অসাধারণ একটি গল্প লিখেছেন তরুণ গল্পকার সন্দীপ মজুমদার। গল্পটি আয়তনে বড়, কিন্তু রহস্য- রোমাঞ্চে ভরপুর প্রেক্ষাপট প্রতিমুহূর্তে কৌতূহল জাগায় এরপর কী হবে। আর গল্পটির ভেতর ইতিহাস-ভূগোল- বিজ্ঞানের আশ্চর্য মিশেল লক্ষ করে অভিভূত হবেন পাঠক। পড়ে নেয়া যাক ----
ইনকুইজিশন ইন অরুণাচল
সন্দীপ মজুমদার
' ডঃ ডি. কে. রায়, ডঃ এস. শুভ্রমনিয়ম, ডঃ পি কুলকার্নি এই তিনজনই দেশের কৃতি বিজ্ঞানী এবং ভাইরোলজিস্ট । সকলেই নিজ, নিজ শহর থেকে নিখোঁজ হয়েছেন গত পরশু । আমার মনে হয় এই তিনজন প্রতিভাবান গবেষকের রহস্যময় অন্তর্ধানের এর মধ্যে কোনো পারস্পরিক যোগসূত্র রয়েছে ।’ বলে থামলেন গোয়েন্দা প্রধান প্রমোদ রঞ্জন চৌধুরী । সফল, বাঙালি গোয়েন্দা প্রধান হিসেবে ডিপার্টমেন্টে তাঁর যথেষ্ট সুখ্যাতি রয়েছে।
মিশনের নির্বাচিত টিম লিডার হিসেবে, অত্যন্ত গোপনীয় এই মিটিং এ অভিমন্যু উপস্থিত হয়েছে । মিটিং স্থল, গোয়েন্দা দপ্তরের একটি আন্ডারগ্রাউন্ড কক্ষ । অভিমন্যু উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল,‘স্যার, আই থিঙ্ক দিস ইস এ কন্সপিরেসি ।’
মিঃ চৌধুরী শান্ত কণ্ঠে বললেন,‘ইউ আর রাইট অভিমন্যু । আর এই ষড়যন্ত্রের পর্দাভেদ করে তোমাকেই প্রকৃত সত্য উদঘাটন করতে হবে । তাই সরকার এবং ডিপার্টমেন্ট তোমাকেই এই গুরুদায়িত্ব পালনের যোগ্য বলে মনে করছে । আর যেখানে ন্যাশনাল সিকিউরিটির প্রশ্ন থেকে যায়, সেখানে আমাদের পূর্ণ শক্তি দিয়ে এই ষড়যন্ত্রকে রুখতে হবে ।
তুমি জান প্রজেক্ট পি. ও.২১০, কিভাবে সারা বিশ্বের তাবড় গোয়েন্দা সংস্থা গুলির রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। সায়ানাইডের তুলনায় আড়াই লক্ষ গুন বেশি বিষাক্ত একটি তেজস্ক্রিয় পদার্থ, পোলোনিয়াম কে বায়োওয়েপন হিসেবে ব্যবহার, সংক্রান্ত গবেষণাকে ব্যাহত কিভাবে করা যায় সেই চেষ্টা চলছে ।
এর মধ্যেই দেশের তিনজন ভাইরোলজিস্ট এর নিখোঁজের ঘটনা, যথেষ্ট উদ্বেগের বিষয় । তাই আজকে আমরা একত্রিত হয়েছি, এরকম কোনো আশঙ্কার কথা ভেবেই । সন্দেহটা থেকেই যাচ্ছে বুঝলে অভি!’ অভিমন্যু দৃঢ় কণ্ঠে বলল,‘ইউ আর রাইট স্যার । আই উইল ট্রাই টু ডু, টু দি বেস্ট অফ মাই এবিলিটি ।’
‘থ্যাংক ইউ অভি, বলে কিছুক্ষন থেমে, মিঃ চৌধুরী সামনের ডিজিটাল স্ক্রিন এর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন । স্ক্রিন এ তিনজন বিজ্ঞানীর ছবি ও ডিটেইলস ভেসে উঠল । মিঃ চৌধুরী বললেন,‘অভি, ইনি হলেন কোলকাতা নিবাসী, ডঃ ডি. কে. রায় । দেশের অত্যন্ত নামী একজন ভাইরোলজিস্ট । খুব সম্প্রতি, ওনার একটি সফল গবেষণাকে স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্ব ।
খড়গপুর আই. আই. টি থেকে মাইক্রোবায়োলজি তে এম. এস. সি করার পর, উনি কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি র প্রফেসর ডঃ ডি. উলড্রিজ এর আন্ডারে দীর্ঘদিন গবেষণা করে পি.এইচ. ডি ডিগ্রি অর্জন করেন । পরে ওখান থেকেই পোস্ট ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করে, ক্যালিফর্নিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকায় বেশ কিছু বছর কাজ করে দেশে ফিরে আসেন । বর্তমানে তিনি একটি নামকরা ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক সংস্থার সিনিয়র ভাইরোলজিস্ট হিসেবে কর্মরত । কিন্তু অদ্ভুতভাবে তিনি গত পরশু নিখোঁজ হয়েছেন, তাঁর কোলকাতার বাড়ি থেকেই ।
এরপর মিঃ চৌধুরী পরের ছবিটি দেখিয়ে বললেন, ইনি হলেন ডঃ এস. শুভ্রমনিয়ম । উনি বেঙ্গালুরু নিবাসী, একজন ভাইরোলজিস্ট । বিজ্ঞানী হিসেবে ওনার রোটা ভাইরাস সংক্রান্ত কাজ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে । মূলত, রোটা ভাইরাসের, ভ্যাকসিন তৈরীতে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন । আন্তর্জাতিক জার্নালে তাঁর তিনশোর অধিক পেপার রয়েছে ।
মূলত রোটা ভাইরাসের সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্স নির্ধারণে, তিনি মাইক্রো লেভেল এ দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। এর আগে আফ্রিকায় তিনি দীর্ঘ গবেষণামূলক কাজে নিযুক্ত ছিলেন ।ইনিও নিখোঁজ হয়েছেন গত পরশু বেঙ্গালুরু থেকেই । এরপর তিনি এর পরের ছবিটিতে ক্লিক করলেন ।
ইনি হলেন ডঃ পি কুলকার্নি । মূলত মলিকুলার প্ল্যান্ট ভাইরোলজি, এনজাইমোলজি এবং প্রোটিন কেমিস্ট্রি বিষয়ক, তাঁর গবেষণা ইতিমধ্যেই নজর কেড়েছে বিশ্বের তাবড় বিজ্ঞানীদের । সম্প্রতি তিনিও দেশের একটি নামকরা প্রস্তুতকারক কোম্পানিতে, সিনিয়র ভাইরোলজিস্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন ।
অভি, তুমি জান, মূলত নিষ্ক্রিয় ভাইরাস বা তার দেহ থেকে নেওয়া স্পাইক প্রোটিন মানব শরীরে প্রবেশ করিয়ে, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্যই আমাদের শরীরে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয় । সম্প্রতি,বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পরা একটি মারণ রোগের ভ্যাকসিন প্রস্তুতির ক্ষেত্রে অন্যতম সফল বিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর নাম খবরের শিরোনামে উঠে আসে ।
বর্তমানে কর্মসূত্রে তিনি হায়দ্রাবাদে থাকেন । পরশু থেকে তারও কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না ।
অভিমন্যু বেশ মনোযোগ সহকারে পুরো বিষয়টা শুনে মন্তব্য করল,‘স্যার, আই থিঙ্ক, পুরো বিষয়টি তে দুটি সম্ভবনা থাকতে পারে । এক, হয়তো এরা কারোর দ্বারা ট্র্যাপড হতে পারেন । অথবা, তিনজনের মধ্যে পারস্পরিক যোগসূত্রের ভিত্তিতে কোনো বিশেষ কাজে লিপ্ত হতে পারেন । আসলে এদের মগজ, অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে যেমন ভালো কাজও হতে পারে, তেমনি মুহূর্তে মানব সভ্যতায়, বিপর্যয়ও নেমে আসতে পারে।’
‘ ইউ আর রাইট অভি । আর এই দ্বিতীয় বিষয়টিই সবথেকে বেশি ভাবাচ্ছে আমাকে ।আর ন্যাশনাল সিকিউরিটির প্রশ্নে এই নিখোঁজ সম্পর্কিত কোনো বিষয় কেই আমাদের হালকা ভাবে নেওয়া উচিৎ হবে না। ’ বললেন মিঃ চৌধুরী। অভিমন্যু আত্মবিশ্বাস এর সাথে বলল,‘ ডোন্ট ওরি স্যার । উই উইল সি এন্ড অফ ইট ।’
মিঃ চৌধুরী অভিমন্যুর পিঠ চাপড়ে বললেন,‘ আমি জানি তুমি পারবে অভি ।’তারপর একটু ভেবে , পকেট থেকে একটা পেনড্রাইভ বার করে, অভিমন্যুর হাতে দিয়ে বললেন,‘ অভি,এতে আরও কিছু ডিটেইল ইনফরমেশন রয়েছে ওনাদের সম্পর্কে, এটা তোমার কাজে লাগবে । আর মনে রেখ এই রহস্য উন্মোচনে, তুমি সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে কাজ করবে । আর যে কোনো প্রয়োজনে তোমার টিম সবসময় তোমার পাশে থাকবে । তুমি পুরোটা আমাকে রিপোর্ট করবে সিকিওর ফোন কলের মাধ্যমে ।
আজ ঠিক সন্ধ্যা সাতটায়, তুমি বাকি টিম মেম্বার দের সাথে মিট করবে, হোটেল শাহী ইন্টারন্যাশনাল এর ২০৩ নম্বর রুমে । ওখানে তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে । দেখবে ভালো লাগবে ।’
‘ থ্যাঙ্কস ফর এভরিথিং স্যার । জয়হিন্দ ।’বলে অভিমন্যু প্রস্থান করল ।
ধূসর মেগাসিটির, যান্ত্রিক ব্যস্ততা ঠেলে, অভিমন্যু পৌঁছল, নিয়ন আলো সুসজ্জিত এক রাজপথে ।কিছুটা গেলেই হোটেল শাহী ইন্টারন্যাশনাল । সুবিশাল পাঁচতারা হোটেলের সামনের পার্কিং এ গাড়িটা রেখে, ড্রাইভার বলল,‘স্যার, দিস ইজ হোটেল শাহী ইন্টারন্যাশনাল ।’
অভিমন্যু, ড্রাইভার কে কিছু নির্দেশ দিয়ে হোটেলে প্রবেশ করল । সুবিশাল হোটেল,আভিজাত্য ও প্রাচুর্যের ছোঁয়া তার প্রতিটি কোনায় । যে কোনো মানুষকে, প্রথম দেখায় তা মুগ্ধ করার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু অভিমন্যু অন্য ধাতুতে গড়া মানুষ । তাই যে কোনো জাগতিক বৈভব তার লক্ষ্যে কখনই বাধা সৃষ্টি করতে পারে না । হোটেলের রিসেপশসন থেকে একজন ওয়েটার এসে অভিমন্যু কে পৌঁছে দিল রুম নম্বর ২০৩ এর সামনে ।
ঠিক সাতটাই রুম নম্বর ২০৩ এর ডোরবেল বেজে উঠল । দরজা খুললো, অভিমন্যুর পরিচিত এক ব্যক্তি,নাম কৈলাস যোশি । অভিমন্যুর, রুমে প্রবেশ করা মাত্র, সকলের অভিব্যক্তিতে বেশ একটা চনমনে ভাব প্রকাশ পেল ।বহুদিন পরে কর্মক্ষেত্রে, পুরোনো সঙ্গীকে দেখলে যেমন হয়, ঠিক সেরকমই ।সকলে সমস্বরে বলল,‘ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম স্যার ।’অভিমন্যু হেসে সকলের সাথে কুশল বিনিময় করল ।
চারজনের টিম । এদের মধ্যে সিনিয়র মোস্ট অভিমন্যু । বাকি তিনজনের দুজন তার পূর্ব পরিচিত । এই গ্রূপের সর্ব কনিষ্ঠ সদস্য হল, বয়স ছাব্বিশের এক বাঙালি যুবক । নাম অর্ণব সামন্ত । সে একজন তুখোড় সাইবার এক্সপার্ট । এগিয়ে এসে, হাসিমুখে অভিমন্যুর সাথে করমর্দন করল অর্ণব অভিমন্যু বেশ সপ্রতিভ দৃষ্টিতে চেয়ে,অর্ণবের কাঁধে হাত রেখে বলল,‘ ওয়েলকাম টু আওয়ার গ্ৰুপ, অর্ণব ।’ অর্ণব শ্রদ্ধালু দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,‘ থ্যাঙ্কস এ লট ।বিয়িং এ এডমায়ারার, ইট মাই প্লেজার টু ওয়ার্ক উইথ ইউ স্যার ।’
কিছুক্ষন পরে, ডোর বেল টিপে ঘরে প্রবেশ করলেন একজন বয়স্ক ভদ্রলোক । সকলে ওনাকে দেখে বেশ অবাক হল । বয়স ষাটের কাছাকাছি,উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত চোখে রয়েছে অদ্ভূত সরলতা । অভিমন্যু মন্তব্য করল ,‘ হোয়াট এ প্লিস্যান্ট সারপ্রাইজ ডঃ রায় ! আমি তো ভাবতেই পারিনি এভাবে আপনার দর্শন মিলবে ।’ বয়স্ক ভদ্রলোক বললেন,‘ তোমরা আর শান্তিতে থাকতে দিলে কোথায় । মিঃ চৌধুরীর ফোন পেয়ে তড়িঘড়ি করে ছুটে এলাম । যেখানে ন্যাশনাল সিকিউরিটি চ্যালেঞ্জ এর মুখে, সেখানে আমি কলকাতায় বসে মৃত্যুর দিন গুনবো, সেটা কি করে হয় বলো ।’
ডঃরায়, অভিমন্যুর পূর্ব পরিচিত । এর আগে বহু কেস এ ওনার সাহায্য পেয়েছে ডিপার্টমেন্ট । অকৃতদার এই মানুষটি, হাসি মুখেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বারবার । অভিমন্যু বলল,‘ আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে চাই না স্যার।’ ডঃ রায় মৃদু হেসে জিজ্ঞাসা করলেন,‘অভি তোমার টিমের সাথে পরিচয় করাবে না?’
‘ অফকোর্স স্যার,’ বলল অভিমন্যু । পরিচয় পর্ব শুরু হল । অভিমন্যু প্রথমে অর্ণব কে ইঙ্গিত করে বলল,‘ও, সাইবার এক্সপার্ট অর্ণব সামন্ত । ’এরপর শিখা ও কৈলাস কে দেখিয়ে বলল,‘ ও শিখা, মানে শিখা দেশমুখ । আর ওর নাম কৈলাস যোশি । ’
এবার ডঃ রায় এর প্রতি ইঙ্গিত করে বলল, ‘ আর ইনি হলেন মলিকুলার ভাইরোলজির সিনিয়র প্রোফেসর ডঃ সুবর্ণ রায় । উনি কলকাতায় থাকেন । বিশেষ ক্ষেত্রে ওনার সাহায্য আমাদের প্রয়োজন হয় । ’ সকলে ডঃ রায় এর সাথে করমর্দন করল । অভিমন্যু কিছুক্ষন থেমে, ডঃ রায় কে আলাদা করে বলল,‘আসলে স্যার এরা সকলেই দক্ষ অফিসার। শিখা আমাদের থাইল্যান্ড এর এজেন্ট , সম্প্রতি এই বিশেষ মিশনের জন্য ওকে উড়িয়ে আনা হয়েছে । এদের বিশেষত্ব হল, এরা যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ঠান্ডা মাথায় লড়াই করতে পারে । অসম্ভব বুদ্ধিদীপ্ত, সাদামাটা চেহারার এই মানুষ দুটি একাধিক ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে এবং যে কোনো প্রকার অস্ত্র ও যানবাহন চালনায় এরা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ।’
পরিচয় পর্ব মিটলে, অভিমন্যু বলল, ‘এবার মূল প্রসঙ্গে আসি । আজকে আমরা এখানে একত্রিত হয়েছি একটি বিশেষ কাজের জন্য ।নিউজ চ্যানেল মারফত আপনারা বিষয়টি কিছুটা শুনেছেন হয়ত, যে আমাদের দেশের তিনজন নামকরা ভাইরোলজিস্ট, ডঃ ডি. কে. রায়, ডঃ এস. শুভ্রমনিয়ম এবং ডঃ পি. কুলকার্নি, গত পরশু থেকে রহস্যজনক ভাবে নিখোঁজ হয়েছেন । এই হাইপ্রোফাইল সায়েন্টিস্টদের নিখোঁজের ঘটনাটি স্বাভাবিক নয় । এর সাথে ন্যাশনাল সিকিউরিটির প্রশ্ন জড়িত রয়েছে । প্রপার ইনভেস্টিগেশন এর মাধ্যমে এদের খোঁজ চালানোর পাশাপাশি, নিখোঁজের কারণ ও খুঁজে বের করতে হবে ।’
এবার অর্ণব কে মিঃ চৌধুরীর দেওয়া পেনড্রাইভ টি দিয়ে, অভিমন্যু বলল,‘অর্ণব, প্লিজ ওপেন দিস পেনড্রাইভ ।’
‘ শিওর স্যার ’, বলে সে পেনড্রাইভ টি তার ল্যাপটপের সাথে সংযুক্ত করল ।
স্ক্রিনে ভেসে উঠল, নিখোঁজ তিন বিজ্ঞানীর ছবি সহ অন্যান্য ডিটেলস । অভিমন্যু, এদের সম্পর্কে অল্পবিস্তর কিছু ইনফরমেশন শেয়ার করল । সবটা শুনে শিখা দেশমুখ,কৌতূহলী দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে, প্রশ্ন করল অভিমন্যু কে, ‘ হোয়াট ইজ আওয়ার প্ল্যান স্যার?’
অভিমন্য বলল,‘ প্রথমত, এই তিনজন বিজ্ঞানীর বাড়ি ও ল্যাব সার্চ করে, সাম্প্রতিক কাজ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ। দ্বিতীয়ত, এনাদের লাস্ট জি. পি. এস লোকেশন, ব্যাঙ্ক ডিটেইলস সম্পর্কে খোঁজ খবর করা। তৃতীয়ত, এনাদের ফ্যামিলি ও বন্ধু বান্ধব, সহকর্মী দের ইন্টারোগেট করে এনাদের বিষয়ে জানা ।
অ্যালার্ম বাজা আর ঘড়িটা সজোরে থাবড়ানো – এর মধ্যের কিন্তু পুরোটাই করতে হবে অতি সন্তর্পনে, শত্রু পক্ষের নজর এড়িয়ে । তবে এর মাঝে কোনো থ্রেট এলে, থ্রেট এলিমিনেট করে আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে । অর্ণব, তুমি আমাকে এই তিনজন বিজ্ঞানীর যাবতীয় ব্যাঙ্ক লেনদেন,রিসেন্ট ফোন কলের ডিটেইলস ইনফরমেশন আমাকে দেবে । এছাড়াও ওনাদের ফোন নম্বরগুলো সার্ভিলেন্স এ ফেলে, নজরদারি চালাবে । যদি কোনো ইন্টেল মেলে, সাথে সাথেই আমাকে কন্ট্যাক্ট করবে ।’
‘ওকে স্যার’, বলে অর্ণব অভিমন্যুর কথায় সম্মতি জানাল । কালকেই আমরা তিনজন, আমি, শিখা এবং কৈলাস রওনা দেব এই তিনজন বিজ্ঞানীর হোমটাউন এর উদ্দেশে । ডঃ রায় আপনার সাথে ফিরে এসে দেখা হবে। সকলে অভিমন্যুর কথায় সম্মতি জানাল । অভিমন্যু বলল,‘নাউ ইটস টাইম টু মুভ অন, ফ্রেন্ডস ।’
‘জয়হিন্দ স্যার ’ বলে একে একে সকলে অভিমন্যুর সাথে করমর্দন করে, হোটেল রুম থেকে প্রস্থান করল ।
ভাইরোলজিস্ট, ডঃ ডি. কে. রায় এর বাড়ি সল্টলেকে । অভিমন্যু, বাড়ির গেটের কাছে যেতেই সিকিউরিটি তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল । নিজের আই কার্ড শো করতেই, সিকিউরিটি কিছুটা হতচকিত ভঙ্গিতে স্যালুট করে, ক্ষমা চেয়ে নিয়ে অভিমন্যুকে ভেতরে নিয়ে গেল ।একটা অল্পবয়সি মেয়ে অভিমন্যু কে, নিচের বসার ঘরে বসতে বলে, সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে অদৃশ্য হল ।
কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পরে, একজন মহিলা এসে উপস্থিত হলেন এবং সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে বললেন,‘নমস্কার আমি মিসেস শর্মিষ্ঠা রায় । কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না!’
‘আমি অভিমন্যু সেন, ভারতীয় গোয়েন্দা দপ্তরের একজন অফিসার বলতে পারেন । ডঃ রায় এর নিখোঁজ এর বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে এখানে এসেছি। আশা করি আপনি তদন্তে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করবেন ।’
মিসেস রায় এবার কিছুটা থতমত খেয়ে বললেন,‘ হ্যাঁ, বলুন কি জানতে চান!’ অভিমন্যু বলল,‘ আচ্ছা মিসেস রায়, যেদিন মিঃ রায় নিখোঁজ হন সেদিন আপনি কোথায় ছিলেন? উত্তরে মিসেস রায় কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললেন,‘ আমি বাড়িতেই ছিলাম । কিন্তু!’
‘কিন্তু কী?’ জিজ্ঞাসা করল অভিমন্যু।‘ একটা বার্থডে পার্টি ছিল সেদিন আমার এক বন্ধুর বাড়িতে । সেখান থেকে আমার ফিরতে একটু রাত হয়েছিল । মানে রাত প্রায় বারোটা । মিঃ রায় কাজ পাগল মানুষ । উনি এসব কোনোদিনই পছন্দ করেন না । তাই উনি বাড়িতেই ছিলেন ।’ বললেন মিসেস রায় ।’
‘ আপনি যখন বাড়িতে ফিরলেন তখন, তখন ডঃ রায় এর সাথে আপনার সাক্ষাৎ হয়েছিল?’ জানতে চাইল অভিমন্যু। ‘না, মানে সাক্ষাৎ ঠিক হয়নি । কিন্তু ওর ল্যাবে তখনও লাইট জ্বলছিল । তার মানে উনি তখনও ল্যাবে ছিলেন ।’বললেন মিসেস রায় ।
‘ লাইট জ্বলছিল মানেই আপনি নিশ্চিত যে উনি তখনও ল্যাবেই ছিলেন?’, অভিমন্যু সন্দিগ্ধ চোখে প্রশ্ন করল মিসেস রায় কে ।‘ নট শিওর । বাট, উনি যতক্ষণ ওনার ল্যাবে থাকেন ততক্ষন লাইট অন থাকে । তাই বললাম ।’ বললেন মিসেস রায় ।
‘ আপনি কখন লক্ষ্য করলেন যে, ডঃ রায় বাড়িতে নেই?’ অভিমন্যুর প্রশ্নের উত্তরে মিসেস রায় একটু ইতস্তত বোধ করে বললেন,‘সকালে । আসলে আমি খুব টায়ার্ড ছিলাম । তাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ।’
অভিমন্যু কিছুটা বিরক্তির সুরে বলল,‘ স্ট্রেঞ্জ! একটা মানুষ বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে গেল, আর আপনি সকালে জানতে পারলেন । প্রচন্ড হতাশাজনক উত্তর মিসেস রায় । মনে রাখবেন ডঃ রায় এর নিখোঁজ এর ঘটনাটা কোনো সাধারণ বিষয় নয় । উনি একজন হাই প্রোফাইল সায়েন্টিস্ট । তাই দুশ্চিন্তার যথেষ্ট কারণ রয়েছে । মিসেস রায় মাথা নিচু করে বসে রইলেন । তার চোখের কোন চিকচিক করে উঠল । ‘ আমি ওনার ল্যাবটি দেখতে চাই’, বলল অভিমন্যু । ঠিক সেই মুহূর্তে একটি ছেলে প্রবেশ করল ডাইনিং এ । অভিমন্যু সন্দিগ্ধ চোখে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,‘উনি কে?’
উত্তরে মিসেস রায় বললেন,‘ও আমার ভাই অতনু । পড়াশুনো শেষ করে ও, ওর জামাইবাবুর ল্যাব সহকারী হিসেবে কাজ করছে, বেশ কিছুদিন হল ।’
‘ অতনু বাবু, আপনি কতদিন ডঃ রায় এর সহকারী হিসেবে রয়েছেন?’ অভিমন্যুর প্রশ্নের উত্তরে ছেলেটি বলল,‘ আসলে উনি বিদেশ থেকে ফেরার পর থেকেই আমি ওনার সহকারী হিসেবে রয়েছি ।’
‘ ইদানিং কোনো বিষয়ে কী ডঃ রায় একটু উদ্বিগ্ন ছিলেন?’,জিজ্ঞাসা করল অভিমন্যু ।
‘ না । মানে সেরকম তো কিছুই বুঝতে পারিনি । তবে কিছুদিন আগে, যখন উনি ল্যাব একটা এক্সপেরিমেন্ট এ ব্যস্ত ছিলেন , ঠিক তখনই একটা ফোন আসে । পাশের ঘর থেকে ওনার উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসতে শুনি আমি । কিছুক্ষন পরে ফিরে এলে তাকে কিছুটা অন্যমনস্ক দেখায় । তবে কিছুক্ষনের মধ্যেই উনি স্বাভাবিক হয়ে আবার এক্সপেরিমেন্ট এ মনোনিবেশ করেন ।’
‘আচ্ছা, যেদিন উনি নিখোঁজ হোন, সেদিন আপনি কোথায় ছিলেন?’, প্রশ্ন করল অভিমন্যু ।
উত্তরে ছেলেটি কিছুটা ইতস্তত কণ্ঠে বলল,‘আসলে, আমি সেদিন একটু অসুস্থ বোধ করাতে উনি আমাকে বাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম করতে বলেন। তাই সন্ধ্যা আট টা নাগাদ, আমি বাড়ির দিকে রওনা দিই ।’‘ আমি, ওনার ল্যাবটি একবার দেখতে চাই অতনু বাবু ।’ বলল অভিমন্যু। ‘অফকোর্স স্যার’, বলে, ছেলেটি দ্রুততার সাথে অভিমন্যুকে নিয়ে ল্যাবের উদ্দেশে প্রস্থান করল । বিশাল জায়গা জুড়ে, ডঃ রায় এর ল্যাব । ল্যাবের দুটি অংশ । এর একটি দিক কিছুটা পুরোনো । অন্য দিকটি বেশ ঝাঁ চকচকে ।খুব সম্ভবত পরে তৈরী । অভিমন্যু এবং অতনু, বিশেষ এক ধরণের পোশাক পরিধান করে ল্যাবে প্রবেশ করল।
অতনু বলল,‘ ল্যাবের এই অংশটিতেই বেশিরভাগ সময় কাজ করতেন ডঃ রায় । ল্যাবটি তিনি নির্মাণ করেছিলেন বিদেশ থেকে ফিরে । আমার এই পুরোনো অংশটিতেই প্রবেশের অনুমতি ছিল । মেইনলি নন -প্যাথোজেনিক মাইক্রোবস নিয়ে এখানে কাজ হত । সম্প্রতি তার কাজের পরিধি এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, উনি এই ল্যাবে কাজ করতে পারতেন না । তাই ইদানিং তিনি বিশেষ কাজে মাসে দু-বার দেশের বাইরে যেতেন ।’
‘উনি সম্প্রতি কোন বিষয়ে কাজ করছিলেন এটা আমার জানা দরকার । এই সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন অতনু বাবু ?’ জিজ্ঞাসা করল অভিমন্যু ।
‘ স্যার, উনি সেভাবে কোনোদিন আমাকে কিছু বলেননি । তবে ইদানিং তিনি ইবোলা ভাইরাস নিয়ে দিনরাত স্টাডি করতেন । আমার অনুমান যে উনি এই ডেডলি ভাইরাস নিয়েই হয়তো কোনো কাজ করছিলেন ।’ অতনু বলল,‘সরি স্যার । ঐ ঘরটি ডঃ রায় এর ফিঙ্গার প্রিন্ট ও ফেস আনলক এর দ্বারা প্রোটেক্টেড । তাই ওনাকে ছাড়া কারোর প্রবেশ অসম্ভব ।’ অভিমন্যু বেশ অবাক হল পুরো বিষয়টিতে । তার মাথায় একাধিক প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে শুরু করল ।
অতনু বলল, ‘ তবে আমি যতদূর জানি স্যার, এই ঘরটিতে ওনার যাবতীয় কাজের থিওরিটিক্যাল পেপার, বিভিন্ন থিসিস এবং সাম্প্রতিক কাজের ডিটেলস রয়েছে । কারন এখানে ল্যাব ভিত্তিক প্র্যাকটিকাল ওয়ার্ক হলে তো আমাকে ওনার প্রয়োজন হত । কিন্তু এখানে আমার এন্ট্রি নেই, সেই ভিত্তিতে আমার অনুমান এখানে উনি থিওরিটিক্যাল ওয়ার্ক ই করেন ।’
অভিমন্যু বলল,‘ওকে অতনু বাবু, অনেক ধন্যবাদ । আজ চলি,কিন্তু ডঃ রায় এর খোঁজ না পাওয়া পর্যন্ত, আপনি এবং মিসেস রায় কেউই কোলকাতা ছেড়ে কোথাও যাবেন না । আমি প্রয়োজনে আবার আসব ।’ অতনু বলল,‘ অফকোর্স স্যার ।’
ডঃ এস. শুভ্রমনিয়ম, সম্পর্কে দু একটা কথা জিজ্ঞাসা করাতেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন মিসেস শুভ্রমনিয়ম । তিনি বারবার হাত জোড় করে মিনতি করতে থাকলেন । ওনাকে যত দ্রুত সম্ভব যেন উদ্ধার করা হয় ।
শিখা দেশমুখ ওনাকে শান্ত করে বলল,‘আপনি নিশ্চিত থাকুন, আমরা যত দ্রুত সম্ভব ওনাকে খুঁজে বার করবই । আচ্ছা, এবার আমাকে কতকগুলি প্রশ্নের উত্তর দিন মিসেস শুভ্রমনিয়ম ।’ তিনি বিস্ময়পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন, শিখা দেশমুখের দিকে। শিখা শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন শুরু করল । ‘আচ্ছা উনি কী কোনো কারনে একটু ডিসটার্ব ছিলেন কিছুদিন ধরে । আই মিন টু সে, ওনার আচরণে সেরকম কোনো অসঙ্গতি কী আপনি লক্ষ্য করেছিলেন?’
ক্ষনিকের বিরতিতে, সামান্য ভেবে উত্তর দিলেন মিসেস শুভ্রমনিয়ম । তিনি বললেন,‘আচরণে অসঙ্গতি কিনা বলতে পারব না । তবে ইদানিং উনি আমাকে একটু এড়িয়ে চলতেন । গভীর রাত পর্যন্ত জেগে বসে থাকতেন । জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, সেরকম কিছু না একটু কাজের প্রেসার রয়েছে । আমিও ওর ব্যস্ততার কথা ভেবে, বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিইনি ।’
‘আচ্ছা ডঃ শুভ্রমনিয়ম, রিসেন্টলি কোন টপিক এর উপর কাজ করছিলেন কিছু জানেন?’, জিজ্ঞাসা করল শিখা । মিসেস শুভ্ৰমনিয়ম বললেন,‘না, তা ঠিক বলতে পারবনা । তবে ইদানিং মাসে দু-বার ওকে বিদেশ যেতে হত। মাঝে মাঝে ফোনে উত্তেজিত ভাবে কোনো একটি ভাইরাস নিয়ে ও কথা বলতো ।’
‘ কি ভাইরাস?’,শিখার প্রশ্নের উত্তরে মিসেস শুভ্রমনিয়ম বললেন,‘ সরি,তা ঠিক এই মুহূর্তে মনে করতে পারছিনা ।’ দীর্ঘক্ষণের বাক্যালাপে ওনাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল ।
‘ওকে, আপনি একটু জলপান করুন’, বলে, জলপূর্ণ কাঁচের গ্লাসটি কিছুটা এগিয়ে দিল শিখা । দ্রুত জলপান করে, গ্লাসটি সেন্টার টেবিলে রেখে, মিসেস শুভ্রমনিয়ম আবার বলতে শুরু করলেন । ‘উনি বেঙ্গালুরুর একটা নামকরা ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক সংস্থায় গবেষণার কাজে নিযুক্ত ছিলেন । রোটা ভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির পরে তার সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পরে । কিন্তু, ওই সুনাম ও খ্যাতি কে বিসর্জন দিয়ে, কি কারনে জানি না, উনি ওই ভ্যাকসিন কোম্পানিতে গবেষণার কাজ ছেড়ে দেন এবং ঘন ঘন বিদেশে যাতায়াত শুরু করেন । আর ঠিক তখন থেকেই ওনার সেই প্রাণবন্ত ভাবটি ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকে ।’ শিখা দ্রুত একটি নোট বুকে বেঙ্গালুরুর সেই ভ্যাকসিন প্রস্তুত কারক কোম্পানির ঠিকানা নোট করল ।
এতক্ষনে মিসেস শুভ্ৰমনিয়ম অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছেন, মনের চাপা বেদনার কথা শিখাকে বলতে পেরে । ‘ আচ্ছা, ডঃ শুভ্রমনিয়ম যেদিন নিখোঁজ হন, সেদিন আপনি কোথায় ছিলেন?’ শিখার এই প্রশ্নের উত্তরে মিসেস শুভ্ৰমনিয়ম বললেন,‘ বাড়িতেই ।’ আসলে উনি গভীর রাত পর্যন্ত স্টাডি রুমে কাটাতেন । তারপর লনে কিছুক্ষন পায়চারি করে,শেষ রাতে ঘুমোতেন । কিন্তু সেদিন!’, বলে থামলেন মিসেস শুভ্রমনিয়ম ।
শিখা মন্তব্য করল,‘আপনি কন্টিনিউ করুন, মিসেস শুভ্রমনিয়ম ।’
‘ সেদিন একটা ফোন পেয়েই, হন্তদন্ত হয়ে রাত এগারোটা নাগাদ উনি বেড়িয়ে যান । আমি ভেবেছিলাম নিশ্চয় কোনো কাজে বেড়িয়েছেন, কিছুক্ষনের মধ্যেই চলে আসবেন । কিন্তু এরপর থেকেই উনি আর ফিরে আসেননি । পুলিশে ডায়েরি করলে, ওরা এসে নিজেদের মতো তদন্ত শুরু করেছে,কিন্তু কোনো সদুত্তর এখনো দিতে পারেনি ।’
এরপর শিখা, চটপট নোটবুকে ডঃ শুভ্রমনিয়ম এর গাড়ির নম্বর থেকে শুরু করে আরও কিছু ডিটেলস নোট করল । ওকে মিসেস শুভ্রমনিয়ম, আজ চলি। আপনি আমাদের উপর একটু ভরসা রাখুন । আমরা খুব দ্রুত ওনাকে খুঁজে বের করব ।
এরপর শিখা, ডঃ শুভ্ৰমনিয়ম এর পুরোনো কর্মস্থলে গিয়ে বেশ কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতেই জানা গেল, তিনি কোনো কারণ ছাড়াই হটাৎ ল্যাবের একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার কাজ অর্ধসমাপ্ত রেখে, সেখান থেকে রিজাইন দেন । ডঃ শুভ্রমনিয়ম বেশ প্রভাবশালী একজন সায়েন্টিস্ট হওয়ায়, কোম্পানি ওনার বিরুদ্ধে কোনো স্টেপ নিতে পারেনি ।
এরপর সেখান থেকে শিখা দেশমুখ রওনা দিল এস. পি অফিসের দিকে । এস. পি, ডি.রাঘবন কে নিজের পরিচয় দেওয়াতে কাজটা বেশ সহজ হল ।
‘ বলুন মিস শিখা দেখমুখ, আমি কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি এই কেস এ ।’ বললেন ডি. রাঘবন । শিখা জানতে চাইল,‘ ডঃ শুভ্রমনিয়ম রাত এগারোটা নাগাদ নিজের গাড়ি নিয়েই বাড়ি থেকে বেড়িয়েছিলেন, গাড়ির নম্বর, কে এ ০১ এম টি ৬৫৬৯, আপনারা কি কারটি কে ট্রেস করতে পেরেছেন?’
‘সরি, মিস শিখা, আমরা চেষ্টা করছি গাড়িটিকে ট্রেস করার । বিভিন্ন রাস্তার সি. সি. টি. ভি ফুটেজ চেক করা হচ্ছে । কিন্তু সব রাস্তায় সি. সি. টি. ভি না থাকায় আমরা পুরো তথ্য পায়নি । তবে দ্রুত ট্রেস করতে পারব, এই ব্যাপারে আমরা আশাবাদী ।’
‘আর কবে ট্রেস করবেন!’, শিখার কণ্ঠে স্পষ্ট বিরক্তি প্রকাশ পেল ।
‘ওনার সম্পর্কে কোনো তথ্য পেলেই, ইমিডিয়েট আমাদের ইনফর্ম করবেন । মিঃ রাঘবন, আপনি এখনও বুঝতে পারছেন না, ব্যাপারটা কতটা সিরিয়াস । এর সাথে ন্যাশনাল সিকিউরিটির প্রশ্ন যুক্ত রয়েছে । পি এম ও এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সরাসরি নজর রেখেছে এই ঘটনার উপর ।’ ,
শিখার এই বক্তব্যে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে, উনি বিস্মিত চোখে তাকালেন শিখা দেশমুখের দিকে এবং টেবিলে রাখা জলের গ্লাস তুলে নিয়ে রুদ্ধশ্বাসে একগ্লাস জল পান করে বললেন,‘ডোন্ট ওরি,মিস দেশমুখ, আমি আমাদের ডিপার্টমেন্ট এর তরফ থেকে আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি । কোনো ইনফরমেশন পেলে অবশ্যই আপনাকে জানাবো ।’
‘ওকে থ্যাঙ্কস মিঃ রাঘবন’, বলে নিজের ফোন নম্বর টি দিয়ে, শিখা দেশমুখ বেড়িয়ে এলেন এস. পি অফিস থেকে ।
ডঃ পি কুলকার্নির সহকর্মী এবং বন্ধু হলেন ডঃ বিক্রম দেশাই । ভদ্রলোক গুজরাটি । পুনের একই ইনস্টিটিউট এ এনারা দুজনেই কর্মরত । ইনি অত্যন্ত ব্যস্ত একজন মানুষ । বহু চেষ্টার পর কৈলাস যোশি সাথে একটা এপয়েন্টমেন্ট ফিক্সড করেছেন । ‘ব্লু অর্কিড’ রেস্তোরাঁ তে টেবিল নম্বর ২০ তে পৌঁছে, কৈলাস নিজের পরিচয় দিয়ে ভদ্রলোকের সাথে করমর্দন করলেন । ডঃ বিক্রম দেশাই এর বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি । চোখের দৃষ্টি উজ্জ্বল। তিনি কৈলাস কে নমনীয় কণ্ঠে বললেন,‘কুলকার্নি ইজ ওয়ান অফ মাই গুড ফ্রেন্ড, মিঃ যোশি । ইট ইজ মাই ডিউটি টু হেল্প ইউ ।’
কৈলাস ওয়েটার কে ডেকে দুটো ব্ল্যাক কফি এবং কিছু স্ন্যাক্স অর্ডার করে বলল,‘ থ্যাঙ্কস ফর কামিং, ডঃ দেশাই ।’ ডঃ দেশাই বললেন,‘প্লিজ স্টার্ট ইওর ইন্টারোগেশন মিঃ যোশি ।’
কৈলাস বিনম্র ভাবে বলল,‘ নো নো স্যার, ইট ইজ নট এন ইন্টারোগেশন, ইটস বেটার, ইফ ইউ সে ইটস এ কনভারসেশন। দুজনেই মৃদু হেসে কিছুটা সহজ হয়ে বাক্যালাপ শুরু করলেন ।
‘ ডঃ দেশাই, ডঃ পি. কুলকার্নি সম্পর্কে আমি সবটা জানতে চাই । মানে আপনাদের বন্ধুত্ব, উনি মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন, সম্প্রতি উনি কী ধরণের গবেষণায় সাফল্য পেয়েছেন – সমস্তটা আমাকে খুলে বলুন ।’ বলল, কৈলাস যোশি।
ওয়েটার টেবিল নম্বর ২০ তে কফি ও স্ন্যাক্স দিয়ে চলে গেল। কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে ডঃ দেশাই,স্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে থাকলেন এবং বলতে শুরু করলেন তাঁদের কলেজের দিনের কথা ।
‘আসলে কলেজে, কুলকার্নি আমার থেকে দু- বছরের জুনিয়র ছিল । কিন্তু আমরা একই হোস্টেল এ থাকতাম । সেই সূত্রে সম্পর্কের আন্তরিকতায় এক নিবিড় বন্ধন গড়ে উঠেছিল আমাদের মধ্যে ।সমবয়সী না হয়েও যে নিবিড় বন্ধুত্বের বন্ধন গড়ে উঠতে পারে, আমরা ছিলাম তার জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত । কলেজ পাশ করে মাস্টার্স করার পরে আমি ডক্টরেট ও পোস্ট ডক্টরেট করতে চলে যাই ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যান্ডফোর্ড ইউনিভার্সিটি তে। কুলকার্নি সুযোগ পায় কেমব্রিজে পড়ার । তারপর সেখান থেকে ভাইরোলজির একটি সম্পূর্ণ নতুন দিক নিয়ে, ডক্টরেট ও পোস্ট ডক্টরেট করে, কিছুদিন কেমব্রিজেই অধ্যাপনা করে দেশে ফেরে । ও বলত, অধ্যাপনা নাকি ওর পোষাচ্ছে না । ও সারাজীবন গবেষণাধর্মী কাজ নিয়েই থাকতে চাই । তারপর ২০১৪ সাল নাগাদ, আফ্রিকায় ইবোলা এপিডেমিক এর সময় ও আফ্রিকায় গিয়ে কাজ করার সুযোগ পায় । এরপর আমরা একসাথে কিছুদিন আমেরিকার একটা আন্তর্জাতিক ভ্যাকসিন প্রস্তুত কারক প্রতিষ্ঠানে কিছুদিন কাজ করি । পরে ওখান থেকে ফিরে এসে, আমরা পুনের একটা ইনস্টিটিউট এ জয়েন করি এবং গবেষণা মূলক কাজে ব্যস্ত হয়ে যাই । কুলকার্নির বুদ্ধি, মেধা, চিন্তাভাবনা বেশ ইউনিক ছিল । সম্প্রতি একটি ভয়াবহ মারণ রোগের এম আর এন এ ভ্যাকসিন তৈরী করে কুলকার্নি সকলকে তাক লাগিয়ে দেয়।
কৈলাস বলল,‘ডঃ দেশাই টেল মি সামথিং এবাউট এম আর এন এ ভ্যাকসিন ।’ ডঃ দেশাই বললেন,‘ ওকে, চেষ্টা করছি একটু সহজ করে বলার । দেখুন, আমাদের শরীরের অন্যতম জেনেটিক মেটিরিয়াল হল ডিএনএ । এই ডিএনএ থেকেই আমাদের শরীরে এমআর এন এ তৈরী হয় । এই প্রক্রিয়াকে বলে ট্রান্সক্রিপশন । এই এম আর এন এ বা মেসেঞ্জার রাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড, তৈরী করে প্রোটিন । আমাদের শরীরের সমস্ত কাজই প্রোটিনের মাধ্যমে হয় । যেমন ধরুন এনজাইম, হরমোন এগুলি সবই প্রোটিন । এই,এম আর এন এ ভ্যাকসিন এ থাকে এম আর এন এ, ফ্যাট, শর্করা,লবণ, জল ইত্যাদি ।
আমাদের দেহ কোষের মেমব্রেন লিপিড দ্বারা গঠিত হয় । তাই ল্যাবে এম আর এন এ, এর উপর একটি লিপিডের আবরণ তৈরী করা হয় । এম এর এন এ, যখন ভ্যাকসিন এর মাধ্যমে আমাদের কোষের মধ্যে চলে আসে, তখন তা প্রোটিন তৈরী করে ।
এখানেই আসল মজা লুকিয়ে রয়েছে মিঃ যোশি । এই এম আর এন এ, যে প্রোটিন তৈরী করবে তা হল ওই নির্দিষ্ট মারণ ভাইরাসের প্রোটিন । যাকে বলে স্পাইক প্রোটিন । একবার এই স্পাইক প্রোটিন তৈরী হলে, আমাদের শরীর এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে, এন্টিবডি তৈরী করতে শুরু করবে। যে এন্টিবডি এই প্রোটিনকে ধ্বংস করার কাজ করবে। সব খেলা এই এন্টিবডি সৃষ্টির জন্যই মূলত ।’
বেশ কিছুক্ষণ মনোযোগ সহকারে শোনার পরে কৈলাস যোশি সাগ্রহে একটা প্রশ্ন করল ডঃ দেশাই কে । ‘ আচ্ছা ডঃ দেশাই বিষয়টি কিছুটা আমার বোধগম্য হলেও একটা জিনিস জিনিস ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা, যে ওই মারণ ভাইরাস যদি প্রকৃতই আমাদের শরীরে প্রবেশ করে তাহলে এই ভ্যাকসিন কিভাবে কাজ করবে?’
‘ ভেরি গুড কোয়েশ্চেন মিঃ যোশি । আসলে যদি কোনোদিন ওই ডেডলি ভাইরাস আমাদের শরীরে প্রবেশ করে, তাহলে সেই ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের বিরুদ্ধ এন্টিবডি, আগে থেকেই আমাদের শরীরে তৈরী হয়ে থাকার জন্য ওই ভাইরাস আমাদের শরীরে সেরকম প্রভাব ফেলতে পারবে না । এটাই এই পদ্ধতির সাফল্য ।’
‘ ডঃ দেশাই, এই ভ্যাকসিন আবিষ্কার এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব কি ডঃ কুলকার্নির ?’, মিঃ যোশির এই প্রশ্নের উত্তরে ডঃ দেশাই বললেন,একদমই তাই । যদিও এটা একটা টিম ওয়ার্ক ছিল । তবে কুলকার্নিই দলের যোগ্য লিডার হিসেবে সমস্তটা প্ল্যানিং, ডিজাইনিং ও ইমপ্লিমেন্ট করেছিল।
আর এরকম একজন কৃতি ভাইরোলজিস্ট এর প্রচুর শত্রু থাকতে পারে। যারা ওর ব্রেন কে কাজে লাগিয়ে যে কোনো মারণ ভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রস্তুত করে ব্যবসায় মুনাফা লুটতে পারে । তাই ওর নিখোঁজ হয়ে যাওয়াটা বেশ চিন্তার ।’
‘ আচ্ছা ডঃ দেশাই, সম্প্রতি এমন কী কোনো ঘটনা ঘটেছে, যার ফলে ডঃ কুলকার্নি সম্পর্কে আপনার ধারণার কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছে?’ প্রশ্নবান ছুড়ল কৈলাস যোশি ।এই প্রশ্নে ডঃ দেশাই কিছুটা অপ্রস্তুত ও বিব্রত বোধ করে বললেন,‘থাক না ওসব কথা, না সেরকম কিছুই ঘটেনি ।’
কৈলাস যোশি, শান্ত কণ্ঠে বলল,‘ডঃ দেশাই আপনার বন্ধুর বড়ই বিপদ । প্লিজ আমাকে সব কথা খুলে বলুন ।’ ইতস্তত ভাব কিছুটা কাটিয়ে উঠে ডঃ দেশাই পুনরায় বলতে শুরু করলেন । দেখুন, ওর সম্পর্কে কোনো খারাপ কথা আমি বলতে চাই না । তবে ইদানিং বেশ কিছুদিন ওকে অন্যরকম দেখাচ্ছিল । একদিন জানতে চাইলাম কী হয়েছে । তাতে ও রেগে মেগে আমাকে মারতে উদ্যত হল।
নিজেকে খুবই হেল্পলেস লেগেছিল সেদিন । তারপর ও হটাৎ একদিন ল্যাবে আমাকে সরি বলে, ল্যাব ছেড়ে বেরিয়ে গেল । ওর এই অদ্ভুত আচরণেও আমি খুব অবাক হলাম । ইদানিং মাসে দু-বার করে, ল্যাবের কাজ ফেলে বিদেশ চলে যেত । আমি জানতে চাইলে আমাকে পর্যন্ত এড়িয়ে চলত। ও তো সংসার করেনি । বৃদ্ধ পিতা কিছুদিন আগে মারা গিয়েছেন । বাড়িতে ও একাই থাকত । আমার মনে হয় মেন্টাল প্রেসার থেকেই ও এই ধরনের আচরণ করছিল । তবে ওর এই অদ্ভুত আচরণে আমি হতবাক হতে পারি, কিন্তু ওর সম্পর্কে কোনো খারাপ জাজমেন্ট আমি কখনই করব না । ও আমার খুবই কাছের বন্ধু । ওর মত এত হেল্পফুল, নিঃস্বার্থ বন্ধু পাওয়াটা সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার । ওকে যে করেই হোক খুঁজে বার করুন মিঃ যোশি ।’
কল্যাণ যোশি বলল,‘আই উইল ট্রাই মাই লেবেল বেস্ট স্যার ।’
‘থ্যাঙ্কস মিঃ যোশি ’, বলে কিছুক্ষন চুপ করে রইলেন ডঃ দেশাই ।
‘ আচ্ছা ডঃ দেশাই, ওনার নিখোঁজের খবর আপনি কিভাবে জানতে পারলেন?’, পুনরায় প্রশ্ন করল কৈলাস ।
‘আসলে ও কিছুদিন ধরে ল্যাবে অনুপস্থিত দেখে,আমি চারিদিকে খোঁজ খবর শুরু করি । তারপর না খোঁজ পেয়ে এখানকার ডি. আই. জি সুখবিন্দর,ওকে পুরোটা জানাই । সে আবার আমাদের কমন ফ্রেন্ড । এরপর স্থানীয় পুলিশ অত্যন্ত তৎপর হয়ে খোঁজ খবর শুরু করে। জানা যাই, ওর গাড়িটা ট্রেস করা গিয়েছে । অসমের কাছে একটা পরিত্যক্ত রাস্তার ধারে সেটা পরে আছে । কিন্তু গাড়িতে কেউ নেই। অসম পুলিশ পুরো বিষয়টি কন্ফার্ম করেছে । পুনে থেকে অসমের দূরত্ব প্রায় ২৮০০ কিমির মত, এতটা রাস্তা আপনি ভাবতে পারছেন মিঃ যোশি!’ বলে মাথায় হাত দিয়ে কিছুক্ষন বসে রইলেন ।
এরপর একটা নোট বুক বার করে, কৈলাস যোশি, ডঃ কুলকার্নির ফোন নম্বর, গাড়ির ডিটেইলস এবং আরও কিছু প্রয়োজনীয় ইনফরমেশন লিখে নিয়ে বলল,‘ থ্যাংক্স এ লট ডঃ দেশাই, আমাকে এতটা সময় দেওয়ার জন্য ।
কৈলাস উঠে দাঁড়িয়ে করমর্দন করে বলল, আজকে চলি, আবার প্রয়োজন হলে আপনাকে বিব্রত করতে হতে পারে ।’
‘অবশ্যই করবেন, আর প্লিজ দেখুন কুলকার্নির যেন কোনো ক্ষতি না হয় ।’
‘ ডোন্ট ওরি স্যার, ইট ইজ আওয়ার ডিউটি টু ফাইন্ড এন্ড রেসকিউ হিম ।’ বলে কৈলাস রেস্তোরাঁর বিল মিটিয়ে বেড়িয়ে গেল । কিছুক্ষনের মধ্যে ডঃ দেশমুখ ও গাড়িতে উঠে বসলেন । কৈলাস যোশি রেস্তোরাঁ থেকে বেড়িয়ে যখন থানায় এসে পৌঁছল, তখন রাত প্রায় দশটা।
নিজের পরিচয় দিতেই লোকাল থানার ও. সি একটু নড়েচড়ে বসল । ডঃ কুলকার্নির নিখোঁজ এর ইনভেস্টিগেশন প্রসঙ্গে, জানতে চাইলে ও. সি, বিজয় লোখান্ডে যা বললেন তা হল,‘আমরা ওনার নিখোঁজ থাকার রিপোর্টের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করি । প্রথমে ওনার বাড়ি ও তার আশেপাশের এলাকার সি সি.টি. ভি ফুটেজ চেক করা হয় । সেখানে দেখা যায়, উনি ঐদিন আনুমানিক রাত দশটা নাগাদ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে একটা ধাবায় পৌঁছে,ফোনে বেশ কিছুক্ষন কথা বলেন । ধাবার সি সি. টি. ভি ফুটেজ থেকে আমরা এটা অবজার্ভ করি । প্রথমে এটুকু ইনফরমেশন ই আমাদের কাছে ছিল । এরপর ঝাঁসি, কানপুর, লখনউ, গোরক্ষপুর,পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি এমনকি অসম পর্যন্ত বিভিন্ন থানায় মেসেজ দেওয়া হয় । ওনার গাড়ির নম্বর, ছবি এবং অন্যান্য ইনফরমেশন দিয়ে ।
শেষ পর্যন্ত অসম পুলিশ কন্ফার্ম করে যে,এই নম্বরের একটা গাড়ি অসমের কালিয়াভমরা ব্রিজের নিকট পরিত্যক্ত রাস্তার ধারে ট্রেস হয়েছে । তবে রহস্যজনক ভাবে গাড়িতে কাওকে পাওয়া যায়নি । ব্রহ্মপুত্র নদের উপর নির্মিত, প্রায় তিন কিমি লম্বা এই ব্রিজ, অসম কে অরুণাচলের সাথে যুক্ত করেছে ।
প্রথমত, আমি অসম পুলিশের পাঠানো ছবি ও ফুটেজ দেখে অবাক হয়ে যাই । এতটা রাস্তা উনি নিজে ড্রাইভ করেছেন। উনি তো ফ্লাইট এও যেতে পারতেন ।স্যার, পুরো বিষয়টি তে বেশ সাসপেন্স রয়েছে । এই বিষয়ে আমি নিশ্চিত ।’ কল্যাণ যোশি বলল,‘প্লিজ সেন্ড মি অল ডিটেলস মিঃ লোখান্ডে । ’
‘ওকে স্যার বলে উনি কম্পিউটার খুঁজে সমস্ত ফুটেজ এবং অন্যান্য ডিটেলস সেন্ড করলেন কল্যাণ যোশি কে ।’
‘থ্যাঙ্কস মিঃ লোখান্ডে ’, বলে করমর্দন করে, থানা থেকে প্রস্থান করল সে । সঙ্গে নিয়ে গেল, একরাশ প্রশ্ন, কৌতূহল এবং রহস্য ।
অভিমন্যুর কেবিনে রুদ্ধদ্বার বৈঠক চলছে । ইনভেস্টিগেশন এর ডিটেইলস খুব ভালো করে স্টাডি করে, অভিমন্যু মন্তব্য করল,‘তিন জনের ক্ষেত্রেই কতকগুলো কমন ফ্যাক্টর রয়েছে । ’ সকলে কৌতূহলপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো অভিমন্যুর দিকে ।
অভিমন্যু বলল,‘প্রথমত, এই তিনজন সায়েন্টিস্ট এর ই বিদেশ যোগ রয়েছে । এনারা মাসে দুবার করে,কোন অজ্ঞাত কারনে দেশের বাইরে যেতেন বিষয়টা বেশ রহস্যজনক । এর কারণ আমাদের জানতে হবে ।
দ্বিতীয়ত, এনারা তিনজনই,২০১৪ সালে, আফ্রিকায় ইবোলা এপিডেমিক এর সময় ওখানে থেকে কাজ করেছেন । কী ধরণের কাজে এরা ইনভল্ভড ছিলেন তার ডিটেইলস জানা প্রয়োজন। তৃতীয়ত, তিনজন আলাদা শহরে থাকা সত্ত্বেও, সুনির্দিষ্ট কোনো মানসিক অবসাদের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন । এর কারণও অনুসন্ধান আবশ্যক ।’
এছাড়াও, ডঃ কুলকার্নির অসম এ পৌঁছে কোথায় নিখোঁজ হলেন? উনি কী স্বেচ্ছায় সেখানে গিয়েছিলেন, না যেতে বাধ্য হয়েছিলেন? বাকি দুজন সায়েন্টিস্ট কোথায়? পুরো বিষয়টা জট পাকিয়ে যাচ্ছে । অর্ণব, এদের ব্যাঙ্ক একাউন্ট ও কল ডিটেলস আমাকে দাও ।’ অর্ণব দ্রুততার সাথে, অভিমন্যুর হাতে একটা হার্ড কপি তুলে দিয়ে বলল,‘স্যার, এনাদের ব্যাঙ্ক একাউন্টে সম্প্রতি কোনো সন্দেহপূর্ণ লেনদেন হয়নি । তবে বেশ কিছু আই. এস. ডি কল হয়েছে । ’
অভিমন্যু খুব ভালো করে দেখে বলল,‘ স্ট্রেঞ্জ,এই আই. এস. ডি কোর্ড তো সাউথ আফ্রিকার । তার মানে তিনজনকেই সাউথ আফ্রিকা থেকে বার, বার ফোন করা হয়েছে । ’অর্ণব বলল,‘ স্যার, এই নম্বর গুলোতে কিছুতেই কল করা সম্ভব হচ্ছে না। খুব সম্ভবত সিম কার্ড ওরা নষ্ট করে দিয়েছে ।’
‘ অর্ণব, তুমি একটা কাজ কর । কোলকাতা, পুনে এবং বেঙ্গালুরু র এয়ারপোর্ট অথরিটির সাথে যোগাযোগ করে, এদের তিনজনের ট্র্যাভেল সংক্রান্ত একটা ডিটেইলস রিপোর্ট, তৈরী কর ।’ বলল অভিমন্যু। ‘ ওকে স্যার’, বলে অর্ণব কেবিন ত্যাগ করল । ঠিক সেই সময়ই শিখা দেশমুখ এর ফোন বেজে উঠল ।
শিখা বলল,‘ স্যার এস. পি, ডি রাঘবন ফোন করেছেন ।’ অভিমন্যু বলল,‘ফোনটিকে রিসিভ করে লাউড স্পিকারে দাও শিখা ।’ শিখা তাই করল ।
এস. পি, ডি রাঘবনের কণ্ঠ ভেসে উঠল । তিনি বললেন,‘ হ্যালো, মিস শিখা দেশমুখ, একটা গুড নিউজ রয়েছে, আমরা ডঃ শুভ্রমনিয়ম এর গাড়িটি ট্রেস করতে পেরেছি । অসমের কালিয়াভমরা ব্রিজ ক্রস করে অরুণাচলের রাস্তায় গাড়িটিকে উদ্ধার করা হয় । গাড়িতে অবশ্য কেউ ছিলনা । আপনাকে ফটো ও ডিটেলস সেন্ড করছি ।’
‘ ওকে, থ্যাঙ্কস ফর ইওর ইনফরমেশন মিঃ রাঘবন ’, বলে শিখা কলটি ডিসকানেক্ট করল । সমস্তটা শোনার পর, অভিমন্যু, সকলের কাছে অনুমতি নিয়ে কেবিনের বাইরে গেল এবং গোয়েন্দা প্রধান প্রমোদ রঞ্জন চৌধুরী কে সমস্ত ঘটনা ব্রিফ করল।
ফোনের বেশ কিছু কথোপকথন এর মধ্যে বেশ কিছু শব্দ অস্পষ্টতার আড়াল থেকে কিছুটা স্পষ্ট ভাবে শোনা গেল তা হল, গভর্নমেন্ট পারমিশন, অরুণাচল, লোকাল সোর্স এবং আর্মি ব্যাকআপ ।’অভিমন্যু পুনরায় কেবিনে প্রবেশ করল এবং ও. সি, বিজয় লোখান্ডে এবং এস. পি, ডি. রাঘবনের পাঠানো ইমেজ ও ফুটেজ গুলো, খুঁটিয়ে চেক করতে থাকল।
কিছুক্ষনের মধ্যেই অর্ণব ফিরে এসে জানাল,‘ স্যার, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট (কোলকাতা ), কেম্পেগোয়াডা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট (বেঙ্গালুরু ) এবং পুনে ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট (পুনে, মহারাষ্ট্র ), এই তিনটে এয়ারপোর্ট অথরিটির সাথে আমি কথা বলেছি । ওনারা প্যাসেঞ্জার ডিটেইলস ও সেন্ড করেছেন । ইনফরমেশন অনুযায়ী এই তিনজন সায়েন্টিস্ট ই মাসের চার ও কুরি তারিখ নাগাদ, দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যতম শহর, জোহানেসবার্গ এর উদ্দেশে রওনা দিতেন ।’
‘ স্যার, এই নিন,বিগত চার মাসের প্যাসেঞ্জার লিস্ট এর হার্ড কপি ।’
‘ ভেরি গুড জব অর্ণব! ’, বলে অভিমন্যু সমস্তটা খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করল এবং মাঝে- মাঝে বেশ অবাক হওয়ার অভিব্যক্তি ফুটে উঠল তার চোখে মুখে ।
অভিমন্যুর ফোন পেয়ে কিছুটা অবাক হল ডেভিড । সে ডিপার্টমেন্ট এর একজন দক্ষ আন্ডার কভার এজেন্ট,বেশ কিছু বছর সে জোহানেসবার্গ এ রয়েছে ।‘ হ্যালো, অভিমন্যু সেন স্পিকিং । হাউ আর ইউ ডেভিড?’ অভিমন্যুর প্রশ্নের উত্তরে ডেভিড বলল,‘ ফাইন স্যার ।’
‘ ডেভিড, আই নিড সাম আর্জেন্ট ইনফরমেশন ফ্রম ইউ ।’
এবার অভিমন্যু, তিনজন ভাইরোলজিস্ট এর ঘন, ঘন জোহানেসবার্গ যাওয়া থেকে শুরু করে তাদের মিসিং এর সমস্ত ঘটনা ব্রিফ করে, ডেভিড এর কাছে ওনাদের দক্ষিণ আফ্রিকা কানেকশন কারণ থেকে কাজের ডিটেল ইনফরমেশন চাইল।’ ডেভিড বলল,‘ওকে স্যার, বাট আই ওয়ান্ট সাম টাইম ।’অভিমন্যু,‘ ওকে, টেক ইওর টাইম ডেভিড ।’বলে ফোন রাখল।
কিছুক্ষণ পর, অভিমন্যুর কেবিনে প্রবেশ করলেন মলিকিউলার ভাইরোলজির প্রোফেসর ডঃ সৌনক রায় । অভিমন্যু ওনার কাছে পূর্ববর্তী ঘটনার কিছু বিষয় ব্রিফ করে বলল,‘ ডঃ রায় এখনও পর্যন্ত যা লিড্ মিলেছে, তাতে আমার অনুমান এই তিনজন ভাইরোলজিস্ট ই ডেডলি ইবোলা ভাইরাস নিয়ে কোনো কাজ করছিলেন । তবে এটা আরও নিশ্চিত ভাবে বলতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। যদি ওনাদের এই গবেষণার মাঝে কোনো ষড়যন্ত্রের বীজ লুকিয়ে থাকে তাহলে তা মানব সভ্যতাকে এক বিপর্যয়ের সামনে দাঁড় করাতে পারে ।তাই এই মিশনে যাওয়ার আগে, আমাদের এই ভাইরাস সম্পর্কে ডিটেলে জানা প্রয়োজন ।
তো, মিঃ এনসাইক্লোপিডিয়া, আমাদের ইবোলা ভাইরাস সম্পর্কে কিছু বলুন । মানে এর অরিজিন থেকে শুরু করে সবটাই জানতে চাই ।’ ডঃ রায় বললেন,‘ ওকে অভিমন্যু, যতটা আমি জানি সবটাই তোমাদের বলছি ।
এই ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৭৬সালের সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ । বেলজিয়ামে এন্টওয়ার্প বা আন্টভের্প নামে একটি শহর রয়েছে । এটা দেশটির ফ্লেমিশ অঞ্চলের আন্টভের্প প্রদেশের রাজধানী নগরী । সেখানে ইনস্টিটিউট অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন (আই. টি. এম ) নামে একটি সংস্থা রয়েছে । ১৯৭৬ সালে, এই ইনস্টিটিউট এ একটি গাঢ় নীল বর্ণের থার্মাল পার্সেল এসে পৌঁছায় । এই পার্সেল এর মধ্যে থাকা বরফের টুকরো ততক্ষনে গলে জল হয়ে গিয়েছিল । পার্সেলটি খুলে দেখা যায়, এর মধ্যে কিছু ছোট-ছোট শিশি রয়েছে । যাতে ছিল ব্লাড স্যাম্পেল । পার্সেল টি সুদূর আফ্রিকার, জাইরে থেকে বেলজিয়ামে এসেছিল।এই জাইরের বর্তমান নাম, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো ।
বেলজিয়ামের একজন ডাক্তার কর্মসূত্রে জাইরেতে থাকতেন । ওনার একজন পেসেন্ট, যিনি ছিলেন স্থানীয় একটি চার্চের নান । ডাক্তারবাবু কিছুতেই ওনার রোগ নির্ণয় করতে পারছিলেন না । শুধু এইটুকু তিনি জানতেন, যে এই রোগ জাইরের আরও কিছু মানুষের হয়েছিল এবং তাদের মধ্যে অনেকের ই মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে । এই রোগ নির্ণয়ের উদ্দেশ্যেই ডাক্তারবাবু ওই নানের ব্লাড স্যাম্পেল আই. টি. এম, এ পাঠিয়েছিলেন । আই. টি এম এর বিশেষজ্ঞ গণ, ওই স্যাম্পেল পরীক্ষা করে চিন্তিত হয়ে পরেন । কারণ
সেখানে উপস্থিত ছিল বাল্বের ফিলামেন্ট আকৃতির একধরণের জীবাণু । যার আকৃতির সাথে মিল ছিল মারবার্গ ভাইরাসের , এই ভাইরাসের কাহিনীও আফ্রিকার সাথে জুড়ে ছিল । এই ঘটনা ১৯৬৬ সালের । একদিন উগান্ডা থেকে আসা দুটি জাহাজ, জার্মানির দুটি শহর, ফ্রাঙ্কফোর্ট ও মারবার্গ এ এসে পৌঁছায় । এই দুটি জাহাজে ছিল উগান্ডার কিছু বাঁদর । যেগুলি মূলত বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য উগান্ডা থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল । কিন্তু এই বাঁদরগুলিকে গবেষণা কেন্দ্রে এনে কিছুদিন গবেষণা চালানোর পর, বেশ কিছু গবেষক রহস্যজনক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন ।
প্রায় ৩২ জন অসুস্থ গবেষক এর মধ্যে দুঃখজনক ভাবে সাতজন মারা যান ।বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে জানতে পারেন, এনাদের মৃত্যু একটি অজানা ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে হয়েছে । যেহেতু সংক্রমণের প্রথম ঘটনা মারবার্গ শহরে হয়েছিল । তাই এই ভাইরাসের নামকরণ করা হয় মারবার্গ ভাইরাস ।
আই. টি. এম এর বিশেষজ্ঞ গবেষক গণ, ওই থার্মাল পার্সেল এর মধ্যে উপস্থিত ব্লাড স্যাম্পল এ, মারবার্গ ভাইরাস সদৃশ জীবাণুর সন্ধান পেয়েছিলেন।প্রথমে ভাবা হয়েছিল, এই নতুন ভাইরাস ও হয়ত মারবার্গ ভাইরাস। কিন্তু আরও অনুসন্ধানের পর তা ভুল প্রমাণিত হয় । জানা যায় এটি একটি নতুন ধরণের ভাইরাস, যাকে পৃথিবী প্রথমবার দেখছে । বিশেষজ্ঞদল পুনরায় অনুসন্ধান শুরু করে, এই ভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে ।
এই ভাইরাস সংক্রমণের প্রথম কেস সামনে আসে, আফ্রিকার জাইরের মুকুগাও নামক স্থানে । এই মুকুগাও এর পাশ দিয়ে একটি নদী প্রবাহিত হয়, স্থানীয় ভাষায় এটি লেকবালা নামে পরিচিত । প্রায় ২৫০কিমি প্রবাহিত এই নদীটি কঙ্গো নদীর একটি অংশ । এই নদীটির ওপর নাম ইবোলা ।
এই ইবোলা নদীর নামানুসারে নতুন ভাইরাসের নামকরণ করা হয় ইবোলা ভাইরাস । ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে এই ভাইরাস আফ্রিকার দেশগুলিতে প্রচন্ড তান্ডব সৃষ্টি করেছিল ।১৯৭৬ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এটি ছিল, ভাইরাস কর্তৃক সৃষ্ট সবথেকে বড় মহামারি । আফ্রিকার গিনিতে, মিলিয়ান্ডো নামে একটি গ্রামের, একটি বৃহদাকৃতির উদ্ভিদের কোটরে বাস করত অসংখ্য বাদুড় । গ্রামের বাচ্চারা ওই গাছে চড়ে খেলা করত এবং খেলার ছলেই তারা ওই কোটরে হাত ভরে বাদুড় ধরত । অনেক সময় সেগুলিকে আবার আগুনে ঝলসে খেত । ওই গ্রামের এমিলে -ও – আমুন নামের একটি বাচ্চা, সেও প্রতিদিন ওই গাছের নিচে বন্ধুদের সাথে খেলতে যেত ।
২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসের ঘটনা, সেদিনও এমিলে খেলাশেষে বিকেল নাগাদ বাড়ি ফেরে । কিন্তু রাত থেকেই ওর প্রচন্ড জ্বর হয় । ধীরে-ধীরে অন্যান্য কিছু লক্ষণও প্রকাশ পায় । কিছুদিনের মধ্যেই বাচ্চা টি সেই অজানা জ্বরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে । এমিলের মৃত্যুর কিছুদিনের মধ্যেই, একই লক্ষণ নিয়ে তার মা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও মারা যান । এছাড়া বাচ্চাটিকে ঝাড়ফুঁক করতে আসা একজন স্থানীয় মহিলা এবং একজন নার্সের পর্যন্ত মৃত্যু ঘটে।
মজার বিষয় এই যে, ওই গাছটির উপরে একটি বড় মৌচাক ছিল । গ্রামের একজন মধু সংগ্রাহক, ওই মৌচাকে মধু সংগ্রহের উদ্দেশ্যে আগুন ধরিয়ে দেওয়া মাত্রই, আগুনের লেলিহান শিখা ওই গাছের বেশ কিছু অংশে ছড়িয়ে পরে । তখন ওই গাছ থেকে ঝাঁকে -ঝাঁকে বাদুড় বেড়িয়ে আসতে থাকে । বেশ কিছু বাদুড়ের আগুনে ঝলসে মৃত্যু হয় । গ্রামবাসীরা ওই মৃত বাদুড়গুলিকে নিয়ে গিয়ে, গ্রামেরই এক প্রান্তে স্তূপীকৃত করে ।তখন কেউ ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি, যে ওই বাদুড়ের স্তূপ থেকেই বিশাল মহামারি সৃষ্টি হতে চলেছে । কিছুদিনের মধ্যেই গোটা গ্রামে অজানা জ্বর ছড়িয়ে পরে । তাতে বহু আক্রান্ত মানুষের মৃত্যু হয় । ষাট দিনের মধ্যেই, এই অজানা মারণ রোগ ছড়িয়ে পরে সমগ্র গিনিতে ।
এর সংক্রমণের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যেই তা গিনি ছাড়াও ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো, রিপাবলিক অফ কঙ্গো, উগান্ডা, লাইবেরিয়া, সাউথ সুদান, সিয়েরা লিওন, গ্যাবন, আইভরি কোস্ট, নাইজেরিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সমগ্র স্থানকে গ্ৰাস করে ফেলে । মূলত এভাবেই ইবোলা মহামারি, হাজার, হাজার নিরীহ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল সেই সময় ।’
অভিমন্যু বলল,‘ ডঃ রায় আপনাকে একটু বিরত করছি । আসলে খুব জানতে ইচ্ছে করছে এই ভাইরাসের প্রকৃতি এবং সংক্রমণ উপসর্গ সম্পর্কে ।’
‘অভি, বিজ্ঞানীদের অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, ইবোলা হল ফিলোভাইরিডে ভাইরাস গোষ্ঠীর একটি জীবাণু । এটি মানব দেহে হেমোরেজিক জ্বর সৃষ্টি করে । সহজ অর্থে হেমোরেজিক মানে হল, মানুষের শরীরের মধ্যেই ব্লিডিং সৃষ্টি হওয়া রোগ ।
যেমন আমরা ব্রেন হেমারেজ এর কথা জানি । যাতে মস্তিষ্কের ভেতরের কোনো অংশে ব্লিডিং সৃষ্টি হয় । বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলতে গেলে,এই ভাইরাস হল একটি সিঙ্গেল স্ট্যান্ডার্ড আর. এন এ ভাইরাস । মূলত উনিশ হাজার নিউক্লিওটাইড বিশিষ্ট, এক সূত্রক আর এন এ ভাইরাস । এর পাঁচটি প্রজাতি রয়েছে। এগুলি হল যথাক্রমে ইবোলা -জাইরে, ইবোলা -সুদান, ইবোলা -আইভরি কোস্ট, ইবোলা -রেস্টন এবং ইবোলা -বুন্দি বুগিও।
ইবোলা ভাইরাসের সংক্রমণে প্রচন্ড জ্বর, বমি ও অন্যান্য উপসর্গ দেখা যায় । সংক্রমিত ব্যাক্তিদের মধ্যে পঞ্চাশ থেকে নব্বই শতাংশের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে। এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে এক মানবদেহ থেকে নির্গত ফ্লুইড এর মাধ্যমে অন্য মানব দেহে । ব্লাড ট্রান্সফিউশন এর মাধ্যমেও এই ভাইরাস অন্য মানবদেহে সংক্রামিত হতে পারে ।
বিশেষত, ভাইরাসের ক্ষেত্রে একটি বিষয় স্পষ্ট যে ভাইরাস একাকি বেশিদিন বাঁচতে পারেনা । এর বেঁচে থাকার জন্য কোনো জীবন্ত জীবের প্রয়োজন হয় । যাকে ভাইরাসের হোস্ট বলে । এই হোস্ট এর দেহ থেকেই সে একাধিক দেহকে বেছে নেয়, সংক্রমণ ও বৃদ্ধির জন্য । শিখা দেশমুখ বেশ উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করল,‘ স্যার, এই ইবোলা ভাইরাস কী ধারাবাহিক ভাবে পৃথিবীর বুকে মহামারি সৃষ্টি করেছে?’ ডঃ রায়, শিখার প্রশ্নে বেশ খুশি হলেন এবং বললেন,‘ জানো শিখা, ইবোলার বিষয়টি বেশ কৌতূহল পূর্ণ ।
কারণ,১৯৭৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত, এই ভাইরাসের কোনো ধারাবাহিক অস্তিত্ব ছিলনা ।১৯৭৭ সালের পর ১৭ বছর পুরোপুরি নিখোঁজ থাকার পর,১৯৯৪ সালে এটি পুনরায় আত্মপ্রকাশ করে । পরে ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত পুরোপুরি আবার নিখোঁজ হয়ে যায় ।এই অদৃশ্য হওয়া এবং পুনরায় হোস্ট খুঁজে মহামারির রূপ নেওয়া, এটিই এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য । হয়তো এই অদৃশ্য হওয়ার মাঝখানে এই ভাইরাস কোনো জীবের মধ্যে, মানে রিজার্ভার হোস্ট এর মধ্যে লুকিয়ে থাকে ।
যেমন, ইয়ালো ফিভার, নিপা এবং হেনড্র্যা ভাইরাসের ক্ষেত্রে এই রিজার্ভার হোস্ট হল বাদুড় । বিশেষত এশিয়ার ফল ভক্ষক বাদুড় । ইবোলার ক্ষেত্রে রিজার্ভার হোস্ট কারা এই নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে । বিজ্ঞানীরা প্রথমে ভেবেছিলেন যে আফ্রিকার জঙ্গলে থাকা শিম্পাঞ্জি, আফ্রিকান গ্রিন মাঙ্কি, বেবুন বা গরিলায় হল, ইবোলা ভাইরাসের রিজার্ভার হোস্ট । কিন্তু এই অনুমান সঠিক প্রমাণিত হয়নি । কারণ ইবোলা ভাইরাসের সংক্রমণে এই সকল প্রাণীদেরও মৃত্যুর ঘটনা সামনে এসেছে । সেক্ষেত্রে হোস্ট রিজার্ভার হলে এদের মৃত্যু ঘটত না। তবে শেষ সমীক্ষা অনুযায়ী বাদুড় কেই এর হোস্ট রিজার্ভার বলে মনে করা হচ্ছে । যদিও এর প্রামাণ্য নথি নেই ।’
এই বলে ডঃ রায়, তাঁর ইবোলা সংক্রান্ত আলোচনার ইতি টানলেন ।
অভিমন্যু মজার ছলে বলল,‘ডঃ রায়, আপনাকে নতুন করে আর ধন্যবাদ দিয়ে ছোটো করবো না । কিন্তু স্যার, কোলকাতা ফিরেই, আমি আপনার শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে চাই ।’
ডঃ রায় হেসে বললেন,‘ তোমার মত অবাধ্য ছাত্রের আমারও খুব প্রয়োজন অভি । আজকাল এরকম ছাত্র তো আর বিশেষ পাই না বললেই চলে, যার মনে সর্বক্ষণ কে, কি, কেন, কোথায়, কিভাবে এই সকল প্রশ্নই ঘোরাফেরা করে । জানো, সুইস সাইকিয়াট্রিস্ট কার্ল জুং এর বিখ্যাত একটি উক্তি রয়েছে । তিনি বলতেন,“ টু আস্ক দ্য রাইট কোয়েশ্চেন ইজ অলরেডি হাফ দ্য সল্যুশন অফ প্রবলেম ।” আর সত্যানুসন্ধানী অভি,এটি যে খুব ভালোই পারে সে বিষয়ে তো কোনো সন্দেহই নেই ।’
দু-জন জ্ঞানী মানুষের,পারস্পরিক বুদ্ধিদীপ্ত ভাব বিনিময়ের মাঝেই হটাৎ ছন্দপতন ঘটল,অভিমন্যুর সামনে থাকা ল্যান্ডফোনের ঝন ঝন শব্দে ডেভিড যে এত তাড়াতাড়ি ফোন করবে সেটা অভিও ভাবতে পারেনি ।
অভিমন্যু ফোন রিসিভ করে, ডেভিডের কথার প্রত্যুত্তরে বলল,‘ জয় হিন্দ ডেভিড । ইয়া ইয়া, ডোন্ট ওরি, দিস ইজ এ সিকিওর কানেকশন । টেল মি এভরিথিং ইউ নো ।’
বেশ কিছুক্ষন মনোযোগ সহকারে ডেভিডের সম্পূর্ণ কথা শোনার পর,‘থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ ডেভিড । ইউ হ্যাভ ডান এ গ্রেট জব ।টেক কেয়ার অফ ইওরসেলফ ’, বলে ফোনটি নামিয়ে রাখল অভিমন্যু ।
কোনো এক অজ্ঞাত কথোপকথনের গাম্ভীর্যতায় অভিমন্যুর ভাব ভঙ্গিমায় অদ্ভূত পরিবর্তন এনে দিল। শক্ত চোয়াল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, মুষ্ঠিবদ্ধ হাত যেন কোনোকিছুর অশনিসংকেত ।পুনরায় বেজে ওঠা ল্যান্ডফোনটির কর্কশ শব্দে সম্ভিত ফিরল অভিমন্যুর । ফোনটি রিসিভ করে, অভিমন্যু বলল,‘ জয়হিন্দ স্যার ।’ ফোনের ওপার থেকে ভেসে এল, গোয়েন্দা প্রধান মিঃ চৌধুরীর গম্ভীর কণ্ঠস্বর ।
‘ জয়হিন্দ অভি । গভর্নমেন্ট পারমিশন দিয়েছে । তোমাদের ইনার লাইন পারমিট ও হয়ে গিয়েছে । তুমি, তোমার টিম নিয়ে আজই রওনা হয়ে যাও অরুণাচলের উদ্দেশে ।
ওখানে আমাদের দুজন লোকাল এজেন্ট, সালোম মিনা এবং সাংঘু মিবাং তোমাদের অ্যাসিস্ট করবে ।আর্মির মেজর জেনারেল বিক্রমজোত সিং এর সাথেও আমার কথা হয়েছে । প্রয়োজনে আর্মির স্পেশাল টিম তোমাদের ব্যাকআপ দেবে । আমি তোমাকে জরুরি কিছু কন্ট্যাক্ট শেয়ার করছি । এগুলো তোমার প্রয়োজন হবে । অভি মনে রেখো, যে করেই হোক এই মিশন আমাদের সাকসেসফুল করতেই হবে। নইলে বড় বিপদ দেশের জন্য!’
অভিমন্যু দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে বলল,‘ স্যার, উই উইল ট্রাই আওয়ার লেভেল বেস্ট । আর এটুকু নিশ্চিত থাকুন, প্রাণ থাকতে এই মিশনে আমরা পরাজয় স্বীকার করব না ।’
মিঃ চৌধুরী,‘ওকে, টেক কেয়ার মাই বয়, ’ বলে ফোন রাখলেন । অসমের জোরহাট বিমান বন্দরে নেমে, অভিমন্যু এবং তার টিম রওনা দিল ‘জিরো ভ্যালির ’ উদ্দেশে ।
সালোম মিনা এবং সাংঘু মিবাং, দুজনেই অরুণাচলের অধিবাসী । অত্যন্ত মৃদুভাষী এবং অনাবিল আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহার এদের । শহরের যান্ত্রিকতা থেকে বহু দূরে, সবুজ বনানীর নিঃস্বার্থ আলিঙ্গন কে পাথেয় করে, সকলকে নিয়ে,গাড়ি ছুটে চলল এক অজানা রহস্যে সমাধানের লক্ষ্যে , শূন্য উপত্যকার দিকে। মূলত, সালোম এবং সাংঘুর দেওয়া কিছু তথ্যের এর উপর ভিত্তি করেই তাদের এই রহস্যভেদি অভিযান ।
ডঃ রায় বললেন,‘ ল্যান্ড অফ ডন লিট মাউন্টেনস অর্থাৎ উদিত সূর্যের দেশ, প্যারাডাইস অফ অর্কিড, মেঘের রাজ্য কিম্বা প্রকৃতির গুপ্তধন -অরুণাচল কে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, এর মত নয়নাভিরাম স্থান, ভূ ভারতে খুব কমই আছে! বুঝলে অভি ।’
অভিমন্যুর স্মৃতিতে অনুরণিত হচ্ছিলো ইউনিভার্সিটিতে পড়া, উইলিয়াম শেকসপিয়ার বিখ্যাত একটি উক্তি,“ দ্য আর্থ হ্যাজ মিউজিক ফর দোজ হু লিসেন।’
ডঃ রায় এর কথায় সে বলল,‘ সত্যিই ডঃ রায়, এ তো অবর্ণনীয় সৌন্দর্য! চারদিকে এত সবুজ অনেকদিন পর দেখছি । আজকাল শহরটা তো কংক্রিটের বিষাক্ত জঞ্জালে ভরে গিয়েছে । আজ অনেক দিন পর একটু প্রানখুলে শ্বাস নিতে পারছি । আর দেখুন না, এখানকার মানুষ জনের এই অদ্ভূত সরলতার পেছনেও কিন্তু এই নৈসর্গিক প্রকৃতিরই অবদান রয়েছে । আর এদেরই এত বড় ক্ষতি করতে চাইছে ওই পাষণ্ডগুলো । এটা আমরা কিছুতেই হতে দিতে পারিনা ।’
ডঃ রায় বললেন,‘অভি, তথাকথিত পশ্চিমা সভ্য সমাজের মানুষেরা তো এতদিন তাই করে এসেছে । মানুষের সরলতা ও অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে, দেশের সম্পদ লুট করে এরা ধনী হয়েছে আর নিষ্পাপ মানুষদের পরাধীনতার নাগপাশে বন্দি করেছে ।’ ‘ কিন্তু সময় বদলেছে স্যার।ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি আর কিছুতেই হতে দিতে পারিনা ।’ বলল অভিমন্যু ।
নানান কথোপকথন এর ভিড়ে, অনেকটা পথ অতিক্রম করে, গাড়ি যখন এসে পৌঁছল,প্রায় পনেরো শো মিটার এর অধিক উচ্চতায় অবস্থিত, ‘জিরো উপত্যকায় ’, তখন সূর্য চারিদিকে তার রক্তিম আবিরমাখা রূপচ্ছটা বিকিরণে শয্যাপ্রস্তুতির জানান দিচ্ছে ।‘ জিরো উপত্যকা ’ থেকে দূরে গগনস্পর্শী পাহাড়গুলি যেন আলো ছায়ার অন্তরালে বিরাট দৈত্যের রূপ ধারণ করেছে ।
রূপসী অরুণাচলের এটি অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান । যা এখনও মানুষের সুপরিচিতির বলয় থেকে কিছুটা নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছে , নিজের দুর্গমতার মোড়কে ।
‘জিরো ভ্যালি ’, থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত একটি হোমস্টের সামনে গাড়ি থামল । নিরাপত্তার খাতিরেই এই দূরবর্তী হোমস্টে নির্বাচন করেছে সালোম। সালোম দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে হোমস্টের দিকে এগিয়ে গেল । কিছুক্ষনের মধ্যেই হোমস্টে থেকে দুজন কর্মচারী দ্রুতপদে এসে পৌঁছল, গাড়ির কাছে। সাংঘুর নির্দেশে ওরা, অভিদের কিছু ব্যাগপত্র নিয়ে হোমস্টের দিকে এগিয়ে গেল ।
সাংঘু বলল,‘ স্যার, প্লিজ আপলোক অন্দর আইয়ে ।’
সকলে একে একে হোমস্টের দিকে অগ্রসর হলেও, অভিমন্যু কিছুক্ষন গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থেকে,পারিপার্শিক পরিবেশ তীক্ষ্ণ চোখে জরিপ করতে থাকল । কিছুক্ষনের মধ্যেই সালোম এসে পাশে দাড়াল অভিমন্যুর এবং দুজনে গোপন আলোচনায় মত্ত হল ।
আলোচনা শেষে সালোম বলল, ‘ নো প্রবলেম স্যার । সবকুছ ইন্তেজাম হো যায়েগা ।’
প্রত্যেকের জন্য আলাদা, আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করা হয়েছে । সকলে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষন বিশ্রাম নিল ।
অভিমন্যুর ডাকে, রাত্রে ডিনার শেষে সকলে উপস্থিত হল অভিমন্যুর ঘরে। অভিমন্যু বলল,‘বন্ধুরা, সকলের উদ্দেশ্যে আমার কিছু কথা বলার আছে ।বেশ কিছু লিড্ মিলেছে । তার ভিত্তিতে বলছি। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এই মিশনের সিক্রেসি আমাদের মেইনটেইন করতে হবে ।নাহলে বিপর্যয় অনিবার্য । মেইনলি, সালোম ও সাংঘুর দেওয়া ইনফরমেশন অনুযায়ী, বেশ কয়েকমাস ধরে, জিরো উপত্যকা এবং তার আশেপাশে বিশেষত কার্দো ও ট্যালি ফরেস্ট এলাকায়, কিছু সন্দেহপ্রবন অপরিচিত মানুষের আনাগোনা শুরু হয়েছে ।
গভীর রাতে গাড়ি চলাচল থেকে শুরু করে স্থানীয় কিছু আপাতানি জনজাতির মানুষের হটাৎ নিখোঁজ হয়ে পুরো বিষয়টা নিছকই কাকতালীয় ব্যাপার হতে পারে না । এমনিতেই ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট অনুযায়ী অরুণাচলের কিছু স্থান খুবই স্পর্শকাতর । তাই আমাদের অতি সতর্কতার সাথেই যেকোনো কাজ করতে হবে ।
অর্ণব তুমি, জিরো ভ্যালির আশেপাশের এলাকা যেমন – হাপলি, ট্যালে এবং কারদো ফরেস্ট অঞ্চলের ওল্ড এবং রিসেন্ট স্যাটেলাইট ইমেজ এনালাইসিস করে একটা রিপোর্ট তৈরী কর ।’
অর্ণব বলল,‘ওকে স্যার ।’
ডঃ রায় বললেন,‘অভি, ওরা যদি এই জিরো ভ্যালির আশেপাশের জঙ্গলে ঘাঁটি গেড়ে থাকে, তাহলে নিশ্চিতভাবে ওরা আমাদের হাত থেকে নিস্তার পাবে না। সাথে সাথেই ডঃ ডি. কে রায়, ডঃ এস. শুভ্রমনিয়ম এবং ডঃ পি. কুলকার্নির খোঁজ ও আমাদের চালিয়ে যেতে হবে ।’
অভিমন্যু বলল,‘ ডঃ রায়, ডেভিডের ইনফরমেশন যদি একশো শতাংশ সঠিক হয়, তাহলে নিশ্চিত থাকুন ওনারা নিরাপদেই রয়েছেন এবং শত্রুদের সাথেই সহাবস্থান করছেন । তাই আমাদের আরও এলার্ট থেকে পুরো কাজটা করতে হবে । দে আর ভেরি ইন্টেলিজেন্ট। আমাদের একটা ভুল পদক্ষেপ পুরো মিশন কে ব্যার্থ করে দিতে পারে ।’
সকলে সহমত পোষণ করল, অভিমন্যুর কথায় ।
‘ কাল,খুব সকাল থেকেই আমরা দুটো দলে ভাগ হয়ে গিয়ে, আমাদের কাজ শুরু করব, বলে অভিমন্যু সকলকে কিছু নির্দেশ দিল ।’সকলে তার কথায় সম্মতি জানিয়ে, নিজের নিজের ঘরে প্রস্থান করল ।
ভোর পাঁচটা নাগাদ সূর্যোদয়ের নরম আলো, সূচীভেদ্য অন্ধকারের অহংকার চূর্ণ করে, অরুণাচল কে আলোকিত করল । চারিদিকে শীতল আবহাওয়ার আবরণ ভেদ করে সূর্যের যে প্রথম রশ্মিটুকু জানালা দিয়ে প্রবেশ করছিল, শীতকাতর অঙ্গে তা ছিল প্রকৃতই আরামপ্রদ ।
কিন্তু, বিশ্রাম ও আরাম এই জাগতিক শব্দগুলোর সাথে হয়ত, গোয়েন্দা দের অনিচ্ছাকৃত বিবাদ দীর্ঘদিনের ।তাই সকলেই বিছানা ত্যাগ করে, দ্রুত তৈরী হয়ে নিল ।
কিছুক্ষনের মধ্যেই দুটো গাড়ি এসে উপস্থিত হল, হোমস্টের সামনে ।একটা গাড়ি ডঃ রায় এবং অভিমন্যু কে নিয়ে নিয়ে এগোতে থাকল,স্থানীয় আপাতানিদের গ্রামের দিকে । ড্রাইভার কাম ট্যুরিষ্ট গাইড হিসেবে সঙ্গে গেল সালোম মিনা । অন্যদিকে আরেকটা গাড়িতে, কৈলাস যোশি এবং শিখা দেশমুখ , স্বামী স্ত্রীর ছদ্মবেশে রওনা দিল কার্দো জঙ্গল ও ট্যালে ভ্যালি সংলগ্ন এলাকা পর্যবেক্ষণে । এদিকে সাংঘু মিবাং , শিখা দের গাড়ির ড্রাইভারের ভূমিকায় অবতীর্ন হল ।
গাড়িতে কিছুদূর অগ্রসর হতেই , চোখে পড়ছিল , চারিদিকে নীলআকাশের নিচে, দুর্গম পর্বতমালার কোলে অবস্থিত এই ‘শূন্য উপত্যকার’ সৌন্দর্য ।
অভিমন্যু, আপাতানি উপজাতি সম্পর্কে সালোমের কাছে জানতে চাইলে সে আপাতানি উপজাতি সম্পর্কে নানান কথা বলতে শুরু করল । তার বক্তব্য অনুযায়ী, লোয়ার সুবনসিরি জেলার জিরো উপত্যকায় হল,এই আপাতানি উপজাতির মানুষের বাসস্থান ।প্রাচীন জনজাতি অধ্যুষিত এই অঞ্চল সম্প্রতি, ইউনেসকোর ‘ ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ’ হিসেবে শর্ট লিস্টেড হয়েছে । এদের সিংহভাগ এখনও তাদের নিজস্ব ঐতিহ্যপূর্ণ প্রকৃতিভিত্তিক ধর্মাচারণ করে । এই আপাতানি উপজাতির মানুষের দুটি বিশেষ ঐতিহ্যপূর্ণ উৎসব হল, ‘ ড্রি ’ এবং ‘ মায়াকো ’ ।
ডঃ রায় এই উৎসবগুলো সম্পর্কে জানতে আগ্রহ প্রকাশ করলে, সালোম পুনরায় এই দুটি উৎসব সম্পর্কে বলতে শুরু করল ।
মূলত জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত হয় এই ‘ড্রি’ উৎসব ।এই উৎসবে তারা মূলত তাদের চারটি দেব দেবীকে সন্তুষ্ট করার জন্য বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান পালন করে। এই দেব দেবীরা হলেন-তামু, হারনিআঙ্গ, মিট্টি এবং দ্যানি । মূলত ভালো ফসলের সাথে সুখ, সমৃদ্ধি, ধন এবং ঐশ্বর্যের প্রার্থনার মধ্যে দিয়েই এই উৎসব পালন করা হয় ।
অন্যদিকে ‘ মায়াকো ’ উৎসব পালিত হয় মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে। এটি এই জিরো উপত্যকায় বসবাসকারী সকল আপাতানি উপজাতির মানুষের, বন্ধত্ব ও সংযোগের উদযাপন । জমিতে নতুন ফসলের চারা যখনই দেখা যায় ঠিক সেই সময়েই এই উৎসব পালনের দ্বারা এরা পারস্পরিক সৌভাতৃত্ব ও ফসলের উৎকৃষ্ট ফলনের জন্য প্রার্থনা করে ।
কিছুক্ষনের মধ্যেই আপাতানি গ্রামে পৌঁছে গেল অভিমন্যুরা । চোখে পড়ল টিনের ছাউনি দেওয়া, বাঁশ নির্মিত কিছু বাড়িঘর । সালোমের সাথে অভিমন্যুরা এসে পৌঁছল,এক বৃদ্ধা আপাতানি মহিলার বাড়িতে ।সালোম কে এখানে সকলে চেনে।
বৃদ্ধা ওদের হাসি মুখে আমন্ত্রণ জানাল । এরা অত্যন্ত অতিথিবৎসল হয় তা সকলের জানা থাকলেও তার চাক্ষুস প্রমান পাওয়া গেল। মাচাতে বসতে বললেন । কিছুক্ষনের মধ্যেই ফিরে এসে বাটিতে করে পরিবেশন করলেন ‘সাদা আপাং ’ এবং প্রথমে কিছুটা মাচার নিচে ফেলে তারপর খেতে বললেন ।সকলে তাই করল । সালোম,অভিমন্যুকে ইশারায় বোঝাল যে সে পরে এর কারণ বলবে ।
সালোম ওই বৃদ্ধার ছেলের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করতেই, তাঁর দু-চোখ বেয়ে নেমে এল অশ্রুধারা ।জানা গেল, বেশ কিছুদিন আগে, জমি থেকে ফেরার পথেই তাঁর ছেলে গেগোঙ নিখোঁজ হয় । গ্রামের লোক অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার কোনো সন্ধান পায়নি ।
কিছুক্ষন পর, ছেলেটার স্ত্রী এবং দশ বছরের পুত্র এসে দাড়াল বৃদ্ধার পাশে।
বাচ্চাটি কে দেখে খুব খারাপ লাগল সকলের । অভিমন্যু কিছু বলতেই, সালোম আপাতানি ভাষায় বৃদ্ধাকে আশ্বস্থ করে বলল, তারা ঠিক খুঁজে বের করবে বৃদ্ধার ছেলেকে ।বৃদ্ধা অবাক হয়ে চেয়ে থাকলেন অভিমন্যুর মুখের দিকে ।
এরপর সেখান বেরিয়ে, অভিমন্যুরা আপাতানি গ্রামটা ঘুরে দেখতে থাকল । গ্রামের একজন মোড়ল গোছের বৃদ্ধ লোক জানালেন, গেগোঙ ছাড়াও গ্রামের প্রেমা, বুগা, সিব্বা ও তাজো নামের আরও চারজন ছেলেকেও বেশ কিছুদিন ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ।
এদের মধ্যে প্রেমা ও বুগা নিখোঁজ হয়েছে, কার্দো জঙ্গলে কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়ে । অন্যদিকে সিব্বা নিখোঁজ হয়েছে, ঘন পাইন উদ্ভিদ সমৃদ্ধ মিডে অঞ্চল থেকে এবং তাজো নিখোঁজ হয়েছে ট্যালে বনভূমি থেকে । সিব্বা এবং তাজো দুটি পৃথক গ্রূপের ট্রেকিং গাইড হিসেবে গিয়েছিল । কিন্তু তারা আর ফিরে আসেনি ।জানা গেল, নিখোঁজ হওয়া প্ৰত্যেকটি ছেলের বয়স, আঠারো থেকে পঁচিশের মধ্যেই ।
হাপোলি টাউনশিপ থেকে চার কিমি দূরে অবস্থিত কারদো জঙ্গল । গাড়ি থেকে নেমে, শিখা, কৈলাস এবং সাংঘু এগিয়ে গেল জঙ্গলের দিকে । পথে কিছু জন সমাগম চোখে পড়ল ।এই জঙ্গলের একটি স্থানে সম্প্রতি কিছুটা কংক্রিটের ছোঁয়া লেগেছে । শিখা এর কারণ জানতে চাইল, সাংঘুর কাছে। প্রত্যুত্তরে সাংঘু স্থানীয় মানুষের প্রচলিত বিশ্বাসের একটা কাহিনী সংক্ষেপে বিবৃত করল।
সে জানাল,২০০৪ সালে এই কারদো জঙ্গলে, প্রেম সুবা নামে একজন স্থানীয় কাঠুরে, কাঠ কাটতে এসে অলৌকিক ভাবে প্রায় পঁচিশ ফুট লম্বা এবং বাইশ ফুট চওড়া, একটা সুবিশাল পাথর দেখতে পায় । যার নিচে ছিল প্রবহমান এক জলধারা । খবর যায় স্থানীয় পুরোহিতদের কাছে । তারাও এসে সেই বিশালাকার পাথর দেখতে পান ।আসলে এটা কোনো সাধারণ পাথর ছিলনা। এটা ছিল একটা শিবলিঙ্গ । এভাবেই আবিষ্কার হয় পৃথিবীর উচ্চতম প্রাকৃতিক শিবলিঙ্গের। বিশেষজ্ঞদের মতে, শিবপুরাণেও নাকি এই প্রাকৃতিক শিবলিঙ্গের উল্লেখ রয়েছে । খবরটি লোকমুখে প্রচারিত হতেই, সারাবছর বহু শিবভক্ত, এই প্রাকৃতিক শিবলিঙ্গ দর্শনে এই কারদো জঙ্গলে আসেন।
শিখা, কৈলাস এবং সাংঘু, কারদো জঙ্গলের আশেপাশে খুব ভালো তল্লাশি করেও কোনো ক্লু খুঁজে পেলনা । শিখা চটপট কিছু ছবি ক্যামেরাবন্দি করল । এরপর সকলে দ্রুতপদে জঙ্গল থেকে বাইরে বেরিয়ে এল ।
এরপর সাংঘু গাড়ি নিয়ে এগিয়ে গেল মনিপোয়লাং বস্তির দিকে ।জিরো থেকে প্রায় তিরিশ কিমি পথ অতিক্রম করে অবশেষে গাড়ি এসে থামল পাংগের নিকট । এরপর থেকে শুরু হচ্ছে ট্যালে ভ্যালি তে প্রবেশের রাস্তা ।
সাংঘু বলল,‘ ইহাসে শুরু হোতা হে ট্রেকিং রুট । ট্যুরিষ্টলোক হাপোলি সে পারমিশন লে কে, ইস রুটসে ট্রেক করকে ট্যালে ভ্যালি যাতে হে । শিখা জিজ্ঞাসা করল,‘ সাংঘু জি, ইহা ট্রেক করনেকে লিয়ে তো বাহার সে বহুত ট্যুরিষ্ট আতে হোঙ্গে?’
সাংঘু মাথা নেড়ে বলল,‘ থোরা বহুত আতে হে । ম্যাডাম, ইতনা জাদা পপুলার নেহি হুয়া, আভি তক ইয়ে স্যাংচুয়ারি । ইহা পর ক্লাউডেড লেপার্ড, ওয়াইল্ড বিয়ার সে লে কর্ অর কুছ ডেডলি এনিম্যাল ভি হে । কাভি, কাভি থোরা রিস্কি হো যাতা হে, নরমাল ট্রেকার্স কে লিয়ে ।’
এই কথোপকথন এর মাঝেই, জঙ্গল থেকে একটা আপাতানি ছেলে বেরিয়ে এলো, পিঠে বাঁশের তৈরী লম্বা ঝুড়ি । ঝুড়িতে আবর্জনা ভর্তি কৈলাস যোশি জিজ্ঞাসা করল,‘ সাংঘু জি, ইয়ে ল্যারকা কোন হে?’ ‘ স্যার,ও তো জিরো ভ্যালি কা এক আপাতানি ল্যারকা হে । উসকা নাম হে দাজু । ইয়ে ল্যারকা বহুত আলাগ হে সাব । ফরেস্ট সে, ও কাচড়া সাফ করতা হে । ইসকে লিয়ে উসে কুছ ভি নেহি মিলতা গভর্নমেন্ট সে । লেকিন খুশিসে ও ইয়ে কাম করতা হে ।’ বলল সাংঘু ।
কৈলাস দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল ছেলেটার দিকে ।প্রথমে কিছুটা ভয় পেলেও, সাংঘু কে দেখে ছেলেটা কিছুটা আশ্বস্থ হল ।এরপর পিঠ থেকে আবর্জনা পূর্ণ, লম্বা ঝুড়িটা নামিয়ে রেখে, একটা গাছতলায় বসল, ছেলেটা । এরপর কৈলাস, খোশগল্প শুরু করল ছেলেটার সাথে । অন্যদিকে শিখা, আবর্জনা পূর্ণ ঝুড়িটার বেশ কিছু ছবি তুলল চটপট করে ।
ছেলেটা জানাল, ছেলেবেলা থেকেই সে তার মা কে, আশেপাশের এলাকা পরিষ্কার পরিছন্ন করতে দেখে বড় হয়েছে।কয়েক বছর আগে তার মা হটাৎ দুদিনের অসুখে মারা যান । তাই মা এর স্মৃতি ও তাঁর আত্মার শান্তি কামনায়, সে এই কাজ করে । শূন্য দৃষ্টিতে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,তার মনে হয়,মা তাকে এই কাজের জন্য সর্বক্ষণ প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করছেন ।
কৈলাস খুব সন্তর্পনে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতেই ছেলেটা খুব স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বলল, ইদানিং সে অদ্ভুতভাবে ট্যালে স্যাংচুয়ারির ভেতরের একটা অংশ থেকে প্রতিদিন প্রচুর আবর্জনা সংগ্রহ করছে।কিন্তু, বিশেষ কোনো ট্রেকার দের গ্ৰুপ ও তাদের তৈরী টেন্ট ও তার নজরে পরছে না ।
শিখা এবং কৈলাস একত্রে বেশ হতবাক হলো বিষয়টা শুনে ।এরপর ছেলেটা সকলের সম্মতি নিয়ে প্রস্থান করল,নিকটবর্তী আরও একটা জঙ্গলের উদ্দেশে । ‘ আই থিঙ্ক উই শুড লিভ নাউ ।’ শিখার এই কথায় সম্মতি জানিয়ে, সকলে রওনা দিল হোমস্টের উদ্দেশে ।
আপাতানি গ্রাম থেকে বেরিয়ে, অভিমন্যু এবং ডঃ রায় গাড়িতে চেপে বসলেন । সালোম গাড়ি স্টার্ট করল ।পথে ডঃ রায় বললেন, ‘ অভি লক্ষ্য করেছ, বৃদ্ধা আপাতানি মহিলাদের নিজস্ব বেশভূষা ও সাজ রয়েছে ।’
অভিমন্যু বলল,‘ ঠিক তাই ডঃ রায় । তাঁদের কপালে ও চিবুকে অদ্ভূত কালো উল্কি এবং নাকে নরম কাঠ বা বেতের তৈরী প্লাগের ব্যবহার, আমি নোটিশ করেছি । কিন্তু একটা বিষয় বুঝলাম না । তাঁদের এই অদ্ভুত দর্শনের কারন কি! আপাতানি অল্প বয়সি মেয়েদের মধ্যে কিন্তু এরকম অদ্ভুত বেশভুষা নজরে পড়ল না । ’
সালোম জানাল ওদের এই অদ্ভূত সাজের পেছনে একটা ইতিহাস রয়েছে । অতীতে আপাতানি মহিলারা আশেপাশের এলাকা ও অন্যান্য উপজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম সুন্দরী বলে বিবেচিত হতেন । ফলে আশেপাশের প্রতিদ্বন্দ্বী উপজাতির পুরুষেরা এই উপত্যকায় এসে এদের জোরপূর্বক অপহরণ করে নিয়ে যেত । এরই বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ এরা নিজেদের কিছুটা কম আকর্ষণীয়া করে তোলার উদ্দেশ্যে , নিজেদের মুখের ও চেহারার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটানোর জন্য, নরম কাঠের তৈরী নাকের ‘প্লাগ ’এর ব্যবহার ও মুখে উল্কি আকার বিষয়টা চালু করে ।
ক্রমে নাকের ছিদ্র বড় হয়ে যায় এবং এনারা অসুন্দর হয়ে যান । তবে এই রীতিতে বর্তমান আপাতানি মেয়েরা বিশ্বাসী নয় । তারা, মূলত আধুনিক পোশাক ও জীবনযাপনে অভ্যস্ত ।সালোম এবারে, বৃদ্ধা আপাতানি মহিলার পরিবেশিত, সাদা আপাং এর কিছুটা অংশ মাটিতে ফেলতে বলার কারণ হিসেবে যা বলল তা অনেকটা এরকম ।
আসলে এইভাবে ওনারা ওনাদের আরাধ্য দেবতা,‘ ডোনি ’ এবং ‘পোলো ’ কে উৎসর্গ করেন । ‘ডোনি -পোলো ’ অর্থাৎ সূর্য এবং চন্দ্র এদের উপাস্য দেবতা। মূলত প্রকৃতির উপাসক, এই আপাতানি উপজাতির মানুষের অন্যান্য আরাধ্য দেব-দেবীরা হলেন- কেইন নানে, বোট করা, পেডং নানে এবং গুডমিন সয়িন । এদের ধর্মের পতাকা সূর্যের প্রতিনিধিত্ব করে । এই কথাবার্তার মাঝে অভিমন্যু মাঝে, মাঝে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল। তার মনে অনবরত আলোড়িত হচ্ছিলো আপাতানি ছেলেদের, রহস্যময়ভাবে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনাস্রোত ।
সন্ধ্যাবেলায়,অভিমন্যুর ঘরে জরুরি আলোচনায় সকলে একত্রিত হয়েছে। অভিমন্যু জিজ্ঞাসা করল,‘শিখা, কৈলাস তোমরা কিছু ক্লু পেলে?’শিখার কথায় প্রথমেই এল দাজুর প্রসঙ্গ । মূলত, ট্যালে ভ্যালি থেকে আবর্জনা সংগ্রহকারী ছেলেটার বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা – পুরোটা খুলে বলল শিখা ।
অভিমন্যু, দুটি ভ্রু কিছুটা উপরে তুলে , শিখার তোলা ছবিগুলো ল্যাপটপে স্থানান্তরিত করে, খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে থাকল এবং অদ্ভূত ভঙ্গিতে ,‘ স্ট্রেঞ্জ! ’ শব্দটা উচ্চারণ করল বার দুয়েক ।
এরপর সকলের উদ্দেশ্যে বলল,‘লুক ফ্রেন্ডস, এটা শিখার তোলা, ঐ ছেলেটার সংগৃহীত আবর্জনা স্তূপের ছবি ।ছবিতে যে ড্রাই ফুড ও ফ্রুট জুসের ক্যান গুলো দেখা যাচ্ছে, তার প্রত্যেকটিই কিন্তু আফ্রিকান ব্র্যান্ড । এই ব্র্যান্ড কিন্তু অন্য কোনো দেশে খুব একটা প্রচলিত নয় ।’
শিখা, সহজাত ভঙ্গিতে বেশ কৌতূহল প্রকাশ করে বলল ,‘ তার মানে স্যার, ঐ ভ্যালি তে যদি কোনো দলের উপস্থিতি থেকে থাকে, তাহলে তারা নিশ্চিত ভাবে আফ্রিকার লোকঅভিমন্যু বলল,‘ এক্সাক্টলি শিখা । সেরকমই তো মনে হচ্ছে ।’সকলে বেশ অবাক হলো, অভিমন্যুর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা দেখে ।
‘ অর্ণব স্যাটেলাইট ইমেজ এনালাইসিস রিপোর্ট কি বলছে?’ প্রশ্ন করল অভিমন্যু ।
‘ স্যার, দিস ইজ হেয়ার ’, বলে অর্ণব তার, ল্যাপটপ খুলে জিরো ভ্যালির আশেপাশের বেশ কিছু স্থানের, এক বছর আগের এবং রিসেন্ট তোলা কিছু স্যাটেলাইট ইমেজ দেখাতে থাকল ।
‘স্যার দেখুন, নর্থ লাইন ও সেম স্কেলে আমরা যদি ইমেজ গুলির প্যাটার্ন, শেপ, টেক্সচার এবং কালার খুব ভালোভাবে দেখি , তাহলে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পারবো । লোয়ার সুবনসিরি জেলার অন্তর্গত এই জিরো ভ্যালি এবং তার আশেপাশের কিছু স্থানে, কিছু নতুন স্ট্রাকচার, মেইনলি বিল্ডিং এর নির্মাণ কাজ হয়েছে এই এক বছরে। এটা নতুন কিছু নয় । কিন্তু সন্দেহজনক ভাবে ট্যালে স্যাংচুয়ারির, এক্সট্রিম নর্থ-ওয়েস্ট এর ডেন্স জঙ্গল এরিয়া তে, ডেফিনেটলি কিছু অসঙ্গতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে । অভিমন্যু সহ সকলেই দৃষ্টি নিবদ্ধ হল অর্ণবের প্রতি ।
অভিমন্যু জিজ্ঞাসা করল,‘তুমি ঠিক কী ধরনের অসঙ্গতির কথা বলছো অর্ণব?’
অর্ণব তার ল্যাপটপ এর স্ক্রিনে একই স্থানের তোলা দুটি স্যাটেলাইট ইমেজ দেখিয়ে বলল,‘স্যার, রাইট সাইড এর ইমেজ টি, এইবছর সেপ্টেম্বর মাসের চোদ্দো তারিখের অর্থাৎ আজ থেকে দশদিন আগের তোলা ট্যালে স্যাংচুয়ারির একটা স্যাটেলাইট ইমেজ । আর লেফ্ট এর ইমেজ টি একই তারিখে তোলা, একই স্থানের , একবছর আগের পুরোনো ইমেজ।
খুব ভালোভাবে দেখলে জঙ্গলের নর্থ -ওয়েস্ট এরিয়ার এই স্থানটিতে জঙ্গল পরিষ্কার করে কিছু অস্থায়ী নির্মাণকাজ করা হয়েছে । কালার ভেরিয়েশন দেখে এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে ।নট শিওর বাট এগুলো, অস্থায়ী টেন্ট ও হতে পারে। ইমেজ দুটি খুব ভালোভাবে খুঁটিয়ে দেখে, অভিমন্যু বেশ বিস্মিত হল এবং অর্ণবের পিঠ চাপড়ে বলল,‘এক্সাক্টলি ! ভেরি গুড অবসেরভেশন অর্ণব । ইউ হ্যাভ ডান এ ব্রিলিয়ান্ট জব ।’ এরপর সকলকে উদ্দেশ্যে করে মন্তব্য করল,‘ ফ্রেন্ডস, আই থিঙ্ক! উই আর ভেরি ক্লোজ টু সল্ভ দিস কেস ।’
মিঃ চৌধুরী ফোনে সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে বললেন,‘অভি, সময় খুব কম । এর মধ্যেই আমাদের সকল প্রস্তুতি নিয়ে ফেলতে হবে । তুমি আজকেই আর্মির স্পেশাল ফোর্স এর সিনিয়র কমান্ডার, এ. বিশ্বাসের সাথে একটা মিটিং ফিক্স কর। ওনার স্পেশাল টিমই তোমাদের ব্যাকআপ দেবে । আমি পি. এম. ও এর সাথে যোগাযোগ করে তোমাকে আপডেট দিচ্ছি।’
‘ওকে স্যার’, বলে অভিমন্যু ফোনটা কেটে দিল ।
এরপর ফোন গেল, কমান্ডার এ. বিশ্বাস এর কাছে এবং সামান্য কিছু আলাপচারিতা শেষে,মিটিং ফিক্স হল, জিরো আর্মি ক্যাম্প এ।
অভিমন্যু বলল,‘ আমাদের খুব ঠান্ডা মাথায় গোটা অপারেশন টা প্ল্যান করতে হবে । শত্রুপক্ষ কতটা শক্তিশালী সেই সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা আমাদের না থাকায়, সকলে হাই এলার্ট থাকবে ।
কালকে আমরা দুটো টিমে ভাগ হয়ে যাব । শিখা এবং কৈলাস তোমরা সাংঘু কে সঙ্গে নিয়ে, পৌঁছবে লোয়ার সুবনসিরির, হাপোলি ফরেস্ট রেঞ্জ অফিসে। সেখান থেকে যাবতীয় ইনফরমেশন তোমরা সংগ্রহ করবে । প্রতিটা তথ্য আমাদের নেক্সট স্ট্রাটেজি ঠিক করা এবং মিশনের প্রপার প্ল্যানিং করতে সাহায্য করবে । সহজে ওরা কোনো কিছুই বলতে চাইবে না । আর না চাইলে কি করতে হবে সেটা তোমরা জানো ।
এদিকে আমি, ডঃ রায় এবং অর্ণব সালোম কে সঙ্গে নিয়ে, রওনা দেব জিরো আর্মি ক্যাম্প এর দিকে । তোমরাও এদিকের কাজ মিটিয়ে আমাদের জয়েন করবে । সকলে সমস্বরে অভিমন্যুর কথায় সম্মতি জানাল ।
সকাল দশটা নাগাদ, হাপোলির ফরেস্ট রেঞ্জ অফিসে সাংঘু কে সাথে নিয়ে শিখা এবং কৈলাস উপস্থিত হল । জানা গেল ফরেস্ট রেঞ্জার, একমাস হল বদলি হয়েছেন । তার দায়িত্বভার সামলাচ্ছেন, তামো মিঞ্জ নামে একজন অধস্তন অফিসার ।
শিখা দেশমুখ, ওনার কাছে ট্যালে স্যাংচুয়ারি তে এন্ট্রি নেওয়া ট্রেকার দের ডিটেইলস ইনফরমেশন চাইতেই তিনি বেশ অসন্তুষ্ট হলেন । তিনি বললেন,‘দিস ইজ নট পসিবল ম্যাডাম । ইয়ে ইনফরমেশন মে আপকো কিউ দুঙ্গা । দিস ইজ ইললিগ্যাল ।’
এরপর শিখা নিজের আই কার্ড দেখালে, তিনি বেশ বিরক্তি প্রকাশ করে, কিছুটা অনমনীয় ভঙ্গিতে বললেন,‘ ইয়ে ডিটেইলস মেরে পাস নেহি হে ।’কৈলাস যোশি, নিজের পিস্তলটা বার করে টেবিলে রাখতেই, লোকটার অনমনীয় ভাব মুহূর্তে নমনীয় ভাবে পরিবর্তিত হল।
‘থোরা রুকিয়ে স্যার, দিখাতা হু ’, বলে লোকটা, কাচুমাচু মুখে লকার খুলে, খুব সন্তর্পনে লুকিয়ে রাখা একটা ফাইল বের করল ।
শিখা ঝটপট ফাইল খুলে কতগুলো পাতা উলটানোর পর নজরে এল, দশ জনের একটা আফ্রিকান টিমের পারমিট ডিটেইলস । যেখানে পারপাস টু ভিজিট এর স্থানে লেখা রয়েছে, বোটানিক্যাল স্টাডি ।
পারমিট ডিটেইলস থেকে জানা গেল, এই আফ্রিকান গ্ৰুপটি ট্যালে স্যাংচুয়ারি তে প্রবেশ করেছে প্রায় পঁচিশ দিন আগে। কৈলাস জিজ্ঞাসা করল,‘ ইয়ে লোক ইতনে দিন তাক ফরেস্ট মে কেয়া কর রাহা হে? আপলোক ডিপার্টমেন্ট সে কুছ নেহি কিয়ে? ’
এরপর লোকটি কথা থেকে যা জানা গেল, তা অনেকটা এরকম – গ্রূপটা ট্যালে স্যাংচুয়ারি তে এন্ট্রি নেওয়ার বেশ কিছুদিন পর থেকে এদের আর কোনো খোঁজ মিলছে না । ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে কিছু লোকজন গিয়ে তল্লাশি চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছে ।
শিখা এবারে বেশ রাগান্বিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল,‘ আপ, লোকাল পুলিশ কো কিউ নেহি ইনফর্ম কিয়ে ?’
লোকটি কিছুক্ষন চুপ থাকার পর বলল,‘মিডিয়া সে লে কর, ইন্টারন্যাশনাল ইস্যু হো যাতা ম্যাডাম । ইহা কা রেপুটেশন খারাপ হোতা ।কোই ট্রেকার্স গ্ৰুপ ইহা পে নেহি আতা । ইস লিয়ে হামলোক কুছ নেহি কিয়ে ।’
‘ অর কোই লোক স্যাংচুয়ারি কি অন্দর হে ? ’ শিখা জানতে চাইল । এবার লোকটি মাথা নিচু করে, টেবিলের দিকে নির্বাক চোখে তাকিয়ে থাকল ।
লোকটির ভাব ভঙ্গিমায় অসচ্ছতা এবং গোপনীয়তার আঁচ টের পেয়ে কৈলাস লোকটির উপর বলপ্রয়োগে উদ্যত হলে । লোকটি হাত জোড় করে কাকুতি মিনতি করতে শুরু করল এবং ভীত কণ্ঠে বলল,‘ স্যার মুঝে ছোড় দিজিয়ে । সবকুছ বাতাতা হু ।’
‘কুছ দিন প্যাহেলে তিন ইন্ডিয়ান ট্রেকার্স ভি ট্যালে স্যাংচুয়ারি সে লাপাতা হুয়া হে । দে অল আর এজেড পিপল ।’ এই কথাটি শেষ করেই লোকটি চুপ করে গেল । বোঝা গেল সে বেফাঁস মন্তব্য করে ফেলেছে ।
শিখা চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করল,‘ পারমিট ডিটেইলস কাঁহা হে?’ লোকটি কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল,‘ নেহি হে ম্যাডাম ।’ কারণ জানতে চাইলে সে, মাথা নিচু করে অপরাধীর ভঙ্গিতে বসে রইল ।
এরপর সাংঘুর চিৎকারে, সম্বিৎ ফিরল লোকটির । কাঁপতে-কাঁপতে সে জানাল, কিছু টাকার বিনিময়ে সে ওদের ট্যালে স্যাংচুয়ারি তে প্রবেশাধিকার দিয়েছে । সম্পূর্ণটাই হয়েছে মৌখিক শর্তের ভিত্তিতে ।
এরপর লোকটি হাত জোড় করে ডুকরে কেঁদে উঠল এবং খুব ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,‘ স্যার, মুঝে মাফ কর দিজিয়ে ।’
‘ দিস ইজ এ ক্রাইম এন্ড ইউ মাস্ট বি পানিশড ফর দিস ।’ ক্রুদ্ধ স্বরে বলল কৈলাস।
‘ স্যার, ইয়ে আপ মুঝপে ছোড় দিজিয়ে ’, বলে, ফোন বের করে জিরো পুলিশ স্টেশনে ফোন করল সাংঘু । কিছুক্ষনের মধ্যেই একটি পুলিশের গাড়ি এসে উপস্থিত হল, ফরেস্ট রেঞ্জ অফিসের সামনে । পুলিশ অফিসার সমস্তটা শুনে গ্রেফতার করল, তামো মিঞ্জ নামের লোকটিকে ।
স্থান, জিরো আর্মি ক্যাম্প । সময় দুপুর বারোটা । আর্মি কমান্ডার, এ. বিশ্বাস এবং তার স্পেশাল টিমের সাথে অভিমন্যুদের গোপন বৈঠক শুরু হয়েছে। ওদিকের কাজ মিটিয়ে শিখা দেশমুখ এবং কৈলাস যোশিও যোগ দিয়েছে এই বৈঠকে।
আর্মি কমান্ডার অরুন বিশ্বাস এর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিতে গেলে বলতে হয়, হাওড়া নিবাসী এই ভদ্রলোক দীর্ঘদিন আর্মিতে নিযুক্ত থাকার পর, আর্মির এই স্পেশাল ফোর্স এর কমান্ডার পদে উন্নীত হয়েছেন এবং আর্মির বেশ কিছু সিক্রেট মিশনকে লিড করার অভিজ্ঞতা ওনার রয়েছে ।বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজিতে সমান দক্ষ, ক্লিন সেভের এই ভদ্রলোকের উচ্চতা প্রায় ছ ফুটের কাছাকাছি । চারিত্রিক দৃঢ়তাপূর্ণ বুদ্ধিদীপ্ত চোখে রয়েছে অফুরন্ত আত্মবিশ্বাস।
কমান্ডার এ বিশ্বাসের টিমে রয়েছেন আরও পাঁচজন জওয়ান । প্রত্যেকেই এই ধরনের অপারেশন এর জন্য স্পেশালি ট্রেইন্ড ।
সমস্তটা শোনার পর, কমান্ডার এ. বিশ্বাস বললেন,‘ স্যার, এটা হল ট্যালে স্যাংচুয়ারির টোপোগ্রাফিক্যাল ম্যাপ । মূলত ২৪০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত, এই জঙ্গলে উপক্রান্তীয় মিশ্র উদ্ভিদ এবং নরম কাঠ যুক্ত সরল বর্গীয় উদ্ভিদের সহাবস্থান দেখা যায় । এছাড়াও এখানে রয়েছে বেশ কিছু বিপন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীকূলের অস্তিত্ব, মাঝে মাঝে ফাঁকা বিস্তৃত ভূমিভাগ এবং বাঁশ ও ফার্নের জঙ্গল ।
উত্তর -পশ্চিম দিকে জঙ্গল আরও ঘন হয়েছে ।
অভিমন্যু বলল,‘ মিঃ বিশ্বাস, আমাদের সন্দেহ জঙ্গলের ঠিক এই স্থানটিকে ঘিরেই ।’
কমান্ডার মিঃ বিশ্বাস বললেন,‘ দিস ইজ জিওগ্রাফিক্যালি ভেরি টাফ প্লেস, স্যার । তাছাড়া জঙ্গলের,এই জায়গাটিতে একাধিক ডেডলি এনিম্যাল এর বাস । আমাদের খুব সাবধানে এগোতে হবে, ক্লাউডেড লেপার্ড এবং হিমালয়ান ব্ল্যাক বিয়ারের আক্রমণ এড়িয়ে । এটা ওদেরই জায়গা, আমরা ওখানে অনুপ্রবেশকারী মাথায় রাখতে হবে আমাদের ।’
মূলত ট্যালে স্যাংচুয়ারি তে প্রবেশ করে, কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর আমরা দুটো টিমে ভাগ হয়ে যাব। স্যার, আপনারা পূর্বদিক হয়ে অগ্রসর হবেন । আমরা পশ্চিম দিকের ঘন জঙ্গল ভেদ করে এগোতে থাকব । মূলত দিনের আলো শেষ হওয়ার আগেই আমাদের শত্রুপক্ষের ঘাঁটি থেকে কিছুটা দূরে টেন্ট তৈরী করে ফেলতে হবে । রাত গভীর হলে আমরা দুদিক থেকে ঘিরে ফেলব স্থানটিকে । এই
অ্যাম্'বুশ্ আক্রমণেই পর্যুদস্ত করতে হবে শত্রুদের ।
ডঃ রায় বললেন,‘মিঃ বিশ্বাস, আমাদের আরেকটি বিষয়ে নজর রাখা উচিৎ । মেইনলি ওরা একটা ডেডলি ভাইরাস নিয়ে কাজ করছে । তাই আমাদের পি. পি. ই, ডবল নাইট্রিল গ্লাভস, মাস্ক, ফেসশিল্ড, সার্জিক্যাল হুড, আই গ্লাস এবং ইমপারমিয়েবিল বুট প্রয়োজন হবে ।
ডঃ বিশ্বাস বললেন,‘ইউ আর রাইট ডঃ রায় ।বিষয়টি জানানো হয়েছে,এইগুলো ইটানগর থেকে আজকে বিকেলের মধ্যেই আর্মি ক্যাম্পে পৌঁছে যাবে । ’
অভিমন্যু বলল,‘গভর্নমেন্ট এই বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট কনসার্ন । আমাদের যে করেই হোক এই মিশন সাকসেসফুল করতে হবে, মিঃ বিশ্বাস । নইলে বড় বিপর্যয় ঘটে যাবে ।’
‘ উই উইল ডু আওয়ার লেভেল বেস্ট স্যার । তাতে যদি প্রাণ দিতে বা নিতে হয়, তা হবে ।কিন্তু শেষ হাসি আমরাই হাসব। ’ কমান্ডার এ. বিশ্বাসের কথায় পরিপূর্ণ আত্মবিশ্বাস প্রকাশ পেল ।
‘ওকে মিঃ বিশ্বাস থ্যাঙ্ক ইউ ’, বলে করমর্দন করল অভিমন্যু
মিঃ বিশ্বাস বললেন,‘ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম স্যার ।’
‘তাহলে কালকে আর্লি মর্নিং এ আমরা আর্মি ক্যাম্প থেকে একসাথে রওনা দেব, ট্যালে ফরেস্ট এর দিকে ।’ বলল অভিমন্যু ।
‘ওকে স্যার’, বলে হাসিমুখে সম্মতি জানালেন কমান্ডার এ. বিশ্বাস ।
ভোরের আলো তখনও ফোটেনি । পূর্ব পরিকল্পনা মতো জিরো আর্মি ক্যাম্প থেকে রওনা দিয়ে, কাঁচা রাস্তা পার করে পাঙগে পৌঁছল সকলে।
কিছুটা এগোতেই চোখে পড়ল একটা ছোটো ব্রিজ । এখান থেকেই পায়ে হেঁটে অগ্রসর হল সকলে । ব্রিজ পার হয়ে কিছুটা এগিয়ে দৃশ্যমান হল,‘ ওয়েলকাম টু ট্যালে ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি ’, লেখা একটা সাইনবোর্ড । এর অনতিদূরেই অবস্থিত ফরেস্ট রেঞ্জ অফিসের চেকপোস্ট।এখান থেকেই সাধারণ ট্যুরিষ্টদের পারমিট চেক করে জঙ্গলে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয় ।
এই স্থানে পৌঁছাতেই, চেক পোস্ট এ থাকা একজন অফিসার ছুটে এসে, অভিমন্যুদের স্যালুট করল । দুদিন যেন কাওকে এই ট্যালে স্যাংচুয়ারি তে এন্ট্রি না দেওয়া হয়,এই বিষয়টি নিশ্চিত করে সকলে মূল জঙ্গলে প্রবেশ করল ।
জঙ্গলের মধ্যে কিছুদূর এগিয়ে, পূর্ব পরিকল্পনা মত সকলে দুটো দলে বিভক্ত হয়ে গেল । কমান্ডার এ বিশ্বাস এবং তার দল পশ্চিমদিকের ঘন জঙ্গলের পথে মুহূর্তে অদৃশ্য হল । এদিকে অভিমন্যুরা সকলে এগোতে থাকল পূর্ব দিকের রুট ধরে ।
চারিদিকে ফার্নের ঘন জঙ্গল, চড়াই -উতরাই পথের শোভা বৃদ্ধি করেছে। পুব আকাশে, কেবলই রক্তিম আভা সৃষ্টি করে ঘুম ভাঙছে সূর্যদেবের । কিছুটা পথ অগ্রসর হতেই চোখে পড়ল, মহিষের মতন দেখতে একটি প্রাণী ।
ডঃ রায় বললেন,‘অর্ণব দেখতে পাচ্ছ প্রাণীটিকে – মিথুন নামের এই প্রাণীটি, অরুণাচলের উপজাতিদের পালিত প্রধান পশু । মূলত সেমি ওয়াইল্ড এনিম্যাল । জঙ্গলে চড়তেই বেশি পছন্দ করে এরা ।’
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর, শৈবাল ও পরগাছা আবৃত, এই আদিম অরণ্যানী যেন উদ্ভিদ জগতের প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য স্বরূপ বিরাজ করছে।কিছু কিছু প্রাচীন উদ্ভিদের নজরে পড়ছিল, বার্ধক্য -জীর্ণ বল্কল ।
বেশ কিছুটা চড়াই অতিক্রম করে, প্রায় আধ ঘন্টা হাঁটার পর, অভিমন্যুরা এসে পৌঁছাল জঙ্গল পরিবৃত প্রায় সমতল একটা জায়গায় । সকলে কিছুক্ষন বিশ্রাম নিল সেখানে । পুরোপুরি ওয়াইল্ড রুটে , জঙ্গলের ভেতর চোখে পড়ল, ‘ তাসি বাইড্যাং ’ নামাঙ্কিত একটা সাইন বোর্ড ।অভিমন্যু রুট ম্যাপ দেখে জায়গাটা চিহ্নিত করল ।
ক্ষনিকের বিশ্রাম শেষে আবার হাঁটা শুরু করল সকলে । রাস্তা যতই গন্তব্যের দিকে এগোচ্ছে,জঙ্গল ততই ঘন হচ্ছে । রডোড্রেনডন ও বাঁশ সমৃদ্ধ জঙ্গল ভেঙে সকলে এগিয়ে যেতে থাকল । যেতে যেতে ডঃ রায় বললেন, ‘ কিছুদিন আগে এই ট্যালে ফরেস্ট এ , একটা ফিল্ড এক্সপিডিশন এসেছিলেন, তিনজন ভারতীয় বায়োলজিস্ট, যারা হলেন – হার্শাল ভোঁসলে, গুরাং গোয়ান্ডে এবং জিসান মির্জা । এনারা এই জঙ্গলে মাটিতে পরে থাকা, একটা কাঠের গুঁড়ির মধ্যে, ট্র্যানচিসচিয়াম আপটি নামের এক সম্পূর্ণ নতুন প্রজাতির, বিষহীন সাপের সন্ধান পায় । ইন্টারন্যাশনাল সায়েন্স জার্নালে তাদের এই পেপার পাবলিশ হওয়ার পরে, গোটা পৃথিবীর বায়োলজিস্ট মহল তা জানতে পারে । চারিদিকে বেশ হইচই পরে যায় । সম্পূর্ণ ঘটনাটি সম্প্রতি, দ্য হিন্দু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল । ভাবতে পারছ, সম্পূর্ণ নতুন প্রজাতির সাপের খোঁজ, এই ট্যালে ফরেস্ট এই ! আজ আমরা সেখানেই রয়েছি ।
অভিমন্যু বলল, ‘সত্যিই ডঃ রায়, এই বিশাল ভারতবর্ষের কতকিছুই না আমাদের জানার বাইরে রয়েছে, ভাবলে অবাক হয়ে যাই ।’ সকলে ডঃ রায় এর কথা শুনে বেশ শিহরিত হল ।
এই বনাঞ্চলের প্রতিটি স্থানই বেশ গা ছমছমে এবং রহস্যে পরিপূর্ণ ।চারদিকে রঙ বেরঙের হাজারো পাখির কলতান শোনা যাচ্ছে ।
অভিমন্যু একসময় পাখি নিয়ে বেশ চৰ্চা করত । হাঁটতে হাঁটতে সে বিভিন্ন পাখি গুলোকে সহজেই চিহ্নিত করছিল। পিঙ্ক -হেডেড ডাক, হোয়াইট -উইংড ডাক, রেড ক্রিস্টেড পোচার্ড, কমন গোল্ডেনআই, আল্পাইন সুইফ্ট এই ওয়াইল্ড ট্রেক এ নজর এড়ালো না অভিমন্যুর ।
সকলে বেশ উপভোগ করল বিষয়টি ।
বেশ কিছুটা পথ অতিক্রম করে সকলে এসে পৌঁছল, জঙ্গলের গভীরে দৃশ্যমান একটি সাইনবোর্ডের সামনে । জানা গেল স্থানটির নাম, ওলাঙ বাইডেঙ। অভিমন্যু ম্যাপ দেখে নিশ্চিত হল । ইতিমধ্যেই প্রায় পনেরো কিলোমিটার পথ অতিক্রান্ত হয়েছে । দীর্ঘ চড়াই -উতরাই এর ফলে সকলে বেশ ক্লান্ত, একটু বিশ্রাম প্রয়োজন । একটা ফাঁকা জায়গা নির্বাচন করে সকলে বসল ।
ডঃ রায় বললেন,‘জানো অভি, একসময় প্রচুর ট্রেক করেছি । কিন্তু এখন মন চাইলেও, শরীর আর সঙ্গ দেয়না ।’
অভিমন্যু বলল,‘ আসলে ডঃ রায়, প্রকৃতির এই দুর্গম নির্জনতা কে উপলব্ধি করতে হলে হাঁটায় একমাত্র উপায়।’
ডঃ রায় ফিনিস মিশেল এর একটা বিখ্যাত উক্তি স্মরণ করে বললেন,‘ উই ডোন্ট স্টপ হাইকিং বিকস উই গ্রো ওল্ড – উই গ্রো ওল্ড বিকজ উই স্টপ হাইকিং ।’ জানো অভি, ওনার এই কথাটির মর্মার্থ আজ ফিল করতে পারি ।
শিখা দেশমুখ সকলকে চকোলেট ও কিছু ড্রাইফুড দিল । কৈলাস যোশি ও অর্ণব, কিছুটা দূরে দূরবীন দিয়ে কী যেন একটা দেখার চেষ্টা করছিল ।হটাৎ অর্ণব ছুটে এসে বলল,‘স্যার, দূরে একটা ওয়াইল্ড বিয়ার দেখা যাচ্ছে। সাথে দুটো বাচ্ছাও রয়েছে ।’ সকলে সাগ্রহে সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হল ।কিছুক্ষন বিশ্রাম নেবার পর, আবার যাত্রা শুরু হল গভীর জঙ্গলের পথে ।
জঙ্গলের উত্তর পশ্চিমে ঘন জঙ্গলের মধ্যে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট এর তৈরী করা একটা পরিত্যক্ত ছোট্ট বাড়িতে, ডঃ ডি.কে. রায়, ডঃ এস. শুভ্রমনিয়ম এবং ডঃ পি. কুলকার্নি সহ বেশ কিছু আফ্রিকান আশ্রয় নিয়েছে ।চারিদিকে অতন্দ্র প্রহরীরা পাহারা দিচ্ছে বন্দুক হাতে । বিদেশে বেশ কিছুদিন ধরে চলা গবেষণার, ইতি টানা হবে এই জঙ্গলেই ।এই ক্লাইমেট এ বেড়ে ওঠা,জঙ্গলের কিছু নিরীহ প্রাণীর প্রাণীর উপর, ল্যাবে মিউটেট করা অতি সংক্রামিত ইবোলা ভাইরাসের প্রয়োগ সফল হয়েছে ।
পরিত্যক্ত বাড়িটির আশেপাশে কিছু গাছ কেটে তৈরী করা হয়েছে অস্থায়ী তাঁবু । সেখানেও রয়েছে কিছু বন্ধুকধারী প্রহরী । গেগোঙ, প্রেম, বুগা, সিব্বা এই চার নিখোঁজ আপাতানি যুবক বন্দি রয়েছে একটি তাঁবুতে । প্রত্যেকেই অচেতন। ইনজেকশন দিয়ে এদের ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে । সেফটি স্যুট পরিহিত তিন ভাইরোলজিস্ট , আফ্রিকানদের সাথে গভীর আলোচনায় মত্ত । খুব সম্ভবত আজকে রাতেই, এই অতি সংক্রামক মারণ ভাইরাস প্রবেশ করানো হবে, অচেতন আপাতানি যুবকদের দেহে ।
আরও বেশ কিছুটা পথ অতিক্রম করে সকলে এসে পৌঁছাল, লেবেয়াপেঙগো নামক একটি স্থানে । সাইনবোর্ড ও রুট ম্যাপ দেখে বোঝা গেল এই স্থানটির উচ্চতা প্রায় ৭,৯৮৪ ফুট । উচ্চতার পরিবর্তনের সাথে সাথে গাছের ধরনও পাল্টে গিয়েছে।
টিম লিডার হিসেবে অভিমন্যু রয়েছে একদম সামনে । নেপাল থেকে সংগ্রহ করা একটা ধারালো কুকুরি দিয়ে সে জঙ্গলের ঝোপঝাড় কেটে পথ তৈরী করে অগ্রসর হচ্ছে । সকলে সারিবদ্ধ ভাবে তার পেছনে চলেছে ।উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে দুর্গম জঙ্গলের নির্জনতাকে ক্রমশ গ্ৰাস করছে এক ভদ্ভুত শীতলতা । অভিমন্যু, বেশ কিছুটা দূরে একটা ওয়াচ টাওয়ার দেখতে পেল ।
জঙ্গলাকীর্ণ পথে আরও অনেকটা দূরত্ব অতিক্রম করে, অবশেষে,‘ওয়েলকাম টু ট্যালে ভ্যালি ’, লেখা একটা সাইনবোর্ড দেখে সকলে উচ্ছসিত হল । সকলে এগিয়ে গেল ওয়াচ টাওয়ারের দিকে ।ডঃ রায় একটা পাথরের উপর বসলেন বিশ্রামের উদ্দেশ্যে ।
ওয়াচ টাওয়ার থেকে দু-পাশের গিরিশ্রেণী দৃশ্যমান হচ্ছে । ট্যালে ভ্যালির পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে, ট্যালে নদীর একটি ক্ষীণ প্রবাহ । মৌনী প্রকৃতির ও নিজস্ব ভাষা আছে,অভিমন্যু দূরবীন দিয়ে সেরকমই কিছু উপলব্ধি করার চেষ্টা করছিল । হঠাৎ তার নজরে পড়ল, একটি পরিত্যক্ত বাড়ি । খুব ভালো করে দেখতেই, এর আশেপাশে কিছু সন্দেহজনক লোকজনের ভ্রাম্যমাণতা তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল । সকলে ওয়াচ টাওয়ার থেকে নেমে সেদিকেই অগ্রসর হল ।
ওরা যখন জঙ্গলের উত্তর পশ্চিমে শত্রুপক্ষের আশ্রয়স্থলের বেশ কাছাকাছি এসে পৌঁছল, তখন বেলা প্রায় শেষের দিকে । অস্তমান সূর্যের রাঙা আবিরে আকাশ রক্তিম হয়ে উঠেছে । ঘন জঙ্গল যেন দুহাত প্রসারিত দৈত্যের রূপ ধারণ করে সকলকে গ্ৰাস করতে চাইছে ।
অভিমন্যু জঙ্গলের মধ্যে সমতল এবং অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার একটা জায়গা দেখিয়ে বলল,এখানেই আমাদের ক্যাম্পিং করতে হবে ।এখান থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দৃশ্যমান হচ্ছে । ফলে শত্রু পক্ষের উপর নজর রাখাও সুবিধা হবে । অভিমন্যুর কথামতো, অর্ণব এবং কৈলাস দ্রুততার সাথে ঐ স্থানে তাঁবু তৈরী করল ।বাইরে অন্ধকার নামতেই সকলে আশ্রয় নিল , সেই তাঁবুর ভেতরে।
সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ অভিমন্যু একটা স্যাটেলাইট ফোন বার করে, যোগাযোগ করল কমান্ডার এ. বিশ্বাসের সাথে । কমান্ডার বললেন,‘ স্যার আমরা পরিত্যক্ত বাড়িটি থেকে কিছুটা দূরে, জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছি । রাত ঠিক এগারোটা নাগাদ, টার্গেটের দিকে এগোতে থাকব সকলে । আমার টিম চারিদিক থেকে শত্রুপক্ষের তৈরী করা টেন্ট গুলোকে স্যানিটাইজ করতে করতে এগিয়ে যাবে। দক্ষ স্নাইপার স্পেশালিস্ট বিক্রম, জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে টার্গেটের উপর নজর রাখবে এবং আমাদের সকলকে ব্যাকআপ দেবে।এদিকের টার্গেট সম্পূর্ণরূপে এলিমিনেট করে আমরা আপনাদের ব্যাকআপ দেব ।আমার সিগন্যাল পেলে আপনার মূল বাড়িতে প্রবেশ করবেন ।
তবে তার আগে সেফটি স্যুট ও অন্যান্য সেফটি মেজার্স নিয়েই আমরা টেন্ট থেকে বেরোবো ।
অভিমন্যু ,‘ ওকে মিঃ বিশ্বাস । জয় হিন্দ ।’ বলে ফোনটা ডিসকানেক্ট করল ।
ঘন জঙ্গলের মধ্যে যেন সময় চলছে অলস মন্থর গতিতে । সকলে অপেক্ষায় রয়েছে রাত গভীর হওয়ার । ঘড়ির কাঁটা এগোনোর সাথে সাথেই ঠান্ডা ক্রমশ নিজের ভয়াল রূপ ধারণ করছে । চারিদিকে সূচীভেদ্য অন্ধকারের ভেতর থেকে অদ্ভূত সব জান্তব শব্দ ভেসে আসছে এবং তা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে চারিদিকে ।
হঠাৎ টেন্টের পাশে একটা গম্ভীর ঘড়-ঘড় গর্জনে সকলে বেশ সতর্ক হয়ে গেল ।
অভিমন্যু বলল,‘ওটা লেপার্ডের ডাক। খুব সম্ভবত ক্লাউডেড লেপার্ড । কৈলাস বন্ধুক বার করতে গেলে, অভিমন্যু মানা করল ।এদিকে বোটকা গন্ধ ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে । প্রাণীটির গরম শ্বাস প্রশ্বাস টেন্টের ঠিক বাইরে অনুভূত হচ্ছে ।
অভিমন্যু ব্যাগ থেকে একটা মশাল বার করে, সেটাকে জ্বালিয়ে দ্রুত গতিতে টেন্টের বাইরে বেরিয়ে এল ।কৈলাস ও বন্ধুক হাতে বাইরে বেরিয়ে ঠিক অভিমন্যুর পেছনে দাঁড়ালো । ক্রমশ সবুজ দুটি জ্বলন্ত চোখ পিছু হটতে থাকল জঙ্গলের গভীরে । অভিমন্যুর সাহসিকতা এবং প্রত্যুত্পন্নমতিত্বে উদ্ধার পেল সকলে।
রাত দশটা তিরিশ মিনিট । অভিমন্যু টেন্ট থেকে বেরিয়ে থার্মাল নাইট ভিশন ক্যামেরায় চোখ রাখল । দূরে শত্রুপক্ষের তাঁবুর আশেপাশে প্রহরারত কিছু বন্ধুকধারী নজরে আসছে । ঠিক তখনই স্যাটেলাইট ফোনে কমান্ডার এ. বিশ্বাসের গলা শোনা গেল ।
‘স্যার আপনারা তৈরী তো?’ উত্তরে অভিমন্যু বলল,‘ ইয়েস মিঃ বিশ্বাস,উই আর রেডি টু মুভ ফরোয়ার্ড ।’
‘ ওকে, লেটস স্টার্ট আওয়ার ফাইনাল মিশন । ’ বলে, কমান্ডার এ. বিশ্বাস কথোপকথনের ইতি টানলেন ।
গেগোং, প্রেমা, বুগা এবং সুব্বা কে টেন্ট থেকে নিয়ে আসা হয়ে পরিত্যক্ত বাড়িটিতে । ডঃ ডি. কে রায় এবং ডঃ পি. কুলকার্নি সেফটি স্যুট, মাস্ক ও গ্লাভস পরিহিত অবস্থায়, হাতে ইনজেকশন এর সিরিঞ্জ নিয়ে অ্যাম্পুল থেকে খুব সামান্য তরল তুলে নিলেন । কিছুটা দূরে দন্ডায়মান দু-জন আফ্রিকান সায়েন্টিস্ট এবং ডঃ এস. শুভ্রমনিয়ম । সকলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে, হাত-পা ও মুখ বাঁধা অবস্থায় বসে থাকা, চার আপাতানি যুবকদের দিকে ।শেষ মুহূর্তে ওদের অজ্ঞান করার প্রস্তুতি চলছে । এর পরেই সেই মারণ ভাইরাস প্রবেশ করানো হবে তাদের দেহে ।
দুদিক থেকে খুব সন্তর্পনে এগোতে থাকল দুটি টিম । কমান্ডার এ. বিশ্বাসের টিমের দুজন গুটি- গুটি পায়ে এগিয়ে গেল প্রথম টেন্টের দিকে ।সেখানে কিছু সামগ্রী ছাড়া কিছুই খুঁজে পাওয়া গেল না । এরপর আরও দুজন এগিয়ে গিয়ে ক্যাম্প এ প্রহরারত দুই আততায়ী কে বিশেষ কৌশলে মাটিতে ধরাশায়ী করল ।তারা ক্রমশ এগিয়ে গেল দ্বিতীয় ও তৃতীয় টেন্টের দিকে ।দূর থেকে আরও তিনজন আততায়ী বন্ধুক হাতে ছুটে এলে, স্নাইপার স্পেশালিস্ট, বিক্রমের ছোড়া গুলিতে তারা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে ।এইভাবে সমস্ত টেন্ট গুলো একে একে খালি করার পরে তারা অগ্রসর হল পরিত্যক্ত বাড়িটির পেছনের দিকে ।
বাড়ির দেওয়ালে ‘ দিব্যচক্ষু রেডার ’ নামে সেনাবাহিনীর হোস্টেজ অপারেশন এ ব্যবহৃত, একটি লাইট ওয়েট পোর্টেবেল ডিভাইস স্থাপন করা হল ।ঘরে কতজন লোক রয়েছে তাদেরকে সক্ষমভাবে টু- ডি ইমেজের মাধ্যমে, প্রায় পাঁচ সেমি রেজল্যুশন দ্বারা ট্র্যাক করতে সক্ষম এই ডিভাইস ।মূলত, ডোবলার ইনফরমেশন এর মাধ্যমে ঘরের ভেতরে থাকা ব্যাক্তিদের হার্ট বিট ও ব্রিদিং প্যাটার্ন ট্র্যাক করার মাধ্যমে এটি করা হয় ।
ডিভাইস এর ডিসপ্লে দেখে নিশ্চিত হয়ে, কমান্ডার এ. বিশ্বাস ইশারা করলেন অভিমন্যুকে ।
সেই মুহূর্তে অভিমন্যুর দক্ষ টিম প্রবেশ করল বাড়িটিতে । ভেতরের বারান্দার ডানদিক দিয়ে শিখা এবং কৈলাস খুব সন্তর্পনে এগোতে থাকল । অন্যদিকে অভিমন্যু, অর্ণব এবং ডঃ রায়, বামদিকের সংকীর্ণ বারান্দা দিয়ে একটা বন্ধ ঘরের কাছাকাছি পৌঁছে গেল ।
আচমকা ঘরের দুটি দরজায় একসাথে সজোড়ে লাথি পড়ল । দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করতেই ঘরের ভেতর থেকে মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণের শব্দ চারিদিকে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল । অভিমন্যু ফায়ার করতে করতে এগিয়ে যেতে থাকল।সামনে থেকে আসা এক আততায়ী, অভিমন্যুর গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল ।শিখা এবং কৈলাস, অভিমন্যুর পেছনে ঠিক বিপরীতমুখী অবস্থানে থেকে গুলিতে নিহত করল আরও দুই আততায়ী কে । সকলে অগ্রসর হল মূল কক্ষের দিকে । ঠিক সেই সময় ডঃ রায় এর কপালে বন্ধুক ধরল এক আততায়ী ।
আততায়ীটি বলল, ‘ পুট দ্য গান ডাউন ।’ সকলে ধীরে, ধীরে বন্ধুক নিচে নামায়।
এরপর পুনরায় আততায়ীটি ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠল ,‘ আই সে ড্রপ দ্য গান ।’
কথাটি শেষ হতে না হতেই,স্নাইপার স্পেশালিস্ট বিক্রমের অব্যর্থ নিশানাই ছোড়া একটা গুলি, কাঁচের জানলা ভেদ করে এসে লাগল, আততায়ীটির কপালে । রক্তাক্ত অবস্থায় মুহূর্তে লুটিয়ে পড়ল সে । ঘটনার আঁচ টের পেয়ে, অচৈতন্য অবস্থায় পরে থাকা চার আপাতানি যুবকের দিকে, ইনজেকশন হাতে, প্রচন্ড ক্ষিপ্রতায় ধাবমান হয়েছে চার পিপিই কিট পরিহিত ব্যাক্তি ।একজন দাঁড়িয়ে পুরো বিষয়টা নজরদারি করছে। ঠিক সেই মুহূর্তে মূল কক্ষে প্রবেশ করল অভিমন্যুর টিম ।
অভিমন্যু তাদের দিকে বন্ধুক তাক করে শান্ত অথচ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,‘আপনাদের খেলা শেষ ডঃ ডি. কে. রায় । আর এক পা এগোলেই জঙ্গল থেকে আপনাদের মৃতদেহ ফিরবে ।’
সাথে সাথেই শিখা, কৈলাস এবং অর্ণব ছুটে গিয়ে, খুব সন্তর্পনে চারটি তরলভর্তি সিরিঞ্জ বাজেয়াপ্ত করে, চার আপাতানি যুবককে বন্ধন মুক্ত করল ।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন দীর্ঘদেহী আফ্রিকান গম্ভীর কণ্ঠে অভিমন্যুকে প্রশ্ন করল,‘ হু আর ইউ?’
উত্তরে অভিমন্যু বলল,‘ ইওর এনিমি স্যার!’
এরপর লোকটি অভিমন্যুকে উদ্দেশ্যে করে বলল,‘ প্লিজ সেভ মি । আই উইল গিভ ইউ এ লট অফ মানি ।’
কথাটি শুনে অভিমন্যুর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল । এবার সে বন্ধুক তাক করল, আফ্রিকানটির দিকে ।ঠিক সেই মুহূর্তে কমান্ডার এ. বিশ্বাস এসে অভিমন্যুকে নিরস্ত্র করলেন ।
সকলকে নিয়ে যাওয়া হল, পাশের একটা নিরাপদ কক্ষে । মুখের মাস্কগুলো খুলতেই তিনজন ভাইরোলজিস্ট এর খুনি চেহারা দৃশ্যমান হল ।
অভিমন্যু গম্ভীর কণ্ঠে বলল,‘ডঃ এ. কে. রায়, আপনিই তো এদের দলের লিডার । তাই কোনো কিছু না লুকিয়ে পুরোটা আমাদের খুলে বলুন ।’
সম্পূর্ণ নীরবতা পালন করলেন ডঃ এ. কে. রায় ।
এরপর অভিমন্যু তার কপালে বন্ধুক তাক করে বলল, আপনি না বললে আরও একটা মৃতদেহের সংখ্যা বৃদ্ধি হবে । নিশ্চই আপনি তা চান না ।’
তবুও নীরব থাকলেন ডঃ এ. কে. রায় ।
এরপর অভিমন্যুর নির্দেশে কৈলাস যোশি এগিয়ে গিয়ে ওনাকে আঘাত করতে উদ্যত হলে, হাত জোড় করে বলে উঠলেন,‘ প্লিজ ডোন্ট ডু দিস । তারপর একটু থেমে বললেন, বলছি, সব বলছি।’
এরপর তিনি মৃদু কণ্ঠে কিছু বলতে শুরু করলে, অভিমন্যু গর্জে উঠে বলল,‘ স্পিক্ আউট, উই ক্যান নট হিয়ার ইউ ।’
ডঃ এ. কে. রায়, পুনরায় বলতে শুরু করলেন ।
‘ সালটা ছিল ২০১৪ । যখন আফ্রিকায় ইবোলা ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে বিশাল মহামারী সৃষ্টি হয় । বহু মানুষের মৃত্যু ঘটে সমগ্র আফ্রিকা জুড়ে । আমি, কুলকার্নি এবং শুভ্রমনিয়ম, একটি টিমে থেকে বহুদিন ফিল্ড এ কাজ করি । আমাদের উদ্দেশ্যে ছিল, এই মারণ রোগের একটা ভ্যাকসিন প্রস্তুত করা । কাজে অনেকদূর অগ্রসর হয়েছিলাম আমরা । অবশেষে একদিন এল, হিউম্যান ট্রায়াল এর দিন । স্থানীয় কিছু আফ্রিকান আদিবাসী কে বন্দি করে, তাদের উপর সরাসরি আমরা সেই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করলাম ।কারণ এনিম্যাল ট্রায়াল এর জন্য সময় আমাদের হাতে ছিলনা ।
নির্মাণ পদ্ধতির কিছু ত্রুটির স্বীকার হতে হল, ঐ নিরীহ মানুষ গুলিকে । চোখের সামনে তাদের নির্মম মৃত্যু বরণের সাক্ষী হলাম আমরা । যদিও সম্পূর্ণ পরীক্ষাটি চালানো হয়েছিল, ওখানকার একটা ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক সংস্থার নির্দেশে, অত্যন্ত গোপনে ।
কিন্তু এই খবরটি জানতে পারে ওদেরই একটা রাইভাল ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক কোম্পানি । এই ক্ষমতাবান এই কোম্পানি আমাদের অনবরত ব্ল্যাকমেল করতে থাকে । এই খবর বাইরে রাষ্ট্র হলে, আমাদের মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত হতে পারে, এই ভয়ে আমরা ওদের শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হয় ।
মুনাফালোভী এই কোম্পানির মূল উদ্দেশ্যে ছিল, ভারতের বিশাল জনসংখ্যা কে টার্গেট করে এম আর এন এ ভ্যাকসিন বাজারে আনা । এর জন্যই পরিকল্পনা মাফিক আফ্রিকার একটা বায়ো-সেফটি লেভেল ফোর ল্যাব এ, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতির মাধ্যমে ইবোলা ভাইরাসের ডিএন এ স্ট্রাকচার এ রদবদল ঘটিয়ে, এটিকে দ্বিগুন সংক্রামক করে তোলা হয় । যাতে দ্রুত হারে কমিউনিটির মধ্যে স্প্রেড করতে সক্ষম হয় ।
আমারা নির্দেশ মত, সেই উদ্দেশ্যেই আসি এই নির্জন ট্যালে ভ্যালি তে । মেইনলি এই জঙ্গলের কিছু স্পিসিস এর উপর এই ডাবল মিউট্যান্ট ইবোলার প্রয়োগ সফল হয়েছে । পরীক্ষার সাফল্যের পরে স্পিসিস গুলোকে মেরে ফেলে, মাটির বেশ কিছুটা গভীরে পুঁতে দেওয়া হয় । নইলে তা আমাদের সংক্রামিত করত । পরের প্ল্যান অনুযায়ী আজকে রাতেই আমরা এই চার অচৈতন্য, আপাতানি যুবকের দেহে ইনজেক্ট করতাম সেই ভয়ংকর মারণ ভাইরাস । তারপর ওদের ছেড়ে দেওয়া হত । দু দিনের মধ্যেই এদের অজান্তেই সংক্রমণ ছড়িয়ে সম্পূর্ণ আপাতানি গোষ্ঠীর মধ্যে ।
সমস্ত কর্মকান্ড চলেছে ‘ জিরো মিউজিক ফেস্টিভ্যাল ’, এর কথা মাথায় রেখে। আর দুদিন পরেই জিরো উপত্যকায় সূচনা হবে চারদিনব্যাপী চলা এই সংগীত উৎসবের । যেখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বহু সংগীত প্রেমী মানুষের সমাগম হবে । আর তারাও অজান্তে বাহক হয়ে যেত এই মারণ ভাইরাসের । তারা ফিরে গেলে এই ভাইরাস ক্রমশ ছড়িয়ে যেত সমগ্র দেশে । আর তখনই আমাদের তৈরী করা এই ভ্যাকসিন চড়া দামে বিক্রি করে মুনাফা লুটত এই ভ্যাকসিন কোম্পানি ।
আর আমরা কালকেই জঙ্গল ছেড়ে পাড়ি দিতাম বিদেশে ।’
সমস্ত কথা অকপটে স্বীকার করে মাথা নীচু করে বসে রইলেন ডঃ এ. কে. রায় ।
এই কথোপকথন পুরোটাই রেকর্ড করল অর্ণব ।
অভিমন্যু ঐ দুজন আফ্রিকান এর পরিচয় জিজ্ঞাসা করতেই, ধীরে ধীরে মাথা তুললেন ডঃ এ. কে. রায় ।
উত্তরে তিনি বললেন,‘ ওনারা আফ্রিকার ঐ ভ্যাকসিন কোম্পানির অন্যতম কর্ণধার, ডঃ ডেজেন এবং ডঃ এবরিমা ।’
অভিমন্যুর চোখে মুখে তীব্র ঘৃণার ভাব প্রকাশ পেল । সে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল,‘আপনারা নিজেদের বাঁচানোর জন্য, এই জঘন্য খেলায় মেতেছিলেন ডঃ রায় ।’ আপনাদের জন্য দেশের এতো মানুষের প্রাণ যেতে পারত । আপনাদের পরিবারের কথা একটিবারও মনে হলো না । তারাও তো এতে আক্রান্ত হতে পারত । সত্যিই আপনাদের মানুষ বলতেও ঘৃণাবোধ হচ্ছে।
আমরা যেখানে দেশের জন্য নিজেদের প্রানকেও তুচ্ছ মনে করি, সেখানে আপনারা দেশকে এতো বড় বিপদের মুখে ঠেলে দিতে যাচ্ছিলেন । মৃত্যুদণ্ড ও আপনাদের জন্য কম মিঃ এ. কে. রায় ।’
ডঃ রায় হাত জোড় করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন ।
সারারাতের রোমহর্ষক অভিযানের পর, রাতের অন্ধকার বিদীর্ণ করে ভোরের আলো ফুটতেই, সকল অপরাধীদের নিয়ে যাওয়া হলো ট্যালে ভ্যালির ফাঁকা অংশের দিকে । চার আপাতানি যুবকের জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষন আগেই । সকলে এখন কিছুটা সুস্থবোধ করছে।
কমান্ডার এ. বিশ্বাস আর্মি বেস ক্যাম্পে যোগাযোগ করার কিছুক্ষনের মধ্যেই, আর্মির দুটি হেলিকপ্টার এসে পৌঁছল ট্যালে ভ্যালিতে । সকল ক্রিমিনাল কে একে একে তোলা হল হেলিকপ্টারে । মৃতদেহগুলিকে আলাদা ভাবে অপর একটি হেলিকপ্টারে তোলা হল । সকলে উঠে বসলে, দুটি কপ্টার ই উড়ে গেল জিরো আর্মি ক্যাম্পের উদ্দেশে ।
জিরো আর্মি ক্যাম্প এ পৌঁছে মিঃ চৌধুরী কে ফোনে, রাতের রুদ্ধশ্বাস অভিযানের ঘটনা ব্রিফ করল অভিমন্যু । মিঃ চৌধুরী সকলের উচ্ছসিত প্রশংসা করে বললেন,‘ ওয়েলডান মাই বয়! আই ওয়ার্মলি কনগ্রাচুলেট্ ইওর টিম অন দিস মারভেলাস অ্যাচিভমেন্ট । আমার বিশ্বাস ছিল তোমরা এই যুদ্ধে জয়লাভ করবেই ।
অভি,প্রচুর ধকল গিয়েছে । তোমরা হোমস্টে গিয়ে বিশ্রাম কর । এদিকটা আমি সামলে নিচ্ছি ।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ স্যার । জয় হিন্দ ।’ বলে কথোপকথনের ইতি টানল অভিমন্যু। জিরো ভ্যালি তে ফিরতেই,আপাতানি উপজাতির মানুষেরা দলে দলে এসে ওদের অভিনন্দন জানাল । অকৃত্রিম ভালোবাসা ও নিষ্পাপ আবেগের সুনামিতে ভেসে গেল সকলে ।
আপাতানি দের অনুরোধে, আরও দুদিন জিরো ভ্যালি তে থেকে যেতে হয়েছে অভিমন্যুদের ।আজ সাতাশে সেপ্টেম্বর, আপাতানি উপজাতি আয়োজিত, জিরো মিউজিক ফেস্টিভ্যাল ’এর সূচনার দিন । অভিমন্যু সহ সকলে উপস্থিত হয়েছে জিরো ফেস্টিভ্যাল গ্রাউন্ড এ । চারিদিকে সবুজ উপত্যকার মাঝে অবস্থিত এই স্থান।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু সংগীত শিল্পী এবং সংগীত প্রেমী মানুষ ভিড় করেছে এই জিরো ফেস্টিভ্যাল গ্রাউন্ড এ । বাঁশ নির্মিত অপরূপ কারুকার্য শোভিত, দুটি আলাদা মঞ্চ, নির্মাণ করা হয়েছে । দিন ও রাতের আলাদা অনুষ্ঠানের জন্য । গ্রাউন্ডে অসংখ্য মানুষ টেন্ট করে রয়েছেন ।
বিকেল শেষে, যখন অস্তমুখী সূর্য যখন পাহাড়ের অন্তরালে আত্মগোপনের লক্ষ্যে এগোচ্ছে, ঠিক সেই সময়, যাত্রীপূর্ণ বেলুন উড়িয়ে সূচনা হলো এই সংগীত উৎসবের । এরপরেই মাঠ জুড়ে শ্বেত শুভ্র পোশাকে অরুণাচলী মেয়েদের সারিবদ্ধ নৃত্য প্রদর্শন মুগ্ধ করল সকলকে । সাথে বেজে চলল, অদ্ভুত সুরের রকমারি বাধ্যযন্ত্র ।
অভিমন্যু, ডঃ রায়, অর্ণব, শিখা, কল্যাণ সকলে পাশাপাশি বসে কিছুক্ষন ধরে এই দৃশ্য উপভোগ করল । কিছুক্ষন পরে, আপাতানি যুবকেরা এসে ওদের কিছু ট্র্যাডিশনাল খাবার ও পানীয় পরিবেশন করল । গেগং, প্রেম, বুগা, সুব্বা সকলে আলাদা, আলাদা করে ওদের খোঁজ নিয়ে গেল । প্রাণপ্রাচুর্য, উদ্দীপনার মাঝে সর্বত্রই বেশ অভিনবত্বের ছোঁয়া নজরে আসছিল। প্রথম দিনের অনুষ্ঠান শেষে সকলে রওনা দিল হোমস্টের উদ্দেশে ।
পরদিন খুব সকালে, জিরো আর্মি ক্যাম্প হয়ে সকলে এগিয়ে গেল জোরহাট এয়ারপোর্টের দিকে । এয়ারপোর্টে সালোম এবং সাংঘু, আন্তরিক সরলতায়, সকলকে শেষ অভিবাদন জানাল ।
রোমাঞ্চপূর্ন এই অভিযানের শেষে রয়ে গেল একরাশ মুগ্ধতা । অপরূপ ‘শূন্য উপত্যকা’, আপাতানি উপজাতির অকৃত্রিম ভালোবাসা , ট্যালে ভ্যালির সৌন্দর্য, সালোম এবং সাংঘুর সাহচর্য – এ সবই ক্ষনিকের দেখা, তবুও মনের চিত্রপটে চির -ভাস্বর রেখা এঁকে দিয়েছে । যা বহুদিন রয়ে যাবে হৃদয়ের অন্ত:কোণে ।
এর কয়েক মাস, পরের ঘটনা । অভিমন্যু কোলকাতা ফিরে, মহানগরের জটিল জীবনের ঘূর্ণাবর্তে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে । ইতিমধ্যেই তার কর্মকান্ড বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। সরকার থেকে অভিমন্যুদের পুরো টিমকে শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে ।
আজ অভিমন্যু, সুপ্রতীক কে সঙ্গে নিয়ে এসেছে ডঃ সুবর্ণ রায় এর বাড়ি। অরুণাচল এর অভিযান প্রসঙ্গে দুজনেই স্মৃতিচারণ এ ব্যস্ত। ঠিক সেইসময় অভিমন্যুর ফোনটা রিং করে উঠল ।
ফোনটা রিসিভ করে, অভিমন্যু বলল,‘ জয়হিন্দ স্যার ।’
ফোনের ওপার থেকে ‘তিব্বত’ এবং ‘লাদাখ’ শব্দদুটি অস্পট ভাবে শোনা গেল ।
অভিমন্যু কিছুটা ভ্রু কুঞ্চিত অবস্থায় উত্তর দিল,‘ওকে স্যার ।সি ইউ সুন ।জয়হিন্দ । ’
সুপ্রতীক এবং ডঃ রায়, সাগ্রহে চেয়ে রইলেন অদম্য,অভিমন্যুর প্রতি ।