মঙ্গলবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

গল্প * বিরথ চন্দ্র মণ্ডল



আজকের  দ্রৌপদী 

বিরথ চন্দ্র মণ্ডল 


লম্বা অফিস ঘর  ।ঘরের শেষ প্রান্তে পাশাপাশি দুটি টেবিল । দুজনই মধ্যবয়স্কা নারী। দু' জনার নামেও যেন অদ্ভুত মিল । নামের সাথে কাজের ও বিস্তর মিল । একই ঘরানার দুজন । চাকরিও আবার একই অফিসে। পার্টি -আড্ডা- সব - জায়গায় দুজন দুজনার দোসর । পিঙ্কি  আর পিয়ালী। 

সেদিন অফিসের কাজের ফাঁকে হাসতে হাসতে পিঙ্কি  বললো --কাল গ্রুপ আছে  ! যাবি  ? 

যদি যাস ; একটা সি এল নিয়ে নে । আর তথাগতর সাথে কালকের প্রোগ্রামটা ক্যানসেল কর। সারাদিনের এনজয়মেন্ট। 

পিয়ালী অবাক হয় । বলে, - -গ্রুপেও এসব হয় নাকি  ! 

পিংকি টিটকারি মারে। বলে - তুই কোন আদ্যিকালের মেয়ে রে ? চাকরি করছিস । ঘর সামলাচ্ছিস । বর  সামলাচ্ছিস । একের পর এক পুরুষ ম্যানেজ করে ফূর্তি  করছিস ! ডেস্পারেট হয়ে এত কিছু করছিস ! অথচ ; গ্রুপ কি জিনিস জানলি না ? ধুর ! পাগলী একটা । 

পিয়ালির চোখ কপালে উঠে যায়। বলে - ওরেব্বাস ! এখানেও তুই কতদিন তোর? 

- জেনে লাভ নেই রে! কাল আমার সাথে বেরোবি ! টের পাবি। মজা কাকে বলে! 

কথাটা শুনে পিয়ালী আর সুখের হাসি চেপে রাখতে পারে না। দমফাটা হাসি বেরিয়ে আসতে চায় ।সরকারি অফিস বলে কথা। সজোরে চেপে যায় হাসি। আর , খুশির আনন্দে চোখ দুটো পিটপিট করতে থাকে। 

বরুন আর রিতেশ ওদের ব্যাপার নিয়ে বেশ আলোচনা করে । 

পিঙ্কি ডিভোর্সি। একমাত্র ছেলে ।  হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে । 

বরটা সারাদিন মদ খেয়ে এখানে ওখানে পড়ে থাকে।

পিঙ্কি -  পিয়ালী' র বন্ধু হবার সূত্রে, পিয়ালীর ব্যাপারে বরুণ বলেছে -  সে নাকি এক কথায় বাঁজা,।

বউয়ের বহুগামীতায় বর কোনরকম রা' করে না। হয়তো এক রকম ভয় চুপ থাকে। চিৎকারে মান সম্মান চলে যাবার ভয় ।  কিংবা এও হতে পারে চাকরি করা বউ , যা করছে করুক। পয়সাটা  তো ঘরে আসছে। 

পিয়ালীর বর সব জেনে শুনে চুপ থাকে। বরুণ বলে  - এছাড়া আরো অন্যরকম কারণ থাকতে পারে । তাই চুপ থাকে । 


একই অফিসে কাজ করে রিতেশ। বরুণও।

ও' কথায় কথায় এসব জেনে ছিল বরুণ-এর কাছ থেকে। তাই  রিতেশের  এ ব্যাপারে অতিরিক্ত কিউরিসিটি - অফিসের কাজের ফাঁকে ফাঁকে ওদের কথাবার্তা, হাব  ভাব নজর রাখে ওদের অজান্তে । আর ভাবতে থাকে-  দ্রৌপদীর কথা । 

মহাভারতের দ্রৌপদী কত রক্ষণশীল ছিল !

কত কিছু শিখবার আছে দ্রৌপদীর কাছে। 

আজকের নারীদের মতো সেও কম স্বাধীন ছিল না। 

বীর যোদ্ধা ছিল তার স্বামীরা। অথচ ; কৌরবের অনেক অন্যায় অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে তাকে । 

পান্ডব বংশের সম্ভ্রম রক্ষা করার জন্য বদ্ধপরিকর ছিল।

সেই জায়গায় আজকের নারীর কথা ভাবে রিতেশ ।  ঘর  - বাইর চারপাশ তাকায় সে । 

কি সব ঘটে যাচ্ছে দিনে দিনে। 

রিতেশ কখনো রক্ষণশীল মানসিকতার নয়, । 

জগত সংসারে যা শুভ , যা সুস্থ মানসিকতার , যার বিকাশ আছে , অথচ মনটা যে কাজে আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে । সে চায় - এমনই পথ চলা । 

সে তার মাকে স্মরণ করে। তেমন শিক্ষা ছিল না তার মায়ের । একান্নবর্তী পরিবারের এক কাঁড়ি মানুষের বসবাস। 

তাতে সুখ যেন থই  থই করতো। 

ওই তো সেদিন;  গ্রামে গিয়েছিল  রিতেশ। 

সেখানেও পরকীয়ার বিচরণ। 

অতুল দাদু কথায় কথায় বলেছিল  -পরকীয়ায়  যে কি সুখ ,বুঝি না

এখানে সংসার ভাবনা বিবর্জিত। 

এটি ভাইরাসের মতো। চতুর্দিকে ছড়িয়ে যায় 

এই জীবনু। 

রিতেশ বলেছিল -  এ এক অসুখ দাদু । 

অতুল বলেছিল - তোদের শহরের  মানুষ কে কি করছে, কেউ খোঁজ রাখে না। অথচ শহরের কিছু কিছু নারী-পুরুষ অলীক সুখ নামক বিশেষ ফ্যাবিয়ায়  আক্রান্ত । ওরা যৌনতা নামক শব্দে  বেশি প্রভাবিত। যাকে আমরা পরকীয়া নামে চিনি । ওখানে কোন স্বাভাবিকতা থাকে না। সারাক্ষণ সুখ সুখ খেলা থাকে মাত্র। যাকে বলে চুপিসারে ফষ্টিনষ্টি ।

গ্রামে-গঞ্জে শহরের বেড়াজাল ছিল একসময়। গুরুজনদের সেয়ানা দৃষ্টি ছিল । কেউ তাকে উপেক্ষা  করতে পারেনি ।  সে ব্যাড়া ডিঙানোর  সাহস কারোর ছিল না।  বিশ - পঁচিশটা গ্রাম ঘাঁটলে হয়তো শোনা যেত এক আধটা। আর এখন  ? 

সে আর বোলো না দাদু! এই দেখো - নটেনের বড় মেয়েটা । বড় ছোট কাউকে জ্ঞান করছে না।

 সাংসারিক অনুশাসন উঠে গেলে যা হয় তাই হচ্ছে । রিতেশ সহমত জানায়। বলে - প্রজন্মকে আর ধরে রাখা গেল না। শিক্ষার ক্ষেত্রেও তাই । মিনিমাম শাসন উঠে গেছে।

আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের সুকেশকে দেখি - সবসময় মনমরা। 

বেচারা চাকরি করে বটে । কিন্তু সুখ নেই। শান্তি ও নেই।এক বেখাপ্পা বউ তার।সকাল - সন্ধ্যায় চেঁচামেচি আর চেঁচামেচি। এই সুযোগে ছেলেমেয়েরা ও পড়াশোনা করে না। সারাদিন ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়ায় ।তার বউটার ও ওই দোষ। 

অতুল বলে - সে আর বলতে! উচ্ছৃংখলতা সমাজের এক অভিশাপ । এর রাশ  টানা জরুরী। তা-না-হলে, দেশ- কাল - সমাজ ধ্বংসের মুখে পড়বে । 

রিতেশ গ্রামে যায়। সামান্য চাষ জমি আছে ওর । 

রাস্তায় রিতেশকে পেয়ে  পথ আটকায় মুকেশ ।মুকেশও কোথায় যাচ্ছিল । বলল-  রিতেশ দা  ,দাঁড়িয়ে পড়ো। একটু কথা আছে।

 রিতেশ বলল ,- বলো, । জবাবে মুকেশ বলল - সে ওই রিনাকে নিয়ে। 

এত বাড়াবাড়ি করছে ও। 


এই নিয়ে একটু শুরাহার আশায় জনা কয়েককে নিয়ে বসেছিলাম। কিন্তু কিছুই হলো না। উল্টে অনেক ক্ষতি হয়ে গেল। মান সম্মান তো গেলই । আরো অনেক কিছু। 

রিতেশ বলল-  সন্ধের সময় এসো, সব শুনবো।


 সন্ধ্যেবেলা মুকেশ এলো। রিতেশের বাড়িতে। 

বলল-  যারা এসেছিল । সবাই আমার খুব পরিচিত। তবুও কেন জানিনা , মিটিংটা পুরো ভেস্তে গেল । এখন কি করব বুঝতে পারছি না! সবাই যেন একতরফা আলোচনা করলো । কে ভুল, কে ঠিক, এই প্রসঙ্গে কেউই এলোনা। খুব অপমানিত হলাম। 

রিতেশ বলল -- স্বামী -স্ত্রী'র উভয়ের ক্ষেত্রে , যাই ঘটুক, এর মধ্যে তৃতীয় জনকে আনতে নেই । এতে লাভ তো কিছুই হয় না। উল্টিয়ে অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। স্বামী-স্ত্রী দুজনের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং এ যতটুকু চলে, ততটাই শ্রেয় । তা নাহলে করার কিছু নেই।বলেই  মুকেশ এর দিকে তাকায়  রিতেশ।

মুকেশ হুড়মুড়িয়ে উত্তর দেয় --হ্যাঁ । তাই তো দেখছি।


স্বামী - স্ত্রী দু ' জনের মধ্যে আন্ডারস্টেন্ডিং এ যত টুকু চলে, ওটাই যথেষ্ট। তা না হলে করার কিছু নেই।মুকেশের দিকে তাকায় রিতেশ। 

চিন্তায় যেন জর্জরিত। যবুথবু  মানুষটা । গাল চোখ চেহারা যেন কিছুই আস্ত নেই।মনের সাথে শরীর ও যেন ভেঙে খানখান। বলল  - তা কি আলোচনা হল শুনি ?

উত্তরের মুকেশ বলল, সাংসারিক ত্রুটি বিচ্যুতি সে না হয় মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু চরিত্রের এত বড় মাপের দোষ কি করে মেনে নেই বলো? নেশাগ্রস্ত মহিলা মনে হয় ওকে। 

অজানা অচেনা অন্য পুরুষকে  কী করে এত তাড়াতাড়ি পটিয়ে ফেলতে পারে! ভেবে পাই না! খোঁজ নিয়ে দেখেছি ,তারা এ তল্লাদের নয়। 

কেসটা একজন ,দুজন নয়, পাল্টে পাল্টে পুরুষের আমদানি। 

প্রখর চিন্তা - গ্রস্ত মানুষের মত কপাল কুঁচকে গেছে মুকেশের। মুকেশ বলতে থাকে - আমার কথা তো বিন্দুমাত্র শুনেই না। ওর বাবার বাড়ির কাউকেও পরুয়া করে না। যদি সালিশি সভায় ওর মতি ফেরে , সেই উদ্দেশ্যে লোক জন ডাকা। কিন্তু তাতেও হল কই ?

কি করব দাদা ? একটু যুক্তি পরামর্শ দাও। 

রিতেশ বলে-  এ এক কঠিন অসুখ । এ শুধু তোমার আমার নয় । এ অসুখ সমাজের । চতুর্দিকে চারিয়ে যাচ্ছে  এ আসুখ। এতে  আপনজন বোঝালেও হয় না। শালিশি সভাতেও হয় না ।  নিজস্ব বিবেক বোধ যদি জাগ্রত না হয় - 'ও ' কোন কিছুতেই কিছু হবে না । যদি ফেরে একা একা, এমনিতেই ফিরবে । 

একটা কথা বলব মুখোশ;  তোমার চাই অসীম ধৈর্য। অসীম মনোবল । আর অপেক্ষা । এ ছাড়া আর  কোন সুরাহা নেই এর।

একটা দিক খোলা আছে -  রিনা যা যা করে বেড়াচ্ছে ,তার অনেক প্রমাণ তুমি রেখেছো ।  তুমি বলেও ছিলে।এইসব প্রমাণ নিয়ে কোর্টে  দাঁড়াতে পারো । কিন্তু তা ও প্রপার সলিউশন নয় । কোনটা ঠিক ,ভেবে দেখতে পারো । চোখ কান খোলা রাখো। দেখবে , তোমার মত আরো অসংখ্য মানুষ কাঁদছে। দিশেহারা তাদের সন্তানের স্বপ্ন। ভবিষ্যৎ। 

আবার কোন কোন স্বামী-  স্ত্রীর আলাপ আলোচনা, ভালো-মন্দ  মিলিয়ে , সুখ যেন দু - কূল ছাপিয়ে ভেসে যাচ্ছে । 

ওই পাশের বাড়ির দিকে তাকাও । অংশু - শ্রাবণী । অর্ণব -  মিতালী । আরো অনেক ফ্যামিলি। ওরা সত্যি ই সুখী । ওরাও তো আজকের দ্রৌপদী। 

আর রিনা সহ আরো যারা যারা, সাময়িক সুখকে বড় বেশি করে দেখছে ,ওরাও তো এই আজকের দ্রৌপদী। 

অথচ ; মহাভারতের দ্রৌপদীর সমগোত্রীয় কে ?? ভাবলে....উত্তর ঠিক পেয়ে যাবে। 


   

****************************************************************************************************



বিরথ চন্দ্র মণ্ডল 

দীর্ঘদিন সাহিত্যচর্চা করছেন ।
 আশাবরী সাহিত্য পত্রিকা (২৬ বছর)- সম্পাদক। লিখছেন কাঁথি ,পূর্ব মেদিনীপুর থেকে। মূলত গল্প এবং কবিতা লেখার চেষ্টা করেন ।                

              

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন