কবিতাগুচ্ছ * শিবালোক দাস
বুড়োটার চুলে ভীরুতা লেগে আছে
দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ সে,
তবু এ স্নানের যে খুব প্রয়োজন।
ক্ষয়িষ্ণু ঝুরঝুরে মাটির পেছনে
লুকিয়ে থাকে শব্দ, তারা তো চায়
না এমন আকস্মিক মুলোৎপাটন।
চোখ লাল, তবু নেশাগ্রস্ত নয়,
হাত থেকে পড়ে ভেঙে যাওয়া
কোনো সুদৃশ্য ফুলদানি নয়,
কোনো বেনামী ভ্রমণের দূরদৃষ্টি নয়,
তুমি লক্ষ্য করে একবার দেখেছ কি
বুড়োটার চুলে ভীরুতা লেগে আছে ?
কোথাও খুঁজে পাই না সুতো, ঘর,
কিন্তু কুরুশ কাঁটা পড়ে আছে পাশে,
বুড়োটা এখনও প্রতি রাতে আকাশে
আঙুল চালিয়ে দেখে নেয় কালপুরুষ।
সেও তো তাকে তিরবিদ্ধ করতে পারত।
যুগ পেরোনো লাশে বুকের শ্যাওলা চেয়ে নিত।
মস্তিষ্কে সুচ ঢুকে যায়, তবু ব্রেন ডেথ নয়,
কাচের নল দিয়ে যাওয়া পোলারয়েড রশ্মি নয়,
চায়ের মধ্যে জমাট বাঁধা কোনো উপসর্গ নয়,
তুমি একবার চেয়ে দেখো, হোক না কঠিন,
বুড়োটার কেউ নেই, শুধু ছায়া রয়েছে কাছে,
চুলে জড়িয়ে থাকা প্রাচীন ভীরুতা আছে,
সে তো মাটির বুকে কোনোদিন আঘাত দেয়নি।
দূরে রাতপেঁচা ডেকে চলে যায় অনবরত.....
কুহক
তোমাকে সত্যিটা বলা হয়নি এখনও,
ঘুড়ির মাঞ্জায় কেটে যায় রোদ,
বহু প্রজন্মের দেনা পাওনার শোধ,
তোমাকে বলা হয়নি সত্যিটা এখনও।
জমাট বাঁধা কুহক ভেদ করে দাও,
দূরে বসে থাকা বাচ্চাটার আদুল
গায়ে রাধাকৃষ্ণের নাম বুনে দাও,
সে তো জন্মগত উলঙ্গ নয়, বলো !
ইট গাঁথতে গাঁথতে কখন বিকেল নামে,
সত্যিটা পুরো বলা হয়ে ওঠেনি তখনও,
কিছু ছায়া ঘিরে ধরে তাকে, এগাছ থেকে
ওগাছ লাফিয়ে যায়, আমি মাথা বাঁচাই।
বিষকন্যার শাপমোচন হয়নি, যেও না,
তার স্পর্শে তুমি হবে অপরাধী ,
যেও না, যেও না, নীল রঙ, শ্বাসরোধ,
মৃত্যুর পর বেঁচে থাকা অভূতপূর্ব সুন্দর।
মর্মভেদী আঙুল, তুমি তোমার লক্ষ্য জানো না,
তাই পরমাণুর অন্দরে সংঘর্ষ বাধে,
মিশে যায় ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন,
তারা কি পৃথিবীর শেষ দেখতে জানে না ?
তোমাকে সত্যিটা আজও বলতে পারলাম না।
কাঠ
কতগুলো ময়ুরকন্ঠী দুঃখ ছড়ানো বাগানে,
ফুটেছিল ফুল, তুলে রেখেছি বইয়ের পৃষ্ঠায়,
ভাঁজে ভাঁজে লতাপাতা, ফুরিয়ে আসে খাতা।
ও পারের মাঝি, তুমি ফেলে দাও দুটো কাঠ,
আমি নদী সাঁতরে পেরিয়ে যাবো এবেলায়।
কোথায় ফেলে এসেছ দূরের দৃষ্টি ? ঢেউ ?
সংকীর্ণ আলোয় জড়িয়ে থাকে বন, আলো
জ্বলে না সেখানে, অবলা নারীর চোখে ডুবে
আসে সূর্য, সে তো পেরোত চৌকাঠ, পেরোত
তিন প্রহরের ভুবন, ছলছলাৎ জল।
দুটো কাঠ তার জন্যেও তুলে রেখো, শুকিয়ে
নেবে ভেজা শরীর, ফুটিয়ে নেবে ভাত।
ফুরোতে নেই, কোথাও ফুরোতে নেই,
স্রোতের নীচে বেঁধে থাকে উষ্ণতা।
হাঁটুতে জোর নেই, পেশী দূর্বল,
হাড় গুঁড়ো করে খেয়েছে বর্বর কীট।
দূরে সরে যায় সব হাত, তবু কাঠ খুঁজি,
আগুন জ্বালিয়ে রাখতে হবে তো স্নেহ !
তোমাকে
হীরকে চুম্বন দিয়ে বিষিয়ে দিই শ্বাসবায়ু,
গেঁথে দাও পেরেক, স্তিমিত অঙ্গুলিস্পর্শ,
শূন্য, কাটা চিহ্ন বা পেরোনো সিঁড়ির ধাপে
কোনো অন্তর দেখিনি, জ্বলেনি শরীর,
দেখেছি স্ট্রিট লাইটে সেদিন ঝরেছিল পলাশ।
হাঁটতে গিয়ে পায়ে বিঁধেছে কাচ, হয়তো সপাটে
কষিয়েছিলাম চড় নিজেকে, তবু ব্যথা হয়নি,
দাঁড়িয়েছিল সমস্ত লোকাল ট্রেন, ভিড় ছিল না।
একি ! তোমার চোখে জল কেন ? উত্তরীয় ছড়ানো,
কৃষ্ণের মতো আমি পা ঢেকেছিলাম ঝরা পাতায়।
তোমার মতোই সেদিন শীতল ছিল চাঁদ, জ্যোৎস্না,
তবুও ছুরি বিদ্ধ হয়েছি, বিশ্বের শেষ প্রান্তে নির্বাসিত,
দিন এখনো খুঁজে মরে ফেরারীকে, বোনা ছিল সুতো,
পুড়ে পবিত্র স্নান, জতুগৃহ দহন, হলুদ নক্ষত্রের আশ্রয়।
দরজা খুলে দাও, তোমার জন্য অপেক্ষমাণ এক যুগ।
একটি দিন বরাদ্দ ছিল মাতৃস্তন্যে
একটি দিন বরাদ্দ ছিল মাতৃস্তন্যে,
ওষ্ঠে রেখো না অঙ্গার। পাহাড়,
তুমি মাথা উঁচু করে ভাঙো শৈত্য,
মুখ ডুবে গেছে হাতের তেলোয়,
রুমালের বুননের শেষ ঘরে আঙুল
রেখে শুষে নাও শিশিরের শেষ বিন্দু।
পথ অবরুদ্ধ, নর্দমার জল ঠেলে ঠেলে
এগোয় মাছরাঙা, অট্টালিকা চেপে ধরে
ক্যালেন্ডার, শিরা বেরোনো হাত, ঘরময়
ঘোরে শুকনো নদীর মত দৃষ্টি, মরা ঘুম,
তুমি তার ক্ষত দেখতে চাও ? বলো ?
গড়িয়ে পড়ে রক্ত, মিশে থাকে মাটি।
একটি দিন বরাদ্দ ছিল মাতৃস্তন্যে,
হীরের কুচির মতো ব্যথা থেকে আলোর
বিচ্ছুরন, মাকড়সার জালের মতো, চেপে
দেয় রাত্রি, চেপে দেয় হাতের মুঠিতে বাতাস।
ছেলে গেছে বনে, তার ফিরতে দেরি হবে।
চাবুক
বিকেলের পর আমি ছায়ার
সাথে ঘর বদলে ফেলি,
চলে দাবা খেলা, এর ওর
কাছে ধার করি ঘুঁটি।
ছেঁড়া পাঞ্জাবীর মলিন পকেটে
কিছু আধুনিক রঙ রেখেছি,
রেখেছি বুকের মধ্যে সর্ষে,
টলটলে নদীতে বকের নিপাট চঞ্চু
তুলে নিচ্ছে জলজ রোমন্থন।
আমি দূর থেকে নিরীক্ষণ করি,
ওতেই চাবুকের দাগ ম্লান হয়।
ড্রিলের পাথর ভাঙা শব্দে ব্যবহৃত
দুপুর এর চেয়ে অনেক দূরে।
কখনও হাতের মধ্যে নিয়েছ লোহার জং ?
ওষ্ঠে লাগে কড়া, রক্তেও রয়েছে ,
তবুও পিষে যায় আঙুলের মাঝে।
বসে কংক্রিট, তারপর আদিম জীবাশ্ম।
পাখিদের সংসদ, হলুদ ট্যাক্সি, চাকার
তলায় ভিখারির হাত, তাল কেটে যাওয়া
মেট্রোর যাপন, সব ফিরিয়ে দাও সূর্য,
শুষে নাও চাবুকের দাগ, দিনের শেষে
তাদেরও তো বাড়ি দেখা যায়, দূরে !
***************************************************************************************************
তরুণ কবি শিবালোক দাস-এর শৈশব কেটেছে মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি শহরে। বর্তমানে কলকাতার আই.পি.জি.এম.ই.আর. এবং এস.এস.কে.এম. হাসপাতালে এম.বি.বি.এস এর তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। ক্লাস এইট থেকে কবিতা চর্চা শুরু। সাহিত্যকে ভালোবাসেন এবং আলাদা আঙ্গিকে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। এখনও পর্যন্ত কোনও প্রকাশিত গ্রন্থ নেই।




কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন