মঙ্গলবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

গুচ্ছ কবিতা * তৈমুর খান



কবিতাগুচ্ছ * তৈমুর খান 

অবিকল্প পংক্তিমালা








পাশ ফিরে ঘুমোলাম

দূষিত হাওয়ারা এসে আমার ভেতরে ঢোকে

দীর্ঘ অভিমানে কান্না চেপে রাখি

জীবিকার প্রচ্ছদেও আর ফোটে না ফুল

কোথাও ডাকে না আর ঘর ছাড়া বাঁশি


দৈনিক দৈন্যের কাছে শুধু মিথ্যাচার

প্রেমহীনের প্রেমের কানাকানি

ব্যাকরণ না জেনেও বৈয়াকরণ

অসতেরা বলে যায় সতীর কাহিনি

বিমোচন হয় আলো ভ্রান্তির শিকারে


নষ্ট আঙুলগুলি অমার্জিত স্পর্শ দেয়

দুঃস্বপ্নের ক্ষত রোজ ঢেকে রাখি

আলোচাল ভাঙে নাকো ঢেঁকি

শুধুই করাতকল চলে

চেরা যৌবনের ফাঁকে জমে অন্ধকার 


     

বাদামওয়ালার গান

 কোথাও আলো নেই আমাদের

কোথাও আনন্দ নেই বলে

এই অন্ধকারে শুধু এক বাদামওয়ালার গান জাগে


ভ্রমের হাসিতে এমন উজ্জ্বল মরীচিকা

তৃষ্ণায় নিভে যাওয়া চাঁদ

আদিম যৌনক্ষুধার ঝড়ে হিল্লোলিত হয়


বিকেলের ম্রিয়মান সংকেতে

উদ্দাম নরনারীগুলি ক্ষয়িষ্ণু মাছির মতো ওড়ে

তাদের ডানার কম্পনে লেগে আছে জীর্ণ যৌনরেণু


ঘোর তমসার কাছে আমাদের সংস্কৃতি শয্যা পাতে

ইন্দ্রিয়পরাগে প্রাগৈতিহাসিক ফুল ফোটে

কোন্ উত্তরণ আজ সভ্যতার ক্রীতদাস লেখে?


  

সন্ন্যাস

প্রতিরাতে ওর সিঁথিতে সিঁদুর দিই

ঢেউ খেলানো চুলের অন্ধকারে

হেঁটে যাই নিহত স্বপ্নের দিকে

চাঁদ চেয়ে থাকে ওর জানালায়

এখনও নক্ষত্ররা জ্বলে,

হাওয়া বয় দীর্ঘ ক্লান্তির রাতে

নৈঃশব্দের ডাকে জেগে উঠি

জাগরণ বাঁশি হয়ে বাজে,

উদাসীন শিহরনের স্পর্শ দেয়

ওর নরম মুখের ঘ্রাণ চুম্বন পাঠায়

ভেজা ঠোঁটের মতো জলবায়ু

আমাকে আজন্ম সন্ন্যাস করে রাখে












মন্থন

নামতে 

          নামতে 

                কোথায় নেমে যাচ্ছি তবে?

 এত আলো চারিদিকে

            আমরা কি আলোর উৎসবে?


 কত কত করুণার কলসি

 টইটম্বুর সব অমৃতের রসে

 অমরত্বের পতাকাও উড়িয়ে দিয়েছে মহাকাশে


 এবার মন্থন বেশ ভালো

                                  পাতালে

                                               পাতালে

 নররাক্ষসেরাও দেবতার পদবী পাবে!


 আমাদের মনুষ্যদিন সভ্যতার আলোয়

                                            ঝিকিমিকি করে

যদিও পূজার অর্ঘ্য রক্তে লাল রঙের বদলে

                         যদিও গরল সব অমৃতকলসে

            যদিও অমরত্ব আঁকা ধ্বংসের পতাকায়


মন্থন চলতে থাকে

       আমরা শুধু সিঁড়ি খুঁজে খুঁজে

              পৌঁছাতে চাই মন্থনের কাছে 


                     

ছিদ্র

আমাদের ছিদ্রগুলি বাড়তে বাড়তে অনেক বড় হয়ে যায় 

আমাদের চরিত্রগুলি নষ্ট হবে বলে বেরিয়ে পড়ে

জ্যোৎস্নার কলঙ্ক ঢুকে ঘরময় দীর্ঘ ছায়া ফেলে


আমরা কলঙ্কের সঙ্গে খেলা পাতি

নির্লজ্জ আমাদের বন্ধুও আসে

তারপর হাসে

অনেক হাসির রাত কেটে যায় নির্ঘুমে


যখন যেমন ইচ্ছে করে

ছোটখাটো আকাঙ্ক্ষারাও দেহ বিক্রি করতে বেরিয়ে যায়

আমাদের আকাঙ্ক্ষারা ক্রমশই বেশ্যা হতে থাকে 


আমাদের পাঠশালা নেই

অন্ধকারে ঢাকা ছিদ্রগুলি অন্ধকার খায়

কখনও শেয়াল আসে, কখনও গুঞ্জন করে পাখি

আমাদের ভোর নেই

কখনও কখনও তবু ছিদ্র দিয়ে আরও ছিদ্র অন্বেষণ করি...

    

           

বৃষ্টির নাম অপর্ণা

আজ বৃষ্টি এল, বৃষ্টির নাম অপর্ণা

সিন্দুক খুলে নতুন হার বের করলাম

আকাশি রঙের জামদানিটিও

আজ ভিজতে বেরোব আমি


নিম অন্ধকারে বাঁশি বাজছে

সুরের ঝরনায় বেশ কাতুকুতু লাগে

হাওয়ায় ভেসে যায় বিসমিল্লা খাঁ 

নরম ব্যালকনিতে বিদগ্ধ পাখি


বৃষ্টির অনুভূতি মাঝে মাঝে হেসে ওঠে

তনুর হিল্লোলে ছোঁয় আনন্দের ভাষা

মৃত শৈশব কল্পতরু হয়ে ফিরে আসে

জীবন আরও জীবন পেতে চায়


নন্দিত সময়টুকু অলৌকিক সান্নিধ্যের কাছে

যেতে চায় বলে আকাঙ্ক্ষারা নৌকা বানায়

নৌকায় বৃষ্টি আর বৃষ্টিতে নৌকা দোল খায় 

আমরা পিছল হতে থাকি, হৃদয় গলে গলে ঝরে



************************************************************************************************





  তৈমুর খান

বাংলা কবিতায় একটি পরিচিত নামছোট বড় বিভিন্ন কাগজে নিয়মিত লিখে থাকেনতাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ ----কোথায় পা রাখি (১৯৯৪), বৃষ্টিতরু (১৯৯৯), খা শূন্য আমাকে খা (২০০৩), আয়নার ভেতর তু যন্ত্রণা (২০০৪), বিষাদের লেখা কবিতা (২০০৪), একটা সাপ আর কুয়াশার সংলাপ (২০০৭), জ্বরের তাঁবুর নীচে বসন্তের ডাকঘর (২০০৮), প্রত্নচরিত (২০১১), নির্বাচিত কবিতা (২০১৬), জ্যোৎস্নায় সারারাত খেলে হিরণ্য মাছেরা (২০১৭) 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন