মঙ্গলবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

উপন্যাস * বিশ্বনাথ পাল



[ 'স্বরবর্ণ'-এর বর্তমান সংখ্যা থেকে শুরু হল বিশ্বনাথ পালের ধারাবাহিক উপন্যাস 'বামনের চন্দ্রাভিযান'। উপেক্ষা, অনাদর আর দারিদ্র্যের তীব্র দংশনজ্বালা দাঁতে দাঁত চেপে, একটি যুবক কী ভাবে একক নিঃসঙ্গ লড়াইয়ে জীবনের সাফল্য ছিনিয়ে আনে, এই উপন্যাস তারই জীবন্ত আখ্যান। লক্ষ লক্ষ  বেকার যুবকের বেকারত্বের জ্বালার বাণীরূপই শুধু নয়, তা থেকে উত্তরণের অমোঘ বিশল্যকরণীও বটে এই উপন্যাস।]


বামনের চন্দ্রাভিযান 

বিশ্বনাথ পাল


‘এসবই রাত্রির কথা, রাত্রে কিনা হয়

কিনা বলে উন্মাদেরা কিনা করে লোভী

বিশ্বাস যাবে না বাবা বলি ভয়-ভয়

বামন হলেও চাঁদ ধরে কিন্তু কবি!’ 

—জয় গোস্বামী 



সেই দিনটার কথা আমার এখনও মনে পড়ে। ১৯৯৯ সাল। কাটাকলে ইকনমিক্স পড়তে গিয়েছি। একটা বেঞ্চে আমি আর প্রদীপ বসে। প্রদীপকে বললাম, “একটা কবিতা শোনা।” ও নিজের লেখা একটা কবিতা আবৃত্তি করতে লাগল। আর আমাদের সামনের বেঞ্চে বসা দু’টি মেয়ে পিছনে তাকিয়ে হাসতে লাগল। মিচকে হাসি। তাদের মধ্যে একটি মেয়ের রূপে আমি মুগ্ধ। হঠাৎ ইচ্ছে হল আলাপ করি। বললাম, “অ্যাই  তোরা হাসছিস কেন— ও নিজের লেখা কবিতা পড়ছে?” 

 আমার কথায় ওরা প্রদীপের কবিতা শুনল। তারপর ঠিক কী কথাবার্তার পর প্রদীপ আর আমার তর্ক শুরু হয়েছিল, মনে নেই। কিন্তু এটুকু মনে আছে তর্কের বিষয় ছিল মৃত্যু। আমি বলেছিলাম, “লেখক-শিল্পীদের মৃত্যুটা খুব ইমপর্ট্যান্ট।” যে মেয়েটিকে সুন্দরী মনে হয়েছিল (পরে তার নাম জানি—সুজাতা), সে দেখি প্রতিবাদ করল, “কেন মৃত্যুটা ইমপর্ট্যান্ট কেন? মৃত্যু তো মানুষের জীবনের একটা সত্য!” আমি ভ্যানগগের কথা বলেছিলাম… কীটসের কথা… জীনিয়াসরা ক্ষণজীবি, তাই তাঁরা জীনিয়াস— দু’-একজন ব্যতিক্রম ছাড়া। কিন্তু প্রদীপ এমন সব নাম বলতে লাগল, যা আমি আমার বাপের জন্মে শুনিনি। দু’টি মেয়ের কাছে এভাবে তর্কে হেরে যাওয়ায় আমার ইগো আহত হচ্ছিল। হঠাৎ শুনলাম, সুজাতা ওর বন্ধুকে বলছে, “ও বলে বিপদে পড়ে গেছে—মুখ এইটুকু হয়ে গেছে।” অর্থাৎ মৃত্যুকে ইমপর্ট্যান্ট বলে আমি বিপদে পড়ে গেছি।  

এরপর কিন্তু প্রদীপ নয়, সুজাতার সঙ্গেই আমার কথা হয়েছিল। জানতে পারি ওদের  বাড়িতে ‘দর্পণ’ পত্রিকা রাখে। ‘দর্পণ’-এ যা কবিতা বেরোয়, ও তা-ই পড়ে। সুজাতা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “চৈতালী সেনগুপ্তের কবিতা আমার কেমন লাগে।” অনল আচার্যর ‘আকাশে যখন চাঁদ ছিল’ ওর ভাল লেগেছে শুনে আমি বলি, “ওটা কিছুই হয়নি। অনলের ওই বইয়ের জন্য পুরস্কার নেওয়া উচিত হয়নি।” অথচ বইটা আমি পড়িনি। এরকম ভণ্ডামি আমার আছে। আমার  এক বন্ধু অয়নের মুখে শোনা কথা অনেকটা অয়নের মতো করেই বললাম। মানে আমি অনেকটা শুনে বৈরাগী। তাতে অবশ্য নিজের বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাবটা বজায় থাকল। যাইহোক, পরে সুজাতার একটা কথা নিয়ে ভেবেছি—‘মুখ এইটুকু হয়ে গেছে’। মানে মেয়েটা আমাকে বেশ বোঝে তো। আবার কবিতাও পড়ে। ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব হলে তো মন্দ হয় না! 

এর দু’-একদিন পরেই বোধহয় আমাদের ‘আকাশ’ গ্রুপের সম্মিলিত কাব্যগ্রন্থ সুজাতাকে পড়তে দিই। উদ্দেশ্য একটা ছিল। আমি কেমন কবিতা লিখি ওর মুখ থেকে শোনা। দু’-চার দিন বাদে বইটা ফেরত পাই। সঙ্গে মন্তব্য, “তোর কয়েকটা কবিতা ভাল লেগেছে।” আমি তাতেই খুশি।

তারপর একদিন অনেকটা ধান্দাবাজের মতোই ‘আকাশ’ পত্রিকার বইমেলা সংখ্যাটা সুজাতাকে গছাতে তৎপর হই। ওর একটা দুর্বলতা জানি, ও কবিতা পড়ে। আর আমাদের পত্রিকায় কবিতাই বেশি। 

ও পত্রিকাটা নেয় এবং বলে পরে টাকা দিয়ে দেবে। পত্রিকাটা বেশ মোটা, দাম পঁচিশ টাকা। কিন্তু বেশ কয়েক দিন কেটে যায়, দাম তো পাই না। পত্রিকার লেখালিখি নিয়ে কোনও মন্তব্যও শুনতে পাই না।

একদিন আর থাকতে না পেরে বিপ্লব দাশের একটা কবিতার বই, যা বইমেলায় কিনেছিলাম, সুজাতার কাছে নিয়ে গেলাম। একটা কবিতা বেছে ওকে পড়ালাম। তারপর জানতে চাইলাম, আমাদের পত্রিকাটা ও পড়েছে কিনা। উত্তরে শুনি শুধু আমার লেখা পড়েছে। ওই দিন আমি ওদের সামনে বসা, অথচ ওরা মানে সুজাতা এবং ওর আরেক বন্ধু দেবলীনা আমাকে কিছু না বলে কেমন গটগট করে উঠে চলে গেল। এটা আমার ভীষণ অপমানজনক মনে হল।

পরের দিন সুজাতা ‘আকাশ’ পত্রিকা ফেরত দিতে আসে। বলি, “একী! তোর পড়া হয়ে গেছে?”

“শুধু তোর লেখা পড়েছি।”

“তুই একটা কেন। পরে টাকা দিয়ে দিস।”

আমার কথায় ও আবার পত্রিকাটা ফেরত নেয়। আর আমার আপশোশ হতে থাকে এই ভেবে যে কেন ওকে কবিতা পড়াতে গিয়েছিলাম। ও নির্ঘাত ভেবেছে— টাকার কথা মনে করাতে গিয়েছি। সেটা সত্যি, কিন্তু তাই বলে টাকা দিতে দেরি হওয়ায় পত্রিকা ফেরত নিয়ে নেব, আমাকে এতটা ক্ষুদ্র মনের ভাবায় দুঃখ হল।  

আমাদের ডিপার্টমেন্টটা যে কাটাকলে তা আগেই বলেছি। যারা মেট্রো করে যেত, তারা  সাধারণত শ্যামবাজারে নেমে ডানলপ-অভিমুখী কোনও বাসে উঠে ইউনিভার্সিটি পৌঁছাত। আমিও মাঝেমধ্যে মেট্রোরেলে করে শ্যামবাজারে নেমে কাটাকলে যেতাম। 

একদিন মেট্রোয় সুজাতার সঙ্গে দেখা। ওকে একা পেয়ে কথা বলতে গেলাম। কী কথা বলেছিলাম মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে শ্যামবাজারে নেমে সুজাতা আমার অপেক্ষা না করে জোরে পা চালিয়ে চলে যায়। ওর পদক্ষেপের দ্রুততা ঘোষণা করছিল কাউকে এড়ানোর সচেতন প্রয়াস। আমি যে ওকে কবিতার বই পড়তে দিই, পত্রিকা গছাই, ও বন্ধুদের মধ্যে থাকলেও শুধুমাত্র ওর সঙ্গে কথা বলার জন্য ঝাঁপাই, কবিতা বোঝাতে চেষ্টা করি— এসব যে ওর প্রতি আমার দুর্বলতার প্রকাশ, এতদিনে এ ধারণা ওর হয়েছে। তাই আমাকে এড়িয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু আমার সুন্দর চেহারা না থাকলেও ছেলে হিসাবে যে খারাপ নই— এ বিশ্বাস আমার ছিল। প্রেম না-হয় না-ই হল, বন্ধুত্ব হতে আপত্তি কোথায়!

আমি ওর পিছু নিলাম। 

স্টেশন থেকে বাইরে এসে দেখলাম একটি মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে। মেয়েটিকে আগে দেখেছি কিনা মনে করতে পারলাম না। ওরা দু’জন একটা বাসে উঠল। আমিও ওদের বাসটাতেই উঠে পড়লাম। আমি স্বভাবতই লাজুক প্রকৃতির ছিলাম। তাই মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে বড় বিষয়ের অভাব বোধ করতাম। সুজাতার সঙ্গে কথা বলতে গেলেও আমার কবিতার বই পত্রিকা এসব ছলছুতোর প্রয়োজন পড়ত।  

সুজাতার সঙ্গের মেয়েটিকে দেখে মনে হল, সে-ও কাটাকলের যাত্রী। জিজ্ঞেস করলাম, “তুই কোন সেকশন?”

মেয়েটি উত্তর দিল, “সেকশন বি।”

বি মানে আমা্রই সেকশন। অথচ কী আশ্চর্য মেয়েটিকে আগে দেখেছি কিনা মনে করতে পারছি না। সুজাতার রূপে মুগ্ধতাই কি এর জন্য দায়ী ছিল?

যাইহোক, ওদের দু’জন এবং আমার— মোট তিনটে বাসের টিকিট আমি কাটলাম। সুজাতার আপত্তি শুনলাম না।

বাসটা মোটামুটি ফাঁকাই ছিল। হঠাৎ দেখলাম সুজাতা মুখে বাঁ-হাত চাপা দিয়ে হাসছে আর ওর বন্ধুকে নিচু গলায় কী-যেন বলছে। মাঝে মাঝে আমার দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছে। ওদের  মুখভঙ্গি দেখে মনে হল যে ওরা আমাকে নিয়েই কথা বলছে। সুজাতা কী বলেছিল শুনিনি। তবে আমি একশো ভাগ নিশ্চিত যে ওর কথার ধরন ছিল এইরকম— এই ছেলেটা আমার প্রেমে পড়েছে। বামন হয়ে চাঁদে হাত দেবার কী শখ! বাড়িতে বোধহয় একটাও আয়না নেই। 

শুধু দেখতে সাধারণ হওয়ার কারণে নয়, গরিব ছিলাম বলেও ও-কথা মনে হয়ে থাকবে।

সুজাতার সেই মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসি আমার বুকে আগুন ধরিয়ে দিল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, যে-করেই হোক সুজাতার অহংকার খর্ব করতে হবে। এবং আমার গুরুত্ব ওর মনে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

সুযোগও এল। একদিন শ্যামবাজার মেট্রো স্টেশনে সুজাতার সঙ্গে দেখা। একসঙ্গে বাসে কাটাকলে এলাম। এবারও বাসের ভাড়া আমিই মেটালাম। কাটাকলে নেমে রাস্তা পার হওয়ার সময় আমি আগে রাস্তা পার হয়ে যাই। আমার পার হওয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই একটা লরী চলে যায়। লরীটা ছুটে আসছিল দেখেও আমি বিপজ্জনকভাবে রাস্তা পার হই। লরীটা চলে যাওয়ার পর সুজাতা রাস্তা পার হয়। আমার দ্রুততায় ওর চোখের অবাক ভাব লক্ষ করে বললাম, “আমার মরার খুব শখ। মৃত্যুর প্রতি আমার একটা ফ্যাসিনেশন আছে।”

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে সুজাতার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপের দিন প্রদীপের সঙ্গে তর্কের বিষয় ছিল মৃত্যু। সুতরাং কথাটা আমার মুখে বেমানান শোনাল না। তাছাড়া একটু আগেই বিপজ্জনকভাবে রাস্তা পার হয়েছি। অবশ্য আমার এসব বলার উদ্দেশ্য সুজাতার মনে জমি তৈরি।

সুজাতা বলল, “আমরা এত কষ্ট করে মানুষজন্ম পেয়েছি আর তুই মরতে চাইছিস!”

“এই নিয়ে একটা কবিতাও লিখেছি—শুনবি?”

“বল।”

আমি আবৃত্তি শুরু করলাম—


“মাঝে মাঝে মরে যেতে খুব লোভ হয়

‘ধুষর কবি’-র মতো ট্রাম না-হোক

বাসের তলায় শুয়ে…

আমার অবশ্য অন্যমনস্কের ভান করতে হবে

কেননা তুমুল শব্দে কিছুতেই ভুলি না যে

রক্ত-মাংস, বিষাদ 

আহা বেঁচে থেকে একবার নেওয়া যেত যদি

মৃত্যুর স্বাদ!

বসন্ত উপড়ে গেছে ঝড়ে—

শুনে ভেঙে পড়ত না কেউ?

তোমার চোখের ভাষা একই থেকে যেত?

যদি জানা যেত কত নোনা জল

নৌকা পারাপার

বেঁচে থেকে একবার নেওয়া যেত যদি

মৃত্যুর স্বাদ!”

তারপর বললাম, “তোকে এভাবে রাস্তায় কবিতা শোনালাম বলে কিছু মনে করিস না। আমি এরকমই।” 

“কবিরা তো আনপ্রেডিক্টেবল্ই হয়।”

“আমার এক বান্ধবীকেও রাস্তা পার হওয়ার সময় কবিতা শুনিয়েছি।”

“তোরা দু’জনেই স্ট্যাম্পড হয়ে যাবি।” 

বলাবাহুল্য আমাদের মরুভূমির মতো শুষ্ক জীবনে প্রেমিকার মতো কোনও নদী তো দূরের কথা, বান্ধবীর মতো জলাশয়ও বিশেষ ছিল না। তবে সেই সময় ‘আকাশ’ পত্রিকা করার সুবাদে বইমেলায় আলাপ হওয়া স্বর্ণালী নামের একটি মেয়েকে সত্যিই রাস্তা পার হতে গিয়ে কবিতা  শুনিয়েছিলাম। তার কথা যথাসময়ে বলব।   

এখানে বলা দরকার যে সুজাতা কবিস্বীকৃতি দেওয়ায় আমি খুশি। তবে মৃত্যু নিয়ে কবিতা শোনানো কিছুটা ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল। মরার কথা তো আর সত্যি সত্যি ভাবি না। তবে মাঝেমধ্যে মৃত্যু নিয়ে আঁতলামি করতে ভাল লাগে। আমার দুর্বলতা সুজাতা আগেই জানত। এবার কবিতা শোনানো ও মরতে চাওয়ার মধ্যে যে বার্তা ওর কাছে পৌঁছল, তা হল—আমি তোমার প্রেমে পাগল। তোমাকে ছাড়া এ জীবন বৃথা। তোমাকে যদি না-পাই তবে মৃত্যুই আমার একমাত্র কাম্য।

ক্লাসের মধ্যে কিংবা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে সুজাতা সব সময় বন্ধুবান্ধব পরিবৃত হয়ে থাকত। তবে সকলের সঙ্গে ও মিশত না। ওর বন্ধু বলতে, যাদের ওর কাছাকাছি দেখতাম, সুলেখা ও দেবলীনা। আর একটি ছেলে, নাম শুভজিৎ, ‘এ’ সেকশনের, কিন্তু টিফিনের সময় এসে এই তিন জনের গল্পে যোগ দিত।


ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে সকলের সামনে সুজাতার সঙ্গে কথা বলতে আমার কেমন যেন লজ্জা করত। তাই অপেক্ষা করতাম কাটাকলে নেমে ক্যাম্পাসে পৌঁছানোর হাঁটা পথটুকুর জন্য। তবে সেটা সব দিন জুটত না। কারণ সব দিন তো আমি আর মেট্রোতে যেতাম না, বা গেলেও সুজাতার সঙ্গে দেখা হত না কিংবা দেখা হলেও ওকে একা পেতাম না। 

একদিন সকালে মেট্রোতে একা পেয়ে গেলাম। বাসে দেখি আমার ভাড়া কাটল। ইতিমধ্যে আমাদের পত্রিকার দাম মিটিয়ে দিয়েছিল। 

কাটাকলে নেমে হাঁটা পথের শুরুতে বললাম, “এ বছর ‘দর্পণ’ পুরস্কার কে পাচ্ছে জানিস—  নিরুপমা সেন। ‘স্বপ্নলতা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য।”

ভাবটা এমন যে আমি যে-সে লোক নই, ‘দর্পণ’ কে পাবে তা ঘোষিত হওয়ার আগেই জেনে যাই। প্রসঙ্গত বলি যে এই আগে জানাটা বিশেষ বাহাদুরির কাজ ছিল না। আমার এক বন্ধু নিরুপমা সেনের বিশেষ বন্ধু।

আরও বললাম পয়লা বৈশাখ ‘দর্পণ’ পত্রিকার সঙ্গে একটি আলাদা ক্রোড়পত্র দেবে। তাতে নিরুপমা সেনের সাক্ষাৎকার থাকবে।

দিন পনেরো কী সপ্তাহ খানেক পরে আমার কথামতো তাই ঘটল। অর্থাৎ নিরুপমাই পুরস্কার পেল, সাক্ষাৎকারও বের হল। এরপর মনে হল সুজাতার মনের কাঁটা ঘুরতে শুরু করছে।

এখানে আর একটা কথা বলা প্রয়োজন। আমি যে সুজাতার প্রতি আকৃষ্ট, ক্লাসের দেখি অনেকেই তা জানে। একদিন অনুপম বলল, “বস, ভালই তো ছক করছ।” 

এরমধ্যে একদিন একটা কাণ্ড করে ফেললাম। চুপিচুপি কাউকে কিছু না বলে ‘দর্পণ’ অফিসে গিয়ে চারটে কবিতা জমা দিয়ে এলাম। প্রচার ও মানে ‘দর্পণ’-কে বাংলা সাহিত্য জগতে এক নম্বর পত্রিকা বললে ভুল বলা হয় না। ‘দর্পণ’-এ কবিতা ছাপা হওয়াটা তরুণ কবিদের কাছে গর্বের বিষয়। কথাটা কাউকে না বলার কারণ আমার উচ্চাকাঙ্ক্ষা অনেকের পরিহাসের বিষয় হতে পারত। কিছুদিন আগেই আমার কবিতা পড়ে একজন স্বনামধন্য কবি আমাকে কোথাও লেখা না ছাপাতে বলেছিলেন। এই উপদেশ বা পরামর্শের তাৎপর্য আমাকে আহত করেছিল। মানে আমার কবিতা ছাপার অযোগ্য। ব্যাপারটা তাই গোপন রেখে কবিতা ছাপা হলে সবাইকে অবাক করে দেব ভেবেছিলাম। তাদের মধ্যে অন্যতম অবশ্যই সুজাতা। 

আমার কপাল ভাল ছিল বলতে হবে। মাস দুই পরে ‘দর্পণ’-এ আমার একটা কবিতা বেরোল। পঁচিশে বৈশাখ উপলক্ষ্যে এক বিশেষ সংখ্যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে এটাই আমার ‘দর্পণ’-এ প্রথম কবিতাপ্রকাশ। ‘দর্পণ’ পত্রিকায় একটা লেখাপ্রকাশ আমাকে কিছুটা সামাজিক সম্মান এনে দিল। ইউনিভার্সিটিতে অনেকের কাছে আমার খাতির বেড়ে গেল। যারা আমাকে শুধু নামে চিনত, তাদেরও কেউ কেউ কাছে এসে বলে গেল, ‘‘দর্পণ’-এ তোর কবিতাটা পড়লাম, ভালই লিখেছিস।” বলাবাহুল্য আমি এতটা আশা করিনি। তবে আশা ছিল সুজাতার নজরে অবশ্যই পড়ব।

হলও তাই। সুজাতা একদিন বলল, ‘‘দর্পণ’-এ তোর কবিতা বেরিয়েছে, বলিসনি তো?”

“তোরা তো ‘দর্পণ’ রাখিস। আর এতে বলার কী আছে?” এমন ভাব করলাম যেন ‘দর্পণ’-এ কবিতা ছাপা হওয়াটা আমার কাছে কোনও বড় ব্যাপার নয়।

বলল, “আমাদের বাড়িতে পত্রিকাটা একটু দেরিতে দেয়।” 


কবিতা পাঠানো ও ছাপা হওয়ার মধ্যবর্তী দু’মাসে আমার মনে পরিবর্তনের ঝড় উঠল। তার কারণও ছিল। সুজাতার একজন প্রেমিক আছে। নাম শুভজিৎ। খবরটা শুনে সত্যতা যাচাই না করেই বিশ্বাস করে ফেললাম। ফলে কয়েকদিন খুব কষ্টে কাটল। কারও সঙ্গে ভাল করে কথা বললাম না। আর দেখেওছিলাম সুজাতা সুলেখা বা দেবলীনার সঙ্গে শুভজিতকে আড্ডা মারতে। ফলে প্রেম থাকাটা অসম্ভব নয়। এই কারণেই হোক অথবা সেই মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসার প্রতিশোধেই হোক, আমি সুজাতাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করলাম। কিন্তু বেশ বুঝতাম ওর মনে আমার গুরত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

সুজাতা ওর বন্ধুদের নিয়ে ক্লাসের মধ্যে আগে যেখানে বসত, সেই জায়গা ছেড়ে আমার ঠিক সামনের বেঞ্চে বসতে লাগল। আমি চুপ করে থাকলে যেচে আমার সঙ্গে কথা বলত। কিন্তু বেশ বুঝতাম ওর কাছে আমার গুরুত্ব বাড়ল কি কমল তাতে আমার আর কিছু যায় আসে না।

আমার ততদিনে আলাপ হয়েছে মৌমিতার সঙ্গে। মৌমিতার মাধ্যমে সোনালি ও পাপিয়ার সঙ্গে।  তবে মৌমিতাই এই তিন বন্ধুর মধ্যমণি এবং আমার পছন্দ।

মৌমিতা স্মার্ট এবং সুন্দরী। সুজাতার থেকে যখন মন সরিয়ে নিচ্ছি একটু একটু করে, তখনই আমাকে ক্রমশ মুগ্ধ করছিল মৌমিতা। যে সুজাতার সঙ্গে একান্তে কিছুক্ষণ কথা বলা ছিল আমার গোপন প্রার্থনা, সেই সুজাতাকেও আর আগের মতো ভাল লাগছিল না। বরং মৌমিতার সঙ্গ আমাকে নতুন আনন্দে ভরিয়ে তুলছিল।

একদিনের কথা মনে আছে। সেদিন একটা খয়েরি পাঞ্জাবি পরে গিয়েছি। একটা ক্লাস হয়ে যাওয়ার পর পরের ক্লাসটা অফ। আমার পিছনের বেঞ্চে মৌমিতা একা বসে। তাকাতেই চোখ দেখে মনে হল আমার পাঞ্জাবি পরা রূপে আকৃষ্ট। আমিও সুযোগের সদব্যবহার করলাম। উঠে ওর পাশে গিয়ে বসলাম। তারপর কেন্দ্রীয় সরকারের পতন নিয়ে গল্প কিংবা তর্ক শুরু করলাম। আমি তখন ফুল ফর্মে। হঠাৎ চোখ গেল সুজাতার দিকে। শরীরিভাষায় মনে হল ওকে দেখানোর জন্যই এই তর্কের সখ্যতা। 

সেদিন কীভাবে যে এক ঘণ্টা কেটে গেল কেউ টের পাইনি। গল্পের মাঝে মৌমিতা একবার আমাকে বলল, “দেখ তুই একটা বিশাল ব্যাঙ্কের ম্যানেজার হলি— এটা তোকে ঠিক মানাবে না। মোটামুটি টাকাপয়সা থাকবে, যাতে লোকের কাছে হাত পাততে না হয়।” 

মেয়েদের বস্তুবাদী ভেবেই অভ্যস্ত। তাই মৌমিতার কথাগুলি আমাকে ডোবানোর পক্ষে যথেষ্ট  ছিল। আমি ওর কথায় খুশির ভাব গোপন করিনি। বলেছি, “জীবনে প্রথম কোনও মেয়ের কাছে এমন কথা শুনলাম, সেক হ্যান্ড।” আমি মৌমিতার হাত ধরেছিলাম।

এদিকে সুজাতার অশান্তি হয়তো বাড়ছিল। আর ও যে আমার বন্ধুত্ব চাইছিল এটা আমার একার উপলব্ধি নয়। একদিন ভাস্কর নামের একটি ছেলে, আমাদেরই ক্লাসের, ডেকে বলল, “শোন, তোকে কি কেউ প্রপোজ করেছে?”

বললাম, “না। কিন্তু কেন বল তো?”

“তুই উত্তমকুমারের মতো দেখতে তো তাই!” 

কিন্তু আমি আমার দিক থেকে ঠিক ছিলাম। না-পাওয়া প্রথম পছন্দ যখন মনে মনে ত্যাগ করেছি এবং দ্বিতীয় পছন্দকে গ্রহণ, তখন প্রথম পছন্দ সহজলভ্য হলেও কীভাবে গ্রহণ করব? 

সুজাতার যন্ত্রণা একদিন খুব নগ্নভাবে বেরিয়ে পড়ল। সুজাতা, দেবলীনা এবং ওদের পিছনে শুভজিৎ ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস থেকে বেরোচ্ছিল আর আমি ঢুকছিলাম। বোধহয় সিগারেট  আনতে  বাইরে গিয়েছি। কাউকে কিছু না বলে এবং সুজাতার সঙ্গে চোখাচোখির সুযোগ না দিয়েই ওদের অতিক্রম করলাম। হঠাৎ কানে এল সুজাতার গলা, “ও কবি-ফবি নয়, ও বলদ! বলদ!”

পরীক্ষা এগিয়ে আসছিল। কিন্তু পড়াশোনা আমার মাথায় কিচ্ছু ঢুকছিল না। মৌমিতার  সঙ্গলাভের আনন্দ তখন বড় প্রশ্নচিহ্নের মুখোমুখি। প্রশ্ন— আমি মৌমিতাকে যে চোখে দেখি মৌমিতাও কি আমাকে সেই চোখে দেখে। উত্তর ‘না’ হলেও সই, কিন্তু উত্তরটা জানা আমার জরুরি হয়ে উঠল। 

কাটাকলের নিয়ম, পরীক্ষার আগে দু’মাস পড়াশোনার জন্য ছুটি। স্টাডি লিভ। ছুটি  পড়ার আগের দিন রাতে পাপিয়াকে ফোন করলাম। পাবলিক বুথ থেকে। তখনও তো মোবাইলের চল হয়নি আর আমাদের বাড়িতে ল্যান্ডলাইনও ছিল না। মৌমিতাকে তখন আমার কিছু বলতে লজ্জা করত। প্রেমপ্রস্তাব দিতে তো করতই। কিন্তু প্রস্তাব দিয়েই কি প্রেম হয়! চোখের ভাষা পড়ে কি হয় না? কিন্তু আমি তখন বিচারবোধলুপ্ত খ্যাপা কুকুর। পাপিয়াকে বললাম, “আমার একজনকে ভাল লেগেছে।” 

“কাকে?”

“যাকে ভাল লেগেছে তাকে তুই চিনিস।”

“কাকে, মৌমিতাকে?”

“হ্যাঁ। আচ্ছা মৌমিতা কি তোদের কখনও আমাকে নিয়ে কিছু বলেছে? আর ও কি এসব কিছু বোঝে? যদি না বুঝে থাকে তবে আর বুঝিয়ে কাজ নেই।” 

“মৌমিতা ওসব বোঝে-ফোজে না।”

“তা-ও তুই একবার হিন্টস্ দে।”

“আচ্ছা। তবে মৌমিতার কাছে কোনও এক্সপেকটেশন না রাখাই ভাল।”


পরদিন পাপিয়ার কাছে যা শুনলাম তার অর্থ— মৌমিতার প্রচুর বন্ধু। ওর এখনও কোনও ফিলিংস্ আসেনি। আসলে বলবে।


সেদিন বিডিজি-র ক্লাস শেষ হলে পর আমি সুজাতার পাশে গিয়ে বসলাম। ওখানে সুলেখা শুভজিৎ এরকম কয়েকজন। মৌমিতা বোধহয় ভেবেছিল আমি ওর সঙ্গে কোনও আলোচনা করব।  দূরে দাঁড়িয়ে আমাকে কিছুক্ষণ দেখে চলে গেল।

সুজাতার পাশে বসেও ওদের আড্ডায় ঠিকঠাক অংশ নিতে পারছিলাম না। কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছিলাম আর ডান হাতের পাতা আমার নিষ্পলক চোখের সামনে নাড়িয়ে সুজাতা আমাকে ফিরিয়ে আনছিল। 


দুই


প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর আমার বুকে তীব্র জ্বালা অনুভব করলাম। অপমানের, ব্যর্থতার। অথচ মৌমিতার প্রতি কোনও রাগ হল না আমার। মনে হল মেয়েটার কোনও দোষ নেই। ওকে আরও সময় দেওয়ার দরকার ছিল। এত অল্প আলাপের প্রস্তাবের বিশ্বাসযোগ্যতা ওর সন্দেহজনক মনে হয়েছে। স্বাভাবিক। প্রত্যাখ্যানের কথাগুলো, যদিও তা পাপিয়ার মুখ থেকে শোনা, সারাক্ষণ আমার কানে বাজতে থাকল— ওর ফিলিংস আসেনি, আসলে বলবে। মনে হল এর মধ্যে যেন পুরো প্রত্যাখ্যান নেই, সময় চেয়ে নেওয়া আছে। কিংবা হ্যাঁ বলারও দরজা খোলা রাখা। সারাদিন, সারাক্ষণ মৌমিতার চিন্তা যেন আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখল। ইউনিভার্সিটি বন্ধ, স্টাডি লিভ। কিন্তু আমার পড়াশোনা লাটে। রাতের দিকে তাও টিউশনি পড়ানো থাকত বলে কিছুটা স্বাভাবিক থাকতাম, সময় কাটত। কিন্তু দিনের বেলা সময় কাটানো বিভীষিকা হয়ে দাঁড়াত। পড়তে পারতাম না। শুয়ে থাকতাম, কিন্তু ঘুমোতাম না। নিদ্রা ও জাগরণের মাঝামাঝি অদ্ভুত এক আচ্ছন্নতা গ্রাস  করে রাখত। সেই আচ্ছন্নতার মধ্যেও এক মুহূর্তের জন্যও মৌমিতার ভাবনা যেন ছিন্ন হত না।  

একদিন নিজের মধ্যে কামনার তীব্র ঢেউ অনুভব করলাম, যা কান্না হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। অথচ আমাদের বাড়িতে তো তেমন জায়গার বড় অভাব যেখানে কাঁদলে আমার কান্নার ইতিহাস গোপন থাকবে। আমার অয়নের কথা মনে পড়ল। অয়নের নিজস্ব একটা ঘর আছে।

সাইকেল চালিয়ে অয়নদের বাড়িতে গেলাম। অয়ন বাড়িতেই ছিল। অয়নের ঘরে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লাম। আমাকে জড়িয়ে ধরে অয়ন বলতে লাগল, “কাঁদছিস কেন? কী হয়েছে সমু আমাকে বল?” 


**************************************************************************************************

(আগামী সংখ্যায়)

***************************************************************************************************

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন