কোনওরকম গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করলেই, মোটামুটি খেতে পরাতে পারবে, এমন একটা ভাল ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দেবে।




এর
বেশি স্বপ্ন শেফালি কোনওদিনই দেখেনি। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় যাদের, তাদের অত বড় স্বপ্ন দেখা পাপ। পাপ? স্বপ্ন দেখা আবার পাপ কীসের! স্বপ্ন ছাড়া মানুষ বাঁচে না কি! যে ভিখিরি, সে- একটা উজ্জ্বল রুটির স্বপ্ন দেখে। ছাত্র বয়সে শেফালিও একদিন কত স্বপ্ন দেখত। পিএইচডি করবে। বাংলার প্রফেসর হবে। ছেলেবেলা থেকেই বাংলার প্রতি যেন কী এক অমোঘ আকর্ষণ অনুভব করত। একবার, ক্লাস সেভেন কি এইট, মনে পড়ে শেফালির, বাংলা স্যার একদিন একটা অনুচ্ছেদ লিখতে দিলেন। বিষয় : 'একটি ঝাঁটার আত্মকাহিনী ' ক্লাসে বসে এত মগ্ন হয়ে অনুচ্ছেদটা লিখেছিল শেফালি, পড়ে স্যার খুব খুশি হয়ে খাতায় লিখে দিয়েছিলেন ' চমৎকার ' নীচে স্যারের সংক্ষিপ্ত সই -- . . মানে রামরমণ ভট্টাচার্য। মনে পড়ে, সেইসাথে মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে স্যার বলেছিলেন, তোমার মধ্যে ভবিষ্যতে সাহিত্যিক হওয়ার সম্ভাবনা আছে।এখন থেকেই অল্প অল্প রবীন্দ্রনাথ,শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ পড়ো। এই ঘটনাটার কথা কতবার যে তিতলি আর পরিমলকে বলেছে শেফালি। সত্যি সত্যিই, পড়াশোনাতেও শেফালি  যথেষ্ট ভাল ছিল। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক দুটো পরীক্ষাতেই স্টার পেয়েছিল। স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে বাংলা অনার্স নিয়ে ভর্তি হল কলেজে। একই কলেজে পড়ত পরিমলও।  তবে ওর চেয়ে দু'বছরের সিনিয়র। বিষয়ও আলাদা।

পরিমালও মেধাবী ছেলে। প্রথম কুড়ির মধ্যে ৱ্যাঙ্ক  ছিল।স্কুলে তো কথাই নেই। প্রত্যেক ক্লাসে ফার্স্ট হত। পরিমলের ইচ্ছে ছিল আইপিএস অফিসার হবে। অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের গুরুদায়িত্ব সামলাবে। ওর বাবা ছিলেন হাই স্কুলের হেডমাস্টার।বাড়িতে পড়াশোনার পরিবেশ। সব চলছিল ঠিকঠাক। কিন্তু ওই যে কথায় বলে, বিধির বিধান খন্ডাবে কে!

 

কলেজে পরিমলের সঙ্গে ওর আলাপ জমল। আলাপ থেকে বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব থেকে প্রেম, ঘনিষ্ঠতা। কিন্তু যেদিন প্রথম ওদের প্রেমের কুড়ির অঙ্কুরোদগম ঘটল সেদিনটার স্মৃতি চিরচিহ্ন রেখে গেছে ওর মনে। মোছেনি এত ঝড়ঝাপটাতেও।

 কলেজের অফ পিরিয়ডে ওরা ঢুকল একটা কাফেতে। টেবিলের এপাশে পরিমল। ওপাশে শেফালি। মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।

 পরিমল প্রথম কথা বলল, " কলেজের নবীনবরণে আলাপ তো হল, কিন্তু ব্যাপারটা কি ওখানেই আটকে থাকবে? "

"কোন ব্যাপার?" শেফালী বুঝতে পারছে না এমন নয়, তবু প্রশ্নটা করল।

" বুঝলি না, আমাদের প্রেমের ব্যাপারটা? " পরিমলের স্ট্রেটকাট কথা। ঢাক গুড়গুড় নেই। একটু থেমে ফের বলল, " তুই রাজি? "

শেফালির রাঙা ঠোঁটে তখন রাঙা হাসির ঝিলিক।  ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল, " হ্যাঁ। "

" তাহলে প্রথমেই যে-কাজটি করতে হবে, সেটা হল--" আইপিএসসুলভ নির্দেশ।

" কাজটি কী শুনি? "

"কী আবার, তোর নামটা প্রথমেই আমি কচুকাটা করব। "

" মানে? "

" বুঝলি না তো? বোঝাচ্ছি। আগে বল, শেফালি  নামটার মাঝখানের ' ফা ' কেটে দিলে কী থাকে?

" শেলি। "

" ইয়েস, ভেরি গুড। " হাসতে হাসতে বলে পরিমল,

" আজ থেকে আমি তোকে ওই নামে ডাকব। "

"শেলি তো ছেলেদের নাম। ওড টু দ্য ওয়েস্ট উইন্ড -এর বিখ্যাত ইংরেজ কবির নাম।

" তাতে কী, কিছু নাম আছে, যার কোনও ছেলে-মেয়ে হয় না। রবীন্দ্রনাথের পোস্টমাস্টার পড়িস নি? ওতে রতন বলে একটা মেয়ের কথা আছে। রতন কি মেয়েদের নাম? আসলে, ওই নামটা আদরের নাম, বুঝলি মূর্খ? আজ থেকে তুই আমার আদরের শেলি। 'শেফালি ' কী বিশ্রী নাম দেখো,যেন আদ্দিকালের মা মাসি। "

"তাহলে শোন, " বাউন্সার দেওয়ার চেষ্টা করে শেফালি, " পরিমল নামটাও আদ্দিকালের, ওই নামে আমি তোকে দিনরাত ডাকতে পারব না। "

"কুছ পরোয়া নেই, কী নাম দিবি,বল?"

"তোর নামটা আমি কচুকাটা করব না, একটু খালি ছেটে দেব। আগে বল  পরিমলের 'মল'-টা বাদ দিলে কী থাকে? "

 " পরি। "

"আজ থেকে তোকে আমি পরি বলে ডাকব। ভাল নামটার চারপাশে বাবা-মা মল ছিটিয়ে রেখেছে।"

হো হো করে হেসে ওঠে পরিমল। শিউলির হাতটা মুঠোয় চেপে হাসতে হাসতে বলে, "দারুণ দিলি তো! "  তার পর মুঠোয় চাপা শিউলির হাতটা ঝাঁকিয়ে বলল, "এই শেলিকে নিয়ে চলল পরি। "

 

কত কত দিন আগের কথা সে সব! প্রেম পড়াশুনো হাত ধরাধরি করে চলছিল ভালই। হঠাৎ কোত্থেকে যে কী হয়ে গেল! পরিমলের সাথে মেলামেশার খবর জানাজানি হতেই বাবা রেগে ব্যোম। মা বলল,আর পড়িয়ে কাজ নেই, বিয়ে দিয়ে দাও। দেখতে নাদেখতে একটা সম্বন্ধও ঠিক করে ফেলল। ছেলে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। তিনতলা বাড়ি। নম্র-ভদ্র। বাবা-মায়ের খুব পছন্দ। বিএ ফাইনালের তখন দু' মাস বাকি। উপায়ান্তর না দেখে,একদিন বাড়ি ছেড়ে পালাল শেফালি। পরিমলকে বলল, " বিয়ে করো, আজই। এক্ষুনি। " আকাশ থেকে পড়ল পরিমল, " তা কী করে সম্ভব? " সদ্য এমএ-তে ভর্তি হয়েছি। দুটো মাত্র টিউশানি করি। 'শো টাকা পাই। "

"বেশ। তাহলে এই আমি মিনি বাসে উঠছি। তার পর সোজা হাওড়া ব্রিজ থেকে গঙ্গায় ঝাঁপ, " বলেই হনহন করে হাঁটা লাগায় শেফালি।

দৌড়ে এসে পথ আগলায় পরিমল, " দাঁড়াও, যাচ্ছ কোথায়? " পরিমলের সমস্ত অস্তিত্বে,নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে তখন শেফালির ঘ্রাণ। শেফালিও পরিমলের ঘামের গন্ধে খুঁজে পায় চন্দন সুবাস। অতএব কালীঘাটেই  মালা বদল হল। জীবন সংগ্রামে অনভিজ্ঞ দুই লায়লা মজনুর। নিরুপায় পরিমল কাজ নিল ' দিশা ফ্যান ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানি'-তে। পাঁচ হাজার টাকা মাইনে। পাঁচ হাজারটা বাড়তে বাড়তে যখন দশ হাজারে দাঁড়াল, তখন নিজেদের বাড়ি করার স্বপ্ন দেখল পরিমল। বাবা আগেই দেড় কাঠা জমি কিনে দিয়েছিল, তিতলির মুখে ভাতের সময়। নাতনির মুখ দেখে বেশি দিন রাগ পুষে রাখতে পারেন নি। আর ওরা দশ বছরের টার্মে  ব্যাঙ্ক থেকে পাঁচ লাখ টাকা লোন নিয়ে এই বাড়ি করল। বাড়ি বলতে আহামরি কিছু নয়। আট -দশ  আর দশ- বারো দুটো ঘর, উপরে অ্যাসবেস্টস একটা রান্নাঘর, ছোট একটা পায়খানা বাথরুম। সেসব বছর তিনেক আগের কথা। করোনার ঢেউ তখনও আছড়ে পড়েনি।

 

বড় ঘরে হঠাৎ কীসের একটা শব্দ। হাঁড়িকুড়ি উলটে পড়ল বোধহয়। পরিমল উঠে পড়ল? চোখ গেল শেফালির। না,একটা বিড়াল লাফ কেটে বেরোচ্ছে। পরিমল যেমন ঘুমাচ্ছিল,তেমনই ঘুমোচ্ছে। তবু রক্ষে। যা তান্ডব শুরু করেছিল সকালে। পরপর দুদিন ওষুধ পড়েনি। ডাক্তার বলেই দিয়েছিল, এক বেলাও যেন ওষুধ বাদ না যায়। তাহলে পাগলামি বাড়বে। ঠেকিয়ে রাখা মুশকিল হবে। তাই তো হল। ভাগ্যিস, পলাশ- পঙ্কজ ছিল। তাই ধরে আনতে পারল। না হলে কী যে হত! শিউরে ওঠে শেফালি।

 

মানুষটা তো এমন ছিল না। বছর দুই আগে, যখন প্রথম লকডাউন হল, কোম্পানি গেল বন্ধ হয়ে।সেই থেকে কোথায় যে হারিয়ে গেল পরিমলের মুখের হাসি! সব সময় গোমড়া মুখ। কী যেন ভাবে আকাশ-পাতাল। শেফালি ভরসা দিয়েছে, " অত ভেবো না তো, দিন ঠিক চলে যাবে। তোমার কাজ গেছে তো কী হয়েছে? দরকার হলে আমি লোকের বাড়ি কাজ করব। না পাই ঘরে বসে ঠোঙা বানাব।

 

" দিন তো ঠিক চলে যাবে শেলি, কিন্তু ব্যাঙ্কের  লোনটা শোধ করব কী করে? সাত হাজার পাঁচশো  টাকা ইএমআই। এক পয়সা ইনকাম নেই।কোত্থেকে দেব? এখন না হয় করোনার জন্য ব্যাঙ্ক কিছু বলছে না, একবছরের  মোরাটোরিয়াম দিয়েছে। এর পর যখন সব ঠিক হয়ে যাবে,ব্যাঙ্ক সুদে-আসলে কড়ায়-গণ্ডায় সব আদায় করে নেবে।

 

পরিমলের আশঙ্কাই সত্যি হল। করোনার তৃতীয় ঢেউ স্তিমিত হতেই, একদিন ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের ফোন, "পরিমলবাবু, আপনার ইএমআইগুলো এবার কন্টিনিউ করুন। "

 " দেখছি স্যার। "

"দেখছি বললে তো হবে না পরিমলবাবু, আপনি না দিতে পারলে,ব্যাঙ্ক আপনার বাড়িটা বিক্রি করে টাকা

তুলে নেবে। "

পরদিনই ছুটল দিশা ফ্যান ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানিতে কবে কারখানাটা খুলবে জানতে। " কোম্পানি আর খুলবে না " দুই -একজন বলল। পরিমল দেখল, কারখানায় বড় তালা ঝুলছে। গেটে কারখানা বন্ধ হওয়ার নোটিশ।

কারখানাটা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়ার চিন্তাটাই যেন মানুষটার মাথায় হিমালয়প্রমান পাষাণ হয়ে চেপে বসল। তার পর থেকেই সব ওলটপালট। অসংলগ্ন কথাবার্তা। এই হাসে, কাঁদে, ঘুমায়, লাফ দিয়ে উঠে পড়ে, কখনও নিজের কপাল চাপড়ায়, কখনও  দুমদাম লাথি, ঘুসি চালায় দেয়ালে, দরজায়। যে ছেলেমেয়ে ওর পাঁজরের টুকরো, রেহাই পায় না তারাও। আর মুখে সেই এক বুলি, " খোল শালা তালা খোল, কারখানায় তালা ঝোলানো! মগের মুল্লুক!"


                            তিন

 

 বসন্তের পড়ন্ত দুপুর। রোদের তেমন তেজ নেই, অলস গাভীর মতো ঝিমুচ্ছে যেন। পলাশদের বাড়ি যাওয়ার এই পথটুকুর দু'পাশে প্রচুর গাছপালা। সুপুরি, নারকেল, সজনে, আম, জাম, জামরুল গাছের ছড়াছড়ি। কোনও কোনও আমগাছে কী সুন্দর মুকুল ধরেছে। কোন গাছে বসে যেন 'কুহু কুহু 'রবে  বাতাসকে মাতিয়ে তুলছে দু-একটা কোকিল। তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করে তিতলি। দেখা যাচ্ছে না ঠিক। গাছ গাছালির ফোকর দিয়ে চোখ যায় আকাশের দিকে। নির্মল নীলাকাশ। একটু মেঘ নেই। আলো ছায়ার পাশ কাটিয়ে ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। সত্যি কী এক অদ্ভুত মাদকতা আছে যেন বসন্ত বাতাসে। রবীন্দ্রনাথ একেই বোধহয় 'বসন্তের মাতাল সমীরণ' বলেছেন, অনুভব করে তিতলি। এই গানটার সঙ্গেই স্কুলের  ফাঙ্কশনে একবার নাচ করেছিল, মনে পড়ল।

 

পলাশদের বাড়ির সদর দরজায় এসে থমকে দাঁড়ায় তিতলি। বাব্বা! কী বিশাল বাড়ি। রাজপ্রাসাদের মতো ঝকঝক করছে। গ্যারাজে ঝা চকচকে গাড়ি। গেটে হুঙ্কার ছাড়ছে আলসেসিয়ান। টুলে বসে খৈনি ডলছে হিন্দুস্তানি দারোয়ান। আগে কখনও এই বাড়ির ভিতরে ঢোকেনি তিতলি। কেমন যেন ভয় ভয় করে।কিন্তু আজ ঢুকতেই হবে। ক্যুইজ কম্পিটিশনে ফার্স্ট হতেই হবে। এক হাজার টাকা পুরস্কার। কম নাকি! বাবার পনেরো দিনের ওষুধ হয়ে যাবে। তাহলে বাবা আর ওরকম করবে না। আজ যেমন বিনা কারণে ঠাটিয়ে চড় মারল। পাঁচ আঙুলের দাগ বসে গেছে, মা বলছিল। আয়নায় দেখবে ইচ্ছেও করেনি। যাক, ব্যথা সেরে গেছে। বাবা কী আর বুঝে মেরেছে। নিজেরও তো আঙুলগুলো ফেটে গলগল রক্ত পড়ছিল। যত ভয়ই করুক আজ ঢুকতেই হবে। মা তো কত বার এসেছে মা' সঙ্গে পলাশদার মায়ের গলায় গলায় ভাব। মাকে দিয়ে মাঝেমধ্যে ফাইফরমাস খাটিয়ে নেয়। মা-টা খুব বোকা। যে যা পারে করিয়ে নেয়। কিচ্ছুটি বলে না। মায়ের মুখেই শুনেছে তিতলি, পলাশদার বাবা মস্ত বড় পুলিশ অফিসার। পলাশদা ডাক্তারি পড়ছে। পলাশদাটা অবশ্য অন্যরকম। হাসিখুশি। মিশুকে। বড়লোক বলে গুমর নেই। রাস্তায় দেখাটেখা হলে কথা বলে। ইয়ার্কি মারে। একদিন ওর চুলের বিনুনি নাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, "সুইট গার্ল, তোকে না একদিন..."

"একদিন কী? "

" কিস করব। "

সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে পালিয়ে এসেছিল তিতলি।

 

গেটে দাঁড়িয়ে এইসব সাত -পাঁচ ভাবছিল তিতলি।হঠাৎ দারোয়ানের চোখে চোখ পড়ে গেল, "কিয়া চাইয়ে?"

"পে-পা-!"

"পেপার! কিসকো? "

 

দারোয়ান -তিতলির অসংলগ্ন কথাবার্তা বাড়ির বারান্দা থেকে নজরে পড়ল পলাশের। হাঁক পাড়ল, "রামু, আসতে দে।"

"যাইয়ে, অন্দর যাইয়ে ম্যাম। "

 


" কী রে, তিতলি? "

"আজকের পেপারটা একটু দেবে, পলাশদা? "

"কেন দেব না। আয়, ভেতরে আয়। "

এক -পা দু -পা করে এগোয় তিতলি।

"আমার ঘরে একটু বোস, বাবা পড়ছে বোধহয়, চেয়ে দিচ্ছি। "

" তবে থাক। "

"থাকবে কেন? বাবা এখুনি ঘুমিয়ে পড়বে।" বলেই পলাশ বাবার ঘরের দিকে এগোয়।

 

তিতলি গিয়ে বসে পলাশের ঘরে। উলটো দিকের দেয়ালে একটা কঙ্কাল ঝোলানো। প্রায় আঁতকে উঠেছিল তিতলি। মুহূর্তে সামলে নেয়। দূর, তো মরা মানুষের কঙ্কাল। ভয়ের কী আছে! মনে সাহস আনে। সারা ঘরটায় কেমন একটা আঁশটে আঁশটে গন্ধ। কীসের গন্ধ বুঝতে পারে না তিতলি। গা ছমছম করে ওর। সব জানলা- দরজা বন্ধ। তবু ঘরটা কী ঠান্ডা! এসি চলছে বোধহয়। এখনও তো সেরকম গরম পড়েনি। অবশ্য বড়লোকদের ব্যাপার স্যাপার আলাদা। নজর এড়ায় না তিতলির, দু'দিকের ওয়াল আলমারি জুড়ে মোটা মোটা সব বই।

 

 "এই নে তিতলি। "পলাশ পেপারটা হাতে দেয়।

 "থ্যাঙ্ক ইউ,আসছি পলাশদা।" উঠে পড়ে তিতলি। দরজা দিয়ে বেরোতে যাবে,এমন সময় পিছন থেকে তিতলির হাতটা টেনে ধরে পলাশ, " যাবি কী রে! একটু বোস। গল্প করি।"

"না পলাশদা, আজ যাই। বাবার শরীরটা ভাল না। মা সকাল থেকে মন খারাপ করে শুয়ে আছে। রান্নাবান্না করেনি কিছু। ভাইটাকেও কিচ্ছু খাওয়ায়নি।" "ভাবছিস কেন? সব ঠিক হয়ে যাবে।" বলেই ড্রয়ার থেকে এক বান্ডিল পাঁচশো টাকার নোট তিতলির মুঠোয় ধরিয়ে দিয়ে বলে, "নে, সব মুশকিলাসান হয়ে যাবে।"

" না। " মনে পড়ল তিতলির, বাবা যখন সুস্থ ছিল, বলত, যে টাকায় তোমার পরিশ্রম নেই, সেই টাকা কোনওদিন ছোঁবে না। তাতে পাপ লেগে থাকে। কোনও পাপ করতে পারবে না। মুহূর্ত খানেক ভেবে নিয়ে বলল, " না, টাকা আমি নিতে পারব না। "

" না কী রে, সুইটি গার্ল! বলেছিলাম না একদিন তোকে ----"

তিতলির সেই পুরনো কথাটা মনে পড়ল। একটু ভেবে নিয়ে বলল, " তাহলে তুমি আমাকে বিয়ে করবে? "

"বিয়ে?"হো হো করে হেসে উঠল পলাশ। আজকালকার ছেলেমেয়েরা আবার বিয়ে করে নাকি! এখন হল লিভ টুগেদার থাকার যুগ। বিয়ে ফিয়ে সেকেলে ধারনা। আয়, আপাতত আমরা.." বলতে বলতে ঝট করে তিতলিকে বুকের মধ্যে জাপটে ধরে পলাশ।

জালের ভেতর ধরা পড়া জ্যান্ত মাছের মতো ছটফট করতে থাকে তিতলি। ওর মুখে, ঠোঁটে, বুকে  পাগলের মতো মুখ ঘষতে থাকে পলাশ। চিৎকার করে আর্তনাদ করে ওঠে তিতলি না আমায় ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও পলাশ ওকে চান্দলা করে যে বিছানায় নিয়ে যেতে উদ্যত হয় তখনই সর্বশক্তি একত্র করে তিতলি কামড়ে খুবলে নেয় পলাশের  পেশীবহুল হাতের একদলা মাংস। যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে তিতলিকে ছেড়ে দেয় পলাশ। সেই ফাঁকে মুঠোয় ধরা পাঁচশো টাকার বান্ডিল ছুড়ে মারে ওর মুখে। "আই হেট ইউ,আই হেট ইউ " পলাশের মুখে খানিকটা থুথু ছিটিয়ে, প্রাণপণ ছুটতে শুরু করে তিতলি।

 

 দৌড়তে দৌড়তে সেই নিরিবিলি আম জাম জামরুল গাছের ছায়ায় ঘেরা জায়গায় এসে দাঁড়ায়। হৃৎপিণ্ডটা যেন পাঁজর ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবে, এত লাফাচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে ফুসফুসের বায়ুও যেন শেষ। মাথাটা উঁচু করে জোরে জোরে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করে তিতলি। চোখ যায় দূর আকাশের দিকে।ওই সূর্য অস্ত যাচ্ছে। গাছ গাছালির ফাঁকে তখনও 'কুহু কুহু' ডেকে চলেছে বসন্তদূত। হাওয়া বইছে ঝিরিঝিরি। পশ্চিম আকাশ লালে লাল। ঝাঁকে ঝাঁকে ঘরে ফিরছে পাখি। দিন আর রাত্রির এই এক আশ্চর্য সন্ধিক্ষণ-- গোধূলি। একটা দিনের শেষ, রাতটুকু  পেরোলেই আর একটা নতুন দিনের শুরু। যা ঘটল, জীবনের চলার পথে, মুহূর্তের কালো মেঘ ছাড়া কিছু নয়। 'মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয় আড়ালে তার সূর্য হাসে ' কবেকার পড়া ভাব সম্প্রসারণটা মনে এল হঠাৎ। প্রতিজ্ঞায় কঠোর হলো চোয়াল। আজ এই প্রথম তিতলি অনুভব করল, ওর বাবা আর অসুস্থ নেই, ওই তো ঘোড়া বানিয়ে বাবাকে ছোটাচ্ছে তা তান, হাসি ফুটেছে মায়ের মুখে, ইঞ্জিনিয়ারিং- ভর্তি হয়েছে সে...

 

 মুঠো ভরে গোধূলির এই আশ্চর্য ধূলিটুকু কুড়িয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে পা বাড়াল তিতলি।

 

 *********************************************************************************************