মঙ্গলবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

উপন্যাস * দীপংকর রায়

 



[ 'স্বরবর্ণে'র চতুর্থ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে কবি দীপংকর রায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে '। এই উপন্যাস লেখকের ষোল-সতের বছর বয়সের কালপর্ব থেকে শুরু। যদিও লেখকের জন্ম এপার বাংলায়, কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে থেকেছে ওপার বাংলায়। কাজেই যাতায়াত থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ ছেড়ে চলে আসা আর তারই নাছোড় এক টানাটানির মধ্যে যে জীবনের ক্রমাগত আসা আর যাওয়া ,এই উপন্যাস মূলত তারই এক নির্মম নিষ্ঠুর ভাঙা-গড়ার আশ্চর্য কথোপকথন। ধারাবাহিকভাবে যা আমরা পড়ছি, কবি দীপংকর রায়ের মায়াময় কলমে।]


কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে 

পর্ব * ৮   

দীপংকর রায়


সমস্ত বাড়িটা গোরুর গোবর-চোনার গন্ধে কেমন যেন একটা ঝাঁঝালো ভাব ।

         ডোবাটার পাশে গোবরগুলি ডাঁই হয়ে উঠেছে ।জমে জমে বেশ একটা বড়সড় জায়গা দখল করছে, যত দিন যাচ্ছে ততোই। সকালবেলায় সেই ডাঁই গোবর থেকে শালিখগুলি কি যেন খুঁটে খুঁটে খায়।

         এ পাশে নতুন বাথরুম হয়েছে ছোটো একটি। তার সামনের দিকটায় খানিকটা জায়গা বাঁধিয়ে একটা চাতাল মতো তৈরি করে নেওয়া হয়েছে কলতলায় । সেখানের টিউকলের জলেই সব কাজকর্ম । তখনও পর্যন্ত কর্পোরেশনের সাপ্লাইয়ের জল এ বাড়িতে নেওয়া হয়নি । সামনের বাড়ির মাসিমারা সবে নিয়েছে। তাছাড়া রাস্তায়ও একটা কল বসিয়ে দিয়ে গেছে সাপ্লাই থেকে । যাদের বাড়িতে এখনও সংযোগ নেওয়া হয়নি তারাই যায় সেখানে । বড়ো একটা পাইপ কেনা হয়েছে , সেটা দিয়েই সেই পথের মাথার থেকে অনেক সময় টেনে নিয়ে এসে, সেই পাইপ ঢুকিয়ে দেওয়া হয় বাথরূমের চৌবাচ্চায়। খানিকটা নিই গোরুর খাবার দেবার কাঠের টবগুলিতে । পর পর টবগুলি বসিয়ে দিয়ে ভরে নেওয়া হয় সেই জল, গোরুগুলিকে স্নান করানোর জন্যে। মাঝে মাঝে সামনের বাড়ির মাসিমাদের থেকেও তাদের উদ্বৃত্ত জল সেই পাইপটি লাগিয়ে টেনে নেওয়া হয়।

         ইদানিং এই কাজে বেশ খানিকটা সময় ব্যয় হয়ে যায় । টিউবওয়েল এ অঞ্চলে খুব বেশি দিন টেকে না । এই কিছুদিনের মধ্যে মাঝেমাঝেই কলের মিস্ত্রি সাহাদার ডাক পড়তে দেখেছি কয়েকবার । তার সঙ্গে বেশ একটা ঘরোয়া আত্মীয়সুলভ সম্পর্ক ছিল এ বাড়ির । টাকাপয়সার খুব একটা বাধ্যবাধকতা ছিল না সেখানে । মা কত হয়েছে জিজ্ঞাসা করলে, সে যেন অত্যন্ত সঙ্কোচের সঙ্গে অনেক জোরজার করার পরে একটা কিছু বলেই যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচতো পানের উপর জর্দা ঢালতে ঢালতে। বলতো এক এক সময় , ও আর কতো ; দেন না , আপনার সঙ্গে কি ওসব নিয়ে বাধবে কিছু দিদি !

         তখন মা হয়তো তাকে বলতো , তা না হয় না বাধলো , কিন্তু এটা তো আপনার জীবিকা সাহাদা------ কত তা বলবেন তো ! কত , দুশো মতো হয়েছে তো ,না কি ?

         সে তখন বলতো , না না দেড়শো দিলেই হবে----- আপনার থেকে এর বেশি আর কি নিই ! 

           সাহা মামার বাড়িতে একদিন মায়ের সঙ্গে গেছিলাম । শান্তিনগরে জোতির্ময় ডাক্তারের বাড়ির গোলির মাথায় বড় একটি কাঁঠাল গাছের ছায়ায় টিনের চালের ছাউনি দেওয়া বাড়ি তার । ঢুকতেই মনটা কিরকম শীতল হয়ে গেল ! মনে পড়ে গেল ওদেশের সেই আমাদের পাড়ার গাছগাছালি ঘেরা টিনের চালের ছাউনি দেওয়া বাড়িগুলির কথা------ মুহূর্তের মধ্যে আমি যেন তাদের সুবাস পেলাম। 

          এরকম কত সব সম্পর্কের বাঁধনই না এখনো পর্যন্ত এ অঞ্চলে রয়েছে!

         সে সব তো সেই গঙ্গাপুরীর বাড়ি থেকে এই বাড়ি পর্যন্ত আজও দেখতে পাই !

         এরা সকলে একভাবে না একভাবে নানা সূত্রে কিভাবে কিভাবে যেন সকল সময়ই একটা পরিজনসুলভ আচরণের মধ্যে নিজেদের এই সব পরিচয় সূত্রগুলিকে নানা ভাবে ভাই-বোন-মামা-মাসি-পিসি-কাকিমা-দাদাভাই-দিদিভাই এই সব সম্পর্কের মধ্যে এমনভাবে ডাকাডাকি করে হই হই করে চালিয়ে নিত যাতে কখনো মনে হত না সত্যি অর্থে এরা কেউ কারো রক্তের সম্পর্কের কেউ না তো ! 

         একটা মন তখন যেন কোথাও হাহাকার করে উঠতো কত কথা ভেবে ! ভাবতাম , তাহলে এই মানুষগুলির মধ্যেই আবার এত বিভেদ কেন?

          এরকম আরও একটি সম্পর্ককে কত দিন ধরে দেখেছি যে ,তার কথা মনে হচ্ছে।

          মা ওদেশে রওনা হবার কদিন আগেই দেখতে পেলাম একদিন এক স্নেহময়ী মাতৃসুলভ আচরণের একজন মানুষকে । একটি ছুটির দিন বিকেলবেলায় আমাদের বাড়িতে তার আগমন ঘটেছিল । তার সঙ্গে প্রথম আলাপেই মনে হলো সে যেন কতদিনের আপনার জন ! আমাকে তাদের বাড়িতে বারবার যেতে বললো । বারবার পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বললো,যেও কিন্তু বাবা , যখন খুশি চলে যাবে এই মামির ওখানে------ কোনো সংকোচ করবে না ।

         মা তাকে যেন নিজের বউদির মতো ভাবতো।

বউদি বউদি বলে ডাকতো। সেও মাকে দিদি দিদি করতো। খুব আন্তরিক ভাবে । তার মুখের ভাষায় বরিশালের টান , কিছুটা ফরিদপুর ঘেঁষাও । 

       যাওয়া হয়নি তাও অনেকদিন পর্যন্ত ।

       মা ওদেশে যাবার সময় বারবার বলে গেছে , শৈলেশদার বউ, বউদি কিন্তু যখনই দেখা হয় তোর কথা বলে।  বলে তোকে পাঠিয়ে দিতে। যাস না কেন একদিন । হাঁটতে হাঁটতে একদিন তো যেতে পারিস ওদের বাড়ি ।তোকে তো সেদিন দূর থেকে দেখিয়েও দিলাম ওদের বাড়িটা । গেলে বুঝতে পারবি ওরা ভীষণ আপনার জনের মতো মনে করে সকলকে। যাস না একদিন , ঘুরে আসিস না , দেখবি ভালো লাগবে। 

       জল সূত্রে কত কথার প্রসঙ্গই না এসে গেল। 

       যদিও তারও একটা কারণ আছে । এই জল টানাটানির কথাটা এলেই মনে পড়ে যায় এর পরের কষ্টকর দিনগুলির কথা। সেদিন যে এই শৈলেশ মামার বউই ছিল আমার প্রতিদিনের স্নানের ব্যবস্থা করে দেবার মানুষ । কেন যে এমন অবস্থা তৈরি হয়েছিল সেই সময়টায় ---- যখন বাড়িতে স্নান করতে পারছি না । জলে এতটাই আইরন আসছে, লাল হয়ে যাচ্ছে সব কিছু । একমাত্র বাসনকোসন ধোয়াধুয়ি  ছাড়া অন্য কোনো কাজই করা যাচ্ছে না। অন্য ভরসা বলতে ওই সামান্য সময়ের জন্য টাইম কলের জল দুবেলা। কাজের দিদি কখনোও কখনোও বা আমি, বালতি নিয়ে লাইন দিয়ে টেনে আনতে যেতাম সেই জল , কখনোও এ মোড়ের মাথায় কখনও ও মোড়ের মাথায় । সাপ্লাইয়ের জলের উপর পুরো ভরসা করার তাই উপায় নেই । পাড়ার কয়েকটি মোড়ে বসিয়ে দিয়ে গেছে একটি করে চাতাল মত তৈরি করে যদিও ; তাতে কখনও কখনও জল শূন্য কলের মাথাটাকেই জেগে থাকতে দেখা যায় শুধুই ! কখন জল আসবে এবং আমরা জল পাবো এই অপেক্ষায় এক এক দিন সমস্ত দিন চলে যায় । অথচ সেদিন আর জলের সারা দিন দেখাই মিললো না হয়তো । সকাল সন্ধ্যা সেখানেই ব্যায় হয়ে যায় দীর্ঘ সময় । আমাদের থেকেও গোরু-বাছুরের জলের যে আরো বেশি প্রয়োজন ।

       

             এখানে আসার পর ছাই সুরকি যোগাড় করে রাস্তা থেকে ঘর পর্যন্ত যে রাস্তাটা তৈরি করেছিলাম ; তার আগে তো কিছু দূর অন্তর অন্তর ইটই পেতে দেওয়া ছিল চলাচলের জন্যে । বর্ষা কালে দূরাবস্থার তো শেষ থাকে না তা না হলে , ওপাশে পালেদের পুকুর ভেসে জলের স্রোত বয়ে যেত রাস্তার উপর দিয়ে , সে স্রোত আমাদের বাড়ির উপরেও তো থাকতো কিছুক্ষণ অন্তত ; তাতে কই , লেঠা, মাগুর , ষোল হামেশাই পথের উপর হাঁটা চলা করে বেড়াতো । একদিন কাজের দিদিও তো উঠোনের উপর থেকেই লাফ দিয়ে 

কই মাছ ধরলো বেশ কয়েকটি।

           বর্ষা যদিও এখন তো আর নেই । বর্ষা কালটায় যে অবস্থা হয় তা তো দেখাই হলো । আর তার জন্যেই তো সাততাড়াতাড়ি এত কান্ড করে ভগ্নিপতি ( অশোকদা ) এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘরের সিলিং দেওয়া , বাথরুম , কলতলা , গোরুর ঘরের সোলিং এসব সব করে দিয়ে গেল ! আর সে কারণেই খানিকটা অসুবিধা লাঘব ও হলো এবারের মতো ; সামনের বর্ষায় ওই জল থৈ থৈ অবস্থা অন্তত কলতলাটায় তো থাকবে না , কিম্বা গোরু গুলির ঘরের ভেতরটায় । কাজ হয়ে যাবার পরে আমাকে বলে গেল পুজোর পরে ওপাশে লম্বা করে আরো গোরু বাছুর থাকার ব্যাবস্থা করা যায় কিনা সেটাই এবারে দেখতে হবে , যাতে করে গোরু বাছুর গুলির বাড়ির ভেতরে আর কোনো ঝামেলাই থাকবে না , ওরা বাইরে দিয়েই যাওয়া আসা করবে ওদের ঘরের ভেতরে ; সেইভাবেই দরজাও বসানো হবে সেই ঘরে। কারণ ইদানিং কিছুটা সময় তো ওরা বাঁ পাশের ফাঁকা মাঠটাতে যায় একটুখানি সময় হাঁটা চলা করতে , কিম্বা যা দুটো চারটে ঘাস পাতা খুঁটে খেতে পারে , এই জন্যে ।

           এখানে আসতে না আসতেই এরকম ই একটা অলিখিত কর্মব্যবস্থার সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছি যে আমি , তা যেন অনুভব করছি । কীভাবে কীভাবে যেন এটাই প্রথম কর্মপ্রাপ্তির একটা দিক হয়ে দাঁড়ালো। আর তাতে খুব ধিরে ধিরে প্রাণসঞ্চার করতে লাগলো ভগ্নিপতি ! কীভাবে কীভাবে যেন তার মাথার ভেতরে ঢুকে গেছে গো-পালনের মধ্যে দিয়েই এই সংসারের খানিকটা উপার্যন বাড়িয়ে তোলা সম্ভব । আর আমিও তার উৎসাহে এই কাজের মধ্যে দিয়েই বাস্তব পৃথিবীতে ঝুঁকে পড়ে যেন একটা অন্য আলোর দিশা খুঁজে নিতে বাধ্য হচ্ছি ।

             কর্মমুখী কোনো জীবনের পরিকল্পনা নিয়ে তখনই ভাবিত হবো বলে তো এখানে চলে আসা নয় ! আসাটা যেন খানিকটা নিয়তি নিয়ন্ত্রিতই বলা চলে।বর্ডার পালিয়ে রোমাঞ্চকর একটা পথ অতিক্রম করবো বলেই তো ছুটে আসা ! আসাটাও একেবারের জন্যেও নয় । মনে করেছিলাম যাই তো , কিছুদিন পরে না হয় ফিরে চলে আসবো ।

            সেখানের সেই একঘেয়েমি থেকে সেই বয়সের যে সব অদ্ভূৎ পরিকল্পনা র কথা মাথায় আসে , খানিকটা যেন সেরকম কিছু একটার প্রভাবে প্রভাবিত 

হওয়া ছাড়া এদেশে চলে আসার পেছনে আর তেমন কোনো কারণ তো ছিল না । হ্যাঁ, সেটা ছিলো মনের ভেতরে হয়তো খানিকটা , আর তা তো সেই শিক্ষে গুরুর খোঁজ করা ! কই , সে খোঁজ মিললো কই ! যদিও সে সব কথারও খানিকটা খোঁজ খবরও দিদিমার কানে পৌঁছেছিলো , সে বিষয়ে সে তো সেবারে কমলেশ চক্রবর্ত্তীকে ডেকে আমাকে বলতে বলেছিলো , ওরে কোয়ে দেখেন ঠাকুরদা , ও যেন একখানা পাসপোর্ট করে তারপরে ওদেশে যায়। আর তার নানা কারণও রইছে , আমি চাই না ও ওদেশের নাগরিকত্ব নিক । আমি চাই ও এদেশের হয়েই ওদেশে যাওয়া আসা করুক । সে ওর যতবার যাতি ইচ্ছে করুক যাবে , তাতে আমি বাধা দেবনানে । কারণ ও আর ওদেশের নেই ।ওর সবটাই এদেশের জল হাওয়ায় গড়ে উঠেছে । আমি জানি ও ওখেনে হয়তো যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু কিছুদিন গেলিই ও কিন্তু বুঝতি পারবেনে ও যে আর ওদেশের নেই যে । আর ওর ওই সব কাব্যটাব্য করবে তো যাক না এদেশের বড় কোনো শহরটহরে । আমি যথাসাধ্য চিষ্টা করবানে তার জন্যি । তুমি ঠাকুরদা, পারো তো ওরে এটটু বোঝাও , সকলে মিলে বলে কয়ে দেহ ছেলেটা যেন বুঝতি পারে । আমি ওর ভালো ডা  কিসি হবেনে তা জানি বলেই কচ্ছি , তোমরা সকলে মিলে ওরে এটটু বলে কয়ে দেহ আমি কী কতি চাচ্ছি । আমি খুব ভালো করে জানি ও পারবেনানে গো , পারবেনানে , সারা জীবন ও কষ্ট ই পাবেনে শুধু , কিন্তু সেদিন আর কিছুই করতি পারবেনানে ও । 

           না , তার এই দমচাপা রুদ্ধশ্বাসী ভবিষ্যৎবার্তাকে আমি সেদিন গুরুত্ব দিই নি । আমি পেছনে ফিরি নি । কিন্তু সত্যি কি পিছনে ফিরি নি ! 

        সে কথা যে কত বড় মিথ্যা তা তো আমিই জানি । সমস্ত জীবন পিছনের সেই টানই তো অন্তরালে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি !

           সেই সময়ের যে মজা পাবার উচ্ছ্বাস আমাকে ব্যাতিব্যাস্ত  করে তুলেছিল , যে নিয়তির হাতে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলাম কিছুটা , তা কি ঠিক ছিলো?

            হয়তো ঠিক ছিল , হয়তো না । সে সময় যদি অমন একটা দুরাবস্থা না ঘটতো তাহলে হয়তো হলেও হতে পারতো আমার ইচ্ছাটারই জয় । কিন্তু ঘটনার সমস্ত মোড়ই তো ঘুরিয়ে দিলো । কাইলে মামাকে ফিরে যেতে হলো নানা অনিশ্চতার মধ্যে দিয়ে । কে জানতো যে মানুষটির প্রেরণায় এতগুলি মানুষ জীবন দিল একটি দেশের স্বাধীনতা আনবার জন্যে ----- আর আজ, সেই দেশেরই মানুষ সেই মানুষটিকে স্ববংশে নিধন করতে একবারও ভাবলো না? 

   ‌       এই সংকট মুহূর্ত ছিল যেমন, তেমন আর একটা দিক ও ছিলো কাইলে মামার সাততাড়াতাড়ি ভাইকে সঙ্গে করে নিয়ে চলে যেতে বাধ্য হওয়া । সেটাও কি আমার ওদেশে পুনরায় ফিরে যাবার পক্ষে একটা অন্তরায় না? 

          সে যাই হোক , সে সব ভাবনা ভেবে আর কীই বা হবে !

           এখন যেন এক অজানা স্বপ্নের ভেতরে বাসা বেঁধে চলেছি কেবল , যেখানে একটাই চিন্তা , যেভাবেই হোক যেমন করেই হোক এই বাড়িটার একটা উন্নতিসাধন করাই প্রধান লক্ষ্য।

            মায়ের যা উপার্জন তাতে কাজের মানুষজন রেখে ,লোকলৌকিকতা করে ,আরো নানা আনুষ্ঠানিকতা সামলে ধার দেনা মিটিয়ে সংসার চালানোটাই কঠিন । 

           তাছাড়া পৈতৃক সূত্রে যে টাকা ওয়ার্লেসের দোকান ঘর গুলির থেকে পাওয়া যায় তা তো কিছুই না । তাই আলাদা একটা উপার্জনের যে প্রয়োজন তা এখানে আসার পরে কিছুদিনের মধ্যেই বুঝে যেতে বাধ্য হয়েছি । আর সেই সূত্রে পাকা বাড়ির স্বপ্ন হয়তো আর একটি বাড়তি স্বপ্ন------ যা একটু একটু করে খড়কুটো সংগ্রহে নেমে পড়েছে হয়তো মনে মনে।

          স্বপ্নটা যত দিন যাচ্ছে যেমন শাখাপ্রশাখা মেলে ধরতে চাইছে, ঠিক তেমন, শিল্প সাধনার জন্যে যতটা উৎকন্ঠিত হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি ঠিক ততটা হয়ে উঠছে না যেন কিছুতেই। সে সব যেন বসার দরকার বসি এমনই একটা ভাব । লেখা দরকার লিখি । পড়াশোনা করার তৃষ্ণা যেমন থাকার দরকার ঠিক ততোটা কিছুতেই হচ্ছে না ------- একটা অস্বস্তি থেকেই যাচ্ছে ভেতরে ভেতরে । তাও যা করি তা আপন আনন্দেই করি । এর বেশি কিছু না । তাকে নিয়ে যে বৃহত্তর ক্ষেত্রে প্রচার করার দিকটা থাকা উচিত ----- তেমন কিছুই হয়ে উঠছে না । অর্থাৎ তার কোনো শাখাপ্রশাখা বিস্তার নেই । সে যেন সেই চারাগাছ চারাগাছই রয়ে যাচ্ছে । সে যেন নিজেই চাইছে ছোটো কয়েকটি চারা গাছ হয়েই থাকতে । মাথা তুলে ছড়িয়ে পড়তে চাইছে না  কোনোভাবেই । তা নিয়ে তার কোনো নড়াচড়া নেই। সেই একজায়গায় কুঁকড়ে মুচড়ে ছোট্টটি থাকার মধ্যেই তার স্বভাব বাঁধা পড়ে যাচ্ছে যেন যত দিন যাচ্ছে ততই আরো বেশি করে বুঝতে পারছি।

           সেদিন শংকরদের বাড়ির সামনের বাড়ির ভূবনদা যেমন আশ্চর্য হয়ে বলেছিলো, "সে কী রে , তুই প্রকাশ চাস না , সে আবার কীরকম কথা রে বাবা? লিখবি আর খাতা বোঝাই করে চাপা দিয়ে পড়ে থাকবে সে সব, তাই আবার হয় নাকি রে এই সময়ে ? আরে কথায় আছে না ---- তোরাই তো বলিস সে সব , তোরাই ভালো জানিস , আরে প্রকাশই তো কবিত্ব নাকি !"

          সেই বয়েসের যে স্বভাব , সব কিছুতেই একটা একগুঁয়ে ভাব, এমনই একটা মতবাদে বিশ্বাসী হয়ে নিজের মতামত টাকেই বড় করে তুলে ধরার একটা একরোখা ভাব যেন সব সময় ভেতরে ভেতরে । আর তারই বশবর্তী হয়ে অন্যের মতামতকে নিজের ভাবনা চিন্তার কাছে কোনোভাবেই যেন খাটো করতে দেওয়া নয় , এরকমই একটা ভাব দেখানো সব কিছুতেই । তাই তার কথাটা খুব ভালোভাবে মেনে নিতে না পেরে তাকে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে চুপ করিয়ে দিয়েছিলাম সে দিন । পরে অবশ্য তার কাছেই যেয়ে স্বীকার করে নিয়েছিলাম , বলেছিলাম , সে দিন আপনার কথাটার গুরুত্ব পরে খুব ভালো ভাবে বুঝতি পারিছি ভূবনদা । আপনার কথাটা যথেষ্ট মূল্যবান। কিন্তু আমার স্বভাবে যে এই গুণটা তেমন নেই ! আমার লেখালিখি প্রকাশ হক তা যে আমি চাই না তা ঠিক না । আমিও চাই প্রকাশ করি কিন্তু উপায় ডা যে কি তা তো বুঝে উঠতি পারি নে যে , সিডার কী করি তাই কন দেহি !

          ভূবনদা শুনে বেশ অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো । খানিক পরে বললো , যাক , তাহলে মানলি তো  ? আচ্ছা , দেখি আমি কী করতে পারি তোর জন্যে।

          আজ মনে মনে একটা বেশ পাকা সিদ্ধান্ত নিলাম, যেভাবেই হোক, যে করেই হোক, যা পারি তেমন করে আজ একখানা চিঠি ওদেশে লিখবই । তার জন্যে হাঁটতে হাঁটতে পোষ্টাফিসে যেয়ে কয়েকখানা খাম কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম । পোষ্ট মাষ্টার বললো , এই খামে কিন্তু ও দেশে চিঠি যাবে না বাবা । এতে আরো বাড়তি পঞ্চাশ পয়সার টিকিট দিতে হবে । বাড়তি পঞ্চাশ পয়সার দুটি টিকিট দুটি খামের উপরে বেশ করে আঠা দিয়ে সেটে খাম দুটিকে হাতের ভেতর নিয়ে বাড়ি ফিরলাম ।

         সিদ্ধান্ত সিদ্ধান্তর মতোনই থেকে গেল । কীভাবে কীভাবে আরো দু দিন একই কাজের মধ্যে দিয়েই কেটে গেল দেখতে পেলাম । এগোলো না এক ইঞ্চিও । একই ধারাবাহিকতা সকাল দুপুর সন্ধ্যা , যে যে কাজে যেমন যেমন অভ্যস্থ হয়ে গেছি -----  তেমনই একটা একঘেঁয়ে নিয়মে পেয়ে বসেছে । যেন তারই পাকে পাকে ঘুরে চলেছি সমস্ত‌ দিন রাত ।

          মা ওদেশে যাবার সময় যে কটা টাকা দিয়ে বলে গেছিল মাছ তরিতরকারি সংগ্রহ করার জন্যে ,তাছাড়া মুদির যা যা লাগবে তার সবই তো নীলুর দোকান।আছেই বাঁধা ।

          বাজার সদাই করতে কুড়ি টাকা হলেই যথেষ্ঠ ।

          মাঠের কোনায় রাস্তার উপরে সকালের বাজার বসে । সেখান থেকেই বাজার সদাই করে মোটামুটি সকলে । আমাকেও সেখান থেকেই বাজার আনতে হয় । গোয়ালার দুধ দোহাই শেষ হলে মানুষ জনেরা দুধ নিয়ে চলে গেলে তারপর থাকে তাদের ঘর দুয়োর পরিষ্কার করা । কাজের দিদির সঙ্গে সে সব পর্ব সারা হলে তাদের পাশের মাঠে বেঁধে দেওয়া । কোনো কোনো দিন আজকাল সে সব কাজ একা একাও সেরে নি । কিভাবে কিভাবে যেন সেই সব অভ্যাসের সঙ্গে আপন মনেই চালান হয়ে যাচ্ছি । নিজের অজান্তেই ঘটে চলেছে এই সব একাগ্রতা । তা দেখে নিজের মনে নিজেই খানিকটা একা একা হেসে নিই । গোরুগুলি যখন বাড়ির পাশের খালি জমিটার ভেতর ঘাস লতাপাতা খায় তখন দূর থেকে আমার নজর চলে যায় ওদের দিকে । মনে মনে বলি , সত্যিই তো আজকে ওদের স্নানটা করিয়ে দিলেই ভালো হতো । সারা গায়ে গোবোরগুলো কীরকম লেপ্টে আছে দেখো ! না ধুয়ে দিলে তো চামটা ধরে যাবে ! তাড়াতাড়ি বালতিতে জল নিয়ে এগিয়ে যাই সেই ময়লা পরিষ্কার করতে ।ওরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে । আমি খড় দিয়ে ডলে ডলে পরিস্কার করি আর ভাবি এখানে আর নদী কোথায় পাবো যে ওদের লেজটা মুড়িয়ে ধরে সিং টা ধরে জলের তলায় চুবিয়ে ধরবো ! ওরা ডুব দিয়ে ভুস ভুস করে নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে আরো খানিকটা সাঁতরে আসবে আপন মনে ঘুরে ঘুরে ! আর আমিও সেই ফাঁকে গোরু স্নান করানো গন্ধের জল থেকে আরো খানিকটা দূরে যেয়ে সাঁতরে স্নান করে আসবো ! ওরাও ওদের আপন মনে উপরে উঠে নদীর চরের ঘাস জঙ্গল খুঁটে খুঁটে খাওয়া শুরু করে দেবে যে !

           কালীবাড়ি র রমনীদার কাছ থেকে দানা ভুসি আনা হয় । তাকে যেয়ে বলি , ও রমনীদা , ওসব গমের ভুসি ছোলার চোকলা এসবের ভাগযোগ গন্ডোগোল করে ফেলি যে------ ওসব আপনি ঠিক ঠাক করে মেলায়ে দিয়েন দাদা । আমার এখনো সব ডা ঠিক মনে থাকে না। সেদিন তো ছোলার চোকলা ডা কতটা দিছিলাম তা মনেই করতি পারলাম না ভাই ।

            খড় বিচালি মেসিনে কাটিয়ে পৌঁছে দিয়ে যায় পরিচিত রিক্সাওয়ালা । ওরাই রিক্সায় বোঝাই দিয়ে বাড়ি পৌঁছিয়ে বসিয়ে দিয়ে যায় গোরুর ঘরের সামনে দিয়ে বারান্দার কোনায় সার সার করে । কখনো কখনো কালো গরুটা গলা বাড়িয়ে টেনে খেতে যায় তার থেকেই আগাম দু একটা ।

           আমি তো রিক্সা করে যেয়ে পণ্ডিতের দোকানে বস্তাগুলি পৌঁছে অর্ডার দিয়ে আসি খড় বিচালি কাটাই করবার জন্যে । অথচ এ অঞ্চলের অন্যান্য গোয়ালারা সন্ধে বেলায় পণ্ডিতের দোকানে বিচালির বস্তা বোগল দাবায় করে নিয়ে যেয়ে বেশ গোল হয়ে একটা মিটিং বসায় । একই কাজে আমিও তো যাই, শুধু আমি যেন ঠিক তাদের গোত্রভূক্ত কেউ না !

          এইসব কাজগুলি করতে করতে মাঝে মাঝে মনে মনে ভাবি, জীবনের এই পরিবর্তীত সময়গুলির কথা ! মনে মনে বলি , এই একইরকম কাজগুলি করতে দিদিমার কাছ থেকে দু টাকা নিতাম । দিদিমাও দিতো ।কারণ আমি যেন নিশ্চিন্তে হাত খরচা করতে পারি । আর আমি ঘাস কাটতে যেয়ে জমির আলে বসে থেকে ভাবতাম কত কথা ! বাতাসে বাক্সা ঘাসের পাতাগুলি নড়তো আর আমি তাদের শরীরের ঘ্রাণ নিতে নিতে কত তেপান্তরের মাঠে মাঠে ছুটিয়ে বেড়াতাম আমার ভেতরের সদা অস্থির এই মনটাকে । যত দূর চোখ যায় শুধু ফসলের মাঠ আর মাঠ --- আমি তারই একটি ক্ষেতের কোণায় বসে বসে পাটগাছের ছায়ায় ঘাসজমি পাটের ক্ষেতের ধান গাছেদের হাওয়ায় দুলতে থাকা এমন একটা পৃথিবীর ভেতর চুপ করে বসে থাকতে থাকতে কত কথাই না মনে মনে বলতাম নিজের সঙ্গে নিজে !

           এখানে আর সেসব কোথায় বা পাই যে তোদের দুমুঠো বাক্সা ঘাস তুলে এনে  স্নানের পরে খাওয়াবো বল ! 

           আর একটা মন যেন কেবলই বলে , এসব কি সত্যিই সত্যিই কোনোদিন চেয়েছিলাম আমি !

          যদিও চাওয়া না চাওয়ায় সবটা নির্ভর করে না জীবনের এই নিয়ম । এইসব কে গ্রহণ করেই সময় চলে তার আপন গতিতে যে, এ কথা যত দিন যাচ্ছে ততই পরিষ্কার হয়ে উঠছে দেখতে পারছি।

          বাকি সময়টুকু এটা ওটা পড়াশোনা করে কাটছে ঠিকই , কিন্তু নিজের ভাবনা চিন্তাকে অবলম্বন করে সেরকম কিছুই হয়ে উঠছে না । আজকাল কোথাও কোনো কিছুতেই যেন সেরকম আলোড়িত হতে পারছি না , যাতে অন্তত সেই মগ্নতায় পৌঁছে ঘস ঘস করে কয়েক লাইন নিয়মিত অন্তত লিখতে পারি ।

          তাই মনখারাপ হয় । বারবার রসিক দাদুর সেই ' বড়ো জায়গার ' কথাটা বড়ো বেশি করে বাজে বুকের ভেতরে । এই বড়ো জীবনটা কোথায় বা পাই ! এখনো তো কলকাতার শহরটার অনেক জায়গাই চিনি না জানি না ! আচ্ছা , তাহলে কি হাঁটতে হাঁটতেই চলে যাবো যে দিকে মন চায়?

            যাইনি যে তাও তো না ! এর মাঝে একদিন অলোকের সঙ্গে টালিগঞ্জের লেকে গেছিলাম । অলোক এসে বললো , চল , যাবি নাকি ---- চল দেখি , শুনেছি লেকের ভেতরে ভালো ভালো শ্যাওলা পাওয়া যায় । চল তো , কিছু নিয়ে আসি যেয়ে। মাছের একোরিয়ামের মধ্যে দিলে মাছগুলো ভালো থাকবে । শুনেছি ভবানী সিনেমা হলের সামনে একটা নতুন মাছের জিনিসপত্রের দোকান হয়েছে নাকি ; চল যাই তো , দেখি গিয়ে কেমন দোকান ! লেকের থেকে আসার সময় ও জায়গাটাও দেখে আসবো আজ ।

       

           আমিও রাজি হয়ে যাই । আমার বাড়তি লাভ লেকের ভেতরটাতে কিছুটা সময় কাটিয়ে আসবো ------  কেন ? না , বড়ো জলাশয়ের কাছে কিছুক্ষন চুপ করে বসে থেকে আসবো । মাথার উপর বড়ো বড়ো গাছের ছায়া থাকবে ---- কোন্ ছোটোবেলায় একবার বাবা মায়ের হাত ধরে ঘুরেছিলাম মনে আছে । খুব বড়ো বড়ো মাছ আছে একটা জায়গায় । সকলে মুড়ি ছড়িয়ে দেয় পাড়ের থেকে । ঠিক পাড় নয়, একটা ব্রীজ মতো আছে সেইখানটাতে । জানি নে এখনো আছে কি না।


          কিন্তু ওখানে যাবার পরে বেশ খানিকটা মন মরা হয়ে গেলাম । ও বললো , "শ্যাওলা যা পেলাম তাতে খরচা পোষালো না রে ! এইসব শ্যাওলা দিয়ে কী হবে !"

           এর অর্থ ওর খুব একটা পছন্দ হয়নি । কিন্তু আমার তো মনে হলো ---- কেন পছন্দ হলো না ওর ? এর চাইতে আলাদা কিছু তো এর আগে ওর একোরিয়ামে দেখিনি আমি ! 

          যাই হোক আমার আলাদা কিছু মনে না হলেও ---- আমার তো বেশ ভালোই লাগলো, বেশ একটা ফুরফুরে হাওয়ায় খানিকটা সময় কাটিয়ে আসা গেলো তো ; আমি তো নবগঙ্গার স্বাদ পেলাম কিছুটা অন্তত ! জল-শ্যাওলার গন্ধে মনটা আবার কিছুক্ষনের জন্যে ফিরে গ্যালো সেইখানে , যেখানের মায়া টান কিভাবে যে ভেতরটায় প্রবেশ করে এমন একটা ঘোর লাগিয়ে দিচ্ছে যত দিন যাচ্ছে ততোই ; যাতে অনেকক্ষণ বসে থাকলাম লেকের জলের ধারের সেই সান বাঁধানো বেঞ্চিতে।

          

           কিভাবে কিভাবে  পরে ভুলেও গেলাম সেই সব বড়ো বড়ো মাছের জায়গাটার খোঁজ করতে। অলোক ফিরে আসার সময় তার সেই মাছের দোকানে বেশ খানিকটা সময় কাটালো । পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চেয়ে চেয়ে থাকলাম আমি, কত সব বিচিত্র রঙবেরঙের মাছ সে সব! তাদের কত সব বিচিত্র ধরণের নাম ধাম ! ছোটো একটা কচ্ছপকেও দেখলাম কাঁচের বাক্সের ভেতরে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে । মনে মনে ভাবলাম এবং নিজের মনে নিজে বললামও , ও বাবা ! কচ্ছপ চাঁদু ----- তুমিও কীরকম দর্শনীয় বস্তু হয়ে গেছো এখানে যে ! রঙবেরঙের মাছগুলি না হয় নানা নামে একটা রাজকীয় ভাব নিয়েছে এই জলের ভেতরে , কিন্তু তুমি বাছাধন ! তোমার ও কি নাম পাল্টে দিয়েছে এই শহরের বাবুদের ছেলেপেলেরা ? তাদের গৃহকোণে এই শোভা বিতরণের জন্যে তোমাকেও এরা ধরে নিয়ে আসলো কীভাবে ?

           সময় এমনই ---- এই তো , এই যে কত কিছু জানতে পারছি , যার কোনো কিছুর সঙ্গে এভাবে যে দেখা হবে এ কি জানা ছিলো? এই যে অলোকের মতো অলোকেরা আছে বলেই তো এমন কাঁচের বাক্স তৈরি হয়েছে । তাতে কত মহনীয় ভাবে সেজে উঠেছে পাহাড়পর্বত , ব্যাঙ , কুমির , পুতুল-মানুষের অবয়ব , যাতে বুড়বুড়ি কেটে জল উঠে যাচ্ছে উপরের দিকে , ওই পুতুলটা হাঁ করছে আর জল বুড়বুড়ি ভেঙে ছড়িয়ে যাচ্ছে সমস্ত কাঁচের বাক্সটার ভেতরে । এরা যাকে বলে একোরিয়াম । এসব কি কদিন আগেও আমি জানতাম ? এই যে গাছেদের কত কত সব নতুন নাম ---- ডালিয়া, জিনিয়া , চন্দ্রমল্লিকা , আরো কত সেসব নাম ফুল গাছেদেরও ; এসব‌ নাম কি আগে জানতাম? এই যে গো পালনের ভেতরে যে সব স্বপ্ন-আকাঙক্ষায় আস্তে আস্তে ঢুকে যাচ্ছি , তাতে যত সব নাম ধাম জানতে পেলাম , যত সব নিয়মকানুন , তা কি এর আগে এমন করে জানতাম ? ফুলেদেরও যেমন এমন সব নামধাম, আগে শুনিনি ! সেই তো গন্ধরাজ , গ্যাঁদা , শিউলির মধ্যেই তো জবা-টবা নিয়ে একটা গন্ডি ছিল , আর এখানে এসে যতটুকু জানতে পারলাম , তা কি কম ?

           মাছেদের খাদ্য করবার জন্য যে ভিজে স্যাঁতসেতে জায়গা থেকে কিম্বা গোবর ডাঁই করা জায়গা থেকে কোদাল দিয়ে যেভাবে গোবর সরিয়ে কেঁচো তুলে নিয়ে নারকোল মালায় ভরে নিতাম সেই কেঁচো গুলিকে ; সেসব তো মোটা মোটা কেঁচো , এখানে সেরকম তো না ! এত সরু সুতোর মতো কেঁচো কিভাবে হয় ! অত সরু হয়ে প্লাস্টিকের প্যাকেটের মধ্যে অতি যত্নে ঢুকে যাচ্ছে কীরকম দেখো ! তারও দাম আবার একটাকা দু টাকা ! কেঁচো বিক্রি হচ্ছে সেও আবার এত কায়দা করে ! 

          প্রথম প্রথম অলোকের মুখে কেঁচো কেনার কথাগুলো শুনে হাসি পেত । এখন এই কদিনের মধ্যে কেমন করে যেন বুঝতে শিখে গেছি এসব কিছুর গুরুত্ব । আমিও ‍আর পাঁচটা ছেলেপেলেদের মতো এই নাগরিক জীবনে প্রবেশ পথ পেয়ে গেছি যে তা বুঝতে পারছি । সে আমার যতোই হাসি পাক না কেন কেঁচো বিক্রি হওয়া দেখে।

            দুপুর বেলায় ঘরের সামনের দিককার জানলাটা খুলে চুপ করে বসেছিলাম । সেরকম কিছুই ভাবছিলাম না । কেন জানি বইটাও খোলা ছিলো সামনে ,তাতেও মন ছিল না । পথের দিকে চেয়েছিলাম নাকি মাসিমাদের বাড়ির পেছনের সেই ঝাউ গাছগুলির দিকে ? তাও হয়তো না। কোনো দিকেই তো সেরকম একটা এক ভাবে চেয়েছিলাম না ! এলোমেলো অন্যমনষ্কতায় ডুবে যাই যেমন মাঝে মাঝে , তেমনই হয়তো বা ; এর মধ্যেই দেখতে পেলাম আমাদের বাড়ির সামনে সেই বাঁশের চটার দরজা টা খুলে শিবানী মলি দের বয়সী একটি মেয়ে ভাইএর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে বাড়ির ভেতরে চলে এসেছে । কাজের দিদি বারান্দায় কিছু একটা কাজ নিয়ে ব্যাস্ত ছিলো মনে হলো । সে মেয়েটিকে বাড়ির ভেতরে ভাই-এর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে আসতে দেখে বললো , "ও তো বাড়িতে নেই গো , সে তো বাঙলাদেশে গেছে ।"

           তাতে মেয়েটি বললো , "ওঁ ...... , সেই জন্যে এসে পর্যন্ত ওর সাড়া শব্দ পাচ্ছি না একেবারেই----- তা মাসিমা আছেন নাকি বাড়িতে এখন---- ?" 

     ‌     কাজের দিদি তাই শুনে বললো , "নাগো বাপু , মাসিমাও তো গেছেন ওদেশে , ভাইকে নিয়ে আসতে । তবে মাসিমার বড়ো ছেলে আছে ।"

          সে আরও খানিকটা বিস্ময় প্রকাশ করলো শুনতে পেলাম । বললো , "বড়ো ছেলে ! মাসিমার আবার বড়ো ছেলে এলো কোথা থেকে?"

       কাজের দিদি তাকে বললো , "ওমা , সে কি , মাসিমার তো দুই ছেলে এক মেয়ে , তুমি জানো না বুঝি ! তা, ও বাড়ির ওরা তোমার কে হয় মা ?"

     ----- ও বাড়ির ওই মাসিমা আমার বড়ো মাসিমা হয় । আগে এখানে এলে ওর সঙ্গে মিশতাম তো তাই , সেই জন্যেই ওর খোঁজ করছিলাম আর কি ।

     ---- তা ভালো তো মা , এসো না , ও নেই তো কি হয়েছে , আমরা তো আছি , বড়ো ছেলেও তো আছে ! ভেতরে এসে বসো না কেন একটু -----। 

         সে তাতে বললো , "না না , থাক , পরে আসবো , আছি তো ; এখন থাক , যাই এখন ...."

         আমাকে সে দেখেছে । কিন্তু সে  দেখার মধ্যে সে হয়তো কোনো সচ্ছন্দ বোধ করেনি । অথবা কোথাও এক জড়তা , যেভাবে, সে যে চোখ দিয়ে দূর থেকে দেখেছে আমায় ! না হলে রহস্যজনক কিছু ছিল তার জানায় , সে দ্বিধাগ্রস্ততায় কিছু আছে যার থেকে সে স্বাভাবিক হয়ে ভেতরে আসতে পারলো না হয়তো । আর সেই জন্যেই কি ফিরে চলে যাওয়ার সময় সে দেখতে পাইনি যে আমায়, তাও তো না ! এবং আমি যে তার আসা এবং এইভাবে চলে যাওয়ার সবটাই যে দেখতে পেয়েছি , সে কথা সেও জানে। তবু কেন জানি না বারান্দাতে সে আর উঠলো না । দেখতে পেলাম সে দরজা পেরিয়ে এসেছিল যেমন তেমনই চলে গেল । শুধু ও বাড়িতে ঢোকবার আগে একবার ফিরে দেখে নিলো , আমি তাকে লক্ষ করলাম কি না ।

          এরপরও সে সমস্ত দিন বারকয়েক এই বাড়ির উপর নজর রাখছে যে তা আমার চোখে পড়েছে ।

   ‌      বুঝতে পারছি না কেন এই উঁকি ঝুঁকি । কেনই বা আমাকে সে একটা বিচিত্র জীবের মতোন মনে করছে? আর আমিও বা কেন এত তাকে বারেবারে লক্ষ্য করতেই যাচ্ছি , তাও তো বুঝতে পারছি না !  নিজের মনে নিজেই যেন এক সম্ভ্রম দোষে দুষ্ট হতে লাগলাম । মনে করলাম বয়েসের দোষ একেই বলে হয়তো ! তাহলে কি তাকে দেখে আমি খুব মুগ্ধ হয়েছি ?

             দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো । বিকেল বেলা গুলি ইদানিং এ বাড়িতে যেমন মানুষ জনের যাওয়া আসার একটা ব্যাস্ততা লেগে যায় , আজও তেমনই হয়েছিলো । সুজিত গোয়ালা গোরুর দুধ দুইয়ে দিয়ে গেলো । মানুষজনেরাও সে দুধের কিছু অংশ নিয়েও চলে গেলো । কাজের দিদি বালতি থেকে তাদের এলুমিনিয়ামের পোয়াতে মেপে সে দুধ সকলকে বাটোয়ারাও করলো নানাভাবে। কাউকে হরলিক্সের শিশিতে , কাউকে স্টিলের ক্যানে , বাকি অবশিষ্ট দুধ নিয়ে রোজকের মতো রান্নাঘরের ভেতরে রাখলো । তারপর সন্ধ্যার কিছু আগে কয়লার উনুন ধরিয়ে দিলো । যেমন প্রতিদিনই এ পাড়ায় সন্ধ্যাবেলা এবং সকালবেলার সময় কয়লার উনুনের ধোঁয়ায় ভরে যায় চারপাশ । ঠিক তেমনই ধোঁয়ায় ধোঁয়াক্কার হয়ে থাকলো সমস্ত বাড়িটাও । আগে আগে দমবন্ধ হয়ে আসতো , ইদানিং অবশ্য অভ্যাস হয়ে গেছে । অনেকটাই কেটে গেছে দমবন্ধকর সেই পরিস্থিতিটা ।


          রেডিওটাকে নিয়ে একবার এ সেন্টার একবার ও সেন্টার করে বেড়াচ্ছিলাম । কোনোখানেই নির্দিষ্ট ভাবে রেডিওর কাঁটাটিকে কিছুক্ষণও অন্তত দাঁড় করাতে পারছিলাম না । কিছুতেই মনটাই যেনো একজায়গায় স্থির হতে করতে পারছিলাম না ।

          একবার ভাবলাম শরৎ রচনাবলীর দ্বিতীয় খণ্ডটিও তো দেখতে পারি খুলে ; তাহলে কি সেটাই করবো ! 

           ওই তো , ওখানেই তো রয়েছে বইখানি ! না , তাও তো চাইছে না মন ! 

           তাহলে কী করবো এখন ? 

           এমন সময় কার যেন বারান্দায় আসার শব্দ শুনলাম । 

            কাজের দিদি উনুনে আঁচ ধরিয়ে দিল যে উঠোনের পরে তা জানি , এখন হয়তো সে জ্বলে ওঠা উনুনটি উঠোনের উপর থেকে তুলে দিয়ে রান্না ঘরে বসাবে । হয়তো বসাতেই যাচ্ছিলো, তখনই মলির উপস্থিতি । সে তাকে দেখে বলছে শুনছি ---- যাও, যাও ভাই ঘরের ভেতরে যেয়ে বসো গে যাও। আছে তো ও ।তোমরা কথা বলো গে , আমি আবার উনুন ডা ধরিয়ে দিয়েছি তো তাই , একটু পরেই চা দিচ্ছি তোমাদের ।

         বুঝতে পারলাম মলি এসেছে ।আচ্ছা , আজকে ওর আসা টাকে এমন আলাদা করে দেখছি কেন ?

          ও তো প্রায়ই আসে। তবে সেদিন বিসর্জনের পরে আর মনে হয় এদিকে আসেনি । তার কারণও ছিলো , এ কদিন ওদের বড়ো দিদি এখানে ছিলো যে । সেদিন সে কথা অলোকের কাছেই জেনেছিলাম লেকে যাবার পথে । সেদিনই জানতে পেরেছিলাম পুজোর সময়কার আত্মীয়স্বজন সমাগম হইহল্লা এখনো কাটেনি ওদের বাড়িতে । আর সে সব মেটেনি বলেই এ কদিন মলিও এ মুখো হয়নি । শিবানী যদিও এসেছিল ঠিকই ---- ওদের বড়ো দিদির মেয়েটিকে সঙ্গে করে । ঠাকুর দেবতার দিকে নজর রাখতে আমার মায়ের নির্দেশ অনুসারে । তাই সে তার কাজ এ কদিন বিশেষ দায়িত্বের সাথেই পালন করে গেছে ; যদিও দুবেলায় ঠাকুর দেবতাদের নিত্য জল মিষ্টি দেবার কাজটি কাজের দিদিই সামলাতে পারে বলে সে জন্যেই শুধু নয় , তাছাড়াও আরো অন্যান্য বিষয় যেগুলি আছে , এই যেমন তাদের জামাকাপড় পাল্টে দেওয়া , তাদের একটু চন্দন তিলক লাগানো , এসব তো আর কাজের দিদি পারবে না , পারলেও মায়ের পছন্দ মতো হবে না বলেই এ কাজের দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকে মা শিবানীর উপর। মার ইচ্ছা হলো অত্যন্ত ভালো সাজগোজ , গোছগাছ , পরিপাটি করে নানা ভাবে ঈশ্বর ভজনা । কিন্তু সে কাজটি সে নিজে করতে গেলেই যত ঝামেলা ; বিগত দিনগুলিতে যারা সেই কাজটি অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে করেছে তাদেরও কাজের খুঁত ধরেছে সে । যদিও সেই কাজটার জন্যে নিজেকে যতটা সময় ও মনযোগ দিতে হয় ততটা সময় তার হাতে সে গুছিয়ে নিয়ে বসতে পারে না যে , এ কথা তো সে নিজেও বিলক্ষণ জানে ! এই যেমন একটা বিষয় , তেমন অফিস যাবার সময় সেই কাজগুলি করতে যেয়ে বারবার কাজের দিদির কাজের ত্রুটি ধরে সে ,এটা ঠিক হয়নি ,ওটা ঠিক হয়নি । এই সব বলে একটা গোল বাধাবেই একটা না একটা ঠিকই । তখন সারা পাড়ার লোক পারলে শুনতে পাবে ---- এই রাধার কাপড় পাল্টাওনি মাসি তুমি ; কেষ্টো ঠাকুরের বাঁশি টা তো উল্টো গুঁজে দিয়েছো ; ঠাকুর কে মোছাও নি । কেমন দাগ পড়েছে পটের উপর দেখেছো ! 

          এরকম নানা অভিযোগ । এদিকে বেলা হয়ে যায় , তখন তার মুখ দিয়ে এই একটি কথাই বেরিয়ে আসবে ,'' না , আজ আর কপালে ভাত জুটবে না আমার .....''

            এমন সব কান্ডের মধ্যেই সময় যায় তার । তারপরেও যদি তাল সামলাতে না পারে তখন বলে , ধুত ছাই , থাকো তুমি । কেন , নিজে নিজে একটু গুছিয়ে গাছিয়ে নিতে পারো না ! দেখতে তো পাও আমার অবস্থা ?

       যেন ঠাকুর দেবতারাই সব গুছিয়ে গাছিয়ে নিলেই তার সব কিছু মনের মত হয় । এমনই ইচ্ছার কথা বলতে বলতেই ঠাকুরের আসন খানি গুছিয়ে তুলে রাখে ।

           আর এ দৃশ্য সেই একাত্তর সালে দিদির সঙ্গেও যেমন এসব নিয়ে ঝামেলা লেগেই থাকতো ; আবার দিদিমা যখন সে সময় তার মতো করে গোছাতে চাইতো , তাতেও তার খুঁতখুঁতানির শেষ থাকতো না । হয়তো দিদিমাকে সেরকম একটা সাহস করে কিছু বলতে পারতো না সেরকম ; তবে অপছন্দের কথাটা কায়দা করে ঠিকই শুনিয়ে দিত । বেশি কিছু একটু বললে তো দিদিমা বলেই ফেলতো , "থাইলো তোর ঠাকুর দেবতা ; আমি যেমন পারি তেমন করিছি , তোমার পছন্দ না হলি মনি তুমি নিজিই করনা ক্যান ! আমার দ্বারায় এর থে বেশি কিছু হবেনানে মনি , সে কথা ডা কিন্তু খুব ভালো করে শুনে নিও মনি , এই কয়ে দিলাম।" 

         আর তাই এখন হয়েছে শিবানী । যে কিনা খানিকটা পছন্দের তার । যার যোগাড়যাতিতে তার বিশেষ একটা আপত্তি থাকে না। বরঞ্চ নিশ্চিন্তই হয় সে খানিকটা ।

         এ বাড়ির ঠাকুরের সিংহাসনে মধ্যমনি হয়ে বসে আছেন যিনি তিনি হলেন রাম ঠাকুর । তাঁর একখানি বড়ো ছবি । আর এক পাশে রাধাকৃষ্ণ । এক পাশে মা কালীর ছবি ।আর আছেন শিবলিঙ্গ। পেতলের একখানি লক্ষী মূর্তিও আছে । এরা সকলেই সুসজ্জিত ।একেবারে ধোপদুরস্ত কাপড়চোপড় পড়ে সব সময় বিরাজমান । এমনকি পটচিত্রে মায়ের গুরুদেব রাম ঠাকুর যে বসে আছেন তিনিও ওই ছবিতেই জামা কাপড় ধুতি সব ই পড়েন দেখি । রাধা কৃষ্ণেরও নানা পোশাক । সে কৃষ্ণের রঙিন ধুতি ,গলায় পীতধরা ,মাথায় নকল চুলও লাগানো হয় পাথরের চুলের ঝুটির ভেতরেই বেশ সুন্দর করে গলিয়ে । রাধারানীকেও একই ভাবে চুল পড়ানো হয়।

           যা জানা গেল------ আজকের সান্ধ্য পুজোর আয়োজন করতেই নাকি মলি এসেছে আজ এই সময়ে আমাদের বাড়িতে । যেহেতু শিবানী পারবে না আজকে তাই তার আসা । 

   

         কিন্তু বুঝতে পেলাম পুজোর গোছগাছ বা ঠাকুরের পোশাক পরিবর্তন করার আগে সে বেশ কিছুক্ষণ সময় গল্প করতে চাইছে সে আজকে । এ কদিন আসতে পারে নি সেই জন্যেই কি সেই অভাবটুকু পুষিয়ে নিতে চাইছে আজ সে ?

        

            আমার যেন আজ কিছুই ভালো লাগছিলো না সে রকম । সেই যে সেই সকাল বেলায় সামনের বাড়ির মাসিমার বোন ঝি এসে কী এক তির্যক হাসি হেসে গেল যেন আড়চোখে ; আর তার পর থেকেই কেন জানি কেবলই মনে হচ্ছিলো , এ আবার কেমন অসহনীয়তা , যার কোনো অর্থ নেই অথচ তারই অর্থ যেন কীভাবে কীভাবে আমি বানিয়ে নিচ্ছি ! অথচ যে কথাটা শত চেষ্টা করেও মলিকে বলতে পারবো না । যদিও কীই বা এমন ঘটেছে , কোই এমন কিছুই তো ঘটে নি, যার একটা কিছু অর্থ বানিয়ে নিয়ে কাউকে কিছু একটা অন্তত বলা যায় ! কোনোভাবেই তার কোনো একটা রোমান্টিক রূপ তো বানিয়ে নেওয়া যায় না ! যদি বা বলাও যেতো কিছু তাহলেও কি সেটা শুনেও ও একটুও কি আনন্দ পেতে পারে ? নাকি তাকে বিমর্ষই করে দেওয়া হতো তাতে ? আসলে তো কোনো কিছুই না ।

          বয়স এমনই । বয়স এমনই সব তুচ্ছাতিতুচ্ছ কিছুকে নিয়ে কীভাবে যে একটুতেই রঙিন করে তোলে সব কিছু ! তার গভীর অর্থ করলে কী দাঁড়ায় , মাসিমার ওই বোনের মেয়েটিকে আমার খুব ভালো লেগেছে ! নাকি সে আমাদের বাড়িতে এলো না বলে , বা আসতে পারলো না বলে , এই বিষয়টা ভেবে , নিজের মনে নিজেই আমি এত সব বানিয়ে বেড়াচ্ছি ? 

           তার চাইতে যে এই মুহূর্তে এতটা আন্তরিকতা নিয়ে এসেছে , যে কিনা এতটা নিষ্ঠার সঙ্গে একটা দায়িত্ব পালন করতে এসেছে , তাকে খুব মন দিয়ে সময় দেওয়া উচিৎ নয় কি ?  যে কিনা সময়ে অসময়ে চা করে এনে মাথার কাছে ধরে ; ঘুমিয়ে থাকলে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় গভীর আহ্লাদে ; তাকে গুরুত্ব না দিয়ে কে একজন এসে বাড়ির ভেতরে ঘুরে গেল আর কী একটু কিছু বলে গেল , তাই নিয়ে এত অন্যমনষ্ক হয়ে যাবো কেন ? তার ওই কয়েকবার উঁকি ঝুঁকি মারাটাই এই মন মেনে নিচ্ছে এমন ভাবে ? আর সে দিন যখন বিসর্জনের লড়িতে উঠে বাবুঘাটে হারিয়ে যাওয়া ---- যখন এক কোণায় দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম ওদের যদি না পাই তাহলে এই রাতে একা একা বাড়ি ফিরবো কেমন ভাবে ! সেদিন তো এই মলিই খুঁজে বেড়িয়েছিল ; সেদিন যদি সে আর তার সমবয়সী দিদির মেয়ে দুজনে আমাকে খুঁজে না পেত তাহলে কী হতো ? তারপরে তো দুজনে দুটি হাত ধরে সহদর ভাইবোনের মতো যদি তুলে নিয়ে না আসতো , তাহলে কি বুঝতে পারতাম সত্যিকারের আন্তরিকতা কাকে বলে ! সে তুমি যেভাবেই ভাবো না কেন , সিদ্ধির নেশার জন্যেই নাকি তুমি এত সামান্য সময়ের মধ্যে ওরকম আন্তরিকতার স্পর্শ পেয়েছিলে ! সেই যে, ও যখন বলেছিলো নাকি ---- আরে আমি থাকতে তুই কি হারিয়ে যেতে পারিস !

        

          আহম্মক ! এই গল্পের ভেতরে এমন কোনো ইশারা নেই যাতে অন্তত এই ঘটনাটিকে বর্ণনা করে একটুও হাসাহাসি করা যায় ; তাহলে সেই সামান্য দুই একবার চাওয়াচায়ির ভেতরেই বা কী আছে ? 

           ভেতরের এত সব তোলপাড় মলিকে বুঝতে দেওয়া যাবে না । ওকে আজ বেশ সপ্রতিভ লাগছে । সে আজ ঠাকুর পুজো করে গল্প করে বিছানায় গড়াগড়ি করে , মাঝে মাঝে আমাকে গায়ে হাত দিয়ে ধাক্কা মেরে এটা ওটা খুনসুটি করে ওদের দেশের কথা বলে বলছিলো ---- এই সময়গুলো ওদেশে থাকতে কী করতিস ?

          বললাম , কী আর তেমনই বা ----- ওখানে তো সকলেই খুব তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা উতরোনোর পরপরই রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে নেয় ; একরকম নটা দশটা বাজলেই শুয়ে পড়ে। তাই যখন পড়াশুনা ছিলো তখন একরকম ছিলো, তা না হলে ঘুম , এই তো ;----- 

          তার ওই দেশে যেতে ইচ্ছে করে । বাবার কাছে যদিও গল্প শুনেছে নানা রকমের , তা একদিকে যেমন ভালো , আবার আর এক দিকে এতটাই তেমন খারাপ --- যাতে সত্যি সত্যিই খুব ভয় করে তার । অথচ দেশের বাড়ির সেই পুকুর নদী খাল বিল , গোয়াল ভরা গোরু বাছুর ---- গোলায় ধান , মাছ , এসবের গল্প শুনে তার মনটা চলে যেতো কেবলই ওদেশে । সে তো বাড়ির ছোটো মেয়ে , তাই বাবার কাছে শুয়ে শুয়ে রাতের বেলা হলেই এই সব গল্প হয় বাবা মেয়ের । তার বাবা নাকি আজও ওই দেশটিকে ভুলতে পারে নি । তার বাবা যেভাবে গল্প করে বলে তাকে, তাতে তার মনে হয় তার বাবার দেশের বাড়িতে সে না পৌঁছতে পারলে কি হয় , সে যদি আমার সঙ্গে যেয়েও পারে তাহলে ওই দেশটাকে একবার অন্তত দেখে আসবে ।

          তার এই বাসনা আমি হয়তো পুরন করতে পারবো না কিন্তু মনে মনে ভাবতাম এবং বলতামও যেন তাকে ------ কী এক অজানা অচেনা টানে এরা এখনো মুগ্ধ হয়ে আছে , তার বাবার মুখে শুনে সেই সব কথায় !

          আরো একটা কথা জেনে আশ্চর্য হতাম , তাদের বাড়িতে তারা যখন সকলে এক জায়গায় হয় বাবা মা ভাই বোন, এখনো তারা সেই দেশের ভাষার টানেই কথা বলে দেখি ! এই যাইতাছি , খাইতাছি , করুম খানে , খামু খানে , কী করুম , কী করণের আছে , হোগো , হ্যাগো , এই সব কথার টানে তারা এখনো কীভাবে ওই দেশটাকে শুধু মাত্র মুখের ভাষায় কথা বলার ভেতরে এমন ভাবে রেখে দিয়েছে যে , তা শুনলে সত্যিই আশ্চর্য না হয়ে পারা যায় না ।

           তার বাবার দেশটি‌ আমার দেখা হয়নি । জানতাম শুধু মাগুরার সেই পুব দিকের পথটা যেটা পারনানদোল পার হয়ে চলে গেছে সোজা ঢাকার দিকে , ওই পথটাই নাকি ফরিদপুর বরিশাল চাঁদপুর  কুমিল্লা চট্টগ্রাম আরো সব কত দিকে যাবার পথ ; একটা মুখে গিয়ে তারপরে সব ভাগ হয়ে গেছে বুঝি ! 

          কল্পনায় এরকম তাদের একটা বর্ণ গন্ধ আমার মনের ভেতরে ভেসে উঠতো শুধু , এই যা , যা আমি ছেলেবেলায় নেয়েদের কাছের থেকেও শুনে শুনে একভাবে না একভাবে একটু একটু করে যেন অনুভব করতাম তাদের সেই সব দেশ গাঁ কেমন হতে পারে ! মনে মনে তাদের একটা রং দিয়ে এঁকে নিতাম । মনে মনে বলতামও ----- সে সব জায়গাগুলি মনে হয় আমাদের এখানের মতো না ! সেখানে মনে হয় সব সময় আকাশটা জল-জঙ্গলে আরো সবুজ ! নীল- সবুজের সেই আকাশ জলে জলে উছলে উঠতো স্টিমারের লঞ্চের সামনের ঢেউ ভেঙে ভেঙে চলে যেত যেন জলের ফেনা ভেঙে একের পর এক ---- কত সব লঞ্চ স্টিমারের সারি ! বড়ো বড়ো ছোই দেওয়া নৌকো, নৌকোয় পাল তুলে ভরে যায় সে সব দেশের নদী নালা খাল বিল গুলি ! নদীর দুপাড় দেখা যায় কোথাও ঝাপসা ভাবে , কোথাও বা খুবই স্পষ্ট । সে সব দেশে এ বাড়ি ও বাড়িতে যেতে গেলেও যেন এক একখানা ডিঙি নৌকো থাকে , যাতে চৈড় দিয়ে কিম্বা ছোটো বৈঠা দিয়ে , হাত পায়ের সংযোগে যেভাবে মালোরা আমাদের এইসব অঞ্চলে নৌকো বেয়ে খুব ধির গতীতে এগিয়ে নিয়ে যায় নৌকোটিকে , ঠিক সেই ভাবে যেন ওই সব দেশের স্থানীয় মানুষজনেরা তাদের পাড়া - ঘর গুলিতে একজন অপরজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে বুঝি ! 

          রাতের আকাশে মিশে থাকে কুয়াশার আস্তরণ ---- মাঠে-ঘাটে , সব সময় যেন একটা ভিজে ভিজে ভাব । বাতাসে লেবু ফুলের গন্ধ । ঝাউ বনে ঝাউ বনে ছাওয়া । বেত বনে বেত বনে হেলে আছে সমস্ত বুনো পথগুলি । মাঠের পর মাঠ শুধুই পাকা ধান গাছে নুয়ে আছে ঠাসাঠাসি করে । খালোই ভর্তি মাছ নিয়ে সকলেই ফিরে যায় সেই সব নদী নালা গুলি থেকে কী এক অদ্ভূৎ প্রসন্নতা নিয়ে ; সেখানে শুধুই বুঝি আনন্দ আর প্রেম ভালোসায় ভরা সেই প্রকৃতি , যা আমাদের এই দেশের থেকে আলাদা ! 

           মলিকে এসব ছেলেবেলার সব স্বপ্ন কল্পনার কথা , যা আমি সেই সব গুড়ের নেয়েদের কাছের থেকে একটু একটু করে সংগ্রহ করে রেখেছিলাম এতকাল --- ঠিক সেরকম স্পষ্ট করে হয়তো বলতে পারলাম না , তবে যেভাবে আজকের এই সন্ধেবেলাটা তাকে আমি দেশ প্রেমের মমতায় আচ্ছন্ন করে রাখতে চাইলাম , তা ভেবে কতটা যে মুগ্ধ হয়ে গেলাম মুহূর্তে , সব কিছুর অস্থিরতা নিমেষে কেটে গেল যেন । মনে মনে বললাম কার উদ্দেশ্যে, হে আমাদের ভাগ্যবান দেশ- গাঁ , আজও তুমি এই সব ফেলে আসা , হারিয়ে আসা , মানুষের সন্তানসন্ততিরাও তোমার সেই সুখ ও শান্তির  পৃথিবীতে আজও একান্তে কীরকম করে ভিজে ওঠে ! অথচ তারা যখন তাদের বাপ মায়ের কাছে সেই দেশটা ছেড়ে আসার প্রকৃত গল্পটা শোনে , তখন কেন জানি বিশ্বাস করতে পারে না , সে প্রকৃতির মানুষ গুলি এতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে ! যে দেশের মানুষে মানুষের সম্পর্ক এমন বাঁধনে বাঁধা ---- সেখানে হিংসা এমন ভাবে প্রবেশ পথ পায় কীভাবে ! আর সেই জন্যেই হয়তো আমরা বঞ্চিত হলাম সেই পৃথিবীর থেকে !

          হয়তো মলিরা ভেবেছে এসব কথা , হয়তো ভাবে নি ! কিন্তু আমার কেন জানি মনে হয় , মলি না ভাবলেও কী হবে , হাজারো মলিরা আজও তাদের বাবা মায়ের কাছে শোনা তাদের সেই পূর্ব পুরুষের ভিটেমাটি কথা উঠলে এ কথাটা একবারও না ভেবে পারে না । জন্মের মাটি সেই ধিক্কারের গ্লানির কথাই বারবার মনে করাতে থাকবে এইসব ছিন্নমূল সন্তান সন্ততিদের কানে কানে আরো অনেক দিন অবধি যেন ।

           কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর পরে চাঁদ ছোটো হয়ে আসলেও উঁকি দিয়েছে আকাশে অনেকক্ষণ । মলি চলে গেলে এ কদিনের সেই অভ্যাসের মোড়া খানি নিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে চুপ করে বারান্দার এক কোনাটিতে বসে থাকি আলো নিভিয়ে ।

            সামনের বাড়ির মাসিমার গলা পাওয়া যাচ্ছে ও বাড়ি থেকে । মাসিমার ছেলেমেয়েরা ও বাড়িতে আজ সকলেই আছে যেন । আর তার মধ্যে কখনোও কখনোও উচ্চগ্রামে ভেসে আসছে মাসিমার সেই বোনঝির গলাও । তার উপস্থিতিটা জানান দিচ্ছে সে তার কথাবার্তা র মধ্যে দিয়ে । যা এই বাড়ির বারান্দায় থাকলে বেশ স্পষ্ট শোনা যায় ।

         তাহলে কী দাঁড়ায় ---- আমিও কি তার গলার আওয়াজ শোনবার জন্যেই এখানে চুপ করে ওঁত পেতে বসে আছি ! 

         না না , এসব ভাবতে যাচ্ছি কেনই বা ! এতো গুরুত্ব পেয়েই বা যাচ্ছে মনের অজান্তে কেনই বা সে? তাহলে কি আমি মুগ্ধ হয়েছি ওই হঠাৎ দেখা অস্থির স্বভাবের চটকদার মেয়েটির প্রতি ! 

          মাসিমার বাড়ির পেছনের সেই আলোআঁধারিতে দোল খাওয়া ঝাউ গাছগুলিও যেন মাথার উপরে কৃষ্ণপক্ষে প্রবেশ করা ছোটো হয়ে যাওয়া চাঁদটিকে পেয়ে কী হাসিই না হাসতে লেগে গেছে ! কী তার অর্থ , কী তার ভাষা তা আমি কার সঙ্গে বসে বসে ভাগ করে নিতে পারি আজ , কেউ তা বলে দেবার নেই চারপাশে এখন । ভীষণ মনে পড়ছে আজ এই মুহূর্তে কেন জানি আর একজনের কথা , সেই যে আসার আগে যাকে সঙ্গে করে বৃষ্টিভেজা নদীর ভেতর ধোঁয়া হয়ে যাওয়া মামাদের নৌকা খানির উপরে দু-মাথায় দুজনে দুটি ছাতা মাথায় দিয়ে ছিপ ফেলে বসে থাকা সদা অস্থির সেই মেয়েটির কথাই মনে পড়তে লাগলো বারবার । কেন যে এখনি তার কথাটা মনে পড়ছে বারবার সেটিই বুঝে উঠতে পারছিলাম না । এসে অবধি কই এমন একদিনও তো তার কথা মনে করিনি ! তাহলে আজকেই বা কেন এখনি মনে পড়তে গেল সে ! বুঝে উঠতে পারি না । খানিকক্ষণ এদিক ওদিকে ঘোরাঘুরি করে আপন মনে এবারে বুঝতে পারলাম কেন ; কোথাও একটা শূন্যস্থানের জায়গাটায় অন্য আলো- বাতাস- হাওয়া এসে লেগেছে যেই ---- সেই সে এসে সেখানে নীরবে বসে পড়েছে ! সেখানে সেই যেন সাড়া দিলো আজ নানা অবহেলায় দূরে চলে যেয়েও । বললো যেন , কীরে , এত স্বার্থপর তুই ! আমি যে গোপন সেই আস্তানায় অতন্দ্র প্রহরীর মতো বসেছিলাম একা , সে কথা কি ভুলে গেলি ?

           কদিন খুব এলোমেলো ঘোরাঘুরি শুরু করেছি । যখন যেদিকে পারি চলে যাই । কখনো হয়তো হাঁটতে হাঁটতে হাজরা ভবানীপুর পার্কসার্কাস ধর্মতলা , হয়তো আরো একটু এগিয়ে কলেজস্ট্রিটের রাস্তাও ধরি । কখনো হয়তো পুরোটা না যেয়েই ফিরে আসি ।

           সকালে যে যে কাজগুলি আমি সংসারের করি , সেগুলিও কিছুটা ইচ্ছা মতো করে নিয়েই কাজের দিদিকে বলি , ''বেরোচ্ছি ।'' তারপর সোজা রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই এই সব জায়গা গুলির দিকে । ট্রাম ট্যাক্সি বাস লরি যা যা চলে কলকাতার পথে তারা তাদের মতো চলে। আমি হাঁটতে থাকি আমার মতো আপন মনে । কীসের খোঁজে ? কী কারণে হাঁটছি ? জানা নেই । হাঁটছি তো হাঁটছি-ই । যদি ক্লান্ত হয়ে যাই, তখন বাসে উঠে পড়ি। না হলে পথের পাশে বসে থাকি কিছুক্ষন। তারপর বাড়ির পথ ধরি আবার । খুব তৃষ্ণা পেলে রাস্তার ধারে যারা লেবুজল বিক্রি করে , তাদের কাছ থেকে দশ পয়শায় লেবুরজল কিনে খেয়ে নি । বাঁধা দোকানের ঠান্ডা বোতল বন্দী পানিও খেতে ইচ্ছা করলেও তার কাছে ঘেঁষতে পারি না ।

          অতো পয়শা পাবো কোথায় ?

          ফেরার পথে দিদির বাড়ির গ্রিলের দরজা ধরে দাঁড়াই । দিদি বলে , কী রে কোথায় গেছিলি এই রোদের ভেতরে ?

          বলি , এই হাঁটতে হাঁটতে একটু ধর্মতলার দিকে গেছিলাম ।

           সে বেশ খানিকটা অবাক হয়ে চেয়ে থাকে আমার মুখের দিকে কিছুক্ষন। তার পরে জিজ্ঞাসা করে , দুপুরে খেলি কোথায় ?

            বলি , না না , এই তো বাড়ি ফিরে খেয়ে নেবো । একটু জল দে না , ঠান্ডা জল ।

            সে ঘরে গিয়ে স্কোয়াশ মেশানো ফ্রিজের ঠান্ডা জল এনে দেয় । সঙ্গে একটা মিষ্টি কিছু । পরম তৃপ্তিতে খেয়ে নি । আসলে তো ওইটুকু পাবার ইচ্ছায়ই এই পথে আসা !

           তখন যদিও ওদের বিশ্রামের সময় । ভাগ্নেটিকে দেখি বিছানায় ঘুমোচ্ছে। তার হাতের মুঠোতে ধরা আছে একটি রুমাল । হয়তো বা কাপড়ের টুকরো। এটা ধরে রেখে ঘুমিয়ে পড়াই তার অভ্যাস । হয়তো এতেই সে তার মায়ের আঁচলের স্পর্শ নেয় মনে মনে ! ছোটো থেকেই ওকে ওরা আমার মায়ের কাছে রেখে দিয়ে যখন এদিকে ওদিকে ঘুরতে চলে যেতো , তখনই মা তাকে এই অভ্যাসটা ধরিয়ে দিয়েছিল । সেই থেকে সে শোয়ার সময় ওই কাপড়ের টুকরো টুকু নিয়ে নাকে মুখে বুলোতে বুলোতে ঘুমিয়ে পড়তো । সেই থেকে এই অভ্যাসে কাজের মেয়ে ছায়াও ওকে আগলে রাখতে পারে । ওই একটুকরো কাপড়ের টুকরোই হচ্ছে ওকে আগলানোর মক্ষম দাওয়াই ।

           ছায়া অনেক দিন আছে ওদের মধ্যে । সে ভীষণ পরিচ্ছন্ন । তাকে দেখে একটুও বোঝার উপায় ছিলো না সে যে কাজের লোক । দিদি না থাকলে ছায়াই আমাকে জল দেয় । এটা ওটা দিয়ে ভদ্রতা করে ।

          কোনো কোনো দিন ঠাকুমার বাড়িতে গিয়েও উপস্থিত হই ।সেখানে গেলে অবশ্য স্নান খাওয়া করেই বিকেলের আগে আগে বাড়িতে ফিরি । কাজের দিদি অপেক্ষা করে করে শেষে খেয়ে নেয় । প্রথম প্রথম কদিন এমন সব অবস্থায় সে না খেয়েই বসে থেকেছে , পরে আমার বলাতে এখন সে আর অপেক্ষা করে বসে থাকেনা আমার আসা অবধি । কদিন অবশ্য চেঁচামেচি করেছে , বলেছেও, ও ভাই এসব কী পাগলামী আরম্ভ করেছো তাই বলো তো ! মা শুনলি আমারেই তো বকাবকি করবে ! মানুষ তো শুনি বিকেলের দিকে হাঁটাহাঁটি করতে বের হয় , আর এ তুমি অসময়ে ঘুরে বেড়াচ্ছো ক্যান তাই কও দেখি ?

          এর মধ্যে শংকর ফোচন ওদের যদি সামনে পেলো তো আরো ভালো হলো, এবার তার সমর্থন পাবার লোকজন যেন পেলো সে  দুএকজন ---- তাদের সাক্ষী করে বলতে থাকলো , ও শংকর ভাই , ফোচন ভাই তোমরাই কও তো এই পাগলামী কারে বুঝোয়ে কোই আমি ! এই যে তোমরাও তো এসে এসে খোঁজ করে গেলে , ক্যান তাই বলো দিন দেখি ? আমি তোমাদেরই বা কি কতি পারিসি ; কইসি না , এই কদিন ধরিসে এই পাগলামী ; সকাল দশটার দিক হলিই , যেই না এদিককির সব হয়ে গেলো আর অমনি গুটি গুটি পায় দাদা আমার চললেন ! কোথায় যায় , কোথায় কোথায় ঘোরে কিছুই তো জানি না ভাই ; তোমরা একটু শুনে দেখ তো কী কয় ? 

          ফোচনের ঠাকুমা সন্ধ্যা বেলায় দেখা হলে একচোট বকাবকি করে ফরিদপুরে ভাষায় --- বলে , এডা তুই কি করতাছিস তাই ক দেহি ভাইডি ! এই বুড়া মানুষডারে শাস্তি দেওনের কি আছে তাই ক দিন দেহি ! এই বেচারি তো ভাইবা ভাইবাই মরে ---- আমি কতোবার আইসা খোঁজ কইরা গেছি তা জানস ? 

           চুপ করে থাকি । খানিকটা শুধু হাসি । মনে মনে যেন বলি ---- আমিও কি জানি ঠাকুমা , কেন আমারে এমন ভুতি ধরিছে !

          এক এক দিন সুজিত ভাইকে চা দেয় কাজের দিদি । সুজিত ভাই একদিন বারান্দার সিঁড়ি তে বসে চায়ের গেলাসে চুমুক দিতে দিতে বলে আমাকে দেখতে পেয়ে , শুনো ভাই , হামি বলি কি , এই কালো গাই কো ছোড় দো ; ---- মাইঝি ফিরে আসলে ইসকো ছোড় দেনে কে লিয়ে হামনে ভি মাইঝি কো বলুঙ্গা , ইসকো ছোড় দো মাই ; নেহি তো মুসিবত মে গির যায়েঙ্গে তুমলোগ ---- ইসকো আভি ভি কাচড়া নিকাল তা হায় । উ গাই ফিন গভনা নেহি হোগা । অভি তো ইসকো দুধ হায় ; ইসিবত ইসকো ছোড়ানে হোগা । নেহি তো বহুত নুকসান মে পড় যায়েগা তুমনে । ইসি কো গভনা হোনে কো কহি রাস্তা নেহি হ্যায় ।

           সে অর্ধেক হিন্দি অর্ধেক বাঙলা মিশিয়ে এটাই বোঝাতে চাইলো : কালো গাই কে ছাড়িয়ে দিতে বলছে সে । অর্থাৎ বিক্রি করে দিতে বলছে । তার ধারণা একে গাভিন করা সম্ভব না আর । এখনো সে দুধ দেয় , এর পর বন্ধ হয়ে গেলে সে তো বসে বসে খাবে । একটা গরুর খাবারের খরচ কি কম ! এখন যদিও তার যা দুধ আছে তাতে তার খোরাকি হয়েও উদ্বৃত্ত কিছু হয়তো থাকে , কিন্তু এর পরে দুধ কমে গেলে কী হবে? এর পরে তো বসে খাবে । যদি সে গাভীন হতো তাহলে আগামী দিনের আশায় তাকে খাইয়েপড়িয়ে লাভ ছিলো। তা না হলে খোরাকির যোগান আসবে কোথা থেকে ? 

         এ কথা তো এসে পর্যন্তই অল্প বিস্তর আলোচনা হতো দেখেছি সরকারদা বলে যে মানুষটি সে বারে এলেন তাকে কৃত্রিম ভাবে প্রজনন করানোর জন্যে ; সেই সরকারদাও বলে গেছে খানিকটা একই কথা শুনেছিলাম । 

           সরকারদা ফ্লাক্সের ভেতর করে কাঁচের টিউবের ভেতরে, সিমেন নাকি বলে তাকে ; সেটা বের করতো । তারপরে লম্বা একটা কাঁচের সিরিঞ্জের মতো জিনিস দিয়ে সেই টিউব থেকে টেনে নিতো সেই সিমেন , তারপরে সেটা কালো গরুটির যোনি পথে কী কায়দায় যে প্রবেশ করাতো তা ওই বাঁধাছাদা অবস্থায় দেখতে চাইতাম না । সেটা ওই সুজিত ভাই আর সরকারদার কবলে পড়ে কালো গরুটির সঙ্গেই চলতো জোরজবরদস্তি! 

            না দেখলেও পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুরো বিষয়টা ভাবতাম । এবং বেশ আশ্চর্যই হতাম । এভাবে যে হয় তা তো জানতাম না ! সত্যিই কি এভাবে হতে পারে ? মনে মনে তখন ওদেশে পৌঁছে যেতাম। দিদিমা যখন বলতো , মেনা গাইডা গরম হইছে। পাইচোরে ডায়ে নিয়ে আয়গে দেখিনি । ওরে ধরাতি হবে তো !

           ধরাতি হবে কথাটা প্রথম প্রথম বুঝতাম না ভালো করে । তারপর যখন সেই ধরানো বিষয়টা নিজের চোখে পাঁচু ভাই-এর সঙ্গে যেয়ে দেখতে পেলাম, কীভাবে কীভাবে যে সে এ বাড়ি ও বাড়ি ঘরে ঘুরে খুঁজে খুঁজে বের করতো মুসলমান পাড়ায় গিয়ে, কার বাড়িতে ষাঁড় আছে , তারপর তাদের মালিককে রাজি করানো সেও তো কম ঝক্কির জিনিস না ! মেনা গাইকে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে তারপর তার কাছে ষাঁড় যোগাড় করে ছেড়ে দিয়ে আমাকে বলতো , ভাইডি, একটু দূরি সরে গিয়ে দাঁড়াও গে ; ডায়া গরু তো , বলা তো যায় না , বেকায়দায়ও তো ফেলতি পারে ; তহনে পড়বানে আর এক ঝক্কিতি !

             তখন আমি হয়তো দূরে যেয়ে কোনো গাছের নিচেয় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম , দাঁড়িয়ে থেকে দূর থেকে দেখতাম পাঁচু ভাই কী কায়দায় না পুরো প্রকৃয়াটা সামলে উঠতো ! হয়তো সঙ্গে স্থানীয় কেউ একজনকে পেয়েছে ঠিকই ---- কিন্তু তবুও বিষয়টা খুব সহজ ছিল না তো ; অনেকটাই ধ্বস্তাধ্বস্তির কাজই সে সব ।

           আর আজ এখানে সরকারদা একাই ষাঁড়। একাই পাঁচু ভাই । সমস্ত প্রকৃয়াটা তার একারই হাতে ?

           মনে মনে ভাবতাম স্বাভাবিক নিয়মে না গিয়ে এইরকম একটা নকল ব্যাবস্থায় এত বড়ো এবং এত সাধারণ প্রাকৃতিক একটি বিষয়কে কীভাবে যে সম্পন্ন করা যায় এটা তো ওই অজ গাঁয়ে থেকে দেখতে পেতাম না ! সত্যিই ভাববার বিষয় তো এটাও ; কেন যেন সরকারদাকে বলতাম ---- ও কাকু , ওরে ষাঁড়ের কাছে নিয়ে গেলি ভালো হতো না ? 

           সে তাতে বললো , হ্যাঁ, তা তো ভালোই হতো। তবে সে তো অনেক ঝক্কির ব্যাপার , তা ছাড়া এভাবেই তো হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ গরুকে ইনসিমেশন করানো হচ্ছে । 

           বললাম , তা হোক , আমার মনে হয় এবারে যদি না হয়, তাহলে পরের বার ষাঁড় দেখালি কেমন হয় ? 

           সে বলে , তা দেখা যাক , কিন্তু অত দূরের পথ ওকে হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে পারবা তো ? নরেন্দ্রপুর তো এখান থেকে কম পথ না ! তার জন্যে তো লোকজন লাগবে আবার ; তবে নিয়ে যেতে পারলে তো ভালোই হবে । ভালো ষাঁড় আছে এখন । তারেই দেখিয়ে দেওয়া যাবে । এখন দেখ এবারে যদি ধরে যায় ।

          ঠিক আছে , তালি ওই কথা থাকলো , মা আসুক কবানে দেহি , আপনার অফিসের ওহেনে ওরে নিয়ে যাওয়া যায় যদি , আর ইবারে যদি ধরে যায় তো তালি তো গেলোই , না হলি ওটাই করতি হবে ।

         এ সব যদিও সুজিত ভাই-এর কথাবার্তার কদিন আগের কথা । কিন্তু এর মধ্যেই সুজিত ভাই এরকম একটা সিদ্ধান্তের কথা বলছে কেনই বা , হতে পারে এরা তো গোয়ালা । গো পালনই এদের জাতীয় পেশা । হয়তো এমন কোনো লক্ষন তার চোখে ধরা পড়েছে যার কারণে তার এরকম কোনো কিছু মনে হয়েছে । 

         কিন্তু তার অর্থ কী এমন কোনো সিদ্ধান্তে এখনই পৌঁছোতে হবে এমনটা ভাবার প্রয়োজন আছে !

         যদিও সে বিষয়টা পরবর্তীতে আমার মায়েরও যেমন বিক্রি করার পক্ষে না, তেমন ভগ্নিপতি অশোকদারও না । আমার ধারণা কতোটুকুই বা , তাই তাদের এই সিদ্ধান্তে আমারও সমর্থন এই কথা ভেবেই গরুটি গাভীন না হলেই তাকে যে কশাই-এর হাতে তুলে দেওয়াটাই বিষয়ী ভাবনা, তাকেই বা সমর্থন করি কিভাবে ! 

          মনে মনে বলি যেন দেখাই যাক না , পরবর্তীতে এই কৃত্রিম ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে স্বাভাবিক নিয়মে তাকে ষাঁড় ধরিয়ে কিছু সুফল পাওয়া যায় কিনা ।

         দুপুর বেলাটায় ভীষণ একা লাগে । কিছুদিন কেউই আসে না তেমন । শুধু ফচনের ঠাকুমা আসে যখন তখন । ঠাকুমা সমস্ত দিনে-রাতে বার তিন চারও খোঁজ খবর নিয়ে যায় । লুডুর আসর বসে না কিছুদিন । মাঝে বেশ জমে উঠেছিল খেলাটা । পাশের বাড়ির অর্থাৎ আমাদের বাথরুমের ও পাশটায় যারা থাকে , ছোটো ডোবাটার ওপারে, আমাদের সীমানার প্রাচীর ডিঙালেই শান্তি ব্যানার্জীর বাড়ি । শান্তি কাকুর তিন ছেলে । তার মধ্যে বড় ছেলেটির সঙ্গে ওদেশে যাবার আগে আমার সম্পর্ক ছিল বেশি । কিন্তু আমার ওদেশে যাওয়া এবং ফিরে আসার মধ্যে সে যে কবে জলে ডুবে মারা যায় , সেটা আমি জানি না । কেন যে তাঁর মুখটাও আর মনে করতে পারি না কিছুতেই , তাও জানি না । 

         এখন তার পরের ছেলেটি যেহেতু শংকরদের বন্ধু সেই কারণে সেই ওদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে আসে । আজ কদিন হলো ফচনের ঠাকুমার সঙ্গে কাল্টুর ঠাকুমাও আসে এই বাড়ির লুডুর আড্ডায় । 


         এ সবে আমার খুব একটা অসুবিধা হয় না । কারণ তারা রান্না ঘরের খানিকটা এবং বারান্দার দরজার খানিকটা জুড়ে বসে । আমি ঘরের ভেতরেই থাকি । বিছানার সামনের জানলাটা খুলে কখনো চেয়ে থাকি , কখনো ঘরের সেই পিছনের জানলাটির সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি । দুপুরের আলোআঁধারিতে বাঁশ ঝোঁড়ের ভেতর দিয়ে ডোবাটির জলে পড়ে এমন এক বর্ণময় চিত্র তৈরি করে সেই যে ভাসিয়ে নিয়ে যায়----- এখনো তেমনিই । যাতে করে আমি আবার পেছনে ফিরে তাকাই । কোথা দিয়ে কীভাবে যেন ওদেশের সেই দুপুর বেলাগুলি আম কাঁঠালের বাগান ছাড়িয়ে গিয়ে একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়ে নবগঙ্গায় । সেই মাছরাঙার চিৎকার । কুবো পাখির কুব কুব । বউ কথা কও পাখির ডাক । জলে ঢেউ-এর শব্দ । রূপো রং ভেঙে যাওয়া । যতদূর নজর যায় নদীর বাঁক ঘোরার আগে পর্যন্ত ; নবগঙ্গা যেন তার নিজের রূপের মধ্যে নিজেই আহ্লাদিত হয়ে খিলখিল করে হেসে বেড়ায় । তার সমস্ত গন্ধ বাতাস এসে আছড়ে পড়ে যখন আমি এই সুমন্ত দাশের বাঁশ বনের ডোবাটির জলের দিকে চেয়ে থাকি । 

          শালিখ চড়াই-এর  উৎপাতে কাজের দিদি পেছনের জানলাটা খুলতে দেয় না ঠিকই। কিন্তু আমি খুলে দি বিশেষ করে দুপুর ও সন্ধ্যা বেলার দিকটায় । কেন যে দাঁড়াই ! যদিও জানি তো , সে আমাকে কেবলই ওদেশে পাঠিয়ে দেয় । কেবলই উপলব্ধি করায় তার এই বদ্ধ জলে ডাহুক বকের আনাগোনায় । ছোটো ছোটো মাছেদের নিঃশব্দ ঘোরাঘুরির ভেতর বলে যেন শুধুই , ভেবে দেখো , আবারও বলছি ভেবে দেখ , যা তুমি ফেলে এসেছো , তা ছিল কেমন ? এখানে তো তুমি ফিরে এলে এক হঠাৎ-এর টানেই বলা চলে । বিচিত্র একটি মুহূর্তের রোমাঞ্চ উপভোগ করবার জন্যে । কিন্তু তোমার ভেতরের মানুষটিকে কখনো কি প্রশ্ন করে দেখেছো কি সে তোমাকে কী কথা বলতে চায় ? সে কি সমর্থন যোগায় ? নাকি ,  এই কথা বলে কেবলই ---- তুমি বড় জায়গায় যাও , সেখানেই তোমার শিক্ষে হবে , সেখানেই তুমি খুঁজে পাবে তাঁকে, যার খোঁজ তোমার ভেতরে প্রতিনিয়ত রয়েছে .....। 

          কিন্তু কই, কিছুরই তো দেখা পাই না তেমন ভাবে , ভেতরের সেই অস্থিরতার খানিকটা হলেও অবসান হয় যাতে অন্তত ; তা না যার মধ্যে ডুবে যাই , সেই আমিও তো সেই-ই --- সেখানেও তো মনে করায় তারই কথা । যে তার কাছে ভেসে গিয়ে এই সমস্ত দিন রাত ফুরিয়ে ফেলাই আজও । সেই তাকেই তো খুঁজে ফিরি আবারও এই বাঁশ বনের ছায়ায় আলোআঁধারির ভেতর । ডোবা পানার জলে । বক ডাহুকের ঘোরাঘুরির মধ্যে । 

          কিন্তু সেই দেখা তোমাকে ভাসিয়ে রাখে কি , না একা হয়ে যায় ? একাকার হয়ে যায় ? সেখানে তাকে তুমি যেমন ভাবে দেখে এসেছিলে , এ যে ঠিক তেমন না ! এ যে আর একটা বাঁধানো ছবির মতোন ; সেকি পটচিত্রের দেশ গাঁ ? সেখানে যেন সে অন্য এক আকৃতি পেয়ে যায় । যেন অদৃশ্য এক মানসলোকে হানা দেয় এমনই এক বর্ণ গন্ধ নিয়ে , যেখানে এই আমি ও সেই আমি এক থাকি না । তবুও যেন অন্য এক আমি হয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি ! 

          নাকি সে তার অপার ঐশ্বর্যে তোমাকে নিয়ে সাঁতরে বেড়ায় আরো কত দূরে দূরে----- তা তুমি নিজেও যেন টের পাও না । তোমার যখন সম্বিত ফেরে , তখন মনে হয় না প্রশ্ন করতে , তবে যে রসিক দাদু বললো , তাই হক , তুই যা , তোর এবার শিক্ষেটা হওয়া দরকার .....।

          কোথায় দাদু আমি যে তাঁকে তন্ন তন্ন করে পথে পথে খুঁজে ফিরলাম ; কিন্তু কই , কিছুতেই তো তাকে খুঁজে পাই না ! এই তো সেদিন , গড়ের মাঠের পাশ দিয়ে কতবার চক্কর কাটছিলাম , সেই যখন আমার নিতান্ত ছেলে বেলা , সেই ছেলে বেলার মুখটাকে খুঁজে পেতে কত যে চেষ্টা করছিলাম ! সেই যখন আমার মাথায় একজিমা হয়েছিল বলে মা আমাকে ট্রফিকালে ডাক্তার দেখিয়ে ফেরার পথে গড়ের মাঠের পাশ দিয়ে পায়ে হাঁটিয়ে নিয়ে আসতো । সেই তখন মাঠের ভেতর দূরে দূরে দাঁড়ানো, সেই যে, আইসক্রিমের সাদা সাদা নাকি রঙবেরঙের গাড়িগুলির ডালা খুললেই যে কমলা রঙের আইসক্রিম বেরিয়ে আসতো ; আমি মার কাছে বায়না ধরতাম, "মা, মাগো, আমায় একটা আইসক্রিম কিনে দেও না ।"

          মা অতি কষ্টে দাম দর করে দেখতাম আমার হাতে একটা আইসক্রিম তুলে দিত । অথচ নিজে একখানা কিনে খেতে পারতো না । সেই আইসক্রিমের গাড়িগুলিকে কতদিন ধরে যে আমার অন্তরলোকে খুঁজে বেড়াচ্ছি ! কত দিন ধরে ! অজান্তে, একাকী ! কিন্তু কোথায় ? কোথায়ই বা আর তাদের আমি খুঁজে পাবো ! সেই দুপুর বেলার সুনসান ধর্মতলার নির্জনতা, তাকে কি আর খুঁজে পাওয়া সম্ভব? গড়ের মাঠের সেই হু হু হাওয়া ; যার ভেতর সেই আইসক্রিম ওয়ালাগুলি হেঁকে চলেছে ---- আ.. ই.. স.. ক্রি.. ম .... , আ ..ই...স... ক্রি....ম .......

          সেই সময়টাকে আমি কিভাবে ফিরে পাবো ?

          কিন্তু হ্যাঁ, ফিরে পেয়েছিলাম যেন অনেক অনেক কিছুকেই ---- যে আমায় সে দিন মুহূর্তের জন্যে হলেও দৃশ্যমান করে রেখেছিলো , আমার মায়ের অত্যন্ত কষ্ট করে আমার হাতে একখানা আইসক্রিম তুলে দেওয়া মুখখানাকে । সেদিন আবার মনে করতে পেরেছিলাম প্রকৃত আমার মায়ের মুখের ভেতর আরো কত মা এমন নিতান্ত কষ্ট করে পথ হেঁটেও নিজে না খেয়ে সন্তানের হাতে তুলে দেয় একটি আইসক্রিম।

           সেদিন শুধু আমি মাকেই মনে করতে পেরেছিলাম, বাবার মুখটা তো ঝাপসা হয়ে গেছে কবেই ; বাবা যেন কোথায় কত দূরে সেই পুরোনো গড়ের মাঠের আবহটার মতোন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে একটি বাঁধানো ফ্রেমের মধ্যে সমস্ত আকাশ বাতাস মেঘে মেঘে ; দুপুরের গনগনে রোদের প্রকৃতিটিকেও কী শীতল করে রেখেছে যে সেখানে ! যাকে আর আমি খুঁজে পাই না কোথাও । কোনোভাবেই। সেই কমলা রঙের আইসক্রিমটির গলে যাওয়া অরেঞ্জ বাসনার ভেতর । সমস্ত বর্ণই যেন পাল্টে ফেলেছে এখনকার আইসক্রিমওয়ালারা, সে তার সময়ের নিয়ম অনুযায়ী । 

            আর আমার মায়ের হাত ধরা সেই অনটনের শিশুটি ! হ্যাঁ ---- তাকেও আমি দেখতে পেয়েছিলাম সেদিন কোনো এক অতীত সময়ের চিত্রে --- যেখানে সে আর বড়ো হতে পারেনি কোনোদিনও।

           অথচ এই আমি কি সেই আমি ? যে আমির গায়ে আজ কত সময়ের দাগ এসে লেগে গেছে গোটা একটা দেশকে বিচ্ছিন্ন করে ! নানা দেশের নানা মানুষের হাহাকারের মধ্যে একটিই কথা নিয়ে , কোথায় আমার ঠিকানা ? কোথায় তুমি প্রকৃত আমার হলে? আমাকে নিয়ে তুমি শান্তিতে ঘুমোতে পারো? যাকে হারিয়ে খুঁজে বেড়ায় আমার মানসলোক, সেই তুমি কোথায় ? যে আমাকে এসে হাত ধরে ছুটিয়ে নিয়ে যাবে এমন এক জায়গায় , যেখানে আমার সমস্ত নিয়ে এক সঙ্গে বসে আছে কেউ । যাকে আমার অন্যমনষ্ক মন খুঁজে বেড়াচ্ছে ? তুমি কি বলে দিতে পারো কতকাল ধরে সেই তোমাকে আমি খুঁজে চলেছি ! যাকে আমি কেবলই হারিয়ে ফেলি এমন সব একাকী নিঃসঙ্গ দুপুর বেলায় ।

          পুরোনো আর এই চির নতুনের ভেতর যখন ওই বকটি উড়ে গেলো------ এই ডোবার জলের ভেতর থেকে কিছু একটা ছোঁ মেরে নিয়ে অন্য কোনো জলার উদ্দেশ্যে .....?


********************************************************************************************************

আগামী পর্বে


************************************************************************************************************

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন